গোল পোস্ট
কি গো কি মনে হচ্ছে, পারবে আমাদের বিট্টু? ঈশানি কপালের দু-পাশটা কাতর ভাবে টিপে ধরে বললো, কিছুই তো বুঝতে পারছি না আসলে৷ মিশনে ভর্তি করাটা সত্যিই বেশ টাফ গো৷ গতবছর তো ছেলেটা রিটেনে পাস করেও ওরালে গিয়ে কি যে বলে চলে এলো, ক্যানসেল হয়ে গেলো৷ এই লাস্ট চান্স আমাদের হাতে৷ প্রলয় চিন্তিত মুখে বললো, এই জন্যই রঞ্জনদা মিশনের চক্করে না গিয়ে টাকা দিয়ে ছেলেকে নামি স্কুলে ভরতি করিয়ে দিয়েছে৷ কথাটা শোনার পরেই নিমেষে জ্বলে উঠলো ঈশানি৷ তুমি থামো তো, তুমি তো আবার সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের সেকেন্ড এডিসন৷ তখন কতবার বললাম, নাম স্কুলে এডমিশন দিতে গেলে ডোনেশন লাগে৷ সে কে শোনে কার কথা! ওহ, ছেলেকে মানুষ করার থেকে ওর সততা আগে হলো৷ এখন বোঝো! প্রলয় বললো, বিট্টুর প্রিপারেশন তো বেশ ভালোই, না পারার কি আছে?
ঈশানি মুখ ঝামটা দিয়ে বললো, শোনো, তুমি যতই সৎ পুলিশ অফিসার হও না কেন, লোকে কিন্তু তোমার আড়ালে তোমাকে ঘুষখোরই বলে বুঝলে? আর তুমি কি ভেবেছো আমি কিছুই জানি না, তুমি তোমার ওই পাড়ার ফুটবল ক্লাবটায় টাকা দিতে পারো, আর নিজের ছেলের ভরতির জন্য এক টাকাও বের করতে তোমার কষ্ট৷ মাইনে কম পাও তো ফুটবলার তৈরির স্বপ্ন কীসের গো তোমার? লজ্জা করে না, পুলিশে চাকরি করে এমন হাঘরের মতো জীবন কাটাতে!
প্রলয় চুপচাপ খবরের কাগজের পাতায় মন দিলো৷ ঈশানি এমনিতে ভালো মেয়ে হলেও রেগে গেলে ওর মাথার ঠিক থাকে না৷ তখন প্রলয় যদি চুপ করে না থাকে তাহলেই বিপদ৷ নামে প্রলয় হলেও ওর স্বভাবটা নেহাতই শান্ত, উল্টে ঈশানি যখন রাগে তখন উত্তাল ঝড়ের দাপটে এলোমেলো হয়ে যায় প্রলয়ের শান্ত জীবন৷ তাই ঈশানির রাগটাকে একটু ভয়ই পায় ও৷
পরিচিতরা হেসে বলে, লোকে পুলিশকে ভয় খায় আর আমাদের পাড়ার পুলিশই বউ-এর ভয়ে জুজু৷
প্রলয় সামন্ত পুলিশ কনস্টেবলের চাকরিটা যখন পেয়েছিল তখন ওর কাঁধে পুরো সংসারের দায়িত্ব এসে পড়েছিলো৷ ওর বাবা প্রানেশ সামন্ত ছিলেন গ্রামীন লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান৷ বাবার রোজগারের টাকায় ওদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য না থাক অভাবের তাড়নায় খেতে না পেয়ে মরতে হয়নি কখনো৷ দু-বোন আর প্রলয়কে লেখাপড়া শেখানোর জন্যই প্রানেশ সামন্তকে বেলার দিকে বাজারে যেতে হতো৷ যখন রোদে গরমে সকালের সবজির অবস্থা ম্রিয়মান হয়ে এসেছে, বিক্রেতারও বাড়ি ফেরার তাড়া, দরাদরির ইচ্ছেয় ভাটা পড়েছে, তখন ঠিক সময়ে প্রানেশ বাবু বাজারে গিয়ে একটু সস্তায় বাজার করে আনতেন৷ যা দুটাকা বাঁচাতেন তাতে ছেলে মেয়ে দুটোর টিফিন খরচটা যদি হতো, সেটুকুই ছিলো চেষ্টা৷
এত কষ্টের পরেও যেদিন শুনেছিলেন, তার একমাত্র ছেলে প্রলয় স্কুলে গিয়ে পড়া না করে ফুটবল খেলে তখন আর বাবা হিসাবে মাথা ঠিক রাখতে পারেন নি৷ স্কুলের শিক্ষকরা লাইব্রেরিতে বই নিতে এসে হেসে বলেছিলেন, প্রানেশ বাবু! ছেলে আপনার মারাদোনা হবে৷ লেখা পড়া ওর জন্য নয়৷ বাড়ি ফিরে প্রলয়কে একচোট পিটিয়েছিলেন তিনি৷ রাগে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, খেলা তোকে পেটের ভাত দেবে? খেলা তোকে চাকরি দেবে? মাথা নিচু করে মুখে টুঁ শব্দ না করে বাবার মার খেয়েছিলো প্রলয়৷ মনে মনে শপথ নিয়েছিলো আর কখনো খেলার মাঠে যাবে না৷
মাও বলেছিল, যাস না বাবা, আমাদের ঘরের ছেলে খেয়ে দেয়ে কেরানীর চাকরি করতে যাবে, এটাই সইবে রে৷
তবে প্রলয়ের আদর্শ ছিলেন সংগ্রাম স্যার৷ সংগ্রাম বক্সী৷ ঠিক মাইনে নেওয়া ফুটবল কোচ ছিলেন না উনি, তবুও সংগ্রাম স্যার ছিলেন তরুণ সমাজের কাছে একটা মডেল ক্যারেক্টার৷ বিকেলে পাড়ার মাঠে ছেলেদের ফুটবল শেখাতেন তিনি৷ শহরের কোনো স্কুলের ওয়ার্ক-এডুকেশন ফিজিক্যাল এডুকেশনের টিচার ছিলেন৷ বিকেল বেলা বাড়ি ফিরেই মাঠে চলে আসতেন৷ রোজ নতুন নতুন ছেলের আমদানি হতো খেলার মাঠে, সংগ্রাম স্যার আগের দিন শেখানো ছেলেটাকে আর খুঁজে পেতেন না৷ তবুও হাল ছাড়তেন না৷ নতুন ছেলেকে দিয়েই শুরু করতেন৷ এই ভাবেই পরিচয় হয়েছিলো প্রলয়ের সাথে৷ প্রথম দর্শনেই ক্লাস ইলেভেনের প্রলয়ের মনের সবটুকু এক নিমেষে জয় করে নিয়েছিলেন সংগ্রাম বক্সী৷ তারপর প্রলয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, ওরে বাবারা অমন একটু বকে! ধর যদি পেলে বাবার বকুনি খেয়ে আর মাঠে না আসতো তাহলে কি আজ পৃথিবীর লোক ওই নাম ধরে চিৎকার করতো?
ধর মারাদোনা পায়ে বল না নিয়ে অঙ্ক কষছে তাহলে কি হতো বলতো?
স্যারের হাঁটা চলা, কথা বলার স্টাইল সব খুঁটিয়ে দেখতো প্রলয়৷ কিছুদিন পর থেকেই প্রলয়কেও লোকে ডান হাতে ঘড়ি পরতে দেখেছিলো৷ সংগ্রাম স্যার বলতেন, ঘড়িটা হলো চূড়ান্ত কাজের জিনিস৷ সময়ের মূল্য যার কাছে নেই সে জীবনে কোনোদিন নিজেকে মানুষ বলেই পরিচয় দিতে পারবে না৷ তাই এমন অমূল্য জিনিসটাকে শুধু শুধু কেন বাম হাতে পরবো, একে ডান হাতেই রাখবো৷ সাংগ্রাম স্যারের কথা মতো ভোরে উঠে পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা রোজ ছুটতো প্রলয়৷ বাড়ি ফিরেই এক গ্লাস ছাতুর শরবত খেতো৷
বাবা ওরকম করে মারার পরে, বেশ কিছুদিন আর মাঠ মুখো হয়নি প্রলয়৷ তারপর হঠাৎই একদিন বৃষ্টির বিকেলে সংগ্রাম স্যারের বাঁশির তীক্ষ্ণ আওয়াজটা কানে পেয়েই সব বাধা ছিন্ন করে ছুটে গিয়েছিলো স্যারের কাছে৷ স্যার বেশ কিছুদিন পরে বাধ্য ছাত্রকে দেখে বলেছিলেন, সামনেই ডিস্ট্রিক্ট লেভেলে খেলা আছে, জোর প্র্যাকটিস কর৷ আমি তোকে নামাতে চাই আমার শহরের টিমের সাথে৷
সংগ্রাম স্যার কখনো মিথ্যে বলেন না, কখনো লেট করেন না৷ তাই প্রলয়ও মিথ্যে বলাকে ঘৃণা করে৷ সেই জন্যই বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রলয় বলেছিলো, বাবা আমি খেলাটা ছাড়তে পারবো না৷ তুমি আমাকে যতই মারো আমি পারবো না৷ ছেলের মুখে অমন স্পষ্ট কথা শুনে বোধহয় বাবাও কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বলেছিলেন, পড়াশনাটাও করো৷ এইচ. এস. পরীক্ষার রেজাল্টের পরে কলেজে ভর্তি হয়েছিলো প্রলয়৷ ঠিক তখনই আচমকা ঝড়টা এসে পড়েছিলো ওদের সামন্ত বাড়ির তিন কুঠুরি ঘরের ছাদে৷
ভোর বেলা রোজই হাঁটতে যাওয়াটা প্রানেশবাবুর দীর্ঘ দিনের অভ্যেস৷ সে অভ্যাস বশেই সেদিনও বেরিয়েছিলেন৷ তারপর প্রলয়রা ঘুম চোখে খবর পেয়েছিলো যে ওদের বাবা বড়ো রাস্তার মোড়ে লরি চাপা পড়েছে৷ মা আকুল হয়ে কেঁদেছিলো৷ বোন দুটো অসহায়ের মতো দাদার দিকে তাকিয়েছিলো৷ প্রলয় সেকেন্ড ইয়ারে কলেজ ছেড়েছিলো৷ কলেজ ছেড়েছিলো কিন্তু মাঠ ছাড়েনি৷ সংগ্রাম স্যারের সাহায্যেই পুলিশের চাকরিটা পেয়ে গিয়েছিলো প্রলয়৷
না, মারাদোনা বা পেলে হওয়া ওর আর হয়নি৷ ও পুলিশ কনস্টেবল হয়েই সংসারের দায়িত্ব নিয়েছিলো৷
ধীরে ধীরে গোটা সংসার গিলে নিয়েছিলো ওর ফুটবলার হবার স্বপ্নটাকে৷ দুই বোনের বিয়ে দেওয়ার সময় ও প্রথম মিথ্যে বলেছিলো৷ বড়ো বোন মাধ্যমিকে ব্যাক পেয়েছিলো৷ যতদিন পর্যন্ত এই সত্যিটা পাত্রপক্ষর সামনে বলে চলেছিলো প্রলয় ততদিন পর্যন্ত কিছুতেই কোনো পাত্র পক্ষ রাজি হচ্ছিল না৷ শেষে মা এসে প্রলয়ের হাত দুটো ধরে কেঁদে বলেছিলো, জীবনে একবার মিথ্যে বল বাবা, বোনটার একটা গতি কর৷
কাঁপা গলায় সেই প্রথম সংগ্রাম স্যারের আদর্শের মৃত্যু ঘটিয়ে মিথ্যে বলেছিলো প্রলয়৷
বড়ো বোনের বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিলো, সারারাত অন্ধকার ঘরে শুয়ে কেঁদেছিলো প্রলয়৷ পরের দিন থেকে প্রলয় বাম হাতে ঘড়ি পরেছিলো৷ মনে মনে বলেছিলো, সংগ্রাম স্যার, আমি কোনো দিক থেকেই আপনার মতো হতে পারলাম না৷ প্রলয়ের মনে একটার পর একটা ঝড় এসেছে, নীরবে ওকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে চলে গেছে৷
প্রথম যেদিন ও চোখের সামনে থানায় বসে বড়োবাবুকে ঘুষ নিতে দেখেও নিশ্চুপ ছিলো সেদিনও আরেকবার মৃত্যু হয়েছিলো প্রলয়ের৷
তবুও ও সাহস করে একবার বলেছিলো, স্যার, যদি ঘুষ না নিতেন তাহলে কি আপনার সংসার চলতো না?
দিন দশকের মধ্যেই পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামে বদলি হয়ে গিয়েছিলো প্রলয়৷ ওখানে গিয়েও শান্তি পায়নি ও৷ রাজনৈতিক নেতারা এসে থানা ঘেরাও করেছিলো, ও কোনো রং না দেখেই লাঠি চার্জ করেছিলো বলে, একমাস উইদাউট পে হয়ে গিয়েছিলো৷ হাতের চুরি বেচে সে মাসে সংসার চালিয়েছিলো মা৷
জীবন কেটেছে জীবনের ছন্দে৷ অনেক মিথ্যে, অন্যায় দিয়ে তৈরি হয়ে গেছে প্রলয় সামন্তর জীবন৷ লোকে আড়ালে ঠাট্টা করে বলে, সামনে ঘুষ নেয় না, সৎ পুলিশ অফিসার৷ পকেটে টাকা ভরে, হাতে নয়৷ সবই কানে আসে প্রলয়ের৷ ডিউটি থেকে ফেরার সময় ফাঁকা মাঠে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বল পায়ে ছুটন্ত বছর আঠেরোর প্রলয়কে আরেকবার ফিরে দেখে নেয় ও৷ দু চোখের কোণে নোনতা জল জমে৷ হঠাৎ সংগ্রাম স্যার কানের কাছে বাঁশি বাজিয়ে বলেন, সবাই পেলে হতে পারে না, সবাই মারাদোনা হতে পারে না৷ কিন্তু প্রলয় তুই তো মিথ্যুক, অন্যায় সহ্য করা একটা মানুষ হয়ে গেলি রে৷ তুই তো সংগ্রাম স্যারের ছাত্রও হতে পারলি না৷
ছোটো বোনের বিয়ের সম্বন্ধ ফাইনাল করে ট্রেনে করে ফিরছিলো প্রলয়৷ হঠাৎই পাশের লোকের হাতের সান্ধ্য কাগজের পাতায় পরিচিত মুখটা দেখে চমকে উঠেছিলো প্রলয়৷ অনুমতি না নিয়েই অপরিচিত ভদ্রলোকের হাত থেকে কাগজটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে বলেছিলো, দেখুন এই ভদ্রলোক আমার স্যার! আমি খুব কাছ থেকে চিনি৷
সংগ্রাম বক্সীর ছবির ওপরে লেখা, একা তিনজন ছেলেকে পিটিয়ে এক যুবতীর সম্মান বাঁচিয়েছেন ভদ্রলোক৷ তিন দুষ্কৃতীকেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ৷ খবরটা পড়েই দু-চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমেছে প্রলয়ের৷ কাগজটা ফেরত দিয়েই ধীরে ধীরে বললো, স্যার আমাকে আপনি ক্ষমা করুন৷ আমি আপনার আদর্শে বাঁচতে পারলাম না৷
যত দিন যাচ্ছে তত যেন প্রলয় অসৎ সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছিলো৷
বোনদের বিয়ে দিয়েই দায় মুক্ত হয়ে বাকি জীবনটা সৎ ভাবে বাঁচবে ভেবেছিলো প্রলয়৷ সেটা শুনেই হয়তো বিধাতা পুরুষ হেসেছিলো অলক্ষ্যে বসে৷ বছর না ঘুরতেই মা উঠে পড়ে লেগে গেলো ঘরে বউ আনবে বলে৷
শেষে ঈশানি এলো ওদের সংসারে৷ প্রলয়ের মা আর বউ-এর আলোচনার বিষয় ছিলো, প্রলয়ের মতো আহাম্মক ছেলে নাকি তারা কোনোদিন দেখেইনি! সৎ পথে থেকে কোনো রকম উন্নতি করতে পারে নি প্রলয়, তবুও সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারে, সে সৎ পুলিশ৷
তবে ইদানীং আয়নাও ওকে আঙুল তুলে বলে, তুই সৎ?
তুই বড়ো বোনের বিয়ের সময় মিথ্যে বলেছিলিস! তুই ছোটো বোনের বিয়ের সময় পাত্র পক্ষকে পণ দিয়েছিস! তুই চোখের সামনে অন্যায় দেখে সহ্য করেছিস!
নিজে ঘুষ নিস নি ঠিকই কিন্তু ঘুষখোরকে চিনেও চুপ করে থেকেছিস৷
হঠাৎ মাঝরাতে উঠে প্রলয় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো সে এই পুলিশের চাকরি ছেড়ে দেবে৷ মুটে গিরি করে খাবে তাও ভালো, তবু এই চাকরি করবে না৷ ভাবতে ভাবতেই সংগ্রাম স্যারের কথা মনে পড়লো, পায়ে বল নিয়ে গোল পোস্টের দিকে ছুটছিলো প্রলয়৷ একটুর জন্য গোলটা মিস করেছিলো নিজের ভুলেই৷ স্যার বলেছিলেন, তুই হয়তো জীবনে অনেক গোল দিবি প্রলয়, কিন্তু এই গোলটার আক্ষেপ তোর সারাজীবন থাকবে৷ এই একটু ভুলের জন্য হারিয়ে ফেলা সুযোগগুলো আর আসেনা রে জীবনে৷ সত্যিই তাই, প্রলয় সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে৷ একটা মিথ্যের সুযোগ নিয়ে ওর জিভ আরও অনেক মিথ্যে বলেই চলেছে৷ পাশ ফিরে ঈশানিকে জানাতে যাচ্ছিলো, যে ও রিজাইন করবে, ঠিক সেই সময় ঈশানি ওর গলাটা জড়িয়ে ধরে ফিস ফিস করে বললো, তুমি বাবা হতে চলেছো৷ এবার থেকে তোমার ওপর আমাদের তিনজনের দায়িত্ব চাপবে৷ সন্তান হবার খুশিতে খুব বেশি আনন্দ পায়নি প্রলয়৷ কারণ ও বুঝেছিলো, আবার অন্যায়ের সাথে আপোষ করেই করতে হবে ওকে চাকরিটা৷ লোকে গালাগাল দেয়, পুলিশ কি অন্ধ, একজন ধর্ষিতা মেয়ের ওপরে অন্যায় দেখেও পুলিশ সহ্য করে! সাধারণ মানুষ বুঝতেও পারে না এর মধ্যে কত কত খেলা চলে৷ প্রলয়ের সব থেকে আপত্তি ওই ধর্ষিতা কথাটাতে৷ একটা মেয়ে একজন দুষ্কৃতীর দ্বারা আক্রান্ত হলো, তার সুস্থ স্বাভাবিক জীবন বিপন্ন হলো, আবার সমাজ তারই একটা নাম ঠিক করে ফেললো, ধর্ষিতা৷ কষ্ট হয় প্রলয়ের৷ কিন্তু সামান্য কনস্টেবলের ক্ষমতার দৌড় সাধারণ মানুষ না জানলেও ও ভালো মতোই জানে৷ কিন্তু অসহায় মেয়েগুলোর বাবারা যখন পুলিশ স্টেশনে এসে ডায়রী করে, তখন প্রলয়ের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, ভেঙে দিন সব নিয়ম কানুন৷ ঈশানি মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, তুমি একা কি সব পাল্টাতে পারবে? নিজেকে ক্ষত বিক্ষত করা ছাড়া আর কি পারবে তুমি?
প্রলয় হেসে বলেছিলো, সংগ্রাম স্যার একাই পারতো৷ একাই গোল দিতো, একাই গোল আটকাতো, একাই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতো৷
দিন কেটে গেছে, প্রলয়ের তিনবার বদলি হয়েছে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে৷ নাতির মুখ দেখে মাও স্বর্গারোহন করেছেন নিশ্চিন্তে৷ প্রলয়ের ছেলের নাম সংগ্রাম সামন্ত৷ ডাক নাম বিট্টু৷ ওকে ঘিরেই প্রলয়ের যত স্বপ্ন৷ স্যারের নামে নামটা রেখেছিলো, যদি ওনার মত একটু গুনও পায় বিট্টু৷ কিন্তু প্রলয় বুঝেছে শুধু নামে দুটো মানুষ কখনো এক হয়ে যায় না৷ সেই জন্যই বিবেকানন্দ নামের চোর জোচেচারকে প্রায় ধরতে হয় ওকে৷
তাই বিট্টুর প্রিয় খেলা ফুটবল নয়৷ প্রলয় ছোট্ট ছেলেটার পায়ে ফুটবল দিয়ে দেখেছে, ছেলেটা বলটা শট না মেরে হাতে তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে৷ বরং বন্দুকের প্রতি ওর আগ্রহ বেশি৷ সব মেলাতে গিয়ে একটা করে বন্দুক ওর কেনা চাই৷ হতাশ হয়েছে প্রলয়৷ নাহ, ছেলে তার সংগ্রাম সামন্তই থেকে গেল, বক্সী হতে পারবে না৷
ঈশানির ইচ্ছে ছিলো নামী কোনো স্কুলে ডোনেশন দিয়ে ভর্তি করার৷ স্বামীর কাছে কাকুতি মিনতি করেছিলো ও৷ কিন্তু প্রলয়ের এক কথা, ওর জীবনটাও গোঁজামিল দিয়ে শুরু হবে? তারপরেই মিশনের আইডিয়াটা মাথায় খেলে যায় ওর৷ গত বছর নামী রামকৃষ্ণ মিশনে রিটেনে পাশ করেও ওরাল পরীক্ষায় আটকে গিয়েছিলো বিট্টু৷ ঈশানির অত খাটনি বিফলে গিয়েছিল৷ এ বছরই বয়েস কমিয়ে যাহোক করে পরীক্ষায় বসিয়েছিলো বিট্টুকে৷ যথারীতি রিটেনে পাশ করেছে ও৷ এখন ঈশানি পাখি পড়ানো করে ওকে সব শেখাচ্ছে৷ প্রলয় শুনতে পাচ্ছে ঈশানি অনেক মিথ্যেও শেখাচ্ছে৷ যেমন তোর বয়েস কিন্তু 10+ নয়, বলবি 9+, আর কিশোর ভারতী বিদ্যালয়ে ক্লাস ফোরে কিন্তু তুমি দু-বছর নয়, একবছরই পড়েছো৷ আর বাবার বারবার বদলি হয়ে যায় সেটাও বলবি না কিন্তু৷ আর রেগুলার মা কি রান্না করে জিজ্ঞেস করলে বলবি, মাছ, মাংস… মনে থাকবে?
বিট্টু ঘাড় নেড়ে বলছে, সব মিথ্যে ঠিক ঠিক মুখস্ত করে নিয়েছি মা৷ কিন্তু আমরা তো সপ্তাহে দু-দিন মাছ, আর একদিন মাংস খাই তাহলে?
ঈশানি মুখ ঝামটা দিয়ে বললো, যেটা বলতে বলছি সেটাই বলবি৷ নাহলে তোর বাবার স্যালারির বহর বুঝেই হয়তো ভরতি করবে না৷
প্রলয়ের বুকটা ফেটে যাচ্ছে৷ শেষ পর্যন্ত ছেলেকে মিথ্যে বলতে শেখাতে হচ্ছে? বিট্টুর নাম সংগ্রাম রাখাটা বড়ো ভুল কাজ হয়ে গেলো৷ প্রলয় পরোক্ষে যেন অপমান করলো সেই মানুষটাকে৷ যিনি হাজার বিপদেও কখনো মিথ্যে বলেননি৷
তবুও টেনশন হচ্ছে, আগামী কাল পরীক্ষা৷ সারারাত প্রলয় আর ঈশানি নির্ঘুম চোখে দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে৷ ঈশানি জিজ্ঞেস করলো, আর কিছু শেখানোর আছে ওকে?
প্রলয় ঘাড় নেড়ে বললো, আর কোনো মিথ্যে বাকি নেই বোধহয়৷ প্রলয়ের চোখের কোনা দুটো ভিজে যাচ্ছিলো৷ বালিশে চোখটা মুছে নিয়ে বললো, ঈশানি আমি একটা হেরে যাওয়া মানুষ৷ আমার পায়ে বল টিকলো না, আমার মুখে সত্যিও থাকতে চাইলো না৷
আজ ছুটি নিয়েছে প্রলয়৷ তার একমাত্র স্বপ্নকে নিয়ে ও আর ঈশানি যখন পৌঁছালো রামকৃষ্ণ মিশনের বিশাল দরজার সামনে তখন স্কুলের প্রার্থনা সংগীত ভেসে আসছিলো ওদের কানে৷ প্রলয়ের রক্তে ধ্বনিত হচ্ছে বিবেকানন্দের সেই সব বাণী৷ যেগুলো ও শুনেছিলো সংগ্রাম স্যারের মুখ থেকে৷
বিট্টুর কাঁধে হাত রেখে বললো, তুই পারবি দেখিস৷ কিছুটা যেন নিজেকেই সান্ত্বনা দিলো প্রলয়৷
মহারাজের ঘরের সামনে যাওয়া নিষেধ৷ তাই ভিতরে বিট্টু থাকা সত্ত্বেও, সামনে দাঁড়াতে পারেনি প্রলয় বা ঈশানি৷ বেশ কিছুটা দূরে পায়চারি করছে ওরা৷ ঈশানি ছটফট করছে, সেটা ওর ঘনঘন নিঃশ্বাস নেওয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে৷
একজন শিক্ষকের সাথে লাফাতে লাফাতে বেরোচ্ছে বিট্টু৷ ঈশানির মুখে চিন্তার ঘন রেখা, প্রলয়ের কপালে দুশ্চিন্তার রেখারা প্রকট৷ বিট্টু এসে বললো, মা সব ঠিক বলেছি৷ শুধু মিথ্যেগুলো বলিনি৷ বলেছি, আমি কিশোর ভারতী স্কুলে দু-বছর পড়েছি৷ আপনারা আগের বছর আপনাদের স্কুলে ভর্তি নিলেন না বলেই এই দুর্ঘটনা ঘটলো৷ বলে দিয়েছি, আমার 9+ নয় আমি আরেকটু বড়ো৷ আর বাবা মোটেই দুষ্টু নয়, বরং খারাপ কাজের প্রতিবাদ করে বলেই বাবাইকে পচা লোকেরা বদলি দিয়ে দেয়৷ আর বললাম, আমার রোজ মাছ, মাংস খেতে ভালো লাগে না বলেই মা রান্না করে না৷ আমার সবজি ডাল খুব প্রিয়৷
উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, রোজ রোজ ভালো খাবার জন্য বায়না করতে নেই৷
ঈশানি ধপ করে বসে পড়লো চেয়ারে৷ চোখের সামনে এত দিনের আশার, পরিশ্রমের মৃত্যু দেখলো৷ দু-চোখ দিয়ে অবুঝ জলের ধারা বেরিয়ে আসতে চাইছে৷ প্রলয় হঠাৎ বাম হাত থেকে ঘড়িটা খুলে ডান হাতে পরে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, ওরে তুই মিথ্যে বলবি কি করে! তোর নাম যে সংগ্রাম! যে স্কুলে পাবি সে স্কুলে পড়বি, চল চল বাড়ি চল৷ আজ থেকে আমি ডান হাতে ঘড়ি পরবো৷ আমার ছেলে মিথ্যে বলে না৷ প্রলয়ের চোখে মুখে খুশির দীপ্তি৷ ঈশানি বোকার মতো তাকিয়ে আছে৷ ফিরে চলে আসছিলো ওরা, সত্যিকে সম্বল করে, ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের ধ্বংসাবশেষ নিয়েই ফিরেছিল… ঠিক সেই সময় পিছন থেকে একজন মহারাজ ডাকলেন৷
প্রলয়রা সামনে যেতেই বললেন, যদিও ওর এজটা একটু বেশি, কিন্তু সার্টিফিকেটে ঠিকই আছে৷ তবে আপনার ছেলের সত্য বচনে আমরা মুগ্ধ৷ আর মিস্টার সামন্ত, আপনাদের মতো সৎ মানুষদের বড্ড প্রয়োজন এই অবক্ষয়িত সমাজের৷ ওর অ্যাডমিশন হয়ে যাবে, নিয়ম ভেঙেই না হয় নিয়ম গড়া হোক৷
মহারাজের কথা গুলো শোনার পরেই প্রলয় ধীরে ধীরে বললো, দেখেছো ঈশানি, সত্যের জয় হয় গো, আজও সত্যের জয় হয়৷
সংগ্রাম স্যার বলতেন, তুই সঠিক থাক চারপাশের লোক জন তোকে ভয় পাবেই৷ সত্যিকে লোকে আজও সমীহ করে৷ বিট্টু বললো, বাবাই… সত্যি বললাম বলেই এবারে আমি চান্স পেলাম?
ঈশানি ছেলের মাথায় হাত রেখে বললো, হ্যাঁ বাবা, তুই সত্যি বলেছিস বলেই ওনারা তোকে ভর্তি নিয়ে নিলেন ওনাদের স্কুলে৷
বিট্টু বললো, বাবাই, আই লাভ ইউ৷ আমি বড়ো হয়ে তোমার মতো হতে চাই৷
প্রলয় সামন্ত আবার ডান হাতে ঘড়ি পরেই ডিউটিতে যাচ্ছে৷ এই ক-বছরে এত জায়গায় বদলি হয়েছে ও যে থানার বড়ো বাবুও ওকে একটু ভয়ই পান৷ আড়ালে বলেন, মাথা খারাপ সৎ মানুষ, ওকে একটু সমঝে চলিস তোরা৷ প্রলয়ের সামনে এখন গোল পোস্টটা পরিষ্কার, সেখানে একটাই শব্দ স্পষ্ট ভাষায় লেখা আছে… সত্য৷ প্রলয় বুঝেছে, সত্যিবাদী সন্তানের বাবা হওয়ার গর্বটাও নেহাত কম নয়৷
__