ঘোরানো সিঁড়ি – ৭

সাত – ওরা

বাবার জন্মতিথিতে ওরা সবাই সমাগত। ন্যালার মা বলল, তিনি থাকতে তো জন্মতিথি দেখি নাই।

—না থাকতে দেখতেছ। দেখা নিয়া কথা। সে থাকতেই দেখ, বা না—থাকতেই দেখ।

ছেলেরা, মেয়ে ও বিনি ঘুরে ঘুরে দেখছিল। বিনি এখন খুব শান্ত। রুমার মৃত্যুর অনেক পরে ও যেন নিজেকে খুঁজে পেয়েছে। বিনিকে এমন আত্মস্থ ও নিজের পরে বিশ্বাসী আমি কখনো দেখিনি।

আমাকে বাগানে নিয়ে গিয়ে বিনি বলল, কাকা। আমার সিদ্ধান্ত কিন্তু অবিচল আছে।

—সবই তোমাদের ওপর।

—আপনি কোনও দাবি করবেন না?

—যাদের উপর দাবি খাটত, তারাই নাই।

—কাকা, আপনি বাঙাল, অ—বাঙাল দু’ভাবেই কথা বলতে পারেন।

—তোমরা যেমন ইংরাজি বলো।

এখানে এলে…. মনে হয় রুমার কথা….

—চলে গিয়ে সে তো মুক্তি দিয়ে গেল মা, মুক্তি পেয়েও গেল। তোমার কিছু হ’লে তার কী হত?

—সুভাষ …. কোনও ব্যবস্থা হয়তো করত।

—গাছপালা সব মায়ের লাগানো?

—দাদা… বউদি….. ন্যালা…..আমার আনা গাছ ওই চাঁপা গাছটা। এখন ফুল ফোটার মতো বড় হয় নাই।

—দিদিকে বাইরে যত শক্ত দেখায়, সে তেমন নয়। ভিতরে খুব ভেঙে গেছে।

হতেই পারে। মাধবীর বয়স সাতচল্লিশ। শিকাগোতে জীবনের অধিক সময়টা কাটাল। সবুজ ওকে ছেড়ে আরেকটা বিয়ে করল। ও কেন সব ছেড়ে চলে এল তাই ভাবি। ছেলেরা তো আসবে না। ও সেই দেশেই কোনও কাজকর্ম করে থেকে যেতে পারত।

দিল্লিতে … একা একা….

সন্ধ্যায় দাদা বউদির ছবিতে মালা ঝুলেছিল, ধূপ এবং গুডনাইট একাধারে জ্বলেছিল। আজ প্রতি ঘরে গুডনাইট জ্বলবে। ডেকরেটরের ঘর থেকে নাইলন নেটের মশারি, বালিশ, তোষক, চাদর এসেছে।

সবাই যেন অপেক্ষা করছিল। আমি সহাস্যে বললাম, তোমরা তো কোনও সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছ। বলেই ফেল। আগেই বলেছি, তোমাদের কোনও সিদ্ধান্তেই ”না” বলব না। আমি—থার্ড পার্টি।

স্বাধীন ঈষৎ হেসে বলল, অন্য পার্টি কে কে?

—বাড়িটা আর তোমরা । তোমাদের মায়ের অনুরোধ ছিল, বাড়িটা তোমাদের হাতে তুলে দিই।

—তুমি কোথায় যাবে?

বিনি বলল, আজ তো কাকারও জন্মদিন। তোমাদের সেটা মনে পড়ল না?

আমি বললাম, আমার নিষেধ ছিল। জীবিতের আবার জন্মদিন কেন? জীবিত যে, সে বাঁচে। যা হোক, তোমরা কী ঠিক করলে তাই বলো।

—সুভাষ বলুক।

—সেই বলুক।

—এ বাড়ি রাখা যাবে না।

—রেখো না।

মাধবী বলল, কাকা। অমন করে বলছ কেন?

—আমি ক্লান্ত রে মা! এবার এই বিনি মাইনের চাকরি থেকে ছুটি চাই।

সবাই চুপ। ন্যালা ট্রে—তে চা, বিস্কুট ও কাজু বাদাম রেখে গেল।

সুভাষ বলল, বাড়ি বেচেই দিতে হবে।

—বেশ তো।

—এখন… বিনি চায় এ বাড়িতেই রুমার নামে কিছু করতে… শিশুদের জন্যে। আমি মনে করি, এ বাড়ি আমি বাজার দরেই কিনে নেব…. দাদা, দিদি, ছোড়দাকে যা প্রাপ্য দিয়ে দেব।

আমি বললাম, এখানে অমন কিছু করা…. আমার মতে অবাস্তব।

—কেন? কেন?

বিনি বলল, আপনি তো জানতেন।

—কোনও দিন মহকুমা টাউনে থাকোনি, অনেক অসুবিধা হবে। স্থানীয় রাজনীতি ইত্যাদির প্রভাব পড়বেই …. আর…. সবাই জানত, বুড়া বুড়ি থাকে, তাদের কিছু নাই। তোমাদের বিষয়ে ধারণা, তোমরা লক্ষ কেন, কোটিপতি। নিরাপদ হবে বলেও মনে করি না।

সুভাষ বলল, হি ইজ রাইট।

—আমি ওখানে থাকতে পারছি না।

—এখানে থাকতে পারবে?

মাধবী বলল, আঃ! তোমাদের সমস্যা নিজেরা ফয়সালা কোরো। এখন সুভাষ বলুক।

—আমি বলি, আমি কিনে রাখি, ফেলে রাখি, তোমাদের যা ভাগে পড়ে, দিয়ে দিই। পরে…

বিনি বিষণ্ণ হেসে বলল, বেশি দামে বেচবে, সুভাষ?

—প্রপার্টির নিয়মই তাই।

—কলকাতায় ওই দুটো ফ্ল্যাট…..বাইপাসে জমি…. সাউথে কোথায় অনেক জমি… কার জন্যে?

—কী করে জানব তুমি মংগোলয়েড…

আমি হাত তুললাম।

—তোমাদের বাবা—মা, শত দুঃখেও অশালীনভাবে কথাবার্তা বলেননি। এখানে বসে তোমরা ও রকম কোরো না।

সুভাষ বলল, এনাফ ইজ এনাফ। দাদা যে ফ্ল্যাট কিনল, সেখানে কি দাদার কেউ থাকবে?

আমি বললাম, সে অর্থে আমাদের বংশে তো একই ইতিহাস… মাধবীর দিল্লির ফ্ল্যাটে কে থাকবে? …. স্বাধীনদের সল্টলেকের বাড়িতে তার ছেলে মেয়ে থাকবে কি না জানো না। থাকলে ভাল, নয় তো… সুভাষের কথা বিনিই বললে দাদা বউদির চার ছেলে মেয়ে ছিল…. বড় সাধের বাড়ি…. কিন্তু এ বাড়িতে কেউই থাকবে না।

—কে থাকবে কাকা? কেমন করে থাকবে?

—তোমরা বোঝ রে মা! তবে এতদিনে আমি নোটিস দেই। হাতে পাঁজি, মঙ্গলবার,—কথায় বলে। আজ রবিবার, মঙ্গলবার আমি গুডবাই করব।

—কোথায়?

—কোথাও।

—কিন্তু এ বাড়িতে তোমারও হক আছে।

—কিসের হক? দাদা বউদি যতদিন ছিলেন, ছিলাম। বউদিকে কথা দেই, তোমরা বাড়ির ভার বুঝে নেবে, তবে যাব। এখন তো থাকার দরকার নেই?

—মঙ্গলবারই।

—হ্যাঁ। ন্যালা আর ন্যালার মা—ও যাবে।

সুভাষ বলল, এ বাড়িতে তো কেয়ারটেকার হয়ে থাকতে পারত!

আমি মৃদুস্বরে বললাম, এনেছিলেন বউদি,—রেখেছিলেন তিনি … এখন আমার ওপরেই ওদের দায়িত্ব।

—না না, অবশ্যই ওরা অনেক করেছে…. দে শুড গেট সামথিং।

—না রে বাবা! কিছু দিতে লাগবে না। অস্থাবর আর আছে বা কী! খাট চৌকি, ফ্যান, লাইট, একখান হাঁড়ি, একটা কড়াই। ও সব থাকুক। তোমরা যা মনে করো, কোরো।

যতিনাথ বলল, কাকা! একটু ভাববে না?

—অনেক ভেবেছি যতি। এখন যে ক’টা দিন বাঁচি, নিজের মতো বাঁচতে চাই। তবে হ্যাঁ, ঘোরানো সিঁড়িটার কথা তখনি হয়েছিল। ওটা আমি দিন দশেক আগে নিয়ে গেছি।

সুভাষ বলল, ঘোরানো সিঁড়ি!

—হ্যাঁ, এ বাড়িটার চেয়ে ওর দাম অনেক বেশি।

দাদা….পাগলামি করে কিনেছিল।

বিনি উঠে এসে আমার হাতে চাপ দিল। বলল, আমি কিন্তু আপনাকে ছাড়ছি না।

—মা রে! ধরে কে, আর ছাড়ে কে! এসব কথা ভবিষ্যৎ বলে দেবে।

মাধবী বলল, আজ মনে হচ্ছে……বাড়িটা থাকবে না……..কী যেন হারিয়ে গেল।

যতিনাথ বলল, তবু ন্যালা যেত….

আমি বললাম, যাক! গাছের ফলপাকুড় পাঠাবার দায় থেকেও মুক্তি পেলাম।

স্বাধীন বলল, কাকা! তোমার কষ্ট হবে না?

—চলো তোমরা, খেয়ে নেয়া যাক। দাদা—বউদির ছবি কি তোমরা নেবে? বিনি বলল, আমরা? আপনি নেবেন।

সুভাষ বলল, ক্রেজি! দুটো ছবি, একটা ঘোরানো সিঁড়ি।

.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *