দশ
নতুন একটা রাস্তা তৈরি করেছে ওরা কাইনোক্সি উপত্যকা পর্যন্ত। বাঁধের জন্যে সরঞ্জাম নিয়ে মিছিল চলেছে ট্রাকের। ফেরার পথে কাটা গাছ নিয়ে আসছে। সদ্য ইঁট বিছানো হলেও, ট্রাকের অনবরত ভার সহ্য করতে না পেরে চাঁদের পিঠের মত উঁচু-নিচু খানাখন্দে ভর্তি হয়ে গেছে রাস্তাটা। যানবাহনের ভিড় বলেই সম্ভবত, ভাবছে রানা, কেউ লক্ষ করছে না এখনও ওকে।
রাস্তাটা নিচু এসকার্পমেন্ট পর্যন্ত নেমে গেছে, যেখানে পারকিনসনরা জেনারেটর হাউজ তৈরি করছে। বিশাল কর্দম-সাগরে প্রকাণ্ড একটা ইঁট আর বালির তৈরি কাঠামো মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ইতিমধ্যে। শ’তিনেক শ্রমিক, কর্দমাক্ত চেহারা দেখে নির্দিষ্টভাবে কাউকে চেনার উপায় নেই, গাধার মত খাটছে আর ঘামছে। এসকার্পমেন্টের উপর, ঝর্ণাটার পাশে ছত্রিশ ইঞ্চি পাইপ বসানো হয়েছে একটা, পাওয়ার হাউজে পানি সরবরাহ করার জন্যে। ঝর্ণার অপর দিকে ঘুরে গেছে রাস্তাটা, পাহাড়টাকে পেঁচিয়ে নিয়ে উঠে গেছে উপরে, বাঁধের দিকে।
কাজের অগ্রগতি দেখে অবাক হলো রানা। লংফেলোর ধারণার মধ্যে ভুল ছিল, বুঝতে পারল ও। তিন মাস নয়, মাস দেড়েকের মধ্যেই কাইনোক্সি উপত্যকা পানির নিচে ডুবে যাবে। রাস্তা থেকে একটু সরে গিয়ে একজায়গায় গাড়ি থামাল ও। প্রায় পঞ্চাশটা মেশিনে কংক্রিট মিকচার করা হচ্ছে। পাথর আর বালির পাহাড় জমে উঠেছে সমতল জায়গা জুড়ে। আয়োজনটা ব্যাপক।
খেপা ষাঁড়ের মত তীরবেগে নেমে গেল রাস্তা দিয়ে একটা কাঠ ভর্তি ট্রাক। পাশ ঘেঁষে যাবার সময় বাতাস লেগে দুলে উঠল রানার ল্যান্ডরোভার। দ্বিতীয় ট্রাকটা আসতে এখনও দেরি আছে ধরে নিয়ে রাস্তায় উঠল আবারও গাড়ি নিয়ে। বাঁধটাকে ছাড়িয়ে উপত্যকার ভিতর পৌঁছুল। রাস্তা ছেড়ে খানিকদূর এগিয়ে গাছের আড়ালে থামাল গাড়িটাকে, যাতে কারও চোখে না পড়ে।
পায়ে হেঁটে পাহাড়ের গা ঘেঁষে অনেকটা উঁচুতে উঠে গেল রানা। যেখানে থামল সেখান থেকে উপত্যকাটা পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায়।
চারদিকে ধ্বংসের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছে রানা। বিশাল উপত্যকার উপর সবুজের যে সমারোহ ছিল তার ছিটেফোঁটা যাও বা অবশিষ্ট আছে, তাও নিশ্চিহ্ন করার জন্যে পুরোদমে কাজ চলছে। এই উপত্যকার ঝর্ণার পানিতে মাছ লাফিয়ে উঠতে দেখেছে রানা, পাতার ফাঁক দিয়ে ছুটে যেতে দেখেছে চঞ্চল হরিণগুলোকে। সব শেষ। উপত্যকার বেশির ভাগটাই এখন ন্যাড়া। চাকার দাগ আর বিচ্ছিন্ন গাছের ডালপালা ছাড়া কিছু নেই। কোথাও কোথাও এখনও গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে বটে কিছু গাছ, কিন্তু এত দূরেও ভেসে আসছে পাওয়ার-স-এর জ্যান্ত সবুজ খেয়ে ফেলার যান্ত্রিক কর্কশ আওয়াজ।
উপত্যকার দূর প্রান্ত পর্যন্ত দেখে নিয়ে দ্রুত একটা হিসেব করল রানা। নতুন পারকিনসন লেকটার আকার হবে বিশ বর্গমাইল। এর মধ্যে উত্তরের পাঁচ বর্গমাইল জায়গা শীলা ক্লিফোর্ডের, তার মানে পারকিনসনরা নিরেট পনেরো বর্গমাইলের সমস্ত গাছ কেটে নিচ্ছে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট বাঁধের খাতিরে অনুমতি দিয়েছে তাদের। এই গাছ থেকে যে টাকা পাবে তারা, বাঁধের খরচ উঠেও অনেক বাঁচবে। তার মানে, মাছের তেলে মাছ ভাজছে তারা।
ল্যান্ডরোভার নিয়ে রাস্তায় উঠল রানা, বাঁধ পেরিয়ে এসকার্পমেন্টের দিকে অর্ধেকটা দূরত্বে নামল। আবার রাস্তা থেকে সরে এসে গাড়ি থামাল ও। কিন্তু এবার আর সেটাকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করল না। চোখে পড়তে চাইছে এখন সে।
গাড়ির পিছন থেকে কিছু যন্ত্রপাতি বের করল রানা। রাস্তা থেকে ওকে পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায় এমন একটা জায়গা বেছে নিল। তারপর সন্দেহজনক আচরণ করতে শুরু করে দিল।
হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মেরে পাথর খসাচ্ছে রানা। খানিক পর মাটিতে গর্ত করতে শুরু করল। তারপর ভাঙা পাথরগুলোকে কাছে টেনে নিয়ে এসে জড় করল, এক জায়গায়। একটা একটা করে তুলে পরীক্ষা করতে লাগল গভীর আগ্রহের সাথে ম্যাগনিফায়িং-গ্লাসের সাহায্যে। সবশেষে হাতে ধরা একটা যন্ত্রের ডায়ালে চোখ রেখে বিরাট একটা এলাকা জুড়ে হেঁটে বেড়াতে লাগল, যেন জায়গাটার প্রাকৃতিক বিশেষত্ব পরীক্ষা করছে ও।
কারও চোখে পড়তে আধঘণ্টার উপর লেগে গেল ওর। ঝড়ের বেগে উঠছিল একটা জীপ, ওকে দেখে ব্রেক কষল ড্রাইভার। নাক ঘুরিয়ে রাস্তা থেকে নেমে এল জীপটা। রানার কাছ থেকে গজ পনেরো দূরে থামল। চোখের কোণ দিয়ে দেখল রানা, দু’জন লোক নামছে। হাতঘড়িটা খুলে মুঠোর ভিতর পুরল ও। তারপর নিচু হলো বড় একটা পাথর কুড়িয়ে নেবার জন্যে।
দু’জোড়া বুট এগিয়ে এল। থামল রানার সামনে।
তাকাল রানা। মুখটা হাসি হাসি।
দু’জনের মধ্যে আকারে বড় লোকটা বলল, ‘কি করছ তুমি এখানে?’
‘প্রসপেকটিং,’ মৃদু কণ্ঠে বলল রানা।
‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি! কিন্তু জানা নেই এটা প্রাইভেট ল্যান্ড?’
‘ঠিক তার উল্টোটা জানি,’ শান্তভাবে বলল রানা।
‘ওটা কি?’ দ্বিতীয় লোকটার প্রশ্ন।
‘এটা? এটা একটা গেইজার কাউন্টার।’ যন্ত্রটাকে হাতে ধরা পাথরটার কাছে খানিকটা সরিয়ে নিয়ে গেল রানা। একই সাথে ওর হাতঘড়ির অত্যন্ত কাছাকাছি পৌঁছুল জিনিসটা। মাকড়সার জালে বন্দী মশার মত আওয়াজ বেরুতে শুরু করল যন্ত্রের ভেতর থেকে। ‘দারুণ ইন্টারেস্টিং তো!’
‘কি বোঝাচ্ছে ব্যাপারটা?’ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে জানতে চাইল লম্বা-চওড়া।
‘হয়তো ইউরেনিয়াম,’ বলল রানা। ‘কিন্তু আমার সন্দেহ আছে। থোরিয়াম হওয়াও বিচিত্র নয়।’ পাথরটাকে চোখের সামনে তুলে গভীর মনোযোগের সাথে উল্টেপাল্টে দেখছে রানা। দেখতে দেখতে কি মনে করে দূরে সেটাকে ফেলে দিল ছুঁড়ে। ‘ওটার মধ্যে কিছু নেই, কিন্তু লক্ষণটা অগ্রাহ্য করার মত নয়। যতদূর বুঝতে পারছি, এই এলাকার জিওলজিক্যাল স্ট্রাকচার খুবই অদ্ভুত।’
পরস্পরের দিকে তাকাল ওরা। বেশ একটু হতভম্ব দেখাচ্ছে দু’জনকেই। জোরালটা বলল, ‘তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু এখানে কোন অধিকারে এসেছ তুমি? এটা তো প্রাইভেট ল্যান্ড।’
নিরুদ্বিগ্ন ভাব রানার চোখমুখে। সহজ গলায় বলল, ‘এখানে আমার কাজে কেউ বাধা দিতে পারে না।’
‘পারে না বুঝি?’ কণ্ঠস্বরটা ব্যঙ্গাত্মক।
‘তোমাদের ওপরআলাকে জিজ্ঞেস করে দেখলেই তো পারো। তাতে হয়তো গণ্ডগোল বাধার কোন কারণ ঘটে না।’
খাটো লোকটাকে দ্বিতীয়বার মুখ খুলতে শুনল রানা। ‘তাই চলো, জিমি, বিগ প্যাটকে গিয়ে সব কথা বরং বলি। ইউরেনিয়াম, তারপর আরেকটার কথা কি যেন বলছে—মোটকথা, এর মধ্যে গুরুত্ব থাকতেও পারে।’
ইতস্তত করছে বড়টা। ক’সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর ভারি গলায় বলল, ‘নাম-টাম কিছু আছে তোমার, মিস্টার?’
‘রানা। মাসুদ রানা,’ বলল রানা। পাঁচ সেকেন্ড পর বলল, ‘আমি ক্লিফোর্ডের শেষ ভরসা।’
‘কি!’
‘ও কিছু না,’ বলল রানা, ‘যাও বসকে গিয়ে আমার নামটা বলো। তাতেই ফল হবে।’
ইতস্তত ভাবটা এখন আর নেই লোকটার মধ্যে। অবাক হয়ে গেছে সে। ‘ঠিক আছে, আমরা যাচ্ছি বসের সাথে কথা বলতে। বড়জোর বিশ মিনিট আছ তুমি এখানে, পাছায় লাথি মেরে তাড়াবে তোমাকে বিগ প্যাট।’
গাড়ির দিকে ফিরে যাচ্ছে লোক দু’জন। পিছন থেকে রানা বলল, ‘তোমাদের বসকে একা আবার পাঠিয়ো না যেন।’
রানার কাছে ফিরে আসার জন্যে ঘুরে দাঁড়াতে যাচ্ছিল বড়টা, কিন্তু তাকে ধরে ফেলে বাধা দিল খাটো। ওদের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসছে রানা।
জীপটা অদৃশ্য হয়ে যেতে একটা পাথরের ওপর বসে সিগারেট ধরাল রানা। ভাবছে। লংফেলো বলেছিল, কুলিমজুরদের সর্দারের চাকরি পেয়েছে বিগ প্যাট, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে তা নয়, ইতিমধ্যে পদোন্নতি ঘটে বস্ হয়ে গেছে সে। একটা হিসাব মেলানো বাকি আছে তার সাথে ওর, ভাবল রানা। মুখ তুলে তাকাল ও রাস্তা বরাবর এগিয়ে যাওয়া টেলিফোন লাইনের দিকে। বিগ প্যাট লোক দু’জনের কাছ থেকে খবর শুনে টেলিফোনে ফোর্ট ফ্যারেলের সঙ্গে যোগাযোগ করবে, সন্দেহ নেই, এবং টেলিফোন পেয়ে বেলুনের মত ফুলে উঠবে বয়েড পারকিনসন।
ইঞ্জিনের আওয়াজ পেয়ে হাতঘড়ি দেখল রানা। লোক দু’জন গেছে মাত্র বারো মিনিট হয়েছে। মুখ তুলতে দেখল একটার পিছনে আর একটা জীপ থামছে ওর ল্যান্ডরোভারটার পাশে।
সকলের আগে নামল বিগ প্যাট। দূর থেকে রানাকে দেখেই নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে উপর নিচে মাথা দোলাল সে। এগিয়ে আসতে শুরু করে শয়তানি মাখা হাসিতে ভরিয়ে তুলল মুখটা। ‘নাম শুনেই বুঝেছি, আর কোন হারামজাদা হতেই পারে না। ভাগো, রানা—মি. পারকিনসন বলেছেন, তাঁর এলাকায় কেউ যেন তোমার মুখ দেখতে না পায়।’ রানার সামনে দাঁড়াল সে দু’পা ফাঁক করে। বডিগার্ডের মত তার দু’পাশে দাঁড়াল বড় এবং খাটো।
‘কোন্ পারকিনসন?’
‘মি. বয়েড পারকিনসন।’
‘তাকে নতুন আর কি গল্প শুনিয়েছ, প্যাট?’ শান্তভাবে জানতে চাইল রানা।
মুঠো পাকাল বিগ প্যাট। ‘বেগড়বাঁই করলে গলার ভিতর হাত ঢুকিয়ে কলজে ছিঁড়ে আনব, রানা। মি. পারকিনসন চান তোমাকে যেন কেটে পড়ার একটা সুযোগ দেয়া হয়। ফোনটা করেই ভুল করেছি আমি। তুমি এখান থেকে যাবে কিনা তাই শুনতে চাই।’
‘এখানে থাকার আইনসঙ্গত অধিকার আছে আমার,’ বলল রানা। ‘এ প্রসঙ্গে বয়েড কিছু বলেনি?’
‘না,’ পকেটে হাত ঢোকাল বিগ প্যাট, ‘পারকিনসনদের ছাড়া কারও কোন অধিকার খাটে না ফোর্ট ফ্যারেলে। শেষ বার জানতে চাই, ভালয় ভালয় যাচ্ছ কিনা?’
দ্রুত চিন্তা করছে রানা। ও একা, ওরা তিনজন…তবে সেটা তেমন কিছু নয়, হয়তো পারবে ও। কিন্তু প্যাট প্যান্টের পকেট থেকে খালি হাত বের করবে বলে মনে হচ্ছে না। তাছাড়া, ওদের সাথে মারপিট করে এই মুহূর্তে তেমন কোন লাভও নেই।
‘ওহে!’ রানাকে চুপ করে থাকতে দেখে চেঁচিয়ে উঠল সঙ্গীদের উদ্দেশে বিগ প্যাট, ‘পা দুটো ভেঙে দিয়ে ওর দাঁড়িয়ে থাকার অধিকারটা বিগড়ে দাও তো!’
‘দাড়াও,’ বলল রানা, ‘আমার পা ভাঙতে এসে তোমরা নিজেদের ক্ষতি করো তা আমি চাই না। এখানের কাজ আপাতত শেষ হয়েছে আমার, আমি চলে যাচ্ছি।’
‘এই তোমার সাহস? কেউ রুখে দাঁড়ালে লেজ গুটিয়ে পালাতে চাও?’ হোঃ হোঃ করে হাসতে শুরু করল বিগ প্যাট, মাথাটা হেলে পড়ল তার পিছন দিকে।
‘পকেটে পিস্তল নিয়ে অমন রুখে দাঁড়াতে অনেক কাপুরুষকেই দেখেছি আমি।’
কথাটা যে ভাল লাগেনি বিগ প্যাটের তা তার মুখ কালো হয়ে যেতে দেখেই বুঝতে পারল রানা। ভাবল, পিস্তলটা বুঝি পকেট থেকে বের করে ফেলবে। কিন্তু তা সে করল না।
পাঁচ সেকেন্ড পর মৃদু হাসল রানা। নিচু হয়ে ব্যাগটা তুলে কাঁধে ঝুলিয়ে নিল। তারপর ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে উঠল ল্যান্ডরোভারে। জানালা দিয়ে তাকাতে দেখল জীপে উঠে ইতিমধ্যে স্টার্ট দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে সেটা বিগ প্যাট।
পাহাড় বেয়ে নামছে জীপটা। সেটাকে অনুসরণ করল রানার ল্যান্ডরোভার। ঠিক পিছনেই রয়েছে দ্বিতীয় জীপটা। দেখে মনে হচ্ছে, ভাবছে রানা, পালিয়ে যাবার কোন সুযোগ দিতে চাইছে না তারা ওকে।
এসকার্পমেন্টের নিচে নেমে জীপের গতি কমাল বিগ প্যাট, হাত দেখিয়ে থামতে ইঙ্গিত করল রানাকে। তারপর জীপটাকে পিছিয়ে নিয়ে এসে ল্যান্ডরোভারের পাশে দাঁড় করাল সে। ‘এখানে অপেক্ষা করো, রানা। কোনরকম চালাকির চেষ্টা করো না।’ কথাটা বলে তীরের মত জীপ ছুটিয়ে দিল সে, হাত নেড়ে একটা ট্রাককে থামাল, ট্রাকটার পাশে গিয়ে জীপ থেকে নামল লাফ দিয়ে। প্রায় মিনিট দুই কথা বলল সে ড্রাইভারের সাথে। তারপর ফিরে এল আবার। ‘ঠিক আছে, রানা। এবার তুমি কেটে পড়তে পারো। সাবধান, দ্বিতীয়বার যেন তোমাকে আর এদিকে না দেখি। অবশ্য দেখতে পেলে খুশিই হব আমি।’
‘কোন সন্দেহ নেই,’ বলল রানা, ‘দেখা আবার করব আমি।’ স্টার্ট দিয়ে ল্যান্ডরোভার ছুটিয়ে নামতে শুরু করল ও। গাছের কাণ্ড ভর্তি ট্রাকটা এর মধ্যে রাস্তা ধরে ছুটতে শুরু করেছে। সেটাকে অনুসরণ করল রানা।
ট্রাকটার ঠিক পিছনে পৌঁছুতে খুব বেশি সময় লাগল না রানার। মন্থর গতিতে যাচ্ছে সেটা। ওভারটেক করতে যাওয়া বোকামি হয়ে যাবে, ভাবল ও। নতুন তৈরি করা রাস্তার দু’ধারে খাড়া পাহাড়ের মত উঁচু হয়ে আছে মাটি আর পাথর। পাশ কাটাতে গিয়ে বিশ টন ওজনের কাঠ আর ধাতুর চাপ খেয়ে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হবার ঝুঁকিটা নিতে সায় দিল না মন।
ট্রাকটার এমন ধীর ভঙ্গিতে হামাগুড়ি দেবার কারণ কি বুঝতে পারল না রানা। ড্রাইভার আরও মন্থর করল গতি। বাধ্য হয়ে আরও কমিয়ে আনল রানা ল্যান্ডরোভারের স্পীড। পায়ে হাঁটার মত ধীর গতি এখন গাড়ি দুটোর।
হর্ন বাজাল রানা। ফল হলো উল্টো। আরও কমে গেল ট্রাকের গতি। সময় নষ্ট হচ্ছে দেখে রাগ হলো রানার, কিন্তু কিছুই ভেবে পেল না করার মত। ড্রাইভারের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে শুরু করল ও মনে মনে। ভিউ মিররে চোখ পড়তে হঠাৎ টনক নড়ল রানার। পানির মত পরিষ্কার হয়ে গেল সামনের ট্রাকটার ধীরে চলার কারণ।
প্রচণ্ড ঝড়ের মত ছুটে আসছে পিছন থেকে আরেকটা যন্ত্রদানব। আঠারো চাকার ট্রাক, গাছের বোঝা নিয়ে বিশ-বাইশ টনের কম হবে না। ল্যান্ডরোভারের ঘাড়ে চেপে বসবে বলে মনে হলো রানার। মাত্র গজ দশেক থাকতে ব্রেকের কর্কশ আওয়াজ পেল ও। চাকাগুলো কর্দমাক্ত রাস্তায় পিছলে গেল, মুহূর্তে ল্যান্ডরোভারের এক ফুটের মধ্যে চলে এল দানবটা।
দুই ট্রাকের মাঝখানে আটকা পড়ে গেছে ল্যান্ডরোভার। ভিউ মিররে পিছনের ড্রাইভারকে দেখতে পাচ্ছে রানা। হাসছে না, কিন্তু মুখের ভাব দেখে রানার মনে হলো যে-কোন মুহূর্তে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে পারে সে। বিপদটার গুরুত্ব বুঝতে পেরে শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা একটা স্রোত উঠে এল রানার। সাবধান না হলে ট্রাক দুটোর মাঝখানে রক্ত, মাংস আর হাড়ের খিচুড়ি তৈরি হবে খানিকটা। হঠাৎ লাফিয়ে উঠে এক দিকে কাত হয়ে গেল ল্যান্ডরোভার, কর্কশ শব্দটা কানে ঢুকতে শির শির করে উঠল রানার শরীর। ট্রাকের ভারি ফেণ্ডার গুঁতো মেরেছে ল্যান্ডরোভারের পিছনে। গ্যাস পেডালে পায়ের চাপ দিয়ে গাড়িটাকে সাবধানে এগিয়ে নিয়ে গেল রানা। সামনের ট্রাকের কাছ থেকে দূরত্বটা কমছে এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে। কিন্তু চাইলেও বেশি দূর এগোনো সম্ভব নয় ওর পক্ষে। এগোতে গেলেই উইন্ডস্ক্রীন ভেঙে ল্যান্ডরোভারের ভিতর ঢুকে পড়বে ত্রিশ ইঞ্চি মোটা একটা গাছের কাণ্ড। ট্রাকের পিছন থেকে রানার দিকে অঙুলি নির্দেশ করছে যেন সেটা।
যতদূর মনে করতে পারল রানা, রাস্তার দু’পাশে এই পাথর আর মাটির খাড়া প্রাচীর প্রায় মাইলখানেক লম্বা। সিকি মাইল পেরিয়েছে মাত্র এর মধ্যে। বাকি পৌনে এক মাইল অত্যন্ত সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে পেরোতে হবে—অবশ্য যদি আদৌ পেরোনো যায়।
হঠাৎ পিছনের ট্রাকটা তার হর্ন বাজাতে শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গে সামনের ট্রাকটা গতি বাড়িয়ে দিয়ে ল্যান্ডরোভারের সামনে একটা ফাঁক তৈরি করল। গ্যাস পেডালে চাপ বাড়াতে যাবে রানা, এই সময় আবার গুঁতো মারল পিছনের ট্রাকটা। এবারের ধাক্কাটা আগের চেয়ে জোরাল। সামনের চাকা দুটোর উপর ভর দিয়ে ল্যান্ডরোভারটা প্রায় এক ফুটের মত শূন্যে উঠে পড়ল।
যা ভেবেছিল তার চেয়ে এখন জটিল লাগছে ব্যাপারটা রানার। ড্রাইভারদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার টের পেল ও। ল্যান্ডরোভারকে মাঝখানে নিয়ে ফুলস্পীডে ছুটবে ওরা গন্তব্যস্থানের দিকে। হঠাৎ কোন্ দিক থেকে কি বিপদ ঘটে যাবে এক সেকেন্ড আগেও তা বোঝার উপায় নেই কারও।
সামনের রাস্তাটা ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে অনেক দূর পর্যন্ত। নাক নিচু করে ছুটছে ল্যান্ডরোভার। স্পীড মিটারের কাঁটা চল্লিশের দাগ পেরিয়ে যাচ্ছে। পিছনের ট্রাকটার অস্তিত্ব ভুলে থাকতে চাইছে রানা। কিন্তু পারছে না। ভিউ মিররে না তাকিয়েও বুঝতে পারছে, মাত্র হাত তিনেক পিছনে রয়েছে সেটা। সামনের ট্রাকটাকে ধরতে চাইছে যেন, মাঝখানে যে আরও একটা গাড়ি রয়েছে সে-ব্যাপারে তার কোন মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না।
হাতের তালু দুটো ঘামে পিচ্ছিল হয়ে উঠেছে। হুইল, গ্যাস পেডাল, ক্লাচ আর ব্রেক সামলাতে গলদঘর্ম হচ্ছে রানা। ভুল যারই হোক—ওর বা ওদের—ল্যান্ডরোভার বাতিল লোহার জঞ্জালে পরিণত হবে এক নিমেষে। ঘটনাটা ঘটার পর নিজের কি অবস্থা হবে ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠল রানা।
আরও তিনবার পিছন থেকে ধাক্কা খেল ল্যান্ডরোভার। একবার সামনে-পিছনে দু’দিক থেকে চাপ খেল। দুটো ট্রাকের ভারি ইস্পাতের তৈরি ফেণ্ডারের মাঝখানে ধরা পড়ল গাড়িটা। এক সেকেন্ডের দশ ভাগের এক ভাগ সময়ের জন্যে স্থায়ী হলো ব্যাপারটা। অনুভব করতে পারছে রানা প্রচণ্ড চাপ খেয়ে সঙ্কুচিত হয়ে গেল চেসিস। মাটি থেকে শূন্যে উঠে গেল গাড়িটা মুহূর্তের জন্যে। উইন্ডস্ক্রীনে একটা গাছের কাণ্ড ঘষা খাচ্ছে, ফেটে গিয়ে অসংখ্য কাটাকুটি দাগে ভরে গেল কাচটা, তারপর গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ভেঙে পড়তে শুরু করল। কয়েক সেকেন্ড সামনের কিছুই দেখতে পেল না রানা।
হঠাৎ যেন দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠল রানা। একটু আগে কি ঘটতে যাচ্ছিল ভেবে ঢোক গিলল ও। পিছিয়ে গেছে পিছনের ট্রাকটা। হাত দশেকের একটা ব্যবধান দেখতে পাচ্ছে রানা। লক্ষ করল, রাস্তার দু’পাশে পাথর আর মাটির প্রাচীর শেষ হয়ে গেছে। সামনের ট্রাকের বাঁ দিকের একটা গাছের কাণ্ডকে অন্যগুলোর চেয়ে বেশ খানিকটা উপরে তোলা হয়েছে, দেখতে পাচ্ছে রানা। আন্দাজ করে বুঝল, ওটার নিচে দিয়ে গাড়িটাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হতে পারে। লক্ষ করল, আবার এগিয়ে আসছে পিছনের ট্রাক।
মাঝখানে বন্দী হয়ে সারাক্ষণ এই বিপদের মধ্যে থাকতে চাইছে না রানা। তার চেয়ে একটা ঝুঁকি নিয়ে দেখা যেতে পারে। ফস্কে বেরিয়ে যাবার একটা উপায় করতে না পারলে ড্রাইভার দু’জন স-মিল পর্যন্ত যেতে বাধ্য করবে ওকে।
স্টিয়ারিঙ হুইল ঘুরিয়ে একটা সুযোগ তৈরি করতে চাইল রানা। এক সেকেন্ড পরই বুঝল, অনুমানটা ভুল হয়েছে। গাছের কাণ্ডটা আর সিকি ইঞ্চি উপরে থাকলে সংঘর্ষটা বাধত না। মাথার উপর ইস্পাতের পাত ছেঁড়ার বিকট আওয়াজ কানে গেল রানার। গাড়িটাকে থামাতে গিয়ে অনুভব করল, গাছের কাণ্ডের সঙ্গে বেধে গেছে ছাদটা, গতি কমাতে চাইলেও এখন আর তা সম্ভব নয়। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল রানা, ট্রাকটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে ল্যান্ডরোভারকে। দাঁতে দাঁত চেপে ধরে জোরে গ্যাস পেডালে চাপ দিল রানা। আবার ইস্পাতের পাত ছেঁড়ার শব্দ উঠল। পরমুহূর্তে তীব্র একটা ঝাঁকুনি অনুভব করল রানা। বাঁধন ছেঁড়া খেপা ষাঁড়ের মত ঝড় তুলে ছুটছে ল্যান্ডরোভার উঁচু নিচু মাটির উপর দিয়ে। সামনে বিরাট একটা ডুমুর গাছ দেখতে পেয়ে আঁৎকে উঠল রানা। সোজা গাছটার দিকে ছুটছে গাড়ি।
বনবন করে একবার এদিক একবার ওদিক স্টিয়ারিঙ হুইল ঘোরাচ্ছে রানা। সাঁ সাঁ করে একের পর এক পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে যাচ্ছে গাছগুলো। রাস্তার পাশ দিয়ে ছুটছে ল্যান্ডরোভার।
সামনের ট্রাকটাকে অতিক্রম করল রানা। গ্যাস পেডাল পুরো দাবিয়ে রেখে লাফিয়ে রাস্তার উপর তুলল ল্যান্ডরোভার।
সাইরেনের মত হর্ন বাজিয়ে রেখে আঠারো চাকার ট্রাকটা ধাওয়া করছে ল্যান্ডরোভারকে। গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার দু’জনের সঙ্গে বোঝাপড়াটা সেরে নেবার ইচ্ছে জাগলেও, সেটাকে গলা টিপে খুন করল রানা। ল্যান্ডরোভার থামলেও, ট্রাক দুটো থামবে না, বুঝতে অসুবিধে হলো না ওর। এখন থামতে গেলে ল্যান্ডরোভারটা খোয়ানো ছাড়া লাভ হবে না কিছু।
সামনে একটা তেমাথা মোড়। স-মিলের দিকে চলে গেছে একটা রাস্তা। সেদিকে না গিয়ে বাম দিকে মোড় নিয়ে মাইল খানেক এগিয়ে গাড়ি দাঁড় করাল রানা।
হুইল থেকে হাত সরাতেই সে-দুটো কাঁপতে শুরু করল থরথর করে। নড়তে গিয়ে অনুভব করল গায়ের সঙ্গে আঠার মত সেঁটে আছে ঘামে ভেজা শার্টটা। একটা সিগারেট ধরাল রানা। হাত দুটোর কম্পন থামতে দরজা খুলে নিচে নামল ক্ষতির পরিমাণ হিসেব করার জন্যে।
সামনেটা খুব বেশি আহত হয়নি, তবে টপ্ টপ্ করে পানির ফোঁটা পড়তে দেখে বোঝা গেল রেডিয়েটরটা ফেটেছে। উইন্ডস্ক্রীনের কোন চিহ্ন পর্যন্ত নেই। আর ছাদটাকে দেখে মনে হচ্ছে টিন কাটার ছুরি দিয়ে কেউ যেন দু’ফাঁক করে দিয়েছে সেটাকে মাঝখান থেকে।
ল্যান্ডরোভারের পিছনটার দশা করুণ লাগল রানার। গোটা পিছনটা চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। কাঠের বাক্সগুলো ভেঙে গেছে সব। ওর টেসটিং কিটের ভিতর যে ক’টা বোতল ছিল তার একটাও অক্ষত নেই। ঝুঁকে পড়ে দেখতে গিয়ে কেমিক্যালের উগ্র গন্ধ ঢুকল নাকে। গেইজার কাউন্টারটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে মাটিতে রাখল রানা, রুমাল বের করে মুছতে শুরু করল সেটা। অ্যাসিডে যন্ত্রপাতি নষ্ট হতে বেশি সময় লাগে না।
পিছিয়ে এসে ক্ষতি-পূরণের একটা হিসেব কষতে শুরু করল রানা: ট্রাক ড্রাইভারদের দুটো রক্তাক্ত নাক, বিগ প্যাটের ভাঙা পিঠ, বয়েড পারকিনসনের কাছ থেকে নতুন একটা ল্যান্ডরোভারের দাম।
ফোর্ট ফ্যারেলে ফেরার পথে মানুষের কৌতূহলী দৃষ্টি কেড়ে নিল ল্যান্ডরোভারটা। কিংস্ট্রীটে অনেক লোককে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখল রানা।
গ্যারেজের সামনে থামতে ডাকাতের মত হুংকার ছাড়তে ছাড়তে ছুটে এল জ্যাক লেমন। ‘মাইরি বলছি, এর জন্যে আমাকে তুমি দায়ী করতে পারো না। কিনে নিয়ে যাবার পর তুমি যদি ওটাকে পাহাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দাও, সেজন্যে তুমি…’
গাড়ি থেকে নেমে হাসি মুখে দুই হাত তুলে থামতে বলল রানা লেমনকে। ‘জানি। মেরামতের সব খরচ আমার, তুমি শুধু চেষ্টা করে দেখো খানিকটা মানুষের চেহারা দেয়া যায় কিনা। সম্ভবত নতুন একটা রেডিয়েটর লাগবে। আর পিছনের আলোটা জ্বালার ব্যবস্থা করতে হবে।’
পুরো এক চক্কর ঘুরল লেমন ল্যান্ডরোভারটাকে কেন্দ্র করে। ফিরে এসে দাঁড়াল রানার সামনে। ‘এটাই আমার কাছ থেকে কিনেছিলে তো? নাকি এটা অন্য একটা?’
‘তোমারটা বলে বিশ্বাস হয়?’
ঘোর সন্দেহ লেমনের দু’চোখে। ‘কিভাবে হতে পারে এমন কাণ্ড?’
‘পারকিনসনদের রাজত্বে এটাকে কি খুব অস্বাভাবিক একটা ঘটনা বলে মনে করো?’ বলল রানা।
বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেল লেমন। ‘পারকিনসন…’
‘থাক,’ বলল রানা, ‘এ প্রসঙ্গে আর কোন কথা জানতে চেয়ো না। কখন দিতে পারবে গাড়িটা বলতে পারো?’
‘পুরানো একটা রেডিয়েটর আছে আমার কাছে,’ মনে মনে একটা হিসেব কষল লেমন, ‘এই ধরো দু’ঘণ্টা পর।’
হেঁটে সোজা পারকিনসন বিল্ডিঙে পৌঁছুল রানা। এগারো তলায় উঠে কাউকে দেখল না করিডরে। আউটার অফিসে ঢুকেও থামল না ও, প্রাইভেট লেখা চেম্বারের দরজার দিকে যেতে যেতে বলল, ‘বয়েডের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি আমি।’
টাইপ করছিল সেক্রেটারি মেয়েটা। চমকে উঠে মুখ তুলে রানাকে দেখতে পেয়ে কেন কে জানে আঁৎকে উঠল সে। ‘না! মি. বয়েড এখন ব্যস্ত আছেন। আপনি…’
‘বটেই তো!’ না থেমে বলল রানা। ‘যত হারামিপনা গিজ গিজ করছে মাথার ভেতর, ব্যস্ত থাকবে না!’ ধাক্কা দিয়ে চেম্বারের দরজা খুলল রানা, দৃঢ় পায়ে ভিতরে ঢুকল। তৃতীয় কেউ নেই, তবু নাথান মিলারের সাথে চুপি চুপি ভঙ্গিতে কথা বলছে বয়েড, দেখল রানা। ‘হ্যালো, বয়েড,’ বলল ও, ‘সব কথা শোনার পরও তুমি আমাকে সামলাবার চেষ্টা করছ না কেন? ভয় পেয়েছ, নাকি, সত্যি কতটা জানি সে-ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত হতে পারছ না?’
‘কি মানে এসবের?’ শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে উঠল বয়েডের। ‘কার হুকুমে ঢুকেছ তুমি আমার চেম্বারে?’ ডেস্কের উপর সুইচবোর্ডের একটা বোতামে থাবা মারল সে। ‘মিস টেরেল, আজেবাজে লোককে তুমি ঢুকতে দিচ্ছ কেন?’
ডেস্কের সামনে গিয়ে থামল রানা। হাত বাড়িয়ে চেপে ধরল বয়েডের কব্জি, তারপর ছুঁড়ে দিল হাতটা তার বুকের দিকে। ‘বেচারিকে ধমক দিয়ে লাভ নেই, বয়েড। ওর কোন দোষ নেই। তোমার উচিত ছিল পোষা গুণ্ডাপাণ্ডাগুলোকে দরজায় বসানো।’ শান্তভাবে কথা বলছে রানা। ‘প্রথম প্রশ্নের উত্তর দাওনি। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর না দিলে নিজের বিপদ ডেকে আনবে তুমি। আমাকে ফোর্ট ফ্যারেল থেকে বের করে দেবার হুকুম দিয়েছ তুমি বিগ প্যাটকে?’
‘একটা ফালতু প্রশ্ন,’ গাম্ভীর্যের সাথে বলল বয়েড। তাকাল নাথানের দিকে। ‘তুমিই বলো ওকে।’
নিস্পৃহ ভঙ্গিতে ঠাণ্ডা দৃষ্টি রাখল নাথান রানার মুখে। ‘পারকিনসনদের মাটিতে যদি কোন জিওলজিক্যাল জরিপের প্রয়োজন হয় তবে তার আয়োজন আমরা নিজেরাই করব, মিস্টার। আমাদের হয়ে কাজটা তুমি করবে, এ আমরা চাই না। আশা করি ভবিষ্যতে এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা থেকে তুমি বিরত থাকবে।’
‘আশা করি মানে?’ নাথানের দিকে রক্তচক্ষু ফেলে ধমক মারল বয়েড। ‘বলো, নির্দেশ দিই। নির্দেশ দিই নিজের ভালর জন্যে এ ধরনের কাজ করা থেকে তুমি বিরত থাকবে।’
‘গাছ কাটার লাইসেন্স পেয়ে নিজেকে তুমি এলাকাটার মালিক ভাবছ,’ শান্তভাবে কথা বলছে রানা, ‘অথচ পারকিনসন করপোরেশন নামে তোমাদের এই প্রতিষ্ঠানটাই ভুয়ো। অর্থাৎ, গাছ কাটার লাইসেন্স পাবার অধিকার তোমাদের নেই। বয়েড, তোমরা ধরা পড়ে গেছ। তোমাদের বাঁচার একটা মাত্র উপায়ই দেখতে পাচ্ছি আমি।’
‘নাম ধরবে না তুমি আমার!’ হিংস্র হয়ে উঠল বয়েডের চেহারা। ‘যা বলতে চাও ভদ্রভাবে পরিষ্কার করে বলো।’
‘সহজ সরল যে কথাটা আগাগোড়াই আমি আভাসে বলতে চেয়েছি সেটা হলো: পালিয়ে গিয়েও রেহাই পাবে না তোমরা। অবশ্য কথাটা তোমরাও জানো।’ মুচকি হেসে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল রানা, ‘পারকিনসনদের মাটিতে ছিলাম না আমি, ছিলাম ক্রাউন ল্যান্ডে। আমি একজন লাইসেন্সধারী জিওলজিস্ট, ক্রাউন ল্যান্ডে যে কোন এক্সপেরিমেন্ট চালাতে পারি। তোমার গাছ কাটার লাইসেন্স আছে বলে তুমি আমাকে বাধা দিতে পারো না। যদি দাও, কোর্ট থেকে অর্ডার আনব আমি, তাতে তোমার গাছ কাটার লাইসেন্স আপাতত বাতিল হয়ে যাবে।’
কথাগুলোর অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে বেশ একটু সময় নিল বয়েড। শেষ পর্যন্ত নাথানের দিকে তাকাল সে। চোখে অসহায় দৃষ্টি।
নাথানের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসতে শুরু করল রানা, তারপর বয়েডের ভঙ্গি নকল করে বলল, ‘তুমিই বলো ওকে।’
নাথান বলল, ‘তুমি ক্রাউন ল্যান্ডে ছিলে কিনা সেটা একটা প্রশ্ন।’
‘স্বীকার করো, কোর্ট থেকে অর্ডার আনতে পারি আমি?’
বয়েডের দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করল নাথান। ‘হ্যাঁ। কিন্তু পারকিনসনদের মাটিতে তুমি কিছু করতে পারো না।’
‘জানি। তা আমি করিওনি!’
‘মিথ্যে কথা!’ হঠাৎ বলল বয়েড। ‘ক্রাউন ল্যান্ডে নয়, তুমি আমাদের মাটিতে দাঁড়িয়ে…’
‘থামো!’ বয়েডের মুখের সামনে বাতাসে বাঁ হাতের চাটি মেরে তাকে থামিয়ে দিল রানা। পা ঝুলিয়ে বসল ডেস্কটার কোনায়। ‘ম্যাপগুলোয় একবার চোখ বুলিয়ে নাও আগে, বয়েড, তারপর আমার সাথে তর্ক করতে এসো। আমার ধারণা, কয়েক বছর ধরে ওগুলো আর খোলনি। নিজেকে গোটা এলাকাটার মালিক বলে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছ।’
চিবুক নেড়ে নির্দেশ দিল বয়েড, নাথান দ্রুত চেয়ার ছেড়ে বেরিয়ে গেল চেম্বার থেকে। কঠোর দৃষ্টিতে তিন সেকেন্ড দেখল বয়েড রানাকে। ‘কি চাও তুমি, রানা? তোমার উদ্দেশ্য কি?’
‘উদ্দেশ্য জীবিকার অন্বেষণ করা। প্রচুর সম্ভাবনা আছে এদিকে, নেড়েচেড়ে একটু দেখতে চাই।’
‘আমার আপত্তি নেই,’ বয়েড গম্ভীর। ‘কিন্তু শত্রুতা সৃষ্টি করে কোথায় পৌঁছুতে চাও তুমি?’
‘শত্রুতা বুঝি আমি সৃষ্টি করছি? প্লীজ, বয়েড, মেয়েদের মত ন্যাকামি কোরো না। ভাল কথা, তোমার ট্রাক-ড্রাইভারদের একজনকে আমি চিনতে পেরেছি। তাকে কথাটা জানিয়ে দিয়ো।’
‘মানে?’
‘মন্ট্রিয়লে দেখেছিলাম ওকে, জ্ঞান হারাবার আগের মুহূর্তে—এই কথাটা বললেই বুঝতে পারবে ও।’ বয়েডের চোখমুখ দ্রুত বদলে যাচ্ছে দেখে হেসে উঠল রানা। ‘আমাকে তোমার যমের চেয়েও বেশি ভয় করা উচিত। কিন্তু মন্ট্রিয়লের ঘটনার জন্যেই শুধু নয়, বয়েড।’
‘কেন এসেছ তুমি ফোর্ট ফ্যারেলে?’
স্থির চোখে চেয়ে আছে বয়েড রানার দিকে। কণ্ঠস্বরটা অসম্ভব ভারি, রানার কানে অপরিচিত ঠেকল। অস্বাভাবিক শান্ত এবং স্থির দেখাচ্ছে বয়েডকে।
‘ফালতু একটা প্রশ্ন,’ বলল রানা। হাসছে ও এখনও। ‘কেন এসেছি তা তুমি এখনও যদি বুঝে না থাকো, আমি বলব সেটা তোমার দুর্ভাগ্য। তোমার প্রতি আমার পরামর্শ, বয়েড: পালিয়ে যাবার চেষ্টা কোরো না। বাঁচার জন্যে ওটা কোন উপায়ই নয়।’
‘নাম ধরে ডাকতে নিষেধ করেছি তোমাকে আমি,’ নিচু, প্রায় ফিসফিস করে বলল বয়েড। ‘আবার জিজ্ঞেস করছি, কেন এসেছ তুমি ফোর্ট ফ্যারেলে? কি চাও?’
‘তোমার এর পরের প্রশ্নটা কি হবে তা আমি অনুমান করে বলে দিতে পারি,’ হাসছে রানা। ‘কত চাও—কি, ঠিক কিনা?’
রাগের কোন লক্ষণ নেই বয়েডের চেহারায়। উদ্বেগের কোন চিহ্ন নেই মুখে। শুধু চেয়ে আছে স্থির দৃষ্টিতে রানার দু’চোখের মাঝখানে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চেম্বার। তবু ঘাম ফুটে উঠেছে কপালে। জুলফি ভিজে গেছে পুরোপুরি। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে রানা ধরতে পারল, বয়েড দমন করার চেষ্টা করলেও শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রমে দ্রুত হচ্ছে তার। ‘আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছ না তুমি, রানা। কি চাও তুমি? কেন এসেছ ফোর্ট ফ্যারেলে?’
‘খুঁড়তে।’
‘আরও পরিষ্কার করে বলো, কি খুঁড়তে এসেছ তুমি?’
‘মাটি।’
আবার প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল বয়েড, কি ভেবে নিজেকে সামলে নিল। চোখ নামিয়ে নিজের ডান হাতটা দেখল। আগেই লক্ষ্য করেছে রানা, সেটা ডেস্কের খোলা ড্রয়ারের মুখের কাছে গিয়ে থেমে আছে। কিলবিল করছে আঙুলগুলো। অত্যন্ত ধীরে ধীরে ঢুকছে ড্রয়ারের ভিতর। ‘কোথাকার মাটি, রানা?’
‘গোরস্তানের।’
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করছে বয়েডকে রানা। কথাটা শুনে কোন প্রতিক্রিয়া হলো না তার মধ্যে। বাঁ চোখের নিচে শুধু কেঁপে উঠেই থেমে গেল একটা শিরা। ‘কি আছে গোরস্তানে, রানা?’ যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে বয়েডের কণ্ঠস্বর।
‘ক্লিফোর্ডদের লাশ।’
‘জানি,’ সড়সড় করে নেমে আসছে ঘামের ধারা বয়েডের জুলফি থেকে। ‘ঠিক লাশ নয়, হাড়গোড়। কি করতে চাও ওগুলো দিয়ে?’
‘নিজের চোখেই দেখতে পাবে।’
কি যেন বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল বয়েড, হাতে একটা ম্যাপ নিয়ে চেম্বারে ঢুকল নাথান। বয়েডের সামনে ডেস্কের উপর সেটা মেলে দিল সে। ফরেস্ট অফিসারের বাংলোয় ম্যাপটা আগেই দেখেছে রানা। বয়েডের মুখের দিকে চোখ রেখে ও বলল, ‘কাইনোক্সি উপত্যকার উত্তরটা শীলা ক্লিফোর্ডের আর দক্ষিণটা তোমাদের। কিন্তু তোমাদের এলাকা এসকার্পমেন্টের কাছাকাছি গিয়ে থেমে গেছে, এর পরে দক্ষিণের সবটুকু জায়গাই ক্রাউন ল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত। তার মানে, এসকার্পমেন্টের মাথার বাঁধ এবং নিচের পাওয়ার হাউজ ক্রাউন ল্যান্ডের ওপর তৈরি হচ্ছে। যখন খুশি ওখানে যেতে পারি আমি, খুঁড়তে পারি—তোমাদের বাধা দেবার কোন অধিকার নেই।’
বয়েড মুখ তুলে নাথানের দিকে তাকাল। মৃদু একটু মাথা নাড়ল নাথান। ‘মিস্টার রানার কথাটা ঠিক বলেই মনে হচ্ছে।’
‘মনে হবার কিছু নেই এর মধ্যে, যা সত্য সেটাকে স্বীকার করে নাও,’ বলল রানা। ‘বয়েড, এবার আমি অন্য প্রসঙ্গে আসছি। ঘটনাটা একটা ল্যান্ডরোভারকে নিয়ে। ওটাকে চিঁড়ে চ্যাপ্টা করে দেয়া হয়েছে।’
ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে আছে বয়েড রানার দিকে। বলল, ‘তুমি গাড়ি চালাতে না জানলে সেটাও কি আমার দোষ?’
‘গাড়ি আমি চালাতে জানি,’ বলল রানা, ‘তার প্রমাণ এখনও আমি বেঁচে আছি। প্রসঙ্গটা আমি তুলেছি তোমাকে সাবধান করে দেবার জন্যে, বয়েড। যা করার করেছ, আমাকে শায়েস্তা করার জন্যে ড্রাইভারদের দ্বিতীয়বার আর নির্দেশ দিয়ো না। তা যদি দাও, এবার রোড অ্যাক্সিডেন্ট কেউ ঠেকাতে পারবে না। এবং সে অ্যাক্সিডেন্টে মানুষ মরবে।’
হঠাৎ হাসল বয়েড। ‘পেয়ে গেছি!’
‘কি পেয়ে গেছ?’
উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে বয়েডের মুখ। চকচক করছে চোখ দুটো। ‘তা বলব কেন? তবে, স্বীকার করছি, তোমার একটা ব্যাপার পরিষ্কার ধরতে পেরেছি আমি। রোড অ্যাক্সিডেন্টকে বড় ভয় পাও তুমি।’
ডেস্কের কোণ থেকে কার্পেটের উপর নামল রানা। ‘হ্যাঁ, পাই,’ বলল ও, ‘কিন্তু ভয় পাই নিজের কথা ভেবে নয়, বয়েড, অন্যের কথা ভেবে।’
‘কার জন্যে ভয় পাও তা জেনে আমার দরকার কি!’ বাঁকা হাসল বয়েড। ‘ভয় পাও এটুকু জেনেই আমি সন্তুষ্ট।’
‘এবং ভয় দেখিয়ে আমাকে তাড়াবার উপায় পেয়ে গেছ বলে ভাবছ, তাই না?’ বলল রানা, ‘ইডিয়ট! কয়েকবার ভাল ফল পেয়ে রোড অ্যাক্সিডেন্টের ওপর খুব ভরসা তোমার, না? কিন্তু, বয়েড জাল যে চারদিক থেকে গুটিয়ে আনছি তা বুঝি দেখতে পাচ্ছ না?’
‘জালে ফুটো আছে, আমি ঠিকই বেরিয়ে যেতে পারব,’ নিরুদ্বেগ দেখাচ্ছে বয়েডকে, কথাগুলো বলার সুযোগ পেয়ে খুব যেন মজা পাচ্ছে বলে মনে হলো রানার। ‘তোমাকে সাবধান করে দিয়ে লাভ নেই, কেননা তোমার পাখা গজিয়েছে, রানা। কিন্তু প্রসঙ্গটা উঠেছে বলেই বলছি, আমি ধরা ছোঁয়ার ঊর্ধ্বে রয়েছি। কেউ ছুঁতে পারবে না।’
‘তোমাকে আমি ছুঁতে চাই তা ভাবছই বা কেন?’ বলল রানা, ‘তোমার বড়জনকে নিয়েও তো হতে পারে আমার কারবার!’
রানা দেখল ভয় বা উদ্বেগ নয়, বিস্ময় বোধ করছে বয়েড। ওর কথা শুনে কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। ‘কি বলতে চাইছ তুমি?’
‘তা বলব কেন?’ হাসছে রানা। ‘তোমার বড়জনকেই না হয় প্রশ্নটা করে দেখো না, তিনি কি বলেন।’
‘আমার বাবা গাফ পারকিনসন সম্পর্কে বলছ তুমি?’
ঘুরে দাঁড়িয়েছে রানা ইতিমধ্যে। দরজার কাছে গিয়ে থামল ও। ‘তাছাড়া আর কার কথা বলব? তিনিই কি পালের গোদা নন?’ দরজা খুলে বেরিয়ে এল রানা। পিছন ফিরে তাকাল একবার। বয়েড পারকিনসন অবাক হয়ে চেয়ে আছে, কি এক জটিল ধাঁধায় পড়ে গেছে যেন সে। মুচকি হেসে ঘাড় ফিরিয়ে নিল রানা।
জ্যাক লেমনের কারখানা থেকে সোজা লংফেলোর কেবিনে পৌঁছুল রানা। জিনিসপত্র নামিয়ে নিয়ে গাড়িটাকে গাছ-পালার আড়ালে রেখে এল। স্টোভে পানি গরম করতে দিয়ে কাপড়চোপড় ছাড়ল ও। স্নান সেরে কফি তৈরি করল। কাপে চুমুক দিয়েছে মাত্র, বাইরে থেকে গাড়ির শব্দ ভেসে এল। জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রানা। দেখল ঝক্কড় মার্কা একটা অস্টিন থামছে দরজার কাছে। গাড়ি থেকে নেমেই রানাকে দেখে মাথা থেকে টুপি খুলে নাড়ল সেটা লংফেলো। জবর কোন খবর বয়ে আনছে সে, ভাব দেখে অনুমান করল রানা।
সশব্দে দরজা খুলে কেবিনে ঢুকল লংফেলো। ‘গত চল্লিশ বছরে এমন ঘটনা ঘটতে দেখিনি।’ কথাটা বলে টেবিল চেয়ারগুলোর দিকে এগিয়ে গেল বুড়ো। রানাকে অবাক করে দিয়ে একটা চেয়ারের উপর উঠে দাঁড়াল সে।
‘ও কি?’
উত্তরে ফিরেও তাকাল না রানার দিকে লংফেলো। ওর দিকে পিছন ফিরে টেবিলের উপর উঠে পড়ল সে। ‘একটি বিশেষ ঘোষণা!’ মুখের উপর চোঙের মত করল লংফেলো বাঁ হাতটাকে। ‘কিং অফ ফোর্ট ফ্যারেল…ফোর্ট ফ্যারেলের রাজাধিরাজ মহামান্য গাফ পারকিনসন টেলিফোন করে আমাকে জানার নির্দেশ দিয়েছেন, মাসুদ রানা কে, কোথায় তার দেশ, কি তার উদ্দেশ্য, এই মুহূর্তে কোথায় সে আছে…’
‘কেউ তার খবর জানে না।’
আধ পাক ঘুরে রানার দিকে তাকাল লংফেলো। ‘মানে?’
‘মানে,’ বলল রানা, ‘গাফ পারকিনসনকে জানিয়ে দাও সাংবাদিকের সাথে কথা বলতে অস্বীকৃতি জনিয়েছে মাসুদ রানা। আমি চাই, তিনি নিজে আমার কাছে আসুন।’
‘স্পর্ধা!’
‘মোটেই না। আমাকে তার প্রয়োজন, তাকে আমার কোন প্রয়োজন নেই।’
‘কিন্তু সে তো জানে না তুমি কোথায়।’
‘প্রয়োজন যদি তেমন জরুরী হয় জেনে নিতে খুব বেশি দেরি হবে না।’
‘লোকে যে তোমাকে উন্মাদ ভাবছে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু দেখছি না। গাফ পারকিনসনের কথায় এক ঘাটে পানি খায় বাঘ আর ছাগল। তার কথা অবহেলা করার সাহস ফোর্ট ফ্যারেলে এক মাত্র পাগল ছাড়া আর কারও নেই।’
‘কে আমাকে পাগল বলে?’
‘লিউ পার্কার, বাসস্ট্যান্ডের সুপারিনটেন্ডেন্ট। জ্যাক লেমন, গাড়ি মেরামত কারখানার…আচ্ছা, তোমার গাড়িটা নাকি পাহাড় থেকে পড়ে গুঁড়ো পাউডার হয়ে গেছে?’
‘বাড়িয়ে বলেছে জ্যাক তোমাকে,’ বলল রানা, ‘পাউডার হলে চালিয়ে এলাম কিভাবে এখানে? তুবড়ে গেছে এক-আধটু, তার বেশি কিছু নয়।’
‘তার মানে পুরোদমে লেগেছে ওরা?’
হাসল রানা। ‘আরে না! বিগ প্যাটের মস্করা এটা। পারকিনসনরা এখনও শুরুই করেনি।’
টেবিল থেকে নেমে চেয়ারে বসল লংফেলো। পকেট হাতড়ে চুরুটের বাক্স বের করল। ‘বাঁধের ওদিকে গিয়েছিলে কি মনে করে?’
‘বয়েডকে নাড়া দিতে,’ বলল, রানা, ‘খোঁচা মেরে দেখতে চেয়েছিলাম কি রকম প্রতিক্রিয়া হয়।’
‘কি বুঝলে?’
‘বুঝলাম বয়েড যদি কিছু অন্যায় করেও থাকে, সে-ব্যাপারে কোনরকম দুশ্চিন্তা নেই তার। যাই করে থাকুক, ওর ধারণা, কেউ কিছু প্রমাণ করতে পারবে না।’
‘এতক্ষণে রহস্যটা পরিষ্কার লাগছে।’
‘কি রহস্য?’
‘আমি ভেবে অবাক হচ্ছিলাম, বয়েড এখনও সহ্য করছে কেন তোমাকে। এখন বুঝতে পারছি ব্যাপারটা। ও আসলে তোমাকে ভয় পাবার কোন কারণই দেখতে পাচ্ছে না। অপরাধের কোন প্রমাণ রাখেনি, সেজন্যেই নিজের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন নয় সে।’
প্রসঙ্গ বদলে জানতে চাইল রানা, ‘বাঁধ দিতে কত টাকা খরচ হবে বলে মনে করো?’
‘বাঁধ, পাওয়ার হাউজ, ট্র্যান্সমিশন লাইন—সব মিলিয়ে ষাট লক্ষ ডলারের কমে হবে না। কিন্তু হঠাৎ টাকার হিসেব জানতে চাইছ কেন?’
‘একটা হিসেব করে দেখেছি কাইনোক্সি উপত্যকা থেকে পারকিনসনরা এক কোটি ডলারের গাছ কেটে নিচ্ছে। তার মানে সব খরচ বাদ দিয়েও ওদের পকেটে যাচ্ছে চল্লিশ লাখ ডলার।’
‘একেই বলে বুদ্ধির ব্যবসা।’
‘আমার ওপর অভিমান করে চলে গেল, এ আসলে শীলা ক্লিফোর্ডের বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়,’ বলল রানা, ‘কাইনোক্সি উপত্যকার তার অংশটা পানিতে ডুবে যাবে অথচ গাছগুলো কাটার কথা ভাবছে না সে।’
‘ঠিক। তোমার সাথে আমি একমত।’
‘জানো, কত ডলার হারাচ্ছে ও? কম করেও ত্রিশ লক্ষ ডলার।’
‘আমার ধারণা, শীলার ব্যবসাবুদ্ধি একেবারেই নেই। ওর টাকা-পয়সার ব্যাপারটা ভ্যানকুভারের একটা ব্যাঙ্ক দেখাশোনা করে। গাছ কাটতে হবে একথা হয়তো তার মাথায় ঢোকেইনি।’ চুরুটটা ধরাল লংফেলো।
‘ফরেস্ট অফিসার এ ব্যাপারে কিছু করতে পারে না? এত টাকার গাছ পানিতে ডুববে?’
‘কেউ তার গাছ না কাটলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবার নিয়ম নেই,’ লংফেলো বলল, ‘এ ধরনের সমস্যা এর আগে দেখা দেয়নি বলেই আমার বিশ্বাস।’
‘কিছু একটা আমাকেই করতে হবে।’
‘তুমি?’
‘শীলা আমার ওপর মিথ্যে রাগ করে চলে গেছে। তার অনুপস্থিতিতে তার কোন ক্ষতি আমি হতে দিতে পারি না।’
‘কি করতে চাও শুনি?’
‘না, বাঁধ তৈরি করতে ওদের আমি বাধা দিতে যাচ্ছি না। আমি শীলার গাছগুলোর ব্যাপারে কিছু একটা করতে চাই। ঠিক কি করব তা আমি নিজেও এখনও জানি না। আমার কি ধারণা জানো?’
‘কি?’
‘শীলার গাছ কেনার জন্যে তৈরি হয়েই আছে পারকিনসনরা। ওরা হয়তো শীলাকে খবর দিয়ে ফোর্ট ফ্যারেলে ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও করবে।’
‘তোমার পরবর্তী চালটা কি হবে?’ একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে জানতে চাইল লংফেলো। চশমাটা নাকের ডগায় নেমে এসেছে। সকৌতুকে চেয়ে আছে সে চশমার উপর দিয়ে।
‘আমার একটা উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে,’ বলল রানা, ‘বুড়ো গাফ পারকিনসনের টনক নড়েছে। আরও খানিক নাড়া দিতে চাই আমি ওদের। এবারের মাত্রাটা একটু বেশি হবে, যাতে ভয় পায়। ভাল কথা, লংফেলো, শীলার আস্তানায় যেতে চাই আমি, পারকিনসনদের মাটির ওপর পা না ফেলে কিভাবে ওখানে যেতে পারি?’
‘পিছন দিক থেকে একটা রাস্তা আছে,’ বলল লংফেলো, ‘দাঁড়াও, ম্যাপটা বের করে দেখাই।’
শীলার ওখানে কেন যেতে চায় রানা সে-ব্যাপারে কোন প্রশ্নই করল না লংফেলো।
***
পরদিন সকালে গোরস্তানে ঢুকল রানা। ক্লিফোর্ডদের কবরগুলোর কাছে মাথায় গাছের ছায়া নিয়ে সবুজ ঘাসের উপর বসে তিনটে ঘণ্টা কাটিয়ে দিল ও স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের একটা রহস্যোপন্যাস হাতে।
মাঝে মধ্যে যখনই বইটার পৃষ্ঠা থেকে মুখ তুলল, কাছে পিঠে লোকজনের নড়চড়া লক্ষ করল ও। দেখেও না দেখার ভান করে থাকল। কিন্তু মনের আশাটা পূরণ হলো না ওর। কেউ কাছে এসে জানতে চাইল না কিছু।
দুপুরে লংফেলোর কেবিনে ফিরে গেল রানা। বিকেলের দিকে আবার ঢুকল কবরস্তানে। ল্যাণ্ডরোভারকে অনুসরণ করে একটা জীপ এল কবরস্তানের গেট পর্যন্ত। ভিতরে ঢুকে ক্লিফোর্ডদের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে একটা ফিতে বের করল রানা। প্রতিটি কবরের দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ মাপল। নোটবুক বের করে পেন্সিল দিয়ে লিখল তাতে কিছু। কিন্তু এবারও নিরাশ হলো ও। কেউ এল না সামনে।
শহরে ফিরল সন্ধ্যার আগেই। বাস স্ট্যাণ্ডে গিয়ে গল্প করল ডিপোর সুপারিনটেণ্ডেন্টের সাথে। কথা প্রসঙ্গে তাকে জানাল, হাডসন, ক্লিফোর্ডের ছেলে টমাস ক্লিফোর্ড ওর বন্ধু ছিল এবং ফোর্ট ফ্যারেলে ও এসেছে টমাস হত্যাকাণ্ডের রহস্য ভেদ করতে।
লিউ পার্কার হতভম্ব। কিন্তু কোন প্রশ্ন করার সুযোগই পেল না সে। গম্ভীর একখানা চেহারা করে দ্রুত তার কাছ থেকে বিদায় নিল রানা। এই একই কাণ্ড করল সে জ্যাক লেমনের কাছে গিয়ে! ফোর্ট ফ্যারেলের আরও তিন চারজন লোককে কথাটা বলল ও। রাত আটটা নাগাদ শহরের অধিকাংশ লোকের কানে পৌঁছে যাবে কথাটা।
শহরটাকে জানিয়ে দেয়ার কাজ শেষ হয়েছে মনে করে ফোর্ট ফ্যারেল ত্যাগ করল রানা। একশো পঁচিশ মাইল দূরত্ব পেরিয়ে ল্যাণ্ডরোভারকে থামাল সে শীলার বাড়ির সামনে।
গাড়ির আওয়াজ পেয়ে বুড়ো এক লোক বেরিয়ে এল বাইরে। ‘তুমিই ডিকসন?’
মাথা নাড়ল লোকটা। বলল, ‘কাকে চান, স্যার? মিস ক্লিফোর্ড তো বাড়িতে নেই।’
‘জানি’, বলল রানা। পকেট থেকে একটা এনভেলাপ বের করে বাড়িয়ে দিল ডিকসনের দিকে।
এনভেলাপটা নিয়ে খুলল ডিকসন। ভিতর থেকে চিরকুট বের করল একটা। লাইন ক’টা পড়ে দাঁতহীন মাড়ি বের করে একগাল হাসল সে। ‘ওহ! আপনিই মি. রানা! তা আগে বলবেন তো! লংফেলো আমার নাতি, ওর চিঠি যখন নিয়ে এসেছেন…।’
ঢোক গিলল রানা। ‘কি?’ অবিশ্বাস ভরা চোখে দেখল ও ডিকসনের আপাদমস্তক। ‘তুমি লংফেলোর নানা…মানে? তার বয়সই তো সত্তরের ওপর!’
‘একশো তেরো চলছে আমার’, ডিকসন হঠাৎ একটা লাফ দিয়ে ঠিক রানার সামনে ডিগবাজি খেলো একটা।
রানা দেখল মাটিতে দু‘হাতের ভর দিয়ে পা দুটো আকাশের দিকে তুলে স্থির হয়ে আছে প্রাচীন ডিকসন, ‘আজকালকের ছেলেরা এখনও আমার সাথে পাঞ্জা লড়ে হেরে যায়,’ মাটির কাছ থেকে বলল ডিকসন।
‘হয়েছে, হয়েছে—বুড়ো বয়সে হাড়গোড় ভাঙতে হবে না তোমাকে’, বলল রানা। ‘পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াও এবার।’
আবার একটা ডিগবাজি খেয়ে সিধে হলো বুড়ো। রানার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ সে যেন লজ্জা পেল। পরিষ্কার দেখল রানা, বলিরেখায় ভর্তি মুখটা লাল হয়ে উঠেছে তার। ‘এই তো গেল হপ্তায় আমার একটা কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। ওর মা আমার সাত নম্বর স্ত্রী। বাপের বাড়ি থেকে ফেরেনি এখনও। কি আশ্চর্য, স্যার, নিজের কথাই কেবল বলে যাচ্ছি… আপনার জন্যে কি করতে পারি বলুন তো?
‘বিশেষ কিছু নয়,’ বলল রানা, ‘এদিকে একটা তাঁবু ফেলতে চাই ক’দিনের জন্যে।’
‘সে কি! তাঁবু ফেলবেন কেন? তা আমি ফেলতে দেবই বা কেন? নাতি লিখেছে আপনি তার সম্মানীয় অতিথি, এবং মিস ক্লিফোর্ডের বন্ধু—আপনাকে আমি বাইরে রাত কাটাতে দিতে পারি? উঁহুঁ, অসম্ভব। আপনি স্যার বাড়ির ভিতরেই থাকবেন। অতিরিক্ত বেডরূম তো একটা আছেই। চলুন, স্যার, ভিতরে চলুন।’
গেট পেরোবার সময় রানা জানতে চাইল, ‘কদ্দিন থেকে আছ শীলার সাথে?’
‘আছি সেই বড় সাহেবের আমল থেকে।’
‘বড় সাহেব?’
‘হাডসনের কথা বলছি। আমার চেয়ে পঞ্চাশ বছরের ছোট ছিল সে, কিন্তু ওকে আমি আদর করে বড় সাহেবই বলতাম।’
‘ওহ্,’ বলল রানা ৷ উঠান পেরিয়ে বারান্দায় উঠল ওরা। ‘অ্যাক্সিডেন্টটা খুবই দুঃখজনক।’
‘অ্যাক্সিডেন্ট?’
‘মানে ওরা সবাই যে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল সেটার কথা বলছি।’
‘ওহ্। হ্যাঁ, ঘটনাটাকে সবাই অ্যাক্সিডেন্টই বলে বটে।’
বারান্দার উপর থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল রানা। ‘সবাই অ্যাক্সিডেণ্ট বলে, তুমি বলো না?’
উত্তরটা ঘুরিয়ে দিল ডিকসন। রানার দিকে তাকালও না কথাটা বলার সময়। ‘জানেন, স্যার, হাডসন খুব পাকা ড্রাইভার ছিল। আমিই ওকে গাড়ি চালানো শিখিয়েছিলাম কিনা। গাড়ি চালাবার সময় কোনরকম ঝুঁকি নিত না সে। রাস্তায় বরফ থাকলে কখনও ত্রিশের বেশি তুলত না স্পীড।’
‘তিনিই যে গাড়ি চালাচ্ছিলেন তা জোর করে বলা যায় না। তাঁর স্ত্রী কিংবা হয়তো তাঁর ছেলে গাড়ি চালাচ্ছিল।’
বাঁকা একটু হাসল মান্ধাতা আমলের লোকটা। ‘নতুন ওই ক্যাডিলাকটা? গাড়ির ব্যাপারে হাডসনের ভাবসাব আমার চেয়ে আর বেশি কে জানে, স্যার? মাত্র এক হপ্তা আগে কিনেছিল গাড়িটা হাডসন, কাউকে ছুঁতে পর্যন্ত দিতে চাইত না।’
‘বেশ। তাহলে কি ঘটেছিল বলে মনে করো তুমি?’
‘সে সময় অনেক আজব ব্যাপারই ঘটছিল ফোর্ট ফ্যারেলে।’
‘কি রকম?’
বারান্দা ধরে হাঁটা ধরল ডিকসন। ‘আপনি, স্যার, অনেক কথা জানতে চাইছেন। হতে পারেন আপনি মিস ক্লিফোর্ডের বন্ধু এবং আমার নাতির অতিথি, কিন্তু এতসব কথা আপনার জানতে চাওয়ার অধিকার আছে কিনা আমি জানি না। সুতরাং, এই আমি ঠোঁটে কলুপ আঁটলাম।’
ড্রয়িংরুমে বসিয়ে গরম কফি তৈরি করে খাওয়াল ডিকসন রানাকে। অনেক চেষ্টা করল রানা, কিন্তু লোকটার কাছ থেকে আর কোন কথা আদায় করতে পারল না ও।
রানাকে ওর বেডরুম দেখিয়ে দিয়ে কাঁধে বন্দুক নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল ডিকসন। ডিনারের সময় হাঁসের রোস্ট পরিবেশিত হতে দেখে রানা অবাক হলো। তা লক্ষ করে ডিকসন বলল, ‘চাঁদনি রাত কিনা, হাঁসেরা বুড়োর চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না।’
‘হুঁ’, বলল রানা। ‘আজ থেকে আট বছর আগে তোমার দেখার ক্ষমতা আরও বেশি ছিল।’
‘তা ছিল,’ বলল ডিকসন, ‘কিন্তু বেশি দেখার পরিণতি অনেক সময় ভাল হয় না।’
আর কোন কথা হলো না ওদের মধ্যে।
পরদিন সকাল। বেড-টি দিতে এসে ডিকসন বলল, ‘মিস ক্লিফোর্ড আপনার বান্ধবী, কিছু দরকারী উপদেশ দিয়ে তার উপকার করতে পারেন না আপনি?’
চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে রানা। কাত হয়ে চায়ের কাপটা নিল হাত বাড়িয়ে। ‘যেমন?’
‘এই যে এত টাকার গাছ ডুবে যাচ্ছে, সেদিকে তার কোন খেয়ালই নেই।’
‘গাছের দাম সম্পর্কে কোন ধারণা আছে তোমার?’
‘বলেন কি! হাডসনের গাছ তো বিক্রি আমিই করতাম।’
‘পারকিনসনরা কাইনোক্সি উপত্যকায় তাদের অংশের সব গাছ কেটে নিচ্ছে। প্রতি স্কয়ার মাইল থেকে কত টাকার গাছ পাবে ওয়া বলতে পারো?’
সিলিঙের দিকে চোখ তুলে চুপচাপ হিসেব কষল ডিকসন। তারপর বলল, ‘সাতশো হাজার ডলারের কম নয়।’
‘শীলা তাহলে কত টাকা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করছে?’
‘হাডসন মারা যাবার পর থেকে এদিকের গাছ একবারও কাটা হয়নি, তা জানেন? গত আট বছর ধরে গাছগুলো বড় আর মোটা হয়েছে। আমার অনুমান, প্রতি বর্গ মাইলে দশ লাখ ডলারের গাছ রয়েছে।’
মনে মনে চমকে উঠল রানা। ‘তার মানে পাঁচ বর্গ মাইলে রয়েছে পঞ্চাশ লক্ষ ডলারের গাছ। এ ব্যাপারে কথা বলোনি তার সাথে?’
‘তাকে পেলে তবে তো! যদি লিখতে জানতাম তাহলেও কথা ছিল।’
‘ঠিকানাটা দিতে পারো আমাকে?’
‘ভ্যানকুভারের ব্যাঙ্কে লিখতে হবে আপনাকে’, বলল ডিকসন। ‘তারা চিঠিটা পাঠাবে মিস ক্লিফোর্ডের কাছে।’ ঠিকানাটা মুখস্থ বলে গেল সে।
বিকেলে ফিরল রানা ফোর্ট ফ্যারেলে। লংফেলোর কেবিনে যাবার পথে প্রকাণ্ড একটা লিঙ্কন কন্টিনেন্টাল গাড়িকে কাদার মধ্যে আটকে থাকতে দেখল ও। গাড়ির ভিতর বা, আশেপাশে কাউকে না দেখে একটু অবাকই হলো ও।
লংফেলোর কেবিনের সামনে পৌঁছে ল্যাণ্ডরোভার থামাল রানা। বয়স্ক অস্টিনটাকে দেখতে না পেয়ে ভাবল ও, কেবিনে নেই লংফেলো।
গাড়ি থেকে নেমে দরজার দিকে এগোচ্ছে রানা। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কেবিনের দরজায় তালা নেই। কেন? কে এসেছে কেবিনে? ভাবতে ভাবতে আবার এগোতে শুরু করল রানা। কিন্তু পা টিপে নিঃশব্দে।
খোলা জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল রানা। উকি দিয়ে তাকাল ভিতরে।
আগুনের সামনে কোলে একটা বই নিয়ে চুপচাপ বসে আছে এক যুবতী। চিনতে পারল না রানা! জীবনে কখনও দেখেনি একে।
***