গ্রাস – ৮

আট

একুশ দিনে কতটুকু বদলেছে ফোর্ট ফ্যারেল?—বাস টার্মিনাল থেকে কিংস্ট্রীটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছে রানা। পার্কের পাশ ঘেঁষে যাবার সময় থামল। হঠাৎ‍ মনে হয়েছে কথাটা। ক্যামেরাটা কাঁধ থেকে নামিয়ে চোখের সামনে তুলল। একটা ছবি তোলা যেতে পারে লেফটেন্যান্ট ফ্যারেলের। ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে তাকাল রানা। অন্তত লেফটেন্যান্ট ফ্যারেলের কোন পরিবর্তন হয়নি। এক চুল নড়েনি তার একটি পেশীও।

মূর্তিটার সাথে পার্কের গেটের একটা অংশও ক্যামেরায় বন্দী করল রানা। পার্কের নামটা যদি কোনদিন বদলেও ফেলা হয়, একটা ছবি অন্তত পুরানো নামের স্মৃতি বহন করবে।

শেষ বিকেলের হলুদ রোদ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে শহরটা। অসুখ-বিসুখ করে না থাকলে, ভাবল রানা; এসময় গ্ৰীক কফি হাউজে পাওয়া যাবে দাদুকে।

ঢোকার মুখেই দেখতে পেল রানা বুড়োকে। কপালটা প্রায় ঠেকে গেছে টেবিলে। হালকা হয়ে আসা চুলের ফাঁক দিয়ে চিক চিক করছে ঘাম। হ্যাটটা পড়ে আছে টেবিলের একধারে। গভীর মনোযোগের সাথে তাকিয়ে আছে লংফেলো টেবিলের উপর।

নিঃশব্দে কাছে গিয়ে দাঁড়াল রানা। টের পায়নি বুড়ো। রানা দেখল, ছোট ছোট আট দশটা কাগজের চার ভাঁজ করা টুকরো ছড়িয়ে রয়েছে টেবিলের উপর। এক চুল নড়ছে না লংফেলো। ভাঁজ করা কাগজগুলোর দিকেই তার নিবিষ্ট মনোযোগ।

‘ধাঁধাটা কি?’

চমকে উঠল লংফেলো। মুখ তুলতে গিয়েও হঠাৎ কি ভেবে তুলল না সে। ‘কে তুমি? দাঁড়াও, পরিচয়টা এখুনি দিয়ো না,’ কথাটা বলে টেবিল থেকে দু‘আঙুলে একটা কাগজের টুকরো তুলে নিয়ে মুখ খুলল সে।

একগাল হাসল। ‘আজ দু‘হপ্তা ধরে রোজ এই ভাগ্য গণনা পরীক্ষা করছি। কিন্তু…’

একটা চেয়ার টেনে বসল রানা। ‘কি আছে কাগজগুলোয়?’ ক্যামেরা আর ব্যাগটা নামিয়ে রাখল ও টেবিলের পাশে।

‘দশ টুকরো কাগজের মধ্যে একটা ছাড়া নয়টাই ফাঁকা। আজ চোদ্দ দিনে চোদ্দবার যে-কোন একটা তুলে দেখতে চেয়েছি তোমার নাম লেখাটা ওঠে কিনা। ওঠেনি। যেদিন ওঠেনি সেদিন বুঝেছি তুমি আজ আসছ না। কিন্তু…আজ় দেখা যাক!’ হাতের কাগজটার ভাঁজ খুলতে শুরু করল বুড়ো।

‘বুড়ো হলে মানুষ শিশুর মত হয়ে যায়, কথাটা দেখেছি পুরোপুরি সত্যি!’

কিন্তু এটা ছেলেমানুষি নয়। এই দেখো।’ আনন্দে চকচক করছে লংফেলোর মুখ। ভাঁজ খোলা কাগজট রানার সামনে মেলে ধরল সে।

রানা দেখল, সুন্দর স্তাক্ষরে ওর পুরো নামটা লেখা রয়েছে কাগজটায়। ‘আর সব খবর কি, মি. লংফেলো? তোমার ওপর কোন রকম চাপ আসেনি তো?’

‘এখনও আসেনি,’ লংফেলো দুটো আঙুল তুলে দু‘কাপ কফি দিতে বলল ওয়েটারকে। ‘ভবিষ্যতে আসবে সে ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তুমি এত দেরি করলে যে? যে কাজে গিয়েছিলে তা হয়েছে?’

‘খানিকটা, ‘প্রসঙ্গটা ওখানেই শেষ করতে চাইল রানা। তারপর বলল, ‘শীলা ক্লিফোর্ডের খবর কি?’

‘বয়েড তাকে কি বলেছে জানো?’ হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল লংফেলো। তুমি নাকি শীলার সাথে এক বিছানায় রাত কাটাবার রসাল একটা গল্প বলে গেছ তাকে। শীলা শুনে তো মহা চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিয়েছিল। ফোর্ট ফ্যারেলের এমন কোন জায়গা নেই যেখানে তোমাকে ধরে নিয়ে যাবার জন্যে লোক পাঠায়নি সে। আমি ব্যাপারটা জানতে পেরে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করি, কিন্তু ব্যাপারটা সে মেনে নেয়নি। রাগে, দুঃখে দু‘দিন পরই সে চলে গেছে ফোর্ট ফ্যারেল ছেড়ে।

‘সে কি। চলে গেছে। কবে আসবে কিছু বলে যায়নি?’

‘না।’

‘কিন্তু বয়েডের কথা শীলা বিশ্বাস করল?’ বিস্ময়ের সাথে জানতে চাইল রানা।,‘বিশ্বাস করবেই না বা কেন? বয়েডকে তুমি ছাড়া আর কেই বা বলতে পারে কথাটা?’

‘বিগ প্যাটের কথা মনে পড়েনি তার?’

‘বিগ প্যাট?’ হঠাৎ আঁৎকে উঠল লংফেলো, ‘আরে, তাই তো। বুঝেছি, তারই ষড়যন্ত্র এটা। তাই তো বলি, শীলার চাকরি ছেড়ে রাতারাতি বয়েডের বাঁ হাত হলো, সে কিভাবে।

‘বয়েড ওকে বাঁ হাত হিসেবে নিয়েছে বুঝি?’ ওয়েটার দু‘কাপ কফি দিয়ে গেল।

‘পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে বাঁধ তৈরির কাজ। আলো জ্বেলে কাজ চলছে সারারাত। বিগ প্যাট এখন যে সে লোক নয়, সাড়ে তিনশো কুলি মজুরের সর্দার সে, পদের নাম সুপারভাইজার।’ সশব্দে চুমুক দিল সে কফির কাপে।

‘ভুল বুঝে এভাবে চলে গেল শীলা? বাঁধ তৈরি হলে কতটুকু ক্ষতি হবে তার এ কথাটা একবার ভেবে দেখল না?’

‘তুমি চলে যাবার পরদিনই এ ব্যাপারে শীলার সাথে বয়েডের যা আলোচনা হবার হয়ে গেছে।’

‘মেনে নিয়েছে শীলা?’

‘মেনে না নিয়ে উপায় আছে কিছু?’ লংফেলা ক্ষোভের সাথে বলল। বয়েড় তো বললই, শীলা নিজেও বুঝতে পেরেছিল, ফোর্ট ফ্যারেলের জনসাধারণ বাঁধের স্বপক্ষে। লোকদের আর দোষ কি! তাদেরকে যা বোঝানো হয়েছে তারা তাই বুঝেছে। বাঁধ হলে ফোর্ট ফ্যারেল রাতারাতি স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা পৃথিবী হয়ে উঠবে, প্রতিটি লোক সরাসরি উপকৃত হবে—বয়েডের ম্যানেজাররা ক্লিফোর্ড পার্কের মধ্যে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে এইসব কথা বুঝিয়েছে সবাইকে। তারা শীলার আপত্তি শুনবে কেন?

‘কতদূর এগিয়েছে কাজে?’ হঠাৎ বিস্বাদ লাগল নানার মুখে কফি। কাপটা একপাশে নামিয়ে রাখল ও।

‘অনেক দূর, বলল লংফেলো। ‘ধরো, মাস দেড়েকের মধ্যে উপত্যকার দশ মাইল জুড়ে একটা লেক দেখতে পাবে। ইতিমধ্যেই ওরা গাছ কেটে সরাতে শুরু করেছে। অবশ্য, শীলার গাছে হাত দেয়নি। বয়েড়কে নাকি সে মুখের ওপর বলে গেছে তার গাছ ডুবে যায় যাক, কিন্তু পারকিনসনদের মণ্ড কারখানায় ওগুলো পাঠাবে না।’

‘আজ রাতে তোমার অ্যাপার্টমেন্টে আসছি আমি,’ সিগারেট ধরাল রানা। ‘কয়েকটা কথা বলার আছে তোমাকে।

কৌতূহল উপচে পড়ল লংফেলোর ক্ষুরধার চোখে। ‘কি কথা? একটু আভাস পেতে পারি না?’

‘এখন না,’ বলল রানা। আবার দেখা হলে বলব।

‘শীলা স্কচ হুইস্কির একটা বোতল দিয়ে গেছে এই বুড়োকে,’ বলল লংফেলো। ‘ওটা সামনে নিয়ে বসে থাকব আমি তোমার অপেক্ষায়। বেশি দেরি করলে কিন্তু শেষ হয়ে যাবে সব।’

উঠে দাঁড়াল রানা। ‘চললাম।’

‘মাই গড!’ মাথায় হাত দিল লংফেলো, ‘সত্যি-ভীমরতি ধরেছে আমার। রানা, তুমি উঠেছ কোথায়? ফোর্ট ফ্যারেলে একটা মাত্র হোটেল, সেখানে যে তোমার জায়গা হবে না…’

‘হোটেল ছাড়া জায়গা নেই নাকি ফোর্ট ফ্যারেলে?’

‘হোটেল ছাড়া জায়গা! কোথায়?’

‘সে-কথা তোমাকে ভাবতে হবে না, মিস্টার!’, বলল রানা। ব্যাগ আর ক্যামেরাটা তুলে নিল কাঁধে। কখনও কোথাও থাকার জায়গার অভাব হয় না আমার, সরকারী ফুটপাথ আছে, ক্লিফোর্ডদের তৈরি করা পার্ক আছে, একশো মাইল জুড়ে জঙ্গল আছে…।’

‘বুঝেছি, এখনও কোথাও ওঠোনি তুমি।’ লংফেলো এক মুহূর্ত কি যেন চিন্তা করল। ‘ঠিক আছে, তুমি আমার বাড়িতে উঠবে, রানা। আর শোনো, এ ব্যাপারে বৃথা জেদ করতে যেয়ো না। তোমার কোন আপত্তি আমি শুনছি না।’

হেসে ফেলল রানা। ‘আচ্ছা, সে দেখা যাবে।’

দৃঢ় পদক্ষেপে বেরিয়ে গেল সে গ্রীক কফি হাউজ থেকে।

***

‘হে-হে, হেহ্-হে,’ আনন্দে চকচক করছে লংফেলোর মুখটা। হাসি আর ধরে না! ‘ঠ্যালা সামলাও দিকি এবার ভায়া। চেক! রাজাকে সামলাতে হলে মন্ত্রী স্যাক্রিফাইস করতেই হচ্ছে তোমার।’ নিজের ঘোড়া দিয়ে চেক দেবার সময় দ্রুত রানার হাতিটাকে মুঠোর ভিতর পুরে নিল লংফেলো।

কালো কিং আর সাদা নৌকার মাঝখান থেকে নিজের সাদা কিং সরিয়ে নিয়ে কালো ঘোড়ার নাগাল থেকে মুক্তি পেল রানা। ‘মন্ত্রী খাবার আগে একটা চেক তোমাকেও সামলাতে হচ্ছে, মিস্টার লংফেলো। দুঃখিত।’ চুরির ব্যাপারে কিছুই বলল না ও।

‘আরে সব্বোনাশ!’ কপালে হাত দিন বুড়ো। ‘নৌকাটাকে তো দেখিনি! মাই গড়, রানা, আমার রাজার যে নড়ার জায়গা নেই!’ ভুরু কুঁচকে উঠল তার। ‘মানে?’

‘বুঝে নাও!’

মিনিটখানেক নিবিষ্ট মনে দাবার বোর্ডটা দেখল লংফেলো। মুখ তুলল বটে কিন্তু সযত্নে এড়িয়ে গেল রানার সাথে চোখাচোখি হবার সম্ভাবনাটাকে। বোতলটা তুলে নিয়ে নিজের গ্লাসে হুইস্কি ঢালল। তারপর নিঃশব্দে হ্যাটের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে সাদা হাতিটা বের করে রাখল বোর্ডের উপর। ‘যত দোষ এই হাতিটার। চুরি করার আনন্দে এত মশগুল ছিলাম যে বিপদটা চোখেই পড়েনি।’

‘আমার চোখে পড়েছিল, তাই বাধা দিইনি চুরির ব্যাপারে।’

সিগারেট ধরাল রানা। আধ ঘন্টার উপর হলো লংফেলোর অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছেচে ও। প্রথম থেকেই বেশ একটু গম্ভীর দেখছে ওকে লংফেলো। সে বুঝতে পেরেছে, সামান্য হলেও উদ্বেগজনক কিছু একটা ঘটেছে। তাই সরাসরি কোন আলোচনায় না গিয়ে দাবার বোর্ড খুলে খেলতে বসায় রানাকে। খেলায় চুরি এবং পরে তা নাটকীয়ভাবে স্বীকার করার মধ্যেও রয়েছে রানার মনটাকে হালকা করার জন্যে তার আন্তরিক চেষ্টা।

এবং এ সবই বুঝতে পারছে রানা।

‘কথাটা তাহলে বলেই ফেলি,’ হঠাৎ বলল রানা, ‘তোমার জন্যে একটু চিন্তা হচ্ছে, মিস্টার লংফেলো।’

‘আমার জন্যে? কেন কেন?’ হাসতে হাসতে রানার দিকে ঝুঁকে পড়ল লংফেলো ৷

‘এখানে ঢোকার মুখে একজন দেখে ফেলেছে আমাকে,’ বলল রানা। ‘অনেকক্ষণ থেকেই অনুসরণ করছিল, তবে খসিয়ে দিয়েছিলাম একসময়। কিন্তু ঢোকার সময় হঠাৎ আবার তাকে দেখেছি।’

‘এর জন্যে এত চিন্তা!’ মুখভাব দৃঢ় করল লংফেলো। ‘হুঁহ্! তুমি ভেবেছ ওদেরকে আমি ভয় পাই এখনও? সেদিন গত হয়েছে, রানা। এখন আমি সাহসে বুক বেঁধেছি, যা হবার হবে, আমি ওঁদের পিছনে লেগে থাকছি যতদিন রহস্যের সমাধান হয়।’

‘তোমার যদি কোন ক্ষতি হয়…’

‘হবে কেন, শুনি? আমি একজন অসহায় বুড়ো, তাকে তুমি রক্ষা করতে পারবে না? যদি না পারো, কিসের পুরুষ মানুষ তুমি, অ্যাঁ?’

হেসে ফেলল রানা। ‘তোমাকে রক্ষা করাটাই তো আমার একমাত্র কাজ নয়। নিজের কথা বা শীলার ব্যাপারও ভাবছি না। কেন আমি এখানে এসেছি, লংফেলো? কেনেথের প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে তার প্রতিশোধ নিতে, ঠিক?’

‘ঠিক।’

‘খুন করা হয়েছে, তাকে, এটা পরিষ্কার জানি। কিন্তু তারও আগে আরও কয়েকটা অন্যায়ের শিকার হয়েছিল সে, আমার বিশ্বাস। সেই অন্যায়গুলো কারা করেছে, কিভাবে করেছে তা এখনও রহস্যময়। এই রহস্য ভেদ করতে হবে আমাকে।’

‘নিশ্চয়ই।’

‘কিন্তু রহস্যটা আরও জটিল হয়ে উঠছে, লংফেলো।

‘কি রকম?’ হাত উঠিয়ে কথা বলতে নিষেধ করল লংফেলো, ‘দাঁড়াও, তোমার গ্লাসটা আগে ভরে দিই, তারপর শুনব।’

লংফেলো হুইস্কি ঢেলে বরফ দিয়ে টইটম্বুর করে দিল গ্লাসটাকে। তার হাত থেকে সেটা নিয়ে দুটো চুমুক দিল রানা। কৈনেথের কাছ থেকে কতটুকু কি জেনেছি আমি তা তোমাকে বলা হয়নি। নতুন কিছু শোনার আগে অ্যাক্সিডেন্টের পর কেনেথ কোথায় ছিল, কে তাকে সাহায্য করেছে, কিভাবে তার সময় কেটেছে এইসব তোমার জানা দরকার।’

‘আমি শুনছি।’

ধীরে ধীরে, কিন্তু সংক্ষেপে সব বলল রানা।

‘নতুন জটগুলো কি ধরনের?’ ভুরু কুঁচকে উঠেছে লংফেলোর।

‘কেনেথকে প্রতি মাসে টাকা কে পাঠাত এটা একটা রহস্য; বলল রানা, ‘এর সাথে যোগ হয়েছে আরও একটা। কেনেথ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে মন্ট্রিয়ল ত্যাগ করার পর একটা প্রাইভেট এনকোয়েরি এজেন্সি তার খোঁজ খবর সংগ্রহ করার চেষ্টা করে।’

‘কেনেথের খরর সংগ্রহের চেষ্টা করে? কেন? কে?’

‘সেটাই তো আশ্চর্য! ভ্যানকুভারে পুলিস কেনেথের খোঁজ নেবার চেষ্টা করবে, না, কারণ, ডা: মারকোভেলী তাদেরকে নিঃসন্দেহে বোঝাতে পেরেছিলেন দুর্ঘটনার পর স্মৃতিভ্রংশের দরুন কেনেথ সম্পূর্ণ নতুন একটা মানুষে পরিণত হয়েছে, তাঁর মধ্যে অপরাধ প্রবণতার কোন লক্ষণ অবশিষ্ট নেই আর। তাছাড়া, পুলিস ইচ্ছে করলে তার খোঁজ এমনিতেও জানতে পারত।’

‘সেক্ষেত্রে প্রাইভেট গোয়েন্দা লাগিয়ে কে তার ঋদর জানতে চাইতে পারে?’

‘প্রতিমাসে যে টাকা পাঠাত সে-ও নয়, কারণ, কেনেথ কোথায় আছে না আছে সবই তাকে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন মারফত জানানো হত। ডা. মারকো বহু চেষ্টা করেন কৌতূহলী লোকটির পরিচয় উদ্ধার করতে, কিন্তু তিনি সফল হননি। সে যাই হোক, আমাদের মনে রাখতে হবে দ্বিতীয় একটা পক্ষ কেনেথের ব্যাপারে আগ্রহী ছিল।’

‘কে হতে পারে!’ গভীরভাবে চিন্তা করার চেষ্টা করছে লংফেলো। হঠাৎ মুখ তুলল সে, ‘কিন্তু এসব ব্যাপার তুমি জানলে কিভাবে?

‘ডা. মারকোভেলীর ডায়রী থেকে। প্রথমে ভেবেছিলাম কেনেথের বন্ধুবান্ধব কেউ হতে পারে।’ মাথা নাড়ুল রানা, ‘কিন্তু খবর নিয়ে যতদূর জানতে পেরেছি, তার বন্ধুরা সবাই দাগী আসামী এবং কপর্দকশূন্য; একটা প্রাইভেট এজেন্সিকে ভাড়া করবার সামর্থ্য তাদের কারও নেই। গ্লাসে চুমুক দিল রানা। ‘সে যাক। একটা প্রশ্নের উত্তর পেতে চাই আমি, লংফেলো। দুর্ঘটনাটা ঘটার সময় বুড়ো গাফ পারকিনসন কোথায় ছিলেন?’

হঠাৎ গম্ভীর হলো লংফেলো। ‘তোমার অনেক আগেই, দুর্ঘটনার পরপরই এ সন্দেহটা জেগেছিল আমার মনে, রানা। কিন্তু সন্দেহটার কোন ভিত্তি পাইনি। দুর্ঘটনার ধারে কাছেই ছিল না গাফ পারকিনসন। কে তার সাক্ষী জানো?’

‘কে?’

‘আমি, আবার কে! তিক্ত লাগল বুড়োর কণ্ঠস্বর রানার কানে। ‘উইকলি ফোর্ট ফ্যারেলের অফিসেই সেদিন ছিল সে দিনের বেশির ভাগ সময়।’

‘দিনের কোন সময়ে দুর্ঘটনাটা ঘটে?’

‘খামোকা মাথা ঘামাচ্ছ তুমি, রানা। দুর্ঘটনার সময় সেখানে গাফ ছিল এটা প্রমাণ করা অসম্ভব।’

‘একমাত্র তিনিই সবদিক থেকে লাভবান হয়েছেন,’ চিন্তিতভাবে বলল রানা, ‘আর সবাই ক্ষতিগ্রস্তূ হয়েছে। তাই আমার মনে হচ্ছে দুর্ঘটনার সাথে কোন না কোন যোগসূত্র ছিল তার।’

‘কিন্তু…কখনও শুনেছ নাকি একজন কোটিপতি আরেক জন কোটিপতিকে খুন করেছে?’ হঠাৎ কি মনে করে থমকে গেল লংফেলো, রানার চোখে স্থির দৃষ্টি রেখে চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর মৃদু কণ্ঠে বলল, ‘মানে, আমি বলতে চাইছি, নিজের হাতে?’

‘হ্যাঁ,’ বলল রানা, ‘ভাড়াটে কাউকে দিয়ে দুর্ঘটনাটা ঘটানোও একটা সম্ভাবনা।’

‘তা যদি গাফ করেও থাকে; আমরা তা এতবছর পর প্রমাণ করতে পারব না। খুনী সম্ভবত পারিশ্রমিকের মোটা টাকা খরচ করে দেউলিয়া হয়ে আত্মহত্যা করেছে অস্ট্রেলিয়া কিংবা লিবিয়ায়।’

‘সত্য প্রকাশ পারেই,’ বলল রানা। যৌথ মালিকানায় ওদের যে বিশাল ব্যবসা ছিল তার চুক্তিপত্রটা কখনও দেখেছ তুমি?’

‘না।’

‘চুক্তিপত্রে কি ছিল জানো?’

‘কিভাবে জানব? তবে, যা ছিল বলে গাফ রটিয়েছিল তা জানি।’

‘কি সেটা?’

‘চুক্তিপত্রের একটি ধারা নাকি ‘এইরকম ছিল যে যে-কোন এক পক্ষ যে-কোন কারণে যদি উত্তরাধিকারী না রেখে মারা যায় তাহলে ব্যবসায় তার অংশ লাভ করবে জীবিত পক্ষ বা তার উত্তরাধিকারীরা। শুনেছি, চুক্তিপত্রটা যখন সম্পন্ন হয় তখন দু‘পক্ষের কেউই বিয়ে করেনি। এ বিষয়ে গাফের বক্তব্য ছিল, বিয়ের পরও তারা চুক্তিপত্রের এই ধারাটি বাতিল করেনি বা বাতিল করার সময় পায়নি।’

‘চুক্তিপত্রটা সরকার দেখতে চায়নি?’

‘শুনেছি, দেখতে চাওয়ার আগেই গাফ সেটা পাঠিয়ে দিয়েছিল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে।’

‘চুক্তিপত্র জাল করাও সম্ভব।’

‘সম্ভব,’ বলল লংফেলো, ‘কিন্তু একজন জীবিত সাক্ষীও সংগ্রহ করেছিল গাফ। যার সই ছিল চুক্তিতে। গাফ নিশ্চয়ই এ প্রসঙ্গটা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানাতে ভোলেনি, রানা, এ পথে বেশিদূর আমরা এগোতে পারব বলে মনে হয় না।’

‘অন্তত পারকিনসনদের একটা দুর্বলতা অত্যন্ত প্রকট,’ বলল রানা, ‘তারা ক্লিফোর্ডদের নাম ফোর্ট ফ্যারেল থেকে একেবারে মুছে ফেলতে চেয়েছে। এর পিছনে কোন কারণ না থেকেই পারে না। এই কারণটা কি তা আমাদের জানতে হবে, লংফেলো। শোনো, ক্লিফোর্ড নামটা ফোর্ট ফ্যারেলে আমি নতুন করে আমদানী করতে চাই। চেষ্টা করব, সবাই যেন ক্লিফোর্ডদের কথা স্মরণ করে, আলোচনা করে। এর একটা প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য।’

‘কিন্তু তারপর?’ ঠোঁটে গ্লাস ঠেকাতে গিয়ে থমকে গিয়ে জানতে চাইল লংফেলো ৷

‘তারপর অবস্থা বুঝে চাল দেব আমরা। দরকার হলে প্রচার করব, আজ থেকে আট বছর আগে যে দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল সে-ব্যাপারে তদন্ত করতে এসেছি আমি। লোককে জানাব সেটা দুর্ঘটনার আড়ালে নির্মম হত্যাকাণ্ড ছিল, এবং অপরাধটা প্রকাশ হয়ে পড়তে পারে মনে করে কেনেথকেও খুন করা হয়েছে পরে। তুমি কি মনে করো, একটা আলোড়ন সৃষ্টি হবে না এসবের?’

‘তা হয়তো হবে,’ লংফেলোকে উদ্বিগ্ন দেখাল। কিন্তু পারকিনসনরা সত্য যদি অপরাধী হয় তাহলে তোমার ব্যাপারে ওরা কি পদক্ষেপ নেবে তা কি একবার ভেবে দেখেছ? চারটে খুন যারা করতে পারে, তাদের পক্ষে আরও একটা করা এমন কিছু কঠিন নয়।’

‘কঠিন। কারণ, ক্লিফোর্ডরা জানত না তারা খুন হতে যাচ্ছে। কিন্তু আমি জানি। তাছাড়া, যে ধরনের আক্রমণ আমার ওপর হবে বলে তুমি মনে করছ সে ধরনের আক্রমণ ফিরিয়ে দেবার ক্ষমতা আছে আমার।’

‘এ-প্রসঙ্গে আমার একটা কৌতূহল আছে।’

‘জানি সেটা কি,’ মুচকি হেসে বলল রানা, ‘তুমি আমার পরিচয় জানতে চাও, এই তো?’

‘হ্যাঁ,’ মৃদু কণ্ঠে বলল লংফেলো। ‘কিন্তু তা জানাতে তুমি রাজি নও, বুঝতে পারি। কিন্তু কেন?’

‘পরিচয়টা বড় কথা নয়,’ বলল রানা। উঠে দাঁড়াল ও। ‘আমার কাজটাই আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। চললাম, লংফেলো। কাল থেকে ঢেউ তুলব ফোর্ট ফ্যারেলে, ধাক্কাটা আমাদের গায়েও লাগতে পারে। একটু সাবধানে থেকো।’

‘চললাম মানে? বললাম না তখন, তুমি আমার বাড়িতে থাকবে?

‘এখানে! না, লংফেলো…।’

‘আরে, সব কথা শোনোই না আগে। এখানে কে থাকতে বলছে তোমাকে? ছোট্ট একটুকরো জমি আছে আমার ঠিক শহরের বাইরেই, সেখানে একটা কেবিনও তৈরি করেছি বুড়ো বয়সটা শুয়ে-বসে কাটাবার জন্যে। তুমি ওখানে থাকছ আজ থেকে।’

‘না, মিস্টার লংফেলো,’ বলল রানা, ‘তোমাকে আমি বিপদ থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখতে চাই। তুমি আমার সাথে জড়িয়ে পড়েছ জানলে পারকিনসনরা…’

‘গুলি মারো পারকিনসনদের!’ রেগেমেগে চেঁচিয়ে উঠল বুড়ো। চেয়ার ছেড়ে ছুটে এসে দাঁড়াল রানার সামনে। ‘খুব সাহসের ভাব দেখাচ্ছ, না? ভেবেছ, তোমার মত সাহসী লোক ফোর্ট ফ্যারেলে আর কেউ নেই? একটা কথা মনে রেখো, রানা, ’ নিজের বুকে আঙুল ঠুকে বলল লংফেলো, ‘এই বুড়ো বেঁচে থাকতে সবচেয়ে সাহসী হবার মর্যাদা কাউকে আমি পেতে দিচ্ছি না, বুঝেছ?’

‘ঠিক আছে, বাবা, ঠিক আছে!’ বলল রানা, ‘মর্যাদা সবটুকুই যাতে তুমি পাও তার ব্যবস্থা এখান থেকে যাবার আগে আমি করে যাব। হয়েছে তো? এবার পথ ছাড়ো।’

‘তুমি দান করবে মর্যাদা আর তাই নিয়ে আমি আনন্দে বগল বাজাব? এই তুমি চিনেছ আমাকে?’ লংফেলোর কণ্ঠে অভিমান।

‘না না, আমি ঠাট্টা করছিলাম,’ তাড়াতাড়ি বলল রানা, ‘বুঝতে পেরেছি, বুড়ো বয়সে সত্যি এক হাত না দেখিয়ে ছাড়বে না তুমি। ঠিক আছে দাঁড়াও তাহলে আমার সাথে। কিন্তু সাবধান মিস্টার লংফেলো, গাফ পারকিনসন প্রচণ্ড একটা ঝড় তুলবে এবার।’

‘তুলেই দেখুক না আমাকে সে কতটুকু নড়াতে পারে?’ হাসল লংফেলো। ‘মাটির নিচে আমার শিকড় দেখে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে সে।’

‘মাটির নিচে তোমার শিকড়?’ চোখ কপালে তুলল রানা।

‘আমি নিরীহ এক বৃদ্ধ সাংবাদিক হতে পারি, কিন্তু আমারও শুভাকাঙ্ক্ষী আছে অনেক।’

রানার হাত ধরে চেয়ারে নিয়ে গিয়ে বসাল বুড়ো। নিজেও বসল ওর মুখোমুখি। গ্লাস দুটো আবার ভর্তি করল বোতল থেকে হুইস্কি ঢেলে। নিজের গ্লাসটা হাতে নিয়ে উঠে পড়ল হঠাৎ। ফায়ার প্লেসের আগুনটা উসকে দিয়ে ফিরে এসে বসল আবার। ‘বিশ্বাস করো, তোমাকে পেয়ে নবযৌবন ফিরে পেয়েছি আমি. রানা। অবশ্য গাফকে আমি কোনদিনই ভয় করিনি, এবং তা সে ভাল করেই জানে। অবসর নেবার সময় হয়ে গেছে আমার, কিন্তু তার আগে আমি চাই উইকলি ফোর্ট ফ্যারেলে আমার একটা খবর ছাপা হোক, যে খবরটা আমি নিজে লিখব এবং ছাপার আগে তাতে কেউ কাঁচি চালাতে আসবে না। তোমার কাছ থেকে কি আশা করি জানো, রানা? খবরটা। আমি চাই, খবরটা তুমি আমাকে উপহার দেবে।’

‘সাধ্য মত চেষ্টা করব আমি,’ কথা দিল রানা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *