এক
মন্ট্রিয়ল। কানাডা। ১৬ আগস্ট।
বাঁ হাতে অ্যাটাচী কেস, পরনে নীল রঙের কমপ্লিট স্যুট, লাল টাই, মাথায় হ্যাট—সিআই অফিস বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এল মাসুদ রানা। মনটা খুশি।
মাঝ আকাশ থেকে নিষ্প্রভ সূর্যটা হামাগুড়ি দিয়ে নামতে শুরু করেছে মাত্র, এরই মধ্যে ঢাকা পড়ে গেছে মন্ট্রিয়ল শহর ফিকে হলুদ রঙের কুয়াশায়।
পঁচিশ গজ দূরে অনেক গাড়ির ভিড় থেকে উঁকি মারছে ধূসর রঙের একটা পন্টিয়াকের নাক। কংক্রিটের উপর জুতোর ভারি আওয়াজ। দৃঢ়, দ্রুত পায়ে গাড়িটার দিকে এগোচ্ছে রানা।
এত সহজে কাজ উদ্ধার হবে ভাবতেই পারেনি ও। ওকে দেখে মাথা নেড়ে বসতে ইঙ্গিত করে মুচকি হেসেছেন কানাডা ইন্টেলিজেন্সের অপারেশনাল ডিরেকটার হুবার্ট গডফ্রে। সাথে সাথেই খটকা লাগে রানার। কেমন যেন রহস্যময় হাসি।
‘তুমি এখানে অফিস খুললে আমরা খুশিই হব, রানা,’ এই ছিল হুবার্ট গডফ্রের প্ৰথম কথা।
মানে? লোকটা জাদু জানে নাকি? ‘কিন্তু আমার প্রস্তাব এখনও তো আমি…’
হাত তুলে ওকে থামতে বলেন গডফ্রে। বাজনা বন্ধ করার জন্যে ক্রেডল থেকে ফোনের রিসিভার দুটো ডেস্কের উপর নামিয়ে রেখে জানান, ‘আমরা সব খবরই রাখি, রানা। দুনিয়ার সমস্ত বড় বড় শহরে অফিস খুলছ, নিশ্চয়ই আমাদের এখানেও চাইবে—এটা অনুমান করা এমন কি কঠিন?’
কিন্তু তাই বলে হুবার্ট গডফ্রের মত একজন জাঁদরেল ইন্টেলিজেন্স চীফ কোনরকম আনুষ্ঠানিকতার ধার না ধেরে এভাবে এক কথায় রাজি? কেমন যেন খটকা লেগেছে রানার। এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোন রহস্য আছে। ও জানে, এখান থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে আছে এক সবুজ-শ্যামল দেশ, সেখানে আছে কাঁচা-পাকা ভুরু কোঁচকানো যেমন রাগী তেমনি নরম এক বাহাত্তুরে বুড়ো—যাঁকে বন্ধু মনে করে গর্ব অনুভব করেন হুবার্ট গডফ্রে। কিন্তু রহস্যটা কি হতে পারে তা অনুমান করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে ওকে। প্রশ্ন করে উত্তর পাবে না জেনে জিজ্ঞেসই করেনি গডফ্রেকে।
ঠোঁটে মৃদু শিস। পন্টিয়াকের পাশে থামল রানা। কানাডা সফর সফল হয়েছে। আগামী দুটো দিন ঘুরে ফিরে বেড়ানো ছাড়া ওর আর কোন কাজ নেই। অফিসের জন্যে জায়গা নির্বাচন, অফিস সাজানো ইত্যাদি কাজগুলো কোন তদারকী প্রতিষ্ঠানকে করতে দিয়ে ইটালীতে চলে যাবে ও।
দূর থেকে ভেসে এল একটা গাড়ি স্টার্ট নেয়ার শব্দ। পকেটে হাত ভরল রানা। চাবি বের করার ফাঁকে দুটো দিক দেখে নিল ও। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কী হোলে চাবি ঢোকাবার সময় মনে হলো; বিসদৃশ কিছু একটা চোখে পড়েছে, কিন্তু কি সেটা, ঠিক ধরতে পারছে না!
আবার ঘাড় ফিরিয়ে রাস্তার বাঁ দিকে তাকাল রানা।
হৈ-চৈ উঠল চারদিক থেকে। মাত্র ছয় হাত দূরে এক লোক রাস্তা পেরোচ্ছে। অনেকটা ওরই মত শরীরের গঠন। অন্যমনস্ক। ঝড় তুলে এগিয়ে আসা গাড়িটার দিকে তাকাল একবার। ছ্যাঁৎ করে উঠল বুক। পাথরের মত জমে গেল রানা এক সেকেণ্ডের জন্যে। পরিষ্কার বুঝতে পারল বাঁচার কোন আশাই নেই লোকটার।
পরমুহূর্তে আধপাক ঘুরেই লাফ দিল রানা।
হেঁচকা টানে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটা। পিছন ফিরল। মুহূর্তের জন্যে রানা দেখল, লোকটার দু‘চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি। পরমুহূর্তে নিজেকে মুক্ত করার জন্যে টানা হেঁচড়া শুরু করল সে। দীর্ঘ তিন সেকেণ্ড চলল টানাটানি। ষাঁড়ের মত জোর লোকটার গায়ে। পরস্পরকে ওরা নিজের দিকে টানছে। এভাবে সম্ভব নয় বুঝতে পেরে আত্মরক্ষার সহজাত প্রবৃত্তি জেগে উঠল রানার মধ্যে। তবু লোকটাকে বাঁচাবার শেষ চেষ্টা করল ও। কিন্তু ল্যাঙ মেরে তাকে দূরে ফেলে দিতে গিয়ে আবিষ্কার করল, ওই শুধু নয়, লোকটাও ওকে শক্ত করে ধরে রেখেছে।
ঘাড় ফেরাল রানা। কুয়াশার ভিতর প্রকাণ্ড কালো গাড়িটাকে মাত্র সাত হাত দূর থেকে নিয়তির নির্মম পরিহাস বলে মনে হলো ওর। থমকে দাঁড়িয়ে গেছে সময়। এক সেকেণ্ডেরও কম সময়ের মধ্যে অনেকগুলো ছবি ফুটে উঠল চোখের সামনে সিনেমার পর্দার মত। রেবেকার মুখ। অনীতা, সোহানার মুখ। রাহাত খানের ভ্রূকুটি। রাঙার মা…গিলটি মিঞা …বন্ধু সোহেল…
ক্ষুধার্ত বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল গাড়িটা ওদের ওপর। ধাক্কাটা লাগতেই বিচ্ছিন্ন হয়ে ছুটে গেছে লোকটা, আলুর বস্তার মত গড়াতে গড়াতে একটা পাঁচিলে গিয়ে বাড়ি খেল তার কুণ্ডলী পাকানো শরীর।
নাকের সাথে সাঁটিয়ে নিয়ে দশ বারো হাত ঠেলে নিয়ে গেল গাড়িটা রানাকে। ড্রাইভারের বিস্ফারিত চোখ, দাঁতে দাঁতে বাড়ি খাওয়া আর নাকের উপর লাল জরুল পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে ও। হঠাৎ তীব্র একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়ি। শূন্যে নিক্ষিপ্ত হলো ও।
দশ হাত দূরে চিৎ হয়ে পড়ল রানা ফুটপাথের উপর। ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে ওর, কিন্তু ব্যথাটা ঠিক কোথায় তা বুঝতে পারছে না। এঞ্জিনের শব্দ, আর সেই শব্দকে ছাপিয়ে অনেক লোকের মিলিত চিৎকার যেন বহু দূর থেকে ভেসে আসছে। প্রাণপণ চেষ্টা করছে ও সচেতন থাকার। কিন্তু সব কিছু কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসছে। কুয়াশা কি হঠাৎ ঘন হয়ে যাচ্ছে? সন্দেহ হলো ওর। মনে হলো, চিন্তাভাবনাগুলো কেমন যেন বিক্ষিপ্ত আর ঘোলাটে হয়ে আসছে। মাত্র দু‘সেকেণ্ড হয়েছে রাস্তার উপর পড়েছে ও, কিন্তু মনে হলো কয়েক শতাব্দী পেরিয়ে গেছে গাড়িটার সাথে ধাক্কা লাগার পর। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে ও গাড়িটাকে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পিছিয়ে যাচ্ছে সেটা। হঠাৎ তীব্র একটা ঝাঁকুনি খেল। চ্যাপ্টা হয়ে গেল পিছনটা। অর্ধেকটা ঢুকে গেল একটা দেয়াল ভেঙে। ড্রাইভারকে দেখতে পাচ্ছে রানা। ভূতে পাওয়া চেহারা হয়েছে তার। ভয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে পালাবার জন্যে। বন বন করে স্টিয়ারিং হুইল ঘোরাচ্ছে সে। বাঁক নিয়ে স্যাঁত করে বেরিয়ে গেল।
সব অন্ধকার হয়ে গেল। আর কিছু মনে নেই রানার।
***
মন্ট্রিয়ল, সেন্ট জোসেফ হাসপাতাল।
মাঝারি আকারের একটা কেবিন। দুটো বেড!
দুধের মত সাদা বিছানা। পাশ ফিরল রানা। বিরাট তৈলচিত্রের মাথায় ওয়ালককটার পেণ্ডুলাম দুলছে। লাল ডায়ালের গায়ে বসানো সাদা সংখ্যাগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঘুরছে সেকেণ্ডের কাঁটা। মিনিটের কাঁটাটা দশের ঘরে স্থির হয়ে আছে। ১১-র ১ টাকে আড়াল করে রেখেছে ঘণ্টার কাঁটা। এখন রাত। ঘেরা পর্দার ওপাশ থেকে সিস্টারের নিঃশ্বাস ফেলার মদ আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
বুক ভরে শ্বাস নিল রানা। ডেটল আর ওষুধের গন্ধ ঢুকল ফুসফুসে। কিসের একটা শব্দ হলো মৃদু! সন্দেহ হলো, ঘুমের মধ্যে আবার বুঝি কাঁদছে কেনেথ।
চোখ মেলে তাকাল রানা। সাত হাত দূরে কেনেথের বেড। চোখে হাত চাপা দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে সে। কাঁদছে বলে মনে হলো না।
অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছে কেনেথ। প্রথম দুটো দিন তার জান নিয়ে যমে মানুষের টানাটানি হলেও ডাক্তার জানিয়েছে, বিপদের ভয় কেটে গেছে। পায়ের ব্যাণ্ডেজ খোলা না হলেও, কেনেথ এখন সেরে উঠছে দ্রুত।
আবার চোখ বোজে রানা। কত কথা উঁকি দিচ্ছে মনে। এক এক করে সাতাশটা দিন কেটে গেল হাসপাতালে। কবে নাগাদ ছুটি দেবে ডাক্তাররা কে জানে। ইউরোপের প্রায় অর্ধেক দেশে রানা এজেন্সির ব্রাঞ্চ খোলা হয়নি এখনও। এখান থেকে ছাড়া পেয়েই ইটালীতে যেতে হবে। হাজারটা কাজের কথা এক এক করে ভিড় করে আসছে মনে। কেন যেন ক্লান্ত লাগে।
গত ক’দিন থেকেই ভাবছে রানা, কোথায় ছিল এত ক্লান্তি? হাসপাতালে একটানা এতদিন শুয়ে থাকার সুযোগ না হলে শরীর আর মনের এই অবসাদের খবর আরও কতদিন চাপা থাকত কে জানে!
মেজর জেনারেল রাহাত খান ভুল করেননি। হঠাৎ স্বীকার করল রানা, ওকে এক বছর ছুটি দেয়ার পিছনে যথেষ্ট কারণ ছিল। সত্যিই একটা রোগ বাসা বেঁধেছে ওর শরীরে আর মনে। এ রোগ কোন ডাক্তার সারাতে পারবে না।
এক এক করে মনে পড়ে যাচ্ছে অনেক ঘটনা। গত ক’মাসে ক’টা ভুল করেছে ও! কখন কোথায় প্রকাশ পেয়েছে ওর দুর্বলতা।
রেবেকার কথাটাই ধরা যাক। প্রেম কি ওর জীবনে এর আগে আসেনি? কম মেয়ের সঙ্গে তো প্রেম করেনি ও। ক’জন বেঁচে আছে তাদের মধ্যে? কই, তাদের অভাব তো এমন করে বাজেনি ওর বুকে। এতটা তো কাহিল করে দেয়নি ওকে আর কোন ঘটনা! রেবেকার জন্যে এতটা মুষড়ে পড়ল কেন ও? এটা কি ওর মানসিক দুর্বলতারই লক্ষণ নয়? সোহানাকে কি কম ভালবেসেছিল ও রেবেকার চেয়ে? রেবেকা তো ফুরিয়ে গেছে, কিন্তু সোহানা বেঁচে থেকেও ওর কাছে মৃত। সোহানার মুখ ফিরিয়ে নেয়াটা তো এমন করে দুর্বল করে দেয়নি ওকে।
তারপর দাতাকুর কথা ধরা যাক। আগেই ও বুঝতে পেরেছিল, চরম কোন ক্ষতি না করে থামবে না সে। বোঝার পরও কেন ও দাতাকুকে পথ থেকে সরায়নি? কেন আবোল-তাবোল ভেবে তাকে সুযোগ করে দিল রেবেকাকে খুন করার? কেন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি ও আরও আগে? এ ঘটনা থেকে কি প্রমাণ হয় না, আগের চেয়ে অনেক বেশি নরম হয়ে পড়েছে ও?
পাহাড়ে আগেও অসংখ্যবার চড়েছে ও। কখনও কি নিচে পড়ে যাবার ভয়ে হাত-পা কেঁপেছে? কাঁপেনি। কিন্তু ভূমিকম্পের দ্বীপে যতবার পাহাড়ে চড়েছে, ততবারই অ্যাক্রোফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ও। কি প্রমাণ হয় এ থেকে?
খুঁজলে এ-ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি আর দুর্বলতা পাওয়া যাবে অসংখ্য। স্যার ফ্রেডারিকের কুমতলব আরও অনেক আগেই কি টের পাওয়া উচিত ছিল না ওর? টের পাবার পরই বা নিজেকে রক্ষার জন্যে কি ব্যবস্থা নিতে পেরেছিল সে? থোর্সহ্যামার যদি না পৌছত, কিভাবে ফিরত ও থম্পসন আইল্যাণ্ড থেকে? তারপর, অত শত কোটি টাকার সিজিয়াম, সেগুলো বরফের নিচে চাপা ফেলে দেয়ার মধ্যে কৃতিত্ব কোথায়? মানব সভ্যতার উপকারে সেগুলোকে কাজে লাগাবার কোন চেষ্টা না করার কারণ হিসেবে যত অজুহাতই খাড়া করা যাক, সেগুলোর একটাও কি ধোপে টেকে? উদ্ধার করে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে পারেনি, তাই নিজেকে যা তা কিছু একটা বুঝিয়ে সান্ত্বনা দিয়েছিল ও। কি প্রমাণ হয় এসব থেকে?
বিশ্রাম চাই। ক্লান্তির শিকল ছিঁড়ে মুক্তি চাই। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নয়, ওর যা দরকার তা হলো নিপাট বিশ্রাম, বিনোদন, নিজেকে আনন্দ আর বৈচিত্র্যের মধ্যে হারিয়ে ফেলা। বছরের পর বছর ধরে একের পর এক অ্যাসাইনমেণ্টে নার্ভের পরীক্ষা দিতে দিতে মরচে ধরে গেছে শরীর আর মনের খুচরো যন্ত্রাংশে। মাজাঘষা করে আবার চকচকে করতে হবে পার্টগুলোকে। তোমাকে শত কোটি সালাম, বজ্জাত বাহাত্তুরে বুড়ো মেজর জেনারেল রাহাত খান ওরফে কাঁচাপাকা ভুরু ওরফে সবজান্তা!
হিস্! সাপের মত শব্দ হতে চমকে ওঠে রানা। চোখ মেলতেই দেখল ওর মুখের উপর ঝুঁকে পড়েছে কেনেথ। ঠোটে আঙুল। দু‘চোখে সতর্ক দৃষ্টি।
বুড়ো আঙুল বাঁকা করে নিজের কাঁধের উপর দিয়ে পিছনের পর্দা ঘেরা কেবিনটা দেখাল কেনেথ। ‘সিস্টার ঘুমিয়ে পড়েছে, রানা। এই-ই সুযোগ!’
উজ্জ্বল হয়ে উঠল রানার মুখ। হিস্ করে শব্দ করল ও। ঠোঁটে আঙুল। ‘আস্তে! জেগে উঠলে মারমার কাটকাট শুরু করে দেবে। কিন্তু, কেনেথ, সিগারেট না হয় আমি যোগাড় করছি, আগুন পাব কোথায়?’
‘কেন, আমার লাইটার কি হলো?’
‘বলিনি বুঝি তোমাকে? শরীর স্পঞ্জ করবার সময় লালচুলো নার্সটা ওটা দেখে ফেলে সিজ করে নিয়ে গেছে।’
রানার বেডে ধপ করে বসে পড়ল কেনেথ। এক হাত দিয়ে তার ব্যাণ্ডেজ বাঁধা পা-টা বিছানায় তুলে দিল রানা।
‘তাহলে উপায়?’
‘দাঁড়াও, চিন্তা করে দেখি,’ নিজের মাথায় তর্জনী দিয়ে টোকা দিতে দিতে বুদ্ধি বের করার চেষ্টা করছে রানা। ‘আচ্ছা, কেনেথ, ধরো, হঠাৎ কারেন্ট অফ হয়ে গেল। তখন কি হবে?’
‘কি আবার হবে, অন্ধকার হয়ে যাবে কেবিন।’
‘ঠিক তখন যদি গেছিরে, বাঁচাও রে বলে চেঁচিয়ে উঠি আমি?’
রানার পিঠে চাপড় মারল কেনেথ। ‘বুঝেছি! তুমি বলতে চাইছ, নিশ্চয়ই সিস্টারের কাছে ম্যাচ বা লাইটার আছে, দরকারের সময় মোমবাতি জ্বালার জন্যে। রানা, দাও তাহলে আলোটা অফ করে। দাঁড়াও, তার আগে আমার বেডে ফিরে যাই আমি। তুমি আলো অফ করলেই আমি চিৎকার জুড়ে দেব।’
চিন্তিত দেখাচ্ছে রানাকে।
‘কি ভাবছ আবার?’
‘অসুবিধে আছে।’
‘কি রকম?’
সিস্টারকে না হয় মাথা ধরেছে বা পেট ব্যথা করছে যা হোক কিছু একটা বলে নিস্তার পাওয়া যাবে, কিন্তু সিরিয়াস রোগী হিসেবে ট্রিট করা হচ্ছে আমাদেরকে, একবার ঘুম ভাঙলে তাকে তো আর দ্বিতীয়বার ঘুম পাড়ানো যাবে না।
‘তাই তো! তাছাড়া, মোমবাতি জ্বালার আগে যদি সুইচ অন আছে কিনা দেখতে চায়?’
‘উঁহুঁ,’ গম্ভীর ভাবে বলল রানা,’ ঘুম কোনমতেই ভাঙানো চলবে না। কেনেথ, উপায় মাত্র একটাই দেখতে পাচ্ছি।’
‘কি?’
‘লাইটার বা ম্যাচ সিস্টারের কাছে আছে, ঠিক তো?’
‘ধরে নিচ্ছি আছে।’
‘সেটা চুরি করতে হবে।’
‘কিন্তু ঠিক কোথায় আছে জানব কিভাবে?’
‘হাতড়ে জানতে হবে!’
‘মেয়েমানুষের গায়ে হাত দেব?’ চাপা কণ্ঠে কথা বলছে কেনেথ। ‘যদি চিৎকার করে ওঠে? যদি…’
‘ঝুঁকিটা ভয়ঙ্কর!’ স্বীকার করল রানা। ‘গিলটি মিয়ার কাছে অবশ্য এসব কাজ নস্টি। কিন্তু তাকে তো পাচ্ছি না…’
‘গিলটি মিয়া কে?’
‘তাকে তুমি চিনবে না,’ বলল রানা। ‘শোনো, ঝুঁকিটা নিতেই হবে, বুঝলে? দু‘টান যদি দিতে না পারি…’
‘দম আটকে মরে যাব বলে মনে হচ্ছে আমার,’ ঢোক গিলতে গিলতে বলল কেনেথ। ‘কিন্তু মেয়েমানুষের গায়ে হাতই বা দিই কিভাবে?’
মাথায় হাত দিয়ে ডুব দিল রানা গভীর চিন্তায়। স্কুল-জীবনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে ওর। হোস্টেলে থাকার সময় সুপারিনটেনডেন্টকে লুকিয়ে সিগারেট খাওয়ার মধ্যে যে রোমাঞ্চ ছিল সেই রোমাঞ্চের স্বাদ আবার যেন ফিরে এসেছে এই মুহূর্তে।
‘ইস্!’
ঝট করে রানার দিকে মুখ বাড়িয়ে দিল কেনেথ। ‘কি হলো?’
‘আমি একটা বুদ্ধু’ এদিক ওদিক মাথা দোলাল রানা। ‘কেনেথ, পেট ফুলে মরে গেলেও কিছু করার নেই আমাদের। সিগারেট খাওয়ার আশা ছেড়ে দাও।’
‘কেন, হঠাৎ কি হলো?’
‘সিস্টারের কাছে ম্যাচ বা লাইটার আছে এটা কোন্ বুদ্ধিতে ধরে নিচ্ছি আমরা? থাকার কথা টর্চ, এবং আছেও তাই। বুঝলে? অর্থাৎ, বুড়ো আঙুল চোষা ছাড়া কোন উপায় নেই।’
শুকিয়ে গেল কেনেথের মুখ। দেখে মায়া লাগল রানার। ‘মন খারাপ কোরো না, দাঁড়াও, ভেবে দেখি কি করা যায়। ডিউটি যদি আজ সিস্টার লোরার থাকত চিন্তার কিছু ছিল না। বুড়ি চেইন স্মোকার। সিগারেট লাইটার ছাড়া এক পা হাঁটে না।’
‘আমাদের জন্যে তাহলে বুড়িই ভাল।’
হেসে ফেলল রানা। ‘তা ঠিক। আজ তার ডিউটি তিন নম্বর ওয়ার্ডে। কিন্তু বুড়িকে আজ রাতে পাচ্ছ কোথায়? পা টিপে টিপে গিয়ে দেখে আসব নাকি ঘুমাচ্ছে কিনা?’
‘যাবে?’ আগ্রহে চক্চক করছে কেনেথের চোখ দুটো।
‘যেতে আপত্তি নেই আমার,’ বলল রানা। গম্ভীর। ‘কিন্তু ব্যাপারটা তাহলে আর চুরি থাকে না। ডাকাতি হয়ে যায়।’
‘কিন্তু ভেবে দেখো, লাইটারের সাথে যদি একটা প্যাকেটও আনতে পারো, সারারাত ধরে যত ইচ্ছা ফুঁকতে পারি…’
বেড থেকে নেমে পড়ল রানা। ‘দেরি করার মানে হয় না আর, কি বলো?’ পর্দা ঘেরা কেবিনের দিকে এগোল ও।
‘ওদিকে কোথায় যাচ্ছ?’ কেনেথের চাপা কণ্ঠে বিস্ময়।
‘টর্চটা আনতে যাচ্ছি,’ বলল রানা, ‘বাইরে তো অন্ধকার।’ সন্তর্পণে মোটা কাপড়ের পর্দা সরিয়ে মাথাটা গলিয়ে দিল রানা। তারপর ভিতরে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে কেনেথ। কি না কি ঘটে! সিস্টার ইজেল যদি চিৎকার করে ওঠে? পর্দা দুলে উঠল। রানাকে দেখে ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এল তার। হঠাৎ খটকা লাগল। অমন হাসির কি হলো ওর?
হাসতে হাসতে কেনেথের সামনে এসে দাঁড়াল রানা। পিছন থেকে হাত দুটো সামনে আনতেই কেনেথের চাক্ষু চড়কগাছ। দু‘প্যাকেট সিগারেট আর লাইটার রয়েছে রানার হাতে।
‘ডিউটি দিচ্ছে বুড়ি তা তো জানতাম না!’ বেডের উপর পা ঝুলিয়ে বসল রানা, ওর আর কেনেথের মাঝখানে রাখল প্যাকেট আর লাইটারটা। ‘পোড়া আধখানা সিগারেট বাথরূমে লুকানো আছে, সেটা রিজার্ভ থাক, কি বলো? ঠেকা বেঠেকায় কাজে লাগবে।’
‘সব নিয়ে চলে এসেছ?’ একটা প্যাকেট খুলতে খুলতে বলল কেনেথ।
‘একটা চুরি করা যা, দু‘প্যাকেট চুরি করাও তা,’ বলল রানা। কেনেথের হাত থেকে একটা সিগারেট নিল ও। লাইটার জ্বেলে নিজেরটা ধরাল, তারপর সাহায্য করল কেনেথকে ধরাতে। ‘এতদিনের অত্যাচারের প্রতিশোধ নেব আমরা। সারারাত ধরে সবগুলো সাবাড় করব ’
পরম তৃপ্তির সাথে সিগারেটে টান দিচ্ছে কেনেথ। রানাকে সমর্থন করল সে মাথা নেড়ে।
‘ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে আমার, বুঝলে?’ বলল রানা, কষে একটা টান দিল সিগারেটে। তারপর মুখ তুলে সিলিঙের দিকে গোলাকার বৃত্ত ছাড়ল কয়েকটা। হঠাৎ ওর খেয়াল হলো, কেনেথ ওর কথার উত্তরে কিছু বলেনি।
ফিরল রানা কেনেথের দিকে। চমকে উঠল ও। উদভ্রান্ত দেখাচ্ছে কেনেথকে। ফর্সা মুখটা কালচে দেখাচ্ছে। দৃষ্টিটা সাদা দেয়ালের গায়ে স্থির। মৃদু কাঁপছে ঠোঁট দুটো। সিগারেট খাওয়ার দিকে মন নেই তার। দু‘আঙুলের ফাঁকে পুড়ছে সেটা।
‘কেনেথ!’
সাড়া পেল না রানা! কেনেথের কাঁধ ধরে নাড়া দিল ও। ‘হঠাৎ কি হলো তোমার?’
‘উহু!’ অন্যমনস্কভাবে শব্দটা উচ্চারণ করল কেনেথ। উদভ্রান্ত দৃষ্টিটা অদৃশ্য হলেও, দেয়ালের দিক থেকে চোখ ফেরাল না সে।
আজ আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে রানা কেনেথকে। বয়স ধরার কোন উপায় নেই তার। হাসপাতালের বেডে প্রায় উন্মুক্ত শরীরে দেখেছে তাকে ও। কোন মানুষের গায়ে এমন দাগ আর ক্ষতচিহ্ন থাকতে পারে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করত না ও। কেনেথের গোটা শরীরের চামড়া কেন কে জানে তুলে ফেলা হয়েছে। গোটা মুখে প্লাস্টিক সার্জারি। অত্যন্ত নিপুণভাবে সার্জারি করা হলেও, চুলের মত সূক্ষ্ম রেখাগুলো ওর চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি। সম্ভবত প্লাস্টিক সার্জারি করার ফলেই যা বয়স তার চেয়ে বেশি দেখায়।
কেনেথ সম্পর্কে গত ক’দিন থেকেই অনেক কথা উকি-ঝুঁকি মারছে রানার মনে। ওকে লুকিয়ে কাঁদতে দেখেছে ও। কি যেন একটা দুঃখ আছে ওর জীবনে। ব্যর্থ প্রেম?
উঁহুঁ তা নয়, ভাবছে রানা। কেনেথ ব্যর্থ প্রেমের জন্য কাঁদবে এটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না ওর। তার কারণ, দুটো হপ্তা একসাথে ওঠাবসা গল্প-গুজব করার ফলে, পরিষ্কার বুঝেছে ও, কেনেথ সাধারণ লোক নয়, অত্যন্ত বুদ্ধিমান সে এবং মেধাবী। পরিশীলিত একটা মন আছে তার। সুন্দর রুচির অধিকারী। এরকম একজন লোকের জন্যে বরং মেয়েদেরই কাঁদা উচিত।
রানার কৌতূহল বেড়েছে আরও নানা কারণে। গল্প করার সময় ওর সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলেই রহস্যজনকভাবে চুপ করে গেছে কেনেথ। ‘ছোটবেলায় মানুষ হয়েছ কোথায়?’ ক’দিন আগে এই প্রশ্নটা করেছিল রানা। উত্তর তো দেয়ইনি কেনেথ, চোখের পানি লুকাবার জন্যে হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে সে, সিস্টারকে ডাকাডাকি শুরু করে দেয়। সিস্টার ছুটে আসতে তাকে বলে, হঠাৎ প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়েছে ওর মাথায়।
পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিল রানা, সবটাই কেনেথের অভিনয়। কি যেন চেপে রাখতে চাইছে সে।
শুধু জেগে নয়, ঘুমের মধ্যেও কাঁদতে দেখেছে রানা তাকে।
আর এক রহস্য হলো, দুর্ঘটনার ফলে রানার পরিচয় খবরের কাগজে প্রকাশ না পেলেও,আলবার্ট কেনেথের পরিচয় ছাপা হয়েছে। দুর্ঘটনার সময়, রানার হাতে যে অ্যাটাচী কেসটা ছিল সেটা ছিটকে দূরে কোথাও পড়ে যায়। পরে সেটা আর পাওয়া যায়নি। দরকারী কিছু কাগজপত্র সহ কিছু কানাডিয়ান ডলারও ছিল ওতে। কোনও লোভী লোকের হাতে পড়ায় সেটা আর পুলিসের হাতে যায়নি।
এ একদিক থেকে ভালই হয়েছে রানার জন্যে। বিশ্রামটা পুরোপুরি উপভোগ করতে পারছে ও, ভিজিটরদের হাঙ্গামা পোহাতে হচ্ছে না। কিন্তু কেনেথের পরিচয় প্রকাশ পাওয়া সত্ত্বেও কেউ তাকে দেখতে আসে না। কেন?
ভুল হলো। কেউ আসে না তা নয়, এক বুড়ো ভদ্রলোক আসে। কিন্তু তার সাথে কেনেথ দেখা করে না। গত পাঁচ ছয় দিন ধরে প্রতিদিনই সন্ধ্যার সময় সিস্টার একটা ভিজিটিং কার্ড এনে দেয় কেনেথকে, জানায়, সেই মি. লংফেলো ভদ্রলোক আজ আবার এসেছেন আপনার সাথে দেখা করতে…
কেনেথ দেখা করে না!
দেখা করতে না পারলেও, রোজ মি. লংফেলো সিস্টারের হাতে এক তোড়া ফুল পাঠিয়ে দেয় কেনেথের জন্যে।
দেখার সুযোগ না ঘটলেও, সিস্টারের মুখে বর্ণনা শুনে বুড়োর চেহারা সম্পর্কে একটা ছবি কল্পনা করে নিয়েছে রানা: সত্তর বছরের উপর বয়স। দাড়ি-গোঁফ-চুলে পাক ধরেছে। পুরানো মডেলের গোল্ড ফ্রেমের গোল বাইফোকাল চশমা। চেহারা দেখে বয়স বোঝার উপায় নেই। বুদ্ধিদীপ্ত চোখা হাবভাব। শিরদাঁড়া এখনও খাড়া করে হাঁটে!
কেন যে বুড়োর সাথে দেখা করতে চায় না কেনেথ বুঝতে পারে না রানা। কেনেথকে কাছ থেকে দেখতে দেখতে কৌতূহলটা বেয়াড়া হয়ে উঠল রানার। ঠিক করল, আজ তাকে চেপে ধরতে হবে, জানতে হবে কিসের দুঃখ তার।
আড়চোখে কেনেথের হাতের দিকে তাকাল রানা। দু‘আঙুলের ফাঁকে সিগারেটটা পুড়তে পুড়তে তিনভাগের দু‘ভাগ ইতিমধ্যে শেষ। আঙুলে ছ্যাঁকা না লাগা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে, ঠিক করল রানা। সংবিৎ ফিরলে চেষ্টা করবে কথা বলাতে।
খানিক বাদে চমকে উঠেই হাত ঝাড়া দিল কেনেথ। আঙুলের ফাঁক থেকে পড়ে গেল সিগারেটটা মেঝেতে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছিল, রানার উপস্থিতি সম্পর্কে হঠাৎ সচেতন হতে সেটাকে দমন করল মাঝপথে কেনেথ।
রানার দিকে ফিরল কেনেথ। একটা অসহায় ভাব ফুটে আছে তার চেহারায়। ‘কি ব্যাপার! কি চিন্তা করো এত তুমি?’ নরম গলায় বলল রানা। প্রায়ই দেখি একা একা গালে হাত দিয়ে কি যেন ভাবছ। তোমাকে আমি লুকিয়ে কাঁদতেও দেখেছি, কেনেথ।
ঠিক লজ্জা পেল তা নয়, রানার মনে হলো, অসহায় ভাবটা আরও যেন প্রকট হয়ে ফুটল তার চেহারায়। ঠোঁট দুটো নড়ল; কি যেন বলতে চাইছে। কিন্তু হঠাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে অন্যদিকে তাকাল সে।
আবার সেই কাণ্ড। চোখের পানি লুকাতে চাইছে কেনেথ।
সহানুভূতির হাত রাখল রানা কেনেথের কাঁধে। ‘তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে হয়তো মাথা ঘামানো হয়ে যাচ্ছে, কেনেথ, কিন্তু তোমাকে দেখে আমি ক’দিন থেকেই ভাবছি, কিছু একটা গণ্ডগোল আছে তোমার জীবনে। তোমার যদি আপত্তি না থাকে, আমাকে সব কথা বলতে পারো। বন্ধুত্বের দাবিতেই জানতে চাইছি আমি, কেনেথ। এমন হতে পারে, সব কথা বলার জন্যে তুমি হয়তো কাউকে খুঁজছ, কিন্তু সঙ্কোচ কাটিয়ে উঠে বলতে পারছ না। চেপে রাখা কথা কাউকে বলে ফেলতে পারলে মনের ভার হালকা হয়। তুমি যদি মনে করো…’
হঠাৎ ঝট্ করে ফিরল কেনেথ রানার দিকে। ‘আমাকে দেখে কি মনে হয় তোমার, রানা? কত বয়স হবে আমার অনুমান করতে পারো?’
একটু চিন্তা করল রানা। তারপর বলল, ‘দেখে মনে হয় বেশি, কিন্তু তা প্লাস্টিক সার্জারীর জন্যে। আমার ধারণা; পঁচিশ থেকে ত্রিশের বেশি হবে না তোমার বয়স। কিন্তু হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন, কেনেথ?’
‘বাইশ বছর বয়সে আমার জন্ম হয়; অদ্ভুত ধীর, শান্ত গলায় কথাগুলো বলল কেনেথ, ‘এখন আমার বয়স আট, রানা।’
কেনেথের কণ্ঠস্বরে, বলার ভঙ্গিতে এমন একটা কিন্তু ছিল, গায়ের রোম খাড়া হয়ে উঠল রানার। শির শির করে উঠল মাথার পিছনটা। ‘কি বলছ তুমি! পরিষ্কার করে বলো, কেনেথ।’
ধীরে ধীরে প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে নিল কেনেথ লাইটার জ্বেলে সেটা ধরিয়ে দিল রানা।
‘জন্মের পর প্রথম যা আমি স্মরণ করতে পারি তা হলো প্রচণ্ড যন্ত্রণা, রানা,’ নিচু গলায় বলছে কেনেথ। ‘জন্মাবার সময় কি রকম ব্যথা পায় মানুষ সে অভিজ্ঞতা দুনিয়ার আর কারও আছে কিনা আমি জানি না। ঈশ্বর যেন সে অভিজ্ঞতার মধ্যে কাউকে না ফেলেন। সেই অসহ্য ব্যথা হজম করে বেঁচে থাকার জন্যে প্রাণপণ লড়াই করি আমি, এবং বেঁচে যাই। পরে ডাক্তাররা আমাকে জানায়, ওষুধ প্রয়োগ করার ফলে অত কষ্ট হয় আমার। ব্যথা কমবার সাথে সাথে আমি জ্ঞান হারাই।’
ভুরু কুঁচকে উঠেছে রানার। গোগ্রাসে গিলছে ও কেনেথের কথা।
‘একনাগাড়ে ছয় সপ্তাহ অজ্ঞান ছিলাম। তারপর জ্ঞান ফিরেছে আর গেছে, ফিরেছে আর গেছে—এভাবে আরও তিন মাস কেটে যায়। এর আরও দেড় মাস পর আমার পা, হাত, কোমর, বুক আর চোখ থেকে ব্যাণ্ডেজ খোলা হয়।’
‘কোন হাসপাতালে ছিলে তুমি?’
‘হ্যাঁ,’ বলল কেনেথ, ‘কুইবেক সেন্ট্রাল হসপিটালে। ডাক্তার শেফিল্ড আমার দেখাশোনা করতেন। তিনিই আমাকে জানান, আমার নাম আলবার্ট কেনেথ আমার বয়স বাইশ। নাম শুনে বোকার মত তাকিয়ে ছিলাম আমি। অনেকক্ষণ চুপ করে চিন্তা করি। তারপর জিজ্ঞেস করি, ‘আলবার্ট কেনেথ’? ড. শেফিল্ড বলেছিলেন, ‘কেনেথই তো! তোমার নাম কেনেথ না?’ পরে আমাকে জানানো হয়, আমি নাকি এই প্রশ্ন শুনে উন্মাদের মত চিৎকার করতে শুরু করি। চিৎকারের কথাটা আমার স্মরণ নেই, ‘শুধু মনে আছে, ড. শেফিল্ডের কথা শোনার পর আমি আমার অতীত, নিজের পরিচয় ইত্যাদি স্মরণ করার চেষ্টা করি এবং হঠাৎ আবিষ্কার করি কিছুই আমার মনে পড়ছে না—বুঝতে পারছি না আমি কে! আমি কে! কোথা থেকে এলাম।’
কেনেথের দু‘চোখ ভরে ওঠে পানিতে। নিজের তোয়ালেটা এগিয়ে দেয় রানা। ধীরে ধীরে চোখমুখ মোছে কেনেথ।
‘ড. শেফিল্ড ছিলেন স্কিন স্পেশালিস্ট। ডাক্তারদের একটা টীমের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি। তিনি বুঝতে পারেন শারীরিক ত্রুটি বিচ্যুতি ছাড়াও মহা একটা গণ্ডগোল আছে আমার মধ্যে। তাই, তাঁরই উদ্যোগের ফলে ড. মারকোভেলীকে নেয়া হয়। ড. মারকোভেলী অল্প ক’দিনেই আমার ঘণিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন। তিনি যে রকম ভালবাসতেন আমাকে, নিজের ছেলেকেও মানুষ বুঝি এতটা ভালবাসে না। তাঁর মুখ থেকেই সব শুনেছি আমি। ‘আমি কে? কেন কিছু মনে করতে পারছি না’, আমার এই ধরনের প্রশ্নের উত্তরে নরম গলায় তিনি আমাকে সান্ত্বনা দিতেন। তাঁর বক্তব্যের সারমর্ম ছিল এই রকম: একটা দুর্ঘটনায় পড়েছিলাম আমি। তার ফলে আমার স্মরণশক্তি লোপ পেয়েছে। স্মরণশক্তি লোপ পাবার অনেক ধরন আছে। আমি সবচেয়ে মারাত্মক অ্যামনেশিয়ার শিকার! আমার মেধা, জ্ঞান ইত্যাদি সবই অটুট আছে, কিন্তু ব্যক্তিগত সমস্ত সম্পর্কের কথা বেমালুম মুছে গেছে আমার স্মৃতি থেকে। কোথায় জন্মেছি, কোথায় ছিলাম, কে আমার মা, কে আমার বাবা, আমরা কয় ভাই-বোন, বন্ধুদের নাম কি, তারা দেখতে কেমন, প্রতিবেশীদের কথা—এই রকম হাজার হাজার ব্যাপার আমি কিছুই স্মরণ করতে পারব না কোনদিন। কিন্তু জিওলজির ছাত্র হিসেবে আমি কলেজে যা শিখেছি তা কিছুই ভুলিনি, ভুলিনি দুনিয়া সম্পর্কে যত জ্ঞান অর্জন করেছিলাম তার এতটুকুও।’
‘কিন্তু স্মরণ করতে পারো বা না পারো, তোমার অতীত সম্পর্কে ডাক্তার মারকোভেলী তোমাকে কিছু বলেননি?’
‘আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি আমাকে জানান, একটা রোড অ্যাক্সিডেন্টের শিকার হয়েছিলাম। দুর্ঘটনাটা ঘটে ডসন ক্রীক এবং এডমনটনের মাঝখানে। মজার কথা হলো, রানা, দুর্ঘটনার কথা মনে না পড়লেও জায়গাটা আমি চিনি।’
‘তারপর?’
‘অনেক ইতস্তত করার পর ডা. মারকো আমাকে বলেন, যতদূর আমরা জানি, তোমার নাম আলবার্ট কেনেথ। আর কিছু জানতে চাও তুমি? আমি বলি, চাই। জানতে চাই কি করতাম আমি, কিভাবে দুর্ঘটনাটা ঘটে— সব, সব জানতে চাই আমি। ডাক্তার বলেন, তুমি ভ্যানকুভারের ইউনিভারসিটি অভ ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ছাত্র ছিলে। মনে পড়ে? আমি বলি, না। হঠাৎ তিনি প্রশ্ন করেন আমাকে, ‘যফেট কাকে বলে’? উত্তরে আমি বলি, ‘মাটিতে একটা গর্ত যা থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড বেরোয়, ভলকানিক ইন অরিজিন’—উত্তর দেবার পর অবাক হয়ে তাকাই তাঁর দিকে, প্রশ্ন করি, ‘এসব আমি জানলাম কিভাবে’? ডাক্তার বললেন, তুমি জিওলজির ওপর পড়াশোনা করছিলে। কেনেথ, তোমার বাবার দেয়া ডাক নামটা মনে করতে পারে? আমি বলি, না। তিনি কি বেঁচে আছেন? ডাক্তার বলেন, না। আচ্ছা, কেনেথ, ধরো আরভিং হাউজ, ওয়েস্টমিনিস্টারে গেলে তুমি কি দেখতে পাবার আশা করো সেখানে? উত্তরে আমি বলি, একটা মিউজিয়াম। আবার তিনি প্রশ্ন করেন, ক’ভাই-বোন তোমরা? আমি বলি, জানি না। তিনি জানতে চান, কোন্ রাজনৈতিক পার্টির সমর্থক তুমি? আমি জানাই, জানি না। এই ভাবে চলতে থাকে রানা। একের পর এক প্রশ্ন করেন তিনি। বেশির ভাগেরই উত্তর দিতে পারি না আমি।’
‘বলে যাও, কেনেথ।’
‘ধীরে ধীরে সব জানানো হয় আমাকে। কানাডার সবচেয়ে নামী প্লাস্টিক সার্জেনকে দিয়ে চেহারাটা পাল্টানো হয় আমার। তার আগে বীভৎস দেখতে ছিলাম আমি। মুখের এক বিন্দু জায়গা ছিল না যেখানের চামড়া পোড়েনি। রহস্যময় ব্যাপার হলো, অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি প্রতিমাসে আমার যাবতীয় খরচ, চিকিৎসার ব্যয় বাবদ যত টাকা লাগে পাঠিয়ে দিত ডা. শেফিল্ডের ঠিকানায়। লোকটা নিজের পরিচয় জানায়নি কখনও। প্রতি মাসে তিন হাজার ডলারের একটা চেক আসত নিয়মিত। এনভেলাপে চেক ছাড়া ছোট্ট একটুকরো কাগজ থাকত। তাতে টাইপ করা থাকত একটা লাইন: আলবার্ট কেনেথের যত্ন নেয়ার জন্যে এই টাকা পাঠানো হচ্ছে। ড. মারকোকে আমি বলি, এই সূত্র ধরেই হয়তো জানা যেতে পারে আমার পরিচয়। কিন্তু তিনি আমাকে নিরাশ করেন।’
‘কি রকম?’
‘ডাক্তার মারকো বলেন, তোমার অতীত সম্পর্কে কিছু খবর আমি সংগ্রহ করেছি। কিন্তু সে খবর তোমাকে জানাবার কোন ইচ্ছে আমার নেই। কেনেথ, আমি এমন একজন ডাক্তার, যে তার রোগীকে স্বাভাবিক করে তোলার চেয়ে সুখী করতে বেশি আগ্রহী। আমি চাই তুমি সুখী হও, তাই একটা পরামর্শ দিতে চাই, নিজের অতীত সম্পর্কে কোনদিন কিচ্ছু জানবার চেষ্টা কোরো না।’
‘কেন! নিজের অতীত জানার অধিকার প্রত্যেকের আছে…’
‘পরে আমার জেদ দেখে ডাক্তার মারকো সব কথাই বলেন আমাকে সংক্ষেপে আমি ছিলাম এই রকম, রানা: আমি ভূমিষ্ঠ হবার পরপরই আমার মাকে আমার বাবা ত্যাগ করে চলে যান, তিনি বেঁচে আছেন কিনা, থাকলেও কোথায় আছেন কেউ জানে না। আমার যখন দশ বছর বয়স, তখন আমার মা মারা যান। আমার মায়ের সত্যিকার পরিচয় হলো, মাত্র এক ডলারের বিনিময়ে যে-সে যেকোন ধরনের বিকৃত রুচি চরিতার্থ করে নিতে পারত তাকে দিয়ে এবং আমার বাবা, যার ঔরসে আমার জন্ম, তার সাথে আমার মায়ের বিয়ে হয়নি। মা মারা যাবার পর আমাকে এতিমখানায় পাঠানো হয়। সেখান থেকে স্কুলে ভর্তি করা হয় আমাকে। তারপর কলেজে এবং ইউনিভার্সিটিতে। আমার কোন আত্মীয়স্বজন ছিল না।’
প্যাকেট থেকে দুটো সিগারেট বের করে একটা দিল রানা কেনেথকে। দুটো সিগারেটেই আগুন ধরাল।
‘স্কুলের উঁচু ক্লাসে থাকতেই বখে যাই আমি। গুণ্ডামি পাণ্ডামি শুরু করে দিই। আমাকে শাসন করার জন্যে এতিমখানা এবং স্কুল কর্তৃপক্ষ চেষ্টার কোন ত্রুটি করেননি। কিন্তু লাভ হয়নি তাতে কিছু, দিনে দিনে আমি আরও খারাপ হয়ে যাই। কলেজ লাইফে অসৎ ছেলেদের নিয়ে দল গঠন করি আমি। চুরি-চামারি, ছিনতাই, রেপ ইত্যাদি কাজে এক্সপার্ট হয়ে উঠি। তারপর ভার্সিটি লাইফ। আরও ভয়ঙ্কর আর বেপরোয়া জীবন যাপন শুরু করি তখন। গাঁজা ছিল আমার নিত্য সহচর। চারটে ডাকাতি কেসে জড়িত ছিলাম আমি। পুলিস আমাকে কয়েকবার গ্রেফতার করে, যদিও প্রমাণের অভাবে বিচারে আমার শাস্তি হয়নি একবারও। পুলিসের খাতায় অন্তত তিনশো জায়গায় নাম লেখা আছে আমার। দুটো হত্যার ব্যাপারেও তারা আমাকে সন্দেহ করত। আরও শুনতে চাও, রানা?’
‘তোমার যদি খারাপ না লাগে, সব কথা বলে ফেলো, কেনেথ।’
‘খারাপ লাগছে না,’ হঠাৎ হাসল কেনেথ, ‘কারণ, এর কোন কিছুই আমার মনে নেই। শুধু যে মনে নেই তা নয়, বড় বড় কয়েকজন ডাক্তার আমাকে পরীক্ষা করে রায় দিয়েছেন, প্রথম জন্মের খারাপ কোন অভ্যাস, স্বভাব, প্রকৃতি—যাই বলো, কিছুই অবশিষ্ট নেই আমার মধ্যে। ডাক্তার মারকোর ভাষায়, আমি একজন সম্পূর্ণ নতুন মানুষ। পরিশীলিত, বুদ্ধিমান, রুচিবান, বিবেকসম্পন্ন একজন আদর্শ মানুষ, নিখুঁত ভদ্রলোক। দুর্ঘটনার আগের কেনেথের সঙ্গে দুর্ঘটনার পরের কেনেথের না চেহারায়, না ব্যক্তিত্বে কোথাও এক বিন্দু মিল নেই—দু‘জন সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ।’
‘বিশ্বাস না করে উপায় নেই,’ বলল রানা, ‘তোমাকে এই ক’দিন দেখে যতটুকু বুঝেছি, তাতে বিশ্বাস হয় না অসামাজিক কোন কাজ করা তোমার দ্বারা সম্ভব। সে যাক, তুমি শেষ করো কথাগুলো।’
‘মারিজুয়ানা শুধু যে খেতাম তাই নয়, ভার্সিটির ছেলেদের কাছে বিক্রি করে ব্যবসাও করতাম পুরোদমে। এর জন্যে পুলিস আমাকে চোখে চোখে রাখত। তুমি তো জানো, ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় মারিজুয়ানা খাওয়া বা বিক্রি করা কঠোর দণ্ডযোগ্য অপরাধ। শেষ ঘটনাটা হলো, একটা আড্ডাখানায় ক্রেতাদের নিয়ে নেশা করছি, এমন সময় পুলিস জায়গাটা ঘেরাও করে। আমি ছাদে উঠে পাশের বিল্ডিঙে চলে যাই, ওখান থেকে পালাই। পুলিস আমাকে ধাওয়া করে। পুলিসের দল অনেকটা পিছনে ছিল। রাস্তায় উঠে আমি একটা গাড়ি দেখতে পাই। সেই গাড়িতে এক দয়ালু লোক ছিলেন। তাঁর নাম ক্লিফোর্ড। তিনি আমাকে একটা লিফট দেন। এর পরের ঘটনাই নাকি অ্যাক্সিডেন্ট। সে-অ্যাক্সিডেন্টে ক্লিফোর্ড মারা যান, তাঁর স্ত্রী মারা যান, তাঁর একমাত্র ছেলেও মারা যায়। আর আমিও, ডাক্তার মারকোর ভাষায়, আটভাগের সাতভাগ মরে গিয়েছিলাম, কোনমতে বেঁচে ছিলাম মাত্র এক ভাগ। ’
‘তারপর?’
‘ডাক্তারকে আমি প্রশ্ন করি, ক্লিফোর্ডদেরকে কি খুন করেছিলাম আমি? তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমার বিশ্বাস, সেটা স্রেফ এটা দুর্ঘটনাই ছিল। কিন্তু, রানা, আমার মনে হয় ব্যাপারটা ঠিক তা নয়…হয়তো, কে জানে, পালাবার একটা কৌশল হিসেবে ওদের তিনজনকে আমিই খুন করেছিলাম।’
‘যা করেছ কিনা মনে পড়ে না তা নিয়ে মন খারাপ করার কিছু নেই, কেনেথ! ’
‘তা ঠিক,’ বলল কেনেথ। সত্যি কি ঘটেছিল তা কোনদিন আমি জানতে পারব, না। আমার দুঃখ ওখানেই। কেন কাঁদি জানো? বড় অসহায়, বঞ্চিত মনে হয় নিজেকে। অপরাধী মনে হয়। আমি কে? সত্যিই কি আমি একজন খুনী? কেমন ছিল আমার ছেলেবেলাটা? বাবা না হয় পালিয়েছিল, কিন্তু মা—তা সে খারাপ হোক বা ভাল—আমাকে কি আদর করত? এইসব প্রশ্ন অস্থির করে তোলে আমাকে, রানা। আমি শান্তি পাই না কিছুতেই। সে যাক। সবটাই প্রায় বলেছি তোমাকে, বাকিটাও শোনো। কুইবেক থেকে ডাক্তার মারকো আমাকে মন্ট্রিয়লে পাঠান। প্লাস্টিক সার্জারীর জন্য। ওখানে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন সার্জেন আমার চেহারা বদলে দেন।’
‘তখনও সেই অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা আসছে?’
‘হাঁ,’ ডা. শেফিল্ড ইতিমধ্যে ডা. মারকোকে হস্তান্তর করেছেন চেক গ্রহণ করার অধিকার। প্লাস্টিক সার্জারীর পর ডা. মারকো আমাকে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার পরামর্শ দেন। ভর্তি হই আমি। প্রথম বিভাগে পাসও করি। পাস করার পর পত্রিকার এজেন্টদের কাছ থেকে পুরানো পত্রিকা কিনে নিয়ে এসে সেই রোড অ্যাক্সিডেন্টের খবরটা জানার চেষ্টা করি। অবশ্য খবর পড়ে খুব বেশি কিছু জানার সুযোগ হয়নি আমার। জানতে পারি, ব্রিটিশ কলাম্বিয়াতে ফোর্ট ফ্যারেল নামে ছোট্ট একটা শহরের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন ক্লিফোর্ড। কি এক রহস্যময় কারণে জানি না, খবরটা বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। মারকো আমাকে প্রশ্ন করেন, এবার আমি কি করব। তাঁকে জানাই চাকরি আমি করব না। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে নৰ্থওয়েস্ট টেরিটরিতে দীর্ঘ সময় কাটাবার সিদ্ধান্ত নিই আমি, ফিল্ড এক্সপিরিয়েন্স অর্জন করার জন্যে। কিন্তু, তার আগে, মনে মনে ঠিক করি, ফোর্ট ফ্যারেলে একবার যাব। ইতিমধ্যে মারকো আমাকে একটা চিরকুট দেখিয়েছিলেন। সেই রহস্যময় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি চেকের সাথে এই চিরকুটটা পাঠিয়েছিল। টাইপ করা কাগজটায় লেখা ছিল: আলবার্ট কেনেথের যত্ন নেয়ার জন্যে এই টাকা পাঠানো হচ্ছে। এই বাক্যটার নিচে আরও দুটো লাইন ছিল, এইরকম: প্রতিমাসে যে পরিমাণ টাকা পাঠানো হচ্ছে তা যদি যথেষ্ট না হয় তাহলে দয়া করে ‘ভ্যানকুভার সান’ পত্রিকার ব্যক্তিগত কলামে এই বিজ্ঞাপনটা ছাপুন—“আলবার্ট কেনেথের আরও দরকার’। মারকো আমাকে জানালেন, প্লাস্টিক সার্জারীর খরচ মেটাবার জন্যে তিনি বিজ্ঞাপনটা ছেপেছিলেন পত্রিকায়। পরের মাস থেকে তিন হাজারের জায়গায় ছয় হাজার ডলারের চেক আসতে শুরু করে।’
‘ভারি আশ্চর্য ব্যাপার তো!’
‘মারকোকে আমি জানাই, টাকার আর দরকার নেই। যে টাকা ইতিমধ্যে জমা হয়েছে তা দিয়েই যন্ত্রপাতি কেনা হয়ে যাবে আমার। দু‘জন পরামর্শ করে পরের হপ্তায় ভ্যানকুভার সানে আরও একটা বিজ্ঞাপন ছাপার ব্যবস্থা করি আমরা বিজ্ঞাপনটা ছাপা হয়। তাতে আমরা বলি: ‘আলবার্ট কেনেথের আর দরকার নেই’। পরের মাস থেকে চেক আসা বন্ধ হয়ে যায়। ফোর্ট ফ্যারেলের উদ্দেশে রওনা হব, হঠাৎ মারকো হার্টফেল করে মারা যান।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে কেনেথ। তারপর ভারি গলায় বলে, ‘মারকোর মৃত্যু আমার জন্যে কি রকম আঘাত হয়ে দেখা দেয় তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না, রানা। মারকো আমার চেয়ে বয়সে দ্বিগুণের বেশি বড় ছিল। কিন্তু তবু সে ছিল আমারই, আমি যতদূর জানি, জন্মদাতা—নতুন কেনেথের স্রষ্টা। তার মৃত্যুর পর আমি সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়ি। পিতা, আত্মীয়, বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী যাই বলো—সেই আমার সব ছিল। তাকে হারিয়ে আরও যেন অসহায় হয়ে পড়ি আমি। নিজের অতীত জানার জন্যে একটা অস্থিরতা আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। এটা সম্ভবত মারকোর অনুপস্থিতির জন্যেই ঘটে। যাই হোক, ফোর্ট ফ্যারেলের উদ্দেশে রওনা হই আমি।’
‘কি দেখলে ওখানে গিয়ে?’
‘অদ্ভুত একটা ব্যাপার কি জানো, রানা?’ বলল কেনেথ, ‘ফোর্ট ফ্যারেল আমার চেনার কথা নয়, কিন্তু ওখানে পা দিতেই অনেক জিনিস কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকল আমার কাছে। ঠিক যে নির্দিষ্টভাবে কিছু চিনতে পেরেছি তা নয়, কিন্তু চেনা চেনা মনে হয়েছে অনেক জিনিসই। এমন কি, জানো, অনেক মানুষকে দেখেও আমার মনে হয়েছে—চিনি, কবে যেন দেখেছি এদের!’
‘ওরা কেউ…না,’ বলল রানা, ‘তোমার চেহারা বদলে গেছে, দেখলেও কারও চিনতে পারার কথা নয়।’
‘হ্যাঁ,’ বলল কেনেথ, ‘পরিচয় দিতেও অবশ্য কেউ আমাকে চিনতে পারেনি। পারবেই বা কিভাবে, বলো? আমি, আলবার্ট কেনেথ, কখনও তো এর আগে যাইনি ফোর্ট ফ্যারেলে—দ্বিতীয় জন্মের আগেও না, পরেও এই প্রথম, এর আগে যাইনি। কিন্তু, যাইনি যখন, চেনা চেনা ঠেকল কেন তাহলে জায়গাটাকে?’
চিন্তা করেও কেনেথের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না রানা।
‘কিন্তু, ওখানে বেশ কিছুদিন থেকে যে হারানো স্মৃতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব তারও সুযোগ পেলাম না, বুঝলে?’
‘সুযোগ পেলে না! মানে?’ ভুরু কুঁচকে উঠল রানার। শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল একটু!
‘ওখানকার লোকগুলো ভাল নয়, রানা,’ বিষণ্ন দেখাচ্ছে কেনেথকে। ‘কি জানি কার কি ক্ষতি করলাম, কিছু গুণ্ডা-পাণ্ডা পিছু লাগল আমার। ক্লিফোর্ডদেরকে যে কবরস্থানে কবর দেয়া হয় সেটা কোথায় এই প্রশ্ন করেছিলাম কয়েক জায়গায়। এছাড়াও আরও কি কি সব প্রশ্ন করেছিলাম, এখন আর খেয়াল নেই। এরপরই ওরা আমার পিছনে লাগে। হোটেলের রুম ভেঙে একরাতে চারজন ঢোকে আমার কামরায়। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ফোর্ট ফ্যারেল ছেড়ে চলে যেতে বলে আমাকে। হুমকি দিয়ে বলল, ‘কথা না শুনলে খুন করা হবে আমাকে।’
‘সে কি!’
‘ভেবে দেখলাম, আমি নিরীহ মানুষ, গুণ্ডাপাণ্ডাদের সাথে লাগতে যাওয়া আমার কাজ নয়, তাই পরদিন চলে এলাম, বুঝলে? ভাল করিনি কাজটা?’
চিন্তিত দেখাল রানাকে। পাল্টা প্রশ্ন করল ও, ‘কিন্তু তোমার মনে প্রশ্ন জাগেনি কেন ওরা ফোর্ট ফ্যারেলে তোমাকে থাকতে দিতে রাজি নয়?’
‘অনেক চিন্তা করেছি। কোন সমাধান পাইনি। আসল ব্যাপারটা যে কি তা কোনদিন জানা হবে না আমার। আর কোনদিন ও-মুখো হচ্ছি না আমি, রানা, তবে, একটা জিনিস সন্দেহ হয়েছে আমার।’
‘কি?’
‘যেভাবে গুণ্ডারা সারাক্ষণ আমার পিছনে লেগে থাকত তাতে পরিষ্কার বোঝা গেছে, কেউ তাদেরকে নিয়োগ করেছিল আমার বিরুদ্ধে।’
‘কেন?’
‘তা জানি না। নিশ্চয়ই আমার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবার ভয় আছে ওখানে কারও। এটাই কি মনে হওয়া স্বাভাবিক নয়?’
‘হ্যাঁ, স্বাভাবিক, কিন্তু…’
‘বাদ দাও, রানা, এ নিয়ে রাতের পর রাত, দিনের পর দিন অনেক ভেবেছি আমি—কোন সমাধানই পাইনি, জানি পাবও না। সত্যিকার অর্থে কোনদিনই জানা হবে না আমার, আমি কে, কেমন ছিল আমার ছোটবেলা, মা আমাকে আদর করত কিনা। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, যেটা আমার বিবেককে ক্ষতবিক্ষত করছে—সত্যিই কি আমি ক্লিফোর্ডদের খুন করেছিলাম? এই প্রশ্নেরও কোন উত্তর আমি পাব না। অর্থাৎ…’
‘অর্থাৎ?’
অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল কেনেথ। ‘যতদিন বাঁচব, রানা, একটা অপরাধের বোঝা আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে, একটা দোদুল্যমান সন্দেহ আমাকে কুরে কুরে খাবে—কিছুই করার থাকবে না আমার।’
তোমার সাথে আমি একমত নই,’ বলল রানা, ‘তুমি আমার পরিচয় জানো না, সেজন্যে হয়তো আমার কথার গুরুত্ব ঠিক বুঝবে না তুমি। কিন্তু আমি এখন যা বলতে যাচ্ছি তার প্রতিটি অক্ষর সত্য, কেনেথ।’
‘কি কথা, রানা?’ ঝট করে ফিরল কেনেথ রানার দিকে, ‘কি বলবে তুমি?’
‘আমি তোমার অতীত উন্মোচন করতে পারি। হয়তো পারি তোমার স্মৃতি ফিরিয়ে দিতে।’
‘রানা!’
দুটো হাত এগিয়ে আসছে রানার দিকে। কাঁপা দুটো হাত। রানার কাঁধের দিকে আসছে, কিন্তু মাঝপথে এসে আর এগোতে পারছে না। থরথর করে অসম্ভব কাঁপছে। পরমুহূর্তে খপ করে আঁকড়ে ধরল কেনেথের হাত দুটো রানার দু‘কাঁধ। ‘পারো, বন্ধু? পারো? আমাকে আমার অতীত ফিরিয়ে দিতে পারো? পারো স্মৃতিশক্তি ফিরিয়ে দিতে?’
‘পারি, কেনেথ,’ দৃঢ় গলায় বলল রানা, ‘পারি আমি তোমার অতীত আর স্মরণশক্তি ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু শান্ত হও তুমি, তোমাকে অনেক প্রশ্ন করার আছে আমার। ধরো, শেষ পর্যন্ত যদি প্রমাণ হয়, তুমিই খুন করেছ ক্লিফোর্ডদেরকে! পারবে সহ্য করতে? তার চেয়ে কি অতীত তোমার যেমন অন্ধকার আছে তেমনি ভাল না?’
‘আমি সত্য জানতে চাই, রানা!’ অদ্ভুত একটা ব্যাকুলতা প্রকাশ পেল কেনেথের কণ্ঠে। ‘সহ্য করতে না পারার কি আছে, বলো? ডা. মারকো বলেছিলেন, দুর্ঘটনার আগের কেনেথের সাথে দুর্ঘটনার পরের কেনেথের কোথাও কোন মিল নেই। দুর্ঘটনার আগের কেনেথ মরে গেছে—সে মৃত। বর্তমান কেনেথ, আমি, যে বেঁচে আছে তার ব্যক্তিত্বে বলো, স্বভাবে বলো, কোথাও এক বিন্দু অপরাধ প্রবণতা নেই। সুতরাং দুর্ঘটনার আগের কেনেথ যদি খুনী হিসেবে প্রমাণিত হয়ও, তাতে আমার অপরাধ বোধ করা উচিত হবে না।’
‘রাইট,’ বলল রানা, ‘আচ্ছা, কেনেথ, একজন বুড়ো মি. লংফেলো রোজ যে তোমার সাথে দেখা করতে আসছেন, উনি কে?’
‘চিনি না, বলল কেনেথ, ‘নামটা জীবনে কখনও শুনেছি বলে মনে পড়ে না আমার। তবে, ফোর্ট ফ্যারেলের লোক উনি। ভিজিটিং কার্ডে লেখা আছে উনি একজন সাংবাদিক। কিন্তু চিনি না বলেই ওঁর সাথে আমি দেখা করি না। ভয় হয়, আবার সেই গুণ্ডাপাণ্ডাদের পাল্লায় পড়ব।’
‘এবার এলে দেখা কোরো,’ বলল রানা, ‘শোনোই না কি বলবার আছে তাঁর। বলা যায় না, মি. লংফেলো হয়তো তোমার অতীত স্মৃতি ফেরাবার ব্যাপারে কোন সূত্র দিয়ে সাহায্য করতে পারেন তোমাকে।’
কি যেন বলতে যাচ্ছিল কেনেথ, বাধা দিল দুটো আওয়াজ-ঢং ঢং। দু‘জনেই তাকাল ওয়ালক্লকটার দিকে। চুপিসারে পেরিয়ে গেছে সময়, টেরও পায়নি ওরা। পরস্পরের দিকে তাকাল ওরা। টেরও পেল না, ওদের কাছ থেকে মাত্র তিন হাত দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সিস্টার লোৱা।
খুক করে কাশল বুড়ি। ঝট করে তাকাল ওরা। বুড়িকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠল।
অপরাধীর মত ভঙ্গি করে এক পা এগোল ওদের দিকে বুড়ি। ‘এই যে মিস্টার রানা, মিস্টার কেনেথ—তোমরা বুঝি ঘুমাতে পারছ না? একটা কথা মানে, বলছিলাম কি, ঘুম আমারও আসছে না অনেকক্ষণ থেকে। খুব বেশি সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস তো, ডিউটির সময় লুকিয়ে চুরিয়ে খাই, ধরা পড়লে চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে—তা এক আধখানা আছে নাকি তোমাদের কাছে? ধার দেবে? শোধ করে দেব…আছে?’
প্রথমে মনে হলো অভিনয়; কিন্তু বুড়ির দিকে কয়েক সেকেণ্ড চেয়ে থেকে মনে হলো, না, অভিনয় করছে না। মায়া লাগল বুড়ির অসহায় অবস্থা দেখে।
‘এত করে যখন চাইছ, নাও একটা,’ প্যাকেট থেকে পাঁচটা সিগারেট বের করে বুড়ির দিকে বাড়িয়ে ধরল রানা। ‘কিন্তু মনে থাকে যেন, সিস্টার, মাঝেমধ্যে আমরা চাইলেও যেন পাই।’
‘তোমাদের অভাব হবে এ আমি বিশ্বাস করি না,’ সিস্টার দাঁতহীন মাড়ি বের করে হাসল, ‘এ জিনিস কোথায় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় তার সন্ধান তো তোমরা জেনে ফেলেছ। ভাল কথা, পাখাটা ছেড়ে দেব কি? ধোঁয়ায় যে কেবিনটা অন্ধকার হয়ে গেছে।’ উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে হাইহিলের শব্দ তুলে সুইচ অন করে পাখাটা চালিয়ে দিল বুড়ি, তারপর দ্রুত বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে।
অদম্য হাসিতে ফেটে পড়ল ওরা।
পরদিন সন্ধ্যায় বুড়ো মি. লংফেলো এক তোড়া ফুলের গোছা নিয়ে ঢুকল কেবিনে। চেহারাটা ঠিক যেমন কল্পনা করেছিল রানা হুবহু তেমনি। লালচে দাড়ি-গোঁফ চুল ধূসর হয়ে আসছে দ্রুত। চমৎকার টিকালো নাক। উজ্জ্বল, তীক্ষ্ণ চোখ। হাসি হাসি একটা ভাব লেগে রয়েছে ঠোঁটের কোণে। মাথায় হ্যাট। পরনে পুরানো মডেলের ঢোলা স্যুট। চোখে সোনালী ফ্রেমের একজোড়া বাইফোকাল চশমা।
আধঘণ্টার উপর এসেছে বুড়ো। কেনেথের মাথার কাছে বেডের উপর বসেছে সে। নিচু স্বরে কথা বলছে। বুড়ো একের পর এক প্রশ্ন করছে বলে মনে হলো রানার। কেনেথের উত্তরও শুনতে পাচ্ছে না ও। তবে তার মাথা নাড়া দেখে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না, বুড়োর প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরে নেতিবাচক কিছু বলছে সে, জবাব দিতে পারছে না।
‘আপনি কে?’ হঠাৎ কেনেথের একটা প্রশ্ন কানে ঢুকল রানার।
উত্তরে বুড়ো কি বলল তা শুনতে না পেলেও কেনেথের পরের কথাটা শুনতে পেল রানা। কেনেথ বলল, ‘সাংবাদিক? বেশ, বুঝলাম। কিন্তু ফোর্ট ফ্যারেলের একজন সাংবাদিকের আমার ব্যাপারে এত আগ্রহ কেন?’
কি যেন বুঝিয়ে বলতে শুরু করল বুড়ো। তার একটা কথাও কানে ঢুকল না রানার।
নিজের বেডে উঠে বসতে যাবে রানা, হঠাৎ নিভে গেল আলো।
রানার মনে পড়ল, গতকালও, ঠিক এই সময় অফ হয়ে গিয়েছিল কারেন্ট। ‘সিস্টার! সিস্ উহ্!’
বৃদ্ধের চিৎকার। মাত্র একবার শোনা গেল। দ্বিতীয় বার সিস্টারকে ডাকতে গিয়েও শব্দটা পুরো উচ্চারণ করতে পারল না সে। বেদনা কাতর একটা শব্দ বেরোল শুধু মুখ থেকে।
কি ঘটছে কিছুই বুঝতে পারল না রানা। মাত্র ক’সেকেণ্ডের মধ্যে দ্রুত ঘটে গেল কয়েকটা ঘটনা অন্ধকারের কালো মঞ্চে। ধপ করে পড়ে গেল কেউ, বা ফেলে দেয়া হলো কাউকে ছুঁড়ে। এক সেকেণ্ড পর আর একটা শব্দ হলো। কাউকে যেন কেউ লাথি মারল, কোঁক করে একটা শব্দ হতে বুঝতে পারল রানা। পরমুহূর্তে একটা, আর্ত চিৎকার। চিৎকারটা মাঝ পথে থেমে গেল। ছুটন্ত একটা পদশব্দ.. বেরিয়ে যাচ্ছে বাইরে।
তড়াক করে লাফ দিয়ে নেমে পড়েছে রানা ইতিমধ্যে বেড থেকে। ‘মি. লংফেলো! কোথায় আপনি? মি. লংফেলো!’
‘কেনেথকে, কেনেথকে বোধহয় ওরা খুন করছে…ওকে বাঁচান!’
পাথর হয়ে গেল রানা। মাথাটা ঘুরে উঠল ওর। গ্রাহ্য করল না ব্যাপারটা। টলতে টলতে কেনেথের বেডের দিকে এগোল ও।
ধাক্কা খেল রানা কিসের সাথে যেন। ঠিক তখনই জ্বলে উঠল আলো। পায়ের কাছে দু‘হাত দিয়ে পেট চেপে ধরে বসে আছে বৃদ্ধ। তাকে ধরে দাঁড় করাতে গিয়ে বাধা পেল রানা।
‘আমাকে নয়, কেনেথকে।’
মুখ তুলে তাকাল রানা। ঠিক সেই সময় ঝড়ের বেগে একজন সিস্টার ঢুকল কেবিনে। তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার বেরিয়ে এল তার গলা দিয়ে। পিছিয়ে গেল কয়েক পা। কেনেথের ব্যাণ্ডেজ বাঁধা বুকে আমূল গাঁথা রয়েছে হাতির দাঁতের হাতলওয়ালা একটা ছোরা। রক্তে লাল হয়ে গেছে ধবধবে সাদা ব্যাণ্ডেজ। একদিকে কাত হয়ে পড়ে রয়েছে কেনেথের মাথা।
দেখেই বুঝল রানা, বেঁচে নেই কেনেথ।
ধীরে ধীরে এগিয়ে বেডের সামনে দাঁড়াল রানা। হুড়মুড় করে কেবিনে ঢুকল কয়েকজন ডাক্তার। তাদেরকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে এল রানা।
‘অন্যায় হলো! মস্ত অন্যায় হলো।’ বিড় বিড় করছে বৃদ্ধ। উঠে দাঁড়িয়েছে সে। চেয়ে আছে কেনেথের দিকে। ধীর, সম্মোহিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ছে এদিক ওদিক। চিক চিক করছে চোখের কোণ দুটো। ‘শেষ সূত্রটাকেও সরিয়ে ফেলা হলো দুনিয়া থেকে। আর কোন ভাবেই অন্যায়টার বিচার হওয়া সম্ভব নয়।’ হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল বৃদ্ধ। এখনও মাথা নাড়ছে। বিড় বিড় করছে।
‘দাঁড়ান!’ ডাকল রানা। পা বাড়াল।
কে যেন পিছন থেকে দু‘হাত দিয়ে ধরে ফেলল ওকে। ঝট করে ফিরল রানা। সিস্টার। ‘ছাড়ো আমাকে। ওই ভদ্রলোককে দরকার আমার…’
‘আপনি অসুস্থ!’ সিস্টার গায়ের জোরে আটকাতে চাইছে ওকে।
দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে বৃদ্ধ। মরিয়া হয়ে চিৎকার করে উঠল রানা, ‘দাঁড়ান! মি. লংফেলো!’
আরও একজন সিস্টার এগিয়ে এসে ধরে ফেলল রানাকে। অবাধ্য হবেন না, মি. রানা, প্লীজ!’ প্রায় টেনে হিঁচড়ে বেডের কাছে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল ওরা ওকে। তারপর শুইয়ে দিল।
হাঁপাচ্ছে রানা। ‘মি. লংফেলোকে ফিরিয়ে আনো।’ চিৎকার করতে গিয়ে হঠাৎ রানা অসুস্থ বোধ করল। মাথাটা ঘুরছে ওর। ঝাপসা হয়ে আসছে চোখের সামনে সব কিছু। ঝাপসা হয়ে গেল। তারপর অন্ধকার।
দেড় মিনিট পর জ্ঞান ফিরল রানার। ওর প্রশ্নের উত্তরে সিস্টার জানাল, মি. লংফেলোকে পাওয়া যায়নি। না, তাঁর ঠিকানাও কাউকে দিয়ে যাননি তিনিI
ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই কেনেথের বেডটা দেখতে পেল রানা। সাদা চাদর দিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে রাখা হয়েছে মৃতদেহটা।
মাথার ভিতর চিন্তার জাল বুনছে রানা। অসংখ্য প্রশ্ন জাগছে মনে। আটাশ দিন আগে যে ঘটনার দরুন ওরা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল সেটা দুর্ঘটনা ছিল না তাহলে! কেনেথকে খুন করার ষড়যন্ত্র ছিল সেটা। ঘটনাচক্রে কেনেথকে বাঁচাতে গিয়ে সেও মরতে বসেছিল। নিতান্ত ভাগ্যগুণেই বেঁচে গেছে ওরা। খুনী ড্রাইভার ভেবেই নিয়েছিল কেনেথের সাথে যদি আর একজন পথিক খুন হয় হোক, ক্ষতি নেই তাতে।
শরীরের রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠল রানার। একটা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে খুন যাচ্ছিল ও। মারা গেলে কারও কিছু আসত যেত না। এতই কি সস্তা ওর জীবন? কারা ওরা? কি ভেবেছে নিজেদের?
কেনেথের কথা ভাবতে গিয়ে কঠোরতর হলো রানার মন। এমন একটা মানুষ, যে নিজের অতীত ভুলে গেছে—তার পক্ষে কারও কি ক্ষতি করা সম্ভব? কেন তাকে এমন নির্মমভাবে খুন করা হলো?
কেন?