চার – আমি, দাদা, বউদি
এ কাহিনী লিখে চলা যেত, যদি লেখক হতেন গণেশ। আমি তো কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস। কালো, পেশল, লোমশ, লম্বা, ব্যাসই বটি।
কিন্তু নেউগীদের বাসগৃহ বানিয়ে অমরত্ন লাভের মহাভারত তো সংক্ষেপে করে আনতে হয়। অন্ত্যপর্ব লিখব আমি, আমাকে দিয়ে।
ভাঙা বাড়ির জিনিসপত্র কেনার কাজ স্বাধীনভাবে করতে পারি, এজন্য ডাটসাহেব, আমাকে দশ হাজার টাকাও হাওলাত দিতে রাজি ছিলেন।
আমি বললাম, না। আপনিই আমার মাল কিনবেন যখন, সেই সময়ে যা মার্জিন থাকবে, আমি তাতেই সন্তুষ্ট থাকব।
—তোমার উচ্চাশা নেই?
—সময় নেই।
—সে কী হে, তুমি তো ছোকরা! আমার অরূপ কেন, অমিতের চেয়েও ছোট।
—ওরা আপনার কোম্পানি দেখবে, আমি কার জন্যে কী করব?
—বিয়ে তো করলে না।
—শেয়ালদার হোটেল খুব ভাল।
—দাদার ছেলে মেয়ে আছে তো।
—তারা তো দাদার। এখনও ছোট। আর ওদেরকে দাদা সরকারি কাজেই ঢোকাতে চাইবেন।
—যাক! তোমার এ কাজটা চালিয়ে যাও। একদিন মানুষ এসব খুঁজবে হে!
—কোথায়! এখন বেশি জায়গা, বড় বাড়ির যুগ তো নেই। যত ঘুরি, বিগত শতকের জীর্ণবাড়িই দেখি। খারাপ লাগে।
মূলধন নিই প্রতাপদাদার কাছে হাওলাত। কিনতাম, বেচতাম, মার্জিন বউদিকে দিতাম। মাসে দু’একবার না গেলে দাদা দুঃখ পেত, চিন্তা করত।
ততদিনে স্বাধীন আর সুভাষও জন্মেছে। স্বাধীনতার পরে জন্মালে ছেলেদের নাম স্বাধীন আর সুভাষ রাখা খুব চল হয়েছিল। দাদা ও বউদি তার ব্যতিক্রম নয়।
ওদের আরেকটি সদভ্যাসের প্রশংসা করি। ডাকনামের ব্যাপার রাখেনি। যার যা নাম, তাকে সেই নামেই ডাকত।
একবার বলেওছিলাম সে কথা। বউদি ঈষৎ হেসে বলল, অদের মা চিরকালই মিরনাল। আদর দিবার মানুষও ছিল না, মায়ের সময়ও আছিল না। নাই কাজ তো বাড়ির ডাল বাট,—নয় মশলাপাতি রোদে দে,—নয় ঠাকুরের বাসন মাজ। কমে চলে তো বাড়াই ক্যান? এক নামই থাক।
এক নাম, যতির জুতো জামা স্বাধীন পরে। বড় জোর তিন বা চারটে জামা ঊর্ধ্বাঙ্গে, অধোবাসও তাই। শীতবস্ত্র? কিছুদিনেই বউদি বুনতে শিখেছিলেন। আমি উল কাঁটা এনে দিতাম।
পরপর চারটি সন্তানের জননী হয়ে বউদির শরীর ভেঙেই যাবার কথা। দাদা কাজের লোক অন্তত দু’জন রাখতেন, ছেলে মেয়ের জন্য কোনও প্রৌঢ়াকে। গিরিবালা অনেক কাল ছিল।
দাদা তখন এই শহরে বদলি হয়েছে, বউদিরা তখনো পশ্চিম দিনাজপুরে।
এমন সময়েই দাদা ঠাণ্ডা লেগে, বুকে কাসি বসে অসুস্থ হ’ল। আমি দৌড়ে এলাম। খুবই আশ্চর্য, এতখানি বয়সে দাদাকে হাঁপানিতে ধরল।
খুব, খুব কষ্ট পেল দাদা। বউদি এলেন ছেলে মেয়ে নিয়ে। দাদা দু’মাস ছুটিও নিল। এই বাসা বাড়ি কিন্তু খারাপ ছিল না। দাদার আগেও মহকুমা—জরিপ বিভাগের অফিসাররা ও বাড়িতেই থেকে গেছেন।
বেশ বাড়ি, তিনখানা ঘর। বারান্দায় বসলে খেলার মাঠে উৎসাহী ছেলেদের বল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখা যায়। দাদা তাই দেখত।
.
একদিন বলল, সইতা! এহানেই সেটেল করি। জল হাওয়া সুট করতেয়াছে। ইস্কুল ভাল, পরিবেশ ভাল, তুই কী ক’স!
—মহারানি কী ক’ন?
—আমি তো রাজি।
বউদি আমাকে বললেন, এই বয়সে হাঁপানি… রোগেই ভয় ধরাইছে। আপনেও বলেন, বয়েস থাকতে বাড়ি করো, বসবাস কইরা লও। এ কথা তো সত্য, যে যতিনাথ জলপানি পাইছে যেমুন, অরে হস্টেলে দিয়া খরচও বাড়ছে কিছু।
—সে টিউশানি করে কেন?
—ক্যান করবে না? আপনে কলকাতায় যোগাযোগ রাখেন। কিন্তু একটা টিউশানি করলে ওর ক্ষতি হইত না। অরা কষ্ট কইরা পরুক ঠাকুরপো! অদের বাপ কাকায় কম কষ্ট করে নাই।
—আর মা!
—মা’র তো কষ্টে অবভাস আছিলই। কষ্ট কমছে তো বিয়ার পর। ছাড়েন মায়ের কথা! দেখেন, আপনের দাদা কই, আপনের নাখাল নয়, আমার নাখালও নয়। সংসারে তপ্ত খোলায় ভাইজা ভাইজা অর কিছু রাখে নাই। আপনের পাইছে থ’নে সহজে ডরায়, দ্যাহও সবল নয়। মন লইছে বাড়ি করুক।
—আপনে যা করেন!
আগেই বলেছি এ শহরের একটা বনেদিয়ানা ছিল। মহকুমা সদর যেমন, সম্পন্ন জমিদারের দানে ধ্যানেই পথ, স্কুল, বাঁধানো ঘাট ও পুকুর, খেলার মাঠ, শরীর চর্চার ক্লাব, ফুটবল শেখার সুবিধা, এসব ছিল। এ শহরই রাজ্যকে কয়েকটি ভাল খেলোয়াড় উপহার দিয়েছিল।
বউদি গভীর উদ্বেগে বললেন, আমি যা কমু তাই হইব? ক্যান, আপনে কি আলদা মানুষ? দেহেন, জমি কিনতে আপইত্য কি! অহনেও সুবিধায় পাইবেন। বাড়িও কম খরচ হইব। মাধবীরেও বাইরে পাঠাইতে হইব।
—তারেও?
—নিচ্ছয়। সুযোগ পাইলে হেও উপরে উঠব। কুমুদবাবুর মাইয়া শান্তা ডাক্তারি পরে না? মালদা’র উকিল যোগেশবাবু তো পয়সার সাগর! তিনি মাইয়ারে ল’পড়াইতেছেন না? অহন দিনকাল অন্য রকম। আমার পোলা মাইয়ারে কষ্ট কইরাই দাঁড়াইতে হইব। মাধবীরে দেখেন না? মাইয়া য্যান ঘোড়া! এই গাছে উঠে, এই সাতার কাটে।
—ঘরের কামও করেন।
—না কইরা যাইত কোথায়?
—আপনে দারোগা হইতে পারতেন!
—থো’ন ফালাইয়া ছিরা কথা! ল্যাখাপড়ি তো আপনের মায়ের কাছে। পরে আপনের দাদাও খুব বই পরাইছে। বিয়ার পাঁচ বছর বাদে যতি হয়। পাঁচ বছর বই ধইরা পাকসাক করছি।
—বেশ! আপনে আর দাদায় কইলে…
—আপনাগো পঁয়তাল্লিশ বৎসর বয়স! আমি আধবুড়া। বাড়ি কি হইত বুড়া বয়সে? আর এ বয়সে হাঁপানি ধরল, তাতেই….
এভাবেই জমি কেনা হয়, পাঁচিল দিয়ে গাছ বসানো হয়। আর ভয়ংকর জেদাজেদি করে বউদি একটা কাজ করে বসেন, যে জন্য দাদার সঙ্গেও তাঁর প্রথম ও শেষ তর্ক বাধে।
মুহুরি রামরতনবাবু বউদিকে ”মা” বলতেন এবং সত্যিই স্নেহ করতেন। বলতেন, মা আমার সর্ব সুলক্ষণা। যিনি গাছ বসাইলে সে গাছে ফল ধরে, তিনির লক্ষণ খুবই ভাল।
জমিদারি সেরেস্তায় মুহুরি ছিলেন, জমিজমার ব্যাপার ভাল বুঝতেন। আরেক জায়গায় ছয় কাঠা ভাল জমির কথা তিনিই বউদিকে বলেন।
—”সম্পত্তি একটা মা! কিছু না করেন, তো পরে বেচলে দাম পাবেন।”
দাদা বলল, আমার সম্পত্তি বাড়াইবার দরকার নাই রামরতনবাবু।
—নয় বেইচা দিবেন।
—থাক না।
বউদি বললেন, চলেন, আমারে একদিন দেখাইয়া আনেন।
কী দেখেছিলেন বউদি? জমি মানে তখন চোর কাঁটা ও শিয়ালকাঁটায় আচ্ছাদিত এক ভূখণ্ড। জমি মানে বড় বড় শ্বেতআকন্দের গাছ। একমাত্র ইতিবাচক যা, পশ্চিমে রাস্তা আছে।
বউদি ফিরে এসে বললেন, ওই জমির দাম এ জমি হইতে অনেক কম। আমি কই, ছয় কাঠা নিমু কইয়া আসছি।
আমি বললাম, কী হইব বউদি?
—পাঁচিল দিমু কইলাম।
—গোসাঘর বানাইবেন?
—অত সওয়ালের জবাব দিতে পারি না। মাধবী তো গিছিল, অরে শুধান।
মাধবী বলল, ভালই তো।
দাদা বলল, কিন্তু ক্যান মিরনাল?
বউদি বললেন, জীবনে পরথম কিছু চাইত্যাছি, তোমরা যে উকিলের সওয়াল শুরু করলা? যদি একখানা গয়না চাইতাম, দিতা না?
দাদা বলল, দিতাম।
—তয় এ জমি কিনবা।
তারপরের বিস্ময়, জমি আমার নামে রেজেস্ট্রি হওয়া।
দাদা বলল, ক্যান, এ বাড়ি সইতারও নয়?
মাধবী বলল, কাকা। কলকাতায় একটা বাড়ি করো। বেশ আমরা থাকব, পড়তে যাব।
—চুপ যা মাধবী। তরে শুধাইছে কে?
আমি বললাম, আমারে তো কইবেন?
বউদি বললেন, আপনের দাদারে কই? যেদিন জেল থিকা বারাইছে, সেদিন থ’নে যা পারে, যহন পারে, আমারে দেয়। ওই টুক তার নিজস্ব থাক।
—আমার পোলারা কি…
—কেউ কারে ফালায় না গো! আবার ভবিষ্যৎও দেখা যায় না। ধরো, যদি বুড়া বয়সে ঠাকুরপো বিয়াই করেন?
—ভালই বলছেন বউদি। কোনো বুড়ি দেইখা রাখছেন না কি?
—ওইটুক তার নামে থাউক। ঠাকুরপো কিছু নাই করেন, নয় আমি গোসাঘর বানামু।
পরাস্ত করে ছাড়ালেন বউদি। কত সামান্য টাকায় সেদিন জমি কিনি, কী বলব!
দাদার স্বপ্নের বাড়ির খানিকটা হতে না হতে ওই ঘোরানো সিঁড়িটা নিয়ে আসি। বলি, বাড়ির এও একজন সদস্য। ইয়ার থাকার প্রভিশান কইরা বাড়ি বানাইতে হইব।
বউদি বললেন, ঘুরাইন্যা সিঁড়ি!
দাদা বলল, ভিত দোতলায়। কুনোদিন দোতলা উঠাইতে কি পারুম না? তখন এই সিঁড়ি বাগানের দিক বসামু। সিধা ছাতে উঠব গিয়া। কী মজবুত, দেখ মিরন্যাল। একশৎ বৎসর টিকব। টাউনে কারও বাড়িতে নাই। সকলে কইবে, দেখছ নি ঘুরাইন্যা সিঁড়ি? কোথা আছে? না নেউগী বাড়ীতে।
.
দাদার চোখের অসম্ভব স্বপ্ন বউদিকে নির্বাক করে দিয়েছিল, আমাকেও।
স্বাধীন আর সুভাষ ইস্কুলে সকলের কাছে গল্প করেছিল। ফলে কয়েকদিন ধরে ওদের সহপাঠীরা সে সিঁড়ি দেখতে আসত।
মাধবী আমাকে বলেছিল, কাকা! ”নিশির ডাক” ছবিতে এ রকম সিঁড়ি আছে। কিন্তু বাবা তো সিনেমা দেখেন না?
—না, হলে গেলে ঘুমাইয়া পরে।
—তোমাদের দেশের বাড়িতে এ রকম সিঁড়ি ছিল বুঝি?
—না রে মা! তর বাপে অনেক কষ্ট করছে। আমার লগে ঘুরতে ঘুরতেই এ সিঁড়ি দেখছিল। যেমুন দেখল, মনে ধইরা গেল।
—মা’দের বাড়িতে ছিল?
—না। নদীর ধারে গ্রাম, সেখানে পাকা বাড়িও অন্য রকম হইত।
—ও বাবা! পাঁচটা বাজে!
—যা, চা বসা। নয় তো মায়ে দিব!
.
ইট, কংক্রিট, লোহার শিক, সিমেণ্ট, বালি, চুন ও অবাস্তবতা নিয়ে তৈরি হয় বাড়িটা।
গেট দিয়ে ঢুকলে, পাঁচিলের গায়ে গেট। যথেষ্ট উঁচু পাঁচিল, সাদা রং করা। গেটের মাথায় অর্ধচন্দ্রাকৃতি লোহার ফ্রেম। তাতে মাধবীলতা।
গেট, ওই ফ্রেম, দরজা, জানলা, মুখ ধোবার বেসিন, সবই আমি ডাট সাহেবের গুদাম থেকে শস্তা দরে আনি।
ডাট সাহেব কি হাসা হেসেছিলেন। দেখ, সতীনাথের পাগলামি দেখ! ও এসব কেনে, আমি কিনি ওর কাছে। আবার আমার কাছ থেকেই …. সতীনাথ! গিফট নিন একটা। দারুণ একটা আলমারি কিনেছি। এটা নিন অন্তত।
—ওটা নয়। গিফট দেবেন তো ছোট্ট রাইটিং টেবিলটা দিন।
—আপনি এক আশ্চর্য মানুষ বটে! সতেরো বছর ধরে সম্পর্ক, কোনও দিন বিগ প্রফিটে গেলেন না। স্বচ্ছন্দে কলকাতাতেই বাড়ি করতে পারতেন!
—দাদা বউদির ”কলকাতা” নামে অ্যালার্জি।
—একদিন তো আসতেই হবে!
—দেখা যাক!
—কলকাতা প্রপার না হোক, কল্যাণী, বেহালা, যাদবপুর, গড়িয়া, সবুজের সমারোহ।
—১৯৬৫—৬৬—তে। বিশ বছর বাদে সব কংক্রিট হয়ে যাবে।
—সে জন্যেই তো পিতৃদেব বালিগঞ্জ সার্কুলারে অত জমির মধ্যে বাড়ি করেছিলেন। তখনকার স্ট্রাকচার।
ডাট সাহেব দেখে যাননি, সেখানে এক বহুতল বাড়ি এখন। অরূপ এবং অমিতের দুটো করে ফ্ল্যাট ছিল। আছে কি না জানি না। ডাট অ্যানড ডাট অ্যানড ডাটের মালিকানা এক অনাবাসী বাঙালির, যে নাকি আরেক ‘ভারতে বাস করেও অনাবাসী” মানুষের শিখণ্ডী। এমনই সব শুনি ও কাগজে ”তদন্তমূলক” রিপোর্টে পড়ি। ডাট সাহেব বলতেন, কয়েক জেনারেশান তো নামটা থাকবে!
প্রতাপদাদাদের বাড়ি তিন শরিকে ভাগ হয়ে গেছে। ওঁর ভাইপোর ছেলে এখন কংগ্রেস নেতা। তার নাম লোকে বেশি জানে। আমি তো কলকাতার কাছে বহুদিন মৃত। গেলেও পালিয়ে আসতাম, এখন আর যাই না।
আমাদের এ বাড়িতে যথেষ্ট বড় ও উঁচু কয়েকটি ঘর। বিশ ইঞ্চি গাঁথনির দেয়াল, সুভাষ বলে, জায়গার অপচয়।
গেট দিয়ে উঠে একটি ঢাকা বারান্দা, তারপর লম্বাটে হলঘর। তার দু’দিকে দুটি করে চারটি শোবার ঘর। তারপর একটি ”আমার ঘর” সংযুক্ত হয়, অ্যাপেনডিকসের মতো।
দোতলা অবধি সিঁড়ি আছে, যা ছাতেই শেষ। দাদার স্বপ্নের দোতলা অবশ্যই ওঠেনি।
.
গৃহপ্রবেশের দিনটা মনে থাকবে। পূজা হ’ল, লোকজন খেল। পঁয়ত্রিশ হাজার সাতশো ঊনষাট টাকাতেই এ বাড়ি হয়েছিল। আজ এ টাউনে এ খরচে এমন বাড়ি তৈরি এক স্বপ্ন কথাই বটে।
১৯৬৫ সালে জমি খরিদ।
১৯৭০ সালে বাড়ি তৈরি শেষ হয়।
একখানা ঘর, পাকশালা, বাথরুম, জল ব্যবস্থা হলেই উঠে আসা যেত। কিন্তু দাদার হাঁপানি আরেকবারও হয়। বউদির ভয় হল, চুন, সিমেন্ট, বালির দৌরাত্ম্যে দাদার আবার হাঁপানি হতে পারে।
যতিনাথ ১৯৬৫ সালে, মাধবী ১৯৬৮ সালে কলকাতা চলে যায় পড়তে। বাড়িতে স্বাধীন, সুভাষ ও বউদি।
এটা বলতে হবে, যে বউদির ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় এত ভাল হবার কোনও ব্যাখ্যা পাই না। বিপুলা এ পৃথিবীর যতটুকু জানি,—(অনেকদিন যাবৎ ”ভ্রমণ” পত্রিকা কিনি এবং এখন ভারতে মানসভ্রমণ করি),—নেউগী বংশ বিষয়ে তার চেয়েও কম জানি।
কেউ কি মেধা উজ্জ্বল, বিদ্যা ও জ্ঞানপিপাসু ছিলেন? প্রমাণ পাই না। বাবা আই. এ. ফেল, দাদা গ্র্যাজুয়েট। আমি ”সেলফ—টট” ব্যক্তি। সে সময়ে জেলে না গেলে, অনেক ভাল লোকের সাহচর্য না পেলে, অনেক বই না পড়লে, অগামুর্খই থাকতাম।
মায়ের দিক থেকে পেয়েছিল মেধা?
প্রমাণ অযোগ্য। বউদির মা অল্প বয়সে মেয়ে নিয়ে বিধবা। বউদি সে বাড়িতে এক আশ্রিতার মেয়ে মাত্র। পাঠশালে গিয়েছিল, লিখতে পড়তে শিখেছিল, আমার মায়ের কাছে পড়তে আসত। পড়ার পিপাসা তার ছিল। মা এবং দাদা ওর পাঠোৎসাহকে লালন করেন।
তার পাঠের নেশা খুবই ছিল। তা মেধার পরীক্ষা তো হয়নি। পড়াশোনার সুযোগ পেলে তবে না বলা যেত।
ছেলেমেয়েদের ”পড়াশোনা করেই দাঁড়াতে হবে”, একথা দাদাও বলত, বউদিও বলতেন। দাদা বলতেন, পড়াশুনা করলে সার্ভিস করতে পারবি। সরকারি সার্ভিস মানে সিকিউরিটি।
বউদি বলতেন, দেখ! মাথা যখন আছে, স্কুলেও তাই কয়, তখন ল্যাখাপড়ায় আগাইয়া পথ কইরা নাও। বাবা আর কাকা জমিদার নয়, ব্যবসায়ীও নয়। কাকা ঠিকাদারি করে বটে, কিন্তু সে পয়সা নয়। এটাও মনে রাখবা, তোমাগো’ কই, সৎ বংশ,—আর তোমাদের কাকা স্বাধীনতা সংগ্রাম করছে।
ওরা মনে করত, যত বাধাবন্ধ সব মফঃস্বলে। যত সুযোগ সব কলকাতায়।
যতিনাথটা হাবা, ও বলেই ফেলেছিল, মফঃস্বলে হাঁপ ধরে যায়, তোমরা বুঝবে না।
বউদি বলতেন, এমুন খোলা বাতাসে হাপ ধরে? আমার তো ধরে না।
আমি আড়ালে বলতাম, নটাকোলের পর জেলায় জেলায় পোস্টিং, তোদের বাবা—মা কলকাতায় থাকেও নাই, সেজন্য দুঃখও নাই। অহন তো তোদের বাবা এমন জায়গাতেই ভাল থাকব।
তা, ওরা এতই ভাল ফল করত, যে শিক্ষক শিক্ষিকারা ওদের বিষয়ে বিশেষ যত্ন নিতেন। যে ছাত্র বা ছাত্রী ভাল রেজাল্ট করে স্কুলের, তথা মহকুমার, তথা জেলার মুখ উজ্জ্বল করবে, তার বিষয়ে যত্ন নিতেন।
এটাও অবাক লেগেছে, রাজনীতি ওদের কত কম আকর্ষণ করেছে। হয়তো প্রত্যেক প্রজন্মেই এমন তরুণরা থাকে,—লেখাপড়া কেরিয়ার করা, দূরে চলে যাওয়ার বাইরে ভাবতে পারে না কিছু। ভাবতে চায়ও না।
সে সময়ে এমনটা স্বপরিবারে দেখা কিছু নৈরাশ্যজনক। যতিনাথের সতীর্থ কিশোর কলেজে পা রেখেই প্রথমে আদি কম্যুনিস্ট পার্টি, পরে মার্কসবাদী কম্যুনিস্ট পার্টি দ্বারা আকৃষ্ট হয়।
যতিনাথ রাত জেগে কী করে তা জানতে দাদা বড় উদ্বিগ্ন হত।
বউদি বলতেন, অর কারণে পুলিশ আইব না কোনও দিন। হেয় পরার বই পরে।
ওঁদের কোনও সন্তানের জন্যই পুলিশ এল না কোনও দিন। ওরা আগে আগে ওদের পিতামহীর বাবার রাজনীতিক ব্যাপারটা শুনেছে। আমার কথা তো জানেই।
কোনদিন আগ্রহ দেখিনি জানতে। আমি স্বাধীনতা সংগ্রামীর পেনশান নিলাম, কোনও আগ্রহ নেই ওদের। শুধু নিজের বাইরে সব জ্ঞাতব্য বিষয়ে এমন অনাগ্রহী কেন করে হ’ল ওরা?
ইতিহাসে কোনও ”হঠাৎ” নেই। ”ধারাবাহিকতা” আছে। একদম আত্মকেন্দ্রিক ও কেরিয়ার—অর্থ—সাফল্য মনস্ক যে তরুণ প্রজন্ম দেখে আমরা ব্যাখ্যা খুঁজছি,—তাদের ঠিক আগের প্রজন্মে তো আমি আদিনাথ ও মৃণালের মতো দুটি অতিসাধারণ, অতি অনন্য মানুষের সন্তানদেরই দেখেছি।
এখন মনে হ’ল, নেউগীদের ধারাবাহিকতা ওরা রক্ষা করছে না তো? হয়তো বা নেউগীরা অতীব মডার্ন ছিলেন সবাই। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তো দেখছি, গুষ্টিবর্গের তোয়াক্কা না করে একেক প্রজন্মে একেকজন বামুনপাড়া ছেড়ে দুর্গাবাড়ি, দুর্গাবাড়ি ছেড়ে নটাকোল চলে যাচ্ছেন। কাদের ফেলে এলেন, তা নিয়ে একদম ভাবিত নন?
নেউগীরা সবাই ”দূরাকাঙ্ক্ষের বৃথা ভ্রমণ” কেন করতেন?
যাক, ”ক” বলতে ”কামস্কাটকা” গিয়ে লাভ নেই। মোট কথা, গৃহপ্রবেশ কালে, যতিনাথ ও মাধবী কলকাতায়। বাড়িতে সুভাষ ও স্বাধীন। ওরা এসেছিল। দ্বিপ্রাহরিক ভোজে নটাকোলা স্মরণে রান্না হয়েছিল—
১. সুকতনি
২. তিতার ডাল (কাঁচা মুগের ডাল ও উচ্ছে)
৩. বিউলি ডাল (ভাজা বিউলি)
৪. পাট ভাজা (পাকা কুমড়া পোরে ভাজা)
৫. চাপড় ঘণ্ট (পাঁচ তরকারি কুচিয়ে মটর ডালের ভাজা চাপড়া, আদাবাটা, ঘি ও কাঁচালঙ্কা দিয়ে। থোড় আবশ্যিক)
৬. কালো জিরা, কাঁচালঙ্কা দিয়ে পাবদা মাছের পাতলা ঝোল (গীতানাথের প্রিয়)
৭. বড় বড় কই মাছের জিরা—কই (শশিপ্রভার প্রিয়)
৮. রুইমাছের নিরামিষ (পিঁয়াজ বর্জিত) কালিয়া
৯. টকের ডাল (মটর ডাল ও আমসি)
১০. তেঁতুলের টক (পাকা তেঁতুল ও আখী গুড়ের ঘন সুমিষ্ট গোলাতে কাগজী লেবুর সুগন্ধি পাতা কচলে দেয়া। এটি কাঁচা টক এবং মৃণালের প্রিয়)।
১১. পায়েস (সতীনাথ এক জামবাটি খেতে পারে)
১২. কাঁচা গোল্লা (নাটোর থেকে আগত এক একদা উদ্বাস্তু ময়রার তৈরি)
১৩. কোমল পিঠা (ক্ষীরের লুচি রসে ফেলা। বড় এলাচের গুঁড়া আবশ্যিক)
না, তেরো ব্যঞ্জনে ভোজ হয়নি। ভাত, ঘি, লবণ, সবই ধরতে হবে।
রান্নার জন্য গদাই সান্ন্যালের জননীকে আনা হয় সাইকেল রিকশা সহযোগে। তাঁর তত্ত্বাবধানে পাচকরা ও বউদির প্রতিবেশিনীরা রান্না করেন। নটাকোলের নিয়মে তাঁকে নতুন কাপড় প্রণামী দিয়ে সাইকেল রিকশায় তুলে দেয়া হয়। নটাকোল হলে পালকিতে বা গরুর গাড়িতে বা নৌকায় আনতে হত। গদাই সান্ন্যালের মা বউদিকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, এতটি সামগগিরি দিছ, তাতেই বেন্ননে স্বাদ হইছে মা!
স্বাধীন, সুভাষ, যতিনাথ এবং যতিনাথের কলকাতার বন্ধু সবুজ দক্ষ হাতে পরিবেশন করেছিল। পরে সুভাষ বাজি ফেলে এক কড়াই পায়েসের অর্ধেকটা খায়।
কেমন করে জানব, সুভাষ কিছু কাল বাদে সকল ভাইবোনের রেজাল্ট নিষ্প্রভ করে এক ”নক্ষত্র ছাত্র” হবে (বাংলা কাগজের রিপোর্ট, জেলার সাপ্তাহিক সংবাদপত্র),—এবং নিজের রেজাল্টকে হারিয়ে বারবার আরও ভাল করবে?
স্বাধীন চলে যাবার পর, দাদার আবারও হাঁপানি হ’ল।
দাদা চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়। আমি বললাম, দ্যাহ আগে, না সার্ভিস আগে?
বউদি বললেন, আর নয়।
—তাই হয়? পোলারা দারায় নাই?
আমি বললাম, আমি কইতাছি, হয়।
সে সময় চার বছর আমি খুব মন দিয়ে কেনা বেচা করি। ডাট সাহেব আমাকে অরূপের নতুন নেশার কাজে লাগান।
ভিনটেজ গাড়ি খোঁজ করে করে আনা, কেনা এবং গাড়ি প্রতি কমিশন।
ডাট সাহেবের অধীনে ও নির্দেশনায় সরকারি আবাসন তৈরি। এ কাজটি উনি মাঝ পথে ছেড়ে দেন। আমিও চলে আসি।
দুর্গাপুরে কারখানার কোয়ার্টার তৈরি।
চার বছরের পর পারিনি। বউদি লিখলেন, ”আপনাদের তো জেল খাটা—পেনশানও হইল। এবার ঘরের ছেলে ঘরে আসেন। একবার আপনার দাদারে কলকাতায় দেখাইলে ভাল হয়।”
দাদা ও বউদিকে কলকাতায় আমার পুরাতন হোটেলের শ্রেষ্ঠ কামরায় রাখি। ডাক্তার দেখাই। ডাক্তার মিত্রর নার্সিং হোমে রাখি, ইনি কমন সেনস ও বাস্তবতা সচেতন এবং বড় ডাক্তার। ইনি বললেন, যেমন খোলামেলা জায়গায় বাড়ি করেছেন, সেখানেই থাকুন। প্রেসক্রিপশান দিচ্ছি। সকালে মাঠে সামান্য হাঁটবেন। কোনও তামাকের নেশা তো নেই?
—নাঃ। ভাতের পরে লবঙ্গ মৌরি।
—ঠিকই আছে। বারো মাস ঈষদুষ্ণ জল খাবেন।
বউদি ডাক্তারকে একান্তে বললেন, কোনও আশঙ্কা তো নেই?
—হাঁপানি….. বেশি বয়সে…… খুব যন্ত্রণাদায়ক। ওখানে অক্সিজেন ব্যবস্থা রাখা সম্ভব? মানে খুব টান উঠলে?
—না। উপায় নাই।
—নিয়েই যান। ওখানে ভালই থাকবেন।
দাদাও বলল, ধোঁয়া আর ধুলা আর মটর বাসের গ্যাস। আমারে লসয়া চল সইতা।
দাদাদের নিয়ে পৌঁছে দেয় যতিনাথ আর মাধবী। আমি কয়েক দিনেই আমার কলকাতার পাট চুকিয়ে ফিরে যাই।
জেনসন ও নিকলসনের লাল রং কিনে নিয়ে যাই। ঘোরানো সিঁড়িটি রং করাতে দাদা খুব আনন্দ পায়। শিশুর মতো।
.