ষোলো
পরদিন। ব্রেকফাস্টে বসে বলল রানা, ‘আজ আবার বয়েডের মুখোমুখি হতে চাই আমি।’
‘কিন্তু পারকিনসন বিল্ডিং তোমার জন্যে নিরাপদ নয়। ওখানে গেলে জীবনে আর বেরুতে দেবে না তোমাকে।’
‘এসকার্পমেন্টে উঠে ওখানে একটা গর্ত খুঁড়তে শুরু করব আমি,’ বলল রানা, ‘তাতেই ছুটে আসবে সে।’
‘তা আসবে,’ সায় দিল লংফেলো। ‘কিন্তু ওর মুখোমুখি হয়ে কি লাভ?’
‘বরং গোলমালে জড়িয়ে পড়তে হবে,’ মন্তব্য করল শীলা।
‘গোলমাল করতেই চাইছি আমি,’ বলল রানা।
‘যাই তাহলে, লেমনকে তৈরি হতে বলি,’ লংফেলো চেয়ার ছাড়তে গেল। ‘না,’ বলল রানা, ‘আজ আমি একাই যাব।’
‘কে তোমাকে নিষেধ করছে একা যেতে?’ চোখ রাঙাল লংফেলো। ‘আমরা তোমার সাথে যাব না, পিছু পিছু যাব। এতে তুমি বাধা দিতে পারো না। আসলে, ক্রাউনল্যাণ্ডে যেতে কেউ আমাদেরকে ‘বাধা দিতে পারে না-এটা তোমারই শেখানো কথা। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ দুটো রগড়াতে শুরু করল সে। ‘মুশকিল হলো, দুপুর পর্যন্ত ঘুমিয়ে নেব ভেবেছিলাম, সেটি আর হলো না।’
‘মানে? রাতে ঘুমাওনি নাকি?’
চোখ রগড়ে নিয়ে রানার দিকে তাকাল লংফেলো। তারপর আড়চোখে শীলাকে একবার দেখে নিয়ে নিজের নাস্তার প্লেটে দৃষ্টি নামাল। সেদিকে গভীর মনোযোগের সাথে তাকিয়ে থেকে মৃদু স্বরে বলল, ‘ঘুমালে তোমাদের গল্প শুনবে কে সারারাত জেগে? বারান্দায় কথাবার্তা, ঘরের ভিতর খুটখাট—ঘুমানো সম্ভব? সাংবাদিক হয়ে?’
হাসি চেপে বলল রানা, ‘তোমার হয়তো জঙ্গলে শোয়ার ব্যবস্থা করা উচিত ছিল—ওখানে কোনরকম অশান্তি নেই।’
পিছন দিকে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল লংফেলো। ‘লেমনকে আমি ডেকে নিয়ে আসি।’
এক ঘণ্টা পর। কাইনোক্সি রোড ধরে ছুটছে রানার জীপ। সাথে আসবার জন্যে জেদ ধরেছিল শীলা, রানা শেষ পর্যন্ত ধমক দিয়ে নিরাশ করেছে।
পাওয়ার হাউজ ছাড়িয়ে গেল জীপ। কেউ ওদেরকে বাধা দিল না। এসকার্পমেন্ট রোড ধরে প্রায় শেষ মাথায় গিয়ে থামল ওরা। রানার ইচ্ছা, ঠিক বাঁধের নিচেই একটা গর্ত করা।
এসকার্পমেন্টের কিনারা দিয়ে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এল জ্যাক লেমন, এঞ্জিনটাকে’। যন্ত্রপাতি বসানোর কাজ শেষ করতে বেশ সময় লাগল। খোলা জায়গায় ওদেরকে পরিষ্কার দেখতে পাবার কথা, কিন্তু কেউই মনোযোগ দিয়ে তাকাচ্ছে না ওদের দিকে। পাহাড়ের নিচে এখনও লোকজন জেনারেটর আর্মেচার নিয়ে নাকানিচোবানি খাচ্ছে। তবে বেশ খানিকটা এগিয়ে নিয়ে গেছে তারা সেটাকে পাওয়ার হাউজের দিকে। সারারাত ধরে পালাক্রমে খেটেছে শ্রমিকরা বড় বড় গাছের গুঁড়ি আর কাণ্ড কাদার উপর ফেলে একটা শক্ত ভিত তৈরি করার জন্যে। উপর থেকে শোনা যাচ্ছে নিচের হৈ-হট্টগোলের ক্ষীণ শব্দ। কিন্তু লেমন এঞ্জিন স্টার্ট দিতেই সব চাপা পড়ে গেল।
প্রথম গর্তটা ত্রিশ ফুট লম্বা করল রানা। যা বেরুল সব রেখে দেয়া হলো কাগজে মোড়ার জন্যে। বাছাকাছি আরও একটা গর্ত করল রানা। এটা চল্লিশ ফুট লম্বা।
‘এঞ্জিনটার এই আওয়াজই যত নষ্টের গোড়া,’ চিৎকার করে বলল লংফেলো, ‘ঠিক বিপদ ডেকে আনবে।’
‘কেউ আসছে বুঝি?’ রাস্তার দিকে না তাকিয়েই জানতে চাইল রানা।
‘শুধু আসছে না, যুদ্ধের পতাকাটাকে সাথে নিয়ে ছুটে আসছে।’
পাহাড়ের ধার ঘেঁষে ঠিক পিছনেই বিগ প্যাটকে নিয়ে পায়ে হেঁটে আসছে বয়েড। কাছে আসতে রানা দেখল রাগে দিশেহারা দেখাচ্ছে তাকে। এঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা তার মুখোমুখি হবার জন্যে। চিৎকার করে উঠল সে, ‘তোমাকে আমি সাবধান করে দিয়েছিলাম, রানা, এখন ফলাফল ভোগ করো!’
অটল দাঁড়িয়ে থাকল রানা। বিগ প্যাটের দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কাছে এসে দাঁড়াল দু‘জন!
‘বয়েড, তোমাদের কপাল মন্দ, তা নাহলে এত টাকার বাঁধটা এভাবে অর্থহীন হয়ে যায়? বিশ্বাস করো, ঠিক বাঁধের পঞ্চাশ গজের মধ্যে অবিশ্বাস্য রকমের মূল্যবান খনিজ পদার্থ পেয়েছি আমি। ধারণা করছি, এর দ্বারা বছরে কয়েকশো কোটি ডলার আয় হবে সরকারের।’
বয়েড ওর একটা কথাও শুনেছে বলে মনে হলো না রানার। তর্জনী তুলে রানার বুকে সেটা ঠেকাল সে। ‘এই মুহূর্তে এখান থেকে যাচ্ছ তুমি, আর কোন কথা আমরা শুনতে চাই না।’
‘আমরা? তোমার সাথে আর কাকে জড়াচ্ছ, বয়েড? তোমার বাবা, যতদূর জানি, তোমাকে নিষেধ করেছেন আমাকে ঘাঁটাতে। সে যাক, তোমরা চাইলেই আমি এখান থেকে যেতে পারি না, বয়েড। যদিও বাঁধ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, কিন্তু ওটার এক কানাকড়িও মূল্য নেই এখন আর। এখানে এবং কাইনোক্সি উপত্যকায় প্রচুর কয়লা পাওয়া গেছে। সোনার খনি পাওয়ার সম্ভাবনাও উজ্জল। পারকিনসন করপোরেশনের অবশ্য কোনই লাভ হবে না, লাভ হবে শীলার আর সরকারের তবে বাঁধ ভাঙার জন্যে যে খরচটা তোমাদেরকে করতে হবে তার জন্যে যৎসামান্য ক্ষতিপূরণ যাতে তোমরা পাও তার জন্যে আমি শীলাকে উদার হতে অনুরোধ জানাব।’
‘তোমার এসব কথা আমি শুনতে চাই না।’ বয়েড ট্রাউজারের দু‘পকেটে হাত ভরল। ‘তুমি যাবে কিনা…’
‘কথাগুলো শুনলে ভালোই হবে তোমার, বয়েড,’ মৃদু কণ্ঠে মন্তব্য করল লংফেলো।
‘অযথা নাক গলিয়ো না এসব ব্যাপারে, বুড়ো গাধা কোথাকার!’ চোখ গরম করে লংফেলোর দিকে তাকাল বয়েড। তারপর জ্যাক লেমনের দিকে ফিরল সে। ‘তোমাকেও জানিয়ে রাখছি, রানার সাথে জোট পাকানোর ফল হাড়ে হাড়ে টের পাওয়াব।’
‘বয়েড, ওদেরকে বাদ দিয়ে কথা বলো,’ রুক্ষ কণ্ঠে বলল রানা।
নিপুণ, অব্যর্থ লক্ষ্য জ্যাক লেমনের। থোঃ করে একটা শব্দ বেরুল তার মুখ থেকে। পরমুহূর্তে দেখা গেল বয়েডের জুতোর ডগা ভিজে গেছে। ‘তোমাকে আমি কেয়ার করি না,’ বলল সে, ‘এটা তার একটা প্রমাণ।’
এক পা এগোল বয়েড, ঘুসি মারার জন্যে মুঠো করা হাতটা তুলল।
বয়েডের বুকে থাবা মেরে নেকটাই চেপে ধরল রানা। ‘থামো! তোমার দলবলকে আরেকটু কাছে আসতে দাও, বয়েড।’ পাহাড়ের দিকে ইঙ্গিত করল রানা। এবড়োখেবড়ো জমির উপর দিয়ে দু‘জন লোক আসছে এদিকে। একজন কড়া ভাঁজের ইউনিফর্ম পরা শোফার দ্বিতীয় ব্যক্তিকে হাঁটতে সাহায্য করছে এক হাত ধরে।
অবশেষে সুরক্ষিত দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসেছেন গাফ পারকিনসন। বুড়ো পারকিনসন এবং রাস্তার ধারে ফিকে হলুদ রঙের প্রকাণ্ড বেন্টলি গাড়িটাকে দেখে চোয়াল ঝুলে পড়ল জ্যাক লেমনের। ‘কি ভাগ্য!’ বিস্মিত ধ্বনি বেরুল তার কণ্ঠ থেকে। ‘কত বছর দেখিনি বুড়ো ষাঁড়টাকে!’
‘হয়তো তার বাচ্চা ষাঁড়টাকে রক্ষা করতেই আসছে সে,’ ব্যঙ্গের সুরে বলল লংফেলো।
এগিয়ে গেছে বয়েড বাপকে সাহায্য করতে। কাছে গিয়ে বাবার হাতটা ছুঁয়েছে মাত্র, ঝাঁকুনি দিয়ে সেটা ছাড়িয়ে নিলেন গাফ। দেখে মনে হলো রানার, গায়ে এখনও যথেষ্ট শক্তি রাখেন বুড়ো।
ব্যাপারটা লক্ষ করে লংফেলো মন্তব্য করল, ‘বয়সে বেশি হলে কি হবে, আমাকে তুলে আছাড় দিতে পারবে বলে মনে হচ্ছে।’
‘কেন যেন মনে হচ্ছে আমার,’ মৃদু কণ্ঠে বলল রানা, ‘সত্য উদ্ঘাটনের মুহূর্ত এটা।’
,
‘এর নাম গাফ, একে কাবু করতে অসম্ভব ধারাল তলোয়ার দরকার, রানা, রানার দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকাল লংফেলো।
বুড়ো গাফ ওদের কাছে পৌঁছলেন। একে একে প্রত্যেকের দিকে তাকালেন কড়া দৃষ্টিতে। তার শোফারের দিকে শেষবার দৃষ্টি ফেলে সংক্ষেপে বললেন, ‘গাড়ির কাছে ফিরে যাও,’ ড্রিলিং যন্ত্রপাতির দিকে তিন সেকেণ্ড স্থির রাখলেন দৃষ্টি, তারপর ঝট্ করে ফিরলেন বিগ প্যাটের দিকে। ‘তুমি কে?’
‘বিগ প্যাট। পাওয়ার প্ল্যান্টে কাজ করি।’
পাকা ভুরু কপালে তুললেন গাফ। ‘কাজ করো? সত্যি? তাহলে এখানে কি করছ? গেট ব্যাক টু ইওর জব।’
দ্বিধাগ্রস্ত দেখাচ্ছে বিগ প্যাটকে। বয়েডের দিকে তাকাল সে। মৃদু মাথা নাড়ল বয়েড। বিগ প্যাট রওনা দিল রাস্তার দিকে।
লেমনের দিকে ফিরলেন গাফ। ‘তোমাকেও আমাদের দরকার নেই,’ থমথমে গলায় বললেন তিনি, ‘তুমিও যেতে পারো এখান থেকে, লংফেলো।’
শান্ত ভাবে বলল রানা, ‘জীপের কাছে গিয়ে অপেক্ষা করো, লেমন,’ বুড়ো গাফের দিকে তাকাল ও। ‘লংফেলো থাকছে।’
‘সেটা ওর ওপর নির্ভর করে,’ গাফ বললেন। ‘কি, লংফেলো?’
‘আমি চাই দু‘পক্ষ যেন সমান শক্তিতে যুদ্ধ করে, সানন্দে বলল লংফেলো। দু‘জনের বিরুদ্ধে দু‘জন, হাসল সে। ‘বয়েডকে রানা কাবু করতে পারবে। আর তোমার সাথে আমার যুদ্ধটাও দর্শনীয় একটা ব্যাপার হবে, সন্দেহ নেই।’ গ্যাসোলিন এঞ্জিনের মাথাটা ছুঁয়ে দেখল সে এখনও গরম আছে কিনা, তারপর সেটার উপর চেপে বসল ধীর ভঙ্গিতে।
মাথা ঝাঁকিয়ে গাফ পারকিনসন বললেন, ‘ভাল কথা! আমি যা বলতে চাই তা আর কেউ শুনলে কিছু এসে যায় না।’ রানাকে তিনি ঠাণ্ডা নীল চোখের দৃষ্টি দিয়ে বিদ্ধ করলেন, ‘তোমাকে আমি সাবধান করে দিয়েছিলাম, রানা, কিন্তু তুমি সেটায় কর্ণপাত না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছ। ক্লিফোর্ডদের ব্যাপারে…’
‘বাবা, তুমি কি ঠিক জানো কেনেথের বন্ধু ছিল এই লোক?
‘শাট আপ!’ ছেলের দিকে না ফিরেই ধমক মারলেন গাফ। ‘ব্যাপারটা আমি নিজে দেখছি। ভুল ইতিমধ্যে অনেক করেছ তুমি—তুমি এবং তোমার বোন।’ রানার চোখে চোখ রেখে কথা বলছেন তিনি। ‘তোমার কিছু বলার আছে, রানা?’
‘বলার কথা আমার অনেক, কিন্তু ক্লিফোর্ডদের ভাগ্যে সত্যি কি ঘটেছিল সে ব্যাপারে এখুনি আমি প্রশ্ন তুলতে চাই না। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, আপনাদের এত সাধের বাঁধটা ভেঙে…’
‘বাঁধ বা অন্য কোন ব্যাপারে আমার কোন আগ্রহ নেই,’ থামিয়ে দিলেন রানাকে গাফ। ‘ক্লিফোর্ডদের ব্যাপারে যদি কিছু বলার থাকে, এখুনি বলো, তা নাহলে মুখ বুজে থাকো। আছে কিছু বলার? যদি না থাকে, চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যেতে পারো তুমি-আমি নিজে দেখব যাতে তুমি দূর হও।’
‘হ্যাঁ,’ ধীর ভঙ্গিতে বলল রানা, ‘দু‘চারটে কথা এই মুহূর্তে বলা যায় আপনাকে। কিন্তু কথাগুলো আপনার মোটেই পছন্দ হবে না।’
‘আমার জীবনে এমন অনেক কিছু ঘটেছে যা আমি পছন্দ করিনি,’ পাথরের মত শক্ত হয়ে উঠল গাফ পারকিনসনের মুখের চেহারা। ‘আরও দু‘চারটে যদি ঘটে তাতে কিছু এসে যাবে না।’ সামনের দিকে একটু ঝুঁকলেন তিনি। ‘কিন্তু যাই বলো, ভেবেচিন্তে বলো, রানা। আগে ভেবে দেখে নাও, প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে এবং তা সামলাবার মত শক্তি তুমি রাখো কিনা।’
নার্ভাস দেখাচ্ছে বয়েডকে। চঞ্চল হয়ে উঠেছে সে। ‘গড!’ বলল লংফেলোর দিকে ফিরে। ‘বুড়ো মানুষটাকে তোমরা উত্তেজনার মধ্যে ফেলছ।’
‘তোমাকে চুপ করে থাকতে বলেছি, সিংহের মত হুঙ্কার ছাড়লেন গাফ। ‘তৃতীয়বার বলব না আমি। রানা, বলো শুনি কি বলার আছে তোমার।’
কিছু বলতে যাচ্ছিল, রানা, পাফ বাধা দিলেন ওকে!
‘তার আগে তোমাকে জানিয়ে দিচ্ছি, তোমার সম্পর্কে সব আমার জানা আছে, রানা।’
‘মানে?’
‘তোমার সম্পর্কে আমি’ নানাদিক থেকে খবর নিয়েছি,’ গাফ বললেন। তুমি কে এবং কি তা আমি জানি।’
‘কিন্তু কতটুকু জানেন?’ বিস্ময় চেপে রেখে ব্যঙ্গের সুরে জানতে চাইল রানা!
‘যতটুকু জানা দরকার, সব!’ গাফ বললেন। ‘তুমি কে, তোমার যোগ্যতা কি, কারা আছেন তোমার পিছনে—সবই আমি জানি এখন। জানি বলেই বেরিয়ে এসেছি বাড়ি ছেড়ে এই ব্যাপারটা নিজে দেখব বলে। তোমাকে আমি ছোট করে দেখছি না, রানা। সেয়ানে সেয়ানে যুদ্ধই আমার পছন্দ। কিন্তু মুখ খোলার আগে একটা কথা শুধু মনে রেখো : এই এলাকার মালিক আমি। এটা আমার রাজ্য। এখানে আমার কথাই আইন।’
গম্ভীর হলো রানা। ‘ঠিক কি জানতে চান আপনি, মি. গাফ? আপনি বরং আমাকেই প্রশ্ন করুন।’
‘কেন এসেছ তুমি ফোর্ট ফ্যারেলে?’
‘খুঁড়তে?’
‘কি খুঁড়তে?’
‘কবর।’
‘কবর? কার কবর?’
‘ক্লিফোর্ডদের।’
থমথম করছে গাফের চেহারা। ‘কেন?’
‘মি. গাফ,’ প্রশ্নটার উত্তর না দিয়ে বলল রানা, ‘আপনি জানেন, কেনেথ এখন কোথায়?’
‘কোথায়?’
‘সে মারা গেছে।’
খবরটা একটা আঘাত হয়ে লাগল বৃদ্ধকে, তার আঁৎকে ওঠা দেখে বুঝতে পারুল রানা।
‘মারা গেছে!’ মাথার হ্যাট নামিয়ে মাথার চুলে আঙুল চালালেন গাফ। ‘কবে? কিভাবে মারা গেল?’ বিচলিত দেখাচ্ছে তাকে।
‘প্রথমবার তার ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়েছিল। তারপর হাসপাতালে ঢুকে তার বুকে ছুরি বসিয়ে দিয়ে আসা হয়েছে।’
‘হোয়াট!’ গাফ কাঁপছেন। ‘কি বললে! কেনেথকে খুন করা হয়েছে? কে—কে তাকে খুন করেছে?’
বুড়ো আঙুল বাঁকা করে বয়েডকে দেখাল রানা। ‘এই প্রশ্নটা আপনি আপনার পুত্রসন্তানকে জিজ্ঞেস করলে সঠিক উত্তর পেয়ে যাবেন।’
কিছু বলতে যাচ্ছিল রয়েড, তার দিকে রক্তচক্ষু মেলে তাকে থামিয়ে দিলেন গাফ। ‘আর কি জানো তুমি, রানা? কেনেথের সাথে কি সম্পর্ক ছিল তোমার?’
‘বন্ধুত্বের।’
‘কতদিনের পরিচয় ছিল?’
‘মাত্র কয়েক দিনের। কিন্তু তার সব কথা সে আমাকে বলে যাবার সময় পেয়েছিল।’
অভিজ্ঞ শকুনের মত তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন গাফ। রানাকে দেখছেন। ‘কেন তুমি ক্লিফোর্ডদের কবর খুঁড়তে চাও, রানা? ’
‘কেন চাই আপনি জানেন না?’
‘আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, রানা!’
‘আপনার মত দুর্বল মানুষের নির্দেশ পেতে অভ্যস্ত নই, মি. গাফ,’ গম্ভীর ভাবে বলল রানা। ‘তবে উত্তরটা আপনার জ্ঞাতার্থে জানাতে আপত্তি নেই।’
‘কি আশা করো তুমি ওদের কবরে?’ উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন গাফ, কাঁপছেন তিনি।
‘দুর্ঘটনার সময় গাড়িতে দু‘জন যুবক ছিল,’ বলল রানা। তাদের একজনের ওপরের মাড়ির দুটো পোকা খাওয়া দাঁত ফিলিং করা ছিল। কবর খুঁড়ে আমি কি দেখতে চাই পরিষ্কার বুঝতে পেরেছেন এবার?’
মুহূর্তের জন্যে দিশেহারা হয়ে উঠতে দেখল রানা গাফকে। কিন্তু দ্রুত নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করছেন তিনি।
আবার বলল রানা, ‘আরও অনেক কিছু জানি আমি, যেগুলোর সাহায্যে সত্য প্রকাশ করা সম্ভব।’
‘আমার শেষ প্রশ্ন, রানা,’ বললেন গাফ। ‘কেনেথের কাছ থেকে কতটুকু কি জেনেছ তুমি?
‘এ প্রশ্নের উত্তর আগেই আপনাকে আমি দিয়েছি।’
‘কিন্তু কেনেথ স্মৃতিভ্রংশের শিকার ছিল, তাই নয় কি?’
উত্তরটা এড়িয়ে গেল রানা। পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘ব্যাপারটা বুঝছি না কিন্তু। কেনেথকে আপনি কেনেথ বলে ডাকছেন কেন?’
লৌহ কঠিন মুখের চেহারা চুল পরিমাণ বদলে গেল বলে মনে হলো রানার। ‘কি বোঝাতে চাইছ তুমি কথাটা দিয়ে?’
‘কি বোঝাতে চাইছি তা আপনার জানা উচিত,’ বলল রানা, ‘ক্লিফোর্ডদের মৃতদেহ আপনিই সনাক্ত করেছিলেন,’ গাম্ভীর্যের সাথে বলল রানা। ‘কেনেথ যে কেনেথ নয়, আসলে, টমাস ক্লিফোর্ড-একথা আপনার চেয়ে বেশি আর কে জানবে?’
একচুল নড়লেন না গাফ, কিন্তু তার মুখের রঙ বদলে গেল দ্রুত। একটু দুলে উঠলেন এবং কথা বলার চেষ্টা করলেন। বোঁজা গলা থেকে দুর্বোধ্য ক’টা শব্দ বেরুল মাত্র, কথা ফুটল না। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে থরথর করে। কেউ ধরে ফেলার আগেই ধড়াশ করে মাটিতে আছড়ে পড়ল বিশাল দেহটা।
ছুটে গেল বয়েড। বাবার সামনে গিয়ে ঝুঁকে পড়ল। তার কাঁধের উপর দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছে রানা। বুড়ো গাফ এখনও বেঁচে আছেন, থেমে থেমে ক্ষীণ নিঃশ্বাস ছাড়ছেন। শার্টের আস্তিন ধরে পিছন থেকে টানল লংফেলো রানাকে। ‘হার্ট অ্যাটাক, বলল সে রানাকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে। আগেও এরকম হতে দেখেছি আমি। সেজন্যেই বাড়ি ছেড়ে বেরোয় না ও।’
সত্য উদঘাটনের মুহূর্তে ওর তলোয়ার বড় বেশি ধারাল ছিল, ভাবল রানা। কিন্তু যা শুনে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন গাফ সেটাই কি প্রকৃত সত্য? এখনও জানে না রানা। এখনও জানে না কেনেথ সত্যিই কেনেথ ছিল, নাকি ছিল টমাস ক্লিফোর্ড।