ছয়
গাছ সমান উঁচুতে দাঁড়াল হেলিকপ্টার। আঙুল দিয়ে একটা জায়গা দেখাল, তারপর, চিৎকার করে বলল রানা পাইলটকে, ‘ওই ওখানে, লেকের পাশে ফাঁকা জায়গাটায়।’
মাথা ঝাঁকাল লোকটা। লেজ ঘুরিয়ে ডান মুখো হলো কপ্টারটা। খানিকদূর এগিয়ে ধীরে ধীরে নামল নিচে, লেকের পাড়ে। স্বচ্ছ পানিতে খুদে ঢেউয়ের চঞ্চল ভাঁজগুলোর দিকে মুগ্ধ চোখে চাইল রানা।
এঞ্জিনের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই এখন। সুইচ অফ করেনি পাইলট। হাতল ঘুরিয়ে দরজা খুলে লাফিয়ে নিচে নামল রানা। একটা একটা করে বাড়িয়ে দিল পাইলট যন্ত্রপাতির বাক্সগুলো। সেগুলো নিয়ে খানিকটা দূরে রেখে এল রানা। কাজটা শেষ হতে পাইলটকে হাত নেড়ে টা-টা করল রানা। বলল, ‘আগামী হপ্তায় দেখা হবে আবার।’
‘এইখানেই, সকাল এগারোটায়।’
প্রকাণ্ড ফড়িংয়ের মত শূন্যে উড়ল কপ্টারটা। গাছের মাথার উপর দিয়ে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল।
ধীরে ধীরে পিছন ফিরল রানা। দু‘চোখে তৃষ্ণার্ত একটা ভাব ফুটে উঠল ওর। হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওকে স্ফটিকের মত স্বচ্ছ পানি। হাত দুটো নিশপিশ করে উঠল শার্টের বোতাম খোলার জন্যে। মৃদু হেসে নিজেকে দমন করল রানা। এখন নয়, পরে নামা যাবে পানিতে। হাতের কাজগুলো শেষ করা দরকার আগে।
ক্যাম্প তৈরি করাটাই সবচেয়ে বড় কাজ আপাতত। সাজসরঞ্জাম সবই সাথে আছে, সুতরাং ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় নিল না কাজটা। আধঘণ্টার বেশি সময় লাগল ল্যাট্রিনটা তৈরি করতেই। লেকের কিনারায় দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে একটা একটা করে তীরে তুলল ভেসে যাওয়া গাছের ডালপালা। আগুন ধরিয়ে বাক্স থেকে বের করল কফি তৈরির সরঞ্জাম। পানি ভরল কেটলিতে। সেটা আগুনে বসিয়ে দিয়ে কয়েকটা বাক্স খুলে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে রাখল।
কফি পান করে অবশিষ্ট বাক্স খুলে টুকিটাকি আরও কিছু জিনিস বের করে সাজাল রানা। ভাঁজ করা একটা কাজ চালাবার মত ছোট টেবিল বের করে পাতল সেটা। তারপর বিছানাটা তৈরি করে ফেলল।
সব কাজ শেষ করে খুঁটিয়ে দেখল সে ক্যাম্পের ভিতরটা। মোটামুটি আরামদায়ক এবং স্বস্তিকর হয়েছে ক্যাম্পটা। প্রয়োজনীয় জিনিস সব হাতের নাগালেই আছে। সন্তুষ্ট হয়ে বাইরে বেরিয়ে এল রানা। আজকের মত কাজ শেষ। আগামীকাল সকাল থেকে অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে কতটুকু কি করা যায় ঘুরে ফিরে দেখবে ও।
পঁচিশ মণ ওজনের একটা পাথরের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে লেকের ধারে বসল রানা। লেকটাকে বড় আকারের একটা দীঘিই বলা চলে। ‘কপ্টারে থাকতে দেখেছে রানা, এক মাইলের বেশি হবে না লম্বায়। উত্তরের পাহাড়ে একটা জলপ্রপাত আছে, এ লেক তার কাছেই ঋণী।
বিকেলটা দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। চারদিকটা ভাল করে একবার দেখার প্রয়োজন বোধ করল রানা। হিংস্র পশু সম্পর্কে ওকে সতর্ক করে দিয়েছে লংফেলো। হঠাৎ ঝপাৎ-ছলাৎ শব্দ হতে ঘাড় ফেরাল রানা। লাফ দিচ্ছে মাছ। আশপাশের সাথে পরিচিত হবার ইচ্ছেটা ঢিলে হয়ে গেল। মাছের তড়পানি দেখে চেগিয়ে উঠল খিদে খিদে ভাবটা। সিদ্ধান্ত নিল; অনেকদিন পর ট্রাউটের স্বাদ নেবে সে।
সন্ধ্যার পর আকাশ ভর্তি জ্বলজ্বলে মুক্তোগুলোর দিকে মুখ করে শুয়ে শুয়ে অনেক কথা ভাবছে রানা। কাহিনীটা অদ্ভুত লাগছে ওর। ক্লিফোর্ডদের নাম এবং স্মৃতি দুনিয়ার বুক থেকে মুছে দেবার চেষ্টা করছে কেন পারকিনসনরা? চিন্তিত ভাবে একটা সিগারেট ধরিয়ে সেটার লাল আগুনের দিকে চেয়ে আছে রানা। এখন পরিষ্কার বুঝতে পারছে ও, যা কিছু ঘটছে সব কিছুরই মূলে রয়েছে সেই আট বছর আগের দুর্ঘটনাটা। কিন্তু মর্মান্তিক ঘটনার শিকার হয়েছিল যারা তাদের তিনজনই মৃত, এবং চতুর্থ ব্যক্তি বেঁচে গেলেও স্মৃতিশক্তি ছিল না তার, তবু তাকে খুন করা হয়েছে। সুতরাং দুর্ঘটনা সংক্রান্ত রহস্য উদ্ধার করার কোনও উপায় বা সুযোগ আপাতদৃষ্টিতে তেমন একটা নেই। দুর্ঘটনাটা কেন ঘটেছিল, কিংবা ঠিক কি ঘটেছিল তা যারা জানে তারা মুখ খুলবে না। অন্তত মুখ খুলতে চাইবে না।
তার মানে, মুখ যাতে খুলতে বাধ্য হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে।
ক্লিফোর্ড পরিবার সবংশে নিহত হওয়ায় লাভ হয়েছে কার? সন্দেহ নেই, গাফ পারকিনসন লাভবান হয়েছে। ব্যবসা এবং ব্যাঙ্কের টাকা সব সে গ্রাস করে নিয়েছে। গ্রাস করার মতলব কি আগে থেকেই ছিল তার? অতি লোভ খুন করার একটা মোটিভ হতে পারে না?
একটা ব্যাপার জানতে হবে; দুর্ঘটনার সময় গাফ পারকিনসন কোথায় ছিল।
আর কে লাভবান হয়েছে? শীলা ক্লিফোর্ড? আপাতদৃষ্টিতে এখনও মনে হচ্ছে ক্লিফোর্ড পরিবার নিহত হওয়ায় তার কোন লাভ তো হয়ইনি, বরং ভীষণ ভাবে বঞ্চিত হয়েছে সে। কিন্তু ভেতরের ব্যাপার ঠিক কি. তা খোঁজ খবর না নিয়ে এখনই বলা যাচ্ছে না। এমনও তো হতে পারে, শীলা ভেবেছিল ক্লিফোর্ডদের অনুপস্থিতিতে সমস্ত কিছুর একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী হবে সে-ই? উঁহুঁ, ঠিক যুক্তিসঙ্গত ঠেকছে না ব্যাপারটা। দুর্ঘটনার সময় শীলার বয়স ছিল মাত্র ষোলো কি সতেরো। এই বয়সের একটা মেয়ের পক্ষে এমন নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্র করা অসম্ভব বলেই মনে হয়। তাছাড়া, সেসময় ফোর্ট ফ্যারেলে শীলা ছিলও না।
আর কে?
যতদূর মনে হচ্ছে, ভাবছে রানা, আর কেউ লাভবান হয়নি। অন্তত ব্যবসা এবং টাকার দিক থেকে নয়। এগুলো ছাড়াও লাভবান হবার আর কোন ব্যাপার ছিল কি? একটা ব্যাপার হতে পারে—শত্রুতা। হাডসন ক্লিফোর্ডের শত্রু ছিল কি? অসম্ভব নয়। কিন্তু তারা কারা?
মনে মনে একটা কাজের ছক তৈরি করে ফেলল রানা। কাজ মানে, খোঁচা দিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যে বেয়াড়া টাইপের কিছু তৎপরতা।
ক্যাম্পে ফিরে বাক্স থেকে হুইস্কির একটা বোতল বের করল সে। পনেরো মিনিট পর বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে ভাবল: রেবেকাকে আজ থেকে আমি আর স্বপ্নে দেখতে চাই না। ওকে ভুলে যাওয়াই আমার জন্যে মঙ্গল।
ভোরের হিমেল হাওয়া চোখেমুখে লাগতে ঘুম ভেঙে গেল রানার। কাপড় না পরেই বাইরে বেরিয়ে পড়ল ও।
ঝাঁপ দিয়ে পড়ে তিনশো গজ সাঁতরে লেকের তীরে ফিরে এল। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ক্যাম্পে ঢুকল। টিন থেকে শুকনো খাবার বের করে তিনজনের মত ব্রেকফাস্ট তৈরি করে গোগ্রাসে গিলল সব একাই। তারপর রাতে গুছিয়ে রাখা চামড়ার রাগটা পিঠে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ল বাইরে।
কালো চামড়ার ব্যাগের গায়ে বড় একটা হলুদ বৃত্ত আগেই আঁকিয়ে নিয়েছে রানা। দূর থেকেও পরিষ্কার দেখা যায় ওটা। হলুদ রঙের এই বৃত্তটা আঁকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ বলেই মনে হয়েছিল ওর। উত্তর আমেরিকার জঙ্গলে এর আগেও দু‘একবার ঢুঁ মেরে গেছে রানা, সে সময়কার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছে, এদিককার বেশির ভাগ শিকারীই কিছু একটা নড়লেই গুলি করতে অভ্যস্ত, সেটা মানুষ না পশু তা দেখার মত ধৈর্য তারা ধরে না। বড় হলুদ একটা বৃত্ত গুলি করার পূর্ব-মুহূর্তে তাদেরকে দ্বিধায় ফেলে দিতে পারে মনে করেই এটা আঁকিয়ে নিয়েছে রানা। শিকারীরা জানে, এদিকের জঙ্গলে হলুদ বুটি বা ছোপওয়ালা পশু নেই। এই একই কারণে হলুদ আর লাল চেকের কোট গায়ে দিয়েছে রানা। ওর মাথায় সাদা একটা ক্যাপ, মিনারের মত উঠে গেছে আধহাত, মাথাটা মসজিদের গম্বুজের মত, টকটকে লাল রঙের!
রাইফেলটা বাঁ হাতে। সেফটিক্যাচ অফ করা। লেকের পাড় ঘেঁষে দক্ষিণ দিকে চলেছে রানা।
এক হপ্তা আগেও জিওলজির অ আ-ও জানত না রানা। চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে আবেদন করার পর বেশ কিছু বই-পত্র যোগাড় করে যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছে ও তা দিয়ে বয়েড পারকিনসনকে সম্ভব হলেও, কোন জিওলজিস্টকে বোকা বানানো সম্ভব নয়। তবে, পারকিনসন যে দায়িত্ব ওকে দিয়েছে তা সুষ্ঠুভাবে পালন করার মত যোগ্যতা ওর হয়েছে বলে নিজেকে সার্টিফিকেট দিতে কার্পণ্য করেনি ও। প্রথম দিনের শেষ ভাগে ওর নিজের আবিষ্কারের সাথে সরকারী জিওলজিক্যাল ম্যাপটা মিলিয়ে দেখল রানা। প্রায় হুবহু মিলে গেল: এলাকার এদিকটায় খনিজ পদার্থ একেবারে নেই বললেই চলে।
পুরো হপ্তাটা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খাটাখাটনি করল রানা। কাইনোক্সি উপত্যকার দক্ষিণ প্রান্তে দামী কোন খনিজ পদার্থ পারকিনসন করপোরেশন পাবে না এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হলো ও। হপ্তার শেষ দিনে বাক্স গোছ-গাছ করার কাজ শেষ করেছে মাত্র, এমন সময় মাথার উপর ‘কপ্টার এসে থামল। রিস্টওয়াচ দেখল রানা। কাঁটায় কাঁটায় এগারোটায় এসে পৌঁছেচে পাইলট।
এবার সে নামিয়ে দিল রানাকে উত্তর এলাকার একটা ঝর্ণার পাশে। এখানেও ক্যাম্প তৈরির পর বিশ্রাম নিয়ে কাটিয়ে দিল রানা প্রথম দিনটা। দ্বিতীয় দিন পিঠে ব্যাগ নিয়ে বেরোল ক্যাম্প থেকে। রুটিন অনুযায়ী সার্ভে করল খানিক জায়গা।
ফলাফল নেগেটিভ।
তৃতীয় দিন টের পেল রানা, ওর উপর নজর রাখা হচ্ছে। লক্ষণগুলো অত্যন্ত সূক্ষ্ম, কিন্তু রানার চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না। ক্যাম্পের কাছাকাছি গাছের একটা নিচু ডালে উলের কয়েকটা রোঁয়া দেখল রানা, অথচ বারো ঘণ্টা আগে জিনিসটার অস্তিত্ব ছিল না। ল্যাট্রিনটা তৈরি করেছে রানা উত্তর দিকে, কিন্তু প্রস্রাবের হালকা গন্ধ ভেসে আসছে দক্ষিণের বাতাসে ভর করে। তারপর, দূর পাহাড়ের গা থেকে আলোর খুদে কণা ঝলসে উঠতে দেখে বোঝা গেল বিনকিউলারে রোদ লেগেছে।
টের পেয়েও ব্যাপারটা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাল না রানা। কারণ, মাথা ঘামিয়ে কোন লাভ হবে বলে মনে করল না ও। লোকটা যেই হোক, ওকে খুঁজে বের করার দরকার পড়বে না, সেই সামনে এসে হাজির হবে—কেন যেন এরকমও মনে হলো রানার।
পাঁচ দিনের দিন উপত্যকার উত্তর প্রান্তটা সার্ভে করার কথা ভেবে রেখেছিল রানা, তাই আগের দিন বেলা থাকতেই উপত্যকার উপর একটা স্বল্পমেয়াদী ক্যাম্প তৈরি করার জন্যে রওনা হলো ও।
আকাশে মেঘ করলেও, প্রচুর জোরাল বাতাস দিচ্ছে। একটা ঝর্ণার পাশ ঘেঁষে হাঁটছে রানা। পিছন থেকে কে যেন বলল, ‘এই যে, লাট সাহেব! মগের মুল্লুক পেয়েছ নাকি? অমন কায়দা করে কোথায় যাচ্ছ শুনি?’
স্থির হয়ে গেল রানা। তারপর সাবধানে ঘুরে দাঁড়াল। ঘাসের মাঝখানে সরু পথটার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে আছে লাল কোট গায়ে লম্বা এক লোক। ঠিক রানার দিকে নয়, তবে রানার দিক থেকে খুব একটা তফাতেও নয়, তাক করে ধরে আছে রাইফেলটা। এইমাত্র একটা গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে সে। তার মানে, ভাবছে রানা, ওরই অপেক্ষায় অ্যামবুশ পেতে অপেক্ষা করছিল। প্রসঙ্গটা ইচ্ছে করেই তুলল না রানা। ওর রাইফেলটা হাতে নেই, রয়েছে কাঁধে, সুতরাং জবাবদিহি চাওয়ার এটা উপযুক্ত সময় নয় বলে মনে করল ও। শুধু বলল, ‘কি, মিয়া কোত্থেকে? আকাশ থেকে পড়লে, নাকি মাটি ফুঁড়ে গজালে?’
লোকটার চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠতে দেখল রানা। অনুমান করল, বয়সে ওর চেয়ে ছোটই হবে। লম্বায় তার সমান, কিংবা আধ ইঞ্চি বেশিও হতে পারে।
দাঁড়াবার ভঙ্গিতে দৃঢ়তার ছাপ। দেখেই বোঝা যার, নিজের উপর অত্যন্ত আস্থা রাখে এ লোক। তার অবশ্য সঙ্গত কারণও আছে। প্রচণ্ড শক্তি রয়েছে ওর দু হাতের পেশীতে।
‘আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না তুমি।’
লোকটার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠাটা পছন্দ করতে পারল না রানা। সন্দেহ হলো, ট্রিগারে বাধিয়ে রাখা আঙুলটাও বুঝি শক্ত হয়ে যাচ্ছে। পিঠ বাঁকা করে ব্যাগটা আরেক দিকে সরিয়ে দিল রানা। ‘উপত্যকার মাথায় চড়তে যাচ্ছি।’
‘কি করতে?’
সহজ ভাবেই কমল রানা, ‘তা দিয়ে তোমার কি দরকার? নিজের চরকায় তেল নাও না কেন? তবে জানতেই যখন চাইছ… পারকিনসন করপোরেশনের হয়ে একটা সার্ভে করছি আমি।’
‘না’ বলল লোকটা। এই মাটিতে সার্ভে করার অধিকার তোমার পারকিনসনদের নেই। এদিকে এই মার্কার দেখেছো?
পোস্টার দৃষ্টি অনুসরণ করে পিরামিডের একটা ক্ষুদে সংস্করণ দেখন রানা, নুড়ি পাথর সাজিয়ে তৈরি করা হয়েছে।
‘তাতে কি?’
‘তাতে এই, পারকিনসনদের জমি ওখানেই খতম, নিঃশব্দে দাঁত বের করল সে, যেন উদ্দেশ্য হাসা প্রদর্শন নয়, দাঁতের ধার দেখান। ‘আমি চাইছিলাম এদিকে আসো তুমি, যাতে মার্কার দেখিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারি এটার এদিকে আসার অধিকার তোমার নেই।’
পিছিয়ে গিয়ে নুড়ি পাথরের পিরামিডটার পাশে দাঁড়াল রানা। তারপর পিছন ফিরতেই দেখল, রাইফেলের তাক ঠিক রেখে লোকটাও এগিয়ে এসেছে। দু‘জনের মাঝখানে রয়েছে এখন পিরামিডটা। রানা বলল, ‘এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে তোমার আপত্তি নেই তো’’
‘না। এখানে তুমি আজীবন পাড়িয়ে থাকতে পারো। আমার কোন আপত্তি নেই।’
‘কাঁধ থেকে ব্যাগ আর রাইফেলটা নামালেও কোন আপত্তি করবে না?’
‘মার্কারের এদিকে যদি নামাও, কোন আপত্তি নেই।’ দাঁতের ধার দেখাল সে আবার।
চোটপাট দেখাবার সুযোগ পেয়ে খুব মজা পাচ্ছে লোকটা বুঝতে পেরেও তাকে রেহাই দেবার সিদ্ধান্ত নিল রানা – আপাতত, সেজন্যে কথা বাড়াল না আর। কাঁধ থেকে ব্যাগ আর রাইফেলটা মাটিতে নামিয়ে রাখল। তারপর আড়মোড়া ভাঙার ভঙ্গিতে কাঁধ দুটোকে উঁচু-নিচু করল ক’বার।
ভঙ্গিটা পছন্দ হলো না লোকটার। রানার শরীরের গঠন অনুমান করে একটা ঢোক গিলল সে। রাইফেলটা এবার সরাসরি রানার বুকের দিকে তাক করল।
ব্যাপারটা দেখেও না দেখার ভান করল রানা। ব্যাগের সাইড পকেট থেকে ম্যাপগুলো বের করল ও। ভাঁজ খুলে দেখল এক এক করে। ‘সীমানা সংক্রান্ত কোন চিহ্ন এখানে তো দেখছি না’ মৃদু কণ্ঠে বলল রানা।
‘না দেখবারই কথা। পারকিনসনদের মাপ যে। চিহ্ন থাক বা না থাক, এটা ক্লিফোর্ডের এলাকা।’
‘কার কথা বলছ তুমি? শীলা কিফোর্ড?’
‘হ্যাঁ, ধরেছ ঠিকই, অসহিষ্ণু ভাবে রাইফেলটা রানার বুকের দিক থেকে মাথার দিকে তাক করল সে।
‘তাকে পাওয়া যাবে? দেখা করতে চাই আমি।’
‘পাওয়া যাবে, কিন্তু যার তার সাথে তিনি দেখা করেন না,’ আবার দাঁত বের করুন লোকটা। ‘দেখা করার অপেক্ষায় থেকো না, মাটির নিচে পর্যন্ত শিকড় গজিয়ে যাবে তাহলে তোমার।’
মাথা ঝাঁকিয়ে উপত্যকার নিচের দিকটা দেখাল রানা ‘ওই ফাঁকা জায়গাটায় ক্যাম্প করব আমি। এক ছুটে ফিরে যাও খোকা, শীলা ক্লিফোর্ডকে গিয়ে বলো যে লাশগুলো কোথায় পুঁতে রাখা হয়েছে তা আমি জানি।’
সামনের দিকে মুখ এগিয়ে দিল লোকটা। ‘কি?’
‘ঝেড়ে দৌড় নাও, আর শীলাকে এই কথাটা গিয়ে বলো,’ বলল রানা, ‘তা না হলে, মিয়া, চাকরিটা তোমার যাবে।’ ঝুঁকল ও, কাঁধে তুলে নিল ব্যাগটা, আবার ঝুঁকল, এবার হাতে নিল রাইফেল। লোকটাকে বিস্ময়ে পাথর করে রেখে ফাঁকা জায়গাটার দিকে এগোতে শুরু করল।
জায়গাটায় পৌঁছে পিছন ফিরল ও। দেখল লোকটা নেই।
আগুন জ্বালল রানা। কফির জন্যে কেটলিতে পানি গরম করছে। হঠাৎ শিস দেয়া বন্ধ করল কথাবার্তার আওয়াজ কানে ঢুকতে। উপত্যকার উপর থেকে আওয়াজটা আসছে। খানিকপরই দেখতে পেল রানা সেই লোকটাকে। হাতে এখন আর তার রাইফেলটা নেই। একটি মেয়েকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছে সে।
জীন্স পরে আছে মেয়েটা। গায়ে গলা খোলা শার্ট আর কোট। মেয়েটার হাঁটা দেখে মনে মনে স্বীকার করল রানা, হ্যা, জীনস পরার মতই একখানা ফিগার। এবং সুন্দরীও বটে। রাগের মাথায় জোরে জোরে পা ফেলে এগিরে আসছে। দূর থেকেই বিদ্ধ করছে তাঁর দৃষ্টি দিয়ে রানাকে। রাগের এই ভাব যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে মেয়েটার সৌন্দর্য। তিন হাত সামনে পা ঠুকে থামল সে। দু‘কোমরে হাত রাখল। ‘এখানে কি হচ্ছে? কে তুমি?’
‘সার্ভে হচ্ছে। আমি একজন জিওলজিস্ট, মাসুদ রানা পারকিনসন করপোরেশন…’
মুখের সামনে হাত নেড়ে থামিয়ে দিল শীলা ক্লিফোর্ড রানাকে। ‘থাক, এর বেশি কিছু শোনার দরকার নেই আমার। উপত্যকায় এইটুকু পর্যন্তই তুমি উঠতে পারো, মি. রানা। আমি চাই এ ব্যাপারে তুমি নজর রাখবে, বিগ প্যাট।’
‘সে কথাই ওকে আমি বলেছি, মিস ক্লিফোর্ড, কিন্তু আমার কথায় কান দিতে চায়নি ও।’
মাথা ঘুরিয়ে বিগ প্যাটের দিকে তাকান রানা। ‘তুমি এখনও দাঁড়িয়ে এখানে? শীলা ক্লিফোর্ড পারকিনসনদের এলাকায় এসেছে আমার নিন্ত্রণ পেয়ে—কিন্তু তোমাকে তো আমি ডাকিনি। যাও ভাগো। অল্প শোনো, ফের কখনও তুমি আমার দিকে রাইফেল ধরো, তোমার ঘাড় মটকে দেব আমি।
‘মিস ক্লিফোর্ড, ডাহা মিথ্যে কথা বলছে ও।’ চেঁচিয়ে উঠল বিগ প্যাট। ‘কখনো আমি–’
ডান হাতটা শক্ত করে বা দিকের নিতম্বের কাছ থেকে ঝড়ের বেগে তুলল রানা, সংঘর্ষটা হলো বিগ প্যাটের চোয়ালের নিচের অংশের সাথে হাতটার উল্টো পিঠের। মাটি থেকে প্রায় এক ফুট শূন্যে উঠল লোকটা, হাত-পা ছড়িয়ে সোজা চিৎ হয়ে পড়ল মাটির উপর, সদ্য ডাঙ্গায় তোলা মাছের মত তড়পাল কয়েকবার, তারপর স্থির, নিঃসাড় হয়ে গেল।
শীলার দিকে তাকাতে তার মুখের ভিতর আলাজিভ পরিষ্কার দেখতে পেল বানা। হাতের উল্টোপিঠটা কোর্টের সামনে ঘষতে ঘষতে মৃদু কণ্ঠে বলল, ‘মিথ্যে কথা একেবারেই সহ্য করতে পারি না আমি।’
‘ও মিথ্যেবাদী নয়। ওর হাতে রাইফেল ছিল না।’
‘থারটি-ও-সিক্স রাইফেল ছিল এটা।’ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল রানা। ‘বাটের গায়ে আনাড়ী হাতে খোদাই করা রয়েছে দুটো অক্ষর—BP, ছোকরা গত দু‘তিনদিন ধরে নজর রাখছে আমার ওপর। এটাও আমি পছন্দ করছে পারিনি। এই মারটা প্রাপ্য ছিল।
‘তুমি একটা বর্বর—ওকে কোন সুযোগই দাওনি!’
রান্না দেখল শীনা ক্লিফোর্ড এমন ভাবে দাঁতে দাঁত চেপে আছে যেন কামড়াবার সুযোগ পেলে আর কিছু চায় না। মুচকি একটু হাসল রানা। ‘নরম হাতে একটু সেঁক এর দরকার এখন, তুমি কি মনে করো?’
‘হুঁহ্’। দুপদাপ শব্দ করে পা ফেলে এগোল শীলা, বিপ প্যাটের সামনে গিয়ে থামল। হাঁটু ভাঁজ করে বসল তার পাশে, ‘প্যাট, চোখ মেলো,’ ঝট করে মুখ তুলল রানার দিকে। গলার স্বরে উদ্বেগ প্রকাশ পেল তার, নিশ্চয়ই চোয়াল ভেঙে দিয়েছ তুমি।’
‘না,’ বলল রানা, যথেষ্ট জোরে মারিনি ওকে আমি। কয়েকদিন ব্যথা আর জ্বর থাকবে, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।’ একটা গ্লাস নিয়ে ঝর্ণার দিকে এগোল রানা! পানি ভরে নিয়ে এসে বিপ প্যাটের চোখেমুখে হড় হড় করে ঢেলে দিল।
নড়ে উঠল বিগ প্যাট, উহ্-আহ্ শব্দ করতে শুরু করল। ‘দু‘এক মিনিটের মধ্যেই উঠে দাড়াবে ও। আস্তানায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিয়ো। আর ভাল করে বুঝিয়ে দিয়ো, ফের যদি রাইফেল ধরে আমার দিকে, সারা জীবন যাতে খুঁড়িয়ে হাটতে হয় তার ব্যবস্থা আমি করব।’
নাকের ফুটো দুটো ফুলে ফুলে উঠছে শীনা ক্লিফোর্ডের। তাচ্ছিল্যের সাথে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে তাকাল বিপ প্যাটের দিকে।
আবার বলল রানা, ‘ওকে বিছানায় শুইয়ে আবার এসে দেখা করতে পারো তুমি, মিস ক্লিফোর্ড। এখানেই আছি আমি।’
মুখটা ফেরাতে সেখানে একটা হতচকিত ভাব দেখল রানা। ‘কি মনে করে ভাবছ তুমি তোমার সাথে আমি দেখা করতে চাইব আবার?
‘লাশগুলো কোথায় পুঁতে রাখা হয়েছে তা আমি জানি বলেই ভাবছি তুমি আমার সাথে দেখা না করে পারবে না,’ মৃদু হেসে বলল রানা। ‘ভাল কথা, একা আসতে ভয় পেয়ো না যেন। মেয়েদের গায়ে হাত তোলার অপবাদ আজ পর্যন্ত কেউ দেয়নি আমাকে।’
নিঃশ্বাসের সাথে চাপা যার শীলা ক্লিফোর্ড কি বলল বুঝতে না পারলেও তা যে শ্রুতিমধুর কিছু না সে ব্যাপারে রানা নিঃসন্দেহ। বিগ প্যাটের হাত ধরে তাকে দাঁড়াতে সাহায্য করল সে। মার্কার টপকে ওপারে চলে গেল দু‘জন। একবারও পিছন ফিরে তাকাল না শীলা ক্লিফোর্ড। ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল তারা
দিগন্ত রেখা ছুঁই ছুঁই করছে সূর্যটা। আগুনের কাছে ফিরে এসে রানা দেখল কেতলির পানি বাষ্প হয়ে উড়ে গেছে সব। রাতের জন্য বিছানা তৈরি করতে হবে, মনে পড়ল ওর।
•
সূর্য ডুবে গেছে। নামব নামব করছে সন্ধ্যা। গাছের ফাঁকে কি যেন একটা ঝলমল করে উঠতে দেখল রানা। তারপর চিনতে পারল। মন্থর পায়ে হেঁটে আসছে শীলা ক্লিফোর্ড।
বড় একটা পাথরে হেলান দিয়ে বসে আছে রানা। নাদুসনুদুস হাস ঝলসাচ্ছে গনগনে আগুনে। লম্বা কাঠি দিয়ে আগুনটা মাঝে-মধ্যে উসকে দিচ্ছে ও। উপতাকার ঢালু জমির উপর দিয়ে নেমে আসছে শীলা।
রানার কাছ থেকে খানিকটা উপরে থামল। খুব যেন তাড়া আছে, নষ্ট করার মত সময় নেই। দাঁড়িয়েই প্রশ্ন ছুঁড়ল, ‘আসলে কি চাও তুমি?’
মুখ ফিরিয়ে আগুন আর হাঁসটা দেখল রানা। তারপর আবার তাকাল শীলার দিকে। খিদে পেয়ে থাকলে স্বীকার করে ফেল, শীপাকে অসহিষ্ণুভাবে নড়তে চড়তে দেখে মুচকি হাসল ও, ‘হাঁসের রোস্ট, গরম রুটি, তেঁতুলের চাটনি আর প্রচুর কফি—কেমন লাগছে শুনতে?’
আরও ক’পা নেমে রানার সমান্তরালে পৌঁছুল শীলা। বিগ প্যাটকে আমি বলেছিলাম, সে যেন তোমার ওপর নজর রাখে,’ বলল সে, ‘তুমি আসছ তা আমি জানতাম। কিন্তু পারকিনসনদের এলাকায় ওকে আমি যেতে বলিনি। কিংবা রাইফেলের কথাও কিছু বলিনি ওকে।’
‘হয়তো বলা উচিত ছিল,’ মন্তব্য করুন রানা, ‘হয়তো সাবধান করে দিলে ভাল করতে, বেয়াড়াপনা করতে যেত না।’
‘বিল প্যাট একটু বেয়াড়া, জানি,’ বলল শীলা, ‘কিন্তু তোমার কাজটাও অত্যন্ত বাড়াবাড়ি হয়েছে।’
মাটির তৈরি আভেন থেকে রুটির চ্যাপ্টা একটা টুকরো বের করে প্লেটের উপর আছড়ে ফেল রানা। আঙ্গুলগুলো মুখের সামনে তুলে ফুঁ দিল কয়েকবার। তারপর প্লেটটা ধরে বাড়িয়ে দিল শীলার দিকে। ‘খাসা হাস, কি বলো?’
ঝলসানো হাঁসের গা থেকে ভাপ উঠে নাকে লাগতে ফুটো দুটো কেঁপে উঠল শীলার, রানা লক্ষ করছে দেখে মৃদু শব্দে হেসে উঠল সে। হার মানছি এ ব্যাপারে। গন্ধটা ভারি চমৎকার!’
ছুরি হাতে নিয়ে মাংস কাটতে শুরু করল রানা। ‘শরীরে নয়, আমার উদ্দেশ্য ছিল বিগ প্যাটের অহমিকায় আঘাত। লোকজনের দিকে খামোকা যদি রাইফেল তাক করতে থাকে, ভবিষ্যতে খেলাচ্ছলেই হয়তো কাউকে খুন করে ফেলবে। গর্বে আঘাত করে এর নিজের জানটাই হয়তো রক্ষা করেছি কে বলতে পারে! কে ও?’
‘আমারই লোকজনদের একজন।’
‘তুমি তাহলে জানতে আমি আসছি,’ একটু চিন্তিত ভাবে বলল রানা, ‘দ্রুত খবর ছড়ায় এদিকে, সন্দেহ নেই।’
প্লেট থেকে বুকের একটুকরো মাংস বেছে নিয়ে মুখে তুলল শীলা। আমি জড়িত এমন সব ব্যাপারের খবরই আমাকে রাখতে হয়। আরে, দারুণ হয়েছে তো!’
‘বাবুর্চি হিসেবে আমি ভাল নই,’ বলল রানা, ‘রোস্টটা ভাল হওয়ার কৃতিত্ব এখানকার খোলা বাতাসের। কিন্তু তোমার সাথে আমি জড়ালাম কিভাবে?’
‘পারকিনসনদের হয়ে কাজ করছ তুমি, আমার এলাকায় পা রেখেছিলে।’
‘একটা কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। নাদান মিলার বয়েড পারকিনসনকে তোমার কথা বলেছিল। এই সার্ভের ব্যাপারে তোমার অনুমতি দেয়ার প্রসঙ্গে। নেয়নি বুঝি?’
‘এক মাসের ওপর রয়েডের সাথে দেখা হয়নি আমার। জীবনে আর কখনো দেখা না হলেও কিন্তু এসে যায় না।’
‘এসব ব্যাপার আমি কিভাবে জানব বলো? ব্যবসায়ী মানুষ পারকিনসন, আমি ভেবেছিলাম সব দিক ঠিক ঠাক করেই আমাকে পাঠিয়েছে।’
‘ব্যবসায়ী, তবে অসাধু ব্যবসায়ী,’ বলল শীলা। ‘কিন্তু কোন পারকিনসনের কথা বলছ তুমি? ওরা দুজনেই অসাধু, কিন্তু গাফ পারকিনসনের হাতিয়ার কূট বুদ্ধি, আর বয়েড পারকিনসনের অস্ত্র গায়ের জোর।’
‘অনুমতি নেবার দরকার নেই একথা ভেবেছে সে, বলতে চাইছ?’
‘ওই ধরনের কিছু একটা ভেবে থাকবে,’ বলল শীলা। ‘কারও কাছ থেকে কিছু চেয়ে নেবার মত লোক সে নয়, তার অভ্যাস কেড়ে নেয়া।এসব কথা থাক; মৃতদেহ পুঁতে রাখার ব্যাপারটা কি?’
হাসছে রানা। ‘না মানে, স্রেফ কথা বলতে চেয়েছিলাম তোমার সাথে আমি। কিছু একটা বলে তোমাকে আনতে চেয়েছিলাম।’
চেয়ে রইল শীলা রানার দিকে। ‘এ-কথা শুনে আসবই তা তুমি জানলে কি ভাবে?’
‘এসেছ তো, তাই না?’ বলল রানা, ‘সেই প্রাকটিক্যাল জোকারের গল্পটা তোমার জানা নেই? যে তার দশজন বন্ধুকে টেলিগ্রাম পাঠায় এই বলে “সব ফাঁস হয়ে গেছে!’ টেলিগ্রাম পেয়ে নয়জনই পালায় শহর ছেড়ে। প্রত্যেকেরই কিছু গোপন ব্যাপার থাকে কি বলো?’
বাঙ্গের সুরটা স্পষ্ট কানে বাজল রানার। ‘সঙ্গ লাভের জন্যে মরে যাচ্ছিলে তুমি!’
‘তোমার মত একটি মেয়ের সান্নিধ্যের জন্য সেটা কি সঙ্গত নয়?’
‘তোমাকে আমি বিশ্বাস করি না, হাত নেড়ে মাছি তাড়াবার ভঙ্গি করল। ‘কোমল কথাবার্তায় লাভ হবে না কিছু! আমি যে নব্বই বছরের একটা বুড়ী নই তা তুমি জানলে কিভাবে? অবশ্য আগেভাগেই খোঁজ খবর নিয়ে থাকলে আলাদা ব্যাপার। সে যাক। ঠিক কি উদ্দেশ্য নিয়ে তুমি এখানে এসেছ, রানা?’
‘সত্যি আনতে চাও?’
‘জানার জন্যে মরে যাচ্ছি তা ভেব না। তবে একটু কৌতূহল বোধ করছি।’
‘যারা মরতে চায় তারা প্রথমে একটু কৌতূহলই বোধ করে—আস্তে আস্তে ওটা বাড়বে। সে যাক। তোমার কৌতূহল মেটাবার খানিক চেষ্টা করতে পারি আমি এই প্রশ্নটার যদি উত্তর দাও; পারকিনসন অ্যান্ড ক্লিফোর্ড ব্যাঙ্কে যে বিপুল টাকা হ্যাডসন ক্লিফোর্ডের নামে জমা ছিল তার পরিমাণ কত এ ব্যাপারে তোমার কোন ধারণা আছে?
খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল শীলার। দু চোখে বিস্ময় এবং সেই সাথে অবিশ্বাস ফুটে উঠল। ‘কি বললে?’
প্রশ্নটা আবার উচ্চারণ করল রানা। এবং সেই সাথে আরও ক’টা কথা যোগ করল, ‘ক্লিফোর্ড মারা যাবার মাত্র পনেরো দিন পর ব্যাঙ্কের নাম বদলে শুধু পারকিনসন ব্যাঙ্ক রাখা হয়। দুর্ঘটনার সপ্তম দিনেই পারকিনসনরা ক্লিফোর্ডদের বাড়িটা দখল করে। পুরানো সব চাকর-বাকরকে বিদায় করে দিয়ে নিজেদের লোক রাখে। আমার সন্দেহ, উইল, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, ব্যাঙ্কের হিসাবপত্র এবং চেক বই—সব তারা দখল করে। শুধু তাই না, ব্যাঙ্কের খাতাপত্রও বদলে ফেলে তারা। অর্থাৎ ব্যাঙ্কে কিবোর্ডদের যে কয়েক কোটি ডলার ছিল তার কোন প্রমাণ তারা অবশিষ্ট রাখেনি, সব গায়েব হয়ে গেছে। এই ব্যাপারটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি কেন বলতে পারে? কারও মাথাতেই কি সন্দেহটা জাগেনি?’
‘রানা! এসব কথা তোমার মুখে কেন? কে তুমি? বয়েড পারকিনসন যদি শোনে—জীবনে বেরোতে দেবে না তা তোমাকে ফোর্ট ফ্যারেল ছেড়ে।’
‘অর্থাৎ আটকে রাখার জন্যে খুন করবে?’ হো হো করে হেসে উঠল রানা।
নির্জন ফাঁকা উপত্যকার হাসির শব্দটা অদ্ভূত ভরাট আর সজীব শোনাল শীলার কানে। ‘আর গাফ পারকিনসন যদি শোনেন?
শীলা গম্ভীর। ‘তুমি কে তা আমি জানি না, রানা। তোমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ অজ্ঞ। কিন্তু তুমি যদি বিগ প্যাটকে কাবু করে ভেবে থাকো এই একই ভাবে বয়েড পারকিনসনকেও… উঁহু, মারাত্মক ভুল হবে সেটা, রানা।’
‘আমার কথা ভেবে দুশ্চিন্তা কোরো না,’ বলল রানা। ‘আমি জানতে চাই, এরকম একটা অন্যায় ঘটে গেল কিন্তু সেটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলল না কেন? এ ব্যাপারে তোমার নিজের অজুহাতটা কি, মিস ক্লিফোর্ড?’
’ আমি কেন মাথা ঘামাব?’ একটু বিরক্তির সাথে বলল শীলা। ‘হাডসন ক্লিফোর্ডের ডলারই বলো আর সয়-সম্পত্তি বা ব্যবসাই বলো, পারকিনসনদের হাত থেকে উদ্ধার করে আমার কি লাভ?’ অভিমানের সুরটা পরিষ্কার বাজল রানার কানে। ‘ক্লিফোর্ড পরিবারের আইনসঙ্গত উত্তরাধিকারিণী আমি নই। সুতরং এদের হাত থেকে কিছু যদি উদ্ধার করা তখন সম্ভবও হত, তার এক কণাও আমি পেতাম না— চলে যেত সরকারী কোষাগারে। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা, উদ্ধার করা সম্ভবই ছিল না। আমি আমার আইন উপদেষ্টার সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করেছি। আমার জেদে তিনি একবার চেষ্টাও করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি আমাকে জানান, নাথান মিলার অন্যান্য সব ব্যবসা এবং ব্যাঙ্কের হিসেব পত্রে এমন জটিলতা সৃষ্টি করে রেখেছে যে প্রকৃত ব্যাপারটা বোঝার জন্যে এক ডজন উঁচুদরের আইনবিদের এবং এক জন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টের একটানা বারো বছরের গবেষণা দরকার হবে। কিন্তু, এসব ব্যাপারে তুমি কেন মাথা ঘামাচ্ছ?’
‘মাথা ঘামাচ্ছি কিনা জানি না,’ বলল রানা। ‘তবে কয়েকটা প্রশ্ন নিয়ে ভাবছি।’
‘কয়েকটা?’
‘আরও একটা প্রশ্ন হলো পারকিনসনরা স্থায়ী ভাবে সরিয়ে দিল কেন ক্লিফোর্ড পরিবারটাকে?’
ত্রিশ সেকেন্ড চুপ করে তাকিয়ে রইল শীলা রানার দিকে। তারপর বলল, ‘খুব খারাপ কথা, রানা। পারকিনসনরা এসব শুনলে দেখা মাত্র গুলি করবে তোমাকে।’ প্লেট নামিয়ে রেখে খানিকটা নিচে নেমে গেল শীলা। ঝর্ণার পানিতে হাত ধুলো। রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ফিরে এল আবার।
ইতিমধ্যে কাপে কফি ঢেলেছে রানা। একটা কাপ বাড়িয়ে দিল শীলার দিকে ও, কাপটা হাতে নিয়ে রানার সামনে বসল শীলা।
‘এসব প্রশ্ন পারকিনসনদের করছি না আমি—এখনও,’ বলল রানা। ‘এই মুহূর্তে আমার সামনে হয়েছে একজন ক্লিফোর্ড, তাকেই জিজ্ঞেস করছি। একজন ক্লিফোর্ড হিসেবে এসব প্রশ্ন কি জাগে না তোমার মনে?’
‘জাগে বৈকি! কিন্তু সবাই জানে, এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সম্ভব নয়—উত্তর নেই। রানা, কে তুমি? কি চাও তুমি?’
‘আমি? আমি কেউ না, তোমাদের কারও কাছে কিছুই চাই না। আচ্ছা, পারকিনসনরা তোমাকে কখনও বিরক্ত করেনি?’
গরম কফিতে চুমুক দিল শীলা। ‘চেষ্টা করেছে, কিন্তু সুবিধে করতে পারেনি। এখানে আমি খুব কম সময় কাটাই। বছরে দু‘এক মাসের জন্য আসি ওঁদেরকে অস্বস্তিতে ফেলার জন্য—ব্যাস। ’
‘আজও তাহলে তুমি জানো না ক্লিফোর্ডদের বিরুদ্ধে ওদের কোন ষড়যন্ত্র ছিল কিনা?’
‘না।’
আগুনের দিকে চোখ রেখে মৃদু কণ্ঠে বলল রানা, ‘কে যেন বলছিল পারকিনসনরা তোমাকে ওদের বাড়ির বউ করতে চায়। ওরা নাকি চায় না ফোর্ট ফ্যারেলে ক্লিশোর্ড নামে কেউ থাকুক, তোমাকে বউ করতে চাওয়ার সেটাই নাকি একমাত্র উদ্দেশ্য।’
ঠিক যেন জ্বলন্ত কয়লার টুকরো হয়ে গেল শীলার চোখ। ‘বয়েড কি এ ব্যাপারে…’ হঠাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল সে।
‘বয়েড কি এ ব্যাপারে… তারপর? ’
উঠে দাঁড়াল শীলা। জিনস থেকে ধুলো ঝাড়ল হাত দিয়ে। ‘তোমাকে আমার পছন্দ নয়, মি. রানা। অনেক বেশি কথা জিজ্ঞেস করো তুমি, কিন্তু আমি একটা প্রশ্নের উত্তর পাই না। নিজের পরিচয় আমাকে তুমি আনাতে রাজি নও। তোমার উদ্দেশ্য সম্পর্কেও আমি কিছু জানি না। পারকিনসনদের সাথে যদি লাগতে চাও, সে তোমার নিজের ব্যাপার, তবে পরিণতিটা কি হবে ইচ্ছে করলে আমার কাছ থেকে জেনে নিতে পারো তুমি—ওদের কাগজ তৈরির কারখানায় ওরা মণ্ড তৈরি করবে তোমার হাড়-মাংস দিয়ে। কিন্তু, এসব ব্যাপার নিয়ে আমি কেন মিছি মিছি মাথা ঘামাই। তবে, একটা ব্যাপার তোমাকে জানিয়ে রাখছি। আমার ব্যাপারে নাক গলিয়ো না।’
‘এমন কি করবে তুমি আমার যা পারকিনসনরা করতে বাকি রাখবে?
‘ক্লিফোর্ডদের নাম মুছে ফেলা হয়েছে ফোর্ট ফ্যারেল থেকে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে সব মানুষের মন থেকেও মুছে গেছে নামটা মি রানা, আমার বন্ধুর সংখ্যা খুব কম নয়?’
‘শুনে খুশি লাগছে। কিন্তু একটা প্রশ্ন, তাদের মার হজম করার শক্তি বিগ প্যাটের চেয়ে বেশি তো?’ হঠাৎ রানার মনে হলো, মেয়েটার সাথে ঝগড়া করছে কেন ও? উঠে দাড়াল তারপর। ‘দেখো, কিছু মনে কোরো না, তোমার সঙ্গে আমার কোন বিরোধ নেই। তোমার ব্যাপারে নাক গলাবারও কোন উদ্দেশ্য আমার নেই। আমার দিকে কেউ রাইফেল না ধরলে এমনিতে আমি একেবারে মাটির মানুষ। তোমার এলাকাটা সার্ভে করতে না পারলে আমার কিছু এসে যায় না, আমি শুধু কথা প্রসঙ্গে বয়েডকে ব্যাপারটা জানাব।’
‘তা জানিয়া, ’ বলল শীলা। তার কণ্ঠে বিস্ময় প্রকাশ পেল, ‘অদ্ভুত লোক তুমি, রানা। এই এলাকার তুমি একজন আগন্তক, কিন্তু পা ফেলেই আট দশ বছরের পুরানো একটা রহস্য খুঁড়ে বের করতে চাইছ, যেটার কথা ইতিমধ্যে ভুলে গেছে প্রায় সবাই। এসব ব্যাপারে জানলেই বা তুমি কোথেকে?’
‘ঘটনা চক্রে।’
ঠাণ্ডা বাতাসকে বাধা দেবার জন্যে কোটের বোতাম লাগাতে শুরু করল শীলা। ‘তোমার সাথে রহস্য নিয়ে আলাপ করে সারাটা রাত অপচয়ের ইচ্ছে আমার নেই। আমি ফিরে যাচ্ছি। শুধু একটা কথা মনে রেখো, আমার এলাকায় পা দিয়ো না কখনও—ভুলেও।
যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়ল শীলা।
পিছু ডাকল রানা, ‘শোনো। জানো না বুঝি, ভূত-পেত্নী, জীব-জন্তু এরা যারা রাতে বেরোয় সবাই ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে তোমার ফেরার অপেক্ষায় ওত্ পেতে আছে? একা যাওয়া কি উচিত হবে? যদি বলো, পৌঁছে দিতে পারি।
‘এসবকে আমি ভয় পাই না,’ বলল বটে, কিন্তু চোখমুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে রানার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল শীলা!
আগুন নিভিয়ে রাইফেল হাতে শীলার পাশে এসে দাঁড়াল রানা, ‘পরে আবার বলবে না তো যে জোর করে নিমন্ত্রণ আদায় করেছি।’
উত্তরে ঝট করে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে হাঁটা ধরল শীলা। দ্রুত তার পাশে চলে গেল রানা। নুড়ি পাথরের পিরামিডটা টপকে মৃদু কণ্ঠে বলল ও, ‘তোমার এলাকার ঢুকতে দিয়েছ বলে ধনবাদ, মিস শীলা ক্লিফোর্ড।’
‘মেয়েরা মিষ্টি কথায় গলে এ তোমার বেশ ভালোই জানা আছে, ’ কথাটা বলে আঙুল দিয়ে ডান দিকটা দেখাল শীলা,‘আমরা ওই পথে যাব।’
চড়াই উৎরাই ঠেলে প্রায় আধঘণ্টা ওঠার পর কালো একটা কাঠ দেখল রানা। শীলার হাতে টর্চ জ্বলে উঠতে বাড়িটার কাঠের দেয়াল আর বড় বড় জানালা দেখে একটু অবাকই হলো ও। এতবড় বাড়ি আশা করেনি ও।
দরজাটা ভেজানো। সেটা খুলে পিছন ফিরে তাকাল শীলা, একটু ইতস্তত করে জানতে চাইল, ‘ভিতরে ঢুকতে আপত্তি নেই তো?’
ভিতরটা দেখে আরও অবাক হলো রানা। সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেমে বাড়িটাকে গরম করে রাখা হয়েছে। হলরুমটা প্রকাণ্ড। এতই বড়, সুইচ টিপে শীলা একটা আলো জানলেও রুমের বেশির ভাগটা ছায়ায় থেকে গেল। পূর্ব দেয়ালের পুরোটাই দখল করে রেখেছে লম্বা একটা জানালা। সেটার সামনে দাঁড়িয়ে জোছনা মাখা উপতাকার মনোরম দৃশ্য দেখতে পেল রানা। অনেকটা দূরে তরল পারদের মত টলটল করছে লেকের পানি।
বোতাম টিপে আরও কয়েক আলো জ্বালল শীলা। পালিশ করা কাঠের মেঝেতে চামড়ার কার্পেট বিছানো। আধুনিক ফার্নিচার। দু‘দিকের দেয়ালে লম্বা বুক শেলফ। মেঝেতে পড়ে আছে একটা ফোনোগ্রাফ, রেডিও-ক্যাসেট-রেকর্ড প্লেয়ার, অ্যাশট্রে, সিগারেটের প্যাকেট এবং ছোট একটা শ্যাম্পেনের বোতল।
‘না দেখলে বুঝতেই পারতাম না কত আরামে থাকো তুমি।’
‘সব ব্যাপারে ব্যঙ্গ করা তোমার একটা বাজে অভ্যাস।’ বলল শীলা। ‘কিছু যদি গলায় ঢালতে চাও, নিজের হাতে বের করো ওটা থেকে,’ গ্রীবা নেড়ে একটা একটা কেবিনেট দেখাল সে। ‘সবরকমই পাবে, যেটা ইচ্ছে বের করে নিতে পারো। আর আগুণটার ব্যাপারে কিছু একটা করলে মন্দ হয় না। উত্তাপের দরকারে নয়, আমি শিখা দেখতে ভালবাসি, তাই।’ অদৃশ্য হয়ে গেল সে, বেরিয়ে গিয়ে ভিড়িয়ে দিল দরজাটা।
ফায়ারপ্লেসটা দেখে রানার মনে হলো বড় আকারের একটা গরুর বাছুর রোস্ট করতেও জায়গার অভাব হবে না এখানে। পাশেই নিখুঁতভাবে সাজানো রয়েছে মসৃণ ভাবে কাটা কাঠের টুকরোগুলো। ধিকি ধিকি জ্বলছে আগুন, তার মধ্যে কয়েক টুকরো কাঠ ফেলে দিল রানা। খানিক পরই দেখা গেল আগুনের শিখা।
কামরাটা দেখছে রানা ঘুরেফিরে। আশ্চর্য! বুক শেলফে আজেবাজে একটা বইও নেই। ক্লাসিক, আধুনিক উপন্যাস, বাছাই করা কিছু জীবনী এবং বাকি সব ইতিহাসের বই। দ্বিতীয় শেলফটায় শুধুই আর্কিওলজির মোটা মোটা বই। রানার মনে হলো স্বতন্ত্র একটা রুচি আর পছন্দ হয়েছে মেয়েটার।
দেয়ালের উঁচু অংশে বড় বড় ফটো ঝোলানো। বেশির ভাগই বুনো পশুর। একদিকে রাইফেল আর শটগানের একটা কাঁচ সেরা র্যাক। ভিতরটা দেখল রানা। ধূলোর মিহি একটা স্তর দৃষ্টি এড়াল না ওর। পাশেই প্রকার একটা খয়েরী রঙের ভাল্লুকের ফটোগ্রাফ। ছবিটা তোলা হয়েছে টেলিফটো লেন্সে, কিন্তু সেই তুলুক, বিপদ সীমার ভিতরে দাঁড়িয়ে তুলেছে সে।
ঠিক পিছন থেকে সকৌতুকে বলল শীলা, ‘এটার সাথে তোমার চেহারার খানিকটা মিল আছে, না?’
ঘাড় ফেরাল রানা। ‘আমি কি অতটা বুনো। এটা আমার চেয়ে অন্তত ছয় গুণ বড় আর দশগুণ হিংস্র হবে।’
পায়ের কোটটা খুলে রেখে এসেছে শীলা। পাল্টে চেক শার্ট পরে এসেছে একটা। জীনসের বদলে পরনে এখন স্ন্যাকস। কিন্তু প্যাটকে এইমাত্ৰ দেখে এলাম। সেরে উঠতে খুব বেশি সময় নেবে না, কি বলো?’
‘প্রয়োজনের চেয়ে জোরে আমি মারিনি। আদব শেখাবার জন্য ওটুকু ওর দরকার ছিল।’ হাত নেড়ে কামরাটা দেখাল রানা, ‘সুখের একটা নীড়, সত্যি!’
‘রানা,’ কঠিন গলায় বলল শীলা, আজেবাজে কথা শুনতে অভ্যস্ত নই আমি। আমার রুচি ইত্যাদি সম্পর্কে তোমার কোন ধারণা নেই, সুতরাং দয়া করে চুপচাপ বেরিয়ে যাও এখান থেকে। তোমার নোংরা মন, তা না হলে তুমি ভাবতে পারতে না বিগ প্যাটের সাথে সুখের নীড় রচনা করেছি এখানে আমি।’
‘আরে!’ অবাক হয়ে বলল রানা। ‘কেমন মেয়ে তুমি? আমার কথার এই অর্থ করলে? ছি, তা কেন ভাবব আমি। জঙ্গলে এরকম একটা আরামদায়ক বাড়ি কল্পনাও করিনি, সেজন্যেই কথাটা মনে হয়েছে আমার। অন্য কিছু ভেবে…’
সামলে নিল শীলা নিজেকে। ধীরে ধীরে মুখের কাঠিন্য দূর হয়ে গেল। ‘দুঃখিত। একটু বুঝি অস্থির হয়ে আছি আজ আমি, কিন্তু সেজনো তুমিই দায়ী, রানা।’
‘দুঃখ প্রকাশের কোন দরকার নেই, ক্লিফোর্ড।’
হেসে উঠল মৃদু শব্দে শীলা, শেষ পর্যন্ত সেটা আর মৃদু রইল না। তার সাথে যোগ দিল রানাও। পরবর্তী ত্রিশটা সেকেন্ড ওদের আনন্দের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ‘না,’ শেষ পর্যন্ত কোনমতে নিজেকে থামাল শীলা, এদিক ওদিক মাথা নাড়ছে দ্রুত। ‘তুমি রাগ করোনি বুঝব কিভাবে? ক্লিফোর্ড নামে ডাকতে পারবে না তুমি আর আমাকে—শীলা বললেই চলবে।’
‘আমি রানা,’ বলল ও। ‘হ্যালো, শীলা!’
‘হ্যালো, রানা!’
‘জানো, তোমার সাথে বিগ প্যাটকে জড়িয়ে কিছু আমি ভাবিইনি। তোমার পায়ের নখের যোগ্যও সে নয়।
হাসিটা বন্ধ করুন শীলা, বুকে হাত বেঁধে চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকল রানার দিকে। অনেকক্ষণ কেটে গেল। তারপর সে বলল, ‘মাসুদ রানা, এর আগে কোন পুরুষ এভাবে আমাকে উত্যক্ত করতে সাহস পায়নি। তুমি যদি ভেবে থাকো গায়ের জোর দেখে মানুষকে পছন্দ করি আমি তাহলে মারাত্মক ভুল করবে। দয়া করে খানিকক্ষণ মুখ বুজে থাকো এবং আমাকে খানিকটা স্কচ হুইস্কি চলে দাও গ্লাসে।’
নিঃশব্দে কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ওয়াল কেবিনেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দরজা খুলে দেখল দুনিয়ার সমস্ত দামী মদের বোতল একটা করে পাশাপাশি সাজানো রয়েছে। স্কচ হুইস্কি দুটো গ্লাসে ঢেলে ফিরে এল ও জানালার সামনে। ওর হাত থেকে একটা গ্লাস নিয়ে বাইরে তাকাল শীলা। ‘এবার কতদিনের জন্যে জঙ্গলে আছ তুমি?’
‘প্রায় দু‘হপ্তা। ’
‘গরম পানিতে গোসল করার সুযোগ পেলে কেমন লাগবে তোমার?’
মুচকি হেসে বলল রানা, ‘মনে হবে হৃদয়টা বিলিয়ে দিই বিনিময়ে।’
তর্জনী তুলল শীলা, ‘ওটা—বা দিকে দ্বিতীয় দরজাটা—তোমার জন্যে তোয়ালে রেখে এসেছি আমি।’
হাতের গ্লাসটা একটু তুলে শীলার দৃষ্টি আকর্ষণ করল রানা, ‘সাথে এটা থাকলে কিছু মনে করবে তুমি?’
‘মোটেই না।’
বাথটাবকে মিনি সাইজের একটা পুকুর বলে মনে হলো রানার। সাবানের ফেনাভর্তি উষ্ণ পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে দিয়ে অনেক কথা ভাবছে ও। ভাবছে বিয়ের কথা তুলতে বয়েডের প্রসঙ্গে কি বলতে গিয়ে অমন চুপ করে গেল শীলা? শার্টের ভিতর থেকে ওঠা শীলার গলার কাছে বাঁকটার কথা মনে পড়ল ওর। ভাবল, গাফ পারকিনসন লোকটা দেখতে কেমন?
বাথটাব থেকে নেমে শাওয়ারের নিচে দাড়াল রানা। কাপড় পরার সময় ডিজেল জেনারেটরের শব্দকে চাপা দিয়ে বেজে উঠল ওয়েস্টার্ন মিউজিকের অপূর্ব সুর। কামরায় ফিরে এসে দেখল, মেঝেতে বসে Sibelius-এর ফার্স্ট সিম্ফনি শুনছে শীলা।
হাত তুলে খালি গ্লাসটা দেখাল সে রানাকে। এগিয়ে গিয়ে হাত থেকে নিল সেটা রানা। ওয়ান কেবিনেট থেকে দুটো গ্লাস ভরে ফিরে এল, বসল একটা সোফায়। ‘সমালোচনা করার মত একটা মাত্র ব্যাপার চোখে পড়ছে আমার,’ বলল রানা। ‘মাঝে মধ্যে রাইফেল আর শটগানগুলো পরিষ্কার করা উচিত তোমার।’
‘ওগুলো আজকাল আর ব্যবহার করি না। শুধু মজার জন্যে খুন করার নেশা ছুটে গেছে। আজকাল ক্যামেরা দিয়ে শিকার ধরি।’
র্যাকের পাশে ঝোলানো খয়েরী রঙের ভাল্লুকের ফটোটা দেখাল রানা, ওটার মত? মাথা দুলিয়ে শীলা, সায় দিতে আবার বলল ও, ‘খুব কাছ থেকে তুলেছ ছবিটা। আশা করি রাইফেলটা হাতের কাছেই ছিল?’
‘এ ধরনের বিপদকে আমি তুচ্ছ জ্ঞান করি,’ বলল শীলা। তারপর অনেকক্ষণ কারও মুখে কথা নেই। দু‘জনেই চেয়ে আছে আগুন আর শিখার দিকে। অনেকক্ষণ পর বলল শীলা, ‘পারকিনসনদের হয়ে ক’দিন কাজ করবে তুমি?’
‘হঠাৎ এ প্রশ্ন? তুমিও কিছু কাজ করাতে চাও নাকি আমাকে দিয়ে?’
‘আমার প্রশ্নের জবাব দিতে না চাইলে বলার কিছু নেই।’
‘ঠিক নেই,’ বলল রানা। ‘ওদের কাজ কয়েক দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আমার কাজ কবে নাগাদ শেষ হবে এখনও তা বুঝতে পারছি না।’
‘তোমার কাজ? তোমার আবার কি কাজ?’
‘এখনও যখন বোঝোনি, থাক তাহলে, পরে আপনিই বুঝতে পারবে—যদি সময় এবং সুযোগ ঘটে। কিন্তু তুমি কি করো? কোথায় থাকো? সব সময় এখানে নিশ্চয়ই নয়?’
‘আমি আর্কিওলজিস্ট,’ বলল শীলা। ‘আমার খোঁড়াখুঁড়ির কাজ মধ্যপ্রাচ্যেই সীমিত। বছরের আট দশ মাস ওখানেই থাকি। মেডিটারেলিয়ানের ওদিকের তীরে গাছ-পালা নেই বললেই চলে—তাই এখানে চোখ জুড়াতে আমি মাঝে মধ্যে। হাজার হোক, এটা আমার নিজের জায়গা।’
‘বুঝতে পারছি।’
কথা বলতে বলাতে অনেক সময় কেটে গেল। অনেক কথা। ছেলেবেলার, তারুণ্যের। শুনছে রানা। ইতিমধ্যে নিভে গেছে আগুনটা। কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল, হঠাৎ চোখ বড় বড় করে বলল শীলা, ‘মাই গড! হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, রানা? ক’টা বাজল বলো দিকি?’
‘দুটো।’
হাসতে লাগল শীলা। ‘তাই তো বলি, কেন ঘুম পাচ্ছে।’ কি যেন ভাবল একটু সে। তারপর বলল, ‘অতিরিক্ত একটা বিছানা আছে, থাকতে চাইলে থেকে যেতে পারো। এত রাতে ক্যাম্পে ফিরে না যাওয়াই বোধ হয় ভাল।’ চোখের দৃষ্টি তীব্র হলো একটু। কিন্তু মনে রেখো, কোনরকম আকার-ইঙ্গিত চলবে না। যদি করো, বের করে দেব বাইরে।’
‘ঠিক আছে,’ মাথাটা একদিকে কাত করে রাজি হলো রানা। ‘কোন ইঙ্গিত নয়। যা কিছু হবে সবই ইঙ্গিত ছাড়া—সরাসরি, কি বলো?’
চড় মারার জন্যে হাত তুলছে শীলা।
চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল রানা। ‘আমি তোমাকে বাধা দিচ্ছি না। তবু কি আঘাত করার মত নিষ্ঠুরতা দেখাতে পারবে তুমি? শীলা?’
গালে নয়, রানা শীলার হাতের স্পর্শ পেল ওর চুলে। চুল ধরে ঝাঁকিয়ে দিল শীলা মাথাটা। ‘বিদেশী, মন ভোলাবার সব কৌশলই দেখছি জানা আছে তোমার!’