ঘােষ বাগানের দানাে
জ্যৈষ্ঠ মাস। রাত প্রায় সাড়ে ন’টা। লাভপুর লাইনের লাস্ট বাসটা সবে পেরিয়েছে।
বাসরাস্তার ধারে শিবপদর চায়ের দোকানের ঝাঁপ আধখানা খােলা। ভিতরে তাসের আসর বসেছে লণ্ঠনের আলােয়। খেলুড়ে চারজন। শিবপদ স্বয়ং। এ ছাড়া ব্রজ দাস, কেষ্ট মণ্ডল ও জটাধর। খেলা চলছে ঘণ্টাখানেক। টুয়েন্টি নাইন। চলবে আরও খানিকক্ষণ।
এই চারটি মানুষেরই বেজায় তাসের নেশা। সন্ধ্যা হতেই বাকি তিনজন এক এক করে জমা হয় শিবপদর দোকানে। উসখুস করে। তারপর খদ্দেরের ভিড় কাটলেই বের হয় তাসের প্যাকেট। দোকানের ঝাঁপ আধখানা ফেলে চারজন গুছিয়ে বসে ভিতরে তক্তপােশের ওপর। মফস্বল গ্রাম বাংলা। পিচ-বাধানাে বাসরাস্তার দু’ধারে বিস্তৃত খেতের জমি, পুকুর, বাগান। কোথাও কাঁকুড়ে খােয়ই ডাঙা। মাঝে মাঝে এক একটি জনবসতি। ছােট বড় গ্রাম শহর।
গরমকালে রাত আটটার পর বড় একটা খদ্দের জোটে না শিবপদর দোকানে। তাসুড়েরা তখন জুত করে খেলায় বসে। শিবপদ তখন ছুটি দিয়ে দেয় দোকানের ছােকরা কর্মচারীটিকে। দু-একজন ছুটকো খদ্দের এলে খেলার ফাঁকেই মালিক একাই তাদের আপ্যায়ন করে। হয়তাে অল্পক্ষণের জন্য বন্ধ থাকে খেলা। ফের শুরু হয়।
শিবপদর বয়স বছর চল্লিশ। তার তাসুড়ে বন্ধুরা কাছাকাছি বয়সি। শিবপদর বাড়ি দোকানের লাগােয়া বাসরাস্তার পাশে। এই গ্রামটির নাম নতুনগ্রাম। ছােট গ্রাম। পঞ্চাশ-ষাট ঘর লােকের বাস। তবে বাস স্টপেজ হিসাবে নতুনগ্রামের গুরুত্ব আছে। এখান থেকে উত্তর ও দক্ষিণে অনেকগুলাে চওড়া মেঠো রাস্তা গিয়েছে দূর দূর গ্রামের দিকে। সারাদিনই এই স্টপেজে বাসযাত্রীর আনাগোনা। শিবপদর দোকান ছাড়াও এখানে আছে আরও একটা ছােট চায়ের দোকান। নতুন গ্রামের ইন্দু মুখুজ্যের। আর আছে একটা গমভাঙাই কল। সদ্য খুলেছে। তবে শিবপদর ছাড় অন্য দুটো দোকানই সন্ধে নামলে বন্ধ হয়ে যায়।
মুলত চা-বিস্কুটের দোকান বটে শিবপদর। তবে সে কিছু মিষ্টি ও নােনতাও বানায়। এছাড়া তার দোকানটা হচ্ছে একটা সাইকেল স্ট্যান্ড। দূর গ্রাম থেকে যারা এখানে এসে বাস ধরে যায় ওদিকে বােলপুর বা উল্টোদিকে নানুর-কির্নাহার-লাভপুর লাইনে, কাজেকম্ম বা দৈনিক চাকরি বা ব্যবসা করতে, তারা অনেকে সাইকেলে এসে শিবপদর কাছে বাইক জমা রেখে যায়। কাজ শেষে বাসে এসে দোকান থেকে সাইকেল নিয়ে গ্রামে ফেরে। দোকানের গায়ে ছােট এক খড়ের চালার নিচে থাকে তালামারা সাইকেলগুলো।
নিয়মিত যারা সাইকেল রাখে তাদের থেকে কিছু ভাড়া পায় শিবপদ। উপরি আয়। তার কোনাে অসুবিধে নেই। কারণ তাসের নেশায় লাস্ট বাসটা অবধি সে তাে থাকেই দোকানে। নেহাতই কোনাে সাইকেল মালিক না ফিরলে শিবপদ তার গাড়িটা নিয়ে গিয়ে রাখে নিজের বাড়িতে।
নিঝুম রাত। তাসুড়েদের টুকরাে টুকরাে কথাবার্তা ও মাঝে সাঝে উচ্চস্বরে কিছু বিতর্ক ছাড়া আর কোনো মানুষের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। কখনও কখনও পিচ রাস্তা দিয়ে হুস করে বেরিয়ে যায় মােটর গাড়ি-ট্রাক।
খেলতে খেলতে জটাধর হঠাৎ ঘাড় কাত করে মন দিয়ে কী শােনে। তারপর বলে, “কীসের শব্দ হচ্ছে জানি।”
অন্যরাও কান পেতে সায় দেয়।
ঝনঝন্। ঘটাং ঘটাং-আওয়াজটা এগিয়ে আসছে দ্রুতবেগে। অসমান মেঠো পথ দিয়ে সবেগে সাইকেল চালিয়ে আসছে কেউ। হরিপুরের দিক থেকে আসছে শব্দটা। কী ব্যাপার?
ঘ্যাচ। সজোরে ব্রেক কষার আওয়াজ হয় দোকানের ঠিক সামনে। ঝনাৎ করে মাটিতে পড়ল একটা সাইকেল। শিবপদরা ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে কাপের একপাশের কোনা তুলে হুড়মুড় করে ঢুকে টলতে টলতে সটান উপুড় হয়ে পড়ল একজন দোকানের মেঝেতে।
ভবা মণ্ডল।
থরথর করে কাঁপছে ভবা। গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরুচ্ছে তার মুখ দিয়ে। শিবপদরা লাফ দিয়ে এগােয়।
“কেউ লাঠি মেরেছে। কিংবা ছুরি। ছেনতাই করেছে ডাকাতে।” ব্রজ নিশ্চিত কণ্ঠে ঘােষণা করে।
“না না। মারেটারেনি। গায়ে রক্ত কই?” জটাধরের প্রতিবাদ—“অন্য কিছু ব্যাপার। জল দে শিগগির।”
শিবপন তাড়াতাড়ি মগে করে জল আনে। ভবাকে চিৎ করে দিয়ে ওর মুখে মাথায় জলের ঝাঁপটা দেওয়া হয়। কিছু একটা ঘটেছে সাংঘাতিক সন্দেহ নেই। তবে দেহে আঘাতের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না।
ভবা মগুল থাকে হরিপুরে।
মাত্র মিনিট দশেক আগে ভবা নেমেছিল লাভপুর লাইনের বাস থেকে। ও বােলপুর শহরে গিয়েছিল। শিবপদর দোকান থেকে তার সাইকেল নিয়ে রওনা দিয়েছিল হরিপুর। মুখে জলের ছিটে পেয়ে একটু সুস্থ হয়ে চোখ মেলল ভবা। ঘােলাটে নয়নে দেখল শিবপদদের। উঠে বসে। কেষ্ট এক গেলাস জল দিতে ঢকঢক করে খায়। অতঃপর তার গলা দিয়ে ভয়ার্তস্বরে যে কথাটি বেরােয় তা শুনে অন্যরা হতভম্ব।
“ভূ-উ-ত”
“আঁ। ভূত!” চারজনই চমকে ওঠে, “কোথায়?”
তক্তপােশে বসে কাঁপা কাঁপা গলায় থেমে থেমে যে অদ্ভুত ঘটনা বলল ভবা তারসারমর্ম এই—
“শিবপদর দোকান থেকে সাইকেলে উঠে হরিপুরের দিকে যাচ্ছিল ভবা। যে রাস্তা ধরে সে দিনের পর দিন গিয়েছে। ফিঁকে জ্যোৎস্নায় দিব্যি দেখা যাচ্ছিল পথ। তাই টর্চ জ্বালেনি। ফুরফুরে বাতাস বইছে। খােশমেজাজে গুনগুন করে গাইতে গাইতে প্যাডেল মারছিল।
মনে ঘুরছে বাড়িতে কিছু কাজের কথা। পদ্মদিঘির পাশ দিয়ে গিয়ে বাঁক নিয়েছে, সহসা রাতের স্তদ্ধতা ভেঙে কেমন একটা চাপা অদ্ভুত বিকট হাসির আওয়াজ কানে যেতে ঘাড় তুলে পুকুরপাড়ে তাকিয়েই তার আক্কেল গুড়ুম।
কিছুটা সামনে, দিঘির উচু পাড়ে বিশাল এক ছায়ামূর্তি। অন্তত দু-মানুষ লম্বা। প্রকাণ্ড মাথা। চুলের গোছা উড়ছে। দু হাত নাড়তে নাড়তে সেটা নামছে ধীরে ধীরে। পাড় বেয়ে নিচে। নিঃশব্দে। গােটা দেহটা মিশকালাে। চলনের ধরনটা অদ্ভুত। ভবা দিঘির ধারে ওইখানে পৌছানাের সময় ঠিক এটা তার ঘাড়ে এসে পড়ত।
ঝঁপ করে সাইকেলে ব্রেক কষে নেমে পড়েছিল ভবা। বিস্ফারিত চোখে মূর্তিটা দেখেছিল চার-পাঁচ সেকেন্ড। জমে যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল আতঙ্কে। ওটা যে কোনাে জীবন্ত প্রাণী নয় তার সন্দেহ ছিল না। নির্ঘাৎ ওটা ভূত দানাে পিশাচ জাতীয় কিছু। অশরীরী। ভবা অজ্ঞানই হয়ে যেত ভয়ে। কোনােরকমে মরিয়া হয়ে সে সাইকেলটা ঘুরিয়ে উঠে পড়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে প্যাডেল মারে। কীভাবে, কতক্ষণে যে পৌঁছেচে দোকানে হুঁশ নেই। শুধু মনে হচ্ছিল যে এই বুঝি কারও হিমশীতল আঙুলের মুঠি আঁকড়ে ধরবে তার ঘাড়।
ভবা তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা শেষ করে যে এক গেলাস জল খান।
শিবপদরা চোখাচোখি করে। চারজনের মনে একই প্রশ্ন। এতকাল ওই রাস্তা দিয়ে কত লােক যাতায়াত করেছে রাতবিরেতে কিন্তু ভূত-প্রেতের দেখা পায়নি তাে কেউ! ভবা মন্ডলও প্রায়ই ফেরে রাত করে। নেহাত ভিতু বলা যায় না লােকটিকে।
-“আমি ভাই ও পথে একা ফিরছি না। মানে আজ রাতে। ভীত কণ্ঠে জানায় ভবা।
-“তাহলে কী করবে?” শিবপদ চিন্তিত।
—“এই দোকানেই শুয়ে থাকি রাতে।”
-“বাড়িতে ভাববে না?”
-“তা ভাববে বই কি! কী করা?”
কেষ্ট গজগজ করে ওঠে—“ভূত-ফুত সব বাজে। চাঁদের আলােয় কলা বা খেজুর গাছের পাতা নড়তে দেখে ভুল করেছে। আচমকা দেখলে এমনি মনে হয় অনেক সময়।”
—“না ভাই, সত্যি বলছি। স্পষ্ট দেখলুম। গাছ-টাছ নয়। এগুচ্ছিল।”
ভবা কাতরে প্রতিবাদ জানায়।
আসলে কেষ্ট দাস চটেছিল ভবার ওপরে। খেলায় হারছিল কেষ্ট। অল্প কয়েক পয়েন্টে। আর আধঘন্টাটাক খেলা হলে হার মেকআপ করে জিতে যেত হয়তাে। ভবা দিল সব ভণ্ডুল করে। হারলে কেষ্টর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আপাতত ভবা যদি এখানে ঠাই গাড়ে তাহলে খেলার দফা গয়া। কেবল ভূতের গল্পই চলবে।
কেষ্ট বলে ওঠে, “চলাে তােমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। দিঘিটা পার করে দিই।”
-“পোঁছে দিবি?” শিবপদ ইতস্তত করে, “তবে আর একজন কেউ যাক সঙ্গে। নইলে তােকে একা ফিরতে হবে। জটা যাবি?”
-‘নাঃ, কী দরকার?” মুখে সাহস দেখালেও কেষ্টর হাবেভাবে বােধ হল যে জটা সঙ্গে গেলে মন্দ হয় না।
-“ঠিক আছে, চ।” জটাধর রাজি।
-“মিনিট পনেরোর মধ্যেই ফিরছি। ফিরে এসে আবার খেলব।” জানাল কেষ্ট।
তিনজন রওনা দিল সাইকেল চেপে।
মিনিট পনেরাে নয়। কেষ্ট ও জটাধর দোকানে ফিরল প্রায় ঘন্টাখানেক বাদে। কাঁপতে কাঁপতে । দুদ্দাড় করে সাইকেল চালিয়ে।
তারা দু’জনেও দেখেছে সেই ছায়া দানবকে। তবে দিঘির পাড়ে নয়। পদ্মদিঘি পাশ কাটিয়ে নিরাপদেই পেরিয়ে গিয়েছিল তিনজনে। অলৌকিক কারও দেখা মেলেনি। কিন্তু হরিপুরের কাছাকাছি গিয়ে তাদের নজরে পড়ে দূরে তালভাঙার খােলা মাঠে এক আবছা বিরাট মূর্তি। যেমন বর্ণনা দিয়েছিল ভবা।
সেই দানােটা ধীরে ধীরে বেড়াচ্ছিল রুপােলি চাঁদের আলােয়। একবার খনখনে গা শিউরানাে হাসির শব্দ শােনা গেল। ওর অট্টহাসি। ক্রমে মুর্তিটা গিয়ে মিলিয়ে গেল দিঘির দক্ষিণে ঘােষ বাগানের ভিতরে।
বহুক্ষণ কাঠ হয়ে নজর করেছে তিনজন। কিন্তু সেই ভৌতিক দানাের দেখা আর মেলেনি। অবশেষে ভরসা করে দোকানে ফিরেছে কেষ্ট ও জটা। ভবা অবশ্য চলে গিয়েছে হরিপুর।
সেদিন আর তাসের আসর বসল না।
বােলপুর শহর। সাপ্তাহিক বঙ্গবার্তার অফিসে উঁকি দিল দীপক। পাশে ভবানী প্রেসের কাজ চলছে খটাখট শব্দে। ভবানী প্রেসের মালিক এবং বঙ্গবার্তার সম্পাদক কুঞ্জবিহারী মাইতি তার ছােট্ট কামরায় বসেছিলেন নিজের চেয়ারে। মাঝবয়সি শ্যামবর্ণ গাট্টাগােট্টা কুঞ্জবিহারীর পরনে ধুতি শার্ট। মাথা ঝুঁকিয়ে গােল গোল চোখে শুনছিলেন সামনে বসা এক ভদ্রলােকের কথা। দীপক দরজা ঠেলতেই কুপ্রবাবু বলে উঠলেন-“এসাে দীপক। তােমার কথাই ভাবছিলাম।”
দীপক ভিতরে ঢুকে চেয়ারে বসে।
কুঞ্জবিহারী বললেন, “আলাপ করিয়ে নিই। ইনি হচ্ছেন শ্রীতারকনাথ ঘােষ। বাড়ি নতুনগ্রাম। আমার বিশেষ পরিচিত। আমাদের বঙ্গবার্তার গ্রাহক। আর এ হচ্ছে দীপক রায়। বঙ্গবার্তার একজন রিপাের্টার। ভেরি ভেরি প্রমিসিং ইয়ংম্যান!”
তারকনাথ ও দীপক পরস্পরকে নমস্কার জানায়। বছর পঞ্চাশের ছােটখাটো নিরীহ দর্শন তারকনাথ সসন্ত্বমে দীপকের পানে চেয়ে কাঁচুমাচুভাবে হাসলেন।
কুঞ্জবিহারী দীপককে বললেন, “তারকবাবু কী বলছিলেন জানাে? ওদের গ্রামের কাছে সম্প্রতি ভূতের উপদ্রব শুরু হয়েছে। ঠিক উপদ্রব বলা উচিত নয়। আবির্ভাব হচ্ছে। যে সে ভূত নয়। বিরাট সাইজ। দানাে বলা যায়। ধারে কাছে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে তাকে। ভেরি ইন্টারেস্টিং। কী বলাে?”
-“সব গ্রামেই ওরকম ভূত দেখা যায়।” নীরস কঠে দীপকের মন্তব্য।
—“না না। আমাদের গায়ে আগে কখনও ভূত-টুত দেখা যায়নি। এই হপ্তাখানেকের ব্যাপার। একদম হঠাৎ। লােকে খুব ভয় পেয়েছে।” ক্ষীণ কণ্ঠে প্রতিবাদ জানান তারকনাথ, “রাতে হরিপুরের পথে কেউ একলা যেতে ভরসা পাচ্ছে না। অনেকে নিজের চোখে দেখেছে কিনা।”
—“একটা কাজ কর না দীপক,” বলে ওঠেন কুঞ্জবিহারী, একদিন চলে যাও ওখানে। খোঁজখবর করাে। যারা দেখেছে তাদের ইন্টারভিউ নাও। ভূতটার ডেসক্রিপশান। তার বিচরণক্ষেত্রের বর্ণনা। হঠাৎ এই ভৌতিক আবির্ভাবের কারণটা কী হতে পারে? খাসা একটা নিউজ হবে। বেশিদূর তাে নয়। এখান থেকে বাসে বড়জোর ঘন্টাখানেক।”
—“আবার ভূত? পারব না।” দীপকের সাফ জবাব।
—“আহা, তােমার যে এ লাইনে হাতযশ আছে। তাই তাে বলছি তােমায়।” এরপর সম্পাদক মহাশয় চোখ ছােট করে, পুরুষ্টু ঝোলা গোঁফজোড়াটি নাচিয়ে রহস্যময় সুরে বললেন, “আর যদি সম্ভব হয় তেনাকে একবার দর্শন করেও আসতে পারাে।”
—“তিনি কি আমায় দর্শন দেবেন? মনে হয় না।” তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে দীপক।
—“আহা-হা, ট্রাই করতে দোষ কী? লাক ফেভার করলে দেখে ফেলতে পারাে। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ। স্বয়ং রিপাের্টার দেখেছে। জম্পেশ একখানা স্টোরি হবে বঙ্গবার্তায়।”
-“হুঃ।” নাক দিয়ে একটা শব্দ করে দ্বিতীয় প্রস্তাবটা উড়িয়ে দেয় দীপক। তবু ওখানে যাওয়ার ব্যাপারে না করতে পারে না। হাজার হােক সম্পাদরে অনুরােধ।
“বেশ, যাব।” দীপক রাজি। তারপর সে তারকবাবুকে জিজ্ঞেস করে—“কাল থাকবেন গ্রামে?”
—“না। পরশু আসুন, রােববার। জানালেন তারকবাবু।
“হ্যা, চলে যাও পরশু,” উৎসাহ দেন কুঞ্জবাবু, “তারকবাবু, দীপকের সঙ্গে ওখানকার লােকের আলাপ টালাপ করিয়ে দেবেন। একটু সাহায্য করবেন।”
রবিবার সকালে চা খেতে খেতে নিজের মনে গজগজ করে দীপক, “যত্তসব। বােগাস ব্যাপার—”
বছর যােলাে বয়সি ভাইপাে ছােটন আর তার ছােট বােন ভাইঝি ঝুমা লক্ষ করছিল দীপককে। ছোটন জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে কাকু?”
“আর বলিস কেন?” দীপক গজরায়, “কোন গ্রামে ভূত দেখা গিয়েছে, আমাকে তাই কভার করতে যেতে হবে। আরে বাবা, বাংলাদেশের সব গাঁয়ে ঝোপেঝাড়ে আর পুরনাে বাড়িতে তাে লােকে হরদম ভূত দেখে। এডিটর আমায় পেয়ে বসেছে। বেকার খাটাবে।”
“কাকু, আমি যাব। ভূত দেখব।” ছােটন লাফিয়ে ওঠে।
“কাকু, আমিও যাব। কখনও ভূত দেখিনি।” ঝুমাও নাচে।
“ভাগ। ছােটন দাবড়ে দেয় বােনকে, অন্ধকারে উঠোনে যেতে ভয় পায়, আবার ভূত দেখবেন।”
“হা হা, তুমি কেমন বীরপুরুষ, জানা আছে।” ঝুমা দমে না।
দীপক থামায় দু’জনকে, “দূর দূর ভূত কে দেখবে? রাতে থাকছি না। একটু খোঁজখবর নিয়ে দিনে দিনে ফিরে আসব।”
“কাকু, আমায় নিয়ে চলাে না, জায়গাটা দেখে আসি।” ছােটনের আবেদন।
তা মন্দ নয়। ভাবে দীপক। একা একা একঘেয়ে লাগতে পারে। তবু ছােটন সঙ্গে থাকলে দুটো গল্প করা যাবে। সে বলল, “আচ্ছা চ। বেলা দশটা নাগাদ খেয়েদেয়ে বেরিয়ে পড়ব।”
—“কাকু, আমিও যাব।” ঝুমার আবদার।
“না। তােমার মাস্টারমশাই আসবেন আজ দুপুরে। আজ থাক।”
—“যাও, যাও।” হতাশ ঝুমা দাদাকে ভেঙচায়, “ভুত যখন ঘাড় মটকাবে বুঝবে ঠেলা।”
—“দিনে ভূত বেরােয় না।” বিজ্ঞ ছােটনের মন্তব্য।
বেলা এগারােটা নাগাদ ছােটনকে নিয়ে দীপক পৌছে গেল নতুনগ্রামে। তারকবাবুর সঙ্গে দেখা করল। তারকনাথ দীপককে নিয়ে এলেন শিবপদর দোকানে। পরিচয় করিয়ে দিলেন শিবপদর সঙ্গে। ভবা মণ্ডল তখন ছিল সেখানে। দোকানে বসে দু’জন অন্য গ্রামের লােক তখন বিস্ফারিত নেত্রে গিলছিল ভবার ভূত দেখার অভিজ্ঞতা।
ঘােষবাগানের দানাে—এই নামেই খ্যাতিলাভ করেছে ওখানকার অশরীরী সেই দানব ছায়ামূর্তি। যে বিচরণ করে রাতে। ঘােষবাগানের কাছাকাছি দিঘির গায়ে অথবা তাকে দেখা গিয়েছে ঘােষবাগানের পূর্বে তালডাঙার প্রান্তরে।
ঘােষবাগানের দানাে বা ভূতের আবির্ভাবে শিবপদর সােনায় সােহাগা। কারণ এর ফলে তার দোকানে বিক্রি বেশ বেড়েছে। পাঁচ গাঁয়ের লােক হাজির হচ্ছে নতুনগ্রাম স্টপেজে। শিবপদর দোকানে বসছে খানিক। আসল উদ্দেশ্য, ঘােষবাগানের দানাের গল্প শােনা। এই সূত্র ধরেই উঠছে নানা লােকের যত শােনা ও দেখা ভূতুড়ে কাহিনি। যক্ষ রক্ষ পিশাচ দানাে মামদো বেহ্মদত্যি পেতনি শাকচুন্নিদের নিয়ে হরেক গা ছমছম দমবন্ধ করা গল্পে দিনভর সরগরম থাকে দোকান। সঙ্গে চা বিস্কুট মিষ্টি নােনতার সদ্ব্যবহারও চলে।
ঘােষবাগানের দানাের প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে ভবা মণ্ডলই আসর জমিয়েছে বেশি। কারণ সেই দেখেছে প্রথম এবং তার অবসরও প্রচুর। তাকেই বেশি পাওয়া যায়। শিবপদর দোকানে।
কেষ্ট ও জটাধর ব্যস্ত মানুষ। সন্ধের আগে তারা বড় একটা আসতে পারে না দোকানে। আরও একজন ওই দানােকে দেখেছে বটে সচক্ষে। কেতুপুরের ভরত সর্দার। কিন্তু সে চাকরি করে বর্ধমানে। সপ্তাহে একদিন মাত্র বাড়ি আসে। ফলে ভবাই জাঁকিয়ে বসেছে।
ভবা থিয়েটারে পার্ট করত। এলেমটা পুরাে কাজে লাগাচ্ছে। যোষবাগানের দানাে দেখার গল্প শুরু করলে শ্রোতাদের আর নড়তে দেয় না। প্রায় প্রতিদিনই তার গল্পে রং চড়ছে। ঠান্ডা নিরীহ শিবপদকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তা নেই। তবে কেষ্ট বা জটাধর হাজির থাকলে সে মােটেই খুশি হয় না। কারণ আসরটা তখন দখল করে নেয় ওরা কেউ। প্রথম ভূত দেখার পর কম্পিত বিপর্যস্ত ভবার উর্দ্ধশাসে দােকানে আগমন দিয়ে শুরু হয় কাহিনি। ভবা তখন কেটে পড়ে।
ব্রজনাথের অফশােস, “ইস, কেন সেদিন গেলাম না ভবাকে পৌছতে! তাহলে কি এমন অগ্রাহ্যি সইতে হয়। কেউ তাকে পৌঁছে না, ভবা, কেষ্ট বা জটাকে পেলে।
শিবপদর অবশ্য এসব গৌরবে মাথাব্যথা নেই। সে শুধু শুনে যায়। কিছু বাড়তি রােজগার হচ্ছে। এতেই সে খুশি।
তবে রাতে হরিপুর যাওয়ার শর্ট কাট রাস্তায় যাত্রী কমে গিয়েছে একদম। আঁধার নামলে কেউ আর ও পথে একলা মাড়ায় না। অন্তত দু-তিনজন একসঙ্গে মিলে তবে যায়। ঘোষবাগান, পদ্মদিঘি, তালডাঙার ধার দিয়ে-রামনাম জপতে জপতে।
শিবপদর দোকান প্রায় ফাঁকাই থাকে সন্ধের পর। ফলে দোকানে তাসের আড্ডা বসে তাড়াতাড়ি।
শিবপদ কেষ্ট জটাধর ব্রজ-চারজনই নতুনগ্রামের বাসিন্দা। তাই তাদের রাতে ঘরে ফিরতে অসুবিধা নেই। বাস রাস্তার উত্তরে ঘােষবাগান, হরিপুর, কেতুপুর। আর দক্ষিণে নতুনগ্রাম।
তবে অন্য পথে চললেও, রাতে বেরুলে গােটা অঞ্চলের লােকেরই গা শিরশির করে। পথে কোনাে ছায়া নড়তে দেখলে বা কোনাে বিদঘুটে আওয়াজ কানে গেলেই আঁতকে ওঠে।
কাগজের রিপাের্টার শুনে দীপকের চারপাশে ভিড় জমল। দীপক দোকানে বসে ভবা শিবপদ এবং আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে নোট নিল। নিউজটা বানাতে কাজে লাগবে। তারপর সে বলল, “ভূতটির বিচরণক্ষেত্রগুলি দেখতে চাই। প্রথমে যাব ঘােষবাগান। আমার সঙ্গে যদি কেউ আসেন দেখিয়ে দিতে-”
দোকান তখন প্রায় ফাঁকা। ভবা এবং আরও জনাকয়েক দুপুরে খেতে গিয়েছে ঘরে। তারকনাথ ভিতু মানুষ। দিনেরবেলাতেও তার ঘােষবাগানে ঢুকতে ভয়। আমতা আমতা করে বলল, “আমার একটু কাজ আছে। এখুনি যেতে হবে। শিবপদ, তুমি যদি ভাই কাউকে দাও ওঁর সঙ্গে!”
শিবপদ বলল, “ঠিক আছে, নকুল যাবে। আমার ভাগনে। নকুল, তাের ভাত খাওয়া হয়ে গিয়েছে তাে? বেশ। বাবুদের সঙ্গে যা। খােলা মাঠে ঘােরাবিনে বেশি। যা রােদ্র।”
নকুল বছর পঁচিশের যুবক। ছিপছিপে শক্ত গড়ন। রং কালাে। সুশ্রী হাসিহাসি মুখখানী। পরনে লুঙ্গি ও শার্ট। খালি পা।
নকুলের সঙ্গে চলল দীপক ও ছােটন। শিবপদ দোকানে ঝাঁপ ফেলে খেতে গেল। “তুমি কী করাে?” যেতে যেতে নকুলকে জিজ্ঞেস করে দীপক।
—“আজ্ঞে, অনেক কিছু।” মুচকি হেসে জবাব দেয় নকুল।
-“মানে?”
-“এই যেমন ফিরি করি। বেলুন, প্ল্যাসটিকের খেলনা, ডুগডুগি, তালপাতার টুপি, হুইসিল-এমনি সব। শীতকালে মেলায় মেলায় ঘুরি। বােলপুর শহরেও যাই। লটারির টিকিটও বিক্রি করি। মামাকেও সাহায্য করি দোকানের কাজে। বােলপুর থেকে মালপত্তর কিনে আনি দোকানের। চাষের কাজেও হাত লাগাই। বেকার তাে। নানা ধান্দা করি।”
-“লেখাপড়া?”
-“স্কুল ফাইনাল পাশ করেছি।”
-“কলেজে পড়লে না কেন?”
-“অনেক খরচ।” নকুলের মুখ ঈষৎ ম্লান হয়।
দীপক আঁচ করে অভাবী সংসারের সমস্যা। এ নিয়ে আর কথা বাড়ায় না। বাস রাস্তা থেকে ঘােষবাগানের দূরত্ব অন্তত আধ মাইল। পথের দু’ধারে বসতি নেই। শুধু চাষের খেত। তখন শস্য নেই মাঠে। এবড়ো-খেবড়াে খটখটে মাঠ।
ঘোষবাগানটা ঠিক পথের ধারে নয়। চলার পথ থেকে প্রায় শ’তিনেক হাত তফাতে। মাঝখানে একটা শুকনাে নালার খাত। আর কিছু ধেনাে জমি।
পদ্মদিঘির দক্ষিণে প্রায় বিঘে দেড়েক উঁচু জমির ওপর ঘােষবাগান। সেখানে পাঁচটি প্রাচীন আমগাছ এবং দু’টি কাঁঠালগাছ। “উঃ, কত আম!” বলতে বলতে ছােটন সাঁ করে একটা ইট ছুড়ল আমডাল লক্ষ্য করে।
“আঃ, কী হচ্ছে?” ধমক দেয় দীপক। তারপর ওপরে দেখতে দেখতে বলে, “বাঃ, খুব আম হয়েছে! ভালাে জাতের মনে হচ্ছে।”
‘হ্যা, ল্যাংড়া আর গােলাপখাস। কলমের গাছ।” জানায় নকুল।
দুটি গাছে মস্ত মস্ত কাঠাল ঝুলছে প্রচুর।
-“এই বাগানের মালিক কে?” প্রশ্ন করে দীপক।
-“মামা।”
-“মানে শিবপদবাবু?”
-“হ্যাঁ।” ঘাড় নাড়ে নকুল। বলে, “মামার তাে চাষের জমি খুব অল্প। এই আম কাঠাল বেঁচে আর দোকানের আয়ে কোনােরকমে চলে। এই বাগান করেছিলেন মামার ঠাকুরদা। দিঘিটাও তিনি কাটিয়েছিলেন। তার অবস্থা খুব ভালাে ছিল। মামার আসল বাড়ি হরিপুর। মামা ভারি ভালাে মানুষ, তাই অন্য শরিকরা জবরদস্তি করে আর ঠকিয়ে নিয়েছে মামার পাওনা বেশির ভাগ সম্পত্তি। মামা তাই রাগ করে নতুনগ্রামে এসে ঘর করেছে। ওই দিঘিটারও ভাগ আছে মামার। সামান্য অংশ। তা দিঘি মজে গিয়েছে। মাছ হয় না। কাটানাে হয়নি বহুকাল। মামা মামি, ওদের চার ছেলেমেয়ে, তার ওপর আমরা তিনজন। আমি, মা, বােন। বড় সংসার।”
-“তােমার বাবা নেই?”
-“না। বাবা হঠাৎ মারা যেতে খুব কষ্টে পড়েছিলুম। তখন মামা এনে এখানে রাখল।”
আমগাছ দেখতে দেখতে নকুল বলল, “গাছের ফল রাখা কি সােজা ব্যাপার? বড্ড চুরি হয়। এখন পাকার টাইম। এখনই বিপদ বেশি। আগের বছর অর্ধেক আম-কাঠাল চুরি হয়ে গেল। এবার দিনরাত পাহারা দিচ্ছি। দিনে মামার বাগাল ছেলেটা থাকে, রাতে আমি। তবে এ কদিন আর রাতে থাকছি না বাগানে। মানে ভূতের ভয়ে। তাই শুধু দিনে ডিউটি দিচ্ছি।”
বাগানের মাঝে দেখা গেল খড়ে ছাওয়া এক ছােট্ট কুটির। ভিতরে হাত দেড়েক উঁচু একটা বাঁশের বেঞ্চি। চারটে খোটার ওপর গায়ে গায়ে লাগানাে বাঁশের কঞ্চি পেতে তৈরি। একটি লােক কোনােরকমে শুতে পারে তাতে। এক কোণে কিছু কাঠকুটো ঘুটে খড় জড়ো করা। মাটিতে একটা উনুন বানানাে হয়েছে।
উনুনটা দেখিয়ে নকুল বলল, “রাতের ঘুম তাড়াতে চা বানিয়ে খাই। ওই বেঞ্চিটায় কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়ি। রাতে একটু করে ঘুমিয়ে নিই, আর জেগে উঠে হাঁক পারি। অভ্যেস করে নিইচি। চোরে ভাববে যে গােটা রাত ঠায় জেগে আছি,” মুচকি হাসে নকুল, “তবে ঠিকমতাে ঘুম কি আর হয়?”
বাগান থেকে বেরিয়ে দিঘির পাড়ে দাঁড়াল তিনজন।
মস্ত দিঘি। এখন অনেকটা বুজে এসেছে। দীঘির মাঝখানে সামান্য একটু জল। বাকিটায় শুকনাে কাদা। দিঘিতে পদ্মফুল আর নেই। কলমি নটে ইত্যাদি নানারকম শাকে প্রায় ঢেকে দিঘিগর্ভ। পাড়ের ঢালে হলুদ ফুলে ভরা প্রচুর কন্টিকারির ঝােপ। দিঘি ঘিরে অনেকগুলাে কলাগাছ আর লম্বা লম্বা নারকেল গাছ।
দিঘির পাড়ে পাড়ে হাঁটে তিনজন। সােজা উত্তরে একটা বড় গ্রাম। গাছপালায় ঢাকা। ফাঁকে ফাঁকে কিছু ঘরবাড়ি চোখে পড়ছে।
-“ওই গ্রামটা কী?” দেখায় দীপক।
-“হরিপুর,” জানাল নকুল, “আর ওই দূরে বাঁ দিকে ওটা কেতুপুর। রাতে এখন লােকে দিঘির পাশ দিয়ে শর্ট কাটে হরিপুর যেতে ভরসা পায় না। তাই কেতুপুরের কাছ দিয়ে গিয়ে ঢোকে। অনেকটা ঘুরপথে।”
নতুনগ্রাম থেকে চওড়া মেঠো রাস্তাটা ঘােষবাগানের কাছাকাছি এসে দু ভাগ হয়ে গিয়েছে। একটা শাখা পদ্মদিঘিকে পাক খেয়ে চলে গিয়েছে উত্তরে হরিপুর। অন্যটা গিয়েছে উত্তর-পশ্চিমে কেতুপুর।
পদ্মদিঘি আর ঘােষবাগানের পুবে জমি ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে। তারপর শুরু হয়েছে রুক্ষ পতিত ভাঙা ভূমি। লােকে বলে তালডাঙা। প্রায় মাইল খানেক বিস্তৃত। সেখানে কোথাও সমতল কঠিন কালচে মাটি। কোথাও বা উঁচুনিচু ঢেউ খেলানাে কাঁকর বালি নুড়ি মেশানাে খােয়াই। ওই ডাঙায় কিছু তাল ও খেজুরগাছ ছাড়া আর কোনাে উদ্ভিদ নেই।
নকুল দেখাল, “ওই যে দূরে ডাঙার শেষে, বাসরাস্তার কাছে গ্রাম। ওর নাম ইসলামপুর।”
-“এখানে শ্মশান-টশান আছে?” দীপকের প্রশ্ন।
-“আছে। হরিপুরের শ্মশান আর ইসলামপুরের গােরস্থান। এই ডাঙার সীমানাতেই।”
-“ভূতটাকে ঘােষবাগানের দানাে নাম দিয়েছে কেন?” দীপক কৌতূহলী।
নকুল বলল, “লােকে ভাবছে যে ঘােষবাগানেই ওর আস্তানা তাই—”
-“আচ্ছা, ভবা মণ্ডল বলছিলেন যে এখানে নাকি একটা খুন হয়েছিল?”
-“হ্যাঁ। গত বছর। তালডাঙায় ওইখানে একটা মৃতদেহ পড়েছিল। পুলিশ বলেছিল, লােকটা দাগি ডাকাত। ওর দলের লােকেই নাকি ওকে খুন করে ফেলে রেখে গিয়েছিল এখানে। কয়েকন গ্রেফতারও হয়েছিল। তারপর হতে অনেক মাস কেটেছে। কোনাে গােলমাল হয়নি। এখন হঠাৎ?”
দীপক চারধার দেখল খানিকক্ষণ খুটিয়ে। তারপর বলল, “চল ফেরা যাক।” তার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে।
নতুনগ্রামে ফিরে দীপক ছােটনকে বলল, “তােকে বােলপুরের বাসে তুলে দিলে, একা ফিরতে পারবি?”
-“কেন পারব না। কিন্তু তুমি?”
-“ভাবছি থেকে যাই এখানে রাতটা।”
-“বুঝেছি। ভূত দেখবে?”
-“একটা ট্রাই করব।”
-“কাকু, আমিও থাকব।”
-“নাে। এই বয়সে ভূত দেখার শখে কাজ নেই। শােন, বাড়িতে মানে দাদা-বউদিকে খবরদার বলবিনে আমি কেন এখানে রয়ে গেলাম। ঝুমাকে বারণ করে দিবি বলতে। বললে কিন্তু কোনােদিন আর আইসক্রিম খাওয়াব না, মনে রেখাে।”
ছােটন চলে গেল বােলপুর।
দীপক শিবপদকে বলল, “আজ রাতে আমার একটা শােবার জায়গার ব্যবস্থা করতে পারেন? একটা খাট হলেই চলবে।”
-“এখানে থাকবেন!” শিবপদ অবাক।
-“হ্যা। আজ রাতে একটু বেরােব। যদি আপনাদের ভূতের দর্শন পাই। তারপর তাে আর ফেরার বাস পাব না। তাই রাতটুকু কাটাতে-”
“এটা কিন্তু মশাই ঠিক হবে না।” শিবপদ বাধা দেয়।
“দেখুন, আমি রিপাের্টার। এমন রিস্ক ঢের নিয়েছি। আমার নার্ভ বেশ স্ট্রং।”
একটু চুপ করে থেকে শিবপদ বলল, “রাত সাড়ে ন’টা-দশটা অবধি আমার দোকান খােলা থাকে। তাস খেলি। তার মধ্যে ফিরলে এখানেই শুতে পারেন। ওই তক্তপােশে। আর যদি দেরি হয়?” সে ভাবনায় পড়ে।
-“ব্যস ব্যস। দশটাই যথেষ্ট। তার মধ্যে দেখা পাই ভালাে। নইলে ফিরে আসব। সারারাত জাগার ইচ্ছে নেই মােটেই। পাঁচ-দশ মিনিট দেরি হতে পারে। একটু অপেক্ষা করবেন প্লিজ।”
রাত আটটা নাগাদ শিবপদর দোকানে পাঁউরুটি, আলুর দম ও রসগােল্লা খেয়ে দীপক নৈশ অভিযানে রেডি। নকুল বলল তাকে, “টর্চ এনেছেন?”
-“টর্চ? নাঃ। টর্চ কেন? দিব্যি চাদের আলাে রয়েছে।”
-“মানে, চাঁদের আলােয় তাে স্পষ্ট দেখতে পাবেন না। বাগানে দিঘির পাড়ে বড় বড় সাপ ঘােরে। বিষাক্ত গােখরো, কেউটে। তাই বলছি।”
ভূতের ভয়ে না হােক, সাপের কথায় ঘাবড়ে গেল দীপক। আমতা আমতা করে বলল, “তাহলে তাে বাগানে বা পুকুরপাড়ে না যাওয়াই উচিত। কী বলে? রাস্তা থেকে দেখবখন। তবু একটা টর্চ থাকা ভালাে। জোগাড় করে দিতে পার একটা?”
-“দেখি।” চলে যায় নকুল।
ইতিমধ্যে শিবপদর দোকানে এসে জুটেছে ব্রজনাথ, কেষ্ট ও জটাধর। তাস খেলার লােভে। জটা উপদেশ দেয়, “মশাই সাবধানে ঘুরবেন। ভূত সাপ কেউ ফ্যালনা নয়। আমাদের অভিজ্ঞতা আছে তাই বলছি। গোয়ার্তুমি করে একটা বিপদ ঘটালে মুশকিলে পড়ে যাব সবাই।”
“না না। সে ভাববেন না। সাবধান হব বইকি।” আশ্বাস দেয় দীপক।
নকুল একটা টর্চ এনে দেয়। তবে সেটার আলাের জোর খুব কম।
নতুনগ্রাম থেকে হরিপুর যাওয়ার রাস্তাটা পদ্মদিঘির গা ঘেঁষে গিয়ে যেখানে উত্তরে ঘুরে সিধে গিয়েছে সেই বাঁকে হাজির হল দীপক। সেখান থেকে দিঘির পাড়, ঘােষবাগান এবং তালডাঙা—এই তিনের অনেকটা অংশ দেখা যায়। পথের ধারে একটা পাথরের ওপর বসল সে জুত করে।
ক্রমে চাঁদ ওপরে ওঠে। শুক্লপক্ষের মাঝামাঝি। হালকা জ্যোৎস্নায় প্রকৃতি রহস্যময়। আলােআধারির জগৎ। মেঘহীন আকাশে হীরের কুঁচির মতাে ঝকঝকে অসংখ্য তারা।
বাতাস উঠেছে। তাই গরমের ঝাঁঝটা কমেছে। দিব্যি আরাম লাগছে খেলা জায়গায়।
কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভােগের চেয়ে একটি অস্বস্তি ক্রমে বাড়তে থাকে দীপকের মনে। উঃ, চারধার কী নিস্তব্ধ। শুধু কানে আসে অসংখ্য ঝিঁঝিঁর তীব্র একটানা ঐকতান। আর মাঝে মাঝে অদ্ভুত কিছু শব্দ। রাতে নির্জন পাড়াগাঁ অঞ্চলে সে কম ঘােরেনি। ভয়ও পেয়েছে কখনও কখনও। তেমনি এক ভয় বা অস্থির ভাব যেন বড় বেশি চেপে বসছে আজ।
কোনাে সড়সড় মড়মড় আওয়াজ পেলেই দীপক টর্চ ফেলে দেখছে আশেপাশে। ঘােলাটে আলাের বৃত্তয় হাত দশেকের বেশি নজর চলে না।
কতক্ষণ দীপক এমনিভাবে বসেছিল খেয়াল নেই। বুঝি একটু ঝিমুনি এসেছিল। সহসা একটা আওয়াজে চটক ভাঙে। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হঠাৎ তার নজরে পড়ল বাগানের কাছে দিঘির পাড়ে বিরাট এক ছায়ামূর্তি। কোনাে মানুষ অত লম্বা হতে পারে। প্রকাণ্ড মাথা। আবছা চন্দ্রালােকে বােঝা যায়, তার গােছা গােছা চুল উড়ছে বাতাসে। দুলছে হেলছে শরীর। সুদীর্ঘ হাত দুটো নাড়ছে এলােমেলাে।
ধীরে ধীরে চলছে মূর্তিটা। ঝােপঝাড়ের গা দিয়ে কিন্তু কোনাে শব্দ নেই। একবার একটা আওয়াজ শােনা গেল। অপার্থিব খনখনে চাপা হাসি। যেন হাসছে ওটা। দেখতে দেখতে সেই দানব মূর্তি অদৃশ্য হল ঘােষবাগানের অন্ধকারে।
আরও মিনিট পনেরাে বসে রইল দীপক একই জায়গায় কাঠ হয়ে। তারপর উঠে গুটি গুটি হাঁটতে শুরু করে নতুনগ্রামের উদ্দেশে। শিবপদর দোকানের আলাে দেখার পর তার যেন ধড়ে প্রাণ এল।
সম্পাদক কুঞ্জবিহারী টেবিলে প্রচণ্ড এক চাপড় মেরে হুংকার দিলেন— “কনগ্রাচুলেশনস দীপক। স্টোরিটা ফাসক্লাস হয়েছে। ঘােষবাগানের দানাে। হইচই পড়ে গিয়েছে। এ হপ্তায় বঙ্গবার্তার বাম্পার সেল। কত চিঠি পাচ্ছি জানাে?”
—“চিঠি? কী চিঠি লিখছে?” দীপক কৌতূহলী।
-“ফর এ্যান্ড এগেনস্ট। কেউ খুব প্রশংসা করেছে লেখাটার এবং রিপাের্টারের সাহসের। কেউ আবার গালমন্দ করেছে। লিখেছে—মিথ্যে। বানানাে গপ্পো।
-“কী বানানাে? তেতে ওঠে দীপক।”
-“আহা, চটছ কেন? তর্ক জমলেই তাে নিউজের দর বাড়ে। তবে বিশ্বাসীর সংখ্যাই বেশি। অনেকে খোঁজখবর নিচ্ছে ব্যাপারটার।”
দীপক বলল, “আমি কিন্তু আর ওমুখাে হচ্ছি না। একবার দর্শনই যথেষ্ট।”
-“না না, তােমার আর যাওয়ার দরকার কী? যার ইচ্ছে হবে সত্যি মিথ্যে যাচাই করতে, সে নিজে যাক।” সম্পাদক ফতােয়া দিলেন।
আরও দিন দশেক কাটল।
এক সকালে ভবানী প্রেসের পিয়ন এসে জানাল দীপককে, “এডিটারসাব আপনাকে ডেকেছেন। জরুরি দরকার।”
কী ব্যাপার? দীপক তখুনি ছােটে।
সম্পাদকের কুঠরিতে বসেছিলেন নতুনগ্রামের সেই তারকনাথ। দীপক ঢুকতেই কুঞ্জবিহারী গমগমে গলায় বলে উঠলেন, “শােন হে দীপক, তারবাবু কী বলছেন?” বলে তিনি নিজেই গড়গড় করে কিছু খবর শুনিয়ে দিলেন—“নতুনগ্রামে নাকি ‘ভূতের ব্যাপারটা আরও জমেছে। এমনকী বঙ্গবার্তার দৌলতে কলকাতা থেকে একজন রিপাের্টার গিয়েছিল ব্যাপারটার খোঁজ করতে। খুব গুজব রটেছে।”
-“আমি আসার পর আর কেউ ভূত দেখেছে?” দীপক জিজ্ঞেস করে।
-“দেখেনি কেউ। তবে শুনেছে দু’জন। জানালেন তারকনাথ।
-“শুনেছে মানে? হাসি?”
-“হ্যাঁ, হাসি। তাছাড়া বাগানের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় শুনেছে জোরে টানা দীর্ঘশ্বাস। কিংবা যেন ফুসছে কেউ। একেবারে ভুতুড়ে আওয়াজ। দুজন একসঙ্গে যাচ্ছিল। শব্দটা কানে যেতেই তারা প্রাণপণে সাইকেল চালিয়ে পালায়।”
-“আহা, আসল কথাটাই যে বলা হল না।” বাধা দেন কুঞ্জবিহারী, “জানো দীপক, এবার ভূত তাড়াবার ব্যবস্থা হয়েছে।”
-“কী ভাবে?”
-“ওঝা ডেকে ঝাঁড়ফোক করা হয়েছে দু’দিন আগে,” বললেন তারকনাথ, “অনেক খরচা করে মুর্শিদাবাদ থেকে আনা হয়েছিল নামকরা ওঝা। নতুনগ্রামের বলাই আর ইসলামপুরের হাবিব—এই দুই ছােকরাই প্রধান উদ্যোগ নিয়েছিল। চাঁদা তুলেছে গায়ে গাঁয়ে। অনেকেই দিয়েছে। হরিপুরের লােকেই বেশি। ওদেরই তাে বেশি অসুবিধে হচ্ছিল। ও, ওঝার কি চেহারা! মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল। লম্বা চুল। ইয়া জোয়ান। লাল লাল চোখ। কপালে সিঁদুরের ফোটা। বাজখাই গলা। গায়ে লাল কাপড়, লাল ফতুয়া। মাথায় লাল ফেট্টি।
সারা সকাল কত কী যে করল। খুব মন্ত্র আওড়ালাে। সংস্কৃত বাংলা হিন্দি। মন্ত্রের কী তেজ। ওহ্। সরষে ছিটিয়ে, গণ্ডি কেটে গেছে ঘােষবাগান, পদ্মদিঘি আর তালডাঙায় যে জায়গাগুলােয় দানােটার ঘােরাফেরা। বলে গিয়েছে যে এবার বাগান ছেড়ে পালাবে বাছাধন।
এই অঞ্চলই ছেঁড়ে যাবে। অন্য কোথা থেকে তাড়া খেয়ে এসে ঘােষবাগানে আস্তানা গেড়েছিল। বিষম প্রকৃতির দানাে ভূত। এখনও কারও ক্ষতি করেনি বটে, তবে করত ঠিক ভবিষ্যতে। অতৃপ্ত আত্মা। হঠাৎ হঠাৎ ক্ষেপে যায় মানুষের ওপর। যাক, এখন বাঁচোয়া।”
-“তারপর রেজাল্ট কী? আর ভূত দেখা যায়নি?” জানতে চায় দীপক।
-“নাঃ। এই দু’দিন তাে দেখা যায়নি। অট্টহাসি বা ফোস-ফোসানিও শােনা যায়নি। অবিশ্যি এখনও হরিপুরের শর্টকাট পথে তেমন লােক চলছে না ভয়ে। তাবে দূর থেকে নজর রাখছে।”
দীপক ভুরু কুঁচকে ভাবে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, আজ হবে না। কাল যাব একবার আপনাদের ওখানে। ব্যাপার স্যাপার দেখতে।
-“ভেরি ভেরি গুড”, টেবিল চাপড়ালেন কুঞ্জবিহারী, “নিউজটা ফলাে করা উচিত। জানতাম, শুনলে তুমি ঠিক যাবে আবার।”
পরদিন সকালে দীপক গেল নতুনগ্রামে। নাঃ, গতকালও রাতে অলৌকিক কিছু দেখা যায়নি বা শােনা যায়নি।
দিনভর গমগম করছে শিবপদর দোকান। নকুল এক ফাঁকে হাসিমুখে জানিয়ে গেল দীপককে, “স্যার, আর এক মাস এমন চললে মামা একখানা কোঠাঘর তুলতে পারবে। জানেন, ওঝা যেদিন এল দোকানে, লাভ হয়েছে তিনশাে টাকা প্রায়। চা টিফিন মিল সাপ্লাই। মামা আর আমার তাে কিছু দেখারই ফুরসত মিলল না।”
দীপক যখন ঘােষবাগানে ঘুরঘুর করছে, তখন বাগানের বাইরে দুটি যুবক ফিসফিস করছে। বলাই আর হাবিব।
বলাই বলল, “আপদ তাে চুকল। এবার কাজ সারি?”
হাবিব চিন্তিতভাবে বলল, “আর ক’টা দিন যাক। ভিড় কাটুক।”
ঘণ্টা দুই সেখানে কাটিয়ে দীপক বােলপুরে ফিরে এল।
দীপক পরদিন ফের গেল নতুনগ্রামে। দুপুরে।
নাঃ, গত রাতেও দানাের দেখা মেলেনি। কোনাে বিদঘুটে শব্দও শােনেনি কেউ। আগের রাতে তিনজন লােক সাহস করে জোট বেঁধে হরিপুরে গিয়েছে দিঘির পাশ দিয়ে শর্ট-কাটে। নিরাপদেই। লােকের ভয় ভাঙছে।
দীপক শিবপদর দোকানে বসে প্ল্যান ভাঁজছে যে ওঝার কেরামতি নিয়ে আজ একটা লিখে ফেলব বােলপুরে ফিরে। এমন সময় বাস থেকে একজন নামল, যাকে দেখে তার পিত্তি জ্বলে গেল।
সমাচারের রিপাের্টার মন্টু। সাপ্তাহিক সমাচারও বােলপুর থেকে প্রকাশিত হয় এবং বঙ্গবার্তার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী।
মন্টু দীপককে দেখে দাঁত বের করে হেসে বলল, “এই যে। এলাম।”
মন্টুর কাঁধে ঝােলানাে ক্যামেরাটা দেখিয়ে দীপক গভীরভাবে বলল, “ভূতের ছবি তুলবে নাকি?”
-“নাঃ। তেমন ক্যামেরা পাচ্ছি কই?”
মন্টু মিচকে হাসে, “এই বাগান-টাগানের ছবি নেব। তুমি তাে হে ফার্স্ট রাউন্ডটা মাত করে দিয়েছ। দেখি সেকেন্ড রাউন্ডে আমি কিছু করতে পারি কিনা? আজ রাতে এখানে থাকছ নাকি?”
-“হুম্। ঠিক করিনি। তুমি?”
-“ভাবছি থেকে যাব।”
দীপক কিঞ্চিৎ দ্বিধায় ছিল রাতে থাকবে কিনা? তক্তপােশে শুয়ে মশার কামড় খেয়ে অনিদ্রায় কাটানাে মােটেই আরামদায়ক ব্যাপার নয়। কিন্তু সে তখুনি স্থির করে ফেলে মনে মনে, রাতটা এখানেই কাটাব। যদি কিছু আজ স্পেশাল ঘটে, মন্টু একা লিখে ক্রেডিট নেবে? কভি নেভি।
রাত আটটা নাগাদ শিবপদর দােকানে কিছু খেয়ে নিয়ে দীপক গুটিশুটি বেরিয়ে পড়ে। ঘুরঘুর করে কাছাকাছি। লক্ষ রাখে মন্টু কোথায় যায়।
একটু বাদেই সে দেখল যে মন্টু হরিপুরের রাস্তা ধরে হাঁটা দিল। অর্থাৎ ওই পথের কোথাও বসে ভূত দেখার তালে আছে। দীপক সে ধারে গেল না। পিচ রাস্তা ধরে খানিক পুবে হেঁটে তালডাঙায় নামল। বসল একটা ঝােপের আড়ালে।
নিশুতি থমথমে রাত। তারা-ফুটফুটে আকাশে ঝকঝকে চাঁদটা প্রায় থালার মতাে গােল। রুপােলি জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে মাঠঘাট।
প্রায় ঘণ্টাখানেক কেটেছে। দীপকের কানে এল কারও হেঁড়ে গলার গান। নজর করে দেখল যে একজন আসছে গাইতে গাইতে হরিপুরের দিক থেকে তালডাঙা ভেদ করে।
আগন্তুক গায়ক পল্টন আলি।
পল্টন কাঠ মিস্ত্রি অর্থাৎ ছুতাের। সে এখানে ছিল না মাসখানেক। হুগলিতে গিয়েছিল কাজ করতে। দু-তিন দিন আগে ফিরেছে, বাড়ি ইসলামপুরে। এসে শুনেছে সব। ঘােষবাগানের দানাের কথা। ওঝা ডাকা—ইত্যাদি এবং হয়তাে এবার পালিয়েছে দানােটা।
পল্টনের যাত্রার শখ বেজায়। সে ক্ল্যারিওনেট বাজায় যাত্রাদলে। দেশে ফিরেই সে রিহার্সাল দেওয়া শুরু করেছে হরিপুরে তাদের পার্টির মহড়ায়। রিহার্সাল শেষে ফিরছে এখন।
পল্টনের ভয়-ডর কম। তাছাড়া ভূতের দেখাও মিলছে না কয়েকদিন। সে তাই নিশ্চিন্তে গলা ছেড়ে গাইতে গাইতে আসছে তালডাঙার ভিতর দিয়ে ইসলামপুর যাওয়ার শর্ট-কাট পায়ে চলার পথ ধরে। ঘুরপথেও যাওয়া যায় তালডাঙা এড়িয়ে। তবে কী দরকার অযথা সময় নষ্ট। খুব খিদে পেয়ে গিয়েছে।
পল্টন যখন ডাঙার মধ্যে বেশ খানিকটা ঢুকে এসেছে তখনই দেখা গেল ঘােষবাগানের দানােকে। দিঘির গা বেয়ে নামছে ডাঙায়।
পল্টন প্রথমে খেয়াল করেনি। মশগুল হয়েছিল গানে। সঙ্গের কুকুর শেরুর গরগর্জন শুনে মাথা ঘুরিয়ে দেখেই থমকে দাঁড়াল। শেরু পল্টনের ভীষণ ভক্ত। প্রায় সব সময়ে সঙ্গে ঘােরে। জাতে দেশি বটে কিন্তু ইয়া তাগড়া। তেমনি তেজি। কয়েকবার শেরু পল্টনকে সাবধান করে দিয়ে সাপের হাত থেকে বাঁচিয়েছে।
পল্টন কয়েক মুহূর্ত ওই নির্জন প্রান্তরে সেই ঘাের কালাে চলমান সাক্ষাৎ বিভীষিকাকে দেখে ‘ইয়া আল্লা’ বলে পিছু ফিরে মারল টেনে দৌড়।
দীপক আবছা দেখতে পেল যে বহুদূরে আর একটি মানুষ গরুর গাড়ির রাস্তা ধরে পাই পাই করে ছুটে মিলিয়ে গেল নতুনগ্রামের দিকে। ও নির্ঘাৎ মন্টু।
দীপকও উঠে পালাবে ভাবছে, এমন সময় এক আশ্চর্য ব্যাপার দেখে সে হাঁ।
পল্টন পালাল বটে কিন্তু পল্টনের বাঘা কুকুর শেরু ঘাউ ঘাউ করে ঢাক ছেড়ে সােজা তেড়ে গেল দানােটার দিকে। আরে মরবে যে কুকুরটা!
এরপর দ্বিতীয় চমক। দীপক দেখল যে ঘােষবাগানের দানাে পালাচ্ছে। বুঝি শেরর তাড়া খেয়ে লগবগ করতে করতে। খানিক পিছনে হেলে বিচিত্র ভঙ্গিতে ছুটে আসছে দীপক যেখানে বসে সেই দিকেই। হঠাৎ দানােটা একটা বেঁটে খেজুরগাছকে জড়িয়ে ধরল। এরপরই শোঁ শোঁ করে একটা তীক্ষ্ণ টানা শব্দ।
অদ্ভুত সেই আওয়াজটা শুনে থমকে গেল শেরু। পরক্ষণে সে বেজায় ভড়কে পিছু ফিরে মারল ছুট। ওর প্রভুর পথেই।
এসব দেখে দীপকের দেহ অসাড় হয়ে গিয়েছিল। উঠে পালাবে যে সে শক্তিও নেই।
দানােটা তার থেকে মাত্র হাত চল্লিশ তফাতে। তার কেমন ভয় হল যে এখন উঠে পালাতে গেলে ভূতটার নজরে পড়ে যাবে। সে কাঠ হয় দেখে।
দীপক লক্ষ করে যে খেজুরগাছ জাপটানাে দানােটা হঠাৎ আকারে ছােট হচ্ছে। ক্রমে ছােট হতে হতে প্রায় মিশে গেল মাটিতে। শো শো শব্দটা তখন থেমে গিয়েছে।
ভীরু চোখে নজর করে দীপক। দেখে, ওই খেজুরগাছের তলায় কে একজন নড়াচড়া করছে। কোনাে মানুষ। এমন কিছু বড়সড় চেহারা নয় মানুষটার।
প্রচণ্ড কৌতুহলে গুড়ি মেরে এগোয় দীপক নিঃসাড়ে। কাছে গিয়ে ঝপ করে টর্চ মারে লােকটার গায়ে। আজ সে নিজের টর্চ এনেছে।
গায়ে আলাে পড়তেই লােকটি চমকে মুখ ফেরায়।
দীপক থ। এ কী! এ যে নকুল। লুঙ্গি ও শার্ট পরা। সে দুই লাফে গিয়ে নকুলের হাত চেপে ধরে বলল, “কী ব্যাপার? তুমি? এখানে কী কচ্ছ?”
নকুল অসহায়ভাবে বলে ওঠে, “স্যার, আলাে নেবান প্লিজ। বলছি সব।”
দীপক নকুলের হাত ছেড়ে দিয়ে লক্ষ করে, মাটিতে শায়িত বিরাট লম্বা এক দেহ। মানুষের মতাে মনে হচ্ছে তবে আকারে যেন দানব। আলখাল্লা জাতীয় পােশাক পরনে। নিথর।
-“কী এটা?” দীপক প্রশ্ন করে।
-“আজ্ঞে ঘােষবাগানের দানাে। মিনমিন করে নকুল।
-“ইয়ার্কি হচ্ছে,” বলেই দীপক টর্চ ফেলে মূর্তিটার মুখে। সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ চমকায়।
বীভৎস এক দানব মুণ্ড। কুচকুচে কালাে চামড়া। ভাটার মতাে লাল লাল চোখ। চিরকুট ধবধবে সাদা রাক্ষুসে দাঁতের সারি। মাথায় চুলের গােছা। গলা থেকে কালাে রঙের বিশাল আলখাল্লায় ঢাকা গােটা দেহ।
-“প্লিজ স্যার, আলো নেবান।” কাতরে ওঠে নকুল।
দীপক টর্চ নেবায় এবং বােঝে নিজের ভুল।
ওটা কোনাে মুণ্ড নয়। গাঢ় নীল গােল মন্ত বেলুনের ওপর হাতে আঁকা ভূতুড়ে মুখ। সত্যি চুল নয়। সরু সরু কালাে রঙের কাগজের ফালি সাঁটা মাথায়।
দীপক বসে পড়ে চিৎ হয়ে শােয়া মূর্তিটা ঘেঁটেঘুটে টিপেটুপে দেখে। ফিনফিনে আলখাল্লাটার তলায় মনে হল একটা লম্বা মােটা বেলুন। তার ডগায় মাথা মুণ্ড আঁকা বেলুনটা। গলা মানে দুই বেলুনের জোড়ের কাছে কঞ্চির ফ্রেমে আটকানাে লম্বা কালাে আলখাল্লাটা। সরু লম্বা দুটো বেলুন বাঁধা রয়েছে কাঁধের কাছে। যেন হাত। তাদের একটা ফেসে চুপসে গিয়েছে। পা বলে কোনাে বস্তু নেই। একটা ভারি লাঠি, চাপানাে রয়েছে মূর্তিটার গলার কাছে।
-“এ যে বেলুন ভূত?” দীপক স্তম্ভিত।
-“আজ্ঞে তাই।” কাচুমাচুভাবে সায় দেয় নকুল।
-“তুমি বানিয়েছ?”
-“আজ্ঞে হ্যাঁ। মানে এই বডি আর মাথাটা গ্যাস বেলুনের। তবে হাত দুটো গ্যাসের নয়, অর্ডিনারি বাতাস বেলুন। আমি তাে বেলুন বিক্রি করি। ঘরেই থাকে নানারকম বেলুন। গ্যাস সিলিন্ডারও থাকে।
গ্যাস বেলুন তাে। তাই এই সরু দড়িটা দিয়ে বেঁধে ধরে থাকি নিচে। নইলে ছাড়লেই মুণ্ডসুদ্ধ জামা পরানাে বডিটা হস করে উড়ে যাবে।”
-“ও, এই বেলুন ভূত দেখিয়ে তুমি লােককে ভয় দেখাচ্ছ?”
-“আজ্ঞে।” নকুল মাথা চুলকায়।
-“কারণটা কী?” দীপকের স্বর কঠিন হয়।
-“বাধ্য হয়ে স্যার”, নকুল করুণ গলায় বলে, “বাগানের ফল বাচাতে। এই বলাই আর হাবিব দুটো মহা চোর। গত বছর ওরাই সাফ করে দিয়েছিল বাগান। হাতে-নাতে ধরতে পারিনি অবিশ্যি। তবে খবর পেয়েছি। এবারও দেখছিলাম যে কেবলই দুটো ঘুরঘুর করছে বাগানে। কাহাতক আর রাত জেগে পাহারা দেওয়া যায়। এরা তাকে তাকে ছিল। এক রাত পাহারা না থাকলে বা বেশি ঘুমলেই ফল সাফ করবে।
একদিন ওদের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম যে দুটোরই খুব ভূতের ভয়। তখন আইডিয়া খেলল মাথায়। এক একদিন চুপিচুপি এসে অন্ধকারে বাগানে বসে বেলুনগুলাে ফুলিয়ে ভূতটা বানাই। বাগান থেকে বেরিয়ে নিচু হয়ে ওটাকে খানিক উড়িয়ে লম্বা জামাটার আড়ালে আড়ালে দড়ি ধরে টেনে টেনে নিয়ে হাঁটি। কারও চোখে পড়ে যায়। ভূত-প্রেত দানাে ভাবে। বিটকেল হাসি-টাসিও দিই। আবার বেলুন থেকে গ্যাস বেরুবার শব্দেও লােক ভয় পায়। গ্যাস সিলিন্ডারটা বাগানে কুটিরের ভিতর গর্তে লাকানাে থাকে।
আজ দেখলাম যে শয়তান দুটো শলা করছে গােপনে। ভয় হল, আজ হয়তাে ফল চুরি যাবে। ভূতের ভয়টা কেটেছে কিনা। তাই আজ ভয়টা ফের চাগিয়ে দিলাম। কিন্তু পল্টনের কুকুরটা যা। বেটা সাংঘাতিক। দানাে-ফানাে মানে না! ভাগ্যিস কামড়ায়নি। ইস্, খেজুর কাটায় লেগে ভূতের পােশাকটা ছিঁড়ে গিয়েছে। একটা হাত ফেসেছে।”
-“কিন্তু লােকের যে ভীষণ অসুবিধে হচ্ছে?” ধমকে ওঠে দীপক।
-“আর বড়জোর দিন পনেরাে স্যার,” নকুল অনুনয় করে, তার মধ্যে আম-কাঠাল সব নেমে যাবে। তার “আমি নিজে ফের ওঝা ডেকে আনব। মানে অন্য ওঝা। দেখবেন তার মন্ত্রের জোর। ঠিক দানােটা পালাবে। অন্তত বছরখানেকের মতাে।” ফিক করে হেসে ফেলে নকুল।
-“হু। মনে রেখ। নইলে—” কিন্তু দীপক ওয়ার্নিং দেয়।
-“যে আজ্ঞে।” নকুল ঘাড় নাড়ে।
-“মামা জানে তােমার কার্তি?”
-“আজ্ঞে না।” বলেই নকুল হামলে পড়ল দীপকের পায়ে, “প্লিজ স্যার, বলবেন না কাউকে। তাহলে মারা পড়ব। মামা আর আমার মুখদর্শন করবে না।”
-“আচ্ছা, আচ্ছা।” অভয় দেয় দীপক।
নকুল বলল, “স্যার, এবার এগুলাে গুটিয়ে ফেলি।”
সে কিছু খুটখাট করে। কয়েকবার শোঁ শোঁ শব্দ হল বেলুন থেকে গ্যাস বা হাওয়া বেরুবার। চোপসানাে বেলুনগুলাে এবং আলখাল্লা দড়ি ইত্যাদি গুটিয়ে নিয়ে সে ভরল একটা ব্যাগে। তারপর বলল, “স্যার, এবার তবে যাওয়া যাক। আপনি তাে দোকানে যাবেন। আমি একটু ঘুরে বাড়ি ঢুকব লুকিয়ে।”
-“চল।” দীপক পা চালায়।
শিবপদর দোকানে পৌঁছে দীপক দেখল যে সেখানে হুলস্থূল চলছে। তক্তপােশে জবুথবু হয়ে বসে আছে শ্রীমান মন্টু। তার গা-মাথা জামা-প্যান্ট সব ভিজে জবজবে। চোখে ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি। তাকে ঘিরে চারজন তাস-খেলুড়ে তাে রয়েছেই, গ্রামের আরও কয়েকজন জুটেছে। সবাই উত্তেজিত সুরে কথা বলছে।
শিবপদর কাছে জানল দীপক, “মন্টু নাকি হাউমাউ করে দোকানে ঢুকে আছড়ে পড়ে তক্তপােশে। তারপরই অজ্ঞান হারায়। জলের ঝাঁপটা দিতে হুশ ফিরেছে। দীপককে দেখে মন্টু ক্ষীণকণ্ঠে বলল, “দেখেছ? উঃ, ডেঞ্জারাস!”
কোনােরকমে হাসি চেপে একবার মাথা ঝাঁকিয়ে দীপক গম্ভীরভাবে বসল তক্তপােশের কোনায়।
মন্টু কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে ওঠে, “আমার ক্যামেরাটা? কোথায় যে পড়ল? অসহায় চোখে সে তাকায় সবার পানে। অর্থাৎ কিনা, দয়া করে কেউ যদি তার ক্যামেরাটি উদ্ধার করে এনে দেয়।”
কারও কিন্তু এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখা গেল না। দীপক বলল, “ক্যামেরা কেউ নেবে না। খুব ভােরে গিয়ে খুঁজে নিও।”
হতাশ মন্টু ধপ করে শুয়ে পড়ল। দীপকের মাথায় তখন দারুণ একটা স্টোরি ঘুরছেঘােষবাগানের দানাের পুনরায় আবির্ভাব। প্রেতদর্শনে সমাচারের রিপাের্টারের নিদারুণ দুর্দশা। তার প্রাণভয়ে পলায়ন। পতন ও মুর্ছা। ক্যামেরা হারানাে-ইত্যাদি।
কাল বাড়ি ফিরেই লিখে ফেলবে।