চটি
সারাজীবন বিপদগ্রস্ত হতে হতে শেষে যে বিপদ আসে তা হৃদয়ঙ্গম করার জিনিস। বিপদের শুরু হয় মাসখানেক আগে, নির্মলের এবারের নতুন চটিজোড়া নিয়ে। কিন্তু নির্মলের চটি বললে মোটে ঠিক বলা হয় না। সম্পূর্ণ ভুল বলা হয়ে যায়।
সেই ছোটবেলায় যা নটিবয়, তারপর থেকে একজোড়া চটি ছাড়া জুতো বলতে নির্মলের কোনো-কালেই কিছু নেই। বিবাহের সময় একজোড়া পাম্প-শূ পেয়েছিল বটে, সেটা, বছরচারেক হতে চলল, বিয়ের জোড় কি জামাইবাবুর সঙ্গে জয়পুরে তোলা মলিনার বালিকাবয়সের ছবিটার সঙ্গে হয়ত তোরঙ্গ বা আলমারির কোণায় পড়েই আছে। নতুন চাকরিটার ইন্টারভিউ-এর দিন শালা-শু পরে গিয়েছিল ঠিকই, সওদাগরি অফিস, নইলে নাকি কাজটাই পেত না। তারপর থেকে চটিতেই তো দিব্যি চলে যাচ্ছে।
চটি ছাড়া সে কিছু পরে না, সে কখনো চটিতে হাফসোল লাগায় না। কাজেকাজেই, বুরুশ, পালিশ, এ-সবের বালাই তাদের বাড়িতে নেই। মলিনাও চটি বা ঐ-জাতের জিনিশ কেনে। চটি ছিঁড়ে কি অকেজো হয়ে গেলে, সে সটান চলে আসে কলেজ স্ট্রিটে। নিউ মার্কেটেও যায়, সে তো অফিসের লাগোয়া। সে বরাবর বাড়ি ফেরে নতুন চটি পড়ে, পুরোনো চটি দোকানে নিয়ে নেয় ভালোই, নতুবা, নতুন বাক্সসহ, কাছাকাছি মুচিকে নির্মল তা দান করে। ডাস্টবিনেও ফেলে দেয়। দোকানের পর দোকান ঘুরে, বেশ নির্বাচন করেই ও বহু সময় ধরে সে চটি কেনে, টেকসই দেখে তো বটেই, প্রায়ই বছর কাবার হবার আগে চটি-বদলের তার প্রয়োজন হয় না। সবসময় একদিনের চেষ্টাতে চটি কেনা যায় নাকি? সেক্ষেত্রে ছেঁড়া চটি পরেই সে কোনোমতে কদিন চালায়, ফুটপাতে মুচিকে দিয়ে একটু সেলাই-ফোঁড়াই করিয়ে নেয় কখনো বা, পুরোপুরি মনোমাফিক না-পাওয়া পর্যন্ত চটি কেনা থেকে তবু সে বিরত থাকে। বাস্তবিক, একটি চটি মানে কি শুধু তার দীর্ঘায়ু নাকি? আরো নানান দিক আছে, যেমন, সেটা স্টাইলিশ তো হবে—যার নাম কিনা বেশ আধুনিক বা সমকালীন হবে—অথচ, এমনটি হওয়া চাই যেন চোখে না পড়ে, যেন পথচারীর শতসহস্র চটির ভিড়ে তা মিশে থাকার যোগ্য হয়। মোটকথা, তার একটা ইউনিকনেস থাকা দরকার। সাবালক হবার পর থেকে চটি থেকে চটি সে এ ভাবেই কিনে যাচ্ছে, অর্থাৎ একা-একা, বন্ধুবান্ধব কারও সাহায্যের প্রয়োজন কোনোদিনই হয়নি। আজ সে একটা বিশেষজ্ঞতা অর্জন করেছে বলা চলে এ-ব্যাপারে, মানে, তার চটি-ব্যাপারে সে। আর কিছু না বুঝুক, এটা মলিনা বোঝে; যে-জন্যে, একদিকে যেন মলিনা তার চটি কি চটি-জাতীয় জিনিস সে নিজেই কেনে বা কিনিয়ে নেয়, অপরপক্ষে সে কখনো চটি-সংক্রান্ত নির্মলকে বিন্দুমাত্র বা কোনোরূপ সাহায্য করার প্রস্তাব করে না। বস্তুত, বিবাহোত্তর চার-বছরে নির্মলকে ৭-টি চটি কিনতে হয়েছে। দীর্ঘজীবনসহ তাদের সর্বৈব অতুলনীয়তার জন্যে মলিনা বরাবরই, প্রতি চটিজোড়াকেই, দিতে পেরেছে সেই চাউনি যা এ্যাডমিরেশানে ভরা। বিপদজ্ঞাপক শেষ চটিটি তো একেবারে হালফিল কেনা হয়েছিল।
বিয়ের পর যাকে অনেক সময় মধুচন্দ্রিমা বলা হয়, কতকটা সে-কারণেই তারা চুনারে গিয়েছিল। চুনারে কবর অজস্র, নুড়ির মতন যত্রতত্র, একটা ছিল শীতের গঙ্গার পারাপারহীন চরের ওপর ‘কেশরী ভবন’ নামে তাদের খেলাদেলির বাড়ির একেবারে খিড়কিতেই, সেখানে রোদে বসে ও পাহাড়ি হাওয়ায় সে বাক্সটি প্রথম খোলে ও দুধ-রঙের খরখরে কাগজ দু-হাতে সরিয়ে কাছে ডেকে মলিনাকে চটিজোড়া দেখায়, যার মাহাত্ম্য, সে কৃতজ্ঞ যে, প্রথম দৃষ্টিপাতেই মলিনা যা বোঝার বোঝে। ‘ওও!’ দেখে চকচকিয়ে উঠেছিল মলিনা, ‘কখন কিনলে?’ ‘তুমি আমাকে আগে বলোনি!’ ওষ্ঠাধর বিস্তৃত করে সে আরও বলে। সত্যি, ভারি আকর্ষণীয় ছিল মলিনার ঠোঁটজোড়াও, শুকনো এবং কাঁপত, ধুলো-ভরা পাখনা বল্লে বলা চলে। এ ছিল সেই ধরনের ঠোঁট, ডাগরএবং পুরন্ত, কথা বললেই যা মস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে, পুরুষমাত্রকে তার কাছে টানে যা। চুনারেই সে ঐ চটিজোড়া প্রথম ব্যবহার করে, আহা, অমন সৌখিন জিনিস, দিন পনেরো ধরে উন্মাদ ও উপর্যুপরি ব্যবহারে, পাথরে ঠোক্কর খেয়ে খেয়ে, পাহাড়ি রাস্তায় ক্রমাগত ওঠা-নামার দরুনই বুঝি তা অমন কমজোরী হয়ে পড়ে। ‘এ তো তোমারই’, কতবার বারণ করেছিল তাকে মলিনা, ‘নিজের জিনিস নিয়ে এমন কোরো না প্লীজ। ছিঁড়ে যাবে।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা। কলকাতায় ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই আবার চটি কিনতে হল।
অপর একজোড়া চুরি হয়ে যায়। চুরি? হ্যাঁ, চুরি। সেটা অবশ্য, শেষ-বিপদের কারণ এই এবারের চটিজোড়ার মতন, আনকোরা নতুন ছিল না। তবে সেটি ছিল কোলাপুরি। সেবার চুনার থেকে ফিরেই নতুন চটি কিনতে হয় এবং মাস পাঁচেকের মধ্যে, মানে, তাদের বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ঐ কাণ্ড! সেটা ছিল ভারি যুৎসই, কালচে চামড়ার, অ্যাঙ্কলের সামনের স্ট্র্যাপটিতে ছিল একটিমাত্র সাদা জরি, যা তার লম্বাপানা ফরসা পায়ে দিব্যি মানিয়েছিল। আর তার ফিটনেস আজো পায়ে লেগে আছে।
সত্যি, ভাবাই যায় না, কল্পনাতীত উপায়ে চটিটি চুরি হয়ে যায় এবং চোখের পলকে। সে-বছর দিনতিনেক ধরে প্রায় ১৯-ইঞ্চি বৃষ্টি হয়, এমন যে, ডি.ভি.সি. জল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। বাড়ির চারদিকে বৃষ্টির জল এত জমে ওঠে যে নির্মলা সেদিন অফিস যেতে পারে না। চারদিকে আর-সব ডুবে গিয়ে অদূরে খানিকটা খালি জমি ও বড়রাস্তার সঙ্গে সংযোগরক্ষাকারী কালভার্টটি শুধু জেগে থাকে। দুপুরবেলা বৃষ্টি একবার থেমে যায়। আকাশ অবশ্য তেমন মেঘময়, জোলো হাওয়া বইছে আগের মতোই। এ বেশিক্ষণের ব্যাপার নয় বুঝে নির্মল একটা আর্জেন্সি বোধ করে বাইরে যাবার, চট করে উঠে পরে একটা পাঞ্জাবি গলাতে গলাতে ব্যস্তস্বরে সে মলিনাকে ডাকে।
‘কিছু পয়সা দাও তো?’
‘সিগারেট?’
‘আঃ দাও না’ বলে সে চটিজোড়ার দিকে অগ্রসর হয়।
একতলার বিড়ালীর বেশ কয়েকদিন হল বাচ্ছা হয়েছে। তার একটি ভিজে একসা হয়ে কী-ভাবে ঢুকে পড়েছে তাদের ফ্ল্যাটে, বসবি তো বোস, নির্মলের চটির ওপরেই বসে আছে। ‘হুশ’, ‘হুশ’, ‘যাঃ’, বলে হাত নেড়ে তাকে তাড়াবার চেষ্টা করে নির্মল, ইস, এক্ষুণি বৃষ্টি এসে যাবে। নির্মল এবার মারমুখো জোরে তাড়া দিলে, অতটুকুন বিড়ালছানা তারই চটিতে বসে মুখব্যাদান করে তাকে শাসায়, স্পষ্টত সে একটা ঠ্যাঙও তোলে। এ-সময় মলিনা এসে একহাতে টুঁটি ধরে ছানাটা তুলে ধরে ও অন্য হতে একটা টাকা নির্মলের দিকে বাড়িয়ে দেয়। ‘এত তেজ, নিশ্চিত বিড়ালী!’ নির্মল সহাস্যে বলে।
টাকাটা একরকম ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে খোলা দরজা দিয়ে সে তরতর করে চটি পরে একতলায় নেমে যায়। যা করার, বৃষ্টি আসার আগেই করতে হবে। তাদের ছাতা নেই।
দু-এক পশলা বৃষ্টি হলেই এদিকটা রীতিমত নাব্য হয়ে ওঠে। একতলার খোলা দরজা থেকে গোড়ালিসমান জলে সে দ্বিরুক্তিহীন নেমে পড়ে। চটি পরে? হ্যাঁ চটি পরে। তবে আর তার কৃতিত্বটা কোথায়, এমন চটিই যদি সে কিনবে যা নাকি রোদে-জলে-কাদায়-পিছলে পরা যায় না? বালির ওপর দিয়ে হাঁটা যায় না? বা, যা পড়ে পাহাড় ডিঙোনো যায় না? এই চটিজোড়া সে কিনতে পায় কলেজস্ট্রীটের ‘পদাম্বুজ’ থেকে। কেনার সময় দোকানের বালক-কর্মচারীর সঙ্গে ভারি মজার একটা কথা হয় তার। চার-পাঁচ জোড়া চটির একটাও ফিট করতে না দেখেছেলেটি, ‘আপনার পাঞ্জা সরু’ বললে, উত্তরে নির্মল তাকে বলে, ‘দ্যাখো ভাই, পা আমার যে-রকমই হোক, তা তো আর তোমার জুতোর মাপে করা যাবে না, জুতোকেই আমার পায়ের মাপে হতে হবে।’ উত্তরটি কোনো না-কোনো দিক থেকে মার্ভেলাস হয়েছিলই, কেননা, উত্তর শুনে, দোকানের নিভৃতি থেকে দোকানের মালিক বেরিয়ে আসে ও স্বহস্তে প্রকৃত চটিটি নির্মলের পায়ে পরিয়ে দিতে যায়।
সত্যি, নির্মল চটি কেনে কত মনস্কভাবে এবং প্রতি চটির সঙ্গে, কেনার আগে, একটা ভালোবাসাবাসি না-জন্মালে সে তা কেনে না বলা চলে। মাঝে মাঝেই নির্মল তার চটি-জোড়া ধোয়, মোছে, তাকে রোদে দিতে দেখা যায়। কোলাপুরিগুলো তো একবার রোদে দিয়ে একটু তেল-ন্যাকড়া বুলিয়ে নিলেই তরতাজা হয়ে ওঠে। কিন্তু কে বলবে নির্মলের প্রাণে একটু মায়াদয়া আছে যখন সে, দৃপ্ত ও দ্বিরুক্তিহীনভাবে, জলে-কাদায় নেমে পড়ে—জুতো পরে নামতে কে না দ্বিধাবিভক্ত হয়—দেখে মনে হয় যেন সে অনিচ্ছুক, মূক জানোয়ারকে চাবকে নামাচ্ছে। হাজার চটির ভিড় থেকে পরিশ্রমসাধ্য পছন্দ করে সে, নির্মল রায়, সেই তো এটা কিনেছে। নির্মলকে সার্ভিস না-দিয়ে তা যাবে কোথা, দিতে বাধ্য।
সেদিন শুকনো কালভার্টে উঠে তবু থমকে দাঁড়ায় নির্মল। মাঠে অল্প জল হলেও, রাস্তায় জল একহাঁটু। গর্তগুলো এড়িয়ে যেতে না-পারলে জল বিপদসীমা ছাড়িয়ে, তা সে জানে। হঠাৎ বহুকাল পরে, স্মরণকালের মধ্যে বোধহয়তো এই প্রথম, চটিজোড়া কালভার্টে রেখে খালি পায়ে নির্মল জলে নেমে পড়ে।
কালভার্টটি এমনিতে বাড়ি থেকে দূরে; ২১০ টাকা দামি দমদম হাউসিং এস্টেটের তাদের এই দক্ষিণ-পূর্বদিকের চারতলার ফ্ল্যাট থেকে দূরতর, তবু জানালার পর্দার ওপর মলিনার মুখ তো জেগেই ছিল, সে চটির প্রতি একটা ইশারা করে যেতে পারত। মলিনার চোখে চশমা, তবে কাছের জিনিসই শুধু সে দেখতে পায় না। তা ছাড়া, জলে তো যা ভেজার ভিজেইছে, গভীরতর জলে চটিজোড়া কি বেশি-বেশি ভিজত নাকি?
পথ প্রাণীহীন। মোড়ে একটা রিকসা এখনও দেখা যায়, এখুনি বাঁক নিলে জঙ্গম বলতে আর কিছুই থাকবে না। রাস্তা পেরিয়েই ভূজাঅলার দোকান, এখন ঝাঁপ-ফেলা, তবে ব্যাটা ভিতরেই আছে। নতুন বউ আনিয়েছে দেশ থেকে, আর এই বৃষ্টি, যাবেটা কোথা। লোকটা সিগারেটও বেচে। এখানে পৌঁছে কালভার্ট পর্যন্ত বেশ দেখা যায়। চারদিকের পানাভরতি, ঘোলা, নোংরা জলের মধ্যে ঐ জেগে রয়েছে, কালভাটের ওপর, তার নাতিতরুণ চটিজোড়া, সে দ্যাখে। ডাকাডাকি করে সিগারেট পেতে কতটুকুই বা দেরি হয়ে থাকবে, বড়জোর পাঁচ-মিনিট? ইতিমধ্যে মেঘ ঝুলে পড়ে।
এবং মুখ ঘুরিয়েই, কে বলে মিরাকল বলে কিছু নেই, জীবনের বিশ্বাসযোগ্য-অবিশ্বাস্যকে সে প্রত্যক্ষ করে। তার চটিজোড়া আর নেই। নেই? না:, কই নেই তো! এবং ঠিক সেই জায়গায়, কোথা থেকে ও কী-করে কে জানে, একটি বেগুনিরঙের আস্ত কচুরিপানার ফুল। পাশে, রাস্তায় জলের ওপর দাঁড়িয়ে, ছেঁড়া গেঞ্জি গায়ে ও কালো হাফপ্যান্ট-পরা একটি গরিবলোকের ছেলে।
ছেলেটি কোথা থেকে এল! ছপছপ শব্দ তুলে কোনাকুনি হেঁটে নির্মল কালভার্টের ওপর ওঠে। যেতে যেতে মেঘ ডেকে ওঠে ও হুড়মুড় করে বৃষ্টি নেমে পড়ে। বৃষ্টির মধ্যে ছেলেটি জলে গোড়ালি ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে। যেন তার কোথাও যাবার নেই! কালভার্টের ওপর, ঠিক, অবিকল চটিজোড়ার জায়গায়, যেন চটির বদলেই রয়েছে মস্ত ফুলটা, হ-য-ব-র-ল’র সেই ‘ছিল রুমাল হয়ে গেল বেড়াল’ গোছের নাকি ব্যাপারটি?
‘এখানে একজোড়া চটি ছিল?’ পাশেই কারখানার টিনের চালের জন্যে বৃষ্টির শব্দ এত বেশি যে ঠোঁটদুটি যথাসম্ভব ফাঁক করে নির্মলকে বেশ চেঁচিয়ে বলতে হয়, যে-জন্যে মুখের মধ্যে তিরের মতো বৃষ্টির জল এসে পড়ে। ছেলেটি মাথা নেড়ে বলে, ‘আমি তো জানি না।’ ‘সে কী!’ অবাক লাগে নির্মলের, এ-রকম অবস্থায় পড়লে বড্ড বোকা-সোকাও লাগে, তার ওপর আবার মৃদু হাসি পায়, যা বোকারই। নির্মল অসহায়ভাবে ওপর দিকে চায়, বৃষ্টি আরও ঝেঁপে আসছে, চারতলার জানালা একটুখানি ফাঁক করে মুহুর্মুহু হাতে নেড়ে কালভার্টের দিকে ইশারা করছে মলিনা, সেদিকে চেয়ে বড়সড় একটা পানাফুলের জল-ধোয়া অমল বেগুনি ছাড়া কোনো চটি নির্মলের চোখে পড়ে না। ফুলে-ফেঁপে বৃষ্টি আরও বাড়ে, ঘন ঘন বিদ্যুৎচমক ও মেঘ-ডাকাডাকির মধ্যে নিচু হয়ে নির্মল ফুলটা কুড়িয়ে নেয়। ফ্ল্যাটের দরজা খুলে মলিনা একরকম কেড়ে নেয় তার হাত থেকে ফুলটি ও ভাস-এ জল ভরে তখুনি রাখে। তারপর শুকনো তোয়ালে বের করে নির্মলের হাতে দেয়। সেদিন আর বাইরে বেরবার দরকার করে না। ফ্ল্যাটে এ-ঘর ও-ঘর করতে গিয়ে যতবার চোখে পড়ে, নির্মল ততবারই বিশ্বাস করতে চায়, ঐ মস্ত বেগুনি ফুলটাই হচ্ছে তার চটি; সে ইচ্ছুক, তবু তার বিশ্বাস হয় না। ফুলের কারুকাজ থেকে বেগুনি আভা ছাড়া কিছু তার কোনো চটি তার, চোখে পড়ে না।
যাইহোক, পরদিন ঘরে-পরার হাওয়াই-চপ্পল পরে নির্মলকে বাজারে যেতে দেখার আগে ব্যাপারটা লক্ষ্যই করেনি মলিনা। গত রাতে নির্মল তাকে যার-পর-নেই আপ্যায়ন করে। তবু চটিহারা নির্মলের রাতের ভালোবাসার যাথার্থ-ব্যাপারে দিনের বেলায় সে রীতিমতো বোকা বনে যায়।
কিন্ত এবারের চটি নিয়ে যে বিপদ আসে অভাবিত দিক থেকে, সত্যি, তা হৃদয়ঙ্গম করার জিনিস। এ কিছু হঠাৎ স্ট্র্যাপ-ছেঁড়া বা চুরি-টুরি হওয়ার ব্যাপার না। ব্যাপার এই যে, আসলে, গত মাস দুই ধরে নির্মল যে-চটিজোড়া পড়ে আসছে-যাচ্ছে, সেটা তার চটিই নয়!
অথচ এবার চটি কিনতে তাকে একটুও বেগ পেতে হয়নি। বিখ্যাত কলেজ স্ট্রীটে এবার তাকে আদৌ ঘোরাঘুরি করতে হয়নি। কিছু টাকার জন্যে সে গিয়েছিল শিবপুরে, মনুর ওখানে। টাকা পায়ও। স্টপে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে, ট্রাম-বাস কিছুরই দেখা নেই, মাঝে মাঝে শালিমারের দিক থেকে লরি-ভরা মাল ও ট্রাকভরতি সি. আর. পি. যায়। ওদিকে ঘন ঘন বোমার শব্দ আগেই পেয়েছে।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে, তারপর সিগারেট-এর দোকানে দড়ি তুলতে গিয়ে সে চমকে ওঠে— আর-এ! ধূলিমলিন কাচের লম্বালম্বি ক্র্যাকের ভেতর দিয়ে মাসদুই আগে ও ধোঁয়াকুয়াশার মধ্যে সহসাই এবারের চটিজোড়ার সম্মুখীন হয় সে। তবু হাতে না নিয়ে তথা পায়ে গলাবার আগে চটির মাহাত্ম্য সে বোঝেনি। হ্যাঁ, এর জাত আলাদা। স্ট্র্যাপের বদলে, ওহ, এটা তৈরি হয়েছে কিনা চামড়ার কতকগুলো পাকানো দড়ি দিয়ে? ভাবা যায়! স্রেফ দড়ি দিয়ে—আর কিচ্ছু না—না-কোনো পেরেক, না-একটা সেলাই, না-কিছু। এ-রকম চটি এখানে, শিবপুরের এই এঁদো দোকানে এল কোত্থেকে, কতদিন ধরে- বা পড়ে আছে এই ভাঙা ধুলো-ভরা শো-কেসে। আর এর পাতলা সোল, আ, নারীর অনিচ্ছুক রূঢ় ঠোঁট যা, পায়ে গলিয়ে দুপা হেঁটেই সে বুঝতে পারে, একে নিস্পিষ্ট করার মত সুখ আর কী। এত হালকা! এ কী এ-দেশে তৈরি? উত্তরের জন্যে সে দোকানির লোল মুখের দিকে তাকায়। আসন্ন বিক্রির লোভে দোকানের মলিন আলোতেও জ্যান্ত হয়ে উঠছে বৃদ্ধের কোটরাগত দুটি চোখ—এ-ছাড়া সে কিছুই সেখানে খুঁজে পায় না। নীরবে সে চটিজোড়া কেনে ও পুরানোটি বিনাবাক্যব্যয়ে রেখে দোকান থেকে বেরিয়ে আসে। আগেরটা আরও মাসখানেক বেকসুর চলত। ঠিক এখুনি কেনার দরকার ছিল না। মানুর কাছে পাওয়া প্রায় সব টাকাই বেরিয়ে গেল।
সে অন্তত দুমাস আগের কথা। তারপর মাসখানেক আগে একদিন ছুটে ট্রাম ধরতে গিয়ে ও অতি অনির্দেশ্যভাবে পড়ে গিয়ে নির্মলের প্রথম সন্দেহ হয়। উঠে দাঁড়িয়ে পা থেকে খুলে, একপাটি উল্টিয়েই যা বাঝার সে বোঝে! দেখে তার মাথার ভিতরে, স্মরণকালের মধ্যে এই প্রথম, স্তব্ধ-এলাকার নিউরনগুলির মধ্যে দারুণ কোলাহল পড়ে যায়; মাথার ভিতরে লক্ষ-লক্ষ-লক্ষ নিউরনের সহসা-ছোটাছুটি সে টের পায় বললে একটুও বেশি বলা হয় না।
এ কার চটি সে পড়ে আছে, গত এক, দেড় কি দুমাস ধরে! এ তার চটি নয়! অথচ, কে বলবে এ তার নয়, অবিকল তারই, এটিও মাস দুয়েকের মত ব্যবহৃত। নিজের মনে ভুলে কখন সে দ্বিতীয়রহিত ভেবে তার চটিজোড়াকে ভুল করেছিল। অথচ আছে; ছিল। অবিকল আর-একজোড়া ছিল এই কলকাতাতেই, কেননা, বিগত দুমাসের মধ্যে সে কলকাতার বাইরে যায়নি এবং যা-কিনা কেনা হয়েছিল আনুমানিক মাসদুই আগেই! অফিসফেরত জনস্রোতের মাঝখানে হতচেতন দাঁড়িয়ে থেকে, ধাক্কা খেতে খেতে, একপাটি চটি ধরে নির্মল দাঁড়িয়ে থাকে। তার গোড়ালির চাপ পড়ে বাঁ-দিকে। সাধারণত তাই তো পড়ে থাকে তার মতো গড়পড়তা মানুষের? কিন্তু, ক্রমাগত পেষণে, এর ডানদিক ক্ষয়ে গেছে। সে এই জন্যে পিছলে গিয়েছিল বাঁ-দিকে। গোড়ালির চাপে ছুটন্ত শরীরের ভার অভ্যাসমতন রাখতে গিয়ে। কিছুদিন যাবৎ এ-নিয়ে অসুবিধের আরও দুটি-একটি খুঁটিনাটি নির্মলের এবার মনে পড়ে। সে আর ট্রামে ওঠার চেষ্টা করে না। এখান থেকে বাসা পর্যন্ত মাইল-তিনেক হাঁটার জন্যে প্রস্তুত হয়ে, ফুরানো সিগারেট থেকে আর-একটা আস্ত ধরিয়ে, সে এগোয়। তবু তার কিছুতে মনে পড়ে না সে গত দুমাসে কোথায়-কোথায় গিয়েছিল, কোথায়-বা পা থেকে খুলে রেখেছিল চটি অথবা কার বাড়িতে বা ঠিক কোথায় তার এহেন-অজ্ঞাতসারে চটি বদলাবদলি হয়ে গেল। আকাশ-পাতল রোমন্থন করেও সে কোনো কিনারা করতে পারে না। যত মনে করতে চেষ্টা করে; ভুলে-যাওয়া তাকে তত ছেঁকে ধরে। ডানদিকে গোড়ালি বসাতে সে একবার, দুবার, পঞ্চাশবার চেষ্টা করে। পঞ্চাশ পা-র বেশি সে এগুতে পারে না। গোড়ালির ডানদিক থেকে একটা শিউরানি উঠে এসে মেরুদাঁড়া নরম করে দিয়ে এখন মাথায় ঢুকে পড়ছে, শরীর ভেসে যাচ্ছে ঘামে, বুকের ওঠা-পড়া অসম্ভব বেড়ে গেছে, সে বোঝে। সে থামে; থেমে সে আবার হাঁটতে শুরু করে।
এতে কোনো ভুল নেই যে অন্তত মাসখানেকের বেশি সময় ধরে যে-চটিজোড়া নির্মল পরে রয়েছে তা নির্মলের নয়। ট্রাম-অ্যাকসিডেন্টটি ঘটে আজ থেকে ঠিক এক মাস আগে। সেটা ছিল পে-ডে। পড়ে যেতে-যেতেই নির্মলের হাত চলে গিয়েছিল বুকের বাঁ-দিকে, হার্টের ওপর, পে-প্যাকেটটি সেদিকেই ছিল। চটির আসল মালিকও টের পেয়েছে নিশ্চয় এতদিনে। সন্দেহ কী যে, ও-প্রান্ত থেকে সেও এমনি খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে।
সমস্যা বটে একটা। সমস্যা যখন, সমস্যামাত্রেরই একটা না একটা সমাধান থাকার কথা। কিন্তু নির্মলের কেমন একটা পূর্বধারণা জন্মায় যে, এটা বোধহয় গুজবের সেই অতিলৌকিক ধরনের, যত দিন যাবে যার জটিলতা ও রহস্য বাড়বে বই কমবে না। সুতো একটা আছেই যা অনুসরণ করলে জটিলতম জটও খোলে, হুঁ, এটা একটা সত্য ধারণা বটে। তবু স্থির নিশ্চিত হবার আগে যে-কোনো একটা সুতো পরীক্ষামূলক ছুঁতে নির্মল সাহস পায় না। একটিমাত্র ভুলে, এক্ষেত্রে, এক-জীবনের ভুলচুক হয়ে যাবে, সে মনে করে। বহু রাত অব্দি জেগে জেগে সে ভাবে। এর শেষ কোথায় নির্মল কিছুতে বুঝে পায় না। ‘আচ্ছা জ্ঞানের বিয়েটা কত তারিখে ছিল বলো তো?’ মলিনা মনে করে এটা কোনো প্রশ্নই না, যে-জন্যে, উত্তরে, অন্ধকার থেকে তার বুকের টিপকল খোলার পুটপুট ভেসে আসে। ‘আচ্ছা, জ্ঞানের বিয়েতে কি আমি চটি খুলেছিলুম?’ মলিনার পিঠের দিক থেকে উপুড় হয়ে শুয়ে নির্মল এবার জানতে চায়।
‘সবুর করো না, আঃ। হুকটা খোলো।’ চাপা কামনাকাতর গলায় মলিনা জবাব দেয়। জ্ঞানের বিয়েতে চটি খোলার প্রশ্ন ছিল না তো, নির্মলের মনে পড়ে যায়।
শ্যামপুকুরের দেবজ্যোতির সঙ্গে একদিন দেখা, সেও প্রায় মাস দুই হতে চলল। ‘মেথি আছে, মেথি?’ একটা মুদির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্নস্বরে দেবজ্যোতি জিজ্ঞেস করছিল। ছেলের হাম রিলাপস করেছে। জীবনভর মানুষ এমন কত-না বিপদে পড়ে। না, চটি সেখানে খোলেনি। সে কথা নয়। সে দেবজ্যোতির বাড়িতেই যায় নি। ‘গা স্পঞ্জ করাও। আর হোমিওপাতি করাবে, বুঝলে?’ গোছের বলে তাকে এড়িয়ে যায়। তখন সবে সন্ধে, তবু বাকি গলিটা কী অস্বস্তিকর ফাঁকা, আজকাল এ-দিকে গণ্ডগোল লেগেই আছে। আল্গা কসিটা আঁট করার জন্যেই এক জায়গায় জামাটা তাকে তুলতে হয়। তুলতেই তড়াক করে তিনটি ছেলে অন্ধকার রক থেকে একসঙ্গে লাফিয়ে ওঠে। নির্মলও জামা তুলে রেখে যতক্ষণ উচিত তার চেয়ে বেশি সময় ধরে কসি আঁটে। সে কিছু প্লেন-ড্রেসড নয়, এটাই দেখায় আর কী। কিন্তু এটাও কথা না। গলি থেকে পরিত্যক্ত রাজপথে পড়ে, ট্রামলাইনের দিকে একা এগিয়ে যেতে যেতে ও একবারও মুণ্ডু না-ঘুরিয়ে, সেদিনই প্রথম নির্মল টের পায় যে, দূরত্ব বজায় রেখে একজোড়া চটি-পরা পা তাকে অনুসরণ করে আসছে।
কথা হল, সেদিন সে যে চটি পরে ছিল, সে কী তার? কেননা, সেই থেকে শুরু। তারপর থেকেই দিনকে-দিন সে কেমন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে, সে ভেবে দ্যাখে। বিশেষত, ট্রাম-অ্যাকসিডেন্টের পর থেকে এটা বেড়েই চলেছে। একটা চার্টার্ড ফার্মে পার্টটাইম সেরে ফিরতে আজকালকার হিসেবে নির্মলের বেশ রাত হয়ে যায়। ততক্ষণে, দোকানপাট এদিকে বিলকুল বন্ধ হয়ে যায়। এস্টেটের মেন গেট থেকে তাদের এফ-ব্লক পর্যন্ত সুরকির পথটুকু ৯-টা নাগাদ নিঃঝুম হয়ে পড়ে। এইটুকুর মধ্যেই নির্মল ঘাড় ফিরিয়ে বারকয়েক আশপাশ দেখে না-নিয়ে পারে না। কেউ বোধহয় একা-তাকে কোনো কিছুর জন্যে দায়ী করবে যে জন্যে সে অপরাধী নয়, তার মনে হয়, অন্তত কোনো প্রমাণ নেই যে সে নয়। উল্টোদিকে সে সম্পূর্ণ নিরপরাধ এই বোধও তার মধ্যে জন্মাতে দ্যাখে। আজ থেকে চার বছর আগে, ভোরবেলার কথা ভেবেই সে এই দক্ষিণ-পূবের বারান্দাঅলা ফ্ল্যাটটি নেয়। বরাবর সে ভোরে ওঠে, প্রত্যুষার এই লাল রৌদ্রাভাটুকুর জন্যে পাঁচ শ-টাকা ঘুষ দেওয়া সে যুক্তিযুক্ত মনে করে। কিছুদিন হল সে আর বারান্দায় বসে না। শুধু সে কেন, মাটি শুঁকতে শুঁকতে, দূর থেকে একটি পুলিশভ্যান আসতে দেখে আজকাল ভয় কে না পায়। ধরো, ঠিক পাশ দিয়ে যাবার সময় একটা পেটো পড়ল, পড়তে তো পারেই, ওঃ, ভাবা যায়! দূরে পুলিশভ্যান বা সি আর পি-র ট্রাক দেখলেই নির্মল তাই দ্রুত হেঁটে একটা না-একটা গলির কাছাকাছি পৌঁছে গতি শ্লথ করে দেয়, যাতে-করে, যদি পড়ে, যেন সে সুট করে গলিতে ঢুকে পড়তে পারে। অনেকেই এ-রকম করছে কিনা, নির্মল তা জানে না। আজকাল কে-বা কার সঙ্গে মন খুলে কথা বলে, বিশেষত এসব ব্যাপারে। গত মাসদুই ধরে, প্রায় চটিবদলের সমসাময়িক কাল থেকে, তার এই অপরাধীবোধ না কমে বরং বেড়েই গেছে।
তাদের ব্লকে ঢোকার মুখে একটা ছোট গেট রয়েছে। গেটের আঙটা খোলার ‘টিং’ করে ছোট্ট শব্দ দিনের মধ্যে কতবারই না তার হৃদস্পন্দন এলোমেলো করে তোলে। আগে তবু রাতের দিকেই ভয় করত বেশি। কর্কশ স্বরে কথা বলতে বলতে রাস্তা দিয়ে কেউ গেলে সে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ত। এখন আর দিন-রাত নেই। ব্লকে আরও ৭-টি ফ্ল্যাট রয়েছে। তাদের কেউ হতে পারে, এ-রকম ভেবে নির্মল আর কোনো সান্ত্বনা পায় না।
রাত এক সময় সত্যিসত্যি স্তব্ধ হয়। ইয়ার্ডে মালগাড়ির শান্টিং-এর বিলীয়মান ঝকঝক-এর সঙ্গে পা ফেলে তখন কলকাতার দিকে থেকে এগিয়ে আসে একজোড়া চটিপরা পা-র হেঁটে আসার শব্দ, সে শুয়ে শুয়ে শোনে। রাস্তার ধুলো-কাঁকরের ওপর অসংলগ্ন পদপাত অতি স্বাভাবিক ও রহস্যজনকভাবে তাদের এস্টেটের চারদিকে ঘোরাফেরা করে। তারপর একদিন ‘টিং’ করে গেট খুলে পদশব্দ ঢুকে পড়ে তাদেরই ব্লকে। একতলায় সিঁড়ির নিচে দারোয়ানের সঙ্গে নিচু গলার জিজ্ঞাসাবাদ নির্মল স্পষ্ট শুনতে পায়।
সিঁড়ি দিয়ে সে উঠে আসে। হৃদস্পন্দন থামিয়ে নির্মল অপেক্ষা করে। একতলা… দোতলা…তিনতলা…পদশব্দ একদিন সত্যি-সত্যি চারতলায় উঠে আসে। তারপর একসময়, কোনো-এক সময়, চারতলার ৩৯ নম্বরের ‘বাজার’ বেজে ওঠে। নির্মল আর পারে না। মলিনার খেশ-এর মধ্যে ঢুকে পড়ে। মলিনা বলে ওঠে, ‘কে?’ বিয়ের পর থেকে গত চার বছর ধরে এই মলিনাই ছিল তার অনিদ্রারোগের একমাত্র চাবুক তথা অব্যর্থ মকরধ্বজ। আজকাল মলিনাও পারে না। মলিনা ঘুমিয়ে পড়ে। সে জেগে থাকে।
এর ওপর একদিন ভোররাতে নির্মল একটা স্বপ্ন দেখে ফ্যালে। একটা রৌদ্রকরোজ্জ্বল বালুকাময় উপত্যকায় খালি পায়ে সে দাঁড়িয়ে, তার পা পুড়ে যাচ্ছে, তাকে ক্রমাগত পা বদল করতে সে দ্যাখে। ওদিকে একটা পাহাড়, ত্রিকোণ, বেশি দূরে হবে না, তার সবুজ বনানী স্পষ্ট দেখা যায়—যা ডিঙোবার সাহস তার নেই, যার ওপারে কী সে জানে না। অথচ পিছনের জনপদ থেকে তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে! দিনের বেলায় ধ্রুবতারকার জন্য ভুল করে আকাশে তাকিয়ে তার আরও ভুল ভাঙে। আকাশে সূর্য নেই। বিরতিহীন বিদ্যুৎচমকে তৈরি এ এক অলৌকিক দিনের বেলা, এখানে হাওয়া নেই। ‘আশার কবরভূমি’, কে যেন বলেই যায় তাকে।
ঠিক তখুনি বালির ওপর দিয়ে একটা মর্মরধ্বনি শুনে সে চমকে ওঠে—কে? অদূর দিয়ে একজোড়া চটি হেঁটে যায়। তীরে-ওঠার আগে হাঁসের মতো সেদিকে সরু ও লম্বা হয়ে যায় তার গর্দান, ‘চটি, তুমি কী পা খুঁজছ?’ সে বলতে চায়, তবু তার গলা দিয়ে স্বর বেরোয় না। সে এক-পা এগুতেই, দ্রুততর হেঁটে চটি অনেকটা এগিয়ে যায়। নির্মল হঠাৎ দৌড় শুরু করে দেয়। চটি ক্রমাগত দিক বদলায়—তবু সে পাহাড়ের দিকেই ছুটে চলেছে নির্মল জানে—যেখানে ঢুকে পড়লে নির্মল আর তাকে খুঁজে পাবে না। ফুটন্ত বালিতে ঝলসে যাচ্ছে তার চটিহারা পা—তবু এই তৃণহীন, দিক-চিহ্নহীন উপত্যকায় সে লুকোবে কোথা? হুকার উৎক্ষিপ্ত জেব্রার দিকে মরুভূমির সোনালি সিংহের মতো অবিশ্বাস্য দৌড়ে নির্মল বারংবার তার কাছাকাছি পৌঁছায় ও শেষ পর্যন্ত পাহাড়ের প্রায় পাদদেশে তার জ্বলন্ত লাফের থাবা একটা পাটি চেপে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে রোদের প্রকাণ্ড থাপ্পড় তার গালে এসে লাগে। স্বপ্নের মধ্যে মাথা ঘুরে নির্মল লুটিয়ে পড়ে…
‘এই—এই—কী হচ্ছে কী—অ্যাঁ—কী হচ্ছে—’ হাসি হাসি মুখ মুখের কাছে নামিয়ে এনে মলিনা তাকে জাগায়। নির্মল বহুসময় ফ্যাল-ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। ওহ, কী কষ্ট তার সর্বাঙ্গে, কেউ যেন বাঁশপেটা করছে সারা রাত। অতিকষ্টে মোচড়ানো হাত তুলে, চুল সরিয়ে মলিনার ঘাড়ে সে রাখে, ‘আচ্ছা মলিনা, ওই যে সেদিন কাঠের পাটা দিয়ে টুবলুরা ক্রিকেট খেলছিল না, সেটা কোথায়। সেটা কাদের।’
ওমা। তা দিয়ে তুমি কী করবে?’
‘আঃ।’ শরীরময় ব্যথা আড়মোড়া দিয়ে ভেঙে, বুকে থেকে মলিনাকে পাশে নামিয়ে রাখে নির্মল, ‘তুমি কিছু বোঝো না। আজকালকার দিনে, ধরো যদি একটা হাউস-ব্রেকার আসে, মাঝরাতে আসতে তো পারে? একটা-কিছু—কিছু-একটা—থাকার তো দরকার। আমি কী দিয়ে তাকে রুখবো? কী আছে আমাদের, একটা বেড়াবার ছড়ি ছাড়া?’ শূন্যে দুহাত তুলে নির্মল বিলাপ করে, ‘ডাকলে আজকাল কেউ সাড়া দেবে তুমি মনে করো?’
যার চটি, সে এখন কোথায়। নির্মল ভাবে। নির্মলদের বেনেটোলার পৈতৃক ছোট্ট বাড়িটি কবেই, সেই ছোটবেলাতেই, বিক্রি হয়ে গেছে। এখন ঘরে ঘরে ভাড়াটে। সে বেশ কয়েকবছর হতে চলল, একদিন, তখন সন্ধেবেলা, কী-একটা ছুঁতো করে সে বাড়িটায় ঢুকে পড়ে ও উঠোনে তাদের আমলেই অকেজো হ্যাণ্ডপাম্পটি আজো থেকে গেছে দেখতে পায়। ছোটবেলায় তার একটা লাল মার্বেল ওর ভেতর পড়ে গিয়েছিল। মার্বেলটি আজও ওখানে থেকে গেছে, নির্মল জানে। এ শুধু নির্মলই জানে যে, যে চটি সে পরে আছে সেটা তার চটি নয়। নইলে, এবারের চটিজোড়া যথার্থই প্রশংসা কুড়িয়েছিল। অফিসে এখনও কারও চোখে পড়লে কিছু না-কিছু জানতে চাইবেই। আগে কত আগ্রহভরে উত্তর দিত। এখন এড়িয়ে যায়। অফিসে সীটে বসামাত্র টেবিলটি তার কাছে একটা দাবার ছকে পরিণত হয়ে যায় যেন। একটিমাত্র কাল্পনিক ঘুঁটিকে সে দাবা-বোড়ে-রাজা-রানি কি মন্ত্রী বেপরোয়া চালে চালায়, যত্র-তত্র রাখে। কোনো একটি ঘরে ঘুঁটিটাকে সে একমুহূর্তের বেশি রাখতে পারে না। রেখেই, তাকে তুলে নিতে দেখা যায়। সে এখন ঠিক কোথায় বা কোন দিকে। সে কী ঠিক পথে? তার থেকে আর কত দূরে; নাকি সে দূর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, এটাই জানতে ইচ্ছে করে তার খুব বেশি। সে কী টের পেয়েছে? হ্যাঁ পেয়েছে? না, পায়নি? টের পেয়ে, সে হয়ত আর একজোড়া কিনেই নিয়েছে। নির্মল পারেনি কিনতে। মাসের শেষে নির্মল পারে না।
বাসে-ট্রামে সর্বত্র নির্মল লোকের চটি-পরা পা দ্যাখে। এত রকমের পা হয় নাকি মানুষের? রেভিনিউ-সেকসানের দোতলা থেকে ফুটপাত স্পষ্ট দেখা যায়। অনেক সময় ফুটপাতে দাঁড়িয়েও সে দ্যাখে। গত রবিবার চটি পরে মলিনার জ্যাঠামণি এসেছিলেন। চুনোটের মধ্যে চটিটা পুরোপুরি দেখতে না-পেয়ে নির্মল কৌতূহলী হয়ে পড়ে। সে বহুক্ষণ চোখ সরাতে পারেনি। প্রণাম করতে ভুলে যাবার জন্যে নয়, এঃহে, ওঁর পায়ে গোদ আছে এটা একদম ভুলে যাওয়ার জন্যেই সে খুব লজ্জিত হয়ে পড়ে। ঘন ঘন কেশে খালি পা বদলাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। কদিন আগে মেজদার বাসা থেকে উঠতে কিছুটা রাত হয়ে যায়। বাসার সামনে ডিপো থেকে বেরবার মুখে ফাঁকা ট্রামের লাইন পালটানোর ঘটাং-ঘট শুনেই সে বরাবর রাত বুঝেছে, আগে টু-দা-মিনিট বলে দিতে পারত। আজকাল অবশ্য আটটা-নটা থেকে ট্রাম-বাস ফাঁকা হতে শুরু করে। তবু, এ কেউ শুনেছে, রাত সাড়ে-দশটায় ফাঁকা বাসে শুধু সে ও আর-একজন মাত্র যাত্রী, বাস পাইকপাড়া ছাড়ালে অন্যমনস্ক নির্মল সহসা পিছন ফিরে তবু তাই দ্যাখে। ওদিকে ছজন বসার লম্বা সীটের কোণে মুড়িসুড়ি দিয়ে সে একা বসে, লোকটি খর্বকায়, মধ্যবয়সী ও তার নাক বাঁকা, নির্মল দ্যাখে। লোকটি এতক্ষণ তাকে, হ্যাঁ, তাকেই নির্মল বুঝতে পারে, মুহূর্তে, কেন কে জানে, লোকটার পা দেখার জন্য নির্মল ব্যাকুল হয়ে পড়ে। লোকটা তখুনি পা সরিয়ে নেয়, সে দেখতে পায় না। লেকটাউনের কাছে আচমকা দ্বিতীয়বার মুখ ফিরিয়ে নির্মল দ্যাখে দুজন নিমগ্ন কণ্ডাকটর ছাড়া হু-হু বাসে সে একা!
এর মধ্যে অফিসের কাজে এক-সপ্তাহের জন্যে নির্মলকে বাইরে যেতে হয়। ভোরের ট্রেনে বাড়ি ফিরেই শোনে পানিহাটি থেকে কে-একজন পর পর দুদিন, পরশু এবং কাল, দুদিনই সন্ধের পর, তাঁর খোঁজে এসেছিল।
‘আচ্ছা লোক বাবা। বললুম তুমি আজ ফিরছ, তবু আবার কাল এসে হাজির, কী অদ্ভুতভাবে বেল দেয় না লোকটা!’
পা-নি-হা-টি! কোন দিকে? পানিহাটিতে তার চেনা কেউ থাকে না তো। সে কখনও পানিহাটি যায়নি। সে যেখানে, পানিহাটি তার থেকে কত দূরে? হঠাৎ পানিহাটিকে পৃথিবীর একমাত্র ভ্রাম্যমাণ জায়গা বলে মনে হয় নির্মলের, যা দূর থেকে ক্রমাগত-দূরে সরে যাচ্ছে।
‘পানিহাটি?’
‘পানিহাটিই তো বলল।’
‘দেখতে কেমন?’ মুখ মোলায়েম রেখে নির্মল জানতে চায়।
‘ছোকরা মতো। বেশ স্মার্ট দেখতে।’
সাধারণত নির্মল জেলাস। বলে তাই মলিনা ঠোঁট টিপে হাসে।
‘নাম বললে?’ শরীর শক্ত করে মুখ ফিরিয়ে রাখে নির্মল।
‘নামটাম তো কিছু বলল না বাপু। চা না কফি?’
‘পানিহাটি কোন দিকে তুমি জানো?’
‘ন্না তো।’
হ্যাঙারে না ঢুকিয়ে হঠাৎ ট্রাউজারটা দেওয়ালে ছুঁড়ে মারে নির্মল। বোঁ করে ঘুরে দুহাতে মলিনার কাঁধ ঝাঁকাতে শুরু করে। ‘কেন জিজ্ঞেস করোনি তুমি নাম কী, অ্যাঁ?’ চীৎকারে সে ঘর ফাটিয়ে ফ্যালে, ‘পানিহাটি কোথায় জানো-না, নাম কী জানো-না, কেন এসেছিল জানো না…হোয়াট আর ইউ? কী করতে রয়েছ তুমি বাড়িতে? আমার কার সঙ্গে কী দরকার…কতটুকু দেখতে পাচ্ছ তুমি আমার; অ্যাঁ? গাধা কোথাকার!’ বলে বৌকে বিছানায় ঠেলে ফেলে দেয় নির্মল।
তারপর পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে হাঁপায়। শুধু আণ্ডারউয়্যার-পরা লোমশ তাকে দেখে মনে হয় অতিপ্রকৃতি বা উপকথা থেকে যেন দুপায়ে উঠে দাঁড়িয়েছে এক দৈত্যাকার কুকুর-মানুষ : ‘আজ সন্ধেবেলা সে আবার আসবে বলেছে’, অফিস বেরবার মুখে ম্রিয়মাণ মলিনা তাকে জানায়। সে কাঁদতে ভুলে গেছে।
অফিসে পাশের সীট থেকে প্রৌঢ় বিশুবাবু রোজকার মতো একখিলি পান এগিয়ে দেন, ‘কী ব্যাপার মশাই, রোজ টেলিফোন, রোজ টেলিফোন। যত বলি বাইরে গেছেন। তবু রোজ সেই এক কথা, নির্মল রায় আছেন? ব্যাপার কী নির্মল?’
আজ সকাল থেকে রেড়িয়োয় সাইক্লোনের কথা বারবার বলা হচ্ছে। সারাদিন মেঘও ঝুলে রয়েছে। অনেকের মতো নির্মল আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসে। এসে দ্যাখে, মলিনা বাড়ি নেই। একটা চিঠিতে লোকটির আজ সন্ধেবেলা আসার কথা মনে করিয়ে দিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের টুবলুকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে। রাতের খাবার করে রেখে গেছে অবশ্য। তবু এটা একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে মলিনা।
অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে, তারপর পাজামা, পাঞ্জাবি ও হাওয়াই চপ্পল পরে নেয় নির্মল। বসার ঘরে এসে তার বেশ সাফসুফ লাগে। বিয়ের পর চার-বছর গড়িয়ে গেল, তবু ছাতা ও জুতো-বুরুশের মতোই গৃহস্থালির বেশ-কিছু অবশ্যম্ভাবী জিনিস তাদের নেই। যেমন, আজও তাদের কোনো বুক-সেলফ নেই। অথচ বইটই বিস্তর এবং কাগজপত্র— সব মেঝের ওপর, যত্রতত্র ছড়ানো। লোকটি যদি আসে, ঐ কোনার সোফাটায় তাকে বসতে দিয়ে তার পিছনে ঘরের অপর ল্যাম্প-স্ট্যান্ডটি জ্বালিয়ে দেবে, নির্মল ঠিক করে ফ্যালে। বইপত্র সরিয়ে একটু পথ করে রাখবে নাকি? কার্পেট থেকে ‘দা অ্যানালেক্টস অফ কনফুসিয়াস’ বইটি হেঁট হয়ে তুলে রাখতে গিয়ে, কী মনে করে, নির্মল আবার ওটা ওখানেই রেখে দেয়। কদিন ধরেই ফুলদানিতে গোঁজা রয়েছে খবরের কাগজের একটা দরকারি পাতা। সেটা খুলে রাখে। তারপর দেওয়াল-আলো নিবিয়ে এদিকের ল্যাম্পস্ট্যান্ডটি জ্বালিয়ে দেয় ও তার নিচে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে বসে। ঝড় জল শুরু হবার আগেই ওরা পৌঁছে গেছে মনে হয়। টুবলুর কাছে একটু পরেই খবর পেয়ে যাবে। বাইরে মেঘগর্জন।
ঠিক সাতটা বাজলে ঝড় আসে, হাড়কলে যথারীতি সাইরেন বেজে ওঠে এবং আসে সে। ‘ক্রিং…ক্রিং-ক্রিং… ক্রিং…ক্রিং…ক্রিং..ক্রিররররিং… ক্রিরররং’… সত্যি, ঠিকই বলেছিল মলিনা— অশ্রুতপূর্বভাবে বেল বেজে চলে, কাটা-কাটা, ঢালাঢিলে, অকুতোভয় ও জেদী, যেন মজায় পেয়েছে। কেউ কারও বাড়িতে এসে এ-ভাবেও বেল বাজায় তাহলে? একটানা এ-হেন বেল বাজিয়ে অবিশ্বাসকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। নির্মল একটু সময় নেয়। গলা জমকালো করে তারপর সাড়া দেয়। ‘কে-এএ?’
বেল থেমে যায়।
দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে আগন্তুক ঢুকে পড়ে। ঠাট্টা করেছিল মলিনা। মোটেই স্মার্ট বা ছোকরা নয়। আধবুড়ো লোকটা পিঠ দিয়ে পাল্লা চেপে ধরার আগে, তার পিছনে মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ জ্বলে ওঠে, যে-জন্য, নির্মলের মনে হয়, বিদ্যুৎ যাকে তাড়া করে এ সে।
লোকটা খর্বকায়; তবু তাকে বামন বলা চলে না। তার মাথায় ফেল্টের টুপি। সে একটি মেয়েলি রেনকোট পরে এসেছে, যাতে এখনও বোতাম লাগাবার প্রয়োজন হয়- নি, যে-জন্যে, অলিভগ্রীন ট্রাউজারের মধ্যে শার্ট ঠিকমতন গোঁজা হয়নি দেখা যায়, ময়লা আণ্ডারউয়্যার দড়িসহ খানিকটা বেরিয়ে। সদ্য ডুব দিয়ে উঠলে যেমন হয়, ভিজে চুলগুলো লেপটে রয়েছে কপালে—অর্থাৎ, ফুরফুরে বৃষ্টিই এমনটি করেছে বা হতে পারে ঘাম। তার বেমানান চওড়া বুকের ওঠা-পড়া দেখে, নির্মল ভেবেছিল, লোকটি হাঁপাচ্ছে।
কাঁপা হাতে আগন্তুক নিজেই ছিটকিনি তুলে দেয়। তারপর তালু উলটে ও একসঙ্গে ভ্রূ ও তর্জনী নাচিয়ে নির্মলকে তার সঙ্গে ভিতরে যেতে বলে।
‘আপনি নির্মল রায়?’ ল্যাম্পস্ট্যান্ডের উজ্জ্বল নিচে এদিকের সোফাটায় গভীরভাবে বসে পড়ে আঙুল তুলে সে জানতে চায়। কণ্ঠস্বর প্রগাঢ়, বয়সকালে মুখে তার ব্রণ হত খুব, ঠিক যেন একটা বন্ধ দরজা, যাতে সংখ্যাতীত বল্টু। নির্মল মাথা নাড়া সত্বেও লোকটা সৌজন্যমূলক বিনতি করে অকারণে আবার প্রশ্ন করে, ‘নির্মল রায়?’ বলে সে একটা বন্ধ খাম নির্মলের দিকে বাড়িয়ে ধরে। খাম ছিঁড়তে ছিঁড়তে নির্মল দ্যাখে, ইতিমধ্যেই সে সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছে। এ নয় যে সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে, নির্মলকেই দেখছে, তবু সে তার দিকে তাকিয়ে নেই। অন্তত নির্মলের অস্তিত্ব সম্পর্কে তার কোনো ধারণা আছে, এ তার চাউনি দেখে মনে হয় না।
‘ন-মামা’, নির্মল পড়ে যায়, ‘এই ভদ্রলোকের নাম মধু ঘোষাল। এঁকে পাঠালাম। এঁদের বাড়ি পানিহাটি, আমাদের বাড়ির কাছে সি-আই-টি রোডে এঁর নতুন বাড়ি হচ্ছে। সেই কারণে আজকাল প্রায়ই আসেন ও যেচে আমাদের সঙ্গে আলাপ করেন। তুমি শেষ যে-দিন আসো, ইনি পাশের ঘরে বাবার সঙ্গে কথা বলছিলেন। অনেক দিন পরে গতকাল হঠাৎ এসে ইনি বল্লেন, আমাদের বাড়িতে সেদিন এঁর চটি-বদল হয়ে গেছে, চটি দেখেই আমি বুঝি, তোমার সঙ্গে। আজ তোমার ঠিকানা আর অফিসের নম্বর এঁকে দিলুম। শুনেছি ভদ্রলোক বহু আগে পাগলাগারদে ছিলেন, তবে এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। তবু এঁর সঙ্গে বুঝে-বুঝে কথা বোলো, মা বলে দিয়েছেন। ইতি তাপস।’
চিঠির তারিখ দিন আষ্টেক আগেকার।
‘আসলে বদলা-বদলি হয়নি, বুঝলেন। সব ঠিক আছে। আমারই ভুল হয়েছিল, মাপ করবেন। সব ঠিক আছে…’ ফস করে দেশলাই জ্বালিয়ে সে নির্মলের দিকে তেড়ে আসে। নির্মলের ঠোঁটের সিগারেটটা ধরিয়ে দেয় ও নির্মলেরই প্যাকেট থেকে বের করে, নেভার আগে, নিজেও একটি দিব্যি ধরিয়ে নেয়। তার আঙুল পুড়ে যাবার কথা, নিশ্চিত গেছেও, তবু সে সাবলীলভাবে অবশিষ্ট কাঠিকুটুর আগুন হাত ঝেড়ে নেভায় ও অ্যাসট্রেতে ফ্যালে। ‘তবু দেখুন’, ঠোঁট বাঁকিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে সে নির্মলকে হেসে বলে, ‘আমি আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এলুম। আলাপ করে গেলুম আমি আপনার সঙ্গে। কেন গেলুম, উঁ, তাই না?’
নির্মল অনেকক্ষণ কথা বলতে পারে না। স্কাইলাইটটা বিদ্যুতের আলোয় জ্বলে উঠে পরক্ষণেই অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। সে সেদিকে চেয়ে থাকে। ঘর নীরবতায় ভরে যায়।
তারপর এক সময় নির্মল বলে, ‘আপনি কিন্তু, আমার মনে হয়, প্রথমেই ঠিক বুঝেছিলেন। মানে, যে-চটি আপনি পড়ে আছেন, সেটা…’
‘ও, নোও! নেভার! আই অ্যাম সিওর। এ নিয়ে আপনি একদম ভাববেন না।’
তাহলে আপনি এলেন কেন! এত খোঁজাখুঁজি…এ কী-জন্যে?’
‘দেয়ার ইউ আর! তাই তো বলছি, আমি তবে এলুম কেন, উঁ?’ নীল ঠোঁটের কোণ মুড়ে সে হাসে, ‘আমি এলুম কেন। তাই না…?’ রেনকোটের পকেটে কনুই-অব্দি ডুবিয়ে, আগন্তুক একটা সবুজ চিরুনি বের করে চটপট চুল আঁচড়ে নেয়। তারপর ধীরে-সুস্থে অপর পকেট থেকে একটা বড়োসড়ো কাগজ বের করে অসম্ভব বাঁকা ও বেঁটে পায়ে বইপত্র মাড়িয়ে, ও-প্রান্তে নির্মলের অন্ধকার সোফা পর্যন্ত হেঁটে যায়। নির্মল এবার এদিকে স্ট্যান্ডটির সুইচ টিপে দেয়। ‘পড়ুন আপনি, পড়ুন এটা…’ নম্রগলায় সে অনুরোধ করে। কাগজটা দুহাতে লম্বালম্বি খুলে ধরে নির্মল দ্যাখে, দশ টাকার ননজুডিসিয়াল স্ট্যাম্প একটা, খাঁটি পার্চমেন্ট। রুদ্ধশ্বাসে সে পড়ে যায় :—
ডীড অফ রেলিঙ্কুইশমেন্ট
আমি শ্রী…….পিতা ……সাকিন……এতদ্বারা অঙ্গীকারপূর্বক বলিতেছি যে অদ্য শ্রীমধুসূদন ঘোষাল পিতা উপেন্দ্রনাথ ঘোষাল, পানিহাটি, ২৪-পরগনা হইতে…তারিখে ক্রীত যে চটি পরিয়া আছেন তাহাতে আমার কোনো স্বত্ব-স্বামীত্ব নাই তথা ইহা আমার নিজের বলিয়া কোনো দাবি করি না কিম্বা ভবিষ্যতে করিব না কিম্বা আমার উত্তরাধিকারীগণ কোনো দাবী করিবে না কিম্বা দাবী করিলেও তাহা সর্বসময়ে আইনমোতাবেক অগ্রাহ্য হইবে। এতদর্থে সুস্থ শরীরে ও সজ্ঞানে এবং অন্যের বিনানুরোধে অত্র নাদাবি পত্র লিখিয়া দিলাম।
‘এ্যা-এ্যাই। এইখানে, হ্যাঁ, এইখানে—’ খোলা লালকালির পেন মেঝের ওপর ‘দা এ্যানালেক্টস অফ কনফুসিয়াস’-এর ওপর একবার ঝেড়ে, তর্জনী ঠুকে লোকটা দেখায়, ‘এইখানে একটা সই করে দিন। জাস্ট নির্মল রায়। ব্যাস, আর কিছু লাগবে না।’
সেই পাঠ শুরু করার পর এতক্ষণে নির্মলের হৃৎপিণ্ডে প্রথম শব্দ হয়। তারপর অনেকক্ষণ পর পর বীট হতে থাকে। ভদ্রলোকের বুকের প্রকাণ্ড ওঠাপড়া দেখে নির্মল বোঝে হাঁপানোর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। সই-করার জায়গায় আগে থেকেই লালকালির একটা টিক মারা রয়েছে, সে দ্যাখে।
সকৌতুক স্মিত হাসিতে মুখের বলিরেখা ও গর্তগুলি ভরিয়ে ফেলে আগ্রহভরে সে দাঁড়িয়ে।
‘আমি দুঃখিত মধুসূদনবাবু। আমি পারব না।’
‘ও!’ মুখ অন্ধকার করে আগন্তুক জানতে চাইল, ‘কিন্তু কেন বলবেন কী?’
নির্মল বলল, ‘কারণ আপনি যেটা পরে আছেন, সেটা আপনার চটি নয়।’
বিদ্রুপ ও ঘৃণায় আগন্তুকের মুখ বীভৎস হয়ে ওঠে।
ওহ, নো-নো! দ্যাটস নট ট্রু। এ নিয়ে আপনি একদম ভাববেন না। এটা ছেড়ে দিন, প্লীজ, এটা ছেড়ে দিন …’ ভূতগ্রস্তের মতো সে ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করে, ‘আচ্ছা। আমি বরং আর-একদিন আসব।’
‘আপনি আর আসবেন না।’ নির্মল উঠে দাঁড়ায়।
‘আর-এ! বসুন, বসুন।’ নির্মলের পিঠে সে এবার হাত রাখে। হাত পৌঁছায়। হুঃ-হুঃ-হুঃ-হুঃ করে ধোঁয়া ছেড়ে, নির্মলের মুখোমুখি সামনে মুখমণ্ডল ধোঁয়ায় লুকিয়ে ফেলে ধোঁয়ার আড়াল থেকে লোকটা বলতে থাকে, ‘দেখুন নির্মলবাবু, আমি যেটা পরে আছি যদিও সেটা আমারই—অ্যাণ্ড দ্যাট ইজ এ ফ্যাকট—তবু যখন কথাটা উঠেছে…মানে আপনারও যখন মনে হয়েছে—ভুল—তবু মনে তো হয়েছে, তাই না, উঁ? ভুল আমারও হয়েছিল। আসলে উই হ্যাভ আনউয়িটিঙলি মেড এ কেস আউট অফ ইট অল…এ-ভাবে আমাদের একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে—একটা বন্ধন—তাই তো? তাই যদি হয় তাহলে আমাকে আবার আসতে হবে, তাই না?’ মাথা থেকে খুলে টুপি দিয়ে ধোঁয়া তাড়িয়ে বিনতি করে সে বলে, ‘হেঃ-হেঃ..ইউ সী মাই পয়েন্ট?’
‘তার চেয়ে লেট আস মেক এ ডীল, অ্যাজ সেনজিবল পীপল অলওয়েজ ডু’, আগন্তুক এবার ধমকের সুরে সোজাসুজি প্রস্তাব করে, ‘আপনি এখানটা একটা সই… জাস্ট নির্মল রায়, দ্যাট উড ডু। এবং আমাদের আর দেখা হবে না।’
‘সী মাই পয়েন্ট?’ চোখ পালটিয়ে সে জানতে চায়।
তর্জনীতে তর্জনী আটকে হাতদুটো কোলের ওপর ফেলে রেখে নির্মল বসে থাকে। স্কাইলাইটটা বহুক্ষণ অন্ধকার হয়ে আছে। বহুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে আছে তার মন। তবে তার হৃৎপিণ্ড ফেটে দুখানা হয়ে যেতে চাইছে, ‘তবে তাই হোক’, সে বলতে চায়। তবু নিজের ল্যারিংস-এ হাত চেপে রেখে সে বসে থাকে।
‘আমি। পারব। না।’ সে বলে।
‘সো ইউ ডোন্ট এগ্রি?’ কলম বন্ধ করে কাগজটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে আগন্তুক মুখ কালো করে বলে, ‘তাহলে দেখা হবে মাঝে-মাঝে? একদিন আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়বেন। এর চেয়ে সই করে দেওয়া ভালো মনে করে হয়ত একদিন—একদিন আপনি—ইউ কান্ট রুল দ্যাট আউট ক্যান ইউ? যে-জন্যে আমাকে আসতেই হবে। আচ্ছা উঠি…’ বলে গভীরভাবে সে সোফায় ডুবে যায়।
এতক্ষণে তার পায়ের দিকে তাকাবার কথা মনে পড়ে নির্মলের। সে তাকায়; সঙ্গে সঙ্গে গোটা ঘর ভরিয়ে মুহুর্মুহু ঝলসে ওঠে বিদ্যুৎ ও বিদ্যুতে ঝলসাতে থাকে তার পা। ল্যাম্পস্টান্ডের ঢাকা আলোর নিচে ভ্রূণ অন্ধকারের নির্মলের চটিজোড়াকে মরণকামড় কামড়ে ঐ পড়ে রয়েছে আগন্তুকের পা, ঐ বিচ্ছুরিত হচ্ছে চটি থেকে ঘন-ঘন বিদ্যুৎ… নির্মলের শরীর সে-দিকে বেঁকে যেতে চায়। মরুভূমির সিংহের গা থেকে অবিরল সোনালী লাফে-লাফে ভরিয়ে ফ্যালে তার বুক, তবু সে স্তব্ধ বসে থাকে। আজ থেকে দু-মাস আগে একদিন, কোনো-একদিন, নিজের মনের ভুলে কখন সে মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদে সর্বান্তঃকরণে গলিয়ে দিয়েছিল তার পা, পথ ছেড়ে সেই থেকে ক্রমাগত বিপথে চলে গিয়ে আজ ফেরা বলতে কী থাকবে? আ, বুক উজাড় করে এবার একটা নিঃশ্বাস ফ্যালে নির্মল, ছোড়দির বাড়িতে একদিন সন্ধ্যেবেলার একটিমাত্র ভুলে এক-জীবনের ভুলচুক হয়ে গেছে।
গোল আলোবলয়ের নিচে ঐ বসে রয়েছে মধুসূদন ঘোষাল। তার শরীর থেকে এখন শীতের বাষ্প বেরুচ্ছে। সে উঠছে না কেন। সরল বিশ্বাসে অতিথির বিদায়-নেওয়া একজন গৃহস্বামী হিসেবে অ্যাকসেপ্ট করার পর তার ওঠাই উচিত। প্রতি মুহূর্তে সে একটা অপরিত্যাজ্য অংশ হয়ে উঠছে নির্মলের, ইতিমধ্যেই শারীরিকভাবে তাকে ফ্ল্যাট থেকে বের করে দেবার ক্ষমতা নির্মলের আর নেই! বোধহয় নির্মল তাকে মুখেও আর চলে যেতে বলতে পারবে না। তাদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে বাইরে সাইক্লোন শুরু হয়ে গেছে।
১৯৭২