গ্রাস – ২২

বাইশ

পরিষ্কার হয়ে গেছে আবার আবহাওয়া। বয়েডের ঘেরাও থেকে বেরিয়ে এসেছে রানা। আবার যে ওরা ধাওয়া করে ঘেরাও করবার চেষ্টা করবে, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। চলার উপর রয়েছে সে। সরে এসেছে বেশ অনেকটা। পুরো একটা দিন গত হবার পরও কাছে-কিনারে বয়েড বাহিনীর কোন সাড়াশব্দ বা চিহ্ন না দেখে একটা হরিণ মারার ঝুঁকি নিল সে।

ছোট একটা আগুন জ্বেলে হরিণটার বাছা বাছা অংশ ঝলসে নিয়ে মাংসের স্বাদ গ্রহণ করল। রাতটা একটা ঝর্ণার ধারে বিছানা পাতল। জঙ্গলে আশ্রয় নেবার পর কোন খোলা জায়গায় এই প্রথম। অসম্ভব ক্লান্ত রানা। রাতটা না ঘুমালে কাল সকাল থেকে আত্মরক্ষার জন্যে একটা আঙুল পর্যন্ত, নাড়তে পারবে বলে মনে হচ্ছে না ওর।

বিছানা তৈরির আগে গদির বিকল্প হিসেবে গাছের শুকনো পাতা সংগ্রহ করল, রানা আশপাশ থেকে। একটা খারাপ এবং অনুচিত কাজ, মাটির দিকে একনজর তাকিয়েই ওর অস্তিত্ব টের পেয়ে যেতে পারে শত্রু। তারপর আরও একটা খারাপ কাজ আগুন জ্বালানো, তাও জ্বেলেছে রানা কফি তৈরি করার জন্যে। রানার উদ্দেশ্যটাই আজ খারাপ। তাড়া খাওয়া শেয়ালের মত বনেজঙ্গলে পালিয়ে বেড়িয়েছে ও এ কয়দিন—হঠাৎ আজ বিদ্রোহ করে বসেছে মনটা।

পাতার উপর চাদর বিছিয়ে তাতে বসল ও। সামনে কুলকুল শব্দে বইছে ঝর্ণা। আঙুলের ফাঁকে সিগারেট। হাতের কাছে ধূমায়িত কফির কাপ। চারদিক নির্জন। নাকে বুনো ফুলের গন্ধ ! অদ্ভুত সুন্দর আর শান্ত লাগল রানার পরিবেশটা।

জঙ্গলে প্রবেশ করার পর একটা পুরো রাতও ঘুমাতে পারেনি রানা। একনাগাড়ে তিন ঘণ্টা, তার বেশি কখনোই নয়। সর্বক্ষণ ভয়: ঘুম থেকে জেগে উঠে চোখ মেললেই দেখতে পাবে কয়েকটা রাইফেলের নল তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে লোলুপ নয়নে। কিন্তু আজকের কথা আলাদা। ঘুমের জন্যে আজ বিছানা পাতেনি সে। সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করার পরও বিছানায় শুলো না সে। মনটা খুঁত খুঁত করছে। যা করতে চাইছে সেটা কি উচিত হবে? যদি হঠাৎ সত্যি সত্যিই ঢলে পড়ে ঘুমে?

মধ্যরাত পর্যন্ত টিকে থাকল রানা। বারবার আগুন জ্বেলে কফি তৈরি করল, খেল। শেষে মাজা-পিঠ যখন ব্যথায় টনটন করছে, সিদ্ধান্ত নিল খানিক গড়িয়ে না নিলেই নয়। ঘুমানো অবশ্য চলবে না, কিন্তু খানিকক্ষণের জন্যে পিঠটা বিছানায় না ঠেকালে আর চলছে না। শুয়ে পড়ল রানা। যাতে ঘুম এসে না যায় সেজন্যে ইচ্ছে করেই বিস্ফারিত করে রাখল চোখ।

ঘুম ভাঙল এঞ্জিনের শব্দে। লাফিয়ে উঠে বসল রানা বিছানায়। কয়েক সেকেণ্ড বুঝতেই পারল না কোথায় কি অবস্থায় রয়েছে সে। যখন হুঁশ হলো, প্রথমেই চোখ গেল ঘড়ির দিকে। বিশ মিনিট এগিয়ে গেছে ঘড়ির কাঁটা ওকে পিছনে ফেলে। বুঝতে পারল ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে সে—নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়ছে এখন যেখানে সেখানে।

আকাশে চলন্ত লাল তারা। হেডলাইট অফ করে রেখেছে হেলিকপ্টারটা। মাথার উপর দিয়ে উড়ে উত্তর দিকে মিলিয়ে গেল এঞ্জিনের আওয়াজ। আড়মোড়া ভেঙে চারদিকে তাকাল রানা। চোখে পড়া গেছে, এবার বাকি কাজটুকু সেরে ফেলতে হবে।

ওর সমান লম্বা একটা গাছের কাণ্ড দেখে রেখেছিল আগেই, ওটাকে বয়ে নিয়ে আসতে বেশি সময় লাগল না। বিছানার উপর শুইয়ে দিল ওটাকে লম্বালম্বিভাবে। চাদর দিয়ে ঢেকে উঠে দাঁড়াল ও। একটু দূরে সরে গিয়ে দেখল, হ্যাঁ, মনে হয় একজন মানুষ শুয়ে আছে চাদর মুড়ি দিয়ে। ব্যাপারটাকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্যে গাছের কাণ্ডের সাথে ফিশিং লাইন বেঁধে অপরপ্রান্তটা ধরে দূরে সরে গেল রানা। সুতো ধরে টানতেই মনে হলো যেন ঘুমের ঘোরে নড়ে উঠল চাদরের নিচে মানুষটা।

আলোর দরকার হতে পারে। তাই নতুন করে আরও বড় একটা আগুন ধরাল রানা। কফি খেল আর এক কাপ। বিশ মিনিট পর বেশ অনেকটা দূরে মট্ করে বাকাটা ডাল ভাঙার শব্দ হলো। আসছে! নিঃশব্দ পায়ে ছুটে চলে এল রানা সুতোর শেষ প্রান্তের কাছে, একটা ঘন ঝোপের আড়ালে।

শটগানটা পরীক্ষা করে দেখে নিল রানা লোড করা আছে কিনা। আগুনের খুব কাছে গা ঢাকা দিয়েছে ও, শটগানের নলটা চকচক করে উঠে সব ভণ্ডুল করে দিতে, ডামন কি মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠতে পারে ভেবে মাটি দিয়ে ঘষে নিল। তারপর’শোপের বাইরে নলের খানিকটা বের করে দিয়ে শুয়ে পড়ল উপুড় হয়ে।

চারজনের বেশি নেই এই দলে—আন্দাজ করল রানা। হেলিকপ্টার বয়ে নিয়ে এসেছে ওদেরকে। ঝর্ণার ধারে আগুন দেখতে পেয়ে ওদের নিয়ে এসে নামিয়ে দিয়েছে পাইলট কাছেই কোথাও। আসছে ওরা। কিন্তু এবার আগের চেয়ে অনেক বেশি সাবধান হয়ে এগোবে—ফাঁদে পড়ে হাত-পা-মাজা ভাঙার ঝুঁকি রয়েছে, জানা আছে তদের।

আরও কাছে একটা ডাল মটকাল। শক্ত হয়ে উঠল রানার পেশী। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে ও অনবরত। দেখতে চাইছে কোন দিক থেকে আসবে আক্রমণটা। ভাবছে, ডাল ভাঙার শব্দ পশ্চিম থেকে এসেছে বলেই মনে করা উচিত হবে না যে ওরা ওদিক থেকেই একসাথে আসছে। ধুরন্ধর কোন লোক পূর্ব দিক থেকেও এগোতে পারে—কিংবা দক্ষিণ থেকে। দক্ষিণ দিকে রয়েছে ও, হয়তো এই মুহূর্তে ঠিক ওর ঘাড়ের কাছে রাইফেল ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে কেউ, আর এক সেকেণ্ড পরই চারদিকের ঝোপের পাতায় ছিটকে গিয়ে লাগবে ওর মাথার মগজ। উপুড় হয়ে শুয়ে থাকাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়, মনে মনে-স্বীকার করল রানা। কিন্তু এছাড়া আর কোন উপায়ও নেই এখন।

সতর্ক চোখ পিছনে একবার ফেলার জন্যে ঘাড় ফেরাতে গেল রানা, কিন্তু চোখের কোণে সামনের দিকে কিছু একটা নড়ে উঠতে দেখে পাথর হয়ে গেল ও। বয়েড পারকিনসন! শ্বাস রুদ্ধ হয়ে গেল ওর বয়েডকে দেখতে পেয়ে। অধৈর্য হয়ে লোকটা যে নিজেই এসে হাজির হতে পারে, ভাবেনি রানা। বাহিনীর ওপর আস্থা হারিয়েছে সেনাপতি, নাকি হ্যারিসের কথায় হাত গুটিয়ে নিয়েছে কাঠুরের দল?

নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে এল বয়েড। কাছাকাছি এসে থাকে দাঁড়াল। সতর্ক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে চাদর ঢাকা গাছের ডালটার দিকে। চট্ করে চারপাশে চাইল একবার। এগিয়ে এসে আগুনের কাছে রাখা রানার ব্যাগটার পাশে দাঁড়াল। নিচু হয়ে ঝুঁকে ব্যাগের গায়ে লেখা নামটা পড়ে নিশ্চিত হলো। বাঁকা একটুকরো নিষ্ঠুর হাসি ফুটল ঠোঁটে।

সন্তর্পণে সুতো ধরে টান দিল রানা। সামান্য একটু নড়ে উঠল গাছের কাণ্ডটা।

পাঁই করে ঘুরল বয়েড। ঝট্ করে কাঁধে তুলল শটগান। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে টিপে দিল ট্রিগার। নিস্তব্ধ রাত চমকে উঠল আলোর ঝলক আর বিস্ফোরণের আওয়াজে। মাত্র আট ফিট দূর থেকে পর পর চারটে গুলি করল বয়েড চাদরটাকে।

চাদরের নিচে নিজেকে কল্পনা করে গাল দুটো কুঁচকে উঠল রানার। দরদর করে ঘামছে। এগিয়ে গেল বয়েড। চাদরে পা ঠেকিয়ে ঠিক লাথি নয়, ঠেলা মারল গাছের কাণ্ডটায়। হুঙ্কার ছাড়ল রানা,‘বয়েড, ইউ বাস্টার্ড! তোমার দিকে শটগান ধরে আছি আমি। তোমার হাতেরটা ফেলো…’

চরকির মত ঘুরল বয়েড, গুলি করল সেই সাথে। তীব্র আলোয় চোখ ঝলসে গেল রানার। পিছন থেকে কেউ একজন আর্তনাদ করে উঠল। পরমুহূর্তে গড়গড়া করার মত শব্দ বেরিয়ে এল তার গলা থেকে। ধপ করে ভারি একটা শব্দ হলো পতনের। ধুরন্ধর কেউ একজন পিছন দিক থেকে আসতে পারে, ভেবেছিল রানা। ঠিকই ভেবেছিল। ধুরন্ধরই বটে বিগ প্যাট, ভাবল রানা, একটু বেশি ধুরন্ধর, এই যা। ওর ঠিক ছয় ফিট পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল সে। রানা দাঁড়িয়ে আছে মনে করে গুলি করায় বয়েড়ের বুলেট ঠিক তার নাভিতে গিয়ে প্রবেশ করেছে।

‘খবরদার, বয়েড!’ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা। বন্দুকটা তাক করা রয়েছে ওর হাঁটুর দিকে।

অবাক বিস্ময়ে রানার দিকে তাকাল বয়েড, পর মুহূর্তে বেপরোয়া উন্মাদের মত গুলি করল আরার। কিন্তু সে ভুলে গেছে তার সেমি অটোমেটিক শটগানে মাত্র পাঁচটা গুলি থাকে। শুকনো একটা শব্দ হলো ফাঁকা চেম্বারে হ্যামার পড়ায়। হাঁটু লক্ষ্য করে গুলি করল রানা, কিন্তু ততক্ষণে লাফ দিয়েছে বয়েড।

একলাফে আগুনটা পেরিয়ে, অপ্রত্যাশিত একটা দিকে ছুটল বয়েড। তিন সেকেণ্ড পরই ঝপাৎ করে শব্দ হলো ঝর্ণার পানিতে। ছপ্ ছপ্ আওয়াজ তুলে সরে চলে যাচ্ছে। অন্ধকারে আবার তাকে লক্ষ্য করে একটা গুলি করল রানা। এটাও লাগল না। ওপারের ঝোপঝাড়ে ছুটন্ত পায়ের শব্দ শুনতে পেল রানা। ক্রমশ দূরে মিশিয়ে যাচ্ছে শব্দটা।

হাঁটু মুড়ে বিগ প্যাটের পাশে বসল রানা। মরে গেছে। রানা ধরে মিল বয়েডের শটগানে ভালুক মারার উপযুক্ত এল জি বুলেট ছিল। নাভি ফুটো করে বিগ প্যাটের নিরপাড়া গুঁড়ো করে দিয়ে বেরিয়ে গেছে একটা বুলেট। পেট থেকে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে পড়েছে, স্তূপ হয়ে রয়েছে পাশে। তার পাশে পড়ে আছে টর্চটা।

বয়েডকে অনুসরণ করতে বিশেষ বেগ পেতে হলো না রানার। টর্চের আলোয় পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে ও তার কাদা মাখা পায়ের ছাপ, নেতিয়ে পড়া ঘাস। কিন্তু টর্চ জ্বেলে এভাবে অনুসরণ করাটা বোকামি হচ্ছে ভেবে থেমে দাঁড়াল রানা। এয়েড ইতিমধ্যে আরও পাঁচটা, বুলেট ভরে নিয়েছে তার শটগানে, এবং আলো দেখে গুলি করলে বিগ প্যাটের মত রানারও নাড়িভুঁড়ি বের করে দেয়া তার পক্ষে কঠিন হবে না।

কোথায় যেন মস্ত এক বোকামি হয়ে যাচ্ছে। ভারতে গিয়ে সেটা ধরতে পারল রানা। যতদূর মনে হয় জঙ্গলে আগুন দেখতে পাওয়া গেছে এই খবর কানে যাওয়া মাত্র বিগ’প্যাটকে নিয়ে উড়ে চলে এসেছে বয়েড। কপ্টারে আর কেউ নেই, পাইলট ছাড়া।

কপ্টারটা উত্তর দিকে নেমেছে। ওদিকে ফাঁকা পাথুরে জমি আছে খানিকটা, জ্ঞানে রানা। ধারণা করল, ওই জমিটাই ব্যবহার করেছে পাইলট ল্যাণ্ডিঙের জন্যে।

বয়েডের আগেই পৌঁছুতে পারবে, আশা করল রানা। ও গেছে পশ্চিম দিকে। ব্যাগটা কাঁধ থেকে ফেলে দিয়ে ছুটতে শুরু করল রানা। উত্তর দিকে।

খানিকদূর ছুটে গতি কমিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল রানা। তারপর নিঃশব্দ পায়ে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল সামনে। দু‘একবার থামল ও, শুনতে চেষ্টা করল কোথাও কোন শব্দ হচ্ছে কিনা। আরও পঞ্চাশ গজ এগিয়ে দেখতে পেল আগুনের কণা।‘কপ্টারের গায়ে হেলান দিয়ে দক্ষিণ দিকে চেয়ে রয়েছে পাইলট, কাঁপা হাতে সিগারেট ফুঁকছে। ফাঁকা পাথুরে জায়গাটাতেই নেমেছে কপ্টার।

ফাঁকা জায়গায় পা দেবার আগে চক্কর দিয়ে ‘কপ্টারটার পিছন দিকে চলে এল ও। ‘কপ্টারটা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার চারদিকের ত্রিশ গজের মধ্যে কোন গাছ নেই। নিঃশব্দ পায়ে ত্রিশ গজ পেরিয়ে এসে পাইলটের পিছনে থামল রানা।

পাঁজরে শটগানের নল চেপে ধরতেই লাফিয়ে উঠল লোকটা।

‘শান্ত হও,’ বলল রানা।‘আমি মাসুদ রানা। আমাকে চেনো না তুমি?’

ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাবার সাহস হলো না লোকটার। ঘড় ঘড় করে শব্দ হলো গলা দিয়ে, যেন দম আটকে গেছে। ‘প্লীজ, আমাকে মেরো না।’

‘আচ্ছা, সহানুভূতির সুর নকল করে বলল রানা, ‘ঠিক আছে, মারব না। যদি কোনরকম চালাকির চেষ্টা না করো বেঁচে যাবে। আগেও আমাদের দেখা হয়েছে, মনে পড়ে? শেষ ট্রিপে তুমি আমাকে কাইনোক্সি উপত্যকা থেকে ফোর্ট ফ্যারেলে পৌছে দিয়েছিলে। কি যেন নাম তোমার?’

‘নেলসন।’

‘গুড। নেলসন, আজও তুমি আমাকে পৌঁছে দেবে ফোর্ট ফ্যারেলে। কি, দেবে না?’

নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল নেলসন।

‘ছয় কদম এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াও,’ বলল রানা। ‘দেখো বোকামি করতে গিয়ে আবার গুলি খেয়ে মরো না।’

গুনে গুনে ছয় পা এগিয়ে থামল পাইলট। ‘কপ্টারে উঠল রানা, বসল প্যাসেঞ্জারের সীটে। শটগানটা পাইলটের দিকে ধরে নির্দেশ দিল ও। ওঠো এবার। এবং দয়া করে তাড়াতাড়ি করো।’

উপরে উঠে সীটে বসল পাইলট। কাঠের শক্ত পুতুলের মত। পকেট থেকে হান্টিং নাইফটা বের করল রানা। শটগানটা পাশের সীটে রেখে ছুরিটা দেখাল সে পাইলটকে।‘এটা বন্দুকের চেয়েও ভয়ঙ্কর। স্টার্ট দাও, আকাশে ওঠো। জেনে রাখো, হেলিকপ্টার আমিও চালাতে জানি। বুঝতে পেরেছ?’

‘বুঝেছি,’ বলল পাইলট। ‘কিন্তু আমাকে মেরো না, মি. রানা।’

উত্তরে বিপজ্জনক ভঙ্গিতে ছুরিটা নাড়াল রানা। মুহূর্ত মাত্র দেরি না করে এঞ্জিন স্টার্ট দিল পাইলট। বিশ্রী আওয়াজ তুলে চালু হয়ে গেল রোটর ব্লেড, ভীত চকিত ফড়িঙের মত হঠাৎ শূন্যে উঠে পড়ল। পরমুহূর্তে ফাঁকা জমির কিনারা থেকে ঝলসে উঠল আগুন, তারপরই রোটরের শব্দকে ছাপিয়ে কানে এল বুলেটের আওয়াজ।

বুঝতেই পারছ, তাড়াতাড়ি নাগালের বাইরে যেতে না পারলে আমি নই, বয়েডই তোমাকে খুন করবে,’ পাইলটকে বলল রানা হাসিমুখে। আরেকটা গুলির আওয়াজ পেল ও। ওর ঠিক পিছনে ধাতব কিছুর গায়ে গুলি লেগে তীক্ষ্ণ, কৰ্কশ শব্দ হলো।

বিপদ টের পেয়ে ‘কপ্টারটাকে দ্রুত তুলে নিল পাইলট আরও উঁচুতে। আরও কয়েকটা আগুনের ফুলকি দেখা গেল, কিন্তু ওরা এখন বন্দুকের রেঞ্জের বাইরে। অন্ধকার ভেদ করে ছুটতে শুরু করল দক্ষিণ দিকে।

উপত্যকার উপর দিয়ে ক্রমশ নিচে নামতে লাগল ওরা। অনেক প্রাসঙ্গিক কথা উদয় হচ্ছে রানার মনে। আজ প্রায় পনেরো দিন ফোর্ট ফ্যারেলের মুখ দেখেনি। কি অপেক্ষা করছে ওর জন্যে সেখানে কে জানে।

আট মিনিটের মাথায় বাঁধটার উপর উড়ে এল ওরা। ফোর্ট ফ্যারেল আর মাত্র চল্লিশ মাইল এখান থেকে। তার মানে, বড়জোর আর দশ মিনিট লাগবে পৌঁছুতে।

অবশেষে ফোর্ট ফ্যারেলের আলোকিত মুখ দেখতে পেল রানা। প্রশ্ন করল সে, ‘পারকিনসনদের বাড়িতে হেলিপোর্ট না থেকেই পারে না, তুমি কি বলো, নেলসন?

‘আপনি ঠিক বলেছেন, মি. রানা।’

‘ওখানেই নামব আমরা।’

ফোর্ট ফ্যারেলের উপর দিয়ে উড়ে গেল ওরা। পারকিনসনদের শ্যাতোর ঠিক পাশেই হেলিপোর্টটা। গোরস্থানের মত নির্জন জায়গাটা। ধীরে ধীরে নামল’কপ্টার শান বাঁধানো প্ল্যাটফর্মে।

‘সুইচ অফ করো।’

রোটরের শব্দ থামতে নিস্তব্ধতাটুকু উপভোগ্য লাগল রানার। ‘সাধারণত তোমার সাথে দেখা করতে আসে কেউ ‘কপ্টার নামলে?’

‘আসে। তবে রাতে কেউ আসে না, মি. রানা।’

খুব ভাল, ভাবল রানা। বলল, ‘এখানেই রেখে যাচ্ছি তোমাকে আমি। কিন্তু ফিরে এসে যদি দেখতে না পাই, বিশ্বাস করো, খুন করার জন্যে তোমাকে আমি খুঁজতে শুরু করব। এবং বিশ্বাস করো, পাব খুঁজে।’

‘এখান থেকে আমি কোথাও যাব না, মি. রানা।’ গলাটা কেঁপে গেল লোকটার।

পকেটে ছুরিটা রেখে শটগান হাতে নেমে পড়ল রানা। এগোল বাড়িটার দিকে। মাত্র দু‘চারটে বালব জ্বলতে দেখা যাচ্ছে ভিতরে, তার মানে এই শেষ রাতের দিকেও জেগে আছে কেউ কেউ। ভিতরে ঢুকে সামনের দরজার কাছে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল রানা। জায়গাটা অন্ধকার, নিঃশব্দ পায়ে পিছন পিকের উদ্দেশে হাঁটছে ও। ওদিক দিয়েই ভিতরে ঢুকতে চায়। গ্যারেজের কাছে এসে নিরাশ হলো রানা। চারদিক আলোকিত। কিভাবে কোথা দিয়ে ঢুকবে তা ঠিক করতে খানিকটা সময় লাগবে ওর, কিন্তু অতটা সময় আলোর মধ্যে থাকাটা উচিত কাজ হবে বলে মনে করল না ও। কি মনে করে গ্যারেজের দিকে টর্চের আলো ফেলল একবার। অনেকগুলো গাড়ি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। টর্চটা নিভিয়ে ফেলল রানা। সামনের দিক থেকেই ভিতরে ঢুকতে হবে, সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘুরতে যাবে, হঠাৎ খুঁত খুঁত করতে শুরু করল মন। কি দেখেছে ও গ্যারেজে টর্চের আলোয়? কি দেখেছে? মনে করতে পারল না রানা। কিন্তু এমন কিছু একটা দেখেছে যা ওর চেনা-চেনা এবং অপ্রত্যাশিত। আবার টর্চ জ্বালল রানা। পাশাপাশি আট দশটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তিনটের পরই লংফেলোর গাড়িটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার পাশেই শীলার স্টেশন ওয়াগন।

ঢোক গিলল হঠাৎ রানা। ভাবল, শীলা কোথায়? আর লংফেলো?

দ্রুত ঘুরল রানা। চলে এল গাড়ির সামনে। হঠাৎ একটা বালব জ্বলে উঠল। আলোর বন্যায় ভেসে গেল চারদিক। স্যাঁৎ করে একদিকে সরে গিয়ে গা ঢাকা দিল একটা তিন ধাপ বিশিষ্ট সিঁড়ির পাশে।

দরজা খোলার শব্দ হলো একটা। একজন লোক কথা বলছে। ‘মনে থাকে যেন, কোনভাবেই যেন তাঁকে উত্তেজিত করা না হয়।’

‘ঠিক আছে, ডক্টর,’ মেয়েলী গলা থেকে এল উত্তরটা।

‘অবস্থার একটু এদিক ওদিক দেখলেই সাথে সাথে ফোন করবে আমাকে,’ গাড়ির একটা দরজা বন্ধ হবার আওয়াজ পেল রানা। ‘সকাল দশটা পর্যন্ত বাড়িতেই থাকছি আমি।’

উঠানটা যেখানে ভুঁড়ির মত ফুলে উঠেছে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে গাড়িটা, তাই দেখতে পাচ্ছে না রানা। স্টার্ট নেবার শব্দ হলো, তারপর হেডলাইট জ্বলতে দেখল রানা। বেরিয়ে গেল গেটের দিকে দ্রুতবেগে।

বাড়ির সামনের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল মৃদু শব্দে। এক সেকেণ্ড পর অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক বালবটা নিভে যেতেই।

দরজা বন্ধ হবার আওয়াজটা এখনও কানে বাজছে রানার। মৃদু একটা আওয়াজ। তার মানে তালা লাগানো হয়নি। ধাপ ক’টা পেরিয়ে বারান্দায় উঠল রানা। দরজাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল নিঃশব্দে। শটগানটা বাঁ হাতে নিয়ে ডান হাত দিয়ে মৃদু চাপ দিতেই কবাট দুটো ফাঁক হয়ে গেল মাঝখান থেকে।

বিশাল হলরুমটা মৃদু আলোকিত। কাউকে দেখছে না রানা। পা টিপে টিপে সিঁড়ির দিকে এগোল ও। কারও সাথে দেখা হলো না সিঁড়ির বাঁকে বা মাথায়।

গাফ পারকিনসনের লাইব্রেরী রুমের সামনে থামল রানা। করিডরটা আলোকিত। রূমের ভিত্তর আছে কেউ। দরজাটা এক ইঞ্চি খোলা। এক চোখ দিয়ে ভিতরে তাকাতেই পুসিকে দেখল রানা। ড্রয়ার খুলে গাদা গাদা কাগজপত্র নামাচ্ছে সে এক হাত দিয়ে। তার বাঁ হাতে লাল রঙের কাভার মোড়া একটা মোটাসোটা ফাইল। ব্যস্ততার সাথে কি যেন খুঁজছে পুসি। ইতিমধ্যেই ফাইল, চিঠির প্যাকেট, কাগজের বাণ্ডিলের পাহাড় তৈরি করে ফেলেছে সে মেঝেতে।

মৃদু চাপ দিয়ে দরজার কবাট পুরোপুরি খুলল রানা। কাজে এমনই মা, পিছন ফিরে একবার তাকালও না। পিছন থেকে ডান হাত দিয়ে গলাটা জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে চেপে ধরল তাকে রান্না। ‘কোন আওয়াজ নয়,’ শান্তভাবে বলল রানা, শটগানটা আস্তে করে ছেড়ে দিল নরম কার্পেটের উপর, তারপর বাঁ হাত দিয়ে পকেট থেকে ছুরিটা বের করে পুসির চোখের সামনে তুলল। ‘বুড়ো গাফ কোথায়?’

‘বাবা…’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল পুসি, ‘বাবা অসুস্থ। তার হাত থেকে লাল ফাইলটা পড়ে গেল।

পুসির ডান চোখের ঠিক নিচে ঠেকাল রানা ছুরির ডগাটা। ‘দ্বিতীয়বার প্রশ্নটা করার আগে এই চোখটা বের করে জুতো দিয়ে মাড়িয়ে…’

শ্বাস নেবার জন্যে ছটফট করছে পুসি, দ্রুত কথা বলল সে, ‘বেডরূমে।’

‘কোথায় সেটা?’ বলল রানা, ‘থাক, বলতে হবে না—আমাকে দেখিয়ে দেবে, চলো।’ পুসিকে ছেড়ে দিয়ে ছুরিটা পকেটে ভরল রানা। শটগান আর লাল ফাইলটা তুলে নিয়ে দরজার দিকে ইঙ্গিত করল। ‘আওয়াজ করলেই গুলি হবে, পুসি। অনেক সহ্য করেছি, আর না। চলো।’

ভিজে বেড়ালের মত দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়াল পুসি। তাকে অনুসরণ করে করিডরে বেরিয়ে এল রানা। ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে একবার মাত্র তাকাল পুসি, শটগানটা তার নিতম্বের দিকে ধরে রেখেছে রানা, দেখে শিউরে উঠল সে। দ্বিতীয়বার আর পিছন ফিরল না।

শেষ মাথার কাছে একটা দরজার সামনে দাঁড়াল পুসি। হাত দিয়ে ধরল নবটা। ঘোরাল। সেই মুহূর্তে পিছন থেকে লাথি মারল রানা দরজার গায়ে। পরমুহূর্তে পুসিকে ধাক্কা মারল বাঁ হাত দিয়ে। দরজার কবাট উন্মুক্ত হবার সাথে সাথে ছিটকে ভিতরে ঢুকল পুসি, কার্পেটের উপর পড়ে গেল হুমড়ি খেয়ে। প্রকাণ্ড একটা কোলাব্যাঙের মত দেখাচ্ছে এখন তাকে। উঁচু হয়ে থাকা নিতম্বে কষে একটা লাথি মারার লোভটা সামলে নিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল রানা। শটগান তুলে চারদিকটা দেখে নিল তীক্ষ্ণ চোখে।

বিস্ময়ে পাথর হয়ে গিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেও ভুলে গেছে মেয়েটা। চোখ কপালে তুলে তাকিয়ে আছে রানার দিকে। নার্স। চোখাচোখি হতেই সোজা উঠে দাঁড়াল ধীরে ধীরে। কোলের উপর থেকে কার্পেটে পড়ে গেল একটা বই। কাঁপছে বেচারী। ‘এসব কি? কে আপনি?’

‘গাফ পারকিনসন কোথায়?’

হামাগুড়ির অবস্থা থেকে পুসি উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছে দেখে তার পিঠে একটা পা রাখল রানা, চাপ দিয়ে কার্পেটের সাথে ঠেকিয়ে দিল বুকটা।

ঢোক গিলল নার্স। চিৎকার করা নিরাপদ কিনা ভাবছে। ‘মি. গাফ অসুস্থ। তাকে আপনি বিরক্ত করতে পারেন না।’ আবার একবার ঢোক গিলল সে। ‘তিনি… তিনি মৃত্যুশয্যায়।’

‘কৈ? কে মৃত্যুশয্যায়?’ একটা পর্দার ওপাশ থেকে ভরাট কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল। ‘তোমার কথা শুনতে পেয়েছি আমি, বাচাল মেয়ে! এত সহজে মরণ নেই আমার। কে ওখানে?’

পর্দার দিকে ফিরল নার্স। পুরো বিচলিত দেখাচ্ছে। চঞ্চল পায়ে এগোল দু‘পা, তারপর কি মনে করে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। মি. গাফ… মি. গাফ, আপনি শান্ত হোন। মাথা ঘুরিয়ে রানার দিকে ফিরল সে। অনুরোধ ঝরে পড়ল কণ্ঠস্বরে, ‘দয়া করে আপনি যান।’

‘রানা? মাসুদ রানা, তুমি?’ পর্দার ওপাশ থেকে জানতে চাইলেন গাফ।

‘আমি,’ বলল রানা।

ব্যঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল বুড়ো গাফের উচ্চারণ থেকে, ‘আমি জানতাম কাছে পিঠেই আছ তুমি। আসতে এত দেরি হলো যে?’

উত্তর দিতে যাচ্ছে রানা, কিন্তু আবার কথা বললেন গাফ। ‘আমাকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে কেন? নার্স, আলো জ্বালো। রানাকে ঢুকতে দাও এদিকে।’

‘কিন্তু… মি. গাফ, ‘ডাক্তার…!’

‘এই মেয়ে! যা বলছি করো। তোমার অবাধ্যতাই বরং উত্তেজিত করছে আমাকে।’

ঝুঁকে পড়ল রানা। ঘাড় ধরল পুসির। টেনে তুলল তাকে। নার্স সুইচ অন করতে উজ্জ্বল আলোর বন্যা বয়ে গেল বেডরূমে।

পুসিকে নিয়ে এগোল রানা। এক হাতে পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকল।

‘এদিকে এসো, রানা।’

বিছানায় শুয়ে আছেন গাফ। চিৎ হয়ে। লাল মখমলের একটা চাদর তাঁর গায়ে।

পুসিকে নিয়ে বিছানার কাছে থামল রানা। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল তাকে একপাশে, কার্পেটের উপর।

‘আরে আরে। এ যে দেখছি আমাদের অলক্ষ্মী পুসি! বাপকে তাহলে শেষ পর্যন্ত দেখতে এলে, অ্যাঁ? বেশ, বেশ-খুব খুশির খবর,’ রানার দিকে তাকালেন গাফ, কঠিন কণ্ঠে জানতে চাইলেন, ‘তোমার কাহিনীটা কি, রানা? ব্ল্যাকমেইল করার জন্যে আরও আগে চেষ্টা করা উচিত ছিল তোমার, একটু বেশি দেরি করে ফেলেছ।’

রানার পাশ ঘেঁষে বিছানার দিকে এগোল নার্স। বিছানা ঘুরে ওপাশে গিয়ে গাঁফের মাথার কাছে দাঁড়াল। তার চোখে চোখ রাখল রানা। বলল, ‘শোনো, এখান থেকে বেরিয়ে যাবার কোন চেষ্টা করবে না। তোমার কাছ থেকে কোন শব্দও যেন না পাই।’

‘আমার পেশেন্টকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না আমি।’

‘খুব ভাল মেয়ে তুমি,’ গম্ভীরভাবে বলল রানা।

‘কি ফিসফাস চলছে এখানে?’ জানতে চাইলেন গাফ।

বাঁ বগল থেকে বের করে ডান বগলের নিচে রেখে চেপে ধরল রানা লাল ফাইলটা। বলল, ‘আপনার বয়েড। আপনার কাছে আসতে সেই দেরি করিয়ে দিয়েছে আমাকে।’

‘কোথায় সে?’

‘কাইনোক্সি উপত্যকায়। পাঁচশো লোকের নেতৃত্ব দিচ্ছে।’

উঠে বসতে চেষ্টা করছেন গাফ, নার্স তাকে ধরে ফেলল। তারপর শুইয়ে দিল মৃদু চাপ দিয়ে। ‘কি বলতে চাইছ পরিষ্কার করে বলো, রানা। হেঁয়ালি সহ্য করার মত শারীরিক বা মানসিক অবস্থায় নেই আমি।’

‘এসব কিছুই তাহলে আপনি জানেন না?

‘কি সব, রানা?’

‘বয়েড আপনার কাঠুরেদের জানিয়েছে আমার হাতে মার খেয়ে আপনি শয্যাশায়ী হয়েছেন।’

‘এই প্রথম শুনছি।’

‘আমাকে জীবিত বা মৃত ধরে দিতে পারলে পাঁচ হাজার ডলার দেয়া হবে, ঘোষণা করেছে সে।’

অবিশ্বাস আর বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠছে গাফের চেহারায়। ‘তারপর?’

‘আজ পনেরো দিন পাঁচশো লোককে ফাঁকি দিয়ে জঙ্গলে জঙ্গলে পালিয়ে বেড়াচ্ছি আমি। আমাকে দেখামাত্র গুলি করার আদেশ দিয়েছে সে তার বাহিনীকে।’

‘মাই গড!’ বালিশে এদিক ওদিক মাথা নাড়লেন গাফ।

‘এইটুকুই সব নয়!’

স্থির হলেন গাফ। রানার চোখে চোখ রাখলেন। ‘যা বলতে চাও বলে ফেলো, রানা।’

‘ইলেকট্রিক চেয়ারে বসার সমস্ত আয়োজন পূর্ণ করেছে সে।’

ভাবলেশহীন দৃষ্টি গাফের চোখে।

‘খুন করেছে সে।’

চেয়ে আছেন গাফ। দু‘ইপ্তায় দশ বছর বয়স বেড়ে গেছে তার। গাল দুটো বসে গেছে ভিতর দিকে, গায়ের মাংস ঝরে গিয়ে হাড্ডিসার কঙ্কালে পরিণত হয়েছে শরীরটা। ‘কাকে?’

‘বিগ প্যাট নামে এক লোককে। গুলিটা তাকে খুন করার জন্যে করেনি, আমাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়েছিল।’

‘বিগ প্যাট—তাকেই কি আমি বাঁধের কাছে দেখেছিলাম?’

‘হ্যাঁ।’

চোখ বুজলেন গাফ। রানা দেখল বোজা পাতার ভিতর থেকে এক ফোঁটা পানি বেরিয়ে এল পাপড়িতে। ‘বয়েড তাহলে আবার এই কাজ করল! ও, গড়! ভুলটা আমারই! আরার যে এই কাণ্ড ও করবে তা আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল।’

‘আবার?’ নিজের কানেই ব্যগ্র শোনাল রানার নিজের কণ্ঠস্বর। আবার মানে? আপনি কি কেনেথের কথা বলছেন?’

এদিক ওদিক মাথা নাড়লেন গাফ।

‘তবে?’ ঝুঁকে পড়ল বৃদ্ধের মুখের উপর রানা। শক্ত মুঠো হয়ে গেছে হাত দুটো। বুক কাঁপছে উত্তেজনায়। ‘মি. গাফ, কে? ক্লিফোর্ড পরিবারকে খুন করেছে কে?’

চোখ মেলে তাকালেন গাফ। রানার কানে যেন অনেক দূর থেকে ভেসে এল তাঁর দুর্বল কণ্ঠস্বর। ‘তুমি কতটুকু জানো, রানা? কেনেথ কি সব কথা বলে গেছে তোমাকে?’

‘না। তার কাছ থেকে বিশেষ কিছুই জানতে পারিনি আমি। জেনেছি অন্য সূত্র থেকে।’

‘কি জেনেছ, রানা? কি প্রমাণ আছে…’

‘অনেক, মি. গাফ। কেনেথ যে কেনেথ ছিল না, টমাস ছিল তা আমি প্রমাণ করতে পারি অনেকভাবে। কবর খুঁড়লেই সব প্রকাশ পাবে। তার দরকার আছে বলে কি মনে করেন আপনি?’

‘না!’ থামলেন তিনি। ‘এ ভয় ছিল আমার,’ শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর। নিজের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠছেন ক্রমশ। ‘আমি জানতাম, একদিন সব ফাঁস হয়ে যাবে। ওরা চারজনই ভয়ঙ্কর পুড়ে গিয়েছিল—পোড়া গা আর কাঁচা মাংস ছাড়া দেখবার মত কিছু ছিল না কেউ চিনতে পারেনি টমাসকে…কিন্তু আমি পেরেছিলাম। ঈশ্বর আমার সহায় হোন!’ বদলে গেল চোখের দৃষ্টি, অনেক দূরে তাকিয়ে আছেন যেন তিনি, ফিরে গেছেন আট বছর আগের অতীতে, যেন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন দুর্ঘটনার পরবর্তী বীভৎস দৃশ্যটা। ‘সনাক্ত করার সময় ভুলটা আমি ইচ্ছে করেই করেছিলাম,’ স্বপ্নাচ্ছন্নের মত বললেন তিনি, ‘করেছিলাম টমাসের নিরাপত্তার কথা ভেবেই—ওখানেই মস্ত ভুল হয়ে গিয়েছিল আমার। টমাস মারা গেছে এই মিথ্যেটা খাড়া না করে টমাস বেঁচে আছে এই সত্যটা প্রকাশ করলে আজ আর এই ঘটনা ঘটত না। কিন্তু ভাল করছি ভেবে করে বসলাম মন্দ। বুদ্ধির দোষ! আমার বুদ্ধির দোষ!’

‘কে দায়ী, মি. গাফ?’ জানতে চাইল রানা। রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে আছে ও উত্তরটা শোনার জন্যে। ‘কে? কে খুন করেছিল হাডসন ক্লিফোর্ডকে?’

ধীরে ধীরে একটা কাঁপা হাত তুললেন গাফ পারকিনসন। নেতিয়ে পড়া আঙুলগুলোর মধ্যে থেকে খাড়া হচ্ছে ধীরে ধীরে তর্জনীটা। পুসির দিকে তাক করলেন তিনি আঙুল।‘ওর ভাই-বয়েড পারকিনসন। কিন্তু ষড়যন্ত্রটা ওর। ওরই বুদ্ধিতে চলত বয়েড, ওই বুদ্ধি দেয় বয়েডকে।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *