গন্তব্য এখনো এক সভ্যতা দেরি – ৩০

৩০

পশ্চিমঘাট পর্বতমালার পাহাড়গুলো বেশ অন্যরকম। কিছুটা এলাকা সমতল, তারপরই সবুজ চাদরে মোড়া পাহাড় এমন খাড়া হয়ে উঠে গিয়েছে, দেখে আশ্চর্য হতে হয়। এখানকার সব পাহাড়ই ঘন অরণ্যাবৃত। বৃষ্টি হওয়ার পর সেই জঙ্গলের সবুজ পাতাগুলোর ওপর দিয়ে যখন বৃষ্টির ফোঁটা পর পর ঝরে ওপর থেকে নীচে আসতে থাকে, মনে হয় যেন পাহাড়ের ওপর কিছুক্ষণের জন্য কোনো জলপ্রপাত তৈরি হয়েছে। তখন মুগ্ধ হয়ে দেখা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না।

পাহাড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে শিরাও সেই দৃশ্যই দেখছিল। কিন্তু তার মন পড়েছিল অন্য কোথাও।

বেশিক্ষণ তাকে অপেক্ষা করতে হল না। জোসেফ যখন পাহাড়ের নীচে এসে পৌঁছোল, তখন আবার গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। জোসেফের জামায় বৃষ্টির জল পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা।

এমনিতে জোসেফ খুবই রগচটা ছেলে, কেউ একটা গরম কথা বললে বদলে ও যে শুধু দশটা কথা শোনায় তা না, মারামারিতেও জড়িয়ে পড়ে। আইজ্যাককাকার সঙ্গে এই ব্যাপারে সাদৃশ্য থাকলেও কাকার সঙ্গে একটা বড়ো পার্থক্য হল, জোসেফের মাথাটা আইজ্যাককাকার চেয়ে অনেকটাই সরেস। অন্তত জোশুয়াকাকা তা-ই মনে করে। যে ছেলে এরকম উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে একজন ‘মারানো’ হয়েও, জন্মাবধি ইহুদি আচারবিচার পালন করেও হাওয়া বুঝে রাজধানীতে গিয়ে শুধু ক্রিশ্চান হওয়ার ভান করা নয়, ওখানকার বাঘা বাঘা পাদ্রী একরকম সম্মোহন করে সরকারি পদে আসীন হতে পারে, সেই ছেলে আর যা-ই হোক বোকা নয়।

এমনিতেই গার্সিয়া দে ওরতা মারা যাওয়ার পর থেকে মোলে গ্রামের সব ইহুদিই জোসেফকে বেশ সমীহ করতে শুরু করেছিল, হাজার হোক, রাজধানীতে হোমরাচোমরা বলতে তো এখন জোসেফই। কিন্তু সহদেব দেশপান্ডের পরিবারের ওই ভয়ানক পরিণতির পর সেই সমীহ রূপান্তরিত হয়েছে ভয়তে। বিশেষত প্রাক্তন গাঁওকরের একমাত্র পুত্র গোকুলকে জোসেফ যেরকম নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, তা এখন লোকের মুখে মুখে ফিরছে। ছোটোবেলার খেলার সঙ্গীকে যে এভাবে মারতে পারে, তাকে ভয় না পেয়ে উপায় নেই।

সহদেব দেশপান্ডের বাড়ি যেদিন পুড়ে ছাই হয়েছিল, তার ঠিক এক মাস পর ক্যাথারিনপিসি আইজ্যাককাকার বাড়ি গিয়ে জোসেফ আর শিরার বিয়ের ব্যাপারে পাকা কথা বলে এল। শিরা কোনো আপত্তি করেনি। শুধু দু-দিন পর আহিরাকে দিয়ে গোপনে জোসেফকে বলে পাঠিয়েছিল, নিভৃতে একবার দেখা করতে চায় সে।

জোসেফ উৎসাহে টগবগ করছিল। শিরা যে বিয়েতে একবার বলতেই সম্মতি দেবে, সে ধারণা করতে পারেনি। একাকী দেখা করতে চাওয়া তো কল্পনার অতীত। শিরার সামনে এসে সে বলল, ”আমি তোমায় ভালোবাসি, শিরা!”

এই নির্জন পরিবেশেও শিরার গাল দুটো যে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল, তা জোসেফের চোখ এড়াল না। এই আদিম বন্য প্রকৃতি, ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে শিরার বসন সিক্ত হয়ে উঠছে। জোসেফের মনে হল, এই বিশ্বচরাচরে কেউ কোথাও নেই, শুধু ও আর শিরা। ও আর নিজেকে সংবরণ করতে পারল না। এগিয়ে গিয়ে আলিঙ্গন করতে চাইল শিরাকে।

কিন্তু শিরা পিছিয়ে গেল।

জোসেফ কামাতুর চোখে তাকাল, ”কী হল? আমি তোমার হবু স্বামী, শিরা!”

শিরা লজ্জায় আরও লাল হয়ে উঠল, ”জানি। কিন্তু এখানে নয়। এদিকে অনেক কাঠুরিয়া আসে কাঠ কাটতে। কেউ দেখে ফেললে ভারী লজ্জার ব্যাপার হবে।”

”তবে?”

শিরা ইঙ্গিতপূর্ণ চোখে তাকাল, ”আমি একটা জায়গা চিনি। একেবারে জনশূন্য। কিন্তু অনেকটা হাঁটতে হবে। তুমি কি পারবে?”

”পারব না মানে?” উত্তেজনায় জোসেফের গলা কেঁপে যায়, ”এখুনি চলো।”

শিরা হাঁটতে থাকে। পেছন পেছন জোসেফও। বনবাদাড় পেরিয়ে, ভিজে গাছপালা পেরিয়ে ওরা হেঁটে চলে।

বৃষ্টির মাত্রা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। তাম্বুরি সুরলা শিব মন্দিরে ওরা যখন পৌঁছোল, ততক্ষণে প্রবল ধারায় বর্ষণ শুরু হয়েছে। ঘন অরণ্যের লম্বা লম্বা গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে বৃষ্টির জল ঝরে শিরা আর জোসেফ দুজনকেই ভিজে সপসপ করে তুলেছে।

মন্দিরের ভেতরে পা দিয়েই জোসেফ আর পারল না। সিক্ত পোশাক শিরার শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে সুস্পষ্ট করে তুলেছে। ও শিরাকে জড়িয়ে ধরল।

শিরা বাধা দিল না। জোসেফ পাগলের মতো ওর শরীরের প্রতিটা কোণ খাবলে চলেছে। ও ফিসফিসে স্বরে বলল, ”এটা খাও!”

”কী এটা?”

শিরা জোসেফের মুখটা নিজের বুকে চেপে ধরল, ”একটা ওষুধ। খেলে তুমি বাঘ হয়ে উঠবে!”

জোসেফ উদ্দীপনার শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। ওর বিস্ময় উত্তরোত্তর বাড়ছিল। শিরা খুব একটা লাজুক না হলেও এতটা খোলামেলা, সে ভাবতে পারেনি। কথা না বাড়িয়ে ও দ্রুত শিরার হাত থেকে ওষুধের বড়িটা নিয়ে মুখে পুরে নিল।

কয়েক মুহূর্তমাত্র। শিরার নগ্ন বুকের ওপর জোসেফের শরীরটা ঠিক দুবার হেঁচকি তুলে যখন স্থির হয়ে গেল, শিরা নিষ্প্রাণ দেহটাকে ঘৃণায় দূরে ঠেলে ফেলে দিল। শিরার বাবা মৃত্যুর আগে শেষবার যখন এসেছিলেন, ওদের দুই বোনকে দিয়ে গিয়েছিলেন এই ওষুধ। এই জঙ্গলেরই এক ধরনের গাছের বীজ। বলেছিলেন, ”যখন দেখবে, জীবনের সব ক-টা দরজাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে, ভীরুর মতো আত্মসমর্পণ করে নিজের সম্মানহানি করতে দেবে না। এটা খেয়ে নেবে।”

শিরার চোখ দিয়ে জল ঝরছে, তবু মুখে হাসি। উঠে দাঁড়িয়ে ও প্রাণপণে জোসেফের মুখে একদলা থুতু ছুড়ে দিল। হিসহিস করে বলল, ”আমার স্বামী একজনই ছিল, যাকে তুই তিলে তিলে মেরেছিলি। বুঝলি?”

বৃষ্টি থেমে গেছে। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শিরা মন্দির থেকে বেরোল। কোথায় যাবে ও এখন? ওর শরীরের মধ্যে একটু একটু করে যে বেড়ে উঠছে, তাকে নিয়ে কোথায় লুকোবে ও?

ওর আবার বাবার বলা কথাগুলো মনে পড়ল। ওর জীবনের কি সব ক-টা দরজা বন্ধ হয়ে গেছে? ও-ও কি ওই ওষুধটা খেয়ে নেবে?

কিন্তু গোকুল যে বলত, সব শেষ হয়ে গেলেও আশা ছাড়তে নেই! শিরাকে যে বাঁচতেই হবে। গোকুলের জন্য। গোকুল আর ওর সন্তানের জন্য। পৃথিবীতে আনতে হবে সেই নতুন প্রাণকে, যার দিকে তাকিয়ে ও আবার খুঁজে পাবে ওর হারিয়ে-যাওয়া গোকুলকে।

শিরা চোখের জল মুছল। না। ও বাঁচবে। জন্ম থেকে যে গ্রামে ও বেড়ে উঠছে, সেই মোলে গ্রাম থেকে অনেক দূরে চলে যেতে হবে ওকে। বাঁচতে ওকে হবেই।

ওর নিজের জন্য। ওদের দুজনের সন্তানের জন্য!  

৩১

”শংকর!”

রুদ্র ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকে এল। পেছন পেছন আনন্দিনী আর প্রিয়ম।

শংকর উদ্ভ্রান্ত চোখে তাকাল, ”ডাক্তার বললেন, দুয়ার্তেকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে।”

”জানি।” রুদ্র বলল, ”শংকর! আর একটুও দেরি করলে চলবে না। তুই ফুল ফোর্স রেডি কর! আমাদের এখুনি বেরোতে হবে!”

”কী হয়েছে?”

”সব বলব। কিন্তু তুই আগে ফোর্স রেডি কর।” উত্তেজনায় রুদ্রর গলার স্বর কাঁপছিল, ”আর মার্তণ্ডর শেষ লোকেশন ট্র্যাক কর। আর-একটু দেরি হলে আমরা পালের গোদাকে ধরতে পারব না!”

শংকর পাক্কা সাড়ে চার মিনিট সময় নিল। নর্থ গোয়ার স্পেশ্যাল সেলের এস. পি.-র নির্দেশে পুলিশ বোঝাই একটা গাড়ি যখন ভাগাতোরের রাস্তা দিয়ে ছুটতে শুরু করল, সামনের জিপে বসে রুদ্র ততক্ষণে উত্তেজনায় নখ খুঁটে রক্ত বের করে ফেলেছে।

প্রিয়ম বলল, ”তুমি এত টেনশন করছ কেন? কী হয়েছে?”

শংকর অনবরত সাইবার সেলের সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছিল। ফোনটা রেখে বলল, ”মার্তণ্ডর ফোন তো বন্ধ। শেষ লোকেশন পাওয়া যাচ্ছে ক্যালাংগুটে বিচ থেকে একটু দূরে।”

”সেটাই অনুমান করেছিলাম।” রুদ্র বলল, ”জলদি চল, শংকর! সময় নেই। একদম সময় নেই!”

গোয়া রাজ্যের পশ্চিমদিকে পর পর রয়েছে একের পর এক বিখ্যাত সমুদ্র সৈকত। ভাগাতোর বিচের পাশের সমান্তরাল রাস্তা বরাবর সোজা এগোতে থাকলে পর পর পড়তে থাকে আঞ্জুনা, বাগা, ক্যালাংগুটের মতো বিচ। মারগাঁও কমিশনারেটের দুটো গাড়ি ছুটছিল উল্কার গতিতে। শংকর ক্রমাগত ফোনে কথা বলে চলছিল, ক্যালাংগুটে পেরিয়ে কন্ডোলিম বিচের কাছাকাছি এসে গাড়ি থামাতে বলল।

”এইখানেই কোথাও মার্তণ্ড রয়েছে। মানে ওর ফোনের শেষ লোকেশন এটাই!” শংকর বিচে নেমে বলল।

কন্ডোলিম বিচ একেবারে ফাঁকা, সমুদ্রের দামাল হাওয়ায় উড়তে-থাকা চুল ঠিক করতে করতে রুদ্র বলল, ”আচ্ছা, এখান থেকে সিংকেরিম বিচ কি কাছে?”

”তুই কী করে জানলি!” শংকর বলল, ”কন্ডোলিম বিচ পেরিয়েই তো সিংকেরিম। গাড়িতে এখান থেকে পাঁচ মিনিট বড়োজোর।”

”শংকর!” গাড়িতে উঠল, ”সিংকেরিম বিচে যেতে হবে। এখুনি।”

শংকর দ্রুত গাড়িতে উঠে আবেলের দিকে তাকাল, ”চলো। কুইক!”

বালির ওপর দিয়ে গাড়ি ছুটছে। প্রিয়ম রুদ্রর কানে একবার ফিসফিস করল, ”কী ব্যাপার বলো তো, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না! ভিলেইন কি মার্তণ্ড নাকি?”

”জলদি চলো আবেল!” শংকর সামনের সিট থেকে বলল, ”সিংকেরিম বিচ ঢুকছি। কোথায় যাব?”

রুদ্র কয়েক মুহূর্ত থামল। তারপর একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, ”ববি গঞ্জালভেজের বাড়ি!”

”মানে?” শংকর ঝট করে পেছনে ফিরল, ”মার্তণ্ড কি ওখানে লুকিয়েছে? বাবার কোনো ক্ষতি করবে না তো!”

রুদ্র উত্তর দিল না। সিংকেরিমের বালির চর পেরিয়ে গাড়ি রাস্তায় ঢুকল।

ফাঁকা ফাঁকা চওড়া রাস্তাঘাট। দু-পাশে তোরণের মতো করে নারকেল গাছ দুলছে। দুটো গলি ঘুরে উজ্জ্বল নীল-সাদা রঙের বাংলোর সামনে যখন শংকরের গাড়ি দাঁড়াল, বাইরে হলুদ গেটের বোগেনভেলিয়া পাতাগুলো হাওয়ায় তিরতির করে কাঁপছে।

ওদের গাড়ির পেছন পেছন এসে ব্রেক কষেছিল পুলিশের দ্বিতীয় গাড়িটিও। রুদ্র, শংকর, প্রিয়ম দ্রুত খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল। পেছন পেছন দশ-বারোজন পুলিশ।

করিডর দিয়ে মিনি চ্যাপেল হলে ঢোকার আগে রুদ্র ফিসফিস করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, শংকর বিদ্যুদগতিতে রুদ্রকে সরিয়ে দিল।

রুদ্র মাথা সরানোমাত্র ওর ঠিক পেছনের দেওয়ালে এসে লাগল একটা গুলি। দেওয়ালে টাঙানো সমুদ্রের ছবিটা ঝনঝন করে খসে পড়ল।

এরপর যে প্রত্যক্ষ এনকাউন্টার শুরু হল, সেটার সঙ্গে পুলিশরা পরিচিত থাকলেও আনন্দিনী আর প্রিয়ম হতভম্ব হয়ে গেল। শংকর, বিজয় আর পরাগ মুহূর্তের মধ্যে চ্যাপেল হলে ঢোকার দরজার আগে পজিশন নিয়ে নিল, পেছন পেছন বাকি পুলিশরা। তারপর চলতে লাগল গুলি ছোড়াছুড়ি।

প্রিয়ম কিছুই বুঝতে পারছিল না। ভেতর থেকে কারা গুলি ছুড়ছে?

পাঁচ মিনিটের মধ্যে ভেতর থেকে কোনো শব্দ বা গুলির প্রত্যুত্তর না আসতে শংকর ইশারা করে ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিল, রুদ্র বাধা দিল, ”দাঁড়া। ওদের কাছে গুলি থাকলেও থাকতে পারে। ঢোকামাত্র শট করবে।”

”আমার খুব ভয় করছে! বাবার কোনো ক্ষতি করেনি তো?” উত্তেজনায় শংকরের কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, ”মার্তণ্ড কি বাবাকে মেরে ফেলেছে?”

”না।” রুদ্র শংকরের চোখের দিকে তাকাল, ”বরং উলটোটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।”

”কী বললি?” শংকর রুদ্রর কথা শুনতে পেল না, কথা চাপা পড়ে গেল গুলির শব্দে। পরাগ অতি উৎসাহী হয়ে ঢুকে পড়েছিল, উলটোদিকের শেষ গুলিটা এসে ওর কাঁধ এ ফোঁড়-ও ফোঁড় করে দিয়েছে।

শংকর আর দেরি করল না। সবাইকে নিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে। মেসেজ পাঠানো আছে, কয়েক মিনিটের মধ্যে লোকাল থানা থেকে ফোর্স এসে পড়বে।

রুদ্র আর প্রিয়ম ঢুকল সবার শেষে। চ্যাপেলের ভেতরটা ছত্রভঙ্গ দশা। টেবিল উলটে, কাচের জিনিস ভেঙেচুরে ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে। তারই মধ্যে মাটিতে শুয়ে রয়েছে দুটো ছেলে। তাদের শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। একজন ইতিমধ্যেই নিস্পন্দ, প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। আরেকজনের কাতরানো দেখে বোঝা যাচ্ছে, পৃথিবীতে তার আয়ু আর কয়েক মুহূর্ত মাত্র।

প্রিয়ম বলল, ”সেই রিকি আর ভিকি দুই ভাই!”

রুদ্র গিয়ে জীবিতজনের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল, ”তোদের মালিক কোথায়? বল!”

ছেলেটা প্রচণ্ড যন্ত্রণায় একটা আর্তনাদ বের করল, চোখ বড়ো বড়ো হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইল। তারপর ছটফট করে স্থির হয়ে গেল। মুখটা হেলে গেল একপাশে।

”শিট!” রুদ্র উঠে দাঁড়াল, ”শংকর, আর এক মুহূর্ত দেরি করিস না। তোদের টিমের কয়েকজনকে এই বাড়িটা সার্চ করতে বল। আর আমাদের এখুনি যেতে হবে কোমিদা হারমোসায়। মার্তণ্ডকে সেখানে পাওয়া গেলেও যেতে পারে!”

কোমিদা হারমোসা! ববি গঞ্জালভেজের রেস্তরাঁ!

গোটা রাস্তা শংকর কোনো প্রশ্ন করল না। পরাগকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হাসপাতালে। ওদিকে ভাগাতোরের দুয়ার্তে হোমকে পুরোপুরি মুড়ে ফেলা হয়েছে কড়া নিরাপত্তায়।

কোমিদা হারমোসা রেস্তরাঁর ঝাঁপ বন্ধ, পেছনের তালাবন্ধ দরজা ভেঙে যখন পুলিশের দল ঢুকল, প্রথমেই তারা সবাই নাক চাপা দিল। রান্নার গ্যাস কি লিক করেছে?

নর্থ গোয়ার স্পেশ্যাল ব্র্যাঞ্চ এস. পি. শংকর গঞ্জালভেজের আদেশে গোটা বাহিনী ছড়িয়ে পড়ল রেস্তরাঁর মধ্যে। প্রতিটি জানলা শক্তভাবে আটকানো, আলো ঢোকার কোনো ছিদ্র নেই। শংকরের নির্দেশে দ্রুত কয়েকজন গিয়ে জানলাগুলো খুলে আলো জ্বালিয়ে দিল।

রেস্তরাঁটাপোর্তুগিজ থিমের ওপর সুসজ্জিত হলেও আকারে খুব একা বড়ো নয়। একসঙ্গে পঞ্চাশজন খেতে পারার মতো ডাইনিং হল, পেছনে কিচেন আর ওয়াশরুম।

বিজয় গোমস নাকে-মুখে রুমাল বেঁধে নিয়েছিল, রান্নাঘরের বন্ধ দরজায় গিয়ে সে যখন জোরে লাথি কষাল, গ্যাসের তীব্র গন্ধ এসে নাকে ঝাপটা মারল সবার।

রান্নাঘরের ভেতরে হাত-পা-বাঁধা অবস্থায় পাওয়া গেল মার্তণ্ডকে। পাশেই গ্যাস বার্নার। তার সব ক-টা নব খোলা।

মার্তণ্ডকে বার বার ডেকেও কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। চোখ বন্ধ, সে এলিয়ে পড়ে রয়েছে দেওয়ালে।  

৩২

রুদ্র একটা লম্বা দম নিল। তারপর বলল, ”শংকর, এতক্ষণে হয়তো তুই অনেক কিছুই অনুমান করতে পারছিস, তবু আমার বলার একটা দায় থেকে যায়। নয়ের দশকে গোয়া রাজ্য কেঁপে উঠেছিল ফ্রেডি পিট মামলায়। রাজ্যের অন্যতম সম্মানীয় এক মানুষ ফ্রেডি পিট তার গুরুকুল অনাথ আশ্রমে প্রায় ত্রিশ বছর ধরে শিশুদের যৌননির্যাতন, চাইল্ড পর্নোগ্রাফির র‌্যাকেট চালাত। তার সাঙ্গোপাঙ্গ ছিল দেশ-বিদেশ ও রাজ্যের অনেকে। সুবোধ বলে একটি ছেলের বাবা প্রথম থানায় অভিযোগ করেন। হাড় হিম করা কাণ্ড। যৌন আনন্দ পেতে সেখানকার অনাথ অসহায় বাচ্চা ছেলেদের ইঞ্জেকশন দিয়ে পুরুষাঙ্গ, অণ্ডকোষ বড়ো করা হত।”

”কী বলছ কী!” প্রিয়ম বলল, ”এ তো সাংঘাতিক ঘটনা! অথচ আমরা জানিই না!”

”সবই কালের গর্ভে তলিয়ে যায়। বিদেশি ট্যুরিস্টরা নিয়মিত আসত, তারা ফ্রেডি পিটের আশ্রম থেকে পছন্দমতো অনাথ ছেলেকে মোটা টাকার বিনিময়ে নিয়ে হোটেলে চলে যেত। উদ্ধার হয়েছিল আশ্রমের বাচ্চা ছেলেদের সঙ্গে বয়স্ক শ্বেতাঙ্গদের যৌনতার তেইশশোরও বেশি পর্ন ছবি, প্রায় দেড়শো ফিলমের নেগেটিভ, প্রচুর ইঞ্জেকশন ও ড্রাগ।” রুদ্র বলে যাচ্ছিল, ”আনন্দিনী আরও ডিটেইলে বলতে পারবে। সেই রেইডে হাতেনাতে ধরা পড়েছিল কয়েকজন, তারপর আরও কিছুজন। তাদের মধ্যে ইংল্যান্ড, জার্মানি, নিউ জিল্যান্ডের লোকও ছিল, আবার ছিল কিছু ভারতীয়। গোটা দেশে তখন ঝড় উঠেছে। ফ্রেডি পিট-সহ বাকিদের বিচার চলছে। তাদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে দেশ উত্তাল। কয়েকজন বিদেশি ফাঁক বুঝে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। তাদের ধরতে ভারতীয় টিম ছুটছে, সেই দেশের সঙ্গে কথা বলে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করছে।”

”আমি এগুলো সবই জানি, রুদ্র!” শংকর কিঞ্চিৎ অসহিষ্ণু স্বরে বলে উঠল, ”এই রাজ্যে পোস্টিং পাওয়ার পর প্রথম ট্রেনিং-এ এই আমাদের এই কেসটা পড়ানো হয়েছিল। এটা গোয়ার ল্যান্ডমার্ক ক্রাইম। কিন্তু এখন…!”

”বলছি, শংকর। আমায় একটু সময় দে।” রুদ্র আনন্দিনীর দিকে তাকাল, ”তোমার ওই কাগজটা দাও।”

আনন্দিনী কাগজটা এগিয়ে দিল।

কাগজটা

রুদ্র বলল, ”দশজনের তালিকায় পাঁচজনের এখনও কোনো হদিশ নেই, তা-ই তো আনন্দিনী?”

”হ্যাঁ।” আনন্দিনী বলল, ”আর ওই তেইশশো ছবিতে এরা ছাড়াও অন্তত কুড়ি-পঁচিশজন ছিল, যাদের পুলিশ কোনোদিনই খুঁজে বের করতে পারেনি।”

রুদ্র একটা লম্বা শ্বাস নিল, ”ধীরে ধীরে সব চাপা পড়ে গেছে। আইনের ফাঁকে ফ্রেডি পিটের মতো মানুষের মৃত্যুদণ্ড হয়নি, সে স্বাভাবিক নিয়মে জেলের মধ্যে মারা গেছে। ব্রিটেনের রেমন্ড ভার্লেকে ফিরিয়ে আনতে ভারতীয় পুলিশ ব্রিটিশ আদালতে গিয়ে আবেদন করতে ব্রিটিশ আদালত রেমন্ড ভার্লেকে অসুস্থতার দোহাই দিয়ে ছাড়েনি। বাকিরাও সব এদিক-ওদিক পালিয়েছে। গোয়া পুলিশও হাঁপিয়ে গেছে। কিন্তু ওরা ভাবতেও পারেনি যে, গুরুকুল অনাথ আশ্রমের ওই পাশবিক কাণ্ড বন্ধ হলেও সেখান থেকে রক্তবীজের মতো উঠে দাঁড়িয়েছে একাধিক পিডোফিল। তারা পুলিশের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্যের বা দেশের এককোণে। তারা নিজেদের মধ্যেই শুরু করেছে নতুন খেলা, এ বেগরবাই করলেই ও পুলিশকে জানাবে, আবার ও বেগরবাই করলে এ।”

রুদ্রর শেষ কথা শুনে শংকর তাকাল, ”মানে?”

”এডউইন কার্লোস বছরখানেক কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল। পরিস্থিতি ঠান্ডা হতে একেবারে ভোল পালটে খুলেছিল সেন্ট সেবাস্টিয়ান হোম। নতুন নাম নিয়েছিল ফাদার জেমসন। ওই একই কাজ করেছিল লা ভাস্কোনিয়া রেস্তরাঁর মালিক টোবিয়াস মুলার, সেন্ট মারিয়া অরফ্যানেজের পিটার অ্যান্ড্রুজ। এরা প্রত্যেকে নতুন ইনিংস শুরু করার সময় প্রত্যেককে সাহায্য করেছিল, একে অন্যের সূত্রে নতুন পরিচয়ের জাল বিছিয়েছিল অনেক দূর।” রুদ্র একটা লম্বা শ্বাস নিল, তারপর বলল, ”আর এদের এই গ্রুপের প্রধান পান্ডা ছিলেন কোমিদা হারমোসা রেস্তরাঁর মালিক মি. ববি ও গঞ্জালভেজ।”

”রুদ্র!”

বিজয় চমকে তাকাল। শংকরের মুখ লাল হয়ে গেছে। বিস্ময়ের চূড়ান্তে পৌঁছে গেছে প্রিয়মও। সে বলল, ”এ তুমি কী বলছ!”

গাড়ি ছুটছে দুরন্ত গতিতে। পুলিশের দ্বিতীয় গাড়িটা সংজ্ঞাহীন মার্তণ্ডকে নিয়ে চলে গেছে হাসপাতালের দিকে। আর এই গাড়িটায় রয়েছে রুদ্র প্রিয়ম আনন্দিনী শংকর আর বিজয়। গাড়ি চালাচ্ছে আবেল।

”ঠিকই বলছি। প্রথমে যে এমন কোনোদিকে ইঙ্গিত যেতে পারে, সেটাই আমার ভাবনায় আসেনি। প্রথম সন্দেহ জাগল, পিটার অ্যান্ড্রুজের বাড়ির পুরোনো ছবিটা দেখার পর। যদিও সেটার পরও আমি ববি গঞ্জালভেজের কথাকেই বিশ্বাস করেছিলাম। একটা খটকা যে লাগেনি তা নয়। সামান্য পরিচিতিতে ছবি তোলা স্বাভাবিক, কিন্তু সামান্য পরিচিত ব্যক্তির ছবি কি কেউ দেওয়ালে বাঁধিয়ে রাখতে পারে? দ্বিতীয় খটকা লাগল যখন টোবিয়াস মুলারের ফাইলটা দেখলাম। পরিষ্কার লেখা আছে, এক শুক্রবার দুপুরে তাঁর অচৈতন্য দেহ পাওয়া যায়। অথচ মি. গঞ্জালভেজের বাড়ি যেদিন গেছিলাম, উনি বলেছিলেন, টোবিয়াস মারা যাওয়ার আগের রাতেও ওঁরা স্নুকার্স খেলেছেন। কিন্তু ক্লাবে তো স্নুকার্স খেলা হত প্রতি রবিবার!”

”থাম রুদ্র!” শংকর হঠাৎ কর্কশস্বরে ঝাঁজিয়ে উঠল, ”এরকম ছোটোখাটো কথার ভুল বলার ফ্লো-তেও মানুষ করে। তুই এইটুকু থেকে অত বড়ো কনক্লুশনে আসতে পারিস না!”

রুদ্র কিছু বলতে যাচ্ছিল, শংকর ওকে থামিয়ে দিয়ে ড্রাইভার আবেলের দিকে তাকাল, ”তুমি এই রাস্তাটা ধরলে কেন? এদিকে কোথায় যাচ্ছ?”

আবেল উত্তর দেওয়ার আগে রুদ্র মুখ খুলল, ”আমরা এয়ারপোর্ট যাচ্ছি, শংকর।”

”এয়ারপোর্ট!”

”হ্যাঁ। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ববি গঞ্জালেজ উড়ে যাবেন প্যারিসে।” রুদ্র ফোনের দিকে তাকাল, ”একবার তিনি পালালে আর কিচ্ছু করা যাবে না। ফ্রেডি পিট মামলার বাকিদের মতো তিনিও তখন ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবেন। আমাদের তার আগেই ধরতে হবে!”

এয়ারপোর্টে ওদের গাড়ি যখন ঢুকল, তখন পনেরো মিনিট কেটে গেছে। গোয়ার ডাবোলিম এয়ারপোর্ট আয়তনে ছোটো হলেও আন্তর্জাতিক অনেক উড়ান চলাচল করে। বেশ ভিড়ও। গাড়ি থেকে নেমে ওরা দ্রুত লাউঞ্জে ঢুকল।

শংকর অনবরত ফোনে নির্দেশ দিতে দিতে এয়ারপোর্ট অথরিটির কন্ট্রোল রুমে প্রবেশ করল, ”নর্থ গোয়া স্পেশ্যাল সেল এস. পি.।”

অনেকগুলো ছেলে-মেয়ে কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করে চলেছে। সিকিউরিটি গার্ড ওদের ম্যানেজারের কাছে নিয়ে গেল।

”বলুন স্যার।”

”প্যারিসের ফ্লাইটটা হোল্ড করুন। একজন ক্রিমিনাল আছে, তাকে নামাতে হবে।” বলার সময় শংকরের গলাটা সামান্য কেঁপে গেল।

”প্যারিসের ফ্লাইট!” ম্যানেজার স্ক্রিনের দিকে তাকালেন, ”ওটা তো এখুনি ফ্লাই করে গেল, স্যার!”

”শিট!” শংকর আবার ফোনের দিকে তাকাল, ”দিল্লিতে আধ ঘণ্টার স্টপ ওভার আছে। আমি এখুনি ডি.জি. স্যারের সঙ্গে কথা বলছি। দিল্লিতে আটকানোর অর্ডার আনাতেই হবে।”

৩৩

রুদ্র বলতে আরম্ভ করল, ”ববি অলিভার গঞ্জালভেজ। প্রথম যৌবন থেকেই তাঁর মধ্যে পিডোফিলিয়ার বিকৃতি প্রকাশ পেয়েছিল। মাত্র উনিশ বছর বয়সে নিজের গ্রামের একটি শিশুকে যৌননির্যাতন করে ধরা পড়তে মেদিনীপুরের পোর্তুগিজ গ্রাম মিরপুর থেকে তাঁকে বিতাড়িত করা হয়। মহিষাদল থেকে এটা কনফার্ম করেছি।

”ববি কলকাতায় চলে এসে নতুনভাবে নিজের জীবন শুরু করেন, কলকাতার সাহেবি হোটেলগুলোয় কাজ করে নানারকম পাশ্চাত্য আদবকায়দা আয়ত্ত করেন ঠিকই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে রয়ে যায় সেই জঘন্য প্রবৃত্তি। হোটেলের সূত্রে ববি খোঁজ পেয়ে যান নিয়মিত চলা গোয়া রাজ্যের এক পিডোফিল র‌্যাকেটের খবর। মারগাঁওয়ের গুরুকুল অরফ্যানেজ, মালিক ফ্রেডি পিট। দেশ -বিদেশের বহু লোক সেখানে আসে, অরফ্যানেজের অসহায় অনাথ গরিব বাচ্চাদের ওপর ভয় বা লোভ দেখিয়ে নারকীয় অত্যাচার চালায়। গা গুলিয়ে-ওঠা সেই ঘটনার বর্ণনা পুলিশ রেকর্ড থেকে শুরু করে রিসার্চার আনন্দিনীর পেপার, সবেতেই রয়েছে। ববি হোটেলে চাকরি করেন আর কয়েক সপ্তাহ অন্তরই টাকা জমিয়ে গোয়া চলে আসেন। শুধু যে তিনি নিজের বিকৃত লিপ্সা মেটান তা-ই নয়, দালালিও করেন। গোয়ায় শিকারের লোভে আসা বিদেশি পিডোফিলদের ফ্রেডি পিটের আশ্রমে নিয়ে আসার জন্য নেন মোটা কমিশন। হোটেলের এক সাধারণ কর্মচারী হলেও ববি গঞ্জালভেজ অত্যন্ত সুদর্শন, কথাবার্তাও খুব আকর্ষক। কস্তুরী চক্রবর্তী নামের শিক্ষিতা বাঙালি এক মেয়ে ববির প্রেমে পড়লেও ঘুণাক্ষরেও টের পাননি তাঁর ওই অন্ধকার দিকটির অস্ত্বিত্ব। বিয়ের পরেও ববি প্রায়ই বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার নাম করে গোয়ায় চলে আসতেন। এভাবেই চলছিল। হঠাৎ ১৯৯১ সালের মার্চ মাসে ছন্দপতন। বমাল সমেত ফ্রেডি পিট গ্রেপ্তার হল। ববি তখন কলকাতাতেই ছিলেন। গোটা দেশে এই কয়েক দশক ধরে চলতে-থাকা ঘৃণ্য অপরাধ আলোড়ন তুলল। ফ্রেডি পিটের অনেক সাঙ্গোপাঙ্গ তার সঙ্গে ধরা পড়লেও ববির মতো অনেকগুলো লোক স্রেফ ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেল। তাদের মধ্যে একজন হল জার্মানির জেল জুরগা অ্যান্ড্রিয়াজ। বিত্তশালী বিকৃতকাম। পুলিশ তার সন্ধান পায়নি, কারণ ওই চক্র ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে নিজের নামধাম সবকিছু বদলে পোর্তুগিজ সাহেব হয়ে এখানে একটা রেস্তরাঁ খুলে বসেছিল। সেই রেস্তরাঁই হল কোমিদা হারমোসা। ববির সঙ্গে তার বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। অর্থ আর লালসার লোভে ববি কলকাতা থেকে সব ছেড়েছুড়ে এসে যোগ দিলেন তার সেই রেস্তরাঁয়। শুরু হল নতুন পিডোফিল চক্র। আর নিজের দুর্ভাগ্যে যে নির্দোষ মানুষটি এই চক্রে তালেগোলে জড়িয়ে পড়লেন, তিনি দুয়ার্তে। যাঁর আসল নাম বসকো জর্জ।”

অনেকক্ষণ একটানা বলে রুদ্র থামল।

ওরা সবাই বসে রয়েছে মারগাঁও কমিশনারেটে শংকরের কেবিনে। ওরা বলতে রুদ্র, প্রিয়ম, শংকর, পরাগ কামাথ, বিজয় গোমস, আনন্দিনী আর মার্তণ্ড। মার্তণ্ডকে আজ সকালেই হাসপাতাল থেকে ছাড়া হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছেন গোয়া পুলিশের ডি.জি রাকেশ দ্বিবেদী, শংকরের বস।

ববি গঞ্জালভেজকে দিল্লি বিমানবন্দরে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। পুলিশি হেপাজতে তাঁকে নিয়ে আসা হচ্ছে গোয়ায়। অন্যদিকে জিমি আর মাইকেলকে তুলে আনা হয়েছে থানায়।

”এইবার চলে আসছি কাহিনির দ্বিতীয় পর্বে। বলতে আপত্তি নেই, এই দ্বিতীয় ভাগ এতটাই রোমাঞ্চকর, জটিল ও নির্মম, যে আমরা কেউই তা প্রথম থেকে বুঝতে পারিনি! অপরাধের জাল এতটাই সুবিস্তৃত যে বহুবার ভুল পথে এগিয়েছি, ঠোক্কর খেয়েছি, আবার ফিরে এসেছি। সেটা বলার আগে আমাদের আবার সেই কাগজটা দেখতে হবে।” রুদ্র কিছুটা জল খেল, তারপর আনন্দিনীর সেই কাগজটা মেলে ধরল।

শংকরের অফিসের ডেটা অপারেটর প্রস্তুত হয়েই ছিল। দ্রুত সেটাকে স্ক্যান করে ফুটিয়ে তুলল সামনের দেওয়ালে সেট করা বিশাল প্রজেক্টরে।

পুলিশ রেকর্ড

”ভালো করে সবাই দেখুন। পুলিশ রেকর্ড কী বলছে।” রুদ্র ফাইল থেকে পড়তে থাকে, ”ক নামক কিশোর গত কয়েক বছর ধরে নিলস অস্কার জনসন নামে এক সুইডিশ সাহেবের সঙ্গে হোটেলে যায়। জনসন সাহেব প্রতিবছর গোয়ায় আসে, এসে তিন-চার মাস করে থাকে। ‘ক’-কে নিয়ে যায় কোলভা বিচের সুখসাগর হোটেলে। নিউ জিল্যান্ড থেকে আসা ইওঘান ম্যাকব্রাইডের সঙ্গে ‘ক’-কে যেতে হত বেনাউলিম বিচের এক গেস্ট হাউসে। সেই গেস্ট হাউসের মালকিন নিজেও সাক্ষ্য দিয়েছে, ম্যাকব্রাইড বছরে দু-তিনবার কোনো না কোনো কিশোরকে সঙ্গে করে এসে তার গেস্ট হাউসে উঠেছে। পায়ুসংগম, যৌন অত্যাচার থেকে এমন কিছু বিকৃতি ছিল না, যা অনাথ ছেলেগুলোকে দিয়ে করানো হত না। ‘গ’ নামক ছেলেটি দশ বছর বয়স থেকেই ইঞ্জেকশনের যন্ত্রণা সহ্য করত। ডমিনিক ও রেমন্ড নামের আরও দুজন শ্বেতাঙ্গের কথা সে বলেছে, যারা ছিল গুরুকুলের নিত্য অতিথি। গোটা কেস হিস্ট্রিতে রয়েছে আরও অনেক নাবালক সাক্ষীর গা শিউরে-ওঠা জবানবন্দি। রয়েছে প্রায় ষাট-সত্তরজন লোকের কথা, যারা নিয়মিত অথবা কখনো কখনো যেত ফ্রেডি পিটের ওই অনাথ আশ্রমে। নিজেদের বিকৃত কাম চরিতার্থ করত অসহায় অনাথ ছেলেগুলোকে দিয়ে।”

রুদ্র নিশ্বাস নিল, ”সুবোধ ভর্গরাজের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে যখন গুরুকুল অরফ্যানেজে চিরুনিতল্লাশি চলছিল, মি. বসকো জর্জ নামক মিশনারিজ অফ ডিভিনিটি থেকে বিতাড়িত হওয়া পোর্তুগিজ স্বেচ্ছাসেবকটি তখন ছিলেন গোয়াতেই। তিনি তার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ফ্রেডি পিটের অরফ্যানেজে কর্মচারী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।”

”দুয়ার্তে ফ্রেডি পিটের অরফ্যানেজে কাজ করতেন?”

”হ্যাঁ। কলকাতায় চাকরি চলে যাওয়ার পর ববি গঞ্জালভেজই তাঁকে এই চাকরির সুপারিশ করে পাঠিয়েছিলেন। অনাথ বাচ্চাদের দেখভাল আর ক্রিশ্চান ধর্মের উপাসনা, এই ছিল বসকো জর্জের লক্ষ্য। পিডোফিলিয়ার বিকৃতি তাঁর মধ্যে ছিল না। ফ্রেডি পিটের আশ্রমের আসল কাণ্ডকারখানা টের পেয়ে দিনকয়েক আগেই তিনি আশ্রমের কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন। আশ্রমের একটি বাচ্চা ছেলের ওপর তাঁর বড়ো মায়া পড়ে গিয়েছিল, তাকে নিয়ে তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন পুলিশ আসার মাত্র কয়েকদিন আগে। নিজের নাম পালটে, চুল-দাড়ি রেখে সম্পূর্ণ ভোল বদলে ফেলেছিলেন তিনি। নতুন নাম নিয়েছিলেন দুয়ার্তে দে অলিভেইরা।”

”এই তথ্যের সত্যতা?” শংকর রুক্ষ কণ্ঠে বলে উঠল।

রুদ্র মার্তণ্ডর দিকে তাকাল। মার্তণ্ড একটা ফাইল এগিয়ে দিল, ”এতে ১৯৯০ সালে মিশনারিজ অফ ডিভিনিটির কলকাতা ব্রাঞ্চের রেজিস্টারের কপি রয়েছে, স্যার। কলকাতায় রুদ্রাণী ম্যাডামের একজন স্টাফ গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে এসেছেন। বসকো জর্জ নামক বিতাড়িত হওয়া ভলান্টিয়ারের ছবির সঙ্গে মি. দুয়ার্তের মুখের আদল হুবহু মিলে যায়।”

 ”মিডিয়ার হইচই থিতু হল প্রায় আড়াই তিন মাস পরে। যে বিদেশিরা ধরা পড়েছিল, তাঁদের অনেকেই চোরাগোপ্তা পথে পালিয়ে গেছেন স্বদেশে, এক্সট্র্যাডিশন চুক্তি প্রয়োগ করে তাঁদের কীভাবে নিয়ে আসা যায়, সেই চিন্তাতেই তখন সরকার মশগুল। সবার অলক্ষে ধরা না-পড়া পিডোফিলদের জোট আবার তৈরি হতে লাগল গোয়ায়। তাঁদের মধ্যে কেউ রেস্তরাঁ খুলে বসেছেন, কেউ আবার নতুন কোনো অরফ্যানেজ। আর নতুন এই জোটের পান্ডা জেল জুরগা অ্যান্ড্রিয়াজ, শাগরেদ ববি অলিভার গঞ্জালভেজ।”

রুদ্র কাগজে লিখতে লাগল, ”পিডোফিলিয়ার তাড়সে কলকাতা থেকে স্ত্রী-পুত্রকে ফেলে রেখে ববি চলে এসেছিলেন গোয়ায়, রেস্তরাঁ খুলে জাঁকিয়ে বসলেন। এডুইন কার্লোস নামক ফ্রেডি পিটের আরেক সঙ্গী ভোল বদলে ফাদার জেমসন হয়ে সেন্ট সেবাস্টিয়ান হোম খুলে বসেছে। অন্যদিকে রয়েছে পিটার অ্যান্ড্রুজের সেন্ট মারিয়া অরফ্যানেজ। জেল জুরগা অ্যান্ড্রিয়াজ আর ববি গঞ্জালভেজ এদের নিয়ে শুরু করলেন নতুন ব্যবসা। ব্রাইট ফিউচার ইন্টারন্যাশনাল। অনাথ অথবা পরিত্যক্ত শিশুদের তুলে এনে যথেচ্ছ নির্যাতন, শেষে বিদেশে দত্তক দেওয়ার নামে মোটা ডলারে বিক্রি করে দেওয়া।”

”ব্রাইট ফিউচার ইন্টারন্যাশনালের মালিকানা সম্পর্কে সব তথ্য আমাদের কাছে এসেছে।” শংকরের গলায় তীব্র ঝাঁজ, ”ফ্রান্সের এক লেখক ওই এন. জি. ও.-র মালিক।”

”হুম। এখনকার বিখ্যাত সেই লেখকও ছিলেন ফ্রেডি পিটের অন্যতম সঙ্গী। ধরাও পড়েছিলেন। পরে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে নিজের দেশে পালান, তারপর নাম-পরিচয় সব বদলে লিখতে শুরু করেন। বইও জনপ্রিয় হয়। কিন্তু ভেতরের সেই পিডোফিলিয়ার বিকৃতি যায় না। নিজেদের দেশের দত্তক নেওয়ার জটিল পদ্ধতি এড়াতে অনেক ইয়োরোপীয় দম্পতিই ভারতীয় শিশু দত্তক নিতে চান। সেই আবেগটাকে কাজে লাগিয়েই ওই লেখক, জেল জুরগা অ্যান্ড্রিয়াজ আর ববি গঞ্জালভেজ শুরু করেন ব্রাইট ফিউচার ইন্টারন্যাশনাল। একদিকে ভালো উপার্জন, অন্যদিকে নিজেদের লালসা চরিতার্থ করা। বছরকয়েক পর জেল জুরগা অ্যান্ড্রিয়াজ হঠাৎ মারা গেলেন। তখন এখানকার একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে উঠলেন ববি।”

”উনি গোয়ায় বসে এত কিছু চালিয়ে যাচ্ছিলেন, আর তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে কিছুই টের পেল না?”

”ওটাই তো মজা, শংকর! ববির দ্বিতীয় স্ত্রী বলেই কেউ নেই তো পুত্র-কন্যা। ববি গঞ্জালভেজ ওগুলো তোদের ভাঁওতা দেওয়ার জন্য বলতেন। উনি একজন ভয়ংকর মানের শিশুকামী। কলকাতার পরিবার ছেড়ে এখানে আসার উদ্দেশ্যই ছিল একাকী নিরাপদভাবে সেই লালসাকে নিয়মিত চরিতার্থ করা। মাঝেমধ্যে প্যারিস যেতেন নিজের ক্রাইম পার্টনারের কাছে। আমি তো শুধু টোবিয়াস মুলার পিটার অ্যান্ড্রুজ আর ফাদার জেমসনের খোঁজ পেয়েছি। আরও কত পিডোফিলকে ববি গঞ্জালভেজ নিজের নেটওয়ার্কে এনেছিলেন, সেটা এবার খুঁজে বের করার দায়িত্ব গোয়া পুলিশের। জেল জুরগা অ্যান্ড্রিয়াজের মৃত্যুটাও স্বাভাবিক না খুন, সেটাও খোঁজ নিতে হবে। হতেই পারে, ববি কৌশলে ওঁকে সরিয়ে দিয়ে একা সবকিছুর মালিক হয়েছেন।”

রুদ্র একটু থেমে শংকরের হাতের ওপর হাত রাখল, ”আমি জানি, তোর মনের ওপর দিয়ে কী যাচ্ছে। আর সেজন্যই এই সন্দেহগুলো মাথায় আসার পর আমি বহুরকম প্রমাণ জড়ো করেছি। প্রিয়মের ফ্রান্সের এক সহকর্মীকে দত্তক নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছি ব্রাইট ফিউচার ইন্টারন্যাশনালে। তারা নানারকম সতর্কতা অবলম্বন করলেও সবশেষে তাকে দিয়েছে গোয়ার একজন লোকের ফোন নম্বর।”

”সেই লোকটা আমার বাবা?” শংকর রুক্ষভাবে বলে উঠল।

”না। সেই লোকটা হল ববি গঞ্জালভেজের রেস্তরাঁ কোমিদা হারমোসার শেফ দিয়েগো। তার আরও একটা পরিচয় আছে। মি. দুয়ার্তের গুড রিটার্ন হোমের জিমি।”

”মানে!” প্রিয়ম এতক্ষণ পর মুখ খুলল, ”একই লোক দু-জায়গায় কাজ করত?”

”হ্যাঁ।” রুদ্র বলল, ”ববি গঞ্জালেজ দীর্ঘদিন ধরে ব্ল্যাকমেইল করে আসছিলেন বসকো জর্জ ওরফে মি. দুয়ার্তেকে। দুয়ার্তের গতিবিধির ওপর নজর রাখার জন্য নিজের চেলা জিমিকে তিনি প্রতিদিন পাঠাতেন দুয়ার্তের হোমে।”

ডি.জি. রাকেশ দ্বিবেদী এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন। এবার জিজ্ঞেস করলেন, ”কীসের জন্য ব্ল্যাকমেইল?”

”ফ্রেডি পিটের আশ্রমে শেষ কয়েক মাস কাজ করেছিলেন বসকো জর্জ। কাকতালীয়ভাবে সেক্স র‌্যাকেট ধরা পড়ার কয়েকদিন আগে কাজ ছেড়ে দিলেও গুরুকুল অরফ্যানেজের রেজিস্টারে ছিল তার নাম ও ছবি। পিডোফিলিয়া চক্রে জড়িত না থাকলেও পুলিশ নিশ্চিত তাঁকে ধরত, এই ভয় তাঁকে সবসময় পালিয়ে নিয়ে বেড়াত। আর সেই ভয়টাকেই পুরোপুরি ব্যবহার করতেন ববি গঞ্জালভেজ।”

”কীভাবে?”

”প্রথমে তিনি বন্ধুর ছদ্মবেশে বসকো জর্জকে সাহায্য করেন। নতুন নাম-পরিচয় নিয়ে নতুন অরফ্যানেজ খোলান। বসকো জর্জ সত্যি সত্যিই মি. দুয়ার্তে দে অলিভেইরা হয়ে ‘গুড রিটার্ন’ করেন তাঁর ‘গুড রিটার্ন হোম’-এ। কিন্তু যতদিন যেতে থাকে, দুয়ার্তে বুঝতে পারেন যে তাঁকে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁরই আশ্রমের একের পর এক ছেলেকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে পিটার অ্যান্ড্রুজের সেন্ট মারিয়া অরফ্যানেজ কিংবা ফাদার জেমসনের সেন্ট সেবাস্টিয়ান হোমে। সেখানে চলছে যথেচ্ছ নিপীড়ন, যারা আদৌ অনাথ নয়, তাদের অল্প টাকায় কিনে নিয়ে মোটা ডলারে বেচে দেওয়া হচ্ছে বিদেশে।”

”এক মিনিট! এই কথার ভিত্তি কী?” শংকর এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। তার কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছিল। স্খলিতস্বরে সে আবার চেঁচিয়ে উঠল, ”কোন এভিডেন্সের ভিত্তিতে তুই এ কথা বলছিস?”

রুদ্র একটু থেমে বলল, ”ভেবেছিলাম, পরে ডাকব। কিন্তু না। কমিশনারেটের ওয়েটিং লাউঞ্জে এক ভদ্রলোক অপেক্ষা করছেন, ডেকে আনতে বল।”

মিনিট দুয়েক বাদে এক কনস্টেবলের পেছন পেছন যিনি প্রবেশ করলেন, তাঁকে দেখে আনন্দিনী চমকে উঠল, ”ড. পটেল, আপনি!”

ড. জয়েশ পটেল ম্লান মুখে তাকালেন আনন্দিনীর দিকে।

রুদ্র বলল, ”ইনিই সেই কিশোর, যাকে নিয়ে চক্র ফাঁস হওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে মি. দুয়ার্তে পালিয়ে গিয়েছিলেন।”

”কী!”

”হ্যাঁ। আশ্রমের এই মেধাবী শান্তশিষ্ট ছেলেটিকে তার আগে দীর্ঘদিন সহ্য করতে হয়েছে পাশবিক বিকৃত অত্যাচার। ছেলেটার ওপর দুয়ার্তের বড়ো মায়া পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাকে পড়ানোর মতো ক্ষমতা ছিল না। বাধ্য হয়ে ববি গঞ্জালভেজের অনুদানে জয়েশকে পড়ান মি. দুয়ার্তে। ববি গঞ্জালভেজের এন. জি. ও.-র টাকায় জয়েশ পড়েন, বিদেশে যান, নামী কলেজের অধ্যাপক হন। বাকি কথা ড. পটেল, আপনিই বলুন!”

ড. পটেল ধরা গলায় বললেন, ”আমার বাবা-মা দুজনই ছিলেন ফাদার দুয়ার্তে! আমার শৈশবের কালো দাগ অনেকটাই ফিকে হয়ে গিয়েছিল তাঁর স্নেহে। তিনি নেই। আমি আর কী বলব? রূপা খুন হয়েছে, আনন্দিনীরও যদি কিছু হয়? তাই গতকাল ফ্লাইট ধরে—!”

রুদ্র বলল, ”রূপা নেইলসনকে তো আপনিই পাঠিয়েছিলেন দুয়ার্তের কাছে?”

”হ্যাঁ। রূপা বলেছিলেন, তিনি পশ্চিমঘাট পর্বতের লতাপাতা নিয়ে কাজ করবেন, এ ছাড়া গোয়ার ইনকুইজিশন নিয়েও লিখবেন। আমি ফাদারের কাছে পাঠাই।” ড. পটেল বললেন, ”তখনও জানি না, রূপা আসলে নিজের শিকড় খুঁজছিলেন। আর সেই শিকড় খুঁজতে গিয়ে তিনি ঢুকে পড়বেন সিংহের গুহায়, জড়িয়ে যাবেন নিজেরই ট্র্যাপে। জানতাম না, রূপা নিজেও শৈশবে শিকার হয়েছেন ববির ওই এন. জি. ও.-র।”

”হুম। রূপা নেইলসনের আগমন সংবাদে ববি গঞ্জালভেজ লাফিয়ে উঠেছিলেন। রূপাকে দিয়ে নিজের অনেকগুলো কাজ নিশ্চুপে সেরে ফেলছিলেন তিনি। সেন্ট মারিয়া অরফ্যানেজের মালিক পিটার অ্যান্ড্রুজ অনেকদিন ধরেই টাকাপয়সা নিয়ে গাঁইগুঁই করছিল, প্রতিটা বাচ্চাকে বিক্রির ঠিক পেমেন্ট না পেলে পুলিশের কাছে যাওয়ার ভয় দেখাচ্ছিল। পিটারকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে পারলে ওর অরফ্যানেজ থেকে নিজের ইচ্ছেমতো শিশু বিক্রি করতে পারেন ববি, পিটারের স্ত্রী মার্থা কিছু দেখেন না। ববি রূপাকে বোঝালেন, পিটার অ্যান্ড্রুজই আসলে রূপার ভাইয়ের ওপর নির্যাতন চালিয়ে তাকে মেরে ফেলেছে। রূপা নিজেও ‘রকি’ পরিচয় দেওয়া ছেলেটি যে প্রতারক তা প্রথমেই বুঝে ফেলেছিলেন। ববি গঞ্জালভেজের কথায় বিশ্বাস করে সে প্রথমে খুন করল পিটার অ্যান্ড্রুজকে।”

”এক মিনিট-এক মিনিট!” বিজয় গোমস বলে উঠল, ”পিটার অ্যান্ড্রুজ তো খুন হননি। স্বাভাবিক কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মারা গেছিলেন।”

”ওটাই তো চালাকি। রাইসিন। ক্যাস্টর অয়েল গাছের বীজে থাকা ভয়ংকর এক প্রাকৃতিক বিষ, যা মানুষের শরীরে ইঞ্জেক্ট করলে কিংবা খেলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু অবধারিত। অথচ সেই মৃত্যু হবে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে।” রুদ্র একটা নিশ্বাস ফেলল, ”রূপা নিজে বোটানির ছাত্রী ছিলেন, পশ্চিমঘাট পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে তিনি সম্ভবত সংগ্রহ করেছিলেন সেই বিষ। ওই একইভাবে একের পর এক খুন হয় লা ভাস্কোনিয়া রেস্তরাঁর মালিক টোবিয়াস মুলার, সেন্ট সেবাস্টিয়ান হোমের কর্ণধার ফাদার জেমসন। এরা সকলেই ছিল ববি গঞ্জালভেজের পিডোফিল চক্র ও অনাথ শিশুপাচারের সঙ্গী। পরে কোনো না কোনোভাবে ববির সঙ্গে ঝামেলা শুরু হয়। ববি রূপাকে বলেন, এরা সবাই শিশুপাচারে, পিডোফিলিয়ায় যুক্ত। রূপা এদের সঙ্গে আলাপ করতেন, ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে খুন করতেন।”

”কীভাবে?”

”সেটা আরও তদন্ত করলে বোঝা যাবে। রূপা নিজে কফি খেতে ভালোবাসতেন, তাঁর কাছে কফির নানারকম কালেকশন ছিল। কফিতে রাইসিন মিশিয়েই কি তিনি খুন করতেন? তা-ই যদি হয়, সেই ভয়ংকর বিষ কি এখনও তাঁর ঘরের কোথাও রাখা আছে? এগুলো সব ইনভেস্টিগেট করে বের করতে হবে।”

ডি.জি. স্যার বললেন, ”ফাদার জেমসনকে তাহলে ওই হুমকিগুলো রূপাই পাঠিয়েছিল?”

”রূপাও হতে পারেন। আবার ববি নিজেও। ওদিকে দুয়ার্তে নিজেও ববির ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিলেন। ববি বুঝেছিলেন, দুয়ার্তেকে প্রথমেই খুন করলে রূপাও হাতছাড়া হবে। দুয়ার্তে নিজে মিশনারিজ অফ ডিভিনিটির ভেতরের কার্যকলাপ, আরও নানারকম বৈষম্য নিয়ে বিরক্ত ছিলেন, তিনি চাইছিলেন সেসব নিয়ে লিখতে। দুয়ার্তেকে হাতে রাখতে ববি নিজে ওই কাগজটা শুরু করান। কাগজের এডিটরের জায়গায় অলিভপাতা আসলে ববি অলিভার গঞ্জালভেজেরই নাম। সেটাকে আমি প্রথমে দুয়ার্তে দে অলিভেইরা বলে ভুল করেছিলাম।”

”ডার্ক হোয়াইটের এডিটর ববি গঞ্জালভেজ!”

”হ্যাঁ। ববি নিজে দুয়ার্তেকে দিয়ে কাগজটা শুরু করান, নিজে থাকেন আড়ালে। দুয়ার্তে যত ফ্রেডি পিট মামলা নিয়ে সেখানে লিখতে থাকেন, তত ভয়ে কুঁকড়ে যেতে থাকে পিটার অ্যান্ড্রুজ, টোবিয়াস মুলারের মতো লোকেরা। তারা ববির সঙ্গেই আলোচনা করে, কে লিখছে এসব? ববি নিজেও অবাক হওয়ার ভান করেন, গোপনে ওদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন।”

পিটার

”হুম জানি।” শংকর ঈষৎ কাঁপা গলায় বলল, ”ব্লু মুন প্রিন্টারসের মালিক শাকিল আহমেদকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। ওই কাগজটা ওখান থেকে ছাপা হত। জেরায় সে-ও ববি গঞ্জালভেজের নামই বলেছে। রিকি মিশ্র আর ভিকি মিশ্র নামের ছেলে দুটোও!”

”রূপা ফাদার জেমসনকে খুন করার পর সম্ভবত কোনোভাবে বুঝে ফেলেন গোলমালটা। তাঁর নিজের ভাই রকিকে বিকৃত অত্যাচারের পর খুন যে করেছিলেন ববি, তা জানার পর থেকে রূপা ক্রোধে উন্মাদ হয়ে ওঠেন। ববিকে বাড়ি গিয়ে সোজাসুজি প্রশ্ন করেন। দুয়ার্তে প্রমাদ গোনেন তখন। তিনি ববি গঞ্জালভেজকে ভালোভাবে চেনেন। এত কিছুর পর যে ববি রূপাকে শেষ করে দেবেন, তা উনি বুঝতে পারেন। তাই রূপাকে বাঁচাতে নিজের আশ্রমেই লুকিয়ে রাখেন তিনি। পুলিশের কাছে মিসিং ডায়েরি করে ববি গঞ্জালভেজের কাছে দেখাতে চান, রূপা নিখোঁজ। কিন্তু যেখানে জিমিকে দুয়ার্তের হোমে ববি রেখেই দিয়েছেন, সেখানে তিনি লুকোবেন কী করে? তাই শেষরক্ষা করতে পারেননি।” রুদ্র বলল, ”রূপা খুন হওয়ার পর দুয়ার্তে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। যেকোনোভাবে পুলিশকে জানাতে চাইছিলেন ববি গঞ্জালভেজের কথা। কিন্তু পারছিলেন না। ওদিকে ববি ক্রমশ বুঝতে পারছিলেন, দুয়ার্তে সীমা ছাড়াচ্ছেন। নিজের হাতে তৈরি করা রোবট আর কথা শুনছে না। অন্যদিকে আমি এদিক-ওদিক ভুল রাস্তায় গেলেও হাতড়াতে হাতড়াতে ঠিক ধীরে ধীরে সত্য উন্মোচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। তিনি ঠিক করেন, আমাকে সরিয়ে দিতে হবে।

”তাঁরই নির্দেশে দুয়ার্তে বাধ্য হয়ে আমায় অপহরণ করেন, নিয়ে যান পোন্ডার সেই গেস্ট হাউসে। সেখানে সম্ভবত আমাকে হত্যার পরিকল্পনাই ছিল। কিন্তু দুয়ার্তে নিজের জীবন দিয়ে আমায় বাঁচিয়ে দেন। ইচ্ছে করে নিজের মাথায় আঘাত করেন, যাতে বোঝানো যায়, আমি তাঁকে জখম করে পালিয়েছি।”

”কিন্তু রূপাকে খুন করল কে?” শংকর বলল, ”রিকি আর ভিকি নামের ওই ভাই বা জিমি, কারো ফিঙ্গারপ্রিন্টই রূপার বডিতে পাওয়া প্রিন্টের সঙ্গে ম্যাচ করেনি।”

”সবই যদি আমি বের করে দিই, তবে গোয়া পুলিশ কী করবে? সেটা তোরা বের কর! তবে রূপাকে সাধারণ কেউই খুন করেছে। বাকিদের মতো রাইসিন দিয়ে মারা হয়নি। সেটাই আমায় প্রথম ইঙ্গিত দেয়, যে রূপার খুনি অন্য কেউ।”

প্রিয়ম জিজ্ঞেস করল, ”আচ্ছা, দুয়ার্তে যখন ববির হয়ে এত কাজ করতেন, ওঁকে মারা হল কেন?”

”কারণ, যত দিন যাচ্ছিল, দুয়ার্তে অবাধ্য হয়ে উঠছিলেন। তাঁর সব থেকে বড়ো অবাধ্যতা হল, রূপাকে সত্যটা বলে দেওয়া, লুকিয়ে রাখা। শেষে আমায় ইচ্ছে করে পোন্ডার সেই গেস্ট হাউস থেকে ছেড়ে দেওয়া।” রুদ্র একটা নিশ্বাস ফেলল, ”আমার মনে হয়, দুয়ার্তের বডিতে রিকি ভিকির হাতের ছাপ পাওয়া যাবে।”

”জিমির নয়?”

”নাহ, দুয়ার্তে খুন হলে প্রথমে সবাই জিমিকেই সন্দেহ করবে। ববি গঞ্জালভেজের মতো বুদ্ধিমান মানুষ এতটা কাঁচা কাজ করবেন না।” রুদ্র এবার সামান্য হাসল, ”তবে দুজন না থাকলে আমি এগুলো কিছুই বের করতে পারতাম না। একজন হল দুয়ার্তের অরফ্যানেজের সেবাস্টিয়ান নামের সেই ছোট্ট ছেলেটা। ফাদার জেমসনের হোমে থাকা সাগর নামের তার বন্ধুটাকে যে কত যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিল, সেটা সেবাস্টিয়ানই আমায় বলেছিল। আর দ্বিতীয়জন হল মার্তণ্ড। যদিও সে নিজেও একটু হলেও এই চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল।”

”মার্তণ্ড! কীভাবে?” বিজয় অবাক চোখে তাকাল।

”মার্তণ্ড যে পরিবারের ছেলে, কয়েকশো বছর আগে সেই পরিবার ইনকুইজিশনের ভয়ংকর শিকার হয়েছিল। মার্তণ্ড গাঁওকরের এক পূর্বপুরুষ ভালোবেসেছিলেন এক ইহুদি মেয়েকে। গোকুল গাঁওকর নামের সেই পূর্বপুরুষকে ইনকুইজিশনের সময় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, কিন্তু তাঁর সেই ইহুদি স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় পালিয়ে যান, গোপনে জন্ম দেন সন্তানের। মার্তণ্ড সেই সন্তানেরই বংশধর। সেই রোমহর্ষক কাহিনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম শুনে এসেছে মার্তণ্ডরা। সেখান থেকেই তার মনে জন্ম নেয় হিন্দু, ইহুদি, ক্রিশ্চান, ইসলাম, সব ধর্ম সম্পর্কে জানার আগ্রহ। দুয়ার্তে কাগজ নিয়ে অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন, তিনি মার্তণ্ডকে ইনকুইজিশন নিয়ে লিখতে বলেন ডার্ক হোয়াইট কাগজে।” রুদ্র মার্তণ্ডের দিকে তাকাল, ”ও আমায় অনেক সাহায্য করেছে। ববি গঞ্জালভেজই যে দলের পান্ডা, ও-ই প্রথম তা আমায় জানিয়েছে। শেষে নিজের অতিসাহসে ভর করে চলে গিয়েছিল ববির রেস্তরাঁয়। কিন্তু সেখানে ওর প্রাণ আরেকটু হলে চলে যেত!”

৩৪

মারগাঁও কমিশনারেটে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ চলছে। বাইরে থিকথিক করছে মিডিয়ার ভিড়। বুম আর ক্যামেরা হাতে সাংবাদিকরা উদগ্রীব হয়ে আছেন, কিন্তু পুলিশের নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না।

ডি.জি. নিজে দাঁড়িয়ে থেকে একেকটা টিম তৈরি করে একেকটা কাজের ভার দিচ্ছেন। ববি গঞ্জালভেজের বিরুদ্ধে পাকাপোক্ত চার্জশিট তৈরি করার আগে অনেকগুলো রহস্য সমাধান করতে হবে। এরই মধ্যে হাসপাতাল থেকে খবর এসেছে। পরাগ কামাতের কাঁধের গুলিটা বের করতে পারা গেছে। তার অবস্থা এখন স্থিতিশীল।

শংকর নিজের কেবিনে টেবিলে মুখ গুঁজে চুপচাপ শুয়ে ছিল। রুদ্র গিয়ে ওর মাথায় হাত রাখল, ”শংকর!”

শংকর উত্তর দিল না। একইভাবে শুয়ে রইল।

রুদ্র আবার ডাকল, ”শংকর! আমায় ক্ষমা করে দিস!”

”কী বলছিস তুই! তোর ঋণ আমি এই জীবনে শোধ করতে পারব না। শুধু আমি কেন, যে বাচ্চাগুলো এখনও ওই অত্যাচারের শিকার হত, তাদের সবাইকে বাঁচিয়ে দিলি তুই।” শংকর লাল চোখে তাকাল, ”বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল। মা চলে গেলেন।”

”সে কী!”

”হ্যাঁ। ঘুমের মধ্যেই হার্ট অ্যাটাক। একদিক দিয়ে ভালোই হল। বাবার এই কুৎসিত রূপ তাঁকে জেনে যেতে হল না। এরপর আমিও মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারতাম না। বাবা যেমনই হোক, মা তো তাঁকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন!” শংকর চোখ মুছল, ”চল। বাড়ি যাই। একটু পরেই দিল্লির ফ্লাইট ঢুকবে। বাড়ি থেকে একটু ফ্রেশ হয়ে আসি। এদিককার কাজ মিটিয়ে তোদের সঙ্গেই কলকাতা চলে যাব।”

রুদ্র প্রিয়ম আর শংকর কমিশনারেটের বাইরে বেরিয়ে এল। পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে গাঢ় কমলা রং ধারণ করেছে। রুদ্রর চোখে পড়ল, আনন্দিনী আর ড. জয়েশ পটেল দূরে হেঁটে চলেছেন। একে অন্যের হাত ধরে।

ড. জয়েশ পটেলের ক্ষতবিক্ষত কৈশোরের বীভৎস স্মৃতিকে, আড়ষ্টতাকে, সংকোচকে হারিয়ে দিয়েছে ভালোবাসা।

কমিশনারেট ক্যাম্পাসের বাগানে ফুটে আছে অজস্র ফুল। মার্তণ্ড সেবাস্টিয়ান নামের সেই ছটফটে বাচ্চাটাকে ফুলগুলো চেনাচ্ছে। সেবাস্টিয়ান ছুটোছুটি করছে বাগানে।

দেখতে দেখতে রুদ্র প্রিয়মের হাত জড়িয়ে ধরল।

প্রিয়ম অস্ফুটে বলল, ”যত খারাপ কাজই হোক, মানুষের যত নীচ প্রবৃত্তিই থাকুক, ভালোবাসা আজীবন জিতে যাবে।”

”হ্যাঁ। তা জিতবে। কিন্তু দুর্গম সেই পথে মি: দুয়ার্তের মত পিষে যাবে অনেকে।” রুদ্র একটা লম্বা শ্বাস নিল, ”যে পৃথিবীতে এখনও ফুলের মতো শিশুদের বিকৃতি সহ্য করতে হয়, সেই পৃথিবীকে কি আদৌ সভ্য বলা যায়? শংকর ঠিকই লিখেছিল। গন্তব্য অনেক অনেক দেরি। হয়তো সব ধ্বংস হয়ে যাবে। গড়ে উঠবে নতুন এক সভ্যতা। সেখানে লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ, জাতি বা অন্য কোনো কিছুর বৈষম্যে পুড়ে মরতে হবে না কোনো মানুষকে। একটা শিশুও তার অনাবিল পবিত্র শৈশব থেকে বঞ্চিত হবে না। সেই গন্তব্য সত্যিই এখনও এক সভ্যতা দেরি!”

কথাটা বলে রুদ্র এগিয়ে গেল বাগানের দিকে।

সেবাস্টিয়ানের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে তাকে জড়িয়ে ধরল!

***

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *