গৌরচন্দ্রিকা
গৌরচন্দ্রিকা বলতে আমরা ভূমিকা বা পূর্বকথাকে বুঝে থাকি। কিন্তু ভূমিকা, মুখবন্ধ বা পূর্বকথাকে গৌরচন্দ্রিকা বলা হয় কেন?
বক্তব্য বিষয়ের সূচনা বা পূর্বাভাষ হলো গৌরচন্দ্রিকা। গৌরচন্দ্র থেকে শব্দটি এসেছে। গৌরচন্দ্র বা গৌরাঙ্গ হলেন নববৈষ্ণব আদর্শের উদ্গাতা শ্রীচৈতন্য (গৌর, নিমাই, গোরাচাঁদ, নদের চাঁদ, নবদ্বীপচন্দ্র, বিশ্বম্ভর ইত্যাদি নামেও পরিচিত) দেব।
ভারতীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনতম হলো ভাগবত-সম্প্রদায় আর নবীনতম হলো শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩ খ্রি.) প্রবর্তিত বৈষ্ণব আদর্শ। এই নব বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কর্মকাণ্ডই এ দেশে সবচেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কারণ এ আদর্শের মূলে আছে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের সমান অধিকার, জাতপাতের ভেদবুদ্ধিহীনতা, জটিল শাস্ত্রদর্শনের অনুপস্থিতি এবং আবহমানকাল থেকে চলে আসা লোকায়ত আচরণ ও লোকধর্মের ঘনিষ্ঠ সংস্রব।
শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত নববৈষ্ণব আদর্শে পূর্ববর্তীকালের বৈষ্ণব আদর্শের চাইতে বেশি যুক্ত হয়েছে বৌদ্ধ সহজিয়া, নাথপন্থা এবং সুফিবাদের অনেক উপাদান ও লোক বিশ্বাস। আমাদের দেশে অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে মঙ্গলাচরণ করার রীতি আছে অতীতকাল থেকে। দিবন্দনা, গুরুবন্দনা, পীরবন্দনা, ধর্মস্থান বর্ণনা, দেবদেবতার বন্দনা করেই অনুষ্ঠানের শুরু। বৈষ্ণব-আদর্শের অনুষ্ঠানের প্রারম্ভে মঙ্গলাচরণের ক্ষেত্রে গৌরচন্দ্রের বা শ্রীচৈতন্যের উদ্দেশে সঙ্গীত নিবেদন করার কাজটিই হলো গৌরচন্দ্রিকা।
বর্তমানে বৈষ্ণব ক্রিয়াকর্ম বা অনুষ্ঠান ছাড়াও যে কোনো কাজ শুরুর আগে ভূমিকা দেয়া হয়ে থাকে অতীতকালের ধারাবাহিকতায়। সেই ভূমিকা বা মুখবন্ধ কিংবা সূচনাকথার বিষয়টিকে আমরা গৌরচন্দ্রিকা বলে থাকি। কেউ মূল কথা সরাসরি না বলে অযথা ধানাইপানাই করে অনাবশ্যক কথাবার্তা বলতে থাকলে সাধারণত বলা হয়-গৌরচন্দ্রিকা বাদ দিয়ে সোজাসুজি বিষয়টি বল।
মুর্শিদাবাদ জেলার মালিহাটি গ্রামের সন্তান রাধামোহন ঠাকুর (আনু. ১৬৯৮-১৭৬৮ খ্রি.) অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে (১৭৩০) পদামৃতসমুদ্র গ্রন্থে সংস্কৃত ও ব্রজবুলি ভাষায় বহু পদ রচনা করেছেন। তার লেখা একটি গৌরচন্দ্রিকা নিচে দেয়া হলো—
আজু হাম কি পেখলু নবদ্বীপচন্দ।
করতলে করই বয়ন অবলম্ব।।
পুন পুন গতাগতি করু ঘর পন্থ।
খেনে খেনে ফুলবনে চলই একান্ত ॥
ছল ছল নয়ন-কমল সুবিলাস।
নব নব ভাব করত পরকাশ।।
পুলক মুকুলবর ভরু সব দেহ।
রাধামোহন কছু না পাওল থেহ॥
অনেক ক্ষেত্রে মূল বক্তব্যের চেয়ে গৌরচন্দ্রিকা বা ভূমিকার বিষয় যদি বেশি লম্বা হয় তখন বিরক্ত হয়ে মানুষ গৌরচন্দ্রিকার কথা উল্লেখ করে।