চতুর্থ অধ্যায়
বোম্বাই শহর ত্যাগ করবার পর লোকে জানলো যে স্যার চার্লস টেগার্ট কলকাতাতে নেই। অথচ চলে যাবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত এমন নিবিষ্টমনে কাজ করেছেন যে কেউ বুঝতেও পারে নি যে তিনি অল্পক্ষণ পরে ভারত ত্যাগ করে অন্যত্র যাবেন। টেগার্ট সাহেব অবসর গ্রহণ করলে মিঃ এল. এইচ. কলসন কমিশনার পদের দায়িত্ব নিয়ে এদেশে এলেন। সংস্কৃত-শাস্ত্রে তাঁর যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি ছিল এবং পুরাণ-বিষয়ে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। এক থানায় হিন্দিভাষী সিপাহীদের জন্মাষ্টমী উৎসবে রামা হৈ গান শুনে তিনি মন্তব্য করেছিলেন: ‘এইবার বুঝেছি কৃষ্ণজী মথুরা ছেড়ে বৃন্দাবনে পালিয়েছিলেন কেন? নইলে এইরকম প্রবল-বাদ্য উচ্চাঙ্গ-সংগীত শুনে ওই সদ্যোজাত শিশুর আকস্মিক মৃত্যু ঘটার সম্ভবনা অবশ্যই ছিল।’
তিনি যুরোপীয় এবং ভারতীয় কর্মীদের মধ্যে শ্রেণীগত যে বিভেদ ছিল তার মধ্যে কিছুটা সামঞ্জস্য বিধান করেছিলেন।
তাঁর সময়ে ব্রিটিশ সরকার প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রথা প্রবর্তন করেন। সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা দ্বারা বিহার প্রভৃতি স্থানে মুসলমান সম্প্রদায় হিন্দুদের এবং বাংলাতে হিন্দু-সম্প্রদায় (মাথা-গুনতি সামান্য হেরফেরে) মুসলমানদের অধীন হয়ে পড়েছিল। আশ্চর্য এই যে হিন্দুস্থানে হিন্দুর বদলে রইল শুধু দুটি সম্প্রদায় —মুসলমান এবং অ-মুসলমান। ভোটের জন্য এক সম্প্রদায়কে অন্য সম্প্রদায়ের মুখাপেক্ষী না-হওয়াতে সাম্প্রদায়িকতা উগ্র হয়ে শহরকে বিষাক্ত করে তোলে। এই সুযোগে অসাম্প্রদায়িক কংগ্রেসের পরিবর্তে মুশ্লিম লীগ ও হিন্দু মহাসভা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে I
১৯৩৮ খ্রী: ভারত-শাসন আইনের এই পরিবর্তনে পুলিশ-বিভাগের কিন্তু কোনো অসুবিধা হয় নি। কারণ, নিয়ম করা হ’ল যে কোনো মুখ্য বিভাগীয় প্রধানের সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীর মতভেদ হলে তার শেষ-মীমাংসা করবেন ইংরাজ গভর্নর স্বয়ং। পুলিশ-বিভাগ ইংরাজ অধিকর্তাদের অধীনে একটি মেজর ডিপার্টমেন্ট হওয়াতে এই পরিবর্তনের তিলমাত্র প্রভাব পুলিশ-ব্যবস্থাপনার উপর পড়ে নি। [কংগ্রেস হাই-কম্যাণ্ড বাংলা ও পাঞ্জাবে হিন্দু-মুশ্লিমে কোয়ালিশন গভর্নমেন্ট গোড়ায় করতে দিলে ভারত বিভাগ কোনও দিনই হ’ত না। এই বিষয়ে জিন্নাকে তাদের চেয়ে উৎকৃষ্ট কূটনীতজ্ঞ বলা যেতে পারে। রাজনীতি-ক্ষেত্রে ভাব প্রবণতার কোনও স্থান নেই। এই-সব কথা তৎকালীন আদর্শবাদী কংগ্রেসীনেতারা ভুলে গিয়েছিলেন বোধহয়।]
কলকাতায় জিন্নাসাহেব বহু সভা করেছিলেন। মুশ্লিম-সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে তাঁর সাবধানবাণী শুনেছিলাম: ‘বারে বারে আমি ঘণ্টা বাজাচ্ছি। কিন্তু দমকল এখনও পর্যস্ত এল না।’—দমকল পাঠানোর মালিক যাঁরা সেই ব্রিটিশ শাসকবর্গ প্রয়োজন না-হওয়া পর্যন্ত দমকল পাঠাবে কেন? দেশ-বিভাগের প্রাক্কালে তাঁরা ওই দমকল পাঠিয়েছিলেন যাকে বলে ঠিক সময়েই।
চেঞ্জার ও নো-চেঞ্জার—কংগ্রেস ও স্বরাজ্য পার্টি। শেষে—কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা, ফরওয়ার্ড ব্লক ও কিছু কমিউনিস্টদের সঙ্গে দলীয় মতবাদে পারস্পরিক দারুণ বিরোধ। জাতীয়তাবাদীদের এই অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগ মুশ্লিম লীগ পুরোপুরি গ্রহণ করতে পেরেছিল। বিভিন্ন পার্কে একাধিক মিটিং-এ এই-সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রায়ই হানাহানি মারামারি হয়েছে। ফলশ্রুতি, আহত হয়ে হাসপাতালে গমন।
আমি কিন্তু নিজ-দায়িত্বে স্থানীয় থানার ইনচার্জরূপে প্রভাত গাঙ্গুলীর সভাপতিত্বে এলবার্ট হল-এর মিটিঙের গোলযোগে, য়ুনিভারসিটি ইনস্টিটিউটে উলেমাদের মিটিঙে মুশ্লিম লীগের আক্রমণে, টাউন হলে হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসের একাংশের বিরোধে ওই সভাগুলি ভেঙে দিয়েছিলাম। আমি দাড়িয়ে উঠে ওদের শুধু বলতাম: ‘আই ডিক্লেয়ার দিস্ মিটিং ইলিগ্যাল।’ তারপরই ওঁরা বিনাপ্রতিবাদে সভা ভেঙে দিতেন ও চলে যেতেন। ওই সব বিষয়ে তাঁদের আইনানুগতা ও সৌজন্যবোধ যথেষ্ট ছিল।
চিরাচরিত প্রথা ত্যাগ করে কলিকাতা পুলিশ-বিভাগে সর্বপ্রথম তিনজন দেশীয় পুলিশ-সুপারকে বাইরে থেকে ডেপুটি কমিশনার করে আনা হ’ল। এই তিনজনের নাম: হীরেন্দ্রনাথ সরকার, ফজল করিম শোভান ও ধর্মদাস ভট্টাচার্য। উত্তর-কলিকাতার জন্য লীগ-গভর্নমেন্ট একজন মুশ্লিম ডেপুটি কমিশনার চাওয়ায় শোভান সাহেবকে উত্তর-কলিকাতার দায়িত্বে বহাল করা হয়।
[পরে শোভান সাহেবের বদলে দোহা সাহেব এবং ধর্মদাসের বদলে হরিসাধন ঘোষচৌধুরী ওই স্থলাভিষিক্ত হন। এরই মধ্যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায়।] তৎকালে—অমৃতবাজার, আনন্দবাজার, বসুমতী প্রভৃতি পত্রিকাগুলি ছিল জনস্বার্থের অতন্দ্র প্রহরী। হকাররা ফুটপাত অবরোধ করলে ওরা সমস্বরে লিখেছিলেন: ‘পুলিশ অকর্মণ্য ও অপদার্থ। ফুটপাথে পথচারীরা চলাচল করতে পারেন না।’ পরদিন পথ-অবরোধ করার অপরাধে হকারদের পাকড়াও করলে ও কাগজওয়ালারাই আবার লিখেছিলেন: ‘পুলিশের একি জবর জুলুম! হকার উচ্ছেদ হলে অনাহার ও বেকার বাড়বে।’ সংবাদপত্রে প্রকাশিত এই বিরূপ মন্তব্যের কাটিংগুলি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হলে তারা সংশ্লিষ্ট কর্মীদের কাছে প্রায়ই কৈফিয়ত চেয়ে পাঠাতেন। অভিযোগ গুরুতর হলে তাঁরা তৎক্ষণাৎ তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন।
[বলতে বাধ্য হচ্ছি কিছু সংখ্যক সাংবাদিক ধর্মের ষাঁড়ের মতো। তাঁরা সকলকে যথেচ্ছ গুঁতোবেন, কিন্তু তাঁদেরকে কেউ গুঁতোলে মহা-অপরাধ। অভিযোগ ওঠে, স্বাধীনতা-উত্তরকালে একবার পুলিশ নাকি ওঁদের গুঁতিয়েছে গড়ের মাঠে। প্রণব সেনের নেতৃত্বে আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। এই অভিযোগের মধ্যে কোনও সত্য ছিল না। এনকোয়ারি কমিশনের রায় প্রকাশিত হলে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। ওই কমিশনের সুমুখে আমি নিজেও সাক্ষী দিয়েছিলাম।]
কমিশনার ফেয়ার ওয়েদার, এম. এ.
পুলিশ-কমিশনার কলসন সাহেব বিদায় নিলে সেই পদে এলেন সি. এস. ফেয়ার ওয়েদার, এম. এ.। তিনি কলিকাতা পুলিশ-বিভাগকে লণ্ডন পুলিশের মতো জনপ্রিয় ও দুর্নীতিমুক্ত করতে চেয়েছিলেন। লণ্ডন পুলিশ-বিভাগের পুরনো ধারা পাল্টিয়ে ওই নতুন আদর্শে চালিত করতে গিয়ে একদা বহু কর্মীকে কয়েক বৎসরের জন্য বরখাস্ত হতে হয়েছিল। কমিশনার ফেয়ার ওয়েদার ওই পদ্ধতিতে কলিকাতা পুলিশ-বিভাগকে দক্ষ ও সৎ করতে চেয়েছিলেন।
তাঁর প্রস্তাব ছিল, নেভি ও আর্মির মতো চৌদ্দ বৎসর বয়স্ক বালকদের অফিসার পদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। যুক্তি এই: বালকদের মন ও শরীর সুগঠিত থাকে না বলে ক্রমে তাদের যথাযোগ্যরূপে গড়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু তৎকালীন গভর্নমেন্টের এই প্রস্তাব মনঃপূত হয়নি।—লণ্ডন পুলিশ বিভাগে কিন্তু এই পদ্ধতিতে কিশোরদের ভর্তি করে তাদের শিক্ষার ভার নেওয়া হয়।
গ্রেট পার্জিঙ
এঁর সময়ে কলিকাতা পুলিশ-বিভাগে কিছু দলবন্ধী তথা ক্লিকবাজি ছিল। এক-একজন দেশীয় ঊর্ধ্বতন কর্মী অনুগত কর্মচারীদের নিজ-নিজ দলভুক্ত করে নিয়েছিলেন। তার ফলে এক-এক এলাকার কর্মীরা ভিন্ন এলাকার ঊর্ধ্বতন কর্মীর অনুগত হয়ে পড়ে। বাংলা পুলিশ-বিভাগে এই-রকম ঘটনার কথা জানতে পারলে কর্মচারীদের দূর-দূর জেলায় বদলি করে দল ভাঙা হ’ত। কিন্তু যান্ত্রিক যুগে কালীঘাট ও শ্যামবাজার এপাড়া ওপাড়া। উনি কিছু অফিসারকে বাংলা-পুলিশে বদলি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা আইনসংগত না-হওয়ায় ওই ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়।
উনি পার্জিঙ পদ্ধতি দ্বারা কলিকাতা পুলিশকে লণ্ডনের অনুরূপ সৎ করতে চাইলেন। এই কাজের জন্য উনি প্রমাণের অপেক্ষা না-রেখে কর্মীদের রেপুটেশন অর্থাৎ সুনামের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। জনসাধারণ এবং উকিল ও সহকর্মীদের মধ্যে কিছু-সংখ্যক পুলিশ-কর্মীর এরূপ স্বীকৃত সুনাম থাকেই। উপরন্তু কর্মীদের সততা সম্বন্ধে গোপন তদন্তে উনি তা জানতে পেরেছিলেন। সততা ও দক্ষতা এই উভয় গুণের উপর উনি একত্রে গুরুত্ব দিতেন। অসৎ অথচ দক্ষ কর্মীদের দ্বারা যুদ্ধ জয় করা যায়, কিন্তু সৎ অথচ অদক্ষ কর্মীদের দ্বারা তা সম্ভব নয়। সেইজন্য অদক্ষ অথচ সৎ কর্মীদের উনি করণিক সুলভ কর্মে নিযুক্ত করেন আর সৎ ও দক্ষ কর্মীদের বেছে-বেছে উচ্চপদে প্রমোশন দেন। ওঁর মতে শুধু নিজেরাই সৎ ও দক্ষ হলে হবে না, অধীনস্থ কর্মীদেরও সৎ ও দক্ষ হতে বাধ্য করতে হবে। এই পদ্ধতির ফলে বহু প্রবীণ কর্মী বরখাস্ত বা পদাবনত হন আর আমি ও আরও কয়েকজন বহু ঊর্ধ্বে উঠে যাই।
কোনো এলাকা দুর্নীতিগ্রস্ত হলে সাধারণত আমাকে সেখানে পাঠানো হত। আমি শ্যামপুকুরের পর—আমহার্স্ট স্ট্রীট, টালিগঞ্জ, বহুবাজার ঘুরে বালিগঞ্জে এলাম। এইখানে এসে অবসর সময়ে আমি গোপনে বিবিধ বিজ্ঞান-বিষয়ক গবেষণাকর্মে মনোনিবেশ করি। আমার গ্রন্থগুলিও এই সময় এক-একে প্রকাশিত হতে থাকে। বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিকরূপে আমার প্রতিষ্ঠা তখন থেকেই।
আমার একটি লজ্জাস্কর কাজ এইখানে অনুতাপের সঙ্গে লিপিবদ্ধ করি। আমি বালিগঞ্জ সায়ান্স কলেজে জুওলজির ছাত্র ছিলাম। কলেজের বাৎসরিক উৎসবে বিজ্ঞান-প্রদর্শনীর প্রথা প্রথম আমি সৃষ্টি করি। ইচ্ছা ছিল, জুওলজিক্যাল সার্ভিসে অথবা অধ্যাপনা-বৃত্তিতেই যুক্ত হব। কিন্তু অধ্যাপক দুর্গা মুখার্জি ও ডঃ জ্ঞান ভাদুড়ীর হাতে কম নম্বর পাওয়ায় স্নাতকোত্তর পরীক্ষাতে অল্পের জন্য প্রথম হতে পারি নি। তার ফলে উক্ত বাঞ্ছিত ক্ষেত্রে চাকুরি পাওয়ার সুযোগ নষ্ট হয়ে যায় এবং আমাকে কলিকাতা পুলিশ-বিভাগে ঢুকতে হয়।
এই চাকুরি পাওয়ার পর সঞ্চিত রাগের কারণে ওই দুজন পরীক্ষকের নাম আমি সেসন-কোর্টের জুরীর তালিকাভুক্ত করে দিই এবং জানতাম, খুবই যোগ্য লোক পাওয়ায় গভর্নমেন্ট এঁদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেবেন না। হ’ল তাই। জুরীর কাজে আটক পড়ে ডঃ ভাদুড়ীর গবেষণা-কার্য ব্যাহত এবং অধ্যাপক মুখার্জির জুওলজি-সংক্রান্ত পুস্তক রচনায় বাধার সৃষ্টি হয়।
হঠাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় আমার জনপ্রিয়তা কর্তৃপক্ষের নিকট দোষ না হয়ে গুণরূপে দেখা দিল। জাপান যুদ্ধে না-নামা পর্যন্ত এই মহাযুদ্ধের গুরুত্ব বোঝা যায় নি। পুলিশ-ক্লাব হতে আমি একটি গ্যাস-মাস্ক স্কোয়াড তৈরি করলাম। কর্তৃপক্ষ এ সময়ে আমার মতো জনপ্রিয় অফিসারদের সাহায্য নিয়েছিলেন। আমি সমগ্র শহরে ঘুরে-ঘুরে সিভিক গার্ড, এ. আর. পি. ফার্স্ট এড এবং ফায়ার-ফাইটিং বাহিনীগুলিতে যোগদানের সার্থকতা সম্বন্ধে তরুণ-সম্প্রদায়কে বুঝিয়ে বলি এবং তাদের সংগ্রহ করি।
চীনে জাপানী অটোক্রেসী সম্বন্ধে বহু ছোটগল্প ও অন্যান্য নিবন্ধ সমূহ কলিকাতা বেতারে পাঠও করেছিলাম।
আমি সভা করে জনগণকে এই বলে বোঝাতাম যে ব্রিটিশদের শোষণ-শক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু জাপানীরা এলে উভয়পক্ষ থেকে আবার তা শুরু হবে। এই দুমুখী শোষণে আমাদের সর্বনাশ অনিবার্য। জনগণের মনোবল অক্ষুণ্ণ রক্ষার জন্য আমি আরও বলেছিলাম যে সিঙ্গাপুর ও বর্মার পতন ঘটেছে। কিন্তু ওই দেশগুলি ও অবশিষ্ট ভারতের মধ্যে আছে বাংলা দেশ। এ দেশে বাস করে দুর্ধর্ষ বাঙালী জাতি। বাঙালীদের পর্যুদস্ত করে জাপানীরা এগোতে পারবেনা। বলতাম বটে কিন্তু এ-রকম বক্তৃতা সর্বত্র সমান সমাদৃত হ’ত না। এক সভায় জনৈক প্রৌঢ় ব্যক্তি চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘ঢের হয়েছে মশাই। ভয় দেখাবেন না। হবে আর কি। মুশ্লিম আমলে ডানদিক থেকে বামদিকে লেখা অভ্যাস করেছি। ইংরাজ-আমলে ঠিক উল্টো—বাম থেকে ডান।* ওদের আমলে না-হয় লিখব উপর থেকে নিচে।’
[* মূল বইয়ে ভুল ছিল। এখানে ছিল: “মুশ্লিম আমলে বামদিক থেকে ডানদিকে লেখা অভ্যাস করেছি। ইংরাজ-আমলে ঠিক উল্টো—ডান থেকে বাম।”]
আমার এক ভায়রাভাই কর্নেল পতিতপাবন চৌধুরী, এম. ই., আই. এম. এস. (পরে—মেজর-জেনারেল) ওদের মেডিকেল কোরের শেষ ব্যক্তি হিসাবে সিঙ্গাপুর থেকে ক্রুজারে ভারতে ফিরেছিলেন। তাঁর মুখে ইংরাজদের পরাজয়ের কিছু-কিছু কারণ জানতে পেরেছিলাম। ভারতীয় বাহিনীর লোকেদের পরিচ্ছন্ন রাখার মানসে ব্রাসো দিয়ে যখন জামার বোতাম চকচকে করানো হচ্ছে বা উর্দী অপরিষ্কার দেখতে পেয়ে ইংরাজ-কর্তারা যখন দাঁত খিঁচিয়ে দণ্ড দিতে ব্যস্ত তখন জাপানী সৈন্যগণ নগ্নপদে হাফ প্যান্ট ও গেঞ্জিমাত্র পরিধান করে, কাদা মেখে, মাথায় টমি-গান ধারণ করে জলাভূমি পার হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ব্রিটিশ ফৌজীরা যেখানে যন্ত্রশকট না-হলে পাদমেকং নড়তে চায় না ও ভূরিভোজ না-হলে তৃপ্তি পায় না সেখানে জাপানীরা ঝোলার মধ্যে ভাতের মণ্ডন ও চাটনি মাত্র সম্বল করে ক্রমাগত দিনযাপন করেছে।
[এ সময়ে পার্ক সার্কাস অঞ্চলে ওয়াজেদ আলি সাহেবের অলক্ষ্যে তাঁর আবাসে একটি বাঙালী মুশ্লিম-সংস্কৃতি কেন্দ্র গড়ে ওঠে। আমি ওই সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সাপ্তাহিক সভায় বহুবার যোগদান করেছিলাম। এই কেন্দ্রের সকলেই তরুণ মুশ্লিম বাঙালী সাহিত্যিক। তাঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের বাঙালী বলে এক দারুণ অভিমান পোষণ করতেন। সম্ভবত ওই দলে শেখ মুজীবর রহমনকেও আমি দেখেছিলাম। প্রকৃতপক্ষে ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াজেদ আলি সাহেবের ওই গৃহেই মুশ্লিম বাঙালী জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়।]
হঠাৎ প্রতি থানায় নকসা-সহ গোপন নথি ও হুকুমনামা এল এই মর্মে যে ব্রিটিশরা রাঁচিতে সেকেণ্ড ডিফেন্স-লাইন খুলছে, প্রয়োজনে কলিকাতা পুলিশকে ওখানে সরিয়ে নেওয়া হবে। কোন্ কোন্ রুট ধরে আমরা পালাব তা-ও ওই নকসায় বলা হয়েছিল। এলাকার প্রত্যেকের ব্যক্তিগত সাইকেলগুলিও নম্বরযুক্ত করে রেজেস্টারি করা হয়। দরকারে ওগুলো সংগ্রহ করে তার সাহায্যে কিছু লোক শহর ত্যাগ করতে পারবে।
ওই গোপন সারকুলার পাওয়ার পর আমি অন্যান্য সহকর্মী ইনচার্জদের সঙ্গে যোগাযোগ করে একান্তে পরামর্শ করলাম। স্থির হ’ল, নাগরিকদের অরক্ষিত অবস্থায় রেখে পালিয়ে না-গিয়ে বরং আমাদের তৈরি সিভিক গার্ড, এ. আর. পি. থানার সিপাহী ও জনগণকে সুসংহত করে আমরা তাঁদের রক্ষা করব।
দীর্ঘদেহী কিছু-সংখ্যক বাঙালী তরুণকে কলিকাতা পুলিশে ভর্তির ব্যাপারে আমি সাহায্য করেছিলাম। পাগড়ি বাঁধা ও পরা তাঁরা পছন্দ করত না। এজন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আমি তাঁদের শিরস্ত্রাণ বদলের জন্য কিছু নকসা-সমেত প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু লাল-পাগড়ির পরিবর্তে বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে টুপির ব্যবহারে গভর্নমেন্ট রাজী হলেন না। এই বছরে আমি গড়িয়াহাট এবং রাইফেল রোড ফাঁড়িদ্বয় স্থাপন করেছিলাম।
একদিন আমার অধীনে কড়েয়া থানা থেকে বিপদবার্তা এল। কড়েয়া রোডের য়ুরোপীয় বেশ্যালয়ে উৎপাতের জন্য দুজন মার্কিন সৈন্যকে ওখানকার সার্জেন্ট-সাহেব থানায় ধরে এনেছিলেন। একগাড়ি মাতাল মার্কিন-সৈন্য সেখানে গিয়ে ড্রাম পিটিয়ে ঘোষণা করেছে: ‘আমেরিকা ডিক্লেয়ার্স ওয়ার অন কড়েয়া ফাঁড়ি।”
আমি দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে তাদের উদ্দেশ্যে বলি: ‘আই ডু নট অ্যাকসেপট ইট।’ অর্থাৎ আমি তোমাদের যুদ্ধ-ঘোষণা গ্রাহ করি না। তারপর মার্কিন মিলিটারী পুলিশ-বিভাগে খবর পাঠালে তাঁরাও দ্রুত চলে আসে এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামাকারী দলটিকে ধমকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যান।
সামরিক বাহিনীর এই রকম কিছু সৈন্যকে আমাদের এ সময় সামাল দিতে হ’ত। তাছাড়া সাইরেন বাজানো, নিষ্প্রদীপ আরোপ করাও পুলিশের অন্যতম কর্তব্য ছিল। সিভিক গার্ড, এ. আর. পি. প্রভৃতি বাহিনীর সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে তাদের পরিচালনাও পুলিশকে করতে হয়েছে। সাইরেন বাজা মাত্র য়ুরোপীয় স্পেশাল কনস্টেবলরা থানায় চলে আসতেন, তাদের দেখ-ভাল করা পুলিশের কাজের মধ্যেই ছিল।
কমিউনিস্ট পার্টি তখন সবেমাত্র সরব হচ্ছে। কিন্তু জনগণের মধ্যে তখনও তাদের বিশেষ সমাদর নেই। উপরন্তু আমাদের মতো তাঁরাও জাপানীদের রুখবে ঘোষণা করায় লোকে তাদের তাড়া করে। মিথ্যা করে রটানো হয় যে গভর্নমেন্ট থেকে অর্থ দিয়ে ওদের গড়ে তোলা হয়েছে। জেলখানায় রাজবন্দীদের কমিউনিস্ট লিটারেচার ছাড়া অন্য কিছু পড়তে দেওয়া হ’ত না বলে তাঁরা ধীরে ধীরে কমিউনিস্ট মতবাদে আকৃষ্ট হচ্ছিলেন।
[বিঃ দ্রঃ—কমিউনিজম উত্তম হলেও ভারতীয় কমিউনিস্টরা সেভাবে গ্রহণ করেন নি। ভূমি সম্পর্কে একজনের মালিকানা কেড়ে অন্য একজনকে তার মালিক করা হয়। কিন্তু প্রতিটি ভূমিখণ্ড রাষ্ট্রের সম্পত্তি বললে লোকের বিরাগভাজন হতে হবে। ভূমি টুকরো টুকরো হলে কৃষিকর্ম লাভজনক হয় না। আমেরিকা, রাশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় কৃষিজমি প্রচুর। ও-সব দেশে প্লেন দ্বারা বীজ ছড়িয়ে ও ট্রাকটার দ্বারা জমি কর্ষণ করে প্রচুর শস্য উৎপন্ন করা হয়। অথচ লোক সংখ্যা জমির অনুপাতে নগণ্য। ভারত বা চীন থেকে রাশিয়ায় বাড়তি লোক পাঠালে যুদ্ধ বেধে যাবে। এক্ষেত্রে গালভরা আন্তর্জাতিক সাম্যবাদ শব্দ দুটি শ্রবণ সুখকর হলেও সম্পূর্ণ অর্থহীন। প্রাচীন যুগের ভৃত্যরা এখন ওদেশে রাষ্ট্রের ভৃত্য। কিন্তু পূর্বের মতো তাদের ব্যক্তি-স্বাধীনতা নেই এতটুকু।]
কলকাতাতে ওই সময় যত্র তত্র হুকুম-দখল করে বাড়ি নিয়ে নেওয়ায় সাধারণভাবে বাড়ি-ভাড়া পাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। এই অসুবিধা বোঝাতে গিয়ে জনগণ নিম্নোক্ত গল্পটি সৃষ্টি করে।
গড়ের মাঠে নিরালা এক পুকুরে মৎস্য-শিকাররত এক ভদ্রলোক সহসা উলটিয়ে পুকুরের জলে পড়ে গেলেন। পথচারী এক ভদ্রলোককে তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘মশাই, ডুবে যাচ্ছি। শিগগির সাহায্য করুন।’ ওই পথচারী ভদ্রলোক ঝুঁকে জানতে চাইলেন, ‘আপনার বাড়ির ঠিকানাটা কী বলুন তো?’ ডুবন্ত ভদ্রলোক বাড়ির ঠিকানা জানালে তিনি বলেছিলেন, ‘ঠিক আছে। এবার আপনি ডুবুন। আমি আপনার বাড়িটা ভাড়া নিতে চললাম।’
ঠিকানা-মতো তিনি সেই বাড়িতে এসে হাজির। কিন্তু দেখতে পেলেন, অন্য এক ব্যক্তি মালপত্র সমেত বাড়ির ভিতরে ঢুকতে উদ্যত। বিস্মিত ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ‘ব্যাপার কী মশাই? বাড়িটা তো এইমাত্র খালি হ’ল, আপনি এত তাড়াতাড়ি খবর পেলেন কী করে?’
ভাগ্যবান ব্যক্তিটি একগাল হেসে উত্তর দিলেন, ‘বুঝতে পারলেন না? আরে মশাই, আমিই তো ওকে ঠেলে জলে ফেলে দিয়েছিলাম।’
শহরে জাপানী উড়োজাহাজ হতে মৃদু বোমাবর্ষণে বিপরীত দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। শহর পরিত্যাগ করে দলে-দলে ক্যালকেসিয়ান’-রা গ্রামের আত্মীয়দের বাড়িতে ভীড় করে। অন্যদিকে কিছু অবাঙালী সিপাহী কর্তৃপক্ষকে না-বলে সোজা মুল্লুকে চলে যায়। গ্রামের আত্মীয়রা শহরবাসী আত্মজনদের কিভাবে অভ্যর্থনা করেছিল জানি না কিন্তু পলাতক সিপাহীদের প্রত্যেকেরই বিচার হয় এবং বিচারে ছ’বছর করে মেয়াদ হয়।
যুদ্ধের প্রথমদিকে জার্মানীদের প্রাথমিক সফলতায় ইংরাজ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মন হতে দাম্ভিকতা সরে গিয়ে মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়। রাশিয়া যুদ্ধে যোগ দিলে তাঁদের সাহস ফিরে আসে। অ্যাংলো-সার্জেন্টরা হিটলারকে উপহাস করে কিছু গণ-গল্প সৃষ্টি করেছিল।
এক বাল্যবন্ধু নাজী হতে অস্বীকার করলে হিটলার তাকে হত্যা না-করে তার বাড়িতে মেথরের কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল। একদিন বাল্যবন্ধুটি হিটলারকে দেখে নাজী-কায়দায় ঊর্ধ্বে হাত তুললে হিটলার তাকে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বসিত হলেন: ‘বন্ধু, তাহলে এতদিন পরে তুমি আমার কথা রাখলে —নাজী হলে শেষ পর্যন্ত।’ অত্যন্ত ঠাণ্ডা গলায় আলিঙ্গনাবদ্ধ ভদ্রলোকের প্রত্যুত্তর: ‘আরে না না। তা . কেন? বিষ্ঠা জমে কতো উঁচু হ’ল হাত তুলে তাই তোমাকে বোঝাচ্ছিলাম?’
কিন্তু এত সত্ত্বেও য়ুরোপীয় মেম-সাহেবদের মধ্যে বর্ণ-বিদ্বেষ দূরীভূত হয়নি। জনৈক কৃষ্ণবর্ণ পুলিশ-কর্মী তদন্তে গেলে এক ইংরাজ-মহিলা তাঁকে ঢুকতে না দিয়ে বলেন, ‘আই ডোন্ট ওয়ান্ট এ ব্ল্যাক অফিসার। সেও এ ব্রাউন অর ফেয়ার অফিসার।’ পাল্টা অনুযোগ করে আমি তাঁকে বলি: ‘ম্যাডাম, বাইবেল ইজ রিটিন ইন ব্ল্যাক ইঙ্ক অর হোয়াইট ইঙ্ক?’
আগস্ট বিপ্লব
নেতাদের গ্রেপ্তারের পর স্বতঃস্ফূর্তভাবে আগস্ট বিপ্লব শুরু হয়ে যায়। তখন দেশের অধিকাংশ যুবক-যুবতী যুদ্ধোদ্যম-সম্পর্কিত নানান কর্মে লিপ্ত। পল্লী অঞ্চলের বেকারবৃন্দ সিভিক গার্ড, এ. আর. পি. ফায়ার ফাইটিং, ফার্স্ট এড প্রভৃতি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত। তখন মানুষ চাকুরি খোঁজে না, চাকুরিই মানুষ খোঁজে। যিনি ফিসারী একসপার্ট তিনি রাতারাতি স্টীল কনট্রোলার হচ্ছেন। চুরি অপেক্ষা আমেরিকান সৈন্যবাহিনীর কুলি হলে উপার্জন অনেক বেশি। এ অবস্থায় আগস্ট বিপ্লবের জন্য তরুণ-সম্প্রদায় কোথায়? তবু, আগস্ট বিপ্লব শহরে গুরুতররূপে সংঘটিত হয়েছিল। নেতৃত্ববিহীন এই আন্দোলন শহরে কিশোরদের দ্বারা সু-সম্পাদিত হয়। তারাই পোস্ট-অফিস ও ট্রাম পুড়িয়েছে, ট্রামের বিজলী তার কেটেছে। তারাই মিলিটারি-গাড়ি আটকে গুলি খেয়ে মরেছে। ‘স্যুট অ্যাট সাইট।’—এই হুকুম তখন পুলিশকে দেওয়া হয়। টেলিগ্রাফ পোস্টের উপর হতে বহু কিশোরকে গুলি খেয়ে রক্তাপ্লুত অবস্থায় মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে আমি দেখেছি।
সিভিক গার্ড
প্রতিটি থানার প্রতিটি বিটে একদল উর্দিভূষিত সিভিক গার্ড নিজেদের গ্রুপ-কমাণ্ডারের অধীনে নিযুক্ত থাকতো। স্থানীয় অধিবাসী হওয়ায় বিটের অলি-গলির সন্ধান তারা জানতো। তাদের ভয়ে জুয়া, চোলাই ও চুরি বন্ধ। পুলিশ উৎকোচ গ্রহণ করলে কিংবা উৎপীড়ক হলে তারা কর্তৃপক্ষকে সেই সংবাদ জানাবে। স্থানীয় জনগণের পারস্পরিক বিবাদ তারা সুষ্ঠুভাবে মিটিয়ে দেয়। ফলে একটিও প্রাইভেট মামলা আদালতে যায় না। থানা-ইনচার্জরা এই বাহিনী গড়ায় উভয়-পক্ষের সম্ভাব অক্ষুণ্ণ। পুলিশ ও সিভিক গার্ড পরস্পরকে সংযত করতো। উভয় পক্ষের মধ্যে সহযোগিতা ছিল অত্যন্ত বেশি। খুবই বাছাবাছি করে ওদের ভর্তি করা হয়েছিল।
[পরবর্তীকালে প্রণব সেন সৃষ্ট স্পেশাল কনস্টেবল-ব্রাঞ্চ কিছুটা এদের মতোই কার্যকর হয়। কিন্তু এদের মতো সাধারণ-শ্রেণী থেকে সংগ্রহ না করে বিত্তবানদের মধ্য হতে ওরা সংগৃহীত হওয়ায় ওরা অতো জনপ্রিয় হতে পারে নি।]
যুদ্ধকালীন মনোবৃত্তি-প্রস্থত অসততার শিকার তখন বহুলোক। সকলেই অন্যায় মুনাফা ও উৎকট উৎকোচ খুঁজে বেড়ায়। যুদ্ধোদ্যম অব্যাহত রাখতে হবে বলে এদের কিছু বলা হয় নি। গভর্নমেন্ট স্বরেও চূড়ান্ত ও নির্লজ্জ পক্ষপাত ও স্বজন-পোষণ। তখন পদের জন্য লোক নিয়োগের বদলে লোকের জন্য পদ তৈরি করা হ’ত। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে এদের ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স ও ধন-সম্পত্তির হিসাব দিতে হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে বহু মামলা রুজু করা হয়।
[বিখ্যাত এস. কে. ঘোষের বর্মা-রিফিউজি তছরূপ মামলার আমি একজন প্রধান তদন্তকারী ছিলাম। এক কোটি টাকার এই মামলার সফলতা অর্জন সম্ভব হয়েছিল আমার সংগৃহীত সাক্ষ্য-প্রমাণাদির জন্য। প্রমথেশ বড়ুয়া প্রমুখের সাক্ষ্য সংগ্রহের জন্য আমি বোম্বে পর্যন্ত ছুটাছুটি করেছিলাম।]
আমেরিকা
আমেরিকানরা বাংলাদেশে অর্থের বলে আর যাই করুক, বিমান হতে ডি-ডি-টি ছড়িয়ে ম্যালেরিয়াবাহী মশককুল ধ্বংস করতে তারা সাহায্য করেছিল। তারা এদেশে বহু পথঘাট পাকা করেছে এবং নিজেদের প্রয়োজনে কিছু পাকা বাড়ি নির্মাণ করে চলে যাবার সময় সেগুলি রেখে যায়। আগস্ট বিপ্লবকালে তাদের গাড়িগুলি এবং নিজেরা ইষ্টকাঘাতে আহত হলেও তারা প্রতিশোধ গ্রহণ করেনি। এই মহাযুদ্ধ বাংলার সমাজ-ব্যবস্থায় এক বিরাট পরিবর্তন এনে দেয়। ওই সময় চাকুরিয়া গৃহস্থ-কন্যাদের বহুজনই আর গৃহমুখী হন নি। সেই থেকে ওয়ার্কিং গার্লস (working girls) বাংলার একটি নতুন উল্লেখ্য পরিভাষা। একশ্রেণী তরুণেরা চাকুরিরা স্ত্রী চায়। অথচ স্ত্রীর। পরপুরুষের সঙ্গে কথা কইলে স্বামীদের মনে সন্দেহ। মেয়েরা চাকুরি পেলে চাকুরে ছেলেদেরই বিবাহ করে। তাদের পুত্রকন্যারা মাতৃস্নেহ হতে বঞ্চিত হয়। উভয়ে চাকুরি করার জন্য কোনো-কোনো ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী মহাভোগী। অন্যদিকে বেকার যুবকদের চাকুরির অভাব হয়।
নেতাজী সুভাষচন্দ্র
বিশ্বরাজনীতি-ক্ষেত্রে অনন্যচরিত্র দেশপ্রেমিক মহাপুরুষ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর স্নেহভাজন হবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। স্থানীয় এলাকার ইনচার্জরূপে আমাকে ও নীহার বর্ধনকে তাঁর এলগিন রোডের বাড়ির উপর নজর রাখতে বলা হয়। সেই বাড়িতে তার অবস্থানকালীন প্রতিদিনই আমরা ‘হাজির’ লিখে যেতাম। ফলে তার অন্তর্ধানের সুবিধা হয়। অবশ্য তাঁর প্রতি ভক্তির জন্যই আমাদের এই শৈথিল্য।
নজরবন্দী, শ্রম-দণ্ড বন্দী বা যে কোনো বন্দী পলায়ন মানেই প্রশাসনের ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতা। এজন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের কোনো না-কোনো কর্মীর দণ্ড অনিবার্য ছিল। আমরা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যাই। এ ব্যাপারে স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডেপুটি-কমিশনারেরও যৌথ দায়িত্ব। তাকে বহুবার সংবাদ দেওয়ার পর তিনি এলেন এবং বললেন, ‘আমি জানি উনি সাধু হয়ে চলে গিয়েছেন।’ এত বড়ো অন্তর্ধান-ঘটনার গুরুত্ব সম্বন্ধে আমরা অবহিত ছিলাম, কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে এজন্য জলপথে বা স্থলপথে কোনও জাহাজ উড়োজাহাজ বা ট্রেন থামানো হয় নি। কোনও তল্লাসী হয়েছে বলে শোনা যায় নি। এমন-কি কাউকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদও করা হ’ল না।
[বিঃ দ্রঃ—ছত্রপতি শিবাজী নজরবন্দী-দশা থেকে পালিয়ে যাবার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মোগল-রক্ষীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে ঢোল পিটিয়েওই সংবাদ প্রচার করেন। কিন্তু আমরা তার অন্তর্ধানের ২৪ দিন পরেও কোনরূপ প্রচার-প্রচেষ্টা করিনি।] একদল ইংরাজ মনে করতেন নেতাজী ভারতে থাকলে তাঁদের পক্ষে বিপদজনক। অন্যদলের ধারণা, তাঁর ভারতের বাইরে খাওয়াই ক্ষতিকর। জনৈক ইংরাজ-সহকর্মী একদিন আমাকে বলেন, ‘সুভাষচন্দ্র পালিয়ে গিয়েছেন।’ প্রত্যুত্তরে আমি জানাই: ‘ঠিক কথা। তবে তাঁর পূর্বে আরও দুজন পালিয়েছিলেন। একজন ছত্রপতি শিবাজী। ফলে, মোগল সাম্রাজ্যের পতন। দ্বিতীয়জন মহামতি লেনিন। ফলে, রুশ-সাম্রাজ্যের পতন। আমার মনে হয়, সুভাষচন্দ্রের পলায়নেরমধ্যে ইতিহাসের সেই ধারার ইংগিত সুস্পষ্ট, তাঁর দ্বারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন হবে।’
আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃবর্গকে দিল্লিতে এনে ঐতিহাসিক বিচারের পর মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু সামান্য অপরাধে বাঙালী বিপ্লবীদের রেঙ্গুনেই ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। শোনা যায়, সমর-নেতারা নেতাজীকে জাপানীদের সাহায্যে ভারতে আসার বিরুদ্ধে পরামর্শ দিয়েছিলেন। নেতাজী বিদেশী জাপসৈন্য-সহ ভারতে পৌঁছুলে তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাবে ভারত অখণ্ড থাকতো। সেই সময় তিনি অগ্রসর হলেই ব্রিটিশ কলিকাতা ত্যাগ করে পাটনা অথবা রাঁচিতে সরে যেতে প্রস্তুত ছিল। তার অভিযান জার্মান ও জাপানের পরাজয়ের পূর্বমুহূর্তে সংঘটিত হওয়ার জন্ম তা ব্যর্থ হয়ে যায়। কারণ—ততোদিনে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী পাল্টা আঘাতের জন্য প্রস্তুত হতে পেরেছিল।
আশ্চর্যের বিষয় এই যে নেতাজীর সহযাত্রীদের কেউ ‘প্লেন দুর্ঘটনার’ নিহত হলেন না—হলেন কিনা একমাত্র তিনি। সুভাষচন্দ্র স্বদেশে ফিরে আসুন মিত্রশক্তির তা কাম্য ছিল না। তাঁকে কোনো গুপ্তঘাতক হত্যা করে থাকতে পারে এরূপ সন্দেহও কেউ-কেউ পোষণ করছিলেন। অধিকাংশ জ্ঞানীগুণীর সুচিন্তিত অভিমত যে তিনি এখনও জীবিত।
[বিঃ দ্রঃ-আজাদ হিন্দ ফৌজ প্রমাণ করে যে ব্রিটিশরা দেশীয় বাহিনীর উপর নির্ভর করতে পারবে না। আমার মতে, তখন দেশের যা পরিস্থিতি তাতে ব্রিটিশরা আরও কিছুদিন দেশীয় বাহিনীর উপর নির্ভর করতে বাধ্য হ’ত। তাছাড়া, হিন্দু-মুশ্লির্ম সাম্প্রদায়িক ভেদ সৃষ্টি করে টিকে থাকার অসুবিধা ছিল না। প্রকৃতপক্ষে বিশাল ভারত-রক্ষার অর্থশক্তি ব্রিটিশের তখন ছিল না। হিটলার যুদ্ধ না-বাধালে এশীয় দেশগুলি এতো সহজে স্বাধীন হ’ত কিনা সন্দেহ।
সে-সময়ে ইংরাজ ও মার্কিনরা ভেবেছে চেম্বারলিন কিংবা চার্চিলই ভুল করেছেন। জার্মানী ও রাশিয়া উভয়ের যুদ্ধশক্তি ক্ষয় হলে তাদের পক্ষে ভালো হ’ত। শক্তিশালী জার্মানীর কতো প্রয়োজন আজ তাঁরা বোঝেন। সমগ্র জার্মান-জাতিকে একত্রিত করার দাবী হিটলারের ন্যায্য ছিল।]
বিঃ দ্রঃ সুভাষচন্দ্রের জনপ্রিয়তার প্রমাণস্বরূপ বহু গণ-গল্পের সৃষ্টি হয়। তাঁর সিভিলিয়ান পরীক্ষায় প্রদত্ত প্রশ্নোত্তর তরুণদের কণ্ঠস্থ ছিল। যথা:
প্রশ্ন। —ডিফারেন্স বিটুইন প্রিন্স এণ্ড ফুটবল?
উত্তর।—ওয়ান ইজ থ্রোন টু দি এয়ার, আদার ইজ হেয়ার টু দি থ্রোন।
প্রশ্ন। -ডিফারেন্স বিটুইন স্টেশন মাস্টার এণ্ড স্কুল মাস্টার?
উত্তর।—ওয়ান মাইণ্ডস দি ট্রেন, আদার ট্রেনস দি মাইণ্ড।
জওহরলালজী সম্বন্ধে এরূপ বহু গণ-গল্প একদা মুখে মুখে প্রচারিত হয়েছিল। যেমন: তাঁর পরিচ্ছদগুলি ইংলণ্ড হতে কাচিয়ে আনা হত। উনি প্রিন্স অব ওয়েলস-এর ক্লাস-ফ্রেণ্ড ছিলেন। প্রিন্স অব ওয়েলস ভারতে এসে তাঁর খোঁজ করলে তিনি তখন জেলে শুনে ভীষণ ক্রুদ্ধ হন। নেহেরু-পরিবার হতে তার প্রতিবাদ সত্ত্বেও জনগণের মন হতে এই বিশ্বাস মুছে যায় নি।
পিউটিনি ট্যাকস
আগস্ট আন্দোলনের সময় সর্বপ্রথম পিউটিনি ট্যাক্স প্রবর্তন করা হয়। কোনও স্থানে ঘটনা ঘটলে স্থানীয় প্রত্যেক পরিবারকে জরিমানা দিতে হত। বালিগঞ্জের একস্থানে ঘটনার পর ওই জায়গা থেকে বিশজন তরুণকে গ্রেপ্তার করার হুকুম হ’ল। কিন্তু সেখানে সমসংখ্যার অধিক তরুণী পাওয়া গেলেও তরুণ পাওয়া যায় মাত্র দুটি। ওখানকার তরুণেরা তখন যুদ্ধ-উপলক্ষে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কর্মরত। বাড়িতে ছিলেন স্ত্রীলোক, প্রৌঢ় ও বৃদ্ধেরা। তাঁরা বলেছিলেন, ‘পিউটিনি ট্যাক্স যুদ্ধরত পুত্র…কর্নেলের নিকট আদায় করা হোক।’
আমার কনিষ্ঠ সহোদর ডঃ হিরণ্ময় ঘোষাল পি-এইচ-ডি যুদ্ধের সময় পোল্যাণ্ডের ওয়ারশ’ য়ুনিভারসিটির ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি স্লাভ ফাইলোলজির ডক্টরেট ও য়ুরোপীয় বহু ভাষায় সুপণ্ডিত। তার একদা ছাত্রী ও পরে জীবন-সঙ্গিনী শ্রীমতী হাৰ্লিনা এম-এ, এম-এল সহ য়ুরোপ হয়ে তুরস্কের মধ্য দিয়ে তিনি ভারতে এসেছিলেন আশ্রয়ের জন্য। তাঁরা আমার গৃহে ওঠার ফলে আমার গৃহেই স্পেশাল ব্রাঞ্চের ওয়াচ বসলো। পরে তাঁকে আমার এলাকার ডেপুটি সাহেব ডেকে পাঠালে তিনি পাল্টা তাঁকেই তাঁর কাছে আসতে বলেন। আমার অসুবিধা হবে বুঝে তিনি সেইদিনই অন্যত্র বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন। তাঁর আত্মসম্মান ও ব্রাহ্মণ্যবোধ অসামান্য। য়ুরোপে তাঁকে প্রতি বছর উপবীত পাঠাতে হয়েছে। এর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, য়ুরোপে থাকাকালীন তিনি ভারতের স্বাধীনতার দাবী উল্লেখ করে ঘুনিভারসিটিগুলিতে বক্তৃতা দিয়েছেন। অধিকন্তু, এক ইংরাজ-সার্কাস পার্টি পোল্যাণ্ডে কিছু ব্যাঘ্র ও সিংহ সহ দুজন বাঙালী ইণ্ডিয়ানকে দেখানো হবে বিজ্ঞাপন দেওয়ায় তিনি তুমুল প্রতিবাদ করেছিলেন। অগত্যা আমার মাধ্যমে ইংরাজ-ডেপুটি পত্রদ্বারা তাঁর বাড়িতে স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই আহারের নিমন্ত্রণ জানান। কিন্তু ডেপুটি ও তাঁর স্ত্রী উপর থেকে নিচে নেমে এসে তাঁদের অভ্যর্থনা না করায় প্রতিবাদ স্বরূপ তাঁরা স্বগৃহে ফিরে এসেছিলেন। পরে ডেপুটি-সাহেব পুনরায় নিমন্ত্রণ জানালে তিনি উদাত্তকণ্ঠে বলেছিলেন যে ওঁরা স্বামী-স্ত্রী উভয়ে এসে তাঁদের নিয়ে যেতে হবে। ভাষা ও উপভাষাবিদ ভ্রাতাটির কাছ থেকে এও জানতে পারি যে ডেপুটির কথাবার্তার ধরন-ধারণ থেকে স্পষ্ট বোঝা গেছে উনি ওয়েলস-এর বিশেষ এক জেলার জনৈক ধোপার পুত্র। এদিকে ওঁদের মান-অভিমানের চক্রে পিষ্ট হয়ে আমার চাকুরি রাখা দায় হয়ে ওঠে। এই পর্ব চুকে গেলে—আরও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুরোধে ভ্রাতাটি এ্যান্টি-এয়ার-রেডের উপদেষ্টারূপে নিযুক্ত হন।
বিশ বছর পরে ফিরে তিনি দেশীয় আচার-ব্যবহারগুলি সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেন নি। ঘুনিভারসিটি থেকে ফিরে এসে একদিন তিনি বলেছিলেন, ‘দাদা, বিশ্ব বিদ্যালয়গুলিতে দেখি এক-একজন মোহান্ত বসে আছেন!’ চোখে যা-কিছু অসংগত ঠেকে তা সংশোধনে তৎপর হন। ঝড়ে হেলে পড়া গাছটিকেও তিনি সোজা খাড়া করে দিতে চান। পথচারীকে কমলালেবুর খোলা পকেটে পুরে দূরে ডাস্টবিনেফেলতে উপদেশ দিতেন। কেউ হাঁচলে তাঁকে নাকে হাত বা রুমাল চাপা দিতে বলতেন।
একদিন তিনি আমাকে রেগেই বলেছিলেন, ‘দাদা, আর তো এই কেষ্টপেন্টুর দেশে থাকতে পারি না। আমার শিশুপুত্র দেবদান ও তোমার বৌমাকে নিয়ে য়ুরোপে ফিরেই যাব। মহাজ্ঞানী বুদ্ধদেব সাতটি ঘটনার পর গৃহত্যাগী হয়েছিলেন, আমি মাত্র তিনটি সত্য-সংঘটিত ঘটনার পরই দিব্যজ্ঞান লাভ করে দেশত্যাগী হবো ঠিক করেছি।’ বলে তিনি ঘটনাক্রম বিবৃত করলেন একে-একে:
‘প্রথম ঘটনা। —প্রতিবেশী কেষ্ট সমবয়স্ক তরুণ পেন্টু কে সঙ্গে করে এনে বলল, ‘স্যার, গত তিন মাসের বিলের দরুণ মাত্র কুড়িটি টাকা জমা না-দেওয়ার জন্য এই পেণ্টু দের বাড়ির ইলেকট্রিক তার কোম্পানির লোক এসে কেটে দেবে।’ প্রতিবেশীদের বিপদে সাহায্য করা তো নাগরিক কর্তব্য, অতএব কুড়িটি টাকা আমি ওদের দিলাম সপ্তাহ দুই পরে ফেরত পাবার প্রতিশ্রুতিতে। কিন্তু দুমাস কেটে যাবার পরও ওদের কারুরই দেখা নেই। আমি রেডিওতে প্রোগ্রাম করে যা পাই তাতেই মাসিক একটা বাজেট খাড়া করে দিন কাটাচ্ছিলাম। রাহাখরচ, ডাক্তার খরচ, বাড়ি ভাড়া, বাজার খরচ প্রভৃতি ওই সামান্য টাকা নিঃশেষ হয়ে যেতো। এর মধ্যে পেণ্টুর সঙ্গে বাজারে একদিন দেখা। সে বলল, ‘টাকাটা আপনি পান নি? সে কি! আমি তো কেষ্টার হাত-মারফত আপনার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।’ গতকাল সকালে পথে কেষ্টার সঙ্গে দেখা হ’ল। সে খুব লজ্জা পেয়ে বলল, “স্থার, আপনাকে আর কি বলব, পেণ্টু লজ্জা পেয়ে ওকথা বলেছে। প্রকৃতপক্ষে সে এখনও টাকাটা জোগাড় করে উঠতে পারে নি।’ দ্বিতীয় ঘটনা।—শিশুপুত্র দেবদানকে হাসপাতালে দেখানোর জন্য ওর মা হালিনাকে তৈরি হতে বলে আমি একটা রিকশা ডেকে এনেছিলাম। রিকশাটি আমাদের বাড়ির দোরগোড়ায় অপেক্ষা করছিল। এমন সময় দুই প্রৌঢ়া মহিলা ভিজে-কাপড়ের পুটলি-সমেত ওই রিকশায় উঠে বসামাত্র রিকশাওয়ালা তাঁদের নিয়ে চলে গেল। আমার ডেকে-আনা রিকশায় ওঁরা উঠলেনই-বা কেন আর রিকশাওয়ালাই-বা কেন আমাকে কোনো কথা না-বলে গাড়ি টেনে উধাও হ’ল .. কেন? এরপরেও কি তুমি এদেশে আমাদের থাকতে বলবে?
তৃতীয় ঘটনাটি ঘটেছে আজ সকালে। বেলা আটটার সময় রেডিওতে প্রোগ্রাম করতে হবে বলে বেরুবার জন্যে তৈরি হচ্ছি— দেখি পোল্যাণ্ডে তুষারপাতের মতো গল গল করে ঘরে কি-যেন ঢুকছে। ব্যাপার কী? বারান্দায় বেরিয়ে এসে নিচে রাস্তার দিকে তাকাতেই সব পরিষ্কার হয়ে গেল। এক মধ্যবয়সী ব্যক্তি উদোম-গায়ে ফুটপাতে জাঁকিয়ে বসে ধুমুরী দিয়ে মনের আনন্দে পুরনো তুলো ধুনছে। নিচের তলার বাসিন্দার আহ্বান মতো ছেঁড়া বালিশ ও ছেঁড়া তোষক হতে রাজ্যির তুলো বার করে সে শীতকালের জন্য লেপ তৈরি করবে। তা করুক। কিন্তু ওখানে বসে কেন? আর কি জায়গা নেই? এভাবে ঘরের সামনে বসে তুলো-ধোনার ফলে ফুটপাতের যত ধুলোবালি আর বীজাণু এঁদের অন্তঃপুরে গিয়ে ঢুকবে। বাতাসে বেগ থাকার জন্যে আমার ঘরেও তার অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পারব না। আমি উপরের বারান্দা থেকে চোখে-চোখে তাকিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করলাম এভাবে কাজ করা উচিত হচ্ছে না। কিন্তু এ দেশের লোকেদের চোখ দিয়ে কথা বললে একেবারেই বোঝে না—মুখ দিয়ে স্পষ্ট করে বলতে হয়। তাতে রাগারাগির সম্ভাবনা এবং সময় নষ্ট। আমার হাতে অত সময় ছিল না। আমি লোকটিকে ক্ষমা করে আমার কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম এবং ঠিক করে ফেললাম যে এদেশে আর-একটা দিনও নয়।’
পরিহাস করে কথাগুলি বললেও তাঁর মর্মবেদনা অব্যক্ত থাকে নি। তিনি প্রথমে বোম্বে তারপর আবার লণ্ডন-অভিমুখে পাড়ি দিয়েছিলেন। চল্লিশটি ভাষায় সুপণ্ডিত এই ব্যক্তিটিকে এদেশ ধরে রাখার কোনই প্রয়োজন বোধ করে নি।
[দেশ স্বাধীন হলে তিনি মস্কোতে ভারতীয় দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি এবং পরবর্তীকালে অন্য একদেশে অ্যামবেসেডারও হয়েছিলেন।]
গভর্নমেন্ট এই সময়ে বিমান-আক্রমণ এড়াবার জন্যে শহরে নিষ্প্রদীপসহ রাত্রে শ্মশানে শবদাহ বন্ধ করেছিলেন। তাতে ওই কেষ্টবাবু প্রতিবাদস্বরূপ সকলকে জবরদস্তি শবদাহ করতে বলেন। তাঁর প্রস্তাবে কেউ রাজি না হলে হিন্দু-আচার ও পারলৌকিক-ক্রিয়া রক্ষার্থে তিনি চিতা সাজিয়ে তার উপর শুয়ে নিজেই পুড়তে চাইলে আমরা তাঁকে ধরে থানায় এনেছিলাম।
তিলজলার রবিদাস-এলাকায় এক মসজিদে হিন্দুদের জিদ অগ্রাহ্য করে মুশ্লিম-ধর্মের অঙ্গ হিসাবে কোরবানীর ব্যবস্থা আমি করে দিয়েছিলাম। এতে উৎসাহিত হয়ে জনৈক মৌলভী রাসবিহারী গড়িয়াহাটের মসজিদে গো-কোরবানী করতে বদ্ধপরিকর হন। পিছনে এক লীগ-মন্ত্রীর নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও এই কাজের বিরুদ্ধে ঘোরতর প্রতিবাদ জানিয়ে তা বন্ধ করেছিলাম। ওই মন্ত্রীর এক দুশ্চরিত্র ভাগিনেয়কে তাঁর বাড়িতেই অপহৃতা নাবালিকা-সহ গ্রেপ্তার করেছিলাম বলে আমি তাঁর বিরাগভঞ্জন হই। তিনি আমাকে চাটগাঁ অঞ্চলে বদলি করতে চাইলেও জন-বিক্ষোভের ভয়ে শেষ পর্যন্ত পেরে ওঠেন নি। ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ডঃ কালিদাস নাগ, কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচি, কবি নরেন্দ্র দেব, রায়-বাহাদুর যোগেশচন্দ্র সেন ও অন্যান্য সুধী ব্যক্তিরা আমাকে প্রভূত সাহায্য করেন। ডঃ সুনীতিকুমার তো ওই মৌলভীকে গো-কোরবানী বন্ধ করে অন্য কোরবানীর জন্যে দুটি রামছাগলের দাম ধরে দিয়েছিলেন।
প্রত্যেক ব্যক্তি যাতে যুদ্ধে সাহায্য করতে বাধ্য হয় সেইজন্য পরিকল্পনা-মতো দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা হয়েছিল। কারণ—একমাত্র যুদ্ধের চাকুরিতে র্যাশন হিসাবে সুলভে খাদ্যলাভ সম্ভব। যুদ্ধের জন্য উদ্যোগ-শিল্পের প্রয়োজন। তাই শ্রমিকদের খাদ্য সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু গ্রাম অঞ্চলের কৃষিজীবীরা হা-অন্ন হা-অন্ন করে শহরে ছুটে এসেছে। চতুর্দিকে নরনারী ও শিশুদের কাতর ক্রন্দনধ্বনি। ‘মা, দুটো খেতে দাও গো।’ খাবারের দোকানের পাশে ওই কৃষিজীবী নরনারী অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করেছে তবু দোকানের সাজানো খাবার-সামগ্রী তারা করে নি। কারখানার শ্রমজীবী সম্প্রদায় হলে তারা নিশ্চয় লুঠ করতো। আমরা পুলিশের পক্ষে চাঁদা তুলে স্থানীয় ব্যক্তিদের অগ্রণী করে প্রতি এলাকায় অন্নসত্র খুলতে সাহায্য করি। বাড়ি-বাড়ি মুষ্টিভিক্ষা করে অন্নসত্রের স্থানে এনে খিচুড়ি তৈরি করা হ’ত। চাউলের দাম মণপ্রতি ছ-টাকা ওঠায় নাগরিকেরা বিপন্নবোধ করে। আমরা চাউলের দোকান থেকে উদ্বৃত্ত চাউল সংগ্রহ করে সাধারণের মধ্যে বিতরণ করেছিলাম। আমাদের ও অন্য বহুজনের বাড়িতে রান্না-করা ভাত ওরা গ্রহণ করেছে।
বাংলা-পুলিশকর্মীরা তদন্তের জন্য গ্রামে গেলে গ্রামবাসীরা তাঁদের ঘিরে ধরতো বলে তাঁরা ব্যক্তিগত র্যাশন ও অর্থ দান করতেন। তাঁরা স্পষ্টত কর্তৃপক্ষকে বলেছিলেন যে খাদ্য ও অর্থ সাথে না-দিলে গ্রামে তদন্তে যাওয়া সম্ভব নয়।
[তৎকালে-চন্দ্রশেখর বর্মন, দিনেশচন্দ্র চন্দ, শিবচন্দ্র চ্যাটার্জি, জ্ঞান দত্ত, বীরেন মুখার্জি, নীহার বর্ধন, খলিলুর রহমন, মহম্মদ মহসীন, অমিয় দত্ত, অবনী গুপ্ত এবং সেই সঙ্গে আমারও যথেষ্ট সুনাম ও খ্যাতি ছিল।]
আমি কয়েকটি দুরূহ মার্ডার, স্মাগলারি এবং চাঞ্চল্যকর বহু গ্যাঙ-কেসের কিনারা করে খ্যাতি ও সুনাম অর্জন করি। উপরন্তু দাঙ্গা-হাঙ্গামা দমন ও সুষ্ঠু প্রশাসনেও আমার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা লিপিবদ্ধ আছে। কর্তৃপক্ষ আমাকে অন্যতম একস্পার্ট-রূপে গোয়েন্দা-বিভাগে বদলি করলেন। আমি ওই সময়ে তিনটি থানার ঊর্ধ্বতনরূপে বহাল ছিলাম। প্রত্যক্ষ-সংগ্রাম বাধানোর সুবিধার জন্য আমাদের মধ্যে বাছা-বাছা কয়েকজনকে থানা থেকে সরিয়ে আনা হয়েছিল।
[গোয়েন্দা বিভাগে যুদ্ধোপকরণ উদ্ধারার্থে একটি বিভাগর কর্তৃত্ব আমাকে দেওয়া হয়। আমি বহু গোপন আড্ডা, ডক ও অন্যান্য স্থান হতে প্রায় দু‘কোটি টাকার বিভিন্ন সামগ্রী উদ্ধার করি। এজন্য বারে বারে দুর্ধর্ষ স্মাগলারঙ্গের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয় এবং তার ফলে একবার গুরুতররূপে আহত হই।
এই ধরনের অন্য একটি উল্লেখযোগ্য কাজ হ’ল: বিখ্যাত অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান গ্যাঙ-কেসের সার্থক তদন্ত ও নিষ্পত্তি। যুদ্ধ-ফেরত প্রায় দুইশত অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ও ভারতীয় একত্র হয়ে কলিকাতা ও চতুঃপার্শ্ববর্তী জেলাগুলিতে বিভীষিকার সৃষ্টি করে। গাড়ি ও পেট্রল চুরি, ডাকাতি ও হত্যা এবং পথ হতে নারীদের তুলে নিয়ে গিয়ে বলাৎকার প্রভৃতি অপকর্ম প্রায় প্রতিদিন ও রাত্রির ঘটনা। গ্রেপ্তার করার পরও তাদের একদল আদালত ও লালবাজার লক-আপ ভেঙে পালায়। তাদের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষকালে আর-একবার আমি সাংঘাতিক আহত হয়েছিলাম।]
হীরেন্দ্রনাথ সরকার, ও-বি-ই
ইনি কলিকাতা গোয়েন্দা বিভাগের প্রথম ডেপুটি পুলিশ-কমিশনার। স্বাধীনতার পর ইনস্পেক্টর-জেনারেল অব পুলিশ হয়েছিলেন। তিনি পূর্বতন ক্রিমিন্যাল রেকর্ড সেকসনটি ভেঙে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উন্নত করে মোডাস অপারেনডাই বিভাগের সৃষ্টি করেন। উত্তর ও দক্ষিণ কলিকাতায় দুটি বাড়ি ভাড়া করে গৃহহীন পুরনো পাপীদের আশ্রয়ের জন্য দুটি জজ-হাউস স্থাপন করেছিলেন। কিশোর অপরাধীদের জন্য লালবাজারে একটি শিক্ষণ-কেন্দ্রও স্থাপন করেন। এই-সব কাজে আমি তাকে সাহায্য করেছিলাম।
[ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলিকাতার নাগরিকবৃন্দ এই উদ্দেশ্যে প্রিরজনারস এইড-হাউস তৈরি করেছিলেন। এটিকে ‘চোর হাউস’ বলা হ’ত এবং এখানে জেল-ফেরত লোকেরা আশ্রয় পেতো ও বাড়ি ফেরার রাহা-খরচ নিতে।। স্বাধীনতার পর এটি পুনর্জীবিত হলে গভর্নমেন্ট ওই সংস্থার একজন এক্সপার্ট মেম্বাররূপে আমাকে মনোনীত করেন। ওই সময় দিল্লিতে সর্বভারতীয় সোস্যাল-ওয়েলফেয়ার কনফারেন্সে যোগদানের জন্য এই রাজ্যের পক্ষে মনোনীত ডেলিগেটরূপে আমাকে পাঠানো হয়।]
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষদের ত্রৈমাসিক সভায় আমি প্রস্তাব রাখি যে, গ্রামে-গ্রামে রিক্রুটিং পার্টি পাঠিয়ে বাঙালী কৃষকদের মধ্য হতে কলিকাতা পুলিশের জন্য কনস্টেবল সংগ্রহ করা হোক। অনেকেই বাঙালী-কনস্টেবল নিয়োগের বিরুদ্ধে অভিমত প্রকাশ করেন, কিন্তু হীরেন্দ্র সরকার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আমার প্রস্তাব সমর্থন করে মন্তব্য করেছিলেন: ‘আমরা আর কতোকাল বহিরাগতদের দিয়ে প্রশাসন চালু রাখবো?’ দৈহিক উচ্চতার প্রশ্ন উঠলে আমি তাদের বলেছিলাম, তাহলে গুর্খাদের ভর্তি করা হচ্ছে কেন?
যুদ্বোদ্যমে সাহায্যের জন্য তাঁর নেতৃত্বে আমি ও সত্যেন্দ্রনাথ মুখার্জি কলিকাতার বণিক-সম্প্রদায় ও অন্যান্য নাগরিকবৃন্দের নিকট থেকে রেডক্রসের জন্য বাৎসরিক দু-লক্ষ টাকা চাঁদা তুলেছিলাম। হায়, এতোসত্ত্বেও আমরা ইংরাজ-প্রভুদের পক্ষপাতিত্ব নিবারণ করতে পারি নি!