চতুর্থ অধ্যায় – বদরের যুদ্ধ
বদরের যুদ্ধের পূর্বে মুসলমানদের সামরিক আন্দোলন।
এলাকার গোত্রগুলির সঙ্গে মহানবীর রাজনৈতিক চুক্তি সম্পাদন।
চুড়ান্ত যুদ্ধ।
এই যুদ্ধের অব্যবহিত কারণ।
কুরাইশদের মরুযাত্রীদল আক্রমণের জন্য মুসলমানদের অভিযাত্রা।
মরুযাত্রীদলের পলায়ন এবং মক্কী সেনাদলের বদর অভিমুখে যাত্ৰা।
মক্কী বাহিনী সম্পর্কে মহানবীর তাঁর সাথীদের সঙ্গে পরামর্শ।
মক্কী বাহিনীর সঙ্গে মুসলমানদের যুদ্ধের সিদ্ধান্ত।
উভয় বাহিনীর বদরে মোকাবিলা।
বহু ঈশ্বরবাদীদের চরম পরাজয়।
.
যে পরিস্থিতিতে মহানবী মক্কা ছেড়ে মদীনায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তার সমাপ্তি ঘটেছিল একট যুদ্ধের মাধ্যমে এবং এর জন্য মক্কার নেতারাই এককভাবে দায়ী ছিলেন। তারাই মহানবীর মাথার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ ছিলেন।
সুতরাং স্বভাবিকভাবেই অন্য পক্ষকেও (মুসলমান) আত্নরক্ষার জন্য সামরিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছিল। তাঁদের মক্কী প্রতিপক্ষের বৈরী মনোভাব এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি বিবেচনা করে তাঁদের পক্ষে আর নিজেদের সামরিক শক্তি গঠনের প্রতি উদাসীন থাকা সম্ভবপর ছিল না।
মুসলমানদেরকে কোনভাবেই সামরিক প্রস্তুতির জন্য দায়ী করা যায় না, যেহেতু অবিশ্বাসীরা তাঁদের বিরুদ্ধে আগেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল এবং তাঁদেরকে বিতাড়িত করার হুমকি দিয়েছিল।
এই সব পরিস্থিতির বিচারেই বদরের যুদ্ধকে (যা মুসলমানদের জন্য পৌত্তলিক কুরাইশদের বিরুদ্ধে অনিবার্য হয়ে উঠেছিল) ন্যায় সঙ্গত মনে হয়। দীর্ঘদিনের অব্যাহত শত্রুতার জের হিসেবে এটা তাদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
বদরের যুদ্ধের আগে সামরিক আন্দোলন সমূহ
বদরের যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে আব্দুল্লাহ্ বিন জাহ্শের[১] নেতৃত্বে পরিচালিত সামরিক অভিযান ছাড়া হিজরত এবং বদরের যুদ্ধের মধ্যবর্তী উনিশ মাসে মক্কী ও মদীনার বাহিনীর মধ্যে কোন রক্তাক্ত সংঘর্ষ অনুষ্টিত হয়নি।
[১. আব্দুল্লাহ্ বিন জাহ্শ বিন রাবাব আল আসাদী বি. আবদ শামসের একজন মিত্র ছিলেন। তিনি দু’বার হিজরত করে। তিনি ছিলেন প্রথম সেনাপতি যার জন্য ইসলামের পতাকা নির্মিত হয়েছিল। তিনি ওহুদের যুদ্ধে শাহাদৎ বরণ করে।]
যুদ্ধের আগে মুসলিম অভিযান
উপরোক্ত অভিযানটি ছাড়া মুসলমানদের অন্য সবগুলি সামরিক অভিযানই ছিল নিরীক্ষামূলক। এসব অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল মদীনার চারপাশের এবং মক্কামুখী রাস্তাগুলি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা এবং আশে পাশের বিভিন্ন গোত্রের শক্তি যাচাই করে তাদের সঙ্গে মৈত্রি চুক্তি স্থাপন করা অথবা নিদেন পক্ষে ইসলাম ও পৌত্তলিকতার মধ্যেকার সংঘর্ষে তাদেরকে নিরপেক্ষ রাখা। ঘটনাক্রমে এইসব অভিযানের ফলে মুসলমান, ইহুদি এবং বহু-ঈশ্বরবাদীদের শক্তিও যাচাই হয়ে যায় এবং এতে করে যে কোন আগ্রাসনের সম্ভাবনা দূর্বল হয়ে পড়ে। বদরের যুদ্ধের পূর্ববর্তী এইসব সামরিক অভিযানগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নরূপ :
(১) হামযা বিন আব্দুল মুত্তালিব পরিচালিত সামরিক অভিযান যাতে ত্রিশজন মুহাজিরিন অংশ নিয়েছিলেন। প্রথম হিজরির রমযান মাসে আল-ইস[১] এর নিকটবর্তী সমুদ্র-তীরে আবু জেহেল বিন হিশামের নিয়ন্ত্রণাধীনে তিনশত যোদ্ধার পাহারায় একটা কুরাইশ বাণিজ্যিক কাফেলার সঙ্গে এই অভিযাত্রীদের মোকাবিলা হয়েছিল। মাজীদ বিন আমর আল-জুহানির সময়োচিত হস্তক্ষেপের ফলে দুই দলের মধ্যে কোন সংঘর্ষ বাঁধেনি।
[১. এটি হচ্ছে ইয়ানবু এবং আল-মারওয়ার মধ্যে অবস্থিত সমুদ্র উপকূলের কাছাকাছি একটা স্থান।]
(২) উবায়িদ বিন আল-হারিস পরিচালিত সামরিক অভিযান। রাবিগ উপত্যকার দিকে অনুষ্ঠিত এই অভিযান হয়েছিল প্রথম হিজরির শাওয়াল মাসে; উদ্দেশ্য ছিল সিরিয়ার সঙ্গে কুরাইশদের বাণিজ্য রোধ করা। এরা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে দুইশত যোদ্ধার একটা বাহিনীর সম্মুখীন হয়েছিলেন তবে কোন সংঘর্ষ হয়নি। এই অভিযানের সময় কুরাইশ সেনাবাহিনীর সাথে আসা দু’জন মক্কী মুসলমান মুসলমানদের পক্ষে চলে এসেছিলেন। এরা ছিলেন আল-মিকদাদ বিন আমর আল-বাহরানি এবং উৎবা বিন গাজওয়ান।
(৩) সা’দ বিন আবি ওয়াককাসের নেতৃত্বে এই পরীক্ষামূলক দলে ছিলেন আটজন মুহাজিরিন। মক্কা ও সিরিয়ার মধ্যেকার বাণিজ পথ রুদ্ধ করার জন্য এই অভিযানের সদস্যরা ১ম হিজরিতে জুল-কায়াদার আল-খাররার[১] পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। অবশ্য এবারও কোন সংঘর্ষ হয়নি।
[১. প্রথম অক্ষরের উপর ফাতা এবং দ্বিতীয় অক্ষরের উপর দ্বৈত শ্বাসাঘাত সহ) আল-খাররার হচ্ছে আল-জাহফার কাছে হিজাজের একটা জায়গা।]
(৪) ওয়াদানের যুদ্ধ[১] : এই সামরিক অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্বয়ং মহানবী। এই অভিযানে দু’শত যোদ্ধা অংশ নিয়েছিলেন এবং২ হিজরির সফর মাসে এই দল ওয়াদান এলাকা পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। কোন রকম যুদ্ধ ছাড়াই মুসলমানরা বি. দামরা বিন বকর বিন কানানা গোত্রগুলির সঙ্গে একটা শান্তি চুক্তি সম্পাদন করে ফিরে এসেছিলেন।
[১. ওয়াদান হচ্ছে মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী একটা স্থান। ওয়াদান থেকে মদীনার নিকটবর্তী রাবিগের দূরত্ব প্রায় ২৯ মাইল।]
(৫) বুওয়াতের যুদ্ধ[১]: এই অভিযানেরও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মহানবী স্বয়ং। দ্বিতীয় হিজরির রাবি১ মাসে অনুষ্ঠিত এই অভিযানে তিনি মক্কা ও মদীনার মাঝপথে বুওয়াত এলাকা পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল কুরাইশদের একটা বহরকে দখল করা। কিন্তু তারা পালিয়ে যাওয়ায় মহানবী কোন রকম সংঘর্ষ ছাড়াই তাঁর দুই শত সঙ্গী নিয়ে ফিরে এসেছিলেন।
[৩. রাদুইয়ের কাছে হিজাজের একটা উপত্যকা। “ব্যূয়াত” লেখা হয় প্রথম অক্ষরে দামা এবং শেষে ‘ড়’ দিয়ে।]
(৬) আল-আশিরার যুদ্ধ[১]: এই সামরিক অভিযানে দুই শত লোক অংশ গ্রহণ করেছিলেন। এটারও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মহানবী নিজে। এই বাহিনী অগ্রসর হয়েছিলেন ইয়ানবু[২] এলাকার আল-আশিরা নামক স্থান পর্যন্ত। এদের উদ্দেশ্য ছিল কুরাইশদের বাণিজ্য পথ বন্ধ করা। কুরাইশদের যাত্রীদল অজ্ঞাতে পালিয়ে যাওয়ায় এবারও কোন সংঘর্ষ হয়নি। মহানবী মদীনায় ফিরবার আগে বি. মুদলিজ এবং তাদের মিত্র বি. দামরাদের সঙ্গে একটা শান্তি চুক্তি সম্পন্ন করে এসেছিলেন। এটি হয়েছিল ২য় হিজরির জামাদি ’১মাসে।
[১. আল-আশিরা (প্রথম অক্ষরে দামা এবং দ্বিতীয় অক্ষরে ফাতা) হচ্ছে মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী ইয়ানবু এলাকার একটা গ্রাম।
২. ইয়ানবু (প্রথম অক্ষরে ফাতা এবং দ্বিতীয় অক্ষরে স্কুন) রাদুইয়ের ডান দিকের একটা গ্ৰাম। দুই জায়গার মাঝখানে মরু যাত্রীদের রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা ছিল।]
(৭) বদরের প্রথম যুদ্ধ : ২য় হিজরীর জামাদি ২মাসে অনুষ্ঠিত এই অভিযানে মহানবীর নেত্বত্বে দুই শত শক্তিশালী যোদ্ধা অংশগ্রহণ করেছিলেন। একটা আকস্মিক আক্রমণে যে সব শত্রুসেনা মদীনার গোচারন ভূমি থেকে কিছু গবাদি পশু তুলে নিয়েছিল তাদেরকে ধরাই ছিল এই অভিযানের লক্ষ্য। এদেরকে ধাওয়া করতে যেয়ে মহানবী-বদরের কাছাকাছি সাফওয়ান উপত্যকায় পৌঁছেন। কিন্তু শত্রুসেনারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হওয়ায় তিনি কোন সংঘর্ষ ছাড়াই মদীনায় ফিরে আসেন।
নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ
২য় হিজরির রজব মাসে আব্দুল্লাহ্ বিন জাহ্শের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত মুসলমানদের সর্বশেষ সামরিক অভিযানে (বদরের যুদ্ধের আগে) আটজন মুহাজিরিন একটা পরীক্ষমূলক পাহারায় নিয়োজিত হয়েছিলেন।
মহানবী এই প্রহরাদলকে পাঠিয়েছিলেন মক্কা এবং তায়েফের মধ্যে ফাঁড়ি স্থাপন করে কুরাইশদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য। তাদেরকে তিনি যুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন না।
নাখলা[১] নামক স্থানে তারা মক্কায় বাণিজ্য পণ্য বহনকারী কুরাইশদের একটা শকট-বহর দেখতে পান। শুধুমাত্র পাহারার জন্য প্রেরিত হয়ে থাকলেও তারা এই শকট-বহরকে আক্রমণ করেন। লড়াইয়ে আমির বিন আল-হাদরামি নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছিলেন এবং অপর দু’জনকে বন্দী করে মুসলমান দলটি তাদের মালামাল দখল করে মদীনায় ফিরে এসেছিলেন। আমির বিন আল-হাদরামি ছিলেন মুসলমানদের হাতে নিহত প্রথম ব্যক্তি এবং এই আক্রমণেই মুসলমানরা কুরাইশদের বিশাল মালামাল দখল করেছিলেন।
[১. মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী আল ইয়ামানিয়া নামাক বিখ্যাত স্থানের নামানুসারে একটা উপত্যকা। একে বলা হত নাখলাতুল ইয়ামানিয়া।]
একটা সংকটময় অবস্থান
এই সংবাদে মহানবী খুব বিরক্ত হলেন, বিশেষ করে তিনি যখন জানলেন যে আল-হাদরামি নামের একজন কুরাইশের মৃত্যু হয়েছে এবং ইবনে জাহশ অনেক লুটের মাল নিয়ে এসেছেন। রজব মাসে (এই পবিত্র মাসে যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ ছিল) যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হওয়ায় তিনি লুটের মাল গ্রহণ করতে অসম্মতি জানালেন। তৎকালীন গোত্রীয় নৈতিকতার সকল অনুশাসন উপেক্ষা করে পবিত্র মাসের মর্যাদা ক্ষুন্ন করায় কুরাইশরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটা হীন প্রচারণা শুরুর জন্য এই ঘটনাকে একটা অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করলো। তারা বললো যে মুহাম্মদ (সঃ) এবং তাঁর সাহাবীরা পবিত্র মাসের মর্যাদা ক্ষুন্ন করেছেন, রক্তপাত ঘটিয়েছেন, মালামাল লুট করেছেন এবং তাদের লোককে বন্দী করেছেন।
এই প্রহরাদলের সদস্যরা একটা অপ্রীতিকর অবস্থার মধ্যে পড়লেন। তারপর আল্লাহর কাছ থেকে এই মর্মে ওহী আসল যে মুসলমানরা বছরের যে কোন সময়ে বহু-ঈশ্বরবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারেন। কুরাইশদের শকট বহরের সঙ্গে আচরণের ব্যাপারে নিম্নোক্ত ওহীটি আব্দুল্লাহ্ বিন জাহশ এবং তাঁর দলকে সমুন্নত করেছিল : “হে মুহাম্মদ, তারা তোমাকে পবিত্র মাসে যুদ্ধের ব্যাপারে প্রশ্ন করছে।
তুমি বল : পবিত্র মাসে যুদ্ধ করা অন্যায়, কিন্তু মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে সরানো, তাঁকে অবিশ্বাস করা এবং উপাসনার স্থান থেকে মানুষকে বহিষ্কার করা আল্লার কাছে আরো বড় অন্যায়, কারণ ধর্মগত নির্যাতন হত্যার চেয়েও খারাপ।” (ii : ২১৭)
যুদ্ধের আইনগত অনুমোদনের পর
মুসলমানরা বছরের যে কোন সময় তাদের শত্রুদের আক্রমণের জবাব দিতে পারেন এই মর্মে ওহী নাযেলের পর ইসলাম এবং পৌত্তলিকতার মধ্যেকার বিরোধ একটা চুড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে। তাদের মধ্যকার ব্যবধান আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। এরপর থেকে মুসলমানরা তাঁদের শত্রুদের আক্রমণের পাল্টা জবাব দিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন। অনুরূপভাবে মক্কার নেতারাও পুরোপুরি বুঝতে পারেন যে মুসলমানরা এখন অতীত অন্যায়ের প্রতিশোধ গ্রহণে দৃঢ় সংকল্প।
মক্কী বাণিজ্য হুমকির সম্মুখীন
কুরাইশদের জন্য যা নতুন বিপদ ডেকে আনলো তা হলো সিরিয়ার সঙ্গে তাদের বাণিজ্য পথ রুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা। এটা ছিল তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যাপারে একটা জীবন-মরণের প্রশ্ন। মহানবী ইয়াসরিবকে[১] তাঁর প্রধান দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করার ফলে মক্কা থেকে সিরিয়ার বাণিজ্য পথ বিপদাপন্ন হয়ে পড়েছিল কুরাইশদের জন্য। এবং মহানবীর মদীনায় হিজরতের পর এটাই ছিল কুরাইশদের জন্য সবচেয়ে ভীতির বিষয়।
[১. ইয়াসরিব হচ্ছে ঐ এলাকার নাম যার মধ্যে মদীনা অবস্থিত প্রথম বসবাস স্থাপনকারী সাম বিন নূহ পরিবারের ইয়াসরিব বিন কানিয়ার নামানুসারে এই এলাকার নাম হয়েছিল ইয়াসরিব।]
বদরের যুদ্ধ
বদরের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে শুধুমাত্র একটা চুড়ান্ত যুদ্ধই নয় বরং এটি ছিল ইসলাম ও অবিশ্বাসের শক্তির মধ্যে প্রথম ভয়ানক সংঘর্ষ। এই যুদ্ধে পূর্বাপেক্ষা অনেক বেশী সৈন্য অংশ গ্রহণ করেন এবং এই যুদ্ধের মাধ্যমে যে সংঘাতের অবসান ঘটে তা যুদ্ধ ছাড়া সম্ভব ছিল না।
যুদ্ধের কারণ সমূহ
মুসলমানরা যখন সিরিয়ার সঙ্গে মক্কী বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিলেন তখন পৌত্তলিক মক্কাবাসীদের ভয় সত্যে পরিণত হলো। মদীনার ইসলামিক রাষ্ট্র সিরিয়ার সঙ্গে কুরাইশদের যাবতীয় বাণিজ্যিক কার্যক্রমের উপর কড়া নজর দিতে থাকলো এবং তাদের স্বার্থে আঘাত করার জন্য সর্বদা তৎপর থাকতে লাগলে।
হিজরতের দ্বিতীয় বছরের শরতের শুরুতে মদীনায় সংবাদ আসলো যে একটা বিশাল বাণিজ্যিক সফরে আবু সুফিয়ান বিন হারব মক্কা থেকে সিরিয়ার পথে রওনা হয়েছেন।
মহানবী অনতিবিলম্বে দু’শ লোক সাথে নিয়ে মদীনা থেকে যাত্রা করলেন। এই অভিযানটি আল-আশিরার অভিযান হিসাবে খ্যাত। কুরাইশদের দলটি মুসলমানদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে নির্বিঘ্নে সিরিয়ায় পৌঁছে যায়। মুসলমানরা তখন তাদের সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
মহানবী উত্তর দিক থেকে কুরাইশ বহরের প্রত্যাবর্তনের উপর নজর রাখার জন্য তালহা বিন ওবায়দুল্লাহ[১] এবং সাইদ বিন জাইদ[২] কে নিয়ে দুই সদস্যের একটি প্রহরীদল পাঠালেন। এরা দু’জন আল-হাওরা নামক স্থানে একটা ছাউনি ফেললেন এবং আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে এক শত উটের কুরাইশ বহর সেখানে পুনরায় না আসা পর্যন্ত ঐ ছাউনিতে অবস্থান করলেন। কুরাইশদের দেখা মাত্রই তালহা এবং সাইদ দ্রুত মহানবীকে এসে সংবাদ দিলেন।
[১. তালহা বিন ওবায়দুল্লাহ্ বিন ওসমান আল-তাইমী আল-কারশী একজন বিখ্যাত সাহাবী। তিনি ছিলেন দশজন নিশ্চিত বেহেশতবাসীর একজন। তিনি মহানবীর সঙ্গে থেকে সব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ওহুদের যুদ্ধে চব্বিশটা ক্ষত লাভ করেন। তিনি ছিলেন একজন ধনী এবং দয়ালু সাহাবী। তিনি আয়েশার পক্ষে লড়তে গিয়ে উটের যুদ্ধে নিহত হন এবং তাঁর সমাধি হয়েছিল বসরায়।
২. সাইদ বিন জাইদ বিন আমর বিন নুফাইর আল-আদুই আল-কারশীও মহানবীর কাছ থেকে বেহেস্তের আশ্বাস পেয়েছিলেন। তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ ও নির্ভীক ছিলেন। তিনি ইয়ারমুকের যুদ্ধে এবং দামাস্কাসের অবরোধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং আৰু ওবায়দা তাঁকে দামাস্কাসের গভর্ণর নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি ৫১ হিজরিতে মদীনায় পরলোকগমন করেন।]
কুরাইশ বহরের দিকে মহানবীর যাত্রা
এই কুরাইশ বহরের প্রত্যাবর্তন মদীনার মুসলমানদের (বিশেষ করে যে সব মুহাজিরিন মক্কা থেকে মদীনায় আসার সময় কুরাইশদের কাছে তাদের সম্পত্তি হারিয়েছিলেন) জন্য একটা সুযোগ এনে দিল। উপরন্তু, মুসলমানরা যদি কুরাইশদের বিশাল একটা বাণিজ্য বহরকে দখল করে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে মক্কীদের জন্য বিপদ ডেকে আনেন তাহলে কি মুসলমানদের ঘাড়ে কোন চোষ চাপবে? এটা কি তাদের জন্য একটা জঘন্য আক্রমণ বা লুঠতরাজের পর্যায়ে পড়ে না?
এ প্রশ্নের জবাব খুব স্পষ্ট, বিশেষ করে যখন আমরা স্মরণ করি যে মক্কা ও মদীনার মধ্যে ইতিমধ্যেই যুদ্ধ চলছিল এবং প্রকৃতপক্ষে মক্কাবাসীরাই মুসলমানদের উপর চড়াও হয়ে তাঁদেরকে গৃহত্যাগে বাধ্য করেছিল এবং তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তাছাড়া এই বাণিজ্য বহরের মালিকরাই তো নতুন ধর্ম গ্রহণের অপরাধে মহাজিরিনদের সহায়-সম্পত্তি জবরদখল করে নিয়েছিল এবং চুড়ান্ত বিচারে এটাই কি প্রমাণিত হয় না যে যাদের উপর যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং যাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়েছে তাদেরও আইনগত অধিকার আছে অন্যায়কারীদের আক্রমণের জবাব দেওয়ার এবং শত্রুপক্ষের ধন-সম্পত্তি দখল করার।
এসব প্রশ্নের জবাব হচ্ছে একটা জোরালো হ্যাঁ’, কারণ এটাই হচ্ছে সারা পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধের নিয়ম। অতএব মহানবী যে কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলায় আক্রমণ করে তাদের (যারা ইতিমধ্যেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল) মালামাল দখলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এতে অদ্ভুৎ কিংবা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।
প্রাচ্যের বহু পন্ডিত এবং তাদের আধ্যাত্মিক শিষ্যদের ধারণা বদরের যুদ্ধ একটা লুণ্ঠনের অভিযান ছাড়া আর কিছু ছিল না। এ রকম ধারণা অবশ্যই পক্ষপাতমূলক এবং সত্যের প্রতি অন্ধ একটা বদ্ধমূল ঈর্ষা থেকে উৎসারিত। অন্যের কার্যাবলী বিচারের ক্ষেত্রে এ ধরণের মনোভাব হচ্ছে আবেগ ও পক্ষপাতিত্বের পরিচায়ক।
কিন্তু এইসব পক্ষপাতমূলক ধারণার বশবর্তী হয়ে কুরাইশদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের অস্ত্রতুলে নেয়ার ব্যাপারে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন না, বিশেষ করে তারা যখন মুসলমানদের সঙ্গে খোলাখুলিভাবে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, তাঁদেরকে ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল এবং জোরপূর্বক তাদের সহায়-সম্পত্তি কেড়ে নিয়েছিল।
অদ্ভূৎ যুক্তি
পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের (যারা মানুষের স্বাধীনতা হরণ করে, তাদের মান-সম্মান কেড়ে নেয়, নির্দ্বিধায় হত্যা করে এবং তাদেরকে বর্বর দস্যু হিসেবে আখ্যায়িত করে) এইসব আধ্যাত্মিক শিষ্যদের এই অদ্ভূৎ ও বিকৃত যুক্তির কোন জুড়ি নেই।
কথিত আছে একবার একজন ইংরেজ সেনা আফ্রিকানদের উপর তাদের জুলুম সম্পর্কে কথা বলার সময় তার এক সহযোগী সেনাকে বলেছিলেন, “এই আফ্রিকানরা একদম বর্বর।” সহযোগী জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কিভাবে বুঝলেন?” তিনি জবাব দিয়েছিলেন, “দেখুন, একজনকে হত্যা করার সময় সে আমাকে কামড়াতে লেগেছিল!”
আক্রমণের শুরু
মহানবী যখন শুনলেন যে কুরাইশদের কাফেলা হিজাজ জেলায় পৌঁছেছে তখন তিনি মুসলমান সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে সেদিকে অগ্রসর হলেন।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলা আক্রমণের জন্য যে সমস্ত বিশ্বাসী মদীনায় সমবেত হয়েছিলেন তাদের কাউকেই মহানবী জোর করে তাঁর দলে ভর্তি করেননি (যেমনটি তিনি সাধারণতঃ করতেন ওহুদের যুদ্ধের মত বড় কোন যুদ্ধের পরিকল্পনার ক্ষেত্রে)। মদীনা ত্যাগের পূর্বে তিনি মুসলমানদের সমাবেশে বলেছিলেন “কুরাইশদের এই কাফেলায় তাদের অনেক ধন-সম্পত্তি আছে। আপনারা গিয়ে এই কাফেলায় আক্রমণ করুন, আল্লাহ্ আপনাদেরকে ঐ সম্পদগুলি দিতে পারেন।”
এবং এ কারণেই বহু সংখ্যক সাহাবী-মদীনায় থেকে গিয়েছিলেন। তারা বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, কারণ এত শীঘ্র যে এ ধরণের একটা যুদ্ধ বাঁধবে এটা কেউ তখন ভাবতে পারেননি।
এ কথার প্রমাণ মেলে মহানবীর এই আচরণে যে তিনি মদীনায় থেকে যাওয়া সাহাবীদের জন্য কোন রকম অসন্তোষ প্রকাশ করেননি এবং এমনকি তাঁদেরকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতেও বলেননি কারণ এই অভিযানে অংশগ্রহণ করা ছিল স্বেচ্ছামূলক এবং মহানবী তাঁর ভাষণের পর বিষয়টি তাঁর সাথীদের নিজেদের ইচ্ছা ও বিবেচনার উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন।
কারণ এ কথা সত্য যে কোন একজন সবল-দেহী মুসলমান ঘরে বসে থাকতেন না যদি তিনি জানতে পারতেন যে তাঁর সঙ্গীরা বদরের যুদ্ধে অংশ নিতে যাচ্ছেন। তাঁরা কখনোই কল্পনা করতে পারেননি যে একটা কাফেলার সঙ্গে মোকাবিলা বড় একটা সংঘাতে পর্যবসিত হবে। কারণ তাদের এটা বিশ্বাস করার কারণ ছিল যে মহানবী এবং তাঁর তিন শতাধিক শক্তিশালী লোকের বাহিনী দেখেই কাফেলার চল্লিশজন কুরাইশ পালিয়ে যাবে। এর অর্থ হচ্ছে এই যে মুসলমানদের দৃষ্টিতে তাঁদের শত্রুদের সঙ্গে বড় ধরণের কোন সংঘাতের সম্ভাবনা ছিল না।
এ কারণেই এত সংখ্যক সাহাবী মদীনায় থেকে গিয়েছিলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আল-হুদাইর’[১] আনসারদের অন্যতম নেতাযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে মহানবী মদীনায় ফিরে আসলে আল হুদাইর আর-রাউহা নামাক স্থানে তাঁর সঙ্গে দেখা ক’রে যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করতে পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, “হে আল্লাহর নবী, আমি আল্লাহর নামে কসম করে বলছি, আমি ইচ্ছা করে মদীনায় থেকে যাইনি। আমি ভেবেছিলাম আপনি শত্রুদের মোকাবিলা করবেন না, শুধুমাত্র একটা কাফেলাকে ঠেকাবেন। এই অবস্থা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা থাকলেও আমি মদীনায় থাকতাম না।” মহানবী ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন।
মহানবী দ্বিতয়ি হিজরির রমযান মাসের ৮তারিখ বুধবারে তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে মদীনা থেকে যাত্রা করেছিলেন।
[১. যারা ইসলামের প্রথম অবস্থায় ইসলাম গ্রহণ করেন উসাইদ বিল আল-হুদাইর বিন সামাক বিন আতিক আল-আনসারী আল-আশালী ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন। তিনি আল-আকাবার অঙ্গীকারের সময় উপস্থিত ছিলেন, এবং ঐ সময় নির্বাচিত ১২ জন শিষ্যের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। তিনি আনসারদের একজন মহান প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে আয়েশা বলেছিলেন : “আনসারদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছেন যারা অনতিক্রম্য গুণাবলীর অধিকারী। এর হচ্ছেনঃ সা’দ বিন মুয়াদ, উসাইদ বিন হুদাইর এবং উবাদ বিন বাশার।” উসাইদ ওহুদের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন এবং মুসলমানদের পরাজয় উপেক্ষা করেও তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যান। এই যুদ্ধে তিনি সাতটা ক্ষতের শিকার হন এবং তিনি ২১ হিজরিতে মৃত্যুবরণ করেন।]
মদীনার গভর্ণর
মদীনা ত্যাগের আগে মহানবী ইবনে উম্মে মাকতুমকে[২] নামায পরিচালনার দায়িত্ব দেন এবং আবু লুবাবাকে[৩] মদীনার গভর্ণর নিযুক্ত করেন। এজন্য তিনি তাঁকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে না নিয়ে আর রাউহা থেকে মদীনায় ফেরত পাঠিয়ে দেন।
[২. এর জীবনবৃত্তান্তের জন্য লেখকের ওহুদের যুদ্ধ বইটি দেখুন
৩. রুফায়া বিন আব্দ আল-মুন্দির আল-আউসি আল-আনসারী আবু লুবাবা ছিলেন আল-আকাবার প্রতিজ্ঞাকারীদের মধ্যে একজন এবং তখনকার নির্বাচিত বারজন শিষ্যের একজন। মহানবী যখন তাবুকের যুদ্ধে গমন করেন তখন যারা তাতে অংশগ্রহণ করতে যাননি আৰু লুবাবা ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন কিন্তু অন্যদের সঙ্গে আল্লাহ্ তাকেও ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তিনি মক্কার বিজয় প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং তাঁর বি. আউফ গোত্রের লোকদের পতাকাবাহী ছিলেন। ৫০ হিজরির পরে খলিফা আলীর শাসনামলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।]
মুসলিম সেনাবাহিনীর সেনাপতিগণ
সেনাবাহিনী নিয়ে মদীনা ত্যাগের সময় সার্বিক পরিচালনার প্রতীক হিসেবে মুসাব বিন উমাইর আল-কারশির হাতে একটা সাদা পতাকা তুলে দেন। তিনি নিজে ছিলেন সর্বাধিনায়ক। সম্পূর্ণ বাহিনীকে দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়। মুহাজিরিনদের পতাকার দায়িত্ব দেওয়া হয় আলী[১] বিন আবু তালিবকে এবং আনসারদের পতাকা দেওয়া হয় সাদ বিন মুয়াদের[২] হাতে। সর্বাধিনায়ক হিসেবে মহানবী তাঁর সেনাবাহিনীর উভয় অংশের নেতৃত্ব দেন।
[১. নবীজির চাচাত ভাই আলী বিন আবি তালিবের জন্য কোন আনুষ্ঠানিক পরিচিতির প্রয়োজন নেই। তিনি ছিলেন চতুর্থ খলিফা। তিনি নবীজির কন্যা ফাতিমাকে বিয়ে করেন এবং পুরুষদের মধ্যে তিনিই প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। যে দশজন বেহেস্তের আশ্বাস পেরেছিলেন তিনি ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন। তিনি ছিলেন বি. আবদ মানাফের একজন সাহসী যোদ্ধা তিনি মহানবীর সঙ্গে থেকে সব যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। মুসলিম উম্মাহ যখন বিভেদে জর্জরিত হয় তখন তিনি চতুর্থ খলিফা হয়েছিলেন। তাঁর ন্যায় বিচার, সততা এবং দৃঢ়তা ছিল দৃষ্টান্ত মূলক। ৪০ হিজরির রমযান মাসের সপ্তদশ রাতে তিনি বিশ্বাস ঘাতক আব্দুর রহমান বিন আল-মালজামের হাতে নিহত হয়েছিলেন।
২. সাদ বিন মুয়াদ বিন আন-নুমান আল-আনসারী আল-আউসি ছিলেন জাহিলিয়া এবং ইসলাম উভয় যুগে আউসদের নেতা। তাঁর মৃত্যুতেই মহানবী বলেছিলেন : “সাদ বিন মুয়াদের মৃত্যুর সময় আল্লাহর সিংহাসন কেঁপে উঠেছিল।” তিনি মোয়াত্তের যুদ্ধে আহত হন এবং তার এক মাস পরে ৫ম হিজরিতে মৃত্যুবরণ করেন।]
ডান পার্শ্বদেশের নেতৃত্ব দেওয়া হয় যুবাইর বিন আল-আওয়াম এবং বাম পার্শ্বদেশের দায়িত্ব দেওয়া হয় মিকদাদ বিন আমর আল-ফিন্দিকে। সমগ্র মুসলিম বাহিনীর মধ্যে কেবল এরা দু’জনই ছিলেন অশ্বারোহী সৈন্য। পশ্চাদ্ভাগের দায়িত্ব পালন করেন কায়েস বিন আবি সাসায়া।
মদীনা বাহিনীর সৈন্যবল
মদীনার বাহিনীতে মোট সৈন্যের সংখ্যা ছিল ৩১৭ জন। তার মধ্যে খাজরাজ গোত্রের ১৭০ জন এবং আউস গোত্রের ৬১ জন সহ মোট আনসার ছিলেন ২৩১ জন।
মুহাজিরিনদের সংখ্যা ছিল ৮৬ জন। এদের মধ্যে ৪১ জন ছিলেন কুরাইশ; ৩ জন ছিলেন বি. হাশিম গোত্রের, একজন আব্দুল উজ্জার; ২জন ছিলেন বি. আব্দুল দারের, ৩জন বি. জাহরার; ১জন বি.টিমের; ৩জন বি. মাখজুমের; ৪জন বি. আদির; ৫জন বি. জামার; ১জন বি. সাহমের ৫জন বি. আমিরের এবং ৬জন বি. আল-হারিসের।
আনসার এবং মুহাজিরিন ছাড়া অন্য সৈন্যের সংখ্যা ছিল ৪৫জন এদের মধ্যে ৩৩জন ছিলেন আমেলবদ্ধ গোত্রের এবং ১২জন মুক্ত ব্যক্তি। এই ১২জনের মধ্যে ৪জন ছিলেন আরবীয় এবং ৮জন ছিলেন অ-আরবীয়। এই মুসলিম বাহিনীতে মোট ৭০টি উট এবং ২টি মাত্র ঘোড়া ছিল। একটি ঘোড়া ছিল আয-যুবাইর বিন আল-আওয়ামের এবং অন্যটি আলমিকদাদ বিন আল-আসওয়াদের সঙ্গে।
সৈন্য ও সেনাপতির অভিন্নতা
সাহাবীগণ এবং তাঁদের মহান নেতা পালাক্রমে ৭০টি উটের পিঠে আরোহন করেন। এজন্য তারা আগে কয়েকটি দলে বিভক্ত হন এবং প্রত্যেকটি দলের ছিল একটা উট। এভাবে তারা বদরে পৌঁছেন।
মহানবী (সঃ) মারথাড[১] বিন আবি মারথাড এবং আলী বিন আবি তালিবের সঙ্গে একটা উট ব্যবহার করেন। মহানবীর সঙ্গীরা তাঁকে একাই উটটি ব্যবহার করতে অনুরোধ করলে তিনি বলেছিলেন, “তোমরা দু’জন আমার চেয়ে বেশী শক্তিশালী নও কিংবা স্বর্গীয় পুরস্কারের প্রয়োজনও তোমাদের চেয়ে আমার কম নয়।” একথা বলে তিনি একা উটের পিঠে চড়তে অস্বীকার করেন।
[১. মারথাড বিন আবি মারথাড আল ঘানুই ছিলেন কায়েস বিন গিলান আল মাদরিয়া গোত্রের মানুষ। তিনি ৩য় হিজরিতে দাত-আর রাজির যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন।]
বদর অভিমুখে অভিযানের সময় মহানবী নির্দেশ দেন যে উটের খাড়ে বাঁধা ঘন্টাগুলি সরিয়ে ফেলতে হবে[২]। এই নির্দেশের উদ্দেশ্য ছিল সম্ভবত : মুসলমান বাহিনীর গতিবিধিকে গোপন রাখা, কারণ চলার পথে ঘন্টার শব্দে শত্রুদের কাছে তাঁদের অবস্থান ধরা পড়ে যেত।
[২. আল-বিদায় ওয়ান নিহায়া, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা ২৬১ দ্রষ্টব্য।]
যুদ্ধের সময় চরম সতর্কতা এবং বিচক্ষণতার প্রয়োজন হয়। মহানবী তাঁর গুপ্তচরদের এমনভাবে ব্যবহার করেন যে তাঁরা বর্তমান সময়ের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের মতই শত্রুদের অবস্থান নির্ণয়ের দায়িত্ব পালন করেন। এজন্য শত্রুদের বাণিজ্য বহর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য কিছু লোককে সেই এলাকায় পাঠানো হয়। মহানবী এজন্য বদরের দিকে সর্বপ্রথম পাঠিয়েছিলেন বাসবাস বিন আমর আল-জুহানি[১] এবং আদি বিন আবি আয-যাগবায়া[২] কে। তাদের কাজ ছিল আবু সুফিয়ানের কাফেলা সম্পর্কে আরো তথ্য সংগ্রহ করে তা মহানবীকে জানানো।
[১. বাসবাস বিন আমর আল-গাতফানি আল-জুহানি।
২. আদি বিন আবি আয-যাগবায়া আল-গাতফানি আল-জুহানি খলিফা ওমরের শাসনামলে মৃত্যুবরণ করেন।]
বদর অভিমুখে অভিযাত্রা
মদীনা থেকে বদরের দিকে যাত্রার সময় মহানবী নগরের নিকটবর্তী পার্বত্য পথে চলতে থাকেন। তিনি যে সব পর্বত-পথ অতিক্রম করেন সেগুলো হচ্ছে আল-আকিক’, জুল-হালাইফা৫, আউলাত আল-জাইশ৬, তারবান ৭, মাল্লাল৮, গামিস আল হামাম, আল-ইয়ামামা, আসসিয়ালা১০ ফাজ আর-রাউহা ১১, এবং সানোকা ১২।
[৩. মদীনার কাছে নাকব আল-মদীনা নামে পরিচিত একটি পর্বত-পথ।
৪. প্রথম অক্ষরে ফাতা এবং ২য় অক্ষরে কাসরা দিয়ে লিখিত আল-আকিক’ হচ্ছে মদীনার বাইরে একটা উপত্যকা।
৫. জুল-হালাইফা (এর দামা এবং J এর ফাতা সহ) মদীনা থেকে ৬ মাইল দূরে অবস্থিত একটা স্থান।
৬. আউলাত আল-জাইশ হচ্ছে জুল-হালাই ফা এবং তারবানের মধ্যবর্তী একটি উপত্যকা।
৭. তারবান (প্রথম অক্ষরে দামা) হচ্ছে জাত-আল-জাইশ এবং মাল্লালের মধ্যবর্তী একটি উপত্যকা।
৮. মিমের এবং লামের ফাতা দিয়ে লেখা মান্নাল হচ্ছে মদীনা থেকে দুই কাফেলা রাত্রির পথ দূরে অবস্থিত একটি স্থান।
৯. প্রথম অক্ষরে ফাতা এবং ২য় অক্ষরে কাসরা দিয়ে উচ্চারিত গামিস আল হামাম হচ্ছে মাল্লালের কাছে একটি উপত্যকা।
১০. আস-সিয়ালা হচ্ছে মাল্লাল এবং আর-রাউহার মধ্যবর্তী একটি স্থান।
১১. আর-রাউহা-এর ফাতা) দূরত্ব মদীনা থেকে ৪০ মাইল।
১২. ১ম অক্ষরের উপর ফাতা এবং ২য় অক্ষরে দামা দিয়ে উচ্চারিত ‘সানোকা’ হচ্ছে বদরের কাছে আর-রাউহার কাছে অবস্থিত একটা পাহাড়।]
বিয়ার আর-রাউহা ছেড়ে তিনি মক্কাগামী পথ থেকে বাম দিকে ঘুরেন এবং তারপর বদরের পথে আন-নাযিয়া অভিমুখে যাত্রা করে আন-নাযিয়া এবং মাদিক আস-সাফার মধ্যবর্তী ওয়াকান নামক একটা উপত্যকায় এসে পৌঁছেন। এরপর তিনি আস সাফরা উপত্যকাকে বামে ফেলে ডানদিকের পথ ধরে ধাপরান উপত্যকায় গিয়ে পৌঁছেন। এই উপত্যকা ছাড়ার পরই তিনি কুরাইশ বাহিনীর বদর অভিমুখে অভিযাত্রার প্রথম সংবাদ পান। তখন তিনি ধাপরান উপত্যকা ছেড়ে আল-আসাফারে পৌঁছেন এবং তারপর বদরের কাছাকাছি আল-দাবা নামক স্থানে পৌঁছে সেখানে তাবু ফেলেন।
সাহায্যের জন্য আবু সুফিয়ানের মক্কার প্রতি আবেদন
কুরাইশ কাফেলার প্রধান আবু সুফিয়ান অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন, কারণ তিনি জানতেন যে মক্কাগামী পথ তার জন্য মোটেই নিরাপদ নয়।
এজন্য উত্তর দিক থেকে হিজাজ জেলায় প্রবেশ করা মাত্রই তিনি মহানবীর সঙ্গীদের গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন দিকে তার গুপ্তচরদিগকে পাঠিয়ে দেন।
একটু পরেই আবু সুফিয়ান তার পুপ্তচরদের কাছ থেকে জানতে পারেন যে মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর সাহাবীগণকে পাঠিয়েছেন তার কাফেলা প্রতিহত করার জন্য এবং তারা এ উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যেই মদীনা ত্যাগ করেছেন। এই সংবাদে আবু সুফিয়ান ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়লেন, কারণ তিনি তার নিজের এবং কাফেলার জন্য সমূহ বিপদ আঁচ করতে পারেন। এজন্য তিনি আসন্ন বিপদের সংবাদটা কুরাইশদের কাছে পাঠাবার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং তাদেরকে তার সাহায্যে এগিয়ে আসার আহ্বান জানালেন।
সতর্ককারীর মক্কা আগমন
আবু সুফিয়ানের দূত দামদাম বিন আমর আল-গাফ্ফারী তার উট নিয়ে মক্কায় পৌঁছলেন। পথে তার উটের জিন উল্টে যায় এবং তার পরনের কাপড় ছিঁড়ে যায়। নগরীতে পৌঁছেই তিনি উচ্চকণ্ঠে ডাক দেন : “হে কুরাইশগণ। কাফেলা! কাফেলা! আপনাদের মালামাল সহ আবু সুফিয়ান কে মুহাম্মদ এবং তার লোকেরা আক্রমণ করেছে। আপনারা আপনাদের মালামাল উদ্ধার করতে পারবেন কিনা সন্দেহ। বাঁচান! বাঁচান!
এই সংবাদ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত মক্কায় পৌঁছলো। মক্কাবাসীরা ভীষণ মর্মাহত হলো এবং দূত আসার অব্যবহিত পরেই তারা তাদের কাফেলা রক্ষার্থে একটা শক্তিশালী বাহিনী তৈরির সিদ্ধান্ত নিলো। এই বাহিনী গঠনে কুরাইশদের সকল গোত্রই লোক ও অর্থ দিয়ে সহযোগীতা করলো। গোত্র প্রধানগণ একত্রিত হয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নিলেন। শুধুমাত্র আবু লাহাব তার অসুস্থতার কারণে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারলেন না কিন্তু তিনি তার পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য সাফওয়ান বিন উমাইয়া নামের অন্য একজন লোককে পাঠালেন সাফওয়ানের বাবা এবং ভাইও এই যুদ্ধে অংশ নেয়।
কুরাইশ এবং বনি কানানা[১]
মদীনার পথে রওনা হওয়ার প্রাক্কালে কুরাইশ নেতৃবৃন্দ বনি বকর বিন কানানার কথা (যাদের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক ছিল না) ভাবলেন। তাদের ভয় ছিল মুসলমানদের মুকাবিলা করার সময় কানানার লোকেরা পিছন থেকে তাদেরকে আক্রমণ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে তারা দুই প্রতিপক্ষ বাহিনীর মাঝখানে পিষ্ট হয়ে যাবে। এই আশংকা তাদেরকে একটা বিপজ্জনক অবস্থায় ঠেলে দিল এবং এমতাবস্থায় তারা তাদের অভিযান বন্ধ রাখার কথা ভাবছিল। এই সময় কানানা গোত্রের একজন নেতা শয়তান রূপী সুরাকা বিন মালিক বিন জাশাম সেখানে আসলেন এবং আশ্বাস দিলেন যে মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার সময় তার গোত্রের লোকেরা কুরাইশদের জন্য কোন সমস্যা সৃষ্টি করবে না। এভাবে পিছনভাগ নিশ্চিত হয়ে মক্কী বাহিনী দ্রুতগতিতে বদরের দিকে অগ্রসর হয়। ইবনু কাসির তার বইতে [২] বলেছেন “(আমি বলেছিলাম) এবং ওটাই হচ্ছে ঐশ্বরিক বাণীর[৩] ব্যাখ্যাঃ ‘তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আত্ম-অহংকারে গর্বিত হয়ে তাদের বাড়ী ছেড়েছিল এবং যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়, কিন্তু তারা যা কিছু করে আল্লাহ্ তার সবই জানেন। এবং শয়তান তাদের কার্যকলাপকে সঠিক বলে প্রতিপন্ন করে বলেছিলঃ ‘আজ কোন মানুষই তোমাদের হারাতে পারবে না। আমি তোমাদের রক্ষা করবো।’ কিন্তু উভয় সেনাবাহিনী যখন পরস্পরের মুখোমুখি হলো তখন সে এই বলে পালিয়ে গেল : “আমি নির্দোষ। আমি যা দেখতে পারছি তোমরা তা দেখতে পারছ না। আমি আল্লাহকে ভয় করি। আন্নার শাস্তি অত্যন্ত ভয়ানক।”
[১ বনি বকর বিন আবদ মানাত বিন কানানা এবং কুরাইশ গোত্রর একজন সাধারণ পূর্বপুরুষ ছিল কানানা বিন খুজাইমা গোত্রে। তারা মক্কা ও মদীনার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল এবং কুরাইশদের সঙ্গে (যখন তারা কাফেলা রক্ষার্থে রওনা হয়) যুদ্ধ করতে প্রস্তুত ছিল। এই যুদ্ধের কারণ ছিল বনি আমর বিন লুয়াই গোত্রের একজন কুরাইশের হাতে তাদের একজন লোকের মৃত্যু।
২. আল-বিদায়া ওয়ান-নিহাইয়া, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা ২৫৯
৩. আল-কুরআন, VIII: ৪৭-৪৮]
মক্কী বাহিনীর অগ্রযাত্রা
বনি বকরের কাছ থেকে নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়ে মক্কী বাহিনী আগ্নেয়গিরির মত রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ছুটে বেরুলো। মদীনার বাহিনীর হাত থেকে তাদের কাফেলা রক্ষার জন্য দৃঢ়সংকল্প হয়ে তারা পথের সমস্ত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে তেরশত শক্তিশালী লোকের এই বাহিনী দ্রুত গতিতে উত্তরে বদর অভিমুখে যাত্রা করলো। তারা বদরের পথে উসফান[১] উপত্যকা, কুদাইদ[২] আল-জুহাফা,[৩] এবং আল-আবওয়া[৪] অতিক্রম করে।তাদের সঙ্গে ছিল ষাটটি ঘোড়া, ছয়শত বর্ম এবং বহু সংখ্যক উট, যার সংখ্যা সঠিকভাবে জানা যায়নি।
[১. উসফান (আইন এর সঙ্গে দামা এবং নীরব সিন হচ্ছে মক্কা ও রাবিগের মধ্যবর্তী একটি স্থান।
২. কুদাইদ (কাফ এর উপর দামা এবং দাল এর উপর ফাতা হচ্ছে উসফান এবং রাবিগের (তোলের কাছে।) মধ্যবর্তী একটি স্থান।
৩. আল-জুহাফা(দামা এবং স্কুনসহ) হচ্ছে রাবিগ উপত্যকার একটি গ্রাম। ইহা সমুদ্র- উপকূল থেকে ছয় মাইল এবং কাফেলার পথে ইহা মক্কা নগরী থেকে ১২২ মাইল দূরে অবস্থিত।
৪. আল-আবওয়া (ফাতা এবং স্কুনসহ) মদীনার নিকটবর্তী আল-জুহাফা থেকে ১৩০ মাইল দূরে অবস্থিত একটি গ্রাম।]
মক্কী বাহিনীর খাদ্য সরবরাহকারীগণ
যে সব নেতা মক্কী বাহিনীর জন্য খাদ্য ও রসদপত্র সরবরাহ করেন তারা ছিলেন নিন্মোক্ত :
(১) মক্কী বাহিনীর মক্কা ত্যাগের প্রাক্কালে আবু জেহেল বিন হিশাম দশটি উট তাদের ভোজের ব্যবস্থা করেছিলেন।
(২) উমাইয়া বিন খালাপ উসফান নামক স্থানে নয়টি উট মেরেছিলেন।
(৩) সুহাইল বিন আমর কুদাইদে দশটি উট মেরেছিলেন।
(৪) শাইবা বিন রাবিয়া কুদাইদের কাছে মিয়াহ্ আল-বাহর নামক স্থানে নয়টি উট মেরেছিলেন।
(৫) উতাবা বিন রাবিয়া আল-জুহাফায় দশটি উট মেরেছিলেন।
(৬+৭) আল হাজ্জাজের দুই পুত্র নুবিয়া এবং মুনাব্বা আল-আবওয়ায় দশটি উট মেরেছিলেন।
(৮) আল-আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব আল-আবওয়া এবং বদরের মধ্যবর্তী একটা স্থানে দশটি উট জবেহ করেছিলেন তাদের সেনাবাহিনীর জন্য।
(৯) আবুল-বখতারি বি, হিশাম বদরে দশটি উট মেরেছিলেন।
মক্কী সেনাবহিনী যখন দ্রুতগতিতে বদরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তখন আবু সুফিয়ান মক্কার দিকে তার যাত্রা চালিয়ে যান। মক্কী নেতাদের কাছে পাঠানো বাণীতে তিনি দ্রুত সাহায্যের উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করলেও তিনি নিষ্ক্রিয়ভাবে অপেক্ষা করেননি। তিনি সম্ভাব্য সকল সংকটাবস্থা মোকাবিলার জন্য নিজস্ব পরিকল্পনা গ্রহণে সর্বদা সতর্ক এবং সচেষ্ট ছিলেন। তিনি তার গোয়েন্দা বাহিনীকে শক্তিশালী করেন এবং এমন সব স্থানে এজেন্টদের মোতায়েন করেন যাতে করে তারা সহজেই মুসলমানদের গতিবিধি প্রত্যক্ষ করতে পারেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি তার কাফেলা নিয়ে মুসলমানদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে চলে যেতেও সক্ষম হন। কিন্তু সতর্কতা এবং ভীতি সত্ত্বেও আবু সুফিয়ান কখনোই তার মক্কাগামী স্বাভাবিক পথ থেকে বিচ্যুত হননি। উত্তর দিক থেকে এসে তার কাফেলা বদরের দিকে অগ্রসর হয় এবং তারা মদীনা নগরীকে ডান পাশে ফেলে পথ চলে।
একটা সংকটময় বিরতি
আবু সুফিয়ানের জন্য সবচেয়ে সংকটময় মূহুর্ত হচ্ছে সেইটা যখন তিনি এবং তার কাফেলা মুসলমানদের হাত থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যান। তিনি বদরের কাছাকাছি পৌঁছলে সৌভাগ্যবশতঃ মাজদি বিন আমরের দেখা পান এবং মুহাম্মদের (সঃ) বাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জবাবে তিনি জানান যে কাছাকাছি একটা ছোট্ট পাহাড়ের উপর দু’জন আরোহী ছাড়া আর অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পাননি।
এই তথ্য পাওয়া মাত্রই আবু সুফিয়ান দ্রুত ঐ পাহাড়ে চলে গেলেন এবং সেখানে আরোহীদের উটের বিষ্ঠা দেখতে পেলেন। ভালভাবে পরীক্ষা করে তিনি ঐ গোবরের মধ্যে একটা খেজুরের বিচি পেলেন এবং চীৎকার করে বললেন : “এটা নিশ্চয়ই ইয়াথ্রিবের মানুষদের তাদের জন্তুকে দেওয়া খাবার।” এতে করে তিনি নিশ্চিত হলেন যে আরোহীদ্বয় মহানবীর সঙ্গী এবং মুসলিম সেনাবাহিনী কাফেলার কাছ থেকে বেশী দূরে নেই এবং তাদেরকে যে কোন সময় আক্রমণ করতে পারেন।
দ্রুত কাফেলার কাছে ফিরে গিয়ে তিনি গতিপথ পরিবর্তন করে পশ্চিমদিকে সমুদ্র উপকূল অভিমুখে রওনা হলেন। এই গতিপথ পরিবর্তনের ফলেই তার কাফেলা মুসলমান বাহিনীর কবল থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছিল।
কাফেলার পলায়নের পর মক্কী বাহিনী
আবু সুফিয়ান যখন নিশ্চিত হলেন যে তার কাফেলা বিপদ মুক্ত তখন তিনি কুরাইশদের খবর পাঠালেন এবং তাদেরকে মক্কায় ফিরে যেতে পরামর্শ দিলেন। কুরাইশরা আল-জুহাফায় তার যে বার্তা পেল তাতে লেখা ছিল, “আপনারা আপনাদের কাফেলা, লোকজন এবং মালামালকে রক্ষা করতে বেরিয়েছেন। কিন্তু ঈশ্বর নিজে সেগুলো রক্ষা করেছেন। অতএব আপনারা বরং মক্কায় ফিরে যান।”
মহানবীর সবচেয়ে বড় ঘোরতর শত্রু আবু-জেহেল আবু সুফিয়ানের পরামর্শ না শুনে বদরের দিকে তাদের অভিযান চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নিলেন। চরম গর্বভরে তিনি বললেন, “আমরা বদরে না পৌঁছা পর্যন্ত কখনই ফিরে যাব না। সেখানে আমরা তিন দিন থাকবো, পশু মারবো, ভোজ দেব, মদ খাব এবং মেয়েরা আমাদেরকে তখন গান গেয়ে শুনাবে। সারা আরব ভূখন্ড আমাদের অভিযান এবং শক্তির কথা জানবে এবং এরপর আমাদের শক্তির ভয়ে সবাই ভীত থাকবে। অতএব চল আমরা অগ্রসর হই।”[১]
[১. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়িয়া ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা ২০৬]
মক্কী বাহিনীতে প্রথম ভাঙ্গন
কুরাইশদের কাফেলা নিরাপদ এবং বিপদমুক্ত হলেও শুধুমাত্র সামরিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতেই আবু জেহেল মক্কী বাহিনীকে বদর অভিমুখে যাত্রার নির্দেশ দেন। এই অভিযানের মাধ্যমে তিনি আসলে মক্কার সামরিক শক্তি প্রদর্শন ক’রে আরবদের বিশেষ করে মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী এলাকার মানুষদেরকে ভয় দেখাতে চেয়েছিলেন।
আবু জেহেলের বিরোধিতা করেন বনি জাহরার মিত্র এবং এই অভিযানে তার গোত্রের সেনাপতি আল-আখনাস বিন শুরাইক আল-তাফাকি[১] বনি জাহরার মিত্রদের সম্বোধন করে তিনি বলেন :
‘হে বনি জাহরার লোক সকল, ঈশ্বর আপনাদের মালামাল এবং আপনাদের লোক মাখরামা[২]-কে রক্ষা করেছেন। এদের নিরাপত্তার জন্যই আপনারা ঘর ছেড়েছিলেন। অতএব এখন যেহেতু তারা নিরাপদ, তখন আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত, কারণ এখন অন্যের জন্য আপনাদের যুদ্ধ করা উচিত নয়-এমনকি আবু জেহেল যা বলছেন তার জন্যও নয়।’ আল আখনাস আল-থাফাকি বনি জাহরার একজন প্রভাবশালী নেতা ছিলেন বিধায় বনি জাহরার সবাই তার কথামত আল-জুহাফা থেকে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করে। বনি জাহরার একজন লোকও বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি। তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় তিন শত।
[১. বনি জাহরার মিত্র আল-আখনাস বিন শুরাইক বিন ওয়াহাব আল-থাফাকি একজন জ্ঞানী এবং প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। তার ডাক নাম ছিল আল-আখনাস, কারণ তিনি মক্কী বাহিনীর বনি জাহরার লোকদের সাথে আল-খানসা পরিত্যাগ করেছিলেন। মহানবীর মক্কা বিজয়ের বছরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি হুনাইনের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন।
২. মাখরামা বিন নওফাল বিন আবদ মানাফ আয-যাহরী তাদের মধ্যে একজন যারা আবু সুফিয়ানের সঙ্গে মুসলমানদের কবল থেকে পালিয়ে ছিলেন মুলমানদের মক্কা বিজয়ের বছরে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি ৫৫ হিজরীতে ১১৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।]
মুসলমান সেনাবাহিনীর সংকটময় অবস্থান
এভাবে আবু জেহেলের পরামর্শ অনুসারে মক্কী বাহিনী গর্ববরে উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং শেষে তারা এমন লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করে যা তারা তাদের দীর্ঘ ইতিহাসে আর কোন দিন বরণ করেনি।
মুসলমানরা একই সাথে আবু সুফিয়ানের পলায়ন এবং মক্কী বাহিনীর অগ্রযাত্রার সংবাদ পান। এটা ছিল প্রকৃত পক্ষেই একটা বিচলিত হওয়ার মত সংবাদ। যে কাফেলা উদ্ধারের জন্য মক্কী বাহিনী যাত্রা শুরু করেছিল সেটি পালিয়ে গেলেও তারা বদরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
এবিষয়ে কোন সন্দেহ ছিল না যে মক্কা এবং মদীনার মধ্যবর্তী এই চরম প্রতিক্রিয়াশীল এলাকার গোত্রগুলির মধ্যে যদি পৌত্তলিক মক্কী সেনাবাহিনী তাদের পরিক্রমা চালাতে পারতো এবং তাদের শক্তির মহড়া দেখিয়ে ঐ এলাকার লোকদের বশ করতে পারতো তাহলে তার রাজনৈতিক ফলাফল মদীনার জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতো। কারণ এতে করে এই এলাকার জনসাধারণের মধ্যে নিঃসন্দেহে মক্কার রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাব বৃদ্ধি পেত। এবং হিজরতের পর কয়েক বছর ধরে আল্লাহর বাণী প্রচারের লক্ষ্যে মহানবী এই এলাকায় যে সব সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছিলেন এবং ইসলামের ক্রমবর্ধমান প্রভাব স্থাপন করেছিলেন তার উপরও মক্কী বাহিনীর কার্যকলাপ একটা বিরূপ প্রভাব ফেলতে সক্ষম হতো।
মক্কী বাহিনী অত্যন্ত সুসজ্জিত হয়ে তাদের উস্কানীমূলক শক্তি প্রদর্শন করে বদর অভিমুখী মুসলমান বাহিনীর পক্ষ থেকে কোন রকম প্রতিরোধের সম্মুখীন না হয়েই বদর পৌঁছতে সক্ষম হয়। মুসলমানরা যদি মক্কী বাহিনীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পিছপা হতেন তাহলে ঐ এলাকায় তাঁদের সামরিক মর্যাদা ভীষণভাবে ক্ষুন্ন হতো। তাদের পক্ষে এহেন দূর্বলতা আৰু জেহেলকে তাদের সংঘর্ষকে মদীনার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসতে উৎসাহিত করতো এবং তা মুসলমানদেরকে তাদের নিজ শহরের মধ্যে যুদ্ধ করতে বাধ্য করতো।
সেনাপতিদের বৈঠক
এই আকস্মিক অবস্থা মোকাবিলার জন্য মহানবী সব রকম প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। মক্কী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের ব্যাপারে তিনি নিজেও আগ্রহী থাকায় তিনি এজন্য যে কোন মূল্য দিতে প্রস্তুত ছিলেন।
কিন্তু নিজের সংঘর্ষের প্রতি আগ্রহ থাকলেও এবং তিনি আল্লাহর রসূল এবং তাঁর বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হলেও মক্কী বাহিনীর বদর অভিমুখে অগ্রযাত্রার ফলে উদ্ভুত অপ্রত্যাশিত সামরিক পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তিনি কোন স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি। এ অবস্থায় তিনি ইসলামের গণতান্ত্রিক নীতি অনুসরণ করেন যা কুরআনে এভাবে বলা হয়েছে : “এবং (হে রাসূল) আপনি এসব বিষয়ে বিশ্বাসীদের সঙ্গে পরামর্শ করুন।”
এজন্য তিনি তক্ষুণি তাঁর সেনাপতিদের একটা জরুরী সভা আহবান করলেন এবং তাঁদের সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে জরুরী অবস্থা মোকাবিলার ব্যাপারে তাদের মতামত গ্রহণ করলেন।
একটা বিপজ্জনক অবস্থা
সার্বিক অবস্থার আকস্মিক অবনতি মদীনার ক্ষুদ্র বাহিনীর জন্য ছিল একটা বড় হুমকি, কারণ তারা তখন বড় কোন যুদ্ধের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। এই বাহিনী বের হয়েছিল শুধুমাত্র একটা কাফেলা দখলের জন্য যার সঙ্গে চল্লিশ জনের বেশী লোক ছিল না।
মুসলমান বাহিনী একটা কাফেলা দখলের জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল কিন্তু বড় কোন সেনাবাহিনীর মোকাবিলার জন্য নয়।
কিন্তু অকস্মাৎ তারা দেখতে পেলেন যে তাদের সাধারণ অভিযান বিশাল একটা সংঘাতের রূপ লাভ করছে এবং এতে করে তারা একটা ভয়ানক খারাপ অবস্থায় পতিত হলেন। কাফেলার সঙ্গে কার চল্লিশ জন লোক পলিয়ে গেলে এই ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনী দেখলো তাদের এখন মক্কার কুরাইশদের মুখোমুখি হতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই এমন একটা শক্তিশালী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া মুসলমানদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন একটা কাজ ছিল এবং সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা তাদের জন্য জরুরী ছিল।
এজন্য মহানবী সামরিক উপদেষ্টা কাউন্সিলের[১] এক সভা ডাকলেন এবং তাঁর সেনাপতিদের সঙ্গে গৃহীতব্য কার্যক্রম সম্পর্কে আলোচনা করলেন।
[১. মদীনা সেনাবাহিনী বদরের কাছে আধ-ধাপরান উপত্যকা পার হওয়ার পর পরই এই কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়।]
মক্কী বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ের ব্যাপারে সেনাপতিদের ঐক্যমত
মুহাজিরিনরাই প্রথম তাদের নেতাদের মাধ্যমে পৌত্তলিকদের সঙ্গে যুদ্ধ করার সংকল্প ব্যক্ত করেন। সভায় মুহাজিরিনদের পক্ষে কথা বলেছিলেন আল-মিকদাদ২. বলেছিলেন : “হে আল্লাহর নবী, আল্লাহর নির্দেশে আপনি এগিয়ে চলুন, আমরা আপনার সঙ্গে আছি। আল্লাহর দোহাই, আমরা আপনাকে সেভাবে বলবো না যেমন মুসাকে বলেছিল ইসরাইলের অধিবাসীরা (তুমি এবং তোমার প্রভু যাও এবং তাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর, আমরা এখানে বসে থাকবো)। আমরা বরং বলবোঃ “আপনি আর আপনার রব যান যুদ্ধ করতে এবং আমরা সবাই আপনার এবং আপনার রবের সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করবো। আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, আপনি নির্দেশ দিলে আমরা দুনিয়ার এক প্রান্ত পর্যন্ত আপনাকে অনুসরণ করবো এবং লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনার সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করবো।” তার কথা শেষ হলে মহানবী তার প্রশংসা করলেন।
[২. আল-মিকদাদ বিন আমরের আরেক নাম হচ্ছে আল-মিকদাদ বিন আল-আসওয়াদ আল-কিনাদি আল- হাদরামি। তাঁর বাবা তাঁর গোত্রের একজন লোককে হত্যা করে হাদরামাউত চলে যান এবং সেখানে বনি কিন্দার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে তাদের একজন মহিলাকে বিয়ে করেন। তিনিই ছিলেন আল-মিকদাদের মা। আল-মিকদাদ বড় হয়ে তার তরবারি দিয়ে আবিশামর বিন হাজর আল-কান্দি নামের জনৈক লোকের পা কেটে ফেলেন। এরপর তিনি মক্কায় চলে যান এবং সেখানে আল-আসওয়াদ বিন আবদ ইয়াগুছ তাকে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন এবং এজন্যই তিনি আল-মিকাদাদ বিন আল-আসওয়াদ নামে পরিচিত হন। “পুত্রদের পরিচয় হবে তাদের আসল পিতার নামে” এই মর্মে ওহী আসলে তার পুনরায় নাম হয় আল-মিকদাদ বিন আমর। তিনি দুবার হিজরত করেন। নির্ভীক এই ব্যক্তি ৩৩ হিজরীতে মৃতু বরণ করেন।]
আনসারদের চূড়ান্ত কথা
মহানবী যেহেতু জানতেন যে মুসলমান সেনাবাহিনীতে মুহাজিরিনদের সংখ্যা খুবই কম সেজন্য তাদের প্রতিনিধির মতামত জানার পরও তিনি জানতেন না যে সংখ্যাগরিষ্ঠ আনসাররা বর্তমান অবস্থায় কি রকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন। অতএব আনসারদের মতামত জানা অত্যন্ত জরুরী ছিল, কারণ আকাবার অঙ্গীকার নামায় এমন কিছু বলা ছিল না যে তারা মহানবীর সঙ্গে থেকে তাদের শহরের বাইরে যুদ্ধ করবেন। সে অঙ্গীকার নামা অনুসারে তাদের দায়িত্ব ছিল তাদের নিজের শহরের মধ্যে থাকাকালীন সময় তারা মহানবীকে রক্ষা করবেন। সেখানে একটা শর্ত ছিল এরকম : তারা (অর্থাৎ আনসারা) তাঁকে প্রতিরক্ষার দায়িত্ব বহন করবেন না, যদি না তিনি (অর্থাৎ মহানবী) তাদের নগরীতে প্রবেশ করেন। যখন তিনি তাদের কাছে আসবেন তখন তিনি তাদের প্রতিরক্ষা পাবেন এবং তারা তাঁকে তাঁর শত্রুদের কাছ থেকে নিজেদের স্ত্রী পুত্রের মত রক্ষা করবেন।
এজন্যই নবীজি নিশ্চিত ছিলেননা আনসাররা বর্তমান অবস্থায় তাদের নগরীর বাইরে তাঁকে সহযোগিতা করবেন কিনা। তাই তিনি আসন্ন যুদ্ধের ব্যাপারে বিশেষ ভাবে আনসারদের মতামত জানতে চাইলেন। তিনি (মুহাজিরিনদের পক্ষ থেকে অনুকূল সাড়া পাবার পর) আবার বললেন : “হে লোকসকল, আপনারা আমাকে পরামর্শ দিন।” এ সময় আনসারদের নেতা এবং তাদের পতাকাবাহী সা’দ বিন মুয়াদ দাঁড়িয়ে বললেন :
“হে আল্লাহর নবী, আপনি কি আমাদের পরামর্শ চাচ্ছেন?”
নবীজি বললেন, “হ্যাঁ।”
এরপর আনসারদের নেতা তাঁর দলের পক্ষ থেকে শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করলেন। মহানবীকে সম্বোধন ক’রে তিনি বললেন :
“আমরা আপনাকে বিশ্বাস করেছি এবং আল্লাহর দূত হিসেবে আমরা আপনাকে শুদ্ধ করি। আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি যা (কুরআন) পেয়েছেন তা সত্য। এজন্যই আপনার কথা শুনতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আপনি আপনার ইচ্ছে মত অগ্রসর হোন, আমরা আপনার সঙ্গে আছি। যিনি আপনাকে সত্য পাঠিয়েছেন সেই মহান আল্লাহর নামে শপথ করে আমরা বলছি, আপনি আমাদেরকে সমুদ্রের মধ্য দিয়ে হাঁটতে বললেও আমরা আপনার সঙ্গে থাকবো এবং আমাদের একজনও পিছনে বসে থাকবে না। আমাদের ভাগ্যে কাল যা কিছুই ঘটুক না কেন আমরা তাতে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট থাকবো, কারণ যুদ্ধে আমাদের ধৈর্য্য আছে এবং আমাদের দলে আমরা সত্যনিষ্ঠ। সম্ভবত : আমাদের কাজে আল্লাহ্ আপনাকে খুশী করবেন। আল্লাহর রহমত নিয়ে আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে অগ্রসর হোন।”
যুদ্ধ ক্ষেত্রের দিকে
মহানবী যখন নিশ্চিত হলেন যে বহু-ঈশ্বর বাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে তাঁর সেনাবাহিনীর উভয় গ্রুপই ইচ্ছুক এবং তার জন্য তারা পুরোপুরি প্রস্তুত আছেন তখন তিনি আনন্দিত বোধ করলেন। তক্ষুণি তিনি তাঁর সেনাবাহিনীকে বদর অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিলেন। তিনি বললেনঃ “অগ্রসর হোন এবং শুভ সংবাদের অপেক্ষা করুন, কারণ সত্যি সত্যি আল্লাহ্ আমাকে একটা জিনিসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে (অর্থাৎ হয় কাফেলার দখল অথবা আবু জেহেলের বাহিনীর উপর আমাদের বিজয়)। তাদের ধ্বংসের ক্ষেত্র আমি দেখতে পাচ্ছি।” এবং মুসলমান বাহিনী বদর অভিমুখে অগ্রসর হলেন।
পরিদর্শন-পরিক্রমার নেতৃত্বে মহানবী
এই যুদ্ধে মহানবী একজন সেনাপতি হিসেবে কয়েকটি অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন-দেখতে বেমানান হলেও তিনি ছিলেন কর্তব্যে সর্বদা তৎপর। মুসলমানরা বদরের নিকট তাবু স্থাপন করেন এবং মহানবী তাঁর একজন সাহাবীকে সঙ্গে নিয়ে অদূরে অবস্থান নেওয়া মক্কী বাহিনীর শক্তি পরিদর্শন করতে যান।
মক্কী তাবুর চারপাশে পরিক্রমার সময় তাঁরা একজন বয়স্ক আরবের দেখা পান। মহানবী বৃদ্ধ লোকটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চান কিন্তু এই ভেবে ভয় পান যে লোকটি তাঁকে চিনে ফেলবে কিনা। “মহানবী (সঃ) তাঁর পরিচয় গোপন রাখার জন্য লোকটিকে উভয় সেনাবাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু লোকটি জানাল তাঁদের পরিচয় না পেলে সে তাঁদেরকে কিছুই বলবে না। সে নবীকে বললোঃ আপনারা দু’জন কে এটা না জানালে আমি আপনাদেরকে কিছুই বলবো না।”
নবীজি বললেন, “আপনি যখন উভয় বাহিনী সম্পর্কে আমাদের জানাবেন তখন আমরা আপনাকে জানাব আমরা দু’জন কে।”
বৃদ্ধ বললো, “তাহলে তাই হোক” এবং তারপর সে বললো, “আমি সংবাদ পেয়েছি যে মুহাম্মদ এবং তাঁর সাহাবীরা মদীনা থেকে রওনা হয়েছেন বেশ কিছু দিন আগে। আমাকে যে লোকটা সংবাদটা দিয়েছে তার কথা যদি সত্য হয় তাহলে আজকে তাদের এখানে এসে পৌঁছার কথা এবং আমাকে এটাও বলা হয়েছে যে কুরাইশরা অমুক তারিখে তাদের নগরী থেকে রওনা হয়েছে। সুতরাং এই তথ্য সঠিক হলে তাদেরও আজ এখানে এসে পৌঁছার কথা। “ কথা শেষ করে বৃদ্ধ বললো, এবার বলুন আপনারা কে।”
মহানবী বললেন, “আমরা পানি থেকে উদ্ভূত।” এই বলে মহানবী নিজের পরিচয় প্রকাশ না করে তাঁর সাহাবীকে নিয়ে ফিরে আসলেন। এটাই ছিল মহানবীর দেওয়া যুদ্ধের নিয়ম এবং এই নিয়ম অনুসারে সম্ভাব্য সব উপায়ে এমন কি সত্যের বিকৃতি ঘটিয়েও শত্রুদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা যায়েজ, অবশ্য সেটা যদি মুসলমান সেনাবাহিনীর নিরাপত্তার স্বার্থে হয়।
টেকোয়াটারে ফিরে এসে মহানবী শত্রুদের সম্পর্কে আরো তথ্য সংগ্রহের জন্য আরেকটা দল পাঠান। এই দলে ছিলেন মুহাজিরিনদের তিন নেতা আলী বিন আবি তালিব, আয-যুবাইর বিন আল-আওয়াম’ সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস এবং অন্য কয়েকজন সাহাবী। তারা শত্রুদের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য একদম বদরের ঝর্ণা পর্যন্ত চলে যান
[১. যে দশজন বেহেস্তের আশ্বাস পেয়েছিলেন আয-যুবাইর বিন আল-আওয়াম ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। তাঁর মাতার নাম ছিল সাফিয়া বিনতে আব্দুল মুত্তালিব বিন হাশিম বিন আবদ্ মানাফ। তিনি দু’বার অভিপ্রয়ান করেন এবং ৩৬ হিজরীতে ৬৬/৬৭ বছর বয়সে উটের যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে আস-সাবা উপত্যকা অতিক্রমের সময় আমর বিন জারমোজের হাতে নিহত হন।]
মক্কী সেনাবাহিনী সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
প্রহরীরা ঝর্ণার কাছে দু’জন পৌত্তলিককে আটক ক’রে তাঁদের তাবুতে নিয়ে আসে এবং অন্য মহানবী নিজে তাদেরকে জেরা করে শত্রুপক্ষ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেন।
মহানবী পৌত্তলিক বালক দু’টিকে মক্কী বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন যে তারা উপত্যকার অন্য প্রান্তে বালিয়াড়ির ওপারে তাবু ফেলেছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেন, “ওদের সৈন্য সংখ্যা কত?”
তারা বললো, “ওখানে অনেক লোক আছে। নবীজি পুনরায় বললেন, “কতজন? “তারা বললো, “আমরা জানি না।” “ তারা প্রতিদিন কয়টা উট জবেহ করে”? তারা বললো,” “কোন দিন নয়টা, কোন দিন দশটা।”
একথা শুনে মহানবী তাঁর সাহাবীদের দিকে তাকিয়ে বললেন যে মক্কী বাহিনীতে ৯০০ থেকে ১০০০ সৈন্য আছে।
আবার জেরা শুরু করে মহানবী ছেলে দু’টিকে মক্কী বাহিনীর সেনাপতিদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তারা জানাল মক্কী সেনাপতিরা হচ্ছে, উতবা বিন রাবিয়া, তার ভাই শাইবা, আবু জেহেল বিন হিশাম, আবু আল-বখতারী বিন হিশাম, ওমাইয়া বিন খালাপ, আল-আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব[১] সুহাইল বিন আমর, নাবিয়াহ এবং মুন্নাব্বাহ (আল-হাজ্জাজের দুই পুত্র)।
এভাবে শত্রু পক্ষের শক্তি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে মহানবী তাঁর বাহিনীর সেনাপতিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “মক্কা তার মূল্যবান সম্পদগুলিকে আপনাদের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে।”
[১. মহানবীর চাচা আল-আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব সম্পর্কে বিশেষ পরিচিতির প্রয়োজন নেই। তিনি বহু-ঈশ্বরবাদীদের সঙ্গে বদরের যুদ্ধে অংশ নেন এবং বন্দী হন। মহানবী (সঃ) তার সম্পর্কে বলেনঃ “আল আব্বাসকে যে কষ্ট দেয় সে আমাকেই কষ্ট দেয়।” তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মক্কা বিজয়ের (যাতে তিনি অন্যান্য মুসলমানদের সাথে অংশ নেন) কিছু পূর্বে মদীনায় চলে যান। হুনাইনের যুদ্ধে যখন অন্য সব মুসলমান প্রথম আঘাতে পালিয়ে যান তখন তিনিই মহানবীর পাশে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করেন। তিনি ৩২ হিজরীতে মদীনায় মৃত্যু বরণ করেন।]
একটি নিরপেক্ষ কাউন্সিলের দৃষ্টান্ত
দ্বিতীয় হিজরীর পবিত্র রমযান মাসের ১৬ তারিখে মহানবী তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে মক্কী বাহিনী পৌঁছার আগেই বদরের ঝর্ণা দখল করার জন্য সেদিকে অগ্রসর হন।
এই আন্দোলনের সময় এমন একটা ঘটনা ঘটে যার মাধ্যমে মহানবীর গণতান্ত্রিক পদ্ধতির (যদি শব্দটা সঠিক হয়) কার্যকারিতা প্রকাশ পায়। মহানবী তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে বদরের ঝর্ণার কাছে অবস্থান গ্রহণ করেন। তখন তাঁর একজন সেনাপতি আল-হুবাব বিন আল-মুন্দির আল-আনসারী[১] মত প্রকাশ করেন যে সামরিক দৃষ্টিকোন থেকে ঐ জায়গাটা তাবু স্থাপনের জন্য উপযুক্ত নয়। তিনি মহানবীর কাছে জানতে চান যে ঐ স্থানটা তিনি নিজেই নির্বাচন করেছেন নাকি তাদের জন্য ওটা স্বয়ং আল্লাহ্ নিৰ্বাচন করেছেন। মহানবী তখন জবাব দেন যে কৌশলগত গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিবেচনা করে তিনি নিজেই ঐ স্থানটি নির্বাচন করেছেন।
[১. আল-হুবাব বিন আল-মুনধির বিন আল-জামুহ আল-খাযরাজি আল-আনসারী খলিফা ওমরের শাসনামলে পঞ্চাশোর্ধ বয়সে ইন্তেকাল করেন।]
একথা শুনে সামরিক বিশেষজ্ঞ আল-হুবাব বললেনঃ “হে আল্লাহর নবী, এটি তাবু স্থাপনের জন্য উপযুক্ত জায়গা নয়। আপনি বরং আপনার সেনাবাহিনী নিয়ে আরো অগ্রসর হয়ে শত্রুদের ক্যাম্পের কাছাকাছি পানি সরবরাহের উৎসটা দখল করুন। আমরা সেখানে থাকবো, সেখানকার আর সব ঝর্ণা ধ্বংস করে দেব এবং এই ঝর্ণার চারপাশে একটা বড় জলাধার তৈরি করে তার মধ্যে সব পানি ধরে রাখবো। এরপর আমরা আমাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো।। তখন আমাদের পানের জন্য প্রচুর পানি থাকলেও আমাদের শত্রুরা কোন পানি পাবে না।
শত্রুদের গোয়েন্দা তৎপরতা
উপত্যকার অন্য প্রান্তে তাবু স্থাপনকারী কুরাইশ বাহিনী মদীনার সেনাবাহিনীর শক্তি ও অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য তাদের গুপ্তচরদের প্রেরণ করে। এ ধরনের একদল গুপ্ত চরের নেতৃত্ব দেন ওমাইর বিন ওয়াহহাব[২] যিনি খবর আনেন যে মুহাম্মাদের সেনাবাহিনীতে তিন শতাধিক লোক আছেন। এরপর তিনি মুসলমান বাহিনীর পশ্চাদ্ভাগে গিয়ে লক্ষ্য করেন যে প্রয়োজনের মুহূর্তে ব্যবহারের জন্য মুসলমানদের কোন সংরক্ষিত বাহিনী আছে কিনা। এ ধরনের কোন বাহিনী যে নেই এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে তিনি ফিরে যান।
[২. ওমাইর বিন ওয়াহাব বিন আল খালাপ আল-জামহি আল-কারশি ছিলেন অন্যতম কুরাইশ নেতা। বদরের যুদ্ধের পর তিনিই মদীনায় গিয়ে মহানবীকে হত্যা করার চেষ্টা করেন কিন্তু আল্লাহতাকে সুপথে আনে এবং তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং ইসলামের একজন বড় নেতা ও সমর্থক হয়ে যান।]
শত্রুদের দৃষ্টিতে মুসলমান বাহিনী
ওমাইর বিন ওয়াহাব মক্কী বাহিনীর কাছে ফিরে এসে মুসলমান বাহিনীর বর্ণনা দিয়েছিলেন নিম্নরূপঃ
“আমি মৃত্যু ডেকে আনার মত দুর্যোগ দেখে এসেছি। আমি দেখেছি ইয়াথ্রিবের পানি-বহনকারী[১] উটগুলি শ্বাশ্বত মৃত্যুর[২] দিকে ধাবিত হচ্ছে। ওদের বাহিনীর কোন শক্তিও নেই, নিজেদের তরবারি ছাড়া আর কোন আশ্রয়ও নেই। আমার স্থির বিশ্বাস তাদের কোন লোক আপনাদের কাউকে না মেরে মরবে না। আপনাদের এতগুলো লোক নিহত হলে বাকীদের বেঁচে থেকে লাভ কি? অবশ্য এ ব্যপারে আপনারা স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করতে পারেন।”
[১. আল-নাওয়াদেহঃ পানি বহনের কাজে ব্যবহৃত উট।
২. মূল বইতে ব্যবহৃত শব্দের অর্থ হচ্ছে শ্বাশ্বত মৃত্যু।]
মক্কী বাহিনীতে দ্বিতীয় ভাঙ্গন
ওমরাইর বিন ওয়াহ্হাবের কথা শুনে আবারো আবু জেহেলের বিরুদ্ধাচারণ করে মক্কী সৈন্যরা যুদ্ধ না করেই মক্কায় ফিরে যেতে চায়।
এর আগে রাবিগে আল-আখনাস বিন শুরাইক আবু জেহেলের বিরোধিতা করে তার মিত্র বনি জাহরার লোকদের নিয়ে মক্কায় ফিরে গিয়েছিলেন। এবারের বিরোধিতা তার চেয়েও অধিকতর প্রবল ছিল। এই বিরোধিতার নেতৃত্ব দেন বনি আবদ্ শামসের নেতা উৎবাহ বিন রাবিয়া এবং তাকে সমর্থন করেনা হাকিম বিন হাযাম। এই বিরোধিতা প্রকাশ পায় বদরের যুদ্ধের মাত্র দু’একদিন আগে। বিরোধী নেতৃবৃন্দ মদীনার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষের বিরোধিতা করেন এবং অবিলম্বে মক্কায় প্রত্যাবর্তনের দাবি জানান। হাকিম বিন হাযাম[৩] মক্কী বাহিনীর উপস্থিত বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের কাছে গিয়ে তাদের সমর্থনের কথা জানান।
[৩. হাকিম বিন হাযাম বিন খাওয়ালিদ বিন আসাদ বিন আব্দল উযযা। তিনি ছিলেন ‘মুসলমানদের জননী’ বিবি খাদিজার ভ্রাতুষ্পুত্র এবং অন্যতম কুরাইশ নেতা। নবুওয়াতের আগে তিনি ছিলেন মহানবীর বন্ধু। তিনি মক্কা বিজয়ের বছর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি মুয়াইইয়া শাসানামলে ৬০ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।]
বিদ্রোহের প্রধান নেতা
হাকিম বিন হাযাম উৎবাহ বিন রাবিয়া আল-উমাইর কাছে (যিনি বদরের যুদ্ধে প্রথম নিহত হয়েছিলেন) গিয়ে বললেন : “হে আল-ওয়ালিদের পিতা, আপনি কুরাইশদের নেতা। আপনি কি এমন একটা ভাল কাজ করতে চান না যার জন্য আপনি সম্মান পাবেন এবং চির-স্মরণীয় হয়ে থাকবেন?” তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “সেই ভাল কাজটা কি?” হাকিম বললেন, “ভাল কাজটা হচ্ছে সেনাবাহিনী নিয়ে আপনার মক্কায় ফিরে যাওয়া। সেখানে গিয়ে আপনার মিত্র আমর বিন আল-হাদরামির মৃত্যুর ক্ষতিপূরণের টাকাটাও আপনি দিতে পারেন।”
উৎবাহ জবাব দিলেন, “আমি সেটা চেষ্টা করেছি; এবং এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন যে মিত্র হিসেবে আমিই তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেব।” অতঃপর উৎবাহ হাকিমকে পরামর্শ দিলেন আবু জহেলকে বুঝিয়ে তার মতে আনতে, কারণ তিনিই হয়েছিলেন মক্কী বাহিনীর স্ব ঘোষিত সেনাপতি।
সেনাবাহিনীর সঙ্গে উত্তাহর আলাপ
উৎবাহ সেনাবাহিনীর সঙ্গে আলাপ করলেন এবং মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ না করে মক্কায় ফিরে যওয়ার পক্ষে জোর দাবি জানালেন। তিনি বললেন : “হে কুরাইশগণ, আপনারা যদি মুহাম্মদ এবং তার সঙ্গীদের সাথে যুদ্ধ করে তাদের কোন রকম ক্ষতি করেন তাহলে চিরদিনের জন্য আপনারা নিজেরাই বিভক্ত হয়ে পড়বেন, কারণ আপনারা পরস্পর এমন সব লোককে হত্যা করবেন যারা রক্ত সম্পর্কে বাঁধা। অত্রএব আমি আপনাদেরকে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। মুহাম্মদের সঙ্গে অন্যরা লডুক। তারা তাঁকে হত্যা করেলেই আপনাদের উদ্দেশ্য পূরণ হবে। আর মুহাম্মদই যদি সে লড়াইয়ে জয়ী হয় তাহলে পরে আপনারা তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়ে শান্তি চুক্তি করতে পারবেন।
[১. আবদ শামস বিন আবদ মানাফের মিত্র আমর বিন আল-হাদরামি ২য় হিজরীর রজব মাসের শেষ দিন আব্দুল্লাহ্ বিন জাহশের অভিযানের সময় মুসলমানদের হাতে নিহত হন।]
লাল উটের আরোহী
উবার এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই মক্কী বাহিনীকে দেখে মহানবী এই মন্তব্য করেছিলেন যে, “এই লোকদের মধ্যে যদি ভাল কেউ থাকে তাহলে সে হবে লাল উটওয়ালা একজন মানুষ। তারা যদি এই লোকদের কথা শোনে তাহলে ঠিক কাজ করবে।” লাল উটওয়ালা এই লোকটিই ছিলেন উৎবাহ বিন রাবিয়া যিনি শান্তির জন্য সর্বশেষ চেষ্টা করেছিলেন।
শান্তি প্রস্তাবের প্রতি আবু জেহেলের প্রতিক্রিয়া
কিন্তু যে মুহূর্তে আবু জেহেল উৎবা বিন রাবিয়ার শান্তি প্রস্তাব শুনতে পেলেন তখনি তিনি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। তিনি উৎবাকে কাপুরুষ বলে জব্দ করলেন এবং বললেন যে তিনি এই যুদ্ধে তার ছেলে আবু হুদাইফা (বিখ্যাত সাহাবী) নিহত হবে এই ভয়ে যুদ্ধ করতে চাচ্ছেন না। তার কাছে পাঠানো উৎবার দূত হাকিম বিন হাযামের দিকে ঘুরে তিনি আরো বললেনঃ “মুহাম্মদ এবং তার সাহাবীদের দেখে উবার ফুসফুস নিশ্চয়ই ফুলে উঠেছে।[১] মুহাম্মদ এবং আমাদের ব্যাপারটা মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত আমরা কখনোই ফিরবো না।
[১. আরবী বাক্রীতিতে ফুস ফুস ফুলার অর্থ হচ্ছে ভয় পাওয়া।]
উবার একথা বলার কারণ হচ্ছে মুহাম্মদ এবং তার সঙ্গীরা (যাদের মধ্যে উবার ছেলেও আছে) এই যুদ্ধে নিহত হবে। তার ছেলেকে বাঁচাবার জন্য তিনি আপনার এবং অন্যান্যদের মনোবল ভেঙ্গে দিয়ে বলছেন যে যুদ্ধ হবে না।” একথা বলে তিনি রাগে অগ্নিমর্শা হয়ে তার তরবারি বের করলেন এবং তা দিয়ে তার ঘোড়ার পিঠে আঘাত করলেন। এ দেখে আইমা বিন রাহুদা আল-গাফফার[২] বুঝতে পারেন যে আবু জেহেলের উদ্দেশ্য খুব খারাপ। তিনি মন্তব্য করেন : “এটা একটা অশুভ লক্ষণ।”
[২.আইমা বিন রাহ্দা অল-গাফফারী মক্কী বাহিনীর ভোজের জন্য দশটা উট দান করেন এবং পরে তার গোত্র বনি গাফফার থেকে লোক ও অস্ত্র পাঠাবার প্রস্তাব দিয়ে তার ছেলেকে তাদের কাছে পাঠান। কিন্তু তারা তাকে ধন্যবাদ দিয়ে জানায়ঃ “যে কোন বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য আমরা যথেষ্ঠ শক্তিশালী, তবে মুহাম্মদের ধারণা অনুসারে আমাদেরকে যদি ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয় তাহলে কেউ আমাদেরকে সাহায্য করতে পারবে না।]
“উবাহ নিশ্চয়ই একটা কাপুরুষ” আবু জেহেলের এই উক্তি শুনে উৎবাহ মন্তব্য করেন : “খুব শীঘ্রই তিনি জানতে পারবেন কে যুদ্ধকে ভয় পান-তিনি না আমি।”
“এভাবে আল্লাহর ইচ্ছাতেই প্রজ্ঞা ও সুবিবেচেনাকে পরাভূত করে আবেগ আর ঘৃণা। লাল উটওয়ালার বাধা উপেক্ষিত হয়। আবু জেহেল আবারো সবাইকে নিয়ে দুই বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষকে অনিবার্য করে তোলে।
চরম বিদ্বেষ
ইসলাম এবং মুসলমানদের যাবতীয় শত্রুদের মধ্যে আবু জেহেল ছিলেন সবচেয়ে ঘোরতর। মহানবীর মক্কা ত্যাগের পর থেকেই তিনি রাগে জ্বলছিলেন। তিনিই মক্কার পার্লামেন্টে মহানবীকে হত্যার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এজন্য দুই সেনাবাহিনীর আপেক্ষিক শক্তি বিবেচনা করে তিনি একটা সশস্ত্র সংঘর্ষের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে এবং ইসলামী বিপ্লবকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন।
আবু জেহেল এবং আল-আখনাস বিন শুরাইক
আবু জেহেল জানতেন যে মহানবী মুহাম্মদ মিথ্যাবাদী নন এবং তিনি যে শুধুমাত্র হিংসার বশবর্তী হয়েই ইসলামের নবীর বিরোধিতা করেছিলেন তার সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলে তার এবং আখনাস বিন শুরাইকের মধ্যে আলাপে। আ- খনাস বিন শুরাইক তার বনি জাহরার মিত্রদের নিয়ে রাবিগে মক্কী বাহিনী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তিনি একদিন আবু জেহেলকে বলেছিলেনঃ
“আবুল হাকাম, আপনি কি সত্যি বিশ্বাস করেন যে, মুহাম্মদ একজন মিথ্যাবাদী?”
“আমরা যখন তার চরিত্রের বিশুদ্ধতা বিচার করে তাকে “আল-আমিন” উপাধিতে ভুষিত করেছি (কারণ জীবনে তিনি কখনো মিথ্যা কথা বলেননি), তখন ঈশ্বর সম্পর্কে তিনি কিভাবে মিথ্যা কথা বলতে পারেন? তবে ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে, বনি আবদ্ মানাফ যদি পানি সরবরাহ, সরকারী তহবিল, কাবা ঘরের কঞ্চুকীগিরি, পরিষদ এবং নবীত্বের দায়িত্ব পায় তাহলে আমাদের জন্য আর অবশিষ্ট কি থাকে?” [এখানে উল্লেখিত কাজগুলি ছিল : আস-সিকাইয়া বা তীর্থ যাত্রীদের জন্য পানি সরবরাহ; আর-রিফাদা বা জন-কল্যাণ যার দায়িত্ব ছিল তীর্থযাত্রীদের সাহায্য করা এবং তাদেরকে চিকিৎসা সুবিধা দেওয়া; আল-হাযাবা বা কাবাঘরে কঞ্চুকীগিরি’ এবং মাশুরা বা পরিষদ। অনুবাদক]
কাফেলার সঙ্গেও না যুদ্ধের মাঠেও নয়
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে আল-আখনাস বিন শুরাইক যখন রাবিগে মক্কী বাহিনী ত্যাগ করেছিলেন এবং যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ছিলেন তখন আবু সুফিয়ান এ কথা জানতে পেরে বনি যাহরা সম্পর্কে বলেছিলেনঃ “তারা কাফেলার সাথেও নয়, যুদ্ধ ক্ষেত্রেও নয়”।[১] আবু সুফিয়ানের এই মন্তব্য আরবী ভাষায় একটা প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছে। তিনি বলতে চেয়েছিলেন যে বনি যাহরার লোকেরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, কারণ এই যুদ্ধে তাদের কোন কিছু বিপদের সম্মুখীন হতে হয়নি। কাফেলা নিয়ে মক্কায় পৌঁছার পর আবু সুফিয়ান নিজে পবর্তীতে কুরাইশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং বদরে যারা আহত হয়েছিল তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন।
[১.”আল-আখনাস” শব্দের অর্থ হচ্ছে “যিনি (মক্কী সেনাবাহিনী থেকে) হঠে গিয়েছিলেন”। যুদ্ধের ময়দান থেকে চলে যাওয়ার জন্যই তার এই ডাকনাম হয়েছিল।]
যুদ্ধের জন্য আবু জেহেলের অস্থিরতা
আবু জেহেলের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য তিনি দুই নেতাকে (উত্তাহ এবং হাকিম) জব্দ করেন এবং চরমভাবে তাদের শান্তি প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। অবশ্য তিনি এটাও বুঝতে পারেন যে তড়িৎ গতিতে অবিলম্বে কাজ শুরু না করলে আরো ভাঙ্গনের ফলে তার সেনাবাহিনী দূর্বল হয়ে পড়তে পারে। এজন্য মক্কা প্রত্যাবর্তনের প্রস্তাব শুনেই তিনি আমির বিন আল-হাদরামিকে[১] ডেকে পাঠান যার ভাইকে মুসলমানরা আব্দুল্লাহ্ বিন জাশের অভিযানের সময় হত্যা করেছিলেন এবং তাঁকে পরামর্শ দেন মক্কাবাসীকে প্রতিশোধ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার জন্য।
[১. ইনি ছিলেন বদরের যুদ্ধে নিহতদের একজন।]
আল-হাদরামির যুদ্ধের ডংকা
কথিত আছে আবু জেহেল ইবনে আল-হাদরামিকে বলেছিলেনঃ “হে আল-হাদরামির পুত্র, আপনার মিত্র উৎবাহ বিন রাবিয়া শত্রুকে সামনে রেখে সেনাবাহিনীকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। উঠুন এবং তাদেরকে আপনার ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে উদ্বুদ্ধ করুন।”
উদ্ধত কুরাইশ নেতার অনুমান ঠিকই ছিল। ইবনে আল-হাদরামি শয়তানের দ্বারা প্ররোচিত হয়েছিলেন। মক্কী সেনাবাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে তিনি চিৎকার করে বললেন : “ওয়া ওমারাহ্, ওয়া ওমারাহ” (ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য প্রতিশোধের ডাক দিয়ে)। অজ্ঞতার যুগে এই একটি মাত্র বাক্যই লোকেরা প্রতিশোধের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করতো এবং মক্কী বাহিনীতে যখন একটা থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছিল তখন যুদ্ধ লাগানোর জন্য এই একটি মাত্র বাক্যই যথেষ্ট ছিল।
এই আহবানের একটা তাৎক্ষণিক ফল হয়েছিল;পৌত্তলিক মক্কী যোদ্ধা আবেগ-তাড়িত হয়ে তক্ষুণি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আবু জেহেল শান্তি প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করতে সক্ষম হয়, অথচ এই শান্তিবাদীরাই ছিলেন তার সেনাবাহিনীর জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। আবু জেহেল তাদেরকে যুদ্ধে টেনে আনেন। তার একগুয়েমির জন্যই যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। সর্বশেষ বিদ্রোহের নেতা উৎবাহ বিন রাবিয়া সম্পূর্ণভাবে অস্ত্র-সজ্জিত হয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। আবু জেহেলকে সম্বোধন করে তাকে বলতে শুনা গিয়েছিল; খুব শীগগিরই জানা যাবে কে কাপুরুষ।”
মহানবীর প্রহরীদল
আল-হুবাব বিন আল-মুন্ধির কর্তৃক নির্বাচিত স্থানে তাবু স্থাপনের পর সা’দ বিন মুয়াদ মহানবীকে পরামর্শ দেন যে তিনি যেখান থেকে সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিতে পারবেন এমন জায়গায় একটা কুঁড়েঘর নির্মাণ করা উচিত। পরাজয়ের ক্ষেত্রে জরুরী সতকর্তা এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা হিসেবে আনসার নেতা আরো প্রস্তাব দেন যে মহানবীর এই সদর দপ্তর এমন একটা নিরাপদ জায়গায় নির্মাণ করতে হবে যেখান থেকে (মুসলিম বাহিনী পরাজিত হলে) তিনি মদীনায় ফিরে যেতে পারেন।
মহানবীর সদর দপ্তর
সা’দ বিন মুয়াদ নবীজিকে বললেন, “হে আল্লাহর দূত, আমরা কি শত্রুদের সঙ্গে লড়াইয়ের আগে আপনার জন্য একটা কুঁড়ে ঘর নির্মাণ করে তা পাহারা দিতে পারি? আল্লাহ্ যদি আমাদেরকে বিজয়ের সম্মান দিতেন তাহলে আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জন করতাম। কিন্তু যদি বিপরীত কিছু ঘটে (অর্থাৎ আমরা যদি পরাজিত হই) তাহলে আপনি আপনার প্রহরীদের নিয়ে ফিরে গিয়ে নগরীতে ফেলে আসা আমাদের জনগণের সঙ্গে মিলিত হতে পারবেন। আমাদের পরে তারাই হবে আপনার সাহায্যকারী, কারণ হে আল্লাহর দূত, তারা সবাই আমাদের মতই আপনাকে ভালবাসে। তারা যদি দেখে আপনি কোন জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধ করছেন তাহলে তারাও ঘরে বসে না থেকে আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করবে।”[১]
[১. আইয়াম উল-আরব ফিল ইসলাম নামক বই দ্রষ্টব্য, পৃষ্ঠা-১২]
পরামর্শটি নবীজির পছন্দ হওয়ায় তিনি আনসার প্রধানকে আশির্বাদ করলেন। যুদ্ধক্ষেত্রের উত্তর-পূর্ব দিকে একটা সুবিধাজনক উঁচু জায়গায় নবীজির প্রধান দপ্তর হিসেবে একটা কুঁড়েঘর নির্মিত হলো।
নবীজি ও তাঁর সদর দপ্তরের পাহারার কাজে সাদ বিন মুয়াদের নেতত্বে একদল যুবক আনসারকে নির্বাচিত করা হলো।
যুদ্ধের একটু আগে আবু জেহেলের প্রার্থনা
এ সময় কুরাইশ বাহিনী আক্রমণের জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত ছিল। আবু জেহেল আবার সামনে এসে মুসলমানদেরকে ধ্বংস করার নির্দেশ দিলেন। ইবনে ইসহাক লিপিবদ্ধ করেছেন যে যুদ্ধের সামান্য আগে আবু জেহেল ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে বলেছিলেন : “হে ঈশ্বর, যে ব্যক্তি রক্ত- সম্পর্ককে ছিন্ন করেছে এবং যে একটা উদ্ভূৎ বাণী প্রচার করছে তাকে তুমি ধ্বংস কর। সে যেন কাল সকালেই ধ্বংস হয়।”
বদরের উদ্দেশ্যে মক্কা ত্যাগের সময় মক্কাবাসীরা কা’বার কাপড় ধরে প্রার্থনা করেছিল; “হে ঈশ্বর, আমাদের মধ্যে যারা সুনিয়ন্ত্রিত, অধিকতর শক্তিশালী, অধিকতর সম্মানী এবং শ্রেষ্ঠতর ধর্মে বিশ্বাসী তাদেরই জয় হোক।” এই প্রার্থনার জবাব তারা পেয়েছিল, অর্থাৎ যুদ্ধে তারা পরাজিত হয়েছিল এবং মহানবী বিজয়ী হয়েছিলেন। এ সম্পর্কে কুরআনের আয়াত হচ্ছে; “(হে কুরাইশগণ) তোমারা যদি বিচার চেয়ে থাক তাহলে বিচার তোমাদের কাছে এসে গেছে।”[১]
[১. আল কুরআন VIII – 19]
যুদ্ধের আগে সেনাবাহিনীর প্রতি নবীজির ভাষণ
যুদ্ধের সামান্য আগে মহানবী মুসলমানদের সম্বোধন করে বলেন, “আল্লাহর নামে (যার হাতে মুহাম্মদের আত্মা) কসম, তোমরা যারা আজকে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিহত হবে এবং শত্রুর প্রতি পৃষ্ঠ প্রদর্শন না করে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে তাদের জন্য নিশ্চিত পুরস্কার হবে বেহেশ্ত্।”[২]
মহানবীর এই ভাষণের সময় আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হয়। এই বিশ্বাসের বলেই মুসলমানরা সব রকম বাধা বিপত্তি অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। বনি সালমার ওমাইর বিন আল-হাম্মাম[৩] মুসলমান বাহিনীর নেতা হয়ে তার হাতের খেজুর খাচ্ছিলেন। কিন্তু নবীজির বক্তব্য শুনার পর তিনি হাতের খেজুরগুলি ফেলে দিয়ে বললেনঃ
[২. আইয়ামুল আরব দ্রষ্টব্য পৃষ্ঠা- ১৬
৩. ওমাইর বিন আল-হাম্মাম ছিলেন আল-জামাওহ্ আল-আনসারী আস-সালামীর পুত্র। তিনিই প্রথম আল্লাহর পথে নিহত হন। এটাও কথিত আছে যে এই যুদ্ধে প্রথম নিহত হয়েছিলেন ওমার বিন আল-খাত্তাবের মুক্ত ক্রীতদাস মাজে।]
“বেহেশ্ত্ এবং আমার মধ্যে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। আমি অবশ্যই যুদ্ধে গিয়ে ঐ অবিশ্বাসীদের খতম করবো” একথা বলেই তিনি তরবারি বের করে পৌত্তলিকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং যুদ্ধ করতে করতে তাদের হাতে নিহত হলেন।
প্রতিশোধের জন্য মহানবীর শরীর উন্মোচন
মুসলমান সেনাবাহিনীকে পরীক্ষা করার সময় সাওয়াদ বিন গাজিয়াকে লাইনে না দেখতে পেয়ে মহানবী তাকে হাতের লাঠি দিয়ে ঘা দিয়ে বলেন, “হে সাওয়াদ, আপনি লাইনে দাঁড়ান।” সাওয়াদ তখন প্রতিবাদ ক’রে বললেন, “হে আল্লাহর দূত, আপনি আমকে ব্যথা দিয়েছেন; আল্লাহ্ কিন্তু আপনাকে সত্য ও ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসেবে পাঠিয়েছেন।” এই বলে সাওয়াদ তাঁর কাছে ক্ষতিপূরণ দাবী করলেন। এ কথা শুনে মহানবী তৎক্ষণাৎ তাঁর শরীর উন্মোচন ক’রে সাওয়াদকে বললেন, “এই নিন, প্রতিশোধ নিন। আমি যেভাবে আপনাকে আঘাত করেছিলাম আপনিও আমাকে সেভাবে আঘাত করুন।”
কিন্তু মহানবীকে আঘাত না ক’রে সাওয়াদ তাঁর পবিত্র দেহে চুমু দিতে লাগলেন। নবীজি বললেন, “সাওয়াদ, আপনি এটা করলেন কেন?” তিনি জবাব দিলেন, “হে আল্লাহর দূত, আপনি তো জানেন, যুদ্ধ আসন্ন। সুতরাং আমার জীবনের শেষ সময়ে আমি আমার শরীর দিয়ে আপনার শরীরকে স্পর্শ করতে চেয়েছিলাম। “ তখন নবীজি তাকে আশির্বাদ করলেন।
মহানবী যখন নিশ্চিত হলেন যে মুসলমানরা যুদ্ধের জন্য যথাযথভাবে প্রস্তুত, তখন তিনি এই মর্মে আদেশ জারী করলেন যে তাঁরা প্রথমে যুদ্ধ শুরু করবেন না। তিনি আরো বললেন, “শত্রুরা যদি আপনাদেরকে ঘিরে ফেলে তখন আপনারা তীর দিয়ে তাদের মোকাবিলা করবেন।”
এরপর মহানবী তাঁর বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা আবু বকর আস-সিদ্দিকীর সাথে তাঁর হেড কোয়ার্টারে ফিরে গেলেন। হেড-কোয়ার্টারের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিলেন সাদ বিন মুয়াদের নেতৃত্বে একদল নির্বাচিত আনসার।
এরপর থেকেই অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপ হতে থাকে এবং যুদ্ধের ময়দানে মৃতে্যুর ছায়া নেমে আসে। পরস্পরকে মোকাবিলার জন্য উভয় বাহিনী-সামনে অগ্রসর হয়। স্বাভাবিকভাবেই মহানবী এটা ভেবে উদ্বিগ্ন ছিলেন যে এই যুদ্ধের উপরই মুসলমানদের ভাগ্য এবং ধর্ম নির্ভর করছে। মুসলমানদের পরাজয়ের অর্থ হচ্ছে ইসলামের শ্বাশত পরাজয়। তিনি হাঁটু গেড়ে বসে তাঁর প্রভুকে বললেন, “হে আল্লাহ্, মুসলমানদের এই ক্ষুদ্র দলটি ধ্বংস হলে পৃথিবীতে তোমার উপাসনার জন্য কেউ অবশিষ্ট থাকবে না।”
যুদ্ধের প্রথম বিস্ফোরণ
মক্কী বাহিনীর প্রথম নিহত ব্যক্তি ছিলেন অত্যন্ত জঘন্য চরিত্রের অধিকারী, আল-আসওয়াদ বিন আব্দ আল-আসাদ আল-মাখজুমি। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। যে, হয় তিনি মুসলমান অধিকৃত ঝর্ণাটিকে ধ্বংস করবেন অথবা তা করতে গিয়ে জীবন দেবেন।
তার বাহিনীকে রেখে তিনি একাই উদ্ধত গতিতে ঝর্ণাটিকে ধ্বংস করতে অগ্রসর হন। কিন্তু জলাধারের কাছে পৌঁছার আগেই হামযা[১] বিন আব্দুল মুত্তালিব তাঁর তরবারির এক আঘাতে তার একটি পা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন ক’রে ফেলেন। কিন্তু তার একগুয়েমি এতই প্রখর ছিল যে একটা পা হারিয়েও তিনি হামাগুলি দিয়েই জলাধারের দিকে এগুতে থাকেন। তখন হামযা এসে আরেক আঘাতে তাকে হত্যা করেন।
তার এই মৃত্যুই বদরের যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে তোলে।
সর্ব প্রথম একই বংশের তিন জন সর্বশ্রেষ্ঠ কুরাইশ যোদ্ধা মুসলমানদেরকে এক-এক লড়াইয়ে আহবান জানান। এরা ছিলেন শাইবা বিন রাবিয়া, উৎবা বিন রাবিয়া এবং তার ছেলে আল-ওয়ালিদ বিন উবা। তারা ছিলেন মহানবীর প্র-পিতামহ আব্দ মানাফের বংশধর।
এরা তিন জন দুই সেনাবাহিনীর মাঝখানে এসে মুসলমানদের এক-এক যুদ্ধে আহবান জানালে তাদের আহবানে সাড়া দেন তিন জন আনসার যুবক-আফরার পুত্র আউফ এবং মুয়াইদ[২] এবং আব্দুল্লাহ্ বিন রাওয়াহা।[৩] কিন্তু কুরাইশত্রয় তখন তাঁদের আনসার পরিচয় পেয়ে তাঁদের সঙ্গে লড়াই করতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ তাদের কথা ছিল তারা তাদের নিজেদের লোকের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন। আনসারত্রয় তখন ফিরে আসনে।
[১. হামযা বিন আব্দুল মুত্তালিব বিন হাশিম বিন আব্দ মানাফ ছিলেন নবীজির চাচা এবং দুধ ভাই। তাঁরা দু’জনেই আবু লাহাবের মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রীতদাসী থাউবিয়ার স্তন্যপান করেছিলেন। অত্যন্ত সাহসী এই ব্যক্তি ইসলামের প্রথম দিকেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি মহানবীর সঙ্গে থেকে সব যুদ্ধে অংশ নেন এবং অবশেষে ওহুদের যুদ্ধে জনৈক নিগ্রো ক্রীতদাস হাবাশির হাতে নিহত হন।
২. আউফ এবং মুয়াইদ বদরের যুদ্ধে নিহত হন। কিন্তু মুয়াইদ ছিলেন আবু জেহেলের হত্যাকারীদের একজন।
৩. আব্দুল্লাহ্ বিন রাওয়াহা বিন থালাবা আল-খাসরাজি আল-আনসারী ছিলেন প্রথম দিকেই ইসলাম গ্রহণকারীদের একজন এবং মিনায় আকাবার প্রতিজ্ঞা অনুষ্ঠানের সময় নবীজি কর্তৃক নির্বাচিত ১২ জন শিষ্যের একজন। তিনি রোমানদের বিরুদ্ধে মুতার যুদ্ধে মুসলমান বাহিনীর নেতৃত্ব দেন এবং ঐ যুদ্ধে নিহত হন।]
যুদ্ধে একটি পরিবারের ধ্বংস
কুরাইশ যোদ্ধাদের আকঙ্খার কথা শুনে মহানবী বনি আব্দ্ মানাফ গোত্রের তিনজন কুরাইশ মুসলমান হামযা বিন আব্দুল মুত্তালিব, ওবাইদা বিন আল-হারিস[১] এবং আলী বিন আবি তালিবকে তাদের রক্তের সম্পর্কের প্রতিপক্ষদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য পাঠালেন। মহানবীর কথায় এই তিন জন মুসলমান সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে গেলেন। কুরাইশ যোদ্ধারা তাঁদের পরিচয় পেয়ে এই বলে সন্তোষ প্রকাশ করলেন : “হ্যাঁ, আপনারাই আমাদের সমকক্ষ এবং সম্ভ্রান্ত বংশীয়।”
[১. ওবায়দা বিন আল-হারিস আল-মুত্তালিব বিন আব্দ মানাফ ছিলেন ইসলামের প্রথম সারির বিশ্বাসীদের একজন। বনি আব্দ মানাফের একজন নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় পতাকাবাহী মুসলমান। এই এক এক যুদ্ধে তিনি আহত হন এবং মুসলিম বাহিনীর মদীনা প্রত্যাবর্তনের পথে আস-সাফরা উপত্যকায় মৃত্যু বরণ করেন।]
এরপর শুরু হলো এক-এক যুদ্ধ। যোদ্ধাদের প্রত্যেকে নিজ নিজ প্রতিপক্ষ নির্বাচন করে নিলেন। আল-ওয়ালিদ বেছে নিলেন আলীকে (এরা ছিলেন কনিষ্ঠতম যোদ্ধা); ওবাইদা লড়লেন শায়বার সঙ্গে এবং হামযা লড়লেন উবার সঙ্গে।
আলী সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর প্রতিপক্ষ আল-ওয়ালিদকে নিহত করেন। একইভাবে হামযাও উৎবাহকে খতম করেন। কিন্তু ওবায়দা (সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ) এবং শায়বা পরস্পরকে মারাত্মকভাবে আঘাত করতে থাকেন। শায়বা নিহত হওয়ার পর আলী এবং হামযা ওবায়দাকে মুসলমান ক্যাম্পে নিয়ে আসেন। তখন তার উরুতে রক্ত ঝরছিল। একটু পরেই মহানবীর পায়ে মাথা রেখে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে তিনি বলেন, “হে আল্লাহর দূত, আবু তালিব যদি বেঁচে থাকতেন এবং আমাকে এই অবস্থায় দেখতেন। তাহলে তিনি আমার মধ্যে তার পংক্তির সত্য প্রতিচ্ছবি দেখতে পেতেন :
“এবং আমরা তাকে রক্ষা করবো এবং রক্ষা করতে করতে আমরা তাঁর পাশে মরে যাব; আমরা আমাদের স্ত্রী-পুত্রদের কথা কিছু ভাববো না।”
অশুভ শুরু
পৌত্তলিকদের জন্য দ্বন্দ্ব যুদ্ধটা ছিল একটা অশুভ শুরু, কারণ এই যুদ্ধে প্রথমেই তারা তাদের সর্বোত্তম তিন জন যোদ্ধাকে হারিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষেই মক্কী বাহিনীর জন্য এটি ছিল একটা চরম আঘাত।
সাধারণ আক্রমণ
দ্বন্দ্বযুদ্ধে হেরে অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ মক্কী বাহিনী তাদের সমস্ত শক্তি নিয়ে মুসলমানদের আক্রমণ করে। মুসলমানদের দিকে প্রথমে তারা তীর ছুঁড়ে মারে এবং পরে তরবারি উঁচিয়ে তাঁদের দিকে অগ্রসর হয়।
মুসলমানদের আত্মরক্ষামূলক ভূমিকা
মুসলমানরা নির্দিষ্ট জায়গায় মক্কী সৈন্যদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন, কারণ তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল মহানবীর আদেশ ছাড়া তারা মক্কীদের আক্রমণ করতে পারবেন না এবং শত্রুদের দ্বারা অবরুদ্ধ হলেই কেবল তীর ছুঁড়তে পারবেন। মহানবীর এই বিচক্ষণ নির্দেশই মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি করেছিল এবং প্রতিপক্ষকে দূর্বল করে দিয়েছিল।
আত্মরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করে মুসলমান সৈন্যরা কুরাইশ বাহিনীর প্রচন্ডতা কমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকেন। কুরাইশরা একের পর এক আক্রমণ রচনা করে প্রচন্ডভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয় কিন্তু মুসলমানদের কোনই ক্ষতি করতে পারেনা।
পাল্টা আক্রমণ
প্রতিপক্ষের শক্তি শেষ হয়ে আসলে মহানবী মুসলমান সৈন্যকে পাল্টা আক্রমণের নির্দেশ দেন। এই দ্রুত আক্রমণে যুদ্ধের মাত্রা প্রসারিত হয়। মুসলমান সৈন্যরা মক্কীদেরকে পিছু হঠতে বাধ্য করেন। যুদ্ধের প্রচন্ডতার মধ্যে মহানবী তাঁর সদর দপ্তর থেকে তাঁর সাহসী যোদ্ধাদের এবং তাদের সেনাপতিদের অবলোকন করেন এবং আশা ও উদ্বিগ্নতার মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় আন্দোলিত হন।
আল-বুখারীর বর্ণনা অনুসারে যুদ্ধের পূর্ণ প্রচন্ডতার মধ্যে মহানবী আল্লাহকে বলেছিলেন, “হে আল্লাহ্, তুমি তোমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা কর। হে আল্লাহ্ আমাদের এই ক্ষুদ্র দলটি ধ্বংস হয়ে গেলে তোমার উপাসনা করার কোন লোক অবশিষ্ট থাকবে না।” মহানবীর সঙ্গে অবস্থানকারী আবু বকর তাঁর হাত ধরে বলেছিলেন, “হে আল্লাহর দূত, আল্লাহ্ আপনার প্রার্থনা শুনেছেন। এবং তিনি অবশ্যই তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন।”
ইবনে ইসহাক বলেন : অতঃপর মহানবী তাঁর কুটিরে ঘুমিয়ে পড়লেন এবং একটু পর ঘুম থেকে উঠে আবু বকরকে বললেন, “আনন্দ করুন। আল্লাহর সাহায্য এসে গেছে। ধুলার মেঘের মধ্য দিয়ে জিব্রাইল তার ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে আসছে।”
মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য এই যুদ্ধে অবশ্যই ফেরেস্তারা অংশগ্রহণ করেছিল। কুরআনে উল্লেখ আছে, “তুমি যখন তোমার প্রভুর সাহায্য চেয়েছিলে, তিনি তখন এই বলে তোমার প্রার্থনার জবাব দিয়েছিলেনঃ আমি তোমাকে এক সহস্র ফেরেস্তা দিয়ে সাহায্য করবো। আল্লাহ্ এই শুভ সংবাদ দিয়েছিলেন এই জন্য যাতে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার। বিজয় আসে শুধুমাত্র আল্লাহর সহযোগিতায়। দেখ, আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান এবং জ্ঞানী।”[১]
[১. আল-কুরআন. VIII : ৯-১০]
এ থেকে বুঝা যায় যে, প্রকৃত যুদ্ধে ফেরেস্তারা অংশগ্রহণ করেনি। তারা এসেছিল শুধু মুসলমানদের মনোবল বৃদ্ধি করার জন্য। কুরআনের এই আয়াতটি থেকে এটাই বুঝা যায়ঃ “আল্লাহ্ শুধুমাত্র শুভ সংবাদ হিসেবে এটা বলেছিলেন, যাতে করে তোমার মনে কোন দুশ্চিন্তা না থাকে।”
যুদ্ধের সময় মহানবী
যুদ্ধের সময় মহানবীকে এতে সম্পূর্ণভাবে জড়িত দেখা যায়। নিজস্ব গার্ড এবং সঙ্গীদের নিয়ে তিনি মুসলমানদের নেতৃত্ব দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যান এবং সেখানে তারা তাদের পথের সব শত্রুসেনাকেই খতম করেন। মহানবী নিজে অত্যন্ত নির্ভীকভাবে যুদ্ধ করেন এবং কুরআনের এই আয়াতটি আবৃত্তি করেন : “শত্রুরা সবাই পরাজিত হবে এবং পালাবে। তথাপি, তাদের জন্য ধ্বংসের সময় অপেক্ষা করবে এবং সেই সময়টা তাদের পার্থিব ব্যর্থতার চেয়ে আরো বেশী ভয়াবহ হবে।”
চরম পরাজয়
প্রচন্ড এবং ভয়াবহ একটা যুদ্ধের পর পৌত্তলিক সেনাবহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং বিশৃঙ্খল অবস্থায় এদিক-সেদিক পলায়ন করে। তাদের সমস্ত প্রতিরোধ তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়ে। যুদ্ধের শেষ দিকে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পালাতে শুরু করে। মুসলমান বাহিনী তখন তাদের ধাওয়া করে হত্যা কিংবা বন্দী করতে থাকে। জুলুমবাজ পৌত্তলিক শক্তির এহেন ছত্রভঙ্গ অবস্থা দেখে মহানবী চীৎকার করে বলেন, “অবিশ্বাসীদের মুখমন্ডল বিকৃত হয়ে যাক!”
আবু জেহেলের অনমনীয়তা এবং ঘৃণা
পৌত্তলিক বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে আবু জেহেল তাদেরকে একত্রিত করতে চেষ্টা করেন। তিনি ঘৃণাভরে উদ্ধত কণ্ঠে তাদের প্রতি আহবান জানিয়ে বললেন, “সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যান। এই পাহাড়ী এলাকায় মুহাম্মদ এবং তাঁর সঙ্গীদের একটা ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত আমরা কিছুতেই ফিরে যাব না।” যথার্থ সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই যুদ্ধে আবু জেহেলের সাহসিকতাকে হালকাভাবে উপেক্ষা করা যায় না। রণে ভঙ্গ না দিয়ে ছোট্ট একটা দল নিয়েই তিনি তার শেষ তাসটি খেলতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মুসলিম বাহিনীর বর্ধমান চাপের মুখে তিনি অসহায় হয়ে পড়েন তারা সম্পূর্ণভাবে বিশৃঙ্খল হয়ে পরাজয় মেনে পালিয়ে যায় এবং মুসলমানরা “আল্লাহ্ এক; আল্লাহ্ এক” ধ্বনি দিতে দিতে তাদের পিছু নেন। যিনি আবু জেহেলকে হত্যা করেন
আবু জেহেলকে হত্যা করেছিলেন মুয়াদ বিন আমর[১] বিন আল-জামুহ্ আল-আনসারী। তিনি দেখতে পান একদল বল্লমধারী লোক বল্লমের ছাতা বানিয়ে আবু জেহেলকে পাহার দিচ্ছে। মুয়াদ তখন সুযোগের অপেক্ষা করেন। কয়েকজন বল্লমধারী তাকে অরক্ষিত অবস্থায় রেখে মৃত্যু বরণ করলে মুয়াদের সুযোগ এসে যায়। তিনি আবু জেহেলের উপর বাজ পাখির মত ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং তরবারির এক আঘাতেই একটি পা কেটে ফেলে রক্তস্নাত মাটির উপর ফেলে দেন।[২]
[১. ইনি ছিলেন আকাবার প্রতিশ্রুতি প্রত্যক্ষকারী আনসারদের একজন।
২. ইবনু ইসহাকের মতে মুয়াদ বিন আমর বিন আল-জামুহ বলেন : আমি কয়েকজন লোককে বলতে শুনেছিলাম যে আবু জেহেলকে তার অনেক সৈন্য ঘিরে রেখেছে। লোকজন বলছিল আবুল হাকামের কাছে পৌঁছা অসম্ভব ব্যাপার। আমি তখন সিদ্ধান্ত নিলাম যে করেই হোক আবু জেহেলের কাছে পৌঁছতে হবে। অবশেষে যখন আমি তাকে আমার নাগালেন মধ্যে পেলাম তখনই তার একটা পা আমি কেটে ফেললাম। আবু জেহেলের দেহ তখন খেজুরের বিচির মত মাটিতে পড়ে গেল। এরপর তার ছেলে আকরাম এসে আমার কাঁধে আঘাত করে এবং আমার বাহু কেটে ফেলে। কর্তিত বাহু কাঁধে ঝুলে থাকায় লড়াই করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। তবু ঐ বাহুটি পিছনে রেখে আমি লড়াই চালিয়ে যাই। কিন্তু বেদনাটা অসহ্য হয়ে পড়ে এবং আমি তখন কর্তিত বাহুটা পায়ের নীচে দিয়ে ছিঁড়ে ফেলি। এরপর আহত অবস্থায় পড়ে থাকা আবু জেহেলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মুয়াইদ বিন আফরা তাকে বর্শা দিয়ে আবার আঘাত করেন এবং তিনি যখন চলে যান তখনও আবু জেহেল জীবিত ছিলেন।]
আবু জেহেলের পুত্র আকরাম[১] তখন পাশ থেকে এসে ইবনু আল-জামুর কাঁধে আঘাত করে তার একটা বাহু কেটে ফেলে। অসমসাহসী এই মুসলমান যোদ্ধাটি তখন এক হাতেই যুদ্ধ চালিয়ে যান। তিনি তৃতীয় খলিফা ওসমানের সময়কাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।
১. পিতা আবু জেহেলের মত আকরামও আল্লাহর নবীর একজন ঘোরতার শত্রু ছিল। যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য মক্কীদের উদ্বুদ্ধ করে ওহুদের যুদ্ধ সংঘটিত করেছিল আকরাম ছিল তাদেরও একজন। মক্কা বিজয়ের পর তাকে বহিস্কৃত ঘোষণা করলে সে ইয়েমেনে পালিয়ে যায়। কিন্তু কিছুদিন পর মক্কায় ফিরে আসলে নবীজি তাকে ক্ষমা করে দেন। পরবর্তীতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং পরবর্তী যুদ্ধগুলিতে তিনি ইসলামের একজন প্রখ্যাত বীর হিসেবে আখ্যায়িত হন। তিনি অনেক সামরিক অভিযানের নেতৃত্ব দেন। তিনি ইয়ারমুকের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এই যুদ্ধে রোমান বাহিনীর ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে মুসলমান সৈন্যদের মধ্যে দূর্বলতার লক্ষণ দেখা দিলে তিনি এমন স্বেচ্ছাসেবীদের আহবান জানান যারা ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। তিনি বলেন : তার ডাকে সাড়া দিয়ে চার শত লোক এগিয়ে আসেন এবং একসঙ্গে রোমানদের আক্রমণ করেন। আকরাম সহ এদের সবাই নিহত হন কিন্তু তাদের আত্ম-ত্যাগের ফলশ্রুতিতেই মুসলমানদের বিজয় অর্জিত হয়। এটি ঘটেছিল ওমরের শাসনামলের পঞ্চদশ বছরে।]
ভীত-বিহবল মক্কী সৈন্যরা আবু জেহেলকে তার ভাগ্যের হাতে সম্পূৰ্ণ করে পালাতে থাকে। একটু পরে মুয়াইদ বিন আফরা আবু জেহেলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার বর্শা দিয়ে আবার আঘাত করেন। এর কিছুক্ষণ পরেই আবু জেহেলের মৃত্যু হয়।
এভাবেই পৌত্তলিক বাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়। সাধারণ সৈন্যদের কাছ থেকে তাদের সেনাপতিরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শিকারীর তাড়া খাওয়া বন্য হরিণের মত তারা সবাই পালাতে থাকে।
আবু জেহেলের নির্বুদ্ধিতা
মক্কী বাহিনীর লজ্জাস্কর পরাজয়ের মাধ্যমে এভাবেই কুরাইশগণ আবু জেহেলের বোকামী ও ঔদ্ধত্যের তিক্ত ফল ভোগ করে। তাদের সত্তর জন সেনা নিহত হয় এবং আরো সত্তর জন মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়। এভাবে তারা সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত হয়।
বনি হাশিমের বন্দীরা
মুসলমানদের হাতে বন্দী কুরাইশদের মধ্যে কিছু লোক ছিল বনি হাশিম গোত্রের। এরা নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধে নামতে বাধ্য হয়েছিল। হাশেমী বন্দীদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন নবীজির নিকট আত্নীয় আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব। বনি হাশিমের এই বন্দীদের ব্যাপারে নবীজির নির্দেশ ছিল এদের কাউকেই যেন মুসলমানরা হত্যা না করেন। তিনি বলেছিলেনঃ “আমি জানি বনি হাশিমের কিছু লোক এবং অন্যান্য কয়েকজনকে জোরপূর্বক যুদ্ধে নামানো হয়েছে। এজন্য তাদেরকে যুদ্ধের ময়দানে দেখতে পেলে আপনারা হত্যা করবেন না। সেই সাথে আবুল বখতারি বিন হিশামকেও না।”
পুত্রের হাতে পিতা নিহত
নবীজির এই নির্দেশ শুনে আবু হুদাইফা[১] বিন উবাহ বিন রাবিয়াহ নামের একজন যোদ্ধা হতাশ হয়ে বলেছিলেন, “আব্বাসকে না মেরে আমাদেরকে আমাদের পিতা, ভ্রাতা এবং আত্নীয়দের মারতে হবে? আল্লার দোহাই, আমার সামনে পড়লে আমি তাকে অবশ্যই আঘাত করবো।” এই যুদ্ধে প্রথম মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছিলেন আবু হুদাইফার পিতা উৎবাহ্ বিন রাবিয়াহ্, তার চাচা শায়বা এবং চাচাতো ভাই আল-ওয়ালিদ।
মহানবী যখন আবু হুদাইফার কথাগুলো শুনতে পেলেন তখন তিনি ওমর[২] বিন আল-খাত্তবের উপস্থিতিতে তাকে বললেন, “আবু-হুদাইফা! আপনি কি আল্লাহর নবীর চাচার বিরুদ্ধে হাত তুলবেন?” আবু হুদাইফা ভন্ড প্রমাণিত হওয়ায় তাকে হত্যা করার জন্য ওমর নবীজির আদেশ চাইলেন। কিন্তু নবীজি আবু হুদাইফাকে আঘাত করতে কাউকেই অনুমতি দেননি।
[১. আবু হুদাইফার নাম ছিল হাশিম এবং তিনি হাশিম বিন উবাহ্ বিন রাবিয়াহ্ বিন আব্দ শামস্ বিন আব্দ মানাফ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ইসলামে বিশ্বাসীদের মধ্যে প্রথম সারির লোক ছিলেন। তিনি দু’বার হিযরত করেন। তিনি ছিলেন দীর্ঘ দেহ ও সাদা চামড়ার অধিকারী। আল-ইয়ামামায় দলত্যাগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে শাহাদৎ বরণ করেন।
২. ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা এবং ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ওমর বিন আল-খাত্তাব বিন নুফাইল আল-আদুই আল-কুরাইশি হাতির বছরের তের বছর পর জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ১৩ হিজরিতে আবু বকরের স্থলাভিষিক্ত হন। তাঁর খোদাভক্তি ছিল অনুকরণীয় এবং চরিত্র ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। একদিন এক জামাতের নেতৃত্ব দেওয়ার সময় তিনি মুগিরা বিন শুয়াবা ফিরোজ ওরফে আবু লুলু নামের একজন পারসী -দাসের হাতে নিহত হন। আবু লুলু মসজিদে নামাযরত আরো তেরজনকে আহত করেছিল যাদের মধ্যে দু’জন মৃত্য বরণ করেছিলেন। অবশ্য আবু লুলুকেও পরে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল।]
আবু হুদাইফা তার কথার জন্য পরে অনুশোচনা করেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, “ এই ঘটনার পর আমি কখনোই স্বস্তি পাইনি। একমাত্র শাহাদাত বরণই এই কলংক দূর করতে পারে।”
একজন অমুসলিমের দয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা
নবীজির সব নির্দেশ পরিপূর্ণভাবে পালন করা হয়। মুসলমানরা পৌত্তলিক বাহিনীর কোন হাশেমীকেই হত্যা করলেন না। তবে তাদেরকে বন্দী করে বেঁধে অন্যান্য বন্দীদের সঙ্গে মদীনায় নিয়ে যাওয়া হয়, কারণ এটি করতে নবীজি নিষেধ করেননি।
হাশেমী বংশের নন এমন লোকদের মধ্যে একমাত্র আবুল বখতারি বিন হিশামকেই মহানবী না মারার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মহানবীর মদীনায় হিজরতের আগে মক্কায় মুসলমানদের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাতেই নবীজি এরূপ নির্দেশ দিয়েছিলেন। মক্কার যে কয়েকজন মুষ্টিমেয় নেতা বনি হাশিম এবং বনি আল-মুত্তালিব গোত্রের উপর আরোপিত কুরাইশদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করেছিলেন এবং অবশেষে নিষেধাজ্ঞার দলিলটি ছিড়ে ফেলেছিলেন তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। এই মহৎ কাজের জন্য কৃতজ্ঞতা দেখিয়েই মহানবী মুসলমানদেরকে তার প্রাণ হরণ না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
আবুল বখতারির মৃত্যু
নবীজির আদেশ সত্বেও মহান যোদ্ধা আবুল বখতারি যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ফলশ্রুতিতে যুদ্ধ করতে করতে পড়ে যান।
যুদ্ধের সময় তার সঙ্গে আল-মাজদার[১] বিন যিয়াদ বিন আমর বিন আখযাম আল-বলিভির সাক্ষাৎ হলে তিনি তাকে তার একজন বন্ধুর সামনে জানান যে মহানবী তাকে না মারার জন্য মুসলমানদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। একথা শুনে তিনি বলেন, “এবং আমার এই সহ-যোদ্ধা? তাকেও কি মারা হবে না?” আল-মাজদার তাকে বললেন যে নবীজির নির্দেশ শুধুমাত্র তার একার জন্য,অন্য কারো জন্য নয়। তার সহযোদ্ধাকে ছাড়া হবে না। একথা শুনে আবুল বখতারি প্রস্তাবটি প্রত্যাখান করে বলেন যে, “তাহলে সে এবং আমি একসঙ্গে মরবো।”
[১. আল-মাজদার বিন যিয়াদ বিন আমর বিন আখযাম আল-বলিভি ছিলেন কুযায়া আল-কাতানিয়া নামক একটা বৃহৎ গোত্রের বিখ্যাত শাখা গোত্র বালিইর লোক। তার আবাস ছিল মদীনা এবং আল-কুরা উপত্যকার মাঝামাঝি একটা স্থানে। তিনি উহুদের যুদ্ধে আহত হন। অজ্ঞতার যুগে তিনি হত্যা করেছিলেন আল-মাজদার বিন আস-সামিতকে যার পুত্র মুসলিম সেনাবাহিনীর আল-হারিস বিন সুয়ায়িদ ষড়যন্ত্র মূলকভাবে তাকে হত্যা করে মক্কায় পালিয়ে যান এবং মক্কা বিজয়ের পর মুসলমানদের কাছে আত্মসম্পূর্ণ করেন। আল-মাজদারকে হত্যা করার অপরাধে মহানবী তার শিরচ্ছেদের আদেশ দিয়ে দিয়েছিলেন।]
এরপর তিনি আল-মাজদারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং বলেন, “কোন মুক্ত নারীর পুত্র কখনো না মরা পর্যন্ত কিংবা বিপদমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তার বন্ধুকে ফেলে যায় না।”
এভাবে আল-মাজদার তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে এবং তাকে হত্যা কতে বাধ্য হন।
যুদ্ধের অবসান এবং আবু জেহেলের শির
যুদ্ধ শেষে মহানবী মুসলমাদেরকে শত্রুদের কাছ থেকে দখলকৃত মালামাল ও অস্ত্রসস্ত্র সংগ্রহের নির্দেশ দিলেন। তিনি আরো নির্দেশ দিলেন তারা যেন আবু জেহেলের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা দেখে তাঁর কাছে রিপোট করেন। আবু জেহেলকে চিনতে যাতে সুবিধা হয় সেজন্য মহানবী তাদেরকে জানলেন যে তার হাঁটুতে একটা ক্ষতের দাগ আছে। মহানবী এবং আবু জেহেলের ছোট বেলায় একটা ঝগড়ার চিহ্ন হিসেবে ঐ দাগটি রয়ে গিয়েছিল।
আব্দুল্লাহ্ বিন মাসুদ[১] নামের একজন অনুসন্ধানকারী আবু জেহেলকে আহত ও মরণাপন্ন অবস্থায় দেখতে পান তিনি কাছে গিয়ে আবু জেহেলের গলায় পা রেখে তার শিরচ্ছেদ করে বলেন, “হে আল্লাহর শত্রু! দেখুন আল্লাহ আপনাকে কিভাবে খাটো করেছেন? আমার চেয়ে বেশী মহৎ কোন ব্যক্তি কি এর আগে আপনার হাতে নিহত হয়েছেন? বলুন আজকের যুদ্ধে কাদের জয় হলো।”
ইবনে মাসুদ তাকে বললেন যে, যুদ্ধে জয় হয়েছে আল্লাহ্, তাঁর নবী এবং মুসলমানদের।
১. আব্দুল্লাহ্ বিন মাসুদ বিন গাফিল বিন হুবাইব আলহাদলি আবু আব্দুর রেহমান একজন সুপরিচিত সাহাবী এবং অন্যতম পন্ডিত ও ধর্মানুরাগী মুসলমান ছিলেন। তিনি প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণ করেন। এবং মক্কায় সর্বপ্রথম উচ্চকণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করেন। তিনি মহানবীর একজন বিশ্বস্ত খাদেম ছিলেন এবং মহানবীর সচিব হিসেবে তিনি সুখে-দুখে সকল সময় তাঁর সঙ্গী ছিলেন। তিনি যে কোন সময় মহানবীর সঙ্গে দেখা করতে পারতেন। ছোট-খাটো মানুষ হওয়ায় তিনি সব সময় পাশের জনের আড়ালে পড়তেন। মহানবীর মৃত্যুর পর তিনি কুফায় কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। তিনি খলিফা ওসমানের শাসনামলে ৩০ হিজরিতে মৃত্যু বরণ করেন।
তখন তার শিরচ্ছেদ করার জন্য বুকের উপর ঝুঁকে পড়া ইবনে মাসুদকে আবু জেহেল বললেন, “ও মেষ পালক, তুমি একটা কঠিন এবং উঁচু জায়গায় আরোহন করেছ!”আবু জেহেলের এ কথা বলার কারণ হলো ইবনে মাসুদ মক্কায় মেষ চরাতেন।
কুরাইশ রাজা
ইবনে মাসুদ আবু জেহেলের মাথা কেটে এনে নবীজির সামনে স্থাপন করে বললেন, “এটা হচ্ছে আল্লাহর শত্রু আবু জেহেলের মাথা।” তখন মহানবী বললেন, “হে আল্লাহর দুশমন, সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি আপনাকে অপমানিত করেছেন। ইনি ছিলেন কুরাইশদের রাজা।
মৃতরা কূপে এবং বন্দীরা শিকলাবদ্ধ
যুদ্ধে মুসলমানরা যখন শত্রুদের মালামাল দখল করে আনলেন এবং বন্দীদের শিকল পরালেন তখন মহানবী পৌত্তলিকদের মৃতদেহগুলিকে নিকটবর্তী একটা পরিত্যক্ত কূপের মধ্যে ফেলে দিতে বললেন। সব সাহাবীরা মহানবীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে মৃতদেহগুলিকে ফেলে দেয়ার কাজ প্রত্যক্ষ করলেন।
বদরের যুদ্ধে এমন কিছু মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয় যেখানে পিতার বিরুদ্ধে পুত্রের লড়াই এবং ভাইয়ের হাতে ভাই নিহত হওয়ার মাধ্যমে রক্ত কিংবা পারিবারিক সম্পর্কের উর্দ্ধে ঈমানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এর একটা দৃষ্টান্ত হচ্ছে আবু হুদায়ফা বিন উবাহ্ বিন রাবিয়াহ্।
একজন মুসলিম যুবকের মহৎ দৃষ্টান্ত
মৃতদের কূপে নিক্ষেপ করার কাজ দেখছিলেন মহানবীর পাশে দাঁড়িয়ে আবু হুদায়ফা; তার মুখে তখন আনন্দের আভা। কিন্তু হঠাৎ করেই তিনি বিমর্ষ হয়ে গেলেন। তিনি দেখলেন তার পিতার মৃতদেহকে কূপে নিক্ষেপ করা হচ্ছে।
মহানবী তার এই আকস্মিক পরিবর্তন লক্ষ্য করে বললেন, “হে আবু হুদায়ফা, তুমি কি তোমার পিতার মৃত্যুতে কষ্ট বোধ করছ?”
যুবক হুদায়ফা বললেন (তিনি সত্যি খুব বিমর্ষ ছিলেন), “না, আল্লাহ্ কসম, আমি আমার পিতার মৃত্যুতে কষ্টা পাচ্ছি না। কিন্তু আমি জানতাম যে আমার পিতা ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও জ্ঞানী, এবং আমার আশা ছিল আল্লাহ্ তাকে ইসলামের পথে পরিচালিত করবেন। এজন্যই আমি যখন দেখলাম যে তিনি আল্লাহর পথে না এসেই মৃত্যু বরণ করলেন তখন তার জন্য দুঃখিত ও বিমর্ষ বোধ করলাম।”
নবীজি তার এই জবাবে খুব খুশী হলেন এবং আবু হুদায়ফাকে শান্তনা দিলেন এবং আশির্বাদ করলেন।
আবু হুদায়ফা ঠিকই বলেছিলেন, কারণ তার বাবা আবু উবা সম্পর্কেই মহানবী নিজেই মন্তব্য করেছিলেন, “এদের মধ্যে ভাল কিছু যদি থাকে তাহলে তাদের মধ্যে লাল উটওয়ালা একজন মানুষ থাকবেন। তার কথা শুনলে তারা ঠিক পথে পরিচালিত হতে পারত।” প্রকৃতক্ষে এই উবাই মুসলমানদের সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিলেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে মক্কা প্রত্যাবর্তনের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। কিন্তু আবু জেহেলের ইচ্ছার কাছে তার মতামত টেকেনি।
ইবনে আল-খাত্তাব কর্তৃক চাচাকে হত্যা
ঈমানের শ্রেষ্ঠত্ব যে কিভাবে অন্য সবকিছুর উপর স্থান পেয়েছিল তার আরেকটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে বদরের যুদ্ধে ওমর বিন আল-খাত্তাব কর্তৃক তার চাচা আল-আস বিন হিশাম ইবনে আল-মাগাইরাকে হত্যা। একইভাবে আবু বকর আস-সিদ্দিকও তার পুত্র মক্কী বাহিনীর যোদ্ধা আব্দুর রহমানের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন।
সম্প্রদায়ের উপর ঈমানের বিজয়
জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলে যারা দাবী করেন যে আদর্শ গত এবং ধর্মীয় বন্ধনের চেয়ে রক্ত ও ভাষার বন্ধন অনেক বেশী শক্ত তাদের যুক্তি অসার প্রমাণিত হয় এই মহৎ দৃষ্টান্তগুলির দ্বারা। বদরের যুদ্ধ কি একই পরিবারের সদস্যদের দ্বন্ধযুদ্ধের মাধ্যমে শুরু হয়নি? বনি হাশিম বিন আব্দ্ মানাফ গোত্রের সাহসী সন্তান হামযা, ওবায়দা এবং আলী একই গোত্রের শায়বা, উত্তা এবং আল-ওয়ালিদকে হত্যা করেছিলেন।
এরা তাদেরকে হত্যা করেছিলেন জাতি কিংবা সম্প্রদায়ের বেদীতে নয়, বরং তাদের আদর্শ ও ধর্মের কারণে।
এটি ছিল একটি আদর্শগত যুদ্ধ, অন্ধ জাতীয়তাবাদ কিংবা স্বাদেশিকতার ফলশ্রুতি নয়। এই যুদ্ধে ইসলামের শক্তির বিজয় হয়েছিল। এবং এই বিজয়ই আরবীয়দের জন্য এমন ইহলৌকিক সাফল্য এনে দিয়েছিল যা মানব জাতির ইতিহাসে ইতিপূর্বে আর কখনো দেখা যায়নি
বদরের যুদ্ধ জাতি কিংবা ভাষার উপর একটা প্রকৃত আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব করেছিল। এই যুদ্ধের ফলে আদর্শগত পার্থক্যের কারণে পরও আপন এবং আপনজনও পর ও শত্রু হয়ে যায়।
তার প্রতি কঠোর আচরণ
যুদ্ধের পর বিখ্যাত সাহাবী মুসায়াব[১] বিন ওমাইর দেখতে পান যে তার ভাই আবু আজিজ[২] বিন ওমাইরকে বন্দী হিসেবে একজন আনসারী সাহাবী শিকল দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। তখন তিনি ঐ সাহাবীকে বললেন, “তাকে সতর্কভাবে রাখবেন এবং তার প্রতি চরম কঠোর আচরণ করবেন। তার মা খুব ধনী এবং তিনি ওর জন্য পুরো মক্তিপণ দিতে পারবেন।” একথা শুনে আবু আজিজ বললেন, “তুমি ভাই হয়ে আমার প্রতি কঠোর হতে বলছ?” মুসায়াব বললেন, “যিনি তোমাকে বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি আমার ভাই।”
[১. মুসায়ার বিন ওমাইর নবীজির আরকামের বাড়ীতে অবস্থানকালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি তখন যুবক ছিলেন এবং কিছুদিন তার মা ও অন্যান্য লোকের ভয় তার ধর্ম গোপন রাখেন। তার ধর্মান্তরের কথা প্রকাশিত হলে তার লোকেরা তাকে হাত-পা বেঁধে আবদ্ধ করে রাখে। পরে তিনি অন্যান্য মুসলমানের সঙ্গে ইথিওপিয়া চলে যান। তিনি দুবার অভিপ্রয়াণ করেন। তিনি বদরের যুদ্ধে অংশ নেন এবং ওহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের পতাকা বহন করেন। এই যুদ্ধেই তিনি শহীদ হন।
২. অন্য নাম জারারা। এর ইসলাম গ্রহণ সন্দেহজনক। আবু ওমর বিন আব্দুল বারের মতে তিনি একজন সাহাবী ছিলেন এবং নবীজির কিছু কথা অন্যের কাছে প্রচার করেছিলেন। আদ-দার কুনির মতে তিনি ওহুদের যুদ্ধে অবিশ্বাসী হিসেবেই নিহত হন।]
কূপের মৃতদের প্রতি নবীজির কথা
ইবনে ইসহাকের ভাষ্য অনুসারে মৃতদেহ কূপের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়ে গেলে সেখানে মৃতদেহ গুলিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “হে কূপের লোক সকল! তোমারা কি দেখেছ প্রভুর কথা কিভাবে সত্য হলো? আমার প্রভু আমাকে যা কিছু বলেছিলেন তার সবকিছুই সত্য হতে দেখেছি।”
আরেক ভাষ্য অনুসারে তিনি বলেছিলেন, “হে কূপের লোক সকল, তোমরা আসলেই নবীজির খুব খারাপ আত্মীয় ছিলে। তোমরা আমাকে নিজের শহর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলে এবং অন্যরা আশ্রয় দিয়েছিল। তোমরা আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলে, পক্ষান্তরে অন্যরা আমাকে সাহায্য করেছিল।”
নবীজির পাশে দন্ডায়মান সাহাবীগণ স্তম্ভিত হয়ে তাঁকে বলেছিলেন, “আপনি কি মৃতদের সঙ্গে কথা বলছেন? জবাবে নবীজি বলেছিলেন, “তারা আসলে তাদের প্রভুর প্রতিশ্রুতি সত্য হতে দেখেছে।
আয়েশা বলেন, “জনগণ মনে করে নবীজি বলেছিলেন যে মৃতরা তার কথা শুনতে পেয়েছিল।”