২৫
ওষুধ খাওয়ার প্রায় আধ ঘণ্টা পর প্রিয়ম যখন ধীরে ধীরে চোখ খুলল, ঘরে কাউকে দেখতে পেল না। প্রচণ্ড মাথা যন্ত্রণা কমে যাওয়ার পর কেমন একটা ঠান্ডা অনুভূতি হয়, চোখ ভিজে যায় ক্লান্তির অশ্রুতে। প্রিয়ম আস্তে আস্তে ডাকল, ”রুদ্র!”
দ্বিতীয়বার আরও একটু জোরে। তৃতীয়বার বেশ জোরে। কোনো সাড়া নেই। এই মধ্যরাতে রুদ্র গেল কোথায়?
প্রিয়মের চোখ পড়ে নিজের ফোনের ওপর। সেখানে জ্বলজ্বল করছে রুদ্রর ছোট্ট মেসেজ।
”কাল থেকে যে খটকাটা মনের মধ্যে খচখচ করছিল, এখন তা পরিষ্কার, প্রিয়ম! এটা একটা গভীর ষড়যন্ত্র। আমি তোমার স্কুটিটা নিয়ে শংকরের কাছে যাচ্ছি। তুমি রেস্ট করো। পরে কথা হবে।”
প্রিয়ম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রুদ্রকে ও চেনে পনেরো-ষোলো বছর হয়ে গেল। চূড়ান্ত অগোছালো, বাড়ির কাজে অসম্ভব কুঁড়ে মেয়েটা বুদ্ধিদীপ্ত, সাহসী হলেও একটা হঠকারী ভাব এখনও ওর মধ্যে রয়ে গেছে। আগুপিছু না ভেবে কিছু আবেগের বশবর্তী হয়ে দুমদাম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার এই বদভ্যাস যেকোনোদিন ওকে বড়ো কোনো বিপদে ফেলবে। ঘুরতে এসে আগ বাড়িয়ে নিজেকে একটা মার্ডার কেসের মধ্যে জড়ানোতে প্রিয়ম অন্তত কোনো বাহাদুরি দেখতে পায় না।
দূরে পাখির কিচকিচ শব্দে প্রিয়ম বাইরের দিকে তাকাল। সূর্যদেব এখনও দেখা দেননি, কিন্তু গাঢ় কমলা রঙে ক্রমশ রক্তাভ হয়ে উঠছে পূর্বদিকের আকাশ। ঘড়িতে ভোর সাড়ে চারটে। আর একটামাত্র দিন ওরা গোয়ায় থাকবে। অথচ সেভাবে কিছু ঘোরাই হল না। সমুদ্র, ইতিহাস, অ্যাডভেঞ্চার, সব মিলিয়ে-মিশিয়ে কত সুন্দর প্ল্যান ছকে এনেছিল ও।
রুদ্র সব মাটি করে দিল।
প্রিয়ম বিরক্ত মুখে আবার ফোনের দিকে তাকায়। রুদ্র মেসেজটা করেছে তিনটে দশে। থানার কাজ কি মিটেছে?
নাহ, রুদ্রর ফোন বন্ধ। প্রিয়ম একটা লম্বা হাই তুলে বিছানা ছেড়ে ওঠে। বাথরুম যায়। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে বাইরের ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। সমুদ্র থেকে আসা ভোরের হাওয়া শরীর-মনকে জুড়িয়ে দিচ্ছে। গোটা ব্যালকনি জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ‘দ্য ডার্ক হোয়াইট’ কাগজের একেকটা ইস্যু। রুদ্রর অগোছালো স্বভাব এই জীবনে আর যাবে না। প্রিয়ম ঝুঁকে একটার পর একটা কাগজ কুড়োতে যায়।
হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে। প্রিয়ম রিসিভ করে কানে দেয়, ”বলো শংকর।”
”আমি অনেকক্ষণ থেকে ওয়েট করছি, এবার ফিল্ডে বেরিয়ে পড়তে হবে। আরও একটা লিড এসেছে।” শংকরের কেজো গলা শোনা যায়।
”হ্যাঁ। তো?”
”রুদ্র যদি আসতে চায়, ওকে রেডি হয়ে থাকতে বলো, আমি তুলে নিয়ে বেরিয়ে যাব।”
”মানে!” মুহূর্তে প্রিয়ম হতভম্ব, ”ও তো অনেকক্ষণ হল বেরিয়ে গেছে!”
”কী বলছ? এখানে তো আসেনি।”
প্রিয়মের মেরুদণ্ড দিয়ে একটা হিমস্রোত নেমে গেল।
* * *
এক ঘণ্টা কেটে গেছে। পরাগ, বিজয় এবং আরও দুজন অফিসার যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সিসিটিভি ফুটেজ চেক করছিল। রাত তিনটে পনেরো মিনিটে রুদ্রকে স্কুটিতে চেপে এস. পি. বাংলো থেকে বেরোতে দেখা যাচ্ছে। বাংলোর প্রহরী জানিয়েছে, ম্যাডাম ওর দিকে একবার তাকিয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন।
ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে, বাংলো থেকে বেরোনোর পর সামনের রাস্তা দিয়ে স্কুটি চালাচ্ছে রুদ্র। গিয়ে বড়োরাস্তায় উঠছে। যেখান দিয়ে তিন-দিন আগে ভোররাতে মার্তণ্ড ওদের দুজনকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে এসেছিল এখানে।
প্রিয়মের গলার কাছটা দলা পাকিয়ে উঠল।
পরাগ ওর এক কর্মীকে বলল, ”পরের ক্যামেরার স্ক্রিনটা খোলো।”
”স্যার! ওটা দু-দিন হল খারাপ।” আমতা আমতা করল সেই কর্মী।
গলির মুখটায় জমাট বেঁধে রয়েছে অন্ধকার। কমিশনারেট যেতে গেলে রুদ্রকে বাঁদিকে যেতে হবে। এদিকের ফুটেজটাকে সর্বোচ্চ জুম করে বোঝা যাচ্ছে, রুদ্র বাঁদিকেই স্কুটি ঘুরিয়ে বেরিয়ে গেল।
তারপর?
শংকর ঝড়ের গতিতে ঢুকে এল, ”ফোনের লাস্ট লোকেশন জানা গেছে?”
”কাজ চলছে, স্যার।”
শংকর প্রিয়মের দিকে তাকাল, ”আচ্ছা, এমন কি হতে পারে, রুদ্র নিজেই কোথাও গেছে?”
”ওর পক্ষে সেটা অসম্ভব নয়, কিন্তু…!” প্রিয়ম নিজের ফোনের স্ক্রিনটা দেখাল, ”এই মেসেজটা দেখো। ও কোনো কিছুর খোঁজ পেয়েছিল, লিখেছে ষড়যন্ত্র।”
শংকরকে রীতিমতো চিন্তিত দেখাচ্ছিল, ”রূপা নেইলসন মার্ডার হওয়ার পর থেকে রুদ্র গোটা ইনভেস্টিগেশনটায় আমাদের সঙ্গে রয়েছে। ওর কি কোনো বিপদ হল?” ”ইমিডিয়েটলি, ইমিডিয়েটলি ভাগাতোরের সব ফুটেজ চেক করো বিজয়। স্কুটিটাকে ট্রেস করতেই হবে। এক-একটা মিনিটও আমাদের কাছে ক্রুশিয়াল!” শংকর বলল, ”তোমাকে আরেকটা খবর দিই, প্রিয়ম। রুদ্র আমাকে ডার্ক হোয়াইট কাগজের ইমেল আইডিগুলো ট্র্যাক করতে বলেছিল। সেগুলো সবই অ্যাকসেস করা হয়েছে কোনো না কোনো সাইবার কাফে থেকে।”
প্রিয়ম রাগে কোনো উত্তর দিল না। কোথাকার কোন কাগজে কী হচ্ছে, তা শুনে ও কী করবে? রুদ্রর কিছু হলে গোয়ার এই পুলিশদের কিচ্ছু যায় আসবে না।
বিজয় বলল, ”স্যার! আর-একটা খবর আছে।”
”কী?” বিরক্ত মুখে তাকাল শংকর।
”একটা মেয়ে ঘণ্টাখানেক আগে পানাজি থানায় গিয়ে জানিয়েছে যে, তার বান্ধবী রূপা নেইলসন নিরুদ্দেশ। তার কাছে রূপা নাকি একটা ইমেল করেছিল।”
”হোয়াট! কিন্তু রূপা নেইলসনের ইমেল আইডি তো ট্র্যাক করা হয়েছিল।”
”এটা অন্য ইমেল আইডি স্যার। ওটা রূপার ল্যাপটপ বা ফোন থেকে কখনো অ্যাকসেস করা হয়নি।”
”মেয়েটা কি লোকাল?”
”না স্যার। দিল্লির মেয়ে, বিদেশে পড়াশুনো করে। গোয়ায় এসেছে দু-দিন আগে। স্যার, আপনার পারমিশন ছাড়াই আমি মেয়েটাকে এখানে নিয়ে এসেছি।”
”গ্রেট জব, বিজয়! প্লিজ আমার চেম্বারে নিয়ে এসো।”
”আমি কনস্টেবল বীথিকাদিকেও বলছি, স্যার।” বিজয় দ্রুতপদে বেরিয়ে গেল।
আনন্দিনী এল দু-মিনিটের মধ্যেই। বিজয়ের হাতে একটা প্রিন্ট আউট। তাতে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে একটি ইমেল।
আনন্দিনী,
আমি তোকে এই ইমেলটা এখনই পাঠাচ্ছি না। শিডিউল করে রাখছি দশ দিন পর। কারণ, দশ দিন পর আমি কোথায় থাকব, আমি নিজেও জানি না। আমার ফোন, ল্যাপটপ সবকিছুর ওপর নজর রাখা হচ্ছে। আমি একটা সাইবার ক্যাফে থেকে তোকে ইমেল করে রাখছি। দশ দিন পর এই ইমেলটা তোর ইনবক্সে ঢুকবে।
আনন্দিনী, আমি গোয়ায় আসতাম আমার হারিয়ে -যাওয়া পরিবার, মা, ভাইকে খুঁজে বের করতে। আমার বাবার দুঃখগুলো চিৎকার করে মানুষকে জানাতে। তুই এবারে আমাকে কাজের যে দায়িত্ব দিয়েছিলি, সেটাও আমি পালন করছিলাম। কিন্তু আমি ভাবতেও পারিনি, সবকিছু এসে এভাবে মিলে যাবে! আপাতত তুই জেনে রাখ, ফ্রেডি পিটের সাঙ্গোপাঙ্গরা আজও আছে। গোয়াতেই আছে। পরের ইমেলে আরও বিশদে বলব। ভালো থাকিস।
শংকর প্রেরকের জায়গাটায় চোখ বোলাল। না, রূপা নেইলসনের নিজস্ব ইমেল আইডি এটা নয়। এখুনি এটা ট্র্যাক করতে হবে।
”এই ইমেলটা আপনার কাছে কবে এসেছে?”
”গতকাল সন্ধ্যাবেলা।” আনন্দিনী তাকাল, ”আমার বন্ধু রূপা নেইলসনকে ফোনে পাচ্ছি না প্রায় আট দিন ধরে।”
শংকর বলল, ”আপনাকে কী কাজে রূপা হেল্প করছিলেন?”
আনন্দিনী একটু থামল। তারপর গলা নামাল, ”আমি ট্রিনিটি কলেজে সোশিয়োলজি নিয়ে পিএইচ. ডি. করছি। ট্যুরিজমের কুপ্রভাবের ওপর। আমার যে রিসার্চ পেপারটা প্রকাশ পেতে চলেছে, সেটা চাইল্ড সেক্স ট্যুরিজম নিয়ে। ফ্রেডি পিট আমার মূল বিষয়।”
”ফ্রেডি পিট মানে মারগাঁওয়ের সেই পিডোফিল? সে তো মারা গেছে। জেলেই!”
”তার সঙ্গে আরও ত্রিশ-চল্লিশজন ওই একই কাজে জড়িত ছিল। ফ্রেডি মারা গেলেও তারা তো মরেনি। আমার পেপারটা এই ভয়ংকর বিকৃত লোকদের প্রতি আইনের দায়সারা ভাব নিয়ে।”
”রূপা আপনাকে কীভাবে সাহায্য করছিলেন?”
”তেমন কিছু না।” আনন্দিনী ঢকঢক করে জল খেল কিছুটা, ”ওই ফ্রেডি পিটের সমাধির ছবি পাঠানো, পুরোনো দিনের লোকদের সঙ্গে কথা বলা, যদি অন্যদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়। বেশির ভাগই তো বিদেশে পালিয়েছে। তাদের যদি কোনো সন্ধান মেলে!”
”তো সেটা আপনি নিজে না এসে রূপাকে দিয়ে করাচ্ছিলেন কেন?”
আনন্দিনী থমকে গেল। এই প্রশ্নের সত্যিই কোনো জুতসই জবাব হয় না। ও আমতা আমতা করল, ”আসলে আমার রিসার্চ গাইড চাইছিলেন না আমি এখানে আসি! এবারে একরকম জোর করেই!”
”বুঝলাম। আর রূপা নিজে কী নিয়ে কাজ করছিলেন?”
”রূপা নিজে বোটানিস্ট ছিল। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার গাছপালা নিয়ে কাজ করছিল। আর সেটা ছাড়া আরও কারণ ছিল।”
”কী কারণ?”
”ওকে তো অনাথ হিসেবে বিদেশে দত্তক নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ও আসলে অনাথ ছিল না। নিজের পরিবারকে খুঁজছিল ও। তারই সঙ্গে খুঁজছিল এই অবৈধ পাচারের জালকে। আমি এই ইমেলটা পেয়ে একটা সাধারণ ডায়েরি করতে গিয়েছিলাম লোকাল থানায়। কিন্তু কেন সেখান থেকে আমায় এখানে নিয়ে আসা হল, আমি জানি না।” আনন্দিনী কাঁধ ঝাঁকাল।
শংকর এক মুহূর্ত থামল। তারপর বলল, ”আপনার বন্ধু দু-দিন আগে খুন হয়েছেন।”
”কী!” আনন্দিনীর চোখ-মুখ সাদা হয়ে গেল।
”হ্যাঁ। আমরা তদন্ত করছি। কিন্তু আপনি বলুন, নিজের আসল পরিবারকে খোঁজা না হয় বুঝলাম, কিন্তু রূপা ওঁর বাবার কোন দুঃখ সবাইকে জানাতে চাইছিলেন?”
আনন্দিনী কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। ওর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে।
শংকর একটু অধৈর্যভাবে বলল, খুনিকে ধরতে একমাত্র আপনিই আমাদের হেল্প করতে পারেন! এই বাবা মানে কি রূপার জন্মদাতা পিতা?”
আনন্দিনী মাথা নাড়ল, ”না। রূপার পালকপিতা মি. জোনাথন নেইলসন।”
”মি. নেইলসনের আবার কীসের দুঃখ?”
আনন্দিনী ধরা গলায় বলল, ”মি. নেইলসন যে ইহুদি! তাঁরা আগে গোয়াতেই থাকতেন। তাঁদের পরিবারের নানা পূর্বপুরুষকে নাকি বিভিন্ন সময়ে গোয়া ইনকুইজিশনের অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছে। ১৮১২ সালে ইনকুইজিশন বাতিল হওয়ার কয়েক বছর আগে মি. নেইলসনের পরিবার ইয়োরোপে চলে যায়। কিন্তু সেই স্মৃতি এতটাই বীভৎস ছিল, যে তার পরের প্রতিটি প্রজন্মই বার বার গোয়ায় এসেছে। নেইলসনও এসেছেন বহুবার। উনি চেয়েছিলেন, রূপা লিখুক।”
”মি. নেইলসনই কি ফাদার দুয়ার্তের কাছে মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন?” শংকর জানতে চাইল।
”না তো!” আনন্দিনী মাথা নাড়ল, ”রূপার সঙ্গে তো দুয়ার্তের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আমার রিসার্চ গাইড! ড. জয়েশ পটেল।”
২৬
গোকুল ছুটছিল। অন্ধকার নদীর জলে পূর্ণিমার চাঁদের আলো পড়ে চকচক করছিল। আর নদীর চরে পাগলের মতো ছুটছিল ও। পেছনে ধেয়ে আসছে উন্মত্ত ষাঁড়ের দল। তাদের সকলের হাতে জ্বলন্ত মশাল।
যে মশালের আগুন একটু আগেই পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে ওদের বাড়ি। বুকফাটা অনুরোধ, মিনতি, চিৎকার, আর্তনাদেও কাজ হয়নি। কোজাগরী পূর্ণিমার ঝলমলে রাত। ওরা পরিকল্পনা করেই এসেছে। হিন্দু মূর্তি বানানো নিষিদ্ধ করা হলেও কদিন ধরে মোলে গ্রামে সেই কাজেই সবাই ব্যস্ত ছিল। ভূদেব কার্লেকরের ওই পরিণতির পর অনেকেই ইতস্তত করছিল, কিন্তু গোকুল ওদের বুঝিয়েছিল।
”গোয়া থেকে এতদূরে কে আমাদের দেখতে আসছে? যত ভয় পাবে, তত ভয় তোমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবে! আচ্ছা বেশ, কেউ জিজ্ঞেস করলে বোলো, আমিই সবাইকে মূর্তি বানাতে বলেছি!”
কোজাগরী উৎসবের উদ্দীপনায় গোকুলের বুঝতে ভুল হয়েছিল যে, গোয়া থেকে কেউ দেখতে না এলেও টাকা কিংবা ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে নিজেদের চর ওরা সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছে।
ফলে মোলে গ্রামে যখন গোয়ার নৌকো এসে ভিড়ল, দূর থেকে অশনিসংকেতে সবাই কেঁপে উঠল।
ওরা খবর নিয়েই এসেছিল। অন্যদের কিচ্ছু করেনি। সোজা এসে গোকুলের ঘুমন্ত বাবা-মা-র ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছিল। তখনও গোকুল কিছু বুঝতে পারেনি কী হতে চলেছে। বুঝল কয়েক মুহূর্ত পর, যখন একজন সৈন্য নৌকো থেকে বয়ে নিয়ে-আসা প্রকাণ্ড কলসি থেকে গোটা বাড়ির চারপাশে, দেওয়ালে তেল ঢালতে লাগল।
মর্মার্থ হৃদয়ঙ্গম করে গোকুলের বুকের রক্ত হিম হয়ে গেছিল। ও তখন পাগলের মতো সৈন্যদের আটকাতে গেছিল, ”কী করছ! ছেড়ে দাও! ছেড়ে দাও!”
কেউ ওকে গুরুত্ব দেয়নি। শুধু একজন দেশীয় সৈন্য বিশ্রী হেসে কোঙ্কণিতে বলেছিল, ”ভূদেবের পা দুটো কয়লায় পুড়তে দেখে মন ভরেনি? তোর বাপ-মা-কে এবার তেলে পোড়াব। তেলের পোড়ার মজাই আলাদা!”
গোকুলের সব সাহস চুরমার হয়ে গিয়েছিল। সৈন্যটার পা ধরে অস্থির চোখে ও বলে চলেছিল, ”ছেড়ে দাও আমার বাবা-মা-কে। তুমি তো এ দেশের লোক। তুমি কেন এমন করছ!”
দেশীয় সৈন্যটা ওর অনুরোধে কর্ণপাত করেনি। গোয়া শহরে পাকা চাকরি, বাড়ি আর টাকা ওকে অন্ধ করে দিয়েছে। গোকুলকে একটা লাথি মেরে সৈন্যটা নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল।
গোটা বাড়িতে তেল ঢালার পর আগুন দেওয়ার দৃশ্যটা গোকুল নিজে দাঁড়িয়ে দেখতে পারেনি। ওর হাত-পা কাঁপছিল, এই কুড়ি বছরের জীবনে এমন অভিজ্ঞতা তার কোনোদিনও হয়নি। দিগবিদিক ভুলে ও ছুটতে শুরু করেছিল নদীর দিকে।
কী করবে ও? নদীতে ঝাঁপ দেবে? সাঁতার ও ভালোই জানে। কতবার কোলেম গ্রাম সাঁতরে গিয়েছে। কিন্তু ওদের সঙ্গে নৌকো আছে। নৌকোর সঙ্গে কি ও পেরে উঠবে? তাও অন্ধকারে?
গোকুল দ্রুত চিন্তা করছিল। নাহ, নদীতে সাঁতরে ও বেশি দূর পালাতে পারবে না। তার চেয়ে কি জঙ্গলে পালিয়ে যাবে?
তাম্বুরি সুরলা শিব মন্দিরে গিয়ে কাটিয়ে দেবে রাতটা?
শিব মন্দিরের কথা মনে পড়ামাত্র শিরার মুখটা ভেসে উঠল ওর চোখের সামনে। শিরা কি এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে? ওর কাছে কি খবর যায়নি যে সহদেব গাঁওকরের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে? খবর গেলেই বা ও কী করবে, ইহুদি পাড়া থেকে এদিকে আসা এখন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
গোকুল জঙ্গলের পথে ছুটতে যাচ্ছিল, এমন সময় প্রচণ্ড একটা হোঁচট খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সামনে। মাথাটা গিয়ে লাগল একটা গাছে, অন্ধকারেও ও বেশ বুঝতে পারল, গরম রক্ত গড়িয়ে পড়ছে কপাল বেয়ে।
কীসে ঠোক্কর খেল? দেখার আগেই ওর মুখে এসে পড়ল একটা ঘুসি।
”আহ!” যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল গোকুল। আর ঠিক তখনই ওর মুখে এসে পড়ল মশালের আলো।
গোকুল অতিকষ্টে চোখ খুলল। ওরা এত তাড়াতাড়ি এসে পড়ল!
কিন্তু না। ওরা নয়। মশাল হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা মানুষ।
কে? গোকুল অসহ্য ব্যথা নিয়েও চেষ্টা করছিল দেখার।
লোকটা আরও কাছাকাছি আসতে ও চিনতে পারল।
”জোসেফ! তুই!”
গোকুল অবাক হল। ইহুদিপাড়ার জোসেফ ছোটোবেলা থেকে ওর সঙ্গে খেলেছে, ঘুরেছে। সে আজ গোকুলকে মারতে এসেছে?
কেন?
জোসেফ তো এখন এখানে থাকেও না। ওর কীসের রাগ গোকুলের ওপর! গোকুলের হঠাৎ চোখ পড়ল জোসেফের পোশাকের ওপর। জোসেফের পরনে পুরোদস্তুর সেনার পোশাক।
জোসেফ বলল, ”কী রে। হিন্দুর বাচ্চা হয়ে খুব শখ শিরাকে পাওয়ার? জানিস না, শিরা, আমি, আমরা সবাই এখন ক্রিশ্চান?”
গোকুল বলল, ”তুই ভুল বুঝছিস জোসেফ!”
”চুপ কর!” প্রবল ঘৃণায় জোসেফ একদলা থুতু ছুড়ে দিল গোকুলের মুখের ওপর, ”শিরার মতো শয়তান মেয়ে আমি দেখিনি। পরিবারটাই বজ্জাত। পিসি আমার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করছে, আর ভাইঝি হিন্দুর বাচ্চার সঙ্গে শুয়ে বেড়াচ্ছে।”
”জোসেফ!” গোকুল এবার চিৎকার করে উঠল, ”একটাও বাজে কথা তুই শিরার নামে বলবি না।”
”বাবা, এত দরদ?” জোসেফের মুখে একটা বিশ্রী হাসি ফুটে উঠল, মশালটা চেপে ধরল মাটিতে পড়ে কাতড়ানো গোকুলের পায়ে, ”ভালো করে শুনে রাখ। শিরাকে আমি বিয়ে করব।”
”নাহ!” পোড়ার প্রচণ্ড জ্বালার মধ্যেও গোকুল চিৎকার করে উঠল।
জোসেফ হেসে দূরে তাকাল, ”সংকেত দিয়ে দিয়েছি। আমার মশালের আগুন দেখে ওরা এখুনি এসে পড়বে। তুই প্রস্তুত হ। মোলে গ্রামের গাঁওকররা সবাই আজ রাতেই শেষ হবে।”
”তুই—তুই শিরার কোনো ক্ষতি করিস না জোসেফ! আমরা তাম্বুরি সুরলা শিব মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করেছি। শিরা— শিরা আমার স্ত্রী!” গোকুল আরও অনেক কিছু জ্বোরো রুগির মতো বলে যাচ্ছিল, কিন্তু সৈন্যরা ততক্ষণে খুব কাছে এসে পড়েছে।
জোসেফ উল্লাসে নিজের ঠোঁট চাটল। গাঁওকরের বাড়ি পুড়ে সম্পূর্ণ ছাই হয়ে গেছে, তেল আর মানুষ-পোড়া গন্ধে চারপাশ ভরে উঠেছে। এবার শুধু শেষ করতে হবে বংশের প্রদীপটিকে। তাহলেই গোটা মোলে গ্রাম ভয়ের চোটে ক্রিশ্চান হবে। এই কৌশল ওরা প্রতিটা গ্রামেই খাটিয়ে আসছে।
হত্যালীলার সম্মিলিত হল্লায় জোসেফ শুনতে পেল না গোকুলের শেষ কথাগুলো।
২৭
অনেকক্ষণ থেকে চড়া সূর্যের আলো চোখের ওপর পড়ছিল, তা সত্ত্বেও রুদ্র চোখ খুলছিল না। খানিক তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে ঘুমোচ্ছিল। অবশেষে একসময় ধড়মড় করে উঠে বসল। ওর চোখে ক্লান্তি লেগে রয়েছে এখনও। বাইরে প্রচুর গাড়িঘোড়ার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সঙ্গে কোলাহল।
এটা একটা ঘর। অনেকটা হোটেলের ঘরের মতো। লাগোয়া বাথরুম। রুদ্র কিছু না ভেবেই বাথরুমে ঢুকল। ফিরে এসে আবার বিছানায় আধশোয়া হল।
এই ঘরটা কোথায়? এখানে ও কী করে এল?
হাতঘড়িতে সকাল দশটা। চোখ বুজে ভাবার চেষ্টা করছিল রুদ্র। প্রিয়মের খুব মাথা যন্ত্রণা করছিল। ওষুধ আনতে একতলায় আফজলের কাছে গিয়েছিল রুদ্র। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ওষুধের এক্সপায়ারি ডেট। রূপা নেইলসনের ঘরের পাঁউরুটি। রুদ্রর হন্তদন্ত হয়ে স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। মাঝপথে হঠাৎই কী মনে করে স্কুটির অভিমুখ ঘুরিয়ে-দেওয়া গুড রিটার্ন দুয়ার্তে হোমের দিকে।
গোয়া কখনোই ঘুমোয় না। তাই মধ্যরাতেও রুদ্র যখন স্কুটিটাকে দুয়ার্তের আশ্রমের সামনে দাঁড় করিয়েছিল, রাস্তায় আলো ঝলমল করছিল। দূর থেকে গানও ভেসে আসছিল।
তারপর?
তারপর কী হল?
চোখ-মুখ কুঁচকে মনে করতে চেষ্টা করে রুদ্র। গেটের বাইরে থেকে ও দুয়ার্তেকে ফোন করেছিল। একবার রিং হতেই দুয়ার্তে রিসিভ করেছিলেন, কেমন শান্তস্বরে বলেছিলেন, ”আমি জানতাম, তুমি আসবে। দাঁড়াও। আমি গেট খুলতে আসছি।”
গেট খুলল। রুদ্র ভেতরে ঢুকল।
তারপর?
রুদ্রর মাথা যন্ত্রণা করতে শুরু করে। তারপর কী হল, ও কিছুতেই মনে করতে পারছে না! কিছু একটা ছুঁচের মতো ফুটল কি?
ঠিক এই সময় ঘরের দরজাটা সশব্দে খুলে গেল। বাইরে থেকে উজ্জ্বল দিনের আলো এসে ছলকে পড়ল ঘরে। সেই আলো মেখে ঘরে ঢুকলেন ফাদার দুয়ার্তে, ”গুড মর্নিং!”
রুদ্র বিরক্তিতে চুপ করে রইল। এই ঘরে কি গোপনে ক্যামেরা লাগানো আছে?
দুয়ার্তের হাতে একটা প্লেট। তাতে রয়েছে ব্রেড, অমলেট আর কিছু ফল। হাসিমুখে বললেন, ”ব্রেকফাস্টটা খেয়ে নাও।”
রাগে রুদ্র কোনো উত্তর দিল না। ওকে এখানে নিশ্চয়ই ব্রেকফাস্ট খাওয়ানোর জন্য নিয়ে আসা হয়নি।
দুয়ার্তে আবার বললেন, ”রাতে ঘুম হয়েছে?”
”হ্যাঁ।” রুদ্র বলল, ”আপনার ঘুমের ইঞ্জেকশন ভালোই কাজ দিয়েছে।”
”থ্যাঙ্ক ইউ।” সলজ্জ হাসলেন দুয়ার্তে, ”খুব ভালো ওষুধ। শরীরে প্রবেশ করার কুড়ি সেকেন্ডের মধ্যে স্নায়ুগুলো ঘুমিয়ে পড়তে থাকে। মাইকেল তোমাকে না ধরলে তুমি উলটে পড়ে যেতে। সাত-আট ঘণ্টার গাঢ় ঘুম। অথচ শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না!”
”শরীরের ক্ষতি হবে না লাভ, সেটা পরের কথা। বিনা অনুমতিতে কাউকে ইঞ্জেকশন দেওয়া অপরাধ। সেটা আপনি কেন করলেন, জানতে পারি? কেনই বা রূপা নেইলসন নিখোঁজ বলে মিথ্যে নাটক করলেন? রূপা নিখোঁজ এক তারিখ থেকে, এদিকে তাঁর ঘরে চার তারিখে ম্যানুফ্যাকচার হওয়া পাঁউরুটি। পুলিশকে কেন বিভ্রান্ত করলেন এভাবে?” রুদ্র তীক্ষ্নস্বরে বলল।
দুয়ার্তের কণ্ঠস্বর পালটে গেল। ঈষৎ ধরা গলায় বললেন, ”বলব। সবই বলব। শংকর যতই ইনভেস্টিগেশন টিমের কর্তা হোক, এই কেসের আসল মাস্টারমাইন্ড তুমি। তোমাকে দেখে আমার বুদ্ধিমান শুধু নয়, সংবেদনশীলও মনে হয়েছে।”
”সংবেদনশীল বলে ইঞ্জেকশন দিয়ে দিলেন? আর এটা কোথায়? এটা তো আপনার হোম নয়!”
দুয়ার্তে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন, ”এটা পোন্ডা শহরের একটা গেস্ট হাউস। ভয় নেই, আমি তোমার কোনো ক্ষতি করব না। আগে খেয়ে নাও।”
রুদ্রর খুব খিদে পেয়েছিল। বিনা বাক্যবয়ে ও প্লেটটা টেনে নিল। পোন্ডা ভাগাতোর থেকে প্রায় ঘণ্টাখানেক দূরের এক শহর। কাছেপিঠে সমুদ্র নেই, তবে নদী আছে কি? খেতে খেতে রুদ্র গোয়ার মানচিত্রটা মনে করার চেষ্টা করছিল।
দুয়ার্তে বললেন, ”আগে বলো, তুমি কী জানতে চাও?”
রুদ্র কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। শত্রু শিবিরে এসে বেশি উদ্ধত হওয়া বোকামি। দুয়ার্তে কেন ওকে এখানে নিয়ে এসেছেন, সেটা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। ও বলল, ”ডার্ক হোয়াইট কাগজে সেক্স র্যাকেট, শিশুপাচার পিডোফিলিয়া নিয়ে লেখাটা কার?”
”আমি কী করে জানব!” দুয়ার্তে কাঁধ ঝাঁকালেন।
রুদ্র একটা আপেলের টুকরো মুখে পুরে বলল, ”এডিটর নিজেই জানেন না, কোন লেখা কে লিখছেন। সেটা কি হতে পারে?”
”মানে?” দুয়ার্তে যেন চমকে উঠলেন।
”ঠিকই বলছি, মি. দুয়ার্তে দে অলিভেইরা। এডিটরের জায়গায় সবুজ অলিভপাতার ছবি প্রথম থেকেই ভাবাচ্ছিল। কিন্তু আপনার মিডল নেমটা একেবারে মাথায় আসেনি। সেই প্রথম আলাপের সময় একবারই শুনেছিলাম কিনা! কিন্তু তারপর গতকাল রাতে একটার পর একটা সন্দেহের তির যখন আপনার দিকে যাচ্ছিল, তখন দুয়ে দুয়ে চার করতে দেরি হয়নি।” রুদ্র বলল, ”ডার্ক হোয়াইট কাগজের এডিটর হয়ে গোপনে সবাইকে দিয়ে একেকটা বিতর্কিত লেখা লিখে গেছেন। কেন?”
”মানুষকে সত্যিটা জানানোর জন্য।” থেমে থেমে বললেন দুয়ার্তে, ”প্রথম জীবনে মিশনারিজ অফ ডিভিনিটিতে কাজ করতাম। মানবসেবার নামে সেখানে কী হয়, নিজের চোখে দেখেছি। মামুলি অসুখে ভোগা মানুষকে সেখানে গিয়ে অপরিচ্ছন্ন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও বিনা চিকিৎসায় মরে যেতে দেখেছি। এক বছরের দুঃস্থ শিশুকেও পুরোপুরি দান না করে দিতে চাওয়ায় গেট থেকে বের করে দিতে দেখেছি।”
”ড. অরূপেশ চ্যাটার্জির সঙ্গে কি তখনই আলাপ?”
”ওঁর সঙ্গে আলাপ সেভাবে হয়নি। ওঁকে জেনেছি বই পড়ে, দেশ-বিদেশে ওঁর ইন্টারভিউ শুনে। ভীষণভাবে রিলেট করতে পেরেছিলাম বাস্তবের সঙ্গে।”
”সেইজন্যই কি ডার্ক হোয়াইট কাগজ শুরু করেছিলেন?”
দুয়ার্তে এবার হাসলেন, ”তোমায় কে বলল, আমি ডার্ক হোয়াইট কাগজ শুরু করেছি?”
”আর আপনি কথার খেলা খেলবেন না!” বিরক্ত হল রুদ্র, ”আচ্ছা সে ব্যাপারে পরে আসছি। আগে বলুন, রূপাকে সাত দিন ধরে নিজের হোমে লুকিয়ে রাখলেন কেন?”
দুয়ার্তে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ”রূপারই অনুরোধে।”
”মানে?” হকচকিয়ে গেল রুদ্র।
”রূপা এমন তিনজনকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছিল,” দুয়ার্তে যান্ত্রিক কণ্ঠে বললেন, ”যাদের বেঁচে থাকার কোনো যোগ্যতা নেই। বাকিরা রূপাকে খুন করার হুমকি দিচ্ছিল। রূপা খুব ভয়ে ছিল। আমি ওকে আমার কাছে লুকিয়ে রেখে ইচ্ছে করে নিরুদ্দেশের কথা রটিয়ে দিয়েছিলাম।”
”রূপা কাদের খুন করেছিল?”
”তুমি ফ্রেডি পিট কেসের কথা জানো?”
”জানি। কাল রাতেই ‘দ্য ডার্ক হোয়াইট’ কাগজে পড়েছি।”
”কুখ্যাত ফ্রেডি পিট মামলায় অনেকে ধরা পড়েছিল, কিন্তু অধিকাংশই পালিয়ে গিয়েছিল। কেউ বিদেশে, কেউ দেশে। তিনজন গোয়ায় ছিল। অন্য নামে। লা ভাস্কোনিয়া রেস্টুরেন্টের মালিক টোবিয়াস মুলার। সেন্ট মারিয়া হোমের মালিক পিটার অ্যান্ড্রুজ। আর সেন্ট সেবাস্টিয়ান অরফ্যানেজের পাদ্রী ফাদার জেমসন। এরা প্রত্যেকেই ফ্রেডি পিট মামলার আসামি। এত বছর ধরে নাম ভাঁড়িয়ে গোয়াতেই লুকিয়ে ছিল এরা। এদের বয়স হয়েছিল, তবু পিডোফিলিয়ার মতো বিকৃত প্রবৃত্তি যায়নি। এদের সবাইকে রূপা শেষ করেছে।”
”কীভাবে?”
”রাইসিন কী, জানো নিশ্চয়ই।”
”ভয়ংকর এক ধরনের বিষ, ক্যাস্টর অয়েল গাছের বীজে পাওয়া যায়।” বলেই রুদ্র মাথায় হাত দিল, ”রূপা বোটানির ছাত্রী ছিল। শিট! এটা মাথাতেই আসেনি।”
”হুম।”
রুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ”রূপার আসল ভাই রকির ওপর কি পিটার অ্যান্ড্রুজ অত্যাচার করত?”
”হ্যাঁ। টানা চার বছর সেই অত্যাচার সহ্য করার পর কিশোর রকি একদিন পুলিশে জানিয়ে দেওয়ার ভয় দেখালে পিটার রকিকে খুন করে।”
”রূপা সেটা জানল কী করে?”
মি. দুয়ার্তে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন, ”আমি যা জানি, তোমাকে সব বলে দিলাম। এবার তুমি ফিরে যাও। গিয়ে শংকরকে বলো, তদন্ত করতে।”
”এক মিনিট!” রুদ্র বলল, ”আপনি তো আমার প্রশ্নের জবাবই দিলেন না!”
”কোন প্রশ্ন?”
”আপনি রূপাকে নিজের হোমে লুকিয়ে রেখে নিরুদ্দেশের নাটক কেন করছিলেন?’
”বললাম তো, রূপার অনুরোধে! ফাদার জেমসনকে খুনের পর ও ভয় পাচ্ছিল।”
”আপনি এত কিছু জানেন, তাহলে এটাও নিশ্চয়ই জানেন যে, রূপার খুনি কে?”
এই প্রশ্নের উত্তরে দুয়ার্তে একটা অদ্ভুত কাণ্ড করলেন। কথা বলতে বলতে হঠাৎ উঠে গিয়ে দেওয়ালে টাঙানো আয়নায় নিজের মাথা দিয়ে আঘাত করলেন। প্রচণ্ড জোর সেই আঘাত দ্বিতীয়বার করামাত্রই ঝমঝম শব্দে আয়নার কাচ ভেঙে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। দুয়ার্তের কপালের অনেকটা অংশ কেটে গিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল।
গলগল করে বেরোনো তাজা রক্ত ঝরতে দেখে হতভম্ব রুদ্র বিছানা থেকে উঠে দুয়ার্তেকে ধরতে যাচ্ছিল, কিন্তু দুয়ার্তে কিছুটা সরে গেলেন, তর্জনী তুলে বললেন, ”তোমায় যা বলার, প্রায় সবই বলেছি। বাইরে মাইকেল গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। তুমি ফিরে যাও! দেরি কোরো না।”
২৮
প্রাক্তন গ্রামপ্রধান সহদেব গাঁওকরের বাড়িটা এমনভাবে ভস্মীভূত হয়েছিল যে, ভেতরে পুড়ে ছাই-হওয়া পোষা প্রাণীগুলোর সঙ্গে মানুষকে আলাদা করা যাচ্ছিল না। তেল আর মাংস-পোড়া গন্ধ ছাড়ছে চারদিকে। তারই মধ্যে পুড়ে কুচকুচে কালো হয়ে-যাওয়া দেওয়াল ধরে ধরে গ্রামের কয়েকজন যুবক খুঁজছিল লাশগুলোকে। অনেক কষ্টে চারটে লাশ উদ্ধার করা গেল। সেগুলো কোনটা কার, বোঝা অসম্ভব।
তালগোল পাকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে, দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে, কালো রঙের কয়েকটা ঝুলি পড়ে আছে।
উদ্ধারকারী একজন যুবক বলল, ”এই! গাঁওকরের বাড়ি তোরা আগে এসেছিস?”
অন্য আরেকজন উত্তর দিল, ”সহদেব দেশপান্ডে বল। গাঁওকর তো এখন অন্যজন।”
”তুই থাম তো! আমরা গাঁওকর এই দেশপান্ডে বাড়িকেই মানতাম, আর মানব। হ্যাঁ, আমি আগে এসেছি। সহদেব গাঁওকর, তাঁর স্ত্রী, ছেলে গোকুল আর একজন দুর সম্পর্কের আত্মীয়া থাকতেন এখানে। আর একজন ভৃত্য।” তৃতীয় যুবক বলল।
”তাহলে মোট পাঁচজন। কিন্তু এখানে লাশ রয়েছে চারটে।”
প্রথম যুবক বিড়বিড় করল, ”গোকুলকে আমি বনের দিকে ছুটে পালাতে দেখেছিলাম!”
অন্যরা কিছু বলার আগেই পেছন থেকে একটা আর্তনাদ ভেসে এল, ”তার মানে গোকুল বেঁচে আছে?”
ছেলেগুলো পেছনে তাকিয়ে দেখল, শিরা। সঙ্গে ইহুদিপাড়ার সেই খ্যাপাটে জোশুয়াকাকা।
শিরার মুখ চোখ কেঁদে কেঁদে ফুলে উঠেছে, চুলের লম্বা বিনুনি খুলে গিয়ে দুলছে অবিন্যস্তভাবে। সে উদ্ভ্রান্ত চোখে বলল, ”উত্তর দিচ্ছ না কেন! গোকুল বেঁচে আছে তো?”
যুবকরা সকলেই গোকুলের বন্ধুস্থানীয়। শিরাকেও ভালোভাবেই চেনে। একজন মুখ খুলল, ”এখনও বুঝতে পারছি না, শিরা। আমি গোকুলকে পালাতে দেখেছিলাম। কিন্তু তারপর কী হয়েছে জানি না! কয়েকজন খুঁজতে গেছে ওদিকে।”
শিরার রাতজাগা শ্রান্ত চোখ দুটো আবার আশায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ক্লান্ত শরীরটাকে কোনোমতে টেনে নিয়ে গিয়ে ও বসল সহদেব গাঁওকরের বাড়ির বাইরের উঠোনে। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, তবু ওর মনের মধ্যে ধিকিধিকি আলো জ্বলছে।
আশার আলো।
কাল রাতে যখন বাড়িতে খবরটা পৌঁছেছিল, তখন ও অঘোরে ঘুমোচ্ছিল। বোন আহিরা ওকে ডেকে তুলেছিল, ”সহদেব গাঁওকরের বাড়িতে ওরা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে, জানিস!”
”কী!” ঘুম ভেঙে ধড়ফড় করে উঠে বসেছিল শিরা।
”হ্যাঁ। বাড়ির দরজা বন্ধ করে বাইরে থেকে তেল ছড়িয়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে!” আহিরা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ”কাল কোজাগরীতে গোকুলদাদা সবাইকে নিয়ে মূর্তি বানিয়েছিল না! জোসেফ নৌকো করে লোক নিয়ে এসেছে।”
শিরা থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছিল, আহিরার শেষ বাক্যে ও যেন স্থবির হয়ে গেছিল, ”কে! কে নিয়ে এসেছে?”
”ঘরের মধ্যে না বসে বাইরে চল, সব জানতে পারবি!”
ঘড়িতে মধ্যরাত্রি হলে কী হবে, ইহুদি পাড়ায় কাল রাতে সবাই জেগে ছিল। প্রত্যেকে বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় এসে জড়ো হয়েছিল, হাতে মোমবাতি নিয়ে জটলা করছিল। সবার মুখে ছিল উদবেগের ছাপ।
শিরা দেখেছিল, দূরের আকাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। কিন্তু কোথাও কোনো হইচই নেই। সবাই কি ভয়ে চুপ?
একটা ঠান্ডা হিমস্রোত যেন ওর শিরদাঁড়া দিয়ে নীচে নেমে গিয়েছিল।
জোশুয়াকাকা আর পিসি একেবারে সামনেই বসে ছিল। জোশুয়াকাকা বেশ উঁচুস্বরে বলছিল, ”এবার বিশ্বাস হল তো, আমাদের মধ্যে কে এতদিন ধরে বিশ্বাসঘাতকতা করছিল?”
সবাই চুপ ছিল। হঠাৎ আইজ্যাককাকা বাজখাঁই সুরে বলেছিল, ”মানে? তুই কী বলতে চাইছিস জোশুয়া?”
”কী বলতে চাইছি, সবাই বুঝতে পারছে আর তুমি পারছ না?” তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়েছিল জোশুয়াকাকা, ”আশপাশের কোলেম, মঠগ্রামে এখনও কোনো হুজ্জতি নেই। মঠগ্রামের মঠগুলোয় দিব্যি পুজোআচ্ছা, লেখাপড়া চলছে, আমি খবর পেলাম। এটা বুঝতে কি কষ্ট হয় যে, তোমার আর তোমার ছেলের যোগসাজশেই এসব অত্যাচার হচ্ছে আমাদের মোলে গ্রামে?”
শিরা দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়েই দেখতে পেয়েছিল, আইজ্যাককাকার ফরসা গোলগাল মুখ লাল হয়ে উঠছে, ”জোসেফ ইনকুইজিশন কোর্টে চাকরি জুটিয়েছে। ও চেষ্টা করছে আমাদের মতো নিউ ক্রিশ্চানদের নিরাপদে রাখতে, আমাদের যাতে গোয়ার কোর্ট ভুল না বোঝে, সেই চেষ্টা করছে সারাক্ষণ। আর তুই কিনা আমাদেরকেই সন্দেহ করছিস?”
”তুই থাম আইজ্যাক!” ক্যাথারিনপিসি চেঁচিয়ে উঠেছিল, ”আজ পূর্ণিমা, ভুলে যাস না। চাঁদের আলোয় সব্বাই দেখেছে, চার-পাঁচজন সৈন্যের সঙ্গে জোসেফ নামছে। জোসেফই ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে। কোজাগরীতে এখানে মূর্তি বানানো হচ্ছিল, সে খবর তুইই দিয়েছিস!”
”হ্যাঁ দিয়েছি। তো?” আইজ্যাককাকা ঝাঁজিয়ে উঠেছিল।
চুপ করে থাকা জটলার মধ্যে প্রথম মুখ খুলেছিল শান্তশিষ্ট জোনাথনকাকা, ”তুমি এটা কী করে পারলে, আইজ্যাক? সহদেবের মতো ভালো লোক এই তল্লাটে একটাও আছে? আমাদের কত বিপদে-আপদে ও প্রাণ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তোমার মনে নেই? কেন, তোমার ছেলে জোসেফ যখন ছোটো ছিল, অজানা জ্বরে মরো মরো, সহদেবই তো তাড়াহুড়ো করে নৌকো জোগাড় করে গোয়া নিয়ে গিয়ে তাকে বাঁচিয়েছিল। তুমি এসব ভুলে গেলে কী করে!”
”থামো জোনাথনদা! বড়ো যুদ্ধ লড়তে গেলে এমন ছোটোখাটো মায়ায় ভুললে চলে না।”
”যুদ্ধ! কীসের যুদ্ধ?”
”আর কতদিন চোখে ঠুলি বেঁধে বসে থাকবে?” আইজ্যাককাকার মুখের কোনো ব্যত্যয় হয়নি, ”অনেকদিন তো এসব হল। একেই আমরা সন্দেহের তালিকায় রয়েছি, তার ওপর এইসব দেশীয় হিন্দুর সঙ্গে যত ঢলাঢলি করব, তত নিজেরাই নিজেদের বিপদ বাড়াব। তাই সহদেব দেশপান্ডে হোক ভূদেব কার্লেকর, এদেরকে ধরিয়ে দিয়ে আমাদের যেভাবে হোক প্রমাণ করতে হবে, আমরা ক্রিশ্চান!”
”মানে?” বিস্মিত চোখে তাকিয়েছিল পিসি, ”তার মানে ভূদেবকেও জোসেফই…!”
”হ্যাঁ। আমার ছেলে এই পাড়ার সকলের জন্য লড়ছে। এত ছেলে তো রয়েছে, খোদ গোয়া শহরেও কোনো ‘মারানো’কে ওরা ইনকুইজিশন কোর্টে চাকরি দিয়েছে? দেয়নি। আমার ছেলে নিজের যোগ্যতায় সেই চাকরি জুটিয়েছে।” আইজ্যাককাকার গলা থেকে প্রচ্ছন্ন গর্ব ঝরে পড়ছিল।
”হুম। সারাদিন ক্রিশ্চান পাদ্রীদের পা চেটে যাওয়াটাই হল যোগ্যতা!” বিড়বিড় করেছিল জোশুয়াকাকা।
আইজ্যাককাকা জোশুয়াকাকার স্বগতোক্তি শুনতে পায়নি, আপনমনে বলে যাচ্ছিল, ”জোসেফ তো পারত, চাকরিবলে শুধু নিজের পরিবারটুকুকে সুরক্ষিত করতে। ও কিন্তু তা করেনি। ও ভেবেছে আমাদের এই মোলে গ্রামের সব ইহুদিদের কথা। কোথায় তোমরা তাকে বাহবা দেবে, তা না…!”
গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলো স্পষ্টতই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছিল। একদিকে সহদেব গাঁওকরের মতো মানুষের প্রতি অত্যাচার, অন্যদিকে নিজেদের প্রাণরক্ষা। কে না জানে, সবকিছুর শেষে নিজের জীবনটাই সবচেয়ে বেশি দামি? গত কয়েক মাস ধরে সবাই সন্ত্রস্ত অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছে। এদের অধিকাংশেরই স্মৃতিতে রয়েছে পোর্তুগাল বা স্পেনে পূর্বপুরুষদের ওপর অমানুষিক নির্মম অত্যাচার। যে বিপদ এড়াতে এতদূরে এসে নতুন জীবন শুরু করেছিল, আবার কি তারই পুনরাবৃত্তি হবে নাকি?
কবে শেষ হবে এই ভয়াতুর অধ্যায়? কীসে মিলবে পরিত্রাণ? সবাই মনে মনে ভাবছিল, আইজ্যাকই হয়তো ঠিক বলছে! নিজেদের পরিবারকে বাঁচাতে গেলে যেভাবে হোক গোয়ার ক্রিশ্চান পাদরিদের কাছে নিজেদের বিশ্বাসভাজন দেখাতেই হবে।
কিন্তু হঠাৎই নিস্তব্ধতা ভেঙে জোশুয়াকাকা রুক্ষ গলায় বলে উঠেছিল, ”আমাদের এত বোকা পাওনি তুমি, আইজ্যাকদা! হিন্দু কেন, ইহুদিদেরও ধরিয়ে দিয়েছ তোমরাই।”
”কী!” আইজ্যাককাকার মুখ রাগে টকটক করছিল, ”মুখ সামলে কথা বল জোশুয়া!”
”মুখ সামলেই বলছি। রেবেকার বাবার সঙ্গে তোমার ঝগড়ার পরই ওদের ধরে নিয়ে গেল। ওই একই জিনিস হল সোফিয়াদিদির সঙ্গেও। আর গার্সিয়া দে ওরতা মারা যাওয়ার আগের দিন তোমার ছেলে তার বাড়িতে ডিনার করতে গেছিল, আমার কাছে পাকা খবর আছে।” জোশুয়াকাকা একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল, ”কী প্রমাণ, যে তোমার ছেলে তাঁর খাবারে বিষ মিশিয়ে দেয়নি? তোমার ছেলের তো খুব শখ নেতা হওয়ার, গার্সিয়াদাদা বেঁচে থাকলে তো সেটা হত না!”
আইজ্যাককাকার মুখে একটা ভয়ের ছায়া পড়েই আবার মিলিয়ে গিয়েছিল। দ্রুত নিজেকে স্বাভাবিক করে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলেছিল, ”যার জন্য করি চুরি, সে-ই বলে চোর। ওরে পাষণ্ড নরাধম জোশুয়া, তোর কোনোদিনও ভালো হবে না!”
কেমন একটা ঘোরের মধ্যে গত রাতের কথা ভেবে চলেছিল শিরা, চমক ভাঙল জোশুয়াকাকার ডাকে।
”কী রে! শুনছিস?”
শিরা তাকাল। জোশুয়াকাকা কেমন একটা অচেনা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। কাল রাত থেকে শিরার অভিব্যক্তি আর চাহনি অনেকের কাছেই দুর্বোধ্য ঠেকলেও পিসি বোধহয় কিছু অনুমান করতে পেরেছিল। তাই সকাল হতে পাথরের মতো বসে থাকা শিরাকে নিজে থেকেই বলেছিল জোশুয়াকাকার সঙ্গে হিন্দু পাড়ায় আসতে।
শিরা কেমন ভাঙা স্বরে বলল, ”বলো কাকা।”
জোশুয়াকাকা একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর ওকে জড়িয়ে ধরল। ফিসফিস করে বলল, ”জঙ্গলে ঢোকার মুখে গোকুলের দেহ পাওয়া গেছে, শিরা! একজন বলল, জোসেফই নাকি— ”
”নাহ!” কাঁপতে কাঁপতে বন্ধন ছিন্ন করার চেষ্টা করল শিরা। ”এ হতে পারে না। কিছুতেই হতে পারে না। সব মিথ্যা কথা বলছ তুমি! ছাড়ো আমাকে, ছাড়ো!”
জোশুয়াকাকা ছাড়ল না। শিরা বুঝতে পারল, খ্যাপাটে কাকার চোখ দিয়েও দরদর করে অশ্রু ঝরছে। জঙ্গল থেকে খবর নিয়ে আসা ছেলে দুটো ছলছল চোখে তাকাচ্ছে।
বাবার মতো গোকুল নিজেও সবার প্রিয় ছিল।
শিরা প্রাণপণে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। এসব কি সত্যি? না কোনো বিশ্রী দুঃস্বপ্ন? তার গোকুল আর নেই? ওরা—ওরা গোকুলকে মেরে ফেলেছে?
শিরা লাল চোখে আকাশের দিকে তাকায়। ঝকঝকে নীল আকাশ। পাখি উড়ছে। ওদিক দিয়ে একটা বিড়াল ছুটে পালাচ্ছে। দেশপান্ডে বাড়ির দুটো পোষা মুরগি পেছনের খামার থেকে বেরিয়ে এসে কোঁকর কোঁ করছে আর মাটিতে কী সব দানা খুঁটে খাচ্ছে।
এত কিছুর মধ্যে তার গোকুলই শুধু নেই? তা কী করে হয়?
শিরার চোখের সামনে ভাসতে থাকে জঙ্গলের মধ্যে লুকোনো এক মন্দির! মন্দিরের গর্ভগৃহে বসে ওদের কথা। কুড়ি বছরের তরুণ তার শরীরের সব ঘাম মাখিয়ে দিচ্ছে এক ষোড়শীর সর্বাঙ্গে। কিছুটা ভয় আর অনেকটা আনন্দে শিরা তিরতির করে কাঁপছে।
আহ! শিরার পেট থেকে যেন হঠাৎই নাড়িভুঁড়ি সব গুলিয়ে ওপরে উঠে আসতে চাইল, মাথা ঘুরতে লাগল দ্রুত।
জোশুয়াকাকা অদূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল কয়েকটা ছেলের সঙ্গে। গোকুলের শরীরটা নাকি লম্বালম্বি চিরে দু-ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। বীভৎস সেই দৃশ্য।
যতক্ষণে জোশুয়াকাকা ছুটে এল, ততক্ষণে সংজ্ঞাহীন শিরা পড়ে গেছে মাটিতে।
ওর পাশেই দানা খুঁটে খাচ্ছে মুরগিদুটো।
মোলে গ্রামের প্রাক্তন গাঁওকরের পরিবারের একমাত্র জীবিত দুই সদস্য।
২৯
রুদ্র ক্লান্তভাবে স্কুটি চালাচ্ছিল। পোন্ডা থেকে ভাগাতোরে ওকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল একটা গাড়িতে করে, চোখ বেঁধে। মাইকেল নামের লোকটা ভাগাতোরে এসে ওকে একটা কাফেতে নিয়ে গিয়ে যত্ন করে খাইয়েছে, তারপর হাতে তুলে দিয়েছে ওর স্কুটির চাবি আর বন্ধ-থাকা মোবাইল ফোন।
রুদ্রর মাথার মধ্যে প্রশ্ন গিজগিজ করছিল। সেইসব প্রশ্নের সুতোগুলো তালগোল পাকিয়ে এমন জট পাকিয়ে গেছে, মনে হচ্ছে না আর আদৌ খোলা সম্ভব! এমন দিশেহারা অবস্থায় ও আগে কখনো পড়েনি।
দুয়ার্তের এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ কী? ওকে ওভাবে ঘুম পাড়িয়ে সুদূর পোন্ডায় নিয়ে গিয়েছিলেন কেন? গেলেনই যখন, হঠাৎ তড়িঘড়ি ফেরতই বা কেন পাঠালেন? পোন্ডার গেস্ট হাউসের ঠিকানা নিয়েই বা এত গোপনীয়তা কীসের?
এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে দুয়ার্তেই রূপাকে দিয়ে খুনগুলো করিয়েছেন। আচ্ছা, এটা কি সম্ভব যে, দুয়ার্তে নিজে ফ্রেডি পিট মামলার একজন আসামি ছিলেন? রুদ্রর আবার মার্থা অ্যান্ড্রুজের বাড়িতে টাঙানো পুরোনো ছবিটার কথা মনে পড়ে গেল।
বিদ্যুৎচমকের মতো ওর মনে হল, দুয়ার্তে বহু আগে থেকেই খুন-হওয়া টোবিয়াস মুলার আর পিটার অ্যান্ড্রুজকে চিনতেন। দুয়ার্তের সঙ্গেও কি ফ্রেডি পিট মামলার কোনো সম্পর্ক ছিল? রূপা হয়তো প্রথমে দুয়ার্তেকে শুভাকাঙ্ক্ষী ভেবেছিল, পরে আসল ঘটনা জেনে ফেলেছিল। হয়তো প্রথমে রূপাকে ইচ্ছে করে বন্দি রেখে চাপ দেওয়া হচ্ছিল, পরে রূপা নিজের জেদে অনড় থাকায় তাকে খুন করা হয়। সতীশ, আজিজ এরাও কি জড়িত?
আর মার্তণ্ডর কী খবর? ও কি কিছু জানতে পারল? রুদ্র ফোন করতে গিয়ে ব্যর্থ হল। চার্জের অভাবে ফোনটা দেহ রেখেছে।
এখন ঘড়িতে বিকেল চারটে। রোদ ঝলমল করছে। ভারতবর্ষের পশ্চিম উপকূলের শহরগুলোয় রাত আটটা অবধি সূর্যের আলো থাকে। ও কি শংকরের বাড়িতে যাবে? নাকি কমিশনারেটে?
দোনামনা করে ও কমিশনারেটে যাওয়াই স্থির করল।
মারগাঁওয়ে কমিশনারেটে ঢুকতে ঢুকতে রুদ্র মনে মনে হিসেব সাজাচ্ছিল। এতক্ষণ অবধি পাওয়া প্রমাণের সাপেক্ষে দুয়ার্তের অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট বের করতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। রূপা খুনের পেছনে দুয়ার্তের হাত রয়েছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই। কিন্তু খুনের উদ্দেশ্য কী? রূপা যদি সত্যিই দুয়ার্তের নির্দেশে ফাদার জেমসন, টোবিয়াস মুলার আর পিটার অ্যান্ড্রুজকে খুন করে থাকে, ও কি সব ফাঁস করে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছিল? ব্ল্যাকমেইলিং-এর জন্যই কি দুয়ার্তে রূপাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছেন?
শংকরের চেম্বারের কাছাকাছি আসামাত্র প্রিয়মকে দেখতে পেল রুদ্র। চুল উসকোখুসকো, চোখ লাল। ফোনে কী খুটখাট করছিল, ওকে দেখামাত্র ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। ধড়ফড় করে উঠে এল, ”তুমি! কোথায় ছিলে?”
একটু কঠিন পরিস্থিতি হলেই প্রিয়মের উত্তেজিত হয়ে যাওয়ার বদভ্যাসে রুদ্র এখন আর বিরক্ত হয় না। ও প্রিয়মকে শান্ত করতে বলল, ”সব পরে বলব। শংকর কোথায়?”
”ভেতরে। কী অবস্থা আমাদের জানো? তোমার কোনো ট্রেস পাওয়া যাচ্ছে না, মোবাইল ফোন বন্ধ, সব দিকে খোঁজাখুঁজি চলছে!” প্রিয়মের কণ্ঠস্বর থেকে উত্তেজনা ঝরে পড়ছে, ”আমি ভাবলাম, রূপার মার্ডার কেসে তুমি এভাবে ইনভলভ হয়েছ, সেইজন্যই কি…?”
”এত চিন্তা কোরো না। আমি ঠিক আছি।”
”এদিকে কী হয়েছে জানো?”
”পরে শুনছি।” রূপা শংকরের ঘরে ঢুকল। শংকর ওর প্রকাণ্ড টেবিলের উলটোদিকে বসে কী লিখছিল। টেবিলের এপাশে বসে রয়েছে ইনস্পেকটর বিজয় গোমস।
”শংকর!”
”কোথায় ছিলি তুই?” শংকর চমকে মুখ তুলল।
”আমি ঠিক আছি, বাকি কথা পরে হবে। শোন, তুই এখুনি মি. দুয়ার্তেকে অ্যারেস্ট করার ব্যবস্থা কর।”
”মানে?” শংকর উদ্ভ্রান্ত মুখে জিজ্ঞেস করল। অবাক চোখে তাকাল পাশে বসে থাকা ইনস্পেকটর বিজয় গোমসও।
”আমার প্রথম থেকেই সন্দেহ হচ্ছিল। উনি মুখে খালি বলে যাচ্ছিলেন, রূপা নাকি বড়ো বড়ো মিশনারি ফাউন্ডেশনের থেকে থ্রেট পাচ্ছিল, তারাই খুন করেছে। কিন্তু কোনো হুমকিরই কোনো প্রমাণ পাইনি। রূপার ঘরে যে পাঁউরুটির প্যাকেট পড়ে ছিল, তার ম্যানুফ্যাকচারের তারিখটা দেখে মনের কোথাও খচখচ করছিল। রূপা যেদিন নিখোঁজ হয়েছে, রূপার ঘরে পড়ে-থাকা পাঁউরুটি তৈরি হয়েছে তারপরে। তার মানে রূপা নিখোঁজ হয়ইনি। ওই ঘরেই সে আরও সাত দিন ছিল। দুয়ার্তে রূপার নিরুদ্দেশ হওয়ার মিথ্যা নাটক করেছিলেন। পুলিশে নিখোঁজ ডায়েরি করে লুকিয়ে রেখেছিলেন নিজের আশ্রমেই।”
”তা কী করে হয়!” বিজয় গোমস আপত্তি জানাল, ”আমি নিজে রূপার ঘর তখন সার্চ করেছিলাম!’
”এটা কোনো কথা হল?” রুদ্র এরকম ছেলেমানুষি প্রশ্নে একটু বিরক্ত হল, ”পুলিশ গেছে দুয়ার্তেকে জানিয়ে। সে সময় রূপাকে অন্য কোন ঘরে চালান করে দেওয়া হয়েছে, সেটা তো একটা বাচ্চাও বুঝতে পারবে। আর ডার্ক হোয়াইট নামে ওই কাগজটা দুয়ার্তেই চালাতেন। এডিটরের জায়গায় সবুজ অলিভপাতা আসলে দুয়ার্তে দে অলিভেইরার চিহ্ন। দুয়ার্তে আজ সকালে নিজের মুখে আমায় বলেছেন, রূপা তিনজনকে মার্ডার করেছে বলে থ্রেট পাচ্ছিল। কথাবার্তায় অনেকরকম অসংগতি। পিটার অ্যান্ড্রুজ থেকে রূপা খুন, সব ব্যাপারেই উনি কোনো না কোনোভাবে জড়িত। ওঁকে কাস্টডিতে নিতেই হবে, শংকর! তুই ওয়ারেন্ট বের করার ব্যবস্থা কর।” রুদ্র ঝড়ের গতিতে বলে যাচ্ছিল।
শংকর এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার মুখ খুলল, ”তোর সঙ্গে আজ দুয়ার্তের কখন দেখা হয়েছিল?”
”সকাল দশটা-সাড়ে দশটা নাগাদ। পোন্ডার কোনো একটা জায়গায়।”
”সকালবেলা দুয়ার্তে পোন্ডায় ছিলেন?” বিজয় গোমস আবার অবাক চোখে বলল।
”হ্যাঁ।” রুদ্র একটু বিরক্ত হল, ”সেসব ডিটেইল আমি পরে বলছি। আগে ওঁকে অ্যারেস্ট করতে হবে। উনিই মেইন।”
বিজয় শংকরের দিকে তাকাল। শংকর বলল, ”জাস্ট পাঁচ মিনিট আগে গুড রিটার্ন হোম থেকে ফোন এসেছিল। দুয়ার্তে খুন হয়েছেন।”
”কী?” নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না রুদ্র।
”হ্যাঁ। মাথায় ইনজুরি আছে।” শংকর উঠে দাঁড়াল, ”আমরা বেরোচ্ছি। তুই কি যাবি?”
রুদ্রর মাথা কাজ করছিল না। এতক্ষণ অবধি ও মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে, দুয়ার্তেই এই হত্যাকাণ্ডের পান্ডা। তাঁকে হেপাজতে নিলেই একে একে সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে। রূপার নিজের উদ্দেশ্য থেকে রূপার খুনি, সব।
কিন্তু দুয়ার্তে নিজেই খুন হয়ে গেলেন? তাহলে তো ওর চিন্তাসূত্রের গোটা পথটাই ভুল প্রমাণিত হল! এমন অসহায় অবস্থায় ও কখনো পড়েনি।
বিমুঢ় চোখে ও তাকাল, ”না। তোরা যা। আমি বাড়ি যাচ্ছি!”
”পরে এসে তোর কাছ থেকে সব শুনছি। খুব চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলি!” শংকর বেরিয়ে যাচ্ছিল, রুদ্র পিছু ডাকল, ”মার্তণ্ড কোথায়?”
”ওকে মারগাঁও পাঠিয়েছি ইনভেস্টিগেশনে।” শংকর ফিরে তাকাল, ”আর হ্যাঁ। পানাজির সেই ব্লু মুন প্রিন্টারসের মালিক শাকিল আহমেদকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। কথা বের করা হচ্ছে।”
”শাকিল আহমেদকে কাগজ ছাপার খরচ আর সতীশ আজিজের মাসমাইনে দুয়ার্তে পাঠাতেন, তা-ই তো?”
”না। শাকিল আহমেদ দুয়ার্তের ছবি দেখে চিনতেই পারেনি। আমার টিম জেরা চালাচ্ছে। বাই দ্য ওয়ে, পরাগ অফিসেই আছে। ও তোকে আরেকটা আপডেট দেবে। আনন্দিনী বলে রূপার এক বন্ধু মিসিং ডায়েরি করতে এসেছিল। সে গোয়ার বহু পুরোনো একটা পিডোফিল র্যাকেটের ওপর রিসার্চ করছে। রূপা নাকি সেই এভিডেন্স কালেক্ট করার জন্য গোয়ায় এসেছিল!”
রুদ্র শংকরের মুখের কথা কেড়ে নিল, ”ফ্রেডি পিট কেস?”
শংকর অবাক হল, ”তুই কী করে জানলি?”
রুদ্রর মুখে কথা সরছিল না। অস্ফুটে ও বলল, ”আমাকে আজ সকালে দুয়ার্তে ফ্রেডি পিটের কথা বললেন! পোন্ডায়। তারপর মাইকেল এসে আমায় ভাগাতোরে দিয়ে গেল।”
”স্ট্রেঞ্জ! এতদিন শুনতাম, রূপা লিখছে গোঁড়া পাদ্রীদের অত্যাচারের ওপর। এখন আবার অন্য কথা। এনিওয়ে, আমি এসে শুনছি, ওই মাইকেল আর জিমি অনেক কিছু জানে। তুই বাড়ি গিয়ে রেস্ট নে। মার্তণ্ডকে কাজ মিটে গেলে তোর কাছে চলে যেতে বলছি।” শংকর মাথার টুপিটা ঠিক করে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
* * *
রুদ্র আর প্রিয়ম যখন শংকরের বাংলোয় ফিরে এল, তখন ঘড়িতে সন্ধ্যা সাড়ে ছ-টা। ভাগাতোর সমুদ্রসৈকতে অন্যান্য দিনের মতোই সূর্যের আলো ঝলমল করছে। ট্যুরিস্টে ট্যুরিস্টে মুখরিত চারপাশ। গাড়িতে বসে সেই হইহুল্লোড় দেখতে দেখতে প্রিয়ম গম্ভীর মুখে বলল, ”কাল বিকেলে আমাদের কলকাতার ফ্লাইট।”
রুদ্র একটা নিশ্বাস ফেলল। প্রিয়মের স্বভাবটাই এরকম। বিপদের সময় উৎকণ্ঠায় ছটফট করবে, আর যেই দেখবে, রুদ্রর কিছু হয়নি, ঠিকঠাক আছে, অমনি আগের মোডে ফিরে যাবে। ও কথা না বাড়িয়ে বলল, ”ওল্ড গোয়া, ব্যাসিলিকা, সে ক্যাথিড্রাল, চাপোরা ফোর্ট তো দেখা হল। তুমি তো আগুয়াডা ফোর্টও দেখে এসেছ!”
”শুধু এই ক-টা দেখার জন্য অফিসে এত কাণ্ড করে ছুটি নিয়ে গোয়ায় এলাম?” প্রিয়ম যেন কালীপুজোর বাজির মতো দুম করে ফেটে গেল, ”দুধসাগর ফলস, আনজুনা বিচ, ক্যালেন্ডুলা বিচ, আরামবোল বিচ, কোলভা বিচ কিচ্ছু যাওয়া হল?”
”আহা!” রুদ্র প্রিয়মকে শান্ত করতে চাইল, ”সবই তো বিচ, সেই একই সমুদ্র আর বালি। আলাদা তো কিছু নয়। ভাগাতোর বিচ তো দেখেই নিলে!”
প্রিয়ম কটমট করে ওর দিকে তাকাল, ”সব বিচই যদি এক হয়, তাহলে আর গোয়ায় এলাম কেন, ঘরের কাছে দিঘাই তো ছিল!”
রুদ্র আর কথা বাড়াল না। উত্তপ্ত অবস্থায় তর্ক করে লাভ নেই। তা ছাড়া প্রিয়মের রাগ হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অতিমারি, প্রিয়মের প্রজেক্টের চাপ, রুদ্রর সময়ের ঠিকঠিকানা না-থাকা চাকরি, সবকিছু সামলে অনেকদিন বাদে ওরা ঘুরতে বেরিয়েছিল। ঘোরাটা যে তেমন জুতসই হল না, তা রুদ্রও স্বীকার করে, কিন্তু কী আর করা যাবে? বিপদ তো বলে কয়ে আসে না! আর বন্ধুর বিপদে চোখ বুজে থাকাও যায় না।
রুদ্রর মাথা কাজ করছিল না। ওর ষষ্ঠেন্দ্রিয় যেন ওকে জানান দিচ্ছিল, ও কিছু একটা মিস করে যাচ্ছে। কী? কী মিস করছে ও? এর মধ্যে ও বারকয়েক মার্তণ্ডকে ফোন করেছে, কিন্তু ওর ফোন বন্ধ। কী করবে ভেবে না পেয়ে ও পরাগকে ফোন করল, ”ওই আনন্দিনী বলে মেয়েটাকে একবার বাংলোয় নিয়ে আসতে পারবে?”
সারাদিন ঠিকমতো খাওয়া হয়নি। আফজল প্লেট ভরতি কিছু গরম সসেজ আর কোকাম জুস দিয়ে যেতে রুদ্র প্লেটটা নিয়ে ব্যালকনিতে বসে পড়ল। খেতে খেতে ও পর পর ফাইলগুলো দেখছিল। শংকরের নির্দেশে সব ক-টা ফাইল এখানে পাঠানো হয়েছে।
ও একটা খাতায় লিখতে লাগল।
১। টোবিয়াস মুলার— বয়স ৭৫ বছর। ক্যালেন্ডুলা বিচের ওপর নামী রেস্তরাঁ লা ভাস্কোনিয়ার মালিক ছিলেন। রেস্তরাঁর ওপরেই থাকতেন। একা মানুষ। আজ থেকে আট মাস আগে এক শুক্রবার দুপুরে ওঁর অচৈতন্য দেহ উদ্ধার হয়। স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলে দেখা যায়, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা। ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদন্ত্রে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। তারপর শ্বাসকষ্ট শুরু এবং সবশেষে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মৃত্যু।
রুদ্র টোবিয়াস মুলারের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট খুলল। সেখানে সুস্পষ্টভাবে কিছু লেখা নেই। রুদ্র ভ্রূ কুঁচকোল। দুয়ার্তের কথা সত্যি হলে রাইসিনের অস্তিত্ব পোস্টমর্টেমে ধরা পড়বে না। কিন্তু সেক্ষেত্রে রূপাকে টোবিয়াস মুলারের যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ হতে হবে, কিছু খাওয়ানোর জন্য বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। রুদ্র রূপার সুইডিশ পাসপোর্টটা একঝলক দেখল। হ্যাঁ, টোবিয়াস মুলারের হত্যার দিন রূপা ভারতবর্ষেই ছিল।
শংকরের বাবা ববি গঞ্জালেজ বলেছিলেন, মাপুসার এক ক্লাবে তাঁরা একসঙ্গে স্নুকার্স খেলতেন। আরও কিছু কি গোলমাল লাগছে? রুদ্র মাথার রগ দুটো চেপে ধরে কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর ফাইল দেখে আবার লিখতে লাগল।
২। পিটার অ্যান্ড্রুজ—মারগাঁওয়ের সেন্ট মারিয়া অরফ্যানেজের মালিক। গ্রামের পারিবারিক কাপড়ের ব্যাবসা ছেড়ে এসে এখানে অনাথ আশ্রম খোলা। ব্রাইট ফিউচার ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে প্রচুর অনাথ শিশু দত্তক হিসেবে বাইরে পাঠানো। গত বছর ৩০ এপ্রিল কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মৃত্যু।
রুদ্র দ্রুত রূপার পুরোনো পাসপোর্টটা খুলল। হ্যাঁ, গত বছর এপ্রিল-মে দু-মাসই রূপা ভারতে ছিল। রুদ্রর শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুততর হল। জট কি ধীরে ধীরে খুলছে?
৩। ফাদার জেমসন—বয়স ৭৬ বছর। পানাজির সেন্ট সেবাস্টিয়ান হোমের কর্ণধার। দশদিন আগে নিজের হোমে মৃত্যু। ডাক্তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বললেও রাঁধুনি গিট্টু ও হোমের ফান্ড অনুযায়ী কেউ ফাদারকে ব্ল্যাকমেইল করছিল। কী ব্যাপারে ব্ল্যাকমেইল করছিল?
দুয়ার্তের কথাই কি ঠিক? এদের প্রত্যেকেরই মৃত্যু হয়েছে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে। নিজের দপ্তরের ড. আশিস গুপ্তর কথা মনে পড়ে গেল ওর। ড. আশিস গুপ্ত কলকাতা পুলিশের ডাক্তার। তাঁকে এখুনি একবার ফোন করে কিছু বিষয় জানতে হবে।
রুদ্র যখন ড. গুপ্তর সঙ্গে কথা বলছে, অন্য একটা কল ওয়েটিং-এ বিপ বিপ করতে শুরু করল। রুদ্র চোখের সামনে ফোনটা নিয়ে এল। মার্তণ্ড।
দ্রুত ড. আশিসের ফোনটা কেটে রুদ্র অস্থির হয়ে দ্বিতীয় কলটা রিসিভ করল, ”মার্তণ্ড! আমি ঠিক আছি। তুমি বলো, কিছু জানতে পারলে?”