গ্রাস – ১৭

সতেরো

ডাক শুনে বেন্টলির কাছ থেকে ছুটে এল শোফার। লংফেলো আস্তিন ধরে আবার সরিয়ে নিয়ে এল রানাকে। ‘বাপকে নিয়ে ছোকরা এখন ব্যস্ত থাকবে,’ বলল সে ফিসফিস করে। ‘কিন্তু একটু সময় পেলেই তোমার দিকে নজর পড়বে ওর। ভেব না তোমাকে সে ছেড়ে দেবে। কয়েক ডজন ডালকুত্তা ফেরার পথ বন্ধ করে দেবে তোমার। চলো, সময় থাকতে কেটে পড়া যাক।’

ইতস্তত করল একটু রানা। বুড়ো গাফের অবস্থা শোচনীয়, ও চাইছে গায়, সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। কিন্তু লংফেলোর যুক্তিটাও অগ্রাহ্য করার মত নয়, অনুধাবন করল ও। পরিস্থিতি এখন যা দাঁড়িয়েছে এখানে থাকলে কোন অনুকূল ফল ছাড়াই ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা। ‘ঠিক আছে, তাই হোক।’

জীপের কাছে যেতে কাঁপা গলায় জানতে চাইল জ্যাক লেমন, ‘ঘটল কি? তুমি বুড়োকে মেরেছ, রানা?’

‘পাগল হলে নাকি তুমি!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল লংফেলো। ‘গাফ হার্ট অ্যাটাকের রোগী, জানো না? কুইক, জীপে ওঠো সবাই।’

‘ড্রিলিং যন্ত্রপাতিগুলোর কি হবে?’ প্রশ্ন করল লেমন।

‘থাক ওগুলো,’ বলল রানা। ওগুলোর কাজ শেষ হয়েছে,’ পাহাড়ের নিচে ছোট্ট ভিড়টার দিকে তাকাল রানা। ‘সম্ভবত অনেক বেশি খুঁড়ে ফেলে প্রায় সত্য আবিষ্কার করে ফেলেছি আমরা।’

বিপদের জন্যে মনে মনে তৈরি হয়ে নিচের দিকে জীপ চালাতে শুরু করল রানা। কিন্তু পাওয়ার হাউজের পাশ ঘেঁষে এগোবার সময় ঘটল না কিছুই। রাস্তায় উঠে স্বস্তি বোধ করল রানা। ঢিলে হয়ে গেল পেশীগুলো।

‘এই ব্যাপারটাই তাহলে এতদিন আমাদের কাছে গোপন করে রেখেছিলে তুমি!’ বলল লংফেলো, ‘হাসপাতালে যে খুন হয়েছে সে কেনেথ নয়, টমাস — প্রথম থেকেই তুমি জানতে? কিন্তু একটা ব্যাপার আমার মাথায় ঢুকছে না, রানা।’

‘কি?’ জানতে চাইল রানা।

‘তুমি বলেছিলে অ্যাক্সিডেন্টের পর যে বেঁচে গেল সে সব ভুলে গেলেও জিওলজি সম্পর্কে কিছুই ভোলেনি। জিওলজির ছাত্র ছিল কেনেথ, তাই না? এখন, যে বেঁচে গেল সে যদি টমাস হয় তাহলে জিওলজি সম্পর্কে জ্ঞান পেল সে কোথা…?’

‘জিওলজির ছাত্র ছিল টমাসও, জানো না বুঝি?’

মাথায় হাত দিল লংফেলো। ‘বলো কি! তা তো জানতাম না!

‘গাফ পারকিনসনের ব্যাপারে নতুন ভাবে চিন্তা করছি আমি,’ বলল রানা। ‘তাকে আমার মোটেও খারাপ মানুষ বলে মনে হয় না।’

‘সে কথা তো তোমাকে আমি আগেও বলেছি,’ বলল লংফেলো। ‘ভয়ঙ্কর হতে পারে, কিন্তু সৎ মানুষ।’

‘কিন্তু ক্লিফোর্ডদের সনাক্ত করার ব্যাপারে তিনি কি ইচ্ছা করেই ভুল করেছিলেন? তা যদি না হয় তাহলে কেনেথ কেনেথ নয় টমাস একথা শুনে তিনি হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হবেন কেন?’

‘তাই তো!’ লংফেলো সমর্থন করল রানাকে। দারুণ রহস্য দেখছি!’

লংফেলোর কেবিনের সামনে একটা পাথরের উপর গালে হাত দিয়ে বসে আছে শীলা, দূর থেকেই দেখতে পেল রানা। জীপ থামতে নামল সবাই। জ্যাক লেমন বিদায় নিয়ে নিজের গাড়িতে গিয়ে উঠল। ফোর্ট ফ্যারেলে ফিরে গেল সে। শীলার হাত ধরে তাকে দাঁড় করাল লংফেলো। ওদের পিছু পিছু কেবিনে ঢুকল রানা। দু‘জনের চেহারা এবং হাবভাব দেখে যা বোঝার বুঝে নিয়ে চঞ্চল হয়ে উঠল শীলা। দ্রুত কেবিনেট থেকে হুইস্কির বোতল আর গ্লাস নামাল সে।

সব কথা বলল রানা শীলাকে। স্নান, রক্তশূন্য হয়ে গেল শীলার চেহারা। ‘গাফ কাকা বলে বরাবর ডাকতাম ওঁকে আমি,’ বলল সে। মাথা তুলল। সত্যি বলতে কি, গাফ কাকাকে কখনও খারাপ লোক বলে মনে হয়নি আমার। নাথান চাকরি নিয়ে আসতেই পারকিনসন করপোরেশন বেয়াড়া হয়ে উঠল।

‘কিন্তু নাথানের দোষ দিয়ে লাভ নেই, সে তো স্রেফ বেতনভুক কর্মচারী। ক্লিফোর্ডদের যাবতীয় সব কিছু মেরে দিয়ে গাফই লাভের টাকা পকেটে ভরেছে।’

‘কিন্তু এটা ঠিক চিটিং কিনা সে ব্যাপারে আমাদের সকলেরই সন্দেহ আছে, তাই না? দলিল এবং চুক্তি অনুযায়ীই সব দখল করেছে পারকিনসনরা।’

‘কিন্তু নীতিগতভাবে আপত্তিকর!’ মন্তব্য করল লংফেলো।

‘এবং দলিল এবং চুক্তিগুলো জাল কিনা তাও কেউ পরীক্ষা করে দেখেনি।’ খানিকক্ষণ কথা বলল না কেউ।

‘এখন আমাদের করণীয় কি, লংফেলো?’

‘শেষ চালটাও চেলে ফেলেছ তুমি,’ বলল লংফেলো। ‘আর কিছু করার নেই। এখন শুধু অপেক্ষা। আমার ধারণা, তোমার পিছু পিছু আসবে বয়েড।

.‘ভুল বুঝেছ তুমি,’ বলল রানা। ‘শেষ চাল হাতেই রেখে দিয়েছি আমি এখনও।’

‘সেক্ষেত্রে আমি বলব,’ চিন্তিত দেখাচ্ছে লংফেলোকে, ‘শেষ চাল দেবার অবকাশ কখনোই হয়তো হবে না তোমার। কি জানি, একমাত্র ভবিষ্যৎই বলতে পারে গাফ মারা গেলে কি ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটবে! রানা?’

‘বলো।’

‘আমার শেষ কথাটা রাখবে তুমি?’

‘কি?’

‘ফোর্ট ফ্যারেল ছেড়ে তোমাকে আমি পালাতে বলছি না, কেননা সে অনুরোধ তুমি রাখবে না জানি। কিন্তু আত্মগোপন করো, প্লীজ! অন্তত রাত পর্যন্ত কোথাও লুকিয়ে থাকো। ফোর্ট ফ্যারেলে এখন যেয়ো না।’

কেন? আমি ফেরারী নাকি? তাছাড়া, কার ভয়ে লুকাব, লংফেলো? ফোর্ট ফ্যারেলে যাব এই জন্যে যে…’

‘বয়েড আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের তুমি যদি চিনতে….’

‘বোঝা যাচ্ছে,’ বলল রানা, ‘ভয়ে মরে যাচ্ছ তুমি। ‘আমাকেও চিনতে ভুল করেছ।’

ভুল করা তো দূরের কথা,’ বলল লংফেলো, ‘তোমাকে কি আমরা আদৌ চিনি, রানা? কে তুমি? কি তোমার পরিচয়? স্কট বা ইংরেজ নও তুমি। ইউরোপীয়ান বলেও মনে হয় না। কোথা থেকে এসেছ, রানা? কেন এসেছ? টমাস ক্লিফোর্ডের প্রতাত্মা নও তো? কিংবা, কেনেথের? আমার কেন যেন সন্দেহ হয় একমাত্র ওদের কারও প্রেতাত্মার পক্ষেই ফোর্ট ফ্যারেলে এসে এরকম অসম্ভবকে সম্ভব করা সম্ভব।’

রানাকে হাসতে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল লংফেলো। ‘আমার কথা, হলো, আত্মগোপন করো। আমি তোমাকে পরাজয় মেনে নিতে বলছি তা ভেব না। এতকিছুর পর তুমি যদি পিছিয়ে যাও, তোমার দিকে থুথু ছুঁড়র আমি। আমি বলতে চাইছি, গাফের অবস্থা কি হয় না জেনে তুমি বয়েডের সামনে চেহারা দেখিয়ো না। রয়েডের পিঠের ওপর গাফ নেই এখন তার লাগাম টেনে ধরার জন্যে এ কাজটা নাথানের পক্ষেও সম্ভব নয়। বিগ প্যাট আর পোষা গুণ্ডাদেরকে নিয়ে বয়ে হয়তো ইতিমধ্যেই তোমার খোঁজে রওনা হয়ে গেছে। তোমাকে পেলে কি অবস্থা করবে… ঝট করে বুড়ো শীলার দিকে ফিরল, বছর কয়েক আগে নিক ব্রাউনের কি অবস্থা করেছিল বয়েড, তোমার স্মরণ আছে, শীলা? ভাঙা একটা পা, ভাঙা একটা হাত, ফাটা পাজর আর চেহারা বদলানো মুখ নিয়ে ফোর্ট ফ্যারেল থেকে পালাতে দিশা পায়নি সে। বয়েডের গুণ্ডাদের হাতে পড়ে খুন হওয়া তবু ভাল, রানা। কিন্তু ওরা যদি ঠিক করে থাকে তোমার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালাবে—বিশ্বাস করো, সেটা হবে তোমার জন্যে মর্মান্তিক, দুর্ভাগ্যজনক। আবার বলছি, ফোর্ট ফ্যারেলে যাবার কোন ইচ্ছা যদি তোমার থাকে, এই মুহূর্তে তা বাতিল করে দাও।’

উঠে দাঁড়াল শীলা। ‘ফোর্ট ফ্যারেলে যাবার ব্যাপারে আমাকে অন্তত কেউ বাধা দিতে পারছে না। আমি চললাম।’

শীলার পথ রোধ করে দাঁড়াল লংফেলো। ‘কিন্তু কেন?’

‘পুলিস সার্জেন্ট হ্যামিলটনের সাথে দেখা করতে,’ বলল শীলা। যথেষ্ট দেরি করা হয়েছে, পুলিসকে সব জানানোর ব্যাপারে আর দেরি করার মানে হয় না।’

শীলার পথ ছেড়ে দিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল লংফেলো। ‘যেতে চাও যাও, কিন্তু প্রশ্ন হলো এক্ষেত্রে হ্যামিলটনের করার কি আছে? কার বিরুদ্ধে ঠিক কি অভিযোগ তুলতে চাও তুমি, শীলা?’

‘সে সব পরে ভাবব,’ বলল শীলা। ‘তার সাথে দেখা করতে চাই আমি।’ দ্রুত, প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল সে। খানিকপরই তার গাড়ির স্টার্ট নেবার শব্দ পেল রানা।

‘নিক ব্রাউন—কে সে?’ জানতে চাইল রানা।

‘বয়েডের বিরুদ্ধে যাবার সাধ হয়েছিল এমন একজন লোক ছিল সে,’ বলল লংফেলো ‘কেন মারধোর করে তার হাড়গোড় ভাঙা হয়েছিল তা সবাই জানত, কিন্তু অন্যাটার প্রতিবাদ করার সাহস একজনেরও হয়নি। সেই যে পালাল নিক, ফোর্ট ফ্যারেলে জীবনে কখনও ফেরেনি, ফিরবেও না কখনও। নিক শুধু একা নয়, এই রকম আরও অনেকে জীবনে কখনও ফোর্ট ফ্যারেলে ভুলেও পা দেবে না। তুমি বয়েডের বিরুদ্ধে যা করেছ এরা কেউ তার সিকি ভাগও করেনি, রানা। খানিক আগে ওকে যে রকম রাগতে দেখেছি আমি, আর কখনও দেখিনি।’ হঠাৎ কপালের পাশটা চেপে ধরল সে। ‘বড্ড ধরেছে মাথাটা, দাঁড়াও চা তৈরি করি,’ বলে বেরিয়ে গেল সে বাইরে।

এক মিনিট পর খালি হাতে ফিরল লংফেলো। ‘স্টোভটা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে, আর কাঠও নেই। আমি না ফেরা পর্যন্ত এখান থেকে নোড়ো না তুমি।’

‘কোথায় যাচ্ছ?’

‘চা না খেলেই নয়,’ বলল লংফেলো। ‘কাঠ আনতে যাচ্ছি। রান্নাবান্নার জন্যেও তো লাগবে।’ বেরিয়ে গেল সে আবার।

একই জায়গায় বসে পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে ভাবতে লাগল রানা। মুশকিল হলো, ক্লিফোর্ড হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে খুব বেশি দূর এগোয়নি সে, ভাবছে রানা। এবং যে লোক রহস্য উন্মোচন করতে পারেন তিনি সম্ভবত এখন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করছেন। ফোর্ট ফ্যারেলে গিয়ে বয়েডের মুখোমুখি হবার একটা ইচ্ছা জেগে রয়েছে ওর মধ্যে—কিন্তু তাতে কিছু লাভ হবে না তাও বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না ওর।

দরজার কবাট দুটো খুলে দু‘পাশে বাড়ি খেতেই রানা দেখল, ফোর্ট ফ্যারেলে যাবার আর দরকার নেই ওর। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে বয়েড পারকিনসন। হাতে রাইফেল। রাইফেলটা তুলে ধরল বয়েড। রানার মনে হলো, এই মুহূর্তে গুলি করতে যাচ্ছে সে। মাজলের গোল গর্তটা তলহীন গহ্বরের মত দেখাচ্ছে। ‘এবার, কুত্তার বাচ্চা?’ বলল বয়েড়। উত্তেজনায় হাঁপিয়ে উঠেছে সে। ‘কেনেথ কেনেথ নয়, টমাস ক্লিফোর্ড—এসবের মানে কি, বলো!’

দু‘পা এগোল বয়েড, কিন্তু তার হাতের রাইফেল একচুল দিক বদল করল না। তার পিছন থেকে পাশ কাটিয়ে কেবিনের ভিতর ঢুকল পুসি। রানার দিকে চেয়ে খিলখিল করে হাসল সে। চেয়ার ছেড়ে উঠতে গেল রানা, কিন্তু বাধা দিল বয়েড। ‘বসে থাকো, বেজন্মা কুত্তা; আর কোথাও যাবার জায়গা নেই তোর। এখান থেকে আমিই তোকে শেষবারের মত সোজা নরকে পাঠিয়ে দেব।’

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পড়ল রানা। ‘টমাস ক্লিফোর্ডের ব্যাপারে তোমার এত আগ্রহ কেন?’ প্রশ্ন করল রানা অদ্ভুত শান্ত গলায়। ‘সে, তার বাবা এবং তার মা ‘আজ অনেক দিন হলো মারা গেছে।’ কণ্ঠস্বরটা শান্ত রাখতে কষ্ট হচ্ছে রানার। রাইফেলের মুখোমুখি বসে ঘণ্ঠনালীকে বশে রাখা কঠিন বলে মনে হলো ওর।

‘ভয় লাগছে, রানা?’ জানতে চেয়ে আবার খিল খিল করে হাসল পুসি। ‘এত ঠাণ্ডা যে? কোথায় গেল তোমার তেজ আর…’

‘চুপ করো,’ বলল বয়েড। আস্তিন দিয়ে কপালের ঘাম মুছে জিভ বের করে নিচের ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিল সে। ধীরে ধীরে সামনে বাড়তে শুরু করল। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রানার চোখের দিকে। ‘কেনেথের বা টমাসের খুনীকে তুমি চেনো-কে সে, রানা?’ নিচু গলায় জানতে চাইছে বয়েড।

হেসে উঠল রানা। তৈরি করা কষ্টসাধ্য হাসি-কিন্তু নির্ভেজাল ঝরঝরে লাগল ওর নিজের কানেই।

‘এই শালা হারামীর বাচ্চা, উত্তর দে!’ চিৎকার করে উঠল বয়েড, ভেঙে গেল লাটা শেষ দিকে। আরও এক পা সামনে বাড়ল সে। মুখটা প্রতি মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে বিচিত্র সব ভাঁজ পড়ে। একটা উদ্বিগ্ন চোখ তার ডান হাতের দিকে রেখেছে রানা, আশা করছে, রাইফেলের ট্রিগারটা খুব বেশি স্পর্শকাতর নয়।

আরও এক পা সামনে বাড়লে হাতের ধাক্কায় রাইফেলের নলটা সরিয়ে দিতে পারবে ও, ভাবছে রানা। কিন্তু হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল বয়েড। ‘আমার প্রশ্নের উত্তর দে, শালা!’ গলা কাঁপছে তার। ‘সত্য কথাটা জানতে চাই আমি। মন্ট্রিয়ল হাসপাতালে যে খুন হয়েছে সে কে ছিল? কেনেথ, না টমাস?’

‘কি এসে যায় তাতে?’ বলল রানা। ‘কেনেথই হোক, আর টমাসই হোক, গাড়িতে সে ছিল।’

‘তা ছিল,’ বলল বয়েড। ‘হ্যাঁ, তা ছিল। কিছু এসে যায় না তাতে, ঠিক। কিন্তু কি বলে গেছে সে তাকে? কি সে দেখেছিল গাড়িতে? এই কথাটা জানতে চাই আমি। এখুনি। কি সে দেখেছিল গাড়িতে?’

‘তুমি বলো কি সে দেখেছিল, তারপর আমি বলব তুমি ঠিক বলছ কিনা।’ সময় নেয়ার চেষ্টা করছে রানা।

মুখটা কঠিন হয়ে উঠল বয়েডের। নড়ল একটু, একটু সামনে বাড়ল। কিন্তু রানার নাগালের বাইরে থাকার ব্যাপারে পুরো সচেতন সে।

শার্টের ভিতর ঘামছে রানা। দ্রুত কিছু একটা করার অবস্থা নয় এটা।

‘অনেক সময় দিয়েছি, আর নয়,’ হঠাৎ অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে বলল বয়েড। ‘মুখ খোল, শালা! নইলে জন্মের মত বন্ধ করে দিচ্ছি মুখটা এখনই।’

দরজার কাছ থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল। ‘রাইফেলটা নামিয়ে রাখো, বয়েড, তা নাহলে খুলি উড়িয়ে দেব আমি তোমার।’

চোখ তুলতেই ডাবল-ব্যারেল শটগান হাতে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল রানা লংফেলোকে। মুহূর্তে স্থির হয়ে গেল বয়েড। তারপর ধীরে ধীরে ঘাড় ফেরাতে শুরু করল।

‘না! আগে রাইফেলটা ফেলো!’ দ্রুত বলল লংফেলো, ‘নড়লেই গুলি করছি।’ ঘাড়টা শক্ত হয়ে গেল বয়েড়ের।

‘সাবধান, বয়েড?’ পুসির কণ্ঠস্বর। ‘মিথ্যে বলছে না ও, শটগান রয়েছে ওর হাতে।’

রাইফেলটা ছেড়ে দিল বয়েড। খটাশ করে ওটা কাঠের মেঝেতে পড়তেই চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে তুলে নিল রানা। পিছিয়ে গিয়ে মুখ তুলল ও। গম্ভীর ভাবে হাসল লংফেলো। ‘আজ সকালে শটগানটা জীপে রেখেছিলাম আমি দরকার লাগতে পারে মনে করে—ভাগ্যিস রেখেছিলাম! ঠিক আছে, বয়েড, লক্ষ্মী ছেলের মত নাক বরাবর দেয়াল পর্যন্ত হেঁটে যাও। তুমিও, পুসি মা।’

বয়েডের রাইফেলটা, পরীক্ষা করছে রানা। সেফটি ক্যাচ অফ করাই ছিল। বোল্ট টান দিতেই গ্ৰীচ থেকে একটা রাউণ্ড বেরিয়ে মেঝেতে পড়ল। মৃত্যু খুব বেশি দূরে ছিল না ওর কাছ থেকে, বুঝতে পারল পরিষ্কার।

‘ধন্যবাদ, লংফেলো,’ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পেল ওর কণ্ঠে।

‘ভদ্রতা প্রদর্শনের সময় নয় এটা,’ দ্রুত বলল লংফেলো। ‘বয়েড, দেয়ালের দিকে মুখ করে মেঝেতে বসো, বাছা। এবং তুমি, পুসি আম্মু,’ পুসি বসতে গিয়েও ইতস্তত করছে দেখে লংফেলো বলল, ‘বসো, বসো, এতে লজ্জার কিছু নেই। এর চেয়ে আরও অনেক বেশি লজ্জার কাজ করেছ তুমি জীবনে।’

ঘৃণায় কুঁচকে আছে বয়েডের মুখ। ‘যাই করো, নিষ্কৃতি পাবার কোন উপায় তোমার নেই, রানা। আমার লোকেরা তোমার হাড় মাংস আলাদা না করা পর্যন্ত ক্ষান্ত হবে না।’

বয়েডের কথা গ্রাহ্য না করে লংফেলোর দিকে তাকাল রানা। চোখে প্ৰশ্নবোধক দৃষ্টি।

‘শীলাকে অনুসরণ করো তুমি,’ লংফেলো বলল। ‘দু‘জন একসাথে ফিরে এসো, সার্জেন্ট হ্যামিলটনকে মাঝখানে নিয়ে। বয়েড ভাতিজাকে আমরা পুলিসের হাতে তুলে দিতে পারলে ওর কিছুটা উপকার হবে। হত্যার চেষ্টা করতে গিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় ধরা পড়েছে—এই হলো আমাদের অভিযোগ। তুমি যাও, ভাই-বোনকে আমি সামলাচ্ছি।’

দ্বিধাগ্রস্ত দেখাচ্ছে রানাকে। ‘দেখো, কোনরকম ভুল করে আবার গোটা ব্যাপারটা উল্টে যেতে দিয়ো না যেন। পারবে একা সামলাতে?’

‘আরে, না। আমার সাথে চালাকি করতে আসবে সে সাহস ওর আছে নাকি? দেখছ না ভিজে ইঁদুরের মত কাঁপছে কেমন? চিন্তা কোরো না, রানা, শটগানে এল জি বুলেট আছে, এত কাছ থেকে মিস হবে না আমার। কথাটা শুনলে তো, বয়েড?’ চোখ গরম করে তাকিয়ে থাকল বয়েড, কথা বলার কোন চেষ্টাই করল না।

‘ঠিক আছে,’ বলল রানা। ‘আধঘণ্টার মধ্যে ফিরছি আমি।’ বয়েডের রাইফেল থেকে বুলেটগুলো বের করে কেবিনের এক কোপায় ছুঁড়ে দিল ও। বাইরে বেরিয়ে রাইফেলটাও ছুঁড়ে ফেলে দিল একটা ঝোপের ভিতর। তারপর ছুটে গিয়ে উঠে বসল জীপে। স্টার্ট দিয়েই ছেড়ে দিল সেটা।

লংফেলোকে একা রেখে আসায় খুঁত খুঁত করছে মনটা। মাইল দুয়েক এগিয়ে এসেছে ও। সামনে একটা বাঁক। এতটা পথ এসে এখন আর ফিরে যাওয়া যায় না। স্টিয়ারিঙ হুইল ঘোরাচ্ছে রানা, হঠাৎ দেখল ঠিক সামনেই হুড়মুড় করে রাস্তার উপর. আড়াআড়ি ভাবে পড়ল একটা মস্ত গাছ। ব্রেক কষার সময় পেল না রানা। দাঁতে দাঁত চেপে ধরল। শক্ত হয়ে উঠল শরীরের প্রতিটি পেশী। নাক বরাবর ধাক্কা খেল জীপ গাছটার সাথে। প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি, মনে হলো উইণ্ডস্ক্রীন ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে গেছে মাথাটা। কোথায় আঘাত লাগল টেরই পেল না রানা। চোখে অন্ধকার দেখছে। বাঁক নেবার জন্যে স্পীড কমিয়ে আনলেও সংঘর্ষটা চ্যাপ্টা করে দিয়েছে জীপের সামনেটা। ঝাঁকুনির পর প্রথম যা টের পেল রানা, কেউ ওর বুকের কাছে শার্ট ধরে উপর দিকে টানছে। নিজের প্রায় অজান্তেই মাথাটা নিচু করে লোকটার কড়ে আঙুল কামড়ে ধরল রানা। আর্তনাদ করে ছেড়ে দিল লোকটা রানাকে। বামপাশের দরজাটা খুলে গেছে আগেই। লাফ দিয়ে বাইরে পড়ার পূর্ব মুহূর্তে ও দেখল ঝোপের ওপাশ থেকে ক্যাঙ্গারুর মত লাফ দিয়ে দুজন লোক ছুটে আসছে!

‘ধর, ধর! ধর শালাকে!’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *