এগারো
দরজাটা ভেজানো। মৃদু ধাক্কা দিয়ে খুলে ভিতরে ঢুকতেই মেয়েটি মুখ তুলে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘মি. মাসুদ রানা ?’
মেয়েটা কে, কেমন কিছুই জানা নেই, কিন্তু ফিগারটা খাসা, মাথা ঘুরিয়ে দেবার মত—মনে মনে প্রশংসা না করে পারল না রানা। ভোগ বা প্লেবয় পত্রিকার পৃষ্ঠা থেকে বেরিয়ে এসেছে যেন। সাড়ে পাঁচ ফুটের মত লম্বা হবে। মুখটা আপেলের মত রাঙা। সর্বাঙ্গে যৌবনের ঢল নেমেছে, এবং তা ঢেকে রাখার চেষ্টা নেই। কাছে গিয়ে দাঁড়াতে একটা অনুমান পাল্টাল রানা মনে মনে। বয়স বিশ বাইশ নয়, সাতাশ আটাশের কম হবে না। ‘হ্যাঁ, আমি রানা।’
মেয়েটি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ‘আমি মিসেস স্টুয়ার্ড। অনুমতি না নিয়ে অনুপ্রবেশ করেছি বলে আমি ক্ষমা চাই, মি. রানা।’
‘কেউ না থাকায় আপনার করারও কিছু ছিল না,’ বলল রানা, ‘কি করতে পারি আপনার জন্যে আমি, মিসেস স্টুয়ার্ড?’
‘আমার জন্যে করবেন?’ হঠাৎ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠন মিসেস স্টুয়ার্ডের মুখ। ‘না, তা নয়—আপনি আমার জন্যে কিছু করতে পারেন না। আমি এসেছি আপনার জন্যে কিছু করতে, মি. রানা। শুনলাম আপনি নাকি এখানে ক’দিন থেকে আছেন, তাই ভাবলাম, যাই, ভদ্রলোকের সাথে পরিচয়ও করে আসি, আর সেই সাথে জেনে আসি ভদ্রলোকের কি উপকারে লাগতে পারি আমি। পড়শীর যা কর্তব্য, সুবিধে অসুবিধে দেখা—এই আর কি!’
পড়শী হিসেবে সোফিয়া লরেন, ব্রিজিদ বার্দোতও এর তুলনায় অবাঞ্ছিত, ভাবল রানা। ‘এত কষ্ট স্বীকার করেছেন দেখে মানতেই হচ্ছে আপনি খুব বড় সেবিকা। কিন্তু সেবার আমার কোন দরকার আছে কিনা সে ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ .আছে। আমি একজন বয়স্ক মানুষ, মিসেস স্টুয়ার্ড।
রানার দিকে চেয়ে থাকল মেয়েটি কয়েকটি মুহূর্ত। দেখল খুঁটিয়ে, পা থেকে মাথা পর্যন্ত। মুখের হাসিটা আরও বিস্তৃত হলো। ঠিক বলেছেন। আপনি বয়স্ক মানুষ! এবং, শব্দ করে হাসল এবার, তারপর বলল, ‘স্বাস্থ্যবান।’
লক্ষ করল রানা, লংফেলোর স্কচ হুইস্কির বোতল ইতিমধ্যে বেশির ভাগ খালি হয়ে গেছে। ‘বোতলটা পুরোই সাবাড় করে ফেলুন,’ কঠিন সুরে বলল ও, ‘ওটুকু আর রেখেছেন কেন?’
‘ধন্যবাদ,’ বলল মেয়েটা, ‘কেউ অনুরোধ না করা পর্যন্ত পুরোটা শেষ করতে কেমন যেন ভদ্রতায় বাধছিল। আপনিও গলা ভেজাবেন?’
আপদটাকে সহজে খেদানো সম্ভব হবে বলে মনে হলো না রানার। যে মেয়ে অপমান হজম করে মুখের হাসিটা ধরে রাখতে পারে তাকে তাড়াবার একমাত্র উপায় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া, কিন্তু নিজেকে রানা সে-রকম আচরণ করতে দিতে রাজি নয়। ‘না,’ বলল ও, আপনার কম পড়ে যাবে।’
. ‘আমার ব্যাপারে মাথা ঘামাবার লোকের অভাব নেই,’ চেয়ারে বসল মেয়েটা। তেপয় থেকে বোতলটা তুলে গ্লাসে হুইস্কি ঢালতে শুরু করল। ‘আসলে আমার কর্তব্য আপনার ব্যাপারে মাথা ঘামানো। আচ্ছা, ফোর্ট ফ্যারেলে অনেকদিন থাকার জন্যে এসেছেন বুঝি আপনি?’
বসল রানাও মেয়েটার কাছ থেকে হাত তিনেক দূরের একটা চেয়ারে। ‘আপনার জানতে চাওয়ার কারণ?’
‘বিশ্বাস করুন, পুরানো মুখগুলো দেখতে দেখতে চোখে পচন ধরে যাবার অবস্থা হয়েছে আমার। কেন যে এখানে পড়ে আছি নিজেই বুঝি না!’
মৃদু কণ্ঠে প্রশ্ন করল রানা, ‘মি. স্টুয়ার্ড কি ফোর্ট ফ্যারেলে কাজ করেন?’
হাসল মেয়েটা। ‘আরে! আসল কথাটাই বুঝি বলিনি এতক্ষণ? মিস্টার ফিস্টার কিছু নেই—অনেক আগে ছিল, এখন আমার ঝাড়া হাত-পা।’
‘দুঃখিত।’
‘সে কি! সুখের কথায় দুঃখ পাচ্ছেন? ওহ্, ভেবেছেন মরে গেছে? আরে না, মরেনি—তাকে আমি ডিভোর্স করেছি। খুব কান্নাকাটি করেছিল অবশ্য যাবার সময়…সে যাক,’ পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে ঊরুর বহুদূর পর্যন্ত দেখতে সাহায্য করল সে রানাকে। ‘আপনি ফোর্ট ফ্যারেলে কাদের হয়ে কাজ করছেন, মি. রানা?’
‘নিজের হয়ে,’ বলল রানা, ‘আমি একজন জিওলজিস্ট।’
‘ওহ্ ডিয়ার! তার মানে আপনি একজন মিস্ত্রী, টেকনিক্যাল ম্যান?’
ভাবছে রানা। ছকের মধ্যে ঠিক যেন ফেলা যাচ্ছে না মেয়েটাকে। একটা চাল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই চালের উদ্দেশ্য কি ঠিক যেন বোঝা যাচ্ছে না। দামী গাড়ি নিয়ে শহর থেকে এতটা পথ পেরিয়ে এসেছে নিজেই, নাকি কেউ পাঠিয়েছে একে?
আবার প্রশ্ন করল সে, ‘কি খুঁজছেন এদিকে? ইউরেনিয়াম?’
‘হয়তো। যা কিছু দামী সব খুঁজছি,’ হঠাৎ যেন কিছু একটা আঁচ করতে পারল রানা, কিন্তু সেটা যে কি তা ঠিক পরিষ্কার বুঝতে পারল না। ভাবল, এত থাকতে ইউরেনিয়ামের কথা জানতে চাইছে কেন? কে ঢুকিয়েছে প্রশ্নটা ওর মাথায় ?
‘যতদূর জানি, এদিকের এক ইঞ্চি জায়গাও সার্ভে করতে বাকি নেই। শুধু শুধু পণ্ডশ্রম করছেন না তো? আমি অবশ্য এই সব টেকনিক্যাল ব্যাপার বুঝি না ভাল মত।’
‘সার্ভে হয়েছে জানি। কিন্তু নিজে তবু একবার পরীক্ষা করে দেখতে চাই।’
‘সব ব্যাপারেই কি আপনি এই রকম, নিজে পরীক্ষা করে দেখতে চান? ধরুন একটি মেয়ে সুন্দরী হিসেবে নাম কিনেছে, সে সত্যি সুন্দরী কিনা তা কি আপনি নিজে পরীক্ষা করে দেখতে চাইবেন?’
‘যদি রুচিতে ধরে, হয়তো চাইব।’
‘সুন্দর উত্তর!’ হাসল মেয়েটা। ‘ভাল কথা, ইতিহাসে আগ্রহ আছে?’
অপ্রস্তুত বোধ করল রানা। এরকম একটা প্রশ্নের জন্যে মোটেই তৈরি ছিল না ও। ‘ইতিহাস নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামানোর সময় হয়নি আমার। কি ধরনের ইতিহাসের কথা জানতে চাইছেন আপনি?’
পরপর কয়েক চুমুক দিয়ে গ্লাসটা খালি করে ফেলল মেয়েটা। ‘ছোট্ট শহর এই ফোর্ট ফ্যারেল, সময় কাটানোর মত কিছু নেই এখানে। তাই ভাবছি ফোর্ট ফ্যারেলের হিস্টোরিক্যাল সোসাইটিতে যোগ দেব। ওটার প্রেসিডেন্ট হলেন মিসেস ইরা ফেরেট—পরিচয় আছে?’
‘নেই,’ বুঝতেই পারছে না রানা মেয়েটা মোড় ঘুরিয়ে আবার কোনদিকে নিয়ে যেতে চাইছে আলাপটাকে।
‘কি জানেন, এ ধরণের শখ একা মেটাতে নীরস লাগে,’ বলল মেয়েটা, ‘কেউ যদি সঙ্গে থাকে, বিশেষ করে কোন পুরুষ, তাহলে উৎসাহ পাওয়া যায়।’
‘আপনি হিস্টোরিক্যাল সোসাইটিতে নাম লেখাতে বলছেন আমাকে?’
‘শুনেছি ফোর্ট ফ্যারেলের ইতিহাস নাকি ভীষণ ইন্টারেস্টিং। হাডসন ক্লিফোর্ডের নাকি প্রচুর দান আছে এই শহরটাকে গড়ে তোলার ব্যাপারে।’
‘তাই নাকি?’ ঠাণ্ডা গলায় বলল রানা।
‘ক্লিফোর্ডদের ব্যাপারটা সত্যি খুব দুঃখজনক। খুব বেশি দিন হয়নি, গোটা পরিবার দুনিয়ার বুক থেকে মুছে গেল। এসব ব্যাপার নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে, মি. রানা?’
‘গোটা পরিবার? বোধ হয় ভুল করছেন আপনি। আমার জানা মতে মিস ক্লিফোর্ড নামে একজন বেঁচে আছেন আজও।’
‘আছে,’ সংক্ষেপে বলল মেয়েটা, ‘কিন্তু শুনেছি সে নাকি খাঁটি ক্লিফোর্ড নয়, মানে, রক্তের কোন সম্পর্ক নেই।’
‘ক্লিফোর্ডদের চিনতেন বুঝি?’
‘তা চিনতাম। মি. হাডসন ক্লিফোর্ডকে ভালভাবেই চিনতাম।’
সিদ্ধান্ত নিল রানা, মেয়েটাকে নিরাশ করতে হবে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ও! ‘আমি দুঃখিত, মিসেস স্টুয়ার্ড। আমি একজন নীরস মিস্ত্রী, ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় আমার নেই,’ হাসল রানা। ‘আসলে, কখন কোথায় থাকি তারই নেই, ঠিক-ঠিকানা, এসব ব্যাপারে মাথা ঘামিয়ে লাভই বা কি? আমি যাযাবর টাইপের মানুষ, ফোর্ট ফ্যারেলে আজ আছি, কাল হয়তো অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাব। বুঝতেই পারছেন।’
এমন ভাবে তাকিয়ে আছে মেয়েটা, ঠিক যেন বুঝতে পারছে না সে রানাকে। ‘তার মানে ফোর্ট ফ্যারেলে বেশি দিন থাকছেন না?’
‘মাটি খুঁড়ে কি পাই না পাই তার ওপর নির্ভর করছে ক’দিন থাকব।’
‘তার মানে আপনি হিস্টোরিক্যাল সোসাইটিতে নাম লেখাচ্ছেন না? আপনি লেফটেন্যান্ট ফ্যারেল, হাডসন ক্লিফোর্ড এবং এই শহরটা যারা গড়েছে তাদের ব্যাপারে কৌতূহলী নন?’
‘কৌতূহলী হয়ে আমার লাভ কি?’
উঠে দাঁড়াল মেয়েটা, ‘তা ঠিক। আপনার কথা বুঝতে পেরেছি আমি। ভুল হয়ে গেছে আপনাকে প্রস্তাব দিয়ে বিরক্ত করতে এসে। তবু, আপনাকে আমার খুব ভাল লেগেছে, এ কথা স্বীকার করছি আমি। যখনই কোন সাহায্যের দরকার হবে, আমাকে জানাবেন, কেমন?’
‘কোথায় পাব আপনার দেখা?’
‘কেন, হোটেলের ডেস্ক ক্লার্ককে জিজ্ঞেস করলেই সে বলে দেবে।’
‘কোন হোটেলে?’
‘ফোর্ট ফ্যারেলে ভাল হোটেল তো একমাত্র পারকিনসনদেরই আছে।’
‘ধন্যবাদ,’ বলল রানা, ‘দরকার হলে অবশ্যই সাহায্যের জন্যে হাত পাতব আপনার কাছে। এখন তাহলে আপনি যাচ্ছেন?’ একটা চেয়ারের উপর রাখা ফার কোটটা তুলে নিল রানা। মেয়েটা পিছন ফিরে দাঁড়াতে সেটা তার গায়ে জড়িয়ে নিতে সাহায্য করল। ঠিক তখনই এনভেলাপটা নজরে পড়ল ওর আলমারির মাথায়।
মেয়েটাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল রানা। এনভেলাপের উপর ওর নাম লেখা রয়েছে দেখে সেটা তুলে নিয়ে খুলল। ভিতর লংফেলোর লেখা একটা চিরকুট। লংফেলো লিখেছে; এই চিঠি পাওয়া মাত্র আমার অ্যাপার্টমেন্টে চলে এসো। লংফেলো।
‘কাদা থেকে গাড়িটাকে ওঠাতে বেশ হাঙ্গামা পোহাতে হবে আপনাকে, মিসেস স্টুয়ার্ড। আপনি চাইলে আমার ল্যাওরোভার দিয়ে ওটাকে ধাক্কা দিতে পারি।’
হাসল মেয়েটা। ‘সব ব্যাপারে আপনিই দেখছি আমার কাজে লাগছেন!’ হঠাৎ যেন কি এক আনন্দে দুলে উঠল সে, বেসামাল পদক্ষেপে রানার বুকের সামনে চলে, এসে গায়ে গা ঠেকাল মুহূর্তের জন্যে।
নিঃশব্দে হাসল রানা। আপনি আমার পড়শী, মিসেস স্টুয়ার্ড। আপনার সুবিধে অসুবিধে আমি দেখব না তো দেখবে কে?
***
নিচে থেকেই দেখল রানা লংফেলোর অ্যাপার্টমেন্টে আলো জ্বলছে। সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে দরজার সামনে দাঁড়াল ও। নক করতেই খুলে গেল কবাট দুটো। রানাকে চমকে উঠতে দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল শীলা ক্লিফোর্ড। ‘খুব অবাক হয়েছ, না?’
নিজেকে সামলে নিয়ে একটু গম্ভীর হলো রানা। শীলাকে পাশ কাটিয়ে লংফেলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। রানার দিকে এখন পর্যন্ত তাকায়নি সে। আলমারি ওয়ারড্রোব থেকে কাপড়চোপড় নামিয়ে মেঝের উপর গাদা করছে। ‘কি ব্যাপার, লংফেলো?’
তাকালই না বুড়ো। ‘আগে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়াটা সেরে নাও তোমরা। তারপর অন্য কথা।’
রানার পাশে দাঁড়াল শীলা। ‘আমি দুঃখিত, রানা,’ বলল সে, ‘ফেলো কাকা আমাকে বলেছে, তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম আমি।’
‘ব্যাপারটা সম্ভবত ঠিক তা নয়,’ মৃদু হেসে বলল, রানা, ‘ভুল তুমি আসলে নিজেকেই বুঝেছিলে। কেউ নিজের স্বার্থ এভাবে পায়ে ঠেলে চলে যায়?’
‘আমার রাগ হবার কারণ ছিল জানোই তো, ক্লিফোর্ড পরিবারের মেয়ে আমি; পরিবারের সুনামটুকু আমার কাছে মূল্যবান। যখন শুনলাম ..’
‘বিগ প্যাট, বলল রানা। চড়ের প্রতিশোধ নিয়েছে সে।’
হাসল শীলা। ‘তুমি আমার ওপর রাগ করে নেই তো?’
‘আরে না!’
আরও কিছু বলত রানা, কিন্তু খুক করে কেশে উঠে লংফেলো বলল, ‘এক্সকিউজ মি, তোমরা যদি ভাল মনে করো তাহলে আমি কিছুক্ষণের জন্যে চৌকির তলায় গা ঢাকা দিতে পারি।’ পকেট হাতড়াতে শুরু করল বুড়ো। ‘কানে দেবার জন্যে খানিকটা তুলাও রেখে দিয়েছি।’
শীলা হেসে উঠল। সে হাসিতে যোগ না দিয়ে রানা আঙুল দিয়ে মেঝে দেখাল, ‘এসব কি হচ্ছে?’
‘তোমার সাথে যোগ দিয়ে আমি যে গর্হিত ভূমিকা নিয়েছি তার নিন্দা করা হয়েছে’ সহাস্যে বলল লংফেলো। ‘আমাদের কার্যনির্বাহী সম্পাদক কার্ল ডেটজার সবিনয়ে আমাকে জানিয়ে দিয়েছে, আমার চাকরিটা নেই এবং তাই বিনা ভাড়ায় এই অ্যাপার্টমেন্ট থেকেও ভালয় ভালয় কেটে পড়তে হবে। ভাল কথা, নাতি, তোমার ল্যাণ্ডরোভারে তুলতে হবে এই সব জিনিসপত্র।’
‘ঠিক আছে,’ বলল রানা। লংফেলো, ‘আমি দুঃখিত। চাকরিটা তুমি আমার জন্যই হারালে।’
‘আরে দূর! এ আবার একটা চাকরি নাকি? আমি অন্যরকম মজা পাচ্ছি এই ভেবে যে গাফকে মস্ত এক ঠ্যালা মেরেছ তুমি, তা নাহলে সে এমন খেপে উঠত না।’
শীলার দিকে ফিরল রানা। ‘হঠাৎ ফিরলে কি মনে করে? তোমাকে আমি চিঠি লিখব ভাবছিলাম।’
‘তুমি একটা গল্প বলেছিলে আমাকে,’ লংফেলোর দিকে একবার তাকাল শীলা। ‘মনে আছে?’
‘কি গল্প?’ ভুরু কুঁচকে উঠল রানার।
‘দশজন না কয়জন বন্ধুকে চিঠি লিখেছিল এক প্র্যাকটিক্যাল জোকার—সব ফাঁস হয়ে গেছে, পালাও!’
‘হ্যাঁ।’
‘সেই রকম একটা চিঠি লিখেছে ফেলো কাকা আমাকে। তাতে লিখেছেঃ সব উল্টেপাল্টে যাচ্ছে, দেখতে চাইলে দেরি কোরো না!’
হেসে উঠল রানা।
শীলা হাত নেড়ে একটা চেয়ার দেখাল, ‘বসো রানা। তোমার সাথে জরুরী কিছু আলাপ আছে আমার।’
চেয়ার টেনে বসল রানা।
লংফেলো বলল, ‘নাতি, শীলাকে আমি সব কথা বলে দিয়েছি।’
‘সব?’
‘হ্যাঁ। সব কথা ওর জানা দরকার। তুমি যে ক্লিফোর্ডদের মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড বলে মনে করো এটা ওর কাছে লুকিয়ে রাখার কোন মানে হয় না। কেনেথ খুন হয়েছে একথাও ওকে আমি বলেছি।’
শীলা বলল, ‘সব জানার পর আমি ঠিক করেছি সবরকম সাহায্য করব তোমাকে আমি, রানা। আচ্ছা, চিঠি লিখবে ভাবছিলে কেন আমাকে?’
‘কাইনোক্সি উপত্যকা ডুবে গেলে কত টাকার গাছ হারাচ্ছ তুমি ভেবে দেখেছ?’
‘কত আর হবে?’
‘পঞ্চাশ লক্ষ ডলার কি খুব কম টাকা, শীলা?’
‘কি! পঞ্চাশ লক্ষ ডলার! অসম্ভব!’
‘অসম্ভব নয়। ডিকসনের হিসেব এটা। আমিও এটাকে নির্ভুল বলে মনে করি।’
‘বলো কি! তার মানে…শয়তানের বাচ্চা!’
চোখ বড় বড় করল রানা, ‘কাকে বলছ?’
‘নাথানকে। সে আমাকে দু‘লাখ ডলার দিতে চেয়েছিল সব গাছ কেটে নেবার বিনিময়ে।’
‘তার মানে?’
‘বলেছিলাম, এ ব্যাপারে এখন আমি মাথা ঘামাতে চাইছি না। তুমি পরে এসো। কিন্তু তারপর তো চলেই গেলাম।’
‘ফিরে এসেছ জানলেই ছুটে আসবে ওরা আবার,’ বলল রানা, ‘আচ্ছা, মিসেস স্টুয়ার্ড কে?’
লংফেলো এবং শীলা দু‘জনই চমকে উঠে একযোগে জানতে চাইল, ‘মিসেস স্টুয়ার্ড?’
মাথা নাড়ল রানা।
‘কোথায় দেখা হলো তোমার সাথে তার?’ জানতে চাইল লংফেলো।
‘তোমার কেবিনে।’
‘মাই গড! অনুমান নয়, সত্যি ভয় পেয়েছে তাহলে গাফ!’
‘মানে?’
‘মিসেস স্টুয়ার্ড ওরফে পুসি হলো বয়েডের বোন, গাফের মেয়ে, আরেক পারকিনসন।’
মুচকি হাসল রানা। ‘এরকম কিছু একটা হবে বলে আমিও ভেবেছিলাম।’ সংক্ষেপে ওর সাথে কি আলাপ হয়েছে জানাল রানা। ‘গাফ ওকে পাঠিয়েছিলেন ভাবতে যেন কেমন লাগছে।’
‘এ থেকেই প্রমাণ হয়, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়,’ বলল লংফেলো।
শীলা বলল, ‘পুসি সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা দরকার তোমার, রানা।’
হাসিটা দমন করে মুখে আগ্রহ ফুটিয়ে তুলল রানা।
‘স্টুয়ার্ড ছিল ওর তিন নম্বর স্বামী,’ শীলা গম্ভীর। ‘মাত্র ছয় মাস আগে তাকে মারধোর করে তাড়িয়ে দিয়েছে ফোর্ট ফ্যারেল থেকে। নিউইয়র্ক, মায়ামি, লাস ভেগাস এই ধরনের জায়গায় জুয়া খেলে, মদ খেয়ে, আর নষ্টামি করে বছরের নয়টি মাস কাটায় সে।’
‘পুরুষ মানুষ দেখলে জিভে নাকি পানি আসে ওর, শুনেছি,’ বলল লংফেলো।
‘সুতরাং, আমাকে সাবধান থাকতে হবে—এই তো?’
‘ঠাট্টা নয়, রানা।’
‘না, ঠাট্টা নয়,’ রানা গম্ভীর, ‘ওর গাড়িটা কাদা থেকে তোলার সময় আর একটু হলেই আমাকে ও রেপ করত।’
‘বলো কি?’
আর একটা হাসি দমন করল রানা। বলল, ‘বাদ দাও তার কথা। লংফেলো, চলো মালপত্তরগুলো গাড়িতে তুলে ফেলা যাক।’
‘শীলা?’
ইতস্তত করতে লাগল শীলা লংফেলোর দিকে তাকিয়ে।
‘আমার কেবিনে চলো। রানার বিছানাটা তুমি ব্যবহার করো। নাতি আমার না হয় রাতটা বাইরেই কাটিয়ে দেবে নেকড়েদের সাথে গল্প করে।’
‘শীলা বোধহয় এতটা যেনে নিতে পারবে না,’ বলল রানা, ‘এমনিতেই বদনাম রটেছে আমাকে নিয়ে…।’
পিছিয়ে গিয়ে দুম করে একটা ঘুসি মেরে বসল শীলা রানার পিঠে। ‘ফের যদি ও-কথা তুলে আমাকে রাগাবার চেষ্টা করো তাহলে কিন্তু ভাল হবে না বলে দিচ্ছি! কি ভেবেছ আমাকে! বদনামকে ভয় পাই?’
‘সত্যি পাও না?’ ফিসফিস করে বলল রানা, ‘শুনে সুখী হলাম। বদনামের কাজকে ভয় পাও?’
আবার কিল তুলল শীলা। মুখে হাসি।