গ্রাস – ১৯

উনিশ

নিচু হয়ে স্যাঁৎ করে এক পাশে সরে গেল রানা। প্রচণ্ড বেগে কি একটা ধাক্কা খেল ওর পিঠে বাঁধা ব্যাগের সাথে। তাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল রানা মাটিতে। আশপাশে টর্চের আলো চঞ্চল হয়ে খুঁজছে ওকে। আলোটা গায়ে পড়তেই পাঁজরে একটা লাথি খেলো রানা। উন্মত্তের মত গড়িয়ে দূরে সরে যেতে চেষ্টা করছে ও, বুঝতে পারছে উঠে দাঁড়াতে না পারলে লাথি খেয়ে শেষ নিঃশ্বাস ভাগ করতে হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। কাঠুরেদের এই বুটগুলো অসম্ভব ভারি হয়, ধারে লোহার পাত মোড়া থাকে, জুতসইভাবে লাগলে পাঁজরের খাঁচাটা টুকরো টুকরো করে দিতে পারে, ফুসফুসে সেঁধিয়ে দিতে পারে ভাঙা হাড়।

ব্যাগটা পিঠের সাথে সেঁটে থাকায় গড়াতে অসুবিধে হচ্ছে রানার। প্রাণপণে চেষ্টা করছে টর্চের আলোটা থেকে দূরে সরে যেতে। দুই জোড়া পা দেখতে পাচ্ছে ও দুই পাশে। কর্কশ একটা কণ্ঠস্বর থেকে হুকুম এল, “জায়গা বেছে মার শালাকে, যেন আর নড়তে না পারে।

লক্ষ্যচ্যুত একটা লাথি উরুর পিছন দিকে লাগল রানার। কাত হয়ে পাল্টা লাথি চালাল সে। ডান পায়ের সাথে সংঘর্ষ হলো একজন লোকের তলপেটের। কোঁক করে একটা বিচিত্র আওয়াজ বেরিয়ে এল লোকটার গলা থেকে, মাটির দিকে মাথা করে পড়ল সম্ভবত লোকটা, শরীরটা গায়ের উপর পড়তে দেখে অনুমান করল রানা। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা এক ঝটকায়। মাথা নিচু করে আরেক লোক ঝড় তুলে এগিয়ে আসছে দেখতে পেল ও। অপর লোকটা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে হাতে টর্চ নিয়ে, গা ঢাকা দেবার কোন সুযোগই সে দিচ্ছে না রানাকে। তবে লাভ এইটুকু, ভাবল রানা, লোকটা নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে থাকায় অবশিষ্ট মাত্র একজনের সাথে লড়তে হবে ওকে।

চোখের পলকে কাছে এসে পড়ল ষাঁড়টা। কাত হয়ে একটা পা তুলল রানা, বিদ্যুৎবেগে নামিয়ে আনল লোকটার হাঁটুর মাথায়, চামড়া তুলে নিয়ে মাঝখান পর্যন্ত নামল রানার বুট, তারপর হাড়ের উপর দিয়ে পিছলে পায়ের উপর থামল। সেই সাথে সোলার প্লেকসাস বরাবর প্রচণ্ড এক ঘুসি খেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটা। চিৎকার করে উঠল ব্যথায়।

কাছে পিঠেই কোথাও থেকে ব্যাপার কি জানার জন্যে হাঁক ছাড়ল কেউ। কয়েকজনের ছুটন্ত পদশব্দ শুনতে পাচ্ছে রানা। ওদের ডাকে সাড়া দিল টর্চধারী—ডাকছে।

সময় নেই বুঝতে পেরে কলার চেপে ধরে হ্যাঁচকা টান মারল রানা লোকটাকে সামনের দিকে। স্বাভাবিক আত্মরক্ষার তাগিদেই রানার টান প্রতিরোধ করবার জন্যে পিছন দিকে জোর করছে লোকটা। হঠাৎ ঢিল দিল রানা, লোকটা এক পা পিছিয়ে গেল তাল সামলাতে গিয়ে এবং সাথে সাথেই এক পা সামনে এগিয়ে এসে হিপ-থ্রো করল রানা। হাত-পা ছড়িয়ে শূন্যে উঠে গেল লোকটা, উড়ে গিয়ে পড়ল টাধারীর ওপর। হুড়মুড় করে পড়ল দু‘জনই মাটিতে। ঠকাশ করে মাটিতে পড়েই নিভে গেল টর্চ। অন্ধকার। দ্রুত পদশব্দ এগিয়ে আসছে।

আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না রানা। গোটা দলটা এসে পড়লে প্রাণ নিয়ে ফিরে যাওয়া কঠিন হবে। দ্রুত এগোল রানা ফিরতি পথে। শহর থেকে দূরে।

মাঝরাত নাগাদ জঙ্গলের ‘গভীরে প্রবেশ করল রানা। দম হারিয়ে নেতিয়ে পড়েছে, প্রচণ্ড ক্লান্তিতে অন্ধকার দেখছে চোখে। পরিশ্রান্ত শরীর, অবসন্ন মন। শহর থেকে ধাওয়া করা হয়েছিল ওকে, আর একটু হলে ধরাই পড়ে গিয়েছিল, ঝাড়া একঘন্টা দৌড়ে পিছনের লোকগুলোকে দমিয়ে দিতে পারলেও বিশ্রাম নেবার জন্যে একটা জায়গায় হাজির হয়ে থামতেই অপর একটা দলের সামনে পড়ে গিয়েছিল। লাফ দিয়ে ওদের নাগালের বাইরে সরে গিয়ে উত্তর দিকে প্রাণপণে ছুটতে শুরু করে রানা। জঙ্গল পর্যন্ত ধাওয়া করে ওকে তারা। তারপর তাদের আর কোন সাড়াশব্দ পায়নি। দিক পরিবর্তন করে পশ্চিম দিকে চলে এসেছে ও।

আর যাই হোক, বয়েডের লোকেরা ভাবতেই পারবে না যে পশ্চিম দিকে চলে এসেছে ও। হিংস্র পশুদের দখলে পশ্চিমের জঙ্গল, আত্মহত্যা করতে না চাইলে এদিকে পা বাড়াবার ইচ্ছে জাগতে পারে না কারও।

লাভ হবে মনে করে পশ্চিম দিকে এগোতে শুরু করেনি রানা। কিছুটা স্বস্তিকর সময় পাবার আশাতেই এদিকে পা বাড়িয়েছে। খানিক বিশ্রাম দরকার। দরকার পরবর্তী কর্তব্য স্থির করার জন্যে চিন্তাভাবনার অবসর। মাথার প্রায় ওপরে উঠে এসেছে চাঁদটা। শক্ত পাথরের মধ্যে একটা গর্ত দেখতে পেল রানা। সেটার ভিতর ঢুকে কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে হালকা হলো। হাঁটু ভেঙে পড়তে চাইছে ক্লান্তিতে। ধপ্ করে বসে পড়ল শক্ত পাথরের উপর। দশ ঘণ্টা একনাগাড়েই বলা যায়, খুনী একদল লোকের ধাওয়া খেয়ে ছুটোছুটি করতে হয়েছে ওকে।

চোখে অন্ধকার আরও একটা কারণে দেখছে রানা। খিদে। কিন্তু কোমরের বেল্টটা আরও একটু এঁটে রেঁধে নেয়া ছাড়া করার কিছুই দেখল না ও।

আপাতত এখানে ও নিরাপদ, ভাবছে রানা। কোথায় ও লুকিয়ে আছে তা অনুমান করতে পারলেও রাতের বেলা অনুসন্ধানী দলগুলোকে সংগঠিত করা সম্ভব নয় বয়েডের পক্ষে। সম্ভাব্য বিপদ আসতে পারে, নিজের অজ্ঞাতে কেউ যদি ভুল করে এদিকে এসে পড়ে।

বিশ্রাম আর ঘুম দরকার। দরকার এই জন্যে যে আগামীকালটা আজকের চেয়েও অনেক বেশি চাপ সৃষ্টি করবে ওর উপর। টিকে থাকতে হলে শক্তি একান্তই দরকার, ফিরিয়ে আনতে হবে শরীরে।

বুট খুলে মোজা বদলাল রানা। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের একমাত্র বন্ধু এখন ওর পা দুটো, সামনের দিকে মেলে দিয়ে একটা পাথরে হেলান দিল রানা, ঢিল করে দিল পেশীগুলো। ব্যাগ থেকে ক্যানটিনটা বের করে দু‘ঢোক পানি খেল ও। একটা ঝর্ণা থেকে ক্যানটিনটা ভরে নিয়েছিল এক সময়, আবার কোন ঝর্ণার সাক্ষাৎ না পাওয়া পর্যন্ত এই পানিতেই কাজ চালাতে হবে।

সারাদিনে এই প্রথম নিশ্চিন্তে বসে চিন্তা করার সুযোগ পেয়েছে রানা। এর আগে সারাক্ষণ বেঁচে থাকার সংগ্রামে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে।

প্রথমে শীলার কথা মনে পড়ল। কোথায় সে? কি ঘটেছে তার কপালে? দুপুরের দিকে বেরিয়েছিল সে..হ্যামিলটনের দেখা পাক বা না পাক, লংফেলোর কেবিনে সন্ধ্যার আগেই তার ফেরার কথা। কিন্তু বয়েডকে বক্তৃতা দিতে শোনার সময় শীলার নাম গন্ধ পর্যন্ত পায়নি ও।

দুটো ঘটনা ঘটতে পারে, ভাবছে রানা। এক, কেবিনেই ছিল সে, কিন্তু পুসির হাতে বন্দী হয়ে, তাই তাকে বাইরে বেরুতে দেখেনি ও। দুই, কেবিনে সে ছিল না। এবং কেবিনে যদি না থাকে, আর কোথায় সে যেতে বা থাকতে পারে ভেবে পেল না ও।

এরপর, লংফেলো। যেভাবেই হোক তার শটগানের আওতা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছিল বয়েড। তার মানে. লংফেলো খুব সম্ভব আহত হয়েছে। মারা গেছে কি?

বুকটা কেঁপে গেল রানার। বয়েডের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। কিন্তু খুন করে থাকলে লাশটা করল কি?

না, ধারণাটা ঠিক বলে মনে হচ্ছে না ৷ ভাবছে রানা কেন যেন মনে হচ্ছে লংফেলো আর শীলার কপালে যাই ঘটুক, একই ধরনের কোন ঘটনার শিকার হয়েছে তারা ৷ হয়তো দু‘জনেই বন্দী হয়েছে বয়েডের হাতে। তাই যদি হয়, বয়েড় তাদের রেখেছে কোথায়?

যেভাবেই রাখুক, তাদেরকে খুন করার ব্যাপারে বা অন্য কোন ব্যাপারে এই মুহূর্তে চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত নেবে না বয়েড। তার এক নম্বর অবজেকটিভ এখন ওকে ধরা’। ওকে ধরতে না পারা পর্যন্ত আর কোন ব্যাপরে মাথা ঘামাতে চাইবে না সে।

বয়েডের ভাষণ। প্রতিটি বাক্য কানে বাজছে রানার তার নির্দেশগুলোর অর্থ কি? যেখানে ধরা পড়বে ও, রয়েড সেখানে নিজে পৌঁছে গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করবে। এর অর্থ কি? ওকে নিয়ে কি করবে সে?

পরিস্থিতিটা ভাবতে গিয়ে গা শির শির করে উঠল রানার। ওকে নিয়ে বয়েডের আর কি করার আছে ভেবে পেল না ও, খুন করা ছাড়া।

প্রকাশ্যে খুন করতে পারে না ওকে সে। তার নিরে লোকেরাও সেটা মেনে নেবে কিনা সন্দেহ। তাছাড়া, সাক্ষী রেখে খুন করার মত বোকামি কেনই বা করতে যাবে সে? কিন্তু, ধরা যাক, ‘দুর্ঘটনাবশত’ যদি ও খুন হয়?—ভাবছে রানা।—ধরা যাক, বয়েড যদি বলে আত্মরক্ষা করতে গিয়ে খুন করেছে ও? এ ধরনের মিথ্যে ব্যাপার নানাভাবে সাজানো সম্ভব। কিংবা, বয়েড ঘোষণা করতে পারে, তাকে ফাঁকি দিয়ে ‘পালিয়েছে’ ও, পালিয়েছে ফোর্ট ফ্যারেল ছেড়ে চিরকালের জন্যে। কারও কিছু বলার আছে? গভীর জঙ্গলে একটা লাশ পোঁতার জায়গার কোন অভাব হবে না তার। খুঁজলে সেটা একশো বছরের আগে পাওয়া নাও যেতে পারে।

এসব চিন্তার ফলে নতুন করে দেখতে ইচ্ছে হলো রানার বয়েডকে। কি কারণ, কেন খুন করতে চায় বয়েড ওকে? উত্তর: কারণ, গাফ পারকিনসন নয়, সে, অর্থাৎ, বয়েডই অ্যাক্সিডেন্টের সাথে কোন না কোনভাবে জড়িত ছিল। জড়িত ছিল—কিন্তু কিভাবে? উত্তর: সম্ভবত ব্যক্তিগত উদ্যোগে দুর্ঘটনার ব্যাবস্থা করেছিল সে সম্ভবত সে একজন নিষ্ঠুর খুনী, ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা যার স্বভাব।

দুর্ঘটনার সময় গাফ কোথায় ছিলেন সে ব্যাপারে খবর নিয়েছে রানা, কিন্তু বয়েডের ব্যাপারে কথাটা মনে পড়েনি। মোটিভ এবং যোগ্যতা আর একজনের ছিল, তাই বিশ বছরের এক নব্য যুবককে সন্দেহ করতে তখন সায় দেয়নি রানার মন। ভুলটা ওখানেই করেছে ও। কোথায় ছিল বয়েড দুর্ঘটনার সময়? উত্তর: জানা নেই। জানা নেই, ভাবল রানা, কিন্তু অনুমান করে নেয়া কঠিন কিছু নয়।

ওকে ধরে ফোর্ট ফ্যারেলে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে না বয়েড। তা গেলে সত্য প্রকাশ হয়ে পড়ার ভয় আছে। নিজেকে বাঁচাতে হলে বয়েডের আর কোন উপায় নেই, ঠাণ্ডা মাথায় আরেকটা খুন করা ছাড়া।

মৃদু শিউরে উঠল রানা। একটা কথা ভেবে হাসল পরমুহূর্তে। বয়েডের হাত থেকে সহজেই আত্মরক্ষার একটা উপায় আছে. দেখতে পাচ্ছে ও। প্রথমে আরও পশ্চিমে, তারপর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এগিয়ে স্টুয়ার্ট বা প্রিন্স রুপার্টে পৌঁছুতে পারে ও, উপকূল ধরে হারিয়ে যেতে পারে। ফোর্ট ফ্যারেলে আর কোনদিন ফিরে না এলেও চলে। কি বিদঘুটে আর অপ্রাসঙ্গিক কল্পনা, ভেবে হাসি পেল রানার। কেনেথের বুদ্ধিদ্বীপ্ত চোখ দুটো ভেসে উঠল মনের পর্দায়। আমি কে? জিজ্ঞেস করেছে রানাকে। আমি কেনেথ, না টমাস? কার কি করেছি আমি, এভাবে কেন মেরে ফেলা হলো আমাকে?

কঠিন হয়ে উঠল রানার মুখের চেহারা। চোখ বুজে কেনেথকে ভুলে যেতে চাইল ও। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে হালকা করতে চেষ্টা করল বুকটাকে।

ব্যাগ থেকে একটা কম্বল বের করে গায়ে জড়িয়ে নিল রানা। ধীরে ধীরে শুয়ে পড়ল লম্বা হয়ে। আকাশের গায়ে মিটমিট করছে অল্প ক’টা তারা। কয়েকটাকে পরিচিত লাগল। কিন্তু নামগুলো স্মরণ করার আগেই নিজের অজান্তে ঘুমে ঢলে পড়ল ও।

***

ভোরের তাজা বাতাস আর ফর্সা আলোয় মাথা খুলে গেল রানার। গুরুত্বপূর্ণ দুটো সিদ্ধান্ত নিল ও। এক, বয়েডের বিরুদ্ধে নিজের পছন্দসই জায়গায় দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে হবে ওকে, যে জায়গাটা ভালভাবে চেনা আছে ওর। অর্থাৎ কাইনোক্সি উপত্যকা। পারকিনসন করপোরেশনের পক্ষে সার্ভে করার সময় উপত্যকাটার পুরোটা চষে বেড়িয়েছিল ও। ওখানে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করে টিকে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

দুই. বয়েডের বাহিনীকে ক্ষতির মুখ দেখাতে হবে। ওকে ধাওয়া করাটা যে মস্ত এক লোকসানের ব্যাপার তা বুঝিয়ে দিতে হবে হাড়ে হাড়ে। বাহিনীর তিনজন ইতিমধ্যেই উপযুক্ত শিক্ষা পেয়েছে, যথা সম্ভব আরও বেশি সংখ্যক লোকের মনে ভয়টা ঢুকিয়ে দিতে হবে। পিছন থেকে খসাতে হবে বাহিনীটাকে। কাজটা সহজ নয়। প্রচুর ঝুঁকি নিয়ে প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলতে হবে রানাকে। এমন উচিত শিক্ষা দিতে হবে ওদের যাতে পাঁচ হাজার ডলার রোজগার করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হয় ওরা।

রোদ ওঠার আগেই রওনা হলো রানা উত্তর দিকে। ধারণা করল, ফোর্ট ফ্যারেলের বারো মাইল পশ্চিমে রয়েছে ও এই মুহূর্তে। অর মানে কাইনোক্সি উপত্যকার উপর পর্যন্ত লম্বা রাস্তাটার সাথে সমান্তরালভাবে এগোচ্ছে ও।

খিদে রয়েছে, কিন্তু এখুনি অচল করে দেবার মত সমস্যা হয়ে উঠছে না সেটা। রানা অনুমান করল, প্রয়োজন হলে আরও দেড় দিন না খেয়ে হাঁটতে পারবে ও।

প্রতি ঘণ্টায় একবার থেমে পিছন দিকটা দেখে নিচ্ছে রানা। দীর্ঘ পথে দীর্ঘক্ষণ হাঁটলে দিক ভুল হবার সমূহ আশঙ্কা থাকে। তাই এই সাবধানতা। নিশ্চিত হয়ে নিয়ে আবার এগোচ্ছে ও। ঘণ্টায় আড়াই মাইল, খারাপ গতি নয়, ভাবল। এলাকাটা দুর্গম, সে হিসেবে বরং বেশ ভালই বলা চলে।

হাঁটতে হাঁটতেই দু‘পাউণ্ড খাদ্য সংগ্রহ করল রানা। মাশরুম। কিন্তু কাঁচা মাশরুম কখনও খায়নি ও। এখনও খাবার কোন ইচ্ছে নেই। জিভে পানি এলেও পকেট থেকে সেগুলো বের করতে চাইল না রানা।

ঘণ্টায় পাঁচ মিনিট করে বিশ্রাম নিল। এর বেশি সময় নষ্ট করতে সায় দিচ্ছে না মন,। তাছাড়া, ও জানে, পাঁচ মিনিটের বেশি বিশ্রাম নিলে পায়ের পেশী শক্ত হয়ে উঠে অচল করে দিতে পারে ওকে। ঝুঁকিটা কোনভাবেই নেয়া চলে না।

দুপুরেও কোথাও থামল না রানা। পাঁচ মিনিটের নির্ধারিত বিশ্রামের সময় শুধু পায়ের মোজা দুটো বদলে পরল নতুন এক জোড়া। ঝর্ণার পানিতে পুরানো জোড়া ধুয়ে ব্যাগের সাথে আটকে নিল ক্লিপ দিয়ে, হাওয়া লেগে যাতে তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। পানির ক্যানটিনটা ভরে নিয়ে আবার উত্তর দিকে এগোতে শুরু করল।

সূর্য ডোবার দু‘ঘন্টা আগে উঁচু একটা টিলার মাথায় শেষবারের মত থামল রানা। আজকে এই পর্যন্ত। টিলাটার উপর থেকে উপত্যকার দুটো দিকই বেশ ভাল দেখা যাচ্ছে। ব্যাগ রেখে আধঘন্টা ধরে ঘুরেফিরে চারদিকটা দেখল ও। নিশ্চিত হলো, কেউ নেই আশপাশে। ফিরে এসে ব্যাগ খুলে কয়েকটা ফাঁদ বের করল রানা। প্রথম যখন ফোর্ট ফ্যারেলে আসে তখন এই ফাঁদ ক’টা সাথে করে নিয়ে এসেছিল ও। পারকিনসন করপোরেশনের পক্ষে সার্ভে করার সময় একনাগাড়ে পনেরো দিন সভ্যতার সাথে কোন সম্পর্ক রাখতে পারেনি ও, তখন তাজা মাংসের অভাব পূরণ করেছিল এই ফাঁদগুলো।

ঠিক সূর্য ডোবার আগে খরগোশগুলো আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ঘাসের উপর খেলা করে, লুটোপুটি খায়। ফাঁদগুলো খানিকটা দূরে পেতে রেখে এল রানা।

সূর্য দিগন্তরেখার কাছাকাছি পৌঁছতে আগুন জ্বালাবার আয়োজন সম্পন্ন করল ও। নুড়ি পাথর দিয়ে ঘিরে নিল জায়গাটা। কাঠ কেটে এনে জড়ো করল পাশে। তারপর আগুন ধরাল। চুলোটার কাছ থেকে একশো গজ পিছিয়ে গেল রানা আগুন দেখতে পাওয়া যায় কিনা পরীক্ষা করার জন্যে। জানা আছে, তাই ওটার অস্তিত্ব টের পেল ও। কিন্তু বুঝল, আর কারও পক্ষে আবিষ্কার করা সম্ভব নয়। ফিরে এসে একটা অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে পানি ঢেলে চুলোয় বসাল সেটাকে। ফুটন্ত পানিতে মাশরুম সেদ্ধ হতে দিয়ে ফাঁদ পেতে কিছু লাভ হয়েছে কিনা দেখতে গেল ও ৰু প্ৰথম দুটো ফাঁদে কিছুই দেখল না, কিন্তু তৃতীয়টায় মাঝারি আকারের একটা খরগোশ আটকা পড়েছে। দেড় পোয়ার বেশি হবে না মাংস, অনুমান করল রানা। ভাবল, নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল। দেড় পোয়া মাংস কম হলো কিসে?

পেট পুঁজো সেরে চারদিকটা আরেকবার দেখে এল রানা। ঝুঁকি নিয়ে সিগারেট ধরাল একটা। ধারণা করল প্রায় ত্রিশ মাইল এগিয়েছে ও উত্তর দিকে। এখান থেকে এখন যদি তির্যকভাবে উত্তর-দক্ষিণের পাহাড়ী পথ ধরে আরও পনেরো মাইল পেরোলেই কাইনোক্সি উপত্যকায় পৌঁছতে পারবে। ওঠার পথে পারকিনসনদের লগিং ক্যাম্প পড়বে। ক্যাম্পের কাছাকাছি গেলে বিপদ হতে পারে। কিন্তু বিপদের তোয়াক্কা করলে তা আরও বাড়বে, কমবে না, ভাবল রানা। পাল্টা আঘাত হেনে নিস্তেজ এবং ক্রমশ নিশ্চিহ্ন করতে হবে বিপদকে।

লগিং ক্যাম্পে যাবে, ঠিক করল রানা। কিছু একটা গোলমাল করতে হবে ওখানে।

পরদিন দুপুর। মাটির একটা উঁচু ঢেউয়ের মাথায় চড়ে কাইনোক্সি উপত্যকা দেখতে পেল রানা। শেষবার যখন দেখেছিল তার চেয়ে নতুন পারকিনসন, লেক বেশ অনেকটা বিস্তৃত হয়েছে। গাছ কেটে নেয়া বিশাল এলাকার তিন চতুর্থাংশই এখন জলমগ্ন। ওখান থেকে আরও বারো মাইল এগোল রানা। লগিং ক্যাম্পটা দেখতে পেয়ে অদ্ভুত একটা খুশি অনুভব করল ও। ওদের বিরুদ্ধে কিছু একটা করার এই প্রথম একটা সুযোগ পাচ্ছে রানা। এর আগে যা কিছু করেছে সবই ঠেকায় পড়ে। এখন তা নয়, ক্ষতি করার ইচ্ছা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েছে ও কিছু একটা দেখাবার জন্যে। নিজের ভেতরে একটা চাপা রাগ অনুভব করছে সে—তাঁড়া খাওয়া জানোয়ারের আক্রোশ।

ক্যাম্পটার চারদিকে বড় বেশি খোলা জায়গা। ব্যাপারটা পছন্দ না হলেও কিছু করার নেই ওর। ঠিক করল, রাতের অন্ধকারে এগোতে হবে ওকে। দিনের অবশিষ্ট আলো সমস্যাটার সঠিক স্বরূপ বিবেচনা করার পিছনে ব্যয় করল ও।

ক্যাম্পে লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে, এটা আবিষ্কার করে প্রথমেই মন খারাপ হয়ে গেল রানার। যাও বা দু‘একজন আছে তারা সবাই বুড়ো। পাহারা দেয়া আর রান্নাবান্নার কাজ করার জন্যে এদেরকে রেখে আর সবাই চলে গেছে! কোথায়? উত্তরটা পেতে অসুবিধে হলো না রানার। কাঠুরেদের ডেকে নিয়ে গেছে বয়েড কাজ থেকে, ওর পিছনে লোক সংখ্যা বাড়াবার জন্যে।

ক্যাম্প থেকে ক্ষীণ ধোঁয়া উঠছে আকাশে। রান্না হচ্ছে ভেবে পেটের ভিতরটা খিদেয় কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল রানার। আর কিছু না হোক, ভাবল ও, কিছু খাবার সংগ্রহের প্রয়োজনেও ক্যাম্পে না ঢুকলেই নয়।

দু‘ঘণ্টায় ছয় জন লোককে দেখল রানা। সন্ধ্যার দিকে প্রস্তুত হয়ে ব্যাগ থেকে একটা চাদর বের করে কোমরে বেঁধে নিয়ে ঢালু মাটির উপর দিয়ে নামতে শুরু করুল নিচের দিকে। জঙ্গলটা পরিচিত; সংক্ষিপ্ত পথ ধরে নামতে খুব বেশি সময় বা শ্রম ব্যয় করতে হলো না। দুটো কাঠের ঘরে আলো জ্বলছে, কাছাকাছি পৌঁছে দেখন রানা। একটু থেমে পা বাড়াতে যাবে, বেহালার করুণ সুর কানে ঢুকতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

কে যেন বাজাচ্ছে। করুণ প্রলম্বিত সুর। একইভাবে একই জায়গায় কতক্ষণ পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বলতে পারবে না রানা। সন্ধ্যা তখনও গাঢ় রাতের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। চারদিকের বনভূমি স্থির, নিষ্কম্প—থমথম করছে। রানার বুকের ভিতর অদ্ভুত একটা বেদনার অনুভূতি। উদাস একটা ব্যাকুলতা দোলা দিচ্ছে মনটাকে। চোখের সামনে কল্পনায় দেখতে পেল রানা সাদা দাড়ি ভরা একটা জরাগ্রস্ত মুখ, দু‘গাল বেয়ে অঝোর ধারায় পানি গড়াচ্ছে, কাঁধে বেহালা ঠেকিয়ে ডান হাতে ছড় টেনে চলেছে বৃদ্ধ—মনে পড়ে যাচ্ছে তার সেই প্রথম যৌবনের একটুকরো সোনালী আলোর মত প্রেমিকার মুখ, টুকটুকে লাল ছিল তার গাল-যে মেয়েটিকে কবে কোথায় যেন হারিয়ে ফেলেছে জীবনের দীর্ঘ চলার পথে…

হঠাৎ বেহালার আওয়াজ থামতেই সংবিৎ ফিরে পেয়ে চমকে উঠল রানা। খেই হারিয়ে ফেলেছিল ভেবে লজ্জা পেল মুহূর্তের জন্যে। আলো লক্ষ্য করে পা ফেলল সামনে।

ক্যাম্পের কিনারায় পৌঁছে সবচেয়ে কাছের ঘরটাকে রান্নাঘর বলে অনুমান করল রানা। ধোঁয়া ওটার ভিতর থেকেই বেরিয়ে আসছে চিমনি পথে। দরজাটা আধখোলা। পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে একটা জানালার পাশে পৌঁছুল, উঁকি দিল ভিতরে।

ঘরটার মাঝখানে মস্ত বড় একটা মাটির চুলো। তা থেকে ধোঁয়া উঠছে, কিন্তু আগুন প্রায় নিভু নিভু, দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। ছোট একটা স্টোভ জ্বলছে, একধারে। কি যেন ফুটছে একটা পাত্রে। লোকজন কেউ নেই ভিতরে। নিঃশব্দে দরজা পেরিয়ে ঢুকে পড়ল রানা। রান্নাঘর থেকে পাশের ঘরে যাবার দরজাটা হাঁ-হাঁ করছে। সোজা সেদিকে এগোল।

পাশের ঘরটা অপেক্ষাকৃত ছোট। আলুর বস্তায় ঠাসা। চার দেয়াল জুড়ে কাঠের র‍্যাক, সেগুলোতে টিনে ভরা খাবার জিনিস সাজানো। কোমর থেকে চাদরটা খুলে মেঝেতে বিছাল রানা। ভেজানো দরজাটা, আধইঞ্চি ফাঁক করে রান্নাঘরটা দেখে নিল আরেকবার। তারপর বিনা দ্বিধায়, নিঃশব্দে র্যাক থেকে দুটো করে টিন নামিয়ে পাশাপাশি সাজাতে শুরু করল চাদরের উপর।

পনেরোটা টিন চাদরে বেঁধে কাঁধের সঙ্গে ঝুলিয়ে নিল রানা। দরজা ফাঁক করে দেখতে গিয়ে আঁৎকে উঠল ও। স্টোভের সামনে বুড়ো এক লোক বসে আছে।

আর কোনও দরজা অথবা জানালা নেই ঘরটায়। রান্নাঘর আবার নির্জন না হওয়া পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় দেখল না ও।

পনেরো মিনিট পর স্টোভের কাছ থেকে উঠল লোকটা। টেবিল থেকে লবণ নিয়ে আবার ফিরে এসে বসল স্টোভের সামনে। লোকটা খুঁড়িয়ে হাঁটে, বয়সের ভারে বেশ খানিকটা কুঁজো হয়ে গেছে। ওকে দেখলেই চেঁচিয়ে উঠবে। অথচ বুড়োর গায়ে হাত তোলার প্রশ্নই ওঠে না।

বিপদে পড়ল রানা। লোকটা কি জ্বাল দিচ্ছে, কতক্ষণে শেষ হবে তার রান্নাঘরের কাজ, বুঝতে না পেরে অস্থিরতা অনুভব করল ও। আধঘণ্টার উপর অপেক্ষা করছে, আরও কতক্ষণ বন্দী হয়ে থাকতে হবে কে জানে।

গায়ে হাত না তুলে উপায় নেই, বুড়োকে ভাঁড়ার ঘরের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে বিষণ্ন মনে ভাবল রানা। কিন্তু হঠাৎ মাঝপথে দাঁড়িয়ে পড়ল বুড়ো, ঘুরে দাঁড়াল, তারপর সোজা বেরিয়ে গেল রান্নাঘর থেকে

দ্রুত রান্নাঘরে পা দিল রানা। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকাল! বুড়োটা অদৃশ্য হয়েছে। আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। বাইরে বেরিয়ে জেনারেটারের আওয়াজ লক্ষ করে দীর্ঘ পদক্ষেপে এগোল রানা। ইতিমধ্যেই একটা বুদ্ধি ঢুকেছে মাথায়।

ক্যাম্পের লাগোয়া একটা ঘরে বসানো হয়েছে জেনারেটার। এটার সাহায্যেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে ক্যাম্পে। নিরাপত্তার কথা ভেবে সরাসরি ঘরটায় না ঢুকে আশপাশে ঘুর ঘুর করল রানা দশ মিনিট। কারও সঙ্গে দেখা হলো না ওর। আবিষ্কার করল, পাশের ঘরটাই একজন ডাক্তারের ডিসপেন্সারী। দুটো ঘরের মাঝখানে ডিজেল অয়েলের একটা প্রকাণ্ড ট্যাঙ্ক, কমপক্ষে এক হাজার গ্যালন তেল ধরে। প্রায় ভর্তি রয়েছে ট্যাঙ্কটা।

ক্যাম্পের কামারশালাটা খুঁজে বের করতে দু‘মিনিট লাগল রানার। একটা কুঠার নিয়ে ট্যাঙ্কটার কাছে ফিরে এল ও।

নিচের দিকে হালকা করে কুঠারের একটা ঘা বসাল রানা। কাজ হলো তাতেই। তবে শব্দটা হলো চমকে দেবার মত! লাফ দিয়ে তেল বেরিয়ে আসতে শুরু করার আগেই স্যাৎ করে এক পাশে সরে গিয়ে দ্রুত পিছিয়ে এল রানা।

তেল বেরিয়ে পড়ার শব্দে টনক নড়ল ক্যাম্পের। কে, কি হলো, অমুক কোথায় গেল—এই ধরনের প্রশ্ন ভেসে আসছে এদিক ওদিক থেকে।

আপন মনে হাসছে রানা। দিয়াশলাইয়ের জ্বলন্ত কাঠিটা তেলের স্রোত লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিয়ে সেখানে আর এক সেকেণ্ড দাঁড়াল না ও। হুপ্ করে একটা শব্দ হলো আগুন লাফিয়ে ওঠার। পিছন ফিরে তাকিয়ে রানা দেখল তিন মানুষ সমান লম্বা আগুন মোচড় খাচ্ছে চীনা ড্রাগনের মত।

দ্রুত সরে যেতে শুরু করল রানা। কেউ অনুসরণ করুক তা ওর কাম্য নয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *