সাত
অন্ধকার থাকতে শীলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রানা। বেশ অবাক হয়েছে ও শীলাকে একটু গম্ভীর হয়ে থাকতে দেখে। তার মৌনতাও অস্বাভাবিক লেগেছে ওর। উপাদেয় এবং পরিমাণে প্রচুর রেকফাস্টের ব্যবস্থা অবশ্য করেছিল শীলা, কিন্তু সে তো যে-কোন সুগৃহিণী তার শত্রুর জন্যেও করে থাকে। রাত পোহাতেই ওর উপর বিরূপ হয়ে ওঠার কি কারণ ঘটল শীলার ভেবে পায়নি ও। পারকিনসনদের হয়ে ও কাজ করছে এ কথাটা বেশি করে মনে পড়েছে বলে, নাকি রাতের বেলা কোনরকম ইঙ্গিত ওর কাছ থেকে আসেনি বলে কে জানে। মেয়েদের মনের খবর টের পাওয়া সহজ নয়।
বিদায় নেবার আগে কথাপ্রসঙ্গে শীলাকে জানাল ও, ‘পারকিনসনদের বাঁধ তৈরি হলে তোমার এই সুন্দর বাড়িটার কিনারা পর্যন্ত উঠে আসবে পানি।
‘তুমি বলতে চাইছ ওরা আমার এলাকাও ডুবিয়ে দেবে? তা আমি হতে দিচ্ছি না। ওদেরকে জানিয়ে দিতে পারো, আমি বাধা দেব।’
‘তা জানাতে পারব,’ রাইফেল তুলে নিয়ে বলল রানা। ‘চললাম। মুখের হাসিটা একবার দেখতে চাই, ক্লিফোর্ড।’
কিন্তু নিঃশব্দে প্রত্যাখ্যান করল শীলা। হাসল না সে।
তিন সেকেন্ড অপেক্ষা করার পর ঘুরে দাঁড়াল রানা। বেরিয়ে এল বাইরে। উপত্যকার আধাআধি নেমে একবার মাত্র পিছন ফিরে তাকাল ও। বাড়ির সামনে বা জানালার কোথাও দেখল না শীলাকে। শীলার বদলে আরেকজনকে দেখল রানা। হলিউড কাউবয়ের ভঙ্গিতে দু’পা ফাঁক করে উপত্যকার মাথায় দাঁড়িয়ে আছে বিগ প্যাট। রানা সত্যি দূর হচ্ছে কিনা নিশ্চিত হবার জন্যেই তাকিয়ে আছে বোধ হয়।
পারকিনসনদের বাকি এলাকা সার্ভে করতে আর মাত্র দুটো দিন লাগল রানার। হাতে একদিন থাকতেই ওর মেইন ক্যাম্পে ফিরে এল ও। পরদিন নির্দিষ্ট সময়ে ল্যান্ড করল হেলিকপ্টার। একঘন্টা পর পৌঁছে গেল রানা ফোর্ট ফ্যারেলে।
পারকিনসন হাউজ, হোটেল অ্যান্ড বার-এ নিজস্ব স্যুইটে ফিরল রানা। প্রচুর সময় নিয়ে বাথটাবে গড়াগড়ি করল, গলা ভেজাল এবং নানা প্রসঙ্গে চিন্তাভাবনা করল। টেলিফোন বাজছে। কিন্তু হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলল না। একসময় সেটা থেমেও গেল। বয়েডের সাথে দেখা ওকে করতে হবে, তারপর সংকেলোকে খুঁজে বের করা দরকার। আরও কিছু প্রশ্ন আছে এর।
কাপড় পরা শেষ হতে তৃতীয়বার বাজতে শুরু করল টেলিফোন। হাত বাড়িয়ে এবার রিসিভার তুলল রানা। ‘হ্যালো।’
‘রানা?’
‘বলছি।’
‘খবর পেয়েছি অনেক আগেই ফিরেছ তুমি’, বয়েড পারকিনসনের অসহিষ্ণু কণ্ঠস্বর। ‘কি করছ এতক্ষণ ধরে। কোথায় ছিলে? এর আগেও দু‘বার ফোন করেছি আমি…’
‘গানটান গাইছিলাম,’ বলল রানা। পাঁচ সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর কন্ঠস্বরে কাঠিন্য ফুটিয়ে আবার বলল, ‘আমি কারও হুকুমের চাকর নই, বয়েড। আমার সময় হলে তোমার সাথে দেখা করব।’
কথাটা হজম করার জন্যে লম্বা একটা সময় নিল বয়েড। রানা জানে, কারও জন্যে অপেক্ষা করতে অভ্যস্ত নয় লোকটা, অস্বাভাবিক শান্ত লাগল ওর কানে বয়েডের কন্ঠস্বর, ‘ঠিক আছে, একটু তাড়াতাড়ি করো। বেড়ানোটা কেমন উপভোগ্য হয়েছে?’
‘মোটামুটি। লিখিত একটা রিপোর্ট তুমি পাবে আমার কাছ থেকে; কাইনোক্সি উপত্যকায় এমন কিছু নেই যার জন্য মাইনিং অপারেশনের ঝামেলা পোহাতে যেতে পারে। আমায় রিপোর্টে বিস্তারিত সবই বলব আমি।’
‘বুঝেছি, বুঝেছি! এইটুকুই জানতে চেয়েছিলাম!’ ফোনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল সে।
রিসিভার নামিয়ে রেখে সোফায় হেলান দিয়ে বসল রানা। পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে গ্লাসের অবশিষ্ট হুইস্কিটুকু দু’ঢোকে নিঃশেষ করল। ক্রেডল থেকে রিসিভার তুলল আবার। ডায়াল করল উইকলি ফোর্ট ফ্যারেলের নাম্বারে।
মেয়েলি একটা কণ্ঠস্বর জানাল,’ লংফেলো বাইরে কোথাও গেছেন। আধঘণ্টার মধ্যে ফেরার কথা।’
‘তাকে বলো আমি মাসুদ রানা, একঘণ্টা পর তার সাথে দেখা করতে চাই গ্রীক কফি হাউজে।’
***
হোটেল থেকে বেক্সিয়ে বয়েডের অফিস বিল্ডিঙে পৌছাল রানা । এবার আরও দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে রাখল বয়েড ওকে। পঞ্চাশ মিনিট পর রিসেপশনিস্ট মেয়েটা ভিতরে ঢোকার অনুমতি দিল ওকে।
‘গ্লাড টু সি ইউ’, এবারও বসতে বলল না বয়েড রানাকে। ‘কোন অসুবিধে হয়নি তো?’
বসল রানা। পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘তুমি জানতে অসুবিধে হতে পারে?’
‘না-না। তা নয়। আমি জানি অত্যন্ত উপযুক্ত একজন বিশেষজ্ঞকে দায়িত্ব দিয়েছি আমি।’
‘ধন্যবাদ’, শুকনো গলায় বলল রানা। ‘একটা ছোট্ট ঘটনার কথা তোমার জানা দরকার। লোকটা পুলিসের কাছে অভিযোগ করতেও পারে। বিগ প্যাট নামে কাউকে চেনো?’
সিগার ধরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বয়েড। ‘উত্তর প্রান্তে?’ রানার দিকে না তাকিয়েই জানতে চাইল।
‘হ্যাঁ, বাড়াবাড়ি করছিল, কষে একটা চড় দিয়েছি।’
একটা সস্তুষ্টির ভাব ফুটে উঠল বয়েডের মুখে। ‘তার মানে গোটা এলাকাটাই সার্ভে করেছ তুমি।’
‘না, তা করিনি।’
শিরদাড়া খাড়া করল বয়েড। ‘মানে? কি বলতে চাও? কেন করোনি?’
‘করিনি, কারণ, মেয়েদের সাথে হাতাহাতি করতে আমি অভ্যস্ত নই’, বলল রানা। ‘মিস ক্লিফোর্ড তার এলাকায় সার্ভে করতে দিতে রাজি হয়নি।’ বয়েডের দিকে একটু ঝুঁকল রানা। ‘নাথান মিলারের সাথে তোমার কথা হয়েছিল মিস ক্লিফোর্ডের সাথে এ ব্যাপাটা নিয়ে আলোচনা করবে তুমি। কিন্তু করোনি।’
‘ওর খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পাইনি’, দুই আঙুলে তবলার মত টেবিল বাজাচ্ছে বয়েড। ‘কিছু এসে যায় না। তারপর কি হলো?’ আগ্রহ উপচে পড়তে চাইছে চোখ মুখ থেকে, কিন্তু সেটা লুকাবার চেষ্টাও করছে সেই সাথে।
‘হবার আর কি আছে। বাকি এলাকায় খনিজ পদার্থ তেমন কিছু নেই।’
‘তেল বা গ্যাসের কোন লক্ষণই দেখতে পাওনি?’
‘না।’
‘রিপোর্টের কথা কি যেন বলছিলে ফোনে?’
‘আগামীকাল।’
‘তাড়াতাড়ি, কেমন?’ বয়েড ব্যস্ততার সাথে বসল। ‘হিসেব করে তোমার মোট যা পাওনা হয় তাও কাল পেয়ে যাবে। কোথায় যাবে এখান থেকে?’
‘জানি না। এখনও কিছু ঠিক করিনি।’
হঠাৎ সিগারের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিল বয়েড রানার দিকে।
‘চলবে নাকি?’
‘না।’
‘কি জানো, ফোর্ট ফ্যারেল ছোট্ট জায়গা, তোমার মত দুনিয়া ঘোরা লোকের পছন্দ না হবারই কথা। তাই অন্য কোন কাজ দিয়ে তোমাকে এখানে আট রাখতে চাই না। নিশ্চয়ই এ ক’দিনে বিরক্ত হয়ে উঠেছ ফোর্ট ফ্যারেলের ওপর? কোনরকম বৈচিত্র্য নেই –’
‘নেই বুঝি?’
‘কোথায়। পিচ্চি শহরে, থাকবেই বা কি বলো?’
‘তোমরা তাহলে বছরের পর বছর থাকছ কিভাবে? অন্যরকম মজা পেয়ে গেছ বুঝি?’
থমকে গেল বয়েড। চেয়ে রইল রানার দিকে। তাড়াতাড়ি বলল, ‘অন্যরকম মজা বলতে নিশ্চয়ই তুমি ব্যবসার কথা বোঝাতে চাইছ। ব্যাপারটা ঠিকই ধরেছ তুমি, রানা প্রচণ্ড রেটেখুটে এতগুলো ব্যবসা দাঁড় করিয়েছি আমরা যে ইচ্ছে থাকলেও এর মায়াজাল কেটে বেরোতে পারব না –’
‘যদি কেউ টেনে হিচড়ে বের না করে দেয়; কি বলো?’
‘তুমি–ঠিক বুঝলাম না তোমার কথা, রানা?’
‘আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছ না? ধরো, কেউ যদি যেচে পড়ে একটা অন্যায়ের প্রতিবিধান করতে চায়?’
পেপার-ওয়েটটা মুঠোয় চেপে ধরছে বয়েড। ‘কি বলছ এসব তুমি?’
‘ব্যবসার ঝামেলা তোমার মাথায় চেপে বসেছে, এটা একটা অন্যায় নয়। কে চাপাল, কেন চাপাল?—ধরো,’ দ্রুত কথা বলছে রানা, ‘কেউ যদি তোমাদেরকে এই ঝামেলা থেকে মুক্ত করতে চায়—সেটা উচিত কাজ হবে না?’
বয়েডের কপালে এত তাড়াতাড়ি ঘাম ছুটে উঠতে দেখে মনে মনে হাসল রানা।
‘যা বলতে তা আরও পরিষ্কার করে বলো রানা।’ কঠিন, থমথমে কণ্ঠস্বর বয়েডের। নার্ভাসনেসটা লুকিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে, ধরতে পারল রানা।
‘আমি বলতে চাইছি বিবেকসম্পন্ন সাহসী কোন লোকের কথা। সে যদি তোমাদেরকে এই ঝামেলা থেকে মুক্তি দেয়? যদি তোমাদেরকে ফোর্ট ফ্যারেল থেকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেয়?’
‘অন্য কোথাও! কোথায়?’ উঠে দাঁড়াতে গিয়ে নিজেকে কোনমতে সামলে নিল বয়েড।
‘যেখানে অনারকম মজা নেই, আমি বলতে চাইছি, ব্যবসার ঝামেলা নেই। ধরো, ব্রিটিশ কলম্বিয়ার রাজধানীর কোন জায়গায় যেখানে অনেক ব্যবসার জটিল জালে আটকে থাকতে হবে না।’ বিস্ফোরণের সময় ঘনিয়ে এসেছে বুঝতে পেরে সামাল দেবার প্রয়োজন বোধ করল রানা। ‘তুমি আসলে আমার বক্তব্য বুঝতে পারছ না বয়েড। সেজন্য দায়ী আমি নই, দায়ী তোমাদের অপরাধবোধ। সে থাক, শোনো তাহলে–আমার কথাই ধরো, যদি এমন ব্যবস্থা করি তোমাদের একঘেয়েমি কাটাবার জন্যে কোথাও বেড়াতে নিয়ে গেলাম কদিনের জন্যে ঘুরে-বেড়িয়ে, হাসি-তামাশা করে, সময়টাকে আনন্দ গানে উপভোগ করে এলে—কেমন হবে সেটা?’
‘জানি না,’ দাঁতে দাঁত চেপে বলল বয়েড। ‘দূর হও তুমি আমার সামনে থেকে।’
‘সে কি! তুমিই না দুঃখ করে বলছিলে যে ব্যবসার জালে আটকা পড়ে আছ?’
‘আমাকে ধৈর্য হারাতে বাধ্য কোরো না, রানা,’ উঠে দাড়াল বয়েড। ট্রাউজারের দু‘পকেটে হাত ভরল। ‘তোমার বাজে প্রলাপ শোনার সময় আমার নেই। কাল সকালে এসে রিপোর্ট দিয়ে টাকা নিয়ে যেয়ো। এখন তুমি বেরোও।’
উঠল রানা। মুচকি হাসল। ‘বুঝলাম না!’
রানার দিকে পিছন ফিরতে গিয়ে হঠাৎ থমকাল বয়েড। ‘কি বুঝলে না?’
‘তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন? কি এমন বলেছি আমি?’
পকেট থেকে ডান হাতটা বের করল বয়েড। অস্বাভাবিক শান্ত দেখাচ্ছে হঠাৎ তাকে। মুখের কাছে পিস্তলটা তুলে গভীর মনোযোগের সাথে নলের ফুটোটা দেখছে। ‘এখনও দাঁড়িয়ে আছ?’ ঠাণ্ডা গলায় বলল সে।
‘গুলি করবে না তাহলে?’ বাঁকা হেসে বলল রানা। ‘ওটা বের করতে দেখে ভাবলাম আমাকে বোধহয় চলে যেতে দিতে চাইছ না। ঠিক আছে, বলছ যখন যাচ্ছি। আবার দেখা হবে।’
পিছন ফিরল রানা। পা বাড়াল দরজার দিকে। গুলি করবে? দ্রুত ভাবছে রানা। ইচ্ছা হলো ঘাড় ফিরিয়ে দেখার, কি করছে বয়েড। কিন্তু দুর্বলতা প্রকাশ পাবে ভেবে দমন করল নিজেকে।
দরজার কাছে থামল রানা। নব ধরে কবাট দুটো খুলল। পিছনে কোন শব্দ নেই।
চৌকাঠ টপকে বেরিয়ে এল রানা বাইরে। তারপর দরজাটা বন্ধ করার জনো ঘুরে দাঁড়াল।
দেখল, দ্রুত নামিয়ে নিল বয়েড হাতের পিস্তলটা। অন্যদিকে তাকাল। বুঝতে অসুবিধে হলো না রানার, এতক্ষণ ওর মাথার পিছনে তাক করে রেখেছিল পিস্তলটা।
***
ক্লিফোর্ড পার্কের সামনে দিয়ে হাঁটছে রানা। চোখে পড়ল, সেই একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে লেফটেন্যান্ট ফ্যারেল কবুতরগুলোর খুঁটে খাওয়া দেখছে। গ্রীক কফি হাউজে চার পাঁচজন লোক গল্প-গুজব করছে। রানাকে ঢুকতে দেখে প্রত্যেকে মুখ তুলে তাকাল।
ওদের কাছাকাছি একটা টেবিলে বসল রানা। লংফেলো আসেনি। যা ভেবেছিল ও, লোকগুলো
ওকে দেখে মৌনতা অবলম্বন করেছে। কফির অর্ডার দিতে ওয়েটার ফিরে গেছে। লোকগুলো ভুলেও আর তাকাচ্ছে না। তার পৌছুবার আগেই পাঁচজন একসাথে উঠে পড়ল চেয়ার ছেড়ে। মিছিল করে বেরিয়ে গেল বাইরে।
কফি দিয়ে গেল ওয়েটার। কাপে চামচ দিয়ে চিনি নাড়তে নাড়তে ভাবছে রানা শহরের লোকেরা এখন জানে, ফোর্ট ফ্যারেলে একজন লোক এসেছে যে বয়েড পারকিনসনকে সম্মান দেখিয়ে কথা বলতে রাজি নয়। জানে, গোরস্থানে গিয়ে ক্লিফোর্ড পরিবারের কবর খুঁজেছে সে। প্রসঙ্গটা বয়েড কেন তুলল না? এটা একটা রহস্য। হয়তো প্রশ্ন করলে প্রসঙ্গটার গুরুত্ব বেড়ে যাবে মনে করে মুখ খোলেনি সে।
‘এখনই এত চিন্তায় পড়ে গেছ, ভায়া?’
সংবিৎ ফিরল রানার। ধপ করে সামনের চেয়ারটায় বসল লংফেলো।
‘দেখো, নাতি,’ বুড়ো মুচকি মুচকি হাসছে, ‘এত তাড়াতাড়ি মুষড়ে পড়লে কিন্তু চলবে না? কি হয়েছে কি? ’
মৃদু হাসল রানা। হাত তুলে ওয়েটারকে আর এক কাপ কফি দেবার জন্যে ইঙ্গিত করল। ‘আচ্ছা, দাদু, শীলা ক্লিফোর্ড এখানেই রয়েছে তা আমাকে বলোনি তুমি!’
‘কেন, ঝগড়া বাধিয়ে এসেছ বুঝি?’ হাসল বুড়ো। ‘বড্ড দেমাক ছুঁড়ির, তা ঠিক। বলিনি, তার কারণ আমি চেয়েছিলাম তুমি নিজেই আবিষ্কার করো ওকে।’
‘বাঁধ তৈরি করতে বাধা দেবে সে,’ বলল রানা। ‘বিগ প্যাটকে চেনো?’
‘বখাটে এক ছোকরা। গুণ্ডামির সুযোগ পেলে ছাড়ে না। কেন?’
‘এমনি জানতে চাইছি। কিন্তু শীলা ক্লিফোর্ড ওকে পুষছে কেন?’
‘হয়তো ভেবেছে দুঃসাহসী একজন লোক থাকলে নিরাপত্তার দিকটা দেখবে সে।’
‘শেষ কবে দেখা হয়েছে তোমার সাথে?’
‘শীলার সাথে? মাসখানেক তো হবেই, কায়রো থেকে আসার পরপরই।’
‘সেই থেকে উপত্যকায় আছে ও?’
‘হ্যাঁ, যতদূর জানি। আর কোথাও থাকার জায়গা নেই তার।’
কপ্টার নিয়ে ওখানে ইচ্ছে করলেই যেতে পারত বয়েড, ভাবল রানা। মাত্র পঞ্চাশ মাইলের দূরত্ব। গেলেই দেখা হত শীলার সাথে। কিন্তু যায়নি। কেন?
‘আচ্ছা, বয়েডের সাথে শীলার ব্যাপারটা কি?’
খুক খুক করে কাশল বুড়ো। ‘বয়েড ওকে বিয়ে করার জন্যে পাগল। কিন্তু সে গুড়ে বালি। পিতা এবং পুত্র সম্পর্কে শীলা এমন সব কথা বলে, কানে আঙুল না দিয়ে উপায় থাকে না।’
‘বাঁধ দিলে শীলার এলাকাটা ডুববে। শীলা তা হতে দিতে চায় না। এ ব্যাপারে তোমাদের এখানকার আইন কি বলে?’
‘আইনের বক্তব্য একটু প্যাঁচ খেলানো।’
‘কি রকম?’
‘এমনিতে ব্যক্তিগত কোন উন্নয়ন সংক্রান্ত উদ্যোগের ফলে জনসাধারণের যদি ক্ষতি হবার আশঙ্কা থাকে তাহলে উদ্যোক্তাকে সরকার নিরাশ করে থাকে, কিন্তু উদ্যোক্তা যদি প্রমাণ করতে পারে যে তার উদ্যোগের ফলে দেশ এবং অধিকাংশ লোকের উপকার হবে তাহলে কে ক্ষতিগ্রস্ত হলো না হলো সে ব্যাপারে সরকার মাথা ঘামাতে রাজি নয়, বরং উদ্যোক্তাকেই সবরকম সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে থাকে।’
‘হুঁ।’
‘উইকলি ফোর্ট ফ্যারেল ইতিমধ্যেই তার ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছে।’
মুখ তুলে তাকাল রানা। দৃষ্টিতে প্রশ্ন।
‘জে-আজ্ঞে-হুজুর, ওরফে আমাদের সম্পাদক কার্ল ডেট জার গত তিন মাস থেকে প্রবন্ধ লিখে ছাপছে। বুঝতেই পারছ, প্রবন্ধগুলোর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় কি!’
‘বাঁধের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা। বাঁধ দিলে মানুষের এই উপকার হবে, সেই উপকার হবে।’
‘ঠিক তাই।’
ওয়েটার এসে কফি দিয়ে গেল লংফেলোকে। তাড়াহুড়ো করে চুমুক দিতে গিয়ে জিভ পুড়িয়ে ফেলল সে। রানাকে হাসতে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। ‘অনেকগুলো দিন তো গায়ে বাতাস লাগিয়ে কাটিয়ে দিলে। কি করবে ভেবেছ কিছু?’
গম্ভীর হলো রানা। বলল, ‘আমার করার কিছু আছে বলে মনে করো তুমি, মিস্টার লংফেলো? আপাতত ওদেরকে খোঁচা দিয়ে দেখতে চেষ্টা করা শুধু, কি রকম প্রতিক্রিয়া হয়। যেখানে খোঁচা খেয়ে সবচেয়ে বেশি লাফ দেবে সেখানেই খুঁড়তে হবে আমাকে।’
‘খোঁচা দিতে দেরি করছ কেন তাহলে?’
‘দেরি করছি কে বলল তোমাকে?’ হাসতে শুরু করল রানা। অন্তত একটা জায়গায় খোঁচা মারা হয়ে গেছে আমার।’
‘তাই নাকি? প্রতিক্রিয়া?’
চিন্তিত দেখল লংফেলো রানাকে। মৃদু কণ্ঠে বলতে শুনল, ‘প্রথম খোঁচাটাই সম্ভবত ঠিক জায়গায় দিতে পেরেছি, মি. লংফেলো। ব্যাপারটা ওদের কাছে অপ্রত্যাশিত, তাই প্রতিক্রিয়া দমন করার চেষ্টা করছে।’
‘তার মানে তুমি বলতে চাইছ শত্রুপক্ষ সাবধান হয়ে গেছে?’
‘না,’ বলল রানা, ‘তা নয়। আসলে এখনও ওরা বুঝতে পারছে না আমি ওদের জন্যে কতটা বিপজ্জনক। আরও কিছু ঘটনার জন্যে অপেক্ষা করছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রানা। ‘একটা রিপোর্ট তৈরি করতে হবে আমাকে, চললাম।’
চাপা কণ্ঠে জানতে চাইল বৃদ্ধ, ‘কিন্তু আরও কিছু ঘটনার কথা বললে-তার কি হবে?’
‘আগামীকাল ঘটাব,’ বলে কফি হাউজ থেকে বেরিয়ে পড়ল রানা। ওর গমনপথের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকল লংফেলো। রানা অদৃশ্য হয়ে যেতে বিড় বিড় করে বলল, ‘মনে হচ্ছে যেমন বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেঁতুল!’
***
রানার বাড়ানো হাত থেকে টাইপ করা কাগজগুলো নিল বয়েড পারকিনসন। ভাঁজ না খুলে ছুঁড়ে মারল পাশের ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেটে। ‘রানা, আমার প্রশ্নের সোজা উত্তর চাই আমি। গতকাল যা বলেছ তাছাড়া আর কি আলাপ হয়েছে তোমার সাথে শীলার?’
‘উত্তর দেয়া না দেয়া আমার ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে, তাই নয় কি?’ বয়েডের রক্তচক্ষুর সামনে সাবলীল ভঙ্গিতে হাসছে রানা।
ডেস্কে ঘুসিটা পড়তে পেপার-ওয়েটসহ কয়েকটা জিনিস লাফিয়ে উঠল। ‘উত্তর আমি চাই! দেবে কি দেবে না বলো!’
‘কেমন ঘুসি হলো ওটা?’ সকৌতুকে জানতে চাইল রানা। ‘এক ঘুসিতে ডেস্কটাই ভাঙতে পারো না, তবু গায়ের জোর দেখাতে যাও কোন্ মুখে? এই দেখো’, মুঠো করা হাতটা শূন্যে তুলে বিদ্যুৎ বেগে ডেস্কের উপর নামিয়ে আনল রানা।
ডেস্কের মাঝখানটা চড়াৎ করে ফেটে গিয়ে একটা গর্ত সৃষ্টি হলো। সেটার ভিতর কব্জি পর্যন্ত ঢুকে গেছে রানার হাত। ঢোক গিলল বয়েড, দু‘চোখে অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টি। পরমুহূর্তে হুঙ্কার ছাড়ল সে, ‘এটা আমার বাবার বন্ধুর উপহার দেয়া ডেস্ক, এর দাম আমি কেটে নেব…’
‘তোমার বাবার বন্ধু? হাডসন ক্লিফোর্ড?’ কণ্ঠে ব্যঙ্গ ঝরছে রানার। ‘বুক কাঁপে না তোমার তাঁর নাম উচ্চারণ করতে, বয়েড?’
‘বস্, আমাদেরকে প্রয়োজন আছে আপনার?’ পিছন থেকে আওয়াজটা এল। ঘাড় ফেরাল রানা। দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক লোক। তার পিছনে আরও কয়েকজনের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু সংখ্যায় ক’জন ঠিক বুঝতে পারল না রানা।
‘আশপাশেই থাকো,’ দ্রুত বলল বয়েড, ‘প্রয়োজন হলে ডাকব।’
বয়েডের দিকে ফিরল রানা। শব্দ শুনে বুঝল, দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল আবার। আবেদনের ভঙ্গি ফুটিয়ে তুলল রানা। ‘যদি অনুমতি দাও, একটা অট্টহাসি দিতে চাই, বয়েড!’ কিন্তু অনুমতির অপেক্ষায় না থেকে হো-হো করে হেসে উঠল ও। ‘তুমি থিয়েটারের ভাঁড় নাকি হে, বয়েড?’ কোনমতে হাসি থামিয়ে বলল রানা, ‘ওদের সাহায্য নিয়ে আমাকে শায়েস্তা করতে চাও? আচ্ছা, আমার অপরাধটা কি, জানতে পারি কি?’ একটা ব্যাপার রহস্যময় লাগছে ওর, খোঁচা খেলেও তা নিঃশব্দে হজম করছে বয়েড, কোন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছে না। গোরস্থানে যাবার প্রসঙ্গটা তোলেনি সে। এখন হার্ডসন ক্লিফোর্ডের প্রসঙ্গে যে-খোঁচাটা মারল সেটারও কোন প্রতিক্রিয়া নেই।
সামলে নিয়েছে বয়েড নিজেকে। কঠিন কিন্তু শান্ত দেখাচ্ছে মুখের চেহারা। ‘শীলার বাড়িতে গিয়েছিলে তুমি?’
‘গিয়েছিলাম,’ বলল রানা। ‘সে তোমারই স্বার্থে। ভেবেছিলাম তাকে শান্ত করতে পারলে তার এলাকাটা সার্ভে করার অনুমিতি পাব।’
‘ওর সঙ্গে রাতটাও কি আমার স্বার্থেই কাটিয়েছ?’
থমকে গেল রানা। বুঝতে পারল, ঈর্ষায় পুড়ছে বয়েড। কিন্তু এ খবর সে পেল কোত্থেকে? দ্রুত চিন্তা করছে ও। শীলার কাছ থেকে শোনেনি। তাহলে? উপত্যকার উপর বিগ প্যাটের দু‘পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে থাকার ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। মার খেয়ে হজম করতে না পেরে প্রতিশোধ নিতে চেষ্টা করেছে সে বয়েডের কানে খবরটা পাচার করে দিয়ে। শীলার প্রতি বয়েডের দুর্বলতার কথা অজানা থাকার কথা নয় তার।
‘না,’ মধুর ভঙ্গিতে হাসল রানা, ‘রাতটা আমি নিজের স্বার্থেই কাটিয়েছি।’
মুখের ধবল চামড়ার নিচে রক্ত জমে উঠল বয়েডের। সটান উঠে দাঁড়াল দু‘পায়ে ভর দিয়ে। ‘এর একটা বিহিত না করলেই নয়! তোমার এই অপরাধের ক্ষমা নেই, রানা। শীলা ক্লিফোর্ডের ব্যাপারে আমরা কতটুকু কনসার্ন্ড তা তোমাকে বুঝিয়ে দিতে চাই। তার সুনাম ক্ষুণ্ণ হবে এ আমরা কিছুতেই সহ্য করতে পারি না।’ ডেস্ক ঘুরে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে সে। বুঝতে অসুবিধে হলো না রানার, ওকে এক হাত দেখাতে চাইছে বয়েড।
‘বয়েড,’ বলল রানা, এই ফাঁকে দ্রুত ভেবে নিচ্ছে পরিস্থিতিটা, ‘শীলা ক্লিফোর্ড শিশু নয়, নিজেকে এবং নিজের সুনাম কিভাবে রক্ষা করতে হয় তা তার ভালই জানা আছে।’ পারকিনসন বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে যাবার সবগুলো পথ বন্ধ করে রেখেছে বয়েড; কোন সন্দেহ নেই। মারপিট করে পথ তৈরি করা সম্ভব, কিন্তু তার আগে জানতে হবে ওকে বাধা দেবার জন্যে কতটা কি করার কথা ভেবেছে ওরা। যদি স্থির করে থাকে আটকাবার জন্যে দরকার হলে খুলি ফুটো করবে, তাহলে বিপদের কথাই বটে। ‘যার সুনাম নিয়ে আলোচনা করছ সে তোমাকে কতটুকু পছন্দ করে সে খবর রাখো? আর শোনো, যদি ভেবে থাকো লোকজনের সাহায্য নিয়ে আমার গায়ে হাত তুলতে পারবে, ভুল করছ তুমি। ঠাট্টা করছি না, দু‘হাতে তুলে ওই জানালাটা দিয়ে নিচে ফেলে দেব তোমাকে। হাসপাতালে পৌঁছুবার আগেই নিশ্চল হয়ে যাবে হার্ট, সন্ধ্যানাগাদ ফোর্ট ফ্যারেলের লোকেরা ক্লিফোর্ডদের পাশে পুঁতে দিয়ে আসবে তোমাকে।’
একটু থমকাল বয়েড। কিন্তু মাত্র আধ সেকেণ্ডের জন্যে। আবার এগিয়ে আসতে শুরু করল।
ধীরে ধীরে চেয়ার ছাড়ল রানা। হাসছে। ‘মানুষ উদাহরণ দেখেও শিক্ষা পায় না,’ চোখের ইশারায় ডেস্কের মাঝখানটা দেখাল ও। ‘বুঝতে পারছি, ওই সাইজের একটা গর্ত চাইছ নিজের বুকে।’ মুঠো করা হাত দুটো মুখের সামনে তুলল রানা, বাতাসে বক্সিং চালাল কয়েকটা, সেই সাথে নাক দিয়ে হুহ্ হুঁহ্ করে শব্দ ছাড়ল। ‘বহুত আচ্ছা, দোস্ত, আগে বাড়ো!’
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বয়েড। আগুন ঝরছে দু‘চোখের দৃষ্টিতে।
শরীরের পাশে নামিয়ে নিল রানা হাত দুটো। গাম্ভীর্যের সুর নকল করে বলল, ‘আমার পাওনা টাকা চাই আমি। এই মুহূর্তে।’
হাতটা লম্বা করে দিল বয়েড। তর্জনী দিয়ে ডেস্কের উপর ফেলে রাখা একটা এনভেলাপ দেখাল। হিসহিস শব্দ বেরিয়ে এল দাঁতের ফাঁক দিয়ে, ‘ওটা নিয়ে দূর হয়ে যাও এখান থেকে। তিন ঘণ্টা সময় দিলাম, এরপর যেন ফোর্ট ফ্যারেলে তোমাকে দেখতে না পাই।’
হাত বাড়িয়ে এনভেলাপটা নিল রানা। কোনা ছিঁড়ে মুখটা খুলল। উপুড় করে নাড়া দিতেই ডেস্কের উপর কাগজের টুকরো পড়ল একটা। সেটা তুলল ও। দেখল পারকিনসন ব্যাঙ্কের একটা চেক। প্রাপ্য টাকার অঙ্ক লেখা রয়েছে ঝরঝরে অক্ষরে!
শার্টের বুক পকেটে সযত্নে ভরুল রানা চেকটা। তারপর মুখ তুলে তাকাল বয়েডের দিকে। ‘কি যেন বলছিলে তুমি?’
‘আগেই শুনেছ তুমি, দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করার প্রয়োজন নেই,’ গোল করে কাটা মাথার চুলের নিচে কপালটায় কিছু বিন্দু ঘাম দেখতে পাচ্ছে রানা। ‘ফোর্ট ফ্যারেলে বয়েডের মুখের কথাই একমাত্র আইন,’ স্থির, নিষ্কম্প কণ্ঠস্বর বয়েডের, ‘আমার হুকুম যদি অমান্য করো, রানা… ক্লিফোর্ডদের ব্যাপারে বড় বেশি কৌতূহলী তুমি, ওদের পাশেই জ্যান্ত কবর দেব তোমাকে।’
‘তোমার শাস্তিটা এক ডিগ্রী বেশি ভয়ঙ্কর, স্বীকার করি,’ হাসছে রানা। ‘আমি তোমাকে জ্যান্ত কবর দেবার ভয় দেখাইনি। সে যাক, চললাম, বয়েড।’ ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে হঠাৎ থামল রানা। ‘ভাল কথা, উত্তরটা তুমি বোধ হয় জানতে চাও, তাই না?’
চেয়ে আছে বয়েড। জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করছে না। বুঝতে পারছে, শুনতে না চাইলেও শুনিয়ে যাবে রানা।
‘ঝুঁকিটা আমি নেব,’ বলল রানা। ঘুরল। এগোল দরজার দিকে।
‘দাঁড়াও!’ কঠিন আদেশের সুরে পিছন থেকে বলল বয়েড।
দরজার নব ছেড়ে দিয়ে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল রানা’। ‘আবার কি?’
‘ফোর্ট ফ্যারেলের গোরস্থানে কেন গিয়েছিলে তুমি?’
ভুরু জোড়া একটু উপরে তুলল রানা, ‘প্রশ্নটা এত দেরিতে করলে যে? অনেকক্ষণ চেপে রেখেছিলে কষ্ট করে। কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর তোমার দরকার কেন?’
‘তোমার মালিককে গিয়ে বলো, সব আমি জানি—তোমার এ কথার অর্থ কি?’
‘একথা বলেছি তা তুমি জানলে কিভাবে? মালিকটা তুমিই তাহলে?’
চুপ করে রইল বয়েড। তারপর বলল, ‘তুমি কি মনে করো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বেরোতে পারবে এখান থেকে?’
‘মনে-টনে করতে অভ্যস্ত নই,’ বলল রানা, ‘আমি জানি, পারব।’
‘আমার একডাকে আড়াইশো লোক ছুটে আসবে। পারবে তুমি সবাইকে ঠেকাতে?’
‘ডাক দিয়ে জড় করেই দেখো!’ পিছন ফিরল রানা, হাত দিল দরজার নবে। তারপর টান দিল।
হা-হা করে হেসে উঠল বয়েড।
দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়েছে কেউ বাইরে থেকে। নব ধরে টানতেও খুলল না।
‘তোমার সেই বিখ্যাত ঘুসি মারতে যেয়ো না আবার,’ পিছন থেকে বলল বয়েড। ‘ব্যথা পাওয়াই সার হবে, সিকি ইঞ্চিও দাবাতে পারবে না। ওটা স্টীলের পাত দিয়ে মোড়া। সাউণ্ড প্রুফও-অথাৎ গুলির আওয়াজ বাইরে যাবে না।’ হঠাৎ কঠিন এবং দ্রুত হলো রয়েডের গলার স্বর, ‘সাবধান! নোড়ো না! গুলি করছি—নড়লেই!’
নড়ল না রানা। কার্পেটে জুতোর মচ মচ আওয়াজ শুনে বুঝল এগিয়ে আসছে বয়েড। আছে কি নেই জানা নেই ওর, কিন্তু কল্পনায় তার হাতে চকচকে নীলচে পিস্তলটা দেখতে পেল ও।
শুনছে রানা। জুতোর শব্দ থামল ঠিক ওর পিছনে। শিরদাঁড়ায় শক্ত মত ঠেকল কিছু ৷
‘কে তুমি? কেন এসেছ ফোর্ট ফ্যারেলে?’ বয়েড উত্তেজিত! নিচু, গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করছে। ‘কি জানো তুমি ক্লিফোর্ডদের সম্পর্কে?’
ঝন ঝন শব্দে বেজে উঠল ডেস্কের টেলিফোনটা।
‘জবাব দাও রানা,’ একঘেয়ে, চাপা কণ্ঠস্বর বয়েডের। ‘বিদেশী হয়ে ক্লিফোর্ডদের সম্পর্কে এত কৌতূহল কেন তোমার? কি চাও তুমি?’
‘আমি?’ বলল রানা, আবার টেলিফোন বাজছে বলে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল ও, তারপর বলল, ‘চাওয়ার মত কি থাকতে পারে আমার? আমি একজন জিওলজিস্ট…’
‘বিশ্বাস করি না,’ বলল বয়েড, ‘হয়তো জিওলজিস্ট কিংবা নয়, ফোর্ট ফ্যারেলে অন্য কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছ তুমি।’
‘তুমিই বলো কি সেটা?’
‘রানা…’
ঝপ করে বসে পড়ল রানা, কাঁধ দিয়ে বয়েডের হাঁটুতে ধাক্কা দিল একই সাথে। কিভাবে কি ঘটল বোঝার আগেই দেখল বয়েড কার্পেটের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, সে। মাথা তুলতে যাবে, সশব্দে শূন্য থেকে পড়ল রানা তার বুকের উপর। ফস্কে গিয়ে ছুটে যাচ্ছে হাতের পিস্তলটা, সেটা শক্ত করে ধরে রাখতে চাইল, কিন্তু কনুইয়ের কাছে ছোট্ট একটা জুজুৎসুর চাপ পড়তেই কাৎরে উঠে আলগা করে দিল মুঠি।
পিস্তলটা হাতে নিয়েই উঠে দাঁড়াল রানা। কলার ধরে টেনে দাঁড় করাল বয়েডকে। মৃদুকণ্ঠে বলল, ‘তুমি একটা ভীতুর ডিম। মিথ্যুক বিগ প্যাটের মতই। যাই হোক, প্রাণভরে আগা-পাশ-তলা ধোলাই করবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু ইচ্ছেটা আপাতত দমন করছি। কিন্তু মনে রেখো, আর বাড়াবাড়ি করলে সুদে-আসলে মিটিয়ে দেব পাওনা।’ বুড়ো আঙুল দিয়ে দরজার দিকে দেখাল, ‘খুলে দিতে বলো বেরিয়ে যাচ্ছি আমি। কেউ বাধা দিলে খুন হয়ে যাবে।’
একপাশে সরে দাঁড়াল রানা। পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে বয়েড। নিজের অজান্তেই থর থর করে কাঁপছে গালের ডান পাশটা। চেনাই যাচ্ছে না তাকে। মুখটা সম্পূর্ণ নতুন লাগছে দেখতে। কয়েক সেকেণ্ডের চেষ্টায় কিছুটা সামলে নিল সে।
‘ঠিক আছে, মনে থাকবে আমার!’ দাঁতে দাঁত চেপে হিস হিস করে উঠল সে। এগিয়ে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াল। আঙুল দিয়ে ঠক্ ঠক্ করে তিনবার টোকা দিল কবাটে।
একসেকেণ্ড পরই খুলে গেল দরজা। তিন চারটে বড় বড় লালচে মুখ দেখল রানা। গলা বাড়িয়ে দিয়েছে দরজার ভিতর। বয়েডকে দেখে একযোগে টেনে নিল যে যার গলা। অবিশ্বাস ভরা চোখে চেয়ে থাকল।
ঘেউ-ঘেউ-ঘেউ-ঘেউ করে চারটে শব্দ উচ্চারণ করল বয়েড, ‘সরে যা কুত্তার বাচ্চারা!’
বাপের বাধ্য ছেলের মত এক নিমিষে সরে গিয়ে পথ করে দিল লোকগুলো।
বয়েডের দিকে তাকাল না রানা। দৃঢ় পায়ে এগোল ও। হাতের পিস্তলটা ঘোরাতে ঘোরাতে বেরিয়ে এল করিডরে।
করিডর ধরে হাঁটছে রানা। পিছন ফিরে তাকাচ্ছে না। থামল, শেষ মাথায়, এলিভেটরের সামনে। হাত বাড়িয়ে বোতাম টিপল। এক দুই করে দশ সেকেণ্ড কাটল। দরজা খুলে গেল এলিভেটরের। ভিতরে ঢুকল ও। তারপর ঘুরে দাঁড়াল দরজার দিকে মুখ করে।
লম্বা করিডর। নির্জন, ফাঁকা। বয়েডের অফিসরুমের দরজাটা বন্ধ দেখল রানা। ভাবল, সম্ভবত রুদ্ধদ্বার কামরায় গোপন ট্রাইবুনালের অধিবেশনে বিচারপতির পদ ‘অলংকৃত করছে এই মুহূর্তে রয়েড পারকিনসন, ঘোষণা করছে আসামী মাসুদ রানার ‘মৃত্যুদণ্ড, রাগত কাঁপা গলায়।
পারকিনসন বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এসে সোজা ব্যাঙ্কে গিয়ে ঢুকল রানা। চেকটা জমা দিয়ে টোকেন হাতে পেলেও সন্দেহটা দূর করতে পারল না মন থেকে; ইতিমধ্যেই ব্যাঙ্কে ফোন করে টাকা না দেবার নির্দেশ দেয়নি তো বয়েড?
হয়তো ভুলে গেছে, কাউন্টার থেকে টাকা গুনে নিয়ে কোটের পকেটে ভরতে ভরতে ভাবল রানা। ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে সোজা বাস স্টেশনে পৌঁছুল। খবর নিয়ে জানল ফোর্ট ফ্যারেল থেকে পরবর্তী বাস ছাড়বে এক ঘণ্টা পর। টিকেট কিনে বেরিয়ে এল!
হাতে মাত্র দুটো কাজ। ব্যাগ ব্যাগেজগুলো গোছগাছ করা, তারপর লংফেলোর সঙ্গে দেখা করে বিদায় নেয়া।
হোটেলের রিসেপশনে ঢুকল রানা। রানাকে দেখে সম্ভবত দরজার আড়াল থেকেই ছিটকে বেরিয়ে এল ম্যানেজার।
থমকে দাঁড়াল রানা।
সামনে এসে থামল প্রৌঢ় ম্যানেজার। নেমে পড়া প্যান্টটা টেনে কোমরে তুলতে তুলতে ঢোক গিলল সে। তারপর আঙুল তুলে দেখাল দরজার পাশটা।
সেদিকে তাকাল রানা। দেখল, ওর ব্যাগ ব্যাগেজগুলো নামিয়ে এনে ফেলে রাখা হয়েছে সেখানে।
‘আমাদের মালিক জানিয়েছেন আপনার মত সম্মানী ব্যক্তির স্থান এই নিচু স্তরের হোটেলে হওয়া উচিত নয়,’ হাত কচলাচ্ছে প্রৌঢ়। ‘দয়া করে অন্য কোন ভাল হোটেলে যদি ওঠেন…’
মুচকি হাসল রানা। ‘ধন্যবাদ। ভাল হোটেল এখান থেকে কতদূর বলতে পারেন?’
‘এই শ-দেড়েক মাইল…’
‘ধন্যবাদ, ধন্যবাদ,’ হাসতে হাসতে বলল রানা। ব্যাগগুলো তুলে নিল কাঁধে। ‘আপনার মালিককে বলবেন, দেড়শো নয় দুশো মাইল দূরে চলে যাচ্ছি আমি। কিন্তু যাচ্ছি ফিরে আসার জন্যেই।’
‘জী, আচ্ছা, বলব,’ হঠাৎ চোখ কপালে উঠল লোকটার, ‘কি। কি বললেন?’
রানা তখন বেরিয়ে যাচ্ছে রিসেপশন থেকে।
***
রাগে উত্তেজনায় ঠক ঠক করে কাঁপছে বুড়ো লংফেলো। ‘কাপুরুষ। বেশ, দূর হও এবার আমার চোখের সামনে থেকে!’ কফি হাউজের দরজাটা দেখিয়ে দিল সে রানাকে। ‘বেরোও! সোজা বাসে চড়ে বিদায় হয়ে যাও ফোর্ট ফ্যারেল থেকে।’ নিজের কপালে বাঁ হাত দিয়ে চাটি মারল সে। ‘ইস্! এই ভীতুর ডিমটার ওপর আমি কিনা ভরসা করেছিলাম! ভাবতেও লজ্জা করছে আমার।’
‘আরে!’ অসহায়ভাবে কফি হাউজের চারদিকে তাকাল রানা। ভাবল, ভাগ্যিস ম্যানেজার ঘুমাচ্ছে আর ওয়েটারটাকে আগেই সিগারেট কিনতে পাঠিয়ে দিয়েছিল সে। ‘আগে সব কথা শোনোই না ছাই!’
‘সব কথা? কোন কথা শুনতে চাই না আমি আর। তুমি একটা কাপুরুষ, তোমার কথা আবার কি শুনব? ডেকে নিয়ে গিয়ে একটু ধমক দিয়েছে, অমনি কুঁকড়ে গেছ! পালাবার জন্যে…’
কচু বুঝেছ তুমি!’ ধমকের সুরে বলল রানা, ‘ভীমরতি আর বলে কাকে! আরে, আমি কি বলেছি চলে গিয়ে আর ফিরব না? যাচ্ছি ফিরে আসার জন্যেই…’
‘কি? বোকা পেয়েছ আমাকে? ফিরে আসার জন্যে যাচ্ছ—বাহ্! কথার কি মার প্যাচ!’
শান্তভাবে বলল রানা, ‘কোথায় যাচ্ছি তা যদি জানতে তাহলে বুঝতে ফিরে আসব কিনা।
ফের সেই কথার প্যাচ,’ একটু প্রকৃতিস্থ হয়েছে লংফেলো। ‘কোথায় যাচ্ছ শুনি?’
‘ভ্যানকুভারে।’
ভুরু কুঁচকে উঠল লংফেলোর। নামটার তাৎপর্য জানা আছে তার, কিন্তু এই মুহূর্তে স্মরণ করতে পারছে না।
ওকে সাহায্য করল রানা। ‘কেনেথকে ভুলে গেছ এরই মধ্যে?’
‘ওহ্-হো! ভ্যানকুভার! ওখানেই পড়াশোনা করত কেনেথ।’ হঠাৎ রানার দিকে ঝুঁকে পড়ল বৃদ্ধ। ফিসফিস করে জানতে চাইল, ‘সত্যি? কিন্তু ওখানে কি পাওয়ার আশা করো তুমি, রানা?’
‘কি পাব তা জানি না,’ স্বীকার করল রানা, ‘গিয়ে খোঁজ খবর করা দরকার, তাই যাচ্ছি!’
‘কিন্তু কেনেথের যা বদনাম ওখানে, তার সাথে সম্পর্ক ছিল। একথা কেউ স্বীকারই করতে চাইবে না। ভেবেছ আমি যাইনি ওখানে?’
হেসে ফেলল রানা। ‘তা ভাবিনি। কিন্তু তোমার যাওয়া আর আমার যাওয়ার মধ্যে বিরাট পার্থক্য আছে, মিস্টার লংফেলো।’
‘পার্থক্য?’
‘হ্যাঁ। তুমি যে ধ্যান-ধারণা নিয়ে গিয়েছিলে আমি ঠিক তার উল্টোটা নিয়ে যাচ্ছি!’
‘কিছুই বুঝলাম না। পরিষ্কার করে বলো।’
‘পরিষ্কার করে বলার সময় এখনও আসেনি;’ বলল রানা। ‘শুধু এইটুকু জেনে রাখো কেনেথের কয়েকটা ব্যাপার আমার কাছে অত্যন্ত রহস্যজনক মনে হয়েছে। নিশ্চিত হতে চাই আমি।’
‘তোমার একথার অর্থ?’
হেসে উঠল রানা। ‘সব কথা প্রকাশ করার সময় এখনও আসেনি। শোনো, আজই চলে যাচ্ছি আমি। কবে নাগাদ ফিরতে পারব জানি না। ভ্যানকুভার থেকে আরও কয়েক জায়গায় যেতে হতে পারে। আমার অনুপস্থিতিতে তোমার কাজটা কি হবে বলো দেখি?’
‘চোখ কান খোলা রেখে সব ঘটনা নোট বুকে টুকে নেয়া।’
‘ঠিক,’ চোখ টিপল রানা। ‘তাহলে উঠতে পারি?’
‘প্রার্থনা করি ভালয় ভালয় ফিরে এসো।’
‘আর একটা কথা,’ বলল রানা, ‘একা কিছু করতে যেয়ো না ওদের বিরুদ্ধে, বুঝলে? ফিরে এসে যদি দেখি মারা পড়েছ, খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি!’