ঘোরানো সিঁড়ি – ৩

তিন – আদিনাথ ও মৃণাল

এসব কথা দাদার কাছেই অতি বিতং করে শুনেছি, চোখ বুজে বলে যেতে পারি।

”বিপ্লব ব্যতীত স্বাধীনতা, স্বাধীনতা নয়”,—এমন বিশ্বাস থেকেই আমি গোপালদা’দের এ. এস. দলে যোগ দিই।

এক পক্ষে সে জীবন, এক অদ্ভুত জীবন।

যুদ্ধের ছত্রছান কাণ্ড, নাজিবাদ ও ফ্যাসিবাদের সঙ্গে মিত্রশক্তির যুদ্ধ, অক্ষশক্তির পরাজয়, স—ব আমরা জেলে বসে জানলাম।

কী হিটলারের সোভিয়েত আক্রমণ, কী হিরোশিমা ও নাগাসাকি, সব সময়েই জেলে।

কম্যুনিস্ট পার্টির কার্যকলাপ কাগজে পড়ে ঘোর সংশয় প্রকাশ করতাম।

বেয়াল্লিশের আন্দোলন জানি না, মেদিনীপুরের সাইক্লোন, মানবসৃষ্ট মহামন্বন্তর,—কোনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই।

ছেচল্লিশ থেকে দাঙ্গার শুরু, সেও জানি না।

জাতীয় ফ্রণ্ট, বা হোমফ্রণ্ট, কী বা জানতাম? দেশে ও দুনিয়ায় কত কি ঘটে যাচ্ছে, আমি কারান্তরালে। স্বাধীনতা আসছে, তা জানতাম, স্বাধীনতা কেমন হবে, তা নিয়ে ঘোর বিতর্ক চলত।

হোম ফ্রণ্ট?

বাড়ির চিঠিপত্র পেতাম, লিখতামও। কিন্তু আমার পরিবার কী অবস্থায় ছিল, তা তারা বুঝতে দিত না। দাদা বিবাহের পর বি. এ. পাস করে। লিখেছিল, ডিস্টিংশনে পাশ করলাম, সে আনন্দ কালো হয়ে গেল। আমি তোর চেয়ে ভাল ছাত্র ছিলাম না।

দাদা কয়েকবার দেখা করে গেছে। আমার জন্য তোয়ালে, জামাকাপড়, খাবার দাবার আনত। অপ্রতিভ হেসে বলত, পাবনা স্কুলেই মাস্টার হলাম। তবে ইচ্ছা আছে, সার্ভে বিভাগে যোগ দিব।

আমি স্বভাবোচিত ঔদ্ধত্যে বললাম, সরকারি কাজ করবি? গভরমেন্ট—এর চাকর?

দাদা মৃদু হাসল।

বলল, বাবার বুড়া বয়সে হাঁপানি ধরল। বংশে কারও আছিল না। ঠিক মত স্কুল করতে পারে না। চাকরি পাইতাম তো টাউনে লইয়া…

—মা কেমন আছে?

—কেমুন থাকতে পারে তুই ক! আমি যে আইব, তাও তো লেখ্যা জানাইলাম।

—বউদি তো পাবনায়?

—কিয়ের পাব না? হে নটাকোলেই থাকে। অগো ছাইরা আসবে কার ভরসায়?

—তুই…. একা থাকস?

—মেসে থাকি। এহানে আইলে শিয়ালদায় হোটেল! ভাল থাকিস অইতা! চিঠি দিস মায়েরে,….. মায়ে কইছে, জেলে আন্দোলন কইরা মিয়াদ বারাস না। বাবার কই, দেহগতিক ভাল যায় না।

দাদার গলায় কোনও অভিযোগ ছিল না। কিন্তু পরে ভেবেছি, কেমন করে বলতে পারলাম, গরমেনের চাকর হইবি? দাদা! আমার নিরীহ, সহ্যশীল দাদা! সে তো নিরাপত্তা খুঁজছিল বাবা—মা—বউদির জন্যে।

বললাম, দাদা! তোর ছেলে?

—মা তর নামে নাম মিলাইয়া নাম দিছে যতিনাথ। ভালই আছে। মা তো অরে লইয়াই ভুইলা থাকে। খুব বেতিবেস্ত সবাই। কবে বা ছারা পাস!

—বাবার স্কুল? ভাদুড়ীবাবু?

—চলত্যাছে। তিনি তো গত বছর চইলা গিছে। পোলারা তেমুন নয়….. খরচ কমাইতেছে…… টোকন পিসি, মিরনালের মা…. শচীন ভাদুড়ীর বউ…..কবিরাজ মশাই.. অনেকে নাই। আমি কই, টোকন পিসি আর মিরনালের মা ভালই গিছে। বড় পোলার বউ বড় হেনস্তা করত। মিরনালই মায়ের সব করল। আসি, তুই ভাল থাকিস। পারলে আজই ঢাকা মেল ধরুম।

মায়ের তৈরি ক্ষীরের তক্তি, আর দাদার কেনা জামাকাপড় হাতে নিয়ে আমার হঠাৎ খুব অস্থির হয়েছিল হৃদয়।

১৯৪৭ সালে দাদার পত্রেই জানলাম, বাবা আর নেই। মা, বউদি ও দাদার ছেলে পাবনায়।

দাদা লিখেছিল, সার্ভে বিভাগে কাজ হইলেও হইতে পারে।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ করে স্বাধীনতা আসে। সে সময়ে দাদা নতুন কাজে, রানাঘাটে। ”বিশ্বনাথ ভবন” সে বেচেওনি, কোনও পূর্ব বাংলাভিমুখী মুসলিমের সঙ্গে সম্পত্তি বদলও করেনি।

মা বলেছিলেন, সব ফেলে রেখে চল। এখন ভাবি, পরে তো বাংলাদেশে যাইনি। নটাকোলে ”বিশ্বনাথ ভবন” আছে কি? বাঁশের বাতার বেড়া। গেটের উপর আর্চ করে মাধবীলতার ঝাড়! জবা, অতসী, শিউলী, কোন ফুলটা ছিল না?

সেই প্রশস্ত উঠোন, সেই কুয়োতলা!

না, নেউগীরা ইতিহাসে স্থায়িত্ব খুঁজেই গেল। ক্ষ্যাপাও তো পরশপাথর খুঁজেছিল।

রেফিউজি সার্টিফিকেটের জোরে দাদা সার্ভে বিভাগে আপার ডিভিশান ক্লার্কের কাজ পায়।

রানাঘাটে দাদা ছোট হলেও বাসা ভাড়া করেছিল।

ঠিকানা জানতাম, সব জানতাম, স্বাধীনতার পর মুক্তি পেয়েই আমি রানাঘাটে ছুটি।

টালির চাল, ব্যারাকবাড়ি, দাদার ভাগে দু’খানা বড় ঘর। মনে আছে, দাদা স্টেশনে ছিল না। খুঁজে খুঁজে বাড়ি বের করেছিলাম।

—মা!

বলে ডেকেই আমি থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। বাড়ির সামনে মহিলা ও বৃদ্ধদের ভিড়। কিছু খই কড়ি পড়ে আছে।

আবার ডাকলাম, মা!

বউদি বেরিয়ে এল। শান্ত গলায় বলল, ঘাটে যান ঠাকুরপো! যদি ক’দিন আগে ছাড়ত!

—মা নাই?

—ঘাটে যান।

একটি গম্ভীর চেহারার শিশু বেরিয়ে এল। নিচে প্যাণ্ট, গা খালি। বউদির আঙুল ধরল।

একজন প্রৌঢ় লোক এগিয়ে এলেন, আপনেই ছোট পোলা? আজই খালাস হইলেন? তিনি তো ….. কাল রাতে … চলেন, ঘাটে লইয়া যাই।

আমার নিরীহ, কাতর দাদা, আর তাজাতাগড়া আমি, যার পরনে শুভ্রাতিশুভ্র পাজামা ও পাঞ্জাবী,—আমরা মায়ের মুখাগ্নি করলাম।

দাদা শুধু বলল, বাবা গেলেন! মা মনে মনে তার কাছে চইলাই গিছিল। কইত, বারো বছর হইতে এত বছর! তারে দেখবে কে? আরে পরলোকেও তো একটা মানুষ লাগে!

শ্মশানে, এক রোগজীর্ণ প্রৌঢ়ার চিতা জ্বলছিল। আমার হঠাৎ মনে হয়েছিল, মা বাবাকে এবং বাবা মাকে, সেই প্রথম দিনের মতই ভালবাসতেন। হঠাৎ পরলোকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়েছিল।

বাবা—মার হাত ধরেই নেউগী বংশে প্রেম এসেছিল একদিন নীরবে। নীরবেই তা চলে গেল।

আমরা শ্মশান থেকে ফিরে দেখেছিলাম ধোয়া মোছা ঘর তক তক করছে। ব্যারাকবাড়িতে দেখলাম দাদার ইজ্জৎ খুব।

সেই প্রৌঢ় আমাকে সমীহ করে কথা বলছিলেন।

—তোমরা কত কষ্ট কইরা স্বাধীনতা আনলা, তোমাগো জীবন সাথ্যক।

তারপর বললেন, শুনত্যাছি, তোমাগো অনেক সুযোগ কইরা দিবে কংরেস গরমেন। যারা সংগ্রাম করছে তারাগো আগে দেখবে।

বারান্দায় হেলান দিয়ে বসে চূর্ণীর ওপারে স্বাধীনতার যে চেহারা দেখছিলাম, তা নৈরাশ্যজনক। বাঁশের বাতার সার সার ঘর, সবই নাকি কলোনি। কয়েকদিন ধরেই দেখলাম, উদ্বাস্তু আসছে, আসছে। ঢুকে যাচ্ছে কলোনিতে। হাউ কাউ, চেঁচামেচি, উন্মত্ত চিৎকার কোনও যুবকের, শূয়ার পাইছেন? খোঁয়াড়ে ভরতেছেন?—আর দেখেছি মলমূত্রে ভাসাভাসি, হাসপাতাল ক্যাম্প, সে এক হরিহর ছত্র।

বউদি বলল, খুব তো বলছিলেন, দাদা! গরমেণ্টের চাকর ক্যান? হইছিল বইলা আমাগো ক্যাম্পে যাইতে হয় নাই। অবশ্য আপনে বোঝবেন না। এতকাল সংসারের বার! চল্লিশ টাকা মণ চাল পঞ্চাশ সালে। ভাবতে পারেন?

—কেমনে জানুম?

—সকল ঝড় মাথায় নিছে ওই একটা মানুষ। আর তারেই মা! কী কইছে আর কী কয় নাই। একটু মাছ, একটু দুধ, দুগা মোয়া বানাইলাম, কানত আর কইত, তারে ফালাইয়া খাস কুন প্রাণে?

মুখে উঠে?

নিরুত্তাপ গলায় বলল, হুতাশে কইত! শ্যাষে কইলাম হেয় জেলে গিছে বইলা পাকসাক বন্ধ কইরা দেই? তাহলেই সে ফিরবে?

—মা কী বলল?

—খুব কানল। খুব দোষঘাট মানল। আবার ভুইলা যাইত। বাবারে খুব বিন্ধা বিন্ধা কথা শুনাইত।

দেখেছিলাম, দুটি ঘর যেন ঝকঝক করে। নিত্য বিছানা কাচে বউদি। ঠিকে ঝিকে দিয়ে কাপড় কাচায়। দাদাকে যেন ঠাকুরসেবা করে।

ক্রমে বুঝেছি, অনেক পরে, দাদা অনেক কারণেই খুব দগ্ধ হয়েছে অনেকদিন ধরে। ছোটবেলা থেকে আমি ডাকাবুকো, পড়াশোনায় ভাল, খেলাধুলো, সাঁতার কাটা, ইত্যাদিতে এগিয়ে থাকি।

আমার বিষয়ে মায়ের বিশেষ দুর্বলতা তখন তো চোখে পড়ত না।

নিচু গলায় বললাম, বউদি, মায়ে এমুন করত ক্যান? বৌদি নিরুত্তাপ নিরীর্ষ গলায় বলল, আপনেরে কইত যুগ্য সন্তান! তারানাথের যুগ্য নাতি! দ্যাশের কথা যারা ভাবে, তারা আগুনে ঝাপ দেয়।

—মাথা খারাপ হইয়া গিছিল।

—আপনে অনেকরে অনেক দুখ্য দিছেন। আপনের কারণে আপনের দাদায় জ্বইলা জ্বইলা…

—বুঝি নাই।

—আইয়া পরছেন থাকবেন তো না?

আমি নীরব।

—হে অনেক আশা কইরা আছে। তারে বইলা কইয়া যাইয়েন। হেয় তো সামান্যই মানুষ ….. গরমেনের …. চাকর…. মা—ভাই—বউ—পোলা বুঝে …. বরো সপন দেখে না…তারে কষ্ট দিতে দিমু না….

সে সময়ে এক সঙ্গে এত কথা বউদি একবারই বলেছিল। বুঝেছিলাম, আমার নয়, দাদারই দরকার অনেকটা প্রোটেকশান,—বউদি বাঘিনীর হিংস্রতায় দাদাকে আগলে চলছে।

দাদা রাতে বারান্দায় বসে বলল, বিশ্বনাথ—ভবন জলে গেল।

—যাক না দাদা! তুই ভাইবা দেখ, নেউগীরা বাড়ি বানায় আর ছাইরা যায়।

—না রে! ভগবান দিন দেয়, তো আমি বাড়ি তোলব। নিজ ঘরে বাস, সে খ্যাড়া ঘর, মাটির দ্যাল হইলেও শান্তি!

—তোর এই চাকরি…..

—সিকিউরিটি আছে রে! আর, অহনে তো পশ্চিমবঙ্গ! নদীনালার দ্যাশ নয়। এহানে শত শত বছর দালান টেকে। রানাঘাট, কৃষ্ণনগর, ঘুইরা দেখত্যাছি তো!

দালান থাকে, মানুষ থাকে না। কিন্তু সহসা নিজেকে গীতানাথ মনে হ’ল। সস্নেহে বললাম, দেখ! আমিও কিছু করুম। অহন তো আমি আইয়া পরছি।

দাদা মৃদু হেসে বলল, আইছস, থাকবি তো না। অহন তোর কত কাম থাকব। আর! আমারও বদলির কাম। এট্টা ভাল জায়গায় বদলি হইতে পারি, তো বাড়ি বানাইব।

আমি বললাম, আমি আছি দাদা!

অন্তর থেকেই বলেছিলাম। ভাসতে ভাসতে শেষ অবধি আমরা ক’জন! যে মৃণালকে ছুটে চলে যেতে দেখেছিলাম হাজার বছর আগে, আমবাগানের আলোছায়া মাখা পথ ধরে,—সে মৃণাল এখন আমার পূজ্য ও প্রণম্য।

দাদা তেমনি এরম গলাতেই বলল, তর বউঠানও জীবনেও সিকিউরিটি জানে নাই। নটাকোল ছাইড়া আইতে খুব কানছিল। অর মনেও শান্তি পাইব যদি বাড়ি হয়! এট্টা আশা লইয়া চলতে হয় রে সইতা! আশার দুয়ারে ভূত খাটে,—মায়ে বইলা গিছে।

আমি বললাম, বেশ! আমিও কাজকাম দেখি। অহনে কাম পাইতে কষ্ট হইত না।

আমার ও দাদার বয়স তখন আটাশ।

বউদির বয়স চব্বিশ।

যতিনাথের বয়স দুই বছর।

দাদা বলল, বিয়াসাদী কর, দুই ভাই সংসার করি!

আমি মাথা নাড়লাম। বললাম, মনে মনে বুড়া হইয়া গিছি রে দাদা! অহনে আর বিয়ার কথা ভাবতে পারতাম না। নেউগী বংশ? তোরে দিয়াই রক্ষা পাইব। বউদি তো লক্ষ্মী!

—লক্ষ্মী নয় রে, দুর্গা! রাগ তো দ্যাখস নাই। দরকারে কাতান ধরতে পারে।

আমার বউদি? মৃণাল? ছিপছিপে ফর্সা মানুষ! এক মাথা চুল! যতিনাথকে বলে, ভাত ফালাইবি না! আবার দাদাকেও বলে, হ! তোমারেই দিছি বেশি কইরা মাছ। কথা না কইয়া খাইবা।

আমার কথা আর বাড়াব না। দেখলাম, ওরা তিনজন ভারি সুন্দর একটি সংসার গড়েছে। দাদা সেবা পেয়ে তৃপ্ত যেমন,—তেমনি বউয়ের শ্রম বাঁচাতে ঝুল ঝেড়ে দেয়, মশারি কেচে দেয়, যতিনাথকে হাঁটিয়ে বেড়াতে নিয়ে যায়। বউদি অতন্দ্র চোখ রাখে তার সাম্রাজ্যের উপর। যতিনাথকে মারধোর করে না, কিন্তু কঠোর শাসনে রাখে। কোনও আবদার দেয় না।

আমি চলে আসি। জেল থেকে কিছু টাকা তো নিয়ে বেরিয়েছিলাম। বউদিকে বললাম, হাজার টাকা রাখেন। আমি এক ঠিকানা থুইয়া যাই, কলকাতায় এনারে লিখলেই যোগাযোগ হইব।

—আর আসবেন না?

—আপনাগো ছাইরা যাইতাম কোথায়? কিন্তু আমিও কামে ঘোরব, দাদাও বদলি হইব,—খবরবার্তা নিতে একটা ঠিকানা দরকার।

—বিয়া করবেন না ঠাকুর পো?

—নিউগীরা বিয়া করত সকলেই। আমি এট্টা নতুন পথ ধরি। একজন বিয়া না কইরা থাকুক।

—আমার জীবন একলাই কাটব।

—কিসে? দাদা আছে, যতি আছে, আর আমি বইলা যাই, আপনাগো’ লিগ্যা আমি চিরদিন থাকলাম।

—ইনির ঠিকানাতেই চিঠি দিব?

—হ। বদলির খবর যেমন সত্বর পাই। আর দেখেন? সকল কথা আমার—আপনার। টাকা পাঠামু যেমন পারি,—দাদার সপন বাড়ি বানাইন্যা, উঠুক বাড়ি।

—হ ঠাকুরপো! চিঠি দিয়েন। নিষ্ঠুরতা হইয়েন না। যতির বাপ বড় কষ্ট পাইছে!

—আর…. আপনে?

—চিঠি দিয়েন। আমি তো চার বছর হইতে আগুন মারাইয়া হাটতেছি। মায়ে বেদম মাইরাও কান্দাইতে পারে নাই!

সগর্বে মাথা তুলে বললেন, কানলে আজ এ সংসার বাইনধা উঠত? মাইয়াদের আপনেরা বাইন্ধা রাখছেন। তা’গো শুধা সইয়া চলতে হয়, সংসার বাচাইতে হয়। কুনদিন বা বসুমতী ফাইটা যাইব।

না, এমনভাবে মেয়েদের দেখতে শিখিনি। তারা কাজ করে, সন্তান বহন করে, শুধুই দুঃখ সয়ে যায়।

—আপনের দাদার নাখাল পুরুষ মানুষ ক’জন? যতি প্যাটে থাকতে এক বালতি জল উঠাতে দেয় নাই—ডাক্তার আইনা প্রসব করাইছে,—দুধ রে! ফল রে! কত যত্ন! কত টনিক! আপনের মায়ের যে সেবা করছে…. এমুন মানুষই ঠেলা খাইল সংসারে… আর …. জেল খাইটা আপনে ঠাকুর হইয়া গেলেন মায়ের কাছে….

—আর কয়েন না বউঠান!

—আমার কথায় দোষ নিয়েন না ঠাকুর পো! বড় দুখ্যে কই!

—আপনের কথায়….. আমি দোষ লইতে পারি?

আমি রানাঘাট ছাড়লাম।

.

আগেই বলেছি এ কাহিনী ঘোরানো সিঁড়ির, আমার নয়। আমার উত্তর—স্বাধীনতা পর্বের জীবনকথা তো লিখতে বসিনি।

জেলের সতীর্থ, আমাদের শ্রদ্ধেয় দাদা, প্রতাপমোহনের ঠিকানা দিয়ে এসেছিলাম। বউবাজারে সেকেলে চকমেলানো বাড়ি,—একদা বিপ্লবীদের মিলন কেন্দ্র ছিল।

প্রতাপদাদা বললেন, চাকরি করবি?

—এই বিদ্যাবুদ্ধি লইয়া?

—তবে কনট্রাক্টরি কর। করতে করতে শেখ। পরে নিজে পারবি।

—দ্যাশের কাম কি ছাইরা দিলেন?

—করবি? কর। তবে দেশের যে হাল…. কত দল… ওদিকে দাঙ্গা… এদিকে উদ্বাস্তু আসছে বন্যার মতো… পশ্চিমবঙ্গের চেহারাটা দেখেছিস? কাজ এখন অনেক থাকবে।

—আপনি কী করবেন?

—অবসর নেব। আঠারো থেকে আটাত্তর, হীরক—জুবিলি হয়ে গেল। এখন আমাদের মতো প্রাচীন বিপ্লবী, আন্দামান ফেরৎ, এদের জন্যে একটা হাসপাতাল, একটা চক্ষু চিকিৎসালয়, তাদের বৃদ্ধাবাস,—স্বাধীন দেশে এসব কাজের কথা তো চিন্তা করা যাবে।

…. আর….

—কী, বলেন?

—কম্যুনিস্ট, আর সি.পি আই, ইত্যাদি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে। কম্যুনিস্ট সমর্থনে চলে যাচ্ছে দেশের শ্রেষ্ঠ ব্রেইনস, শিক্ষিত ছেলেরা। এটা ইতিহাসের….

—দিক সংকেত।

—রাইট।

—জেলে বইসা বললে আপনি রাইগা উঠতেন।

—আমার কথা ছাড়। তোকে কি…..

—রোজগারের কথা ভাবতে হইব দাদা! বাবা, মা, গত কয়েক বছরে বিগত। যদি ক’দিন আগে ছাড়ত, মা’রে দেখতে পাইতাম। সে খুব হুতাশে মরছে।

—রইল কে আর?

—যমজ দাদা, বউদি, এক পোলা।

—দাদা কাজ করেন?

—হ। সার্ভে বিভাগে।

—কোথায় আছেন?

—রানাঘাট। দাদার বড়ো ইচ্ছা, আমি যদি পাশে থাকি, হে যেমুনতেমুন একখানা বাড়ি করে। প্রপিতামহ, পিতামহ, বাবা, যিনিই বাড়ি করছে, তিনিদেরই বাড়ি থাকে নাই। পোলারা ছাইড়া গিছে, নয় নদীতে খাইছে, আমরা তো পূর্ববঙ্গের মানুষ! দাদায় একলা খুব করছে! অহন আমার কর্তব্য হয় তারে কিছুদিন সাথ দিই!

—তুই সংসার করবি না?

—নাঃ!

একটা ডাহা মিথ্যা বললাম, নেউগী বাড়িতে একজন না একজন বিয়া না কইরা থাইকা যায়। আমি বা নিয়মটা ভাঙি ক্যান, বলেন?

প্রতাপদাদা বললেন, ঠিকই। থাক আজকে। কাল তোকে নিয়ে যাব অরুণ দত্তের কাছে। ডাট অ্যানড ডাট অ্যানড ডাট,—মার্টিন বার্নের কাজও করে। সেখানে ঢুকিয়ে দেব। অগাবগা জায়গায় পাঠাবে….

—সে তো ভালই। আর দাদা! আপনের বাড়িরে অনুমতি না লইয়াই পোস্টাপিস বানাইলাম। দাদায় লিখবে, আমিও খবর নিব।

—পারবি তুই। এককালে ছিল স্বদেশী পাঁঠার দোকান, রাজবন্দীর ট্রাঙ্কের দোকান…..আজ তো সে নিয়মে চললে হবে না। তোর হবে সতীনাথ! জেলে খেয়ে খেয়ে, ব্যায়াম করে করে, বডি তো বানিয়েছিস! ওই ভাষাটা! যাবে, ক্রমে মিলে মিশে যাবে। আরে আমিই একবার ম্যাট্রিক, না এনট্রান্স ফেল করে বিবাগী হই। খুব হিন্দি ভাষা শিখেছিলাম। চাইলে চাকরিও পাবি।

—না, চাকরি করুম না।

—যা ইচ্ছে করগে যা। চল, খেয়ে নিই।

প্রতাপদাদার বাড়িতে শ্বেতপাথরের দালানে গালচের আসনে বসে ঝকঝকে কাঁসার থালায় সাত ব্যঞ্জনে ভোজন! জেলেও তো হরদম ওঁর বাড়ি থেকে সকল রাজবন্দির জন্য ভারে ভারে খাবার যেত। সবাই খেতাম।

অরুণ ডাটের সঙ্গে ভিড়ে পড়লাম। পুরনো বাড়ি ভাঙা হচ্ছে জানলেই তার মালমশলা, আসবাব, দরজা—জানলা কিনতেন,—সেটা স্বতন্ত্র ব্যবসা।

বানাতেন ব্রিজ, রেল ও হাসপাতালের কোয়ার্টার। দুর্গাপুর যখন অনস্তিত্ব এক কাগুজে প্রকল্প, বলেছিলেন, বিশাল জায়গা হয়ে যাবে।

কুলি বা লেবার খাটানোর কাজ দিয়ে আমার হাতে খড়ি। অরুণ ডাটের বয়স তখন নিশ্চয় চল্লিশ হবে। আমার চেয়ে বছর বারোর বড় হবেন। ”ডাট” লিখতেন, সাহেবমার্কা ছিলেন। অন্য রকম সাহেব।

খাকি হাফপ্যান্ট ও খাকি হাফশার্ট পরতেন। সোলা হ্যাট পরে রোদে জলে সাইটে থাকতেন। আমাকে বলেছিলেন, গভরমেন্টের কন্ট্রাক্টর,—পরিবারে কেউ ইংরেজের বিরুদ্ধে যায়নি। কিন্তু প্রতাপ কাকার কথায় আপনাকে কাজ দিলাম, অ্যানড, আই ফিল প্রাউড।

প্রতাপদাদা এঁর বাবার বন্ধু ছিলেন। দুটি পরিবারই আমার ভাষায় ক্যালকেশিয়ান।

এঁদের বন্ধুত্ব কেমন করে হতে পারে?

প্রতাপদাদা বললেন, ওদের আদি বাস বলাগড়ে, হুগলী জেলায়। কত সময়ে সেখানে আমরা শেলটার নিয়েছি! আবার টাকার জন্যে জীবনে দু’বার আশুতোষ ঠেকে গেছে,—দু’বারই আমার দাদা দিয়েছেন। এ রকম সম্পর্ক তখনকার দিনে হত হে!

আমি তখন দুইশত টাকা পাই। কিছু দিনেই বেতন আড়াইশো হ’ল। অরুণ ডাট বললেন, আমি তোমার কাজে খুব খুশি হে। এবার তোমাকেই একটা কাজের দায়িত্ব দেব।

এক সরকারি নগরীতে (আজও তা গ্রাম ও টাউনের জগাখিচুড়ি হয়ে আছে) অফিস তৈরির কাজের একাংশ। আমি চার হাজার টাকা লাভ রাখতে পেরেছিলাম।

আর প্রতাপদাদার সে সময়ে রাইটার্সে খুব দহরম মহরম। সে ভাবেই দাদাকে কৃষ্ণনগরে আনা যায়। তখন দাদার মেয়ে মাধবীলতা কোলের শিশু।

চারটি সন্তান হয় আদিনাথ ও মৃণালের। যতিনাথ ও মাধবীর মধ্যেই যা তিন বছরের তফাত। মাধবীর চেয়ে স্বাধীন দু’বছরের ছোট। আবার স্বাধীন ও সুভাষের বয়সের তফাত মাত্রই এক বছর কয়েক মাসের।

এইটে ভাবলে ঘোল খেয়ে যাই। দাদা বিয়ে করল বটে, যতিনাথ জন্মাল পাঁচ বছর বাদে। তিন বছর তফাৎ দিয়ে পর পর মাধবী, স্বাধীন ও সুভাষ।

কৃষ্ণনগরে ওরা ভাল বাসা পেয়েছিল। দাদার বেতনও বেড়েছিল। মাধবী জন্মাল তো বললাম, এমন সেকেলে নাম রাখলি?

বউদি বলল, ঠাকুরপোর কথায় পালিশ আসছে।

—কয়েন, নামরহস্য কী?

দাদা মাথা চুলকে বলল, নটাকোলে মাধবীলতার গাছ ছিল….আর তর বউদিদি ”মাধবী কঙ্কণ” পইড়া কানত এক সময়ে…

—আপনে বই পইড়া কানতেন?

—সকলে কি আপনের নাখাল পাষাণ না কি? মাইয়ার মুখ ঢাকা দিলাম। খালি হাতে দেখতে দিমু না। আপনে অর একোই কাকা।

আমি একটি খাম ফেলে দিলাম। ডাট অ্যানড ডাট অ্যানড ডাট কোম্পানির নাম ছাপা, কাগজের ভেতর গজের কাপড় সাঁটা শক্ত খাম।

বউদির মুখ সাদা।

—এ কি দিতেছেন?

—ব্যাঙ্কে ফিকস কইরা দিবেন।

—কত টাকা?

—পাঁচ হাজার!

স্বামী স্ত্রী নিরুত্তর। ১৯৪৮—এর মাঝামাঝি সে অনেক টাকা।

দাদা বলল, কেমুন কইরা পাইলি?

—চুরি ডাকাতি করি নাই। কামাইছি, জমাইছি। পাপের টাকা নয় রে দাদা!

বউদি বললেন, আমরা নিমু?

জামা খুলতে খুলতে বললাম, একজনের না বাড়ি বানাইবার বড়ো আশা! তা, আমারও তো থাকতে লাগব। অহন বয়স আছে! বুড়া তো হ’মু একদিন!

দাদা কেঁদে ফেলেছিল।

কাঁদবেই। তখন অবধি নগদে পাঁচ হাজার টাকা আমরা কেন, নেউগী বাড়িতে কেউ দেখেনি। আমার মা—বাবার পাকস্পর্শের দিন দুর্গাবাড়ি গ্রামের মানুষ হেলে ঢেলে খেয়েছিল,—তখন শুভ কাজে মাছই হ’ত,—খরচ হয়েছিল একশো সত্তর টাকা। চাল—ডাল—মাছ ঘি—দই—সন্দেশ,—মণ দরেই এসেছিল।

পাঁচ হাজার টাকায় তখন কৃষ্ণনগরের আশেপাশেই জমি কিনলেও ভিতপত্তনের টাকা থাকে।

দাদা বলল, জমি বায়না করি?

বউদি বললেন, অহনই? বাড়িই যদি করো, এমুন থনে করবা, যে ইস্কুল থাকে, ছেলে মেয়ে পড়তে পারে, ইলেকটিরি থাকে, সভ্য জায়গা।

আমিও বললাম, তুইও বদলি হবি, এখন চাকরিতে উপরে উঠবি। আর! সকল সময়ে ভাল কাম কইরা টাকা পামু, এমন কি বলা যায়? হয়তো অনেকদিন শুকনা যাইত!

কোনও পুরানো বাংলো প্যাটার্নের বাড়ির যা আউট হাউস ছিল, সেটাই দাদা ও গোপালবাবুর কোয়ার্টার।

গোপালবাবুর গৃহিণী এ সময়ে যতিনাথকে দেখেছেন, বউদিকেও দেখতেন।

আমার জন্যে মাছ রেঁধে এনেছিলেন। ননদকে দিয়ে চা পাঠিয়েছিলেন।

বউদি বললেন, ঠাকুরপো! রাজি থাকেন তো বলেন, অতসীর লগে বিয়া দিয়া দেই।

—সকলের কি দাদার নাখাল বউভাগ্য হয়? আমার বাবার ছিল, দাদার আছে,—

—আপনেরও হইব।

—না বউদি! বিয়া মানে বউয়ের ম্যাজাজ, ছাওয়াল মেয়ের কান্নাকান্নি, ন্যানজারি অবস্থা! আমি অহনে তো পারুম না।

—বুড়া বয়সে গিরীশ সা’ হইবেন?

—বুড়া হই আগে।

—গিরীশের বিধবা আমারই বয়সী গো! অরা তো সকলটি মুর্শিদাবাদ আইসা উঠছে। শুনছি যতির বাবার কাছে, দেখি নাই!

—দাদার…. আপনের দেহগতিক ভাল তো?

—হ! আমি তো ভালই থাকি। হেয়ও আপনেরে পাইয়া শান্তি পাইছে।

—এ জায়গা ভাল তো?

—খুব, সংসার কইরা শান্তি আছে। খাওন দাওন, চলাফিরা, দোকানবাজার, কুন—অ কষ্ট নাই। গরম যেমুন, শীত তেমুন! আর বেড়াইয়া সুখ! রাজবাড়ি দেখবেন, শিবনিবাস দেখবেন, নদীর ঘাট বা কত সুন্দর!

—নটাকোলের লিগ্যা মন পুরায় না?

—মন পুরাইবে ক্যান? পুরাইয়া লাভ বা কী? হেয় খুব হাহাকার করে, আমি করি না। যা ফালাইয়া আইলাম, সে কথা ভাইবা লাভ? আর দেখতেছেন তো! সংসার….আপনের দাদা… এই যতি….মাধবী…. চিন্তার সময়ও তো পাই না।

—আপনেরে পাইয়া আপনের দাদা য্যান….. চিঠি একখান দেন, তো হেয় পাচখান লিখে…

—আমারই বা কে আছে আর…

—নাঃ। তিনোজনের তিনোজন আছি!

বউদি কথাটা আনমনে বলেন। তখন বাইরে বিকেল পড়ে আসার অবস্থা—প্রাচীন শালগাছের পাতার মর্মর,—যতিনাথ কলকল করে ঝি—কে কী বলছে,—বউদির চেহারা কিছু কাহিল হলেও তেমনই সুন্দরী,—আঙুল দিয়ে চুলে বিলি কাটছিলেন,—পরনে হালকা সবুজ শাড়ি,—”তিনোজনের তিনোজন” কথাটি মনে গেঁথে গেল।

কথাটি মনে করি, জবাকুসুম তেলের সুবাস পাই। বউদিদি মাখতেন। বউদিদির সঙ্গে জবাকুসুমের সুবাস, কিউটিক্যুরা পাউডারের শিশু—শিশু গন্ধ, এরকম কয়েকটা স্মৃতি বড় জড়ানো।

আর জড়ানো পরিচ্ছন্নতা। আরও তো সন্তান হয়েছিল, আরও তো অন্যান্য বাসায় থাকেন,—সর্বদাই সব যেন ঝকঝক করত।

ছেলে মেয়ে কেন, দাদাকেও রবিবারে পিঠে সাবান ঘষে দিতে দেখেছি। একদিন বাদে একদিন নখ না কাটলে রক্ষা ছিল না। মাধবী ইস্কুল থেকে যতবার মাথায় উকুন এনেছে, ততবার ওর মাথা নেড়া করেছেন। ফলটা খারাপ হয়নি।

এখনও মাধবীর মাথায় ঘন চুল, তাতে রুপোর তারের ঝিকিমিকি।

সেবারই ওদের একটা রেডিও কিনে দিই। দাদা বলল, আবার খরচ?

—বউদি গান শুনবে, খবর শুনবে।

দূরদর্শনের যুগ ছিল না।

সামান্যে সন্তুষ্ট থাকবার দিন ছিল।

কৃষ্ণনগর থেকে ফেরার পথে অরুণ ডাটের গাড়ি পেয়েছিলাম। অরুণ ডাট বলেছিলেন চাকদা ঘুরে যেতে এবং নীলসন সাহেব বেঁচে থাকলে তার সঙ্গে দেখা করতে।

দাদাকে বললাম, চল না আমার সঙ্গে। গাড়িতে যাব, গাড়িতে আসব?

—এদের রাইখা যাব?

বউদি বললেন, না সিনেমা, না পূজামণ্ডপে থিয়েটার, আমাগো রাইখা হে নরেই না। ঠাকুরপো বলতেছেন, ঘুইরা আস গিয়া।

আমি বললাম, সন্ধার নাখাল আইয়া পরুম।

দাদা শিশুদের মতো আনন্দ পেয়েছিল। ছুটি, ছুটি, মস্ত ছুটি ওর। আটাশ বছর বয়স দুজনেরই, চেহারা ওর রোগাটে, কিন্তু বয়সে যেন বালকের কৌতূহল। জিপে বসেই ওর আনন্দ কি!

বলেছিলাম, থাকে যদি। একটা আশ্চর্য জিনিস দেখবি।

”নীলদর্পণ” পড়েছিস তো? নীলকর সাহেবদের শেষ বংশধরকে দেখবি।

মনে আছে, বিশাল হাতা, বড় বড় গাছ, মেহগনি, শাল, শিশু। আউট হাউস ধ্বংসস্তূপ, বাংলোটি জীর্ণ, শীর্ণ, তবে দাঁড়িয়ে আছে।

নীলসন সাহেবেরই সন্তান, চোখও নীল। কিন্তু বেজায় বুড়ো, রং তামাটে, চুল কটাশে। শার্ট, প্যান্ট, সবই অতীতের ধ্বংসাবশেষ।

ওর বউ, ছেলে, সবাই ইংলন্ড চলে গেছে। ও যেতে পারছে না কিছুতে।

নিস্পৃহতায় যেন ”আরণ্যক” বইয়ের ধাওতাল সাহু।

—প্ল্যান্টেশান আমি দেখিনি। সে সব তো কবেই উঠে যায়। মা মারা যেতে বাবা এক বেংগলি মেয়েকে বিয়ে করে। বাগানের কোণে তাদের সমাধি আছে। ছিল প্ল্যান্টেশানের জমি। চাকদা ছড়িয়ে পড়ছে, অনেক জমি চলেও গেছে। আমি এ জমি বা বাড়ি রাখতে পারব না। ডাট আবার জমি চায় না, বাড়ি চায়, মানে বাড়ির মেটেরিয়াল। এসো, দেখো!

—নীল তৈরি হত কোথায়?

—কাছাকাছিই, আমি দেখিনি।

—শুধু বাড়ি বেচবেন?

নীলসন নিরানন্দ হাসল। বলল, ফায়ার প্লেস, দরজা জানলা, একটা বিলিয়ার্ড টেবিল, মার্বেল, বেসিন, বড় বড় চাইনিজ ভেস। মাউন্টেড বাঘ দুটো,—হ্যাঁ হ্যাঁ, শিকার বিস্তর ছিল। এখন যেখানে হাই স্কুল, তার পিছনে একটা বাঘ তো আমিই মারি।

কেমন ভরসাহীন চোখে চাইল ও। বলল, সব বদলে যাচ্ছে।

—আমার বয়সও বাহাত্তর হ’ল। সব বেচে দিয়ে যা পাই….

—ইংল্যান্ড যাবেন?

—এই বয়সে? নো মিস্টার। লাস্ট ব্রিটিশ ইনডিগো প্ল্যান্টার কোনও ওলড এজ হোমে যাবে, বা স্যালভেশান আর্মির শেলটারে।

—একা পড়ে যাবেন।

—ঠিকই আছে ইয়ং ম্যান। একাই তো থাকি। ওই লোকাল একটা পরিবার আছে, স্বামী রিকশা চালায়, স্ত্রী… ছেলে মেয়ে…. ডাটকে তাড়াতাড়ি করতে বলুন। আমার কোনও ক্যাশ নেই…. অসুবিধে হয়ে যায়।

বেরিয়ে এসে হোটেলে ভাত খেয়েছিলাম। দাদাকে বললাম, ল! নীলকরদের অত্যাচারের কথা খুব পড়ছি, আজ জ্যান্ত নীলকর দেখাইলাম।

—বাংলা বলতে আছিল।

—আরে, এটা তো মড়া নীলকর! কুনোদিন পূর্ব পুরুষ আছিল…সেটেল কইরা যায়…ডাট সাহেব বলে, এ ল্যাখাপড়াও করে নাই…জমির ধান খাইত…

—বউ ছেলে বিলাতে থাকে?

—তারা অ্যাংলো আছিল। চইলা গিছে।

—কী থামগুলো! কী সিঁড়ি! কী দেয়াল! বাড়ি বানাইছিল বটে!

—ওই বাড়ির মতো বাড়ি, অহন কে বানাইবে?

—দামি জিনিস সব!

—ডাট সাহেব যদি সাহায্য করে, তবে এইসব কিনুম।

—বেচবি কারে?

—ওনারেই। পরে পারলে নিজের কিছু করব।

—লাভ থাকব?

—তিনি তো কয় থাকব।

—যদি সার্ভিস করতি সইতা…অহন স্বাধীন দেশের সরকার…

—নেউগী বংশে তুই সারভিস করতে আছিস দাদা। আমি নয় বেবসা করি! আর… বাড়ি বানাইতে হইব না?

—অহনই তারা কিসের?

—তাড়াতাড়ি করতে পারলে মন্দ কী? রিটায়ার কইরা বাড়ি বানাইলে কত বৎসর বা বাস করবি? নিজ বাড়িতে থাকলি….সন্তানদের পরাইলি…সে অনেক ভাল। আর…আমিও জানুম আমার জায়গা পাক্কা! একদিন নিশ্চয় গভরমেন আমাগো পেনশান দিব। প্রতাপ দাদার লগে জেলে আছিলাম…মস্ত সাট্টিফিকেট…ল, মিষ্টি কিন্যা লই।

—সইতা!

—ক’ দাদা!

—আমার সংসার দাড়া করাইবার লিগ্যা তুই বিয়া করবি না? আমারে দোষী কইরা রাখবি?

—দাদা! আমি দেখ! তোর নাখাল নিঃসাথ্য নয়। তুই সংসার কইরাও বাবা, মা, আমার কথা ভাবছস। আমি কই সাথ্যপর! বিয়া করতে তো মনই উঠে না। যদি করি, সাথ্যপর হইয়া যামু। আমাগো নাইও কেউ আর। তিনজনার তিনো জন আছি। তেমুনই থাকি, কেমুন?

দাদা মুখ ফেরাল।

আমার মানসিক অবস্থান পরিষ্কার করি। একদা, হাজার বছর আগে, অধুনা অবলুপ্ত (আমার কাছে) এক বহতা, সতত জলদায়িনী নদীতটের এক গ্রামে, এক বালিকা এক কিশোরকে বলেছিল, তোমাগো ঘরে যা’মু। মনে মনে বলেছিল। তার মা আমার জননীকে বলেছিলেন। সেই বালিকার মনে গভীর দুঃখ দিয়ে আমি গ্রাম ত্যাগ করি। পরে তার কথা ভাবতাম মাঝে মাঝে। সে আমাদের ঘরেই এল। তাকে নিয়ে আমার দাদার জীবন পূর্ণ থেকে পূর্ণতরো হচ্ছে, এটা চোখে দেখার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হই কেন?

সেও তো বদলাচ্ছে। এখন সে মা, দাদার স্ত্রী,—আমার প্রতি ব্যবহারে কত স্নেহশীল। বলে, আর দাদারে ছাইড়া যাইয়েন না ঠাকুরপো। হেয় বড় দুখ্যে আছিল। অহন শান্তি পাইছে।

দাদাকে কিছু বলার আগেই কৃষ্ণনগরে পৌঁছে গিয়েছিলাম। তখন সন্ধ্যা। কাজের মেয়েটি ঘরে ঘরে ধুনো দিচ্ছিল।

বউদি বললেন, জল রাখছে। পা ধুইয়া উঠবা। পথের ধূলা ঘরে আইনো না।

মন কিছু এলোমেলো ছিল। ধুনোর গন্ধে সহসা নিজের জননীকে মনে পড়ল।

পা ধুয়ে ঘরে উঠে বললাম, দাদার আর শাসন মুক্তি ঘটল না। পরাধীন ভারতে মায়ে যা কইত, স্বাধীন ভারতে আপনে একোই কথা ক’ন।

বউদি হাসলেন।

.

এভাবে মাল কিনতে মাঝে মাঝেই যখন গেছি, দাদাকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করতাম। দাদা বিমোহিত হয়ে বলত, পার্মানেন্ট স্ট্রাকচার করছিল!

কী ভ্রান্ত উক্তি আমরা করে চলি স্থায়িত্বের স্বপ্ন দেখে দেখে!

দেখছ জনমানব পরিত্যক্ত জীর্ণ বাড়ি, যা ভাঙা হবে। বলছ, পার্মানেন্ট স্ট্রাকচার।

কিছুই চিরস্থায়ী নয় মানুষ ছাড়া।

কালে কালে, অনাদিকাল হতে যুদ্ধে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে, রোগেভোগে মহামারীতে, দুর্ভিক্ষে ও খাদ্যাভাবে মানুষ মরছে। তবু মানুষ থাকে।

এমনই এক বিমোহন হৈমন্তিক দিনে দাদার চোখে স্বপ্নমাখা চাহনি দেখে আমি ওই ঘোরানো সিঁড়ি কিনি।

দাদা বলেছিল, কিয়ের জমাদার? ঘুরাইন্যা সিড়ি বসামু বাসার গায়ে, বাগানে। অন্দরে দোতলার সিড়ি থাকব। আমরা ঘুরাইন্যা সিড়ি ধইরা ছাতে গিয়া বসুম।

বাইশটা ধাপ। টাটার লোহা। নির্মাতা ব্ল্যাকবার্ন অ্যানড শেপার্ড কোম্পানি।

.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *