ঘোরানো সিঁড়ি – ১

এক – সতীনাথ

দাদার ছেলেমেয়েদের চিঠি পেয়েই বুঝে গেছি, ওদের বাবার জন্মদিনে এ বাড়িতে পারিবারিক সম্মেলন এমন ঘনঘটা করে ঘোষিত হল কেন। যতিনাথ লিখতে কিছু সংকোচ বোধ করেছে। কিন্তু সিধা বুঝছি, ওরা বাড়ি বেচে দেবে।

পারে, দিতেই পারে। ওদের বাবার তৈরি বাড়ি। ওরা বেচে দেবে, আমি বলার কে! আমি তো বাধা দিতে যাব না। বউদির মৃত্যুর পরেও একবার এ কথা উঠেছিল বটে। দাদার কনিষ্ঠ ছেলে সুভাষই জোর করছিল। সে সময়ে আমার ভ্রান্ত ধারণা ছিল যে, আমার কথার কিছু দাম আছে ওদের কাছে। হতে পারি অকৃতদার এবং অপুত্রক। অকৃতদার হলেই অপুত্রক হয় না। আমার এক জ্ঞাতি কাকা ছিলেন খুব ঢঙের মানুষ।

তিনি বিয়ে শাদি করেননি। কাজকর্মও করেননি। একটা মোটা খাতায় তখনকার যুক্তবঙ্গ থেকে ওদিকে সিলেট, শিলচর,—পশ্চিমে বিহার, যুক্ত প্রদেশ (আমরা যুক্ত প্রদেশই বলতাম, এরা বলে উত্তরপ্রদেশ), দিল্লি, পাঞ্জাব, দক্ষিণে নাগপুর, জব্বলপুর, সর্বত্র নিয়োগী বংশের কোনও না কোনও ডালপালা আছে, সকলের নাম ঠিকানা লিখেছিলেন খোঁজ করে করে।

জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ফেমিলির হিসট্রি লিখতাছি। তার লিগ্যা এত খোঁজ করি।

তখন সমাজটা এমনই ছিল, যে জমির ধান থাকলে স্বেচ্ছায় কোনও কোনও শিক্ষিত ছেলে যৌথ পরিবারে বেকার হয়েই থেকে যেত। বিয়েও করত, বাপও হত, এটা অস্বাভাবিক বা স্বার্থপরতা বলে মনে করত না কেউ।

আমার এই কাকা ”পরিবারের ইতিহাস লিখব” বলে সকলকে চমৎকৃত করে দেন এবং অচিরে নগদ বাইশ টাকা এবং খাতাটি নিয়ে ”গৃহত্যাগ করিলাম” লিখে রেখে চলে যান। স্নেহাতুরা পিতামহীকে ও জননীকে তিনি মাঝে মাঝে ”তীর্থে তীর্থে সাধুসঙ্গ করিতেছি” লিখতেন। মহিলারা, ”ও পোলার সন্নাস যোগ আছিল বা!” বলে শোক করতেন।

বছর ছয়েক বাদে প্রভূত স্বাস্থ্য, পেঁটরা বোঝাই জামাকাপড় নিয়ে ফিরলেন। পরনে গেরুয়া, পায়ে নরম চামড়ার বিলাতি জুতো। বললেন, বা’র বাড়িতে থাকুম। অন্দরে যাইতাম না।

তাঁর আহারাদির ব্যবস্থা চলছে, এমন সময়ে একটি ডাঁটোখাটো স্ত্রীলোক এক বালককে নিয়ে প্রবেশ করল। ইনি বললেন, তীর্থপথে এ আমার সাধন সঙ্গিনী, পোলাটা স্বপনে পাইছে।

বংশের সম্মান রাখতে তাঁকে গ্রাম থেকে দূরে পাবনা টাউনে প্রতিষ্ঠা করা হয়। স্বপ্নে প্রাপ্ত সাধনসঙ্গিনীর পোলা তাঁকে ”বাবা” বলেই ডাকত। ছয় বছরে ইনি সিলেট টু লাহোর সব আত্মীয় গৃহে গেছেন, খেয়েছেন, থেকেছেন। সে বিষয়ে ”আমার ভারত ভ্রমণ” বই লেখা শেষ না হতেই তাঁর অকাল বিয়োগ হয়। পাবনার বাড়ি সেই মহিলাই পেয়েছিলেন।

আমাদের কাছে ওঁকে খুব মজার মানুষ মনে হত। কিন্তু বাড়ির বড়রা ওঁকে ”বংশের কুলাঙ্গার” বলতেন। তবে বাসা খরচ পাঠানো হত, যাতে তিনি গ্রামে না ফেরেন। অকৃতদার এই লোকের ঔরসজাত ছেলে কিন্তু লেখাপড়া শিখে ঢাকায় কাপড়ের কলে কাজ করতে চলে যায়। আমার ঠাকুর্দা ইংরেজি শিক্ষিত ছিলেন। তিনি বলতেন, দেখ! ইতিহাসের বিবর্তন! আমরা জমি লইয়া আছি। হে গেল ইনডাসট্রিতে। অকৃতদার আর কাউকে পাইনি আমি ছাড়া। আমি সে সময়ে বিপ্লবী দলে যোগ দিয়ে এই জেলে ক’বছর, আবার বাইরে, আবার জেলে। যাক, শিক্ষিত। উঁচু জাতের ও ঘরের ছেলেরা তিন মাস ইংরেজের জেল খাটলেই স্বাধীনতা সংগ্রামীর পেনশান পায়। আমার জেল রেকর্ড জুড়লে এগারো বছর। স্বাধিকারে আমি পেনশানভোগী।

তা, আমি এদের কাকা। বুদির মৃত্যুর পরে বললাম, বাড়িতে আমি তো থাকলাম। বাড়ি অরক্ষিত থাকল না। বেচতে হলে চিন্তা করো। ক’বছরে দামও বাড়বে। বেশি টাকা পাবে।

—তুমি থাকছ তো, আমরা ভাবব কেন? মাধবী কান্নাভরা গলায় বলেছিল, তুমি ছাড়া আমাদের কেউ রইল না কাকা।

—তোমরা এসো মাঝে মাঝে। বাড়ি তো তোমাদেরই। এলেও তাদের আত্মাটা শান্তি পাবে।

সুভাষ বলেছিল, বাড়িটা দেখাশোনা করে ঠিকভাবে রাখবারও তো একটা খরচ আছে!

আমি তখন নিজেকে ভাবছি ফাদার ইমেজ। প্রবল আত্মবিশ্বাসে বলেছি, আমি পেনশান তো পাই। আমি আর ন্যালা। খেয়ে দেয়ে বাড়ি ও বাগান দেখে শুনে রাখতেই পারব।

সুভাষের ভয়েসকন্ট্রোল অসামান্য। আমি ভাবতেই পারি। ওর ল্যাণ্ড অ্যানড প্রপার্টি কেনা বেচা ব্যবসায়ে গলার আওয়াজটা কেমন পর্দায় পর্দায় ওঠায় নামায়।

সুভাষ গাঢ়, অভিভূত গলায় বলেছিল, তুমি থাকলে মানে, তোমার মধ্যেই তাঁদের পাব। সে সময় মনটা নরম কাদাভূমি, যা বুনবে বুনে যাও। যা বলবে তা মেনে নেবে মন। আমি কিছু আপ্লুত হয়েছিলাম। কিন্তু রাতে দেখি ন্যালা আর শুতে আসে না। সকালে বললাম, কী করছিলি?

—সুবাষ ঠাগমার কলসি—মলসি নিয়ে যাবে তো! ওর ঘরে টেনে দিচ্ছিলাম।

—এটা তো ঠিক কাজ নয়।

—বলল, ঠাগমার সিঁতি।

—সিঁতি নয়, স্মৃতি।

—ওই হ’ল। আমাকে পাঁচটা টাকা দিয়েছে, এট্টা শার্ট! আর এই হাওয়াই চটি।

আমি প্রমাদ গুনলাম। ওদের মা, মৃণাল বউদি নিজ বাড়ি হওয়া থেকে বাসন কিনতে শুরু করেন। অনেক বাসনের লৌকিক নাম ছিল, যেমন ”তরকারি ঢালাঢুলির বেলি”, এঁটো না করে জল খাবার পেতলের ”পাউলি ঘটি”, আদা বা পোস্ত বেটে রাখার ”চুন্নুনী বাটি”, কানা উঁচু কালো পাথরের থালা ছিল ”পাথরী”। এসব শব্দ কোনও শব্দকোষে পাওয়া যাবে না। এ সব গার্হস্থ্য শব্দ বিলীন হয়েই যাবে।

সুভাষ কলসি সরাচ্ছে, স্বাধীন বা কী সরাবে,—যজ্ঞির বাসন তো কয়েক প্রস্থ।

সকালে আমি বললাম, বাড়িটা স্থাবর। একে হালকা করে রেখে যাও। আমি সামলে নেব।

—খাট—আলমারি—টেবিল—চেয়ার?

—না কাঁঠাল কাঠের বড় বড় পিঁড়ি?

—বাসন কোসন নিজেরা ভাগ করে নাও। রাখলে রেখো, বেচলে বেচো।

—তুমি আর ন্যালা?

—একটা দুটো রেখে যাও। আমাকে বউদির পাথরীটা দিও। অনেক স্মৃতি জড়ানো। উনি ওটায় খেতেন।

ন্যালা বলল, আমি ঠাগমার জল খাওয়ার পাউলিটা নেব। আর… আর … ঠাগমা বলিছিল, ঠাকুরঠুকুর কে বা পুজবে ন্যালা, ঠাকুরপো তো চিরকালের কালাপাহাড়,—ও তুই জলে ফেলে দিস।

আমি বললাম, তোমরা নেবে কেউ?

এ—ওর দিকে—সে—তার দিকে তাকাল। ন্যালার মুখের স্বাভাবিক অভিব্যক্তি হাসি—হাসি,—কাঁদলেও মনে হয় হাসছে। ও বলল, ঠাগমা যেতে না যেতে তাকে ধুয়ে পুঁছে ফেলে দেবে? একথা ওদের কোনও নৈতিকতায় ঘা দিল। সুভাষ সাধারণত সুপার বসের মতো কথা বলে। সে বলল, রেখে লাভ আছে?

আমি বললাম, থাক এখন। মুখুজ্জেদের পুরোহিতকে বলে দেব, ফুল ফেলে ঘণ্টা নেড়ে দিয়ে যাবে। সন্ধ্যায় ধুপধুনা তো মশার জন্য দিতেই হয়।

বাসনকোসন নামানো হয় উঠোনে। ওরা কে কী নিল, কে কী বেচল, সে আমি দেখিনি। জমাদারনি বউটা বউদির অনেক মলমূত্র কাচত, আমার নাম লেখা থালা—বাটি—গেলাস তাকে দিয়ে দিলাম।

ঠিক হ’ল, ঘরে ঘরে আসবাব থাকবে। অস্থাবর বলতে আর কি?

আমি ঈষৎ হেসে বললাম, ঘোরানো সিঁড়িটা কে নেবে, কী হবে ওটার?

সুভাষ বলল, কী হবে, লোহালক্কড়ের দোকানে বেচে দিলে পয়সা পাবে কিছু।

—ঘোরানো সিঁড়িটা এ বাড়িতে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সুভাষ। তোমাদের বাবা…

যতিনাথ, পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের এক মিতভাষী অধ্যাপক। ও বলল, হ্যাঁ… ঘোরানো সিঁড়িটা….

মাধবী বলল, হ্যাঁ রে দাদা! বাবা ওটা কোথা থেকে যেন কিনে এনেছিল, তাই না কাকা?

আমি বুঝতে পারছিলাম দেয়ালে পাশাপাশি ঝোলানো আদিনাথ ও মৃণালের ফোটোর চোখে প্রত্যাশা। ওই সিঁড়ির কথা ছেলেমেয়েরা কি জানে। কি মনে রেখেছে সিঁড়ি? সিঁড়িটাতে বাইশটা ধাপ আছে। বছর বছর রং করাই, ঝকঝক করে। বর্তমানে দীর্ঘকাল সিঁড়িটার জন্যই ভিতর উঠানে একটা ছাউনি করা হয়েছে। সেখানে সিঁড়িটি থাকে।

মনে মনে আমি আদিনাথ ও মৃণালের বিদেহী টেনশান টের পাচ্ছিলাম। ঘোরানো সিঁড়িটার পিছনে একটি আপাত সাধারণ মানুষের একটা অসম্ভব স্বপ্ন ছিল। স্বপ্নটিকে বাস্তবে অনুবাদ করা অসম্ভবই।

যতিনাথ বলল, আমি কী জানব?

আমি নেউগী পরিবারের কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন নানা অর্থেই। বাড়ির ইতিহাসটা জানি। গায়ের রং ঘন কালো, রোমশও বটে। আমি বললাম, দাদা ওটা কেনে খুব সস্তায়। জেল থেকে বেরিয়ে আমি তো কন্ট্রাকটরি করি। সে সময়ে, মানে ১৯৪৭ সালে হুগলি নদীর ওপারে বেশ কিছু কুঠি বাড়ি ভাঙা হয়। মালপত্র কেনাবেচার কাজ কিছুদিন করি। দাদা মাঝে মাঝে যেত। ঘোরানো সিঁড়িটা খুব পছন্দ হয় ওর। তাতেই কিনেছিলাম।

—এ সিঁড়ি কোন কাজে লাগত?

—সায়েবী আমলে এগুলো ছিল বাথরুমে জমাদার ঢোকার সিঁড়ি। পিছন দিয়ে উঠত, কাজ করে নেমে যেত। শুনেছি এখন আবার এ সবের ফ্যাশান হয়েছে।

মাধবী অবাক হয়ে বলল, বাবা কত বড় বাড়ির কথা ভাবত? করেছিল তো একতলা একটা বাড়ি।

স্বাধীন বলল, হয়তো ভেবেছিলেন যে কখনও দোতলা করবেন। তখন জমাদার উঠবে দোতলায়।

—ঘোরানো সিঁড়িটার বিষয়ে আমার কিছুটা দুর্বলতা আছে। ওটা নয় আমিই নেব।

ওরা হেসেই ফেলল। আমি খুব সিরিয়াস। ঘোরানো সিঁড়ি আমার মাধ্যমে ঢুকেছিল, আমার সঙ্গে যাবে।

মাধবী আবার অবাক, এই যে বললে, যাবে না কোথাও?

—একদিন তো যাবই রে মা! তখন যা হয় করিস। আমি তো আর দেখতে আসব না।

ন্যালা এ সময়ে হঠাৎ হাঁউমাউ করে বিচ্ছিরিভাবে কেঁদে উঠল, কোথা যাবে গো ছোটকত্তাদাদা? কত্তাদাদা গেল, ঠাগমা গেল, তুমিও কি মরে যাবে? আমি তাইলে থাকব কোথা গো?

বললাম, আমার মরতে অনেক দেরি এখন। যা, চা করগে যা। আমি যেমন খাই, তেমনি করিস।

এখানেই ঘোরানো সিঁড়ির প্রসঙ্গ থেমে যায়। শ্রাদ্ধশান্তির পর যাবার কালে যতিনাথ বলল, সত্যি! এমন চমৎকার বাড়ি, এমন বাগান, বড় বড় চারটে ঘর, দু’দিকে বারান্দা, দুটো বাথরুম….।

—পুরনো বাংলো বাড়ির স্বপ্ন তো দাদার চোখে ভাসত। সেই মডেলেই….

—তুমিও তোমার সব ঢাললে!

—হ্যাঁ… আমরা তিনজন খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম।

—বিয়ে টিয়ে করলে না…

—আমাদের প্রজন্মে এমন ব্যাচেলর থাকত কেউ কেউ। সেটা এমন আশ্চর্য কিছু নয়।

—এমন বাড়িতে থাকলে আমি তো শান্তি পেতাম। কিন্তু সুলতা রিটায়ার করাবে ২০১০ সালে, আমি রিটায়ার করব ২০০৫ সালে। বেহালায় ফ্ল্যাটটা না কিনলে…..

—অবশ্যই।

দাদার বড় ছেলে যতিনাথ অধ্যাপক। বিয়েও করেছে এক অধ্যাপিকাকে। ওই কলেজের অধ্যাপকরাই সমবায় প্রথায় ফ্ল্যাট করেছে অতি সস্তায়।

—থাকতে পারবে না, মন করলে ঘুরে যেও।

—হ্যাঁ… দেখি….

ওরা আসবে না। সুলতার ব্যক্তিত্ব প্রবল, যতিনাথ দুর্বল চিত্ত। মাঝে মাঝে আজ এসে কাল চলে যেত বাপ—মা থাকতে। শিয়ালদা থেকে এ শহর আসতে পাঁচ ঘণ্টা লাগে। বেহালা ও এই শহর যেন পৃথিবীর দুই মেরুতে।

—বাবার এ বাড়িটা করা…

—কে করে না যতি? তার তো তিন ছেলে এক মেয়ে ছিল। তোমরা নিঃসন্তান, ফ্ল্যাট করোনি? এ বাড়ির ভাগীদার আছে, ও ফ্ল্যাটের উত্তরাধিকার কার? থাক গা, সম্পর্ক আমি যতদিন আছি রাখব। ন্যালাও যাবে, গাছের আম, নারকেল, পেঁপে, সজনাডাঁটা নিয়ে।

যতি এমনই মূর্খ যে বলল, ন্যালারও কলকাতা বেড়ানো হয়।

আদিনাথ ও মৃণাল নেউগীর বংশধররা ক্রমশ বিদায় নিল। মাধবীই সবচেয়ে দূর থেকে এসেছে। কোথায় শিকাগো, কোথায় এই বাড়ি। মাধবী কোন মিউজিয়ামে কাজ করে, করণিক। ওর স্বামী সবুজ এবং যমজ ছেলে অরু ও বীরু তিনজনেই সবুজের ক্লিনিকে নকল দাঁত তৈরি করে। ওদের বাড়িও শিকাগোর কিছু বাইরে। শুনি অঢেল জমি আছে, সুইমিং পুল। মাধবী বলল, বাবার সময়ে আসতে পারিনি …. মা’র সময়ে তবু…

—দিল্লিতে তো বাড়িও কিনেছ।

—ফ্ল্যাট। দেশে ফিরলেও পশ্চিমবঙ্গে থাকব না।

—ছেলেরা আসবে?

—মনে হয় না।

আদিনাথ ও মৃণালের মাধবীলতা আর বাংলার মাটিতে ফুল ফোটাবে না।

—বাসন কোসন?

—ঘর সাজাব কাকা! ভারতীয় অ্যান্টিক বলে কথা!

—ওই সব গামলা হাঁড়ি?

—স—ব। সুভাষ কলসি নিল কেন? ওর বন্ধু অ্যান্টিক জিনিসের ব্যবসা করে না?

স্বাধীন! সুভাষ! দেশ স্বাধীন হবার পর অনেক বাঙালির মতো আদিনাথ আর মৃণালও ছেলেদের নাম ”স্বাধীন” ও ”সুভাষ” রেখেছিলেন।

স্বাধীন তো শ্বশুরাধীন। শ্বশুর ওকে যেমন চালান, তেমনি চলে। লেখাপড়ায় চারজনই চারটি রত্ন। স্বাধীন কেমিস্ট্রিতে ডক্টরেট করেছিল। কিন্তু তিনি নামী দামি চা—বাগানের মালিক। স্বাধীনকে বিশাল চাকরি দিলেন ল্যাবরেটরিতে। তাঁর তিন মেয়ের এক মেয়েকে বিয়ে করেছে স্বাধীন, যে মেয়ে বিক্রি বাটা দেখে। স্বাভাবিক অঙ্কের নিয়মেই সে শ্বশুরাধীন।

স্বাধীন মায়ের কাজে বউ আনেনি কেন?

বউ ঋষিভ্যালিতে ছেলেমেয়েকে দেখতে গেছে।

স্বাধীনরা গাড়িতে সিকিম বা দার্জিলিং বেড়াতে যাবার পথে এখানে এক বেলা—একদিন— আধবেলা—দু’ঘণ্টা হলট করে যায়। স্বাধীনরা কলকাতায় সল্টলেকে থাকে শ্বশুর প্রদত্ত বাড়িতে।

স্বাধীন নরম, নম্র, শ্বশুরের পথের পথী ও রামানন্দ স্বামীর শিষ্য। এই ছেলেটাই চুল দাড়ি ফেলল, কাছা কম্বল নিল, মাটিতে শুল, হবিষ্য করল। শ্রাদ্ধকালে ওর চোখে জলও দেখেছি।

স্বাধীন বলল, কাকা! যতদিন তুমি, ততদিন বাড়ি। তারপর কে আসবে, কে থাকবে?

—সেই তো!

—ছুটি ছাটায় তো ওদের দাদু দিদিমা ব নাতিনাতনিকে নিয়ে বাইরে যান। মা এত দার্জিলিং দেখতে চাইত… আমি আর ..

—এখন আর ভেবে কী হবে? আমি দু’জনের পাশ পাই। দাদা বউদিকে দক্ষিণ ভারত ঘুরিয়েছি। বউদিকে পুরী, শিলং, খুব ঘুরিয়েছি। সে তো প্রকৃত ভ্রমণরসিক ছিল।

হ্যাঁ…. বরাবর দেখলাম… আমরা কিছুই করলাম না … অথচ তুমি সবই করলে।

—আমরা তিনজন খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম তো!

—এ বাড়ি যে কী হবে!

—এখন আছে, রাখলে থাকবে। নইলে বেচে দেবে। দেখ। আমি তো এ বাড়ির কোনও অংশ পাই না। আমার হত, তো দেখিয়ে দিতাম!

—কী করতে?

—বৃদ্ধ বয়েসের বৃদ্ধাবাস। বৃদ্ধাবাসই তো হয়ে গিয়েছিল। তিন বুড়া বুড়ি… দাদা টিকিট কাটল তো আমরা থামলাম…

—ওরা কি রাজি হবে?

—সে আমি জানি না। তবে মাসে আটশো—হাজার দিয়ে থাকতে রাজি হবে অনেকজন। এই শহরেও। নিজেদের দোষ দিও না স্বাধীন, বৃদ্ধ বাপ—মা—কাকা—ঠাকুমা—জ্যাঠা, এখন ঘরে ঘরেই অবাঞ্ছিত! এই প্রজন্ম, পূর্ব প্রজন্মকে নিয়ে বসবাস করতে পারে না। দুই মেরুর ব্যবধান।

সুভাষ বলল, ভালো কমার্শিয়াল প্রপোজাল। তবে করতে হলে কলকাতাতেই ভাল।

—তুমি তো আসতেই পারো না।

—টু বিজি কাকা! তবে বিনি কয়েকবার এসেছে, থেকেছে। রুমাও ঠাম্মাকে ভালবাসে, মানে বাসত। খবরটা পেয়ে কেঁদেও ছিল। তার বেশি তো পারে না।

—বিনি কি মাদ্রাজে?

—হ্যাঁ… রুমাকে নিয়ে ছুটেছে। ব্রেনই যার ড্যামেজ, সে মেয়েকে সারাবে কে? না, ওই যে ডক্টর নায়ারের কথা পড়ল…

—তুমি গেলে না?

—বিনি আর রুমা, ওদের জগতে আমি ঢুকিই না। আর রিয়াল এস্টেট ইজ আ নিউ আইডিয়া। আমার সময় কোথায়?

—টাকা বানাতে ব্যস্ত!

—টাকাটা কোনও ব্যাপার নয় কাকা! যাক গে, এ বাড়ি নিয়ে আর যাইহোক, ন্যালাকে মালিক হতে দিচ্ছি না।

—সে মালিক হবে কেন? আমি তারে দেখব।

—মা তো এইসব করত। একে—ওকে—তাকে…..না, বাড়িটার বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত করে ফেলতে হবে। আমি ভাবি, তোমার কী হবে?

—না সুভাষ, আমার বিষয়ে ভাবার অধিকার কাউকে দিইনি আমি। মাথা উঁচু রেখে চলেছি, তেমন রেখেই চলে যাব।

—সত্যি কাকা… তুমি এমন হাসাতে পার… মাথা উঁচু মানে কী… যত আদ্যিকেলে ধারণা!

—যাও, শুয়ে পড়ো।

—তুমি কী করবে?

—আমি আর ন্যালাও শোব।

—আজ রাতে জানো তো! দিদি খিচুড়ি রেঁধেছে। সত্যি রেঁধেছে।

—ও দেশে তো রেঁধেই খায় সবাই।

—সে জন্যেই তো যাব না। এন—আর—আই হব না। আর—এন—আই হয়ে গেছি।

—বিনি কী বলে?

—ওরা এক ফ্ল্যাটে, সেম ফ্লোরে আমি আরেক ফ্ল্যাটে। মেয়ে নিয়েই সে…

সুভাষ চলে গেল।

পরদিন থেকেই চলে যাওয়া শুরু। ন্যালাকে দিয়ে টাটকা রাইখয়রা মাছ আনলাম, ঝোল করল ন্যালার মা। সুভাষ ভুরু কোঁচকাল, এসব মাছে বেজায় কাঁটা।

—কষ্ট করেই খাও। তোমার মায়ের ভ্রান্ত ধারণা ছিল, রাইখয়রা খেতে তার ছেলেমেয়ে ভালবাসে। এবারটা যা হবে তারই সম্মানে।

স্বাধীন ও সুভাষ নিজের নিজের গাড়িতে, মাধবী গাড়ি ভাড়া করেই এসেছিল। যতিনাথ গাড়ি—না—থাকা পার্টি, ক্ষমাপ্রার্থীর মতো মাধবীর সঙ্গেই গেল। সুভাষ বলল, দাদা! কেনো তো আমার পুরনো অ্যামবাসাডরটা বেচে দিই।

ওরা চলে গেলে লোহার সিঁড়িটার গায়ে টর্চ ফেলে দেখে এলাম। মৃণাল বউদি বলত, স্বপন দেখতে জানত তোমার দাদা। পোলারা খোঁজ নেয় না, মাইয়া বিদেশে, কার লিগ্যা দোতলা উঠাইত?

আমরা তিনজনে, পরে দু’জনে দেশের কথা বলেছি। বলেছি বলা ঠিক নয়। অবিকৃত তো থাকেনি। টানেটোনে বুঝে নাও কোন দেশের মানুষ।

—মাইয়া পোলাদের লিগ্যা বুক পুরায়?

—না ঠাকুরপো। তারা যে—যার মতো সুখে থাকুক। অহনই এই সব ভাবি,—আমার দিদিমার সাত বছরে বিয়া, দশ না হইতে শ্বশুরঘর,—উৎরানীর চানে বইনরে দেইখাও চিনে নাই। কুনো কষ্ট নাই আমার, তোমরা তো আছ।

দাদা হাঁপানিতে ভুগে ভুগে বড় কষ্ট পেয়ে মারা যায়। দাদার মৃত্যুর আগে বউদি বলত, ঠাকুর অরে লয় না কেন? কত কষ্ট দিব?

মৃত্যুর পরে বলল, হে শান্তি পাইছে গো! দেহ, মুখে কুনো কষ্টের চিহ্ন নাই। য্যান ঘুমাইতেছে।

এসব ভাবতে ভাবতেই ওরা বিদায় হলে আমি প্রত্যহের মতো নদীর ধারে বেড়াতে যাই। ননীবাবু ঠুকঠুক করে এসে বসল। বলল, ভাবলেন কিছু? কোথায় থাকবেন?

—এখনো তো ওখানে।

—আদিবাবুর ছেলেরা বাড়ি বেচে দেবে। বাপ মা বলেই কোনও টান ছিল না, বাড়ি রাখে?

—মনে হয়….. রাখবে না।

—তখন? পথে বসবেন?

—না না, আপনার প্রস্তাবটা ভাবছি।

—এত ভাবছেন বা কেন? দু’জন ব্যাচেলর মাস্টার, দু’জন স্বাধীনতা সংগ্রামী, আর দু’জন কি জুটবে না? জমি আপনার, সেই আপনি তো থাকবেন। ঘরটা তোলা নিয়ে কথা….. তা তিনটে ঘর, দুটো বাথরুম…..হয়ে যাবে।

—হয়ে যাবে নিশ্চয়। ছ’কাঠায় তিন কাঠা বেচলেই হয়ে যাবে।

—আপনার নামেই হবে।

—আমার নয়, দাদা বউদির নামে। ন্যালা আর ওর মা’র একটা ঘর থাকবে।

—ভাগ্যে কিনেছিলেন!

—সবের মূলেই বউঠান! জোর করে কেড়েকুড়ে নিয়ে নিল টাকা। বলল, তিনশো টাকা কাঠা! কেনো ঠাকুরপো। টাকা তোমার থাকবে না।

ননীবাবু সদুঃখে বলল, আমি কিনেছিলাম দু’শো টাকা কাঠায়। সদরও নয়, মহকুমা শহর। সেখানে জমির দাম চল্লিশ হাজার টাকা কাঠা হবে জানলে কি আরও জমি কিনতাম না? কে জানত, হাইওয়ে হবে, রেললাইন কাছে আসবে। মহকুমা সদর হবে টাউন। এখন ছেলে এমন গাল দেয় ”নির্বোধিতা করেছেন” বলে, জানলে তো আমিই কিনতাম।

আমি বললাম, সে তো বটেই।

যা বললাম না, তা সবাই জানে, কেউ বলে না। ননীবাবু তখন তিনশো টাকা কাঠায় জমি কিনবে কি, কোনও জমিই কিনত না। জমিদারি এস্টেটের গোমস্তা, সে জমি বা বাড়ি কেনেনি, হাতিয়েছে। তখন পুকুর ধানজমি, ভালই গুছিয়েছিল, ছেলেরা বাগিয়ে নিয়েছে।

আমি জানি, বউঠানের তাড়ায় জমি কিনি, রেজেস্ট্রি করাই, পাঁচিলও দিই। ননীবাবু যতই বলুক, বৃদ্ধাবাস তো করব না। ”আদিনাথ—মৃণাল ভবন” হবে নিচে দু’খানা, ওপরে একখানা ঘর। ঘোরানো সিঁড়ি ছাড়া সিঁড়ি থাকবে না। নিচে থাকবে ন্যালার মা। আমি ঘোরানো সিঁড়ি ধরে উঠে যাব ওপরে। ”নেউগী বংশের ইতিহাস” লিখব হয়তো। অন্তত পৃথিবীর বুকে নিজের নাম লিখে যাবার যে মরীচিকা দেখে নেউগীরা প্রজন্ম হতে প্রজন্মে ধাবিত,—তার কিছু নোট করে রেখে যাব।

”তাপস কুমার ঘোষের মতে বর্ষপঞ্জী আর তিনশো পঁয়ষট্টি দিন থাকছে না। পৃথিবীর সূর্য ঘিরে আবর্তনের বলয়টি সঙ্কুচিত হচ্ছে। ফলে বর্ষপঞ্জী থেকে প্রত্যহ ০.১ মিলি সেকেন্ড কমে যাচ্ছে।”

এই যখন ব্যাপার স্যাপার। তখন নেউগীরা নিজ নাম স্থায়ী করার জন্যে কী কী অবিমৃষ্যকারিতা করেছে, সে তো আমার লিখে রাখা কর্তব্য। সেই কাজই করব।

সুভাষটার ঘোর সন্দেহ, একদা দাদাকে কিছু টাকা দিয়েছিলাম বলে, আমি কোনওদিন ও বাড়ির অংশ দাবি করতে পারি।

ছিল, এমন সন্দেহ তার ছিল। এবার তো কাগজপত্র হাবি জাবি, সকলই দিয়ে দিয়েছি। বললাম, দেখিয়ে নিও, দেখে নিও, এই বাড়ির উপর কোনও দখল নেই আমার।

মাধবী বলল, তোমার সম্পর্কে এমন কথা ভাববে কে? তুমি তো মামলা করতে যাবে না।

আমি ঈষৎ হেসে বললাম, এসব কথা উচ্চারণও কোরো না মা!

ব্যাপারটা এই, মামলা যদি করতে চাই, তাহলে আমাকে কেউ ঠেকাতে পারত না। মামলা করেই দাদার সোদপুরের বাড়ি খালাসও করাই, বেচেও দিই। বৃথা কাজ অনেক করেছি।

এখন আমার উদ্যম নেই। বয়স অনেক, শরীর শক্ত, এখনও কাজের কাজ করা বাকি।

ঘোরানো সিঁড়ি নাম দেব কি আমার সেই নোট বুকের, যার একটা পাতাও লেখা হয়নি কাগজে? শুধু মন লিখে চলেছে, মন। ঘোরানো সিঁড়ির বাঁকে বাঁকে কত না কথা, কত তথ্য!

ননীবাবু বলল, কী ভাবছেন?

—ঘোরানো সিঁড়িটার কথা।

—লোহার দামে বেচে দিলেও….।

—ওটা বেচা যাবে না। চলুন, উঠি।

—বাজার করে ফিরবেন না আজ?

—নাঃ, ঘরে আছে সবই।

—সবাই আসতে পারেনি!

—তাই কি পারে? বউঠান তো কোনও দিনই কাজের ব্যাঘাত করে ওরা আসুক, তা চায়নি। মাধবী এসেছিল, সে তো এমন নয়, যে কেষ্টনগরে থাকে! যতি, স্বাধীন, সুভাষ—এরা এল এই তো যথেষ্ট। বউঠান বুদ্ধি করে গ্রীষ্ম বা পূজার ছুটিতে তো মরেননি।

—ওরা কমই আসত।

—এঁরাও যেতেন না। দাদার তো বাড়ি বলে ম্যানিয়া ছিল। বউঠানের আবার সেন্টিমেন্ট জন্মে গেল, তোমার দাদারে কথা দিছি, বাড়ি ছাইরা যামু না।—এইসব হাবি জাবি আর কি…

ঈর্ষা—দগ্ধ নিঃশ্বাস ফেললেন ননীবাবু!

—চার ছেলে মেয়েই লেখাপড়ার রত্ন একেকটি। চারজনই কৃতী!

—হ্যাঁ, দাদা—বউঠানের কৃতিত্ব সেটা। স্কুলের রেজাল্ট দেখেই কলকাতায় রেখে পড়ালেন। ওরা স্কলারশিপও পেয়েছে, আমার কষ্টও করেছে! টিউশানি করা, মেসে হস্টেলে থাকা, কম কষ্ট নয়।

—আমার ছেলে দেখুন! এইচ. এস. তাও ”পি” ডিভিশনে বিদ্যার জাহাজ!

—টাকা তো করছে!

—তা করছে!

আমি হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটাহাঁটিটা এ বয়সেও বন্ধ করিনি। এটি বন্ধ করলেই মরে যাব।

.

এতক্ষণ যা বললাম, ১৯৮৭ সালের কথা। বউঠান গেলেন। ওরা এসেছিল।

এই আট বছরে দৃশ্যপটে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। যতিনাথের বউ সুলতা মাথায় রক্তচাপে অসুস্থ। কলেজে যেতে পারে না। ঘরবন্দী হয়ে আছে। সুলতার এক ভাইপো সস্ত্রীক ওখানে থাকছে। যতিনাথের খুবই লেজে—গোবরে অবস্থা।

মাধবীর ছেলেরা স্বাবলম্বী হয়ে সরেও গেছে, ও দেশেই যে—যার ব্যক্তিগত জীবন গড়ে নিয়েছে। সুভাষ বলে, বিয়ে, না বিয়ে নয়, তা জানি না। ওসব ভাববে কে?

সবুজ এ বয়সে মাধবীকে ছেড়ে আবার বিয়ে করেছে। এটা ঘটনা। মাধবী বছর তিনেক হ’ল দিল্লিতে। নিজের ফ্ল্যাটেই পেয়িং গেস্ট রেখে চালায়। নিজেও কোথাও পার্ট—টাইম কাজ করে।

স্বাধীন শ্বশুরাধীন ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর বউয়ের অধীন। সে সাত বছরে বার আষ্টেক ঘুরে গেল। প্রতিবারই সদরে ট্যুরিস্ট লজে থাকল,—গাড়ি করে ঘুরে গেল।

সুভাষ নয়, বিনির কথা ভাবলে কষ্ট পাই। ওর মেয়ে রুমা গত বছর মারা গেল। সে যে ভাল হত না, জড়বুদ্ধি মাংস স্তূপ হয়েই থাকত, একথা বিনিও জানে। কিন্তু বিনির অবলম্বন তো চলে গেল। সুভাষ বিনিকে নিয়ে ইউরোপ ঘুরেও এল, কিন্তু বিনির বিমর্ষতা কাটছে না।

আট বছর ধরে আমাদের প্রচুর পত্রালাপ হয়েছে। প্রধানত সুভাষের সেক্রেটারিকে দিয়ে লেখানো কাজের চিঠিপত্র।

তা আমি শেষ পত্রে লিখলাম, যা ঠিক করবে, করো। আমি সকল প্রস্তাবেই ”হ্যাঁ” বলব, তবে একই শর্ত,—আমি ন্যালা ও ন্যালার মাকে নিয়ে চলে যাব। তোমাদের বাবা—মা, আমার দাদা—বউদির চেয়ে অনেক বেশি ছিল। পৃথিবীতে আমার আপনতম জন। তাদের সম্মানার্থে অনেক দিন কাটিয়ে গেলাম এখানে। এখন মুক্তি চাই। আমার বয়স পঁচাত্তর।

এরমধ্যে আশ্চর্য, বিনি একদিন এল। সঙ্গে এনেছিল একটি মহিলাকে,—যিনি বাংলার চেয়ে ইংরিজি বেশি বলেন। কিন্তু ন্যালার মাকে ও ন্যালাকে নিয়ে বাড়ি পরিষ্কার করলেন দু’দিন ধরে।

বিনি একবারও রুমার কথা বলল না। শুধু বলল, মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কোনও স্কুল কাম মেডিক্যাল সেন্টার গড়ার পক্ষে বাড়িটা ভাল।

—কাজে লাগলেই ভাল। বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি তো মেলে না বিনি। কর্মেই বন্ধন, কর্মেই মুক্তি।

—হ্যাঁ কাকা….. কিন্তু আমার তো কিনে নেবার পয়সা নেই।

—সুভাষের আছে।

—ও মনে করে রুমার নামে মাদার টেরিজাকে দিয়ে দেয়া অনেক ভাল। ও নিজে কিছুতে জড়াতে চায় না। বন্ধুর অসুখ, ফুল পাঠিয়ে দাও। কারও জন্মদিন, উপহার পাঠিয়ে দাও। রুমাকে নিয়ে কষ্ট হচ্ছে? ওর নার্সকে নিয়ে লং ড্রাইভে বেরিয়ে যাও। সুভাষ খুব অপরিণত মানুষ।

—তোমার ওর ওপর কোনও রাগ নেই বিনি?

—একটুও না। মাত্র তো পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স ওর। রুমাও চলে গেল। সুভাষ আমাকে ছেড়ে দিক, আরেকটা বিয়ে করুক!

—করবে না?

—বিবাহিত জীবনের দায় স্বীকারে ওর ভয়।

—তুমি তো মেনেও নিলে এত বছর।

—রুমা ছিল না? ওঃ, সেই জাম গাছটা। ওর নিচে মা বসতেন রুমাকে নিয়ে। ও কাদায় গড়াত। পাখিদের কাছে ডাকত। সকালে পায়রাদের চাল দিত। কাকা! তখন তো তুমিও দেখেছ ওকে।

—বউদি তো ম্যাজিশিয়ান ছিল বিনি।

—মা যতদিন অসুস্থ, আমি রুমাকে নিয়ে কোথাও যাইনি? রাজস্থান, পনহেরী, হায়দ্রাবাদ….কিছু তো হ’ল না।

—বাড়ি এরা রাখবে না।

—দেখি….সুভাষ যদি রাজি হয়…

—না হলে?

—জানি না। চলে যাব পনহেরী। রুমার মতো ছেলেমেয়েদের ইনস্টিট্যুশনে সোশাল ওয়ার্কার হব। একটা কিছু করব। সুভাষ ….আমাকে অবাক করে দিচ্ছে। শুধু বলছে, যেও না। আমাকে ওর খুব দরকার।

—বাইরেই আলানফালান করে, ভেতরটা তো সেই চেনা সুভাষের। মধ্যবিত্ত মানুষ ঘোরানো সিঁড়ি ধরে হাইরাইজে ওঠে, কিন্তু তার রক্তের সংস্কার, মূল্যবোধ, একটা লক্ষ্মণের গণ্ডী দিয়ে রাখে। সংকটকালে বোঝে, বেরতে পারবে না। তুমি আর রুমা। ভাব দেখাত তোমাদের বাদ দিয়ে ওর চলবে। কিন্তু সেটা সত্য নয়।

—হয়তো তাই সত্য, সেটাই।

—ভাঙাচোরা সহজ, এ বয়সে কোন প্রেমিস থেকে শুরু করবে?

—রুমার কথা ভাবলে….

—আমারি কি মনে হয় না? বউদির কথায় তারে কোলে নিয়ে রুপোর বালা পরিয়ে এনেছি। শান্ত মেয়ে—কেন যে এমন হ’ল! যাক, সুভাষও কি তাই বলছে?

বিনি মাথা নাড়ল।

—সে কিছুই বলছে না। জমি বাগাচ্ছে, হাইরাইজ বানাচ্ছে। এটা তো উন্মত্ততা কাকা। তোমার একমাত্র সন্তান, সেও থাকল না। কার জন্য এত সম্পদ বানাচ্ছ? ও উন্মাদ হয়ে গেছে।

—যা ঠিক করবে, তাই করো মা! তবে আমি মনে করি, চলে গিয়ে রুমা তোমাকে মুক্তি দিয়ে গেছে। আমাদের গেনি পিসিমার কথা তো জানো।

—তাঁরও তো মেয়ে।

—মেয়ে তো বটেই। গেনি পিসিমার তেরোতে বিয়ে, ষোলোতে মা। সে মেয়ে জন্মালই এক বিকৃত শিশু। দুটো পা পরস্পরের সঙ্গে জড়ানো, সম্পূর্ণ জড়বুদ্ধি।

—চিকিৎসা হয়নি?

—পূর্ববঙ্গের গজগ্রাম রে মা! অমন মেয়ের জন্ম দিয়ে গিনি পিসি অপরাধী। তা বাদে পিসেমশাইও মারা যান। উনি মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি ফিরে এলেন। খুব, খুব নাটাঝামটা হয়েছেন। মেয়েটাকে একটা ঘরে বসিয়ে উনি সেই বৃহৎ সংসারের নানা কাজ সারতেন। বেলা গড়ালে মেয়ের মলমূত্র পরিষ্কার করে তাকে নাইয়ে ধুইয়ে ভাত মেখে খাওয়াতেন, তারপর নিজে স্নান করে খেতেন….

রোগা, ফর্সা, চুল ছাঁটা গিনি পিসি, হাবির মা হয়ে যে কী নরকদণ্ড ভোগ করে গেলেন!

সে মেয়েও একদিন রজঃস্বলা হয়েছিল। সব করে দিতেন গিনি পিসি। এই দণ্ড ভোগ করেন তিনি নব্বই বছর। ততদিনে ভাইয়ের নাতির গলগ্রহ হয়েছেন, বসবাস গোয়ালের পাশে। বলতেন, আমি তো পারিনি। ”দেখ, আমি মরলেই ওরে তোরা বাঁশবনের ডোবায় ফেলে দিয়ে আসিস। অনেকবার ভেবেছি, পরিনি।”—এ কথা বলতেন।

হাবি থেকে থেকে হাঁ করে করে হাসত আর দুলত। ও তো বসতে বা শুতে পারত না। দু’হাতে ভর দিয়ে বসে বসে দুলত।

চুয়াত্তর বছর মাকে যমযন্ত্রণা দিয়ে, চুয়াত্তর বছর বয়সে হাবি একদিন মরে গেল। নড়ে না, চড়ে না, কাঠ।

আর হাবি মরতে না মরতে গিনি পিসি মাঘের বিকেলে গোয়াল ছেড়ে বাইরে গিয়ে শুয়ে থাকলেন গাছের নিচে। ”ওই হিমে জাড়ে মরে যাবে” শুনে বললেন, কোনদিন তো জ্বরজ্বালা, অসুখ পালা হয়নি এবার হবে, জ্বরজ্বালা হয়নি। খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়ে মরে গেলেন।

গেনি পিসির কথা শুনলেই আমার বউঠান শিউরে উঠতেন। বলতেন, কেমন নিয়ম ঠাকুরপো? একা মা দোষের দোষী হয়ে থাকলেন? তখন তো মাসে দুটো টাকা আর কাপড় দিলে একটা কাজের মেয়ে রাখতে পারত।

বিনি বলল, তাঁরা তো নেই।

—নেই তো বটেই। হাবি কিন্তু চুয়াত্তর বছরে মারা যায়। রুমা তোমাকে মুক্তি দিয়ে গেছে। তাই বিনি! যা কোরো ভেবে চিন্তে কোরো। সুভাষ ও তুমি, এক সঙ্গে থাকো, বা দূরে,—এ—ওর শত্রু হোয়ো না।

—না, শত্রু হব কেন?

—হয়, তাও হয়।

—আগেও হত?

—নিশ্চয়। তোমরা কী মনে করো? যা হয় তা এখনই হয়? সবই আগেও হত। বহিরঙ্গ পালটায় রে মা! ভিতর ভিতর আমরা খুব সেকেলে। খুব কি বদল ঘটেছে? আমি তা মনে করি না।

—খুব নেতিবাচক মন্তব্য।

—শুরু হয়েছে, কিছু কিছু প্রকাশ দেখা যাচ্ছে, তবে সেকালেও ব্যতিক্রম দেখা যেত।

—কাকা!

—বলো।

—ন্যালা, ওর মা…..

—আর আমি?

—কোথায়?

—যাব কোথাও। আমার বয়সই কি কম হ’ল? তবে বউদির কাছে কথা দিয়েছিলাম, তার সন্তানদের হাতে বাড়ি তুলে দিয়ে যাব। তার অবশ্য শেষে জ্ঞানোদয় হয়েছিল। বুঝত যে ছেলেরা বা মেয়ে কেউ থাকবে না।

—বড়ই অবহেলা পেয়ে গেলেন।

—কিসের? আমি ছিলাম না? দাদার নির্দেশ ছিল, ও বাবা! বউদির তুচ্ছতম ইচ্ছাও অপূর্ণ। রুমার কল্যাণে এ বাড়িতে সত্যনারায়ণ পূজা কতবার হয়েছে, তা তোমরা খবরও রাখো না। আরে ন্যালার উপর…. ওঁর যে টান…

—কাকা!

—হ্যাঁ, সে জন্যই। থাক, বিনি, কাল তোমরা যাবে।

বিনির বান্ধবী মহিলা ঘরে ঢুকলেন। বললেন, বাড়ি ঝকঝকে করে দিলাম। অবশ্য তেমন অপরিষ্কার ছিল না।

বিনিরা চলে যাওয়ার পর আমি ঘুরে ঘুরে দেখলাম। ন্যালাকে বললাম, কেমন দেখছিস?

—খু—উ—ব ভাল।

—এমনই রাখবি। যা, ফুল লইয়া আয়। নিত্য ঘরে ঘরে ফুল রাখবি। ধুনা দিবি। তারা আইলে যেমন চক্ষু ধাধায়।

—হ্যাঁ গো ছোটকত্তাদাদা!

—বিনিরে কিছু বলিস নি তো?

—না না। তিনি বলছিল, লোহার সিঁড়ি নিয়ে কাকা যাবে কোথায়?

আমি হাসলাম। ন্যালার চোখে ভীরু আশা, মিনতি, অনিশ্চয় ভবিষ্যতের ভয়।

বললাম, যেখানে যাই, তুই যাবি। তোরে আমি ভাসাব না। দাদা আর বউদি তোরে আমার হাতে সমর্পণ কইরা টিকিট কাটছে। যা, ফুল আন।

বাড়িটা সজ্জিত, ঝকমকে। দাদার জন্মদিনে আদিনাথ ও মৃণালের সন্তানরা আসবে।

আসুক, আমি তৈয়ার।

লোহার সিঁড়িটার উদ্দেশ্যেও বললাম, যাবি, যাবি।

.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *