১
”আমি যখন ক্ষুধার্ত, তখন তুমি খাবার দিলে,
আমি যখন নিরাবরণ, তুমি তখন বস্ত্র দিলে।
আমি যখন গৃহহীন, তুমি আমায় ঘরের মধ্যে ডেকে নিলে।
আমি যখন কারাগারে অসুস্থ এক বন্দি, তুমি আমাকে দর্শন দিলে!”
ফাদার জেমসন ভক্তিভরে নিজের বুকে ক্রস আঁকলেন। তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন চ্যাপেলে। সেন্ট সেবাস্টিয়ান লিটল হোমের সার সার ঘর পেরিয়ে একেবারে কোণে রয়েছে এই ছোট্ট চ্যাপেল। উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে অনেকগুলো সুদীর্ঘ মোমবাতি। দেওয়ালে ঝুলছে যিশুর প্রতিকৃতি। নাতিদীর্ঘ এই উপাসনাগৃহ বাহুল্যবর্জিত হলেও রুচির ছাপ সর্বত্র।
ঘরের ওপারে খোলা বাগান। সেখানে ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে জোনাকিরা। জানলা বেয়ে ভেসে আসছে সমুদ্রের নোনা হাওয়া আর লতানে ব্ল্যাকবেরি গাছের হালকা গন্ধ। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে গানের সুর। সঙ্গে গিটার।
ফাদার জেমসন ধীরপায়ে এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে। বাঁদিকের দেরাজ খুলে বের করে আনলেন ছোট্ট একটা বাক্স। নিজের সাদা পোশাকের পকেট থেকে চাবি বের করে সন্তর্পণে খুললেন, হাত দুটো ভালো করে ঘষে নিয়ে বাক্সের ভেতর থেকে বের করে আনলেন একটা ডিম্বাকৃতি পদক। সোনালি রঙের ধাতব পদকটাকে মুখের কাছে এনে চোখ বন্ধ করে চুমু খেলেন। বিড়বিড় করে বললেনও কিছু। তারপর আবার ঢুকিয়ে রাখলেন ভেতরে।
”ওটা কী, ফাদার?”
”এটা মিরাকুলাস মেডেল, পবিত্র…!” ফাদার জেমসন বলতে বলতে থেমে গেলেন। পরিচিত কণ্ঠস্বর।
আজ হোমে লোকজন বিশেষ কেউ নেই। কয়েকদিন টানা ছুটি আছে, যে যার বাড়ি চলে গেছে। থাকার মধ্যে রয়েছে শুধু রাঁধুনি গিট্টু। রাত গভীর হয়েছে, গিট্টু ঘুমোচ্ছে। চ্যাপেলের মধ্যে মোমবাতি জ্বললেও প্রবেশদ্বারের কাছটায় আলো জ্বালানো নেই। আর যান্ত্রিক আলো জ্বালাতে ফাদার খুব বেশি পছন্দ করেন না।
”আরে তুমি!” ফাদার স্মিতকণ্ঠে বলে উঠলেন, ”অনেকদিন দেখা পাইনি তো!”
কোনো উত্তর নেই। ফাদার সন্দিগ্ধভাবে এগিয়ে এলেন। হাতে ধরে-থাকা মোমবাতিটা উঁচু করে ধরে আরও একটু এগিয়ে এসে গিট্টুকে ডাকতে চাইলেন। কিন্তু পারলেন না।
হঠাৎ একটা ‘আহ’ শব্দ বেরিয়ে এল তাঁর মুখ দিয়ে।
মিনিটখানেক মাত্র। তাঁর সুস্থ সবল পা দুটো ছটফট করতে করতে হঠাৎই বিদ্রোহ ঘোষণা করে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। সঙ্গে ছ-ফুট উচ্চতার বিশাল দেহটাও।
চ্যাপেলের বাইরে হোমের অফিসঘরে রাখা বড়ো ঘড়িতে যখন ঢং ঢং করে বারোবার ঘণ্টা বাজল, ততক্ষণে দুর্বল মোমবাতিটা কাঁপতে কাঁপতে পড়ে গিয়েছে মাটিতে।
গলন্ত মোম টপটপ করে পড়ছে ফাদারের নিষ্প্রাণ হাতের ওপর।
২
৬ জানুয়ারি, ২০০৬
সেন্ট ইনেজ ক্রিশ্চান কবরখানা, গোয়া
ভারতবর্ষের পশ্চিম উপকূলের এই সমুদ্রনগরীতে সেভাবে কখনোই জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়ে না। তা-ই বলে জানুয়ারির ঝকঝকে সকালে এমন আকাশ ভেঙে যে বৃষ্টি নামতে পারে, তা সকলেরই ধারণার বাইরে ছিল। সকলে বলতে দু-তিনজন লোকাল নিউজ চ্যানেলের রিপোর্টার, এই কবরখানার কিছু কর্মী আর কয়েকজন কাজকর্ম না-থাকা ভবঘুরে প্রকৃতির লোক।
কেউই ছাতা বা রেইনকোট নিয়ে আসেনি। ফলে পুলিশ ভ্যান যখন ডেডবডি নিয়ে কবরখানায় ঢুকল, অধিকাংশজনই কাকভেজা হয়ে গিয়েছে।
দু-একজন কিছুক্ষণের জন্য মাথা বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিল পাশের সেন্ট অ্যাগনেস চার্চে, কিন্তু কতক্ষণ? তা ছাড়া সেখান থেকে তো ফাদারের স্তব বা শেষকৃত্য কিছুই দেখা যাবে না। গোরখোদকরা ভিজতে ভিজতে কবরের গর্ত খুঁড়ছিল, লোকজনও চুপচাপ ভিজতে ভিজতে তা-ই দেখছিল।
শুধু দুজন মানুষ কালো রঙের ছাতা মাথায় দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। দুজনেই প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হয়েছেন, দুজনেরই মাথায় কালো গোল টুপি, পরনে ওভারকোট। আশপাশের কয়েকজন সেই দুটো ছাতায় আশ্রয় নেবে বলে এগিয়ে এলেও দুজনের মুখের গম্ভীর অভিব্যক্তিতে ও আভিজাত্যে কিছু বলার সাহস পেল না।
প্রথমজন পকেট থেকে একটা সাদা রুমাল বের করে মুখ মুছলেন। বললেন, ”বৃষ্টি বড়ো প্রিয় ছিল ফ্রেডির। আর আজকের দিনেও বৃষ্টি। কী অদ্ভুত সমাপতন বলো জেল!”
”হুম। সেদিনও এমনই বৃষ্টি পড়ছিল।” জেল নামক দ্বিতীয় ভদ্রলোক বিড়বিড় করলেন, ”যেদিন তুমি…”
”জানি। মনে আছে।” প্রথমজন আবারও মুখে ছিটকে-আসা অদৃশ্য বৃষ্টির ফোঁটা মুছলেন, ”ফ্রেডি কবে মারা গেছে, জেল?”
”কেন ডমিনিক, তুমি জানো না? গত বছর এপ্রিলে।”
”এপ্রিল! আর এটা জানুয়ারি। ন-মাস ধরে ওর বডি কোথায় ছিল?”
”পুলিশের মর্গে।”
”হোলি জেসাস! কেন?”
”কেন আবার!” ডমিনিকের এমন বালখিল্য প্রশ্নে জেল বুঝি একটু বিরক্তই হলেন, ”যদি কোনো আত্মীয় এসে বডি ক্লেইম করে, তাই!”
”কিন্তু ফ্রেডি তো অবিবাহিত ছিল!”
”সেটা তুমি জানো, আমি জানি, পুলিশও জানে। কিন্তু আইনের তো কিছু নিয়মকানুন আছে।” জেলের ঠোঁটের ডান পাশে একটা সূক্ষ্ম ব্যঙ্গের ভাঁজ পড়ল, ”তোমার শেষ বইটা ক্রাইম থ্রিলার না? এই তুমি গোয়েন্দা গল্প লেখো!”
ডমিনিক চাপাস্বরে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় একজন দীর্ঘদেহী সুদর্শন ধর্মযাজক এসে উপস্থিত হলেন। পরনে গলাবন্ধ সাদা জোব্বা। বুকে ঝুলছে একটা বড়ো মাপের ক্রস। পেছনে রয়েছে তাঁর গুটিকয় অনুগামী। তাদের হাতে নানারকম ফুলের মালা। পরনে একই পোশাক। বৃষ্টি থেমেছে এর মধ্যে।
সাত-আটজন সাদা পোশাকের লোক গাড়ি থেকে নেমে পেছনের ভ্যান থেকে ধরাধরি করে প্লাস্টিকে মোড়া একটি শব নামিয়ে আনছিল, তাদের সুপারভাইজ করতে-থাকা পুলিশ অফিসারটি শশব্যস্ত হয়ে সসম্ভ্রমে এগিয়ে গেলেন ধর্মযাজকের দিকে, ঈষৎ ঝুঁকে অভিবাদন জানালেন। স্যারের দেখাদেখি ঝুঁকতে লাগল কনস্টেবলরাও।
”ইনি কে, জেল?”
”ফাদার ভ্যালেরিয়ান ভাজ। এই অঞ্চলের সবচেয়ে মান্যগণ্য যাজক। ফ্রেডির শেষকৃত্য উনিই সম্পন্ন করবেন।”
”ফ্রেডি কি খুব ভুগছিল?”
জেল দ্রুত মাথা নাড়লেন, ”আমি কোনো খবর রাখতাম না।”
কবর খোঁড়া শেষ। একটানা বৃষ্টির পর প্রকৃতি শান্ত হলেও থমথম করছে চারপাশ। প্লাস্টিকে মোড়া শবকে ঢোকানো হয়েছে সুদৃশ্য কারুকাজ-করা কফিনের মধ্যে।
ফাদার ভ্যালেরিয়ান ভাজ ধীরপায়ে এগিয়ে এলেন সেদিকে। তাঁর হাতে রয়েছে খোলা বাইবেল।
”এখানে যিনি চিরঘুমে শায়িত রয়েছেন, তিনি তাঁর জীবনের একটা বড়ো অংশ কাটিয়েছেন কারাগারে। প্রায় কুড়ি বছর কারাগারের অন্তরালে থেকে তিনি পাপী ও নিষ্পাপ, দু-ধরনেরই আত্মার সংস্পর্শে এসেছেন। আমরা আত্মবিশ্বাসী যে, এভাবেই ঈশ্বর তাঁকে স্পর্শ করেছেন। তাঁকে ক্ষমা করেছেন!”
মন্দ্রস্বরে কথাগুলো বলে ফাদার ভাজ বাইবেলের একটি পৃষ্ঠা পড়তে শুরু করলেন, ”আমাদের সকলকেই ঈশ্বরের কাছ থেকে ক্ষমা পেতে হবে। আমরা সকলেই পাপ করেছি। পৃথিবীতে এমন কোনো সৎ লোক নেই যে সব সময় ভালো কাজ করে, কখনো পাপ করে না। যদি আমরা বলি আমাদের মধ্যে পাপ নেই তবে আমরা নিজেদের ফাঁকি দিই। এতে এটাই বোঝা যায় যে, আমাদের অন্তরে ঈশ্বরের সত্য নেই। সমস্ত পাপই হচ্ছে চূড়ান্তভাবে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। এই কারণেই ঈশ্বরের কাছ থেকে ক্ষমা লাভ করা আমাদের জন্য একান্তই প্রয়োজন। আমাদের পাপ যদি ক্ষমা করা না হয়, তাহলে আমরা আমাদের পাপের ফল হিসাবে অনন্তকাল ধরে শাস্তি ভোগ করব। তাই মহামহিম ঈশ্বর সবাইকেই ক্ষমা করেন।”
ফাদার ভাজ অনুচ্চ অথচ দৃঢ়স্বরে বাইবেল থেকে আবৃত্তি করছিলেন। পুলিশ ইনস্পেকটরটি নিচু গলায় নিজের টিমকে কিছু নির্দেশ দিচ্ছিলেন। অত্যুৎসাহী তরুণ সাংবাদিকগুলো গিয়ে তাঁকে খুচরো প্রশ্ন করছিল, তিনি দু-এককথায় উত্তর দিচ্ছিলেন।
ডমিনিক আবার নিচুস্বরে বললেন, ”আমাদের এজেন্সির খবর কি ফ্রেডির কানে পৌঁছেছিল?”
”জানি না।”
ডমিনিক একটা নিশ্বাস ফেললেন, ”বেচারা ফেঁসে গেল। অস্কারের কী খবর, জানো জেল?”
”না।”
”আর বাকি সবাই?”
জেল নামক প্রৌঢ় এবার বেশ বিরক্ত হলেন, ”তোমাকে তো বললাম, আমি কারো খবরই রাখি না। ব্যাবসা নিয়েই আমি জেরবার। কেন এক প্রশ্ন বার বার করছ?”
ডমিনিক রাগলেন না, হেসে বললেন, ”খবর না রাখলে আমার ক্রাইম থ্রিলার লেখার খবর পেলে কী করে!”
”তোমার খবর রাখি না সেটা তো বলিনি!” জেল বিড়বিড় করলেন, কিন্তু তা শোনা গেল না।
”বিচারের নামে প্রহসন চলে যিশুকে দেওয়া হয়েছিল মৃত্যুদণ্ড। ক্যালভারি পাহাড়ে ক্রুশ কাঠে ঝুলিয়ে মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে পেরেক মেরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় যিশুকে। মৃত্যুর আগে যিশু নিজেও ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন, হে পিতা! তুমি ওদের ক্ষমা করো। ওরা জানে না ওরা কী করছে!”
ফাদার ভাজ বাইবেল বন্ধ করলেন। চোখ বন্ধ করে নিজের বুকে আঁকলেন ক্রসচিহ্ন। স্মিতমুখে বললেন, ”আসুন, আমরা আমাদের এই বন্ধুর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি। আসুন, আমরা আমাদের এই বন্ধুকে ঈশ্বরের হাতে তুলে দিই। ঈশ্বর তাঁকে ক্ষমা করুন। ঈশ্বর তাঁকে চিরন্তন বিশ্রাম দিন।” বৃষ্টি ছাপিয়ে ফাদার ভাজের কণ্ঠস্বর ক্রমশই উঁচুতে উঠছিল, ”ফ্রেডি পিট, রেস্ট ইন পিস!”
একটা লোক দ্রুত গর্তের চারপাশে জ্বেলে দিল চারটি মোমবাতি। বৃষ্টিশেষের দমকা হাওয়ায় সেগুলো কেঁপে কেঁপে উঠলেও নিভল না। ফাদার ভাজ পাশের এক অনুগামীর কাছ থেকে ফুলের ক্রসটা নিয়ে এগিয়ে গিয়ে রাখলেন কফিনের ওপর।
গোরখোদকরা প্রস্তুত হয়েই ছিল। দড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে গর্তে নামানো হতে লাগল কফিনটাকে।
মাটি যতক্ষণে বুজিয়ে দেওয়া হল, ততক্ষণে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মোমবাতিগুলো নিভে গিয়ে এ ওর ঘাড়ে পড়ে গিয়েছে। দাঁড়িয়ে থাকা রিপোর্টাররা তো বটেই, বাকিরাও চলে গিয়েছে।
ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন শুধু দুজন প্রৌঢ়। বৃষ্টির ছাটে তাঁদের দুজনেরই চশমার কাচ ঝাপসা হয়ে গিয়েছে।
৩
৮ ডিসেম্বর ২০২২
শীতের মধ্যরাত। ঠিক রাত বারোটায় যে প্লেনটা কলকাতা এয়ারপোর্ট থেকে উড়ে গিয়েছিল, তার যাত্রা শেষ হয়েছে সাড়ে তিন ঘণ্টা পর। অধিকাংশ যাত্রীই ঘুমে আচ্ছন্ন। বিমানসেবিকাদের ক্রমাগত ঘোষণায় তাঁরা একরকম ধড়মড় করে উঠে প্লেনের মাঝখানের সরু প্যাসেজে দাঁড়িয়ে পড়ছিলেন।
তাতে সমস্যা আরও বাড়ছিল। যাঁরা ঘুমোচ্ছিলেন, তাঁরা দাঁড়াতে যাওয়া যাত্রীদের বারংবার গুঁতো খেয়ে খুব বিরক্ত হয়ে পড়ছিলেন। এই মাঝরাতের ফ্লাইটেও ভিড়ের কোনো কমতি নেই।
এই ক্যাঁচরম্যাচরের মধ্যেও রুদ্রাণী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল।
সারাদিন অফিসে খুব খাটনি গিয়েছে। বহু পুরোনো একটা জাল নোটের অপরাধচক্র আবার মাথাচাড়া দিয়েছে কলকাতা শহরে। ইনভেস্টিগেশন টিমের একজন সদস্য হিসেবে গত এক সপ্তাহ ওদের টিমের নাওয়া-খাওয়া প্রায় বন্ধ। আজ সকাল অবধিও ভয়ে ভয়ে ছিল, ছুটিটাই না ক্যানসেল হয়ে যায়। কিন্তু তা হয়নি। সিটের একদিকে মাথা হেলিয়ে ও নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিল। ব্যাঙ্ক ছেড়ে ইউ. পি. এস. সি. পরীক্ষা দিয়ে ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসে জয়েন করেছে, প্রায় বছর পাঁচেক হয়ে গেল। তবু পুলিশি সদাসতর্ক সজাগ ঘুম রুদ্র এখনও আয়ত্ত করতে পারেনি।
প্রিয়মের জোরে জোরে ঝাঁকুনিতে ওর ঘুম ভেঙে গেল, উঠে লালচে চোখে তাকাল, ”কী হয়েছে?”
”কী আবার হবে, আমরা এসে গেছি। চলো ওঠো। এখন আবার লাগেজ বেল্টে যেতে হবে।” প্রিয়ম ব্যাজার মুখে বলল, ”রাতের ঘুমটা হল না, এবার গোটা দিন মাথা ধরে থাকবে। তখনই বলেছিলাম, দিনে দিনে যাই, এইসব ঝামেলা থাকবে না।”
সামান্য এদিক থেকে ওদিক হলেই প্রিয়মের এই বকবকের সঙ্গে রুদ্র এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আগে হলে সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর করত, এখন আর করে না। কী হবে? থাকতে তো হবে এর সঙ্গেই। ছেলেটা খারাপ না, শুধু বেচাল হলে বকবক করে। এসব ছোটোখাটো ব্যাপারকে গুরুত্ব না-দেওয়াই ভালো। খুচরো বিষয়কে পাত্তা না দিলে জীবনে শান্তি থাকে।
রুদ্র চোখ দুটো কচলে নিয়ে ফোন দেখল, ”কই! শংকরের কোনো মেসেজ নেই তো এখনও! সেই রাত দশটা থেকে প্লেনে ওঠার আগে অবধি কতবার ফোন করলাম, ধরল না। সকালেও ধরেনি। ভাবলাম, এখানে নেমে ওর মেসেজ দেখতে পাব। এই তো দিব্যি টাওয়ার এসে গেছে, কোনো টেক্সট করেনি তো!”
”বোঝো কাণ্ড!” প্রিয়ম ফ্যাকাশে চোখে তাকাল, ”এবার এই মাঝরাতে আমরা কী করব?”
”উফ! সবেতে এত হাইপার হোয়ো না। তেমন হলে কোনো হোটেল-টোটেলে…!”
”মানে? এক সপ্তাহ ধরে শুনে যাচ্ছি, তোমার বন্ধু এখানে পোস্টেড, সে নাকি সবকিছু আয়োজন করছে, আর এখন হোটেলে উঠতে হবে? গোয়া কি একটুখানি জায়গা?” প্রিয়ম দ্রুত লাগেজ বেল্টের দিকে হাঁটছিল, ”নর্থ গোয়া, সাউথ গোয়া দুটো দু-মুলুকে। আর ডাবোলিমের এই এয়ারপোর্ট প্রায় মাঝামাঝি। তোমার বন্ধুর বাড়ি ভাগাতোর, সেটা হল নর্থ গোয়া। সেটাকে বেস করে আমি গোটা আইটিনেরারিটা বানিয়ে নিয়ে এলাম। এখন আমরা কোনদিকে যাব?”
”বাড়ি নয়, কোয়ার্টার।” রুদ্র কথা না বাড়িয়ে লাগেজগুলো ট্রলিতে নিচ্ছিল।
”ওই যা-ই হোক!”
এই মধ্যরাতে যাত্রীরা হুড়মুড়িয়ে লাগেজ নিয়েই ছুটছেন গেটের বাইরে। সেখান থেকে প্রিপেইড ক্যাব নিয়ে গন্তব্যে। শংকর তো সত্যিই সমস্যায় ফেলে দিল। ওর সঙ্গে শেষ কথা হয়েছে গতকাল দুপুরে।
কাজের চাপে বহুদিন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় না। মাসখানেক আগে রুদ্র আর প্রিয়ম যখন শীতের শুরুতে গোয়া যাওয়ার প্ল্যান করছিল, তখনই একটু ডিটেইলে জানার জন্য ফোন করেছিল শংকরকে।
শংকর হায়দরাবাদে পুলিশ অ্যাকাডেমিতে রুদ্রর ট্রেনিং-এর ব্যাচমেট ছিল। হাসিখুশি ছেলেটা শুনেই বলেছিল, ”এই তোরা কিন্তু আমার এখানে উঠবি! ওই সময় একটু হালকাও থাকব। আমি সব ব্যবস্থা করে রাখব, পুরো গোয়াটা ঘুরে নিবি।”
”তোর ওখানে?” দ্বিধাগ্রস্ত রুদ্র বলেছিল, ”অসুবিধা হবে না তো!”
”ধুর! কীসের অসুবিধা? একা মানুষ। গোয়া খুব শান্তির রাজ্য, ক্রিসমাস আর নিউ ইয়ার ছাড়া খুব বেশি চাপ নেই। আর রাঁধুনি থেকে মালি, সিকিউরিটি থেকে চাকরবাকর সবই তো আছে। এখানে কলকাতার মতো ছোটো ছোটো কোয়ার্টার নয়। অঢেল জায়গা, একেকটা প্রকাণ্ড বাংলো। বিন্দাস চলে আয়! তোর বরের সঙ্গেও আলাপ হয়ে যাবে।”
রুদ্র একটু চিন্তিত মুখে ট্রলি হাতে গেটের দিকে হাঁটছিল। শংকর কাল দুপুরেও বলেছে, সাবধানে আসবি। কিন্তু তারপর থেকে পাত্তা নেই কেন?
প্রিয়মের হঠাৎ ঝাঁকুনিতে রুদ্রর ভাবনা ছিন্ন হল।
”আচ্ছা, তোমার বন্ধুর সারনেম কী?”
”কেন?” রুদ্র জিজ্ঞাসু চোখে সামনে তাকাতেই দেখতে পেল, গেট থেকে কিছুটা বাইরে একটা ছেলে মাথার ওপর প্ল্যাকার্ড তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছেলেটার বয়স চব্বিশ-পঁচিশ। দীর্ঘদেহী, গাঁট্টাগোট্টা চেহারার, পরনে খয়েরি সাফারি স্যুট।
‘‘Welcome to GOA, Rudrani Sinha Roy– IPS.
Regards, Shankar Ganjalves, IPS.’’
ছেলেটার পেছনে দাঁড়িয়ে একটা বড়ো পুলিশ জিপ। তার সামনে বড়ো বড়ো করে লেখা ‘‘Superintendent of Police, Special Cell, North Goa.’’
”ওই তো!” রুদ্রর মুখ মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ”শংকর নিশ্চয়ই কোনো অ্যাসাইনমেন্টে আটকে গিয়েছে, ফোনও ধরতে পারছে না, তাই লোক পাঠিয়ে দিয়েছে। দেখেছ, আমার বন্ধু বলে কথা, কথার দাম আছে।”
”সে তো বুঝলাম!” প্রিয়ম ট্রলি দুটো দ্রুত গাড়ির পেছনে চালান করে দিয়ে বলল, ”কিন্তু তোমার বন্ধু যে ক্রিশ্চান, তা তো জানতাম না! নাম শংকর, এদিকে সারনেম গঞ্জালভেজ? এ আবার কেমন ব্যাপার? আমি ভেবেছিলাম বাঙালি বুঝি!”
”বাঙালিই তো!” রুদ্র গাড়িতে উঠতে উঠতে ভ্রূ কুঁচকোল, ”অদ্ভুত কথা বলো। যার মাতৃভাষা বা পরিবারের ভাষা বাংলা, সে-ই বাঙালি। তার সঙ্গে হিন্দু, মুসলমান, ক্রিশ্চানের কী সম্পর্ক?”
”আরে এ তো পোর্তুগিজ। কোনো বাঙালি পোর্তুগিজ ভাষা বলে বুঝি?”
রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ”আজ স্নানের সময় কী মেখেছ?”
”মানে?” প্রিয়ম বিরক্ত হল, ”অপ্রাসঙ্গিক কথা বলছ কেন?”
”উত্তরটা দাও-না।”
”কী আবার, সাবান মেখেছি। আজব।”
”হুম। ওয়ার্ডরোবটা লক করেছ তো?”
”আশ্চর্য! এতদিনের জন্য বাইরে আসছি, আলমারিতে চাবি দেব না? কী বলতে চাইছ বলো তো!”
”বলতে চাইছি এটাই যে, সাবান, আলমারি, চাবি এগুলো সবই পোর্তুগিজ শব্দ। তাহলে কি তুমিও পোর্তুগিজ?”
প্রিয়ম চুপ করে গেল।
রুদ্র বলল, ”শংকরের বাবা পোর্তুগিজ। কিন্তু ও নিজে খাঁটি বাঙালি, মেদিনীপুরের ছেলে। শংকর আমাদের যাদবপুর থেকে ফিজিকস অনার্স পড়েছে। ট্রেনিং-এর সময় যা সুন্দর রবীন্দ্রসংগীত গাইত, আমরাও অমন নিখুঁত উচ্চারণ করতে পারব না। আর ওর মা তো বাঙালি, সম্ভবত চক্রবর্তী।”
”বুঝলাম।”
প্ল্যাকার্ড ধরে-থাকা ছেলেটা গাড়ি চালাতে শুরু করে দিয়েছিল। রুদ্র হেলান দিয়ে বসে বলল, ”আচ্ছা, শংকর কি কোনো কাজে আটকে পড়েছে?”
”হ্যাঁ ম্যাডাম। এস. পি. স্যার কাল থেকে টানা ডিউটিতে আছেন। আমি অর্ডার পেয়ে পিক আপে এসেছি।”
”হুম।” রুদ্র জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। এয়ারপোর্ট ছাড়িয়ে এগোচ্ছে গাড়ি। পূর্ব আকাশে সূর্যদেব এখনও দেখা দেননি, তবে উজ্জ্বল কমলা আলোর ছটা জানান দিচ্ছে তাঁর শীঘ্র আগমনের। গোয়া রাজ্যটা একদিকে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা, অন্যদিকে দাক্ষিণাত্য মালভূমির মাঝামাঝি কোঙ্কণ উপকূলে অবস্থিত। স্কুলে পড়তে রুদ্র একবার বাবা-মা-র সঙ্গে ঘুরতে এসেছিল গোয়াতে, তখনকার স্মৃতি যেটুকু মনে আছে, তাতে শীতের কয়েকটা দিন ছাড়া গোয়াতে বেশ গরম। বিশেষ করে সমুদ্রতটগুলোয় তো রোদের তাপে পা ফেলা যাচ্ছিল না। এখন মনে হয়, একই রকম গরম হবে।
শংকর ফোনে বলেছিল, গোয়া মোটামুটি শান্ত রাজ্য। তাহলে কী এমন হল? বিদেশি পর্যটকদের একটা বড়ো অংশ আসে গোয়াতে। আর এখানে আড়ালে-আবডালে ড্রাগস ব্যাবসাও চলে রমরমিয়ে। তেমনই কি কোনো র্যাকেট ধরা পড়ল?
প্রিয়ম জলের বোতল থেকে ঢকঢক করে অনেকটা জল খেল, ”শংকর মেদিনীপুরের ছেলে? তাহলে গোয়ায় পাঠাল কেন? তোমরা যারা পশ্চিমবঙ্গ থেকে ট্রেনিং-এ গিয়েছিলে, সবারই তো বলেছিলে বাংলাতে পোস্টিং হয়েছে।”
”সেই প্রশ্নটা আলাপ হলে শংকরকেই কোরো না হয়!” রুদ্র হাই তুলল, ”কতক্ষণ লাগবে পৌঁছোতে, ভাই?”
”পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার রাস্তা, ওই ধরুন সয়া এক ঘণ্টায় ঢুকে যাব। আপনারা গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নিতে পারেন। ব্রেকফাস্টের আগে ফ্রেশ হয়ে যাবেন।”
”বেশ। তোমার নাম কী?”
”মার্তণ্ড। মার্তণ্ড গাঁওকর।”
”মারাঠি?”
”কোঙ্কণি।” মার্তণ্ড ধীরে ধীরে গাড়ির গতি বাড়াচ্ছিল।
”ওহ!” রুদ্র অপ্রস্তুত হাসল, ”আমি জানতাম, তেন্ডুলকর, মঙ্গেশকর, আম্বেদকর… শেষে কর আছে মানেই মারাঠি।”
”ঠিকই জানেন ম্যাডাম। কর মানে মারাঠিতে নিজের হোমটাউন বোঝায়। তবে গাঁওকর মানে গ্রামের প্রধান, ওই ধরুন মোড়লজাতীয়।”
”তোমার হোমটাউন কি গোয়াতেই, মার্তণ্ড?”
”হ্যাঁ।” মার্তণ্ড হাসল, ”আমরা এখানে প্রায় সাতশো বছরের বাসিন্দা। তখন গোয়ার নাম ছিল গোপাকাপুরী। তবে আমি পুলিশে ঢোকার আগে কলকাতায় একটা ছোটো কোম্পানিতে কয়েক মাস চাকরি করেছি, জানেন তো। বাংলা বলতে পারি না, তবে বুঝি মোটামুটি।”
”বাহ!” প্রিয়ম জিজ্ঞেস করল, ”আচ্ছা, গোয়াতে এখনও পোর্তুগিজরা থাকে?”
”হ্যাঁ স্যার, প্রচুর। তবে সব থেকে বেশি থাকে মারাঠি আর কোঙ্কণিরা।”
গাড়ি দুরন্ত গতিতে ছুটছে। মোটামুটি সমতল এলাকা হলেও মাঝেমধ্যে পাহাড়ি টিলা চোখে পড়ছে। যত পূর্বদিক ফরসা হচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে, গোয়ার রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা, দু-পাশে জঙ্গলের সারি। তারই মধ্যে চোখে পড়ছে একেকটা বাড়ি।
কোনো কোনো বাড়ি আধুনিক ধাঁচের, কোনোটা আবার পুরোনো আমলের বাংলো। দেখামাত্র প্রিয়ম ক্যামেরার লেন্সে চোখ রাখছে, ”ওই দেখো, পোর্তুগিজ বাংলো!”
”হুম। ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, ডাচ, ইয়োরোপীয় যতগুলো জাতি সারা পৃথিবীতে নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, সবচেয়ে নিষ্ঠুর আর হিংস্র ছিল তখনকার পোর্তুগিজরা।” রুদ্র হাই তুলল, ”বাংলাতেও কম অত্যাচার করেনি।”
”বাংলায়?”
”হ্যাঁ। পোর্তুগিজ জলদস্যুদের কথা পড়োনি? বিশাল বিশাল জাহাজে করে জলপথে লুঠপাট চালাত? স্প্যানিশ আর্মাডা মনে নেই? সেই আর্মাডা থেকেই তো এসেছে হার্মাদ শব্দটা। মধ্যযুগের কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম লিখেছিলেন, রাত্রিদিন বহি যায় হার্মাদের ডরে। সেই যুদ্ধবাজ হার্মাদরা জাহাজে করে এসে অতর্কিতে হামলা চালাত নিরীহ শান্ত মানুষদের ওপর। লুঠতরাজ করত, যাওয়ার সময় ধরেও নিয়ে যেত অনেককে। তারপর বেচে দিত দাস বিক্রির বাজারগুলোয়।”
”তা তারা হঠাৎ গোয়ায় এল কেন? আর এল তো এল, এমন জাঁকিয়ে বসল, ইংরেজরাও সরাতে পারল না।” প্রিয়ম ফটাফট ছবি তুলে যাচ্ছিল।
”এইজন্যই বলি, কোথাও ঘুরতে যাওয়ার আগে শুধু নতুন ক্যামেরা না কিনে সেখানকার ইতিহাস, ভূগোল সম্পর্কে একটু পড়াশুনো করে আসতে হয়। তাহলে ঘুরেও মজা পাবে!” রুদ্র আবার একটা বিশাল হাই তুলল, ”ভাস্কো দা গামাকে মনে আছে?”
”ইয়েস! মনে থাকবে না? মাধ্যমিকে বিরাশি পেয়েছিলাম। ১৪৯৮ সালে কালিকটে এসেছিল লোকটা। তার আগে পশ্চিমের কত লোক ভারতবর্ষের সন্ধানে সমুদ্রে বেরিয়েছিল, কেউ খুঁজে পায়নি। ওদিকে তুর্কিদের হাতে কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন ঘটেছে, প্রাচ্যের দেশগুলোয় স্থলপথে আসার উপায় পুরোপুরি বন্ধ। কী করা যায়? পোর্তুগালের যুবরাজ হেনরির ছিল দেশ আবিষ্কারের নেশা, আফ্রিকার দিকটা তিনি কিছুটা এগোলেন, তারপর বার্থালোমিউ দিয়াজ নামের এক পোর্তুগিজ নাবিক চলে গেলেন কেপ অফ গুড হোপের দিকে। উত্তমাশা অন্তরিপ। শেষমেশ ভাস্কো দা গামা সেই কেপ অফ গুড হোপ দিয়েই ঘুরে এসে উপস্থিত হল ভারতের পশ্চিম উপকূলের কালিকটে। শুরু হল মশলা, সুগন্ধি, রেশমের সাপ্লাই। পোর্তুগিজরা ভারতে এল প্রথম, তারপর একে একে ডাচ, ইংরেজ আর ফরাসিরা। কী, ঠিক বললাম তো?”
”একদম!”
”দেখেছ, আমার কোথাও যাওয়ার আগে পড়াশুনো করার দরকার লাগে না, এমনিতেই এত কিছু জানি!” প্রিয়ম কলার ওঁচাল, ”এবার বলো, কালিকট থেকে পোর্তুগিজরা হঠাৎ গোয়ায় এল কেন?”
রুদ্র বলল, ”গোয়া বহু প্রাচীন রাজ্য। প্রথমে এখানে রাজত্ব করত কদম্ব রাজবংশ, তারপর কিছুদিন বিজয়নগর সাম্রাজ্যের আওতায় ছিল। তারপর গোয়া অধিকার করে নিলেন ইব্রাহিম আদিল শাহ, শুরু হল মুসলিম শাসন। গোয়ার হিন্দুরা বৈষম্যের শিকার হতে লাগল। তখন তারা সবাই প্রতিবেশী হিন্দু রাজ্য হোনাভারের রাজাকে চিঠি লিখল, আমাদের মুসলিম শাসন থেকে বাঁচান। আমরা এখানে অত্যাচারিত হচ্ছি। প্লিজ কিছু করুন। হোনাভারের রাজার একজন সেনাপতি ছিল, তার নাম তিমোজা। রাজা তাকে আদিল শাহের সঙ্গে যুদ্ধ করে গোয়া দখলের দায়িত্ব দিলেন।”
”তারপর?”
”এই তিমোজা ছিল মহাধুরন্ধর সেনাপতি। সে বুঝল, আদিল শাহের সঙ্গে যুদ্ধে এঁটে ওঠার ক্ষমতা তার নেই। সে তখন দেখা করল পোর্তুগিজ নেতা আলফানসো দ্য আলবুকার্কের সঙ্গে। বলল, তুমি এসে গোয়া আক্রমণ করো। গোয়ার বেশির ভাগ সেনাই হিন্দু, তারা তোমায় ভেতর থেকে সমর্থন করবে। আলবুকার্ক তখন কোচির সমুদ্রে, তিমোজার লোভনীয় প্রস্তাব পেয়ে রণতরী হাঁকালেন গোয়ার দিকে। আদিল শাহের সঙ্গে যুদ্ধে জিতে আলবুকার্ক গোয়ার নতুন শাসক হলেন। কিন্তু তিমোজার চালে একটা মস্ত ভুল হয়েছিল। সে ভেবেছিল, আলবুকার্ককে একটা মোটাসোটা অঙ্কের টাকা দেওয়া হবে, তাই নিয়ে উনি পোর্তুগালে ফেরত চলে যাবেন। তিমোজার ভাবনায় ভুল কিছু ছিল না। আলবুকার্ক হলেন পোর্তুগালের রাজার একজন আর্মি অফিসার, তিনি গোয়ায় থেকে কী করবেন? কিন্তু আলবুকার্ক বুঝে গিয়েছিলেন, গোয়া হল সোনার ডিম পাড়া হাঁস। ক্ষমতায় এসে তিনি বরং উলটে তিমোজাকেই নির্বাসিত করলেন। তার জায়গায় স্থানীয় প্রশাসক হিসেবে আনলেন নিজের বিশ্বাসভাজন মেলরাজকে। আর আলবুকার্ক নিজে হলেন গোয়ার ডি ফ্যাক্টো রুলার।”
”হুঁহ!” প্রিয়ম মুখ দিয়ে বিরক্তির শব্দ করল, ”পলাশি থেকে গোয়া, সব জায়গায় একই চিত্র। নিজেরা খেয়োখেয়ি করতে গিয়ে ডেকে আনে বাইরের শত্রুকে! তারপর কান্নাকাটি। কেন ভাই, প্রায় গোটা ভারতবর্ষ অশোকও শাসন করেছেন, আবার আকবরও শাসন করেছেন, কে কীভাবে অত্যাচারিত হয়েছে? ধর্ম ধর্ম করে মরল। যত্তসব!”
রুদ্র বলল, ”আলবুকার্ক যে গোয়া অধিকার করেছিলেন, সেটা কিন্তু আজকের গোয়া নয়। গোয়ার যে অংশটাকে আমরা এখন ওল্ড গোয়া বলি, সেইটুকু। মেইনলি দুটো দ্বীপ। বরদেজ আর সলসেট। তারপর ধীরে ধীরে আলবুকার্ক চোরাও, দিভার, এইসব কাছাকাছি দ্বীপগুলো দখল করা শুরু করলেন।”
”দাঁড়াও দাঁড়াও! দ্বীপ মানে? গোয়া তো একটা রাজ্য, এখানে দ্বীপ কোত্থেকে এল?”
রুদ্র বলল, ”গোটা গোয়া জুড়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলছে অনেক নদী। মাণ্ডবী, জুয়ারি, সাল, চাপোরা। আর একদিক পুরোটাই জুড়ে রয়েছে আরব সাগর। তাই এখানে অনেক ছোটো ছোটো বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড আছে। সেগুলোকেই আইল্যান্ড বলে। আলবুকার্কের পরের দু-শো বছরে গোয়ার প্রায় সব দ্বীপই পোর্তুগিজরা দখল করে নিয়েছিল। শুরু হয়েছিল বিখ্যাত গোয়া ইনকুইজিশন।”
”সেটা কী? কোথাও পড়িনি তো!”
”সেভাবে কোথাও লেখা থাকলে তবে তো পড়বে! নিজেদের লজ্জার কথা কেউ ডকুমেন্টেড রাখে? যেটুকু আছে, অনেক কমিয়ে, লুকোছাপা করে।”
মার্তণ্ড হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে ব্রেক কষল। নিস্তব্ধ অন্ধকারে কর্কশ যান্ত্রিক শব্দ যেন ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিল শান্ত অন্ধকারকে।
টাল সামলাতে না পেরে রুদ্র আর প্রিয়ম হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তেও সামলে নিল নিজেদের।
”ভেরি স্যরি ম্যাডাম! অন্ধকার তো, গলিটা মিস করে যাচ্ছিলাম!” মার্তণ্ড বাঁদিকের রাস্তায় গাড়িটা ঢোকাল।
”হ্যাঁ, এদিকের রাস্তায় আলোর একটু অভাব দেখছি।” রুদ্র বলল।
গাছপালা প্রচুর বলে নিঝুম ভাবটা আরও বেশি। কয়েক সেকেন্ড অন্তরই একটা করে রিসর্ট। গাছগুলোকে জড়িয়ে আছে নানা রঙের আলো। আর সেই আলোর ঝকমকানিতে বাড়িগুলো কেমন থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। বাঁদিকের হোটেলটা থেকে একটা ইংরেজি গান ভেসে আসছে। শোনা যাচ্ছে করতালির শব্দও।
এইজন্যই কি বলা হয়, গোয়া কখনো ঘুমোয় না?
মিনিটখানেক এগোলে স্পষ্ট হল পুলিশ বাংলোটা। শংকর ঠিকই বলেছিল। পশ্চিমবঙ্গে ডি.জি. বা পুলিশ কমিশনারের মতো সিনিয়র অফিসাররা যে মাপের বাংলো পান, এই বাংলোটাও তেমনই। গেটের এপাশ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, ভেতরে বেশ বড়ো মাপের উদ্যান। তাতে লম্বা লম্বা গাছ। আঁকাবাঁকা নারকেল গাছগুলো ঘিরে রেখেছে প্রকাণ্ড দ্বিতল বাড়িটাকে।
ঘড়িতে ভোর সাড়ে চারটে। বাংলোর বাইরে দুজন প্রহরী দণ্ডায়মান। গেটের পাশের নেমপ্লেটে জ্বলজ্বল করছে—
Shankar Ganjalves– IPS
SP (Special Cell), North Goa.
৪
কাঠচেরাইয়ের কলে প্রচণ্ড জোরে করাত ঘষতে থাকলে যে কর্কশ শব্দটা বেরোয়, তেমনই একটা বিশ্রী অথচ প্রচণ্ড জোর শব্দে রুদ্র ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠে বসল।
ঘরের পূর্বদিকের বিশাল জানলার কাচ ভেদ করে নরম রোদ এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে গোটা ঘরটাকে। বাইরের সবুজ বাগানে দুলছে সতেজ ফুলগাছ। খাটের সোজাসুজি একটা পুরোনো দিনের মেহগনি কাঠের প্রকাণ্ড ঘড়ি। সেখানে সাড়ে ন’টা বাজে।
কিন্তু এই অসহ্য আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে?
এদিক-ওদিক তাকাতেই রুদ্র প্রিয়মের মোবাইল ফোনটা দেখতে পেল। শব্দটা ওখান থেকেই আসছে। মাথা ধরে যাচ্ছে পুরো।
রুদ্র বিছানা থেকে নেমে ফোনটা নিতে যাবে, প্রিয়ম বাথরুম থেকে বেরোল। স্নান সেরে নিয়েছে। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বলল, ”ওহ, আমার রোজ সাড়ে ন-টায় অনসাইটে কল থাকে তো, সেটার অ্যালার্ম বাজছে।”
”এটা অ্যালার্ম?” রুদ্র বিরক্ত মুখে ফোনটা বন্ধ করল, ”কী জঘন্য শব্দ। আর কোনো কিছু পাওনি?”
”বাহ, অ্যালার্মে সুন্দর গান হলে কারো ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে হয় নাকি?” প্রিয়ম অদ্ভুত মুখব্যাদান করল, ”অ্যালার্ম যত কর্কশ হবে, তত তাড়াতাড়ি ঘুম চটকে যাবে।”
”তার মানে আমি সাড়ে আটটায় রোজ অফিস বেরিয়ে যাই, আর তুমি সাড়ে ন-টা অবধি ঘুমোও?” রুদ্র অবাক, ”ওয়ার্ক ফ্রম হোম কর্পোরেটের লোকজনদের কুঁড়ে করে দিয়েছে। এত বেলা অবধি কেউ ঘুমোতে পারে?”
”অবশ্যই পারে। সারাদিন একটানা ল্যাপটপের সামনে বসে কোড করতে হলে সাড়ে ন-টা অবধি ঘুমোতেই হয়। আর তা ছাড়া…” প্রিয়ম তেরচা চোখে তাকাল, ”তুমি নিজে আজ কখন উঠলে যেন?”
”সে তো সারারাত জেগে ছিলাম, তাই!” রুদ্র হাই তুলে বাথরুমের দিকে এগোল, ”তোমার স্নান হয়ে গেল?”
”তা হবে না?” প্রিয়ম দ্রুতগতিতে বলল, ”প্রথম দিনের প্ল্যানে তো সকাল এগারোটায় বেরোনো রয়েছে। যদি ঘুমিয়েই থাকব, তাহলে তো বাড়িতেই ঘুমোতে পারতাম। পাঁচ দিনের প্রোগ্রাম, সকাল থেকে রাত, সবকিছু পরপর দেখে নিতে হবে তো।”
”এই শোনো!” রুদ্র বেজার মুখে বাধা দিল, ”সবসময় এত তাড়া মেরো না। ভালো লাগে না। কাল অবধি দেখলে তো দিনরাত এক করে কাজ করতে হয়েছে। রাত দুটোতেও ফিরেছি কতদিন। অফিসে তাড়া, বাড়িতে তাড়া, আবার ঘুরতে এসেও তাড়া। লোকে ঘুরতে আসে রিল্যাক্স করতে।”
”ওহ আচ্ছা! আমি জানতাম না, এত হিস্ট্রি জিয়োগ্রাফি জেনে তুমি আসলে এখানে ঘুমোতে এসেছ। ঠিক আছে, তাড়া দিচ্ছি না, ঘুমোও ভালো করে। পাঁচ দিন রেস্ট নিয়ে কলকাতা ফিরে যাব।” প্রিয়ম ভাবলেশহীন মুখে সোফায় বসে খবরের কাগজটা টেনে নিল।
প্রিয়মের গজগজের মধ্যে রুদ্র বাথরুমে ঢুকল। ফ্রেশ হয়ে স্নান করে বেরোল ঠিক কুড়ি মিনিট পর। প্রিয়ম তখন বাইরের বাগানে ঘুরছে। সবুজ ঘাসে মোড়া বাগান, তাতে প্ল্যান করে বসানো ছোটো বড়ো গাছ, বাহারি ফুলগাছ। মাঝে একটা শ্বেতপাথরের টেবিল, তার ওপর রাখা রয়েছে খবরের কাগজ। দোতলার ব্যালকনি থেকে দূরের ভাগাতোর বিচ দেখা যাচ্ছে। জনশূন্য সেই সমুদ্রতটের নোনা গন্ধ ভেসে আসছে এদিকে।
সেজেগুজে রেডি হয়ে এসে রুদ্র দেখল, বাইরের বাগানে ঝকঝক করছে রোদ। কিন্তু নভেম্বরের সেই রোদের ওমে কোনো আরাম নেই, বরং তীব্র হলকা অস্বস্তি জাগাচ্ছে। নাহ, সত্যিই সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হবে, না হলে ঘুরে আরাম পাওয়া যাবে না।
বাগানে চুপচাপ আগাছা পরিষ্কার করছে দু’জন মালি। আশপাশে তাকিয়ে মার্তণ্ডকে কোথাও দেখতে পেল না রুদ্র। খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে ও বেরিয়ে এল।
”শংকর কি এখনও ফেরেনি নাকি!”
”না।” প্রিয়ম উবু হয়ে বসে একটা নীল রঙের ফুল দেখছিল, ”ধন্য তুমি আর তোমার বন্ধুর আতিথেয়তা। বাড়িতে গেস্ট এসেছে, তিনি আসা তো দূর, একবার ফোন করারও সময় পেলেন না! কুক এসে বলে গেল, ব্রেকফাস্ট ডাইনিং-এ দেওয়া হচ্ছে, চলে যেতে। আরে এটা কি হোটেল নাকি?”
”এভাবে বোলো না। শংকর খুব ভালো ছেলে। নিশ্চয়ই খুব জরুরি কোনো কাজে আটকে গেছে। পুলিশের ডিউটি এমনই, সে তো তুমি জানো।”
”আমাকে আর বোঝাতে হবে না। আর আধ ঘণ্টা দেখব, দেখে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে যাব। যেমন তোমার হোস্ট, তেমন তুমি।”
রুদ্র কিছু না বলে খবরের কাগজে চোখ রাখল। দ্য গোয়া ডেইলি। প্রথম পৃষ্ঠায় রাজনীতির খবর পেরিয়ে ওর পুলিশি চোখ চলে গেল অন্য খবরে।
নিজস্ব সংবাদদাতা, পানাজি সেন্ট সেবাস্টিয়ান হোমের প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার ফাদার জেমসনের মৃত্যুতে তাঁর স্মরণে পানাজি টাউন হলে গতকাল একটি শোকসভার আয়োজন করা হয়েছিল। এলাকায় জনদরদি পাদ্রী হিসেবে সুপরিচিত ফাদার জেমসনের আকস্মিক প্রয়াণে এখনও শোকস্তব্ধ পানাজির মানুষরা। গতকালের অনুষ্ঠানে ফাদার জেমসন সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন স্থানীয় বিধায়ক ও আরও কিছু বিশিষ্ট মানুষ। প্রসঙ্গত, গত ৩০ নভেম্বর সকালবেলা নিজের আশ্রমে ফাদার জেমসনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। পানাজি হাসপাতালের চিকিৎসক তাঁর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কথা ঘোষণা করলেও আশ্রমের রাঁধুনির বয়ানের ভিত্তিতে পানাজি পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করে। কিন্তু সাতদিন কেটে গেলেও তদন্তে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় এই নিয়ে নিন্দায় সরব হয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী মহল। এই প্রসঙ্গে নর্থ গোয়া স্পেশ্যাল ব্র্যাঞ্চের এস পি মি. শংকর গঞ্জালভেজের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তদন্ত চলছে।
প্রিয়ম বলল, ”আচ্ছা শোনো, তুমি বলার পর গোয়ার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অনেক খুঁজলাম। কিন্তু ইনকুইজিশন রিলেটেড তো কিছু পেলাম না।”
রুদ্র চমকে তাকাল, ”উঁ?”
”বলছি, ইনকুইজিশনের নিদর্শন কোথায় গেলে দেখতে পাব?”
”সেভাবে কোথাওই পাবে না। গোয়া ইনকুইজিশন শুরু হয়েছিল ১৫৬১ সালে। চলেছিল ১৮১২ অবধি। প্রায় আড়াইশো বছরের নির্মম অত্যাচারের পর যখন ইনকুইজিশন আইন বাতিল হয়, তার বেশির ভাগ প্রমাণ ও প্রামাণ্য নথি ধ্বংস করে দেওয়া হয়।”
”এই ইনকুইজিশন মানে কী?”
”যারা ক্রিশ্চান ধর্মকে মানে না, যারা বাইবেল ও পোপকে প্রশ্নাতীত সম্মান করে না, তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য মধ্যযুগে ক্যাথলিক চার্চগুলোয় একটা করে ইনকুইজিশন অফিস তৈরি করা হয়েছিল। এই অফিসে ইনকুইজিটররা বসে থাকত, যাদের কাজ ছিল হঠাৎ হঠাৎ গ্রামেগঞ্জে গিয়ে গ্রামবাসীদের পাপ স্বীকার করতে বলা। সোজা ভাষায় ক্রিশ্চান ধর্ম গ্রহণ করতে বলা। না করলেই শুরু হত অত্যাচার। শাস্তি, মারধর, পুড়িয়ে মারা। স্পেনে একসময় ত্রিশ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল এই ইনকুইজিশনের নামে।”
”হরিবল! সবাইকে মারত?”
”না। যারা ক্রিশ্চান নয়, তাদের। অথবা যারা ক্রিশ্চান ধর্ম গ্রহণ করেও ধর্মের আচারবিচার মানে না, তাদের। পৃথিবী জুড়ে সেই সময় লক্ষ লক্ষ ইহুদি ও মুসলিমের ওপর এই অত্যাচার করা হয়েছে। তবে গোয়া ইনকুইজিশনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল হিন্দুরা। মুসলিমরাও হয়েছিল, মসজিদের ওপর মোটা কর বসেছিল, তবে হিন্দুদের মতো ভয়াবহ নয়।”
”কীভাবে? আলবুকার্ক গোয়া দখল করে নেওয়ার পর?”
”আলবুকার্কের সময় হিন্দুরা চাকরি, সুযোগসুবিধা, সামাজিক সুরক্ষা হারানোর ভয়ে ধর্মান্তরিত হয়েছে, তবে ব্যাপকভাবে নয়। আলবুকার্ক ছিলেন কৌশলী শাসক, একদিকে হিন্দু বণিক, ব্রাহ্মণদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতেন, অন্যদিকে ধর্মান্তরও হত। তবে খাতায়-কলমে কোনো পলিসি ছিল না। গোয়াতে ইনকুইজিশন বলবৎ করার পেছনের মানুষটা কে, তা জানো?”
”কে?”
”ফ্রান্সিস জেভিয়ার। যাঁর নামে দেশ জুড়ে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল, কলেজ ছড়িয়ে আছে। ওল্ড গোয়ায় ব্যাসিলিকা অফ বম জেসাসে যাঁর সমাধি দেখার জন্য তুমি একটা গোটা দিন বরাদ্দ করে রেখেছ, সেই তিনি।”
”অ্যাঁ!”
”হ্যাঁ। জেভিয়ার গোয়াতে আসেন ১৫৪০ নাগাদ। এসে কিছু বছর থেকে উপলব্ধি করেন, যাদের তিনি অনেক চেষ্টাচরিত্র করে ক্রিশ্চান করছেন, তারা কয়েকদিন পরেই নিজের ধর্মে ফিরে যাচ্ছে। কেউ আবার লুকিয়েচুরিয়ে পুরোনো ধর্মই প্র্যাকটিস করছে। জেভিয়ার তখন পোর্তুগালের রাজাকে চিঠি লেখেন। তখন খোদ পোর্তুগালেও ইনকুইজিশন চালু রয়েছে। জেভিয়ার লেখেন, যারা এভাবে পুরোনো ধর্মে ব্যাক করছে, তারা খুবই নিকৃষ্ট চরিত্রের। গোয়ায় অবিলম্বে ইনকুইজিশন চালু করা হোক। তবেই তাদের শাস্তি দেওয়া যাবে।”
”তারপর?”
”সেই সময়ে পোর্তুগালের রাজা তৃতীয় ডোম জোয়াও ছিলেন বেশ পরধর্মসহিষু� শাসক, তিনি জেভিয়ারের আবেদনে সাড়া দিলেন না। সময় এগোতে লাগল। রাজা জোয়াও মারা গেলেন। রাজার ছেলে আগেই মারা গিয়েছিলেন, নাতির বয়স মাত্র তিন বছর। তাই নাতি সেবাস্টিয়ানকে খাতায় কলমে সিংহাসনে বসিয়ে রাজত্ব চালাতে শুরু করলেন রানি ক্যাথারিন। রানি ক্যাথারিন আবার ছিলেন গোঁড়া ক্যাথলিক, হেনরিক নামের এক কার্ডিনালের কথায় তিনি ভীষণভাবে প্রভাবিত হতেন। তাঁরই উসকানিতে ১৫৬০ সালে গোয়ায় পাশ হল ইনকুইজিশন আইন।”
”তখন জেভিয়ার বেঁচে আছেন?”
”না। মারা গেছেন। গোয়ায় ইনকুইজিশন আইন পাশ হওয়ার আগেও কিন্তু দুজন ধর্মযাজক ধর্মান্তরের নামে জোরাজুরি চালিয়েছিল। দিয়েগো দা বোরবা আর মিগুয়েল ভাজ। ১৫৪০-এর মধ্যে ওল্ড গোয়া আইল্যান্ডের সব মন্দির ভেঙে ফেলা হয়েছিল, ১৫৪৩-এ আদিল শাহের থেকে বরদেজ আর সলসেট অধিগ্রহণ করে সেখানেও জোরজুলুম শুরু হয়েছিল। কিন্তু ওই যে! লোকজন শাস্তির ভয়ে সামনে ক্রিশ্চান হলেও লুকিয়ে পুরোনো ধর্মই পালন করছিল। মিগুয়েল ভাজও এত মন্থর কনভার্সনে খুশি ছিল না। তাই সে গিয়ে পোর্তুগালের রাজাকে বোঝাল। এল কড়া ইনকুইজিশন আইন। কেউ কারো সম্পর্কে গিয়ে ইনকুইজিটরদের বললেই হল, অমুক ক্রিশ্চান হওয়ার পরেও রোজ পুজো করে কিংবা নামাজ পড়ে। ব্যাস! কোনো তদন্তের ব্যাপার নেই, সত্যি-মিথ্যে যাচাই করার ব্যবস্থা নেই, শুরু হয়ে যেত ট্রায়াল। ক্রমশ পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হতে লাগল। গোয়াতে প্রচুর মন্দির ছিল, ছিল গৌড় সারস্বত ব্রাহ্মণদের অনেক কুলদেবতার মন্দির। সেগুলো ভেঙে ফেলা শুরু হল। বলতে গেলে ওল্ড গোয়ার সব মন্দিরই ভেঙে ফেলা হল। অনেক পুরোহিত বিগ্রহ নিয়ে পালিয়ে গেল নদীর ওপারে, যেখানে পোর্তুগিজ শাসন নেই। অনেক হিন্দু চলে গেল কেরালায়, কেউ আবার পালাল উত্তরে।”
”তারপর?”
”আইন জারি হল, কোনো নতুন মন্দির বানানো যাবে না। কোনো পুরোনো মন্দিরকে মেরামত করা যাবে না। কাঠের হোক বা পাথরের, কোনোরকম মূর্তি বানানো যাবে না। ধরা পড়লেই শাস্তি। আর যে ধরিয়ে দেবে, তার জন্য মোটা টাকার পুরস্কার। অবস্থা বুঝতে পারছ? যাচাই করার কোনো ব্যাপার নেই। ধরো, তুমি আমায় পছন্দ করো না, গিয়ে বললে, আমি মূর্তি বানাচ্ছি। অমনি আমাকে ধরে নিয়ে যাবে, আর তুমি প্রাইজ পাবে।”
”ইয়োরোপিয়ানরা এইসব করেছে?” প্রিয়ম কাঁধ ঝাঁকাল, ”কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগছে!”
”আমিও আসার আগে যখন এগুলো পড়ছিলাম, বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। চার্লস ডেকন বলে তখন একজন ফরাসি ডাক্তার এই গোয়াতে প্র্যাকটিস করতেন, তিনি এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন বলে তাঁকে জেলে পোরা হয়েছিল। পরে দেশে ফিরে গিয়ে একটা বই লিখেছিলেন। The Relation of Goan Inquisition.—বইটা কিনেছি, ফিরে পোড়ো। লতা মঙ্গেশকররা তো ছিলেন গোয়ার মঙ্গেশি গ্রামের আদি বাসিন্দা। সেই গ্রামে রয়েছে বিখ্যাত মঙ্গেশি মন্দির। অরিজিনাল মন্দিরটাকে ১৫৬৬ সালে ভেঙে ফেলে সেখানে একটা গির্জা বানানো হয়েছিল। কোনোভাবে বিগ্রহটাকে লুকিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, পরে অন্য জায়গায় নতুন করে মন্দির করা হয়। এরকম প্রায় প্রতিটা গ্রামের মন্দিরকেই ধ্বংস করা হয়। পুরোহিত থেকে শুরু করে স্থানীয় অধিবাসী, যারা বাধা দেয়, তাদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়।”
প্রিয়মের মুখে বেদনা, ”পোর্তুগিজরা এত খারাপ? আর আমরা কিনা একজন পোর্তুগিজের বাড়ি এসে উঠেছি?”
রুদ্র কথার ফ্লো-তে বলে যাচ্ছিল, হঠাৎ রেগে গেল, ”এ আবার কেমন কথা! পোর্তুগিজরা খারাপ হতে যাবে কেন? পাঁচশো বছর আগে কয়েক হাজার লোক অত্যাচার করেছিল মানে এখনও গোটা জাতি খারাপ? এই দু-হাজার বাইশ সালের পৃথিবীতে কি আর ধর্ম-জাতপাত নিয়ে কেউ ভাবে নাকি! না ভাবা উচিত। তুমি একেক সময় এমন সব কথা বলো! তবে হ্যাঁ, ইতিহাসকে ভুলে যাওয়াও কিন্তু উচিত নয়। জানো, গোয়া ইনকুইজিশন সম্পর্কে আমাকে প্রথমে কে বলেছিল?”
”তোমার বন্ধু শংকর গঞ্জালভেজ?”
”ঠিক তাই।” রুদ্র বলল, ”কে কবে খারাপ কাজ করেছে, তার দায় এখনকার মানুষ কেন নেবে? এখন সময় হল, নিরপেক্ষভাবে সব জানার। সত্যকে অস্বীকার করা মানে নিজেকে অস্বীকার করা। সত্যকে চাপা দেওয়া যায় না। এই দেখো, এই খবরটা পড়ো। শংকর সত্যিই খুব ব্যস্ত একটা মার্ডার কেস নিয়ে।”
”আপনারা বুঝি শংকরের গেস্ট!”
অচেনা কণ্ঠস্বরে রুদ্র ফিরে তাকাল।
এক প্রৌঢ় পরিষ্কার ইংরেজিতে কথাগুলো বললেন। অদূরেই বাংলোর গেট। গেট পেরিয়ে এসে লম্বা মোরামের লন, দু-পাশে বাগান। ভদ্রলোক লনের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন। রোগাটে গড়ন। গায়ের টকটকে গৌরবর্ণ রোদের তেজে ঈষৎ লালচে ভাব ধারণ করেছে। মাথার চুল থেকে গোঁফ-দাড়ি সবই ধবধবে সাদা। ভদ্রলোক এই গরমেও পরে আছেন গাঢ় নীল রঙের স্যুট-প্যান্ট। বয়স সত্তরের ওপারেই হবে। কিন্তু সেই ছাপ মুখের বলিরেখায় পড়লেও চেহারায় তেমন পড়েনি।
”হ্যাঁ।” প্রিয়ম স্মিতমুখে উঠে দাঁড়াল, ”যদিও হোস্টের এখনও অবধি দেখা নেই।”
”আহ! বড্ড বাজে বকো!” রুদ্র চাপাস্বরে প্রিয়মকে ধমক দিয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকাল, ”আমি শংকরের ব্যাচমেট। আমরা কলকাতা থেকে এসেছি। আপনি?”
”ব্যাচমেট মানে আপনিও পুলিশের লোক?”
”হ্যাঁ। বেঙ্গল ক্যাডারের অফিসার। আপনি?”
”আমি কাছেই থাকি।” ভদ্রলোক ধীরকণ্ঠে বললেন, ”আমার নাম দুয়ার্তে দে অলিভেইরা। পাশেই ভাগাতোর বিচ। সমুদ্রের পাশে আমার একটা ছোটো আশ্রম রয়েছে। সেখানে অনাথ বাচ্চারা থাকে, পড়াশুনো করে। কলকাতা আমার খুব প্রিয় জায়গা।”
”আপনি পোর্তুগিজ?” রুদ্র আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, ”এখানে কবে থেকে আছেন?”
দুয়ার্তে ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন, ”আমি পোর্তুগিজ। কিন্তু পোর্তুগালেরই পোর্তুগিজ। ভারতে জন্মাইনি। বড়ো হয়ে এসেছি।”
”বোঝো!” প্রিয়ম বিড়বিড় করল, ”এতক্ষণ যা গালমন্দ করলে, কতটা শুনেছে কী জানি!”
”না না, সত্যিটা তো সত্যিই!” প্রৌঢ় একটা ছোটো নিশ্বাস ফেললেন, ”ইনকুইজিশন সম্পর্কে আপনি এত জানেন শুনে বেশ অবাকই হলাম। আপনি কি এইসব নিয়ে চর্চা করেন?”
”না না।” রুদ্র হেসে মাথা নাড়ল, ”কোথাও ঘুরতে যাওয়ার আগে সেখানকার সম্পর্কে যতটা সম্ভব জানার চেষ্টা করি। সেভাবেই…!”
”আই সি!” প্রৌঢ় মাথা নাড়লেন, ”কী জানেন, যুগে যুগে ক্ষমতার আস্ফালনই শেষকথা বলেছে। ওই যে, মাও বলে গিয়েছিলেন, বন্দুকের নলই যাবতীয় ক্ষমতার উৎস! মজার ব্যাপার হল, এত জোর করে ছিনিয়ে যারা বলীয়ান হয়, কয়েক শতাব্দী পর মানুষ কিন্তু সেই বলীয়ানদেরই মনে রাখে। আদর্শ বলে মানে। ক্ষমতাপুষ্ট কাজের আড়ালে চাপা পড়ে যায় তাদের রক্ত মাখা হাতগুলো। আমরা যতই বলি, ভালো কাজ রয়ে যায়, কিন্তু সত্যিই কি তা-ই? না। ক্ষমতাই রয়ে যায়।”
গেটের বাইরে দুটো গাড়ি এসে দাঁড়াল। সামনের নীল বাতি গাড়িটা থেকে পুরোদস্তুর পুলিশি উর্দিতে নেমে এল শংকর। সঙ্গে মার্তণ্ড ও আরও চারজন পুলিশ।
রুদ্র ভাবল, মার্তণ্ড কি তাহলে ওদের নামিয়ে দিয়েই ভোররাতে চলে গিয়েছিল? না, তা নয়। রাতে মার্তণ্ডর পরনে ছিল খয়েরি সাফারি স্যুট। আর এখন পরে আছে গাঢ় নীল জিনস আর শার্ট। এই পোশাকে তাকে আরও অল্পবয়সি লাগছে। মনে হচ্ছে কোনো কলেজের ছাত্র।
লন দিয়ে হেঁটে আসতে আসতে শংকর কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছিল, এদিকে চোখে পড়তেই হাসিমুখে হাত নাড়ল, ”এক্সট্রিমলি স্যরি! এমন একটা কাজে ফেঁসে গেছিলাম। কাল সারাদিন বাড়িই ফিরিনি। ওয়েলকাম টু গোয়া! কাল কোনো অসুবিধা হয়নি তো?”
”না না। আমাদেরও এরকম ডিউটি পড়ে যায় মাঝে মাঝে। মার্তণ্ড খুব ভালো ছেলে। ভালো ড্রাইভারও।” রুদ্র হাসল।
”আর খুব ব্রিলিয়ান্টও। আপাতত মাসকয়েক হল স্টেট ক্যাডারে ঢুকেছে। কিন্তু…!” শংকর সস্নেহে মার্তণ্ডের কাঁধে হাত রাখল, ”আগের বার ইউ. পি. এস. সি.-তে ইন্টারভিউ দিয়েও একটুর জন্য কেটে গেছে। এবার আবার বসবে।”
”বাহ তা-ই নাকি! মার্তণ্ড, সেটা তো বলোনি কাল!”
মার্তণ্ড সলজ্জ হাসল, ”এটা আবার কী বলব! স্যার খুব হেল্প করেন আমায়। দিল্লি থেকে স্টাডি মেটিরিয়াল আনিয়ে দিয়েছেন।”
”ভেরি গুড! অগ্রিম ওয়েলকাম জানিয়ে রাখলাম।” রুদ্র প্রিয়মের দিকে তাকাল, ”শংকর, তোর সঙ্গে তো আলাপ হয়নি। আমার হাজব্যান্ড প্রিয়ম।”
শংকর গঞ্জালভেজের রং বেশ চাপা, উচ্চতাও খুব বেশি নয়, কিন্তু গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। পুলিশের ইউনিফর্মে হাতের বলিষ্ঠ পেশিগুলো আরও ফুটে বেরোচ্ছে। সে সোজা এসে প্রিয়মের সঙ্গে কোলাকুলি করল, ”তোমার কথা রুদ্রাণীর মুখে হায়দরাবাদে প্রচুর শুনতাম। স্যরি বস! প্লিজ কিছু মনে কোরো না। এমন ফেঁসে গেছিলাম।”
”আরে না না, ঠিক আছে!” প্রিয়ম বিগলিতভাবে হাসল, ”এ তো হতেই পারে, আমি সেটাই বলছিলাম রুদ্রকে। ও-ই খালি অস্থির হয়ে পড়ছিল।”
রুদ্র সরু চোখে তাকাল প্রিয়মের দিকে। তারপর বলল, ”শংকর, তুই ফ্রেশ হয়ে আয়। একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট করব।”
”একী! তোরা এখনও ব্রেকফাস্ট করিসনি? আচ্ছা, জাস্ট দশ মিনিট ওয়েট কর। এক্ষুনি আসছি! আজ আর কাল অফ নিয়েছি। তোদের সঙ্গে ঘুরব। আমারও এসে থেকে তেমন কিছু দেখা হয়নি, কাজ নিয়েই কেটে যায়।”
শংকর এতক্ষণ একটু দূরে অপেক্ষারত মি. দুয়ার্তেকে দেখতে পায়নি, এখন চোখাচোখি হতে কিছুটা যেন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, ”ফাদার দুয়ার্তে! কখন এসেছেন?”
”তা কিছুক্ষণ হল।” দুয়ার্তে সামান্য হাসলেন, ”রোজই যেমন আসি। কোনো প্রোগ্রেস হল?”
”না ফাদার। আমরা চেষ্টা করছি। চিন্তা করবেন না।”
দুয়ার্তে চশমাটা চোখ থেকে খুললেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ”আজ আটই ডিসেম্বর। এক সপ্তাহ হয়ে গেল, শংকর!”
”আমি বুঝতে পারছি, ফাদার। স্পেশ্যাল টিম ফর্ম করা হয়েছে এইজন্য। আশপাশের হোটেলের সঙ্গে কথাও বলছি। আমাদের প্লিজ একটু সময় দিন।”
”তোমার বন্ধু এসেছে, আর সময় নষ্ট করব না।” ফাদার দুয়ার্তের চোখের নীচের বলিরেখাগুলো যেন হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে উঠল। ঈষৎ চিকচিক করা অশ্রু তিনি মুছে নিলেন পরিপাটি করে হাতে ধরে-থাকা রুমালে, ”রোজ সকালে এসে বিরক্ত করার জন্য আই অ্যাম রিয়্যালি স্যরি, শংকর। একটু দেখো। মেয়েটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চালাচ্ছিল বলে অনেকেরই চক্ষুশূল হয়ে পড়েছিল। আমার খুব ভয় করছে, শংকর!”