গোলোকপুরের পরশ পাথর – ১

এবারেও শূন্য রানে আউট হয়ে গেল গৌরীনাথ। খুব এলেবেলে বল ছিল।

অফস্ট্যাম্পের বাইরে হাফ ভলি। যখন ফর্মে ছিল, এই বলকেই অবলীলায় মাঠের বাইরে পাঠিয়েছে। এবার সেসব কিছুই হল না। বলটা দেখে সে এতটাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েছিল, খুব জোরে মারতে গেল। কী থেকে যে কী হয়ে গেল, বলটা ব্যাটের ভেতরের দিকে লাগল। পরমুহূর্তেই সে বুঝতে পারল অফস্ট্যাম্পটা আহত হয়েছে, এবং তার উইকেটটি নিহত।

মাথা নাড়তে নাড়তে ফিরে এসে গেমস টিচার শিশিরবাবুর সামনে পড়ে গেল সে। শিশিরবাবু রাগী গলায় বললেন, “এটা কী করলি তুই? মন কোথায় ছিল এবারে? এই বলে কেউ আউট হয়? ওদের ওই বোলারটা লাস্ট তিন বছর একটা উইকেটও পায় নি। এবার কী আনন্দ করছে দেখ”।

বাস্তবিকই তাই। সে বাউন্ডারির বাইরে চলে এসেছে অথচ ছেলেটা এখনও লাফিয়ে যাচ্ছে। সারাদিন ফিল্ডিং করে ব্যাট করতে নেমে প্রথম বলেই আউট। দলের বাকিরা তার দিকে করুণা মিশ্রিত বিদ্রূপের চোখে তাকিয়ে আছে। দলের ক্যাপ্টেন একটার পর একটা ম্যাচে শূন্য রানে আউট হয়ে যাচ্ছে।

গৌরীনাথ স্যারকে বলল, “স্যার, বাড়িতে কাজ আছে। আমি বরং চলে যাই। আর ক্যাপ্টেন্সিটা এখন থাক বরং”।

শিশিরবাবু গজগজ করতে করতে বললেন, “হ্যাঁ, আর থেকেই বা কী করবি? কত আশা ছিল তোর উপরে। আমি ভেবেছিলাম তুই ইন্ডিয়া খেলবি। এখন তো মনে হচ্ছে তোকে স্কুলের টিম থেকেই বাদ দিতে হবে। ক্যাপ্টেন্সি তো দূরের কথা”।

গৌরীনাথ আর থাকল না। তারও মন খারাপ হয়ে গেছিল। মাথা নিচু করে মাঠ থেকে বেরিয়ে গেল।

কিছুক্ষণ চুপ করে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বাড়ির দিকে রওনা দিল।

বাউন্ডারির বাইরে রামখিলন গোয়ালার মহিষেরা শুয়ে আছে। তার দিকে জুল জুল করে তাকালো। অন্যদিন হলে গৌরীনাথ তাদের আদর করে দিত। আজ মন এতটাই খারাপ ছিল যে সেসব কিছুই করল না। জোরে প্যাডেল করতে শুরু করল।

ঠিকই তো! তার কী যেন হয়েছে। সারাদিন ধরে সে প্র্যাকটিস করে যাচ্ছে অথচ মাঠে নামলেই গোল্লা। সব কিছুই কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

শীতের দুপুরের রোদ হলেও রোদটা মোটেই নরম নয়। বরং তেজটা ভালোই জানান দিচ্ছে। পাড়ার রাস্তায় বাচ্চারা ডাং গুটি খেলছে। অন্য দিন হলে গৌরীনাথ নিজেও খেলতে নেমে যেতো। এদিন নামল না। তাকে সবাই কত করে ডাকল, তাদের কথা গৌরীনাথ যেন শুনতেই পেল না।

রুনু পিসি বাড়ির সামনে আচার শুকাতে দিয়েছে। সাইকেল দাঁড় করিয়ে উদাস মনে আচারের বয়ামে হাত বাড়াতেই কোত্থেকে রুনু পিসি দৌড়ে এলো, “কী রে, তোদের জন্যই তো করি। এগুলো এঁটো না করলেই নয়?”

গৌরীনাথ অন্যমনস্ক ভাবে বয়ামের ভিতর হাত ঢুকিয়ে খানিকটা আচার খাবলে নিয়ে মুখে পুরে বলল, “ভাল লাগছে না পিসি। এখন খুব মন খারাপ। বাধা দিও না তো”!

রুনু পিসি চিন্তিত মুখে বলল, “কী হয়েছে তোর? কেন মন খারাপ?”

গৌরীনাথ বলল, “আজকেও আমি শূন্য রানে আউট হয়ে গেলাম। কী যে হয়েছে কে জানে। এর পর তো স্কুল টিম থেকেই বাদ হয়ে যাবো”।

রুনু পিসি দুঃখী গলায় বলল, “তাহলে কী হবে তোর? তোর বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে আমরা তোকে খেলতে পাঠালাম। এভাবে রোজ রোজ শূন্য রানে আউট হয়ে গেলে তোর বাবাকে আমরা কী উত্তর দেবো?”

আচারটাও কেমন তেতো লাগছিল তার। গৌরীনাথ বলল, “বাবা কবে ফিরবে যেন?”

রুনু পিসি বলল, “আর দিন পনেরো পরে। মেলা শেষ হবে আর তোর বাবাও এসে হাজির হবেন। এসে যেই শুনবে তুই স্কুলের টিম থেকে বাদ চলে গেছিস, নিশ্চয়ই তোর খেলা ছাড়িয়ে দেবে”।

গৌরীনাথ বলল, “তারপর আমাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেবে। বলবে পড়াশুনা করে যা। খেলাধুলো বন্ধ। নইলে কিচ্ছু হবে না”।

রুনু পিসি বলল, “তোকে কি স্যার আর একটাও সুযোগ দেবে না?”

গোরীনাথ বিষণ্ণ গলায় বলল, “না মনে হয়। আমার কপালে ওই হোস্টেলই নাচছে”।

রুনু পিসি বলল, “আমি বলি কী, তুই একবার গবা তান্ত্রিকের কাছে গিয়ে দেখ। গবা অনেক রকম মন্ত্র জানে, কারা নাকি বলে, গবা খুব ভাল বশীকরণও করতে পারে। আমার সঙ্গে যাবি?”

গৌরীনাথ রেগে গিয়ে গলল, “না, এসব বুজরুকির মধ্যে আমি নেই। এসব বিশ্বাস কর কেন?”

রুনু পিসি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এই জন্য আমি তোকে বলতে চাইনি। ঠিক আছে বাবা। হাত মুখ ধুয়ে আয়। ভাত বেড়ে দি। খেয়ে নে। ক’দিন ধরে ভাল করে খাওয়া দাওয়াও করছিস না। সারাক্ষণ শুধু রান পাচ্ছি না, রান পাচ্ছি না বলে চলেছিস। এভাবে শরীরটা থাকবে না বাপু। যা তো, দেরী করিস না”।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে গৌরীনাথ কুয়োর দিকে রওনা দিল। দু মাস আগেও সে ইন্টারস্কুল টুর্নামেন্টে সেঞ্চুরি করেছিল। তাও মাত্র আশি বলে। পাশের গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টারমশাই তার ব্যাটিং স্টাইলের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছিলেন, “আহা, কী দেখিলাম! জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না। এমন ছেলের কাছে ম্যাচ হেরেও সুখ। যেন খোদ গাভাসকারকে দেখলাম। কী অনবদ্য ব্যাটিং! কতদিন পর এমন একটা ছেলে চোখে পড়ল। শোনো ছোকরা, তোমার যদি মনে হয় তুমি আমাদের স্কুলে ভর্তি হবে, এনি ডে চলে আসবে। তোমার পঠন পাঠন সব বিনামূল্যে হবে”।

তাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিদ্যাপতিবাবু বেজায় রেগে গেলেন। কেন তার স্কুলের গর্বকে খর্ব করার চেষ্টা হবে? তুমুল ঝামেলা শুরু হয়ে গেছিল।

সেসবই এখন অতীত।

পাড়ার মোড়ে মাইক বাজছে। মেলা হবে। কত লোক আসবে। অন্য সময় হলে সে মেলার জন্য খুব খুশি হত। এখন মনে কোন খুশিই যেন আসছে না। খেতে বসে মনের ভুলেই যে দু থালা ভাত খেয়ে ফেলল। হাত মুখ ধুয়ে

সাইকেল নিয়ে পোড়ো বাড়ির জঙ্গলে গিয়ে বসে রইল সে। কবে রান পাবে আর? মা মারা যাবার পর বাবা হোস্টেলে ভর্তি করে দেবে, সব একবারে ঠিক হয়ে গেছিল। কোন মতে সেটাকে ঠেকিয়ে রেখেছিল রুনু পিসি।

ক’দিন পর সে যখন ক্রিকেট খেলতে শুরু করল, বাবা তো কিছুতেই মানবে না। কপালজোরে সে বারই সে পর পর তিনটে সেঞ্চুরি করেছিল। বিদ্যাপতিবাবু নিজে বাড়িতে এসে তার বাবাকে জোরাজুরি করেছিলেন, যার জেরে সে বারের মত হোস্টেলভর্তি আটকে গেছিল।

এখন বিদ্যাপতিবাবু আর কেন ওসব করতে যাবেন?

একা একা মনমরা হয়ে বসে রইল গৌরীনাথ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *