একুশ
পরবর্তী দুটো দিন উত্তর কাইনোক্সি উপত্যকায় গা ঢাকা দিয়ে থাকল রানা। সাহস যোগানোর জন্যে বয়েডকে তার শিকারীদের উদ্দেশ্যে আর একটা ভাষণ দিতে হয়েছে, এ ব্যাপারে রানা নিশ্চিত। ওর খোঁজে তারা ক্রমে উপত্যকার উত্তরে আসছে, কিন্তু সবসময় কমপক্ষে ছয়জনের একটা দল নিয়ে। দশ গজ এগোতে হলেও গোটা দল একসঙ্গে এগোচ্ছে, দেখেছে রানা। ওকে অবশ্য এখনও কোন দলের চোখে পড়তে হয়নি। ও একা বলেই একটা অবিচ্ছিন্ন, দলের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকা সহজ হয়েছে। সেদিন ওদের শায়েস্তা করে অন্তত এটুকু লাভ হয়েছে ওর।
এক এক করে আরও বারোটা ফাঁদ পেতেছে রানা ইতিমধ্যে। কিন্তু একটা ছাড়া বাকিগুলো কোন সুফল বয়ে আনেনি। অবশ্য একটা ফাঁদই খুব কম কেরামতি দেখায়নি। আরও দু‘জন তাদের পা হারিয়েছে, একজনের হাত ভেঙেছে।‘তিনজনকে নিয়ে উড়ে যেতে দেখেছে রানা কপ্টারটাকে।
চুরি করা খাবার শেষ হয়ে এসেছে রানার। মস্ত একটা বিপদের সঙ্কেত এটা। লগিং ক্যাম্পে আবার ঢুঁ মারার চেষ্টা করাটা হবে ভয়ঙ্কর ঝুঁকির ব্যাপার। বয়েড ওদিকের পথে যথেষ্ট কাঁটা পুঁতে রেখেছে ধারণা করা যায়। সুতরাং, পুব মুখো হয়ে শীলার আস্তানার দিকে যেতে চায় রানা এবার।
শীলাকে পাওয়া যেতে পারে ওখানে। খাবারেরও কোন অভাব হবে না! বয়েড কি করছে তা শীলার মাধ্যমে হ্যামিলটনকে জানাবার একটা সুযোগ হতে পারে ওখানে গেলে।
বয়েডের লোকদের ফাঁকি দিয়ে দু‘বার চেষ্টা করেছে রানা পুবদিকে পৌঁছুবার। দু‘বারই বয়েড বাহিনীর অস্তিত্ব টের পেয়ে পিছিয়ে এসে ঘুর পথ ধরে এগোবার চেষ্টা করতে হয়েছে ওকে। অবশ্য আজু, তিনবারের বার, সফল হয়েছে ও। ব্যুহ ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে শত্রুপক্ষের তীক্ষ্ণ নজর এড়িয়ে।
সন্ধ্যা নামছে উপত্যকায়। পাহাড়ের গা ঘেঁষে শুয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে শালার বাড়িটা দেখছে রানা। বড় হতাশ হতে হয়েছে ওকে। গত আটচল্লিশ ঘণ্টা ঘুমায়নি ও। শরীরটা এমনিতেই সহ্যসীমার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে। তার উপর এই অশুভ লক্ষণ : শীলার বাড়িতে আলো নেই।
শীলা কি তবে নেই ওখানে? ভাবতে ভাবতে কঠোর হয়ে উঠল রানার মুখ। রয়েড কি এত বড় পাগল, শীলার কোনরকম ক্ষতি করার আগে আগু-পিছু ভেবে দেখবে না?
মিটমিট করে আলো জ্বলছে বাড়িটার শেষ প্রান্তের একটা কামরায়। বুড়ো ডিকসনের কামরা ওটা, জানে রানা। ভাবল, ওর কাছ থেকে খবর সংগ্রহ করা যেতে পারে।
সন্ধ্যার পরও এক ঘণ্টা অপেক্ষা করল রানা। বাড়িটার উপর কেউ নজর রাখছে কিনা নিশ্চিতভাবে জানার কোন উপায় দেখল না ও। বাড়ির ভিতর কেউ ওত পেতে এসে আছে কিনা তাই বা কে জানে?
সমস্ত দ্বিধা কাটিয়ে উঠে পড়ল রানা ! ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে নামতে শুরু করলে নিচে।
সন্তর্পণে বাড়ির ভিতর ঢুকল রানা। পাঁচিল টপকাতে হলো ওকে। ডিকসনের কামরায় আর কেউ আছে কিনা জানালা দিয়ে দেখে নিয়ে দরজায় নক করল ও।
‘যেই হও, খুলছি মা দরজা! ভিতর থেকে জানিয়ে দিল ডিকসন দৃঢ় কণ্ঠে।
‘ডিকসন, আমি রানা।’
সাড়া দিল না আর ডিকসন। আবার নক করতে যাবে রানা, দরজা খুলে গেল।‘ঢোকো, ঢোকো তাড়াতাড়ি! দেখতে পেলে তোমাকে খেয়ে ফেলবে ওরা।’
ভিতরে ঢুকল রানা। দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিয়ে রানার দিকে ফিরল, ড্রিকসন। তার মুখের কালচে হয়ে ওঠা ক্ষতচিহ্নগুলো দেখে যা বোঝার বুঝে নিল রানা। ও চেয়ে আছে দেখে মাথা নিচু করে নিল বৃদ্ধ।
‘কৈ?’ সংক্ষেপে জানতে চাইল রানা।
‘বয়েড,’ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চোখের পানি লুকাল ডিকসন।‘আর বিগ প্যাট,’ ঝট করে বুড়ো তাকাল রানার দিকে।’কিন্তু হয়েছেটা কি, মি. রানা? মিস ক্রিফোর্ড কোথায়?’
‘শীলা নেই এখানে?’
এদিক ওদিক মাথা নাড়ল বৃদ্ধ। ব্যাকুল দৃষ্টিতে রানার মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন খুঁজছে।‘তুমি জানো না, মি. রানা? মিস ক্লিফোর্ড এক হপ্তা আগে সেই যে গেছে এখনও তার কোন খবর নেই। কি হয়েছে তার? কোথায় সে?’
‘চিন্তা কোরো না,’ কেঁপে গেল রানার গলাটা রাগে। মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠল দুটো হাত।‘শীলার খবর জেনে নেব আমি।’
‘মি. রানা, তুমি গাফ পারকিনসনকে মারতে গেলে কেন?’
চমকে উঠল রানা।‘তুমিও বয়েডের কথা বিশ্বাস করেছ? না, ডিকসন, মি. গাফকে আমি মারিনি। তিনি হার্ট অ্যাটাকের ফলে পড়ে গিয়েছিলেন। তার কোন খবর জানো?’
এদিক ওদিক মাথা নাড়ল ডিকসন।‘বোধহয় মারা গেছে, তা নাহলে ফোর্ট ফ্যারেলে এমন অনাসৃষ্টি শুরু হয় কিভাবে?’
‘মারা গেছে, অনুমান করে বলছ?’
‘জানি না, কেউ বলেনি আমাকে কিছু।’
‘মারল কেন ওরা তোমাকে?’ জানতে চাইল রানা।
‘মিস ক্লিফোর্ডের চাবি ওদের দিতে চাইনি বলে।’ ডিকসন হঠাৎ শশব্যস্ত হয়ে উঠল।‘কি বোকা আমি। মি. রানা, তোমার বিশ্রাম দরকার…’
‘ছয়দিন পালিয়ে বেড়াচ্ছি,’ বলল রানা।‘আমার মাথার দাম ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার ডলার। ইচ্ছা করলেই বয়েডকে খবর পাঠিয়ে টাকাটা রোজগার করতে পারো তুমি।’
সব ভুলে হেসে উঠল ডিকসন।‘পাঁচ হাজার ডলার আবার একটা টাকা নাকি? মিস ক্লিফোর্ড আমার নামে পঞ্চাশ হাজার ডলার ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে রেখেছে। পেটে খিদের মেজাজ কি রকম, মি. রানা?’
‘নষ্ট হয়ে গেছে, খিদে,’ বলল রানা। হাসছে। দুটোর বেশি হাঁস খেতে পারব না।
‘সে ব্যবস্থা করা যাবে,’ উৎসাহের সঙ্গে বলল ডিকসন।‘আজই গোটা ছয়েক’ হাঁস মেরেছি আমি।’ হেসে ফেলল সে।‘আর কোন কাজ নেই তো, তাই ওদেরকে মেরেই গায়ের ঝাল মেটাই। ভাল কথা, প্রচুর স্টু আছে, গরম করতে যা দেরি, দেব এনে? ইতিমধ্যে শাওয়ারটা সেরে নাও মিস ক্লিফোর্ডের বাথরূমে গিয়ে।’ পকেট থেকে চাবির গোছাটা বের করে রানার দিকে বাড়িয়ে দিল সে।
‘এই চাবির জন্যে অপমানিত হয়েছ তুমি।’ বলল রানা।‘ওদেরকে দাওনি কিন্তু আমাকে দিচ্ছ যে?’
‘ওরা কে!’ বলল ডিকসন।‘কিন্তু তুমি মিস ক্লিফোর্ডের বন্ধু।
খাওয়া দাওয়ার পর শীলার বেডরূমে ঢুকল রানা। বালিশে মাথাটা ঠেকার অপেক্ষা ছিল শুধু, সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল।
চোখে রোদ লাগতে ঘুম ভেঙে গেল রানার। কাপড় পরে বাড়িময় ঘুরে কোথাও দেখল না ডিকসনকে। শীলার ছোট্ট কিচেনটায় একটা স্টোভ, একটা ফ্রাইপ্যান, ছয়টা ডিম, এক পাউণ্ড কেক আর কফির সরঞ্জাম দেখল ও।
নাস্তা সেরে কফির দ্বিতীয় কাপে চুমুক দিচ্ছে রানা, এমন সময় ছুটন্ত পদশব্দ ঢুকল ওর কানে। জানালার সামনে গিয়ে দাড়াতেই দেখল হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ির ভিতর ঢুকছে ডিকসন।
ঝড়ের বেগে হলরূমে ঢুকল সে। মি রানা, পালাও। একদল লোক …এদিকেই আসছে…দশ মিনিটও লাগবে না পৌঁছুতে…
গায়ে কোটটা চড়িয়ে ব্যাগটা তুলে নিল রানা কাঁধে।
তোমার ব্যাগে কয়েকটা জিনিস ভরে রেখেছিলাম রাতে, আর সব জিনিস’আজ সকালে ভরব ভেবেছিলাম,‘কিন্তু…’
‘দরকার নেই,’ বলল রানা।‘ধন্যবাদ, ডিকসন। শোনো, জরুরী একটা কাজের দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি তোমাকে। প্রথম সুযোগেই ফোর্ট ফ্যারেলে যাবে তুমি। আমাকে যে তাড়া করে মেরে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে এ ব্যাপারে যা জানো সব জানাবে সার্জেন্ট ফ্র্যামিলটনকে। এবং চেষ্টা করবে লংফেলো আর শীলার খোঁজ করতে। পারবে?’
‘পারব, পারব,’ জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল ডিকসন, ব্যস্ত হয়ে উঠেছে সে থানার নিরাপত্তার কথা ভেবে। তাড়াতাড়ি রওনা দাও, মি. রানা। ওরা পৌঁছে যাবে এখুনি।’
‘তোমার আতিথেয়তার কথা ভুলব না,’ হলরুম থেকে বেরুবার আগে বলল রানা।‘আবার দেখা হবে।’
আবার সেই জঙ্গল। দ্রুত পাহাড়ে উঠে গত রাতে যেখান থেকে কেবিনের পিকে চোখ রেখেছিল সেই জায়গায় পৌঁছল রানা। উপুড় হয়ে শুয়ে একটা সিগারেট ধরাল ও।
তিন মিনিট পর শীলার বাড়ির সামনে দেখা গেল বয়েড বাহিনীকে। সংখ্যায় ছয়জন। গোটা বাড়িটা তিনবার করে সার্চ করল ওরা। পাহাড় থেকে বুঝতে পারল রানা, তালা ভেঙে শীলার বেডরুমেও ঢুকল ওরা। পরিষ্কার বুঝল, খুঁজছে ওকে।
ওকে খুঁজতেই এসেছে ওরা, সন্দেহ নেই। কিন্তু জানল কিভাবে?
ভাবতে ভাবতে সমাধানটা বের করে ফেলল রানা। নিশ্চয়ই দূরে কোথাও লোক ছিল বাড়িটার দিকে নজর রাখার জন্যে। গতরাতে সেই দেখেছে শীলার কামরায় আলো জ্বলতে।
বোকামিটা ওর, সন্দেহ নেই, বুঝতে পারল রানা। শীলার রূমে আলো জ্বালা উচিত হয়নি।
ঠোঁট কামড়ে ধরে আবার বিনকিউলার তুলল চোখে রানা। গ্যারেজের সামনে শীলার মাইক্রোবাসটা দাঁড়িয়ে আছে, একজন লোক কি যেন করছে এঞ্জিনের উপর ঝুঁকে পড়ে। খানিকপর সিধে হলো লোকটা। তার হাতে একগাদা তার দেখতে পাচ্ছে রানা।
ফোর্ট ফ্যারেলে যাওয়া হচ্ছে না ডিকসনের, বোঝা গেল।
***
বিপদ হয়ে দেখা দিল আবহাওয়া। মাথার কাছাকাছি নেমে এল দিগন্তজোড়া মেঘ, তুমুল বৃষ্টি হলো একনাগাড়ে কয়েক ঘণ্টা, তারপর নেমে এসে মাটি ছুঁলো গাঢ় কুয়াশা। দুর্যোগের ভাল দিক এইটুকুই, ভাবল রানা, খুব কাছ থেকেও ওকে কেউ দেখতে পাবে না। আর একটা ব্যাপার,‘কপ্টারটাকে অচল করে রেখেছে এই দুর্যোগ।
একটানা ছয় ঘণ্টা, তারপর আধঘণ্টা বিরতির পর আবার একটানা তিনঘণ্টা ভিজতে হলো রানাকে। সর্দি লেগে গেল। জ্বর জ্বর ভাব। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত কাবু করে ফেলল ওকে। প্রতিকূল সময়ে একটা হাঁচি মৃত্যু ডেকে আনতে পারে ভেবে সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকল রানা। বৃষ্টির মধ্যে নতুন উদ্যমে খোঁজা শুরু করেছে বয়েড। তার বাহিনী ছোট একটা এলাকার ভিতর ঘেরাও করে এনেছে রানাকে। তিন বর্গমাইলের বেশি হবে না সেটা। বয়েডের বেড়া টপকে চট করে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় তা বুঝেছে রানা গত চব্বিশ ঘণ্টায় তিনবার বাধা পেয়ে। কর্ডনটা নিখুঁত হয়েছে, এবং ক্রমশ সেটা ছোট করে আনছে ওরা। এখন আর রানা ধারণা করতে পারছে না ঠিক কত লোককে লেলিয়ে দিয়েছে বয়েড ওর পিছনে। যদি পাঁচশো বা তার বেশি হয় তাতেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
চতুর্থবার কর্ডন’ ভেদ করতে গিয়ে কুয়াশার মধ্যেও দেখে ফেলল ওরা রানাকে। চারদিক থেকে মুষলধারে বৃষ্টির মত ছুটে এল বুলেট।
কাদার উপর দিয়ে ক্রল করে পিছিয়ে এসে প্রাণটা বাঁচাল রানা কোনমতে। যদিও উরুর খানিকটা চামড়াসহ আধ ছটাক মাংস হারাতে হলো ওকে। ভাগ্য ভাল যে বুলেটটা হাড়ে গিয়ে লাগেনি।
এক মাইল পিছিয়ে এসে একটা পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে বসল রানা। উরুতে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে নিয়ে আবার দাঁড়াল দু‘পায়ে। পরনের কাপড় শুকায়নি এখনও। রক্তশূন্য, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে হাত-পায়ের চেহারা। নাক দিয়ে পানি গড়াচ্ছে। অবস্থা কাহিল, মনে মনে স্বীকার করল রানা। কিন্তু অবস্থা যত কাহিলই হোক, চলার মধ্যেই থাকতে হবে ওকে, ভাবল ও। থামলেই বিপদ, নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে এসে স্রেফ গলাটা দু‘ফাঁক করে দেবে ওরা।
***
একটুর জন্যে ধাক্কা খেল না রানা ভালুকটার সঙ্গে। রাগে গরগর করে উঠল পশুটা, সামনের পা দিয়ে মাটিতে নিষ্ঠুর থাবা মারল কয়েকটা, পিছনের দু‘পায়ে ভর দিয়ে আট ফুট উঁচু হয়ে দাঁড়াল, মস্ত হাঁ করে দাঁত দেখিয়ে দিল রানাকে। পিছিয়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে এল রানা, তাকিয়ে থাকল ভীত-বিস্মিত দৃষ্টিতে।
ভয় পেয়ে রানাকে পিছিয়ে যেতে দেখে চার পা ভাঁজ করে আগের ভঙ্গিতে বসল সেটা, রসাল একটা গাছের শিকড় চিবুতে শুরু করল আবার। রানার দিকে লক্ষ রেখেছে এক চোখে, দু‘একবার গরগর করে জানিয়ে দিচ্ছে: খবরদার, আর এক পা কাছে এগোলে তোমার একদিন কি আমার একদিন!
ভালুকটা যাতে বিরক্ত না হয় সেজন্যে সরে গিয়ে একটা গাছের পিছনে দাঁড়াল রানা, ভাবতে লাগল কি করা যায় এখন।
কিছুই না করে চলে যেতে পারে রানা। ওর কেটে পড়াটাই স্বাভাবিক ব্যাপার হবে। কিন্তু মাথায় এখন অন্য বুদ্ধি খেলছে। আটশো পাউণ্ড ওজনের একজন মিত্র হতে পারে ভালুকটা, কৌশলে যদি ব্যবহার করতে পারে ওটাকে। খেপা একটা ভালুকের মুখোমুখি হবার সাহস হবে না কাঠুরেদের।
দ্রুত ভাবতে লাগল রানা। সবচেয়ে কাছাকাছি আছে যে দল সেটা আধ মাইলটাক দূরে। ধীর গতিতে আরও কাছে এগিয়ে আসছে। অভিজ্ঞতা থেকে জানে রানা, হাঁটার সময় যথেষ্ট শব্দ করে থাকে তারা। খানিকক্ষণের মধ্যেই ভালুকটা তাদের আওয়াজ শুনতে পাবে। রানার এগিয়ে আসা টের পায়নি, তার কারণ, স্রেফ প্রাণ রক্ষার তাগিদে নিঃশব্দ পায়ে হাঁটার সবরকম কৌশল প্রয়োগ করতে হচ্ছে ওকে।
ওদের শব্দ পেয়ে সরে যাবে ভালুকটা, কিন্তু যেদিকে সরে যাওয়ার কথা তার উল্টো দিকে যদি ওকে নিয়ে যাওয়া যায় তাহলে কর্ডন ভেদ করে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব হতে পারে। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব? ভালুকটাকে মানুষের সাড়া পেয়ে সরে যেতে না দিয়ে শত্রুদের দিকে ছুটতে বাধ্য করা, ভাবতে যত সহজ, কাজটা তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন বলে মনে হলো রানার।
কঠিন মনে হলেও, নিরাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিল না রানা। মিনিটখানেক মাথা ঘামাবার পর উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুখ। পকেট থেকে কয়েকটা শটগানের শেল বের করল ও। হান্টিং নাইফ দিয়ে প্রতিটি শেল চিরতে শুরু করল। সীসাগুলো ফেলে দিয়ে রাখল শুধু পাউডার চার্জ। একটা দস্তানার উপর পাউডারের স্তূপ তৈরি করে, জিনিসটাকে শুকনো রাখার জন্যে মুড়ে ফেলল সেটা।
পায়ের নিচে মাটির কোন চিহ্ন নেই। পাইনের কাঁটা পুরু কার্পেটের মত বিছিয়ে আছে। পাইন কাঁটার একটা বৈশিষ্ট্য হলো, অনেকটা কচু পাতা বা হাঁসের পালকের মত, গায়ে পানি মাখে না। ছুরি দিয়ে পাইন কাঁটার কার্পেট খুঁড়তে শুরু করল রানা। খুব বেশি খুঁড়তে হলো না, খানিকটা নিচেই শুকনো, খড়খড়ে জিনিসের অস্তিত্ব অনুভব করল ও।
কাজ করছে, কিন্তু ভালুকটার দিক থেকে দুই সেকেণ্ডের বেশি সময়ের জন্যে চোখ সরায়নি ও। একমনে চিবুচ্ছে ওটা এখনও মোটাসোটা শিকড়টাকে, এবং সতর্ক একটা চোখ রেখেছে রানার দিকে। রুমা জানে, যতটুকু দূরত্বকে ভালুকটা ভদ্র-দূরত্ব বলে মনে করে, তার বাইরে থাকলে কিছুই বলবে না সে ওকে। তবু, সাবধানের মার নেই ভেবে, কাছাকাছি একটা গাছ বেছে রেখেছে ও, বিপদ দেখলেই যাতে চড়ে বসা যায়।
কোর্টের সাইড পকেট থেকে একটা সরকারী জিওলজিক্যাল ম্যাপ আর একটা নোটবই বের করল রানা। ম্যাপটা ছিঁড়ল লম্বা লম্বা ফালি করে, নোটবই থেকে খুলে নিল একটা একটা করে পাতা। নোটবইয়ের পাতাগুলোকে ছোট ছোট কাগজের কাঠিতে পরিণত করল রানা পাকিয়ে। শুকনো পাইন কাঁটা আর কাঠিগুলোর কয়েকটা দিয়ে বৃত্ত তৈরি করল একটা। বৃত্তের মাঝখানে বসাল তিনটে তাজা কার্তুজ। ভালুকটার ডাইনে ও বাঁয়েও এই রকম আরও দুটো বৃত্ত রচনা করল সে কাগজ আর শুকনো পাইন কাঁটা দিয়ে। তিনটে করে তাজা কার্তুজ বসিয়ে দিল বৃত্তের মাঝখানে। এবার ম্যাপের লম্বা ফালির উপর গান পাউডার ছিটিয়ে ইংরেজি `V’ অক্ষরের মত সরলরেখায় যুক্ত করল তিনটে বৃত্তকে। এখন যে কোন এক জায়গায় আগুনের একটা কণা ছোঁয়ালেই আগুন পৌঁছে যাবে তিন বৃত্তে।
কাজ শেষ করে বেশ খানিকক্ষণ কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করল রানা। ভালুকটার পিছন থেকে এখনও কোন সাড়া শব্দ নেই শত্রু পক্ষের। রানাকে নড়তে চড়তে দেখে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে গরগর করে সাবধান করেছে ভালুকটা ইতিমধ্যে কয়েকবার, পিছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে যুদ্ধংদেহী ভাব নিয়ে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভদ্র-দূরত্ব লঙ্ঘিত হচ্ছে না দেখে আবার বসে মন দিয়েছে নিজের কাজে।
কাজ শেষ করে বয়েড বাহিনীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে রানা। হাতে মোম দিয়ে মোড়া দিয়াশলাইয়ের কাঠি। ভালুকটাই সতর্ক করে দেবে ওকে, জানে রানা, কেননা ওর আর শত্রুদের মাঝখানে বলে রয়েছে ওটা। বগলে শটগানটা চেপে ধরে আছে রানা। ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করছে। মুহূর্তের জন্যে চোখ সরাচ্ছে না ভালুকটার উপর থেকে।
ক্ষীণ একটু আওয়াজও টের পেল না. রানা, কিন্তু ভালুকটা পেল। নড়ে উঠে মাথাটা ঘোরাল সে। এদিক ওদিক দোলাচ্ছে, ফণা তোলা গোখরো সাপের মত ছোবল মারার ভঙ্গিতে। কাঁপা, কর্কশ, রোমহর্ষক শব্দ রতে শুরু করল। সশব্দে ঘ্রাণ নিচ্ছে বাতাস থেকে। এবং অকস্মাৎ ছোট্ট একটা গর্জন করেই রানার দিক থেকে ঘুরে গিয়ে পিছন ফিরল।
দশ সেকেণ্ড পর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে পিছিয়ে আসতে শুরু করল বিশাল ভালুকটা রানার দিকে। কিছু একটা আসছে ওর দিকে, টের পেয়েছে ভালুকটা। ঠিক ভয়ে নয়, অযথা গোলমালে জড়াতে চায় না বলেই পিছিয়ে আসতে শুরু করল সে। অস্বস্তির সঙ্গে রানার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাচ্ছে, যেন সন্দেহ করছে ফাঁদে আটকা পড়ে যাচ্ছে সে।
ঢোক গিলল রানা। কোন ভালুক যখন বুঝতে পারে তাকে ফাঁদে আটকাবার চেষ্টা করা হচ্ছে তখন সে যে কী ভয়ঙ্কর দুর্দমনীয় একটা মূর্তিমান প্রলয় হয়ে ওঠে, জানা আছে রানার। এই অবস্থায় একজন মানুষের জন্যে সবচেয়ে মঙ্গলজনক কাজ হলো কেটে পড়া।
এতক্ষণে রানার কানেও ঢুকল মানুষের পায়ের শব্দ।
ঝুঁকল রানা। দিয়াশলাইয়ের কাঠিটা জ্বেলে বাম পাশের দুই বৃত্তের মাঝামাঝি জায়গায় গান পাউডারের রেখার উপর ছোঁয়াল আগুনটা। মুহূর্তে সাদা আর নীলচে ছোট ছোট ফুলকি ছড়াতে ছড়াতে ছুটতে শুরু করল আগুন রেখাটা ধরে দুই দিকে।
পিছিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ আগুন দেখে থমকে দাঁড়াল ভালুকটা। চাপা গর্জন ছাড়ল একটা, তারপর ঘুরে এগিয়ে এল কয়েক পা। রানার মনে হলো ওকেই প্রধান শত্রু’ ধরে নিয়ে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জানোয়ারটা। সত্যিই এগোতে দেখে ছ্যাঁৎ করে উঠল বুকটা। হিতে বিপরীত না হয়ে যায়! আকাশের দিকে বন্দুক তুলেই ফায়ার করল রানা। আওয়াজটা শুনেই থমকে দাঁড়াল আবার বিশাল ভালুকটা। খানিকটা পিছিয়ে গেল। অনিশ্চয়তায় ভুগছে। কি করবে দিশে পাচ্ছে না। তিন দিকে আগুনের রেখা।
এমনি সময়ে ভালুকটার পিছন থেকে একটা উত্তেজিত চিৎকার ভেসে গুলির আওয়াজ শুনে ছুটে আসছে এই দিকেই।
বামদিকে এগোতে যাচ্ছিল, এমনি সময়ে ওদিকের বৃত্ত থেকে প্রচণ্ড শব্দে ফাটল একটা শো। এক লাফে দিক পরিবর্তন করল ভালুকটা। কিন্তু যাবে কোনদিকে—ডান দিকের বৃত্ত থেকে আধ সেকেণ্ডের ব্যবধানে ফাটল দুটো কার্তুজ। বেচারা ঘাবড়ে গিয়ে দিশা হারিয়ে ফেলল একেবারেই। কয়েক সেকেণ্ড পাগলের মত ছুটাছুটি করল এদিক ওদিক—কয়েক পা গিয়েই থামে, দিক বদলে ছুটে যায় অন্য।
এমনি সময়ে তিনটি বৃত্তের বাকি সব ক’টা শেল ফাটল একসঙ্গে। এতেই সিদ্ধাস্ত নিয়ে ফেলল জানোয়ারটা, একমাত্র যে দিকটা থেকে বিকট শব্দ হচ্ছে না পাহাড়ের মত শরীরটা নিয়ে সেদিকে ঘুরেই লাগাল ছুট।
সিদ্ধান্ত যেন আবার পরিবর্তন না করে সেজন্যে ওটার লেজের ডগা উড়িয়ে দিল রানা গুলি করে। তারপর দমকা বাতাসের মত উড়ে চলল ওটার পিছন পিছন ধাওয়া করে।
ভালুকটা তার পথের মাঝখানে যে ক’টা ছোট ছোট গাছ পেল ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলল একের পর এক। প্রায় আধটন ওজনের গতিবেগ সহ্য করার ক্ষমতা এদিকের বেশির ভাগ গাছেরই নেই। ঝোপ ঝাড় মাড়িয়ে, গাছ উপড়ে ফেলতে ফেলতে দ্রুত রানাকে ছাড়িয়ে সামনের দিকে ছুটছে তো ছুটছেই। ক্রমশ উঁচু হয়ে ওঠা জঙ্গলের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে তিনজন লোক, হঠাৎ দেখতে পেল রানা। বিকট দর্শন ভালুকটাকে দেখামাত্র প্রাণভয়ে যে যেদিকে পারল ছুটতে শুরু করে দিল। এক মুহূর্ত দেরি হয়ে গেল একজনের, চোখে শর্ষে ফুল দেখল সে। ভালুকটা থামল না তার সামনে। পাশ ঘেঁষে ছুটে যাবার সময় শুধু থাবা মারল একটা। পর মুহূর্তেই রানা দেখল লোকটা পড়ে গেছে কাত হয়ে, একদিকের নিতম্বে মাংস নেই, সাদা হাড় বেরিয়ে পড়েছে। কাছে গিয়ে দেখল যাবার সময় এক পা দিয়ে মাড়িয়ে দিয়ে গেছে ওকে বিশাল জানোয়ারটা। লোকটার একপাশের সব ক’টা পাঁজর ভেঙে গেছে, চোখা হাড় বেরিয়ে পড়েছে চামড়া ফুঁড়ে নিজের অজান্তেই শিউরে উঠল রানা। আরও অনেকটা সামনে থেকে মানুষের চিৎকার আর গুলির শব্দ কানে ঢুকল ওর। আবার ছুটতে শুরু করল সে দানবটার পিছু পিছু। পঁচিশ গজ পেরিয়ে স্যাৎ করে একটা গাছের আড়ালে গা ঢাকা দিল ও। খুব কাছেই দাঁড়িয়ে রয়েছে বয়েড বাহিনীর একজন। রাইফেল তুলে লক্ষ্য স্থির করছে ভালুকটার দিকে। ভালুকটা মারা পড়লে কর্ডন ভেদের আর কোন সুযোগ পাবে না রানা।
লোকটার ডান পাশে রয়েছে রানা আড়াল থেকে বেরিয়ে ছুটল ও। কিন্তু নিজের অজ্ঞাতসারে পায়ের একটা শব্দ করে ফেলায় নির্ঘাত মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হলো ওকে।
চরকির মত আধপাক ঘুরে রানার বুকের দিকে রাইফেল তাক করল লোকটা। পিছলে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল রানা। ওর বুকের কাছ থেকে মাত্র দুই হাত সামনে রাইফেলের নল।
চকচক করছে লোকটার চোখ দুটো সাফল্যের আনন্দে। মনে মনে ধন্যবাদ দিল সে বয়েডকে, দেখামাত্র রানাকে গুলি করার নতুন নির্দেশ দিয়েছে বলে। পাঁচ হাজার ডলার এখন শুধু একবার ট্রিগার টিপে দিলেই পেয়ে যাবে সে।
শরীরের দু‘দিকে দু‘হাত রানার অনেকটা আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে, খানিকটা আক্রমণের ভঙ্গিতেও। শটগানটা ডান হাতে, কিন্তু নলটার মুখ নিচের দিকে।
লোকটার মুখের দিকে একবার চেয়েই পরিষ্কার বুঝে নিল রানা—মোমেন্ট অফ ট্রুথ সমুপস্থিত। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই মৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে ওর। লাফিয়ে সরে যাওয়ার জন্যে ধনুকের ছিলার মত টান হয়ে গৈছে দু‘পায়ের পেশী। ও দাঁড়িয়ে পড়ার পর বড়জোর এক সেকেও পেরিয়েছে, লোকটা রানার বুকে গুলি করল। এবং লাফ দিল রানা। কোনটা আগে হলো—রাইফেলের ট্রিগারে চাপ, নাকি সরে যাবার জন্যে রানার লাফ-বোঝার উপায় নেই, সেকেণ্ডের দশ ভাগের একভাগ সময়ের মধ্যেই ঘটে গেল ব্যাপারটা।
খালি চেম্বারে পড়ল হ্যামার। পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেঁপে উঠল লোকটা গুলি বেরোয়নি বুঝতে পেরে। মুহূর্তে রক্তশূন্য হয়ে গেছে প্রাণবন্ত মুখটা। হাতের রাইফেলটা দেখছে, যেন চেনে না জিনিসটাকে।
দু‘পা এগিয়ে ধীর ভঙ্গিতে রাইফেলটা তার হাত থেকে নিল রানা।‘ভয় নেই, তোমাকে আমি খুন করব না। কিন্তু বিনিময়ে আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে তোমাকে।’
বিস্ময়ের উপর বিস্ময়, বোকার মত তাকিয়ে থাকল লোকটা রানার দিকে।‘তোমরা আমাকে খুঁজছ কেন?
কথা বলতে চেষ্টা করল লোকটা, কিন্তু ঠোঁট জোড়া নড়ল শুধু, শব্দ বেরুল না।
‘কেন তাড়া করছ তোমরা আমাকে? এর জবাব চাই আমি। সত্য কথাটা জানতে চাই।’
গলা ফুঁড়ে বেরিয়ে এল কয়েকটা শব্দ। ‘বুড়ো গাফকে মেরেছ তুমি।’
‘কে বলেছে বুড়ো গাফকে মেরেছি আমি?’ শান্তভাবে জানতে চাইল রানা। হাতেই রয়েছে শটগানটা, কিন্তু মুখটা মাটির দিকে নামানো।
‘বয়েড ছিল সেখানে-সেই বলেছে। বিগ প্যাটও দেখেছে।’
‘বিগ প্যাট দেখবে কিভাবে? সে ওখানে ছিলই না।’
‘কিন্তু সে বলল ছিল, বয়েডের সামনেই, লোকটা ঘনঘন ঢোক গিলছে।‘বয়েড তো প্রতিবাদ করেনি।’
‘তার কারণ, দু‘জনই মিথ্যে কথা বলেছে,’ বলল রানা।‘বুড়ো গাফের হাট অ্যাটাক হয়েছিল। তাঁর বক্তব্য কি এ ব্যাপারে?’
‘তিনি কথা বলবেন কিভাবে? তিনি অসুস্থ…’
‘কোথায়? বাড়িতে না হাসপাতালে?’
‘ঠিক জানি না, তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত শুনেছি বাড়িতেই রাখা হয়েছে।’
‘কি নাম তোমার?’
‘হ্যারিস।’
‘শোনো, হ্যারিস ……আচ্ছা, বলো তো, এই মুহূর্তে তোমাকে আমি খুন করতে পারি, এখাটা স্বীকার করো?’
পরপর দু‘বার ঢোক গিলল হ্যারিস। ‘আমার কি দোষ?’
‘বাহ! আমাকে দেখামাত্র গুলি করার হুকুম পেয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছ, এইমাত্র করেছও গুলি—অথচ তোমার কোন দোষ নেই বলতে চাইছ? আমার দিক থেকে ভেবে দেখো ব্যাপারটা—আমার কাছে এটা মস্ত দোষ নয়?’
চুপ করে থাকল লোকটা। কিন্তু কাঁপুনিটা বেড়ে গেল তার।
‘আমার প্রশ্নের জবাব দাও,’ বলল রানা। তোমাকে খুন করব কি করব না সেটা পরে ভাবব আমি। স্বীকার করো, ইচ্ছা করলে পারি, কেউ আমাকে বাধা দিতে পারবে না।’
পুতুলের মত মাথা কাত করল লোকটা।
‘ঠিক এইরকম সুযোগ আরও অনেকবার পেয়েছি আমি, হ্যারিস,’ বলল রানা, তোমাদের অন্তত পঁচিশ জন লোককে ইচ্ছে করলেই আমি খুন করতে পারতাম। কিন্তু করিনি। কেন জানো?’
‘কেন?’
‘করিনি, তার কারণ, আমি অকারণে খুন করা পছন্দ করি না। বুড়ো মানুষের গায়ে হাত তোলাকেও ঘৃণা করি। গাফের গায়ে হাত তোলার কথা কল্পনাও করতে পারি না। বয়েড যা বলছে সব মিথ্যে কথা। আসল ব্যাপার হলো, ওরা ভয়ঙ্কর ধরনের কয়েকটা অপরাধ করেছে, আমি চাই সেগুলো প্রকাশ হোক, ওরা উপযুক্ত শাস্তি পাক। এইটুকুই আমার অপরাধ। এরই জন্যে কুকুরের মত ভাড়া করা হচ্ছে আমাকে, হুকুম দেয়া হয়েছে যেন দেখামাত্র গুলি করা হয়। সে যাক, হ্যারিস, এই নাও তোমার রাইফেল,’ রাইফেলটা হ্যারিসের হাতে ধরিয়ে দিল রানা। আমি জানি তোমার পকেটে বুলেট আছে। কিন্তু তবু আমি ঝুঁকিটা নিচ্ছি, তোমাকে কিছুই না বলে মুক্তি দিচ্ছি আমি। বলতে পারো, প্রাণ ভিক্ষা দিচ্ছি তোমাকে। কেন বলো তো?’
পাগল হয়ে গেছি একথা মনে না করলেই হলো, ভাবল রানা। কথা বলতে পারছে না দেখে আবার বলল ও, ‘কারণ, আমি যে সত্যিই একজন অপরাধী নই তা প্রমাণ করতে চাই। আমি চাই তোমার সঙ্গীদের কাছে আমার দিকটা তুলে ধরবে তুমি, ওদেরকে সব জানাবে। চললাম।’
ঘুরে দাঁড়াল রানা। কয়েক পা এগিয়ে দাঁড়াল আবার। ঘুরল। ‘ভেব না আবার, খুন করতে ভয় পাই আমি। বিশ্বাস করো, এই কাজটাতেই বিশেষভাবে ট্রেনিং নেয়া আছে আমার। আমি হাঁটতে শুরু করলে তুমি যদি পিছন থেকে কোন সুযোগ নিতে চাও, মরবে। খুন করতে এখনও শুরু করিনি আমি, কিন্তু তোমাকে যদি বেঈমানী করতে দেখি, তোমাকে দিয়েই শুরু করব।’ বলে আর দাঁড়াল না রানা। ঘুরল হাঁটতে শুরু করল।
ঝুঁকিটা ভয়ঙ্কর, স্বীকার করল রানা। শির শির করে উঠল পিঠ। মাথার পিছনের চুল খাড়া হয়ে উঠতে চাইছে। পিছন ফিরে তাকাল না রানা। দৃঢ় পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। ছুটতে শুরু করার একটা অদম্য ইচ্ছা জাগছে, কিন্তু দমন করে রাখল নিজেকে। পিছন ফিরে তাকাবার ইচ্ছাটাকেও অতিকষ্টে দমন করল ও।
ক্রমশ উঠতে উঠতে পাহাড়ের অনেকটা উপরে উঠে যখন বুঝল রাইফেলের নাগালের বাইরে চলে এসেছে, পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকাল রানা।
পাহাড়ের নিচের অংশে দাঁড়িয়ে আছে হ্যারিস, ছোট দেখাচ্ছে তাকে, মুখ তুলে তাকিয়ে আছে উপর দিকে। হাতের রাইফেলটা আগের ভঙ্গিতেই ধরে আছে সে দু‘হাত দিয়ে, একটুও নাড়েনি।
হাত নাড়ল রানা। কয়েক সেকেণ্ড অনড় দাঁড়িয়ে থাকার পর উত্তরে পাল্টা হাত নাড়ল হ্যারিস।
আবার এগোতে শুরু করল রানা। পাহাড় বেয়ে ওপারে চলে গেল ও।