পনেরো
পৌছুতে রানার বিকেল গড়িয়ে গেল। কাইনোক্সি উপত্যকা থেকে ফোর্ট ফ্যারেলের বাস স্টেশন ঘুরে আসতে হয়েছে ওকে ডিপো থেকে ড্রিলিং যন্ত্রপাতি গাড়িতে তুলে নেয়ার জন্যে।
পৌঁছেই দেখল ও, ফ্যাসাদে পড়ে গেছে পারকিনসন করপোরেশন তাদের জেনারেটরগুলো নিয়ে। এসকার্পমেন্টের তলা দিয়ে পাওয়ার হাউজটাকে ঘুরে এগোবার সময় প্রায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়ার উপক্রম করল রানা। প্রকাণ্ড একটা বিশ টনী ট্রাক একটা আর্মেচার নিয়ে নাকানিচোবানি খাচ্ছে কাদায় আটকে গিয়ে।
ট্রাকটাকে ঘিরে কর্দমাক্ত শ্রমিকদের একটা দল গলদঘর্ম হচ্ছে, চিৎকার-চেঁচামেচির প্রতিযোগিতা চলেছে যেন তাদের মধ্যে। আরেকটা দল নুড়ি পাথর বয়ে নিয়ে এসে ফেলছে, তৈরি করার চেষ্টা করছে একটা রাস্তা। হাঁটু, কারও কারও কোমর পর্যন্ত, ডুবে গেছে কাদায়। মাত্র দুশো গজ দূরে পাওয়ার হাউজটা। কিন্তু এই কাদার উপর দুশো গজ রাস্তা তৈরি করা অসম্ভব বলেই মনে হলো রানার।
গাড়ি থামিয়ে মজাটা দেখতে লাগল ও। লোকগুলোকে অহেতুক কষ্ট করতে দেখে একটু খারাপও যে লাগছে না তাও নয়। কিন্তু জেনারেটরগুলোকে এভাবে পাওয়ার হাউজে নিয়ে যেতে না পারলেও দিনের মজুরী এরা সবাই পাবে, সুতরাং সহানুভূতি অপাত্রে ঢালতে সায় দিল না মন। সময় এবং টাকা লোকসান যা হচ্ছে সবই পারকিনসনদের। রানা ভাবল, শীলার জন্যে এটা সুবিধেই বয়ে আনবে। সুইস গেট খুলতে আরও সময় লাগবে, বোঝাই যাচ্ছে, তার মানে কাইনোক্সি উপত্যকার শীলার অংশ এক হপ্তার মধ্যে ডুবছে না।
আকাশের দিকে তাকাল রানা। দক্ষিণ প্রান্ত থেকে মিছিল করে আসছে কালো মেঘ। যদি বৃষ্টি হয়, পাড় থেকে মাটি ধসে পড়ে কাদার পরিমাণ দশ গুণ বাড়িয়ে দেবে।
রাস্তা থেকে বাঁক নিয়ে এগিয়ে এল একটা জীপ, কাদার উপর ব্রেক কষে দাঁড়াল। দরজা খোলার সাথেই ছিটকে বেরিয়ে এল বাইরে বিগ প্যাট। ‘এখানে তোমার কি কাজ, শুনি?’
ট্রাকগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে হাসল রানা। উত্তরটা দিতে ইচ্ছা করেই দেরি করল একটু। ‘কোনও কাজ নেই, মজাটা দেখছি।’
কালো হয়ে গেল বিগ প্যাটের মুখ। ‘এদিকে তোমাকে আমরা দেখতেই চাই না,’ দু‘কোমরে হাত রাখল সে। ভালয় ভালয় কেটে পড়ো।’
‘কিন্তু গাফ পারকিনসন? তিনিও কি চান না? তোমার সাথে বুঝি দেখা হয়নি তাঁর? কিংবা, বয়েডের মাধ্যমে তাঁর নির্দেশ এখনও বুঝি পাওনি?’
রাগে দাঁতে দাঁত ঘষল বিগ প্যাট নিঃশব্দে। রানাকে এক হাত দেখাবার জন্যে ছটফট করছে সে, কিন্তু গাফ পারকিনসনের কথা ভেবে নিজেকে দমন না, করে উপায় দেখছে না।
শান্তভাবে বলল রানা, তেড়িবেড়ি কিছু করলেই কড়া একটা চড়ের মত গাফ পারকিনসনের গালে এসে পড়বে কোর্ট অর্ডার। এবং তুমি দায়ী বলে তিনি তোমাকে নিশ্চয়ই কোলে তুলে সকাল-বিকেল দুই গালে চুমু খাবেন না। তার চেয়ে নিজের চরকায় তেল দাও গিয়ে, কাদা থেকে ট্রাকগুলোকে কিভাবে তুলতে পারো তার চেষ্টা করো। আবার বৃষ্টি এলে লেজে গোবরে জড়িয়ে পড়তে হবে।’
‘আবার…কি বললে?’ ভুরু কুঁচকে মারমুখো হয়ে উঠল বিগ প্যাট। ‘বৃষ্টি হতে কখন দেখলে তুমি?’
‘হয়নি বলছ? তাহলে কাদা এল কোত্থেকে?’ মুচকি হাসল রানা।
‘কোত্থেকে এল তা আমি কি করে বলব? ওখানেই ছিল আগে থেকে,’ হঠাৎ ব্যাপারটা ধরতে পারল বিগ প্যাট। ‘ঠাট্টা করছ আমার সাথে, না? বড় বাড় বেড়েছ তুমি, রানা। কিন্তু মনে রেখো, মি. গাফও তোমার শেষ দেখে ছাড়বেন। তিনি যখন
খেপবেন কেউ তাকে ঠেকাতে পারবে না।’
‘তুমি আসলে কুয়ার ব্যাঙ, বিগ প্যাট,’ বলল রানা। হাসছে। ‘কিছুই জানো না। তোমাদের গাফকে খেপাবার জন্যেই তো আমি ফোর্ট ফ্যারেলে এসেছি। কিন্তু ‘মুশকিল হলো, খোঁচা খেয়েও হজম করছেন তিনি, নড়াচড়া করছেন না। শোনো তাহলে, আমার ভবিষ্যৎ কর্মসূচীটা তোমাকে শুনিয়েই দিই। খোঁচায় কাজ হবে না, বুঝতে পেরেছি। তাই এবার মার লাগাব। এ-মার কিন্তু হাতের মার নয়। হাতের মার তোমাদের জন্যে তুলে রেখেছি।’
‘ঠিক আছে,’ চরকির মত আধপাক ঘুরে জীপের দিকে ছুটল বির্গ প্যাট, ‘গিয়ে সব বলছি মি. বয়েডকে! তোমার গায়ের ছাল তুলবেন তিনি, দেখে নিয়ো!’
পিছন থেকে হাসল শুধু রানা।
হেলেদুলে রাস্তায় গিয়ে উঠল জীপটা, তারপর রাস্তা ধরে তীরবেগে ছুটে অদৃশ্য হয়ে গেল একটা বাঁকে। সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে কাদার দিকে তাকাল রানা। ভাবছে। বোতাম টিপে দিয়েছে ও। মাত্র একটা। এখন দেখা যাক, বৈদ্যুতিক ধাক্কা কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
স্টার্ট দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল রানা। পাওয়ার হাউজ ছাড়িয়ে রাস্তায় পড়ে পাহাড়ের দিকে উঠতে শুরু করল। মাঝামাঝি উঠে গাড়ি থামিয়ে নামবে, এমন সময় এঞ্জিনের শব্দে থমকে গিয়ে পিছন দিকে তাকাল।
ঝকঝকে একটা মাইক্রোবাস থামল জীপের পাশে। গম্ভীর চেহারা নিয়ে সেটা থেকে নামল লংফেলো। সাথে একটা পাহাড়-জ্যাক লেমন।
‘এখানে তোমরা কি মনে করে?’ জীপ থেমে নেমে জানতে চাইল রানা। ‘কারও ঘাড়ে বোঝা হবার ইচ্ছে নিয়ে নয়, এসেছি নিজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে,’ গম্ভীর ভাবে জানিয়ে দিল লংফেলো।
‘আর তুমি?’ প্রশ্ন করল রানা।
‘লক্ষ লক্ষ ডলারের লোভ নেই বলে এতদিন গায়ে মাখিনি,’ বলল লেমন, ‘পারকিনসনরা অন্যায় ভাবে আমার মিস্ত্রী, খদ্দেরদের ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, আমার মিস্ত্রীদেরকে দিয়ে তারা গ্যারেজ থেকে স্পেয়ার পার্টস চুরি করায়, যাতে ব্যবসায় আমি লাল বাতি জ্বালাই। মুখ বুজে সহ্য করেছি এতদিন। কিন্তু যেই শুনলাম ওদের বিরুদ্ধে অন্তত একজন লোক কিছু করতে যাচ্ছে, অমনি ছুটে এসেছি। আমারও করার মত কিছু আছে। আমি যে বয়েডকে ভয় করি না এটা প্রকাশ করার সময় হয়েছে এখন।’
‘কিন্তু ওদের সাথে গায়ের জোরে তুমি পারবে কেন!’
‘মানুষ অতিষ্ঠ হলে অন্যায়ের প্রতিকার করার জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে, পারা না পারার প্রশ্ন তখন অবান্তর—তাই নয় কি?’ হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে জ্যাক লেমন জানতে চাইল, ‘শুনলাম তুমি নাকি ক্লিফোর্ডদের হত্যাকাণ্ড রহস্যের মীমাংসা করতে ফোর্ট ফ্যারেলে এসেছ, মি. রানা?’
‘ঠিকই শুনেছ,’ বলল রানা। ‘কিন্তু তুমি কি মনে করো সেটা একটা হত্যাকাণ্ড ছিল?’
‘ঠিক কি মনে করি তা জানি না,’ বলল জ্যাক লেমন। ‘তবে, ঘটনাটা ছিল খুবই আশ্চর্য। গোটা পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, ভাবতে কেমন যেন লাগে! কিন্তু তার চেয়ে আজব ব্যাপার, ক্লিফোর্ডরা মরতেই তাদের সমস্ত সম্পত্তি, বাড়িঘর, টাকা পয়সা—সব, সব, চলে গেল পারকিনসনদের পকেটে। তারপর, ফোর্ট ফ্যারেল থেকে ক্লিফোর্ডদের নামটাও মুছে ফেলা হলো। এসব দেখে কি সন্দেহ করা যেতে পারে তা তো বুঝতেই পারো।’
‘হুঁ,’ গাড়ির দিকে ফিরল রানা। তারপর বলল, ‘এসেই যখন পড়েছ, গতর খাটাও খানিক। ড্রিলিং রিগটা গাড়িতে তুলতে দম ফুরিয়ে এসেছিল আমার। ধরাধরি করে নামাও ওটা।’
‘ড্রিলিং রিগ? ও দিয়ে কি হবে?’ আকাশ থেকে পড়ল লংফেলো।
এসকার্পমেন্টের কিনারাটার দিকে আঙুল তুলে দেখাল রানা। ‘প্রথম গর্তটা ঠিক ওটার মাঝখানে খুঁড়তে চাই আমি, ওই ওখানে।’
‘কি…কি বললে?’
‘এতেই এত ঘাবড়ে যাচ্ছ?’ মুচকি হাসল রানা।
বাঁধের পাঁচিলের দিকে চেয়ে আছে জ্যাক লেমন। খাড়াভাবে কংক্রিট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে সেটা। ‘এতবড় তা কিন্তু ভাবিনি!’ বিস্ময় প্রকাশ পেল তার কণ্ঠে। ‘কত হারামের পয়সা খরচ হয়েছে কে জানে!’ পাহাড়ের নিচের দিকে তাকাল সে। পিঁপড়ের মত দেখা যাচ্ছে অসংখ্য মানুষকে। ‘ওরা কি গোলমাল করতে আসতে পারে, মি. রানা?’
‘পারে,’ বলল রানা। ‘যদিও ওদেরকে গোলমাল না করার জন্যে সাবধান করে দেয়া হয়েছে।’
‘তবু আসতে পারে?’ জানতে চাইল লংফেলো।
‘আমি যদি বাড়াবাড়ি করি, না এসে ওদের উপায় কি?’
‘বাড়াবাড়ি…’
‘করছি বৈকি,’ বাধা দিয়ে বলল রানা। ‘আরও অনেক করব। ওরা একবার এলেই হয় শুধু এখন।’
ড্রিলিং যন্ত্রপাতি নিয়ে বিপাকেই পড়ল ওরা। জ্যাক লেমন না থাকলে এঞ্জিনটাকে চালু করতে পারত কিনা সন্দেহ হলো রানার। পনেরো বার অস্বীকৃতি জানাবার পর সেটা হঠাৎ স্টার্ট নিয়ে কান ফাটানো আওয়াজ করতে শুরু করল। এত বেশি ধাক্কা মারছে পিস্টনটা, রানার মনে হলো কনেকটিং রড এঞ্জিনের দেয়াল ফুঁড়ে যে-কোন মুহূর্তে ছিটকে বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু জ্যাক লেমনের যাদু স্পর্শে এঞ্জিনটা অটুট তো থাকলই, স্টার্টও বন্ধ হলো না।
দেরি না করে কাজে নেমে পড়ল রানা। এবং ওর আশা অনুযায়ী, এঞ্জিনের শব্দে আকৃষ্ট হয়ে ছুটে এল পারকিনসনদের দল থেকে কেউ একজন। ঝড়ের বেগে জীপটাকে আসতে দেখে মুচকি একটু হেসে নিজের কাজে মন দিল রানা। ভাবছে, আসছেটা কে?
রানার সামনে দু‘কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে লংফেলো আর জ্যাক লেমন। রানা মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসেছে। জীপের শব্দ ক্রমশ এগিয়ে আসছে শুনতে পাচ্ছে ও। মুখ তুলে সামনের দিকে তাকাল একবার। দেখল চিৎকার করার জন্যে মুখ খুলছে লংফেলো। চোখ কপালে উঠে গেছে লেমনের।
পৈশীগুলো শক্ত হয়ে উঠল রানার। পিছন ফিরে তাকাতে যাবে, এমন সময় ব্রেক কষার আওয়াজ পেল ও। ঠিক ওর পিঠের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে জীপটা।
ধীরে ধীরে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল রানা। জীপ থেকে মাথা কামানো দুই লোক নামছে, দেখল ও। দশাসই চেহারা আর মুখের গাম্ভীর্য দেখেই যা বোঝার বুঝে নিল রানা: এরা পারকিনসনদের পোষা গুণ্ডা।
‘এসব কি হচ্ছে এখানে?’
কানের পিছনে একটা হাত রেখে চিৎকার করে উঠল রানা, ‘শুনতে পাচ্ছি না!’
যে লোকটা কথা বলছে তার পরনে ট্রাউজার আর শার্ট, কোট নেই। ট্রাউজারের পকেটটা উঁচু হয়ে আছে তার। দ্বিতীয় লোকটার পরনে কমপ্লিট স্যুট। তার হাতে ছোট সাইজের একটা ওয়্যারলেস সেট দেখা যাচ্ছে। সেটটা অফ করা রয়েছে। সঙ্গীকে এক পা এগিয়ে যেতে দেখেও নিজের জায়গা ছেড়ে নড়ল না সে।
এক পা এগিয়ে দ্বিতীয় লোকটা বলল, ‘এসব যন্ত্রপাতি নিয়ে কি করছ তুমি এখানে?’
‘একটা টেস্ট হোল তৈরি করছি।’
এঞ্জিনের আওয়াজকে ম্লান করে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল লোকটা, ‘সুইচ অফ করো ওটার!’
এদিক ওদিক মাথা নেড়ে অসম্মতি প্রকাশ করল রানা। তারপর হাত নেড়ে পাহাড়ের খানিকটা নিচের একটা জায়গা দেখিয়ে দিল লোকটাকে।
উঠে দাঁড়াল রানা। নিচে নামতে শুরু করল ধীর ভঙ্গিতে। লোকটা ওকে অনুসরণ করে নামছে কিনা দেখার জন্যে একবারও পিছন ফিরল না ও।
পঁচিশ গজের মত নেমে দাঁড়াল রানা। তারপর ঘুরে দাঁড়াতেই দেখল লোকটা ওর ঠিক তিন হাত সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ‘এসবের মানে কি জানতে চাই আমি। টেস্ট হোল তৈরি করছ বলতে ঠিক কি বোঝাতে চাও?’
‘আরও সহজ করে বলব? বেশ। মাটিতে গর্ত খুঁড়ে দেখতে চাই ভিতর থেকে কি উঠে আসে।’
‘এখানে এসব করা চলবে না।’
‘কেন করা চলবে না?’
‘কারণ…কারণ…’
‘কোন কারণ নেই,’ দৃঢ়কণ্ঠে বলল রানা। ‘ক্রাউন ল্যাণ্ডে গর্ত খুঁড়ছি আমি। এটা আমার আইনসঙ্গত অধিকার।’
কি করবে ঠিক করতে পারল না লোকটা। ‘ঠিক আছে, জেনে আসি ব্যাপারটা,’ বলেই ঘুরে দাঁড়াল সে, জীপের দিকে উঠে গেল।
জীপটাকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখল রানা। তারপর ফিরে এসে আবার গর্ত খোঁড়ার কাজে হাত লাগাল।
গোটা ব্যাপারটাই প্রহসন। রানা জানে, এই এলাকার মাটির নিচে মূল্যবান কোন খনিজ পদার্থ নেই। কিন্তু ব্যাপারটাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার জন্যে গর্তের ভিতর থেকে যে জঞ্জাল বেরুল সেগুলোকে কাগজের মোড়কে মুড়ে জীপে তুলে রাখতে শুরু করল ও। প্রথম গর্ত থেকে যা বের করার করে নিয়ে ইঞ্জিন অফ করেছে মাত্র, এমন সময় আসতে দেখা গেল বিগ প্যাটকে।
‘খেপতে বড় বেশি সময় নিচ্ছে পারকিনসনরা,’ মুচকি হেসে বলল রানা। ‘আরও বড় ডোজের ওষুধ লাগবে বলে মনে হচ্ছে।’
লংফেলোর দৃষ্টি শুধু তীক্ষ্ণ হলো, কোন মন্তব্য করল না। রানাকে বুঝতে চেষ্টা করছে সে, কিন্তু বুঝতে পারছে না এখনও এই আয়োজনের মাধ্যমে ঠিক কি হাসিল করতে চাইছে রানা।
জ্যাক লেমন বলল, ‘ঠ্যালা সামলাও এবার!’
‘মানে?’ জানতে চাইল লংফেলো।
‘দেখতে পাচ্ছ না কুকুরের লেজ আসছে?’ বিগ প্যাটের দিকে ইঙ্গিত করে বলল লেমন।
হো-হো করে হেসে উঠল রানা। বলল, ‘ওর নাম যাতে তুমি বদলে রাখতে পারো তার ব্যবস্থা আমি করব, লেমন। কথা দিচ্ছি।’
চেহারা দেখেই বোঝা গেল, পাওয়ার হাউজে জেনারেটর নিয়ে যাওয়ার সমস্যাটার সমাধান করতে না পেরে মেজাজ উত্তপ্ত হয়ে আছে বিগ প্যাটের। কাদার পুরু প্লাস্টার প্যান্টের হাঁটু পর্যন্ত। সারা গায়েও বড় বড় কাদার ছোপ। মুখের, চেহারাটা রুক্ষ। কাছাকাছি এসে দাঁড়াল সে। হাত নেড়ে বলল, ‘আর কোন কাজ নেই আমার, শুধু তোমার সাথেই লেগে থাকতে হবে?’
‘না চাইলে লাগবে কেন?’ বলল রানা, ‘তুমি হাজার বার এলেও আমার উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। আমি বয়েডকে ছুটে আসতে দেখতে চাইছি।’
‘এঞ্জিনের শব্দ হচ্ছিল কিসের? কি করছিলে তোমরা?’
‘মাটিতে গর্ত খুঁড়ছিলাম। পারকিনসনদের মাটিতে বা তাদের মাথায় নয়, ক্রাউন ল্যাণ্ডে।’
এ ব্যাপারেও কি অনুমতি নেয়া আছে তোমার মি. গাফের কাছ থেকে?’
‘অনুমতি! কিসের অনুমতি? কারও অনুমতি দরকার নেই আমার।’
‘ওহ, তার মানে মি. গাফ এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না?’
‘তা কিভাবে বলব? কেউ যদি জানিয়ে না থাকে তাহলে জানার কথা নয় অবশ্যই।’
ধীরে ধীরে দু‘কোমরে হাত রেখে মুখের চেহারা কঠিন করে তুলল বিগ প্যাট! ‘তুমি পারকিনসন বাঁধ আর পারকিনসন পাওয়ার হাউজের মাঝখানে গর্ত করছ অথচ অনুমতির দরকার আছে বলে স্বীকার করছ না। রানা, মি. গাফ তোমাকে পাগলাগারদে পাঠাবেন।’
তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল রানা, ‘যত কিছুই বলো, এটা পারকিনসনদের জায়গা নয়। এই জায়গার বিশেষ স্বত্ব যদি ভোগ করতে চায় তারা তাহলে সরকারের সাথে বিশেষ চুক্তি সম্পাদন করতে হবে তাদের। যদ্দিন না তা করছে, আমি জায়গাটা গর্ত করে মৌমাছির চাকের মত ঝাঁঝরা করে ফেললেও কারও কিছু বলবার নেই। ওয়্যারলেসে যোগাযোগ করে আমার এই কথাটা তাকে গিয়ে শোনাও, খোকা। মেসেজে ওদেরকে একথাও জানিয়ো বাঁধ নিয়ে তারা বিপদে পড়েছে।’
কথাটার অর্থ বুঝল না বিগ প্যাট। রানার দিকে বোকার মত চেয়ে থাকল। ‘মানে?’ অস্বাভাবিক একটা চিৎকারের মত শোনাল তার কণ্ঠস্বর। ‘বাঁধ নিয়ে বিপদে পড়েছে মানে?’
‘মানে ওদের মুখেই শুনো,’ বলল রানা। ‘তুমি ওদের বেতনভুক চামচা, তোমাকে কেন সব কথা শোনাতে যাব? ওদেরকে পাঠাও, তখন বলব।’
‘ঠিক আছে, যাচ্ছি আমি,’ হাত নেড়ে বলল বিগ প্যাট। আর কোন গর্ত যাতে খুঁড়তে না পারো তার ব্যবস্থা আজই করা হবে, এটুকু জেনে রাখো।’ রানার পায়ের কাছে মাটিতে থুথু ফেলল সে, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে লম্বা পা ফেলে হাঁটতে শুরু করল।
‘বিপদটা আসলে কি? নাকি ভুয়া একটা ব্যাপার মাত্র?’ আগ্রহে চকচক করছে চোখ দুটো, রানার দিকে ঝুঁকে পড়ে জানতে চাইল লংফেলো।
‘ধীরে, লংফেলো, ধীরে,’ কৃত্রিম গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বলল রানা। ‘সময় হলে সবই জানতে পারবে। এখন চলো দেখি, একটু উপরে উঠি। আরও দুটো গর্ত খুঁড়তে হবে আমার।’
পাহাড়ের ধারে বয়ে নিয়ে যাওয়া হলো ড্রিলিং যন্ত্রপাতি। চল্লিশ ফুট দীর্ঘ একটা গর্ত করল রানা। তারপর আবার রাস্তার ধারে ফিরে এসে, জীপটার কাছাকাছি তৃতীয় আর একটা গর্ত করল ও। মাটির নমুনা নিয়ে নিচের রাস্তায় ফেরার সময় পথরোধ করে দাঁড়াল একটা গাড়ি। ঝকঝকে টয়োটা ডিল্যাক্স থেকে ধীর ভঙ্গিতে রাস্তার উপর নামল ছোট পারকিনসন। সারা মুখে লেপটে আছে ঘাম, চকচক করছে রোদ লেগে। এমন লাল মুখ বড় একটা চোখে পড়েনি রানার। পিন দিয়ে ফুটো করলে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটবে বলে মনে হলো। রানার দিকে স্থির শীতল দৃষ্টি রেখে এগিয়ে আসছে সে। হাঁটার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের দৃঢ়তা নজর এড়াল না রানার।
সামনে এসে দাঁড়াল বয়েড। হ্যাটটা বগলের নিচে চেপে ধরল।
‘রানা, আমার সহ্যের সীমা তুমি ছাড়িয়ে যাচ্ছ,’ কণ্ঠস্বরটা নিচু কিন্তু দৃঢ়। কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘কারও সহ্যশক্তি কম থাকলে আমার কিছু করার নেই, বয়েড। ওটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, আমি কোন মন্তব্য করতে চাই না। ঠিক কেন এসেছ তুমি এদিকে?’
‘বিগ প্যাট বলল তুমি নাকি গর্ত খুঁড়ছ এদিকে। আমি চাই, এদিকে আর যেন গর্ত খোঁড়া না হয়। কি বলার আছে তোমার এ ব্যাপারে?’
‘দরকার ছিল, খুঁড়েছি,’ বলল রানা। ‘আবার যদি দরকার হয়, খুঁড়ব বৈকি।’
‘আমার আদেশ অমান্য করেও?’
‘কে হে তুমি?’ ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল রানা।
দাঁতে দাঁত চাপল বয়েড। ‘এসব ব্যাপারে আপাতত আমি মাথা ঘামাচ্ছি না, কিন্তু শুনতে পাচ্ছি তুমি নাকি ক্লিফোর্ডদের মৃত্যুটাকে হত্যাকাণ্ড বলে উল্লেখ করছ আর লোককে বলে বেড়াচ্ছ যে হত্যারহস্য মীমাংসা করতেই এসেছ ফোর্ট ফ্যারেলে, সত্যি?’
‘লোকে এসব বলছে বুঝি?’
‘আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।’
‘তুমি তো সবই জানো। নতুন আর কি শুনতে চাও?’
ঘামে ভেজা বয়েডের মুখে নতুন ঘামের ফোঁটা দেখা যাচ্ছে। ‘সব জানি মানে? সব কি জানি আমি?’ ধীর স্থির রাখতে চাইছে বয়েউ তার কণ্ঠস্বর।
‘জানো, সেটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল না। জানো, আরোহীদের মধ্যে একজন কপালগুণে বেঁচে গেছে…’
‘কেনেথের কথা বলছ তুমি?’
‘কার কথা বলছি জানো না? আমার বিশ্বাস তাও তুমি জানো।’
‘তুমি পাগল,’ বলল বয়েড, নীল হয়ে গেছে তার মুখের চেহারা। ‘কিংবা, কথাটা ঘুরিয়ে বললে বলতে হয়, দিন ফুরিয়ে এসেছে তোমার। এই পৃথিবীর আলো-হাওয়া-বাতাস তোমার জন্যে নয়।’
‘খারাপ মানুষের এই এক ধরন,’ বলল রানা। ‘নিজের কপালে যা ঘটতে যাচ্ছে তাই সে অন্যের ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করে।’
‘ওসব কথার মারপ্যাঁচ শোনার জন্যে আমি এখানে আসিনি,’ বয়েড বলল। ‘এই শেষ সুযোগ দিচ্ছি তোমাকে আমি, রানা। এরপর তোমাকে আমি আধখানা সুযোগও দেব না। আমি চাই, দুর্ঘটনাটাকে হত্যাকাণ্ড বলা বন্ধ হোক।’
‘মামার বাড়ির আবদার?’ বলল রানা। ‘নিজেদের মধ্যে লোকজন কি বলছে না বলছে সে ব্যাপারে আমি কোনু দুঃখে মাথা ঘামাতে যাব? যা খুশি বলুক তারা, আমার কোন ক্ষতি হচ্ছে না। তবে, মনে হচ্ছে, তুমি খুব ভয় পেয়েছ। ভয়ের কি আছে, বয়েড? যা সত্য তা যদি রটেই তাতে তোমার কি এসে যায়?’
‘সব ব্যাপার জানতে চেয়ো না, রানা। আমার শেষ কথা আমি বলে দিয়েছি—এরপর ভেবেচিন্তে পা ফেলো তুমি। বাবা তোমাকে সাবধান করে দিয়েছেন, তুমি শোনোনি। তাঁর কথামত তোমাকে আমি ‘একটা শেষ সুযোগ না দিয়ে পারলাম না। তোমার কোন ক্ষতি এতদিন আমি করতে চাইনি, ভেবেছিলাম নিজের ভালটা তুমি দু‘দিন দেরিতে হলেও বুঝবে। কিন্তু এখন দেখছি ভুল করেছি থাক, একই ভুল দ্বিতীয়বার করতে চাই না আমি। কবে যাচ্ছ জানতে পারলে খুশি এতাম, রানা।’
‘এক্ষুণি যেতে চাই,’ বলল রানা, তারপর আঙুল দিয়ে টয়োটাকে দেখাল। ‘ওটা না সরালে যাই কিভাবে?’
‘খুব বেশি স্মার্ট মনে করো নিজেকে,’ বলল বটে, কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকল না। ফিরে গিয়ে গাড়িতে চড়ল, গাড়ি ব্যাক করে জায়গা করে দিল রানার জীপকে।
টয়োটার পাশে থামাল রানা জীপটা। ‘বয়েড, বাঁধটা ভাঙছ কবে?’
মুহূর্তে পাথর হয়ে গেল বয়েড। ‘কি!’
‘বাঁধটার কথা বলছি,’ গম্ভীর হলো, রানা। ‘ওটা বোধহয় তোমাদের ভেঙে ফেলতে হবে, বয়েড।’
কথা বলছে না বয়েড। রানার দিকে তাকিয়ে আছে শুধু।
‘কারণটা জিজ্ঞেস করছ না কেন?’
‘কি কারণ?’
‘কাইনোক্সি উপত্যকার মাটির নিচে দামী খনিজ পদার্থ পাওয়া গেছে,’ বলল রানা। ‘গোপনীয়তার স্বার্থে এই মুহূর্তে সব কথা তোমাকে বলা, সম্ভব নয়। শুধু জেনে রাখো, বাঁধের কাজ যাতে বন্ধ করার হুকুম দেয়া হয় তার জন্যে সরকারের কাছে আবেদন করছি আমরা…’
‘করো না,’ রানাকে কথা শেষ না করতে দিয়েই নিষেধ করল বয়েড। ‘এবং চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ফোর্ট ফ্যারেল ছেড়ে চলে যাও। অস্বাভাবিক শান্ত গলায় বলল সে, তোমার ভালর জন্যেই বলছি।’ গাড়ি ছেড়ে দিল সে। রাস্তা ছেড়ে পাশের কাদায় পড়তেই আটকে গেল গাড়ির চাকা। সামনে এগোচ্ছে না দেখে গাড়ি ব্যাঙ্ক করল বয়েড। সবেগে ছুটে গিয়ে পাহাড়ের গায়ের সাথে ধাক্কা খেল টয়োটা। তীব্র একটা ঝাঁকুনি খেল।
তার উদ্দেশে সহাস্যে হাত নাড়ল রানা। হুস্ করে বেরিয়ে গেল জীপটা ফোর্ট ফ্যারেলের উদ্দেশে।
একটা কথাও হলো না গাড়িতে। লংফেলো গম্ভীর, থমথম করছে মুখের চেহারা। ঘনঘন চশমা নামিয়ে কাঁচ মুছছে শুধু। জ্যাক লেমন পরিষ্কার কিছুই বুঝতে পারছে না। একবার রানার দিকে আরেকবার লংফেলোর দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝার ব্যর্থ চেষ্টা করছে শুধু।
লংফেলোর কেবিনের সামনে থামল জীপ। ‘ওটা মিস. ক্লিফোর্ডের স্টেশন ওয়াগন না?’ জানতে চাইল জ্যাক লেমন
নিচে নামতে নামতে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটার দিকে চোখ রেখে লংফেলো বলল, ‘হ্যাঁ। ওই তো শীলা!’
জীপের শব্দ পেয়ে বেরিয়ে এসেছে শীলা বাইরে। ওদের দেখে ছুটে কাছে চলে এল। ‘চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছিলাম,’ বলল, ‘এক্ষুণি ভাবছিলাম গিয়ে দেখেই আসি কিছু অঘটন ঘটল কিনা!’ হাঁপাচ্ছে শীলা। ‘তেমন কিছু ঘটেনি তো?’
‘তুমি এসে পড়েছ,’ মুচকি হেসে বলল রানা, ‘তার মানে, আজ থেকে আবার আমাকে জঙ্গলে রাত কাটাতে হবে।’
‘আমার ছেলের মা আবার দুশ্চিন্তা করবে আমাকে নিয়ে,’ লাজুক হাসি হেসে বলল জ্যাক লেমন, ‘এখন যাই, দরকার পড়লেই আবার আমাকে খবর দিয়ো, ফেলো কাকা।’
‘দরকার তো পড়বেই,’ বলল লংফেলো। ‘কোথাও যদি যাও বাড়িতে জানিয়ে যেয়ো।
‘হয় বাড়িতে, নয় গ্যারেজে থাকব,’ বলে বিদায় নিয়ে চলে গেল জ্যাক লেমন!
শীলার সাথে বকবক করতে করতে কেবিনের দিকে এগোল লংফেলো। ওদেরকে অনুসরণ করল রানা।