চোদ্দ
পরদিন সকালে কাইনোক্সি উপত্যকায় পৌঁছে দিল রানা শীলাকে।
বুড়ো ডিকসনকে বন্দুক হাতে হাঁস যোগাড় করে আনতে পাঠিয়ে দিয়ে স্টোভ জ্বেলে তাতে কফির গানি চড়াল শীলা। সোফায় হেলান দিয়ে বসে সিগারেট ধরাল রানা। ‘তোমার এলাকাটা সার্ভে করতে না দিয়ে ভুলই করেছ তুমি, শীলা,’ বলল রানা। ‘কে জানে, হয়তো সত্যি সোনার খনি আছে মাটির নিচে।’
‘দূর!’ কাপে কফি ঢালতে ঢালতে হেসে উঠল শীলা।
‘উড়িয়ে দিচ্ছ কথাটা?’ বলল রানা, ‘আর কিছু না হোক, বাঁধ তৈরির কাজে ওদেরকে একটা বাধা দেয়া যেত।’
রানার হাতে একটা কাপ ধরিয়ে দিয়ে পাশের সোফায় বসল শীলা। ‘কিভাবে?’
‘ধরো, সার্ভে করে জানা গেল তোমার এলাকায় খনিজ পদার্থ আছে। বিষয়টা আমরা সরকারের গোচরে আনলাম।’
‘বেশ। তারপর?
‘বাঁধ যত লোকের কর্মসংস্থান করবে তার চেয়ে কয়েকশো গুণ বেশি লোকের রুজি রোজগারের ব্যবস্থা করবে একটা খনি, সুতরাং, সরকার বাঁধ তৈরির অনুমতি প্রত্যাহার করে নেবে।’
‘ভাল কথা মনে করিয়ে দিয়েছ,’ কাপটা নামিয়ে রেখে বলল শীলা। ‘হাতে কি সময় নেই? এখনও তো দেখতে পারো পরীক্ষা করে।’
‘তা পারি,’ বলল রানা, ‘যন্ত্রপাতি নিয়েই এসেছি। খনি থাক বা না থাক, আছে এই কথা প্রচার করে দিয়ে ওদের কাজে বাধাও সৃষ্টি করতে পারি।’
‘কিন্তু পরে?’
‘পরের কথা পরে ভাবা যাবে,’ বলল রানা। ‘ওদেরকে খেপিয়ে দিয়ে দেখিই না, কোন লাভ হয় কিনা।’
‘শেষ পর্যন্ত সবদিক যদি সামলাতে পারো তাহলে তোমার যা খুশি তাই করতে পারো, আমি কোন বাধা দেব না।’
‘ভেবে দেখি আরও,’ কথাটা বলেই চমকে মুখ তুলল রানা জানালার দিকে। উঠে দাঁড়িয়েছে শীলা। কপ্টারের আওয়াজ তার কানেও গেছে।
‘তুমি বসো,’ বলে দ্রুত বেরিয়ে গেল শীলা কামরা থেকে।
জানালা দিয়ে রানা দেখল ‘কপ্টারটা বাড়ির পিছন দিকের খোলা মাঠে নামছে। এক মিনিট পর বয়েড আর নায়ান মিলারকে যান্ত্রিক ফড়িংটা থেকে নিচে নামতে দেখল রানা। শীলাকেও দেখা যাচ্ছে। ধীর ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে সে ওদের দিকে। ‘কপ্টারের এঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে পাইলটকেও নিচে নামতে দেখে রানা ভাবল, যে কাজেই এসে থাকুক ওরা, বেশ কিছুক্ষণ থাকবে বলে মনে হয়।
একটা বিতর্ক শুরু হয়েছে বলে ধারণা করল রানা। বয়েড দু’কোমরে হাত রেখে কথা বলছে দুটো একটা। নাথান হাত নেড়ে ব্যাখ্যা করছে সম্ভবত তার বক্তব্যের অর্থ। কিন্তু কঠিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে শীলা। মাঝেমধ্যে তার ঠোঁট নড়তে দেখতে পাচ্ছে রানা। থেকে থেকেই অসম্মতি প্রকাশ করছে সে এদিক ওদিক মাথা নেড়ে। একসময় বয়েড একটা প্যাকেট বের করে চুরুট ধরাল। তারপর বাড়ির দিকে ইঙ্গিত করে মাথা নাড়ল সে।
দূর থেকেও পরিষ্কার অনুভব করল রানা, শীলা ইতস্তত করছে। হঠাৎ কাঁধ ঝাঁকাল সে। তারপর ওদের দু‘জনকে পিছনে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
অদৃশ্য হয়ে গেল তিনজনই রানার দৃষ্টিপথ থেকে। এক মিনিট পর ওদের অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর পেল ও পাশের ড্রয়িংরূম থেকে।
খানিক ইতস্তত করার পর ওদের আলোচনায় নাক গলানো থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিল রানা। ভাবল, শীলা জানে ওর এলাকার গাছের দাম কত হতে পারে, সুতরাং দর কষাকষিতে খুব একটা ঠকে যাবার ভয় নেই তার।
শীলার এলাকাটা আগামীকাল সকাল থেকেই সার্ভে করতে শুরু করবে ঠিক করে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে শুরু করল রানা। দশ মিনিট পর কাজে বাধা দিল শীলা।
‘আমাদের সাথে বসতে তোমার আপত্তি আছে?’
মুখ তুলতে রানা দেখল দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে শীলা। ঠোঁট দুটো পরস্পরের সাথে শক্তভাবে সেঁটে আছে।
শীলার পিছু পিছু ড্রয়িংরূমে ঢুকল রানা। ওকে দেখেই বদলে গেল বয়েডের চেহারা। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে সামলে নিল নিজেকে। লাল হয়ে উঠল মুখটা। ‘ও এখানে কি করছে?’ কঠিন সুরে জবাব চাইল সে।
‘তা জানার অধিকার তোমার নেই,’ সোজাসাপ্টা বলল শীলা। তারপর নাখানকে দেখিয়ে বলল, ‘তোমার পোষা সহকারীকে সাথে করে নিয়ে এসেছ তুমি। রানা আমার উপদেষ্টা।’ রানার দিকে ফিরল সে। ‘ওরা দ্বিগুণ করেছে ওদের প্রস্তাব। মানে, পাঁচ লক্ষ ডলার দিতে চাইছে পাচ বর্গ মাইল এলাকার সব গাছ কেটে নেবার বিনিময়ে।’
‘পাল্টা কোন প্রস্তাব দিয়েছ তুমি?’
‘দিয়েছি। পঞ্চাশ লক্ষ ডলার।’
হাসল রানা। ‘একটু বিবেচক হও, শীলা। যে দর হেঁকেছ তাতে পারকিনসনরা খুব একটা লাভ করতে পারবে না। আর লাভ না হলে ওরা তোমার গাছ কিনবেই বা কেন? তার চেয়ে এক কাজ করো, নতুন প্রস্তাবে পঁয়তাল্লিশ লক্ষ ডলার দাম দাও।’
‘পাগল!’ বলল নাথান।
ঝট করে ফিরল তার দিকে রানা। ‘এর মধ্যে পাগলামিটা কোথায় দেখলে? ন্যায্য দাম কত হয় বলে তোমার ধারণা?’
‘এ ব্যাপারে তোমার কোন কথা আমরা শুনতে চাই না!’ রাগে টগবগ করে ফুটছে বয়েড।
‘আমন্ত্রণ পেয়ে আলোচনায় যোগ দিয়েছি আমি, বয়েড,’ বলল রানা। কিন্তু তোমরা এসেছ আমন্ত্রণ ছাড়াই, নিজেদের গরজে। ঠকাবার খেলায় তোমরা জিতে যেতে পারছ না দেখে আমি সত্যি দঃখিত, কিন্তু জেনেশুনে আমার পার্টিকে আমি ঠকতে দিতে পারি না।’
‘ও! পার্টি, না বান্ধবী?’
‘সে ব্যাপারে তুমি অনর্থক তোমার মোটা মাথা ঘামাতে যেয়ো না,’ বলল রানা। ‘প্রসঙ্গে ফিরে এসো। তুমি জানো শীলার এলাকার গাছ গত দশ-বারো বছর ধরে কাটা হয়নি। গাছ এবং বাঁশ কতটুকু বেড়েছে তার হিসেবও তোমার জানা আছে। পঁয়তাল্লিশ লক্ষ মোটেই বেশি দাম চাওয়া হয়নি। হয় প্রস্তাব গ্রহণ করো, না হয় প্রত্যাখ্যান করো।’
‘অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করব,’ দ্রুত জবাব দিল বয়েড। ‘চলো নাথান।’
হেসে উঠল রানা। ‘কিন্তু ভেবে দেখেছ কি তোমার বাবা ব্যাপারটা পছন্দ করবেন কিনা? আমার বিশ্বাস অতি লোভ করে, কিংবা ভাবাবেগ-তাড়িত হয়ে লাভজনক একটা প্রস্তাব পায়ে ঠেলার অপরাধে তিনি তোমার তীব্র সমালোচনা করবেন!’
রানার কথায় যেন টনক নড়ল বয়েডের। নাথানের দিকে তাকাল সে। তারপর বলল, ‘নিজেদের মধ্যে কথা বলতে পারি আমরা?’
‘অনায়াসে,’ বলল শীলা। বাইরে বিশাল পৃথিবী পড়ে আছে।’ নাথানকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে গেল বয়েড।
‘তোমার অনুমানই ঠিক দেখতে পাচ্ছি, রানা,’ বলল শীলা।
‘হিসেবের কথা বলছ তো?’ বলল রানা, ‘জানি, এটা মোটেই ভুল অনুমান নয়। কিন্তু জেদের বশে বাস্তবতাকে নাও মেনে নিতে পারে বয়েড। মেনে না নিলে নিজেরই ক্ষতি করবে ও।’
‘কিন্তু ওর জেদ বজায় রাখতে গিয়ে আমরা ঠকতে রাজি নই, রানা। শোনো, এ ব্যাপারে তুমি যা ভাল মনে করবে তাই হবে। শেষ পর্যন্ত যদি গাছ ওরা না কেনে নাই কিনুক। ন্যায্য দাম না পাওয়ার চাইতে পানিতে সব ডুবে যেতে দিতেও আমার আপত্তি নেই।’
‘তা আমি ডুবতে দিচ্ছি না,’ বলল রানা। ‘ওরা কিনুক বা না কিনুক, তোমার এলাকা যাতে না ডোবে তার জন্যে কি করা যায় ভেবে বের করব আমি।’
কামরায় ফিরে এল ওরা। সম্পূর্ণ বদলে শান্ত হয়ে গেছে বয়েড! ‘ঠিক আছে, আমরা ঠিক করেছি, রানার অপমানজনক প্রস্তাবটা অগ্রাহ্য করব আমরা। স্রেফ ব্যবসার খাতিরে নতুন একটা প্রস্তাব দেব। এটা আগের প্রস্তাবেরই দ্বিগুণ, অর্থাৎ পুরোপুরি দশ লাখ ডলার দিতে রাজি হচ্ছি আমরা—এরচেয়ে ন্যায্য দাম আর হতে পারে না।’
ঠাণ্ডা চোখে তাকাল শীলা রয়েডের দিকে। ‘চল্লিশ আর পাঁচ।’
‘বড় বেশি জেদ ধরছেন আপনি, মিস ক্লিফোর্ড,’ নাথান বাঁকা চোখে দেখছে শীলাকে।
‘দু‘পক্ষকেই আমি একটা পরামর্শ দিতে চাই,’ হাসতে হাসতে বলল রানা, ‘সবাই মিলে চলো ফরেস্ট অফিসার ডোনাল্ডের কাছে যাই, নিরপেক্ষ লোক সে, সে যে দাম বলবে সেটাই মেনে নেবে তোমরা রাজি?’
‘আমরা এখানে ব্যবসা করতে এসেছি, বিচার চাইতে নয়,’ বলল বয়েড। ‘তৃতীয় কোন পক্ষের নাক গলানো পছন্দ করব না। তাছাড়া, নষ্ট করার মত অত সময়ও আমাদের হাতে নেই। বাঁধ প্রায় তৈরি হয়ে এসেছে। সুইস গেট আমরা আগামী দু‘হপ্তার ভেতরই বন্ধ করে দেব। দেড় দু‘মাসের মধ্যে এই এলাকা ডুবে যাবে পানিতে। এই অল্প সময়ের মধ্যেই গাছ কেটে সরিয়ে ফেলতে হবে আমাদের। কাটার কাজ আজই যদি শুরু করি আমরা, আমাদের প্রতিটি লোককে রাত দিন দু‘শিফটে খাটিয়েও সময় মত শেষ করতে পারব কিনা সন্দেহ।’
‘সুতরাং চুক্তি করে ফেলো,’ বলল রানা। ‘আরেকটা প্রস্তাবে ন্যায্য দাম উল্লেখ করো।’
ঘৃণার চোখে দেখল বয়েড রানাকে। তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে শীলার দিকে ফিরল। ‘আমরা কি ব্যাপারটা আপোষে মিটিয়ে ফেলতে পারি না, শীলা?’ অনুরোধের সুরে বলল সে, ‘আমরা কি এই উটকো চরিত্রটাকে বাদ দিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে পারি না?’
‘রানার কথা বলছ? ও তো আমার ডান হাত। ওর সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করলে আমাদের আলোচনা এখানেই…’
দ্রুত বলল নাথান, ‘পনেরো লক্ষ ডলার।’
‘চল্লিশ এবং পাঁচ,’ জবাবটা সাথে সাথেই নরম সুরে আওড়াল শীলা। দুটো হাত মুষ্টিবদ্ধ হলো বয়েডের। দেখে হেসে উঠল রানা।
‘আমরা দাম বাড়িয়েই চলেছি, মিস ক্লিফোর্ড,’ বলল নাথান। ‘কিন্তু আপনি আমাদের দিকে নামছেন না।’
‘তার কারণ আমার জিনিসের প্রকৃত দাম সম্পর্কে আমি অজ্ঞ নই।’
‘ঠিক আছে, নাথান,’ বলল রানা, ‘তোমাদের দিকে নামছি আমরাও, আমাদের নতুন প্রস্তাব সাড়ে বিয়াল্লিশ লক্ষ। এবার বলো তোমাদের পাল্টা প্রস্তাব কি?’
‘ফর খ্রীস্ট সেক!’ ছটফট করে উঠল বয়েড। ‘শীলাঁ, তোমার হয়ে দর কষাকষির অধিকার আছে কি ওর?’
বয়েডের চোখে চোখ রাখল শীলা। ‘সম্পূর্ণ।’
‘একথা আগে বলোনি কেন?’ বয়েড় পা ঠুকল মাটিতে। ‘বেশ; আমাদের শেষ কথা, কপর্দকহীন একজন জিওলজিস্টের সাথে কোনরকম চুক্তির ব্যাপারে আলোচনা করতে আমরা রাজি নই।’
‘বেশ,’ দৃঢ়তার সাথে বলল শীলা, ‘তাহলে এখন তোমরা আসতে পারো। আমি তোমাদের সাথে চুক্তিতে আসছি না।’ বলে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে। ‘যদি কিছু মনে না করো, আমরা এখন কাজে বসব।’
দ্রুত কথা বলল নাথান, ‘আমাদের কারুরই মাথা গরম করা উচিত হচ্ছে না। রয়েডের দিকে ফিরে ভুরু কুঁচকে কিছু একটা ইঙ্গিত করল সে। ‘আমি এখনও আশা করি, আলোচনার মাধ্যমে আমরা একটা চুক্তিতে পৌঁছুতে পারব। আমার পাল্টা প্রস্তাব কি জানতে চেয়েছেন মিস্টার রানা। শুনুন তাহলে, পুরোপুরি বিশ লক্ষ ডলার দেব আমরা, এর বেশি একটা কানাকড়িও নয়।’
নাথান এখনও শান্ত, কিন্তু বয়েডের চেহারাই প্রমাণ করছে যে কোন মুহূর্তে হাঙ্গামা বাধিয়ে দিতে পারে সে। তার এই রাগে ফুলে ওঠার সঙ্গত কারণ আছে, মনে মনে স্বীকার করল রানা। পঞ্চাশ লাখ টাকার জিনিস মাত্র পাঁচ লাখ টাকায় কেনার আশা নিয়ে এসেছিল সে, অথচ ইতিমধ্যে বিশ লাখ টাকা দাম দিতে চেয়েও অনুকূল সাড়া পাচ্ছে না সে। দ্রুত ভাবছে রানা, ভুল করে বসছে না তো সে? গাছ বা বাঁশ সম্পর্কে বিশেষ ধারণা নেই ওর, হিসেবটা করেছে ও স্রেফ অনুমানের উপর নির্ভর করে। ভুল হওয়া বিচিত্র নয়।
‘দুঃখিত,’ কথাটা বলার সময় রানা অনুভব করল সড় সড় করে ঘামের ধারা নামছে ওর পিঠে।’
চেঁচিয়ে উঠল বয়েড। ‘ঠিক আছে, এখানেই আলোচনা শেষ। চলো, নাথান। এখানে আর এক সেকেণ্ডও নয়। শীলা, উপদেষ্টা হিসেবে পাঁড় এক মাতালকে জোগাড় করেছ তুমি। আমরা যাচ্ছি, নতুন কোন প্রস্তাব যদি তোমার থাকে, কোথায় আমাকে পাওয়া যাবে তা তোমার জানা আছে।’ নাথানের জন্যে অপেক্ষা না করেই সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে, হাঁটা ধরল দরজার দিকে।
নাথানের দিকে চোখ ফেলল রানা। যেতে চাইছে না লোকটা। বুঝতে পারল রানা, হিসেবে ভুল করেনি ও। নাথান এখনও দর কষাকষি করতে রাজি।
কিন্তু বয়েড সম্ভবত আর এগোতে দেবে না নাথানকে, ভাবল রানা। দেখল, দরজার কাছে পৌঁছে গেছে সে ইতিমধ্যে। ছেলে ছোকরাদের দ্বারা কিচ্ছু হবে না, দ্রুত বলল রানা। ‘বুড়ো ডিকসনকে এখানে ডেকে নিয়ে এসো তো, শীলা।’
অবাক হয়ে তাকাল শীলা রানার দিকে। কিন্তু কোন প্রশ্ন না করে লক্ষ্মী মেয়ের মত পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে ডিকসনের নাম ধরে ডাক ছাড়তে শুরু করল। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে পড়েছে বয়েড, অনিশ্চিতভাবে তাকিয়ে আছে রানার দিকে। কোঁচকানো ভুরুর ভিতর দিয়ে তাকিয়ে আছে নাথানও।
শীলা কামরায় ফিরতেই রানা বলল, ‘তোমাকে আমি আগেই সাবধান করে দিয়ে বলেছি, বয়েড, যে তোমার বাবা ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ করবেন না। কিন্তু তুমি আমার কথায় কান দাওনি। ভাল লাভ হচ্ছে, অথচ তুমি শুধু জেদের বশে তা পায়ে ঠেলছ, একথা জানার পর তিনি তোমার ওপর ভবিষ্যতে ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে কতটা ভরসা রাখবেন—একমাত্র ভবিষ্যৎই তা বলতে পারে। এ ব্যাপারে তোমার বক্তব্য কি, নাথান?’
‘আমার বক্তব্য কি হবে বলে আশা করো তুমি?’ মৃদু হাসল নাথান।
শীলার দিকে তাকিয়ে রানা বলল, ‘কলম আর কাগজ যোগাড় করো। আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি লিখে গাফ পারকিনসনকে একটা প্রস্তাব পাঠাও। তোমার গাছ আর বাঁশের জন্যে সর্বমোট দাম চাও পঁয়তাল্লিশ লাখ, তবে দর কষাকষি করে তিনি তোমাকে চল্লিশে রাজি করাবেন, এ আমি বাজি ধরে বলতে পারি। তাতেও লাভ করবেন তিনি পাক্কা দশ লাখ ডলার। চিঠিতে প্রসঙ্গক্রমে একথাও জানাও যে একজন অর্বাচীনের সাথে চুক্তি করার চাইতে পরিণত একজন মানুষের সাথে চুক্তি করাই তোমার একান্ত ইচ্ছা। ডিকসন তোমার চিঠিটা আজই পৌঁছে দিয়ে আসবে।’
রাইটিং ডেস্কের কাছে গিয়ে দাঁড়াল শীলা। তারপর বসল চেয়ারে। দৃঢ় পায়ে সোজা রানা‘র দিকে এগিয়ে আসছে বয়েড। তৈরি হবার প্রয়োজন বোধ করল রানা। কিন্তু হাত পাঁচেক দূরে থাকতেই বয়েডকে বাধা দিল নাথান সামনে দাঁড়িয়ে দু‘হাত দু‘দিকে মেলে দিয়ে।
‘সরো!’ খেঁকিয়ে উঠল বয়েড।
ফিসফিস করে কি বলল নাথান শুনতে পেল না রানা। রয়েডের কোট আঁকড়ে ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেল সে এক কোনায়। দু‘জন ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করল এরপর।
খানিকপর বুড়ো ডিকসন ঢুকল কামরায়। ‘তোমাকে একটা চিঠি নিয়ে ফোর্ট ফ্যারেলে যেতে হবে, ডিকসন,’ বলল শীলা!
দু‘জনের ফিসফিস থামল হঠাৎ। শীলার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল নাথান ‘এক মিনিট, মিস ক্লিফোর্ড।’ আবার বয়েডকে বোঝাবার চেষ্টায় ফিসফিস করতে শুরু করল সে।
একসময় শ্রাগ করল বয়েড। দু‘জনই ফিরে এল রানার কাছে। ‘এই তোমার শেষ কথা, রানা…পুরোপুরি চল্লিশ লাখ ডলারই নেবে তুমি?’ বেসুরো গলায় জানতে চাইল নাথান।
‘আমি না, শীলা নেবে।’
মুহূর্তের জন্যে নাথানের ঠোঁট দুটো পরস্পরকে চেপে ধরল। ‘ঠিক আছে, তোমাদের প্রস্তাবে রাজি না হয়ে উপায় দেখছি না আমরা।’ পকেট থেকে একটা চুক্তিপত্র বের করল সে। টাকার অঙ্ক বসিয়ে মিস ক্লিফোর্ড একটা সই করে দিলেই ঝামেলা মিটে যায় এখন।
‘আমার আইন উপদেষ্টাকে না জানিয়ে কোথাও আমি সই করতে পারি না,’ মৃদু কণ্ঠে বলল শীলা। ‘সইয়ের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে তোমাদের।’
মাথা ঝাঁকিয়ে রাজি হলো নাথান। ‘যত তাড়াতাড়ি পারেন তাকে দেখিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে অনুরোধ করছি আমি।’ কলম বের করে চুক্তিপত্রে টাকার অঙ্কটা লিখল সে। তারপর কাগজ আর কলমটা ধরিয়ে দিল বয়েডের হাতে। বয়েড ইতস্তত করছে লক্ষ করে নাথান বলল, ‘সই করো—সেটাই সবদিকে থেকে ভাল।’
একটা সোফায় বসল বয়েড। নিচু টেবিলের উপর চুক্তিপত্রটা রাখল। ঝুঁকে পড়ে সই করতে গিয়ে চোখ তুলে তাকাল রানার চোখে। সাবধানে থেকো, রানা—এটুকুই শুধু বলবার আছে তোমাকে আমার। প্রাণপণ চেষ্টা করো সাবধানে থাকতে। আমার সাথে এরকম করার সুযোগ পাবে না তুমি আর কখনও।’ খসখস করে চুক্তিপত্রে সই করল সে।
চুক্তিপত্রে এরপর নাথান সই করল সাক্ষী হিসেবে।
‘সাবধান বাণীর জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ। কিন্তু লাভ নেই জেনে তোমাকে আমি সাবধান করছি না। শুধু এটুকু জেনে রাখো, বাপের আদেশ অমান্য করে যদি আমার বিরুদ্ধে সামান্যতম কিছুও করো, স্রেফ ঘাড় মটকে দেব।’
‘প্লীজ, রানা!’ কৃত্রিম আতঙ্কে আঁৎকে উঠে বলল শীলা, ‘দোহাই তোমার, অমন কথা মুখেও এনো না। ঘাড় ভাঙার শব্দ হলে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।’
‘ঠিক আছে,’ দাঁতে দাঁত ঘষে বলল বয়েড, কে কার ঘাড় ভাঙে দেখা যাবে!’ বলে চরকির মত আধপাক ঘুরল সে, তারপর প্রায় ছুটেই বেরিয়ে গেল কামরা ছেড়ে। নাথান তাকে অনুসরণ করল ধীর পায়ে। সে বেরিয়ে যেতে ফড়ফড় করে চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলল শীলা, তাকাল ডিকসনের দিকে। ‘ফোর্ট ফ্যারেলে যাওয়ার খাটনি থেকে তুমি বেঁচে গেলে শেষ পর্যন্ত, ডিকসন।’
দাঁতহীন মাড়ি বের করে হাসল বুড়ো। ‘মিস ক্লিফোর্ড, আমি বুঝতে পারছি, এতদিনে সত্যি একজন ভাল লোককে পাশে পেয়েছেন আপনি।’ রানার দিকে তাকিয়ে মৃদু মাথা ঝাঁকাল সে, তারপর বেরিয়ে গেল কামরা থেকে।
হাঁটুতে জোর পাবে না মনে করে উঠতে গিয়েও উঠল না রানা।
‘মনে হচ্ছে গোটা এক বোতল হুইস্কি দরকার এখন তোমার,’ দেয়াল-আলমারি থেকে বোতল আর দুটো গ্লাস নিয়ে সোফায় ফিরে এসে রানার গা ঘেঁষে বসল শীলা। ‘ধন্যবাদ, রানা। ’
‘ওরা রাজি হবে এ আমি ভাবতেই পারিনি,’ বলল রানা। ‘মনে হচ্ছিল গোয়ার্তুমি করে সবই বুঝি হারাচ্ছি। বয়েড যখন বেরিয়ে যাচ্ছিল।’
‘ওকে তুমি ব্ল্যাকমেইল করেছ,’ গ্লাসে হুইস্কি ঢালছে শীলা। ‘বাপকে যমের মত ভয় করে সে, এটাকে তুমি ব্যবহার করেছ ওকে ব্ল্যাকমেইল করার ব্যাপারে।’
‘উপযুক্ত শিক্ষা পেয়েছে ও,’ বলল রানা, ‘এটা ওর প্রাপ্য ছিল। সে যাক, চল্লিশ লক্ষ ডলার নিয়ে কি করছ তুমি, শীলা?’ মনে মনে হিসেব করল, একচল্লিশ টাকা দরে ষোল কোটি চল্লিশ লক্ষ বাংলাদেশী টাকা—ওরেব্বাপ!
রানার হাতে গ্লাস ধরিয়ে হাসল শীলা। ‘ভাবিনি এখনও। সম্ভবত সংসার পাতব ওই টাকা নিয়ে। কিন্তু তার আগে, বয়েডের ভাষায়, কপর্দকহীন একজন জিওলজিস্টের ব্যাপারে একটু মাথা ঘামাতে চাই আমি।’
‘দূর! কি এমন করেছি আমি…মাথা ঘামাতে চাও মানে?’ ভুরু কুঁচকে উঠল রানার।
‘বয়েডের সাথে কোন কালেও ওভাবে দর কষতে পারতাম না আমি,’ বলল শীলা। ‘ন্যায্য দাম যে আমি পাচ্ছি, এর সবটুকু কৃতিত্ব তোমার। নিয়ম অনুয়ায়ী আমার কাছ থেকে তুমি কমিশন পাবে।’
হো-হো করে হেসে উঠল রানা। হাসি থামতে বলল, ‘অসম্ভব, শীলা।’
‘তর্ক কোরো না। ব্যবসা ব্যবসাই। দশ লাখ আশা করেছিলাম, আদায় করে দিয়েছ চল্লিশ লাখ। যাই হোক, বিশ পার্সেন্ট যদি দিই, কিছু বলার আছে তোমার?’
প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল রানা, কি একটা কথা মনে পড়তে মুচকি হাসল ও। বলল, ‘বিশ পার্সেণ্ট? মাই গড, সে যে মেলা টাকা!’ শীলার চোখে অদ্ভুত এক উজ্জ্বলতা ঝিলিক দিয়ে উঠতে দেখল ও। ‘না। দশ পার্সেন্ট।’
‘তুমি একটু বাড়াও,’ বলল শীলা। ‘আমি একটু কমাই। অর্থাৎ পনেরো পার্সেন্ট।’ ঠোঁটে আঙুল রাখল সে। ‘চুপ। এ ব্যাপারে আর কোন কথা নয়।’
‘ঠিক আছে,’ বলল রানা। ‘তাই সই।’ গ্লাসে চুমুক দিতে গিয়ে আর একটু হলে বিষম খচ্ছিল ও, কারণ হিসেব করে বুঝতে পারল ও, এইমাত্র বাংলাদেশী টাকায় এক কোটি বিশ লক্ষ টাকা রোজগার করেছে সে।
‘কি করবে তোমার ভাগের টাকা দিয়ে?’ জানতে চাইল শীলা।
‘ভাবছি সে কথাই। ভাবছি, হীরের একটা জড়োয়া সেট উপহার দেব তোমার বিয়েতে।’
অবাক হয়ে গেল শীলা। কথা না বলে চেয়ে রইল সে রানার দিকে বেশ কিছুক্ষণ, যেন নতুন করে চিনতে চেষ্টা করছে সে রানাকে। ‘তার মানে,’ এক সময় বলল সে, ‘কপর্দকহীন নও তুমি! ছয় লক্ষ ডলার যে হাসিমুখে পায়ে ঠেলতে পারে…তার মানে টাকার কোন অভাব নেই তোমার। কে তুমি, রানা? কি তোমার আসল পরিচয়?’
যেন শুনতে পায়নি শীলার কথা, আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াল রানা সোফা ছেড়ে। ‘এবার যেতে হয়, শীলা।’
‘আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে?’
‘কি জানতে চাও?’
‘তোমার পরিচয়।’
‘কি হবে জেনে? এই তো আমিই আমার পরিচয়।’
‘আমার এলাকাটা সার্ভে করতে চাইছ তুমি,’ তীক্ষ্ণ হলো শীলার দৃষ্টি, ‘কিন্তু সে যোগ্যতা কি তোমার আছে, রানা?’
কুঁচকে উঠল রানার ভুরু। সরাসরি তাকাল শীলার চোখে। ‘কি বলতে চাইছ?’
‘আমাকে তুমি ফাঁকি দিতে পারোনি, রানা,’ হাত বাড়িয়ে রানার কব্জি চেপে ধরল শীলা। ‘বসো।’ রানা বসতে সে বলল, ‘সাবজেক্ট আলাদা হলেও, আমি. একজন কোয়ালিফায়েড আর্কিওলজিস্ট। লেখাপড়া করে ডিগ্রী নিতে হয়েছে আমার। আমি জানি, তুমি জিওলজিস্ট নও, রানা।’
‘নই,’ সরলভাবে স্বীকার করল রানা। ‘কিন্তু তাতে কি? অ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশন না থাকলেও কাজ চালিয়ে নেবার মত জ্ঞান আমি অর্জন করেছি।’
‘তা যে করেছ তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই,’ বলল শীলা। ‘কিন্তু ভাবতে গিয়ে অবাক লাগে আমার, কিসের টানে এসেছ তুমি ফোর্ট ফ্যারেলে! এদেশী নও, এটা তো পরিষ্কার বোঝা যায়। কোত্থেকে এসেছ তুমি? কেন? কি তোমার সত্যিকার পরিচয়? সত্যি করে বলবে রানা, কে তুমি?’
একটু ভেবে নিয়ে বলল রানা, ‘এখান থেকে অনেক… অনেক দূরে সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা অপূর্ব সুন্দর এক দেশ আছে-আমি বাংলাদেশী। এর বেশি কিছু জানতে চেয়ো না।’
কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে থাকল শীলা, গম্ভীর হয়ে উঠল একটু। ‘বেশ। কিন্তু ফোর্ট ফ্যারেলে আসার উদ্দেশ্যে কি শুধু কেনেথ হত্যার প্রতিশোধ নেয়া? কেনেথের সাথে কতদিনের পরিচয় তোমার?’
‘খুব অল্প দিনের,’ বলল রানা। ‘আসলে হাসপাতালে কেনেথকে আমার খুব ভাল লেগে গিয়েছিল। ওকে পেয়ে আমি আমার ছেলেবেলায় ফিরে যাবার দুর্লভ একটা সুযোগ পেয়েছিলাম। দু‘জনে একসাথে লুকিয়ে সিগারেট খেয়েছি, ফাঁকি দিয়ে দু‘চার টান বেশি খেয়ে ফেলেছি বলে এ ওর কাছে গাঁট্টা খেয়েছি, তুমুল ছেলেমানুষি ঝগড়া করে কথা বলা বন্ধ করেছি, পাঁচ মিনিট কাটতে না কাটতে দু‘জন আবার মানিকজোড় হয়ে পা টিপে টিপে বাইরের লনে গিয়েছি চাঁদনী রাত দেখতে…সেই ছেলেবেলার ছেলেমানুষিতে পেয়ে বসেছিল আমাদেরকে। কেনেথ আমার বন্ধু হয়ে উঠেছিল, ছেলেবেলার বন্ধু।; শীলা, আমাদের এই বয়সে কেউ আমরা কারও সত্যিকার বন্ধু হতে পারি না—মানুষের সাথে আমাদের পরিচয় হয়, জানাজানি হয়, কিন্তু বন্ধুত্ব হয় না। কিন্তু কেনেথের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল। সেই কেনেথ…’ গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল রানার বুকে ভিতর থেকে, ‘… নেই আর। আমার বন্ধুকে খুন করেছে ওরা। বুঝতে পারছ, কেন এসেছি ফোর্ট ফ্যারেলে?’
কয়েক সেকেণ্ড অবাক হয়ে চেয়ে রইল শীলা রানার মুখের দিকে।
‘কিন্তু এদের সাথে তুমি পারবে বলে ভাবছ কেন? একে বিদেশী, তার ওপর একা।’
শীলাকে থামিয়ে দিয়ে রানা বলল, ‘পারব কিনা জানি না, শীলা। তবে এর আগে এদের চেয়েও ভয়ঙ্কর লোকের বিরুদ্ধে লেগেছি আমি। বেঁচে যখন আছি এখনও, বুঝতেই পারছ, পরাজয় তাদেরই হয়েছে। আরেকটা কথা, দেখে মনে হলেও আসলে কিন্তু আমি একা নই। ফোর্ট ফ্যারেলে হয়তো কেউ নেই আমার, কিন্তু আমার পিছনে লোক আছে।’
‘তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আরও অনেক অন্যায়ের প্রতিবিধান করেছ তুমি। এটাই কি তোমার পেশা?’
‘আমি বাংলাদেশের একজন সরকারী চাকুরে ছিলাম।’
‘নিশ্চয়ই চাকরিটা সি.আই.ডি বা ইন্টেলিজেন্স বিভাগে?’
‘এবার সত্যি আমি উঠব,’ বলল রানা। উঠে দাঁড়াল।
দেখাদেখি শীলাও উঠল। ‘আমার সব কৌতূহল মেটেনি, রানা। তোমার সম্পর্কে সব জানতে চাই আমি।’
‘জেনে লাভ?’
‘লাভ লোকসান বড় কথা নয়। আসলে তুমি আমাকে কৌতূহলী করে তুলেছ। সহজে কারও ব্যাপারে কৌতূহলী বা আগ্রহী আমি হই না, রানা।’
‘আমি ভাগ্যবান,’ মুচকি হেসে বলল রানা।
‘কিংবা হয়তো আমি,’ বলল শীলা। ‘ঠিক জানি না এখনও। তবে, জানব।’ কথা দিল সে।
কিছু বলতে যাচ্ছিল রানা, এমন সময় নক হলো দরজায়। ‘ভিতরে এসো।’
কামরায় ঢুকল বুড়ো ডিকসন। সোজা রানার সামনে এসে দাঁড়াল সে। ‘স্যার, আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন মি. হাডসন ক্লিফোর্ড নিহত হবার সময় অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছিল কিনা, মনে আছে?’
‘আছে।’
‘এইমাত্র একটা ঘটনার কথা মনে পড়েছে আমার,’ বলল, ডিকসন, ‘কিন্তু ঘটনাটা অস্বাভাবিক কিনা তা ঠিক বুঝতে পারছি না।’
‘ঘটনাটা কি?’
‘গাফ সাহেব নিজের জন্যে একটা গাড়ি কিনেছিলেন অ্যাক্সিডেন্টের ঠিক এক হপ্তা পর। গাড়িটা ছিল মার্সিডিজ।’
‘না,’ বলল রানা, ‘এটা ঠিক অস্বাভাবিক কোন ঘটনা নয়।’
‘কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, স্যার, এই মার্সিডিজটা তার আগের গাড়ির জায়গা দখল করে। আগের গাড়িটা ছিল একটা বুইক। মাত্র দেড় মাস আগে কেনা।’
চমকে উঠল রানা। শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল ওর মুহূর্তে। অদ্ভুত শান্ত গলায় জানতে চাইল ও, ‘ঠিক মনে আছে তোমার, ডিকসন? মাত্র দেড় মাস আগে কেনা গাড়ির জায়গায় নতুন মার্সিডিজের কি দরকার ছিল? কি দোষ ছিল বুইকটার?’
‘জানি না,’ ডিকসন বলল, ‘মাত্র দেড় মাসের পুরানো গাড়ির আবার দোষ থাকবে কি…বুঝতে পারিনি আমি।’
‘কি হলো বুইকটা?’
‘তাও জানি না। স্রেফ অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, কখনও আর দেখিনি।’
‘ধন্যবাদ, ডিকসন,’ বলল রানা। ‘কথাটা জানিয়ে তুমি আমার মস্তবড় উপকার করেছ।’
ডিকসন বেরিয়ে যেতে শীলা জানতে চাইল, ‘ব্যাপার কি, রানা?’ সাড়া না পেয়ে আবার বলল, ‘কি ভাবছ তুমি?’
হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরল রানার। ‘কিছু বলছিলে?’
‘ডিকসনের কথা শুনে এত কি চিন্তা করছ?’
‘তেমন কিছু নয়,’ ব্যাপারটা এড়িয়ে গেল রানা। শীলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ও কাইনোক্সি উপত্যকার উদ্দেশে।
সন্ধ্যার বেশ খানিক আগেই ঝর্ণার ধারে ফিরে এল রানা। হাড়ভাঙা খাটুনি গেছে একনাগাড়ে সাতটি ঘণ্টা। কাইনোক্সি উপত্যকার পাঁচ বর্গমাইল এলাকার প্রায় অর্ধেকটা সার্ভে করা হয়ে গেছে। সেইসাথে শিকার হয়ে গেছে একটা পাতিহাঁস। খুব ভোরে উঠে পড়তে হবে কাল, মনে মনে ঠিক করল ও, সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে বাকি কাজ শেষ করে ফেলতে হবে কালই।
একটু জিরিয়ে নিয়ে ক্যাম্প তৈরি করার কাজে হাত লাগাল রানা। এক ঘণ্টা পর চুলো ধরিয়ে আগুনের উপর ছাল ছাড়ানো হাঁসটাকে আড়াআড়িভাবে ঝুলিয়ে দিয়ে ঝর্ণার পানিতে গিয়ে দাঁড়াল ও। গোসল সেরে ফিরতে ফিরতে ঝাঁকে ঝাঁকে অসংখ্য তারা জ্বলে উঠল আকাশে। মস্ত পিতলের থালার মত একটা চাঁদও উঠল দিগন্তরেখার কাছে।
রাতটা বেশ ঠাণ্ডা। গাছের গায়ে হেলান দিয়ে আগুনের ধারে বসল রানা। পাশেই পড়ে আছে রাইফেলটা।
খাবার তৈরি। কেটলিতে ফুটছে কফির পানি। একটা সিগারেট ধরাল রানা। সড় সড় করে একটা আওয়াজ হতে আপনাআপনি ডান হাতটা গিয়ে পড়ল রাইফেলের উপর। পিছন ফিরে তাকাতে যাবে, একটা ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল মূর্তিটা!
‘আমি।’
উঠে দাঁড়াল রানা রাইফেলটা রেখে। ‘এই রাতে?’
রানার সামনে এসে দাঁড়াল শীলা। ‘সন্ধ্যার পরপরই বেরিয়েছি, অন্ধকারে পথ চিনতে দেরি হয়ে গেল,’ একটু বিরতি নিল সে। ‘একা একা ভাল লাগছিল না, তাই ভাবলাম গল্প করে আসি।’
চাঁদের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে শীলা, তার পাশেই উপত্যকার নিচে দেখা যাচ্ছে চাঁদটাকে। তারার আলো পড়েছে শীলার চোখে মুখে। চকচক করছে চোখের মণি দুটো।
‘খালি হাতে এভাবে কেউ বেরোয়?’
‘ভুল হয়েছে,’ স্বীকার করল শীলা। ‘বেরুবার সময় মনে পড়েনি। যাক, কি রেঁধেছ তুমি, এত সুগন্ধ কিসের?
‘পাতিহাসের রোস্ট।’
‘জিভে পানি আসছে,’ বলে রানার পাশ ঘেঁষে এগোল শীলা, তারপর বসল আগুনের ধারে, গাছটার গায়ে হেলান দিয়ে। রানার একটা হাত ধরল সে। দাঁড়িয়ে আছ যে?’
শীলার দিকে ফিরল রানা। ‘রাত আরও বাড়লে ফিরতে পারবে তুমি? চলো, তোমাকে পৌঁছে দিই।’
তখুনি কথা বলল না শীলা। রানার দিকে চেয়ে আছে। ‘ফিরব তা কে বলল তোমাকে? আমি থাকব বলেই এসেছি।’
একটু দূরত্ব রেখে বসল রানা। কথা বলল না।
‘কি, চুপ করে আছ যে?’
‘ভাবছি…’
রানাকে থামিয়ে দিল শীলা হাত নেড়ে। ‘আমার রেপুটেশন নিয়ে তোমাকে অযথা মাথা ঘামাতে হবে না, রানা। আমি স্বেচ্ছায় এসেছি।’
‘না,’ বলল রানা, ‘সে-কথা আমি ভাবছি না।’
‘তবে কি ভাবছ?’
‘ভাবছি এখানের দিন শেষ হয়ে আসছে একটা একটা করে,’ বলল রানা। ‘আর হয়তো কোনদিন…’
‘যা ভেবেছি তাই দেখছি ঠিক,’ কথার মাঝখানে বলল শীলা। ‘কর্তব্যের ডাকে চলে যেতে হবে তোমাকে, আর হয়তো আমাদের দেখা হবে না কোনদিন, এই তো?’
‘তুমিও ভেবেছ?’
‘তোমার পেশা কি তা অনুমান করার পর এসব বুঝতে অসুবিধে কোথায় বলো?’ শীলা হঠাৎ অধৈর্য হয়ে উঠল। ‘এসব কথার আগে জিভের পানি থামাবার জন্যে কি করা যায় সে ব্যাপারে একটা পরামর্শ দাও দেখি।’
‘তুমিই পরিবেশন করো না কেন?’
‘কিন্তু তোমার ভাগে কম পড়ে যাবে না তো আবার?’ কোটের পকেট থেকে স্কচ হুইস্কির একটা মাঝারি আকারের বোতল বের করে চাদরের উপর ঠুকে বসাল সে। ‘এটা তোমার জন্যে এনেছি। ঘুষ।’ বলে আপন মনেই হেসে উঠল।
আগুনটা একটু উস্কে দিল রানা। রাতের সাথে বাড়ছে ঠাণ্ডা। হালকা একটা কুয়াশার স্তর তৈরি হচ্ছে মাথার উপর। খাওয়ার পাট চুকতে ছোট দুটো গ্লাসে হুইস্কি ঢালল শীলা। চুলো থেকে কেটলিটা নামিয়ে রাখল সে। ‘তা মন্ট্রিয়লে কি জন্যে এসেছিলে?’
‘রানা এজেন্সির ব্রাঞ্চ খুলতে,’ শীলার হাত থেকে গ্লাসটা নিতে নিতে বলল রানা।
‘রানা এজেন্সি?’
‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু তুমি না বললে সরকারি চাকরি করো?’
‘এক বছরের ছুটি দিয়ে বের করে দিয়েছে আমাকে অফিসের বুড়ো কর্তা, ’ বলল রানা। একটা সিগারেট ধরাল। ‘তাই দুনিয়া ঘুরে নিজের অফিস খুলছি।’
‘রানা এজেন্সির কাজ কি?’
‘ইনভেস্টিগেশন করা। সাড়া দুনিয়ার নেট-ওয়র্ক থাকবে আমার, শীলা। পৃথিবীর কোথায় কি হচ্ছে সব আমি আমার এজেন্সির হেডকোয়ার্টারে বসে জানতে পারব। বুঝতে পারছ, মানুষের কতটা কাছে যেতে পারব আমি এর মাধ্যমে?’
‘কিন্তু…ঠিক বুঝছি না আমি,’ বলল শীলা, ‘তুমি যে নেট-ওয়র্কের কথা বলতে চাইছ সেটা কি এসপিওনাজ…’
‘হ্যাঁ,’ বলল রানা। ‘আবার না-ও। প্রাইভেট কাজও করব আমি।’
‘কিন্তু, এ ধরনের প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় ভিত্তিতে হয়ে থাকে বলে শুনেছি। ব্যক্তিগতভাবে কেউ…তাছাড়া, এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে লাভ কি তোমার? কি উদ্দেশ্যে…’
‘উদ্দেশ্য আগে যা ছিল এখনও তাই থাকবে।’
‘বুঝলাম না।’
‘দেশের সেবা করেছি আমি চাকরি জীবনে, শীলা,’ বলল রানা। ‘রানা এজেন্সি গড়ে তোলার পিছনেও সেবার আদর্শ কাজ করছে আমার ভিতর। ইতিমধ্যেই আমি নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, লণ্ডন, প্যারিস, নেপলস, বার্লিন, টোকিও, হংকং, ব্যাঙ্কক, সিঙ্গাপুর, দিল্লী—অর্থাৎ বড় বড় প্রায় সব শহরেই রানা এজেন্সির ব্রাঞ্চ খুলেছি। পুরোদমে সবগুলো ব্রাঞ্চকে চালু করে দিয়ে ঘুরে ঘুরে সবার কাজ দেখব আমি।’
‘এতে দেশের কি কাজ হবে তোমার?
‘হবে না? দুনিয়াজোড়া প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে আমি প্রতি মুহূর্তে জানতে পারব কোথায় কি ঘটছে কোথায় কি ঘটতে যাচ্ছে। আমার দেশের বিরুদ্ধে কোথাও কোন ষড়যন্ত্র হলে আগেই তা টের পেয়ে যাব আমি। সেই ষড়যন্ত্রকে কঠিন হাতে দমন করব আমরা। আজ আমার দেশ গরীব, কিন্তু একদিন তার এই গরীবানা হাল থাকবে না। অবস্থা ভাল হবার সাথে সাথে আমাদের শত্রুও বাড়বে। এখন থেকেই কি আমাদের প্রস্তুত হওয়া উচিত নয়?’
‘বুঝেছি, ’ শীলা বলল। ‘তোমার দেশ তখন তোমার কাছ থেকে সাহায্যও চাইবে হয়তো…’
‘চাইবে না, হুকুম করবে,’ মৃদু হেসে বলল রানা। ‘একজন বুড়ো কর্তার কথা বলেছি, মনে আছে? সেই বুড়ো আমাকে তাড়িয়ে দিলে কি হবে, এখনও আমাকে, ভালবাসে। সে কি রকম ভালবাসা তা আমি তোমাকে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারব না। এই যে সারা দুনিয়ায় রানা এজেন্সির শিকড় গাড়ছি, আমি জানি এতে তার নীরব সমর্থন আছে। তার আনুকূল্য ছাড়া এত সহজে কোন রাষ্ট্র আমাকে ব্রাঞ্চ খুলতে দিত না। সেই বুড়ো যদি কখনও হুকুম করে সুড় সুড় করে সামনে গিয়ে দাড়াতে হবে আমার।’
‘কিন্তু টাকা? টাকা পাচ্ছ কোথায় এত? তোমার কি অনেক টাকা আছে?’
‘আমার নেই। কিন্তু আবার আছেও। তাহলে আরও গল্প শোনাতে হয় তোমাকে,’ রেবেকার মুখটা মনে পড়ে যেতে সিগারেটটা মাটিতে ফেলে দিয়ে জুতোর তলায় পিষে চ্যাপ্টা করে দিল সেটাকে রানা। ‘একটি মেয়ে উইল করে দিয়ে গেছে আমাকে কয়েকশো কোটি ডলার। বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তার কয়েক ডজন শিপ ইয়ার্ড। সবগুলোর মালিক এখন আমি।’
‘একটা মেয়ে…কে সে?’
‘আমার সাথে তার বিয়ের কথাবার্তা ঠিক হয়েছিল। কিন্তু…।’
‘বিয়ে! তার মানে তাকে তুমি ভালবাস।’
‘হ্যাঁ,’ বলল রানা। ‘বাসতাম।’
‘বাসতে? তার মানে সে বেঁচে নেই?’
‘নেই, বলল রানা। অনেক দূর-থেকে ভেসে আসতে শুনল শীলা তার কণ্ঠস্বর। ‘তবে থাকলে বড় ভাল হত।’
‘আমি দুঃখিত, রানা,’ শীলা ম্লান কণ্ঠে বলল। ‘না বুঝে তোমার স্মৃতিতে আঘাত করেছি।’
‘ও কিছু না,’ নতুন করে একটা সিগারেট ধরাল রানা। ‘যে গেছে সে তো আর কখনও ফিরবে না, কি হবে তার জন্যে দুঃখ করে? কিন্তু ভুলতে পারি না, বড় ভাল মেয়ে ছিল রেবেকা। আশ্চর্য রোমাঞ্চপ্রিয় ছিল ও, অদ্ভুত একটা কল্পনাপ্রবণ মন ছিল ওর—আমাকে ভালবাসার জন্যেই যেন পৃথিবীতে এসেছিল সে। জানো, মারা যাৰে তা আগেই বুঝতে পেরে আমার নামে সব উইল করে দিয়ে গেছে সে।’
‘আশ্চর্য একটা রূপকথার মত শোনাচ্ছে,’ বলল শীলা।
‘কোথায় যেন অদ্ভুত একটা মিল আছে তোমার সাথে রেবেকার,’ বলল রানা। ‘তোমার সাহস্র, সচ্ছলতা, মেলামেশার সহজ ভঙ্গি—রেবেকার কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু, শীলা, এখন বুঝতে পারি, রেবেকাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা আমার ভুল ছিল।’
‘ভুল ছিল! কেন?’
‘আমি বিপদ ভালবাসি’ বলল রানা। ‘সে জন্যেই এরকম একটা পেশা বেছে নিয়েছি। আমার চারপাশে সর্বক্ষণ ভিড় করে থাকে বিপদ, ভয় আর রোমাঞ্চ। সুখ ভরা শান্তির নীড় আমার জন্যে নয়। তাই বলছি, ওর সাথে জড়ানো উচিত হয়নি আমার। তোমারও একটু সাবধান হওয়া উচিত।’
‘কোনও দরকারই নেই। আমি আগেই বুঝতে পেরেছি তোমাকে। সব কথা শোনার পর আমার ধারণা আরও পরিষ্কার হলো মাত্র। আমার ভাগ্য, রানা, তোমার মত একজন মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি আমি। তোমাকে ধরে রাখার শক্তি আমার নেই, থাকলে ছাড়তাম না। ধরে রাখতে পারব না বলে হা-হুতাশের মধ্যে বর্তমান সময়টা অপচয় করতে চাই না আমি, রানা।’
‘সত্যি তো! অযথা অপচয় হচ্ছে রাতটা, তাই না?’ হাসল রানা।
রানার চোখে চোখ রেখে হাসছে শীলা। ধীরে ধীরে মৃণাল দুই বাহু কণ্ঠ জড়িয়ে রানার। ব্যবধান কমছে দুজনের। তারার আলোয় চিকচিক করছে শীলার চোখ। সামান্য ফাঁক হয়ে রয়েছে অধর। এগিয়ে আসছে রানার নিষ্ঠুর একজোড়া ঠোঁট।
কাট্
***
পরদিন ভোর। অন্ধকার থাকতে যন্ত্রপাতি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রানা ক্যাম্প থেকে। শীলাকে ঘুম থেকে জাগাল না আর। ভাবল, এইমাত্র শুয়েছে, দুপুর নাগাদ ঘুম থেকে জেগে একাই ফিরে যেতে পারবে বাড়িতে।
তিনটের সময় ফিরল রানা। শীলাকে দেখে অবাক হলো ও।
‘রান্নাবান্না সব রেডি,’ বলল শীলা। ‘তুমি হাতমুখ ধুয়ে এসো, আমি বাড়ছি। ইস্, খিদেতে পেটে ইঁদুর দৌড়তে শুরু করেছে। এত দেরি করে মানুষ?’
কাঁধ থেকে ব্যাগ নামাল রানা। ‘তুমি বাড়ি যাওনি যে?’
‘কেন যাব?’ বলেই খিল খিল করে হেসে উঠল শীলা। হাসি থামতেই তাড়া লাগাল। ‘কেমন মানুষ তুমি, শুনি? আমার বুঝি খিদে লাগে না?’
ঝর্ণার দিকে এগোল রানা। পিছন থেকে শীলা বলল, ‘সাবান, তোয়ালে সব রেখে এসেছি ওখানে।’
এক ঘণ্টা পর একটা সিগারেট ধরাল রানা। কাত হলো বিছানায়। ‘কাজটা কি ভাল করছ?’
‘কোন্ কাজের কথা বলছ?’
‘এই যে আমার সাথে…’
‘চুপ!’ রানার পাশে বসে ধমক লাগাল শীলা। ‘এ প্রসঙ্গে কোন কথা শুনতে চাই না।’
মিনিট দুয়েক চুপচাপ বসে থাকল ওরা। শীলা একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে রানার দিকে। রানা একমনে কি যেন ভাবছে আর সিগারেট টানছে।
‘কথাটা কি সত্য?’ তৃতীয় একটা কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠল ওরা দু‘জনেই। ‘স্রেফ বয়েডকে অপমান করে ছয় লক্ষ ডলার কামিয়েছ তুমি?’ নাকের উপর নেমে আসা চশমা সামলাতে সামলাতে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল লংফেলো।
হেসে উঠল ওরা দু‘জনেই। রানা বলল, ‘ভুল শোনোনি।’
হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল লংফেলো। ‘চললাম।’
অবাক হয়ে গেল রানা। ‘চললাম মানে?’
‘বয়েডকে অপমান করতে। আমারও ছয় লাখ ডলার দরকার।’ খোঁজার ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকাল লংফেলো। ‘সাথে একটা বন্দুক-টন্দুক থাকলে…’
হো-হো করে হেসে উঠল রানা। হাসি থামিয়ে ‘এনভেলাপে ভরা চুক্তিপত্রটা লংফেলোকে দিল ও। ‘সাথে করে এটা নিয়ে যেয়ো। ফোর্ট ফ্যারেল থেকে ডাকবাক্সে ফেলে দিতে হবে। তার আগে ইচ্ছে করলে এনভেলাপ খুলে চুক্তির বিষয়টার ওপর চোখ বুলিয়ে নিতে পারো তুমি।’
‘তা নেব,’ বলল লংফেলো। ‘এদিকের খবর কিছু রাখো?’ হঠাৎ জানতে চাইল সে। ‘বাঁধ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। চার পাঁচ দিনের মধ্যে সুইস গেট খুলে দেবে ওরা।’
‘কিন্তু বয়েড যে বলল আরও দুইণ্ডা পর খোলা হবে?’
লংফেলো এদিক ওদিক মাথা নাড়ল। ‘না, মিথ্যে কথা বলেছে সে তোমাদের। এইমাত্র আমি বাঁধ হয়ে আসছি। ওদের আলোচনা থেকেই জেনেছি ব্যাপারটা।’
‘তাহলে তো এখুনি একবার দেখে আসতে হয় কতটা এগিয়েছে ওদের কাজ।’
‘তাই চলো নাহয়,’ বলল শীলা।
‘তোমার উৎসাহটা প্রেরণাদায়ক, মুচকি হেসে বলল রানা, ‘কিন্তু দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, তোমাকে আমি সাথে নিয়ে যেতে পারছি না।’
‘ঠিক,’ গম্ভীরভাবে রুমালে চশমার কাঁচ মুছতে শুরু করে মাথা ঝাঁকাল লংফেলো। ‘এসব হাঙ্গামা থেকে মেয়েদের দূরে থাকাই সবদিক থেকে ভাল। মেয়েরা হলো ফুলের মত, এদের কাজ শুধু সুগন্ধ বিলানো। চলো হে, নাতি, আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়া যাক।’
শীলা ম্লান মুখে বলল, ‘কিন্তু রানাকে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। ঝগড়া বাধাবার জন্যে এক পায়ে খাড়া হয়ে আছে ও। শেষ পর্যন্ত একটা গোলমাল বেধে গেলে?’
উঠে দাঁড়াল রানা। ব্যাগ তুলে কাঁধে ঝোলাল। তারপর ফিরল শীলার দিকে। ‘ভেবেচিন্তে যে হাঙ্গামা বাধায় সে তা থামাতেও পারে। শীলা, আমার কথা ভেবে অযথা দুশ্চিন্তা কোরো না। চললাম, লংফেলো।’
আকাশ থেকে পড়ল লংফেলো। ‘মানে? আমিও কি যাচ্ছি না তোমার সাথে?’
‘না।’
‘কেন?’
‘আমি নিজেই নিজের বোঝা হয়ে উঠছি ইদানীং, আর কাউকে বইতে পারব না,’ বলেই ঘুরে দাঁড়াল রানা। পা বাড়াল।
রানা ঢাল বেয়ে নেমে যেতে চশমাটা ধীর ভঙ্গিতে নামিয়ে রাখল লংফেলো। পরমুহূর্তে প্রচণ্ড শক্তিতে একটা ঘুসি মারল মাটির উপর। ‘ছোকরার দুঃসাহস দেখলে, শীলা! ভাবছে, একাই সব সামলাতে পারবে।’
‘বোধহয় ঠিকই ভাবছে,’ বলল শীলা। ঝর্ণার চঞ্চল স্রোতের দিকে তাকিয়ে আছে সে। উজ্জ্বল আর উৎফুল্ল দেখাচ্ছে মুখটা। ‘ফেলো কাকা, রানাকে যতটা চিনেছি, ওর পক্ষে সবই সম্ভব।’
‘চোখে রঙিন নেশা আর রক্ত গরম থাকলে ধরাকে সরা জ্ঞান করা সহজ ব্যাপার,’ খেপে গিয়ে উঠে দাঁড়াল লংফেলো। ‘রানা বিপদে পড়তে যাচ্ছে এ আমি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি, শীলা। আমিও চললাম,’ বলেই ছোঁ মেরে ক্যাপটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে ছুটল সে।