গোলোকপুরের পরশ পাথর – ৬

শীতের সকাল। চারদিকে পাখি ডাকছে। মাঠের এক কোণে মোক্ষদা পিসি বড়ি শুকোতে দিয়েছে।

ক্রিকেট মাঠে অবশ্য সকাল থেকেই বেশ ভিড় হয়েছে। প্রাণনাথ ইন্সটিটিউশন বনাম ভুবনপুর স্কুল।

ভুবনপুর টস জিতল। শিশিরবাবু গম্ভীর মুখে গৌরীনাথের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এটাই তোর লাস্ট চান্স গৌরী। আজকেও যদি ডাক করে আউট হয়ে যাস, তাহলে আমাদের আর কিছু করার থাকবে না”।

গৌরীনাথ মাথা নাড়ল।

শেষ রাতের দিকে ঘুম এসেছিল তার। গবা যে তাকে আস্ত একটা ব্যাট দেবে, সে ভাবতেই পারে নি।

বিদ্যাপতিবাবু খেলা দেখতে এসেছেন। প্রধান শিক্ষক হলেও তিনি ক্রীড়াপ্রেমী। শিশিরবাবু বিদ্যাপতিবাবুর কাছে এসে বললেন, “স্যার, আপনিই সিদ্ধান্ত নেবেন আজকে। গৌরী যেভাবে আউট অফ ফর্ম আছে, মনে হচ্ছে আমাদেরও ইন্ডিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কঠিন সিদ্ধান্ত যদি টিমের স্বার্থে নিতে হয়, তাহলে তো কোন সমস্যা নেই স্যার। ক্লাস নাইনের একটা ছেলে ভাল ব্যাট করছে নেটে। ওকে হয়ত রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে পরের ম্যাচে খেলাতে হবে”।

বিদ্যাপতিবাবু বললেন, “দেখা যাক। গৌরীর একটা শেষ সুযোগ প্রাপ্য। ওকে সে সুযোগ দেওয়া হোক”।

প্রাণনাথের পিন্টু এলাকার ব্যাটসম্যানদের ত্রাস। পিন্টু বাউন্সার স্পেশালিষ্ট। কতজনের যে থুতনি ফেটেছে, তার ইয়ত্তা নেই।

এই দুটো টিমের মধ্যে রেষারেষি আজকের না। বহুদিনের। খেলায় যে হার জিত আছে, তা এই দুটো দল কিছুতেই মানে না। এক দল হারলে অপর দল প্রবল দুয়ো দিতে শুরু করে। অবশ্য আজকের ম্যাচ হারলে ভুবনপুরের টিম এমনিতেই টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যাবে।

তার দলের ছেলেরা কিছুতেই তাকে ওপেন করতে দিচ্ছিল না। গৌরী জোর করে ওপেন করতে নামল।

ব্যাট করতে নামার সময় শুনতে পেল তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে পিন্টুকে ওদের ক্যাপ্টেন অমিয় বলছে, “ওহ, এই ছেলেটা তো এক বলের খদ্দের। যাবে আর আসবে। এমন একটা বাউন্সার দে, আর যেন কোনদিন মাঠে নামার সাহস না করে”।

তা দিলও পিন্টু। প্রথম বলটাই বাউন্সার।

নতুন বলটা পিচে পড়ে গৌরীর হেলমেট ছোঁয়ার জন্য উতলা হয়ে ছুটে এল।

গৌরীনাথ বলটাকে বিন্দুমাত্র রেয়াৎ না করে প্রবল জোরে হুক মারল। একবারে যেন কপিবুক শট। ব্যাটে লাগামাত্র বলটা এত দ্রুত মাঠ ত্যাগ করল যে, কেউ চোখের পলক ফেলবার সময়টুকুও পেল না। গৌরীনাথ শিশির স্যারের দিকে তাকালো। শিশির স্যার হাতের ইশারা করে ধীরে খেলার সংকেত দিলেন। কোন রকম প্রলোভনে পা দিতে বারণ করলেন।

পিন্টুর পরের বল অফস্ট্যাম্পের বাইরে। অন্য দিন হলে ছেড়ে দিত। কানায় লাগার চান্স থাকে। আবার এরকম বলেই আগে কতবার আউট হয়েছে সে! এবার আর কোন ভুল হল না। বলটাকে সজোরে স্কোয়ার কাট মারল। অমিয়র মাথার উপর দিয়ে চার রান হয়ে গেল। শিশির বাবু টুপি খুলে তার প্রশস্ত টাকে হাত বোলালেন। এ ছেলেটা কথা শোনার নয়। পরের বলটা নিখুঁত ইয়র্কার হল।

অন্য দিন হলে গৌরীনাথ শুধু ব্লক করতো। এদিন হাঁটু মুড়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে সে বলটাকে সজোরে সুইপ করল। বাধ্য ছেলের মত বলটা গড়াতে গড়াতে বাউন্ডারি পেরিয়ে মোক্ষদা পিসির বড়ির মধ্যে গিয়ে লাগল। মোক্ষদা পিসির প্রতিবাদে খেলা দু মিনিট বন্ধ হয়ে গেলো।

“অলপ্পেয়ে ছোকরাগুলোর জ্বালায় আমি কি একটু বড়িগুলো রোদে দিতে পারবো না?”

শিশিরবাবু গিয়ে স্পেশাল রিকোয়েস্ট করায় শেষ মেশ মোক্ষদা পিসি বড়ি নিয়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে যেতে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

প্রথম ওভার শেষে রান হল ৬, ৪, ৪, ৪, ৪, ৬। শিশির বাবু চিৎকার করতে শুরু করলেন, “ওরে তোকে বাদ দেবো বলেছি বলে রেগে গেলি নাকি? দেখে খেল বাবা”।

বাধ্য ছেলের মত মাথা নাড়ল গৌরীনাথ। কিন্তু তার পার্টনার বগা একটা সিঙ্গেল নিয়ে তাকে ব্যাট করতে দিতেই আবার তাণ্ডব শুরু করল সে। একটা ছেলে ভারি সুন্দর চায়নাম্যান বল করে। টুর্নামেন্টে অনেকগুলো উইকেট নিয়েছিল। তার ছ বলে ছ’টা ছয় মারল গৌরীনাথ।

মাত্র তিরিশ বলে সেঞ্চুরি হয়ে গেল তার। যত রকম শট হয়, সব রকম মারল সে। পুল, হুক, স্কোয়ার ড্রাইভ, আপার কাট, দিলস্কুপ, এমনকী রিভার্স সুইপ মারতেও ছাড়ল না।

গ্রামের লোকজন মাঠের চারধারে জড়ো হয়ে নাচতে শুরু করল। কেউ আবার বাজি নিয়ে এল। বাজি ফাটতে শুরু করল। প্রাণনাথের ছেলেরা একটা সময় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। পঁচিশ ওভারের ম্যাচে গৌরী একাই করল তিনশো আশি রান। জেলা থেকে বিশেষ পর্যবেক্ষক এসে শিশিরবাবুকে বললেন, “কী কী রেকর্ড ভাঙল বলতে পারবেন মশাই? আমার তো এ ছেলের ব্যাট দেখে রীতিমত হৃদকম্প হচ্ছে। একে এখনই আই পি এলের কোন ক্লাব লুফে নেবে। ইন্ডিয়া টিমে চান্স পাওয়া তো সময়ের অপেক্ষা”।

শিশিরবাবু টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, “আমিও তো বুঝতে পারছি না মশাই। সাতটা ম্যাচে পর পর শূন্য রানে আউট হয়েছিল। আজ শুধু বলেছিলাম টিম থেকে বাদ চলে যাবি। তারপর মাঠে নেমে যা করল, তা তো ইতিহাস”।

পর্যবেক্ষক বললেন, “আমাকে কলকাতায় খবর দিতে হবে। এরকম প্রতিভা তো ফেলে রাখা যাবে না। দরকার হলে ওর স্পেশাল গ্রুমিং করাতে হবে”।

বিদ্যাপতিবাবু বললেন, “যাই করবেন, আমাদের স্কুলের নামটা যেন থাকে। সেটা যেন বাদ না যায়। আমি গৌরীনাথকে স্কুলরত্ন পুরস্কার দেবো। আর কী কী পুরস্কার দেবো, সেটা ভেবে ঠিক করতে হবে”।

মাঠ থেকে স্কুলের ছেলেরা কাঁধে করে গৌরীনাথকে নিয়ে এল। যে ছেলেরা তার সঙ্গে এ ক’দিন ঠিক করে কথাই বলছিল না, তাদের কাঁধে করে ফেরার সময় গৌরীনাথের কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, সে এত রান করেছে। সে যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। ব্যাটটার মধ্যে কি সত্যিই জাদু আছে? গৌরীনাথ যত্ন করে ব্যাটটা কিটব্যাগের মধ্যে রাখতে গিয়ে অবাক হল। এটা তো গবার দেওয়া ব্যাটটা নয়! সে যে ব্যাটটা নিয়ে এতদিন শূন্য করে এসেছে, এটা সেই ব্যাটটাই। এই তো, আগের ব্যাটের কোণায় সে জি লিখেছিল, এই ব্যাটটাতে সেটাই লেখা আছে!

ব্যাট করতে যাবার তাড়াহুড়োয়, আর টেনশনে সে তার নিজের ব্যাটটা নিয়েই ব্যাট করতে চলে গেছিল। এত এত রান তাহলে কোন জাদুমন্ত্রে হয় নি? সে নিজেই করেছে? সবার লাফালাফির মধ্যে অবাক হয়ে সে তার নিজের ব্যাটটার দিকে তাকিয়ে রইল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *