চতুর্থ পরিচ্ছেদ— শ্রীযুক্ত শৈলচরণ শান্যাল
“বটতলা বলতে তুমি ঠিক কী বোঝো?” গম্ভীর গলায় চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক।
আমি থতোমতো খেয়ে “আমাকে বলছেন?” বলতেই প্রায় ধমকের সুরে উত্তর এল, “তা তুমি ছাড়া এই ঘরে দ্বিতীয় কোনও গোয়েন্দা আছে কি? গোয়েন্দাগিরি করবে আর এটুকু জেনারেল নলেজ থাকবে না, তা কী করে হয়?”
গলা-টলা খাঁকরে, “বটতলা… মানে বটগাছের তলা”, বলতে না বলতেই হাঁটুতে প্রবল চিমটি। উর্ণার দিকে তাকিয়ে দেখি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে। আমি সোজা সারেন্ডার করলাম, “জানি না স্যার।”
“তুমি স্যার বলছ কেন? তুমি কি আমার ছাত্র নাকি?”
“তাহলে কী বলব?”
“অধীশদা বলবে”।
.
গত পরশু চক্রবর্তী চ্যাটার্জিতে বই খুলে ভিতরে বাংলা বই দেখে উর্ণা প্রথমে বেশ খানিক মজা করছিল। আমি কিচ্ছু না বলে পাতা উলটে দেখছিলাম। পো-র কবিতার বইয়ের ভিতর আসল বইটাই নেই। পড়ে আছে শুধু মলাটটা। ভিতরে অদ্ভুত রকমের একটা বাংলা ভাষায় সম্পূর্ণ অন্য একটা বই। সে ভাষার কিছুটা বোঝা যায়, আবার কিছুটা দুর্বোধ্য। যেন ধরা দিয়েও দিচ্ছে না।
উর্ণাকে বললাম, “শোনো না, তুমি তো সাহিত্যের মেয়ে। এই ভাষা চেনো?”
“সাহিত্যের তাতে কী হয়েছে? সে তো ইংরাজি সাহিত্যের। বাংলা তো আমার পাস সাবজেক্ট।”
“তাতে কী? চেনো কি না বলো।”
“চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু শিওর না। কেন বলো তো?” ততক্ষণে আমি যা দেখার দেখে নিয়েছি।। যতটুকু এই বইটা আদতে একটা নাটকের বই। তাও আজকের না, বাংলা ১৩০৩ সনে লেখা। এই হিসেবটা আমি জানি। এরসঙ্গে ৫৯৩ যোগ করলেই ইংরাজি সাল পাওয়া যায়…… ১৮৯৬ সাল। আমার প্রপিতামহ তারিণীচরণের ডায়রি ওই একটি বছরেই মিসিং। নাট্যকারের নাম শ্রীযুক্ত শৈলচরণ শান্যাল। সান্যালের এমন বানান আগে দেখিনি। এই নামও আগে কানে আসেনি। কিন্তু চমকটা অন্য জায়গায়। মলাটের নিচে খুদে খুদে অক্ষরে লেখা, “যাঁহার এই পুস্তক প্রয়োজন হইবেক তিনি ৩৫ নং ক্লাইভ স্ট্রিটের শ্রী তারিণীচরণ রায়ের আপিসে অনুসন্ধান করিলে প্রাপ্ত হইবেন।” ফলে এই লেখক যিনিই হোন না কেন ইনি তারিণীর পরিচিত। শুধু পরিচিতই না, ঘনিষ্ঠ। ঘনিষ্ঠ না হলে কেউ নিজের লেখা বইয়ের দায়িত্ব অন্য কাউকে দেয় না। তারিণীর যে কটা ডায়রি পড়েছি, তাতে কোনও লেখায় আমি এঁর কথা পাইনি। পেলেও খেয়াল করিনি। হয়তো সেই হারিয়ে যাওয়া ডায়রিতে ছিল। ডায়রি যখন নেই, তখন হাতে ব্লু বলতে শুধু এটাই। “তোমার চেনা কেউ আছেন, যিনি এসব ব্যাপারে ভালো জানেন?”
“আছেন একজন, বাংলা ডিপার্টমেন্টের। অধীশ স্যার। অধীশ বিশ্বাস। কিন্তু আমার সঙ্গে ততটা ঘনিষ্ঠতা নেই। বাংলায় আমার এক বান্ধবী আছে, শ্রুতি। ওকে বললে ব্যবস্থা করে দেবে।”
সেই ব্যবস্থা অনুযায়ী দেড়দিনের মধ্যে আমরা দুজন অধীশ বিশ্বাসের বাড়িতে। উত্তর কলকাতার বনেদি অঞ্চলে দোতলা বাড়ি। বেল বাজাতেই তাঁর স্ত্রী হাসিমুখে দরজা খুলে আমাদের লাইব্রেরি রুমে নিয়ে বসালেন। রুম দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ। মেঝে থেকে ছাদ অবধি বিরাট বিরাট লোহার ব্যাক। প্রতিটায় ঠাসা সব বই। তাতেও সাধ মেটেনি। মেঝেতে ডাঁই করে পাহাড়ের মতো কিছু বই রাখা। সেন্টার টেবিলে বই বাদে এক ইঞ্চি জায়গা ফাঁকা নেই। কারও ব্যক্তিগত কালেকশানে এত বই থাকতে পারে সে ধারণা আমার ছিল না। টেবিলের আশেপাশে তিন-চারটে গদিআটা চেয়ার। তার ওপর থেকেও বই সরিয়ে বসলাম। অধীশ বিশ্বাস প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ঢুকলেন। রাশভারী গোলগাল চেহারা, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, ঠোঁটের কোনায় হালকা একটা হাসি ঝোলানো। যখন কথা বললেন, বুঝলাম সাধে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ইনি এত ফেমাস নন। ভদ্রলোকের যা ভয়েস মডিউলেশান, নিশ্চিন্তে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে সংবাদপাঠকের চাকরি পেতে পারেন।
অধীশবাবু খুব মন দিয়ে আমার কথা শুনলেন। সত্যি মিথ্যে মিশিয়ে বললাম, ঠাকুরদার বাবার পুরোনো জিনিসপত্র ঘাঁটতে গিয়ে এটা পেয়েছি। আমি পেশায় গোয়েন্দা, রহস্য ভালোবাসি। ওঁর নাম আছে তাই জানতে আগ্রহ হচ্ছে কে এই লেখক? আর সেজন্যেই আসা। আমার হাত থেকে বইটা নিয়ে অনেকক্ষণ মন দিয়ে দেখলেন ভদ্রলোক। পো-র বইয়ের মলাটটা খুলে বাড়িতে রেখে এসেছি। ওটা দেখলেই হাজার কথা উঠবে। শুরুতেই দুই-একবার আপনমনে “স্ট্রেঞ্জ, স্ট্রেঞ্জ” বললেন। প্রায় আধঘণ্টা ধরে খুব মন দিয়ে বইটা পড়ে গম্ভীর গলায় চশমার উপর তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “বটতলা বলতে তুমি ঠিক কী বোঝো?”
আমি কিছুই বুঝি না জেনে ভদ্রলোকের মাস্টারি ভাবটা ফুটে বেরোল। আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগের কথা। “তবে শোনো, শোভাবাজার কালাখানা অঞ্চলে বিরাট একটা বটগাছ ছিল। সেই বটগাছের শানবাঁধানো তলায় শহরের মানুষরা বিশ্রাম নিতেন, আড্ডা দিতেন, গান বাজনাও করতেন অনেকে। সঙ্গে বসত সস্তার বইয়ের পসরা। এইসব বই ছিল বিশ্বনাথ দেব নামে একজনের ছাপা। ১৮১৮ সালে বটতলা অঞ্চলে বা উত্তর কলকাতায় তিনিই প্রথম ছাপাখানা খোলেন। বহুকাল অবধি এই বান্ধা বটতলাই ছিল অন্য প্রকাশকদের ঠিকানা। তবে এই বইগুলোর কিছু বিশেষত্ব ছিল। একেবারে সাধারণ কাগজে সস্তায় ছাপা হওয়াতে এইসব বইগুলোর প্রোডাকশান কস্ট কম। ফলে দাম কম, আর প্রচুর বিক্রি। কম দামে মানুষ কিনতে শুরু করল তাদের পছন্দমতো বই। কী নেই তাতে? ধর্ম থেকে যৌন কেলেঙ্কারি, জ্যোতিষ থেকে নেশা-বেশ্যা-আমোদ বিষয়ে নানা বই, যা মূল ধারার প্রকাশকরা প্রকাশ করতেন না। এলিট পাঠকরাও নাক কোঁচকাতেন। গরানহাটা, বড়বাজার, এন্টালি, ডালহৌসি, শ্যামবাজার হয়ে এমন বিরাট বইয়ের বাজার আগে কেউ দেখেনি। বিশ শতকের শুরু অবধি রমরমিয়ে চলেছে বটতলার ব্যবসা।”
“এই বইটা সেই বটতলার বই। তাই তো?”
“এই বইটা অতি অদ্ভুত এক বটতলার বই। একটা কারণে না। অনেকগুলো কারণ আছে।”
“যেমন?”
“শুরু থেকে শুরু করি। বটতলার বইতে ব্রাত্য হিসেবে কিছু ছিল না। তবে মূলত বটতলার বই ছিল দুরকম। ধর্মবিষয়ক, যাতে রামায়ণ, মহাভারত থেকে অন্নদামঙ্গল, বিদ্যাসুন্দর ছাপা হত, অথবা নানা নকশা বা প্রহসন। এই নকশা বা প্রহসনে চেষ্টা করা হত সমকালকে ধরার। তাতে নানা বিতর্কও থাকত। যৌন কেলেঙ্কারি, মদ্যপান, বেশ্যাশক্তি, বাল্যবিবাহ এইরকম আর কি। এই নকশা বা প্রহসনগুলো হত মূলত নাটকের ফর্ম্যাটে। এই নাটকেও শুরুতেই দাবি করা হয়েছে এটি একটি প্রহসন। কিন্তু কন্টেন্টে সমকাল তো নেই-ই, বরং এ এক রূপকথা বা ফ্যান্টাসির গল্প। তাও যে-সে ফ্যান্টাসি না, আজকের ভাষায় যাকে বলে ডার্ক ফ্যান্টাসি।”
“মানে?”
“তুমি পড়েছ এটা?”
“হ্যাঁ, একবার চোখ বুলিয়েছি। ভালো বুঝিনি।”
“না বোঝার কিছু নেই। মন দিয়ে পড়ে দ্যাখো। কী নেই এখানে? সরাসরি যৌন সংগম আছে, ভূত আছে, খুন আছে, বিশ্বাসঘাতকতা আছে, আর সবটাই আছে রূপকথার ছদ্মবেশে। গোলা লোকেদের জন্য লেখা প্রহসনে এত লেয়ার থাকতই না। এ নাটকের উদ্দেশ্য অন্য। আরও অদ্ভুত ব্যাপার, নাটকে সরাসরি থেকে কোট করা হচ্ছে।”
“কীরকম?”
“এই জায়গাটা দ্যাখো।”
দেখলাম লেখা আছে, “কাপালিক–তোমাদের পণ কি? / বুদ্ধিধর— আমাদের পণ জীবনসর্বস্ব।”
“কী? চেনা চেনা লাগছে?”
মাথা নাড়লাম। চিনি না।
“বাংলা কি কিস্যুই পড়ো না নাকি?” বলে ভদ্রলোক উঠে আলমারি থেকে একটা লাল মলাটের বই নিয়ে এলেন। পাতা উলটে বললেন, “দ্যাখো দেখি।”
দেখি তাতে লেখা, “এইরূপ তিনবার সেই অন্ধকার সমুদ্র আলোড়িত হইল। তখন উত্তর হইল, “তোমার পণ কী?” প্রত্যুত্তরে বলিল, “পণ আমার জীবনসর্বস্ব।” “এবার বইয়ের নাম দ্যাখো”, দেখলাম লাল কাপড়ে সোনার জলে লেখা “আনন্দমঠ।” শ্রী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রণীত। তলায় বইয়ের মালিকের সই, শ্রীযুক্ত প্রসন্নকুমার দত্ত।
“কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথ থেকে কুড়ি টাকায় এই অমূল্য রতন পেয়েছিলেন, বুঝলে! আনন্দমঠ লেখা হয় ১৮৮২ তে। ১৮৯৬-এ এই নাটক যখন লেখা হচ্ছে, তখন বঙ্কিম মারা গেছেন দুই বছর হল। কিন্তু আজ অবধি এমন ক্লাসিক বইয়ের উদ্ধৃতি কোনও বটতলার বইতে আমি দেখিনি।”
“এই নাট্যকার সম্পর্কে কিছু জানা যায় কি? সান্যাল নামের বানান এমন কেন?”
“বানান নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না। তখন থোড়াই বাংলা আকাদেমি ছিল। যে যেমন পারত বানান লিখত। বোঝা দিয়ে কথা। যাই হোক, এই শৈলচরণের আদি নিবাস চুঁচুড়ায়। কলকাতায় এসেছিলেন অভিনেতা হতে। কিন্তু চেহারা, গলার স্বর নায়কের উপযুক্ত ছিল না। ফলে যা হয়, একদম শুরুতে কিছুদিন ন্যাশনাল থিয়েটারে নায়িকার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। বেশ কিছু হিট নাটকও ছিল ঝুলিতে। একদিন আচমকা অভিনয় ছেড়ে দিয়ে নাটক লেখার দিকে ঝুঁকলেন। কিন্তু তেমন সফল হলেন না। এদিকে ন্যাশনাল থিয়েটার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনও এক ব্যাপারে ঝামেলার জন্য তাঁকে থিয়েটার থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল। অভাবের ঠেলায় পঞ্জিকা, হ্যান্ডবিলের বিজ্ঞাপনও নাকি লিখেছেন এককালে। তারপর আচমকা তাঁর ভাগ্য ফেরে। বিজ্ঞাপনে দেখা গেল স্টার থিয়েটারে নাকি শৈলচরণের নতুন সামাজিক নকশা আসতে চলেছে। একাকার। আর তারপরেই সব শেষ।”
“শেষ মানে?”
“শৈলচরণ মোটেই এত বড়ো অভিনেতা বা নাট্যকার ছিলেন না, যে, তাঁর সম্পর্কে এটুকুও জানা যাবে। জানার অন্য কারণ আছে। শৈলচরণের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। তখনকার এই নিয়ে বেজায় হাঙ্গামা বেধেছিল”।
“খুন?”
“শুধু খুন না, রিচুয়ালাস্টিক খুন। সারা দেহ ছুরি দিয়ে ফালা ফালা করে চিরে দেওয়া। অণ্ডকোশ কেটে মুখে পুরে দেওয়া হয়েছে। সে এক বীভৎস ব্যাপার। স্টারের অমৃতলাল বসু জানিয়েছিলেন শৈলচরণ নাকি মারা যাবার আগে একটা পূর্ণাঙ্গ প্রহসন লিখে জমাও দিয়েছিল। যদিও পরে সেই নাটকের আর হদিশ পাওয়া যায়নি। দারোগার দপ্তরের প্রিয়নাথ মুখুজ্জে নিজে এই কেসে ছিলেন। রহস্যের সমাধান হয়নি। আমি মাঝে মাঝে ভাবি, সব কেস নিয়ে লিখলেও এই কেসটা নিয়ে প্রিয়নাথ একটাও শব্দ লিখলেন না কেন?”
এটুকু শুনেই মনে পড়ে গেল চন্দননগরের দেবাশিসদার লাশটার ছবি। রিচুয়ালিস্টিক খুন। ঠিক এটাই লেখা হয়েছিল পরের দিনের পত্রিকায়। আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘোরাচ্ছিল। তবু তার মধ্যেই শুনতে পেলাম অধীশদা বলছেন, “আমি সবচেয়ে চমকে গেছি বিজ্ঞাপনের এই লাইনটা পড়ে, ‘এক্ষণে গ্রন্থকর্তার জীবননাশ বা জীবনোদ্ধার দুই কার্য্যের বিবিধ ভার আপনার উপরেই সমর্পিত হইল’। তাহলে কি শৈলচরণ বুঝতে পেরেছিলেন তিনি এই নাটকের জন্য খুন হয়ে যেতে পারেন? তার চেয়েও বড়ো প্রশ্ন। এটাই কি সেই হারিয়ে যাওয়া নাটক?”