২০
প্রতিদিন দুপুরে বনজঙ্গল পেরিয়ে তাম্বুরি সুরলা মন্দিরে যাওয়াটা শিরার কেমন অভ্যেস হয়ে গেছে। সকাল থেকে পিসির সঙ্গে হাতে হাতে গৃহস্থালি সামলায়। তারপর নদীর দিকে তাকিয়ে জানলায় বসে কিছুক্ষণ ছবি আঁকতে চেষ্টা করে।
কিন্তু গুটিকয়েক আঁকিবুকি ছাড়া কিছুই টানতে পারে না। আনমনা চোখে কিছুক্ষণ বসে থাকে, মনের মধ্যে অনেক দৃশ্যপট ভেসে ওঠে, কিন্তু আঁকতে গেলেই বিষাদ এসে জমা হয়। আর কিছুক্ষণ পরেই সব ছাপিয়ে বাবার মুখটা ভেসে ওঠে।
একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে ও রওনা দেয় জঙ্গলের দিকে।
ভেবে আশ্চর্য হয় শিরা। বাবা যখন বেঁচে ছিলেন, তখন তো কখনো এমন তীব্রভাবে বাবার অভাব ও অনুভব করেনি। বরং একটা চাপা অভিমানই কাজ করেছে সবসময়। সকলের বাবা একসঙ্গে থাকেন, কিন্তু ওদের বাবা থাকেন না, এই দুঃখই জন্ম দিয়েছিল সেই অভিমানবোধের।
কিন্তু বাবা চলে যাওয়ার পর ও উপলব্ধি করছে, বাবা কেন ওদের গোয়া শহরে নিয়ে যাননি। যেকোনো বিপদের আঁচ আগে এসে পড়ে রাজধানীতে। বাবা ঘরপোড়া গোরু, পোর্তুগালের রাজধানী লিসবনে বন্দি দেখে এসেছেন নিজের মা, দুই বোনকে, আপশোসে ছটফট করেছেন, কিন্তু কিচ্ছু করতে পারেননি। পোর্তুগিজ-ভারতের রাজধানী গোয়াতেও যদি তেমনই হয়? যদি সেভাবেই হঠাৎ একদিন ধরে নিয়ে যাওয়া হয় শিরা আহিরা আর ক্যাথারিনপিসিকে? যতই মান্যগণ্য বিশিষ্ট মানুষ হন, এক ক্রিশ্চান গভর্নর তো একবার সগর্বে বলেছিল, ”পৃথিবীর দুটো ভাগ। ক্রিশ্চান আর নন-ক্রিশ্চান!”
আজ বাবা চলে যাওয়ার পর শিরা মর্মে মর্মে অনুভব করে বাবার ভয়টাকে। বাবা নিজে থাকতেন রাজধানীতে। যাতে কোনো বিপদের খোঁজ তিনি আগে পান। আর বোন, মেয়েদের নিরাপদে রাখতেন অনেকটা দূরের এই গ্রামে।
কিন্তু শেষরক্ষা হল কই! ওদের ছবির মতো সাজানো মোলে গ্রাম আস্তে আস্তে যেন প্রেতপুরী হয়ে যাচ্ছে। গোয়া থেকে প্রায়ই একেকটা দল আসছে। তারা ইচ্ছেমতো মন্দিরগুলো ভেঙে ফেলছে। কয়েকটা মন্দির রাতারাতি পালটে গির্জা করে ফেলা হয়েছে। প্রথম প্রথম হিন্দু পাড়ার কেউ কেউ বাধা দিতে গেছিল, তাদের ওপর এমন অত্যাচার করা হয়েছে, আর কেউ সাহস করেনি তারপর থেকে।
সহদেব গাঁওকরের ডান হাত ভূদেব কার্লেকর নিষ্ঠাবান চিৎপাবন ব্রাহ্মণ। সে যেন মোলে গ্রামের অলিখিত রক্ষক ছিল। ডান হাতে লাঠি, মাথায় ফেট্টি, কপালে তিলক। লম্বা চুল নেমে এসেছে ঘাড় অবধি। সগর্বে সে বলত, ”আমরাই ভারতবর্ষের একমাত্র ব্রাহ্মণগোষ্ঠী, যারা পুজোপাঠ করি, আবার অস্ত্রও ধরি!”
গ্রামের এককোণের শিব মন্দিরটায় প্রতিদিন নিয়ম করে পূজার্চনায় বসত ভূদেবকাকা। কতদিন অন্ধকারে কোথাও থেকে আসার সময় শিরাকে বন্য শিয়াল তাড়া করেছে, ভূদেবকাকা বরাভয় দিয়ে পৌঁছে দিয়ে গেছে বাড়িতে। ওদের ইহুদিপাড়ায় একবার খুব সাপের উৎপাত হয়েছিল, ভূদেবকাকা নিজের লাঠি দিয়ে মেরেছিল দু-দুটো সাপ।
শান্তশিষ্ট গ্রামপ্রধান সহদেব গাঁওকর আর তার ছায়াসঙ্গী অসমসাহসী ভূদেবকাকা, এই জুটিকে শুধু মোলে গ্রাম নয়, আশপাশের সব গ্রামই ভালোবাসত।
শিরার চোখ দিয়ে নিজের অজান্তেই অশ্রু ঝরে পড়ে। ওর আশপাশের সব ভালোমানুষ এত কষ্ট পাচ্ছে কেন?
গোয়া থেকে আসা পশুগুলো সব খোঁজখবর নিয়েই এসেছিল। ওরা প্রতিটা গ্রামে কাঁচা টাকা ছড়িয়ে চর বানিয়েছে কাউকে। তারপর কয়েকজনের ওপর লক্ষ্য স্থির করেছে। যারা প্রভাবশালী, যাদের মর্মান্তিক পরিণতিতে শিউরে উঠবে গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলো, তিরতির করে ছড়িয়ে যাবে আতঙ্কের স্রোত। প্রথম দিন এসেই ওরা ভূদেবকাকার হাতে এত্তেলা ধরিয়েছিল। ইনকুইজিশন কোর্টের আদেশ, ভূদেব কার্লেকরকে ক্রিশ্চান হতে হবে।
”মানে? কথা নেই, বার্তা নেই, খামোখা ক্রিশ্চান হতে যাব কেন?” ভূদেবকাকা গর্জে উঠেছিল।
ওরা সেদিনের মতো চলে গিয়েছিল। যাওয়ার সময় দিয়ে গিয়েছিল সাত দিন সময়। ভূদেবকাকা পাত্তাই দেয়নি। বলেছিল, ”আমি চিৎপাবন ব্রাহ্মণ, ভুলে যেয়ো না!”
ওরা ভুলে যায়নি। আবার এসেছিল দশ দিন পর। সন্ধ্যাবেলা। ভূদেবকাকা তখন মহাদেবের আরাধনায় বসেছিল। এক হাতে প্রদীপ, অন্য হাতে ঘণ্টা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে হিড়হিড় করে নামিয়ে আনা হয়েছিল মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে।
তারপর তার পা দুটো বেঁধে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল জ্বলন্ত কয়লার মধ্যে। লম্বা-চওড়া দশাসই চেহারার ভূদেবের সেই নাভিকুণ্ডলী থেকে উঠে আসা ভয়ংকর কান্না আর চিৎকার শুনেছিল গোটা গ্রাম। সেই অবস্থাতেই ভূদেবের ঘরের ভেতর থেকে হিড়হিড় করে টেনে মন্দির প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা হয়েছিল তার বারো বছরের কন্যা শীতলকে। ভূদেবের চোখের সামনে পিঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো করে পৈশাচিক আনন্দে শীতলকে নগ্ন করেছিল ওরা। তারপর তার ওপর চলেছিল জান্তব অত্যাচার।
সবশেষে সংজ্ঞাহীন শীতলকে নিয়ে ওরা চলে গিয়েছিল। নৌকোর ছইয়ের ভেতর বলির ছাগলের মতো হাত-পা মুড়ে ঢুকিয়ে নিয়ে পাড়ি দিয়েছিল গোয়ার দিকে।
শিরা চোখ মুছল। ভূদেবকাকার পা দুটো এখন পুরোপুরি অকেজো হয়ে গেছে। নিজের বাড়ির বাইরে পাতা খাটিয়ায় সে এখন দিনরাত শুয়ে থাকে আর শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে দূরে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল শিরা। গাউনে মুছে নিল চোখের জল।
বাড়ি থেকে বেরোতে যাবে, হঠাৎ পিসি ঢুকে এল, ”তুই প্রতিদিন এই ভরদুপুরে কোথায় যাস বল তো!”
শিরা গুটিয়ে গেল, ”এমনি ঘুরে বেড়াই। এদিক-সেদিক।”
”দিনকাল কেমন তা তো জানিসই!” পিসি একদৃষ্টে ওর দিকে তাকাল, ”তুই—তুই নাকি জঙ্গলের দিকে যাস!”
”না তো! কে বলল তোমায়?”
পিসি শিরার চোখের ভয়ার্ত চাহনি পড়তে পারল কি না কে জানে। কাছে ঘনিয়ে এল, ”শিরা!”
পিসির কণ্ঠে এমন কিছু ছিল, শিরার বুকের ভেতরটা যেন কেমন কেঁপে উঠল।
”জোসেফ বলছিল, তুই গোকুলের সঙ্গে আজকাল একটু বেশিই মিশছিস। দেখ, অন্য সময় হলে আমি কিছু বলতাম না। তুই আর গোকুল ছোটো থেকে একসঙ্গে বড়ো হয়েছিস। গোকুল তোর বড়ো দাদার মতো।”
জোসেফের নামটা শোনামাত্র শিরার মাথার শিরাগুলো দপদপ করতে লাগল। পিসি এখনও জানে না, বাবার জীবনের শেষরাতে গোয়ার বাড়িতে জোসেফ গিয়েছিল। জোশুয়াকাকা পইপই করে বলতে বারণ করেছে। বলেছে, প্রমাণ ছাড়া এসব কথা বললে কেউ বিশ্বাস তো করবেই না, উলটে আইজ্যাককাকা আর জোসেফ আরও হিংস্র হয়ে উঠতে পারে।
পিসি কি ইচ্ছে করেই ‘দাদা’ শব্দটার ওপর একটু বেশি জোর দিয়ে শিরার জীবনে গোকুলের অবস্থানটা বুঝিয়ে দিতে চাইল?
”একেই আমাদের ওপর সবসময় নজর রাখা হচ্ছে। দাদা চলে যাওয়ার পর প্রতিটা দিন প্রাণ হাতে করে কাটাচ্ছি। তার ওপর একজন হিন্দু ছেলের সঙ্গে বেশি মেলামেশা ওদের কানে গেলে কী হবে বুঝতে পারছিস?” পিসি চাপাস্বরে বলল, ”আহিরা প্রতিদিন সকালে গির্জায় যায়, ফাদারের কথামতো ওখানকার ঘরদোর পরিষ্কার করে। বুঝিস না কেন? কাজটা বড়ো কথা নয়, আমরা যে নিয়মিত গির্জায় যাচ্ছি, সেটা দেখানোটাই আসল।”
শিরা চুপ করে রইল।
”তুই এবার থেকে বিকেলবেলায় গির্জায় যাবি। গিয়ে কথাবার্তা বলবি, ফাদার কিছু কাজ করতে বললে হাতে হাতে করে দিবি। বুঝলি? কী রে? হাঁ করে কী ভাবছিস? উত্তর দিচ্ছিস না কেন?” পিসি এবার ধমকে উঠল।
দেরি হয়ে যাচ্ছে। পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢলতে শুরু করবে এখুনি। গোকুল কি মন্দিরে পৌঁছে গেছে? নাকি জঙ্গলের মধ্যে একাকী বয়ে চলা সেই নিভৃত জলপ্রপাতটার পাশে চুপ করে বসে অপেক্ষা করছে শিরার জন্য!
শিরা অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিল, ”উঁ।”
পিসি ওর রকমসকম দেখে বিরক্ত হচ্ছিল, ”উঁ আবার কী?”
”কিছু না। আমি একটু বেরোচ্ছি। ফেরার সময় গির্জা ঘুরে আসব।” শিরা বেরিয়ে যাচ্ছিল, থমকে গেল পিসির ডাকে।
”দাঁড়া।”
পিসি কাছে এগিয়ে এল, ”জোসেফ তোর জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ওর সঙ্গে যা। ও-ই তোকে গির্জায় নিয়ে যাবে।”
”মানে?” শিরা পিসির কথার কোনো মাথামুন্ডু বুঝতে পারল না। জোসেফ গ্রামে এসেছে দিন দুয়েক হল। যত দিন যাচ্ছে, জোসেফের হাবভাব যেন পালটে যাচ্ছে। আগে ঝগড়াটে ছিল, কিন্তু গোয়ায় যাওয়ার পর থেকে চালচলনে একটা হামবড়া ভাব চলে এসেছে। কথায় কথায় সবাইকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, নিজেকে বিশাল কিছু দেখানো। শিরার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সেটা যেন আরও বেড়েছে।
পিসি যেন দম নিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিল, ”দেখ, আমি স্পষ্ট কথা স্পষ্টভাবে বলতে ভালোবাসি। জোসেফ ছেলেটা খুব করিতকর্মা, গোয়ায় গিয়ে ক্রিশ্চানদের মধ্যে ভালো মিশে গেছে। একজন নিউ ক্রিশ্চান হিসেবে এখনকার পরিস্থিতিতে সরকারি কাজ জোটানো মুখের কথা নয়। ও তাও জুটিয়েছে। আমি চাই…।” গলাটা অনর্থক ঝেড়ে একটু পরিষ্কার করে নিল পিসি, ”আমি চাই জোসেফের সঙ্গে তোর বিয়ে দিতে। তাহলে আমাদের আর কোনো ভয় থাকবে না। জোসেফের স্ত্রী হিসেবে তুইও গোয়ায় ক্রিশ্চানদের একেবারে কাছের হয়ে উঠবি।”
শিরা হাঁ হয়ে গেল পিসির কথা শুনে। পিসি এসব কী বলছে! যে ওর বাবার সম্ভাব্য হত্যাকারী, যার পরিবার একের পর এক বিশ্বাসঘাতকতা, প্রবঞ্চনা করে মোলে গ্রামের মানুষগুলোকে শেষ করে দিচ্ছে, ও কিনা তাকে বিয়ে করবে?
আর বিয়ের কথা মনে করলেই ওর চোখের সামনে যার মুখ ভেসে ওঠে, তাকে ছাড়া কাউকে স্বামী হিসেবে মানার কথা ও কল্পনাও করতে পারে না। যত দিন যাচ্ছে, ও যেন আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়ছে গোকুলের সঙ্গে।
বাবা চলে যাওয়ার পর যে প্রচণ্ড অবসাদ গ্রাস করেছিল ওকে, সেই সময়ে ও আঁকড়ে ধরেছিল গোকুলকে। গোকুলের নিজের জীবনের ওপর দিয়েও ভয়ংকর ঝড় যাচ্ছে, তবু সে নিঃশর্তে ওকে আশ্রয় দিয়েছিল। সদ্য তারুণ্যে পা-দেওয়া ছেলে-মেয়ে দুটো অস্থির সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছিল না, একে অন্যের হাতে ভর রেখে বাঁচতে চাইছিল।
সারাদিনের দুঃখ, রাগ, হতাশা দুজনেই জমিয়ে রাখে এই অলস দুপুরের জন্য। তাম্বুরি সুরলা মন্দিরের নির্জন গর্ভগৃহে বসে দুজন দুজনকে উজার করে দেয় সেসব কথা।
যৌবনের নিয়ম মেনে ওদের সম্পর্কেও শরীর এসেছে, কিন্তু ওদের বন্ধন নশ্বর শরীর পেরিয়েও অনেক অনেক বেশি দৃঢ়।
পিসির কথায় ওর চমক ভেঙে গেল।
”আমি জানি, তুই কী ভাবছিস। আইজ্যাক লোকটা ভালো নয়। হ্যাঁ, আমিও মানছি।” পিসি চাপাস্বরে বলল, ”কিন্তু তুই তো আর এখানে থাকবি না, আইজ্যাকের সঙ্গে তোকে থাকতেও হবে না। বুঝলি? জোসেফের তোকে খুব পছন্দ। অনেকবার ঠারেঠোরে আমায় জানিয়েছে।”
শিরা এমনিতে বেশ শান্ত। বিশেষত পিসির সামনে সে সাত চড়ে রা কাড়ে না। কিন্তু এখন সে আর থাকতে পারল না, রীতিমতো ঝাঁজিয়ে উঠল, ”না! আমি জোসেফকে বিয়ে করব না।”
পিসি ওকে এভাবে উত্তেজিত হতে দেখে থমকে গেল, ”কেন? দেখতে-শুনতে ভালো, রোজগার ভালো, স্বজাতি!”
”তো কী হয়েছে?” শিরা তিরিক্ষি স্বরে জবাব দিল, ”আমি— আমি কিছুতেই জোসেফকে বিয়ে করব না!”
পিসি কিছুক্ষণ তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। তারপর কেটে কেটে বলল, ”তবে তুমি কাকে বিয়ে করবে? গোকুলকে?”
২১
রুদ্র প্রিয়ম আর মার্তণ্ড মারগাঁও কমিশনারেটে পৌঁছোল রাত ন-টার সময়ে। শংকর পরাগ, বিজয় এবং আরও কিছু অফিসারের সঙ্গে মিটিং-এ বসেছিল। মার্তণ্ডকে দেখে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল, ”তোমার বিকেল থেকে পাত্তা নেই কেন! সকালেও গায়েব হয়ে গিয়েছিলে। একটা সিরিয়াস ইনভেস্টিগেশন চলছে আর তুমি ইচ্ছেমতো যাচ্ছ-আসছ। এগুলো কী ধরনের কনডাক্ট?”
”স্যরি স্যার!” মার্তণ্ড মাথা নিচু করল।
শংকরের সেই হাসিখুশি মেজাজটা একেবারে উধাও, ”শোনো মার্তণ্ড, তোমায় রেসপনসিবল ভেবে ভুল করেছিলাম। ডিপার্টমেন্টে নতুন ঢুকেছ তো, একটা কথা বলে দিই। পুলিশের চাকরিতে ‘স্যরি’ বলে কিছু হয় না, হয় শুধু শো কজ আর সাসপেনশন। সেটার জন্য তৈরি থাকো।”
মার্তণ্ড নীরবে দাঁড়িয়ে রইল।
শংকর কয়েক মুহূর্ত ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ”ভেতরে এসো।”
রুদ্র বলল, ”শংকর! তোর যদি অসুবিধা না থাকে, মার্তণ্ড যদি আমার সঙ্গে দু-দিন থাকে, হয়তো আমি তোকে একটু হেল্প করতে পারতাম।”
শংকর চুপ করে রইল, তারপর বলল, ”ঠিক আছে।”
রুদ্র মার্তণ্ডকে নিয়ে বাইরের করিডোরে বেরিয়ে এল।
কিছুক্ষণ পর ও যখন একা ফিরে এল, শংকর তখন অন্য একটা কেবিনে ঢুকছে।
”এই রুমে কফি পাঠাতে বলো বিজয়!” শংকর রুদ্রর দিকে তাকাল, ”মান্ডুর বউকে জেরা করা হয়েছে। রূপা-রকির বাবা-মা আর মান্ডুরা থাকত একই বস্তিতে। রূপার বাবা মারা যাওয়ার পর মান্ডুর সঙ্গে রূপার মায়ের একটা অবৈধ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রূপা-রকির সামনে সেই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় সমস্যা হচ্ছিল। ফলে দুজনেই পরামর্শ করে বাচ্চা দুটোকে সরিয়ে দেবে। রূপা-রকির মা ওদের পার্কে ছেড়ে দিয়ে আসে। আর পরে মান্ডু গিয়ে ওদের সেন্ট মারিয়া অরফ্যানেজে জমা দিয়ে দেয়। বলে, রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছে।” শংকর একটানা বলে থামল।
”আর মান্ডুর বউ সব জেনেও চুপ ছিল?”
”ঝগড়া-অশান্তি হয়েছে অনেক। যেমন হয় বস্তিতে। তারপর কী আর করবে, মেনে নিয়েছে বরের পরকীয়া। আর বছর দুয়েকের মধ্যেই রূপা-রকির মা ক্যানসারে মারা যায়। তাই ঝামেলা বাড়েনি, সব ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল।” শংকর বলল, ”ক্রস ভেরিফিকেশন হয়েছে বস্তির বাকি লোকদের থেকে। মান্ডুর বউ ঠিক কথাই বলেছে।”
”তারপর?”
”সেন্ট মারিয়া অরফ্যানেজ সিজ করা হয়েছে। রকি ফার্নান্ডেজ বলে নিজেকে দাবি করা ছেলেটা বলছে, ও কিছু জানে না। ছোটোবেলার কোনো কিছু ওর স্মৃতিতে নেই। রূপা এসে ওকে ‘ভাই’ বলেছে, বাকিরাও ওকে যা বুঝিয়েছে, ও তা-ই বুঝেছে।” শংকর কাঁধ ঝাঁকাল, ”কাস্টডিতে তিন-দিন থাকবে, আজ রাতে আরও ডিটেইলে জেরা করব। অ্যাকাউন্টসে প্রচুর অসংগতি। বিদেশি ওই এজেন্সির সঙ্গে অনেক টাকার আদান প্রদান।”
”ব্রাইট ফিউচার ইন্টারন্যাশনাল?”
”হ্যাঁ। আমার টিম ব্যাঙ্কের সঙ্গে কথা বলে সব খতিয়ে দেখছে।” শংকর তাকাল, ”সম্ভবত রূপা বুঝতে পেরেছিল ওই ম্যানেজার ওর ভাই রকি নয়। হয়তো ও সত্যিটা জানতে চাইছিল। এই শিশুপাচারচক্রের ভেতরে ঢুকতে চাইছিল। তাই ওকে খুন করা হয়েছে।”
”আর মার্থা অ্যান্ড্রুজ?”
”ওঁর সঙ্গেও কথা বলা হয়েছে। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে উনি নামেই মালকিন। সেরকম কিছু জানেন না। পিটার অ্যান্ড্রুজের ছবিও পেয়েছি।” শংকর একটা ফোটোগ্রাফ এগিয়ে দিল।
রুদ্র ছবিটা দেখল। একজন শ্বেতাঙ্গ প্রৌঢ়ের ছবি। মাথায় টাক, গোলগাল চেহারা, নাকের নীচে পুরুষ্টু কাঁচা-পাকা গোঁফ।
শংকর একটা পেন ড্রাইভ দেখাল, ”পরাগ ভিডিয়ো করে এনেছে। দাঁড়া, চালাই।”
রুদ্র চুপ করে ছিল। কফি দিয়ে গিয়েছে। কফির কাপে ও চুমুক দিচ্ছিল চুপচাপ। শংকর ল্যাপটপটা খুলল।
নৈঃশব্দ্য কাটাতে মার্তণ্ড আড়ষ্টস্বরে মুখ খুলল, ”স্যার! রূপা কিন্তু নিয়মিত ক্যাথলিকদের ভুল দিকগুলো নিয়েও ব্লগ লিখতেন। মি. দুয়ার্তে বলছেন, এইজন্য ওকে হুমকিও পেতে হয়েছিল। রূপা সেইজন্য কি কারো চক্ষুশূল হতে পারেন না?”
”সেভাবে কোনো হুমকির খবর তো আসেনি। জানি না, কী বেসিসে ফাদার দুয়ার্তে ওই এক কথা বলে চলেছেন।” শংকর বলল, ”কী রে রুদ্র? কী ভাবছিস?”
রুদ্র চোখ বন্ধ করে কী চিন্তা করছিল। ওর মনের মধ্যে পিঁপড়ের মতো কী যেন কামড়াচ্ছে। সব সুতো জট পাকিয়ে তালগোল হয়ে গেলেও সেখানে যেন একটা ছুঁচ আটকে আছে। শংকরের ডাকে ও তাকাল, ”এমনি। শোন, একটা কাগজ ছাপা হয় পানাজির ব্লু মুন প্রিন্টারসে। দ্য ডার্ক হোয়াইট। কাগজটার অফিস পানাজিতে, যারা সেখানে বসে, তারা বিশেষ কিছু জানে না। কাগজটার পেছনে কারা আছে, খোঁজ নিতে হবে। প্রেসের মালিকের নাম শাকিল আহমেদ।”
”হয়ে যাবে। কিন্তু হঠাৎ খবরের কাগজ নিয়ে পড়লি? এরকম লোকাল কাগজ এদিকে অনেক আছে।”
মার্তণ্ড দ্রুত তাকাল রুদ্রর দিকে।
”রূপার সঙ্গে ওই কাগজের যোগাযোগ থাকলেও থাকতে পারে।” রুদ্র বলল, ”রূপার বডি কোথায় রয়েছে?”
”মর্গে। ওর বাবা-মা আসছেন সুইডেন থেকে। এলে তুলে দেওয়া হবে। ওদিকে বিজয় জানাল, সেন্ট সেবাস্টিয়ান হোমের সেই ফাদার জেমসনের টেবিল থেকে আরও দুটো চিরকুট উদ্ধার হয়েছে।”
”কী চিরকুট?”
”ওই পুরোনো দিনের ডিটেকটিভ গল্পে যেমন থাকত। তোমার পাপের শাস্তি পাওয়ার জন্য প্রস্তুত হও এইসব। রাঁধুনি গিট্টু বলেছে, দুটো চিরকুটই নাকি গত কয়েক মাসে পাওয়া গিয়েছিল হোমের লেটার বক্স থেকে।” শংকর একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল, ”আর ভালো লাগে না। ধুর ধুর। কী করতে পুলিশে জয়েন করলাম। এর চেয়ে কোথাও দশটা-পাঁচটা চাকরি করতাম। মাইনে কম পেতাম, এত ঠাটবাট থাকত না, কিন্তু জীবনে শান্তি থাকত। গানবাজনা করতাম।”
রুদ্র হাসল, ”এত চাপ নিস না। ফাদার জেমসনের কেসটা মেইনলি কে ইনভেস্টিগেট করছে?”
”সুন্দর ত্রিপাঠী। পানাজি থানার আই.সি.।”
”আমার সঙ্গে একবার কথা বলাতে পারবি?”
”না-বলানোর কী আছে? কিন্তু আগে ভিডিয়োটা দেখ।”
”মার্থা অ্যান্ড্রুজের বাড়ি তো মারগাঁওয়ে, না?” রুদ্র জিজ্ঞেস করল।
”হ্যাঁ।”
”মারগাঁওয়েরও কি কোনো ইতিহাস আছে, মার্তণ্ড?”
মার্তণ্ড মুখ খুলল, ”ছেষট্টিটা গ্রাম নিয়ে তৈরি সলসেট, তারই একটা গ্রাম হল মারগাঁও। আগে নাম ছিল মঠগ্রাম। ন-টা মঠ ছিল সেখানে।”
”মঠ?” শংকর ভ্রূ কুঁচকে তাকাল।
”মন্দির, তার সঙ্গে পড়াশুনোর জন্য স্কুল।” মার্তণ্ড বলল, ”পরে সব ভেঙে গুঁড়িয়ে চার্চ বানানো হয়েছে।”
ভিডিয়োটা চলতে শুরু করেছে। মারগাঁও শহর থেকে একটু দূরে সমুদ্র। সেই সমুদ্রসৈকতের ওপর দাঁড়িয়ে-থাকা যে বাড়িটায় ইনস্পেকটর পরাগ ঢুকছেন, তা প্রাসাদ বললেও অত্যুক্তি হয় না। বাইরে চওড়া গেট, দু-পাশে পাথরের সিংহ উবু হয়ে বসে, ভেতরে সার সার সাদা রঙের পেল্লায় থাম, পেঁচিয়ে শ্বেতপাথরের সিঁড়ি উঠে গেছে ভেতরে।
”বাবা! এ তো ভিক্টোরিয়ান বাড়ি দেখছি। গোয়ায় এমন ইংরেজ বাড়ি তো খুব বেশি নেই।” শংকর বিড়বিড় করল।
প্রকাণ্ড ডাইনিং হল। চারদিকে পুরোনো দিনের দামি আসবাব ছড়িয়ে রয়েছে। পরাগ কামাথ গিয়ে বসতে না-বসতেই একজন বৃদ্ধা এসে বসলেন সোফায়। অত্যন্ত কৃশকায়, ক্ষয়াটে গড়ন, বয়স আন্দাজ করা একটু কঠিন, তবে সত্তরের ওপারেই হবে। নিচু গ্রামে ইংরেজিতে কথা বলছিলেন তিনি।
রুদ্র, প্রিয়ম আর শংকর মন দিয়ে শুনছিল। পিটার অ্যান্ড্রুজের আসল বাড়ি পশ্চিমঘাট পর্বতমালার আনমোদ পাহাড়ের একটা গ্রামে। সেই গ্রামে পিটার অ্যান্ড্রুজের পারিবারিক কাপড়ের ব্যাবসা ছিল। পানাজি, মারগাঁও থেকে কাপড় কিনে নিয়ে গিয়ে গ্রামে বিক্রি করা হত। কয়েক বছর পর পিটার অ্যান্ড্রুজ পাকাপাকিভাবে মারগাঁও চলে আসে। সেটা নয়ের দশকের শুরু।
”তখন পিটার অ্যান্ড্রুজের বয়স?” পরাগ ভিডিয়োতে প্রশ্ন করছে।
বৃদ্ধা একটু চিন্তা করে বললেন, ”সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ।”
”পিটার গ্রামের ব্যাবসা ছেড়ে এখানে চলে এসেছিলেন কেন?”
”আমি ঠিক জানি না।” বৃদ্ধা মার্থা অ্যান্ড্রুজ মাথা নাড়লেন, ”তখনও আমাদের বিয়ে হয়নি। তবে শুনেছি, গ্রামের দোকানে শরিকি ঝামেলা হচ্ছিল খুব। পিটার ছোটোবেলাতেই ওর বাবা-মা-কে হারায়। আত্মীয়স্বজনের আচরণে বিরক্ত হয়ে নিজের ভাগ বিক্রি করে দেয়। তারপর সেখানকার পাট চুকিয়ে শহরে এসে নতুন ব্যাবসা আরম্ভ করে।”
”তারপর?”
”তারপর ঈশ্বর সুপ্রসন্ন হন। এখানে ওর দোকান খুব ভালো চলতে থাকে। আমাদের বিয়ে হয়।” আলোকিত হয়ে ওঠে মার্থার মুখ, ”কিন্তু কী জানেন অফিসার, অর্থই তো সব নয়। পিটার বরাবরই দুস্থ বাচ্চাদের নিয়ে কিছু করতে চাইত। ও নিজেও তো অনাথ ছিল, যন্ত্রণাটা বুঝত!”
”অনাথদের যন্ত্রণা বুঝতেন, এদিকে তাদের মোটা ডলারে বাইরে বিক্রি করে দিতেন?” পরাগ কামাথ পুলিশি ঢঙে প্রশ্ন করল।
”স্টপ!” হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল রুদ্র, ”স্টপ!”
”কী হল?” শংকর হাত বাড়িয়ে ভিডিয়োটা পজ করল।
রুদ্র দ্রুত ভিডিয়োটা জুম করল। বলল, ”দেখতে পাচ্ছিস?”
”কী?”
”মার্থা অ্যান্ড্রুজের পেছনে দেওয়ালের পুরোনো ছবিটা?”
শংকর, মার্তণ্ড আর প্রিয়ম ঝুঁকে পড়ে। একটা ফোটোফ্রেম আটকানো রয়েছে দেওয়ালে। সমুদ্রের ধারে চারজন পুরুষের ছবি। মাথা ভরতি চুলেও মুখের ধাঁচের জন্য পিটার অ্যান্ড্রুজকে বুঝতে অসুবিধা হয় না। ঠিক যেমন সহজেই চেনা যায় একেবারে বাঁ পাশে দাঁড়িয়ে-থাকা দুজনকে।
”একজন তো ফাদার দুয়ার্তে!” মার্তণ্ড বলল।
”আরেকজন ববি গঞ্জালভেজ।” অস্ফুটে বলল শংকর, ”আমার বাবা। এ যে মেঘ না চাইতেই জল। বাবা তাহলে কিছু ইনফো হয়তো দিতে পারবেন।”
২২
”রূপা ইজ ডেড? সেটা আপনি আমাকে আগে বললেন না?” ড. জয়েশ পটেল উত্তেজিত মুখে মোবাইলে কথা বলছিলেন, ”আমি তাহলে যেভাবে হোক আনন্দিনীকে আটকাতাম!”
”বলার মতো পরিস্থিতি ছিল না, জয়েশ।”
”এবার ও গিয়ে বন্ধুকে না পেয়ে যদি খোঁজাখুঁজি শুরু করে?”
ওপাশ থেকে উত্তর ভেসে আসার আগেই ড. পটেলের ফোনে আরেকটা কল ঢুকতে লাগল। ড. পটেল দ্রুত প্রথম কলটা কেটে দিয়ে দ্বিতীয়টা রিসিভ করলেন।
”হ্যালো স্যার! শুনতে পাচ্ছেন?” আনন্দিনী খোলা ল্যাপটপের সামনে বসে ফোন স্পিকারে করে কথা বলছিল।
”পাচ্ছি। বলো। রূপার সঙ্গে দেখা হল?”
”না স্যার, ওর ফোন বন্ধ। হয়তো অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত আছে।”
”সেটাই হবে।” ড. পটেল দ্রুত বলে উঠলেন, ”ওর কথা না ভেবে তুমি বরং তোমার কাজে মন দাও। তাড়াতাড়ি সব মিটিয়ে ফিরে এসো।”
”হ্যাঁ স্যার, আমি দু-দিন ধরে কাজ শুরু করে দিয়েছি। গোয়ায় চাইল্ড সেক্স ট্যুরিজম রমরমিয়ে বাড়ছে। এখানে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে অরফ্যানেজ, বিদেশ থেকে ট্যুরিস্টরা ঘুরতে এসে সেখান থেকে ইচ্ছেমতো বাচ্চা নিয়ে কয়েকদিনের জন্য চলে যায়। আবার ফেরত দিয়ে যায়। ফ্রেডি পিটের কেসের পর সরকার সচেতন হলেও এখনও অনেক জায়গাতেই এগুলো চলছে।”
”সেটা শুধু গোয়া কেন আনন্দিনী, জনবহুল দেশগুলোর অধিকাংশ ট্যুরিস্ট স্পটে আজকাল লুকিয়েচুরিয়ে এগুলো চলে। তোমার মুম্বইয়ের সেই কেসটা মনে নেই? সুইটজারল্যান্ডের এক দম্পতি মুম্বইয়ের বস্তি থেকে বাচ্চাদের চকোলেট, জামাকাপড়ের লোভ দেখিয়ে রিসর্টে নিয়ে গিয়ে পর্নোগ্রাফি শুট করাত? সাত বছর এইভাবে ব্যাবসা চালানোর পর তাদের ধরা হয়েছিল। এর আগে তারা নাকি থাইল্যান্ড-শ্রীলঙ্কাতেও একই কাজ করেছে।” ড. পটেল একটু থামলেন, ”কিন্তু পুলিশ গ্রেপ্তার করলেই তো হল না। ভারতের মতো দেশে আইনব্যবস্থা এত মন্থর, সেই ফাঁকফোকরকে কাজে লাগিয়ে তারা স্বদেশে পালায়। তাদের ফিরিয়ে আনতে আবার এক্সট্র্যাডিশন চুক্তি লাগে, সেই দেশও তাদের ছাড়তে চায় না, অনেক ঝামেলা। যা-ই হোক, কিছু যদি না মনে করো, তোমায় একটা কথা বলি।”
”বলুন স্যার।”
”গবেষক আর গোয়েন্দা, দুজনেই সত্যকে খোঁজে। কিন্তু দুজনের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। গবেষকের কাজ হল, দোষটাকে খুঁজে বের করে বিশ্বের সামনে নিয়ে আসা। আর গোয়েন্দার কাজ হল দোষীকে খুঁজে বের করা। তাকে শাস্তি দেওয়া। তুমি কি বুঝতে পারছ, আমি কী বলতে চাইছি? তুমি দোষ খোঁজো, দোষীদের নয়।”
আনন্দিনী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ”ইয়েস স্যার। কিন্তু দোষী যদি দোষ করেও অবলীলায় ঘুরে বেড়ায়, আরও পাঁচজন সেই দেখে সাহস পাবে অন্যায়টা করার। দোষীকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে আইনের লুপহোলগুলোকে দেখানোটা কি গবেষকের কাজ নয়?”
ড. পটেল বললেন, ”আমি তর্কে যাব না। শুধু এটুকু বলব, যারা এইসব কাজ করতে পারে, তারা সব পারে। নিজেকে সাবধানে রেখো।”
”অফ কোর্স, স্যার।”
ফোনটা রেখে আনন্দিনী কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তার মনের মধ্যে তোলপাড় হচ্ছে। গতকাল ও ফ্রেড পিটের সমাধিতে গিয়েছিল। সেখানকার এক বয়স্ক কর্মী ফ্রেডি পিটের কথা মনে করতে পারলেও আর কিছুই সেভাবে বলতে পারেনি। অথচ গুরুকুল অরফ্যামিলির সেই ঘটনায় কেঁপে গিয়েছিল গোটা দেশ। অসহায় বাচ্চাগুলোর ওপরের বছরের পর বছর চলা অত্যাচার ভয়াবহতা প্রায় সব কাগজ জুড়ে বেরোত। সেই সময়ে গোয়া পুলিশ আরও অনেক দুর্নীতি চালানো এন. জি. ও.-কে গ্রেপ্তার করেছিল। কিন্তু সময়ের পলিমাটিতে সবই ফিকে হয়ে যায়। এই একত্রিশ বছরে ইন্টারনেট এসে এই অপরাধীদের আরও সুবিধা করে দিয়েছে। একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী ভার্চুয়াল দুনিয়ায় পিডোফিলরা ঝাঁকে ঝাঁকে বিচরণ করছে।
আনন্দিনী আবার ল্যাপটপের দিকে তাকাল। ফ্রেডি পিটের সময় মোট দশজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে একমাত্র ফ্রেডি পিট মারা গেছে। বাকিরা কেউ জেল খেটে বেরিয়ে এসেছে। কেউ প্রথম থেকেই পলাতক। নানারকম সোর্স খুঁজে ও সবার ডিটেইল জোগাড় করেছে।
এ ছাড়াও তখনকার সি. বি. আই. রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, আরও দশ-পনেরো জন বিদেশি ওই র্যাকেটে যুক্ত ছিল, যাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এতগুলো বিকৃত, অসুস্থ লোক সারা পৃথিবীতে ঘুরছে। কে বলতে পারে, এতগুলো বছরে তারা তাদের লালসা পূরণ করে চলেছে কি না? অপরাধ তো হয় হাজার হাজার, ক-টা ধরা পড়ে?
ফ্রেডি পিট ছাড়া বাকি যে নজন পলাতক, তাদের প্রত্যেকেই পিডোফিল। সাত বছরের জেল শেষে বেরোলেও সে কি পিডোফিলই থাকবে না?
আনন্দিনী চিন্তা করতে করতে আয়ার্ল্যান্ডে একটা ফোন করল।
”হ্যালো ইরফান, কেমন আছ?” ইরফানের সঙ্গে আনন্দিনী সবসময়ে বাংলায় কথা বলে।
”আরে এই তো, সকাল থেকে বৃষ্টি। আর বোলো-না। তুমি কোথায়?”
”আমি ডাবলিনে নেই ইরফান। ইন্ডিয়া এসেছি একটা কাজে।”
”ওহ গ্রেট। আমার জন্য রসগোল্লা আনবে। এসে রুমে দাওয়াত দেবে।”
”কলকাতায় যাইনি গো। আমার রিসার্চের কাজে গোয়া এসেছি।”
”যাহ!” ইরফানের হতাশ গলা শোনা গেল, ”তবে খানিক নোনা বালিই এনো!”
আনন্দিনী হাসল, ”পরের বার রসগোল্লা নিয়ে যাব। আপাতত তোমার কাছে একটা বিষয় জানতে ফোন করেছি।”
”বলো বলো।”
”পিডোফিলিয়া কি কোনোদিনও সারে?”
ইরফান ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি নিয়ে ট্রিনিটি কলেজে গবেষণা করছে। ওর রিসার্চ শেষ হতে মাসকয়েক বাকি, কিন্তু এরই মধ্যে ওর বেশ কিছু ভালো পেপার ছাপা হয়েছে। আনন্দিনীর প্রশ্ন শুনে ও বলল, ”জটিল প্রশ্ন। দেখো, পিডোফিলিয়া তো কোনো শারীরিক রোগ নয়, এটা একটা মানসিক বিকৃতি। শিশুদেরকে ভুলিয়েভালিয়ে তাদের ওপর যৌন অত্যাচার করে পিডোফিলরা প্লেজার পায়। পিডোফিলিয়া সেরেছে এমন কোনো প্রমাণ এখনও অবধি পাওয়া যায়নি, তবে হ্যাঁ, দীর্ঘমেয়াদি কিছু সাইকোলজিক্যাল থেরাপির মাধ্যমে হয়তো এই ইচ্ছাটা মনের মধ্যে ধীরে ধীরে ঘুম পাড়িয়ে রাখা সম্ভব। ওইটুকুই।”
”পিডোফিলদের কি জেলে সেই থেরাপি দেওয়া হয়?”
”ইয়োরোপ-আমেরিকার কোনো কোনো উন্নত দেশের কিছু জেলে কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা আছে, কিন্তু এই জাতীয় বিকৃতিতে সেটা পর্যাপ্ত নয়।”
”আর ভারতে?”
”ধুর! কী যে বলো।” ইরফানের হাসি শোনা গেল, ”বাংলাদেশ-ভারতের মতো দেশে জেলের আরেক নাম নামেই সংশোধনাগার, কাজে নয়। শোনো, ৯৯% কেসে পিডোফিলরা ধরাই পড়ে না, কারণ ভিকটিম হওয়া বাচ্চাটা চুপ করে যায়। কিন্তু তবুও পরিসংখ্যান বলে, সারা বিশ্বে প্রতি মিনিটে সাড়ে সাত লাখ শিশু যৌননির্যাতনের শিকার হয়। সাড়ে সাত লাখ। আর ধরা-পড়া পিডোফিলদের অধিকাংশের বয়স চল্লিশের ওপর আর তারা সন্তানের বাবা। বুঝতে পারছ?”
ফোনটা রেখে আনন্দিনী আবার ল্যাপটপের দিকে তাকাল। ফ্রেডি পিট মারা গেছে। কিন্তু চার্জশিটের বাকিরা? তারা তো এই পৃথিবীর বুকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে, শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছে, আর সুযোগ পেলেই হয়তো কয়েক বছর মাত্র পৃথিবীতে আসা নিষ্পাপ প্রাণগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
আনন্দিনীর মাথায় কেমন যন্ত্রণা শুরু হয়। মনে হয়, ও খেই হারিয়ে ফেলছে। জানলা দিয়ে চোখে পড়ে দূরের সমুদ্রসৈকত। বিচের এত কাছে হোটেল হয়েও এখনও অবধি ওর সমুদ্রে যাওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি।
বিছানা থেকে নেমে খানিক আড়মোড়া ভাঙে ও। বিকেল সাড়ে পাঁচটা। রুমের মিনিবারে দিয়ে-যাওয়া কফি দিয়ে কড়া করে এক কাপ ব্ল্যাক কফি বানিয়ে ব্যালকনিতে আসে।
সমুদ্রের পাড়ে কাতারে কাতারে লোক। কেউ সঙ্গিনীর হাত জড়িয়ে স্নান করছে, কেউ পায়ের পাতা ভিজিয়ে ছবি তুলছে। কেউ আবার একটু দূরত্বে বালির ওপর শুয়ে আছে। সব মিলিয়ে চারদিকে আনন্দ। গোয়া মানেই আনন্দ।
অথচ পরিসংখ্যান বলছে, এই আনন্দনগরীতেই ঘটে চলেছে কতরকম ভয়াবহ ঘটনা।
বিছানায় খোলা থাকা ল্যাপটপে হঠাৎ একটা ইমেল ঢোকার শব্দ হতে আনন্দিনী আনমনে ঘরে আসে। এটা ওর একেবারে কাজের ইমেল আইডি। বিজ্ঞাপনজাতীয় কিছু মেল এখানে আসে না। তবে কে মেল করল?
২৩
প্রিয়ম ঘরে ঢুকে ব্যাগটা খাটের ওপর ছুড়ে দিয়ে বলল, ”মরিস ফোন করেছিল।”
”কী বলল?” রুদ্র উৎসাহী হয়ে উঠল।
”আমার কথা শুনে ও তখুনি গিয়েছিল ওই এন. জি. ও.-র অফিসে। গিয়ে বলেছে, ও আর ওর স্ত্রী নিঃসন্তান, প্রাচ্যের সংস্কৃতি খুব পছন্দ করে। ভারতীয় কোনো শিশুকে দত্তক নিতে চায়।”
”গ্রেট! তারপর?”
”ওরা নামধাম ইমেল আইডি সব লিখে নিয়েছে। বলেছে, যোগাযোগ করা হবে। তখন মরিস বলেছে, আজই ওরা গোয়ায় ঘুরতে আসছে, একটু তাড়াতাড়ি হলে ভালো হত। বেশ কয়েকবার অনুরোধ করার পর বলেছে, গোয়ায় নামার পর হোটেলের নাম-ঠিকানা মেল করতে, তখুনি যোগাযোগ করা হবে।”
”বাহ!” রুদ্র উজ্জ্বল মুখে হাসল, ”তোমার এই মরিস লোকটা তো খুব চালাক-চতুর দেখছি! তার মানে একটা হোটেলের নাম-ঠিকানা পাঠাতে হবে। তারপর সেখানে লোক ফিট করে রাখতে হবে।”
”দাঁড়াও। অত তাড়াহুড়ো করলে তো ওরা সন্দেহ করবে। এখনও তো ওদের উদ্দেশ্য বোঝা যাচ্ছে না।” প্রিয়ম বলল, ”আমি একটা ফ্লাইটের হিসেব করেছি। কাল বেলায় সেটা গোয়া পৌঁছোবে। তুমি শংকরের সঙ্গে কথা বলে হোটেল ঠিক করে রাখো। তারপর মরিসকে ইমেল করতে বলব।”
”ঠিক।” রুদ্র আরও কী বলতে যাচ্ছিল, ঘরের ইন্টারকম টেলিফোনটা বেজে উঠল।
প্রিয়ম ফোনটা ধরে কিছুক্ষণ কথা বলল। তারপর রুদ্রর দিকে তাকাল, ”তোমার তো ডিউটি দেখছি শেষই হচ্ছে না! ওই সেবাস্টিয়ান বলে বাচ্চাটাকে নীচে নিয়ে এসেছে।”
”এত রাতে?” রুদ্র বিস্মিত হল, ”দুয়ার্তে সন্দেহ করতে পারেন তো!”
”পরাগ কামাথ এনেছে। বলল, এই সময় ছেলেটার আঁকার ক্লাস থাকে। সেই আঁকতে যাওয়ার সময়েই…!”
পাঁচ-মিনিট পর রুদ্র যখন নীচে গেল, সেবাস্টিয়ান তখন ঘুরে ঘুরে এস পি. বাংলোর ড্রয়িং রুমের দেওয়ালে লাগানো ছবিগুলো দেখছে।
”কোন আঁকাটা ভালো লাগছে তোমার?” রুদ্র এগিয়ে এল।
”এইটা!” একটা ছুটন্ত খরগোশের ছবির দিকে আঙুল তুলল সেবাস্টিয়ান, ”একটা খরগোশ ছিল, জানো! মরে গেছে।”
কিছু খাবার আনার নির্দেশ দিয়ে রুদ্র সেবাস্টিয়ানকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছিল, ”তা-ই? খরগোশটা কি তোমার ঘরেই থাকত?”
”না না!” দ্রুত মাথা নাড়ল সেবাস্টিয়ান, ”ও তো সাগরের কাছে থাকত।”
”সাগর বুঝি তোমার বন্ধু?”
”হ্যাঁ।”
”তোমার ঘরেই থাকে?”
”না না। ও তো আমার হোমে থাকত। এখন আর থাকে না।”
”তোমার হোম? মানে মি. দুয়ার্তের গুড রিটার্ন হোম?”
সেবাস্টিয়ান হলদে দাঁতগুলো বের করে উজ্জ্বল হাসল, ”না। সেন্ট সেবাস্টিয়ান হোম। আমার নামে যখন হোম, সেটা তো আমারই হোম হল, তা-ই না? ওখানে আমার কত বন্ধু আছে, জানো!”
রুদ্র বিস্মিত চোখে প্রিয়মের দিকে তাকাল। প্রিয়ম বলল, ”সেন্ট সেবাস্টিয়ান হোম মানে সেই মারা যাওয়া ফাদার জেমসনের আশ্রম? সেই হোমের সঙ্গে দুয়ার্তের গুড রিটার্ন হোমের কী সম্পর্ক?”
রুদ্র আবার সেবাস্টিয়ানের দিকে তাকাল, ”তোমার সেই বন্ধু সাগর কোথায় গেল?”
* * *
মার্তণ্ড ক্লান্ত পায়ে রেস্তরাঁয় ঢুকল। প্রচণ্ড জোরে খিদে পেয়েছে ওর। এটা একটা পুরোদস্তুর পোর্তুগিজ রেস্তরাঁ। আয়তনে খুব বড়ো না হলেও দেওয়ালে নানারকম ইয়োরোপীয় আর্টের ছবি, সুন্দর নরম আলো গোটা রেস্তরাঁটাকে স্নিগ্ধ ওমে ভিজিয়ে দিচ্ছে। মার্তণ্ড গিয়ে একটা ফাঁকা টেবিলে বসামাত্র ওয়েটার এসে টেবিলে মেনু কার্ড রাখল, ”গুড ইভনিং, স্যার!”
মার্তণ্ড মেনু কার্ডে চোখ রাখল, ”ক্যালডো ভার্ডে স্যুপ একটা, দুটো ফ্রান্সেসিনা স্যান্ডউইচ আর একটা চিকেন পিরি পিরি। একটু তাড়াতাড়ি দেবেন।”
”স্যরি স্যার!” ওয়েটারকে অপ্রস্তুত দেখাল, ”পোর্তুগিজ ডিশ তো এখন হবে না!”
”সে কী!” মার্তণ্ড বিরক্ত হল, ”পোর্তুগিজ রেস্তরাঁ আর পোর্তুগিজ ডিশ হবে না?”
”না স্যার।পোর্তুগিজ ডিশ শুধু লাঞ্চের সময় পাওয়া যায়। আপনি মোগলাই ট্রাই করতে পারেন। আমাদের মোগলাই ডিশ খুব পপুলার।”
হতাশ মুখে এক প্লেট বিরিয়ানি অর্ডার দিল মার্তণ্ড। পশ্চিম আকাশে এখনও কমলা ছটা। পাশেই সমুদ্র, নোনা হাওয়া এসে ওর সারাদিনের ক্লান্তি যেন ধুইয়ে দিচ্ছে। মার্তণ্ডর ভীষণ খিদে পেয়েছে, কিন্তু এখানকার বিরিয়ানি কি ভালো হবে?
মনে কোনো প্রশ্ন এলেই তা দ্রুত ইন্টারনেটে সার্চ করা ওর ইদানীং স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই পোর্তুগিজ রেস্তরাঁর রেটিং কেমন?
২৪
How many roads must a man walk down
Before you call him a man?
How many seas must a white dove sail
Before she sleeps in the sand?
শংকরের একতলার ঘর থেকে এতক্ষণ গান ভেসে আসছিল। ডিনার শেষে নিজের ঘরে গিয়ে শংকর খোলা গলায় বব ডিলানের বিখ্যাত Blowing in the wind গাইছিল। সঙ্গে বাজাচ্ছিল গিটার। রুদ্র দোতলা থেকে মন দিয়ে গানটা শুনছিল। এস. পি. বাংলোর কর্মচারীরা নিশ্চয়ই এমন গাইয়ে সাহেব পেয়ে খুশি।
এখন গান থেমে গেছে। মিনিট দশেক আগে বাংলোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটা স্টার্ট দিয়েছে। ড্রাইভার আবেল শংকরকে নিয়ে আবার কমিশনারেটে চলে গেছে। আজ সারারাত সেন্ট মারিয়া অরফ্যানেজের ম্যানেজার রকি মহাবংশীকে জেরা চলবে।
রুদ্রর ট্রেনিং-এর দিনগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল। সেখানে এভাবেই অনেক রাত অবধি শংকর গাইত, ওরা শুনত, কখনো কখনো একসঙ্গে গলা মেলাত।
ছেলেটার এলেম আছে। মাথার ওপর দু-দুটো আনসলভড কেস নিয়েও রিল্যাক্স থাকার চেষ্টা করছে। রুদ্র একটা লম্বা শ্বাস ফেলল। সেবাস্টিয়ান বলে বাচ্চাটাকে পরাগ যখন এনেছিল, তখন শংকর ফেরেনি। রুদ্র কি এখনই শংকরকে কিছু ঘটনা জানাবে? না, পরক্ষণেই ও মাথা নাড়ল। আগে ওকে ভাবতে হবে। অনেক কিছু। রুদ্র ঘড়ির দিকে তাকাল।
মার্তণ্ড এখনও ফোন করেনি। ওকে দিয়ে কি আদৌ কিছু কাজ হবে?
রুদ্র আবার ভাবছিল। শংকরের জীবনটা সত্যিই অন্যরকম। বাবার অংশটা পুরো শূন্য।
রুদ্র এখানে আসার আগে একবার ফোনে জানতে চেয়েছিল, ”তোকে গোয়ায় প্রথম দেখে তোর বাবার কী প্রতিক্রিয়া ছিল? খুশি হননি?”
”হ্যাঁ, খুশি হয়েছিলেন। বহু পুরোনো কোন প্রতিবেশীকে অনেকদিন পর দেখলে মানুষ যেমন খুশি হন, তেমন। বলেছিলেন, ফাঁকা থাকলে মাঝে মাঝে আসতে পারো বাড়িতে। We’ll have good wine together.’’ শংকর বলেছিল।
”আর তোর মায়ের ব্যাপারে কিছু জানতে চাননি?” রুদ্র একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করেছিল।
”ওই দু-এক কথা। আমিই বরং যেচে যেচে বলেছিলাম।” শংকর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল, ”বাবার এই পক্ষের দুই ছেলে-মেয়ে। মেয়ে পানাজিতে নাকি একটা ক্যাসিনো চালায়। ছেলে প্যারিসের এক ‘বারে’ গান করে। আমার সঙ্গে আলাপ হয়নি, বাবাই গর্ব করে বলেছেন। ওদের জীবনযাত্রা খুবই অন্যরকম। এখানকার গোয়ানিজদের মতো। আমার মা তো আমাকে ভেতো বাঙালির মতোই মানুষ করেছেন, এতটা আধুনিক সত্যিই হয়তো হতে পারিনি।”
”আচ্ছা, তোর বাবা কলকাতা ছেড়ে হঠাৎ গোয়া চলে গিয়েছিলেন কেন?”
”গোয়ায় বাবার একটা বড়ো বন্ধুবৃত্ত ছিল। মাঝে মাঝেই যেতেন। হয়তো সেখানেই নতুন প্রেম হয়। আমি ঠিক জানি না। আমার সাড়ে তিন বছর বয়সে এসে ডিভোর্সে সই করে পাকাপাকি চলে যান। কিন্তু বাপ-ছেলেতে কি ডিভোর্স হয়? একটু বাবার স্নেহ পেতে খুব ইচ্ছে করে, সেইজন্য বার বার মনে হয়, ছুটে যাই!” বলতে বলতে ফোনে শংকরের গলা বুজে এসেছিল।
সমুদ্রের খুব কাছে রাত কাটানোর একটা আলাদা মাদকতা আছে। অন্ধকারে দোতলার বারান্দায় বসলে হু হু করে নোনা বাতাস ভেসে আসে। দূরের নারকেল গাছগুলো অল্প অল্প দুলতে থাকে। আরও দূরের ঘন নীল আকাশ যেখানে মিশে যায় সমুদ্রের সঙ্গে, সেদিকে তাকালে চোখে কেমন ধাঁধা লেগে যেতে থাকে।
সরকারি এই বাংলো সমুদ্রের খুব কাছে না হলেও দোতলার এই ব্যালকনির একটা জায়গা থেকে গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে দেখা যায় সমুদ্র। রুদ্র ঠিক সেই জায়গাতেই চেয়ার পেতে বসে পড়ছিল ‘দ্য ডার্ক হোয়াইট’-এর ইস্যুগুলো। বাবুর্চি আফজলকে দিয়ে ও একটা বড়ো কোকাম ফলের ক্যান আনিয়েছে। সেটা হালকা ঠান্ডা জলে মিশিয়ে নিয়েছে। প্রথমেই ফোন করেছিল শংকরের বাবাকে। কিন্তু উনি কি আছেন? না, এর মধ্যেই প্যারিস বেরিয়ে গেছেন?
না, ববি গঞ্জালভেজ গোয়াতেই ছিলেন। ফোনে রুদ্রর প্রশ্ন শুনে উত্তর দিয়েছিলেন, ”কতদিন আগেকার ছবি বলো তো?”
”তা প্রায় বছর কুড়ি তো হবেই!”
”হুম। মনে পড়েছে। মারগাঁওয়ে সমুদ্রের ধারে একটা ফেস্টিভ্যাল চলছিল, সেখানেই গিয়েছিলাম। দুয়ার্তের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তার সঙ্গে তার এক বন্ধুও ছিল। ওই সময়েই তোলা।”
রুদ্র নিভে-যাওয়া স্বরে বলল, ”আপনি পিটার অ্যান্ড্রুজকে চিনতেন না?”
”না তো!” ববি গঞ্জালেজ হেসেছিলেন, ”তখন তো কথায় কথায় ছবি তোলা যেত না। রিল ক্যামেরায় গোনাগুনতি ফোটোগ্রাফ, তাই একসঙ্গে কেউ হয়তো তুলে দিয়েছিল, আজ আর মনে নেই।”
রুদ্র হতাশ হয়ে ফোন রেখে দিয়েছিল। তারপর কী মনে হতে রিং করেছিল মার্তণ্ডকে। ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পর গত কয়েক বছরের গোয়ার সব মার্ডার কেস সামারি নিয়ে বসেছিল। তারপর এখন দুয়ার্তের কাগজের একেকটা কিস্তি পড়ছে।
‘দ্য ডার্ক হোয়াইট’ কাগজের কপিগুলো যত দ্রুত ও শেষ করছিল, ততই দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিল। সঙ্গে বাড়ছিল মনের ভেতর কুরে কুরে খাওয়া অস্বস্তিটা। এমন কোনো সমস্যার সঙ্গে ও যে এভাবে কখনো জড়িয়ে পড়তে পারে, তা কখনো ভাবেনি। এ যেন মহাভারতের সেই ব্যূহ, যেখানে অভিমন্যু যত ভেতরে প্রবেশ করছিল, ততই আরও জড়িয়ে যাচ্ছিল। রূপা হত্যা রহস্যও যেন তেমনই।
‘দ্য ডার্ক হোয়াইট’ কাগজের প্রথম প্রকাশ ১ জানুয়ারি, ২০২০। আর এখন ডিসেম্বর, ২০২২। এই তিন বছরে প্রতিমাসে একটা করে সংখ্যা বেরিয়েছে। বেশির ভাগ সংখ্যাতেই গোয়া ইনকুইজিশন, গোয়ায় রমরমিয়ে চলা পর্যটন ব্যাবসার পেছনের কালো জগৎ উঠে এসেছে। মার্তণ্ড গোয়া ইনকুইজিশন নিয়ে লিখছে ছ-মাস আগে থেকে।
রুদ্র দ্রুতগতিতে পরের পর সংখ্যাগুলো পড়ে চলেছিল। গোয়ায় বহু বছর আগে ঘটে-যাওয়া একটা অপরাধ নিয়ে প্রায় দু-বছর ধরে একটা ধারাবাহিক লেখা চলছে। এই লেখাটা কে লিখছে?
রুদ্র পড়ছে, কিন্তু ওর মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে অনেক কিছু। সত্যিই কি ডার্ক হোয়াইট কাগজের সঙ্গে রূপার কোনো সম্পর্ক আছে? না পুরোটাই ওর সময় নষ্ট? রূপার ঘরের ডাস্টবিনে পড়ে-থাকা কাগজটা নেহাতই এমনি!
রূপা কি সত্যিই ক্রিশ্চান মৌলবাদীদের রোষের শিকার হয়েছেন? ‘দ্য ডার্ক হোয়াইট’-এ পাঁচ মাস ধরে চলা কলামে উঠে এসেছে শিশুপাচার, ম্যানুফ্যাকচার্ড অরফ্যানদের মতো বিষয়। রুদ্র রূপার ব্লগে লেখা প্রবন্ধগুলোর সঙ্গে কাগজের লেখার মিল খুঁজতে চেষ্টা করছিল। প্রত্যেকের লেখার নিজস্ব ধরন থাকে। কিছু শব্দ, কিছু বাক্যগঠন দিয়ে তা আন্দাজ করা যায়। সে রকম কিছু সাদৃশ্য কি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে? আর সতীশ ও আজিজের বক্তব্যটা?
নিজের মনের দোলাচল অবস্থা কাটাতে রুদ্র ফোনে একটা নম্বর ডায়াল করল। এখন এখানে ঘড়িতে রাত সাড়ে এগারোটা। তার মানে লন্ডনে সন্ধ্যা ছ-টা সাড়ে ছ-টা।
দুবার রিং হতেই একটা গমগমে কণ্ঠ শুনতে পেল রুদ্র।
”হ্যালো।”
”হ্যালো। ড. অরূপেশ চ্যাটার্জি বলছেন?”
”বলছি। কে বলছেন?” পরিষ্কার বাংলায় গলা ভেসে এল।
”আমি ইন্ডিয়া থেকে রুদ্রাণী সিংহরায় বলছি। ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসে আছি। গোয়ায় একটা কাগজ বেরোয়। দ্য ডার্ক হোয়াইট। আপনি কি সেই কাগজে কখনো লিখেছেন?”
”না। নামই শুনিনি।”
রুদ্র ভ্রূ কুঁচকোল, ”কিন্তু গোয়ার সতীশ আর আজিজ নামের দুজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক আপনার নাম বলেছে। ওরা আপনার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে একসময়ে একটা রিপোর্ট করেছিল।”
ওপারে কিছুক্ষণের নীরবতা। তারপর ড. চ্যাটার্জি বললেন, ”মনে পড়েছে। একসময়ে ওই নামে দুজন ইমেলে ও ফোনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল বটে। বছর দুয়েক আগে। আমার বইটা পড়ে। সে তো অনেকেই ইমেল করে। আমি উত্তরও দিই। লম্বা লম্বা চিঠি চালাচালি হয়।”
”আপনি মাদার সিসিলিয়ার একটা অন্যদিককে তুলে ধরেছেন আপনার বইতে। কোনো প্রতিবাদের সম্মুখীন হতে হয়নি?”
”বিশ্ব জুড়ে হয়নি। আমেরিকা বা ইয়োরোপে সবাই ব্যাপারটাকে মনোযোগ দিয়ে যুক্তিসম্মতভাবে শুনেছে। কিন্তু প্রতিবাদ করেছে আমার দেশের লোকরাই।” ড. অরূপেশ চ্যাটার্জি মৃদু হাসলেন, ”অবশ্য সেটা ভারতীয়দের মজ্জাগত দোষ। আসলে শতাব্দীর পর শতাব্দী শ্বেতাঙ্গদের দাসত্ব করতে করতে তাদের দেখেই পুজো করা, সম্ভ্রম করাটা ইন্ডিয়ানদের স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। ছয়ের দশকের কলকাতায় বেড়ে উঠেছি, মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময়ে শহরটাকে ভালো করে চিনেছি, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু রিফিউজিকে ডাক্তার হিসেবে সেবাও করেছি। অনেক বন্যা দেখেছি, ঝড়ঝঞ্ঝা দেখেছি বাংলার বুকে। পরবর্তীকালে লন্ডন চলে আসি। কিন্তু এত বছর এখানে কাটিয়েও মনেপ্রাণে বাঙালিই রয়েছি।”
”এই বিষয় নিয়ে বই লেখার কথা ভাবনায় এল কীভাবে আপনার?” রুদ্র ধীরে ধীরে ভদ্রলোককে সহজ করতে চাইছিল।
”অনেকদিন থেকেই সিসিলিয়ার বক্তৃতায় ও কাজে নানা অসংগতি লক্ষ করতাম। নয়ের দশকের গোড়া থেকে কাজ শুরু করি। অনেকরকমভাবে ফোন করে নিশ্চিত হই, মিশনারিজ অফ ডিভিনিটি একেবারে অনাথ না হলে কাউকে গ্রহণ করে না। সে যতই দুস্থ হোক, অসহায় হোক। বিদেশে সবাই সিসিলিয়া বলতে অজ্ঞান, এদিকে কলকাতার লোক তাঁর সেবার সেভাবে কোনো নমুনা দেখতে পায় না। তখনও মাদার সিসিলিয়া সেন্ট হননি। ভ্যাটিকানে বিটিফিকেশনের সময় আমি আর ক্রিস্টোফার সিচেন্স ডেভিল’স অ্যাডভোকেট হয়েছিলাম। নানা উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছিলাম, তিনি চিকিৎসাকে বিশ্বাস করতেন না, চাইতেন অসুস্থরা যেন যিশুর মতো কষ্ট পায়। বিশ্বব্যাপী প্রচারমাধ্যমকে তিনি অনেক অতিরঞ্জিত তথ্য দিয়েছেন।”
”কিন্তু— কিন্তু আমরা ছোটো থেকে জেনে আসছি মাদার সিসিলিয়া মানেই সেবার প্রতিমূর্তি!” রুদ্র দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বলল।
”হুম। কিন্তু দেশের কোনো বড়ো বিপদেই তাঁকে বা তাঁর প্রতিষ্ঠানকে দেখায়নি। এখনো যায় না। কিছু উদাহরণ দিই। ১৯৮৪ সালে ভোপালে ইউনিয়ন কার্বাইডের কারখানা থেকে বেরোনো সেই বিষাক্ত গ্যাস দুর্ঘটনায় মারা গেল সাড়ে তিন হাজার মানুষ। মাদার সিসিলিয়া তখন সদ্য বিরাট একটা পুরস্কার পেয়েছেন। মানুষের অনেক প্রত্যাশা। সিসিলিয়া গেলেন। তিনবার ‘ক্ষমা করো’ বলে এক আর্তের হাতে গাঁদা ফুল বাড়িয়ে দিলেন তিনি। খবরের কাগজে সেটাই বড়ো বড়ো করে ছাপা হল। ১৯৯৩-এ ভয়ংকর ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল মহারাষ্ট্রের লাতুর। মারা গেল আট হাজার মানুষ, গৃহহীন হল আট লক্ষেরও বেশি। ত্রাণকাজে ছুটে গেল দু-শোরও বেশি সেবা সংগঠন। কিন্তু না, মিশনারিজ অফ ডিভিনিটি যায়নি। সেই সময় সিসিলিয়া ব্যস্ত আমেরিকায়, জুলিয়াসকোজ নামক এক ধনী ব্যক্তি গর্ভপাতের বিরুদ্ধে গলা তুলেছিল, সিসিলিয়া তাঁর হয়ে সুপ্রিম কোর্টে ধরনা দিচ্ছিলেন। সিসিলিয়ার সংগঠন যায়নি উত্তরকাশীর ভূমিকম্পেও, যেখানে মারা গিয়েছিল দেড় হাজার মানুষ। এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি। ১৯৯৫-এ ফিরোজপুর ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গেল দু-শোজন, সিসিলিয়া শুধু প্রার্থনা করলেন। ওই বছরেই পুজোর ঠিক আগে পশ্চিমবঙ্গ ভেসে গেল বন্যায়, ত্রিশ লক্ষ মানুষ গৃহহারা। ত্রাণ তহবিলের জন্য ভিক্ষা করতে রাস্তায় নেমে এসেছিল ছাত্র, শিক্ষক, ছোটো-বড়ো ব্যবসায়ী, শ্রমিক থেকে কলকাতার পতিতাপল্লির যৌনকর্মীরা পর্যন্ত। কিন্তু না, মিশনারিজ অফ ডিভিনিটি যায়নি। ১৯৯৪-এর গোটা গ্রীষ্ম কলকাতায় কাটিয়ে সিসিলিয়া অক্টোবরে আবার বেরোলেন বিশ্বের প্রতি তাঁর কর্তব্যের টানে। গোটা পৃথিবীর কাছে তিনি প্রার্থনা করবেন, অনুদান চাইবেন এবং গর্ভপাতের পাপের কথা শোনাবেন।”
”গর্ভপাতের পাপ মানে?”
”সিসিলিয়া গর্ভপাতকে পাপ মনে করতেন। এক ভাষণে বলেছিলেন, আফ্রিকা বা ভারতের অনেক শিশু খিদের জ্বালায় মরে, অনেকে এদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন। কিন্তু চিন্তা করেন না লক্ষ লক্ষ অনাগত প্রাণদের নিয়ে, যাদের হত্যা করে তাদের মায়েরাই। তাঁর মতে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো পাপ হল গর্ভপাত। স্পেনের পার্লামেন্ট থেকে জাপানের পার্লামেন্ট, যেখানে যখন গর্ভপাত নিয়ে বিল পেশ করা হয়েছে, তিনি ছুটেছেন। গিয়ে গর্ভপাত নিষিদ্ধ করার সপক্ষে ভাষণ দিয়েছেন। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় খান সেনারা হাজার হাজার বাংলাদেশি মহিলাকে ধর্ষণ করেছিল। মার্কিন সাংবাদিক জয়েস গোল্ডম্যান সেই বীভৎস অত্যাচারের বর্ণনা করেছিলেন। মেয়েদের সেনা ব্যারাকে ধরে এনে অবিরাম ধর্ষণ চালান হত। বেশির ভাগ সময় ধর্ষিতা মারা যেত। গোল্ডম্যান আট বছরের একটা বাচ্চা মেয়ের কথা লিখেছিলেন, যার যোনিপথ যথেষ্ট ছোটো হওয়ায় সেনারা ছুরি দিয়ে সেই পথ প্রশস্ত করে। বাচ্চাটা মারা যায়। এত কাণ্ডের পর সিসিলিয়া শুধু উপদেশ দিলেন, গর্ভবতী হয়ে গেলে গর্ভপাত না করে সন্তানবতী হতে। তিনি খান সেনাদের কোনো নিন্দা করলেন না। ধর্ষিতাদের প্রতি কোনো সমবেদনা জ্ঞাপন করলেন না। শুধু গর্ভবতী নারীদের সন্তান জন্মানো অবধি নিজের আশ্রমে আশ্রয় দিতে রাজি হলেন।”
”মানে আপনি বলছেন, মাদার সিসিলিয়া কোনো ভালো কাজ করেননি?”
”অবশ্যই করেছেন। সিসিলিয়ার কয়েকটা ছোটো ছোটো প্রাইমারি স্কুল ছিল কলকাতায়। কয়েকটা লঙ্গরখানা ছিল, ছোটোখাটো অ্যাম্বুলেন্স বাহিনীও ছিল। কিন্তু তাঁর গোটা কর্মকাণ্ডকে যেভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে পরিসংখ্যানে ও গুণমানে অন্তত পাঁচশোগুণ বাড়িয়ে পৃথিবীসুদ্ধ মিডিয়ার কাছে প্রচার করা হয়েছে, আমার আপত্তি সেইখানে। আর এর পেছনে যে লোকটা ছিল, তার নাম কোলরিজ মাগাকম। একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক। তিনিই মূলত সারা পৃথিবীর কাছে মাদার সিসিলিয়াকে বিখ্যাত করে তুলেছিলেন। মাদার সিসিলিয়া প্রথম জীবনে তাঁর ছোটো পরিসরে সত্যিই ভালো কাজ করতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ওঁর মাথাটা ঘুরিয়ে প্রচারলোভী করে তুলেছিলেন এই মাগাকম।”
”কীভাবে?”
”১৯৬৯ সালে কোলরিজ মাদার সিসিলিয়ার ওপর একটা ডকুমেন্টারি বানান। Something wonderful for God. পাঁচ দিনের শুটিং-এ কলকাতাকে কদাকারভাবে দেখানো হল সেখানে। যেন, কলকাতার মতো বস্তি আর কুষ্ঠে ভরে-থাকা শহরে সিসিলিয়া এক ঈশ্বর। প্রচণ্ড হিট হল সেই টেলিফিলম। সিসিলিয়া রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন। তারপর যত দিন গিয়েছে, মাগাকমও প্রচার করেছেন, মাদার সিসিলিয়ারও ভাষণে এসেছে অতিরঞ্জন। ক্রমে বেড়েছে নানা দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ, এসেছে বড়ো বড়ো সব পুরস্কার।”
”কিন্তু সেন্ট হতে গেলে দুটো অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে হয়। মাদার সিসিলিয়ার তো তেমন উদাহরণ রয়েছে!”
”আগে ছিল বিটিফিকেশনের জন্য দুটো মিরাকল, আর ক্যানোনাইজেশনের জন্য দুটো। এখন পোপ দুটো প্রসেসেই কাটছাঁট করে একটা করে মিরাকল করে দিয়েছেন। এখন হুড়মুড় করে সেন্ট করা হচ্ছে। আগের দু-হাজার বছরে অত সেন্ট বানানো হয়নি, যত এখন হচ্ছে। মাদার সিসিলিয়ার মিরাকল বলতে যেটা দেখানো হয়েছে, সেটা হল দিনাজপুরের বালুরঘাটে মনীষা ওরাওয়ের ইউটেরাস টিউমার মিলিয়ে যাওয়ার ঘটনা। ১৯৯৮-এর মে মাসে মনীষার ইউটেরাসে একটা টিউমার ধরা পড়ে। সেপ্টেম্বর মাসে দুই সন্ন্যাসিনী মনীষার তলপেটে বেঁধে দেন ‘মাদার সিসিলিয়া অ্যালুমিনিয়াম মেডেল’। ডিম্বাকৃতি ছোটো পদক। রাতভর প্রার্থনার পর দেখা যায়, টিউমার মিলিয়ে গেছে। অথচ পরে দেখা যায়, মনীষার টিবি থেকে ওই টিউমার হয়েছিল। টিবির চিকিৎসা চলছিল বহুদিন ধরে।”
ফোনালাপ চলল বহুক্ষণ। ড. অরূপেশ চ্যাটার্জি এই বিষয়ে মানুষকে জানাতে চান, তাই যে বা যারা জানতে চায়, তিনি তাদের বিস্তারিত জানান নিজের গবেষণার কথা। ফোন রাখার আগে রুদ্র বলল, ”ড. চ্যাটার্জি, আপনি প্রথম দিন আমাকে এত কিছু বললেন, ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করব না। শুধু একটা প্রশ্ন করব। আপনি রূপা নামে কাউকে চেনেন?”
ড. চ্যাটার্জি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ”নো। নেভার হার্ড দ্য নেম!”
রুদ্র প্রচণ্ড হতাশ হল। এতক্ষণ কথা বলতে বলতে ওর একটা দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল যে, এই ড. অরূপেশ চ্যাটার্জির সঙ্গে রূপার যোগাযোগ আছে। কিন্তু সেটা নয়? তবে রূপা কি অন্য কোনো ড. চ্যাটার্জিকে ইমেল করার কথা লিখে রেখেছিল?
রুদ্র কোনদিকে যাচ্ছে? এতগুলো বন্ধ দরজায় হোঁচট খেতে খেতে ও তো দিশেহারা হয়ে পড়ছে! মনের কোন এক গভীর কোণে খচখচানিটা হয়েই চলেছে। সেটা কি দিগভ্রান্ত হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে?
ঘড়িতে দুটো বাজে। যত রাত গভীর হচ্ছে, সমুদ্রের দিক থেকে বয়ে-আসা হাওয়াটা ঠান্ডা হচ্ছে। কিন্তু সেই শীতল বাতাসও রুদ্রর মাথাটাকে শান্ত করতে পারছে না। ও অন্যমনস্কভাবে নোটবুকের দিকে তাকাল। একটু আগে সেখানে ও নিজেই লিখেছে নানারকম কথা।
রূপা খুনের সম্ভাব্য উদ্দেশ্য:
১। দুয়ার্তের কথা অনুযায়ী কোনো উগ্র মৌলবাদী রূপাকে সরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু দুয়ার্তে বলেছেন, রূপা গত কয়েক মাসে গোয়ার অনেক ধর্মীয় সংগঠন থেকে হুমকি পেয়েছিল। কীভাবে পেয়েছিল? ইমেলে? চিঠিতে? ফোনে? রূপার ইমেইল আইডি পুলিশ ট্র্যাক করেছে। সেখানে কোনো হুমকি নেই। তবে কারা ওকে হুমকি দিচ্ছিল? রূপার অন্য কোনো ইমেল আইডি থাকলে সেটা কীভাবে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে?
২। দুয়ার্তের সঙ্গে পিটার অ্যান্ড্রুজের বহুদিনের যোগাযোগ। শংকরের বাবাও তা-ই বললেন। সেই সূত্রেই হয়তো দুয়ার্তের সঙ্গে রূপার আলাপ। অথচ, দুয়ার্তে মিথ্যা কথা বললেন। রূপা কি কোনোভাবে বুঝতে পেরে গিয়েছিল রকি ওর ভাই নয়? রূপা কি সেন্ট মারিয়া অরফ্যানেজের শিশুপাচারচক্রটাকে ধরিয়ে দিতে গিয়েছিলেন? তাই ওকে সরিয়ে দেওয়া হল?
এই অবধি লিখে রুদ্র আবার চিন্তা করতে লাগল। ফাদার দুয়ার্তে নিজে ‘দ্য ডার্ক হোয়াইট’ কাগজের নিয়মিত গ্রাহক, সেই থেকে রূপার ঘরে কাগজটা দেখতে পাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। রূপার সঙ্গে ওই কাগজের কোনো সম্পর্ক না থাকলে সতীশ, আজিজ, ডার্ক হোয়াইটের সব সংখ্যার বিভিন্ন লেখা কিংবা এই ড. অরূপেশ চ্যাটার্জিকে নিয়ে এত ভেবে সময় নষ্ট করার কোনো অর্থই হয় না।
তাহলে?
শংকরের এক জুনিয়র ইতিমধ্যেই সেন্ট মারিয়া অরফ্যানেজের ফাইলটা পাঠিয়েছে। রুদ্র সেটা খুলল।
সত্যিই কি নিজের বিবেকের তাগিদে পিটার অ্যান্ড্রুজ অনাথ আশ্রম খুলেছিল?
ও চুপচাপ নোটবুকে আঁকিবুকি কাটছিল। গত তিন বছরে নর্থ গোয়ায় একশো দশটা মার্ডার হয়েছে। যার মধ্যে দশটা কেস এখনও আনসলভড। তিন-চারটে কলগার্ল ছাড়াও সেই লিস্টে রয়েছে রেস্তরাঁ মালিক, ট্রাভেল এজেন্ট ও আরও কয়েকজন। এদের সঙ্গে কি রূপার কোনোরকম যোগসূত্র থাকতে পারে?
মার্তণ্ড কি সত্যিই কোনো হেল্প করতে পারবে?
তন্ময় হয়ে ভাবছিল রুদ্র, এমন সময় ‘টুং’ শব্দে ফোনে মেসেজ ঢুকল। শংকর।
”জেগে আছিস? একটা ফোন করব?”
ঘড়িতে আড়াইটে। রুদ্র দ্রুত ফোন করল শংকরকে।
”এতক্ষণ রকি মহাবংশীকে নিয়ে পড়ে ছিলাম। থার্ড ডিগ্রি দিতে হল।” শংকর হাঁপাচ্ছিল।
”কিছু বলল?”
”টুকটাক কিছু ইনফর্মেশন। পিটার অ্যান্ড্রুজের কাজকর্মের বেশ কিছু ঘাপলা নিয়ে। মিসেস মার্থা যতই ভালোমানুষ সাজুন, পিটার বাচ্চা বিক্রি করত।”
”কীরকম? ওই ব্রাইট ফিউচার ইন্টারন্যাশনালের মালিক কে?”
”সেটা এখনও বের করা যায়নি। তুই কি একবার কমিশনারেটে আসতে পারবি?”
”আসছি।” রুদ্র উঠে দ্রুতগতিতে ঘরে গেল। রেডি হতে যাবে, এমন সময় বিছানায় শুয়ে-থাকা প্রিয়মের দিকে চোখ পড়ল ওর। প্রিয়মের মুখ-চোখ যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। হাত কপালের ওপর আড়াআড়ি রাখা।
”কী হয়েছে তোমার?” রুদ্র ভ্রূ কুঁচকে প্রিয়মের দিকে এগিয়ে গেল।
”মাথা যন্ত্রণা। অসহ্য ব্যথা করছে। সকালে ব্যাসিলিকায় ওই ঝাঁ ঝাঁ রোদে ঘোরার সময় থেকেই একটু একটু হচ্ছিল। এখন যেন মনে হচ্ছে, শিরাগুলো ফেটে রক্ত বেরিয়ে পড়বে।” প্রিয়ম ম্লান মুখে বলল।
”আমি তো ওষুধ এনেছি। খাওনি কেন?” রুদ্র দ্রুত উঠে ওর হাতব্যাগের দিকে এগিয়ে গেল। আপৎকালীন কিছু ওষুধ সবসময় ওর ব্যাগে থাকে।
”আমি খুঁজে দেখেছি।” প্রিয়ম সংক্ষেপে জবাব দিল, ”তোমার ব্যাগের ওষুধটার ডেট এক্সপায়ার করে গেছে। নেওয়ার আগে দেখেও নাও না।”
”যাহ দাঁড়াও, নীচে আফজল আছে। কোনো দরকারে শংকর ওকে ডাকতে বলেছে।” প্রিয়ম আপত্তি করার আগেই রুদ্র বাইরের লবিতে এসে নীচে ফোন করল।
”হ্যাঁ, আফজলের কাছে ওষুধ আছে। নিয়ে আসছি এখুনি।”