গ্রাস – ৩

তিন

সাইনবোর্ডগুলো একঘেয়ে। পারকিনসন কেমিক্যাল কোম্পানি, পারকিনসন ব্যাঙ্ক, পারকিনসন অটোমোবাইল শো-রূম, তারপর পারকিনসন হাউজ, হোটেল অ্যাণ্ড বার। খাওয়া এবং লাঞ্চ সারতে মাত্র বিশ মিনিট নিল রানা। নিচে এসে পাকড়াও করল রিসেপশনিস্ট মেয়েটাকে। ‘তোমাদের এখানে নিউজপেপার আছে?’

‘সাপ্তাহিক। প্রতি শুক্রবারে বেরোয়।’ রানার সুঠাম শরীরের নিচে থেকে উপর পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নিল মেয়েটা। বয়স আঠারো উনিশের বেশি হবে বলে মনে হলো না রানার। তার প্রশ্ন শুনে বুঝতে পারল, পুরুষ ঘায়েল করার কৌশল রপ্ত করছে সে। ‘খবরের কাগজের কথা জানতে চাইছ কেন? আমাদের শহরে বার, সিনেমা হলও আছে।’

মুচকি হেসে রানা বলল, ‘বউকে সাথে আনিনি, কিন্তু সন্দেহ করছি তার চর লক্ষ্য রাখছে আমার ওপর,’ অসহায় ভাবে কাঁধ ঝাঁকাল রানা, ‘অফিসটা কোনদিকে?’

অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ঝাঁঝের সাথে মেয়েটি বলল, ‘ক্লিফোর্ড পার্কের উত্তরে।’

উইকলি ফোর্ট ফ্যারেলের অফিসটা খুঁজে বের করতে অসুবিধে হলো না রানার। ছোট একতলা একটা বিল্ডিং, তিন চারটে কামরা, মান্ধাতা আমলের একটা ট্রেডল মেশিন, দুটো কম্পোজ কেস—এই নিয়ে উইকলি ফোর্ট ফ্যারেল। প্রতিষ্ঠানের চেয়ে সাইনবোর্ডটাকে বড় বলে মনে হলো রানার, এতই লম্বা, বিল্ডিংটার দু‘প্রান্ত ছুঁয়ে আছে। ভিতরে ঢুকে একটা বিশ বাইশ বছরের মেয়ে ছাড়া কাউকে দেখল না ও।

রানার প্রশ্নের উত্তরে মেয়েটি জানাল, সেই একমাত্র ক্লারিক্যাল স্টাফ। বলল, ‘পুরানো কপি অবশ্যই রাখি আমরা। কতদিনের পুরানো কপি দরকার আপনার?’

‘এই ধরো, আট বছর আগের।’,

চিন্তায় পড়ে গেল মেয়েটা। তার মানে বস্তার প্যাকেটগুলো থেকে খুঁজে বের করতে হবে। ‘পিছনের অফিসে যেতে হবে আপনাকে।’ মেয়েটার পিছু পিছু ধুলো-ময়লা ভর্তি একটা কামরায় ঢুকল রানা। ‘নির্দিষ্ট কোন্ তারিখের কপি চান আপনি?’

কেনেথের কণ্ঠস্বরটা পরিষ্কার কানে বাজল রানার, ‘বুধবার, সেপ্টেম্বরের চার তারিখ, উনিশশো সত্তর সাল—আমার জন্মদিন।

‘চৌঠা সেপ্টেম্বর, উনিশশো সত্তর,’ মেয়েটাকে বলল রানা।

মাচার উপর পাশাপাশি দাঁড় করানো চটের বস্তাগুলোর গায়ে লাল কালি দিয়ে তারিখ লেখা। সেদিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলল, ‘ডান পাশের সবশেষের বস্তাটায় আছে…।’

‘আমি নামিয়ে আনছি ওটা,’ একধার থেকে মইটা তুলে এনে মাচার গায়ে লাগাল রানা। ধাপ ক’টা বেয়ে উঠে গেল উপরে।

নিচে থেকে বস্তাটা নিল মেয়েটা রানার হাত থেকে। ‘কপি কিন্তু আপনি নিয়ে যেতে পারবেন না। এখানে বসেই পড়তে হবে।’

নিচে নেমে বস্তার মুখ খুলতে শুরু করে রানা বলল, ‘আলোটা জ্বেলে দেবে?’ সুইচ টিপে আলো জ্বালল মেয়েটা। বস্তা থেকে কয়েকটা প্যাকেট বের করল রানা। নির্দিষ্ট একটা প্যাকেট বেছে নিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসল। প্রতি প্যাকেটে চার মাসের পত্রিকা আছে, প্রতি সংখ্যা দশ কপি করে। সংখ্যার এত আধিক্য দেখে রানার মনে হলো বিক্রি বা বিলির চেয়ে অনেক বেশি ছাপা হয় সাপ্তাহিকটা।

‘আমি তাহলে বাইরের অফিসে বসে কাজ করি?’

অন্যমনস্কভাবে মাথা ঝাঁকাল রানা। মেয়েটা বেরিয়ে গেল কামরা থেকে। সেপ্টেম্বরের সাত তারিখের পত্রিকাটা খুঁজে নিল রানা। এর আগের সংখ্যাটা বেরিয়েছে এক তারিখে।

প্রথম পৃষ্ঠাতেই খবরটা ছাপা দেখল রানা। হেডলাইন: সড়ক দুর্ঘটনায় হাডসন ক্লিফোর্ড নিহত।

হেডলাইনের নিচে খবরটা ছাপা হয়েছে। পড়তে শুরু করল রানা।

‘হাডসন ক্লিফোর্ড, ৫৬, স্ত্রী ডায়না (বয়স জানা সম্ভব হয়নি), এবং তাঁর পুত্র টমাসকে (বয়স বাইশ) নিয়ে ডসন ক্রীক থেকে এডমনটনে যাচ্ছিলেন। তাঁরা মি. হাডসনের নতুন ক্যাডিলাকে ভ্রমণ করছিলেন। কিন্তু, অত্যন্ত দুঃখের সাথে আমাদের সংবাদদাতা জানাচ্ছেন যে গাড়িটা এডমনটনে পৌঁছুবার আগেই পাহাড়ী রাস্তা থেকে দুশো ফিট নিচের খাদে গড়িয়ে পড়ে। চাকার সাথে রাস্তার ঘষা খাওয়ার দাগ এবং গাছের ছাল ওঠা দেখে বোঝা যায় দুর্ঘটনাটা কিভাবে ঘটেছিল। ‘সম্ভবত, ’ আমাদের সংবাদদাতাকে পুলিস সার্জেন্ট জানান, ‘গাড়িটা অস্বাভাবিক দ্রুতবেগে ছুটছিল, কিংবা, এমনও হতে পারে, নতুন গাড়ি হলেও, ব্রেক কাজ করছে না দেখে গাড়ির চালক নার্ভাস হয়ে পড়েছিলেন। আমার ধারণা, সত্যি কি ঘটেছিল তা আমরা কোনদিনই জানতে পারব না।’

এরপরও দীর্ঘ দু‘কলাম জুড়ে খবরটা পরিবেশন করা হয়েছে। খাদে পড়ার পর ক্যাডিলাকে আগুন ধরে যায়। ক্লিফোর্ড পরিবারের তিনজনই মারা যায় সেইসাথে। গাড়িতে চতুর্থ একজন আরোহীর উপস্থিতি সম্পর্কে বলা হয়েছে খবরে।

চার নম্বর আরোহীর বয়স অল্প, বিশ বাইশের বেশি হবে না। তার পরিচয় উদ্ধার করা গেছে। নাম আলবার্ট কেনেথ।

আলবার্ট কেনেথকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। জীবিত হলেও স্থানীয় ডাক্তারের মতে তার বাঁচবার কোন আশা নেই। শরীরের এক ইঞ্চি জায়গাও অক্ষত অবস্থায় নেই তার। মাথার খুলি তো কয়েক টুকরো হয়েছেই, গোটা শরীর পুড়ে গেছে তার। এই পত্রিকা যখন ছাপা হচ্ছে, শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, সিটি হাসপাতালের ডাক্তাররা তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছেন। মি. কেনেথ, ধারণা করা হচ্ছে, নিশ্চয়ই ডসন ক্রীক এবং দুর্ঘটনার মধ্যবর্তী কোন জায়গা থেকে গাড়িতে লিফট নিয়েছিলেন।

ফোর্ট ফ্যারেল তথা সমগ্র ব্রিটিশ কলম্বিয়া মি. ক্লিফোর্ডের মৃত্যুর সাথে সাথে যে যুগের অবসান ঘটল তার জন্যে গভীর শোকে আপ্লুত না হয়ে পারবে না। লেফটেন্যান্ট ফ্যারেলের বীরত্বমাখা দিনগুলোর সময় থেকে এই শহরের সঙ্গে ক্লিফোর্ড পরিবারের যোগাযোগ। আজ এটা খুবই মর্মান্তিক দুঃখের বিষয় (বিশেষ করে লেখকের জন্যে) যে এমন একটি বিখ্যাত পরিবার সমূলে ধ্বংস হয়ে গেল। তবে যাই হোক, মি. ক্লিফোর্ডের এক পালিতা কন্যা, মিস এস ক্লিফোর্ড সুইটজারল্যাণ্ডে লেখাপড়া করছেন। বিশ্বস্ত সূত্রে প্রকাশ; মি. ক্লিফোর্ডের সাথে রক্তের কোন সম্পর্ক এই পোষ্য কন্যার না থাকলেও তিনি মেয়েটিকে লেখাপড়া শিখিয়ে আদর্শ নারী হিসেবে সমাজে দাঁড় করাবার ইচ্ছা পোষণ করতেন। সেজন্যে আমরা আশা করব, এই মর্মান্তিক দুঃসংবাদ যেন মিস ক্লিফোর্ডের লেখাপড়ায় কোনরকম বিঘ্ন সৃষ্টি না করে।

সংবাদদাতা আরও জানিয়েছেন, মি. ক্লিফোর্ডের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু এবং ব্যবসার অংশীদার মি. পারকিনসন এই দুর্ঘটনার সংবাদে ভীষণ ভাবে মুষড়ে পড়েছেন। মি. পারকিনসনের তত্ত্বাবধানে গত পরশু স্থানীয় গোরস্থানে নিহতদের দাফন কার্য সমাধা হয়।

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল রানা। একটা সিগারেট ধরাল। ক্লিফোর্ড তাহলে পারকিনসনের বিজনেস পার্টনার ছিলেন, ভাবছে ও, কিন্তু এ কোন্ পারকিনসন? নিশ্চয়ই যে বাঁধ তৈরি করতে চাইছে সে নয়। আজ থেকে আট বছর আগে এর বয়স ছিল বিশ-বাইশ, মি. ক্লিফোর্ডের ছেলে টমাসের সমবয়েসী। মি. ক্লিফোর্ড নিশ্চয়ই ছেলের বয়েসী কারও সাথে ব্যবসা করতেন না। তার মানে, নিশ্চয়ই একজন বুড়ো পারকিনসন আছে। লোকটা নিশ্চয়ই বয়েড পারকিনসনের বাবা।

মিনিট দুই পর পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যাটার ভাঁজ খুলে চোখের সামনে মেলল রানা।

অবিশ্বাস্য! পরের হপ্তায় কাগজে দুর্ঘটনা বা ক্লিফোর্ড পরিবার সম্পর্কে কোন খবর নেই। তাড়াতাড়ি তার পরের হপ্তার কাগজটাও দেখল। নেই কিছু। একটা লাইনও না।

গুম মেরে গেল রানা। কপালে চিন্তার রেখা। ব্যাপার কি? এতবড় একজন মানুষ, এমন বিখ্যাত একটা পরিবার, ষাঁদের প্রত্যক্ষ অবদান রয়েছে এই শহরটাকে গড়ে তোলার পিছনে—রাতারাতি মানুষ ভুলে গেল তাদের কথা? কেন?

পরবর্তী বছরের সেপ্টেম্বর মাসের সব ক’টা পত্রিকা এক এক করে দেখল রানা। স্তম্ভিত হয়ে গেল ও। মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষেও পত্রিকায় কিছু লেখা হয়নি ৷ নামটা পর্যন্ত ছাপা নেই কোথাও। অদ্ভুত লাগল ব্যাপারটা রানার। পত্রিকার এই আচরণ দেখে সন্দেহ হয় হাডসন ক্লিফোর্ড নামে কোন লোক যেন ফোর্ট ফ্যারেলে ছিলেনই না, তাঁর অস্তিত্ব সম্পর্কে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ যেন সম্পূৰ্ণ অজ্ঞ!

আবার পত্রিকাগুলো ঘেঁটে দেখল রানা। না, দেখতে ভুল হয়নি ওর। ক্লিফোর্ড শব্দটা কোথাও আর মুদ্রিত হয়নি।

এর নাম পত্রিকা? ভাবছে রানা। হঠাৎ একটা সন্দেহের উদয় হলো মনে। এর মালিক কে?

দরজার ফাঁক দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে উঁকি দিল মেয়েটা। ‘এবার আপনাকে যেতে হবে। অফিস বন্ধ করে দিচ্ছি।’

হাসল রানা। ‘পত্রিকা অফিস কখনও বন্ধ হয় বলে তো শুনিনি।’

‘এটা ভ্যানকুভার সান,’ বলল মেয়েটা, ‘বা মন্ট্রিয়ল স্টার নয়।’

‘এটা আদৌ কোন পত্রিকা কিনা সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে,’ ব্যঙ্গের সুরে বলল রানা।

‘যা খুঁজছিলেন পাননি বুঝি?’

মেয়েটার পিছু পিছু সামনের অফিস কামরায় ফিরে এল রানা। ‘কয়েকটা উত্তর আর অসংখ্য প্রশ্ন পেয়েছি,’ বলল ও। ‘সবচেয়ে কাছের কফি শপটা এখান থেকে কত দূরে বলতে পারো?’

‘চৌরাস্তায় গেলেই সাইনবোর্ডটা দেখতে পাবেন: গ্রীক কফি হাউজ।’

‘মুশকিল হলো,’ মৃদু হাসির সাথে বলল রানা, ‘আমি আবার সঙ্গী ছাড়া কফি খেতে পারি না।’ মেয়েটার সাথে কথা বলে কিছু তথ্য পাওয়া যাবে কিনা ভাবছে রানা!

‘মা নিষেধ করে দিয়েছে, অপরিচিত কারও সাথে যেন বাইরে কোথাও না যাই। তাছাড়া, আমার বয়ফ্রেণ্ডের আসার সময় হয়ে গেছে।’

‘তাহলে অন্য কোনদিন,’ বলে বেরিয়ে এল রানা বাইরে।

‘গ্রীক কফি হাউজটা ক্লিফোর্ড পার্কের পুব দিকে। স্বল্প পরিসর, কিন্তু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। একজনই ওয়েটার। রানাকে কফি দিয়ে তার কোনার চেয়ারটায় ফিরে গিয়ে চোখ বুজল সে, কাউন্টারে বসা লোকটার অনুকরণে ঘুমিয়েও পড়ল সম্ভবত। মাত্র চুমুক দিয়েছে রানা কাপে, এমন সময় পায়ের আওয়াজ পেয়ে মুখ তুলল ও।

আরে! খুঁজতে হলো না। নিজেই এসে হাজির। বুড়োকে দেখে চিনতে পেরে ভাবল রান্না। ওকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে বুড়ো প্রবেশ পথের কাছে। নাকের ডগায় নেমে এসেছে চশমা, ফ্রেমের উপর দিয়ে স্থির চোখে চেয়ে আছে রানার দিকে।

‘মি. লংফেলো!’

নড়ল না বুড়ো। দাঁড়াবার আর তাকিয়ে থাকার ভঙ্গিতে একটা কাঠিন্য রয়েছে টের পেল রানা। ভাবের কোন পরিবর্তন হলো না চোখেমুখে। রানার কথা যেন শুনতেই পায়নি। কাঁধ ঝাঁকিয়ে শ্রাগ করল বুড়ো। তারপর এগিয়ে আসতে শুরু করল। টেবিলের সামনে রানার মুখোমুখি এসে থামল সে।

‘বসো, মি. লংফেলো,’ বলল রানা, ‘আমাকে চিনতে পারো?’

‘কেন এসেছ ফোর্ট ফ্যারেলে?’ টেবিলে দু‘হাত রেখে রানার মুখের দিকে ঝুঁকে পড়ল বৃদ্ধ! ‘কি চাও তুমি?’

‘উঁহু,’ এদিক ওদিক মাথা নাড়ল রানা, ‘প্রশ্ন আমি করব। কিন্তু তুমি কি বসবে না, মি. লংফেলো?’

বসল লংফেলো। ভুরু কুঁচকে দেখল রানাকে নিঃশব্দে। তারপর বলল, ‘দু‘ঘণ্টাও হয়নি ফোর্ট ফ্যারেলে পা দিয়েছ, এরই মধ্যে লোকের মনে খুঁতখুঁতে একটা ভাব জাগিয়ে তুলেছ তুমি—এসবের মানে কি, রানা?’

‘আমার নাম জানলে কোত্থেকে?’

‘পারকিনসন বিল্ডিং থেকে কাগজের অফিস হয়ে এসেছি আমি, রানা। ছোট্ট শহর এটা, খবর রটতে দেরি হয় না।’

‘কে এবং কেন খুঁত খুঁত করছে?’

‘যারা লক্ষ্য রাখছে তোমার ওপর,’ বৃদ্ধ পকেট থেকে চুরুট বের করে রানার দিকে পিস্তলের মত তাক করল, ‘গোরস্থানটা কোথায় একথা জানতে চাইবার অর্থ কি? ক্লিফোর্ড পরিবার সম্পর্কেই বা তোমার এত আগ্রহের কারণ কি? তোমার কপালে খারাবি আছে, রানা। আমার একটা উপদেশ শুনবে?’

‘না,’ বলল রানা, ‘নিজেকে খয়রাত করবার মত যথেষ্ট উপদেশ আছে আমার নিজেরই পেটে। এবার আমি কয়েকটা প্রশ্ন করছি তোমাকে। তুমি কে? আলবার্ট কেনেথের সাথে কি সম্পর্ক তোমার?’

‘আমি একজন সাংবাদিক। কেনেথের সাথে কোন সম্পর্ক ছিল না। কৌতূহল চরিতার্থ করতে গিয়েছিলাম মন্ট্রিয়লে।’

‘নিশ্চয়ই উইকলি ফোর্ট ফ্যারেলের সাংবাদিক তুমি?’ বাঁকা হাসল রানা। ‘পত্রিকা ছাপার নামে প্রহসন করার কি মানে, লংফেলো? কোন সংবাদপত্র এমন নির্লজ্জভাবে একজন মানুষ সম্পর্কে চুপ করে যেতে পারে, ভাবা যায় না!

‘আমি সম্পাদক নই, হাত-পা বাঁধা একজন সাংবাদিক মাত্র,’ বলল বৃদ্ধ ‘কেনেথের সাথে তোমার কি সম্পর্ক?’

‘বন্ধুত্বের।’

‘ফোর্ট ফ্যারেলে আসার উদ্দেশ্য?’

‘একটা অন্যায়ের প্রতিবিধান করা, সত্যি কথাটাই বলল রানা।

‘অন্যায়? কিসের অন্যায়?’

‘না জানার ভান কোরো না,’ বলল রানা, ‘কেনেথ খুন হবার পর তুমি কি বলেছিলে সবই আমি শুনেছি।’

থমকে গেল বৃদ্ধ। তারপর হঠাৎ চাপা কণ্ঠে বলল, ‘সময় থাকতে ফোর্ট ফ্যারেল ছেড়ে পালাও, ইয়াংম্যান। চলে যাও, আজই তুমি চলে যাও এখান থেকে। যত দূরে পারো।’ ঘাম ফুটে উঠেছে তার কপালে।

‘কার ভয়ে, লংফেলো? পারকিনসনের?’

রানার চোখের দিকে তিন সেকেণ্ড চেয়ে রইল বৃদ্ধ। ‘হ্যাঁ-না-না, কোন প্রশ্ন আমাকে কোরো না, রানা। আমি চাই না–’

‘কি চাও না? আমার কোন ক্ষতি হোক, এই তো?’ বলল রানা। ‘বিশ্বাস করো, আমার ক্ষতি করার সাধ্য ফোর্ট ফ্যারেলে কারও নেই। যে-কোন অবস্থায় নিজেকে আমি রক্ষা করতে পারব।’

‘তুমি ওদেরকে চেনো না।’

‘তার দরকারও নেই। ওদের চেয়ে অনেক ভয়ঙ্কর লোককে চিনি। লংফেলো, তুমি খামোকা ভয় পাচ্ছ। শোনো, তোমার সাথে নির্জনে কথা বলতে চাই আমি। তোমার বাড়িটা কেমন জায়গা?’

‘বৃথা চেষ্টা করছ তুমি, রানা। আমি মুখ খুলব না। তাছাড়া, এমন কিছু আমি জানিও না যা তোমার কোন সাহায্যে লাগবে।’

সাহায্যে নাই লাগুক, সব কথা আমি জানতে চাই। তুমি যতটুকু জানো।’

‘না।’

‘না কেন?’

‘তোমার বয়স কম, আরও অনেকদিন বাঁচবে, আমি চাই না…’

বুড়োকে থামিয়ে দিয়ে রানা বলল, ‘ফের সেই এক কথা? লংফেলো, আমার পরিচয় তুমি জানো না, জানলে বুঝতে…’

‘দরকার নেই তোমার পরিচয় জানার। রানা, আমার কথা রাখো। ফিরে যাও তুমি।’

‘এতবড় একটা অন্যায় যেমন চাপা আছে তেমনি চাপা থাকবে বলতে চাও?’

চুপ করে থাকল বৃদ্ধ!

‘‘অন্যায় সহ্য করাও অন্যায় করার সামিল, কথাটা নিশ্চয়ই তোমার জানা আছে, মিস্টার লংফেলো?’

‘আছে,’ বৃদ্ধ বলল, ‘কিন্তু সহ্য না করে কিইবা করার আছে আমাদের!’

‘আছে,’ বলল রানা। ‘কিছু যে করার আছে তা প্রমাণ করার জন্যেই আমি ফোর্ট ফ্যারেলে এসেছি।’

‘রানা!’

‘তুমি আমাকে সাহায্য করো আর না করো, এই অন্যায়ের রূপটা আমি জানতে চাই। শুধু তাই নয়, ফোর্ট ফ্যারেলের লোকদের জানাতে চাই। সেজন্যেই এখানে এসেছি আমি। সেই সাথে সবাইকে জানাব, এই ফোর্ট ফ্যারেলে এক বুড়ো আছে যে প্রথম থেকেই সব জানত বা সন্দেহ করেছিল, কিন্তু ভীতুর ডিম আর কাপুরুষ বলে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খোলেনি। মিস্টার লংফেলো, লোকে তোমার গায়ে থুথু ছিটাবে—লিখে নাও কথাটা।’

বুড়ো গম্ভীর। ধূসর ভুরু জোড়া কাঁপছে তার। ‘দেখো রানা, আমাকে উত্তেজিত করতে পারবে না তুমি। আমি জানি, তোমার একার পক্ষে এই অন্যায়ের প্রতিবিধান করা সম্ভব নয়। তাছাড়া, অন্যায় কিনা তা প্রমাণ করার শেষ সূত্রটাকেও সরিয়ে দেয়া হয়েছে দুনিয়া থেকে—এখন শত চেষ্টা করেও কোন লাভ হবে না। কি হবে আর ঝুঁকি নিয়ে? না, রানা, তোমাকে আমি…’

হঠাৎ নাটকীয় ভঙ্গিতে রানা বলল, ‘ওহ-হো! কি ভুলো মন আমার! জরুরী কাজটার কথা একেবারেই ভুলে গেছি! মি. লংফেলো, কিন্তু যদি মনে না করো, দয়া করে বিদায় হবে কি?’

রানার দিকে চেয়ে আছে বুড়ো। ‘আর তুমি?’

‘আমি? আমার সম্পর্কে নতুন করে কি জানতে চাও তুমি আবার?’

‘কি করবে ঠিক করেছ?’

‘কি করব তা একবারই ঠিক করি আমি। একটা একটা করে ভাঙব পাঁজর।’

‘কার?’ কপালে উঠল বুড়োর চোখ।

‘যারা অন্যায়টা করেছে, তাদের প্রত্যেকের,’ দৃঢ়তার সাথে বলল রানা। আর যারা অন্যায়টা সহ্য করেছে তাদের প্রত্যেকের মুখে যাতে চুনকালি মাখিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করানো হয় তারও ব্যবস্থা করব।

দাঁতহীন মাড়ি বের করে হঠাৎ রানাকে অবাক করে দিয়ে একগাল হাসল বুড়ো লংফেলো। ‘আমার পরীক্ষায় তুমি পাস করেছ, রানা। মনে হচ্ছে হয়তো পারবে, একমাত্র তুমিই পারবে।’ হঠাৎ খাদে নামাল সে কণ্ঠস্বর। ‘এখন নয়, সন্ধ্যার পর তুমি আমার অ্যাপার্টমেন্টে এসো। তখন অনেক কথা বলব তোমাকে। এই কফি হাউসের ওপরেই আমার অ্যাপার্টমেন্ট।’

কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াল বুড়ো। রানাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হন হন করে বেরিয়ে গেল কফি হাউস থেকে।

তার গমন পথের দিকে চেয়ে রইল রানা। অদ্ভুতই বটে বুড়োটা, ভাবছে ও।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *