গোলোকপুরের পরশ পাথর – ৫

লোকটা অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে থেকে অধৈর্য হয়ে পড়েছিল।

গবার মন্ত্রোচ্চারণই করে যাচ্ছে গবা সেই তখন থেকে।

গৌরীনাথ চলে যাবার পর আর থাকতে না পেরে লোকটা বলল, “আমায় কলকাতা চলে যেতে হবে। আমাকে কি একটু তাড়াতাড়ি ছাড়া যায় না?”

গবা লোকটার দিকে না তাকিয়েই বলল, “শহরে গিয়ে তুই যতই মুখ পালটে আসিস তারক, তোকে আমি ঠিকই চিনতে পেরেছি। চৌধুরী খুড়োর সিন্দুক ভেঙে তুই পালিয়ে গেছিলি, পনেরো বছর হতে চলল, এখন আবার কী করতে এসেছিস?”

লোকটা বলল, “আমি কেন তারক হতে যাবো? আশ্চর্য! বাজারে একটা পাগলের সঙ্গে দেখা হল, সে বলল তারক, আপনিও তারক বলছেন! কে এই তারক?”

গবা তান্ত্রিক হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে লোকটার কপালে হাত রাখল। লোকটা ভেবলে গেল। গবা বেশ কয়েক সেকেন্ড লোকটার কপালে হাত রেখে বলল, “কী করতে এসেছেন এখানে?”

লোকটা বলল, “আমি একটা সিনেমার কাজে যুক্ত। সিনেমায় তন্ত্র মন্ত্র দেখানো হবে। আমাকে আমাদের প্রোডাকশান ম্যানেজার… সরি, আপনি বুঝবেন না, আমার বস বললেন গ্রামের একজন তান্ত্রিকের সঙ্গে দেখা করে আসতে। আমাদের সেটে যে ছেলেটা চা দেয়, সে আপনার কথা বলল”।

গবা পিটপিট করে লোকটার দিকে তাকিয়ে হাসতে শুরু করল। লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “কী হল?”

গবা বলল, “আমি কি চিড়িয়াখানার বাঁদর? আমাকে দেখতে আসার কী আছে রে তারক? আবার কত বোল চাল ফুটেছে রে তোর! প্রোডাকশান ম্যানেজার? খিক খিক খিক।”

লোকটা রেগে গিয়ে বলল, “কতবার বলব আমি তারক না?” গবা লোকটার গলা টিপে ধরে বলল, “টাকাগুলো সব শেষ হয়ে গেছে না? এখানে আবার আমার থেকে মোহর নিতে এসেছিস! সত্যি করে বল?” লোকটা চি চি করে বলল, “ছাড় গবা, আমাকে ছেড়ে দে”।

গবা লোকটার গলা ছেড়ে দিল। লোকটা গলায় হাত দিয়ে কোন মতে সামলে উঠে বলল, “ঠিকই চিনেছিস তাহলে। কী করে চিনলি? তোর দেওয়া ওই মোহরগুলো বেচেই আমার অনেক দিন চলেছে। কিন্তু এখন আবার সব শেষ হয়ে গেছে। আমাকে আরো কিছু মোহর দে।”

গবা লাল চোখে তারকের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই এখান থেকে চলে যা তারক। এখানে আমি ভালো আছি। আমার কাছে আর কোন মোহর নেই। পৃথিবীর উপর থেকে সব মায়া ত্যাগ করেছি আমি। তুই চলে যা”।

তারক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আজ যাচ্ছি। কিন্তু আমি আবার আসবো। আমার মোহর লাগবে। যেখান থেকেই হোক আমাকে জোগাড় করে দিতে হবে তোকে। আমি ঠিক আসব। আমার মোহরগুলো চাই গবা। তুই লুকিয়ে বাঁচতে পারবি না”।

গবা হাসতে শুরু করল। হাসতে হাসতে বলল, “কে যে কার থেকে লুকোয়, মা কালীই জানেন। যা যা। তুই যে নরক থেকে এসেছিস, সে নরকে ফিরে যা। তোর আর কিছু হবে না”।

তারক লাল চোখে কিছুক্ষণ গবার দিকে তাকিয়ে গবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। গঙ্গারাম দাঁড়িয়ে ছিল। রিক্সায় উঠে বলল, “স্টেশনে চল”।

গঙ্গারাম রিক্সায় উঠে প্যাডেলে চাপ দিল। গবা ঘর থেকে বেরিয়ে বলল, “বাবুকে সাবধানে নিয়ে যা গঙ্গা। আবার রিক্সা নিয়ে ফেলে দিস না কোথাও”।

গঙ্গারাম রেগে গেল, “কেন ফেলে দেবো? আজ অবধি ফেলেছি কোথাও?”

বলতে না বলতেই একটা ইটের টাল সামলাতে না পেরে গঙ্গার রিক্সা বড় ড্রেনে পড়ে গেল। গবা নাচতে শুরু করল, “পড়ে গেছে, পড়ে গেছে, গঙ্গার রিক্সা পড়ে গেছে, ও হো হো হো”।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *