গ্রাস – ২০

বিশ

পরদিন ঘুম ভাঙল রানার মাথার উপর হেলিকপ্টারের শব্দে। চোখ মেলতেই পাতার ফাঁক দিয়ে যান্ত্রিক ফড়িংটাকে উড়ে যেতে দেখল ও মাত্র হাত চল্লিশেক উপর দিয়ে। বয়েডকে পরিষ্কার চিনতে না পারলেও পাইলটের পাশে একজন মাত্র লোককে বসে থাকতে দেখল রানা এবং অনুমান করল লোকটা বয়েড না হয়ে যায় না।

গাছের দুটো ডালের মাঝখান থেকে দড়ি খুলে নিজেকে মুক্ত করল রানা। ব্যাগ নিয়ে নিচে নামতে শুরু করে ভাবল, আগুন জ্বালাবার ফল এত তাড়াতাড়ি ফলতে শুরু করবে ভাবা যায়নি।

ধীরেসুস্থে মুখ হাত ধুয়ে এল রানা সিকি মাইল দূরের একটা ঝর্ণা থেকে। চুলো তৈরি করে আগুন জ্বালল। বেছে বেছে কাঠ ঢোকাল চুলোটায়। যাতে ধোঁয়া না হয়। রান্নার কাজ শেষ হতেই আরেকবার মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল ‘কপ্টারটা। ঘন পাতার আড়ালে দেখতে পাবে না ওকে পাইলট, জানে রানা। কিন্তু খাওয়ার পাট চুকিয়ে ফেলার একটা তাগাদা অনুভব করল ও। মাথার উপর এখন থেকে হয়তো সারাদিনই চক্কর মারবে ওরা। বোঝা যাচ্ছে, মরিয়া হয়ে উঠেছে বয়েড ওর অস্তিত্বের লক্ষণ দেখতে পেয়ে। ওকে খুঁজে বের করার জন্যে এই এলাকার প্রতিটি গাছ কেটে ফেলতে হলেও পিছপা হবে না সে।

তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়ার পর দেহমনের বল যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেল রানার। বয়েড এখন ওর বিরুদ্ধে যা ইচ্ছা করুক, যতজনই লেলিয়ে দিক না কেন—মনে হলো, সামাল দিতে পারবে সে।

শিকারীদের চলাচলের ফলে একটা রাস্তা তৈরি হয়েছে উত্তর দিকে, সেটা ধরে আধ মাইলটাক এগোল রানা। রাস্তাটা এক জায়গায় একটা চার ফুট উঁচু পাথরের পাড় বেঁধে এগিয়েছে, অপর দিকে ছয় ফুট নিচু একটা খাদ, একেবারে খাড়া নেমে গেছে। রাস্তাটা ধরে কেউ যেতে চাইলে এই জায়গাটা পেরোতেই হবে তাকে।

প্রায় মন খানেক ওজনের একটা পাথর বয়ে নিয়ে গেল রানা পাথরের উঁচু পাড়ে, সেটাকে রাখল পাড়ের একেবারে কিনারা ঘেঁষে, খুদে একটা পাথরের সঙ্গে ঠেক দিয়ে। পরীক্ষা করে দেখে নিল কয়েকবার, মৃদু একটু ধাক্কাতেই পড়ে যাবে সেটা। ব্যাগ থেকে এরপর বের করল রানা খরগোশ ধরার একটা ফাঁদ। মাছ ধরার আঠারো পাউণ্ড টেস্টের নাইলন মোনোফিলামেন্ট লাইন বের করল। ফাঁদের সঙ্গে সুতোটা বেঁধে অপর প্রান্তটা ঝরে পড়া শুকনো পাতার নিচ দিয়ে নিয়ে গিয়ে বড় পাথরের ঠেক-এর সাথে যুক্ত করল।

আধঘণ্টার মত সময় লাগল রানার ফাঁদটা পাততে। উপত্যকার অপরদিক থেকে মাঝেমধ্যেই ‘কপ্টারের আওয়াজ ভেসে আসছে শুনতে পাচ্ছে ও। ফাঁদটাকে লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা সেরে পথটা ধরে চারশো গজ উঠে গেল রানা। এখানে পথের দু‘পাশে কর্দমাক্ত মাটি। কাদার উপর পায়ের ছাপ ফেলে, জুতোর ঘষায় ঘাস ছিঁড়ে কিছু চিহ্ন তৈরি করল নিজের। তারপর পথ ছেড়ে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ফিরে এল ফাঁদটার কাছে।

পরিকল্পনার বাকি অর্ধেকটা পূরণ করার পালা এবার। পথ ধরে নিচের দিকে নেমে একটা ফাঁকা জায়গায় পৌঁছল সে। এখানে একটা ঝর্ণা রয়েছে। পথের ধারে ব্যাগ আর চাদরের পোঁটলাটা নামিয়ে ভাবল, এদিকে ‘কপ্টারটা আসতে দেরি আছে এখনও।

ক্যানটিনে পানি ভরল রানা। একটু জিরিয়ে নেবার জন্যে একটা গাছের নিচে বসতে যাবে, অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ একেবারে মাথার উপর চলে এল ‘কপ্টারটা।, অবাক হয়ে উপরে তাকাতে রানা পাতার ফাঁক দিয়ে পরিষ্কার দেখতে পেল পাইলটকে। চোখ কপালে উঠে গেছে লোকটার। রানার সঙ্গে চোখাচোখি হতে অদ্ভুত একটুকরো হাসি ছড়িয়ে পড়ল লোকটার মুখে। মুচকি হাসল রানাও—খসল বয়েডের এক হাজার ডলার।

লাফ দিয়ে আরও নিরাপদ একটা আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটল রানা প্ৰাণপণে, যেন ধাওয়া করেছে ‘কপ্টারটা ওকে, তাতে ও ভয় পেয়েছে। বাতাসে তীক্ষ্ণ আওয়াজ তুলে ফাঁকা জায়গাটার উপর দিয়ে উড়ে গেল সেটা দ্বিতীয়বার। এরপর আরেকবার চক্কর মারল বড় একটা বৃত্ত রচনা করে। নাক ঘুরিয়ে দ্রুত ফিরে যেতে শুরু করল উপত্যকার নিচের দিকে। বয়েড় পারকিনসন শেষ পর্যন্ত সন্ধান পেতে যাচ্ছে মাসুদ রানার।

ফাঁকা জায়গাটায় ফিরে গিয়ে গায়ের শার্ট খুলে ফেলল রানা। খানিকটা ছিঁড়ে কাপড়ের একটা ছোট টুকরো পথটার ধার ঘেঁষে দাঁড়ানো একটা ঝোপের গায়ে কাঁটার সঙ্গে আটকে দিল। ওকে যাতে লোকগুলোর অনুসরণ করতে অসুবিধে না: হয় তারই জন্যে এই আয়োজন। ব্যাগ আর চাদরের পোঁটলাটা এমন এক জায়গায় রাখল যেখান থেকে ও ফাঁদটা পরিষ্কার দেখতে পারে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা সময়টা অপব্যয় না করে একটা গাছের ডাল কেটে সেটাকে চেঁছে মসৃণ করতে শুরু করল রানা ওর হান্টিং নাইফ দিয়ে।

‘কপ্টারটা বড়জোর বাঁধ পর্যন্ত যাবে, ভাবল রানা। লোকজন নিয়ে ফিরে আসতে খুব বেশি সময় নেবে না। দশ মাইলের পথ, ধরা যাক, আট মিনিট লাগবে পৌঁছতে। পনেরো মিনিট সময় দেয়া যাক কি করবে তা ঠিক করতে। ফিরতে লাগবে আরও আট মিনিটের মত। তার মানে সর্বমোট আধঘণ্টার বেশি লাগার কথা নয়। পাইলট ছাড়া চারজন লোক বয়ে আনবে ওটা। তার বেশি লোকের জায়গা হবে না। অবশ্য, চারজনকে নামিয়ে দিয়ে আবার ফিরে যাবে দ্বিতীয় দলটাকে নিয়ে আসার জন্যে। মাঝখানে, ধরা যাক, বিশ মিনিট সময় পাওয়া যাবে। এই বিশ মিনিটের মধ্যে ওর অচল করে দিতে হবে প্রথম চারজন লোককে।

প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর ‘কপ্টারটার ফিরে আসার আওয়াজ পেল রানা। শব্দের তেজ অনুমান করে বুঝল ফাঁকা জায়গাটাতেই নেমেছে সেটা। খানিকপরই আবার সেটা আকাশে উঠল, শুরু করল চক্কর দিতে। প্রমাদ গুনল রানা। ফিরে গিয়ে লোক না এনে চক্কর দেবার ইচ্ছা কেন পাইলটের? আনুমানিক সময়ের মধ্যে ওটা যদি ফিরে না যায়, সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে তাহলে।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল রানা ‘কপ্টারটাকে দক্ষিণ দিকে নাক ঘোরাতে দেখে। ফাঁকা জায়গাটার দিকে সোজা চলে গেছে পথটা, সেদিকে দৃষ্টি ফেলল ও। টোপ এখন গিললেই হয়।

খানিক বাদেই ক্ষীণ একটা চিৎকার শুনতে পেল রানা। কণ্ঠস্বরে উল্লাসের সুর রয়েছে অনুভব করে বুঝতে পারল ও, টোপটা পুরো গিলেছে ওরা। পাতার পর্দার ভিতর থেকে উঁকি দিয়ে দেখল, পথটা ধরে দ্রুত, প্রায় ছুটতে ছুটতে এগিয়ে আসছে দলটা। তিনজনের হাতে অস্ত্র রয়েছে। একটা শটগান, দুটো রাইফেল।

পথটা ধরে ছুটতে ছুটতে উঠে আসছে ওরা। চারজনেরই অল্প বয়স। রোমাঞ্চের স্বাদ পেয়ে উত্তেজিত। পাশাপাশি জোড় বেঁধে ছুটে আসছে, কিন্তু পথটা সেখানে সরু হয়ে গেছে সেখানে দু‘জন একসঙ্গে হাঁটতে পারবে না দেখে পিছিয়ে পড়ল সামনের সারি থেকে একজন।

একজনের পিছনে আরেকজন; মন্থর গতিতে হাঁটছে এখন ওরা। ফাঁদটার কাছে পৌঁছল। নিঃশ্বাস আটকে রেখে চেয়ে আছে রানা। প্রথম লোকটা এড়িয়ে গেল ফাঁদটাকে। নিরাশার একটা ঢেউ জাগল রানার বুকে। কিন্তু দ্বিতীয় লোকটা সরাসরি পা দিল তাতে, সুতোর টান পড়ল, বড় পাথরের ঠেকটা স্থানচ্যুত হলো মুহূর্তে। এক মণ ওজনের বড় পাথরটা ধুপ করে পড়ল তৃতীয় লোকটার কোমরে, ছিটকে পড়ার আগে তার সামনের লোকটাকে আঁকড়ে ধরে ফেলল সে, তারপর দু‘জনেই হুড়মুড় করে পড়ে গেল ছয় ফুট নিচু খাদে, বড় পাথরটার পিছু পিছু।

মহা হাঙ্গামা লেগে গেল ওদের মধ্যে। ঠিক কি হয়েছে বুঝতে না পেরে যার যা খুশি তাই বলে চিৎকার জুড়ে দিল। সকল চিৎকারকে ছাপিয়ে উঠল আহতদের কাতরানি। শোরগোল একটু স্তিমিত হতে দেখা গেল নিচের খাদে ঘাসের উপর বসে আছে একজন নিজের পা ধরে, সেটা ভেঙে গেছে গোড়ালির একটু উপরে। আরেকজন কোমর বাঁকা করে কাতরাচ্ছে, ব্যথায় নাকি জান বেরিয়ে যাচ্ছে তার!

দলপতিকে চিনতে পারল রানা। সোভাক! প্রায় ছয় ফুটের মত লম্বা, কাঁধ পর্যন্ত লাম্বা চুল, পেটা লোহার মত শরীরটা। ‘কানা নাকি, অ্যাঁ?’ খেঁকিয়ে উঠল সে। ‘কোথায় কি আছে দেখে পা ফেলতে পারো না?’

নিতম্বে হাত রেখে আহত লোকটা ভেঙে পড়ল কান্নায়, ‘পা ফেলার দোষ হয়নি, সোভাক। পাথরটা এমনি এমনিই গড়িয়ে পড়েছে আমার ওপর।’

মাত্র বিশ ফুট দূরে ঝোপের ভিতর শুয়ে নিঃশব্দে হাসছে রানা।

খাদ থেকে দ্বিতীয় লোকটা কাতরাচ্ছে। ‘আমার পা! আমার পা! সোভাক রে, আমার পায়ের হাড় ভেঙে গেছে…’

খাদে নেমে লোকটার পা পরীক্ষা করতে শুরু করল সোভাক। নিঃশ্বাস আটকে রেখে অপেক্ষা করছে রানা। ফাঁদটার অস্তিত্ব যদি প্রকাশ হয়ে পড়ে তাহলে পরিকল্পনার বাকি অংশটা ভণ্ডুল হয়ে যাবে। সাবধান না হয়ে এখান থেকে এক পা সামনে বাড়বে না ওরা। ভাগ্য ভাল, স্বীকার করল রানা, সোভাক দেখতে পায়নি সুতোটা। হয় সেটা ছিঁড়ে গেছে নয়তো পাতার নিচেই রয়েছে, এখনও।

উপরে উঠে দু’কোমরে হাত রাখল সোভাক। ‘কী অলক্ষুণে কাণ্ড! পাঁচ মিনিটও হয়নি, এর মধ্যে অচল হয়ে গেল একজন-নাকি দু‘জন… কি অবস্থা তোমার, টম?’

‘ব্যথায় হাড় ফেটে গেছে কিনা ঠিক…’

খেঁকিয়ে উঠল সোভাক। ‘বুঝেছি, ইনিয়ে-বিনিয়ে ব্যাখ্যা করতে হবে না আর। আর সবাই খানিকপরই এসে পড়বে। তুমি কার্টারের সঙ্গে এখানেই থাকো। আমি আর স্মিথ আগে বাড়ি। প্রতি সেকেণ্ডে এগিয়ে যাচ্ছে ব্যাটা। এসো, স্মিথ।’

ওদেরকে চোখের আড়াল হতে সময় দিল শুধু রানা, পরমুহূর্তে ঝোপ থেকে বেরিয়ে মাথা নিচু করে নিঃশব্দ পায়ে দ্রুত এগোল সামনের দিকে। কার্টার পা ধরে কাতরাচ্ছে, তার উপর ঝুঁকে পড়েছে টম, ওর দিকে পিছন ফিরে।

এখন আর ছুটছে না রানা। কোমর ভাঁজ করে, মাথাটা যথাসম্ভব নুইয়ে দ্রুত এগোচ্ছে ও। ছাল ছাড়ানো ডালের মোটা মুগুরটা ওর ডান হাতে! শেষ মুহূর্তে কিছু একটা যেন আঁচ করতে পারল টম। ঝট করে পিছন দিকে তাকাল সে।

কিন্তু রানাকে দেখতেই পেল না। মোটা ডালটা তার নাকের উপর পড়াতে থ্যাচ করে শব্দ হলো একটা। হুড়মুড় করে কার্টারের উপর পড়ল সে।

ইতিমধ্যে শটগানটা তুলে নিয়েছে রানা মাটি থেকে। ‘খবরদার! চেঁচালেই সাবাড় করে দেব!’ কার্টারের আতঙ্কিত দুচোখের মাঝখানে তাক করল রানা শটগানের নল। ‘একবার মাত্র বলব, কথা না শুনলে গুলি বেরুবে এটা থেকে।’ যথা সম্ভব কঠিন করল রানা কণ্ঠস্বর, ‘চোখ বোজো!’

ভাঙা পায়ের ব্যথা, তার উপর এই অপ্রত্যাশিত বিপদ, ঠক ঠক করে কাঁপছে, কার্টার। দ্রুত চোখ বুজল সে। কিন্তু রানার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে আবার চোখ খুলতে যাবে, এমনি সময়ে ঠিক চাঁদি বরাবর পড়ল মুগুরটা। ঠাস করে আওয়াজ হলো। মুখ তুলল ও। না, দেখা যাচ্ছে না সোভাক বা স্মিথকে। ফিরে আসছে না কেউ।

কার্টারের গা থেকে টেনে হিঁচড়ে নামাল রানা অচেতন টমকে। কোমর থেকে বেল্ট খুলে নিয়ে ছুরি দিয়ে দু‘টুকরো করল সেটাকে। পা এবং হাত জোড়া বেঁধে তার মুখে রুমাল গুঁজে দিল একটা।

আর এক মুহূর্ত দেরি করল না রানা। শটগানটা হাতে নিয়ে সোভাক আর, স্মিথের উদ্দেশে ছুটল।

চার মিনিটের বেশি পেরোয়নি, ভাবছে রানা। কর্দমাক্ত জায়গাটায় ওরা পৌছুবার আগেই সেখানে ওকে পৌঁছে যেতে হবে। অবশ্য ওদের পথটা বিরাট একটা অর্ধবৃত্ত রচনা করে এগিয়ে গেছে, কিন্তু রানা ছুটছে সরলরেখা ধরে। তার মানে অনেক কম দূরত্ব পেরোতে হবে ওকে। যতটা সম্ভব দ্রুত দৌড়ে ওদের আগেই পৌঁছে গেল রানা নির্দিষ্ট জায়গায়। পথের পাশে একটা লম্বা ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে।

ওদের এগিয়ে আসার শব্দ পাওয়া গেল। আগে আগে আসছে সোভাক, সেই কাদার মধ্যে রানার পায়ের ছাপ দেখতে পেল। ‘স্মিথ! পথ ভুল করিনি আমরা। এদিক দিয়েই গেছে ব্যাটা। পায়ের দাগ দেখো, খানিক আগেই গেছে।’

রানাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল সে। তাকে যেতে দিল রানা। পাঁচ সাত হাত পিছনে স্মিথ। মাথা নাড়ল রানা। তোমাকে যেতে দিচ্ছি না! দুই হাতে ব্যারেল ধরে উল্টো করে তুলল বন্দুকটা মাথার উপর। স্মিথের মাথাটা দেখা দিতেই সাঁই করে নামিয়ে আনল সেটা।

কাদার উপর ধপাস করে পড়ল শরীরটা। জ্ঞান হারিয়েছে স্মিথ আগেই। আওয়াজ পেয়ে ‘কি হলো,’ বলেই চরকির মত ঘুরল সোভাক। প্রথম দেখল সে “টিগানের নল, ওর বুক থেকে মাত্র দুই হাত দূরে। তারপর দেখল শটগানধারী রানাকে। ‘রাইফেল ফেলো’ নির্দেশ দিল রানা।

নির্দেশ পালন করতে দ্বিধা করল না সোভাক। বোকার মত দেখাচ্ছে তাকে। কাদার মধ্যে ছেড়ে দিল সে রাইফেলটা।

‘বিগ প্যাট কোথায়?’

দ্রুত সামলে নিচ্ছে সোভাক নিজেকে। রানার প্রশ্ন শুনে ঠোঁট বাঁকা করে হাসল। ‘আকাশে—তোমাকে নিতে আসছে সে।’

‘খুশির খবর,’ মুচকি হেসে বলল রানা। অবাক হয়ে গেল সোভাক। শটগানটা নাড়ল রানা। সোভাককে পথ ছেড়ে দিয়ে সরে গেল খানিকটা। ‘স্মিথকে কাঁধে তুলে নাও। বয়ে নিয়ে চলো ফিরতি পথে। সাবধান, রাইফেলটার দিকে হাত বাড়িয়ো না। উড়িয়ে দেব মাথার খুলি।’

নিঃশব্দে এগিয়ে গেল সোভাক। স্মিথের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

‘কুইক!’ তাড়া লাগাল রানা!

বিমূঢ় একটা ভাব ফুটে উঠেছে সোভাকের চোখমুখে। রানার উদ্দেশ্য বুঝতে পারছে না। পিছন থেকে রানা শটগানের নল দিয়ে গুতো মারতে আসছে দেখে আড়াতাড়ি কাঁধে তুলে নিল সে অজ্ঞান দেহটা।

ফাঁদের কাছে ফিরে এল ওরা। সোভাককে দেখেই চিৎকার করে উঠতে গেল টম, কিন্তু তার পিছনে রানাকে দেখতে পেয়েই হপ্ করে বুজে ফেলল মুখটা। স্মিথের জ্ঞানহীন দেহটা রানার কথামত খাদের নিচে, টমের শরীরের উপর ফেলল সোভাক। তারপর অত্যন্ত ধীর ভঙ্গিতে নিচে নামল সে। তারপর কয়েক পা হেঁটে দুয়ে সরে গেল ও।

এক হাতে শটগান নিয়ে নামতে গিয়ে অসুবিধে বোধ করল রানা। লাফ দিল ও। ওর পতনের আওয়াজ পেয়েই চরকির মত ঘুরল সোভাক। কিন্তু রানা ইতিমধ্যেই তাল সামলে নিয়ে শটগান তুলে ধরেছে দেখে স্থির হয়ে গেল, চোখের

পাতা পর্যন্ত নাড়তে সাহস পেল না আর।

‘প্যান্ট খোলো,’ সোভাককে বলল রানা।‘ওটা দিয়ে স্মিথের হাত-পা বাঁধো।

দাঁতে দাঁত ঘষল সোভাক। কিন্তু বোতাম খুলতে শুরু করল প্যান্টের।

‘স্মিথের হাত-পা বাঁধার কাজ শেষ করে এনেই রানাকে ধরাশায়ী করার শেষ চেষ্টা করল সোভাক। তার ভাগ্য খারাপ, কেননা ঠিক সেই মুহূর্তে পিছন থেকে উল্টো করে শটগান তুলছিল রানা কুঁদো দিয়ে মাথায় আঘাত করার জন্যে। বিদ্যুৎবেগে একপাশে সরে গিয়ে লাফ দিল সোভাক রানার দিকে। শটগানের কুঁদোটা পড়ল তার চোয়ালে। থমকে দাঁড়িয়ে গেল, সোভাক ব্যথায় বিকৃত হয়ে গেছে চোখমুখ।

এক পা পিছিয়ে গিয়ে প্রচণ্ড শক্তিতে সোভাকের পাঁজরে একটা লাথি মারল রানা। বালির বস্তার মত ধুপ করে পড়ল সোভাক মাটিতে। লাখির সঙ্গে সঙ্গেই কড়াৎ করে একটা শব্দ এসেছিল সোভাকের পাঁজর থেকে, কিন্তু সেদিকে মোটেই খেয়াল দিল না রানা।

সোভাকের শরীর সার্চ করে একটা বিনকিউলার; ছোট একটা হাতুড়ি, বুলেট আর একজোড়া হাতকড়া পেল রানা। স্মিথের পকেট হাতড়াবার সময় আর হলো না।‘কপ্টারের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ফিরে আসছে পাইলট। বিগ প্যাট কি থাকবে দলে? ভাবছে রানা।

কাগজ কলম বের করে দ্রুত একটা লাইন লিখল রানা ইংরেজিতে।‘এই পরিণতি যার কাম্য সে যেন আমার পিছু নেয়—রানা।’

কাগজের টুকরোটা কোথায় রাখা যায় ভাবতে ভাবতে এদিক ওদিক তাকাল ও। সোভাকের খোলা মুখটা পছন্দ হলো ওর। হাঁ করা মুখের ভিতর চিরকুটটা গুঁজে দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। হাতে শটগান।

দ্রুত উঠে যাচ্ছে হাইল্যাণ্ডের দিকে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *