গ্রাস – ৪

চার

পারকিনসন হাউজের নিচতলার বারে বসে, পর পর দুই ক্যান বিয়ার খেতে মাত্র বিশ মিনিট লাগল রানার। সন্ধ্যা হতে এখনও আড়াই ঘণ্টা দেরি। সময়টা অপব্যয় করার কোন ইচ্ছে নেই ওর। পরিচয়, বিশ্বাস অর্জন, ইত্যাদি প্রাথমিক ঝামেলাগুলো না থাকলে বারে উপস্থিত সুন্দরীদের একটাকে বেছে নিয়ে বেরিয়ে পড়া যেত, ভাবছে ও। হঠাৎ মনস্থির করে উঠে দাড়াল ও। একটা জায়গায় খোঁচা মেরে দেখা যাক কি রকম প্রতিক্রিয়া হয়, ভাবতে ভাবতে চারতলায় নিজের স্যুটে গিয়ে ঢুকল।

এক মিনিট পর বেরিয়ে এল রানা। কাঁধে ঝুলছে একটা ক্যামেরা।

নিচে নেমে রিসেপশনে থামল রানা। স্মার্ট চেহারার রিসেপশনিস্টকে প্রশ্ন করল, ‘স্থানীয় গোরস্থানটা শহর থেকে কতদূরে বলতে পারো?’

‘মাইল তিনেক দূরে, স্যার,’ বলল রিসেপশনিস্ট। ‘পারকিনসন অটোমোবাইলে যান, রেন্ট-এ-কার পাবেন ওখানে। কিন্তু গোরস্থানে কেন যাবেন, স্যার? কোন বন্ধুর কবর…’

‘বন্ধুর না,’ বলল রানা, ‘এই শহরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতার কবরে ফুল দিতে যাব। কাজটা নিশ্চয়ই উচিত হবে, কি বলো?’

‘একশোবার উচিত হবে, স্যার,’ রিসেপশনিস্ট গদগদ হয়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই উচিত হবে। কিন্তু আপনি ঠিক কার কথা বলছেন, স্যার?’

চোখ কুঁচকে তাকাল রানা। ‘এই শহরের সবাই কি তোমার মত অকৃতজ্ঞ?’ কথাটা বলে আর দাঁড়াল না ও। বোকার মত অবাক হয়ে ওর গমন পথের দিকে চেয়ে থাকল রিসেপশনিস্ট। তার অপরাধটা কোথায় হলো বুঝতেই পারেনি সে।

চৌরাস্তায় পৌঁছে বড় আকারের একটা গ্যারেজ দেখল রানা। সাইনবোর্ডে পারকিনসন নয়, জ্যাক অটো ডিলার লেখা রয়েছ দেখে অবাক হলেও সেদিকেই এগোল ও।

‘চার পাঁচজন মেকানিক কাজ করছে গ্যারেজে। নতুন পুরানো মিলিয়ে পনেরো বিশটা নানান ধরনের গাড়ি রয়েছে। ভিতরে ঢুকে বলল রানা, ‘গাড়ি ভাড়া দাও তোমরা?’

‘ফোর্ট ফ্যারেলে নতুন বুঝি?’ গরিলার মত বিশাল বুকের অধিকারী এক লোক বেরিয়ে এল যেন মাটি ফুঁড়ে। নিজেকে ছোট্ট লাগল রানার লোকটার তুলনায়। একটা মাইক্রোবাসের নিচে শুয়ে কাজ করছিল সে। রানার প্রশ্ন শুনে বেরিয়ে এসেছে। ‘আমি জ্যাক লেমন, এই গ্যারেজের মালিক। কি গাড়ি চাই তোমার, মিস্টার?’

‘যে-কোন একটা গাড়ি হলেই চবে,’ বলল রানা। ‘ঘণ্টা দেড়েকের জন্যে মাত্র।’

‘কোথায় যাবে জানলে..’. হাত কচলাতে শুরু করল।

‘কোথায় যাব না যাব তা দিয়ে তোমার কি দরকার?’ লোকটাকে বিনয়ের অবতার বলে মনে হতে ধমক লাগাল রানা।

রাগতে জানে না। হাসিটা এতটুকু ম্লান হলো না তার। ‘দরকার না থাকলে জানতে চাই? ধরো যদি দক্ষিণে যাও তাহলে তোমাকে গাড়ি দিতে পারব না আমি। দিলে সেটাকে তুমি চিঁড়ে চ্যাপ্টা করে নিয়ে আসবে। আর যদি উত্তরে যাও, মাইক্রোবাস দিতে আপত্তি করব না। কিন্তু যদি পুবে যাও, জীপ দেবার আগে ও ভেবে দেখতে হবে আমাকে…’

‘পুবেই যাব। গোরস্থানে।’

‘নিশ্চয়ই মৃতদের তালিকায় নাম লেখাতে নয়?’ রানার মুখে কাঠিন্য ফুটছে দেখে তাড়াতাড়ি বলল, ‘পুবে বটে, কিন্তু এত কাছে যে আমাদের প্রায়-নতুন টয়োটাই তোমার হাতে ছেড়ে দিতে পারি। রাস্তাটা গোরস্থানের এদিক পর্যন্ত ভালই, প্রশান্ত মহাসাগরের মত। ঘণ্টা প্রতি পাঁচ ডলার লাগবে।’ খাতা খুলল জ্যাক লেমন। চটপট ঠিকানাটাও বলে ফেলো দেখি।’ হাতঘড়ি দেখে আঁতকে উঠল সে। ‘এই সেরেছে রে! দেড় মিনিট দেরি হয়ে গেছে! জ্যাকির মা আজ আমাকে আস্ত রাখবে না।’ হঠাৎ রানার দিকে মুখ তুলল। শিশুর মত হাসল সে দাঁত বের করে। ‘আমি আবার ঘড়ি দেখে সব করি কিনা। রোজ এই সময়টা আমার স্ত্রীকে একটা চুমো খেতে যাই। ঘড়ির অভ্যাসটা ওই ধরিয়েছে কিনা, তাই এদিকওদিক হলে… হেঃ হেঃ…’

‘পারকিনসন হাউজ, থার্ড ফ্লোর, বত্রিশ নম্বর স্যুইট।’

‘ওহ্! তুমিই তাহলে পারকিনসনের নতুন কর্মচারী? জিওলজিস্ট।’

লোকটার কণ্ঠস্বরে ব্যঙ্গের ছোঁয়া রয়েছে ধরতে পারল রানা। গায়ে মাখল না ব্যাপারটা।’ তুমি জানলে কিভাবে?’

‘ফোর্ট ফ্যারেল খুব ছোট্ট শহর, মিস্টার। তাছাড়া আমি বিশেষ করে পারকিনসনদের কাণ্ডকারখানা একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করি। দাঁড়াও, গাড়িটায় তেল আছে কিনা দেখে দিই তোমাকে।’

সত্যি কথাই বলেছে জ্যাক, গাড়িটাকে প্রায় নতুনই বলা চলে। সুপারমার্কেট থেকে ফুল কিনে নিয়ে গোরস্থানের দিকে যাচ্ছে রানা। পাহাড়ী পথ ধরে সাবলীল গতিতে ছুটে চলেছে গাড়িটা। ফোর্ট ফ্যারেল, ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে গাড়িটা উপরে ওঠার সাথে সাথে। ভিউ মিররে একটা মোটরসাইকেলকে দেখল রানা। একশো গজের মত পিছনে। রোদ লেগে চকচক করে উঠল একবার হলুদ হেলমেটটা।

মূল রাস্তা থেকে ডান দিকে বাঁক নিতেই দেখা গেল গোরস্থানটাকে। পাঁচ ফুট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। গেটের কাছে গুমটিঘরের মত দুটো ঘর। ঘর দুটোর সামনেই গাড়ি থার্মাল রানা। ফুলের তোড়া দুটো নিয়ে নামল। নামার আগেই দেখল কাদা মাখা ড্রেনপাইপ প্যান্ট পরে একজন লোক ঘুমাচ্ছে একটা ঘরে।

লম্বায় একশো গজের মত হবে গোরস্থানটা, চওড়ায় পঞ্চাশ গজ। হাঁটু—কোথাও কোথাও কোমর সমান উঁচু ঘাস জন্মেছে সরু পথের দু‘ধারে। কবরের উপর মর্মরমূর্তি, পাকা বেদী ইত্যাদি দেখা যাচ্ছে। মৃতদের নাম, আবির্ভাব এবং তিরোধানের তারিখ পড়তে পড়তে এগোচ্ছে রানা। এসব তথ্য খোদাই করা হয়েছে সিমেন্টের প্লাস্টারের গায়ে। কোন কোন কবরের উপর শ্বেতপাথরের খুদে মিনার ও দেখল রানা। কালো রঙ দিয়ে লেখা রয়েছে তথ্য এবং শোকবাণী।

চারদিক নির্জন আর নিঝুম। হু-হু বাতাসে ঘাসগুলো নুয়ে নুয়ে পড়ছে। গোরস্থানে এলে কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে ওঠে রানার মন। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটল না।

একটা ব্যাপার লক্ষ করে মনটা দমে গেল ওর। কোন কোন কবরের গায়ে মৃত ব্যক্তির নাম, জন্ম ও মৃত্যু তারিখ বা শোকবাণী—কিছুই লেখা নেই। ক্লিফোর্ড পরিবারের কবরগুলোর গায়ে কিছু লেখা আছে তো?

তাঁদের কবরে কিছু লেখার মত লোক ফোর্ট ফ্যারেলে ছিল কিনা সেটা একটা সন্দেহের ব্যাপার। লেখা যদি না হয়ে থাকে, কবরগুলো চিনতে পারবে না রানা। অবশ্য যেজন্যে এখানে আসা সে উদ্দেশ্য ঠিকই সিদ্ধ হবে।

‘ভাবছে রানা। ফোর্ট ফ্যারেলের কিছু লোক নিশ্চয়ই জানে কোন্ কবরগুলো ক্লিফোর্ড পরিবারের। তাদের কাছ থেকে জেনে নেয়া কঠিন কিছু হবে না। তার মানে, চেনার জন্যে আর একদিন আসতে হবে হয়তো ওকে।

হঠাৎ একটা কবরের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল রানা। কবরটার কোন বৈশিষ্ট্য ওকে আকৃষ্ট করেনি, দাঁড়াবার কারণ চোখের কোণ দিয়ে কিছু নড়তে দেখেছে ও। আড়চোখে গোরস্থানের গেটের দিকটা দেখে নিল। ওর ওপর নজর রাখা হচ্ছে বুঝতে পেরে গম্ভীর হয়ে উঠল মুখের চেহারা।

গোরস্থানটা দু‘ভাগে বিভক্ত। সামনের অংশের প্রায় সবগুলো কবর শ্বেতপাথর দিয়ে বাঁধানো। দ্বিতীয় অংশের কবরগুলো সাদামাঠা, কোনটাই পাকা বা বাঁধানো নয়। মুচকি হাসল রানা-মরেও বড়লোক রয়েছে ওদিকের লাশগুলো!

প্রথম অংশের সমস্ত কবর দেখা শেষ হতে কঠোর হয়ে উঠল রানার মুখ। অভিজাতদের সবগুলো কবর দেখেছে সে। ক্লিফোর্ড পরিবারের কারও কবরই চোখে পড়েনি।

নেই নাকি? এইখানে কবর দেয়া হয়নি ওদের?

না, তা হতে পারে না। ভাবল রানা। সাদামাঠা ভাবে ক্লিফোর্ড পরিবারের সদস্যদের মাটি চাপা দিলে সেটা একটা বিস্ময়ের সৃষ্টি করত। শত্রু যেই হোক, তার উদ্দেশ্য যাই হোক, এতবড় ভুল করার কথা নয় তাঁর। কবর অভিজাত এলাকাতেই দেয়া হয়েছে, কিন্তু কবরের গায়ে কিছু লেখার ব্যবস্থা করা হয়নি। উদ্দেশ্য?

উদ্দেশ্য ক্লিফোর্ড-পরিবারের নাম মুছে ফেলা। কেউ যাতে নামটা দেখে কৌতূহলী হবার সুযোগ না পায়।

দ্বিতীয় অংশটাও দেখা শেষ করল রানা। ফেরার পথে অনেক কথা ভাবছে। পাঁচ হাত সামনে হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল দু‘জন লোক। দাঁড়িয়ে পড়ল রানা।

দু‘জনেরই গায়ে কিছু নেই। একজনের পরনে ড্রেনপাইপ প্যান্ট। তাতে শুকনো কাদা লেগে রয়েছে। তার হাতে ঘাস কাটার ধারাল একটা কাস্তে। দ্বিতীয় লোকটাকে দেখে বুঝল রানা, ছদ্মবেশী। এ লোঁকের পেশা ঘাস কাটা নয়।

ট্রাউজারটা নতুন। ধুলোকাদা কিছুই নেই। কপালে আর কানের পিছনের চামড়ায় দাগটাও লক্ষ করল রানা। এইমাত্র হেলমেটটা খুলে রেখে ঢুকেছে গোরস্থানে। নিঃশব্দে চেয়ে আছে দু‘জন রানার দিকে।

‘কি করছ তোমরা?’ জানতে চাইল রানা।

‘ঘাস কাটছিলাম। তুমি কে হে?’ গভীর একটা শুকনো ক্ষতচিহ্ন লোকটার চোখের নিচ থেকে ঠোঁটের প্রান্ত পর্যন্ত নেমে এসেছে। কাস্তেটাকে এমন ভঙ্গিতে ধরে আছে, যেন প্রথম সুযোগেই আক্রমণ করে বসবে। ব্যাপারটা পছন্দ করতে পারল না রানা। এক এক করে দু‘পা সামনে বাড়ল ও।

‘আমি কে তা জেনে তোমাদের কি দরকার?’ বলল রানা। ‘ঘাস কাটতে হলে ঘাসের ভিতর লুকাতে হয় নাকি? কি করছিলে তোমরা? কে পাঠিয়েছে তোমাদের?’

‘ঘাস কাটি আমরা। কাটতে কাটতে ক্লান্ত হয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। কেউ পাঠায়নি আমাদের।’

মিথ্যে কথা বলছে।

‘কাটা ঘাসগুলো দেখাতে পারবে না আমাকে, আমি জানি,’ নিরস্ত্র লোকটার চোখে চোখ রেখে বলল রানা, ‘যেই তোমাকে পাঠাক। সে একটা বুদ্ধ। লোক বাছতে জানে না সে। তুমি এসব কাজে এখনও খোকা, বুঝলে? মোটরসাইকেল নিয়ে পিছু পিছু আসার সময়ই ধরা পড়ে গেছ।’

বোকার মত চেয়ে রইল লোকটা রানার দিকে। কোথাও কিছু নেই, দুম করে একটা ঘুসি মেরে বসল রানা লোকটার নাকের উপর। দু‘হাতে নাক চেপে ধরে লাফাতে শুরু করল লোকটা। আঙুলের ফাঁক দিয়ে দু‘তিনটে ধারা বেরিয়ে এল রক্তের।

মাথার উপর কাস্তে তুলে এক পা এগোল ড্রেনপাইপ। ডান হাত মুঠো করে তারও নাকের দিকে ঘুসি মারার ভঙ্গি করণ রানা। লোকটা নাক বাঁচাবার জন্যে ড. হাতটা মুখের সামনে তুলতেই তার বগলের নিচে বাঁ হাতের ঘুসি বসিয়ে দিল রানা। ছিটকুে লম্বা ঘাসের ভিতর পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল ড্রেনপাইপ।

প্রথম লোকটা, তখনও লম্ফ দিচ্ছে দেখে একপায়ে দাঁড়িয়ে চরকির মত একটা পাক খেল রানা, দ্বিতীয় পা-টা থপাস করে লাগল লোকটার নিতম্বে। লাফ-ঝাঁপ বন্ধ হলো সাথে সাথে। এক পা এগিয়ে ডান হাত দিয়ে তার কণ্ঠনালীটা আঁকড়ে ধরল রানা। ‘বল কে পাঠিয়েছে?’

ঢোক গিলতে গিয়ে আটকাচ্ছে দেখে দু‘চোখে আতঙ্ক ফুটে উঠল লোকটার। আরও একটু চাপ বাড়াল রানা। গাঁ-গাঁ করে আওয়াজ বেরিয়ে এল লোকটার গলার ভিতর থেকে।

‘যেই পাঠিয়ে থাকুক, তাকে বলিস, আমি সব জানি,’ বলল রানা। ‘মনে থাকবে তো?’

দ্রুত মাথা ঝাঁকাল লোকটা। তীব্র একটা ঝাঁকুনির পরপরই ধাক্কা দিয়ে মাটির উপর ফেলে দিল রানা তাকে। দ্বিতীয়বার আর সেদিকে তাকাল না। দৃঢ় পায়ে হাঁটা ধরল গেটের দিকে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *