ছয় – আমি
আমি আর বউদি, সে পাঁচ বছরই হবে, দুজনে রইলাম।
বউদিকে সান্ত্বনা দেবার জন্য একটা কথাও বলা যেত না। ঠোঁট টিপে হেসে উনি যেতেন। শোকটা, শূন্যতাটা এতই ওঁর নিজস্ব, তাকে যেন সযত্নে রক্ষা করে চলতেন।
দাদা গেল ষাট বছরে।
বউদির তখন পঞ্চান্নই হবে। পঞ্চান্ন বছরের বিধবা স্ত্রীলোককে আন্তরিক সৎপ্রস্তাব দ্বারা আক্রমণ করে চলাও সমাজের নিয়ম।
বউদি আবার খাওয়া দাওয়া, ওঠা বসা, জীবনচর্যা, সব কিছুতে খুব স্বতন্ত্র ও প্রাইভেট পারসন। এটাকে দাদা মর্যাদা দিত আজীবন। তাই প্রতিবেশিনীরা খুব নিরুৎসাহিত হন।
—চলেন যতির মা, আমাগো বারি কীর্তন হইব। প্রতি বছরই হয়, যাইতেন না। এখনে চলেন। মন শান্তি পাইব।
—না দিদি। ঘর ছাইরা ভালো লাগেনা।
—ব্রজবাবুর মা অনন্ত চতুর্দশী ব্রত উদযাপন করবেন, ডাকতে এলাম।
—শরীলে দেয় না দিদি।
—কেদারবদ্রীর প্রসাদ যতির মা!
বউদি কপালে ঠেকিয়ে রেখে দিলেন। একদিন কাতর হয়ে বললেন, কুনো দিন পারা বেড়াই নাই, ইচ্ছাও হয় নাই। অহনে ওনাদের লগে কী কথা কমু বলেন?
—বলবেন না। যেমন মনে লয়, তেমন চলবেন। আপনেরে টোকাবো কে?
—শুধা ছাওয়ালরা আসে না কি, টাকা পাঠায় না কি, মাইয়া কবে আইব…
—শুনবেন না।
—আপনে তো জীবন ছইকা নিছেন। চা খাইলেন, হাটতে গেলেন, বাজার করলেন, ফিরা চা খাইলেন, বাগানের কাজ করলেন,—দুপারে স্নানাহার সারলেন, কাগজখান খুটাইয়া পরলেন,—বিকালে চা খাইয়া হাটতে গেলেন,—লাইব্রেরি গেলেন, আইসা ন্যালারে যুক্তাক্ষর শিখাইতে খানিক যুদ্ধ করলেন,—রেডিও শুনলেন,—খাইয়া দাইয়া বই লইয়া শুইলেন।
—রুটিন মাইপা চলি বউদি! কইতে পারেন, আপনেরে সময় দেই না। কিন্তু সময় তো আপনের কাইটা যায়।
—হ ঠাকুরপো! কুনঅ অভাব বোধ করি না। সারাদিনই ত হে আমার মনের মধ্যে থাকে। কই, দেখ! ফুল সাজাইলাম…অহনে ঘর গোছাইতেছি…কই, তুমি দুঃখ করতা, মিরনাল বই পরতে সময় পায় না! দেহ, আমি মন দিয়া কত বই পরি অহনে। যতিনাথ আমারে বিভূতি বাঁড়ুজ্জার রচনাবলী আইনা দিছে।
ঠাকুরপো হেমচন্দ্র—নবীনচন্দ্র—মাইকেল—রমেশ দত্ত—গ্রন্থাবলী কিনতেছেই। ”সঞ্চয়িতা” খানও পরি। পইরা পইরা ন্যালারে গল্প শুনাই। কাপর ছারলে বলি, সেই কালা চিকন পার পরাইয়া ছারলা! অর লগে কথা কইয়াই সময় কাটে।
বউদি নির্মল হাসলেন। ছিপছিপে শরীর,—সাদা সিঁথি ও নিরাভরণ দেহ,—ধপধপে সাদা শাড়ি, সাদা জামা,—গুচ্ছ গুচ্ছ চুলে ঘেরা মুখ, ছোটোবেলার মৃণাল নয়, বিবাহিতা বউদি নয়। এ আরেক রকম শুচিতাময় কুমারী সৌন্দর্য। শুধু রং যেন ফর্সা লাগে।
—ফর্সা হইতাছেন, না এনিমিয়া ধরল?
—হা রে পুরুষের বুদ্ধি। জীবনে প্রথম সংসার নাই, রোগীর সেবা নাই। রাইত জাগা নাই, সময়ে খাই, সময়ে ঘুমাই,—রং তো ফর্সাই আছিল এককালে, আছিল না? শ্বাশুড়ি কইতেন, আমার সোনার প্রতিমা জ্বইলা গেল।
—মায়ে বলত?
—খুব বলত। আপনের দুর্ভাগ্য, অমন মা—বাপেরে স্যাবা করতে পারলেন না। মায়েই ত কইত, পরবা। পইরা পইরা শিখে মানুষ।
—আপনে যা পরতেছেন, বাংলার মাস্টারেও পরে না এখন।
—আপনের দাদায় বলত, পরো, ভিত পাকা হইব। আর ভিত পাকা! পরি, ভালো লাগে, মনটা ভইরা থাকে।
বউদি যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়ের ”বিপ্লবী জীবনের স্মৃতি” ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায়ের ”ভারতে সশস্ত্র বিপ্লব” আর উপেন্দ্রচন্দ্র ভট্টাচার্যের (শ্রী অরবিন্দের সহযোগী বিপ্লবী অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্যের ভাই) ”আমার এলোমেলো জীবনের কয়েকটি অধ্যায়” বারবার পড়ত। বলত, দেখেন। উপেন ভটচাজ আপনের মাতামহের কথা লেখছেন।
আর পড়ত ”ভ্রমণ’। বলত, যাইতে তো পারি না সর্বত্র, মনে মনে ঘুইরা লই। ইশ! আপনে তো পাশ পান, যান না?
—আপনে যাইতেন?
—না ঠাকুরপো! এই বারি অহনে আমার হিমালয় হইতে কন্যাকুমারিকা। ছাইরা গেলে তার কাছে পাতকী হইতাম! হে যা যা দেখে নাই…
—দাদা কিন্তু আমার সঙ্গে একটু বেড়ালেই খুশি হত।
—হইব না? তারে নিত কে?
—যাক, আমার সৌভাগ্য যে দাদাকে কিছু কাছে পেলাম!
—একদিন কইছিলাম…আপনে দুঃখ দিবেন…দুঃখ পাইবেন…দেখলেন তো, সত্য হইল?
—আপনেও তো পাইছেন।
—হে তো জন্ম থিকাই। ডাকাইতা মাইয়া আছিলাম, মায়ে বলত, এমুন ঘরে দিমু, যে তারা বারিন্দায় বারাইতে দিব না। মায়েরে জিভ দেখাইয়া পলাইতাম।
—রাতদিন ফল টোকাইতেন!
—না টোকাইয়া উপায়?
বলছেন আর হাসছেন বউদি। হাতে ন্যালার জামা, বোতাম বসাচ্ছেন।
—কী পরিবর্তন মিরনালের! পোলাদের বলছি, বোতাম টাইকা লও, ছিরা ফাটা সিলাও, জুতায় রং দাও, বিছানা পাইতা লও আর আজ…তা ভাদুড়ীবাড়িতে কর্তা কইতেন, সকালে সকল ছোটোদের ক্ষীর, মুড়ি, বাতসা দাও। উনার বোন কইত, তোরা আলাদা বসগা যা! অর্থাৎ, আমাগো গুড় মুড়ি। ভাত খাইব তো মা’র লগে তেতপ্পর বেলায়। তাই জাম, জামরুল, ফলসা, টোপাকুল, কাচা আম, খুব খাইতাম।
—জানতাম না সব কথা।
—আগে তো কাঁদি নাই। কানছি বিয়ার পর। ঘুরাফিরা এক্কেরে বন্ধ! তহনে শাশুড়ি মাটির পুতুল। মাটির রান্নাবাটি কিন্যা দিছে, শ্বশুরে রোজ সন্দেশ আইন্যা দিছে। অত যত্নেন না বুনা টিয়া পোষ মানল?
—আর দাদা?
—হেয় কী দিব? বাপ—মা আছে না? পাবনা হইতে ”বর্ণপরিচয়” আইনা দিছে,—হাতের ল্যাখা লেখাইছে। রাতে পরাইত। তবে শাসন করে নাই।
.
খারাপ খবরটা আমিই এনেছিলাম। আমাদের চক্ষু হাসপাতালের উদ্বোধনে কলকাতা গেলাম। বউদি বলে দিলেন, বিনির তো পরসব হইবার কথা! খবরটা লইবেন।
খবরটি ভালো ছিল না। সুভাষের তখন একটাই ফ্ল্যাট।
পাশেরটিও যে ওর। তা জানতাম না।
নবজাতিকার আগমনে বাড়ি উৎসব মুখর থাকবে। বাড়ি থমথম করছিল। যতিনাথ, সুলতা, স্বাধীন ও তপাকে দেখলাম। দেখলাম না সুভাষকে।
যতিনাথ আমাকে বলল, সুভাষ খুব দাপাদাপি করে ঘুমোচ্ছে, ঘুমের ইনজেকশানে।
—কী হইছে, বলবি তো?
—অগো মাইয়া…মংগোলয়েড বেবি।
—তার মানে?
—বিনিকেও ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। বেবিকে দেখছে নার্স।
—মংগোলয়েড বেবি কী?
ওরা নিচু গলায় যা বলল, তার সারাংশ যা, এও এক অর্থে গেনি পিসির মেয়ের মতোই ভার ও বোঝা।
এমন শিশু শান্ত হয়, কাঁদে না বললে হয়। শরীর ও মনের বৃদ্ধি একেবারে রিটার্ডেড। নাক চেপটা, চোখ মঙ্গোলিয়ান, মুখ হাঁ, জিভ বেরিয়ে থাকে। হাত বেঁটে ও চওড়া, আঙুলও তাই। পায়ের পাতায় দেখা যায় বুড়ো আঙুল ও পরের আঙুলের মাঝে ফাঁক।
তপা নিচু গলায় বলল, মংগোলয়েড বেবিদের জন্মগত হার্টের রোগ থাকে,—লিউক্যেমিয়াও হয়। বেশিদিন বাঁচে না।
—সুভাষ…খুব বিচলিত?
—উন্মাদের মতো। সে তো ও বেবি আনতেই চায়নি। বিনি বলেছে, ও আমার সন্তান। আমি নিয়ে যাব।
সুলতা বিষণ্ণ হেসে বলল, বিনি বলছে, ও আমার গর্ভজাত, আমারই ক্রুশ, আমিই বহন করব।
—ঈশ! এতো বরো আঘাতটা পাইল অরা!
যতিনাথ সদুঃখে বলল, মেয়ে হলে রুমা, ছেলে হলে রূপক, কত আলোচনা! জানাব কী! এই জন্যেই জানাইনি। এমন শিশু ক্বচিৎ কদাচ, কোটিতে গোটিক, বেশি দিন বাঁচে।
সুলতা সদুঃখে মাথা নাড়ল। বলল, দ্বিতীয় সন্তানও মংগোলয়েড হবে, তা বলে না ডাক্তার। কিন্তু বিনি বা সুভাষ…!
—এই শিশুর নিরন্তর ডাক্তার দেখানো দরকার হবে না যেদিন,—সেদিন বউদির কাছে বিনি ওকে নিয়ে যেতে পারে। আমি চলি আজ! বড়ো ভারাক্রান্ত হয়ে গেল মনটা! সুভাষ আর বিনি যে এমন চোট পাবে, কে ভেবেছিল!
অতীব আলোকপ্রাপ্তা তপা গভীর দুঃখে বলল, নিশ্চয় ওরা কোনও পাপ করে থাকবে পূর্বজন্মে!
আমি চোরের মতো বেরিয়ে এলাম। গেনিপিসির ভাগ্য যা, বিনিরও তেমন হবে?
পরদিন ডাক্তার মুখার্জির মাধ্যমে এক তরুণ শিশু চিকিৎসকের কাছে গেলাম।
সে বলল, মায়ের বয়সও কম। তারপর…এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা যা পাই…
কিছুই আমার মাথায় ঢুকল না। বললাম, এই শিশু চুয়াত্তর বছর অবধি বাঁচতে পারে? (গেনি পিসির মেয়ে হাবি তো বেঁচেছিল।)
ডাক্তার খুব সুপিরিয়র হেসে বললেন, এটা স্পোরেডিক বা ট্রাইসোমিক মংগোলিজম মনে হচ্ছে। হার্ট ঠিক থাকলে, যা খুবই বিরল, যৌবন, বা প্রৌঢ় বয়স অবধি বাঁচতে পারে। নিরানব্বই ভাগ কেসে তাড়াতাড়ি চলে যায়।
মন বলল, তাই যাক! মন আরও বলল, সুভাষের উপরে ওঠার, বাজি জিতবার দুরন্ত জেদ! বিনি এখন এই মেয়েকে নিয়ে…
বউদি সব শুনে স্থির হয়ে গেলেন। পাথর পাথর। বললেন, আপনে জাপানে এটম বোমার গল্প করছিলেন। তখন নাকি অনেক শিশু…..বিনিদের কেন এমন হইল?
—আরও হয় বউদি। আমরা জানতে পারি না। আমাদের ঘরে হইছে বইলা….
এই একটি ঘটনা নানাভাবে বউদির বাঁচার ইচ্ছা কমিয়ে দেয়, তাতে আমার সন্দেহ নেই। খবরটা পেয়ে থেকে যেন নিভে গেলেন।
একদিন বললেন, ”কেন” জিগ্যাসা কইরা তো লাভ নাই। আমার নাকাল কতজনা খাইয়া না—খাইয়া, অসুমার খাইটা, অন্য পোলাপানদের ঝক্কি সামলাইয়া সন্তান বিয়াইছে। এমুন তো হয় নাই। শুনছি আপনেগো গেনি পিসির …. আর ….
—এমন শিশু দীর্ঘজীবী হয় না বউদি।
—হেই ভাবতেও তো বুক ফাটে। সন্তান মরলে তয় মা বাপে শান্তি পাইব?
দাদার মৃত্যুর ঠিক পাঁচ বছর বাদে বউদি ১৯৮৫ সালে মারা যান। একদিন বললেন, মন দিয়া পূজাপাট করলে কি শান্তি মিলে ঠাকুরপো? কুনো দিন তো করি নাই….
—বউদি! করেন নাই, করেন নাই! আজ মনে করেন তো করেন। কয়েন কী করতে চান?
—ন্যালার মা কয় সত্যনারায়ণরে সিন্নি দেন গো কত্তা মা! দোষ আপাই কাইটা যাইব।
—ন্যালার নিশ্চয় খুব আগ্রহ?
—খাওনদাওন, যগ্যিপূজা, হে তো পাইলেই নাচে। আহা। অর মায়ের বা কী কষ্ট!
—হয়তো মেনে নিয়েছে।
—মায়ে মাইনা নিতে পারে না কুনো দিন!
—সুভাষও কম ঘা খায় নাই।
—জানি! তাতেই ক্ষ্যাপা ক্ষ্যাপ্ত হইয়া কাম বারাইতেছে। বিনি ত’ লেখছে, মা! অরে কই, আমারে ছাইরা তুমি এট্টা বিয়া করো। হে শুনে না। কয়, কারো পাপে এমুন হইলে দুজনে পাপ করছি। তুমি একা অরে লইয়া থাকবা, আর মানুষ আমারে থুথু দিব,—তা হইতে দিমু না।
ততদিনে বিনি ডাক্তার, স্বপ্নাদ্য ওষুধ, কোনও কিছুই বাকি রাখেনি। এখানে আসত ওর মাদ্রাজী আয়া আর রুমাকে নিয়ে। বউদির কাছে এলে শান্তি পেত। বলত, শান্তি পাই মা!
—তয় থাকো ক’দিন। এহানে খাও, ঘুমাও। রুমারে লইয়া তো কোনও অশান্তি নাই।
—হ্যাঁ….. এখানে সব কেমন মাপের মধ্যে…..এখন আমার আর রুমার তো আরেকটা ফ্ল্যাট…..তিনটে শোবার ঘর, চারটে বাথরুম, সব কলকাতার লিডিং ডেকোরেটারের সাজানো। আমি, রুমা আর কনকাম্মা তো একটা ঘরেই থাকি।
তারপর বলত, বিবাহিত জীবন বলে কিছু নেই। তবু ও আমাকে ছাড়বে না।
স্থির হয়ে এখানেও থাকতে পারত না, আবার ও চলে যেত।
বউদির মৃত্যুর দশ বছর পর মাধবীর আসাটা শুধু বউদির জন্য নয়। মাধবীর দিল্লির ফ্ল্যাটটা সুভাষই কিনে দেয় ব্যবস্থা করে। সুভাষই রুমার বিষয়ে সব বিশদ লিখে পাঠিয়েছিল। জানলে মাধবী জানবে, বিনি যদি রুমাকে ওখানে কোথাও ভর্তি করে নিজেও থাকতে পারে।
.
সুভাষ এই স—সে—মি—রা অবস্থাটা মেনে নিতেও পারছিল না। বিনি আর রুমাকে অন্য কোথাও বাড়ি কিনে দিয়ে টাকা পয়সা দিয়ে থিতু করে দিতেও পারছিল না।
যতিনাথ বলত, নিঃসন্তান জীবন মেনে নেয়া যায়, এমন সন্তান নিয়ে…
স্বাধীন আর তপা ছেলেমেয়েকে ঋষিভ্যালি সে জন্যেই পাঠায়। সুভাষ আর বিনির সামনে ওরা যেন কুণ্ঠা বোধ করত।
বউদি সত্যনারায়ণ একবার নয়, দু’তিন বার করেন। বলেন, কইরা তো যাই। ফলাফল কী হইত কে জানে।
রুমার মতো না হলেও ন্যালা যে অসহায়, সেটা ওঁর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ন্যালা, হিসেব করে দেখেছি, বউদির কাছে খুব কাছের মানুষ হয়ে ওঠে। দাদার জন্যে বউদি যেসব সোয়েটার বুনেছিলেন, ন্যালাই সেগুলো পরে।
এ সময়টা, কয়েক বছর ধরে মাঝে মাঝে বলতেন, চলেন ঠাকুরপো নটাকোলের কথা কই।
—কুন কথা বউঠান?
—ন্যালা জানে! ঠাকুর বানাইতে কুমার আসত, কুন গ্রাম থিকা?
—আদ্যাবাড়ি।
—দেবীপক্ষে নৌকায় গাদা কইরা শত শত বঙ্গলক্ষ্মী আর মোহিনী মিলের শাড়ি—ধুতি থান আইত। আপনেরা দেখেন নাই। ভাদুরীবাড়ির দালানে ঢালা হইত। উনি তো সগলরে কাপড় দিত।
—উনি অন্য মাপের মানুষ আছিলেন গো!
—হ। উনি বলত, পূজায় নটাকোলে কী আমার নাতি, কী বেন্দা জাউলার বেটা, সব এক কাপড়। বিজয়ার দিন ঠাকুর ভাসাইয়া সকলে নূতন কাপড় পরবা।
—হ বউদি, আমরাও ধুতি পাইছি।
—বেটা ছেলেদের সবুজ, খয়েরি আর লাল পার ধুতি। বউগো লাল পার, গিন্নি গো লাল আর কালা পার। বিধবা গো থান, আর আমাদের, মাইয়া গো লাল আর সবুজ নকশা পাড়। নকশা তো শঙ্খ পদ্দ, নয় রেল পার। আমরা হা কইরা থাকতাম। সবাই দু’খান কইরা পাইতাম তো!
কখনো বলতেন, ঠাকুরপো আছিলেন ডাকাত! ঠাকুর জলে পড়ল, উনি ঝাপ দিয়া ঠাকুরের মটুক, হাতের খারা, নিবই নিব।
এ সবই মৃণালের কথা, বালিকা মৃণাল।
আবার আপন মনেই বলতেন, যতি কুনোদিন জিদ করে নাই, শুধা সুজির পায়েস রানলে কইছে, মা আরটু দিবা? জিদ কি স্বাধীনের! ক্যান তুমি সুভাষরে কোলে নিবা? ক্যান তারে আগে খাওয়াইবা?
একদিন বললেন, অগো নামে নামে থালা—বাটি—গেলাস! ভাবতাম অগো মাইয়া পোলারে দিমু। কারে দিমু। আমার মাইয়া পোলাদেরই নাগাল পাই না! কী আছিল আমার দুধে, যে তারা সকলার হইল, আমাদের হইল না?
তারপরই বলতেন, ভাল থাক, শান্তিতে থাক। আমাগো শান্তি ছিল যৎসামান্যে। অগো শান্তি … অরা বুঝুক!
বই পড়াও কমিয়ে আনলেন। কাগজটা উলটেও দেখেন না। কেমন উদাস উদাস ভাব। বললাম, বউদি! কলকাতা যাইবেন? অরাদের দেখবেন?
—কেমনে? আজকাল তো বেশি কইরা শুনি, সে যাইতে নিষেধ করে। ঠাকুরপো!
—কয়েন।
—এত টাকা সুভাষের। একখান ঘর তুইলা ঘুরাইন্যা সিঁড়িটা বসাইলে তার বাপ শান্তি পাইত। সে সাধ তো মিটে নাই?
—এই কথা বউদি? ঘুরাইন্যা সিঁড়ি আমি বসামু। কথা দিলাম।
—কোথায়।
—যেখানেই দেই, সে দাদা আর আপনের বারিই হইত।
বউদি গভীর, গভীর চোখে চাইলেন। আমার চোখ নিচু।
তারপর বললেন, সাধে কি দাদা ভাই বইলা মরত? হ, আপনের বারি তো আমাদেরি। তিনজনার।
—হ। আপনে যেয়েন না বউদিদি।
—কনে যাইতাম? দাদাই কি গিছে? দিনে দিনে যেমুন কাছে আইতাছে।
তারপর বললেন, চলেন তো। চা কইরা খাই দু’জনে। ন্যালারে পাঠান। এই সময়ে কুচা নিমকি ভাজে। না, আমার লিগ্যা ভাইবা ভাইবা আপনে…
তয় কয়েন, ডাক্তার দেখাই আপনারে?
—শান্তি পায়েন, তো ডাকেন। রোগ তো নাই ঠাকুরপো, কেমুন জানি মনে হয়, দূরে চইলা যাইত্যাছি।
—আমিও পাছ ল’মু।
—আর বারিতে বট অশথ গজাইত।
—তয় কী করুম?
—আমাগো বাসায় হাত দেন। ঘুরাইন্যা সিঁড়ি তো বসাইবেন।
—টাকা কোথা?
—তা জিগাইবেন মিরনাল ঠাকুরানীরে। পাসবুক ফালাইয়া দিমু। দ্যাখবেন, সংসার চালাইয়াও দু’জনের পেনসানে কত বাচছে, —কতটি ফিকছে রাখছি,—পোলারা বৎসরে মাঝে মাঝে পাঠায়,—সব রাইখা দিছি। অরা টাকা পাঠায়, অপরাধী বোধ করে ত! টাকা পাঠায়।
—আপনের টাকায় হাত দিতে দেই না, আমার টাকা হইতেও বাচান?
—অত কৈফিয়ৎ দিতে পারি না। ন্যালারে ডাকেন।
.
না, অসুখ কিছু ছিল না। কিন্তু, খাওয়া কমে যাচ্ছিল, দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন। ন্যালার মা বলল, কী বোঝেন? রাতে ঘোম নাই। শুধা কথা কয়, বরো কত্তার লগে, কার কার লগে, বুঝি না। কিন্তুক চক্ষু বন্ধ। ডাকলে ধরমরাইয়া উঠে।
সদর থেকে প্রবীণ ও বিচক্ষণ ডাক্তার অনন্তবাবুকে আনলাম। বললাম, জ্বর নেই, পেচ্ছাপ, পায়খানা, রক্তপরীক্ষায় কিছু পাওয়া যায়নি। কিন্তু খাওয়া কমে আসছে, হাঁটা চলা প্রায় বন্ধ। বাগানে অনেকদিন নামেন না।
অনন্তবাবু ভাল করে দেখলেন। রক্ত পরীক্ষা আবার হ’ল। হেমোগ্লোবিন বড় কম। এনিমিক হয়ে যাচ্ছেন। বললেন, এই ইঞ্জেকশান, সুখাদ্য, টনিক, এগুলো চলুক। দুর্বল যথেষ্ট, কিন্তু ভয়ের কিছু দেখলাম না।
আমি ধমক দিয়েই বললাম, দাদার সময়ে আমি, আপনি, ন্যালার মা! অহনে আমি আর ও পারি।
ভোরের চাঁদের মতো ম্লান হাসলেন বউদি। বললেন, একা আপনে আমাগো কষ্ট দিয়া পার পাইয়া যাইতেন? আমরা অহনে দিতেছি।
—আপনি আর কে?
—ক্যান, আপনের দাদা?
বউদি খুব স্বাভাবিক ভাবে বললেন।
—দাদা আজ পাচ বৎসর নাই বউদি।
—হে তো আমি জানি। কিন্তু আমার মনের মধ্যে বইসা কথা কয়। চক্ষু বুজলে খুব ভাল থাকি ঠাকুরপো। আমার মা, তোমার মা, শিউলিরে মনে পরে না। আমাগো লগে খেলাইত? হে’র লগেও কথা কই।
—কী কথা কন?
—এই ঘর….. সংসার…..ছাওয়াল মাইয়া…..এই সকল সইত্য নয় ঠাকুরপো… আমি পাগল হই নাই…. কিন্তু সইত্য মনে হয়…
—পোলাদের খবর দিমু?
—অরা….ব্যস্ত…..
বউদি পাশ ফিরে শুলেন।
আমার ধমক ধামকে বেশ খাচ্ছিলেন একটু একটু। স্বাভাবিক ঘুমও হচ্ছিল। কিন্তু বাথরুমে যেতে গিয়ে শোবার ঘরেই শুকনো মেঝেতে আছাড় খেলেন যেদিন, সেদিন ন্যালার মা চাল বাছছে, ন্যালা দোকানে, আমি বাজারে।
খুব, খুব পরিশ্রম হয় আমার। আমার বয়সও তো পঁয়ষট্টি। ছুটোছুটি করে টাউন হাসপাতালেই নিলাম। পায়ে ফ্র্যাকচার, এক্স—রে প্লাস্টার, হেনতেন। ন্যালার মাকেই বসিয়ে রেখে এলাম।
গৌরাঙ্গদের বাড়ি থেকে কলকাতায় যতিনাথকে ফোন করলাম। অন্যদের খবর দিতে বললাম।
ওরা এসেছিল, দু—চার দিন করে থেকেও যায়। সুভাষ বলল, হাসপাতাল নয়, কলকাতা নিয়ে যাই…..নার্সিং হোমে রাখি।
বউদি মাথা নাড়লেন।
বললাম, এখানে ডাক্তার পালের নার্সিং হোমও ভাল।
বউদি মাথা নাড়লেন।
—বারি নেন ঠাকুরপো। বারি নিলেই আমি ভাল হইয়া উঠুম।
বারি নেন আমারে।
অগত্যা বাড়ি। অগত্যা ডাঃ পালের সাহায্যে নার্স সীমা। ছেলেরা ফিরেও গেল। বলল, এখন তো শুধু শুয়ে থাকা।
—অহনে তোমরা ভার নেও।
—মা কলকাতা যাবেন না। এখানে নার্সিং হোমেও থাকবেন না। আমরা কতদিন কাজ ফেলে থাকব?
সুভাষ বলল, টাকার জন্য ভেবো না কাকা। ডে অ্যানড নাইট নার্স রাখো। এই টাকাটা রাখো।
বউদি ক্ষীণ স্বরে বললেন, টাকাই কি সব? নার্স রাখলে তাদের খেজমত খাটে কে? অরাদের সময় নাই, ছাইরা দেন।
ওদের বললাম, চান মানুষের সঙ্গ।
—বুঝি……বুঝি….. প্রবেলমটা খুব হিউম্যান। তোমার শরীর ভাল তো কাকা?
—১৯২০ সালে, তোমার বাবার সাত মিনিট বাদেই জন্ম। আমার জন্য ভাবতে হইত না।
—এই বয়সেও……
ন্যালার মা বলল, ছোটকত্তারে চলতে হইব, তাই চলতাছে। যার চারপাশে কেও নাই, মাথায় আছে বোঝা, তারে চলতেই হয় রে দাদা। ভগমানে চালায়। কত্তা মা আর থাকত না। হে নিজেরে তুইলা নিতেছে।
আমি বললাম, থাক ন্যালার মা।
—ক্যান? থাক থাক করো ক্যান? বলি নাই। যে বড় কত্তার লগে কথা কয়, চক্ষু বুইজা কথা কয়? তিনিই কত্তা মারে লইয়া যাত্যাছে।
সুভাষ বলল, সুপারস্টিশান যত! ডেথ ইজ ন্যাচারাল এনড অফ লাইফ।
আমি বললাম, পলিথিনের বেডপ্যান আর ইউরিন্যাল পাঠিয়ে দিও।
—তুমিও নাইট নার্স রাখো একজন।
ওরা চলে গেলে বউদি বনমালীর বোন সিদ্ধেশ্বরীকে ডাকলেন। বললেন, অ পাকসাক করুক, ন্যালার মা আমারে দেখব। কাম বেশি হয়, তো বনমালীর বউ বাগান—বাসন—কাপড় কইরা দিব।
ন্যালা বলল, আমি নেই কত্তা মা?
—হ, আমার ন্যালা তো আছে। তুই ছোট কত্তাদাদারে দেখবি। আর ঠাকুরপো। এই নাসরে ছুটি কইরা দেন। নাস্যে তো হাগাইব না, মোতাইব না, এমন নয় যে জ্বরো রোগী, জ্বর দেখব, ঔষধ দিব।
বউদির এই গোপন ষড়যন্ত্রের ফলে আমরা আমাদের চেনা জগতে ফিরে এলাম। বউদিকে ব্যথা না দিয়ে সযত্নে তুলতে ন্যালা,—আমাকে চা করে দিতে ন্যালা,—বউদি বললেন, যান। হাটাহাটি করেন যেমুন করতেন!
আমি খুব স্বস্তি পেলাম।
আর বউদি ধীরে ধীরে নিভতে থাকলেন। খাওয়া কমাতে কমাতে….
—শুইয়া শুইয়া কত খাওন যায়?
—তবে ফুটবল খেলেন?
—বাতাপি লেবু লাথাইতেন, মনে পরে?
—মায়ে জাইন্যা….
—মায়ের শাসন ছিল কি। চুল যখন বাইধা দিছে, একটু মাথা নড়ছে তো ধমক দিছে।
—চরও তো খাইছেন!
—বিয়ার পরে নয়। তহনে তো খুব আদর। তবে কষ্ট দিছে বরো পোলারে। য্যান, তার দোষেই আপনে জেলে গেলেন।
আমি নীরব।
—কতদিনের কত কথা ঠাকুরপো।
—নেন ঘুমান।
—এট্টা কথাই কইয়া যাইতাম।
কথাটি না বলেই ঘুমিয়ে পড়লেন।
না, বউদির বিষয়ে এটাই বলা যায়, বাঁচার ইচ্ছা ছিল না আর। থাকলে বাঁচতেন। যথাসাধ্য সবাই করেছিলাম। বনমালীর বউ কি ঝুক্তি ফুলের পাতা বেটে দিত, তিতা খাইলে জিভের সোয়াদ ফিরব।
ডাক্তার বলেছিলেন, সিমপল ফ্র্যাকচার। একটু হাঁটাবেন। পায়ে রক্ত চলাচল হবে।
ন্যালার মা দিকে দিকে মানত করেছিল।
কিছুতেই কিছু কাজ হয়নি।
শেষে ন্যালা বলত, কত্তা মা! আমি গপ্প বলব? তুনি যেমন বলতে?
—ঠাকুর পাটে ফুল জল দে’ ন্যালা।
—সকালে দিয়েছে মা!
—কচুর শাক বেশ কইরা ভাপাইয়া—জল নিস্যরি কইরা—তা বাদে নাইরকেল কুইরা…
—তুমি খাবে?
—ঝর উঠছে… জানলা বন্ধ কর…..
সব অসংলগ্ন কথা। শেষটা খুব ধীরে আসে। আমাকে বললেন, এট্টা কথা…. পোলারা….মাইয়া…. বারির ভার নিলে তবে যেয়েন…
—কথা…. দিলাম বউদি।
কয়েক দিনের মাথাতেই চলে যান বউদি। তখন ভরা সকাল, প্রসন্ন নীল আকাশ, সাদা মেঘের পালে মন্থর বাতাস, শরতের ফুল শিউলি তুলেছিল ন্যালা। আমি বুঝলাম বউদি ঘুমোচ্ছেন না।
আমি একা হয়ে গেলাম।
এমন নিঃশব্দ প্রস্থান দেখিনি। যেন পর্দা সরিয়ে পা টিপে টিপে চলে গেলেন।
মৃণাল, মিরনাল, বউদি। আমি অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিলাম। এক সময়ে আবিষ্কার করলাম, সবাই ঘাটে।
বাড়িতে শুধু আমি আর ঘোরানো সিঁড়িটা।
.