তেরো
দেঁতো হাসি ফুটল রানার মুখে। ‘চড় খেতে চাইনি বলে ওর হাতটা ধরে মুচড়ে দিয়েছিলাম, ব্যস। ওর চড় আমার পছন্দ নয়।’
রানার কথায় কান দিলেন না, গাফ। ‘আমার হিসেবে এখনও তুমি খুব বড় হওনি, পুসি। গায়ের ছাল এখনও তুলতে পারি। সম্ভবত আগেই উচিত ছিল আমার কাজটা করা। এখন বিদায় হও তোমার ওই আহামরি চেহারা নিয়ে।’ পুসি দরজা পর্যন্ত না পৌঁছানো পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন তিনি। ‘এবং মনে রেখো, আর কোনরকম চালাকি নয়! এই ব্যাপারটা আমি নিজে সামলাব।’
দরজা বন্ধ হবার জোর শব্দ হলো।
রানা বলল, ‘আপনার উপায়টা আইনসঙ্গত হবে, তাতে নিশ্চয়ই সন্দেহ নেই।’
চোখ কুঁচকে রানাকে দেখলেন গাফ। ‘আইন মেনেই যা কিছু করি আমি।’ ড্রয়ার খুলে ভিতর থেকে একটা চেক বই বের করে ডেস্কের উপর রাখলেন তিনি। সেটা খুললেন। ‘লংফেলোর বাড়ির ব্যাপারে আমি দুঃখিত-ক্ষতির পরিমাণ কত হবে?’
‘হাজার পাঁচেক ডলার পেলে লংফেলোর মনে কোনরকম দুঃখ থাকবে বলে মনে করি না,’ এক সেকেণ্ড বিরতি নিয়ে যোগ করল রানা। ‘এছাড়া, আমার একটা চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া ল্যাণ্ডরোভারের প্রশ্নও আছে।’
খয়েরী রঙের ভুরুর ভিতর থেকে রানার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন গাফ পারকিনসন। ‘রানা, আমাকে নাড়া দিয়ে টাকা ঝরাবার চেষ্টা করো না। ল্যাণ্ডরোভারের প্রসঙ্গ কোথা থেকে আসছে?’
‘সেটা একটা আলাদা গল্প।’
‘শুনি।’
কাইনোক্সি রোডে যা ঘটেছিল ব্যাখ্যা করে বলল রানা। ‘বিগ প্যাটকে বয়েড হুকুম দিয়েছিল আমাকে শায়েস্তা করতে, রিগ প্যাট তার হুকুম পালন করেছে মাত্র।’
‘দেখেশুনে মনে হচ্ছে একটা ঠগী পরিবারের কর্তা আমি,’ বিড়বিড় করে কথাটা বলে চেক লিখলেন গাফ, তারপর বই থেকে পাতাটা ছিঁড়ে রানার দিকে ঠেলে দিলেন সেটা। রানা দেখল দশ হাজার ডলারের অঙ্ক বসানো হয়েছে তাতে।
‘আপনার মেয়েকে সাবধান করে দিয়েছেন,’ বলল রানা। ‘কিন্তু বয়েডের ব্যাপারে কি করবেন ঠিক করেছেন? ভবিষ্যতে সে যদি কোনরকম চালাকি করতে চেষ্টা করে তার মুখটা যাতে চেহারা বদলায় তার ব্যবস্থা আমি করব।’
‘তা তুমি পারবে কিনা সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে,’ গাফ হাসলেন, কিন্তু তা তিক্ত বলেই মনে হলো রানার। টেলিফোনের রিসিভার তুললেন তিনি। ‘বয়েডের অফিসে কানেকশন দাও।’
রিসিভারের মুখটা হাত দিয়ে চেপে ধরলেন গাফ। ‘এ কাজ আমি বয়েডের স্বার্থে করছি না। তোমাকে আমি চোখের সামনে থেকে দূর ঠিকই করব রানা, কিন্তু তা করব আইনসঙ্গত ভাবে এবং পাল্টা আঘাত যাতে না আসে তার ব্যবস্থা করেই।’
টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে ক্ষীণ বেসুরো একটা কণ্ঠ ভেসে এল।
‘বয়েড! কান খুলে শোনো এখন,’ গাফ পারকিনসন ছেলেকে বলছেন, ‘এখন থেকে মাসুদ রানার পেছনে লাগবে না তুমি। ওর ব্যাপারে মাথা ঘামাবার দরকার নেই তোমার—যা করার আমিই করব।…একশোবার! একশোবার সে বাঁধের কাছে যাবে—ক্রাউন ল্যাণ্ডে মাটি খুঁড়লে তোমার কি? …শুনতে চাই না…ওর যা খুশি করুক, তুমি ওর কথা ভুলে গিয়ে নিজের চরকায় তেল দাও। ভাল কথা, গতরাতে লংফেলোর বাড়িতে পেট্রল ঢালার ব্যাপারে কি জানো তুমি? …কিছু জানো না— বেশ, তোমার প্রিয় বোনকে জিজ্ঞেস করে দেখো, সে জানে।’
ক্রেডলে রিসিভার রাখলেন গাফ পারকিনসন। ‘সন্তুষ্ট?’
‘নিশ্চয়,’ বলল রানা, ‘নিতান্ত বাধ্য না হলে গোলমালে জড়াতে চাই না আমিও!’
‘কিন্তু যাতে জড়িয়ে পড়ো তার ‘ব্যবস্থা আমি করব,’ প্রতিজ্ঞার সুরে বললেন তিনি। ‘অবশ্য, ফোর্ট ফ্যারেল ছেড়ে যদি ভালয় ভালয় চলে যাও তাহলে আলাদা…’ রানার হাসি হাসি মুখ আর দৃষ্টিতে তাচ্ছিল্যের ভাব লক্ষ্য করে থেমে গেলেন গাফ। গলার স্বর পাল্টে প্রায় মিনতির ভঙ্গিতে বললেন, ‘সত্যি সত্যিই, কে তুমি, রানা? কি চাও তুমি? কেন এভাবে আদাজল খেয়ে…’
কোন মন্তব্য তো করলই না রানা, আলোচনা চালিয়ে যাবার আর ইচ্ছে নেই তা জানিয়ে দেবার জন্যে প্রশ্ন করল, ‘শহরে ফিরব কিভাবে আমি? আপনার মেয়ে আমাকে নিয়ে এসেছে এখানে, নিশ্চয়ই সে আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসবে না?’
স্থির দৃষ্টিতে কয়েক সেকেণ্ড চেয়ে রইলেন গাফ পারকিনসন রানার মুখের দিকে। তারপর ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘হাঁটাটা তোমাকে চিন্তা ভাবনা করতে সাহায্য করবে। মাত্র তো একুশ মাইল পথ।’
কাঁধ ঝাঁকিয়ে গাফ পারকিনসনের দিকে পিছন ফিরল রানা। দৃঢ় পায়ে বেরিয়ে এল কামরা থেকে।
নিচে নেমে হলরুমে বা বাইরে কোথাও দেখল না রানা পুসিকে। দারোয়ান বা চাকরবাকরদের কাউকেও নজরে পড়ল না ওর। দু‘মানুষ উঁচু পাঁচিল ঘেরা উঠান ধরে খানিকদূর গিয়ে দিক পরিবর্তন করে সুইমিং পুলটার দিকে এগোল রানা। নির্জন, খাঁ-খাঁ করছে চারদিক। কনটিনেন্টাল গাড়িটার ছায়া পর্যন্ত দেখল না ও। কংক্রিটের চাতাল ধরে সুইমিং পুলটাকে বাঁ দিকে রেখে মন্থর গতিতে হাঁটছে রানা। একুশ মাইল পায়ে হেঁটে শহরে ফেরার কোন ইচ্ছা ওর নেই। গ্যারেজটা খুঁজে পেলেই হয় এখন।
সুইমিং পুলটা পেরিয়ে এসে হঠাৎ রানা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কংক্রিটের পাকা উঠানটা বাড়ির পিছন দিকে চলে গেছে একটা অর্ধবৃত্তের আকৃতি নিয়ে। গ্যারেজটা সম্ভবত এদিকেই। কিন্তু রানার দৃষ্টি আটকে গেছে উল্টো দিকে একটা একতলা বিল্ডিঙের উপর।
ঘন গাছপালার ভিতর থেকে উঁকি মারছে একটা একতলা বিল্ডিঙের কাঠামো। সঙ্গত কোন কারণ না থাকলেও, অদ্ভুত একটা আকর্ষণ বোধ করল রানা দালানটার প্রতি। ওদিকে পা বাড়াবার ইচ্ছাটাকে কাঁধ ঝাঁকিয়ে দমন করতে গিয়েও কি ভেবে, অনেকটা যুক্তির বিরুদ্ধেই, দিক পরিবর্তন করে এগোতে শুরু করল ও।
কংক্রিটের উঠান পেরিয়ে ঘাসের উপর নামল। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এগোল লাল ইঁট দিয়ে তৈরি বিল্ডিংটার দিকে।
ক্রমশ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে রানা দালানটা। লাল ইঁটের উপর কালচে শ্যাওলা জন্মেছে। জানালা দরজায় পর্দা নেই। তার মানে, বসবাসের জন্যে বাড়িটাকে ব্যবহার করা হয় না বলে অনুমান করল ও। কিন্তু গেটটা দেখে বেশ একটু অবাক হলো।
প্রকাণ্ড গেট। পাশাপাশি দুটো ট্রাক গলে যেতে পারবে অনায়াসে। লোহায় মরচে ধরেছে। ওর অবাক হবার কারণ হলো, মস্ত একটা তালা ঝুলছে গেটের মাঝখানে।
গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ভিতরে তাকাল রানা লোহার রডের ফাঁক দিয়ে। কেউ নেই বলেই মনে হলো। অদ্ভুত একটা ঠাণ্ডা, নির্জন আর নিস্তব্ধ পরিবেশ বিল্ডিংটার ভিতর। তালাটা বহুকাল ধরে খোলা হয় না, বুঝতে পারল গায়ে মরচে পড়ার দাগ দেখে।
কৌতূহল জাগাতে পারে এমন কিছু চোখে না পড়লেও গেট টপকে বিল্ডিঙটা ঘুরে একবার দেখার ইচ্ছা থাকলেও ব্যাপারটা স্রেফ সময়ের অপচয় হবে মনে করে ঘুরে দাঁড়াল রানা। পা বাড়াবে ফেরার জন্যে, হঠাৎ পায়ের দিকে চোখ পড়তে থমকে গেল ও।
গাড়ির চাকার দাগ মাটিতে। বেশ পুরানো, কিন্তু এখনও পরিষ্কার। তার মানে, ভাবল ও, মাস কয়েকের বেশি পুরানো নয়। দাগটাকে দৃষ্টি দিয়ে অনুসরণ করার জন্যে গেটের দিকে ফিরল আবার। গেট পেরিয়ে বিল্ডিংটার উঠানে, সেখান থেকে বাঁক নিয়ে চলে গেছে পিছন দিকে।
তিন সেকেণ্ড চিন্তা করার পর গেট টপকে ভিতরে ঢুকল রানা। বিল্ডিংটার পিছন দিকে-এগোতে এগোতে একটা সিগারেট ধরাল।
পিছন দিকে পৌঁছে টিনশেডটা দূর থেকেই চোখে পড়ল ওর। একদিকের ছাদ নিচু হয়ে গেছে সম্ভবত কোন ঝড়-ঝাপটায়। কেউ নেই আশপাশে। টিন-শেডের দরজাটাও টিন দিয়ে তৈরি। বন্ধ। গাড়ির চাকার দাগটা দরজা পেরিয়ে ভিতরে চলে গেছে। হাঁটার গতি বেড়ে গেল রানার।
এ ভালাটাও অনেক দিনের পুরানো। টানাটানি করতে খুলে গেল সহজেই, কবাট দুটো খুলে ভিতরে তাকাল রানা।
শেডের ভিতর পুরানো অচল প্রাইভেট কার, ট্রাক্টর, মোটরসাইকেল, ট্রাক আর মাইক্রোবাসের ভিড়। সবগুলোই ভাঙা, তোবড়ানো, বিধ্বস্ত গাড়ি। জায়গাটাকে যানবাহনের গোরস্থান বলা চলে। দু‘পাশের গাড়িগুলো দেখতে দেখতে সামনের দিকে এগোল রানা। শেডের মাঝখানটায় হঠাৎ থমকে দাঁড়াল ও।
ধুলোর স্তর প্রায় ঢেকে রেখেছে গাড়িগুলোর স্বাভাবিক চেহারা। কিন্তু তবু ওগুলো যে সবই অতি পুরাতন, রঙচটা, বাতিল গাড়ি তা এক নজর দেখলেই বুঝতে অসুবিধে হয় না। এগুলোর ভিড়ে খাপছাড়া একটা জিনিস দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে রানা!
গাড়িটা বিরাট। ধুলোর স্তর প্রায় ঢেকে ফেলেছে পুরোটা। কিন্তু ভিতর থেকে একটা উজ্জ্বল ভাব ফুটে বেরিয়ে আসছে তবু। এই সব মরচে ধরা গাড়ির ভিড়ে এটা যেন একটা ব্যতিক্রম। কাছে গিয়ে দাঁড়াল রানা। একটা আঙুল দিয়ে গাড়িটার ছাদে ঘষা দিতেই ধুলোর স্তর সরে গিয়ে বেরিয়ে পড়ল চকচকে, লাল গা।
চিন্তিত হয়ে পড়ল রানা। আনকোরা নতুন গাড়ি এটা। এখানে ফেলে রাখা হয়েছে কেন? ঘুরে গাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রানা। কারণটা বুঝল এতক্ষণে ও। গাড়ির সামনেটা চ্যাপ্টা হয়ে গেছে দুঃখজনকভাবে। নাক বরাবর কোন শক্ত বস্তুর সাথে ধাক্কা খেয়েছিল, সন্দেহ নেই। ধুলোর স্তর সরিয়ে গাড়ির নাম ও নাম্বারটা দেখে নিল রানা। মাঝখানের রাস্তাটা ধরে আবার এগোতে শুরু করল রানা। সত্যিকার বিস্ময় অপেক্ষা করছিল একেবারে পিছন দিকে।
দেখেই চিনতে পারল রানা কালো গাড়িটাকে। উইগুস্ক্রিনের মাঝখানে এখনও ঝুলছে জাপানী পুতুলটা। কেনেথের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল রানার। এই গাড়িটাই চাপা দিয়েছিল ওদেরকে মন্ট্রিয়লে।
গাড়ির নাম্বার-প্লেটটা দেখল রানা। নাম্বারটা টুকে নিতে গিয়েও নিল না, ভাবল লাভ নেই; কেননা অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটাবার পর নাম্বার-প্লেট নিশ্চয়ই বদলে ফেলা হয়েছে
বিল্ডিঙটা থেকে বেরিয়ে এল রানা। গেট টপকে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সুইমিং পুল পর্যন্ত এসে পারকিনস দের বসতবাটির পিছন দিকে যেতেই গ্যারেজটা দেখতে পেল, পুসির কনটিনেন্টাল দাঁড়িয়ে আছে, পাশে আরও কয়েকটা গাড়ি।
কনটিনেন্টালের পাশে গিয়ে দাঁড়াল রানা। ঝুঁকে দেখল, ইগনিশনলকে রিঙসহ ঝুলছে চারিটা
হালকা শিস দিল রানা। গাড়িটাকে না পেয়ে পুসির চেহারা কেমন হবে ভাবতে গিয়ে মৃদু হাসল ও। উঠে বসে স্টার্ট দিল কনটিনেন্টালে।
***
জ্যাক লেমনের কাছে পানির দামে বিক্রি করে দিল রানা ল্যাণ্ডরোভারটা। প্রায় নতুন একটা, টয়োটা জীপ কিনে ফেলল গাফ পারকিনসনের টাকায়। লেমনকে অনুরোধ করতে সে রাজি হলো কনটিনেন্টালটাকে পারকিনসন বিল্ডিঙ-এর সামনে রেখে আসতে। জীপ নিয়ে কেবিনে ফিরে রানা দেখল শীলার কোমর ধরে নাচছে লংফেলো, হাঁপাচ্ছে ঘনঘন, আর ঢোক গিলতে গিলতে বলছে, ‘ছেড়ে দে মা, এই বুড়ো বয়সে এসব শিখে আর কি হবে…!’
‘চমৎকার!’ ভিতরে ঢুকে বলল রানা। ‘আজ উৎসবেই দিন বটে। নাচো, নাচো!’
দু‘জনেই থামল ওরা। ফিরল রানার দিকে।
‘উৎসবের দিন?’ জানতে চাইল শীলা। লংফেলোকে ছেড়ে দিয়ে এক পা এগোল সে রানার দিকে।
‘কেবিনের ক্ষতি হওয়ার দরুন পাঁচ হাজার ডলার দিয়েছেন তোমাকে গাফ,’ লংফেলোর দিকে তাকিয়ে বলল রানা, ‘আর আমার ল্যাণ্ডরোভারের দাম হিসেবে আমি পেয়েছি আরও পাঁচ।’ পকেট থেকে ডলারের বাণ্ডিলটা বের করে ছুঁড়ে দিল রানা লংফেলোর দিকে।
‘বলো কি!’ বাণ্ডিলটা লুফে নিয়ে আকাশ থেকে পড়ল লংফেলো। পরমুহূর্তে ‘সবজান্তার মত মাথা দোলাল সে। ‘আসলে এরকম হওয়াই স্বাভাবিক। তখনই আমার মনে খটকা লেগেছিল। গাফ এ ধরনের কাজ কখনও করে না। সে নির্মম একটা জানোয়ার, তাতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু আজ পর্যন্ত বেআইনী কিছু করে ধরা পড়েনি কোনদিন।’
কি ঘটেছে সংক্ষেপে বলল রানা। কিন্তু টিনশেডের প্রসঙ্গটা জানাল না ওদের। সবশেষে বলল, ‘গাফকে একজন সৎ লোক বলেই মনে হয়েছে আমার। চেঙ্গিস খানের মত বদরাগী বা পাষাণ তিনি হতে পারেন, কিন্তু যা করেন সরাসরি, আইনের আওতায় থেকে করেন। তাঁর সাথে কথা বলে এটুকু আমি পরিষ্কার বুঝেছি। এখন প্রশ্ন হলো, এরকম একজন লোকের লুকিয়ে রাখার মত কি থাকতে পারে?’
‘ব্ল্যাকমেইলের কথা তিনি তুললেন কেন বুঝতে পারছি না,’ শীলাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে।
‘তার সম্পর্কে তোমার ধারণা কি, লংফেলো?’
‘সৎ লোক, সন্দেহ নেই। এ ব্যাপারে আমি তোমার সাথে একমত।’
‘তাহলে ব্ল্যাকমেইলের ভয় কেন করছেন তিনি?’
চুপ করে থাকল লংফেলো। কি যেন ভাবছে।
আবার বলল রানা, ‘এক হতে পারে, কেনেথকে খুন করা হয়েছে এবং আমি তার সাক্ষী, এটা তিনি জানেন। কিন্তু…’
‘আমাদের ধারণা যদি সত্যি হয় অর্থাৎ সত্যিই যদি গাফ একজন সৎ লোক হয়ে থাকে,’ বলল লংফেলো, ‘তাহলে কেনেথ হত্যাকাণ্ডে তার কোন হাত না থাকারই কথা। তাই যদি হয়, তার ভয়ের কি আছে?’
‘হয়তো ছেলের অপরাধের জন্যে তুমি তাকেই ব্ল্যাকমেইল করতে চাইছ এরকম ভেবে থাকতে পারেন,’ বলল শীলা
‘উঁহুঁ,’ বলল রানা, ‘তিনি যেভাবে কথাটা বলেছেন তাতে শুধু এটাই বোঝায় যে তাঁর নিজের কোন অপরাধের জন্যেই আমি তাঁকে ব্ল্যাকমেইল করার কথা ভাবছি বলে ধরে নিয়েছেন তিনি। পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি, ব্ল্যাকমেইল করার মত, অন্তত একটা অপরাধ তিনি করেছেন তাঁর জীবনে।’
শীলা এবং লংফেলো চুপচাপ চেয়ে আছে রানার দিকে। কথা নেই মুখে।
‘কেনেথকে খুন করার ব্যাপারে তার কোন ভূমিকা নাও থাকতে পারে,’ বলল রানা, ‘কিন্তু হাসপাতালে আমি যে কেনেথের সাথে ছিলাম এ খবর তিনি হয়তো জানেন।’
‘না হয় জানলই…’
লংফেলোকে থামিয়ে দিয়ে বলল রানা, ‘তিনি জানেন কেনেথ তার প্রথম জীবনে বখাটে এবং বদমাশ ছিল। এই কেনেথই, ছিল হাডসন ক্লিফোর্ডের ক্যাডিলাকে, যখন অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটে। অ্যাক্সিডেন্টের পর কেনেথ স্মৃতি হারিয়ে ফেলে। কিন্তু আমার সাথে হাসপাতালে থাকার সময় তার স্মৃতি ফিরে এসেছিল—গাফ পারকিনসন যদি এরকম ভেবে থাকেন? হয়তো তাই ভেবেছেন এবং ধরে নিয়েছেন অ্যাক্সিডেন্টের সময় ঠিক কি ঘটেছিল তা কেনেথ আমাকে জানিয়ে গেছে এবং আমি এখন ফোর্ট ফ্যারেলে এসেছি প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ করে দেবার ভয় দেখিয়ে তাঁর কাছ থেকে টাকা আদায় করতে।’
লংফেলোর চোখ কপালে উঠে গেছে। ‘তার মানে তুমি পরিষ্কার বলছ সেটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল না?’
‘হ্যাঁ, ঠিক তাই বলতে চাইছি আমি,’ বলল রানা, ‘সেটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল না। সৎ হলেও, গাফ পারকিনসন সম্ভবত জীবনে বড় একটা বেআইনী কাজ করেছিলেন। যে কাজের একমাত্র সাক্ষী ছিল কেনেথ।’
‘বড় একটা বেআইনী কাজ বলতে কি বোঝাতে চাইছ তুমি?’ জানতে চাইল লংফেলো।
‘খুন,’ বলল রানা, ‘বেআইনী কাজ বলতে আমি খুন বোঝাতে চাইছি, লংফেলো।’
চোখমুখ থমথম করছে ওদের। দু‘জনের দিকে তাকাল রানা পালাক্রমে। তারপর কাঁধ ঝাঁকাল ও। ‘যদিও, বুঝলে লংফেলো, এতক্ষণ ধরে যা বললাম তার একটা কথাও আমি নিজেই বিশ্বাস করি না।’
বিস্ময়ে কথা ফুটল না লংফেলোর মুখ থেকে।
‘কি!’ প্রায় আঁৎকে উঠল শীলা।
পায়চারি শুরু করেছে রানা। মাথার চুলে আঙুল চালাচ্ছে। মৃদুকণ্ঠে বলল ও, ‘হ্যাঁ। যে ব্যাপারটার ওপর ভিত্তি করে কথা বলছি সেটা আসলে কপোলকল্পিত, বাস্তব কোন ব্যাপার নয়।’
‘কিছুই বুঝছি না আমরা তোমার কথা, রানা,’ বলল লংফেলো।
‘আমরা যেমন ভাবে ভাবছি তার গোড়ায় মস্ত কোন গলদ রয়ে গেছে,’ চিন্তিত ভাবে বলল রানা। ‘কেনেথের মুখ থেকে ঘটনাগুলো শোনার পর আমি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলাম গোটা ব্যাপারটার মধ্যে অদ্ভুত একটা রহস্য আছে। যে রহস্যের মীমাংসা করা পুলিস বা সিআইডি বিভাগের পক্ষে কোন দিনই সম্ভব নয়। নিজেকে এই রহস্যের সাথে জড়াবার কয়েকটা কারণের মধ্যে এটাও একটা বড় কারণ, লংফেলো। দুর্ভেদ্য রহস্যের প্রতি আমার অদম্য আকর্ষণ। সে যাই হোক, রহস্যটা আমরা যতটুকু মনে করছি তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল এবং নাটকীয়, এটুকু নিশ্চয়তা তোমাদের আমি দিতে পারি।’
‘কিন্তু পরিষ্কার করে বলছ না কেন জটিলতা কোনখানটায়? গোড়ায় গলদ রয়ে গেছে বলছ, কি সেই গলদ?’
পায়চারি থামিয়ে হঠাৎ মুচকি হাসল রানা। ‘না, লংফেলো, সব কথা বলার সময় এখনও আসেনি। আমার অনুমানের কথা শুনিয়ে কারও কান ভারি করতে চাই না। প্ৰমাণ চাই।’