চতুর্থ পরিচ্ছেদ— বলিদান
১০ এপ্রিল, ১৮৯১, লন্ডন, রাত ৮-৩৫
“তাহলে এখন বলুন প্রফেসর, এই প্রস্তাবে আপনি রাজি কি না।” এপ্রিলের লন্ডনে এবার অদ্ভুত এক শুকনো হাওয়া বইছে। রেস্তোরাঁর ভিতরের এই গোপন ঘরে কোনও জানলা নেই, তবু ফিনফিনে রোগা, তালঢ্যাঙা প্রফেসরের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। ভদ্রলোকের বয়স সবে পঞ্চাশের কোঠায়। কিন্তু বিলীয়মান কাঁচাপাকা চুল, চওড়া কপাল দেখে তাঁকে আরও অনেক বেশি বয়স্ক লাগে। এক অর্থে সুবিধাই। চেহারা দেখে তাঁর বয়স আন্দাজ করা যায় না। আর তিনি সেটাই চান।
প্রশ্ন শুনে প্রফেসরের গর্তে বসা চোখ দুটো যেন রাগে জ্বলে উঠল। কিছুদিন আগে হলেও হয়তো লোকটার সাহস হত না তাঁকে এই প্রস্তাব দেবার। তিনি কোনও উত্তর না দিয়ে সোজা তাকিয়ে রইলেন প্রশ্নকর্তার দিকে। বিরাট চেহারার মানুষটার সারা মুখ দাড়িগোঁফের জঙ্গলে ভরা। খাদ্যরসিক। যখন কথা বলেন ঠোঁটের কোনায় একটা হালকা হাসির রেশ লেগে থাকে, যেন কোনও মজার জোকস শোনাচ্ছেন। খবর আছে, স্বয়ং মহারানি তাঁর ঘনিষ্ঠতম বৃত্তে এঁকে স্থান দিয়েছেন।
প্রফেসরের আজ ক্লাস ছিল বাইনোমিয়াল থিয়োরেমের উপরে। মাত্র একুশ বছরেই এই নিয়ে একটা পেপার লিখে সবাইকে এমন চমকে দেন যে তার জোরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ তিন হাজার পাউন্ডের গণিতের অধ্যাপকের পদটি তাঁর দখলে। ক্লাস চলছিলও খুব সুন্দরভাবে। দারুণ কথা বলতে পারেন তিনি। গোটা ক্লাস মুগ্ধ হয়ে শোনে। ক্লাস শেষ হতেই ছাত্ররা একে একে এসে তাদের ভালোলাগা জানায়। কেউ কেউ প্রয়োজনীয় প্রশ্ন করে। আজ ছাত্রদের মধ্যে থেকেই একজন এগিয়ে এসে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে করমর্দন করে চলে যেতেই প্রফেসর বুঝতে পারলেন তাঁর হাতের তালুতে ছোটো একটা কাগজের টুকরো চলে এসেছে। সেখানেই হলবর্ন রেস্তোরাঁর কথা আর সময়ের উল্লেখ ছিল। অন্য সময় হলে প্রফেসর হয়তো ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিতেন না, কিন্তু সবকিছু গুলিয়ে দিল একটা ছবি। চিহ্ন। মোটা পালক কলমের দাগে কাগজের নিচে আঁকা ছিল এই চিহ্নটা।
এই চিহ্নকে অস্বীকার করার সাহস প্রফেসরের অন্তত নেই। ক্লাস শেষে একটা ছ্যাকরাগাড়িতে উঠে বসলেন। টপ হ্যাট পরে ছপটি হাতে চালক বসে আছে গাড়ির ছাদে। তিনি গাড়িতে উঠে কিছু বলার আগেই চালক ঘোড়ার পিঠে চাবুক মেরে বেশ জোরেই “হলবর্ন” বলে রওনা হল। প্রফেসর অবাক হলেন। আবার হলেন না। এদের কাজকর্ম অনেক আঁটঘাট বাঁধা। নিজেও এই ধরনের গোছানো কাজ পছন্দ করেন। অন্ধকার রাস্তায় টিমটিমে গ্যাসলাইট। গাড়ির দুপাশে তেলের বাতি জ্বলছে। ঘোড়া চলার সময় পায়ে পায়ে শিকল ঠেকে ঝমঝম শব্দ হচ্ছে। মাথার দুইদিক টিপে ধরে প্রফেসর বসে রইলেন অনাগত কালের প্রতীক্ষায়। তিনি বুঝতে পারছিলেন জাল গুটিয়ে আসছে। কিন্তু সে জালের কেন্দ্রে তিনি নেই, থাকতে পারেন না। তিনি একাই একটা ইন্ডাস্ট্রি, তবু তিনি সর্বদাই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেছেন। আইনি পথে তাঁকে পাকড়াও দূরে থাক, ছোঁয়া অসম্ভব। এই সবকিছু তিনি জানেন। তবু এই ছোট্ট চিরকুটের মধ্যে অশুভ কিছু একটা ছিল, যা তাঁকে কিছুতেই শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। বহু অলিগলি এদিক ওদিকের পথ পেরিয়ে গাড়ি কিংসওয়ে আর হাই হলবর্নের পশ্চিম পাড়ে হলবর্ন রেস্তোরাঁর সামনে থামল। কেউ পিছু ধাওয়া করছে কি না নিশ্চিত হবার জন্য এই ঘুরে ঘুরে গন্তব্যস্থানে আসার পাঠ। নতুন অপরাধীদের একেবারে শুরুতেই শেখানো হয়। গাড়ির ছোকরা তবে নিতান্তই নভিস। গাড়ি মূল গেটে না দাঁড়িয়ে পাশের এক ছোটো খিড়কির সামনে দাঁড়িয়েছে। নেমে বটুয়া বার করতেই ক্যাবের ছোকরাটি “লাগবে না স্যার। পেমেন্ট করা আছে”, বলে ঝনঝনিয়ে আবার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। দরজার সামনেই খাটোমতো, টাকমাথা একজন দাঁড়িয়ে। সে সসম্মানে প্রফেসরকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে চলল। দোতলায় নাচঘর থেকে ভেসে আসছে বাজনার টুংটাং, হাসির শব্দ। কিন্তু প্রফেসরকে নিয়ে যাওয়া হল একতলার বড়ো হলের পাশ দিয়ে। এককালে এখানে বসত লন্ডনের সবচেয়ে বড়ো জুয়ার আসর। হলবর্ন ক্যাসিনো। সরাসরি না হলেও প্রফেসরের আয়ের একটা বড়ো অংশ আসত এখান থেকে। এখন রানির আদেশে ক্যাসিনো বন্ধ। ক্যাসিনোর ঠিক পাশেই লবি শেষ। টাকমাথা লোকটি সেই দেওয়ালের সামনে গিয়ে একবার পিছনে তাকিয়ে দেখে নিল। তারপর এক অজানা বোতামে চাপ দিতেই দেওয়ালের গা থেকে একটা পাল্লা খুলে এল। ভিতরে দারুণ সুসজ্জিত একটা ঘর। আলো জ্বলছে। মনে মনে একটু হাসলেন প্রফেসর। এই বুদ্ধি নরওয়ের সেই স্থপতি জোনাস ওল্ডএকর ছাড়া কারও হতেই পারে না। একেবারে সিগনেচার কাজ। প্রফেসরের চেনা। ছোট্ট ঘরে ডিনার টেবিল সাজানো। একেবারে ফুল কোর্স ডিনার। দুরকম স্যুপ, মাছের দুরকম পদ, স্টেক, চিপস, স্যালাড, চিজ আর ডেজার্ট। এক কোণে দুটো বোতল ভরা রিসবার্গের ভিন্টেজ মদ। দরজার দিকে পিছনে ফিরে বসে যে মোটা ভদ্রলোকটি একটা বইয়ের পাতা আনমনে ওলটাচ্ছিলেন, তাঁর পরিচয় আলাদাভাবে দেবার কোনও প্রয়োজন নেই। দরজা খোলার আওয়াজ পেয়েই তিনি পিছন ফিরে “কাম ইন” বলে প্রফেসরকে ডেকে নিলেন। দরজা আবার আগের মতো বন্ধ হয়ে গেল। এই গোপন ঘরে এখন তাঁরা। দুজন। প্রফেসর আড়চোখে ভদ্রলোকের হাতের বইয়ের দিকে তাকালেন। এ বই তাঁরই লেখা। যেন প্রফেসরের মনের কথা বুঝতে পেরেই ভদ্রলোক দাড়ির ফাঁকে হেসে বললেন, “একা বসে বসে কী আর করব? আপনার লেখা বইটাই পড়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু এ তো ভয়ানক কঠিন বই মশাই। দুপাতা এগোতে পারলাম না। শীতালি পাখির মতো সব সংকেত আর ইক্যুয়েশনে ভর্তি!”
প্রফেসর মৃদু হাসলেন। মুখে কিছু বললেন না। এদের আসলে মনেপ্রাণে ঘৃণা করেন তিনি। এরা ভাবে ক্ষমতা হাতে আছে বলে সব কিছু বোঝার অধিকার এরা পেয়ে গেছে। কিন্তু তা বলে এদের মাথায় তাঁর লেখা ‘ডাইনামিক্স অফ অ্যান অ্যাস্টেরয়েড’-এর মতো কঠিন গণিতের বই ঢুকবে, তা আশা করাই বাতুলতা।
অনুমতি নিয়ে সামনের চেয়ারে বসতেই সরাসরি কাজের কথায় চলে এলেন ভদ্রলোক।
“দেশ চালানো তো ক্রমে মুশকিল হয়ে যাচ্ছে প্রফেসর। বুঝছেন তো? বিশেষ করে আমাদের মহারানির শত্রু এখন চারিদিকে। সবাই ষড়যন্ত্র করছে রানিকে হেয় করার, তাঁর ব্যর্থতাগুলো বড়ো করে দেখানোর, এমনকি বিরোধীরা তোরানির একটা নামও দিয়েছে। ফ্যামিন কুইন। দুর্ভিক্ষের রানি। এসব কি রানির ভাবমূর্তির পক্ষে ভালো? আপনিই বলুন প্রফেসর?”
প্রফেসর উত্তর দিলেন না। এইসব ছেঁদো কথা বলতে যে তাঁকে ডাকা হয়নি, তা তিনি জানেন। শুধু তিনি অপেক্ষা করছিলেন আলোচনাটা কোনদিকে গড়ায় সেটা দেখার জন্য।
“রাজকুমার এডির ঘটনাটা আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই?”
আগেই বোঝা উচিত ছিল। কিন্তু প্রফেসর ভেবেছিলেন চিরকালের মতো ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে গেছে। তিন বছর বাদে আবার সেই ঘটনা মাথাচাড়া দেবে, এ তাঁর চিন্তার বাইরে। এবারও উত্তর না দিয়ে শুধু উপরে নিচে মাথা নাড়লেন প্রফেসর।
“রাজকুমার এডি একটা ভুল করে ফেলেছিল। অল্প বয়স, অমন অনেকেই করে। বোঝেনি, সেই ভুলে শুধু রানি ভিক্টোরিয়া না, গোটা ইংরেজ সাম্রাজ্য বিপদে পড়তে পারে। ফ্রেঞ্চ আর জার্মানরা আমাদের দিকে তাক করে বসে আছে। তাদের গুপ্তচর ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের অলিতে গলিতে। একবার ভাবুন তো, যদি এই খবর প্রকাশ পায়, তবে কত বড়ো বিপদ হতে পারে! যে আন্তর্জাতিক চাপ আসবে, এই মুহূর্তে সেটা সামলানোর ক্ষমতা ব্রিটিশ সরকারের নেই। তাও আমরা চালিয়ে নিচ্ছিলাম কোনওক্রমে, কিন্তু গত সপ্তাহে আমাদের সমিতির কাছে যে খবর এসেছে তা ভয়ানক। যতই অবাক লাগুক, খবরটা সত্যি।”
“কী খবর?”
“আমাদের অজান্তেই ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স আবার কেসটা রি-ওপেন করেছে। খুব সম্ভব ওরা অ্যালিস মার্গারেটকে খুঁজছে।” খুসখুসে একটা কাশি গলার কাছে পাক দিচ্ছিল অনেকক্ষণ থেকেই। এবার দমকে দমকে কাশি শুরু হল প্রফেসরের। মুখে সাদা রুমাল চাপা দিলেন তিনি। সামনের ভদ্রলোক গেলাসের জল এগিয়ে দিলেন। দুই ঢোঁক জল খেয়ে শান্ত হলেন প্রফেসর। “কিন্তু অ্যালিসের আসল সন্ধান তো…”
“আমাদের সমিতির বাইরে মোট সাতজন জানে। সেই পাঁচ মহিলা, আপনি আর মহারানি স্বয়ং।”
“কিন্তু সেই পাঁচজন মহিলাকে তো…”
“জানি জানি প্রফেসর। আপনার সাহায্য ছাড়া এই নিখুঁত পরিকল্পনায় সেই
পাঁচজনকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব হত না। সাধে কি আপনাকে অপরাধ জগতের নেপোলিয়ান বলে? এমনকি জ্যাক দ্য রিপার নামটাও তো আপনারই মাথা থেকে এসেছিল! আমরা কিছুই ভুলি না। স্বয়ং মহারানি আমাকে জনান্তিকে জানিয়েছেন তিনি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু মুশকিল হল আপনাকে আর সামান্য একটু পরিশ্রম করতে হবে প্রফেসর।”
“কীরকম?”
“এবার আপনাকে মরতে হবে। আমি দুঃখিত, এইভাবে আপনাকে অনুরোধ করতে হচ্ছে বলে। কিন্তু আমি নিরুপায়।”
স্তম্ভিত বললেও বুঝি কম বলা হয়। প্রফেসর নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। যে সমিতির জন্য তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে জঘন্যতম অপরাধের পরিকল্পনা করেছেন, আজ তাঁরাই তাঁকে মারতে চাইছে? কিন্তু কেন?
আবার স্মিত হাসি ফুটে উঠল সামনের লোকটির মুখে।
“জীবন তো অনেক উপভোগ করলেন প্রফেসর। আর কত! বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতনে কতটুকু কী হয় আমাদের জানা। আমার কাছে নিশ্চিত খবর আছে, আপনার বৈঠকখানা ঘরে নাকি একখানা চার হাজার পাউন্ড দামের জঁ ব্যাপ্তিস্তে গ্রুজের অরিজিনাল ছবি আছে! আমরা সব জানি। জেনেও এতদিন কিছু বলিনি, প্রয়োজন হয়নি বলে। এখন প্রয়োজন হয়েছে, তাই বলতে বাধ্য হচ্ছি।”
“কী প্রয়োজন?”
“আপনি মাইক্রফট হোমসের নাম শুনেছেন?”
মাথা নাড়লেন প্রফেসর। শুনেছেন।
“এই লোকটি অদ্ভুত চরিত্রের। আমাদের গুপ্তচর বিভাগের প্রধান, আর তাই আমি কেন, স্বয়ং রানিও ওকে দমিয়ে রাখতে মাঝে মাঝে অসমর্থ হন। জ্যাক দ্য রিপারের কেসের সমাধানকে ও একেবারে নিজের মিশন ভেবে নিয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম পাঁচ মহিলার হত্যার পরে আর নতুন হত্যা না হলে একসময় সব ধামাচাপা পড়ে যাবে। ওইসব দেহোপজীবিনী মেয়েদের হত্যা নিয়ে কার মাথাব্যথা থাকতে পারে?”
“পাঁচজনের কেউ দেহোপজীবিনী ছিল না”, শুধরে দেবার চেষ্টা করলেন প্রফেসর, “সেটা আমরাই রটিয়েছিলাম।”
“সে যাই হোক। কিন্তু মাইক্রফট তলে তলে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছিল। এমনকি আঁচ পেয়ে ওকে এই তদন্ত থেকে সরিয়ে দেবার পরও মাইক্রফট অন্য একজনকে দিয়ে তদন্ত চালিয়ে গেছে।”
“কাকে দিয়ে?”
“ওর নিজের ছোটো ভাই। যেহেতু সে প্রাইভেট কনসালটিং ডিটেকটিভ, তাই তার ওপরে সরকারের কোনও হাত নেই। সে স্বাধীনভাবে তদন্ত করে, আর ডায়োজেনিস ক্লাবে গিয়ে দাদাকে নিয়মিত খবর দেয়।”
“সে খবর আপনারা পেলেন কী করে?”
“ডায়োজেনিসেও আমাদের লোক আছে। সেটা বড়ো কথা না, বড়ো কথা হল, ওঁর ভাই খুঁজতে খুঁজতে এবার আপনার সন্ধান পেয়েছে। রিপারের কেসে আপনি যে একটা বড়ো খুঁটি, সে আন্দাজও সে করেছে। আপনি জানেন কি না জানি না, সে এখন হন্যে হয়ে আপনাকে খুঁজছে।”
“এখন আমার কর্তব্য?”
“গতকাল আমরা সমিতির বৈঠকে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেটা জানাতেই আপনাকে এখানে ডাকা। আগেই বলে দিই, এটা কিন্তু কোনও আলোচনা নয়। আমাদের সিদ্ধান্ত, আর সেটা আপনাকে মানতেই হবে। এ এমন প্রস্তাব, যা আপনি কিছুতেই প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন না।”
“কী সেই প্রস্তাব?” প্রফেসর বুঝতে পারছিলেন তাঁর গলা শুকিয়ে আসছে। তিনি আবার জলের গেলাসের দিকে হাত বাড়ালেন। গেলাসটা সরিয়ে নিয়ে কঠিন গলায় লোকটা বলল, “মাইক্রফটের ভাইকে ওর প্যাঁচেই জব্দ করব। ও আপনার পিছু ধাওয়া করেছে। এমনকি আমি খুব ভুল না হলে আপনি এখানে ওর চালানো ছ্যাকরাগাড়িতেই এসেছেন। আমাদের প্রস্তাব, আপনি ওকে লোভ দেখিয়ে রাইখেনবার্গ জলপ্রপাতের ধারে নিয়ে যাবেন।”
“তারপর?”
“তারপর টুক করে লাফ মারবেন সেই বিপুল জলরাশির মধ্যে। খুব কষ্ট পাবেন না, এটুকু বলতে পারি।”
“আর সেই ডিটেকটিভ? তার কী হবে?”
“ওর ব্যবস্থা করবে আপনারই সহকারী কর্নেল সেবাস্টিয়ান মোরান। সে চিন্তা আপনাকে করতে হবে না। আমরা খবরের কাগজে রটিয়ে দেব আপনাকে খুন করে ডিটেকটিভ ফেরার। তাতে এক কাজে দুই কাজ হবে। মাইক্রফটের শেষ সূত্র আপনি। আপনার সঙ্গেই রিপারের মামলা শেষ হবে। আর সেই ব্যাটা টিকটিকির একটা বদনাম রটিয়ে দেওয়া যাবে। কিংবা ডাক্তার ডয়েল, তাঁকেই বলব বিরাট করে একটা অবিচুয়ারি গল্প লিখে স্ট্যান্ডে প্রকাশ করতে। মরেও হিরো হয়ে যাবে ব্যাটা।”
“ডয়েল আপনাদের কথা শুনবে?”
“অবশ্যই। ও নিজেও ব্রাদারহুডের সদস্য। আমাদের কথাতেই ও নিজের প্রিয়তম বন্ধু অস্কার ওয়াইন্ডের বিরুদ্ধে সমকামিতা আর পায়ুমন্থনের অভিযোগে সাক্ষী দিয়েছিল। ভুলে গেছেন?”
“তাহলে তো সব ছকেই নিয়েছেন। কিন্তু আমি যদি রাজি না হই?”
“ভালো কথা। আপনি যদি রাজি না হন! এটাও আমরা গুরুত্ব সহকারে ভেবেছি। প্রথমেই আপনাকে বলে রাখি রিপারের কেসে আপনি শুধু প্ল্যান করেছেন, বাকি কাজে আপনার চেয়ে ভূতের গুরুত্ব বেশি ছিল। তাই ডাক্তার এলি হেনকিকে একেবারে অবহেলা করবেন না। দ্বিতীয়ত ডাক্তার হেনকিই জানিয়েছেন, বেশ কিছুদিন হল আপনার যক্ষ্মা ধরা পড়েছে। কাশির সঙ্গে রক্ত বার হয়। খুব বেশি হলে আর ছয় মাস। এবার ভেবে দেখুন, আমাদের প্রস্তাবে রাজি না হলে আপনার দলের সবাইকে আমরা জেলে পুরব, আপনার সম্মাননীয় চাকরিটা যাবে, সবচেয়ে বড়ো কথা এই হলবর্ন থেকে বেরবার আগেই আপনাকে গ্রেপ্তার করা হবে। বাকি জীবন নিউগেটের নোংরা জেলে কাটাবেন? না ডাক্তার হেনকির হাতে আপনাকে ছেড়ে দেব? তিনি আবার নানারকম এক্সপেরিমেন্ট করেন রোগীদের নিয়ে….”
“কিন্তু… কিন্তু আমার দলের দায়িত্ব?”
“সে চিন্তা করবেন না। কর্নেল সেবাস্টিয়ান মোরান বহু যুদ্ধের সফল সৈনিক। রানি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দও করেন। আপনার পরে তিনিই দলের দায়িত্ব পাবেন।”
এইটুকু বলে রিসবার্গের মদের গেলাসে আয়েশে চুমুক দিলেন ভদ্রলোক। খানিক সময় দিলেন প্রফেসরকে। তারপর একটু সামনে ঝুঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তাহলে এখন বলুন প্রফেসর, এই প্রস্তাবে আপনি রাজি কি না?”
আবার উপরে নিচে মাথা নাড়লেন প্রফেসর। এরা তাঁকে এমনভাবে জড়িয়েছে, পরিত্রাণের উপায় নেই।
“এর মানে কী ধরব? হ্যাঁ?”
“হ্যাঁ”, প্রফেসরের গলা আরও ক্ষীণ।
“ভেরি গুড”, উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক। এখন তাঁকে ওভারকোটে আরও বড়ো লাগছে। “ইংল্যান্ড আপনার এই বলিদান মনে রাখবে। রানিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনার কথা জানাব। আজ তাহলে আপনি বাড়ি যান। পরের পদক্ষেপের প্রতিটি ধাপ আপনাকে জানিয়ে দেওয়া হবে। ধন্যবাদ প্রফেসর জেমস মরিয়াটি।” হাত এগিয়ে দিলেন ভদ্রলোক।
করমর্দন করে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রফেসর উত্তর দিলেন, “ধন্যবাদ প্রাইম মিনিস্টার লর্ড স্যালিসব্যারি।”