বারো
সামনেই লংফেলোর কেবিন। গিয়ার বদল করল রানা। এক পাশের ঝোপজঙ্গল দুলে উঠতে নাকের ডগা থেকে চশমাটা ঠিক জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে ব্যস্ত হয়ে উঠে বিস্ময় প্রকাশ করল লংফেলো। ‘তাজ্জব ব্যাপার! এর আগে কখনও তো এখানে হরিণ দেখিনি।’
হেডলাইটের আলো ঘুরে গিয়ে স্থির হলো কেবিনের উপর, ছুটে ঝোপের আড়ালে গা ঢাকা দিতে দেখল রানা একটা মূর্তিকে। ‘হরিণ নয়।’ গাড়িটা পুরোপুরি দাঁড়ায়নি তখনও, লাফ দিয়ে নিচে নেমে ছুটল ও।
কাঁচ ভাঙার ঝনঝন শব্দে ঠিক কেবিনের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল রানা। চরকির মত ঘুরল আধ পাক। কেবিনের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে কেউ, শব্দ পেয়েই ডাইভ দিয়ে পড়ল রানা দরজাটাকে লক্ষ্য করে।
ঠিক দরজার উপর হলো সংঘর্ষটা। ধাক্কা খেয়ে কেবিনের ভিতর ছিটকে ফেরত গেল লোকটা। পতনের শব্দের পরপরই দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলার আওয়াজ পেয়ে রানা বুঝতে পারল লোকটা কেবিনের ভিতর দিকে সরে যাচ্ছে হামাগুড়ি দিয়ে। এক পা ভিতরে ঢুকে পকেটে হাত ভরল রানা লাইটার বের করার জন্যে! লংফেলোর হুঙ্কার শুনতে পাচ্ছে ও। যে লোকটা পালিয়েছে তার চোদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছে সে। লাইটারটা স্পর্শ করেও পকেট থেকে খালি হাত বের করে আনল রানা। বিপদের উগ্র গন্ধ ঢুকেছে ওর নাকে। কুঁচকে উঠল ভুরু। বুঝতে অসুবিধে হলো না কেবিনটার প্রতিটি ইঞ্চি ভিজিয়ে রাখা হয়েছে পেট্রল দিয়ে। মুহূর্তে গোটা কেবিনে আগুন ধরাবার জন্যে আগুনের একটা কণাই এখন যথেষ্ট।
সামনে নিকষ কালো অন্ধকার। পিছনে পায়ের শব্দ। ‘সাবধান, লংফেলো।’ দ্রুত বলল রানা, ‘সরে যাও দরজার কাছ থেকে।’
অন্ধকার সয়ে আসছে রানার চোখে। কেবিনের পিছন দিকের জানালা থেকে ক্ষীণ আলোর আভাস আসছে। হাঁটু মুড়ে নিচু হলো ও। সামনেটা দেখার চেষ্টা করছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। ক্ষীণ আলোটা মুহূর্তের জন্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। সরছে লোকটা। ডান দিকে সরে আসছে নিঃশব্দে, দরজার দিকে এগোচ্ছে। লোকটার অবস্থান অনুমান করে লাফ দিল রানা।
অনুমানে ভুল ছিল। যতটা ভেবেছিল, তার চেয়েও দ্রুত সরছে লোকটা। ধরার জন্যে একটা পা পেল রানা শুধু। ধরেই বুঝতে পারল আটকে রাখা যাবে না একে। জোরে পা ঝাড়া দিল লোকটা। পরমুহূর্তে ডান কাঁধে তীক্ষ্ণ একটা ব্যথা অনুভব করল রানা। নিজের অজান্তে ছেড়ে দিল লোকটার পা। আরও আঘাত আসছে বুঝতে পেরে গড়িয়ে সরে যাবার আগেই আচমকা ওঁর মুখে পড়ল একটা লাথি। বোঁ করে ঘুরে উঠল মাথাটা। মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে তিন লাফে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল লোকটা। ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে ছুটন্ত পদশব্দ।
বাইরে বেরিয়ে এসে রানী দেখল কুণ্ডলী পাকানো একটা মূর্তির সামনে ঝুঁকে পড়ে কি যেন দেখছে শীলা।
কাছে গিয়ে পৌছুবার আগেই লংফেলো কাতরাতে কাতরাতে উঠে বসল।
‘কোথায় লেগেছে…?’
তলপেট চেপে ধরে উঠে দাঁড়াল লংফেলো। ব্যথায় কুঁচকে আছে মুখটা। ‘শালা ষাঁড়টা আমার পেটে গুঁতো মেরেছে।’
‘এখানে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত হচ্ছে না’ চারদিকে ত্রস্ত দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বলল শীলা, ‘চলো, কেবিনে আশ্রয় নিই আগে।’
‘না, বলল রানা, কেবিনটা এখন বোমার মত হয়ে আছে। গাড়িতে টর্চ আছে, নিয়ে আসবে তুমি?’
লংফেলোকে ধরে একটা পাথরের কাছে নিয়ে গিয়ে সেটার উপর বসিয়ে দিল রানা। ফিরে এসে রানার মুখের উপর টর্চের আলো ফেলল শীলা।
‘মাই গড!’ আঁতকে উঠে পিছিয়ে গেল সে এক পা। ‘তোমার মুখের এ অবস্থা হলো কি করে?’
‘মাড়িয়ে দিয়েছে,’ বলল রানা, ‘দাঁড়াও এখানে। টর্চটা দাও।’ টর্চ হাতে কেবিনের ভিতর ঢুকল রানা। দেখল চাদর, বালিশ, লেপ তোষক সব বিছানা থেকে নামিয়ে স্তূপ করে রাখা হয়েছে এক কোণায়। কয়েক গ্যালন পেট্রল খরচ করা হয়েছে ওগুলো ভেজাবার জন্যে। কার্পেটটাকে ছোরা দিয়ে ফালি ফালি করা হয়েছে যাতে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকতে পারে পেট্রল। মেঝেতে গড়াচ্ছে এখনও তরল জ্বালানি। লণ্ঠনটা খুঁজে নিয়ে বৈরিয়ে এল রানা। ‘বাইরেই তাঁবু গাড়তে হবে আজ রাতে। গাড়িতে কম্বল আর চাদর তো আছেই।’
‘কেন, কেবিনটা কি দোষ করল?’
পেট্রলের কথা বলল রানা। শুনে অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে গেল লংফেলো। খানিকপর শুধু মন্তব্য করল, ‘এটাই পারকিনসনদের নিয়ম। যাকে পছন্দ করে না তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়।’
‘তোমার কি মনে হয়?’ জানতে চাইল রানা, ‘মেয়ের কাছ থেকে রিপোর্ট পেয়ে গাফ পারকিনসন লোক পাঠিয়েছিল কেবিনে আগুন ধরাবার জন্যে?’
‘গাফ?’ এদিক ওদিক মাথা নাড়ল লংফেলো। ‘আমি বিশ্বাস করি না। গাফ এ ধরনের কাজ করতে পারে না। আমি বাজি ধরে বলতে পারি এটা বয়েজের শয়তানি।’
‘এই মুহূর্তে পুলিসে খবর দেয়া উচিত আমাদের,’ বলল শীলা।
‘দু‘জনের কারও মুখই দেখতে পাওনি তুমি, রানা?’
‘কিভাবে!’
‘সেক্ষেত্রে,’ বলল লংফেলো, পুলিসে খবর দিয়ে কোনও লাভ হবে না।
‘ব্যাপারটার সাথে পারকিনসনরা জড়িত তা আমরা প্রমাণ করতে পারছি না। ওদের বিরুদ্ধে প্রমাণ ছাড়া অভিযোগ করতে গেলে দূর দূর করে ভাগিয়ে দেবে পুলিস সার্জেন্ট হ্যামিলটন।’
‘পুলিসকেও গোলাম বানিয়ে রেখেছে পারকিনসনরা?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘ঠিক তা নয়,’ বলল লংফেলো, ‘এমনিতে হ্যামিলটন মানুষ হিসেবে ভাল, অফিসার হিসেবেও। কিন্তু যখনই পারকিনসনদের কথা উঠবে, নিশ্ছিদ্র প্রমাণ ছাড়া তাকে দিয়ে কিছুই করানো যাবে না। পারকিনসনরা এখানকার হর্তকর্তা বিধাতা, চাইলেও কথাটা কেউ ভুলে থাকতে পারে না, রানা।’
কেবিন থেকে আধ মাইল দূরের একটা ঢালু জমিতে তাঁবু খাটানো নিরাপদ বলে মনে করল রানা। ল্যাম্প এবং আগুন জ্বালাবার পর হঠাৎ ব্যথা করে ওঠায় ডান কাঁধে হাত রাখল রানা। উষ্ণ এবং ভেজা ভেজা ঠেকতে হাতটা ফিরিয়ে আনল চোখের সামনে। রক্ত দেখে আঁৎকে উঠল শীলা। ‘ও কি!’
‘আরে!’ সবিস্ময়ে বলল রানা। ‘ছুরি মারা হয়েছে বুঝতেই পারিনি।’
***
পরদিন সকালে শীলা আর লংফেলোর উপর কেবিন পরিষ্কার করার দায়িত্ব দিয়ে ফোর্ট ফ্যারেলের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল রানা। রক্ত বন্ধ হয়ে যাবার পর কাঁধের অগভীর ক্ষতটা বিশেষ বিরক্ত করেনি আর ওকে। শীলা সকালে আর একবার ড্রেসিং করে দিয়েছে।
‘গন্তব্যস্থান?’ কৃত্রিম জবাবদিহি চাইবার ভঙ্গিতে জানতে চাইল লংফেলো। সংক্ষেপে উত্তরটা সারল রানা, ‘শয়তানের আস্তানা।’
‘বোকার মত বিপদের দিকে পা বাড়িয়ো না। তোমাকে নিষেধ করছি আমি।’
‘আমার জন্যে কোথাও কোন বিপদ নেই।’
ফিড-ল্যাম্পটা গোলমাল করছিল, ল্যাণ্ডরোভারকে জ্যাক লেমনের বৃষস্কন্ধে চাপিয়ে দিয়ে পায়ে হেঁটে পুলিস স্টেশনে পৌঁছুল রানা। কিন্তু হ্যামিলটন ফোর্ট, ফ্যারেলে নেই। কনস্টেবল লোকটা রানার সব কথা শোনার পর প্রশ্ন করল, ‘স্যার, লোক দু‘জনকে আপনি চিনতে পেরেছেন কি?’
‘অন্ধকার ছিল।’
‘আপনার কিংবা মি. লংফেলোর কোন শত্ৰু আছি কি?’
একটু বিরতি নিয়ে উত্তরটা দিল রানা, ‘খোঁজ নিলে জানতে পারবেন ওরা দু‘জনই সম্ভবত পারকিনসনদের কর্মচারী।’
বিস্ময় ফুটে উঠল কনস্টেবলের চেহারায়। ‘কিন্তু ফোর্ট ফ্যারেলের অর্ধেক লোকই তো পারকিনসনদের কর্মচারী, স্যার। সে যাই হোক, মি. রানা, আপনি যদি লিখিত অভিযোগ করেন তাহলে ব্যাপারটা আমি সার্জেন্টের গোচরে আনতে পারি।’
‘লিখে পাঠিয়ে দেব অভিযোগটা। সার্জেন্ট হ্যামিলটন ফিরবেন কবে?’
‘দিন কয়েকের মধ্যেই।’
পুলিস স্টেশন থেকে পারকিনসন বিল্ডিং সাত মিনিটের রাস্তা। লিফটে ওঠার মুখে পিছন থেকে বাধা পেল রানা। ‘হ্যালো, মি. মাসুদ রানা! অমন বেজার মুখে যাওয়া হচ্ছে কোথায়?’
ঘাড় ফিরিয়ে মিসেস স্টুয়ার্ডকে দেখল রানা। মুচকি হেসে বলল, ‘ব্রাদার বয়েডের কাছে। কেন যাচ্ছি তা জানতে চাও?’
‘চাই, যদি বলো।’
‘ওর খাড়া নাকটা দুমড়ে দিতে,’ বলল রানা।
খিল খিল করে হেসে উঠল পুসি। রানার সামনে এসে থামল সে। একটা হাত রাখল ওর বাঁ কাঁধে। ‘যাচ্ছ, কিন্তু আশা পূর্ণ হবে না। কঠিন পাত্র এই বয়েড। ওর বডিগার্ডের সঠিক সংখ্যা ওর নিজেরই জানা নেই।’ মাথাটা একটু সরিয়ে তির্যক দৃষ্টিতে তাকাল সে। ‘হুঁ। বুড়ো লংফেলো তাহলে আমার কথা বলেছে-তোমাকে?’
‘বলেছে। কিন্তু সবই খারাপ কথা, প্রশংসাসূচক একটা শব্দও নয়।’
প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেল পুসি। ‘রানা, তোমার আমি ভাল চাই। যদি জিজ্ঞেস করো, কেন? এর আমি সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারব না। হয়তো লংফেলো তোমাকে যা বলেছে তাই সত্য। হয়তো সত্যিই আমি পুরুষ ঘেঁষা মেয়ে। তবে যাই বলো, তোমার মত পুরুষ অনেক সতী সাধ্বী মেয়েরও মাথা ঘুরিয়ে দেবে। সে যাই হোক, পরিষ্কার করে বলছি কথাটা, সত্যি বলতে কি, তোমার ওপর আমার একটা দুর্বলতা মত জন্মেছে। আমি চাই না তোমার এমন সুন্দর শরীরটা কোন জানোয়ারের হাতে পড়ে ক্ষতবিক্ষত হোক। তাছাড়া, আমাদের বুড়ো বাপ তোমার সাথে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। সেজন্যেই এখানে দেখছ তুমি আমাকে। হ্যাঁ, তোমার জন্যেই আমি অপেক্ষা করছিলাম এইখানে।’
‘গাফ পারকিনসন আমার সাথে দেখা করতে চান?’
‘চান। আমাকে তিনি পাঠিয়েছেন তোমাকে সাথে করে নিয়ে যাবার জন্যে।’
‘কেউ যদি দেখা করতে চায় তাকে আমি সাধারণত বিমুখ করি না,’ বলল রানা। ‘ডুমুরের ফুল নই, যখন ইচ্ছা তিনি আমার কাছে আসতে পারেন।’
‘অবুঝ হয়ো না, রানা। বুড়ো একজন মানুষ তোমার কাছে কষ্ট করে আসবেন, তারপর তুমি তাঁর সাথে দেখা করবে-এটা কি একটা কথা হলো? আমার বাবার সাতাত্তর চলছে। বাইরে তিনি একান্ত বাধ্য না হলে বেরোনই না।’
হাতের তালুতে চিবুক ঘষছে রানা। দেঁতো হাসি লেগে রয়েছে মুখে। ‘এমন উপযুক্ত ছেলে থাকতে তার বাইরে বেরুবার দরকারটাই বা কি? তিনি বাইরে বেরিয়ে সব ব্যাপারে খোঁজ-খবর রাখতে চাইলে বরং হাঙ্গামাই বেধে যাবে, কি বলো?’
‘মানে?’
‘বাপ-বেটার গোলমাল দেখা দেবে না?’
বিস্ময় ফুটে উঠল পুসির চেহারায়। কিন্তু দ্রুত সামলে নিল সে নিজেকে। খোঁচাটা ঠিক জায়গা মতই যেন লেগেছে, মনে হলো রানার।
‘ঠিক আছে পুষি বিড়াল। চলো, তোমার জনকের সাথে মোলাকাত পর্বটা সেরেই নিই আজ।’
হাসল পুসি। ‘আমি জানতাম যুক্তি মানবে তুমি, রানা। চলো, বাইরে গাড়ি রেখে এসেছি তোমার জন্যে।’
কন্টিনেন্টালে চড়ে শহর ত্যাগ করল ওরা। দক্ষিণ দিকের রাস্তা ধরে গাড়ির স্পীড আশির উপর তুলল পুসি। প্রথমে ভাবল রানা, পারকিনসনদের স্বর্গপুরী লেকসাইড নামে খ্যাত এলাকারই কোথাও হবে। পারকিনসন করপোরেশনের উচ্চপদস্থ অফিসাররা সবাই ওদিকেই বসবাস করে। কিন্তু এলাকাটাকে পাশ কাটিয়ে গাড়ি আরও দক্ষিণ দিকে ছুটছে দেখে ভুলটা ভাঙল ওর। হঠাৎ যেন বোধোদয় হলো ওর, তাই তো, গাফ পারকিনসন নিজেকে উচ্চপদস্থ বলে কেন মনে করবে, সে নিজেকে রাজা ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারে না। সবচেয়ে ভাল জায়গায় অনুপম প্রাসাদে রাজত্ব করবে সে এবং সেটাই তার জন্যে মানানসই।
গল্প জমাবার চেষ্টা করল পুসি, কিন্তু, শুরুতেই ধমক লাগিয়ে তাকে নিরাশ করল রানা। গুম মেরে সিগারেট টানতে লাগল সে। এক হাতে গাড়ি চালাচ্ছে। একটা সিগারেট শেষ হলে আরেকটা ধরাতে দশ সেকেণ্ডের বেশি সময় নিচ্ছে না। মাঝে মধ্যে আড়চোখে শুধু দেখছে রানাকে।
ফরাসীদের শ্যাতোর অনুকরণে তৈরি করেছে পারকিনসনরা তাদের প্রাসাদ। দূর থেকে দেখেই মুগ্ধ হলো রানা। একজন মানুষের ছায়া পর্যন্ত নেই বাড়িটার আশপাশে। লাল ইঁট, কারুকাজ করা জানালা, রঙিন টালির ছাদ—সব নতুনের মত ঝকঝক করছে, যেন এইমাত্র তৈরি করে দিয়ে বাড়ি গেছে মিস্ত্রীরা।
মাঝারি আকারের একটা ফুটবল খেলার মাঠের মত হলরূমে ঢুকল পুসি রানাকে নিয়ে। একদিকের পুরো দেয়াল নেই, তার জায়গায় উঠে গেছে ক্রমশ সিঁড়ির ধাপ। সেদিকে না গিয়ে রানার হাত ধরে এলিভেটরের দিকে এগোল পুসি।
‘ঘাড় মটকে দেব,’ হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল রানা, ‘ফের যদি অনুমতি না নিয়ে গায়ে হাত দাও।’
হাসিটা এতটুকু ম্লান হলো না মুখ থেকে, পুসি বলল, ‘ঠিক আছে, অনুমতি চাইছি, একটা চুমো খাব?’
‘অবশ্যই।’ কথাটা বলেই পুসির দিকে পিছন ফিরে ঘুরে দাঁড়াল রানা।
দুপ দাপ পায়ের শব্দ তুলে রানাকে ছাড়িয়ে এলিভেটরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল পুসি। বোতাম টিপতে খুলে গেল দরজা। ভিতরে ঢুকে ঠিক মাঝখানে দাঁড়াল সে, যথাসম্ভব বেশি জায়গা নিয়ে। রানা উঠল, দাঁড়াল একপাশে। এলিভেটরের দরজা বন্ধ হয়ে যেতে বোতাম টিপে দিল পুসি। উপরে উঠতে শুরু করল ওরা। রানার গায়ের দিকে সেঁটে এল পুসি। ‘রানা, আমার প্রতি তুমি ঠিক সদয় আচরণ করছ না। কারণটা জানতে পারি কি?’
‘খুব একটা সহৃদয় লোক নই আমি। সব মেয়েকে আমার ভাল লাগে না।’
‘হুহ্,’ রানার পেটে কনুই দিয়ে মৃদু খোঁচা মারল পুসি। ‘নিজেকে খুব কেউকেটা ভাবো, না?’
‘কেউকেটা না হলে তোমার মত মেয়ে প্রেম নিবেদন করবে কেন? যাকে তাকে নিশ্চয়ই তুমি ….’
চড়টা এগিয়ে আসছে দেখে দ্রুত হাত তুলে পুসির কব্জি ধরে ফেলল রানা, তারপর জোরে একটা চাপ দিয়ে ছেড়ে দিল। ব্যথায় নয়, রাগে লাল হয়ে উঠতে দেখল রানা মুখটাকে। মৃদু শব্দে এলিভেটরের দরজা খুলে যেতে খট খট খট-খট করে হাই হিলের আওয়াজ তুলে করিডর ধরে দ্রুত এগোল পুসি। একটা বাঁক পর্যন্ত তাকে অনুসরণ করল রানা। ডান দিকে তর্জনী তুলে শেষ মাথার একটা দরজা দেখিয়ে বলল পুসি, ‘ওখানে,’ তারপর সাঁই করে ঘুরে হাঁটা ধরল অন্যদিকে।
দরজা খুলে বিশাল একটা লাইব্রেরী রুমে ঢুকল রানা। দেয়ালের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত লম্বা বুক শেলফে অসংখ্য বই আর বই। বইগুলোর মলাট তৈরির জন্যে কয়েক ডজন গরু জবাই করা হয়েছে, ভাবল রানা। মলাটগুলোর চকচকে ভাব এতটুকু ম্লান হয়নি দেখে ধারণা করল ও; রোজ দু‘বেলা মালিকের জুতো পালিশ করার মত চাকর-বাকরেরা ওগুলোও বুক কেস থেকে নামিয়ে পালিশ করে। অপর দিকে মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত উঁচু কয়েকটা জানালা। সেগুলোর সামনে বড় একটা মেহগনি কাঠের ডেস্ক, উপরটা সবুজ লেদার দিয়ে মোড়া, সোনালী নকশা কাটা।
পাশাপাশি চারজন বসতে পারে ডেস্কের পিছনের রিভলভিং চেয়ারটায়। সিংহাসনের মতই আকৃতি সেটার। তাতে বসে আছেন মহারাজ—গাফ পারকিনসন।
রানা জানত লংফেলোর চেয়ে পাঁচ বছরের বড় গাফ পারকিনসন, কিন্তু তাঁকে দেখে পাঁচ বছরের ছোট বলেই মনে হলো ওর। সামরিক অফিসারের মত কড়া গোঁফ, খয়েরী রঙের চুলের সাথে মিলে গেছে পুরোপুরি। শালপ্রাংঙ্গ শরীর। কাঁধের দিকটা বিশাল, কোমরটা সরু, পেশীর অস্তিত্ব এখনও পরিষ্কার, গায়ে, চর্বির স্তর তৈরি হয়নি। ধারণা করল রানা, নিয়মিত ব্যায়াম চালিয়ে যাচ্ছেন ভদ্রলোক এই বয়সেও।
হাত নাড়লেন তিনি। ‘সিট ডাউন, রানা,’ কণ্ঠস্বর ভরাট এবং সেই সাথে স্পষ্ট, ভঙ্গিতে কর্তৃত্বের সুর। ‘ওটাই তোমার নাম, তাই নয় কি?’
‘তাই,’ বলল রানা, ‘বসতে বলার জন্যে ধন্যবাদ, কিন্তু আমি দাঁড়িয়ে থাকতেই পছন্দ করব। বেশিক্ষণ থাকব বলে আসিনি আমি।’
‘সে তোমার ইচ্ছা,’ গাফ পারকিনসন বললেন, ‘বিশেষ একটা কারণে তোমাকে আমি এখানে ডাকিয়ে এনেছি।’
‘আমারও তাই ধারণা !’
লৌহ কঠিন মুখে এক চিলতে হাসি ফুটল। ‘তুমি ফোর্ট ফ্যারেলের লোক নও বলেই আমার ডাকের অর্থ সম্পর্কে পরিষ্কার কিছু জানো না। সে যাক, ভয় পাবার কিছু নেই তোমার। এখনও আমি সিদ্ধান্ত নিইনি তোমার ব্যাপারে। আমি জানতে চাই ফোর্ট ফ্যারেলে কি করছ তুমি।’
‘আপনার মত আরও অনেকেই তা জানতে চাইছে,’ বলল রানা। ‘কিন্তু ফোর্ট ফ্যারেলে বা এই দুনিয়ায় আমি কি করছি না করছি তা দিয়ে আপনার কি দরকার, মি. পারকিনসন?’
‘দরকার নেই? আমার মাটিতে তুমি বিনা অনুমতিতে জিওলজিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছ কেন তা আমি জানতে চাইব না?’
‘আপনার মাটিতে? খবর নিন, ওটা ক্রাউন ল্যাণ্ড।’
হাত নেড়ে বিরক্তি প্রকাশ করলেন গাফ, ‘তর্কে আমার রুচি নেই, রানা : কি করছ তুমি এখানে, পরিষ্কার জানতে চাই।’
‘স্রৈফ পেটের ধান্ধায় ঘুরছি।’
তীক্ষ্ণ চোখে দেখলেন তিনি রানাকে। ‘আমাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে সুবিধে করতে পারবে না, ইয়ংম্যান। তোমার চেয়ে অনেক কঠিন পাত্র এর আগে চেষ্টা করেছে, আমি তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে জন্মের মত উচিত শিক্ষা দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছি।’
কপালে ভুরু তুলল রানা। ‘ব্ল্যাকমেইল? আপনার কাছ থেকে কিছু আদায় করার চেষ্টা করেছি বলে তো মনে পড়ছে না আমার, মি. পারকিনসন। ব্ল্যাকমেইলের কথা উঠছে কেন? এমন অপরাধ আপনি হয়তো করে থাকতে পারেন যা গোপন করে রাখতে চান, কিন্তু সেগুলো প্রকাশ করে দিয়ে টাকা আদায় করার কোনও উদ্দেশ্য আমার নেই।’
‘হাডসন ক্লিফোর্ড সম্পর্কে তোমার কৌতূহলের কারণ কি?’ সরাসরি রুক্ষ স্বরে জানতে চাইলেন তিনি।
‘আপনার কাছে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই আমি,’ চোখে চোখ রেখে বলল রানা।
ডেস্কে চাপড় মেরে সেটাকে নড়িয়ে দিলেন গাফ পারকিনসন। ‘আমার সাথে গোঁয়ার্তুমি কোরো না, ছোকরা! তার পরিণতি ভাল হবে মনে করলে ঠকবে তুমি।’
ডেস্কের উপর ঝুঁকে পড়ল রানা। ‘কি মনে করেন নিজেকে আপনি, গাফ পারকিনসন? এবং আমার সম্পর্কে কি ধারণা আপনার?’ রানা দেখল, গাফ পারকিনসন হঠাৎ পাথরের মত স্থির হয়ে গেছে। ‘ফোর্ট ফ্যারেলের আর সব ছাগল-ভেড়ার মত আমি নই যে তাদের মত আমার মুখেও হাত চাপা দিতে পারবেন। আপনি ভেবেছেন, অসহায় এক বুড়োর ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেবেন আপনি, আর আমি তা মুখ বুজে সহ্য করব?’
গাফ পারকিনসনের মুখের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ‘জ্বালিয়ে দেবার হুকুম দিয়েছি আমি, এটাই কি তোমার অভিযোগ, ইয়ংম্যান?’
‘পেট্রল ঢালার কাজ শেষ করেছিল, আগুন জ্বালাবার সময় পায়নি,’ বলল রানা।
চেয়ারে হেলান দিলেন তিনি। ‘কার বাড়ি আমি জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছি জানতে পারি কি?’
‘আপনার পছন্দ নয় বা আপনি ভয় করেন এমন একজন লোকের সাথে মি. লংফেলো ওঠাবসা করে বলে, তার চাকরি খেয়েছেন আপনি, কিন্তু তাতেও আপনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি…’
হাত তুলে থামালেন তিনি রানাকে, ‘কবেকার ঘটনা?’
‘গত রাতে।’
ডেস্কের উপর সুইচবোর্ডের দিকে তাকালেন তিনি। তর্জনী দিয়ে একটা বোতাম চেপে ধরে অদৃশ্য মাইক্রোফোনের মাধ্যমে নির্দেশ পাঠালেন, ‘আমার মেয়েকে এখানে পাঠিয়ে দাও।’ রানার দিকে মুখ তুলে তাকালেন। গলার স্বরে আগের মতই কাঠিন্য। ‘রানা, তোমার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, কারও বাড়ি-ঘরে আমি কখনও আগুন ধরাই না। যদি কখনও ধরাতে চাইতাম, সেগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যেত, পেট্রল ঢালার পর বাকি কাজটা অসমাপ্ত থাকত না। এবার, আলোচ্য প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। হাডসন ক্লিফোর্ড সম্পর্কে তোমার এত মাথা ব্যথা কেন?’
‘হতে পারে যে মেয়েটিকে আমি বিয়ে করব বলে ভাবছি তার অতীত ইতিহাস সম্পর্কে সম্ভাব্য সবকিছু জানতে চাই আমি,’ মুচকি হেসে ঠাট্টাচ্ছলে বলল রানা। কিন্তু বলেই বুঝল, গাফ পারকিনসনের জন্যে এটা একটা চমক তো বটেই, আঘাতও কম নয়।
রানার দিকে ভুরু কুঁচকে চেয়ে থাকলেন গাফ। তারপর যেন সংবিৎ ফিরে পেয়ে মাথা ঝাঁকালেন। ‘ওহ্, বুঝেছি। তার মানে শীলাকে বিয়ে করে আখের গুছাতে চাইছ!’
‘তাই যদি চাইতাম তাহলে আমি তো আপনার মেয়ের ওপরই নজর দিতে পারতাম।’ কথাটার উত্তরে স্তম্ভিত গাফ পারকিনসনের কি বলবার আছে তা আর জানা হলো না রানার। কারণ, সেই মুহূর্তে কামরার ভিতর ঢুকল পুসি।
ঝট করে মেয়ের দিকে ফিরলেন গাফ পারকিনসন। ‘লংফেলোর বাড়ি জ্বালিয়ে দেবার একটা অপচেষ্টা চালানো হয়েছে,’ রূঢ় কণ্ঠে জানতে চাইলেন তিনি, ‘কর্মটি কার?’
‘আমি কি জানি!’ পুসি মুখ কালো করে ফেলল।
‘আমাকে মিথ্যে বলতে চেষ্টা করো না, পুসি,’ মেয়েকে সতর্ক করে দিলেন গাফ পারকিনসন। ‘চিরকাল ধরা পড়েছ তুমি আমার কাছে।’
তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল পুসি একবার রানার দিকে। কাঁধ ঝাঁকাল। তারপর মৃদুকণ্ঠে বলল, ‘বললাম তো, এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।’
‘জানো না?’ গাফ পারকিনসন বললেন, ‘দ্বিতীয়বারও মিথ্যে কথা বলতে সাহস হচ্ছে তোমার! ঠিক আছে, এই শেষবার। হুকুমটা কে দিয়েছিল—তুমি, না বয়েড? রানা এখানে আছে বলে ইতস্তত করার কিছু নেই। আমি সত্য জানতে চাই।’
‘আমি! আমি!’ ফেটে পড়ল পুসি। ‘তখন আমার মনে হয়েছিল কাজটা ভালই হবে। আমি জানতাম ওকে তুমি ফোর্ট ফ্যারেল থেকে তাড়াতে চাও।’
দু‘চোখে অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টি ফুটে উঠল গাফ পারকিনসনের। ‘লংফেলোর বাড়ি জ্বালিয়ে দিলে মাসুদ রানা পালাবে, এই ভেবেছিলে তুমি? তুমি আমার মেয়ে, পুসি এ-কথা আমাকে বিশ্বাস করতে বলো? ওহ গড, আমি দেখছি একটা কেঁচোর বাপ হয়েছি!’ বিদ্যুৎবেগে একটা হাত তুললেন তিনি রানার দিকে। ‘তাকাও একবার এই লোকের দিকে। পারকিনসন করপোরেশনের কাছ থেকে চমৎকার কৌশলে এই লোক কয়েক হাজার ডলার খসিয়ে নিয়েছে এবং বর্তমানে সে নিপুণ কায়দায় বয়েডের চারদিকে জাল পাতছে। এসব জানার পরও কিভাবে তুমি ভাবলে যে এই লোককে আগুনের ভয় দেখিয়ে তাড়াতে পারবে?’
বড় একটা শ্বাস নিল পুসি। কণ্ঠস্বর কচি খুকির মত করে বলল, ‘বাবা, এই লোক আমার হাত মুচড়ে দিয়েছে।’
***