দুই – সতীনাথ ও নিয়োগীদের বেভ্রম
ঘোরানো সিঁড়িটা যে কী ভাবে আমাদের জীবনের বিভ্রমের প্রতীক হয়ে উঠল, তাই ভাবি, আর ভাবি। সময় পরে অনেক পাব। এখন শুধু মুখ বন্ধ করি।
আজ বিকালে দেখি ননীবাবু আর তেমন মন খুলে কথা বলে না।
বললাম, নিরাশ হলেন মনে হয়?
—কোথায় আপনার বৃদ্ধাবাস? কী যে তুলছেন, বোঝাই যায় না।
—বৃদ্ধাবাসই হবে। বুড়া বুড়িরাই থাকবে। একেক জন একেক তলায়।
—জমিও বেচলেন না, ঘরের ভিত কাটছেন, ঘরও তো দেখি….
—নিচে একখান, রান্নাঘর, স্নানের ঘর।
—দোতলায়?
—একখান বড় ঘর।
—আপনি তো একা মানুষ। আমাকে অন্তত সঙ্গে রাখুন।
—নিজের বাসায় একা থাকব, সেই আনন্দেই মশগুল হয়ে আছি—যারে কয় বিভোর!
—এ টাউনে আপনি একটা রহস্য হয়েই থাকলেন।
—রহস্য থেকেই চলে যাব।
—অবশ্য এটা সবাই বলে, যেভাবে দাদা—বউদির সেবা করেছেন…
—এর শতগুণ করলেও যথেষ্ট হত না।
—সন্ন্যাসী হবেন না তো?
—ধুর মশাই! ধপধপে জামা ধুতি পরি, লাইব্রেরিতে যাই, সভাসমিতিতে ডাকলেই যাই। এগুলো কি সন্ন্যাসীর লক্ষণ?
—বয়সও ….
—বয়সকেও আমি প্রশ্রয় দিই না।
—আপনার দাদা কিন্তু এমন টগবগে ছিলেন না।
—একো জন, একো রকম।
—বাড়িটা হচ্ছে, দোতলা সিঁড়ি?
—স—ব দেখতে পাবেন।
—গৌরাঙ্গকে দিয়েই করাচ্ছেন?
—প্রতুল গুহর ছেলে! ওর বাপ জেলে আমাকে দেশে দেশে বিপ্লবের ইতিহাস পড়িয়েছিল। বললাম, তোমার ফার্মের নাম আছে। সরকারি ঘরবাড়ি বানাও। এটা করে দাও। সে তো বলছে, কাকা পাগল। একটা পাগলের বাড়ি বানাচ্ছি। গৌরাঙ্গের তৈরি বাড়ির বৈশিষ্ট্য তা দশ বছরে ভেঙে পড়ে না।
—আপনার….কথাই আলাদা। তা নিচে থাকবে কে?
—ন্যালা আর ন্যালার মা, আর কে?
এই ন্যালার কথাও তো সূত্র নির্দেশপূর্বক ব্যাখ্যা করা উচিত। এটা ঘটনা, যে ন্যালার বাবা যোগীন এবং আমরা, একই জেলার একই গ্রাম থেকে আগত। বস্তুত টাউনে পৌঁছে যোগীনকে প্যাডলার হিসেবে দেখে দাদা ও বউদি খুবই আনন্দিত হন।
যোগীনরা সবাই পুবপাড়ায় এসে উঠেছিল। অধিকাংশ প্যাডলার। কেউ সবজি ও মাছের ব্যাপারী,—ওদের বউ বিটিরা শহরে ঝি খাটতে শুরু করে।
এটা খুবই স্বাভাবিক, যে যোগীনের অকাল মৃত্যুর পর ন্যালার মা এবং ন্যালা এ বাড়িতে বহাল হবে। ন্যালা বরাবরই অপরিণত মস্তিষ্ক। বয়স হলে কী হবে, ওর বুদ্ধিসুদ্ধি বাড়ল না। আমার তেজস্বিনী বউঠান ওকে ক্লাস টু পাশ করাতে পারলেন না।
দাদাকে ও বলত, বড় কত্তা দাদা।
বউদিকে বলত, কত্তা মা।
আমাকে বলত এবং বলে, ছোট কত্তা দাদা।
যতিনাথ, মাধবী, এরা একদা যোগীনকে ”যোগীনদা” বলেছে। ন্যালাকে নিয়ে ন্যালার মা একটা আশ্রয় পেয়ে খুব অভিভূত হয়ে পড়ে।
ন্যালা বাগানের কাজ করতে, বাজার দোকান করতে, গাছে জল দিতে, দরকারে বিছানা মাদুর রোদে দিতে, কয়লা ভাঙতে, সব কাজে খুব উৎসর্গিত প্রাণ। কিন্তু লেখাপড়া বিষয়ে ওকে আগ্রহী করাই গেল না।
ন্যালার মা সাহায্য করত অন্যান্য কাজে। ওর একটা স্বপ্ন ছিল, যে কোনদিন ন্যালাও তার বাবার মতো সাইকেল রিকশা চালাবে। কিন্তু ন্যালা যোগীন নয়। উদ্বাস্তু যোগীন মণ্ডল যখন চলে আসে, পিছনে অপার জমিজমা ফেলে আসেনি। ন্যালার মা ওর দ্বিতীয়া। প্রথমা ও তাঁর ছেলেরা উচ্চাশাতাড়িত ছিল। শুধু খাটাখাটনির ক্ষমতা ও বুদ্ধির জোরে তারা এক ঘুমন্ত শহরের অর্থনীতিক জগতে গর্ত কেটে ঢুকে পড়ে।
আমি তো ওই প্রথম দিকের উদ্বাস্তুদের সেলাম দেই। জমি চাষ, পুকুর সংস্কার ও মাছ চাষ, সম্বৎসর কায়িক পরিশ্রমের কাজ, কী তারা করেনি। তারা তো ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক স্কুলেও ভর্তি করেছে। প্রথম ব্যাচের উদ্বাস্তুদের নাতিপুতিরা এখন তো রীতিমতো দাঁড়িয়ে গেছে। সুসংহত—শিশুবিকাশ—প্রকল্পে ওদের কিছু মেয়ে কাজ করে। শিক্ষকতায় ছেলে ও মেয়েরা তো আছেই। হাসপাতালের সামনের বাজারটি ওদেরই গড়া। আর আজ, প্যাডলারদের মধ্যে নন—বাঙাল একজনও আছে বলে জানি না। দেশে যোগীনরা স্কুলে ছেলেমেয়ে পাঠাবার কথাও ভাবত কিনা, সন্দেহ। দেশভাগের পর উদ্বাস্তু হয়ে এসেই লেখাপড়ার দিকে ঝুঁকল এমন। আটচল্লিশ বছরের চেষ্টা, শতাব্দীর শেষে ফল দিচ্ছে।
ননীবাবু যা বলে, তা হল, ওঃ! এস. সি. আর. এস. টি। সোনার চাঁদ আর সোনার টিয়া! যত ব্যাপারে ওদের কথা আগে ভাবে সরকার!
এ বিষয়ে গৌরাঙ্গের মনোভাবও অনমনীয়।
—এতে ভাল হবে না। দেশ টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। ও. বি. সি., আবার দলিত জাতি, সবাই যেন মাথা—চাড়া দিয়ে উঠেছে।
—ইতিহাসের নিয়মে ঘটছে গৌরাঙ্গ।
—আপনিও তাতে ইন্ধন জোগাচ্ছেন।
—আমি কী করলাম?
—ন্যালা ”নমো” নয়? আপনার পর টঙের ঘরে বসে থাকবে না ও?
আমি হাসলাম। অত তো ভাবিনি। গৌরাঙ্গের কথায় মনে হ’ল, ব্যাপারটি বেশ ”প্রতীকী”। গৌরাঙ্গর বেটা অরূপ এক সময়ে রাজনীতিও করত। সাহিত্য বাতিকও ছিল, কেন না কবিতার কাগজ বের করত। গৌরাঙ্গ বলত, শিক্ষা সমাপন এবং কাজে ঢোকা,—মধ্যবর্তী সময়ে ওর বাবারও সাহিত্য বাতিক ছিল, ওরও আছে।
অরূপ ভীরু ও কুণ্ঠিত হেসে বউদিকে ত্রৈমাসিক ”মর্মর” পড়তে দিয়ে যেত। বউদি মোচা বা লাউ বা থোড় কুচাত,—সামনে বসে অনেক কথা বলে যেত। ‘প্রতীকী”, ”বিমূর্ত”, ”ঐতিহ্যবাহী” এসব শব্দ ওর পত্রিকাতেই দেখেছি।
তা প্রতীকী ব্যাপারই বটে। নেউগীদের তৈরি বাড়ির দোতলার ঘরে একদিন থাকবে যোগীন মণ্ডলের ছেলে ন্যালা মণ্ডল। অপরিণত বুদ্ধি, পৃথিবীর কাছে বিনা দোষে ক্ষমাপ্রার্থী, পর্বতসানুর অরণ্যে শিশিরের মতো নিষ্পাপ হৃদয় ন্যালা অবাক কৌতূহলে জানলা দিয়ে পৃথিবী দেখবে।
সবই ইতিহাসের নিয়মে ঘটে।
ইতিহাসের নিয়মে ন্যালা ও তার মা এ বাড়িতে ঢুকেছিল। ন্যালা অপরিণত মস্তিষ্ক, একান্ত এক হাবাগোবা ছেলে। ভয় পেলে ওর কথা আটকে যায়,—বাজারের হিসাবে ভুল করে ও নির্মল হেসে বলে, অত টাকা দাও কেন? আমি দশ পনেরোর পর আর গুনতে পারি?
এ হেন ন্যালাকে মেরে মাছওয়ালা গালের চামড়া ফাটিয়ে দিয়েছিল। সে খুবই এক মস্তান মাছ ব্যবসায়ী। আধ কিলোর বাটখারাটি কেন যেন ন্যালার খুব পছন্দ হয়েছিল। কিনছিল আড়াইশো চারা পোনা,—(আদিনাথ নেউগী গ্রীষ্ম হতে বসন্ত ছয় ঋতু জুড়েই চারাপোনা খেতেন) চাপিয়ে দিল আধ কিলোর বাটখারা।
বলে, আরও দাও। আরও মাছ দাও।
পরিণামে গালে চড়। ন্যালা কেঁদে কেঁদে বাড়ি এল। মৃণাল ঠাকরুণ বললে আমি মরতে পারি,—লক্ষ্মণ নয়, আমি লক্ষ্মণাতীত এক দেবর,—সে মস্তানের ব্যবস্থা করেছিলাম।
কিন্তু ন্যালাকে বোঝাতে পারি না যে ভুলটা তোর হয়েছিল।
সে সময়টা আবার রুমার চিকিৎসার এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে। বিনি সে চিকিৎসার বিশদ বিবরণী দিয়ে চিঠি দিয়েছে।
বউদি দেখলাম, ন্যালার গায়ে হাত রেখে বসে আছেন।
বললাম, আজ কি আমাগো উপাস? না আপনে কোনও বর্ত করছেন?
বউদি নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, না ঠাকুরপো, দেই! ভাবতে আছিলাম, রুমার মতোই তো ন্যালা! একোই অসুখ! ন্যালারে কেও মমতা করে না।
মনে মনে বললাম, আপনে করেন! যার আপনে আছেন, সে তো পুণ্য কইরা আইছে। সেদিনই বুঝেছিলাম, কেন ন্যালার প্রতি ঠাকরুণ এমন বিশেষ দৃষ্টি দেন, ওকে বাঁচিয়ে চলেন।
ন্যালার মা—র কোনও নিজস্ব নাম আছে কি না আমরা জানতে পারিনি। সে হট্টাকট্টা, মজবুত হাড়ের স্ত্রীলোক। ভূতগত না খাটতে পারলে তার ঘুম হয় না। ভূতগত খাটলে সে হাঁপায় না। চোখ মুখ নির্বিকার থাকে। গাছ থেকে নারকেল খসে পায়ে পড়ল, আঙুল ছেঁচে গেল। খানিক চুন হলুদ লাগিয়ে ও কাজে নেমে পড়ল। চোখে মুখে ভাব বদলায় না।
দাদা আর বউদি, দুজনেরই শেষ সময়ে দেখেছি ওর সেবা করা, জেগে থাকা। বড়জোর শেষ রাতে আমাকে ডেকেছে, ছোট কত্তা! বসেন গিয়া। আমি একটু চক্ষু বুইজা লই।
এখন যে বাড়ি এত খালি,—ন্যালার মা আছে বলে আমাদের তিনজনের সংসার চলে নিঃশব্দ নিপুণ পরিচালনায়।
সেদিন নারকেল পাতা চাঁছতে চাঁছতে বলল, ন্যালারে বিয়া দেওন কি উচিত হইত? বনমালীর বউ খুব ধরছে।
বললাম, কিছুকাল দেরি কর রে মা! অদের বাড়ি অরা বুইঝা নিক, তারপর!
ও নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমিও বুঝি যে দেহ য্যান কয়, পারতেছি না। অহনে তারা নাই। আপনেরও বয়স হইল, আমিও একদিন … অরে কে বা ভাত জল দিব?
বউদি অত বলতেন, তখন রাজি হইলে মা! তিনি শান্তি পাইত।
—ন্যালার ফাঁড়া আছিল।
আমি কাগজ পড়ছি, ও নিপুণ দক্ষতায় নারকেল পাতা চেঁছে যাচ্ছে। খরশাণ বঁটি।
—ন্যালার পোলাও কি অর মতো….?
—না রে মা! তেমুন কুনও ডাক্তার কয় নাই।
—তয় বাড়ির বেপার মিটলে অর বিয়া দিতাম! অরে দেখত কে?
—তাই কইরো রে মা!
মনে মনে অবাক হলাম। এত নির্বোধ কেন আমি? আমি ন্যালাকে আমার স্বপ্নের বাড়িটি দিতে চাইছি। কিন্তু মায়ের মন আসল কথাটি ধরেছে। আমি নেই, ও নেই, তেমন পৃথিবীতে ন্যালাকে দেখবে কে?
—বনমালীর ভাইঝি খাটাপিটা মাইয়া। বয়সও বিস্তর। দাঁত উচা, চক্ষু টেরা, তাতেই বিয়া হয় নাই। বনমালীরাও কুটুম হইব।
—তাই হইব গো মা!
—কত্তা মা সরগ হইতে আশীর্বাদ দিব।
—আমি কি দিতাম না?
—আপনের কথা আলাদা। মরবেন একদিন ঠিকোই, সেদিন মুনি রিষির মতো ধু ধু কইরা পুণ্যবলে জ্বইলা যাইতেন। ক্যারেও কিছু করতে হইত না।
আমার এখন ভাবমূর্তি? ন্যালার মায়ের চোখে আমি এত বড় পুণ্যাত্মা?
বললাম, পুণ্যবানেরেও মশায় খায় রে মা? মশারিটা এট্টু সাইরা দিও।
—দিছি। কাইচাও দিছি।
ন্যালার মা মাসে দু’বার আমার বিছানা কাচে। ধুতি, গেঞ্জি, লুঙ্গি, পাঞ্জাবী, খাদির গামছা, সবই কাচে প্রত্যহ। দোকানে ইস্ত্রি করায়।
নারকেল কাঠি ও বেচবে। নারকেল পাতা, ঝরা ডালপালা দিয়ে ও বাগানে উনোন জ্বালে। তাতে মাঝে মাঝে সোডা সাবানে সিদ্ধ হয় চাদর, পর্দা, ওদের কাপড় চোপড়।
সব চলে স্বর্গতা (এটা কথার কথা, স্বর্গ বা নরক বিষয়ে আমি ঘোর অবিশ্বাসী) মৃণাল ঠাকরুণের নিয়মে। যেন যে কোনও সময়ে পর্দা সরিয়ে তিনি মুখ বাড়াবেন।
আমরা নিয়োগীরা কয়েক পুরুষ ধরেই ইতিহাসের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে চলেছি এক ভয়ঙ্কর বিভ্রমের শিকার হয়ে। এ বিভ্রম কী, তা বুঝলেই বোঝা যাবে আদিনাথ কেন ঘোরানো সিঁড়িটি কিনেছিলেন।
এই বিভ্রম আর কিছুই নয়, ইতিহাসের বুকে নিজেদের নাম চিরস্থায়ী করবার প্রয়াস।
বংশবৃক্ষ আমি দেখিনি। কিন্তু পিতামহের মুখে শুনে শুনে সাপের মন্তরের মতো আউড়ে যেতে পারি। দাদা এ টাউনে বাড়ি করার সময়েও আমি বাধা দিয়েছিলাম।
বলেছিলাম, বাড়ি করবি কেন?
এখানে বলে রাখা দরকার, আমার পিতামহীকে অনেক দেখে আনা হয়েছিল, কেন না তাঁদের বংশের মেয়েরা সকলেই পুত্র প্রসবিনী।
আমার পিতামহও অনুরূপ কোনও বিবেচনায় আমার পিতামহীকে বিয়ে করেন।
পিতামহ বিশ্বনাথ বড়ই ব্যতিক্রমী মানুষ ছিলেন অনেক কাল। যে দিনকালে ”ছেলে রোজগার করলে তবে বিয়ে”,—বঙ্গভূমির চিন্তাধারাতেই এ দূষণ প্রবেশ করেনি,—তিনি সে যুগেরই বঙ্গসন্তান।
হতে পারে তাঁর কপালে আব ছিল,—কিন্তু বেটাছেলের কপালে আব আজও বিয়ের প্রতিবন্ধক নয়। তখনও ছিল না।
”রোজগার করি, তবে বিয়ে করব” বলে তিনি গ্রাম ত্যাগ করেন। রোজগার হয়নি, দেশ ভ্রমণ হয়েছিল। তখন ঢাকা থেকে ফরিদপুর বা বরিশাল বা রাজশাহী গেলেই তা দেশভ্রমণ বলে গণ্য হত।
ষোলো বছরে গৃহত্যাগ করে বাইশ বছরে তিনি ফিরে আসেন। এমন বাংলা ও অঙ্কে পারদর্শী, বহুদর্শী যুবককে জমিদার ডেকে সেরেস্তায় বসান। সেকালের নিয়মে তাঁর তিন টাকা মাইনে হয়। নায়েব বা গোমস্তার মাইনে নগণ্য হত। প্রজা ঘরে আদায় করেই তাঁরা সম্পত্তি বানাতেন।
বিবাহও হ’ল। শুনেছি পিতামহী সুন্দরী, মোটাসোটা এবং দজ্জাল ছিলেন। সম্পত্তি, আয়পয়, সবই হয়েছিল। কিন্তু পিতামহী ছয় কন্যা ও এক পুত্রের জন্ম দেন।
আমাদের সেসব পিসিমাদের কার কোথায় বিয়ে হয়, কিছুই জানতাম না। তবে আমি যখন অনেক পরে ”ইংরেজ রাজ! ভারত ছাড়ো” করছি, তখন প্রথম যে দারোগার হাতে ঠ্যাঙা খাই, পরে তিনি বলেছিলেন, তিনি আমার মেজ পিসির ছেলে।
পিতামহ বিশ্বনাথ, পিতা গীতানাথ, কিন্তু প্রপিতামহ ছিলেন শশাঙ্কমৌলী। মনে হয় এঁরা অ্যাডভেঞ্চারাস ছিলেন। প্রপিতামহের পিতা শান্তাহারের কাছে বামুনপাড়া নামক গ্রামে জমিজমা করেছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল ”মাট্যা দোতলা” ঘর বানাবার। মাটির দোতলা ঘর কয়েকটি তুলেছিলেন। সবাই বলত ”নেউগীবাড়ি”।
প্রপিতামহ কেন বামুনপাড়া ছেড়ে ঢাকায় গোবিন্দপুর গ্রামে আসেন, তা জানি না। তাঁর অবশ্য চার ছেলে ছিল, এমন শুনেছি। অর্থাৎ পিতামহের আরও ভাই ছিলেন।
এও শুনেছি, প্রপিতামহের মৃত্যুতে প্রপিতামহী ”সতী” হতে মনস্থ করেন। কিন্তু এক বেয়াড়া ‘কায়েত দারোগা” এ সংকল্পকে বাস্তব হতে দেননি। পরে প্রপিতামহীর ইজ্জত খুব বেড়ে যায়, কেন না তিনি ”সতী” হতে চেয়েছিলেন। ইনি মটকা বা তসরের থান পরতেন, মাথা নেড়া করেছিলেন এবং হবিষ্যান্নের বদলে আম, কলা, কাঁঠাল ইত্যাদি ফল এবং দুধ—দই—ক্ষীর খেতেন।
গোবিন্দপুরে এসে প্রপিতামহ আবার কুহকিনী ইতিহাসের প্রলোভনে ফেঁসে গেলেন।
—”ইট পুরাইয়া দালান দিমু” বলে বসলেন। বললেন, ভবিষ্যতে আমার পোলারা দালান রক্ষা করবে। এই গ্রামে নেউগীদের নাম অক্ষয় হইব।
অক্ষয়চন্দ্র মুস্তাফি (”সরল পাটীগণিত” খ্যাত ভূষণচন্দ্র মুস্তাফির পিতামহ) পই পই করে নিষেধ করেন প্রপিতামহকে।
—নবাবী আমলে যারাই দালান দিছে, তারাই সবংশে মরছে। তাছাড়া নদী তীরে বাস! এই নদী কীর্তিনাশা! এমুন কাম করবেন না।
কে শোনে কার কথা! আমার বাবা যেমন বলতেন, হোআট ইজ পুরুষ মানুষ, বাট জেদ?
পুড়ল ইট, উঠল দালান। গ্রামে দালান বাড়ি কার? না নেউগীদের! দালান বাড়ি হ’ল, অন্দরের মহিলাদের পুকুর হ’ল ; —বাইরে বারোয়ারি পুকুর। পুকুরে কাছিম আনিয়ে ছাড়া হ’ল। খুব ঢাক ঢোল! খুব ধুমধাম!
গোবিন্দপুরে নেউগী বাড়ি কোথায়? গোবিন্দপুরই বা কোথায়। ডাউন দি ড্রেন নয়, ডাউন দি রিভার। সে নদীর নাম কীর্তিনাশা নয়। কিন্তু যে নদী মন্দির—মসজিদ— ইমারত— দালান—কুটীর—শস্যক্ষেত্র খেতে খেতে যায়, সেই কীর্তিনাশা। নেউগীদের নাম চিরস্থায়ী হবে, একই বাড়িতে পুত্র—পৌত্র—সবাই ক্যালব্যাল করবে,—জন্ম—উপনয়ন—বিবাহ—মৃত্যু—বৈধব্য—তীর্থভ্রমণ—স্ত্রী—কোন্দল—ভায়ে ভায়ে বিবাদ পূজা—ব্রত—গুরু দীক্ষা ইত্যাদির চক্র ঘুরতে থাকবে,—দেয়ালে অনেক বসুধারা আলপনা,—ঠাকুরঘরে মৃতদের পায়ের আলতার ছাপ দেয়া কাগজ থাকবে,—সে স্বপ্ন আক্ষরিক অর্থেই জলে গেল। এক অর্থে ওই বাড়ি এবং ঘোরানো সিঁড়ি, দুরাশারই প্রতীক। এক স্বর্ণমৃগ প্রজন্ম হতে প্রজন্মে আমাদের ঘোল খাওয়াচ্ছে।
আমাকেও ছাড়ল না। ন্যালা এবং দোতলা।
পিতামহ বিশ্বনাথ দেশভ্রমণ ও জ্ঞান আহরণের পর যে জমিদারের সেরেস্তায় ঢুকলেন, তিনি পিতামহকে বসত করালেন রংপুর—নীল—ফামারিতে।
সেখানেই তিনি সেরেস্তায় নায়েব। সাদা টাট্টু ঘোড়া চেপে মৌজা দেখতেন।
নেউগীরা পৃথিবীর মায়া কাটাবেন না বলে মনে মনে উদাসীন সাজে সেজেছিলেন। যিনি বাইরে বেরোতেন, তিনিই আর ফেলে আসা ঘরে ফিরতেন না, এটা ঘটনা।
প্রপিতামহ তস্য পিতা, ভাই, বোন, আশ্রিত পরিজনের খবর রাখতেন না। প্রবণতাটা পাশ্চাত্য জগতের মতো। নিজেরটুকু নিয়েই থাকতেন। বামুনপাড়া থেকে গোবিন্দপুর থেকে নীলফামারি, কী অসম্ভব দেশ—দেশান্তরে খুঁটি পুঁতে ঘর বানানো!
এরপর কেন তিনি পাবনা চলে আসেন, সে ইতিহাস অলিখিত।
পাবনা জেলাতেই দুর্গাবাড়ি গ্রামে তিনি বসত করেন। যথারীতি সেখানেও তিনি নেউগীদের এক বিশাল বাড়ি তৈরি করেন। এ বাড়ির বর্ণনা আমি খুব শুনেছি। শুনে শুনে ফুরাত না।
বাবা বলে যেতেন স্মৃতি থেকে। ততদিনে কথা বলার রীতিতেও পাবনার টানটোন ঢুকে পড়েছে বলে বুঝি। বাবা অবশ্য ছয় বোনের পরে এক ভাই, একমাত্র ভাই তিনি।
স্ত্রী—জাতির অ্যাটেনশান খুব পেয়েছিলেন। বোনদের কোলে কোলে ঘুরতেন। ছয় বোনে ভাইফোঁটা দিত। তিনি চাকরের কাঁধে চেপে পাঠশালা যেতেন। পাশের গ্রামে হাই স্কুল ছিল। ফলে ম্যাট্রিকও পাস করেন,—পাবনা টাউনে কলেজেও যান।
তখন অবধি তিনি নেউগী বংশের সবচেয়ে উচ্চ শিক্ষিত লোক আই.এ. ফেল।
সেই বাড়ির বাইরে ছিল কাছারি ঘর, যেখানে বসে পিতামহ কাঞ্চনমূল্যের বিনিময়ে আমিনের নক্সা চেকের কাজ করতেন।
কাছারি ঘরের মুখোমুখি ঠাকুর মণ্ডপ। কেন নেউগীরা দুর্গা, লক্ষ্মী, কার্তিক, কালী, জগদ্ধাত্রী ইত্যাদি পূজায় অধিকারী ছিলেন না, তা আমার জানা হয়নি।
অন্দর মহলে প্রশস্ত উঠানের চার কোণে চারটি বড় বড় মাটকোঠা ছিল। টিনের ছাউনি দেওয়া।
পিতামহী জলচৌকিতে বসে সংসারের তদারকী করতেন। এক জামাইকে ঘরজামাই রেখেছিলেন। ফলে সংসারে ছেলেপিলের অভাব ছিল না। কিন্তু ছেলের ঘরের নাতিপুতি, সে না হলে কি মন ভরে? বাবার আবার গ্রামের জীবন খুব নিস্তরঙ্গ লাগত।
গ্রামে তাঁর সময় কাটত তারানাথ মৈত্রের সঙ্গে। তারানাথ ও বামানাথ গ্রামে স্বদেশী হাওয়া এনেছিলেন। তাঁরা মাঝে মাঝে ভিটা দর্শনে আসতেন। গ্রামদেবতা ভদ্রকালীর পূজায় অবশ্যই আসতেন। বাবাকে তুইয়ে তুইয়ে তাঁরা কলকাতায় আনেন। সেখানে তাঁদের কুমুদ্রিত এবং প্রায় বাজেয়াপ্ত হওয়া কাগজের প্রেসে চাকরি দেন। কাগজের নাম আজ ”ভৈরব” তো কাল ”স্বরাজ”, কাল ”স্বরাজ” তো পরশু ”ভৈরী”। অবশেষে পিতামহ জানতে পারলেন, তারানাথ তাঁর মেয়ে শশীপ্রভার সঙ্গে পিতার বিয়ে দিচ্ছেন।
এ বিয়ে নিয়ে দুই পরিবারে এক প্রখ্যাত কলহ বাধে। তারানাথের মেয়ে শশীপ্রভা রাঁধে বাড়ে, সকলকে পরিবেশন করে ভাত, ইলশার মুড়ো দিয়ে কচু শাকের ঘণ্ট, ইলশার ঝোল, তেঁতুলের টক।
ওইটুকুই যা দেখা শোনা। কিন্তু পিতামহ বেজায় খেপে যান। বলেন, বড় ঘরে বিয়া দিতাম। তারা সোনায় সাজাইয়া দিত। মাইয়া দেখাইয়া আমার পোলারে ভোলাইছে।
পোলা অবশ্য মাইয়ার, অথবা আমার মায়ের হাত ও পা ছাড়া কিছুই দেখেননি। তখনকার নিয়মানুযায়ী তারানাথ ও বামানাথের প্রেসে যারা কাজ করত, আসত যেত, সকলেই তাঁর বাসাতেই খেত। সকালে মুড়ি গুড়, বড়জোর নারকেল কোরা,—দুপুরে ও রাতে ভাত। শশীপ্রভা পরিবেশন করতেন সর্বাঙ্গ আঁচলে ঢেকে। শশীপ্রভাকে বাবা মুখ তুলে দেখেননি। তারানাথই প্রস্তাবটি করেন পিতামহের কাছে। কারণ? অন্য মেয়েদের বিয়ে দূরে দূরে হয়েছে। ছোট মেয়েটিকে তিনি একটু মাঝে সাঝে চোখের দেখা দেখতে চান।
পিতামহী যথেষ্ট ফোঁসফোঁস করেছিলেন। কিন্তু ছেলেকে স্বগ্রামে বিয়ে দেবার জন্য লোভও হয়। তেরো বছরের এক ছলছলে বালিকা,—ভদ্রকালীর পুজোয় তাকে দেখেছেন, বেশ মেয়ে!
মেয়ের বাপ—মা যেখানেই থাকুন, মেয়ে তো থাকবে তাঁর কাছে। মেয়ের ঘরের নাতিনাতনি নিয়ে তিনি কতকাল ঘর করবেন?
পিতামহ অচল, অটল।
এই বড় বড় কোঠা, কাঁঠাল কাঠের চৌকি ও সিন্দুক, কয়েক সিন্দুক ঠিকরে দেওয়া বাসন কোসন, এ কি কম বৈভব?
জমির ধানের চাল আছে, গোহালে গরু আছে। বুকের সবচেয়ে গভীরে আছে বিশ্বনাথ নেউগীর আটচালা মাটকোঠার পর মাটকোঠা। বাইরে থেকে অন্দর দেখা যায় না, কলকে ফুলের গাছের বেড়া।
নেউগী বাড়ি বললেই সবাই চেনে।
বউ আনবো সলপ বা সিরাজগঞ্জ থেকে। বস্তুত সিরাজগঞ্জের সান্ন্যালরা বিশ্বনাথের ছেলেটিকে মনে মনে বেছেই রেখেছেন। তাছাড়া, তারানাথ ও বামানাথ, এ গ্রামে সাবজেকট অফ সাসপিশাস। কেন তারা সাহেব তাড়াতে চায়?
কেন তারা স্বদেশী—করা ছেলেদের বাড়িতে রাখে? কেনই বা শোনা যায়, তারা ”অনুশীলন” বা ‘যুগান্তর”, কী সব দলের সঙ্গে আছে?
পিতামহী বললেন, লয়েন, আরও বাড়ান বিষয় আশয়। ভোগ করব মেয়ে জামাই।
—সকলই গীতানাথের।
—আমি তো মাইয়া মন্দ দেখি না। বাপ—জ্যেঠা সন্ন্যাসী বললে হয়। ওই মাইয়া সংসার চালায়। অর মা বাতে বিছনায় পইড়া থাকে। জ্যেঠি আজ কলকাতা, কাল তারানগর ছুটে। সে তো বাপের বাড়ি চিন্যা থুঁছে।
—আরে! এই যে সম্পত্তি কইরা থুছি, এ তো পোলার লিগ্যা। জমজমাইয়া বিয়া দিমু, নবীন সান্ন্যালরে শ্বশুর পাইব। সরকারি উকিলরে শ্বশুর পাওয়া কম ভাগ্যের কথা? মাইয়ারে দিবে কী জান?
—ছি ছি! পোলা ব্যাচবেন?
—তোমার পোলারে সরকারি চাকরি কইরা দিবে। গরমেনের চাকরি, ভাবতে পারো? দুর্গাবাড়িতে পোস্ট মাস্টার হইছে একা নবনী রায়। তাতেই তার লেজ ফুইলা কলাগাছ। পূজায় আইল, তো খালি ইংরাজি শুনায়।
—দেহেন আপনি! আপনাগো বংশে কে বা পোলা লইয়া ঘর করছে? কে বা এক ভিটায় তিন পুরুষ থাকছে? আমার কই এক পোলা! ছয় মায়্যারে ভাল বংশে দিছি। পোলার মনে বেথা দিয়া আমি কাম করুম না। হেয় যাতে মন সন্তুষ্ট, হেই করুক।
পিতামহ কিছু থতমত খেলেন। কিন্তু স্ত্রী—বুদ্ধির কাছে পরাজিত হতেও কিন্তু কিন্তু লাগছিল। কিংবা নিজের জেদটি বড় হয়ে উঠেছিল। ছেলেকে তিনি পত্র লিখে গ্রামে ফেরার জন্য হুকুম দিলেন।
তা—না—না—না করে বাবা আষাঢ়স্য চতুর্দশ দিবসে গ্রামে এলেন। তিনি এক নৌকায়, আরেক নৌকায় সপরিবারে তারানাথ ও বামানাথ।
তারানাথ ছিলেন খর্বকায়, তেজস্বী, গৌরবর্ণ, অতীব ক্রুদ্ধ। তিনি পিতামহকে গোপনে যা বললেন, তেমন কথা ১৯১৬ সালে অন্তত কেউ কোথাও শোনেনি।
তারানাথ কাঁপতে কাঁপতে (রাগে) বললেন, মায়্যা বই কাগজ পড়ে, তার বুদ্ধি পাকছে। আপনের পোলা কই, দ্যাবাংশী পোলা! কুনোদিন তারে চাইয়া দেখে নাই। বিয়া ঠিক করছিলাম মাইয়ার। আমার বড় বউঠানের ভাস্তা। আদালতে কাম করে, হুনারি পোলা। বউ মরছে, বিয়া করবো। তা আমরা কথাবার্তা কইত্যাছি, এমুন সময়ে ছুড মাইয়া চিল চিৎকার করল।
—ক্যান? ক্যান?
—আমার মাইয়া এক গাছ দড়ি লইয়া ঘরে গিয়া দরজা দিছে। হয় গীতানাথের লগে বিয়া দেও, নয় গলায় দড়ি দিমু, নয় পুকুরে ডুইবা মরুম। গাল পাইরা রাখি নাই কিছু। মাইয়ারে কাটতে বাকি রাখছি।
—অহন আইলেন বা ক্যায়?
—অরে বিয়া দিয়া ফিরুম। কী আছে! রায় বাড়ির সুবইল্যা খায়, দায়, ভেরেণ্ডা ভাজে, অর লগেই বিয়া দিমু। যান, পোলার বিয়া দেন গা!
এমন চমকপ্রদ ঘটনা দুর্গাবাড়িতে কেন, আশপাশেও ঘটেনি। শশীপ্রভা দ্বাদশোত্তীর্ণা বালিকা মাত্র, গীতানাথের বয়স কুড়ি। গীতানাথ এসে চৌকিতে চিত হয়ে পড়লেন। বিশ্বনাথ বারবার গালাগালির গোলাবর্ষণ করলেন, ছেলে নিরুত্তর।
শুধু তাই নয়। কারও সঙ্গেই তিনি কথা বলেন না। শোনা যাচ্ছে ও বাড়িতে মেয়েও অন্ন জল ত্যাগ করে পড়ে আছে।
গ্রামে অনেক গুজব দৌড়তে লাগল। এমন ঘটনা আগে ঘটেনি কখনও। কোনও মেয়ে বলেনি, ওই যুবকটিকে বিয়ে করব।
এর মূলে কী আছে? কলকাতা বাস? বই কাগজ পড়া? থিয়েটার দেখা?
সে তো হতে পারে না। তারানাথের বাড়ির মেয়েরা যোগে গঙ্গা স্নানে যায়, থিয়েটার দেখে না।
এক হাতে কি তালি বাজে?
দু’হাতে কি বাজেনি?
আগেই বলেছি, পিতামহী দজ্জাল ছিলেন। তখনকার দিনে তিনি স্বামীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন।
—মেয়ে যে অন্নজল ত্যাগ করেছে, সে মরলে তো আমরা পাতকী হব।
তারানাথের ”স্বদেশী দোষ” আছে, সে বাড়িতে থাকত গীতানাথ,—সব জেনে শুনে সান্ন্যাল, সরকারি উকিল, মেয়ে বিয়ে দেবে?
—মাইয়া কই মন্দ নয়। চলাফিরা ভাল। চক্ষু নামাইয়া কথা কয়। হ! জিদ বিস্তর! তা আমার পোলারও তো মাজাভাঙা, ভিতু! এই বিয়া দেন,—যত কথা উঠছে, হকল চাপা পইড়া যাবে।
পিতামহ বললেন, হারামজাদায় আমারে জুতা মারল। ছি ছি ছি!
—তয় কি পোলার মরা মুখ দ্যাখবেন? হেয় তো খাওয়া ছাইরা দিছে। আর! এ বিয়া যদি না হয়, বামুনের বিটি আপ্তঘাতী হয়, আমাগো পাপ হইত কি না বলেন!
হাহাকার করতে করতে বিশ্বনাথ ও তারানাথ বেহাই হলেন। তুমুল বর্ষণ,—মণ্ডপঘরে বিয়ে হ’ল। শশীপ্রভা তেমন অলঙ্কার আনেননি। পিতামহী তাঁর গয়নায় সাজিয়ে বউ ঘরে তুললেন।
বললেন, ন্যাও! অহনে ঘর সংসার করো, শ্বশুররে দ্যাবতা জানবা,—এই সেজ ননদ ঘরে থাকবো। আর পোলাপানরে দেখবা। আর! আমারে নাতি নাতিন দাও। সেই হুতাশে তোমারে আনছি।
কেন শশীপ্রভা খেপেছিলেন?
পাগলামি, নির্লজ্জতা, কী?
তার নাম প্রেম।
নেউগী বাড়িতে প্রাকবিবাহ বা বিবাহোত্তর প্রেম কেউ জানত না। প্রেম তো হ’ত না, বিয়ে হত।
আমার মাকে আমার যেমন মনে পড়ে,—স্বল্প বাক, সংযত, সভ্য, মার্জিত।
বাবার সগুম্ফ, বাঁকা সিঁথি, শার্ট, ধুতি ও বুট পরিহিত, কাঁধে চাদর,—প্রত্যহ গরম দুধ খেয়ে পেট বাজাতে বাজাতে শৌচালয়ে যেতেন,—ওঁদের বিয়ের মূলে প্রেম, তা ভাবতেও আমার দাদার আশ্চর্য লাগত।
মা মানে কঠোর নিয়মের শাসন। স্কুলে খারাপ ফল করলে কয়েকদিন খেলাধূলা বন্ধ। মা মানে, মোটা ভাত, ডাল, মাছের ঝোল ও পাতলা দুধ। মা মানে খাকি শার্ট ও হেঁটো ধুতি। জন্মদিন মানে পায়েস। মাসে মাসে বাধ্যতামূলকভাবে পিতামহ এবং মাতামহকে চিঠি লেখা।
এই বিয়ের পর কি বাবা দুর্গাবাড়িতে থিতু হয়ে বসেছিলেন?
না, না, না।
নেউগী বংশের কপালে ঘুরণপোকা।
১৯১৬ সালে বিবাহ। ১৯২০ সালের সাতাশে জ্যৈষ্ঠ মা যমজ ছেলে প্রসব করেন।
আদিনাথ সাত মিনিটের বড়, তাই সে দাদা।
আমি সাত মিনিটের ছোট, তাই আমি অনুজ।
দুর্গাবাড়িতেই জন্মাই আমরা। পিতামহ গ্রামে দই কাঁচাগোল্লা বিতরণ করেন, গিনি দিয়ে আমাদের মুখ দেখেন এবং মাকে মটরমালা দেন।
বাবা তখন নটাকোলে মাস্টারি করছেন।
নটাকোলই আমার স্মৃতিতে দেশের বাড়ি। মাস্টারি করার মূলেও মায়ের চাপ।
—শিক্ষকের কাজ ভাল। তারা ছেলেদের শিখায়। বিদ্যার তুল্য কী আছে?
নটাকোলে বাবা শিক্ষক, মা থাকেন দুর্গাবাড়ি। পিতামহ আছেন, পিতামহী আছেন, জাজ্জ্বল্যমান সংসার। তবে বুঝি, সেজ পিসিমা সুরধুনীর মনে ভয় ঢুকেছিল। বাবা দেখে শুনে অনাত্মীয়, অবান্ধব জামাই এনেছিলেন। তিনি পাঁচটি মেয়ের বিয়ে দিকে দিকে দেন। অনাথবন্ধুকে ঘরজামাই রাখা মানে তাকে অন্তত স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানকে দুধে—মাছে রাখবার ব্যবস্থা করে দেবেন।
ভাই বউ যে যমজ ছেলে বিইয়ে বসল, আর তো ভরসা রাখা চলে না। এনিয়ে ঘরে স্বামী স্ত্রী কানাকানি, পরে মা—বাবার সঙ্গে সক্রন্দন কোন্দল, পরে ভাই বউকে গালাগাল ইত্যাদি শুরু হ’ল।
শশীপ্রভার মৃদু উক্তি, ”আদিনাথ, সতীনাথ যেমন, ওরাও তেমন থাকবে।”
—তোমাগো গোলাম হইয়া?
এই পিসি চিরকালই পিতামহের রান্নাবান্না সেবা যত্ন করেছে, মায়ের মাথায় জবাকুসুম তেল মাখিয়েছে। রান্নার ভার ভাজকে ছাড়েনি।
এখন সে মহাকোন্দল আর কান্নাকাটি জুড়ল। ছুটি কাটাতে এসে কেচামেচা গীতিনাথ বললেন, হাত পুড়াইয়া কতদিন খাইতাম? অনুমতি দেন, অগো লইয়া যাই।
ঠাকুরদা বললেন, অ রে মূর্খ! বামুনের বলদ! একবার বারাইলে অরা সব লইব।
—সেজদিদিরে দেন অর্ধেক।
সে তো পিতামহ পারেননি। এনিয়ে বছর তিনেক জল ঘোলা হয়। পুত্রকে দেয় ভূসম্পত্তি। কন্যাকে কে দেয়?
—তারে তো আপনিই বসাইছেন।
—ঘর তুইলা দিতে পারি, জমি কিন্যা দিতে পারি। ঘরবসতের খরচ দিতে পারি, এ বাড়ির ভাগ দিতে পারি না। তরে ভাইবা সব করছি।
—সেজ জামাইদাদা তো আকম্মা। খায়, ঘুমায়, আর রায়বাড়ি যায়। রাখতে পারত না কিছু।
—তয় কী করন?
—ভাবেন। নেয্য যা হয়, তাই করেন।
দুর্গাবাড়িতে নেউগীদের স্থায়ী বসতির স্বপ্নের গোড়ায় ঘুণ ধরেছিল। অর্ধেক নয়, এক তৃতীয়াংশ মেয়ের নামে লিখে দিয়েই বিশ্বনাথ ভেঙে পড়েন। কোথায় তাঁর সুযোগ্য, শিক্ষিত, আই—এ. ফেল, কোটের উপর উড়ানি ফেলা পুত্র!
আর কোথায় নির্বোধ হাসি মুখে মেখে গোটা কাঁঠাল ও এক কাঠা মুড়ি খাওয়া জামাই! যে রাতে ঘুমায়, দুপুরে ঘুমায় এবং কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় জীবিত, ভূমিষ্ঠ হয়েই মৃত, কয়েক মাসে মৃত সন্তানদের জন্ম দেয়।
পিতামহীও কম মর্মাহত হননি। মা আমাদের নিয়ে নটাকোল গমনের পর তিনি মরাকান্না কেঁদে শোক করেছিলেন।
পিতামহ গেলেন শোথ জ্বরে।
পিতামহী গেলেন নটাকোলে ছেলে—বউয়ের সেবা নিয়ে। আসার কালে সর্বস্ব গয়নাগাঁটি, বাসনকোসন, নৌকোয় বহে এনেছিলেন।
মাকে বলেছিলেন, গীতানাথ দুর্গাবাড়ি যাইয়া দখল নিব? বিশ্বাসও করি না। নেউগীরা নৌকার মাঝি। একেক থনে নঙ্গর ফালায়, আবার ভাইসা পড়ে। যাক, মাছ উঠাইয়া বেচছি,—দ্যাশে মাছের দর কি বা! ধান অর্ধেক বিলাইছি। চাল, চিড়া, গুড় নারকেল, ক্ষীরের পাতিল আনছি। আমি কই, আর বেশিদিন নাই। যে ক’দিন থাকুম, লাতিদের লইয়া থাকুম। তা….বউমা! অগো ভাইবোন হইব না?
মা মাথা নামালেন।
ঠাকুমা মানে একজন মোটাসোটা ফর্সা বৃদ্ধা, যাঁর গলায় আঁচিলটি আমরা নাড়তাম। ঠাকুমা মানে দুর্গাবাড়িতে আলেয়া ভূতের গল্প, ঝড় তুফানে নৌকা ডোবার কথা, কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমার রাতে এক অপরূপা সুন্দরীর ব্রত কথা শুনতে আসা ও পাঁচালী পাঠ,—(প্রত্যূষে তাঁকে দেখা যায়নি, তবে উঠোনে আলতা পরা পায়ের ছাপ ছিল),—এমনই সব কথা। বাস্তব ও অবাস্তবে জড়ানো অতীত কথা বালক মনকে বড় সমৃদ্ধ করে। ঠাকুমা মারা গেলেন।
বাবা আর দুর্গাবাড়ি ফিরলেন না। ঈষৎ হেসে মাকে বললেন, নটাকোল গ্রাম বললে হয়, টাউন বললে হয়। ভাদুড়ীমশাই দানবীর জমিদার। পাঠশালা, হাই স্কুল, ইট বাধাইন্যা রাস্তা, শান বান্ধা পুকুর ঘাট, বান্ধা বাজার, পোস্টাপিস, কী নাই? গ্রামে চারখান ”দৈনিক বসুমতী’ আসে, লাইব্রেরি কইরা দিছেন, কত কথা আলোচনা হয়!
মা বললেন, আর পুলিশ নজর রাখে!
—শচীন ভাদুড়ীর গ্রাম! রাখতেই পারে।
—তাই!
—এখানেই দালান তুলব, ভাবত্যাছি। জমি দিবেন, ইট দিবেন, ওনার মেস্তরি শস্তায় কইরা দিব,—জলের ইন্দারা, কুয়া পায়খানা, কেমন মনে কর?
—টাকা?
—মা আনছিল কিছু। বইলা গিছে, তর বাড়ি তুইলা নে।
আমরা আদিনাথের ঘোরানো সিঁড়ির কাছাকাছি চলে আসছি ক্রমে ক্রমে।
বামুনপাড়া, গোবিন্দপুর, দুর্গাবাড়ি, নটাকোল! বাবার স্বপ্নই ছিল দুর্মর। ঘর পাঁচখানা, ছোট ছোট। রান্নাঘর মাঝারি। উঠানটি মস্ত বড় ও বাঁধানো। ভাদুড়ী মশাই সহাস্যে বললেন, বল খেলবেন, না তীর বা বন্দুক চালাবেন?
বাবা বললেন, ছেলেদের পইতা, বিয়া, শুভ কাজে লোক খাইব না?
—আর একটেরে ঘরখানা?
—ছেলেরা পড়ব। অহন তো জমিজমা লইয়া চলত না ভাদুড়ীবাবু। ল্যাখাপড়া করব, মাস্টারি করব, দিন কি একোভাবে যাবে?
এই নেউগী বাড়ির নাম কিন্তু হয় ”বিশ্বনাথ—আলয়”। বাবা বলতেন, আর ঘুরে ঘুরে বেড়াব না। এখানেই থিতু হব।
ঠাকুমার মৃত্যুর পর আমাদের আরেক ভাই হয়, বোন আমাদের ছিল না।
ভাদুড়ী মশাইয়ের এই গ্রাম ঘিরে অনেক স্বপ্ন ছিল। তিনি বিরাজমোহিনী হাই স্কুলের জন্যে ভাল ভাল মাস্টার এনেছিলেন,—তাঁদের জন্য একটি দশ কামরা বাড়ি ছেড়ে দেন। শহীদ শচীন ভাদুড়ী তো তাঁরই জাটতুত ভাই, এই স্কুলে পড়তে পড়তেই ক্লাস টেনের কিশোর ঢাকা চলে যায়। তারপর সাহেব মারতে গিয়ে মারা যায়। লাইব্রেরি সম্ভবত ওঁর বাবার স্থাপিত। ইনি তাতে বড় ভূগোলক, পৃথিবী, ভারত ও বঙ্গের বড় বড় মানচিত্র, অনেক অভিধান, অনেক রকম বই এনেছিলেন।
ওই স্কুলেরই ছাত্র মনীন্দ্রমোহন বিশ্বাস পাবনা জেলায় মাট্রিকে প্রথম হন।
শিক্ষকদের গ্রামে বসত করাবার স্বপ্নও তাঁরই। কিন্তু শিক্ষকরা সবাই রাজি হতেন না। বাবা রাজি হওয়াতে তিনি হাতে চাঁদ পান। স্বদেশী ভাবাপন্ন মানুষ, প্রখ্যাত অথচ গরিব দেশপ্রেমিক—সাংবাদিক তারানাথের মেয়ে বাবার স্ত্রী। ভাদুড়ীবাবু উচ্ছ্বসিত। মা লেখাপড়া জানতেন বলে লাইব্রেরির ভবানীবাবু মাকে বই দিয়ে যেতেন।
নটাকোলের স্মৃতিই আমার ও দাদার মনে সব চেয়ে প্রোজ্জ্বল। যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি, বিকালে এসে দেখি মা এক ফুটফুটে বালিকার চুল বেঁধে দিচ্ছে। সেটা ১৯৩৩ সালই হবে।
মা বললেন, এত চুল, নিজে বাঁধতে পারে না, মা সময় পায় না। চিনলি এ কে?
মুখ তুলতেই বললাম, এ তো মৃণাল! এক্কেরে জলের পোকা গো মা! ভয় ডর নাই। সাঁতরাদীঘিতে মাছের মতো সাঁতার কাটে।
মৃণাল জিভ ভেঙিয়ে বসে থাকল।
ভাদুড়ীবাবুর বাড়িতে তখনকার নিয়মেই অনেক পাতা পড়ত, অনেক লোক খেত। নিজের মা ও বিমাতা, আপন ও বৈমাত্রেয় ভাইরা, তাদের ছেলে মেয়ে, তিন বিধবা পিসি, তাঁদের ছেলেমেয়ে, লতায় পাতায় আত্মীয়, আবার অনেক অনাত্মীয়, দাস দাসী, বাইরের পাট করুনী, জলচল দাসীরা বাসন মাজত, জল—অচল দাসীরা ঘর—উঠোন লেপত, বোঝা বোঝা পাটকাঠি এনে কাঁঠালের আঠা জড়িয়ে মশাল বানাত। মৃণাল কোনও আশ্রিত বিধবার মেয়ে। বাড়িতে সবার মতোই থাকত।
স্বাধীনচেতা ছিল। সাপখোপের ভয় ছিল না, আম—জাম—তেঁতুল—জামরুল—নোনা—কুল—আমড়া টুকিয়ে বেড়াত। আমার মা ওকে আর ও বাড়ির আরও কয়টি মেয়েকে অক্ষর চেনাতেন।
মৃণাল বলত, স্কুলে আমাগো নেয় না কেন?
আমি বলতাম, তুই কি বেটাছেলে? ছেলেদের ইস্কুলে মেয়েরা যায়?
—পাঠশালে তো যাইতাম।
—আর যাস না?
মা কয়, বড় হইয়া গিছস। পইড়াই বা কী করবি? বিয়ার পর তো হাড়ি ঠেলবি।
—যাঃ। আমার মায়ে তো বই পড়ে।
—তিনি পণ্ডিতানী।
—ভাল কইরা পড় মৃণাল!
—ক্যান?
ভুরু কুঁচকে তাকাত ও। ফুটফুটে মুখ, ছিপছিপে গড়ন, চুল টেনে বেড়া বিনুনি বাঁধা। গাছকোমর বাঁধা শাড়ি। পায়ে মল।
—না শিখলে বররে চিঠি লেখতেও পারবি না, তার চিঠি পড়তেও পারবি না।
—আমি বিয়াই করুম না।
—তবে কী করবি?
—টোকন পিসি ভাদুড়ী বাড়িরই কেউ। বিয়ে করতে আসার কালে নৌকো ডুবে ভাবী বর মরে যায়। ফলে টোকন পিসির আর বিয়েই হল না। তিনি ঘোর অলক্ষণা বলে প্রতিপন্ন হলেন। না বিধবা, না সধবা, টোকন পিসি সারাজীবন বড়ি, আচার, কাসুন্দি সাম্রাজ্য সামলে গেলেন।
—থাকিস! থাকতে দিবে তোর মা!
—যারে মন লয় তারে বিয়া করুম!
আমি চমকিত হলাম। আমার তেরো, মৃণালের দশ পুরে এগারো। আমি বঙ্কিমচন্দ্র পড়েছি, গিরীন্দ্রমোহন সরখেলের ”কুন্দকুসুম” পড়েছি। অবশ্যই মা’র কাছে শুনেছি ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল, কানাইলালদের কথা। পড়ার ক্ষুধা, জানার ক্ষুধা অসম্ভব। কিন্তু মৃণাল বলবে, ”যারে মন লয়, তারে বিয়া করুম”,—এমন কথা আমার কিশোর হৃদয় কাঁপিয়ে দিল। বললাম, ঘর যা মৃণাল! বড় পাকা হইছস!
মৃণাল জিভ ভেঙিয়ে পালাল। আম বাগানের অন্ধকার ছায়ার মধ্য দিয়ে মৃণাল মল ঝমঝমিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, এ ছবিটা এখনও আমি দেখতে পাই।
শুনতে পাই, তার সহাস্য কণ্ঠ, অ সতীনাথ দাদা! ঘরে যাও। তোমার মায়ে কাওনের পায়েস বানাইয়া বইসা আছে।
কী স্বাধীনতাই না ছিল সেদিনের মৃণালের!
এক পাল মেয়ে জুটিয়ে সাঁতরা পুকুরে এপার—ওপার সাঁতার কাটত।
আষাঢ়—শ্রাবণের ঝমঝমে বৃষ্টিতে যখন পুকুর ভাসত, কই মাছ ধরতে যেত।
বাড়িতে থাকত কতক্ষণ? সর্বদাই তো আমার মায়ের কাছে।
—দেন, শাক বাইছা দেই,—সরেন, উনানে ফুঁ দেই,—আমারে পোলা দেন, আপনে স্নান করেন গো।
ছোট ভাই মল্লিনাথ মৃণালের কোলে কোলেই থাকত। মল্লিনাথ বড়ই রোগা, বড়ই ফর্সা, বড় ক্ষীণজীবী ছেলে।
আমি চিরকালই ঘোর কালো। হট্টাকট্টা জোয়ান। স্কুলে ফুটবল খেলি। নৌকা বাইতে পারদর্শী, নদীতে সাঁতরাই, আর রাতে লণ্ঠনের আলোয় সখারাম গণেশ দেউকরের ”দেশের কথা”, ”মানিকতলা বোমার মামলা” পড়ি।
দাদা ছিপছিপে, শ্যামবর্ণ, সুশ্রী,—লেখাপড়ায় খুব মন,—ও যে বড়,—ওকে যে বাড়ির দায় নিতে হবে,—এ বিষয়ে খুবই সচেতন। সবাই বলে, আদিনাথের মতো পোলা এ যুগে দেখা যায় না। আমাদের ভূগোল শিক্ষক সতীশ স্যার বলতেন, আদিনাথ সত্যযুগের ছেলে বললে হয়। সতীনাথ এ যুগের ছেলে। লেখাপড়ায় মন নেই।
মৃণাল যে মায়ের কাছে আসে যায়, এ নিয়ে নটাকোলেও গুঞ্জন হচ্ছিল। আদিনাথের মা সেমিজ পরেন, শহুরে সভ্য ভব্য ভাব! তিনি ছেলেদের পড়তে বসান। ভাদুড়ীবাড়ির পুজোপার্বণে যান, কিন্তু মেয়ে সমাজে খুব গলাগলি করেন না। পুকুরে যান না, বাড়িতে স্নান করেন। স্কুল প্রত্যাগত, অতীব অনুগত স্বামীকে মচমচে পরোটা ভেজে দেন, যা নটাকোলে তখনও প্রবেশাধিকার পায়নি। পূজার সময়ে নৌকায় গ্রামে কাপড়, পাথরের বাসন যেমন,—তেমনি বসুমতী প্রেসের ও দেবসাহিত্য কুটিরের বইও আসে।
বই কেনেন আদিনাথের মা।
আমার মা গ্রামে একটি সসম্ভ্রম রহস্য হয়েই থেকে যান।
মল্লিনাথের যখন ইনফ্যান্টাইল লিভার হয়, পাবনা শহর থেকে যতীন ডাক্তারকে আনা হয়েছিল।
মল্লিনাথ অবশ্য বাঁচেনি।
কিন্তু মা শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন। সেই সময়ে ভাদুড়ীমশাই মৃণালের মাকে পাঠিয়ে দেন। যাও, পাকসাক কইরা দাও, উনারে একটু দেখো!
মা এল তো মেয়ে এল।
কয়েকদিন ওরা আমাদের বাড়িতে সকালে আসত, রাতে যেত। এর পরে পরেই মৃণালের মা একদিন মায়ের কাছে এলেন। বললেন, জানেন তো দ্যাশের কথা! অহনো চৌদ্দ পারাইতে মাইয়ার বিয়া দিতে কয় মানুষ।
—না, এখন আর তত বাড়াবাড়ি নেই।
—দিদি, আমি তো পরাশ্রয়ী, নিঃসম্বল মানুষ! বিয়াও দিমু অর ভিক্ষাসিক্ষা কইরা। অবশ্য যানার আশ্রয়ে আছি, তানার কথা বইলা পার পাই না। মেনির মতো এমুন কত মাইয়ারে বিয়া দিয়া দিছে!
—মৃণাল খুব ভাল মেয়ে।
—দিদি, এটা কথা!
—বলেন।
—পায়ে ধরি আপনার,—আপনের পোলারা য্যান সোনার পোলা! মৃণালরে যদি পায়ে ঠাঁই দেন!
—এরা তো আজও ছাত্র।
—তাতে কী?
—না, শিক্ষা শেষ করব, রোজগারি হইব, তয় না বিয়া! তারও দেরি আছে!
—দেখেন! মাইয়ার ভাবগতি দেইখা মনে হয়, ও যেমুন আপনের হাঁড়িতেই চাল দিয়া বইয়া আছে। কয়, আপনার নাখাল মানুষ এ গ্রামে নাই। ভাইবেন দিদি, কোন বা ঘরে যাইব, কেমন বা হাল হইব! মাইয়া তো আগুনের চেংরি। সে কয়, বিয়া বিয়া করো ক্যায়? টোকন পিসির বিয়া হইছিল?
মা বললেন, এখন তো ওসব কথা ওঠে না। পরে বলব আপনেরে। আমাগো না জমিজমা, না কিছু, ওই বাপের ব্যাতন টুকু,—তাও ভাদুড়ীবাবু দ্যাবতা কইলে হয়, তিনি অনেক করে। আম রে, মাছ রে, কাঁঠাল রে, ঘরে জামাইরা আইলে মিষ্টি মাষ্টা রে!
নটাকোল গ্রামই আমার মনে এক আশ্চর্য স্মৃতির আলপনা এঁকে রেখেছে। আমাদের ন্যালা বলে, কত্তামা যেদিনে মরল, সেদিনে দামা পাখি নেমেছিল বাগানে, জানলে ছোট কত্তাদাদা?
—এৎকাল বাদে সে কথা?
—না… ভাবি তো তিনি গেল কেন… আজ সপনে জাজ্যল্য দেকলাম দামা পাখি ঘুরছে।
হ্যাঁ, দশ বছরের কথা সপনে দেখিস!
—তুমি দেখো না?
দেখি, আমি দেখি। মৃণালের মা’র চিতা নিভে এসেছে, আমরা বসে আছি ঘাটে। দেখি, মা যাচ্ছেন ওর মায়ের কাজে। দেখি, ভাদুড়ীমশাই এসেছেন, ওর কোনও কাকাকে নিয়ে। বলছেন, এতকাল খবর ছিল না, অহনে বিধবার চাটিমাটি লইতে আইছে। কয় মৃণালরে দেইখা যাবে।
মা বাবাকে ডাকলেন। কী যেন বললেন। বাবা ভাদুড়ী মশাইকে বললেন, পোলাদের মা, মিরনালের মায়েরে কথা দিচ্ছিল আমার ঘরে অরে লইবে।
ভাদুড়ীমশাই চমৎকৃত!
বললেন, দেবতা! দেবতা তুমি নেউগী? আদিনাথের মা—ও স্বয়ং দেবী ঠাকরুণ! তয় আর কী! আর চিন্তা থাকল না।
রাতে যখন আমি আর দাদা পাশাপাশি শুয়ে আছি, দাদাকে খোঁচা মেরে বললাম, শুনলি?
দাদা ওই বয়সেই যেন ধীর স্থির এক বুড়ো। দাদা বলল, এ তো জানাই ছিল। মায়ে যহন অরে পছন্দ করছে, তহন আর কি ছারে?
আমি বলতেই পারলাম না আমার মনের কথা। বলব কাকে? মৃণাল আর আসেই না। বলব কখন? আমি, শচীন ভাদুড়ীর দাদার নাতি হাম্বির (শহীদের গ্রাম! হাম্বির, প্রতাপ, অর্জুন, ছিল নিজেদের দেয়া নাম। অনাদিনাথ, বাণেশ্বর, অনিলচন্দ্র নামে বীরত্ব কোথায়?) রাজেন গুহর ছেলে প্রতাপ, নেপু ভৌমিকের ছেলে অর্জুন, হাম্বির ও আমি তখন পাবনা থেকে সুকৌশলে আনানো বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের খবর—টবর পড়ে বি. ভি. হব ঠিক করেছি।
চলে যাব পাবনা। অতঃপর ঢাকা। দেশের জন্য আত্মবলি দিতে কিশোরদের রক্ত চাই।
তবে নটাকোলে নয়। এটাও ভাবলাম, যে মৃণালের মনে যদি কোনও আশা উন্মীলিত করে থাকি, সেটি উপড়ে ফেলা দরকার। আমি তারানাথের দৌহিত্র, (যাঁকে দেশ ও মানুষ ভুলে গেছে। ‘আমার জীবন স্রোত” নামক বই ব্যতীত তাঁর ছবি দেখা যায় না) আমি কেন নটাকোলে নেউগী বংশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করি?
পাবনায় ফুটবল খেলতে যাচ্ছিলাম, তা সবাই জানত।
তখন শরৎকাল। পূজা আসে আসে। অতীব প্রত্যূষে আমবাগান দিয়ে শর্টকাট করছি, সহসা দেখি মৃণাল।
রোগা, গম্ভীর, একবেণী ধরা, এক হাতে আঁকশি, এক হাতে সাজি, অনেক, অনেক শিউলি ও স্থলপদ্ম তুলেছে মৃণাল।
বললাম, তুই?
—অবাক হইলা?
—এত ভোরে…..এখানে……. কেউ দেখলে….
—নিন্দা হবে? কারে নিয়া? তুমি তো পলাতেছ!
—ঘর যা মৃণাল।
—যামু, কিন্তু কইয়া গেলাম সতীনাথদা, তুমি বড় নিষ্ঠুর। অনেক কষ্ট দিবা, আবার দুনো কষ্ট পাইবা।
—ঘর যা!
মৃণাল মুখ ফিরিয়ে গটগট করে চলে গেল। শারদ সকালের আলোছায়ার আলপনা মাড়িয়ে চলে গেল রানির মতো। আমি জানি ওর চোখে জল এসেছিল,—এও জানি যে ও আমাকে তা দেখতে দিত না। ও চলে যাচ্ছে, চলে গেল, শরতের মেঘ যেন।
বাবা—মা—দাদা, কাউকে বলে যাইনি।
পাবনা থেকে ঢাকা। হৃদয়ে প্রজ্বলন্ত স্বপ্ন। বি.ভি.—তে যোগ দেব, বিপ্লবী হব, ইত্যাদি। সেদিনের আন্তরিক উন্মাদনাকে অশ্রদ্ধা করি না। কিন্তু কোনও দলীয় শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে যাইনি,—কোনও পড়াশোনার পটভূমি তৈরি হয়নি।
নারায়ণগঞ্জের কাছের এক গ্রামে প্রপার শেলটারেই যাই। সেখানেই হারাণ সাহার খোঁজে পুলিশ আসে। হারাণ সাহার বিধবা দিদি আমাদের সাহায্যও করেন। দিনে মানে অন্ধকার ঘরে পড়ে থাকা,—রাতে গোপনে অন্য গ্রামে নেতাদের ডাকে মিটিঙে যাওয়া,—এভাবে তিন মাসও কাটেনি। এরমধ্যে নিখিল দারোগাকে মারার চেষ্টা করলেন সতীশদা।’ আমরা গ্রেপ্তার হয়ে গেলাম।
খবর নটাকোলে পৌঁছেছিল। পুলিশ বাড়ি তছনছ করেছিল সকলেরই। বাবা—মা—দাদা, ওদের কী অবস্থা হয়েছিল জানি না। তিন বছরের মাথায় খবর পাই, দাদার সঙ্গে মৃণালের বিয়ে হয়েছে। এভাবেই আমি ও মৃণাল ”বউদি” ও ”ঠাকুর পো” হলাম।
জেল থেকে বেরিয়ে কিছুকাল বাদে আবার জেল। আমার জীবনকথা বলতে তো বসিনি, বলব ঘোরানো সিঁড়িটির কথা।
.