গ্রাস – ৫

পাঁচ

লংফেলোর ছোট্ট ডেরা। ঘরটায় একটা খাট, দুটো চেয়ার, দু‘প্রস্থ ভাঙা সোফা আর একটা বুক-কেস ছাড়া কিছু নেই।

‘সাংবাদিক সাহেব,’ বলল রানা, ‘তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছ না।

মুখ তুলল না ‘বুড়ো লংফেলো। ধীরস্থিরভাবে বোতল থেকে হুইস্কি ঢালছে দুটো গ্লাসে। থার্মোফ্লাস্কেৰ মুখ খোলার ফাঁকে একবার তাকাল, কিন্তু কথা বলল না। বরফের টুকরো বের করে একটা একটা করে গ্লাস দুটোয় ছাড়তে লাগল। ‘উইকলি ফোর্ট ফ্যারেল নয়, রানা, ক্লিফোর্ডদের সম্পর্কে আমি ব্যক্তিগতভাবে আগ্রহী!

‘এত বছর পর? কেন? আটটা বছর ঘুমাচ্ছিলে নাকি?’

‘সে অনেক কথা। পরে শুনো। একটা কথা মনে রেখো, ক্লিফোর্ডদের প্রসঙ্গ নিয়ে আমি কারও সাথে কথা বলছি এটা জানাজানি হয়ে গেলে বিপদে পড়ব আমি। পারকিনসন আমার শেষ দেখে ছাড়বে। আমি বলতে চাইছি, মুখের লাইসেন্সটা হারিয়ে ফেলো না।’ রানার দিকে একটা গ্লাস বাড়িয়ে ধরল সে, ‘আগুপিছু ভেবে দেখেছ তো, রানা? ওদের সাথে লাগা মানে একটা প্রচণ্ড অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা।’

‘ভেবেচিন্তেই সব কাজ করি আমি। ওরা অশুভ শক্তি, সেটাই তো ওদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।’

‘তা ঠিক,’ নিজের গ্লাসে চুমুক দিয়ে ভাঙা সোফায় হেলান দিল লংফেলো, ‘কিন্তু, শক্তিটা অশুভ হলেও এর ক্ষমতা সম্পর্কে তোমার মনে কোনরকম ভুল ধারণা থাকুক তা আমি চাই না, রানা। আমি চাই না, অকালে দুনিয়ার বুক থেকে তিরোধান ঘটুক তোমার।’

‘বাজে বকবক কোরো না, রানার গলার স্বরে স্পষ্ট বিরক্তি প্রকাশ পেল, ‘ক্লিফোর্ডদের সম্পর্কে জানতে এসেছি, যদি কিছু জানাবার থাকে, সংক্ষেপে বলতে পারো আমাকে।’

‘ওদের প্রতি তোমার এই তাচ্ছিল্যের ভাব, এটা যদি সত্যি সত্যি তোমার যোগ্যতা এবং অসম সাহস থেকে উৎসারিত হয়ে থাকে তাহলে তার চেয়ে বেশি আনন্দের আর কিছু হতে পারে না, রানা,’ বৃদ্ধ গম্ভীর। ‘সে যাক, তুমি পারো আর নাই পারো, ওদের বিরুদ্ধে লাগবে এটা পরিষ্কার বুঝেছি! আমি তোমার দলে, এ ব্যাপারে কোন ভুল নেই। তাহলে, এবার শুরু করা যাক।’

লংফেলো ঘণ্টাখানেক ধরে বকবক করে যা বলল তা থেকে মোদ্দা কথা যা বুঝল রানা: ফোর্ট ফ্যারেলের পত্তনের সময় থেকে এখানে ছিল দয়ালু ক্লিফোর্ড পরিবার। তিন পুরুষ ধরে তারা ফোর্ট ফ্যারেলে কাঠ আর বাঁশের বিশাল ব্যবসা চালিয়ে আসছিল। হাডসন ক্লিফোর্ডের আমলে এই ব্যবসা উন্নতির শিখরে ওঠে। তাঁর সময়োচিত একটা সিদ্ধান্ত ছিল : গাফ পারকিনসনকে ব্যবসার অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করা।

আশ্চর্য কর্মদক্ষতা ছিল গাফ পারকিনসনের একটা মস্ত গুণ। আর হাডসন ক্লিফোর্ডের মাথায় ছিল আশ্চর্য সব নতুন নতুন বুদ্ধি। ৪৫/৫৫ এই অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে তারা ফোর্ট ফ্যারেলে একের পর এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। প্রতিটি ব্যবসার শেয়ার দুই বন্ধুর মধ্যে সীমিত ছিল। হাডসনের ছিল ৫৫ ভাগ, গাফের ৪৫।

‘গাফ পারকিনসন কে? বয়েডের বাপ?’

‘হ্যাঁ,’ বলল লংফেলো, ‘আমার চেয়ে দু‘চার বছরের বড়ই হবে। হার্ডসনের চেয়েও। দু‘জন মিলে ফোর্ট ফ্যারেলে একের পর এক প্লাইউড প্ল্যান্ট, পালপিং প্ল্যান্ট, স-মিল, অটোমোবাইল বিজনেস, ব্যাঙ্ক, কেমিক্যাল বিজনেস, ট্র্যান্সপোর্ট বিজনেস, ব্রিক ফিল্ড (পারকিনসনরা পরে এটাকে বিক্রি করে দিয়েছে), অ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরি, ফার্নিচার মার্ট ইত্যাদি কয়েক ডজন ব্যবসা ফেঁদে বসে। এক সময় ওদের টাকার পরিমাণ কত এই নিয়ে আনুমানিক হিসেব করতে বসে অবসর সময়টা কাটাত ফোর্ট ফ্যারেলের লোকেরা।’

‘বেশ, বুঝলাম, পারকিনসন আর ক্লিফোর্ড দু‘জন মিলে অগাধ টাকার মালিক হলো। তারপর?’

লংফেলো হঠাৎ গম্ভীর। ‘তার আর পর নেই।’

‘মানে?’

‘মানে, তারপর, হাডসন ক্লিফোর্ড স্ত্রী এবং একমাত্র ছেলেকে নিয়ে নিহত হলো—এই সুযোগে ওদের যাবতীয় সয়-সম্পত্তি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, নগদ টাকা সব গ্রাস করে নিল পাফ পারকিনসন। কারণ, ক্লিফোর্ড পরিবারের কেউ বেঁচে না থাকায় দাবি জানাবার কেউ ছিল না আর।’

‘শীলা ক্লিফোর্ডের কথা ভুলে যাচ্ছ তুমি।’

‘না, ভুলিনি,’ বলল লংফেলো, শীলা হাডসনের দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়ার মেয়ে এবং তাকে সে পোষ্য কন্যা হিসেবে গ্রহণ করলেও রক্তের কোন সম্পর্ক ছিল না বলে ক্লিফোর্ড পরিবারের আইনসঙ্গত উত্তরাধিকারিণী সে নয়। মেয়েটার মা-বাপ কেউ ছিল না, তাই তাকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছিল হাডসন। পোষ্য কন্যা হিসেবে ঘোষণা করলেও, এ ব্যাপারে লেখাপড়ার কাজটা বাকি ছিল। আমি যতদূর জানি, শীলা এবং ছেলে টমাস ক্লিফোর্ডকে স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি আধাআধি ভাগ করে দেয়ার ইচ্ছেই ছিল তার। শীলাকে সে নিজের ছেলের সমানই ভালবাসত। কিন্তু উইল করে রেখে যায়নি হার্ডসন, যার ফলে তার সারাজীবনের পরিশ্রমের ফল অনায়াসে গ্রাস করতে পেরেছে গাফ।

ভুরু কুঁচকে উঠল রানার, ‘উইল করে রেখে যায়নি? কেন?’

কেন কে জানে! সম্ভবত এত তাড়াতাড়ি মরতে হবে তা ভাবেনি। কিংবা, হয়তো ভেবেছিল, সে মরলেও তার ছেলে তো বেঁচে থাকবে।’

‘পরস্পর বিরোধী হয়ে যাচ্ছে না ব্যাপারটা?’ বলল রানা। ‘শীলা এবং টমাসকে সব যদি আধাআধি ভাগ করে দেয়ারই ইচ্ছে ছিল তাহলে তিনি মারা গেলে ছেলে টমাস শীলাকে অস্বীকার করতে পারে ভেবে উইল তো অনেক আগেই করার কথা।’

‘যুক্তিটা অকাট্য, স্বীকার করল লংফেলো। মাথার টুপি খুলে পাকা ক’গাছি চুলে আঙুল চালাল। ‘সে যাই হোক, মোট কথা, উইল সে করেনি।’

‘করেনি, নাকি সেটার কোন খবর পাওয়া যায়নি?’

কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করল লংফেলো। তারপর বলল, ‘আসলে, উইলের প্রসঙ্গটা নিয়ে মাথা ঘামাইনি আমি কখনও। সবাই বলাবলি করেছিল সে-সময়, হাডসন উইল করে যায়নি—ব্যাপারটা অবিশ্বাস করার কথা মনে হয়নি আমার।’

‘তাহলে দাঁড়াল কি ব্যাপারটা? শুধু উইল করা হয়নি বা সেটার কোন হদিস পাওয়া যায়নি বলে শীলা ক্লিফোর্ড নগদ কোটি কোটি ডলার এবং ডজন কয়েক চালু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শতকরা পঞ্চান্ন ভাগ মালিকানা থেকে বঞ্চিত হলো?’

‘হ্যাঁ,’ বলল লংফেলো, ‘তবে শীলা সবকিছু থেকে বঞ্চিত হলেও, দিন তার কারও চেয়ে খারাপ কাটছে না। হাডসন যখন তাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার জন্যে ফোর্ট ফ্যারেলে নিয়ে আসে তখনই তার নামে কিছু সম্পত্তি লিখে দেয়। তার পরিমাণও খুব কম নয়। এছাড়াও, শীলার নামে কয়েক লাখ ডলার জমা ছিল ব্যাঙ্কে তার লেখাপড়ার খরচ চালাবার জন্যে।’

‘আচ্ছা, হাডসন তার সবকিছু শীলাকেও অর্ধেক দিয়ে যাবে একথা কি শীলা জানত?’

‘মনে হয় না,’ লংফেলো শেষ চুমুক দিয়ে গ্লাসটা নামিয়ে রাখল নিচু তেপয়ে। ‘মেয়েটা বেশিরভাগ সময়ই থাকত সুইটজারল্যাণ্ডে, এসব ব্যাপার তার জানার কথা নয়।’

‘ক্লিফোর্ড পরিবার যখন নিহত হয় শীলার বয়স তখন কত?’

‘ষোলো। বড়জোর সতেরো।’

খানিক চিন্তা করল রানা, তারপর জানতে চাইল, ‘তোমাদের সাপ্তাহিক পত্রিকাটির মালিক কে? প্রতিষ্ঠাতা যে হাডসন ক্লিফোর্ড তা আমি ওতেই ছাপা দেখেছি…’

‘সে সাত-আট বছর আগের কথা,’ বলল লংফেলো। ‘প্রায় বছর ছয় হলো, প্রতিষ্ঠাতার নাম ছাপা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পারকিনসনরাই এখন এটার মালিক।’

‘দুর্ঘটনার খবরটা কে লিখেছিল?’

‘সম্পাদক। কার্ল ডেটজার। পারকিনসনদের লাউডস্পীকার বলতে পারো লোকটাকে। গাফ পারকিনসন ডিক্টেট করেছিল, কলম ছুটিয়েছিল সে-ই।’

হাত বাড়িয়ে বোতল থেকে নিজের গ্লাসে হুইস্কি ঢালছে রানা। গোটা ব্যাপারটা আরেকবার ভেবে দেখছে। তারপর বলল, ‘একটা ব্যাপার আমার মাথায় ঢুকছে না। ক্লিফোর্ডদের নাম এভাবে মুছে ফেলল কেন পারকিনসনরা? ব্যাপারটা শুধু দৃষ্টিকটু নয়, রহস্যজনকও। কিছু যেন লুকাতে চাইছে এরা। কি হতে পারে সেটা, মিস্টার লংফেলো?’

‘আসল কথা পেড়েছ এতক্ষণে!’ বুড়োকে উত্তেজিত মনে হলো রানার। ‘এদের এই কাণ্ডকারখানা দেখেই তো সন্দেহ জেগেছে আমার। কিন্তু ক্লিফোর্ডদের নাম মুছে ফেলে কি যে এরা লুকাতে চায় তা আমি জানি না। তবে কিছু যে একটা গোপন করতে চায় সে ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই।’

‘ফোর্ট ফ্যারেলে এক জায়গায় অন্তত ক্লিফোর্ড নামটা আছে। এটা মোছেনি কেন এরা? শীলা ক্লিফোর্ডের ব্যাপারটা বোঝা যায়, তার নাম তো এরা চাইলেও বদলাতে পারে না। কিন্তু…’

‘তুমি ক্লিফোর্ড পার্কের কথা বলছ,’ বলল লংফেলো, ‘ভীষণ জেদী এক বুড়ি আছে ফোর্ট ফ্যারেলে, তার নাম মিসেস ফেরেট, সে হলো গিয়ে ফোর্ট ফ্যারেলের হিস্টোরিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট। পার্কটার নাম বদলে রাখার ব্যাপারে পারকিনসনদের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে ওই বুড়ি। আর শীলা ক্লিফোর্ডের ব্যাপারটা হলো, ওর নাম বদলে রাখারও সম্ভাব্য সব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পারকিনসনরা, বাপ বেটা দু‘জনেই এ ব্যাপারে সমান আগ্রহী-কিন্তু চিঁড়ে বোধহয় ভিজবে না, অন্তত এখন পর্যন্ত প্রস্তাবের উত্তরে মধুর হাসেনি শীলা।’

‘প্রস্তাব?’

‘হ্যাঁ। গাফের প্রস্তাব। বয়েড পারকিনসনের সাথে বিয়ে দিয়ে শীলার নাম বদলাতে চায় সে।’

‘গাফ পারকিনসন তাহলে বেঁচে আছেন?’

‘বহাল তবিয়তে কিনা জানি না, ভবে বেঁচে আছে। দুর্গ ছেড়ে বড় একটা বেরোয় না ইদানীং। না বেরোলে কি হবে, তারই তত্ত্বাবধানে পারকিনসন করপোরেশন পরিচালনা করছে বয়েড। বাপ-বেটার সম্পর্কটা খুব স্বচ্ছন্দ নয়। বয়েড়কে সামলাবার ক্ষমতা বুড়ো বাপের নেই। বড় উগ্র, বড় বেপরোয়া টাইপের ‘ছেলে এই বয়েড। যদিও, বাপের মত কূট বুদ্ধি তার আছে বলে মনে হয় না।’

‘পারকিনসন করপোরেশনে নাথান মিলারের ভূমিকাটা কি?’

‘নাথান গাফের লোক। ছেলেকে সামলেসুমলে রাখার দায়িত্ব দিয়েছে সে নাথানকে। কিন্তু বয়েড এ যুগের বেয়াড়া যুবক, অমন এক ডজন গাফ আর দুই ডজন নাথানকে নাকানিচোবানি খাওয়াতে পারে সে।’

‘শহরটা না হয় ওদের,’ বলল রানা, ‘কিন্তু আশপাশের সমস্ত জায়গা? কাঠ বা বাঁশের যে ব্যবসা এরা করছে সেগুলো জন্মাচ্ছে কার জায়গায়? আমার ধারণা ছিল বনভূমি কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, সবই ক্রাউন ল্যাণ্ড।’

‘ব্রিটিশ কলম্বিয়ার শতকরা পঁচানব্বই ভাগ জমিই ক্রাউন ল্যাণ্ড, রানা। মাত্র পাঁচ পার্সেন্ট, ধরো, সর্বসাকুল্যে সত্তর লক্ষ একর ব্যক্তিগত মালিকাধীনে রয়েছে। গাফ দশ লাখেরও কম একরের মালিক। কিন্তু হলে কি হবে, সে আরও বিশ লাখ একর জমি ভোগ দখল করছে। বছরে সে কাটছে ষাট লক্ষ কিউবিক ফিট কাঠ আর বাঁশ। এ ব্যাপারে সরকারের সাথে গোলযোগ তাঁর লেগেই আছে। রাজকীয় প্রশাসন চায় না তাদের জমির গাছপালা কেউ কাটুক। কিন্তু গাফ অত্যন্ত ধুরন্ধর চরিত্র, সে ঠিক জায়গা মত ভেট পাঠিয়ে বছরের পর বছর ক্রাউন ল্যাণ্ডের কাঠ আর বাঁশ কেটে লক্ষ লক্ষ ডলার রোজগার করে যাচ্ছে, সত্যিকার বিপদের মধ্যে পড়েনি আজও। এই অবস্থায় এরা নিজেদের হাইড্রোইলেকট্রিক প্ল্যান্ট বাস্তবায়িত করতে যাচ্ছে। এর ফলে কি হবে জানো? ফোর্ট, ফ্যারেল এবং চারদিকের একশো বর্গমাইলেরও বেশি জায়গা সরাসরি এদের দখলে চলে আসবে। সরকার চাইলেও তখন আর কাউকে এই এলাকায় কাঠ বা বাঁশের ব্যবসা করতে দিতে পারবে না। এই ব্যবসার কলকাঠি তখন পুরোপুরি চলে আসবে পারকিনসনদের হাতে। মোট কথা, এদের উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার। তা হলো, এই এলাকায় কোনরকম প্রতিদ্বন্দ্বিতা চায় না এরা। বিশাল এলাকা জুড়ে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করতে চায়।’

শেষ চুমুক দিয়ে গ্লাসটা নামিয়ে রাখল রানা। একটা সিগারেট ধরাল। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে লংফেলোর দিকে তাকাল সে। একটু তীক্ষ্ণ হলো ওর চোখের দৃষ্টি। ‘তুমি বলেছ, গোটা ব্যাপারটা সম্পর্কে তোমার ব্যক্তিগত কৌতূহল আছে। সেটা কি, বলো এবার। কেনেথের ব্যাপারেই বা তুমি এত আগ্রহ দেখিয়েছিলে কেন?’

রানার চোখে চোখ রেখে বুড়ো চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরেসুস্থে একটা চুরুট ধরাল সে। ভারি শোনাল তার কণ্ঠস্বর। ‘রানা, হাডসন ক্লিফোর্ড আমার বন্ধু ছিল। এই পত্রিকাটি ছিল তার, এবং সে আমাকে এখানে আনে। সামান্য দু‘পয়সা বেতনের একজন সাংবাদিক হলেও আমি যে তার ছেলেবেলার বন্ধু একথা কখনও সে ভোলেনি। প্রায়ই সে যেত আমাদের অফিসে, হুইস্কির বোতল আর হাভানা চুরুটের বাক্স নিয়ে। গল্প গুজব করত আমার সাথে। হঠাৎ যখন সে মারা গেল হাউ মাউ করে কেঁদেছিলাম আমি। ভেবেছিলাম ফোর্ট ফ্যারেলে ক্লিফোর্ডদের নাম চিরস্থায়ী করার জন্য যতটুকু করা সম্ভব করব। কিন্তু তার মৃত্যুর পর এক মাস কাটল না, পারকিনসনরা এক এক করে বদলাতে শুরু করল সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ড থেকে ক্লিফোর্ড শব্দটা বাদ পড়ল। দেখতে দেখতে একটিমাত্র জায়গা ছাড়া ওই শব্দটা থাকল না আর কোথাও। এসব দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম আমি।’

‘কিন্তু এমন একটা জঘন্য কাজের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করল না?’

‘কে করবে? কার বুকে এত সাহস আছে? ফোর্ট ফ্যারেলের লোকেরা জানে পারকিনসনরা যেমন ধনী তেমনি নির্মম। চলার পথে বাধা তারা সহ্য করে না। আমার কথা যদি বলো, আমি তখন ছিলাম ভীতুর ডিম, কাপুরুষ। দুর্ঘটনাটা যখন ঘটে তখন আমার বয়স পঁয়ষট্টি, শরীরে বা মনে এমন বলশক্তি ছিল না যাতে একা এদের বিরুদ্ধে লড়তে সাহস হয়। তাছাড়া, সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা ছিল চাকরি হারাবার। চাকরি গেলে খাব কি? ফোর্ট ফ্যারেলের বিধাতা এরাই, আর কোথাও কোন চাকরিও পাব না।’

‘কিন্তু আজ তুমি ওদের বিরুদ্ধে লাগার সাহস পাচ্ছ কোত্থেকে?’

‘সাহস পাচ্ছি এই ভেবে যে ক’দিনই বা আর বাঁচব। ঘনিয়ে এসেছে সময়, না হয় একটা অন্যায়ের প্রতিবিধান করতে গিয়ে সেটাকে আরও এগিয়ে আনব, তার বেশি কিছু তো নয়? তাছাড়া, চাকরি হারাবার ভয় আর আমি করি না, রানা। এই ক’বছরে বেশ কিছু টাকা সঞ্চয় করেছি, হঠাৎ অভাবে পড়ব সে ভয় নেই। আমি কাপুরুষ, তাই এতদিন সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করেছি। কিন্তু আর নয়। এই শেষ বয়সে এটাই আমার শেষ সুযোগ বন্ধুর জন্যে কিছু করার।’

‘কিন্তু কি করতে চাও তুমি? পারকিনসনদের বিরুদ্ধে তোমার অভিযোগটা কি?’

‘নির্দিষ্ট কোন অভিযোগ আমার নেই.’ বলল লংফেলো। ‘কয়েকটা ব্যাপারে সন্দেহ আছে আমার। এবং আমার বিশ্বাস, ভয়ঙ্কর ধরনের একটা অন্যায় করেছে পারকিন্‌সন সেজন্যেই তারা ক্লিফোর্ডের নাম মুছে ফেলেছে ফোর্ট ফ্যারেল থেকে। আমার এই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছে কেনেথকে খুন হতে দেখে।’

‘কেনেথ খুন হবার কারণ সম্পর্কে তোমার কি ধারণা?’

‘অ্যাক্সিডেন্টের সময় কেনেথ ছিল ক্লিফোর্ডদের নতুন ক্যাডিলাক গাড়িতে। এটুকুই সম্ভবর্ত অপরাধ। হয়তো এমন কিছু দেখেছিল সে যা প্রকাশ হয়ে পড়লে এত সাধের হজম করে ফেলা রাজত্ব তাসের ঘরের মত হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বার ভয় ছিল, তাই পারকিনসনরা তাকে খতম না করে পারেনি।

‘পারকিনসনরাই এই হত্যার জন্যে দায়ী মনে করো?’

‘কোন সন্দেহ নেই।’ কি যেন ভাবল লংফেলো। তারপর আবার বলল, ‘রানা, ওই দুর্ঘটনাটাকে আমি স্রেফ দুর্ঘটনা হিসেবে কখনই মেনে নিতে পারিনি। তবে আমার সন্দেহের পেছনে কোন তথ্য প্রমাণের ভিত্তি নেই। যাই হোক, কেনেথ বেঁচে আছে শুনে আমি এডমনটন হাসপাতালে তাকে দেখতে যাই। দুর্ঘটনাটা সম্পর্কে সে কিছু বলতে পারে কিনা জানার জন্যেই আমি গিয়েছিলাম। কিন্তু গিয়ে শুনলাম, কেনেথকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সাংবাদিক হয়েও কে পাঠিয়েছে, কোথায় পাঠিয়েছে—কোন খবরই আমি সংগ্রহ করতে পারিনি। ব্রিটিশ কলম্বিয়া এবং কানাডায় আমার অসংখ্য সাংবাদিক বন্ধু আছে। তাদের কাছে কেনেথের সংবাদ চেয়ে চিঠিও লিখেছিলাম। কোথাও থেকে কোন খবর পাইনি। তারপর হঠাৎ, মাস দু‘য়েক আগে, হঠাৎ কেনেথ স্বয়ং ফোর্ট ফ্যারেলে এসে হাজির। কিন্তু খবরটা যখন আমি পেলাম, কেনেথ তখন ফোর্ট ফ্যারেল ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু গুজবও কানে ঢুকল, তাকে নাকি ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে ফোর্ট ফ্যারেল থেকে। যাই হোক, এর হপ্তাখানেক পরই হঠাৎ খবরের কাগজে দেখলাম, আলবার্ট কেনেথ নামে এক যুবক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। কেনেথ নামটা দেখে সন্দেহ হলো আমার। দেরি না করে অমনি ছুটলাম…।’

রানা বলল, ‘কেনেথের সাথে কথা বলে আমি যা বুঝেছি, দুর্ঘটনার কথা ওর কিছুই মনে ছিল না। স্মৃতিশক্তি পুরোপুরি লোপ পেয়েছিল তার। আমি ভাবছি, পারকিনসনদের তাকে ভয় করার কি ছিল? যে কিছুই স্মরণ করতে পারত না…’

‘পারত না, কিন্তু যদি স্মৃতিশক্তি ফিরে আস তার?’

‘হুঁ’ বলল রানা, ‘আর একটা রহস্য হলো, কেনেথ ফোর্ট ফ্যারেলের মানুষ নয়, সম্ভবত দুর্ঘটনার আগে জীবনে কোনদিন এখানে সে আসেওনি, অথচ প্রথমবার এসে ফোর্ট ফ্যারেলের অনেক জায়গা, এমন কি মানুষজনের মুখও তার চেনা চেনা লাগে। এ কেমন ব্যাপার?’

‘কি বলছ তুমি!’ চোখ কপালে উঠে গেল লংফেলোর।

‘কেনেথ নিজে আমাকে বলেছে। পুরোপুরি চিনতে পারেনি সে কিছুই, কিন্তু সবই কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকেছিল তার। কেন?’

খানিকক্ষণ কোন কথা নেই দু‘জনের মুখে। তারপর লংফেলোর একটা দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেল রানা।

‘কি জানো, এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো আমরা আর কোনদিনই পার না, রানা।’

‘কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর আমাকে পেতেই হবে, লংফেলো,’ হঠাৎ উঠে দাঁড়াল রানা। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ ওর। পায়চারি শুরু করল মেঝেতে। ‘জীবনে সবচেয়ে বেশি ভালবাসি আমি কি জানো?’

‘কি?’ ধূসর ভুরু বলিরেখায় ভর্তি কপালে তুলে প্রশ্নটা করল লংফেলো।

‘রহস্য! তোমাদের ফোর্ট ফ্যারেলের যে কাহিনী আমি শুনলাম তার মধ্যে সবচেয়ে রহস্যময় লাগছে আমার কেনেথের খুন হবার ব্যাপারটা। কেন চেনা চেনা লেগেছিল তার ফোর্ট ফ্যারেল? কেন?’ হঠাৎ বদলে গেল রানার কণ্ঠস্বর, প্রতিজ্ঞার ছাপ ফুটে উঠল তাতে। ‘এই রহস্য আমি ভেদ করব, মিস্টার লংফেলো।

চকচক করছে বৃদ্ধের চোখ জোড়া। অবাক, সেই সাথে প্রশংসার দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রানার দিকে। ‘তুমি পারবে, রানা,’ বিড়বিড় করে উঠল সে। ‘পারবে তুমি!’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *