১৫
রুদ্র ল্যাপটপ খুলে বসে ছিল। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। ফোনের ওপারে মার্তণ্ডর কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়ামাত্র বলল, ”হ্যাঁ, তোমায় ফোন করেছিলাম একটা জিনিস জানতে।”
”কী, ম্যাডাম?”
”তোমার ধর্ম নিয়ে এত আগ্রহ জন্মাল কেন, মার্তণ্ড?”
”এমনি!”
”এমনি তো হতে পারে না।” রুদ্র বলল, ”তুমি বলেছিলে, সলসেটের নাগোয়া গ্রামে তোমার বাড়ি। ওই অঞ্চলের সব গ্রামই ইনকুইজিশনে কম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তোমাদের পরিবারেও কি এমন কোনো ছাপ ছিল?”
মার্তণ্ড কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ”যদি বলি, ছিল না, তবে মিথ্যা কথা বলা হবে, ম্যাডাম। আমার পূর্বপুরুষদের অনেকেই এই ইনকুইজিশনের প্রত্যক্ষ ফল ভোগ করেছেন।”
”হুম।” রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ”কাল সকালে চলে এসো।”
ফোনটা রাখতে প্রিয়ম বলল, ”ঘুমোবে না? কত রাত হল! কী করছ?”
রুদ্র হাই তুলতে তুলতে ল্যাপটপ ঘাঁটছিল। অন্যমনস্কভাবে বলল, ”উঁ?”
”কী করছটা কী?”
”তোমাকে তো কিছু বলতে ভয় লাগছে। ঘোরা ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে কথা বলতে গেলেই এমন ঝাঁপিয়ে পড়ছ!”
”আরে না।” প্রিয়ম এবার কাছে এসে বসল, ”কদিনের জন্য এসেছি, এসব খুনখারাপিতে সময় নষ্ট হবে, তাই বলছিলাম! কী হয়েছে বলো-না!”
”ব্রাইট ফিউচার ইন্টারন্যাশনাল। ফ্রান্সের একটা এন. জি. ও.। তাদের ওয়েবসাইটটা দেখছিলাম। দুঃস্থ ও পরিত্যক্ত শিশুদের নিয়ে কাজ করে। ১৯৯৫ সালে তৈরি হয়েছে। এতগুলো বছরে হাজারেরও বেশি শিশুকে রেসকিউ করেছে।”
”রেসকিউ মানে তো দত্তক নেওয়ার প্রসেসে মিডলম্যানের কাজ করেছে।” প্রিয়ম হাই তুলল, ”ডিটেইল লেখা আছে কিছু?”
”না। তবে অনেক টেস্টিমনিয়াল রয়েছে। মানে কোনো নিঃসন্তান দম্পতি শিশু পেয়ে কত খুশি এইসব।” রুদ্র ওয়েবসাইটটা বন্ধ করে ইন্টারনেটে এন. জি. ও.-টা সম্পর্কে নানারকম সার্চ করে চলেছিল, ”কিন্তু ইন্ডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারে কিছু লেখা নেই। শংকরকে কি ওদের ফোন করতে বলব?”
প্রিয়ম বলল, ”এখনও তো বুঝতে পারছ না, এই এন. জি. ও.-টার মতলব ভালো না খারাপ। পরিচয় দিয়ে ফোন করলে ওরা সাবধান হয়ে যাবে।”
রুদ্র মাথা নাড়ল, ”সেটাও ঠিক। ফোনে বা ইমেলে কিছু জানা যাবে না। ওরা ফর্ম্যাল রিপ্লাই করবে। তবে?”
”একটা ট্র্যাপ পাতা যেতে পারে।” প্রিয়ম বলল।
”কীরকম ট্র্যাপ?”
”আমার প্রজেক্টের অনসাইট তো প্যারিসেই। আমার অনসাইটের কাউন্টার পার্ট মরিসকে বলতে পারি, ওদের অফিসে গিয়ে কথা বলে আসার জন্য।”
”ওয়ান্ডারফুল!” রুদ্র লাফিয়ে উঠল, ”প্লিজ বলো! ইন্ডিয়ার সঙ্গে কানেকশনটা যেন বের করার চেষ্টা করে।”
”হুঁ। কিন্তু কীভাবে বলব? ওর তো নিজের চারটে বাচ্চা, ও তো আর দত্তক নিতে চাইবে না!” প্রিয়ম বিড়বিড় করল, ”ঠিক আছে। কিছু একটা দিয়ে ম্যানেজ করছি।”
রুদ্র আবার ল্যাপটপের দিকে মুখ ফেরাল, ”বিজয় গোমস রূপা মার্ডারের ফাইলটা স্ক্যান করে পাঠিয়েছে। রূপা নিরুদ্দেশ হওয়ার দু-দিন পর মি. দুয়ার্তের সহকারী জিমি থানায় গিয়ে মিসিং ডায়েরি করে।”
”হুঁ।” প্রিয়ম আবার হাই তুলল, ”অনেক রাত হল। তুমি কি শোবে?”
”আর দশ মিনিট।” রুদ্র ল্যাপটপের স্ক্রিনে একটা ছবি এনলার্জ করল, ”রূপার ডায়েরিটা ফাঁকা, কিন্তু ডায়েরির পেছনের কভারে কী লেখা আছে দেখো।”
প্রিয়ম উঁকি মেরে দেখল। শংকরের নির্দেশে রূপা নেইলসনের ঘরের সমস্ত একজিবিটস স্ক্যান করে পাঠানো হয়েছে। ডায়েরির পেছনের কভারে হিজিবিজি কিছু লেখা।
”এই ডায়েরিটারই সামনের পৃষ্ঠায় মোজেসের ওই বাণী লেখা ছিল?”
”হ্যাঁ।” রুদ্র আরও এনলার্জ করল। খুব ছোটোছোটো করে ইংরেজিতে লেখা। কোনো কিছু মনে রাখতে গেলে লোকে যেমন লিখে রাখে।
”রিমাইন্ডার: আনন্দকে মেল করতে হবে। ড. চ্যাটার্জির ইমেলের উত্তর দিতে হবে।”
রুদ্র ভ্রূ কুঁচকোল। রূপার ইমেলের সব ডিটেইল সাইবার ক্রাইম দপ্তর ট্র্যাক করেছে। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ‘আনন্দ’ নামের কাউকে খুঁজে পেল না রুদ্র। নেই ‘ড. চ্যাটার্জি’ নামেরও কেউ।
প্রিয়ম বলল, ”রূপা তো লতাপাতা নিয়ে রিসার্চ করছিল, সেই ব্যাপারে কাউকে কিছু পাঠাত বোধহয়।”
”সে পাঠাক কিন্তু তার ইমেলটা তো মেল বক্সে থাকবে! রূপার ইমেলে তাঁর কাজ সংক্রান্ত সব ইমেলই রয়েছে। তবে কি এই গোয়ার লেখালেখির ব্যাপারে রূপা অন্য কোনো ইমেল ব্যবহার করতেন?” রুদ্র চিন্তা করল কিছুক্ষণ। তারপর শংকরকে ফোন করল, ”জেগে আছিস তো? আচ্ছা বলছি, রূপা নেইলসনের কি অন্য কোনো ইমেল আইডি ছিল?”
”তা তো জানি না।”
”তুই একবার খোঁজ নে, ওঁর ফোন নম্বরের সঙ্গে আরও কোনো ইমেল অ্যাড্রেস লিঙ্ক আছে কি না। আর শোন, মি. দুয়ার্তের আশ্রমে সেবাস্টিয়ান বলে একটা বাচ্চা ছেলে থাকে। হ্যাঁ হ্যাঁ, সেদিন যে আমাদের রূপার ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। তার সঙ্গে একবার একান্তে কথা বলতে চাই। তুই ব্যবস্থা করাতে পারবি?”
”এ আর এমনকী। কালই হয়ে যাবে।” শংকরের গলা শোনা গেল।
রুদ্র বলল, ”আর রূপা আর রকিকে যে লোকটা অরফ্যানেজে এনেছিল, সেই মান্ডু মহাবংশীর সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল?”
”সে মরে গেছে রে বছরকয়েক হল। ওর ঠিকানায় লোক গিয়েছিল।”
”যাহ, আর কাউকে পাওয়া গেল না?”
”মান্ডুর বউ বেঁচে আছে। তাকে এনকোয়্যারি করছে পুলিশ। রিপোর্ট পেলে তোকে জানাব। তোরা এখনও জেগে আছিস?”
”তুইও তো ঘুমোসনি!”
”আমার ঘুম-টুম সব উড়ে গেছে। একে মায়ের শরীরটা একদম ভালো নেই, বারবার কলকাতায় ফোন করছি।” শংকরের গলা থেকে অনুতাপ ঝরে পড়ল, ”আর এদিকে খবর পেলাম, কাল সকালে গোয়ার সবচেয়ে বড়ো কাগজ ‘দ্য গোয়া ডেইলি’ রূপা মার্ডার নিয়ে বিরাট কভার স্টোরি করতে যাচ্ছে। ওদিকে সুইডেনের অ্যাম্বাসাডর দিল্লিতে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন, গোয়ায় বিদেশিদের সুরক্ষা নিয়ে তিনি চিন্তিত। এর আগেও বেশ কিছু আনসলভড কেস রয়ে গেছে। এবার সবাইকে ছেড়ে এই কেসের চিফ ইনভেস্টিগেশন অফিসার হিসেবে আমারই অপদার্থতাকে বার বার হাইলাইট করা হচ্ছে। ডি.জি.-র কাছে এই নিয়ে আমায় এখন গালাগাল খেতে হচ্ছে। এত চেষ্টা করছি, একটু এগোতে পারছি না! রূপা নেইলসনকে গোটা নর্থ গোয়ায় কেউ ওই সাতটা দিনে দেখেনি। সেন্ট মারিয়া অরফ্যানেজের উলটোদিকে একটা সিসিটিভি আছে, সেটারও ফুটেজ ট্র্যাক করা হয়েছে। রূপা সেখানেও যায়নি। রূপার বডি যেখানে পড়েছিল, তার আশপাশের বালির ফুটপ্রিন্ট থেকেও তেমন কিছু আইডেন্টিফাই করা যাচ্ছে না। একটা ক্লু নেই, যেদিক দিয়ে এগোতে পারি।”
রুদ্র একটু থামল। তারপর বলল, ”পুরো গোয়া রাজ্যের মার্ডার লিস্টটা আমায় দিতে পারবি? গত দু-তিন বছরের?”
”এটা আর কী এমন ব্যাপার। সব ডিটেইল ডেটাবেসেই তো রয়েছে। আমি আমার টিমের অভিষেককে বলে দিচ্ছি। তোকে পাঠিয়ে দেবে।”
”থ্যাঙ্ক ইউ!” ফোনটা রেখে রুদ্র প্রিয়মের দিকে তাকাল, ”তুমি প্লিজ তোমার ওই মরিসকে একটু রাজি করাও। ব্রাইট ফিউচার ইন্টারন্যাশনালের ডিটেইল পেতেই হবে।”
”অলরেডি পুরোটা জানিয়ে মেসেজ করে দিয়েছি।” প্রিয়ম বেজার মুখে জবাব দিল, ”এসে থেকে নিজের কাজ করে যাচ্ছিলে, এবার আমাকেও অফিসের লোকের সঙ্গে কথা বলতে ভিড়িয়ে দিলে। ওহ, কী কুক্ষণে যে একটা পুলিশের বাড়িতে উঠেছিলাম! আর জীবনে এই ভুল করব না।”
১৬
গোয়ার বিখ্যাত চিকিৎসক গার্সিয়া দে ওরতা হঠাৎ মারা গেলেন। গোয়ায় নিজের বাড়িতে ঘুমের মধ্যে মৃত্যু। গোটা অঞ্চলের ইহুদিরা এই অপ্রত্যাশিত দুঃসংবাদে কেঁপে উঠল।
কীভাবে তিনি মারা গেলেন, তা নিয়ে কেউই তেমন নিশ্চিত হতে পারল না। আগের দিন রাতেও তিনি ঠিক সময়ে নৈশাহার করেছেন, ভৃত্যদের সঙ্গে হেসে কথা বলেছেন, তারপর নিজের বাড়ির প্রকাণ্ড লাইব্রেরিতে গিয়ে বইয়ের মধ্যে ডুবে গিয়েছেন। সকালবেলা বিছানায় তাঁর মৃতদেহ পাওয়া গেছে।
নিথর মুখটিতে প্রশান্তির ছায়া।
সম্পূর্ণ সুস্থ দাদার এমন আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ক্যাথারিনপিসি বিস্ময়ে মূক হয়ে গেল। মোলে গ্রামের বাকি ইহুদিদের মুখও ভয়ে পাংশু হয়ে গেল। গার্সিয়া দে ওরতা খুব কম এই গ্রামে আসতেন ঠিকই, কিন্তু একটা যেন অদৃশ্য বট গাছের মতো তিনি সবাইকে আড়াল করে রেখেছিলেন। তাঁর মৃত্যু কি আদৌ স্বাভাবিক? নাকি, খাবারে বিষ মিশিয়ে তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে? অসম্ভব কিছুই নয়। শুধু মোলে গ্রাম নয়, খোদ গোয়ারও অনেক ইহুদি পরিবারকে তিনি নিরাপদে থাকতে সাহায্য করতেন। সেইজন্যই কি তাঁকে এভাবে সরিয়ে দেওয়া হল?
ক্যাথারিনপিসি কিছুই বুঝতে পারে না, দিনরাত জোশুয়াকাকার সঙ্গে নিচুস্বরে কী সব আলোচনা করে, কেউ এলেই চুপ করে যায়। পিসির চোখে একটা স্থায়ী ভয়ের ছাপ পড়েছে, শিরা তাকালেই বুঝতে পারে।
ইহুদিপাড়ার কেউ মনের কথা খুলে ব্যক্ত করতে পারে না। ভীত চোখে এ ওর দিকে তাকায়। সবার চোখেই সন্দেহের ছায়া।
দু-মাস কেটে গেলেও শিরা বাবার মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে পারছিল না কিছুতেই। ওর জীবনে স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা যতটুকু পাওয়ার, পিসির থেকেই পেয়েছে। মায়ের মৃত্যু ওর আবছা মনে পড়ে, কোনো স্মৃতিই সেভাবে নেই। বাবা তিন-চার মাস অন্তর মোলে গ্রামে আসতেন, আসার সময় গোয়া থেকে নিয়ে আসতেন অনেকরকম ফল আর কেক। গ্রামে এলে তাঁকে ঘিরে থাকত সব ক-টা ইহুদি পরিবার। সারাক্ষণই কেউ না কেউ আসছে অসুখবিসুখের কথা নিয়ে। বাবা বাইরের বারান্দায় বসে মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনছেন, নিজের খাতায় লিখে রাখছেন, পরের দিন সে এসে ছোটো পেতলের পাত্রে ওষুধ নিয়ে যাচ্ছে। এই করতে করতেই কেটে যেত তিন-চার দিন। বাবা আবার ফিরে যেতেন।
কিন্তু শেষবার যখন এলেন, বাবার মুখের মধ্যে কি তীব্র বিষাদের ছাপ পড়েছিল? শিরা অনেক ভেবেও মনে করতে পারে না। এবারে যেন বাবা বাইরে বেশি বসে থাকতে চাইছিলেন না, বার বার এসে বসছিলেন শিরার বিছানায়। মেয়েদের নিজের পাশে বসিয়ে অনেকক্ষণ গভীর চোখে দেখছিলেন, কী যেন খুঁজছিলেন ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে। কাছে ডেকে বার বার জানতে চাইছিলেন, ”তোরা ঠিক আছিস তো মা? ভয় পাবি না একদম, সব ঠিক হয়ে যাবে। মোজেসের ওপর ভরসা রাখ, মনুষ্যত্বের জয় হবে।”
আর যাওয়ার দিন সকালে? ভাবামাত্র শিরার চোখ জলে ভরে আসে। বাবা অমন একটা জিনিস কেন দিয়ে গেলেন ওকে?
শিরা চোখের জল মুছল। না-ই বা পাক বাবার সাহচর্য, এই পৃথিবীতে কোথাও তো ওদের বাবা ছিলেন! যিনি দূর থেকে হলেও ওদের ভালো চাইতেন, রক্ষা করতেন। তিনি এমনভাবে হঠাৎ মারা গেলেন? সত্যিই কি বাবাকে হত্যা করা হল?
শিরা আকাশ-পাতাল ভেবেও কোনো কূলকিনারা করতে পারে না। সারাদিন শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে নদীর দিকে। চঞ্চলমতি আহিরাও এখন অনেক শান্ত হয়ে গেছে, অল্প কয়েকদিনের মধ্যে ওর জীবন থেকে প্রিয় বান্ধবী ও বাবা দুজনেই হারিয়ে গেছে। এক ধাক্কায় ওর কৈশোরকে যেন টুঁটি চেপে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। মরা মাছের মতো চোখে সে এখন নীরবে পিসিকে সংসারের কাজে সাহায্য করে।
গ্রামের আবহাওয়া বদলাচ্ছে দ্রুত। গোকুলের বাবা সহদেব গাঁওকরকে গ্রামপ্রধানের পদ থেকে অযোগ্যতার অভিযোগে বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁর জায়গায় গোয়া থেকে পাঠানো হয়েছে সান্টিয়াগো জর্জ নামের একজন ক্রিশ্চান পোর্তুগিজকে। মোলে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কথা বলে কোঙ্কণি ভাষায়, নতুন গ্রামপ্রধান সেই ভাষা বুঝতে পারছে না, গোয়া থেকে তার সঙ্গে আসা শাগরেদরা ধীরে ধীরে হুজ্জতি শুরু করছে গ্রামের হাটবাজার, মন্দির এলাকায়।
সহদেব গাঁওকর শুধু স্থানীয় ছিলেন না, তিনি ছিলেন অত্যন্ত সজ্জন ও পরোপকারী মানুষ। হিন্দুরা তো বটেই, মোলে গ্রামের গুটিকয়েক মুসলমান ও ইহুদি পরিবারও তাই কখনো এই গ্রামে কোনো অসুবিধায় পড়েনি। অমন একজন মানুষকে এখন কথায় কথায় রাস্তাঘাটে হেয় করা শুরু হয়েছে। তাঁর পরিবারকে ক্রিশ্চান গ্রামপ্রধানের নির্দেশে ক্রমশ একঘরে করে দেওয়া হচ্ছে।
গার্সিয়া দে ওরতা মারা যাওয়ার ঠিক চার মাসের মাথায় গোয়ার ইনকুইজিশন কোর্টের নৌকো আবার এসে ভিড়ল মোলে গ্রামে। কয়েকজন সেনা উন্মত্ত ষাঁড়ের মতো ছুটে এল, আঁতিপাতি করে খুঁজে বের করল সোফিয়ামাসির ঘর। সোফিয়ামাসি নিঃসন্তান বিধবা, কারো সাতে-পাঁচে থাকে না। নিজের কয়েকটা গোরু-ছাগল আছে, সেই দুধ বিক্রি করে একার সংসার চলে যায়।
সেই সোফিয়ামাসিকে বাঁধা হল ঘোড়ার সঙ্গে, তারপর সেই ঘোড়া ছুটিয়ে নিয়ে যাওয়া হল নদীর তীরে। সোফিয়া মাসির পরনের পোশাক ছিঁড়ে লুটোতে লাগল ধুলোয়, মাথা ফেটে রক্ত ঝরতে লাগল দরদর করে, সেনাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।
সোফিয়ামাসির বিরুদ্ধে একই অভিযোগ। নিউ ক্রিশ্চান হয়েও গোপনে ইহুদি ধর্মাচরণ। এবার আর কেউ বাধা দিল না। ভীতসন্ত্রস্ত প্রাণীর মতো সবাই নিজের ঘরের ভেতর থেকে বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে লাগল সোফিয়ামাসির লাঞ্ছনা। মাসির পিছু পিছু কেউ গেল না নদীর পাড়ে।
সেই দৃশ্য মনে করামাত্র শিরার বুকের রক্ত হিম হয়ে এল। মনে মনে প্রাণপণে ঈশ্বরকে ডাকতে লাগল ও। এই কালো অধ্যায়ের শেষ কবে?
”কী ভাবছিস এত? ভেবে কিছু হবে কি?”
শিরা চমকে পিছু ফিরল। জোশুয়াকাকা। আজকাল হঠাৎ হঠাৎ চমকে ওঠে ওরা সবাই। মোলেগ্রামের এই কয়েক ঘর ইহুদির মুখে বিষাদের, আতঙ্কের কালো ছায়া। সবাই মনে মনে কাঁপছে, এই বুঝি তার পালা এল। জোশুয়াকাকা ব্যাবসার জিনিসপত্র কিনতে গোয়া গিয়েছিল, এই ফিরছে। হাতে বড়ো বড়ো ঝোলা।
কাকা অলসভাবে মাটিতে বসে পড়ল, ”কী গরম! ক্যাথিদিদি কোথায়?”
”রেবেকার মায়ের কাছে গেছে।” শিরা অস্ফুটে বলল, ”সোফিয়ামাসির কোনো খবর পেলে, কাকা?”
”নাহ!”
শিরা ঢোঁক গিলল। চার দিন হয়ে গেল সোফিয়ামাসিকে ধরে নিয়ে গেছে ওরা। মাসি কি আদৌ বেঁচে আছে? বেঁচে থাকলেও মাসির ওপর যে ভয়াবহ অত্যাচার হয়েছে, তাতে কি তার আর কোনো চেতনা আছে? নাকি সোফিয়ামাসিও এখন রেবেকার মায়ের মতো হাসছে। হা হা করে পাগলের মতো হাসি।
”তোর ছবি আঁকা কেমন চলছে?”
জোশুয়াকাকার প্রশ্ন শুনে শিরা হতবাক হয়ে গেল। এই পরিস্থিতিতে ছবি আঁকা তো দূর অস্ত, আঁকার কথা যে কেউ জিজ্ঞেসও করতে পারে, তা ও ভাবতে পারেনি। তবে কাকা একটু পাগলাটে, তা কারোই অজানা নয়।
ওর মুখ দেখে জোশুয়াকাকা বোধহয় ওর বিরক্তি আন্দাজ করতে পারল। মৃদু হেসে বলল, ”আমার ওপর রাগ করে লাভ নেই। আজ হোক কাল, আমরা সবাই বন্দি হব। শুধু একটা পরিবার ছাড়া।”
”কোন পরিবার?”
জোশুয়াকাকা তীক্ষ্ন চোখে তাকাল, ”যে আমাদের মধ্যে থেকেই বিশ্বাসঘাতকতা করছে, তার পরিবার!”
শিরা কিছু বুঝতে পারল না। জোশুয়াকাকা কার কথা বলছে? ওদের এই কয়েকটা ঘরের মধ্যে এমন গুপ্তচর কে থাকতে পারে?
জোশুয়াকাকা ওর আরও কাছে সরে এল। ফিসফিস করে বলল, ”প্রহ্লাদকে মনে আছে তোর?”
”বাহ, থাকবে না? বাবার গোয়ার বাড়ির সবকিছু তো প্রহ্লাদকাকাই দেখভাল করত। ঠিক সময়ে বাবার খাবার হয়েছে কি না দেখা, বইপত্র গুছিয়ে রাখা, বাইরের বাগান পরিষ্কার রাখা, সব। আমরা গেলেও কত যত্নআত্তি করত!” বলতে বলতে কেমন আনমনা হয়ে গেল শিরা, ”তোমার সঙ্গে কি দেখা হল নাকি গোয়ায়?”
”দেখা হয়নি। আমি দেখা করেছি।” জোশুয়াকাকা বলল, ”তোর বাবা মারা যাওয়ার আগের রাতে কার সঙ্গে ডিনার খেয়েছিলেন, জানিস?”
”না তো!” শিরা বিস্মিত।
”জোসেফ।”
”আইজ্যাককাকার ছেলে জোসেফ? সে শুনেছি ইদানীং প্রায়ই বাবার কাছে যেত!”
”হুম। জোসেফ ডিনার করে গেল, তোর বাবা শুলেন, ঘুমের মধ্যে মৃত্যু। কী অদ্ভুত না? সেই মৃত্যুর কোনো তদন্ত হল না, রাতারাতি ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হল অত বিখ্যাত একজন মানুষের মৃত্যুকে।”
শিরা বিস্ফারিত চোখে শুনছিল। জোসেফ গোয়ায় পড়তে গেছে। এখানে আসে মাঝে মাঝেই। মাসকয়েক আগে শেষ যখন এসেছিল, শিরাকে একলা পেতেই জিজ্ঞেস করেছিল, ”তুমি গোকুলকে ভালোবাসো?”
বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল শিরার। দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে বলেছিল, ”এসব ভুলভাল কথা কে বলল তোমায়!”
”কেউ বলেনি। আমি নিজের চোখে দেখেছি।” জোসেফ হঠাৎই ওর হাত চেপে ধরেছিল, ”সেদিন তোমরা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে ফিরছিলে।”
শিরার ব্যথা লাগছিল, ও প্রাণপণে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলেছিল, ”গোকুল আমার বন্ধু।”
”বন্ধু! ওই হিন্দুর বাচ্চা তোমার বন্ধু?” জোসেফের ফরসা নাকের পাটা ফুলছিল দ্রুত, ”আর আমি? আমি তোমার কেউ নই? একটা অন্য ধর্মের ছেলের সঙ্গে নির্জন জঙ্গলে গেছিলে কেন তুমি?”
শিরা ঝাঁজিয়ে উঠেছিল, ”তাতে তোমার কী!”
”কী রে কী ভাবছিস?” জোশুয়াকাকার উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে ও বর্তমানে ফিরে এল।
”আরও অদ্ভুত ব্যাপার আছে। রেবেকার বাবার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া হল আইজ্যাকের, তার কয়েকদিনের মধ্যেই রেবেকাদের পরিবারকে শেষ করে দেওয়া হল।”
শুনতে শুনতে শিরার সর্বাঙ্গে যেন কাঁপুনি দিচ্ছিল।
”আর গত সপ্তাহে সোফিয়াদিদির সঙ্গে আইজ্যাকের কথা কাটাকাটিটা নিশ্চয়ই তুই ভুলে যাসনি! এগুলো সব ক-টাই কি কাকতালীয়, শিরা?”
১৭
গোয়ার রাজধানী পানাজি। শহরের প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে-থাকা চার্চ স্কোয়্যার দেখে রুদ্র আর প্রিয়ম বেরোতে যাবে, মার্তণ্ড বলল, ”ওই বাগানটায় একটু ঘুরে আসবেন চলুন!”
চার্চ স্কোয়্যারের পেছনে একটা সাজানো-গোছানো ছিমছাম বাগান।
সবুজে ঘেরা মাঠ, ফুলগাছ, প্রবেশপথটা খাঁটি পোর্তুগিজ ধাঁচের, নীল-সাদা রঙের ওপর খোদাই করা ‘গার্সিয়া দে ওরতা উদ্যান’।
”গার্সিয়া দে ওরতা কে ছিলেন, জানেন ম্যাডাম?”
”না তো! পোর্তুগিজ কোনো গভর্নর?” রুদ্র জিজ্ঞেস করল।
মার্তণ্ড মাথা নাড়ল, ”উনি ছিলেন একজন ইহুদি। গোয়ার কিংবদন্তি ডাক্তার ছিলেন। বিজ্ঞানীও। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার অরণ্যে ঘুরে ঘুরে বন্য উদ্ভিদ থেকে কতরকম ভেষজ ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন। ভারতবর্ষের গাছগাছালি থেকে বানানো সেইসব ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে বইও লিখেছিলেন।”
”মারা গেছেন?”
মার্তণ্ড হাসল, ”উনি পাঁচশো বছর আগের মানুষ। পোর্তুগাল থেকে গোয়ায় এসেছিলেন ইনকুইজিশন থেকে বাঁচতে। তখন স্পেনে পোর্তুগালে ইনকুইজিশন আইন চালু রয়েছে, মারানোদের ধরে ধরে জেলে পোরা হচ্ছে, আগুনে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে।”
”মারানো কী?”
”স্পেনে ১৩৯১ সালের ম্যাসাকারে হাজার হাজার ইহুদিকে মারা হয়েছিল। তখন লক্ষ লক্ষ ইহুদি প্রাণে বাঁচতে ক্রিশ্চান হয়েছিল। তাদের বলা হত নিউ ক্রিশ্চান। এদেরকেই গালিগালাজ করে ‘মারানো’ বা ক্রিপ্টো-ইহুদি বলত লোকে। গার্সিয়া দে ওরতার পূর্বপুরুষও এভাবেই বাধ্য হয়ে ক্রিশ্চান হয়েছিলেন। গার্সিয়ার পরিবারও বাড়িতে ইহুদি ধর্মই পালন করতেন। অত বড়ো একজন বিজ্ঞানী হয়েও গার্সিয়া দে ওরতা ছাড় পাননি, তাঁর মা আর দুই বোনকে লিসবনের জেলে বন্দি করা হয়, গার্সিয়া তাঁর স্ত্রী আর আরেক বোন ক্যাথারিনকে নিয়ে পালিয়ে আসেন গোয়ায়। তখন গোয়ায় সবেমাত্র পোর্তুগিজ শাসন শুরু হয়েছে, অনেক ইহুদিই এখানে চলে এসেছিল। যদিও শেষরক্ষা হয়নি। ফ্রান্সিস জেভিয়ারের চিঠিতে কিছুদিন পরই গোয়াতেও ইনকুইজিশন আইন বলবৎ হয়।” মার্তণ্ড একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ”চলুন, ওদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
পাঞ্জিম থেকে ওরা চলে এল পুরোনো গোয়ায়। ঘড়িতে সকাল সাড়ে ন-টা। ব্যাসিলিকা অফ বম জেসাসের সামনে যে খোলা মাঠটা রয়েছে, মার্তণ্ড ওদের সেখানে নিয়ে এল।
প্রায় পাঁচশো বছর আগে পোর্তুগিজরা বানিয়েছিল এই ব্যাসিলিকা। গাঢ় খয়েরি রঙের এই প্রকাণ্ড অট্টালিকার মধ্যেই শায়িত রয়েছে সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ারের মরদেহ। প্রায় সাড়ে চারশো বছর বয়স সেই দেহের, পর্যটকদের জন্য রয়েছে ফোটোগ্রাফ। তবে প্রতি দশ বছর অন্তর জেভিয়ারের দেহ লোকসমক্ষে আনা হয়, শেষ আনা হয়েছিল ২০১৪ সালে। এইসবই মার্তণ্ড ওদের একাধিকবার বলেছে।
রুদ্র আজ আর প্রিয়মকে চটায়নি, ভোরবেলাতেই ঘুরতে বেরিয়ে পড়েছে। মুগ্ধ চোখে ওরা চারপাশ দেখছিল। পোর্তুগিজ আমলে এই ওল্ড গোয়াই ছিল তাদের রাজধানী, প্রশাসন, উপাসনা থেকে বিনোদন সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। একই ক্যাম্পাসে সে ক্যাথিড্রাল, ব্যাসিলিকা অফ বম জেসাস, একটু দূরে ক্রিশ্চান আর্ট মিউজিয়াম। পুরো ক্যাম্পাসটা চোখ-জুড়োনো কেয়ারি-করা ঘাসে ঢাকা, মাঝখান দিয়ে একাধিক পিচের রাস্তা।
হাঁটতে হাঁটতে রুদ্র জিজ্ঞেস করল, ”জেভিয়ার কি এখানেই মারা গিয়েছিলেন?”
”না। জেভিয়ার মারা গিয়েছিলেন চীনে ধর্মপ্রচার করতে গিয়ে। সেখান থেকে বছর দুয়েক পর তাঁর দেহ গোয়ায় আনা হয়। আসুন, ওরা এসে গিয়েছে!” মার্তণ্ড ব্যাসিলিকার দিকে এগিয়ে গেল।
দুটো অল্পবয়সি ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে।
মার্তণ্ড আলাপ করাল, ”সতীশ আর আজিজ। ‘দ্য ডার্ক হোয়াইট’ কাগজটা ওরাই দেখে। আজিজই আমাকে গোয়া ইনকুইজিশন নিয়ে লিখতে বলেছিল।”
”হ্যালো।” রুদ্র বলল, ”গোয়া ট্যুরিজমের বাড়বাড়ন্তের জন্য সেক্স র্যাকেট আর শিশুপাচার নিয়ে আরেকটা যে ধারাবাহিক চলছিল, সেটা কে লিখছিলেন?”
”সেটা জানি না। আসলে আমাদের অনেক লেখাই আসে ইমেলে, বাইরে থেকে।” আজিজ বলল, ”আর কোনো লেখার ক্ষেত্রেই আসল নাম ব্যবহার করা হয় না।”
”আসল নাম ব্যবহার না করা হোক, একটা কাগজ ছাপছেন যখন, আপনাদের কাছে তো তার ডিটেইল থাকে।”
”না ম্যাডাম। আমরা দুজন সাব-এডিটর হলেও মূলত প্রূফ, লে আউট, প্রেসের দিকটা দেখি।” সতীশ মাথা নাড়ল, ”পেটের দায়ে কাগজে চাকরি করি। ওইটুকুই। এসব পুলিশি চক্করে পড়তে চাই না।”
”আমি গোয়া রাজ্যের পুলিশ নই, সতীশ। তোমরা যদি কিছু অপরাধ না করো, নির্ভয়ে থাকতে পারো।” রুদ্র জিজ্ঞেস করল, ”তোমাদের কাগজে এডিটরেরও কোনো নাম নেই। তোমাদের এডিটর কে?”
”জানি না ম্যাডাম!” আজিজের কণ্ঠস্বর থেকে আকুতি ঝরে পড়ল, ”প্লিজ বিশ্বাস করুন।”
”মানে? তোমরা কার অধীনে চাকরি করো, সেটা জানো না? তোমাদের মাইনে কে দেয়? কবে থেকে রয়েছ এই কাগজে?” রুদ্র কড়া গলায় বলল।
আজিজ কাঁচুমাচু মুখে বলল, ”বছর দুয়েক আগে থেকে। আমরা দুজনেই তখন টুকটাক ফ্রিল্যান্সিং করতাম গোয়ার কাগজগুলোয়। জয়েন্টলি আমরা একটা কলাম লিখছিলাম। সেটা নিয়ে রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। অনেকগুলো বড়ো মিডিয়া হাউস থেকে তখন আমাদের ব্যান করে দেওয়া হয়।”
”কী নিয়ে ছিল সেই কলাম?”
সতীশ ঢোঁক গিলল। বলল, ”ক্রিশ্চান ধর্মের কিছু দিক নিয়ে। আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে, মাদার সিসিলিয়ার কিছু অন্ধকার দিক নিয়ে।”
”মাদার সিসিলিয়া!” প্রিয়ম অবাক। ভারতবর্ষে মাদার সিসিলিয়া একটা বিশাল নাম। ইয়োরোপে জন্মানো সিসিলিয়া ছিলেন একজন ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনী এবং ধর্মপ্রচারক। প্রথম জীবনে তিনি ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতে খ্রিস্টধর্মপ্রচারে আসেন। তারপর জীবনের বাকি অংশ তিনি ভারতেই থেকে যান। বহু দরিদ্র শিশু ও আর্তের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। গোটা দেশ জুড়ে তাঁর সংস্থা মিশনারিজ অফ ডিভিনিটির অনেক শাখা তৈরি হয়। বিদেশেও বহু দেশে। পেয়েছেন ছোটো থেকে বড়ো, সবরকম পুরস্কার ও সম্মান। মাদার সিসিলিয়া এখন মারা গিয়েছেন, কিন্তু তাঁর সংস্থার সিস্টাররা সমাজে একই রকম শ্রদ্ধেয় ও আদৃত। কয়েক বছর আগে মাদার সিসিলিয়াকে ‘সেন্ট’ উপাধিও দেওয়া হয়েছে।
এমন একজন মানুষের অন্ধকার দিক!
আজিজ ঢোঁক গিলল, ”হ্যাঁ স্যার। আমরা ভারতীয়রা মাদার সিসিলিয়াকে খুব বড়ো শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছি। ভাবি, গরিবদের সেবা করাই ছিল ওঁর জীবনের মূলব্রত। সিসিলিয়া কিন্তু আসলে দরিদ্রদের ভালোবাসতেন না, ভালোবাসতেন দারিদ্র্যকে।”
”তার মানে?”
”মানুষের কষ্টভোগকে সিসিলিয়া ভাবতেন ঈশ্বরের আশীর্বাদ। সেবা নয়, তাঁর আসল কাজ ছিল সারা পৃথিবী জুড়ে গর্ভপাতের বিরোধিতা করা। গরিবদের তুলে এনে মৃত্যুর আগে তাকে ক্রিশ্চান ধর্মে দীক্ষিত করা। শহরের বস্তি, কুষ্ঠরোগীদের ছবি মিডিয়ায় দেখিয়ে প্রচার করে সারা পৃথিবী থেকে আনা হত মোটা অনুদান। সেই অনুদানের বেশির ভাগই চলে যেত ভ্যাটিকানের ব্যাঙ্কে আর সারা বিশ্ব জুড়ে মিশনারিজ অফ ডিভিনিটির সন্ন্যাসী আবাসগুলোর নির্মাণে, পরিচালনায়। অতি সামান্য অর্থই ব্যয় হত সেবাকাজে।”
”এসব আজেবাজে কথা কে বলেছে তোমাদের?” প্রিয়ম বিস্ফারিত চোখে রুদ্রর দিকে তাকাল।
রুদ্র নির্বিকার। বলল, ”পৃথিবীতে যত মনীষী জন্মেছেন, প্রত্যেকের বিরুদ্ধে এরকম নেগেটিভ মতবাদ প্রচার করা হয়েছে। সেটা লাইমলাইটে আসার জন্যই হোক বা অন্য কোনো কারণে। কিন্তু কোনো মতবাদ তখনই সত্যতা পায়, যখন তার সপক্ষে প্রমাণ থাকে। না হলে তা প্রোপাগান্ডা হয়েই থেকে যায়। তা-ই না?”
”প্রমাণ আছে ম্যাডাম!”
”কী প্রমাণ?”
”আপনাকে একজনের সঙ্গে আলাপ করাতে পারি।” আজিজ এক মুহূর্ত থামল, ”আপনি Devil’s advocate কাদের বলে, জানেন?”
”শয়তানের উকিল! না। কী সেটা?”
”সেটা জানতে গেলে এখন অনেক কিছু বলতে হবে।”
”বলো। আমি শুনতেই এসেছি।” রুদ্র বলল। যত দিন এগোচ্ছে, রূপা হত্যা রহস্য যেন ততই জটিল হয়ে উঠছে। কোনটা প্রাসঙ্গিক আর কোনটা অপ্রাসঙ্গিক, তা বোঝার কোনো চিহ্নই খুঁজে পাচ্ছে না ও। তাই সবকিছুকেই এখন খতিয়ে দেখতে হবে।
আজিজ সতীশের দিকে ইশারা করতে সে উঠে কাছের টি স্টলটায় গেল। সেখান থেকে একটা ট্রে-তে করে নিয়ে এল চার কাপ কফি। এই ডিসেম্বরেও রোদের খুব তেজ। ওরা সবাই ঘেমে গিয়েছে।
আজিজ নিজের ব্যাগ থেকে একটা খাতা আর পেন বের করল।
”আগে আপনাদের সংক্ষেপে বুঝিয়ে বলি কয়েকটা শব্দ।”

”এগুলো ক্রিশ্চান ধর্মে কাউকে Saint বা সন্ত উপাধি দেওয়ার আগের প্রসেস। মারা যাওয়ার কমপক্ষে পাঁচ বছর পর আঞ্চলিক বিশপ একটা রিপোর্ট কমিটি তৈরি করেন, যে, যাঁকে সেন্ট করা হবে, তিনি সত্যিই সারাজীবন পবিত্রতার সঙ্গে সেন্টের মতোই কাটিয়েছেন কি না। রিপোর্ট মনোমতো হলে তাঁকে বলা হবে, ‘ঈশ্বরের ভৃত্য’। তারপর দেখা হবে, তাঁর উপাসনা কতটা শক্তিশালী ছিল। তাঁর মাধ্যমে জনসাধারণ কতটা ঈশ্বরের কাছাকাছি পৌঁছোতে পেরেছেন, সেটা হল ভেনারেশন। সেটা পাশ হওয়ার পর বিটিফিকেশন। মৃত্যুর পরেও তাঁর মাধ্যমে কেউ ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছেন, এমন কোনো ‘মিরাকল’-এর খোঁজ পাওয়া গেলে পাশ হবে বিটিফিকেশন। চূড়ান্ত ধাপ হল ক্যানোনাইজেশন। তার জন্য দরকার আরেকটি মিরাকল। এতগুলো ধাপ পাশ করার পর তাঁকে যখন ভ্যাটিকানের পোপ ‘সেন্ট’ উপাধি দেবেন, তার আগে কেউ যদি বিপক্ষে সওয়াল করতে চান, তিনি হলেন ডেভিল’স অ্যাডভোকেট। তিনি সেন্ট হতে যাওয়া মানুষটির কিছু খারাপ দিক কিংবা মিরাকলের বিপক্ষে প্রমাণ পেশ করতে পারেন।”
রুদ্র বাধা দিল, ”এই টোটাল প্রসেসে কত সময় লাগে?”
”ওরকম কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই।” আজিজ হাসল, ”ফ্র্যান্সিস জেভিয়ার মারা যাওয়ার প্রায় পঁচাত্তর বছর পর তাঁর বিটিফিকেশন হয়েছিল। আরও তিন বছর পর ক্যানোনাইজেশন হয়ে তিনি হয়েছিলেন সেন্ট জেভিয়ার। আবার, সেন্ট বেড মারা যান ৭৩৫ সালে, তিনি সেন্ট হন ১৮৯৯ সালে, অর্থাৎ প্রায় ১১০০ বছর পরে।”
”এদিকে, আমাদের মাদার সিসিলিয়া মারা যাওয়ার মাত্র কুড়ি বছরের মধ্যেই ‘সেন্ট’ হয়েছিলেন।” সতীশ এতক্ষণ পর মুখ খুলল, ”মাদার সিসিলিয়াকে যাতে ‘সেন্ট’ না করা হয়, তার জন্য ভ্যাটিকানে ডেভিল’স অ্যাডভোকেট হয়েছিলেন দুজন। প্রথমজন সাংবাদিক ক্রিস্টোয়ার সিচেন্স। আর দ্বিতীয়জন একজন বাঙালি ডাক্তার।” সতীশ বলল।
”বাঙালি?”
”হ্যাঁ। কলকাতার বাঙালি। ড. অরূপেশ চ্যাটার্জি। ওঁরা দুজনেই নানারকম প্রামাণ্য নথি দিয়ে দেখিয়েছিলেন, সিসিলিয়ার সেন্ট হওয়ার জন্য দুটো মিরাকলই লোকমুখে ছড়িয়ে-দেওয়া গুজব। এবং তাঁর আসল কাজ সেবা ছিল না, ছিল গর্ভপাতের বিরোধিতা ও ক্রিশ্চান ধর্মে দীক্ষিত করা। কিন্তু দুজনের কোনো যুক্তিই ভ্যাটিকানের আদালত শোনেনি। মাদার সিসিলিয়া সেন্ট হন ২০২০ সালে।” সতীশ বলল, ”আমরা দুজনে ওই কলাম লিখেছিলাম ড. অরূপেশ চ্যাটার্জির সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রথমজন অর্থাৎ ক্রিস্টোফার সিচেন্স মারা গেছেন। আপনি যদি বলেন, আপনাকে ড. চ্যাটার্জির সঙ্গে আলাপ করাতে পারি।”
”ড. চ্যাটার্জি?” প্রিয়ম কথাটা বলে রুদ্রর কানের কাছে ফিসফিস করল, ”এই ড. চ্যাটার্জির ইমেলের উত্তর দেওয়ার কথাই কি রূপা লিখে রেখেছিল?”
রুদ্র চোখের ইশারায় প্রিয়মকে চুপ করতে বলে সতীশের দিকে তাকাল, ”ড. চ্যাটার্জি কি এখনও বেঁচে আছেন?”
”বহাল তবিয়তে। কলকাতা থেকে ডাক্তারি পাশ করে চলে গিয়েছিলেন লন্ডনে। সেখানেই থাকেন। সারাজীবন তিনি মাদার সিসিলিয়ার এই দিকটা উন্মোচন করার চেষ্টা করে চলেছেন। সারা পৃথিবী ঘুরে অনেক এভিডেন্স জোগাড় করেছেন, বিবিসি-র মতো প্রচুর চ্যানেলে দিয়েছেন ইন্টারভিউ, লিখেছেন বই। কিন্তু, খুব কম মানুষই তাঁর বক্তব্য জানতে পেরেছে। আমাদের কলামে আমরা সেই কাজটাই করছিলাম। উনি লন্ডন থেকে আমাদের সহযোগিতা করছিলেন। কিন্তু গোয়ার ক্যাথলিকদের প্রবল প্রতিবাদে কলামটা মাঝপথে বন্ধ তো হয়ে যায়ই, জার্নালিস্টস’ অ্যাসোসিয়েশন থেকে আমাদের ব্যানও করে দেওয়া হয়।”
”তারপর?”
”আমরা দুজনেই বেকার হয়ে পড়ি। খুব টালমাটাল দিন চলতে থাকে। টুকটাক এদিক-ওদিক কাজ করতে থাকি, কিন্তু মন পড়ে থাকে জার্নালিজমের দিকেই। ওরকম অবস্থায় একটা ইমেল পাই। সেখানে বলা ছিল, একটা নতুন কাগজ খোলা হচ্ছে। সেখানে আমরা সাব-এডিটর হয়ে জয়েন করতে পারি। স্যালারি মাসে আট হাজার টাকা।” সতীশ একটা ঢোঁক গিলল, ”বাড়িতে খুব অভাব। এই লাইনে আমাদের আর কেউ কাজও দেবে না। অন্য কোনো কাজও শিখিনি সেভাবে। সেইজন্য আর দুবার ভাবিনি।”
”বাড়িতে অভাব বলে কোনো কিছু যাচাই না করে এরকম একটা সাসপিশাস কাজে ঢুকে পড়বে? তোমাদের মাইনে কীভাবে হত? কোনো ব্যাঙ্কে?”
”নগদে, ম্যাডাম।” আজিজ অপরাধী মুখে তাকাল, ”যে প্রেস থেকে আমাদের কাগজটা ছাপা হয়, সেই প্রেস মালিকের কাছ থেকে রসিদে সই করে প্রতিমাসের এক তারিখে নিয়ে আসি। আমাদের বলা হয়েছিল, মালিক বিদেশে থাকেন।”
”মালিক মানে কি এডিটর? যার নামের জায়গায় একটা সবুজ পাতা আঁকা?”
”সেটাও ঠিক জানি না। তবে, আমাদের কাছে যা নির্দেশ আসত, এডিটরের থেকেই আসত। এডিটর বলে দিতেন, কে কোন লেখা ইমেল করবে, সেটা কোনখানে ছাপতে হবে।”
”অফিস কোথায় তোমাদের?”
সতীশ এক মুহূর্ত থমকে বলল, ”পানাজিতে একটা গ্যারাজঘরে।”
”তোমরা ছাড়া সেখানে আর কে আছে?”
”আর কেউ নেই। একটা ছেলে সকালে আসে, ঘরদোর ঝাঁট দেয়, চলে যায়।”
”মার্তণ্ডর সঙ্গে যোগাযোগ হল কীভাবে?”
আজিজ বলল, ”আট-দশ মাস আগে এডিটরই ইমেলে নির্দেশ দেন। ওর ফোন নম্বর দেন। গোয়া ইনকুইজিশন নিয়ে লেখার প্রস্তাব দিতে হবে, সেটাও বলে দেন। আমরা তখন যোগাযোগ করি।”
”অন্য লেখকদের বেলায়ও কি তোমরাই যোগাযোগ করো?”
”না ম্যাডাম। বাকি সব লেখকের সঙ্গে আগে থেকে এডিটরের কথা হয়েই থাকে। ওঁরা সরাসরি লেখা পাঠান।”
রুদ্র একটা নিশ্বাস ফেলল, ”আবারও জিজ্ঞেস করছি। কাগজে আরেকটা ধারাবাহিক কলাম বেরোচ্ছে। গোয়ায় বেড়ে-চলা সেক্স র্যাকেট আর শিশুপাচার নিয়ে। ওটা কে লিখছে?”
আজিজ আর সতীশ মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, ”ওটা আমরা জানি না।”
”রূপা নেইলসন বলে যে বিদেশিনি খুন হয়েছেন, তার পেছনে কি তোমাদের হাত রয়েছে?” রুদ্র সোজা ব্যাট চালাল। এতে অনেক সময় অপরাধীর চোখে-মুখে সত্যিটা ফুটে ওঠে।
কিন্তু সতীশ আর আজিজের মুখ ভয়ে কালো হয়ে গেল, ”আমরা এসব কিচ্ছু জানি না, আপনি বিশ্বাস করুন!”
”মিথ্যে কথা বলছ?”
”মা কসম! আমরা শুধু প্রোডাকশন দেখি।” সতীশ ছটফটিয়ে উঠল, ”লেখকরা শুধুমাত্র এডিটরেরর সঙ্গেই যোগাযোগ রাখেন।”
”কোন প্রেসে ছাপা হয় কাগজটা?”
”পানাজিতেই। রয়্যাল ক্যাসিনোর পাশের গলিতে। ব্লু মুন প্রিন্টারস।” আজিজ বলল, ”মালিক শাকিল আহমেদ। আমরা ওখান থেকেই মাইনে নিয়ে আসি।”
সতীশ আর আজিজ চলে গেল একটু পরে। মার্তণ্ডকে খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। উসখুস করতে করতে একসময় সে বলেই ফেলল, ”আমি সত্যিই খারাপ কোনো কিছুর সঙ্গে জড়িত নই। আমার ধর্মের প্রতি আগ্রহ থেকেই।”
”আমায় কিছু বোঝাতে হবে না, মার্তণ্ড।” রুদ্র মন দিয়ে ব্যাসিলিকার বাইরের ভাস্কর্য দেখছিল, ”তুমি যদি আর একটাও কিছু গোপন করো, সেটা তোমার পক্ষে খুব একটা ভালো হবে না।”
মার্তণ্ড বলল, ”আমি কিছু গোপন করব না। বলুন, কী জানতে চান।”
”আপাতত তুমি সতীশ আর আজিজের ইমেল আইডি, ওই কাগজের ইমেল আইডিগুলো আমায় দাও।”
”এখুনি মেসেজ করছি আপনাকে।”
”রূপা নেইলসনের সঙ্গে মি. দুয়ার্তের কীসের যোগাযোগ ছিল?”
”আমি সত্যিই জানি না!” মার্তণ্ডকে অসহায় দেখাচ্ছিল, ”ফাদার দুয়ার্তের সঙ্গে আমার শুধুমাত্র এইসব ইতিহাস আর ধর্ম নিয়ে আলোচনা হয়।”
”জানো না, কিন্তু জানতে হবে। দুয়ার্তের কাছ থেকে পুরোটা জেনে তুমি আমায় বলবে।” রুদ্র মার্তণ্ডর দিকে তাকাল, ”আপাতত শংকরকে আমি কিছু বলছি না। আর আজ বিকেলের মধ্যে তুমি আমায় ওই ‘দ্য ডার্ক হোয়াইট-এর প্রতিটা মাসের কপি দেবে।”
মার্তণ্ড চলে যেতে রুদ্র শংকরকে ফোন করল, ”তুই কোথায়?”
”মিটিং-এ ঢুকব ডি.জি. স্যারের রুমে। কিছু দরকার?”
”তোকে কয়েকটা ইমেল অ্যাড্রেস পাঠাচ্ছি। সেগুলো শেষ কোন লোকেশন থেকে অ্যাকসেস করা হয়েছে, সেটা ট্র্যাক করতে হবে।”
শংকরের সঙ্গে কথা শেষ হতে রুদ্র দেখল, প্রিয়ম ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। রুদ্র খানিকটা জবাবদিহির ভঙ্গিতে বলে উঠল, ”তোমার আবার রাগ হয়ে গেল? ভোর থেকে বেরিয়ে এতগুলো জায়গা তো ঘুরলাম! যার কাছে রয়েছি, তাকে একটু বিপদে সাহায্য করব না?”
প্রিয়ম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ”তুমি কি একটা জিনিস খেয়াল করেছ?”
”কী?”
”সতীশ আর আজিজ দুজনে একই ধরনের ঘড়ি পরেছিল। কালো প্লাস্টিকের ব্যান্ড আর সাদা রঙের গোল ডায়াল। কিছু লেখা নেই।” প্রিয়ম একটা নিঃশ্বাস ফেলল, ”ওই একই ঘড়ি সেদিন পরেছিল বিচের ওই ভলিবল প্লেয়ার দুই ভাই। রিকি মিশ্র-ভিকি মিশ্র।”
”কী! দ্য ডার্ক হোয়াইট!” রুদ্র চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, ”তুমি শিয়োর?”
”দু-শো পারসেন্ট! ছেলে দুটো খালি গায়ে ছিল বলে আরও বেশি করে মনে আছে।”
”ওরা কি তাহলে ওই কাগজের সঙ্গে যুক্ত? নাকি এও হতে পারে, কেউ ওদের গিফট করেছে?”
”হতেই পারে।” প্রিয়ম কাঁধ ঝাঁকাল, ”আবার না-ও হতে পারে।”
”আমি এখুনি শংকরকে বলছি!” রুদ্র একটা গাছের তলায় ছায়া দেখে বসে পড়ল। তারপর ব্যাগ থেকে একটা নোটবুক বের করে দ্রুতগতিতে লিখতে লাগল।
১। রূপা ও রকি মহাবংশীর বাড়ি ছিল বেতুল গ্রামে, যা মারগাঁও থেকে ঘণ্টাখানেকের রাস্তা। মান্ডু মহাবংশী ২০০০ সালে তাদের মারগাঁওয়ের সেন্ট মারিয়া অরফ্যানেজে দিয়ে যায়। রূপা, রকির মা বেঁচে থাকা সত্ত্বেও মান্ডু এই কাজ করল কেন? মান্ডু কে হয় ওদের? মান্ডুর স্ত্রী-র বয়ান, মান্ডুর বাড়ির প্রতিবেশীদের বয়ান নিতে হবে।
২। রেজিস্টারের ওই একই পৃষ্ঠায় বাকি দুটো শিশুও বিদেশে দত্তক হিসেবে গিয়েছে ব্রাইট ফিউচার ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সির থ্রু দিয়ে। ওই এজেন্সির সঙ্গে কি সেন্ট মারিয়া অরফ্যানেজের কোনো আর্থিক লেনদেন আছে? অরফ্যানেজের অ্যাকাউন্টস খুঁটিয়ে দেখতে হবে। মালিক মার্থা অ্যান্ড্রুজকে জেরা করতে হবে।
৩। রকি নামধারী সেন্ট মারিয়া অরফ্যানেজের ম্যানেজারটি নিজেকে রূপার ভাই বলে দাবি করছে কেন? আসল রকি মহাবংশী কোথায় গেল? রকি ও রূপার ডি. এন. এ. প্রোফাইল ম্যাচিং-এর পর এই বিষয়ে এগোতে হবে।
৪। রূপা নেইলসন ভারতে এলে ওঠে দুয়ার্তের গুড রিটার্ন অরফ্যানেজে। আগেও সে যতবার এসেছে, ওই আশ্রমেই উঠেছে। কেন? রূপার সঙ্গে দুয়ার্তের কী সম্পর্ক ছিল?
৫। ভিকি মিশ্র ও রিকি মিশ্র কি ‘দ্য ডার্ক হোয়াইট’-এর হয়ে কাজ করে? ওরা কি রূপার অন্তর্ধান সম্বন্ধে আগে থেকেই জানত?
৬। রূপা নিখোঁজ হয় ১ ডিসেম্বর। তার মৃতদেহ উদ্ধার হয় ৮ ডিসেম্বর। এই এক সপ্তাহ সে মারগাঁওয়ে সেন্ট মারিয়া অরফ্যানেজে যায়নি। তবে কোথায় ছিল?
৭। ড. অরূপেশ চ্যাটার্জি। মাদার সিসিলিয়াকে সেন্ট দেওয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সেই ডেভিল’স অ্যাডভোকেট। এঁর সঙ্গে কি রূপার কোনো যোগাযোগ আছে? রূপা নিজের ডায়েরিতে লিখে রেখেছিল, ড. চ্যাটার্জির মেলের উত্তর দিতে হবে। সেই ড. চ্যাটার্জি আর ইনি কি এক? ড. চ্যাটার্জির সঙ্গে যোগাযোগ করতে করতে হবে যত দ্রুত সম্ভব।
প্রিয়ম চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল। রুদ্র সব ক-টা পয়েন্ট গুছিয়ে লেখার পর ১ থেকে ৬ পয়েন্টের To do listটা বসে বসে ফোনে টাইপ করল, তারপর পাঠিয়ে দিল শংকরকে।
কয়েক মিনিট মাত্র। শংকর ঘুরিয়ে ফোন করল রুদ্রকে। তরল গলায় বলল, ”তুই তো কাজে ডুবে গেছিস রে। প্রিয়ম রেগে যাচ্ছে না?”
”রাগলে আর কী করা যাবে!”
”শোন, ডি. এন. এ. স্যাম্পলিং-এর রিপোর্ট এসেছে এইমাত্র। সেন্ট মারিয়া অরফ্যানেজের ওই রকি বলে দাবি করা ম্যানেজারের সঙ্গে রূপা নেইলসনের ডি. এন. এ. ম্যাচ করছে না।”
”গ্রেট। যা গেস করেছিলাম। আর রিকি-ভিকি বলে ছেলে দুটোর রিপোর্ট?”
”না। ওদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেলেনি ডেডবডিতে। অরফ্যানেজের ওই ম্যানেজারকে অ্যারেস্ট করা হচ্ছে। রাতের দিকে কাস্টডিতে নেব। এখন ঘণ্টা দুয়েক সময় ফাঁকা আছি। একবার কি সিংকেরিম বিচ থেকে ঘুরে আসবি?”
”হঠাৎ সিংকেরিম বিচ!” রুদ্র অবাক হল।
”আসলে…” শংকরের দ্বিধাগ্রস্ত গলা শোনা গেল, ”মা ফোনে এত কান্নাকাটি করছে, ভাবছি বাবাকে একবার গিয়ে সরাসরি অনুরোধ করব। তোদের সঙ্গেও দেখা হবে।”
”হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আমরা চলে যাচ্ছি ওখানে। তুইও আয়।”
রুদ্র ফোন রাখতেই প্রিয়ম বলল, ”তুমি তো দেখছি এই কেসের পুরোদস্তুর ইনভেস্টিগেশন অফিসার হয়ে গেলে!”
”মোটেই না। অনেক সময় সিস্টেমের ভেতরে বসে যা চোখে পড়ে না, বাইরে থেকে সেটা বোঝা যায়। আমি সেটুকুই করেছি। আসল কাজ যা করার শংকরের টিমই করছে। এখন দ্য মিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন ইজ, রূপার আসল ভাই রকি— সে কোথায় গেল? রূপা কি মৃত্যুর আগে বুঝে ফেলেছিল, অরফ্যানেজের ওই ম্যানেজার ওর ভাই নয়? সেইজন্যই কি ওকে মরতে হল?” রুদ্র চুপচাপ খাতায় আঁচড় কাটছিল।
প্রিয়ম চুপ করে বসে রুদ্রর আঁকিবুকি দেখল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, ”এত কিছু ওকে বললে, আর ‘দ্য ডার্ক হোয়াইট’-এর সঙ্গে যে মার্তণ্ডও জড়িত, সেটা কেন বলছ না?”
”মার্তণ্ড আমার কাজের বোড়ে।”
”বোড়ে? মানে দাবা খেলার সৈন্য?”
”হ্যাঁ। ওকে দিয়ে অনেক কিছু জানতে হবে। আগেই ওকে এক্সপোজ করে দিলে ও মুখ খুলবে কেন!” রুদ্র বলল, ”আর তা ছাড়া ওর আদৌ কোনো ক্রিমিনাল মোটিভ ছিল নাকি শুধুমাত্র নিজের ধর্ম সম্পর্কে আগ্রহের কারণে কাগজটার সঙ্গে অ্যাসোসিয়েটেড হয়েছিল, সেটা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে শংকরকে কিছু বলাটা ঠিক নয়। বেচারার চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে।”
”কিন্তু তুমি কি ক্রমশই খেই হারিয়ে ফেলছ না? রূপা নেইলসন খুন হয়েছে, তুমি চলে যাচ্ছ ‘দ্য ডার্ক হোয়াইট’ কাগজে।”
”চলে যেতাম না।” রুদ্র উদাস চোখে তাকাল ব্যাসিলিকার খয়েরি চূড়ার দিকে, যার নীচে শায়িত আছেন সেন্ট জেভিয়ার, ”যদি না রূপা নেইলসনের গেস্ট রুমের রান্নাঘরে যেতাম।”
”মানে?”
”কোথাও কয়েকদিনের জন্য রান্নাবান্না করতে হলে লোকজন নুন চিনি মশলাপাতি কিনে ছোটোছোটো কাগজে মুড়ে রাখে।”
”হ্যাঁ, তো সমস্যাটা কী?”
”রূপা নেইলসনের রান্নার সেই কাগজের টুকরোগুলো ছিল ‘দ্য ডার্ক হোয়াইট’-এর। রূপা একজন বিদেশিনি, সে একটা আঞ্চলিক ছোটো কাগজ ঘরে রাখবে কেন? এটা কি অদ্ভুত নয়?”
”দুয়ার্তে যখন কাগজটা নিয়মিত পড়তেন, গেস্ট হাউসে থাকতেই পারে।”
”তা পারে!” রুদ্র একটা নিশ্বাস ফেলল, ”কী একটা মনের মধ্যে খচখচ করছে। যাক গে। চলো।”
”মারগাঁও কমিশনারেট?”
”সেখানে তো যাব। তার আগে একবার শংকরের বাবার সঙ্গে দেখা করে আসি, শংকর বলল। সিংকেরিম বিচটাও ঘোরা হয়ে যাবে।”
১৮
উজ্জ্বল নীল আর সাদা রঙের একখানা একতলা বাড়ি। বেশ বড়ো জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাড়িটার বিশেষত্ব হল, মাথাটা ছুঁচোলো হয়ে উঠে গেছে অনেকখানি, খাঁজকাটা টালি দিয়ে বানানো ছাদটাও একই রকম ছুঁচোলো হয়ে বাড়ির চূড়াকে সংগত করেছে। বাইরে বোগেনভেলিয়া পাতায় মোড়ানো ছোট্ট হলুদ গেট। গেটের দু-পাশে হলুদ পাঁচিল। সেখানে বাহারি হরফে লেখা, ‘Bobby O Ganjalvej.’
বাড়িটার গায়ে ছোটো ছোটো ঝাঁজরি-কাটা নীল রঙের জানলা। একদম বাইরের দরজায় ঝুলছে একটা ইলেকট্রিক লম্ফ। বাগানে ছড়িয়ে-থাকা সবুজ গাছগুলো বাড়িটার সৌন্দর্যকে আরও বর্ধিত করেছে। ভেতরে ঢুকে প্রকাণ্ড হলের মতো ড্রয়িং। একপাশে ছোট্ট একটা উপাসনাগৃহ, যাকে বলে মিনি চ্যাপেল।
রুদ্র মুগ্ধ হয়ে চারপাশ দেখছিল। কাঠের কারুকাজ-করা সোফায় বসে বলেই ফেলল, ”কী সুন্দর বাড়িটা রে, শংকর!”
প্রিয়ম বলল, ”খাঁটি পর্তুগীজ বাড়ি। কিন্তু এগুলো কি এখন আর তৈরি হয়?”
”না।” শংকর মাথা নাড়ল, ”এটা প্রায় দেড়শো বছরের পুরোনো বাড়ি। ১৯৬১ সালে গোয়া পোর্তুগিজ শাসন থেকে মুক্ত হয়। তারপর থেকে অনেকেই বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে স্বদেশে ফিরে যেতে থাকে। হাতবদল হয়ে হয়ে এই বাড়িটা কেনেন আমার বাবা।”
ডাইনিং-এ চারখানা বড়ো বড়ো জানলা। দক্ষিণের জানলা দুটোর ওপারে দেখা যাচ্ছে সমুদ্রতটের নারকেল গাছের সারি। পড়ন্ত বিকেলে সিংকেরিম বিচের ঠান্ডা হাওয়া দখিন-খোলা জানলা দিয়ে ঢুকে জুড়িয়ে দিচ্ছে সবাইকে।
ঘড়িতে বিকেল সাড়ে চারটে। গোয়ায় কাঁটায় কাঁটায় তিনটেয় সব রেস্তরাঁ বন্ধ হয়ে যায়। আবার খোলে সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ। সেই হিসেব করেই এসেছে ওরা, যাতে শংকরের বাবা কিছুক্ষণ সময় দিতে পারেন। তাঁর রেস্তরাঁ বাড়ি থেকে হাঁটা-দূরত্বে, বাড়ি ফিরে তিনি ভেতরে লাঞ্চ সারছেন।
মি. ববি গঞ্জালভেজ ডাইনিং-এ ঢুকলেন পাক্কা আধ ঘণ্টা পর। শংকরের সঙ্গে চেহারায় একেবারেই মিল নেই। তাঁকে দেখলেই বোঝা যায়, শরীরে বইছে ইয়োরোপীয় রক্ত। লালচে ফরসা গাত্রবর্ণ, উচ্চতা প্রায় ছ-ফুটের কাছাকাছি। বয়স সত্তরের কাছাকাছি হলেও শক্ত দোহারা গড়ন। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, মাথায় টাক। শংকর তার বাঙালি মায়ের চেহারা পেয়েছে।
ববি গঞ্জালভেজ পরিষ্কার বাংলায় রুদ্র ও প্রিয়মের সঙ্গে প্রাথমিক আলাপচারিতা সারলেন। তারপর ডাইনিং-এর একপাশের কাচের আলমারির দিকে এগিয়ে গেলেন, ”হুইস্কি না ভদকা?”
”কোনোটাই নয়।” রুদ্র স্মিত হাসল, ”আমরা দুজনেই টিটোটেলার। স্মোক, ড্রিংক কিছুই চলে না।”
”সেকী!” ববি গঞ্জালভেজের ভ্রূদুটো কৃত্রিম বিস্ময়ে কিছুটা ওপরে উঠে গেল, ”গোয়ায় এসে এ রসে বঞ্চিত হলে চলে নাকি! বেশ। ড্রিঙ্ক না করো, কিন্তু ফেনি তো খেতেই হবে।”
”ফেনি?”
রুদ্রর প্রশ্নের উত্তর ববি গঞ্জালভেজ দেওয়ার আগেই প্রিয়ম বলে উঠল, ”গোয়ার লোকাল অ্যালকোহল। হ্যাঁ স্যার, ফেনি তো টেস্ট করবই।”
”ভেরি গুড।” ববি খুশি হয়ে উঠলেন, ”দু-ধরনের ফেনি এখানে পাওয়া যায়। কাজু গাছের ফেনি আর নারকেল গাছের। তোমাদের জন্য কাজুটাই আনাই।”
ববি গঞ্জালভেজ ফোনে সম্ভবত নিজের রেস্তরাঁর শেফকে অর্ডার দিতে লাগলেন। রুদ্র লক্ষ করল, শংকর এখনও অবধি একটাও কথা বলেনি। একটু আড়ষ্টভাবে বসে রয়েছে চেয়ারে।
রুদ্রর মনে পড়ল, শংকর ট্রেনিং-এর সময় বলত, ওর শৈশব কৈশোর যৌবন জুড়ে রয়েছেন মা। সেই সময় নাকি ওর বাবা কোনো খোঁজও নেননি। শংকরের মনে বাবার সম্পর্কে জমা হয়ে আছে তীব্র অভিমানবোধ। অথচ কী আশ্চর্য, ট্রেনিং শেষে তদবির করে ও নিজেই গোয়া ক্যাডার বেছে নিয়েছিল। তারপর এখানে এসে নিজে থেকেই বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, মাঝে মাঝে আসে। সত্যিই আশ্চর্য। সেইজন্যই বোধহয় মানবচরিত্রের বিশ্লেষণ অত স্থূলভাবে করা যায় না।
‘ফেনি’কে যতই স্থানীয় মদ হিসেবে গৌরবান্বিত করা হোক, খেতে আর পাঁচটা অ্যালকোহলের মতোই। রুদ্র আর প্রিয়মের যত অমিলই থাকুক, এই একটা বিষয়ে ওদের অদ্ভুত মিল। দুজনের কেউ অ্যালকোহলের স্বাদটাই পছন্দ করতে পারে না। কোনো ছুঁতমার্গ থেকে নয়, খেতে ভালো লাগে না বলেই ওরা খায় না। দুজনেই দু-ঢোঁক করে গিলে তেতো মুখে গ্লাস নামিয়ে রাখল।
শংকর মৃদু গলাখাঁকারি দিয়ে শুরু করল, ”বলছিলাম, আপনি কি একবার কলকাতায় যেতে পারবেন?”
”কলকাতায়? এখন?” ববি গঞ্জালেজ বেশ অবাক হলেন।
”হ্যাঁ।” শংকরের মুখ কালো হয়ে এল, ”মায়ের শরীরটা একেবারেই ভালো নেই। উনি আপনাকে একবার দেখতে চাইছেন। শেষবারের মতো।”
”ওহো! কিছুদিন আগে বললে হত, কিন্তু আমি তো পরশু দিন সকালে প্যারিস চলে যাচ্ছি।”
”প্যারিস?”
”হ্যাঁ। আমার ছেলের কাছে থাকব কয়েক মাস।” ববি গঞ্জালভেজ সোফায় হেলান দিলেন, ”তারপর? রূপা নেইলসনের মার্ডারটার কোনো কিনারা হল? কাগজে তো এখন আর অন্য কোনো হেডলাইন নেই।”
”ওই এগোচ্ছে।” শংকর চুপ করে গেল।
”দুয়ার্তে কী বলছে?”
”কিছুই বলছেন না। উনি কোনো সহযোগিতা করছেন না।”
রুদ্র এবার অবাক, ”আপনি দুয়ার্তেকে চেনেন?”
ববি গঞ্জালভেজ হাসলেন, ”আটের দশকে কলকাতায় চাকরি করতাম। বিয়ের আগে অবধি থাকতাম রিপন স্ট্রিটের একটা মেসে। সেটা ছিল মূলত অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের ডেরা। আমরা সবাই ছিলাম রেঞ্জারস ক্লাবের মেম্বার। রেঞ্জারস ক্লাব কী, তা জানো?”
রুদ্র, প্রিয়ম আর শংকর মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। কেউ এই ক্লাবের নাম শোনেনি।
”কলকাতায় অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কমিউনিটির ক্লাব। একশো বছরেরও বেশি পুরোনো। প্রথমদিকে শুধু অ্যাংলোরাই ছিল, পরে আমাদের মতো খিচুড়িরাও ঢুকেছিল। রেঞ্জারস ক্লাব ফুটবল, ক্রিকেট, আরও অনেক কিছু খেলত। আমরা প্রায় প্রতিদিন অফিস শেষে আড্ডা মারতে ঢুঁ মারতাম। দুয়ার্তেও আসত। ও তখন এক মিশনারি ফাউন্ডেশনের স্টাফ।”
”কোন মিশনারি ফাউন্ডেশন? মিশনারিজ অফ ডিভিনিটি?”
ববি গঞ্জালেজ একটু থমকালেন, ”হ্যাঁ।”
রুদ্র আর শংকর নিজেদের মধ্যে দৃষ্টিবিনিময় করল।
”দুয়ার্তে প্রথমে কয়েক বছর ছিল গোয়া ব্রাঞ্চে, পরে চলে যায় কলকাতায়। বাংলা তো দূর, ইংরেজিও ভালো বলতে পারে না। সেসময় আমাকেই ও একমাত্র স্বজাতি পেয়েছিল। বন্ধুত্ব বেশ জমে উঠেছিল।”
”সেটা কোন সাল?”
”উমম।” ববি গঞ্জালভেজ মনে করার চেষ্টা করলেন, ”ছিয়াশি সাল হবে প্রোব্যাবলি। প্রোব্যাবলি নয়, ছিয়াশিই। কারণ তার দু-বছর পর আমি বিয়ে করি, ততদিনে ওকে আবার গোয়ায় ফিরে আসতে হয়েছে।”
”গোয়ায় ফিরে আসতে হয়েছিল কেন?” শংকর জানতে চাইল, ”ওই ফাউন্ডেশনের কি ট্রান্সফারের পলিসি ছিল?”
”ওদের কী পলিসি আছে, তা আমি জানি না।” ববি গঞ্জালভেজ মাথা নাড়লেন, ”তবে দুয়ার্তে ট্রান্সফার হয়নি, ওকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।”
”কেন?”
ববি কাঁধ ঝাঁকালেন, ”নো আইডিয়া! তেমন ঘনিষ্ঠতা তো ছিল না। রেঞ্জারস ক্লাবে একসঙ্গে হুইস্কি খেতাম। আমি জানতামও না ও গোয়ায় এসেছে। পানাজিতে একদিন হঠাৎ দেখা হয়েছিল। তারপর ওর বিভিন্ন লেখা, মতামত পড়তাম টুকটাক কাগজে। এই ছ-মাস আগে আবার দেখা হয়েছিল ক্যালেন্ডুলা বিচের লা ভাস্কোনিয়াতে।”
”লা ভাস্কোনিয়া? মানে, যে রেস্তরাঁর মালিক মারা গেল?” শংকর জিজ্ঞেস করল।
”হ্যাঁ। টোবিয়াস মুলার আমার বন্ধু ছিল। নর্থ গোয়ার সব রেস্তরাঁ মালিকদের একটা ক্লাব আছে মাপুসাতে, সেখানে প্রতি রবিবার আমরা স্নুকার্স খেলতাম।” ববি গঞ্জালভেজ একটা লম্বা নিশ্বাস ফেললেন, ”ও মারা যাওয়ার আগের রাতেও খেলেছি। বেচারা টোবিয়াস বিয়ে-থা করেনি, মাঝখান থেকে অত ভালো রেস্তরাঁটা বন্ধ হয়ে গেল।” ববি গঞ্জালভেজ মাথা দোলালেন।
”আপনার রেস্তরাঁয় কি শুধু পোর্তুগিজ খাবারই পাওয়া যায়?” আচমকা প্রসঙ্গ পালটে জিজ্ঞেস করল রুদ্র।
”না না। সবকিছুই রাখতে হয়। থাই, ইন্ডিয়ান, কন্টিনেন্টাল। না হলে চলবে কী করে! তবে পোর্তুগিজ ডিশের জন্য আমার স্পেশ্যাল শেফ রয়েছে, দিয়েগো। আমার রেস্তরাঁর নামও কোমিদা হারমোসা। পোর্তুগিজ ভাষায় যাকে বলে সুন্দর খাবার।” ববি হাসলেন, ”আজ ডিনারে আশা করি হতাশ হবে না!”
”আমরা আজ ডিনার করতে পারব না।” এবার গলাখাঁকারি দিয়ে বলল শংকর, ”এখুনি বেরোতে হবে। জরুরি কাজ ফেলে এসেছি।”
”ওহ! মাই ব্যাড।” কাঁধ ঝাকিয়ে বললেন ববি গঞ্জালভেজ, ”তবে আরেকদিন এসো। গুডবাই!”
মি. গঞ্জালভেজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওরা সমুদ্রের পাড়ে হাঁটতে লাগল। আজ পূর্ণিমা। সন্ধ্যাবেলায় পূর্ণগর্ভা চাঁদের ঝকঝকে আলো ভিজিয়ে দিচ্ছে সবাইকে। গাড়ি থাকতেও ওরা ইচ্ছে করেই সমুদ্রের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল।
দশ-মিনিট হাঁটার পর সমুদ্রের ঢেউগুলোতে চাঁদের আলো পিছলে যাওয়া দেখতে দেখতে রুদ্র বলল, ”তোর বাবা কিন্তু বেশ আমুদে মানুষ, শংকর!”
”আমুদে তো বটেই! না হলে দেড় বছরের ছেলে আর স্ত্রী-কে ফেলে কেউ গোয়ায় এসে নতুন সংসার পাতে?” শংকরের গলা থেকে প্রতিটা শব্দে শ্লেষ ঝরে পড়ল।
”দেখ, তুই মা-র ইচ্ছের কথা বলা সত্ত্বেও উনি যেভাবে বিষয়টাকে এড়িয়ে গেলেন, ওটা সত্যিই খারাপ লেগেছে। তবে কে কোন পরিস্থিতিতে কী করেন, বা করতে বাধ্য হন সেটা হয়তো আমরা বুঝব না, তা-ই না!” রুদ্র একটু ইতস্তত করে বলেই ফেলল, ”এই যেমন, তোর যে বাবার প্রতি একটা অসম্ভব রাগ, তবু যে তুই নিজে ইচ্ছে করে গোয়াতে পোস্টিং নিয়েছিলি, তা তো আমরা সবাই জানি!”
শংকর কোনো উত্তর দিল না। ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ ওদের সবার কানে বাজছিল। ববি গঞ্জালভেজ একটু আগে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন রেস্তরাঁর দিকে। ওরা ইচ্ছে করেই হাঁটছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর রুদ্র মুখ খুলল, ”কিছু যদি মনে না করিস, মি. গঞ্জালভেজের দ্বিতীয় স্ত্রী কবে মারা গেছেন?”
”শুনেছি চার বছর আগে। ঠিক যে সময় আমার মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে।” শংকরের গলাটা একটু কেঁপে গেল, ”জানিস রুদ্র, ভেবেছিলাম, জীবন তো একটাই। মা সারাজীবন অপরিসীম দুঃখ পেয়েছেন। স্কুলে পড়িয়ে আমাকে মানুষ করেছেন। অথচ অত প্রতিকূল সময়েও কখনো বাবার প্রতি বিরূপ মন্তব্য করেননি। বলতেন, সবই নিয়তি। যে সময়ে আমি ভালো চাকরি পেয়েছি, মা-রও ক্যান্সার ধরা পড়েছে। বাবার প্রতি আমার রাগ, ক্ষোভ কিছুই নেই। শুধু একটু অনুনয় আছে। বাবাও তো এখন একা, মা-ও তা-ই। শেষ বয়সে যদি বাবা একটু মায়ের কাছে যেতেন, একটু ভালো কথা বলতেন, মা হয়তো শান্তিতে চোখ বুজতে পারতেন।”
রুদ্র চুপ করে রইল।
শংকর বলল, ”কিন্তু ওই! বাবার কোনো তাপ-উত্তাপ নেই। প্রতিবেশীর মতো সমবেদনা প্রকাশ করেছেন। ওইটুকু। দেখলি না, কেমন বলে দিল, প্যারিসে আমার ছেলের কাছে যাব।” শংকর শ্লেষাত্মক হাসল, ”আর আমি কে? আমি কি বানের জলে ভেসে এসেছি যে একবার কাজ আছে বলতেই আমায় ‘গুডবাই’ বলে দেওয়া যায়?”
”শান্ত হও শংকর!” প্রিয়ম শংকরের পিঠে হাত দিল।
”শান্তই আছি। মারগাঁওয়ে থাকার মেয়াদ তো ফুরিয়েই এল। এত কিছুর পর হয়তো এক সপ্তাহের মধ্যে আমায় সাউথ গোয়ায় ট্রান্সফার করবে।” শংকর ঢোঁক গিলল, ”তার আগে নির্লজ্জের মতো আবারও একবার বলে দেখব। মা আজও বাবাকে ভালোবাসেন। বাবা ফিরে এসে একবার গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে… অবশ্য ততদিন যদি মা থাকেন!”
গাড়ির কাছাকাছি এসে রুদ্র বলল, ”তুই অফিসে যা। আমরা একটু পরে আসছি।”
”এদিকে কোথায় ঘুরবি?”
”এই একটু এদিক-ওদিক!” রুদ্র হাসল, ”ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে কমিশনারেটে চলে যাব। তুই বেরিয়ে যা। আমরা চলে যাব।”
শংকরের গাড়ি অদৃশ্য হয়ে যেতে রুদ্র প্রিয়মের দিকে তাকাল, ”একবার ভাগাতোরে যাব এখন। চলো।”
”ভাগাতোর? সে তো আমাদের ওখানে। এখন কেন?”
”চলোই-না! একটা জায়গায় তোমায় ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।”
১৯
রুদ্র আর প্রিয়ম যখন গুড রিটার্ন দুয়ার্তে হোমে ঢুকল, তখন বিকেলের রোদ পড়ে এসেছে। রুদ্র আগেই মার্তণ্ডকে ফোন করে দিয়েছিল, সে দাঁড়িয়ে ছিল একটু দূরে। হাতে একটা মোটা ফাইল। ‘দ্য ডার্ক হোয়াইট’ কাগজের সব ক-টা সংখ্যা। ওদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে বলল, ”আমার খুব নার্ভাস লাগছে, ম্যাডাম!”
”এত তাড়াতাড়ি সব ইস্যু কোথা থেকে পেলে?” রুদ্র ফাইলটা দ্রুত নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল।
”আমার বাড়িতেই ছিল। জমাতাম।” মার্তণ্ড অস্থির হয়ে উঠছিল, ”আপনার কি এখন সত্যিই এখানে ঢোকার দরকার আছে? ফাদার যদি আমায় ভুল বোঝেন!”
”ওঁর নিজের কাজে কোনো ভুল না হয়ে থাকলে ভুল বুঝবেন না।” রুদ্র এগিয়ে এসে মার্তণ্ডর কাঁধ চাপড়ে দিল, ”ভয় পেয়ো না। আমি তোমার খারাপ চাই না ভাই। এসো আমার সঙ্গে।”
আশ্রমের গেটে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। মার্তণ্ড বলল, ”ফাদার কি নিজের ঘরে রয়েছেন? একটু দাঁড়ালে বোধহয় কাউকে দেখতে পাব।”
রুদ্র দাঁড়াল না। সোজা ঢুকে অফিসঘরের পাশ দিয়ে চলে গেল পেছনদিকের ব্যালকনিতে। বাধ্য হয়ে প্রিয়ম আর মার্তণ্ড ওকে অনুসরণ করল। কিন্তু সেখানে দুয়ার্তে নেই।
ব্যালকনি-লাগোয়া যে ঘর, সেখানেই কি দুয়ার্তে থাকেন? রুদ্র এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল, হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হল একটা লম্বা-চওড়া লোক। তার চোখে রাগ আর বিস্ময় একসঙ্গে খেলা করছে। রুক্ষস্বরে হিন্দিতে বলল, ”কী চাই?”
মার্তণ্ড ফিসফিস করল, ”জিমি।”
”যা চাই, নিয়ে নেব।” রুদ্র কথাটা বলে অপেক্ষা করল না, দ্রুত এগোতে লাগল পাশের বাড়ির দিকে। জিমি বাধা দেওয়ার আগেই সোজা সিঁড়ির ধাপ বেয়ে উঠে গেল সামনের ঘরে।
মার্তণ্ড পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিল, ”কিছু না, জিমি। উনি একটু ফাদারের সঙ্গে কথা বলবেন।”
এটা একটা উপাসনাগৃহ। কয়েকটা বাচ্চা ছেলে বসে আছে। একেবারে সামনেই বড়োবড়ো চোখ মেলে সেবাস্টিয়ান তাকিয়ে। দুয়ার্তে দরজার দিকে পেছন করে বসে হাতে বাইবেল নিয়ে নিচুস্বরে কিছু পড়ছিলেন, রুদ্রর আকস্মিক আবির্ভাবে বিস্মিত হয়ে চোখ তুলে তাকালেন।
”আপনি তো রূপাকে ব্লগে ক্রিশ্চান ধর্মের খারাপ দিকগুলো তুলে ধরতে উৎসাহ দিতেন। আপনার মতো খ্রিস্টধর্মের ঘোর বিরোধীর হাতে বাইবেল কেন?” রুদ্র কৌতুক মাখা গলায় বলল।
”মূর্খের মতো কথা বোলো না।” দুয়ার্তে শান্ত হাসলেন, ”ক্যাথলিক গোঁড়ামির খারাপ দিকগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা মানেই সে অ-ক্রিশ্চান, এ কথা কে বলল তোমায়? প্রোটেস্ট্যান্টদের নাম শোনোনি?”
ততক্ষণে পেছন পেছন জিমি চলে এসেছে। এসেছে প্রিয়ম আর মার্তণ্ডও। বাচ্চাগুলো ভীত চোখে তাকাচ্ছে এদিকে। রুদ্র বলল, ”আপনার ধর্মের ষাঁড়টিকে একটু শান্ত হতে বলুন। আমি আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই।”
দুয়ার্তে জিমির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার ইশারা করলেন। তারপর ক্ষুব্ধ মুখে রুদ্রর দিকে ফিরলেন, ”আমি তোমার সঙ্গে কোনো কথা বলতে চাই না।”
”কেন?” রুদ্র আশ্চর্য হল।
”তুমি কে? তোমার সঙ্গে আমি কথা বলব কেন?”
রুদ্র একটু থামল। তারপর বলল, ”যদি বলি, রূপা নেইলসনকে ‘দ্য ডার্ক হোয়াইট’ নামক কাগজে লেখার জন্য বেঘোরে প্রাণটি দিতে হয়েছে, তবে কি কথা বলবেন?”
”মানে?” দুয়ার্তেকে স্পষ্টতই বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল, একঝলক তাকালেন মার্তণ্ডর দিকে।
”এই ‘মানে’ জিজ্ঞেস করার জন্যই আগে আপনার কাছে এসেছি। আমি তো এখানে পুলিশ নই। সেই জুরিসডিকশনই আমার নেই। পুলিশের কানে কথাটা গেলে তারা আর আপনার স্টেটাস, ইমেজ, রেপুটেশনের রেয়াত করবে না, সোজা আপনাকে নিয়ে টানাটানি শুরু করে দেবে।”
”ফাদার!” মার্তণ্ড এবার আমতা আমতা করে বলল, ”উনি ‘দ্য ডার্ক হোয়াইট’ কাগজটা দেখেছেন। আজ সকালে ওই কাগজের সাব-এডিটরদের সঙ্গেও কথা বলেছেন। রূপা কি সত্যিই ওই কাগজে লিখত? আপনি কি কিছু জানেন? যদি পুরো বিষয়টা খোলসা করেন, তাহলে !”
দুয়ার্তে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর চারপাশে বসে-থাকা ছেলেগুলোকে ইঙ্গিতে চলে যেতে বললেন। জিমিকেও। মিনিট দুয়েকের মধ্যে ঘর ফাঁকা হয়ে গেল।
”দ্য ডার্ক হোয়াইট’ কাগজটা আমি পড়ি। আগের বার যখন রূপা এসেছিল, ও কাগজটা মন দিয়ে পড়েছিল। আমি এটুকুই জানি।” দুয়ার্তে দায়সারাভাবে উত্তর দিলেন।
”আপনি নিয়মিত পাঠক, কাগজের এডিটরকে চেনেন না?”
”সে তো আমি ‘দ্য গোয়া ডেইলি’, ‘দ্য হিন্দু’র মত কাগজেরও নিয়মিত পাঠক, আমি কি তার এডিটরকে চিনি? অদ্ভুত তো!”
”অন্য কোনো কাগজ তো এত গোপনীয়তা বজায় রাখে না।”
”পরাধীন ভারতে তো স্বাধীনতা সংগ্রামীরা গোপনেই তাঁদের কাজকর্ম চালাতেন। নেতাজি নিজেও গোপনে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। গোপনে কিছু করা মানেই সেটা কি খারাপ কিছু?”
”তা নয়। তবু এই কাগজটা যে আপনি পড়েন, তা পুলিশকে বলেননি কেন? আপনি কি সত্যিই এগুলো মানেন?”
দুয়ার্তে এবার একটা লম্বা নিশ্বাস ফেললেন, ”আমি যা জানি, পুলিশকে বলেছি। রূপার খুনের সঙ্গে এই কাগজের কোনো সম্পর্ক আছে, এটা আমার মনে হয়নি, তাই বলিনি। আমি কী মানি, আমি কী ভাবি, সেসব জানতে গেলে আমায় ভিলেইন ভাবা বন্ধ করতে হবে। ধৈর্য ধরে অনেক কিছু শুনতে হবে তোমায়।”
”অবশ্যই শুনব।” রুদ্র আগ্রহের সঙ্গে বলল, ”আপনি বলুন।”
দুয়ার্তে বলতে শুরু করলেন, ”স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে গেলে অনেক কিছু গোপনভাবেই করতে হয়। সভ্যতার আদি পর্বে পৃথিবীর সব মানবগোষ্ঠীই ছিল পৌত্তলিক, বৃষ্টি, সূর্যজাতীয় প্রকৃতির উপাসক কিংবা আগুনের মতো কোনো শক্তির উপাসক। ইনকা, মায়া, অ্যাজটেক সভ্যতা বলো কিংবা গ্রিক, মিশরীয়, রোমান বা ভারতীয়, নিরাকার একেশ্বরবাদের অস্তিত্ব কোথাও ছিল না। প্রাচীন পৃথিবীর এইসব আদি জাতি নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করত, নিজেদের দেবতাদের নিয়েও লড়াই করত। কিন্তু অন্যের দেবতার অস্তিত্ব তারা কখনো অস্বীকার করত না। অন্যদের দেবতা মিথ্যা, তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই, নিজেদের দেবতাই একমাত্র সত্য—এই জাতীয় তত্ত্ব প্রথম উপস্থাপন করেন ইহুদি পয়গম্বর মোজেস। তিনিই বলেন, তাঁদের ঈশ্বর নিরাকার, সেই ঈশ্বরের নাম যিহোবা। বাকি সবার ঈশ্বর মিথ্যে। যিহোবা নিজে মোজেসকে আগুনের শিখারূপে দর্শন দিয়ে প্রদান করেছিলেন Ten Commandments. দশটা আদেশ। সেগুলো কী জানো?”
”না।”
”আমাকে ছাড়া অন্য কোনো দেবতাকে পুজো করবে না। পৃথিবীর কোনো কিছুর মূর্তি বানাবে না। কোনো মূর্তির সামনে নত হবে না বা তাকে পুজো করবে না। কারণ, আমি কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী সহ্য করি না। আমাকে যারা ঘৃণা করে, আমি তাদের তৃতীয়, চতুর্থ প্রজন্ম অবধি শাস্তি দিই, আর যাকে ভালোবাসি, যারা আমার নিয়ম মেনে চলে, তাদের হাজার পুরুষ পর্যন্ত ভালোবাসি। আমার নাম কোন খারাপ কাজে ব্যবহার করবে না। সপ্তাহের সপ্তম দিন বিশ্রাম নেবে। ওইদিন ক্রীতদাসদেরও কাজ করাবে না। পিতা-মাতাকে সম্মান করবে। খুন, ব্যভিচার, চুরি করবে না। কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করবে না। অন্যের স্ত্রী ও সম্পত্তির প্রতি লোভ করবে না।”
”শেষের কথাটা তো আমাদের শাস্ত্রেও আছে। মাতৃবৎ পরদারেষু, পরদ্রব্যেষু লোষ্ট্রবৎ।” প্রিয়ম এতক্ষণ পর মুখ খুলল।
”ঠিক।” মার্তণ্ড মাথা নাড়ল, ”চাণক্যর শ্লোক।”
”এরপর ঈশ্বর যিহোবা বললেন, তোমরা আমার মনোনীত জন। তোমাদের জন্য আমি কানান প্রদেশ দান করছি। দুধ ও মধুতে পূর্ণ ওই প্রদেশ তোমাদের জয় করতে হবে তরোয়ালের তীক্ষ্নতায়। ভেবে দেখো, কোনো ভালোমন্দের নিরিখে নয়, ধার্মিক অধার্মিকের নিরিখে নয়, চরিত্র বা মূল্যবোধের নিরিখে নয়, শুধু যিহোবা নিজে ঈর্ষাপরায়ণ, তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী সহ্য করতে পারেন না, সেইজন্য মূর্তিপুজোর বিরোধিতা করতে হবে। নিজে ঈশ্বর হয়ে কিছু না করে সৃষ্টির এক অংশকে দিয়ে অন্য অংশ ধ্বংস করাতে হবে।
”বিভাজনের সেই শুরু। ইহুদিদের হিব্রু বাইবেল পড়লে জানতে পারবে, কানান প্রদেশের সমস্ত নর নারী, গবাদি পশু ধ্বংস করা হয়েছিল। লুঠ করা হয়েছিল যাবতীয় সম্পদ ও নারী। কুমারীদের বিতরণ করে নেওয়া হয়েছিল নিজেদের মধ্যে। হিব্রু বাইবেলের যুশা খণ্ডে রয়েছে, কীভাবে জেরিকো, ম্যাকেডা, আই, লিবনা, ল্যাকিসের মতো শহরগুলোয় ব্যাপক হত্যালীলা চালিয়ে অধিবাসীদের সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়। এই মনোভাব পরে সঞ্চারিত হয় পরবর্তী সেমীয় ধর্ম খ্রিস্টধর্মের মধ্যে। আর ওই ধারণাগুলোই পরে রূপান্তরিত হয় উপনিবেশবাদ, ফ্যাসিবাদ, নাৎসিবাদে।
”আপনি ক্রিশ্চান ধর্মের কথা বলতে গিয়ে ইহুদিদের কথা কেন বলছেন?” প্রিয়ম না জিজ্ঞেস করে পারল না।
দুয়ার্তে কিছু বলার আগে মার্তণ্ড বলল, ”কারণ যিশুখ্রিস্ট নিজেও প্রথমে ইহুদিই ছিলেন। পরে তিনি খ্রিস্ট্রধর্মের প্রবর্তন করেন। অথচ লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে মধ্যযুগে ইনকুইজিশনে ফাঁসিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। ইহুদি ধর্ম প্রথমে ইব্রাহিমের বংশোদ্ভূত কয়েকটা জাতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীকালে সেন্ট পল ক্রিশ্চান ধর্ম বিস্তার করলেন অ-ইহুদিদের মধ্যেও। বললেন, যারা খ্রিস্টের, তারাই ইব্রাহিমের বংশধর। এভাবেই খ্রিস্টধর্ম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। আসল উদ্দেশ্য হয়ে উঠল, বিশ্ব জুড়ে যিহোভার রাজত্ব প্রতিষ্ঠা। বাইবেলের Old testament তো মূর্তিপুজোর বিরুদ্ধে ছিলই, New testament এক ধাপ এগিয়ে যাবতীয় পাপ ও অপরাধের সঙ্গে এক সারিতে বসাল মূর্তিপুজোকে। বিরোধিতা করা হল শক্তি ও প্রকৃতির উপাসনাকেও। New testament বলেই দিল, খ্রিস্টধর্ম প্রসারের জন্য প্রয়োজনে পেশির ব্যবহারও করা চলবে। নেওয়া হবে রাজশক্তির অনুগ্রহও। হিব্রু বাইবেলে আগে থেকেই বলপ্রয়োগের অনুমতি দেওয়া ছিল, এবার ধর্মপ্রচারকরা ছলে অথবা বলে সারা বিশ্বে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের কাজে বেরিয়ে পড়লেন। রাজার সঙ্গে যুক্তি করে ঔপনিবেশিক দেশগুলোয় বলবৎ হল ইনকুইজিশন। সেসব তো আপনারা জানেনই।”
”ঠিক।” দুয়ার্তে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকালেন মার্তণ্ডের দিকে, ”এবার চলে আসি পরের কথায়। Old testament ও New testament হল ঈশ্বর যিহোভার বচন। Old testament-এ বিভিন্ন পয়গম্বরের মাধ্যমে ঈশ্বর যিহোভা শুধুমাত্র তাঁর মনোনীত ইহুদিদের বচন দান করেছিলেন। কিন্তু New testament-এর বচন সমগ্র মানবজাতির জন্য, এবং সেটা বলছেন যিহোভার পুত্র যিশু ও তাঁর প্রধান শিষ্যরা। সুতরাং দুটো testament-ই আদতে ঈশ্বর যিহোভার বাণী। কাজেই সেটা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। Old testament অনুযায়ী, ঈশ্বর যিহোভার আদেশ অমান্য করে আদম ও ইভ নিষিদ্ধ ফল খান এবং মানবজাতির সৃষ্টি করেন, সেইজন্য খ্রিস্টীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, মানুষমাত্রই জন্মগতভাবে পাপী। ওদিকে New testament বলছে, ঈশ্বর যিহোভা অশেষ কৃপাপরবশ হয়ে তাঁর সৃষ্ট সন্তান যিশুকে পৃথিবীতে পাঠাচ্ছেন। মানুষের সমস্ত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে যিহোভার বিদ্বেষ প্রশমিত করার জন্য যিশু মানবজাতির জন্য মৃত্যুবরণ করছেন ক্রুশে। ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার তৃতীয় দিনে যিশু সশরীরে কবর থেকে উঠে আসছেন জেরুজালেমে তাঁর প্রধান শিষ্যদের কাছে। এরপর একই দেহে যিশু আবার চলে যাচ্ছেন স্বর্গে যিহোভার কাছে। এই ঘটনার পর থেকে যারা যিশুকে পরিত্রাতা মনে করে, তাদেরই ঈশ্বর যিহোভা ক্ষমা করেন। আর এরই কান্ডারি হল চার্চ। চার্চ মানে শুধু কোনো ইমারত নয়। যারা যিশুকে পরিত্রাতা মনে করে, তাদের সংগঠনই হল চার্চ। চার্চের কাজ উপাসনা, প্রার্থনা, শিক্ষাদান, দীক্ষাদান, অবিশ্বাসীদের ক্রিশ্চান ধর্মে কনভার্ট করা ইত্যাদি। এইভাবে পৃথিবীকে যিশুর পুনরাগমনের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। যিশু আবার আসবেন, সমস্ত অবিশ্বাসীকে জয় করবেন। তারপর হাজার বছরের জন্য পৃথিবীতে কায়েম হবে তাঁর রাজত্ব।”
”সব ধর্মেই ঘুরেফিরে সেই ফিরে আসার গল্প!” প্রিয়ম বিড়বিড় করল, ”সে কল্কি হোক আর যিহোভা!”
”যিশুর পুনরুত্থানের হাজার বছর পর পৃথিবী শেষ হয়ে যাবে। পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে শেষ অবধি যত মানুষ জন্মেছে, সবাইকে সশরীরে উত্থিত করা হবে। যারা খ্রিস্টধর্মকে মেনেছে, তারা যাবে স্বর্গে। আর অ-ক্রিশ্চানরা নিক্ষিপ্ত হবে নরকে।” দুয়ার্তে একটু দম নিলেন, ”মিশনারিদের মিশন কী? যেনতেন প্রকারেণ অবিশ্বাসীদের খ্রিস্টধর্মে আনাটাই হল তাঁদের মিশন। যিশু যেকোনো মানুষের মধ্য দিয়ে যেকোনো সময় পুনরাবির্ভূত হতে পারেন, তাই গর্ভপাত করা ক্যাথলিক ধর্মে মহাপাপ। ১৮১৩ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উইলবারফোর্স বললেন, আমাদের খ্রিস্টধর্ম স্বর্গীয়, বিশুদ্ধ ও উপকারী। আর ভারতের ধর্মগুলো ইতর, লাম্পট্যময়, নিষ্ঠুর। পাশ হয়ে গেল ভারতে মিশনারি পাঠানোর আইন। ভারতে হু হু করে ঢুকতে শুরু করল এই মিশনারিরা। ভারতের জন্য মোটা বেতনে ব্যবস্থা করা হল বিশপের, এ ছাড়া তিন প্রেসিডেন্সির জন্য পাঠানো হতে লাগল আর্চডিকন। কিছু উচ্চবর্ণ হিন্দুকে ধর্মান্তর করা গেলেও সেটা একটু কঠিন। কারণ, ততদিনে রামমোহন রায়ের মতো অনেকেই এই মিশনারিদের উদ্দেশ্য নিয়ে তোপ দেগেছেন। তখন টার্গেট করা হল আদিবাসী, দরিদ্র ও নিম্নবর্ণ হিন্দু-মুসলিমদের। তাদের নানারকম প্রলোভন দেখিয়ে, সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কনভার্ট করা হতে লাগল!”
রুদ্র এতক্ষণ একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। এবার ও আর থাকতে না পেরে বলেই ফেলল, ”মি. দুয়ার্তে! আপনার মতো পণ্ডিত মানুষের কাছে ধর্মীয় উত্থানের এই বিশাল ইতিহাস শোনাটা সত্যিই প্রাপ্তি। অন্য সময় হলে আমি এর সত্যিকারের রসাস্বাদন করতে পারতাম, কিন্তু বিশ্বাস করুন, এই মুহূর্তে আমার সেই মানসিক স্থিতি নেই। আমার বন্ধু এই হত্যাকাণ্ডে এগোতে পারছে না বলে ওকে নানারকমভাবে হেনস্থা হতে হচ্ছে!”
দুয়ার্তে বিরক্ত হলেন না, বললেন, ”সেই ব্যাপারে আমি শংকরকে যথেষ্ট সাহায্য করেছি। রূপা নেইলসন তার ব্লগে ক্রিশ্চান ধর্মের নানা গোঁড়ামি, পুরোনো দিনের জোর করে কনভার্সন নিয়ে লিখছিল। তাতে ও অনেক হুমকি পায়। আমি ওকে সাহস জোগাতাম। ওকে তাই গোয়ার কোনো বড়ো অর্গানাইজেশন সরিয়ে দিয়েছে।”
”আপনি শিয়োর?” রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ওর মনের মধ্যে হাজারও প্রশ্ন তোলপাড় করছিল। দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলল, ”রূপার নিজের বাড়ি, আত্মীয়স্বজন নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না? কোনো খটকা ছিল না?”
”আমার তো তা মনে হয় না!” দুয়ার্তে কাঁধ ঝাঁকালেন, ”রূপার সুইডিশ বাবা-মা ইহুদি। তাঁদের পূর্বপুরুষ একসময় গোয়াতে থাকতেন। তাঁদের ইচ্ছে ছিল রূপা এসব নিয়ে লিখুক। এও হতে পারে, ও ডার্ক হোয়াইট কাগজেও লিখত। আমাকে বলেনি। হতেই পারে।”
”আপনার সঙ্গে পরিচয় হল কীভাবে?”
দুয়ার্তে বললেন, ”আমার এক পরিচিতের থ্রু দিয়ে। গোয়াতে আসার পর ও একমাত্র আমাকেই চিনত। ওকে মেয়ের মতো দেখতাম। এইসব কাজে সাহস জোগাতাম। কারণ, আমি নিজেও একসময় এই ঝড় সামলেছি।”
রুদ্র জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতে দুয়ার্তে আবার বললেন, ”প্রথম জীবনে আমি ছিলাম একজন মিশনারি ভলান্টিয়ার। নিজের দেশ ছেড়ে এতদূরে এসেছিলাম শুধুমাত্র মানবসেবার আদর্শে উদবুদ্ধ হয়ে। ধর্মীয় কোনো আবেগে নয়, ভেবেছিলাম আর্তের সাহায্যেই জীবনটা উৎসর্গ করব। কিন্তু বাস্তবের চিত্রটা যখন দেখলাম, বিরাট ধাক্কা খেলাম। মুমূর্ষু রুগিরা বিনা চিকিৎসায় দিনের পর দিন পড়ে থাকে। তাদের একই সিরিঞ্জে ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। সারা পৃথিবী থেকে অনুদান এলেও সেই অর্থ চলে যায় অন্য খাতে। প্রতিবাদ করলাম। ব্যাস! সরিয়ে দেওয়া হল আমায়। প্রথমে কলকাতা থেকে গোয়া। তারপর বহিষ্কার।”
”কোন সংগঠনে ছিলেন আপনি?”
দুয়ার্তে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ”মিশনারিজ অফ ডিভিনিটি।”