ঘোরানো সিঁড়ি – ৫

পাঁচ – আমি আর বউদি

ওই হাঁপানিই দাদাকে নিয়ে গেল পনেরো বছর আগে। খুব, খুব কষ্ট পাচ্ছিল দাদা। সুভাষ কলকাতা থেকে গাড়ি করে অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং তা দেবার লোক নিয়ে আসে।

খুব কাজ হয়নি।

বউদির ছেলেমেয়ের মধ্যে যতিনাথ ও সুলতা আগেই এসেছিল। মাধবী ও সবুজ তো আমেরিকায়। ওদের আসার কথা ওঠেইনি। স্বাধীন আগে, তপা পরে আসে। সুভাষ আগে আসে, বিনি পরে এল।

এই যে ছেলেমেয়েরা যে—যার ইচ্ছায় বিয়ে করে, দাদা খুব মর্মাহত হয়েছিল। তার ধারণাতেই ছিল না, যতিনাথ বাবা—মাকে কিছুই না বলে রেজেস্ট্রি বিয়ে করবে।

দাদা বলল, আমারে বললে আমি কী করতাম? বাধা দিতাম, আমি কি দেখি না, পোলা মাইয়া সব স্বেচ্ছায় বিয়া করে?

আমি ব্যাপারটা হালকা করতে চাইলাম। বললাম, দাদা! ওরা কেও এহানে থাকত না।

—কলকাতা টাইনা নিতেছে অগো।

—আমরা তো থাকলাম।

—যতি আছিল নেরু (নিরীহ) পোলা। হে এট্টা মেয়েরে বিয়া বসল, যে নিজেও পরায়। দুজনেই কাজে যাইব, সংসার দেখব কেডা?

বউদির ঈশ্বর বিশ্বাস খুব গভীর। তিনি বললেন, শিক্ষিৎ মাইয়া খারাপ হইব না। যতি তো তুমি নয় গো! মায়ের কথায় কাঙালিনীর মাইয়া লইলা। মা গো! তহনে ”মৃণাল” লেখতে ”ম্রিনাল’ লেখি।

—তোমার লগে তার তুলনা?

বউদি লিখলেন, তোমরা আসিবে। এখানে ছোট করিয়া পাকস্পর্শ হইবে। তোমরা কলকাতায় থাক। আমরা পল্লীসমাজে থাকি। তোমার বাবার দেহ ভাল যায় না। একুশা আষাঢ় শুভদিন। তোমরা আসিবে।

মজার বাপার, সুলতা এতে খুব খুশি হয়। হলে বা যতির সতীর্থ, সমবয়সী,—চেহারাটা কচি কচি, মুখ চোখে আলগা শ্রী আছে। সে সারাদিন গৌরাঙ্গদের বাড়িতে থাকল। সন্ধ্যায় ভাড়া করা মোটরে এ বাড়ি এল। বধূবরণ করে গালচেতে বসিয়ে বউদি তাকে একজোড়া রুলি, একটি ঢাকাই শাড়ি দিলেন।

শতখানেক নিমন্ত্রিত ছিল। খরচপাতি আমিই করলাম। বিয়েতে ওরা বই, শাড়ি ও টি—সেট পায়। মা—বাবার ছবিতে প্রণাম করালেন বউদি। হাসনুহানা, দোলনচাঁপা, রজনীগন্ধা, সবই ছিল বাগানের ফুল।

সুলতা বাড়ি দেখে মুগ্ধ। বলে, চেঞ্জে যাব না কোনদিন, এখানেই আসব।

সুলতার মামা দাদার সহকর্মী ছিলেন। ফলে সুলতা দাদার সঙ্গেও কথাবার্তা বলল খুব।

ওরা চলে গেলে দাদা বলল, স্বজাতি নয়। কী করা যাইব? অহন তো এ বিয়া আইনসিদ্ধ। আমার দুঃখ, যতিনাথ ডবলিউ—বি সি এসে বসব না। কলেজে পরাইব।

সরকারি সার্ভিসের মর্ম এরা বুঝল না।

আমি বললাম, মন্দ কী? মাইনে তো বাড়বে। শুরুতেই আটশো দাদা!

—দেখ, ভাল হইলেই ভাল।

সবুজ ও মাধবীর প্রেম, বিবাহ, বিদেশগমন, সবই সাইক্লোন গতিতে হয়ে যায়। মাধবী ও সবুজের শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিলই। কিন্তু সবুজের দিদির স্পনসরশিপের জোরে সবুজ সবুজ কার্ড পায়। এই টাউন,—কলকাতা, —বন্ধুদের সঙ্গে কিছু ঘোরা,—একবার সেমিনারে দিল্লি যাওয়া, এটুকু অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই মাধবী চলে গেল আমেরিকা।

ও একা এসে বাবা—মা—আমাকে দেখে গিয়েছিল। আমেরিকা থেকে লিখেছিল, দু’বছর বাদে ও নিজে টাকা দিয়ে মা—বাবাকে নিয়ে যাবে। বাবার চিকিৎসা করাবে।

দাদা আস্তে বলল, কবিরাজী ত্যালটা ন্যালার মা ভাল মালিশ করে।

তারপর বলল, মনটা নির্লিপ্ত করতে চেষ্টা করতে আছি মিরনাল! সহজ নয়, তবু পারুম।

আমি বললাম, তুই বিয়া দিলেও তারা যাইতে পারত, অহন তো যায়। ও নিজে বিয়া কইরা গিছে। ভাল মনে ল’ ব্যাপারটা।

—হ! কিছু পাইতে গিছে, পাউক।

স্বাধীনকে কেন তপার বাবা নির্বাচন করেন, তা বোঝা খুব সহজ। স্বাধীন হাই—ফাই কাজই করছিল ওঁর চা—রপ্তানির অফিসে। ওঁর তিন মেয়ে, তপা—দীপা—রূপা। ওঁর তিন মেয়ের তিনটি বাড়ি সলট লেকে এ—ই সেকটরে। ওঁর দরকার ছিল ঘরজামাই।

অবশ্য আনুষ্ঠানিকতা বজায় রেখেছিলেন। গাড়ি নিয়ে প্রস্তাব করতে আসেন। স্বজাতি, স্বঘর, বৈভব দেখে পাত্রপক্ষ আসে। স্বাধীন সে গোত্রের নয়। সে বলছে, মা—বাবা—কাকাকে বলুন।

বউদি বলেছে, দেখলেন তো অর বাবারে! অহন আমরা তো কিছু পারতাম না।

—অনুমতি করেন, সব করে দেব। তপা আমার অফিসও দেখে! ওরা দু’জনে দেখবে। নয়, রিসপশানে যাবেন?

—কেমুন কইরা? আমার কর্তব্য ইয়ার সেবা করা। আমি যাইতে পারি?

—কাকা?

—ইনিই তো ধইরা আছেন সংসার।

—এই তো! এমন না হলে পরিবার? এমন না হলে স্বাধীনের মতো ছেলে হয়? কিন্তু এখানে এমন…..

বউদি যেন অনেক দূর থেকে বললেন, বউ নিয়া আইব স্বাধীন! আশীর্বাদ লইয়া যাইব। কাছ থিকা হউক, দূর থিকা হউক,—আশীর্বাদ তো অর দাদা আর দিদিরেও করছি! স্বাধীনরে কইয়েন, বাপরে য্যান দেইখা যায় একবার!

তপার বাবা বললেন, সে কী বলছেন! বাবাকে গাড়ি এনে নিয়ে চলুক কলকাতা! ভাল ডাক্তার……… ভাল নার্সিং হোম………

—আর লাগত না। একবার য্যান দেইখা যায়। ঠাকুরপো বরো পোলা আর সুভাষরে লেইখা দিবেন, তারাই য্যান দারাইয়া শুভকার্য সম্পন্ন করে। ইনির দ্যাখেন, বুরাবয়সে হাপানি ধইরা দ্যাহ ভাঙল। কলকাতায় লইয়া চিকিৎসা তো ঠাকুরপো করাইছে। আমার মন এহানে, …. কী বা করতাম? আর অবস্থাও দ্যাখলেন। আমরা চলছি আমাগো মাপে।

—তাতেই তো এমন সব সন্তান হয়েছে! সুসন্তান দিয়ে দেশকে আপনারা এনরিচ করেছেন।

উনি সঙ্গে অনেক মিষ্টি এনেছিলেন। সম্ভবত ওঁর অফিসের একটি ছেলে ও ড্রাইভার সঙ্গে ছিল। বউদি আমাকে বললেন, অগো খাইয়া যাইতে বলেন।

তপার বাবা হাত জোড় করলেন। বলেন, ভাত তো চলবে না বেহান। মেয়ের বিয়ে দিতে এসে….

—কিছু হইত না। আর…… ইনি কারেও না খাওয়াইরা ছারে নাই। স্বাধীনরা ফুটবল খেইলা ফিরতে দেরি করছে, তো রাত দশটায় ওদের সগলটিরে পাক কইরা খাওয়াইছি।

—বেয়াইয়ের কথা যখন বললেন……. খেয়ে যাব। তবে বেশি কিছু নয়। সন্ধ্যাতেই ফিরব।

—না, রাতে যেয়েন না। পথঘাট….. শুভ কার্যের আগে কুনঅ বিপদ হইতে পারে….

আমি মাছ আনলাম। বউদি ডাল, পাঁচ রকম ভাজা, টাটকা রুই মাছের ঝোল, ঘরে পাতা দই, টাটকা রসগোল্লা পরিবেশন করলেন বড় বড় খাগড়াই কাঁসার থালা—বাটিতে।

তপার বাবা মুগ্ধ হয়ে বললেন, দেশে গেলে ঠাকুমা রাঁধতেন। সেই কথা মনে পড়ছে।

—আপনাগো দ্যাশ?

—নদীয়া—মেহেরপুর!

—সে তো দ্যাশ ভাগে গিছে।

—হ্যাঁ….. ওই পুজোতে যাওয়া হ’ত! বাড়িতে মা কষে রাঁধতেন, ভুলে গেছি। আমার স্ত্রী তো…

—ব্যস্ত থাকেন!

—খুব, খুব। মা…. মেয়েরা…

—আরেকটা মাছ নেন!

খুব তৃপ্তি করে খেলেন ভদ্রলোক। বাগানে গিয়ে গাছ দেখতে দেখতে আমাকে বললেন, আমার মেয়ের সৌভাগ্য যে এমন পরিবারে বিয়ে করছে।

—দেরি করবেন না….দাদার শরীর ভাল যায় না….

যতিনাথ, সুলতা, সুভাষ ওদের বন্ধু বান্ধবই স্বাধীনের বিয়েতে যায়। শুনলাম সে খুব আলিশান বিবাহ। বউদিকে ওরা অতীব দামি এক লালপেড়ে গরদ দেয়।

বিয়ের পর যতিনাথ, সুলতা, সুভাষ সকলেই আসে ওদের নিয়ে। সদর শহরে সার্কিটহাউসে উঠে স্নান করে তাজা হয়ে তবে এল নববধূ।

তপার বিষয়ে বলব, ও যা, তা তাই। কোন ভানভনিতা নেই। কাঠ কাঠ চেহারা, স্বল্পভাষী, মেপে হাসে, প্রণাম করল আলতো ছুঁয়ে।

বউদি ওকে একটি মুর্শিদাবাদী সিল্ক ও আংটি দেন। দিনে খেয়ে বিকেলে ওরা সার্কিটহাউসে ফিরে যায়। স্বাধীন কাতর কণ্ঠে বলে, ওর বাবার বন্দোবস্ত…. আমরা দার্জিলিং যাব…. চা—বাগানে…… ফিরে এসেই বাবাকে দেখতে আসব।

—আসিস। ভাল থাকিস। সাবধানে থাকিস।

তপাকে বললেন, স্বাধীন আমার শান্ত পোলা। অরে দেইখো। জ্বর হইলে কাতরায় নাই, পা ভাঙলে উঃ করে নাই……… তুমি বুদ্ধিমতী………. শিক্ষিত….. ভাল থাইকো মা…. আমরা পয়সা চিনি নাই… পোলাগো মানুষ করতে চেষ্টা করছি…..

তপা ওঁর হাতে সামান্য চাপ দিয়েছিল। সেটাই যেন আশ্বাস দিল।

ওরা চলে গেলে বউদির ঠোঁট কেঁপেছিল, চোখ সজল হয়েছিল।

দাদা বলল, কাইন্দনা মিরনাল!

—স্বাধীনরে অরা গ্রাস করবে।

—ক্যান মিরনাল, এ কথা বলো ক্যান?

—তার চক্ষু ধাধাইছে গো! কৎ বরো বারি দিছে শ্বশুর! গারি দিছে অগো! বারির সগল জিনিস না কি বিদ্যাশের! সুলতারে কইতে আছিল। দার্জিলিংয়ে বরো হোটেলে থাকব!

—ঠিকোই আছে। কালের গতি! তুমি আমি কী করতাম?

কী করতাম? কী করেছিলাম? কোনদিন বিদেশী কাপড় পুড়িয়েছিল এ দেশ? কত বিপ্লব, কত সংগ্রাম,—স্বাধীনতার আগে এবং আজও কত আন্দোলন।

দেশের জন্যই তো সব! সে যে পার্টিই করুক। দেশ দেশের মতোই থাকল। বিদেশী আক্রমণ এখন পোশাকে, প্রসাধনে, ওষুধে, গৃহসজ্জায়, সর্বত্র!

আদিনাথ আর মৃণালের তিন ছেলে, এক মেয়ে। নাতি নাতনি চারটি।

স্বাধীন ও তপা এখন এন. আর. আই। নন রেসিডেন্ট ইন্ডিয়ান। রাজর্ষি বা রাজ্যশ্রী হয়ে গেছে রাজ ও রিচা। ওরা বাংলা জানে না। রুমা তো থাকলই না।

মাধবীর এন. আর. আই. ছেলেরা অরু ও বীরু আমেরিকাতেই বড় হ’ল। বাংলা ও সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য প্রবাসী বাঙালিরা যেসব অনুষ্ঠান করেন, তাতেও ওরা যেতে চান না,—একদা মাধবী লিখেছিল। ‘আ মরি বাংলা ভাষা”র দেশে মফঃস্বলে, সমৃদ্ধ গ্রামেও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ভাইরাস ব্যাপক ছড়িয়েছে।

আমরা তিনজন যেন নটাকোলেই ফিরে গেলাম।

সুভাষের বিয়েও ধর তক্তা মার পেরেক গোছের। বিনিকে ও প্রায় কিডন্যাপ করে বিয়ে করে। বিয়ে করেই চলে এসেছিল এখানে। বলল, রেজেস্ট্রি সেরেই আসছি মা! বরণ করো, আমি সিঁদুর পরাই।

বিনিই অনুষ্ঠান অভাবে খুব দুঃখ পায়। বউদিকে বলল, আমার কবে থেকে ইচ্ছা, হোমযজ্ঞ করে বিয়ে হবে! আমার বাড়ি বলতে তো মাসির বাড়ি। আপনাদের জানালে হয়তো হ’ত।

—না রে মা! অর বাবা যে কষ্ট পাইত্যাছে। কে হোম যগ্য বেবস্থা করে, বলো?

বিনি বুঝেছিল। বিনি তপার চেয়ে অনেক ইংরেজিনবিশ, অনেক শিক্ষিত। আবার ওর মধ্যে একটি খাঁটি মানুষ আছে।

বউদির একমাত্র ঢাকাই শাড়ি পরিয়ে দেন বউদি। একমাত্র রুপোর সিঁদুর কৌটো থেকে ওর সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে কৌটোটি দেন। বলেন, এর বেশি পারলাম না রে মা!

সুভাষ বাড়ির বাতাসে মৃত্যুর আগমনবার্তা শুনেছিল? জানি না।

কিন্তু ওই গিয়ে মাছ কিনে আনল। ন্যালার মাকে বলল, জমিয়ে রাঁধো। আমরা খেলেই হ’ল।

জিগ্যেস করলাম, তোরাও কি হনিমুনে যাবি?

—কিসের? ব্যস্ত, ব্যস্ত এখন কাকা! ফিরে যাব।

বিনি আমাদের অবাক করে বলল, আমি ক’দিন থেকে যাব। তুমিই বা কী? এখানে এমন অবস্থা দেখে ফিরে যাবার কথা বলছ?

—মিটিং, মিটিং, অ্যাপয়েন্টমেন্ট….

—তুমি যাও, আমি দু’দিন বাদে যাব।

বউদি বললেন, বলছ, এই যথেষ্ট রে মা! থাকতে লাগব না।

—আমি তো আমার মা—বাবার জন্য কিছু করতে পারিনি….

সুভাষ বলল, প্লেন দুর্ঘটনায় মারা গেল সকলে…. তুমি কী করতে?

—থাক।

সুভাষ চলে যায়, বিনি সত্যিই দিন তিনেক থাকল। সুভাষ বহির্মুখী স্বভাবের, বিনি অন্তর্মুখী। বিনি সে সময়ে দাদার বুকে মালিশ করেছে, পাখার বাতাস দিয়ে দুধ জুড়িয়ে দিয়েছে, দাদা কাস ফেললে পিকদানি ধরেছে।

আনাড়ি হাত, কিন্তু আন্তরিকতা আছে।

বিনিই আমাকে জিগ্যেস করেছে জেল—জীবনের কথা। বলেছে, আপনাদের খুব ভাল লেগেছে আমার।

—তুমি কী পাশ করেছ মা?

বিনি মুখ নামিয়ে বলেছে, ফিজিকসে এম. এস. সি. করেছিলাম। রিসার্চও করছিলাম। বাড়ির অ্যাকসিডেন্টের পর…. কী যে খেয়াল হ’ল….. একটা বিজ্ঞাপনের অপিসে ঢুকলাম … তারপর একটা আর্কিটেকটের অফিসে …. সেখানেই সুভাষের সঙ্গে আলাপ…..

—শুনলেও ভাল লাগে।

—সুভাষ খুব উদ্যোগী। ও অনেক দূর যাবে।

হ্যাঁ, এটাই এ শহরের কাছে, আমাদের কাছে ব্যাখ্যাতীত হয়ে রইল। কেন দাদার ছেলেমেয়েরা এমন অত্যুজ্জ্বল হ’ল? কেন তারা সকলেই এমন বিয়ে করল, যা গতানুগতিক নিয়মের বাইরে?

বিনি চলে যাবার পর বউদি সদুঃখে বললেন, ঠাকুরপো! টাউনে এরাদের ছুটকাল হইতে দেখতেয়াছে। কিন্তুক অহনে সগলে এমুন ভাব দেখায়, জানি আমাগো মধ্যে কী বা রহস্য আছে। কয়, আপনেরা তো কীর্তিমান পোলাগো মা—বাপ! কলকাতায় বারি কিনা চইলা যান! মটর কিনেন! নয় দশটা চাকর দাসী রাখেন!

—ঈর্ষা করে। মানুষের যা ধর্ম!

—আমারই কি মন পুরায় না? সাদাসিধা হইত তো একোজন কাছে থাকত!

দাদা বললেন, কলকাতাই অদেরে খাইল!

সুভাষের বিয়ের পর দাদা বেশি দিন বাঁচেনি। হাঁপানিগ্রস্ত মানুষ নাকি দীর্ঘজীবী হয়। দাদা তো উপর্যুপরি আক্রমণে দুর্বল হয়ে পড়ছিল।

যাবার আগে কয়েকদিন বড়ই কষ্ট পায়। সুভাষ অক্সিজেন সিলিন্ডার ও তা দেবার লোক নিয়ে আসে। রাত জেগে জেগে বউদির অবস্থাও কাহিল। ছেলেরা বউরা আগে পরে এল।

বৃহস্পতিবার বউদি ও ঘর ছেড়ে বাগানের দিকে বারান্দায় চলে গেলেন।

বিনি ভয়ে ভয়ে বলল, মা কথা বলছেন কার সঙ্গে। বুঝতে পারছি না।

যতিনাথ বলল, আমি দেখছি।

দাদার সামনে বসেও আমি বুঝতে পারছিলাম, বউদি কী বলছেন!

বলছেন, ভগমান অরে নিক, অরে নিক! এই কষ্ট আর দেখা যায় না! অরে আর কষ্ট দিয়েন না ঠাকুর।

গৌরাঙ্গ সহসা বলল, যতিকে ডাকুন।

যতি ঢুকতেই বলল, জল দাও বাবাকে।

বউদি মেঝেতে বসে পড়লেন দেয়ালে হেলান দিয়ে। আমি ঘর ছেড়ে চলে গেলাম। নটাকোলে শৈশব থেকে কৈশোর, অনেক স্মৃতির চলমান মিছিল। মনে যেন নদীর ধস নামছিল। আমিই তো চলে যাই, দাদা তো থাকে? দাদা কেন চলে যাচ্ছে? ও ঘরে পড়শী, চেনাজানাদের ভিড়। কে যেন বলল, যতি! আর জল দিও না।

আমি বউদিকে ছুঁই না। স্বাধীনভাবে বললাম, মা’রে ধরো। উনি বেচেতন হইয়া গিছেন।

এমনি করেই আদিনাথ নেউগী আমাকে বউদির জন্য, বউদিকে আমার জন্য রেখে চলে গেল।

দাদা বউদিকে পুরী দেখিয়ে এনেছিলাম। হঠাৎ মনে হ’ল দাদা বলেছিল, তুই আমার কুনো সাধই অপূর্ণ রাখলি না সইতা।

ঘোরানো সিঁড়িটা নিয়ে দাদার যে সাধ, তা তো অপূর্ণ থেকে গেল।

.

.

দাদার কৃতী ছেলেরা দাদার কাজ খুব সাড়ম্বরে করে। যতিনাথ ও স্বাধীনকে দেখে সুভাষও মাথা কামায়।

যতিনাথ, সুলতা ও বিনি ছাড়া কেউই টানা থাকতে পারেনি। স্বাধীন, সুভাষ ও তপা ফিরে গেল, আবার এল ছেলেরা। তপার আসা ঠিক হবে না, স্বাধীন বলল, ও খুব ভেঙে পড়েছে। তবে সব নিয়মই অবজার্ভ করছে।

বউদি নিজেকে গুটিয়েই নিলেন। বললেন, অরাই করুক। এ করা বেশি করা নয়। অদের বাপ নিজের বাপ—মার লিগ্যা অনেক করছে। তখন তো সংসারের পালে বরো বরো ছিদ্দির।

আমাকে বললেন, আপনেও করেন। সকল দুর্দিনে সে আপনের নাম করছে। যমক ভাই, নাড়ী কাটলেও বান্ধা থাকে।

আদিনাথ নেউগীর শ্রাদ্ধ, টাউনে এক গল্প কথাই হয়ে দাঁড়ায়।

সব মিটে গেলে আমরা বৈঠকে বসলাম। নিয়মভঙ্গে মাছের সমারোহ হবে কাল। বউদিকে যে যা বলে, উনি বলেন, তোমরাই করো।

সুভাষ বলল, এখন কী হবে? মাকে নিয়ে যাই কলকাতা?

যতিনাথ বলল, কোথায়?

—আমার ওখানেই? বিনিও তো…..

বউদি মাথা নাড়লেন। বললেন, কুন বাল্য বয়সে বিয়া! এক দিনের লিগ্যাও ছাইরা থাকি নাই। আমারে বারবার বলছে, বারি ছাইরা থাইক না মিরনাল! অহন…আমি এহানেই থাকুম!

—বাবার পেনশান তো পাবে?

—ঠাকুরপো আছেন! কী পামু, সেসব কথা ভাবিও নাই। চিন্তা করিস না, হইয়া যাইব। আর দরকারে তোরা তো আছস।

এবার বিনি কয়েকদিন থেকে গেল। কয়েক মাস সন্তানসম্ভবা, সুভাষ রাজি হচ্ছিল না। বিনি বলল, ক’দিনে কিছু হবে না। তুমি যাও।

খুব সাধারণ আশা আকাঙ্ক্ষার সামান্য একটি মানুষের কৃতী ছেলেরা একে একে চলে গেল।

বিনি বলল, বাবার ঘর যেমন আছে, তেমনি থাকুক মা?

—হ বিনি। অহন আমি ওখানে থাকব, ন্যালার মা মাটিতে শুইব। ন্যালা থাকব ঠাকুরপোর কাছে, আর কী!

—আমি যদি পারতাম…

—না রে মা! আর মায়া কাইড় না। কলকাতা গিয়া সাবধানে থাকবা, ডাক্তারের নিয়মে চলবা। আমাগো কালে এত সুবেবস্থা আছিল না গো! কষ্ট পাইছি অনেক।

বিনি চলে যেতে বউদি বলেছিলেন, দু’জনের স্বভাবে এমুন তফাৎ! মাইয়াটা কষ্ট না পায়।

তারপর প্রত্যহের মতোই দরজা জানলা বন্ধ আছে কি না দেখলেন। ন্যালার মাকে বললেন, তারাতারি খাইয়া শো’রে মা! কতদিন ঘুমাস না।

বনমালীর বউ ও বোন, ন্যালার পিসি সিদ্ধেশ্বরী, বা ঘনার মা, এরা এ কয়দিন এখানেই। ওরা এ রাতটাও রইল।

বউদি বললেন, পোলারা যে খরচ এই কাজে করল ঠাকুরপো! যদি তারে দিত…

—দোতলায় একখান ঘর উঠত…..ঘুরাইন্যা সিঁড়ি বসত, এই তো!

—তাই! যাক, ছিরা কথা ভাইবা লাভ নাই। অহন থাকলাম আমি আর আপনে।

—হ বউদি। দাদায় সেই ভরসা লইয়া গেছে।

—আমি আর আপনে।

—ন্যালা আর ন্যালার মা’রে ভুলবেন না।

—তাই পারি?

ন্যালা এসে বলল, আমিও কত্তা মা’র ঘরে ঘুমাব।

রাতে বউদির বিনবিন কান্নার গুঞ্জন শুনেছিলাম। যেন কোনও স্থায়ী আবহসংগীতের মতো কিছুকাল রাতে শোনা যেত, কথা বলে বলে কাঁদতেন বউদি। কথা বোঝা যেত না।

একদিন কান্না থেমে যায়।

বেলায় ঘুম থেকে উঠলেন বউদি। বললেন, কাল খুব ঘুমাইছি ঠাকুরপো!

আর শুনিনি কান্না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *