১০
গাড়িতে করে ফাদার দুয়ার্তের আশ্রমে যেতে সময় লাগল পাক্কা দেড় মিনিট। সমুদ্রসৈকতের গায়েই ছোট্ট ছিমছাম আশ্রম। ফুল-লাগানো কাঠের বাহারি গেট। বাইরে পেঁচানো হরফে নেমপ্লেট।
গুড রিটার্ন দুয়ার্তে হোম
ভেতরে একপাশে খেলার মাঠ, সেখানে কয়েকটা বাচ্চা হুটোপুটি করে খেলছে। অন্য পাশে ছিমছাম দুটো বাড়ি।
ফাদার দুয়ার্তেকে পাওয়া গেল তাঁর অফিসঘরের পেছনে ব্যালকনিতে। ব্যালকনির গায়ে একফালি বাগান, সেখানে নানারকম মরশুমি তরিতরকারির চাষ হচ্ছে। দুটো ধবধবে ফুলকপি ফুটে আছে সেখানে। কয়েকটা চোদ্দো-পনেরো বছরের ছেলে সেখানে উবু হয়ে বসে ছোটো ছোটো বেলচা দিয়ে মাটি কোপাচ্ছে। কেউ কেউ আবার গাছের পরিচর্যা করছে।
দুয়ার্তে একটা বেতের চেয়ারে বসে সেই ঝকঝকে ফুলকপি দুটোর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। পাশের ছোট্ট টেবিলে পড়ে আছে না-খাওয়া কফি আর খবরের কাগজ। মুখের বলিরেখার মধ্যে টকটকে লাল চোখ আর ভেজা গাল চার-পাঁচ মিটার দূর থেকেও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।
শংকর এগিয়ে গেল, ”ফাদার?”
দুয়ার্তে এদিকে তাকালেন। বিড়বিড় করার ভঙ্গিতে ধরা গলায় বললেন, ”আই টোল্ড ইউ শংকর… দে উইল কিল হার! অ্যান্ড দে কিলড।”
শংকর অপরাধী গলায় বলল, ”আমরা আততায়ীকে খুঁজে বের করবই। আপনি একটু হেল্প করুন প্লিজ।”
”তোমাকে তো বললাম, রূপার কাজকর্মে গোয়ার অনেক বড়ো বড়ো ফাউন্ডেশন বিরক্ত হচ্ছিল। এর আগে ও হুমকিও পেয়েছে। আর কত খুলে বলব? সবই যদি বলে দিই, কাঁধের ওই তারাগুলো খুলে ফেললেই তো হয়!”
শংকরের মুখে রাগ আর বিরক্তি একসঙ্গে এসে জমা হল। ফাদার দুয়ার্তেকে ও সম্মান করে। শুধু ও কেন, ভাগাতোর, ভাগাতোর ছাড়িয়ে গোটা নর্থ গোয়াই মানুষটাকে সমীহ করে। কিন্তু সেই সম্মান, সেই সমীহের অর্থ এই নয় যে, উনি পুলিশের উর্দিকে ব্যঙ্গ করবেন। ও নিজেকে সংবরণ করল। লোকাল এম. এল. এ. টনি ডিসুজা থেকে খোদ গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী, দুয়ার্তের পরিচিতি অনেক বেশি। অনেক প্রসারিত। ওঁর এক অঙ্গুলিহেলনে শংকরের সাউথ গোয়ার জঙ্গলে ট্রান্সফার হয়ে যেতে পারে।
ও স্থিরকণ্ঠে বলল, ”শান্ত হন ফাদার। আপনি যদি আর কিছু না বলতে চান, আমি জোর করব না। রূপা নেইলসন যে ঘরে থাকত, সেটা আরেকবার সার্চ করার যদি পারমিশন দেন।”
”পারমিশন?” ফাদার দুয়ার্তে তেরচা চোখে রুদ্রর দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে আবার বাগানের দিকে মুখ ফেরালেন। ধরা গলায় ডাকলেন, ”জিমি! জিমি!”
”জিমি তো এখনও আসেনি, ফাদার!” একটা বেঁটেখাটো চেহারার লোক এসে হাজির হল।
”ওহ। মাইকেল, রূপা যে ঘরে থাকত, সেটা পুলিশ আরেকবার সার্চ করবে। এবারে বড়োকর্তা এসেছেন। তুমি কোঅপারেট করো।”
আশ্রমের গেস্ট হাউসটা আলাদা, মূল বাড়ির বাঁ পাশে। ছোটো একতলা বাড়ি। দুটো ছোটো ফ্ল্যাট। মাইকেল লোকটার চোখগুলো কেমন পাথরের মতো, নিষ্প্রাণ ভাবলেশহীন। একটা বাচ্চা ছেলেকে ওদের সঙ্গে এগিয়ে যেতে বলে সে গেস্ট হাউসের চাবি আনতে গেল।
গেস্ট হাউসের আগে একটা গলির অন্ধ বাঁক। সেই বাঁক পেরিয়েই যে একটা জলের পাম্প থাকবে, সেটা ওরা খেয়াল করেনি। রুদ্র হুমড়ি খেয়ে পড়তে যাচ্ছিল, মার্তণ্ড আগেভাগে সাবধান করায় বেঁচে গেল।
”থ্যাঙ্কস মার্তণ্ড!” রুদ্র ফিসফিস করল, ”শংকর, সকালে যখন দুয়ার্তের সঙ্গে আলাপ হল, তখন কিন্তু খুব বিনয়ী মনে হয়েছিল। এখন এরকম খোঁচা দিয়ে কথা বলছেন কেন রে?”
”শকে সম্ভবত।” শংকর তেতো গলায় জবাব দিল, ”নিজে অনেক কিছু জানে, কিন্তু বলবে না। আজব পাবলিক। আরে, পুলিশ হয়েছি বলে কি থট রিডিং করব নাকি। অদ্ভুত!”
রুদ্র সঙ্গে হাঁটতে থাকা বাচ্চা ছেলেটার দিকে তাকাল। বয়স বারো-তেরো। খোঁচা খোঁচা চুল, চোখ-দুটো চঞ্চল। রুদ্র জিজ্ঞেস করল, ”তোমার নাম কী?”
”আমার নাম সেবাস্টিয়ান।” ছেলেটা উজ্জ্বল মুখে হাসল।
”তোমরা এখানে কতজন থাকো, সেবাস্টিয়ান?”
”বাহান্নজন।”
”সবাই ছেলে?”
”হ্যাঁ। এটা তো বয়েজ হোম।”
”ওহ, তা-ই তো!” রুদ্র মাথা নাড়ল, ”কোন ক্লাসে পড়ো সবাই?”
”ক্লাস ফাইভ থেকে টেন। আমাদের তো স্কুল নেই। ভাগাতোর গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে পড়তে যাই। তবে খাওয়াদাওয়া, থাকা সব এখানে। একদম ফ্রি-তে। হি হি।” সেবাস্টিয়ান নিষ্পাপ হাসল।
”বাহ, তুমি কতদিন রয়েছ এখানে?”
”উমমম!” সেবাস্টিয়ান এবার মাথা চুলকোল, ”জন্মে থেকেই তো এখানে আছি!”
রুদ্র হাঁটতে হাঁটতে শংকরের দিকে তাকাল, ”তুই আগে এই আশ্রমে এসেছিস?”
”হুম। বাইরের বাগানে একটা প্রোগ্রামে ইনভাইট করেছিল।”
”রূপা নেইলসন নিরুদ্দেশ হওয়ার পর আসিসনি?”
”না। আমি তো ম্যাটারটা সুপারভাইজ করছিলাম। আই.সি. বিজয় গোমস এসেছিল।”
”সেই ফাইলগুলো কোথায়? আমাকে একবার দেখাবি?” রুদ্র ঠোঁট কামড়াল, ”অবশ্য তোর যদি আপত্তি না থাকে।”
”আপত্তি আর কীসের? আমি এমনিতেই শোকজের জন্য ওয়েট করছি। ফাদার জেমসনের কেসটার কোনো আপডেট নেই, সাত দিন ধরে নিখোঁজ থাকার পর একজন বিদেশিনি খুন হল, দায়িত্বে গাফিলতি নিয়ে আমার কাছে ডি.জি. সাহেবের চিঠি এল বলে। মার্তণ্ড, এই কেসের সব ফাইল আমার বাংলোয় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করো।”
ফাদার দুয়ার্তের আশ্রম বেশি বড়ো নয়। সেবাস্টিয়ান হাঁটতে হাঁটতে অনেক কথা বলছিল। আশ্রমের কর্মচারী নাকি সাতজন। দুজন রান্নাঘর সামলায়। দুজন অফিসের কাজকর্ম করে, অ্যাকাউন্টস সামলায়। আর মাইকেল আশ্রমের ঘরদোর, বাগান দেখভাল করে। এ ছাড়া রয়েছে জিমি। সে দুয়ার্তের ব্যক্তিগত সচিব। তবে সে সবসময় থাকে না। সেবাস্টিয়ান ফিসফিস করে বলল, ”জিমি আঙ্কলকে দেখলেই তোমাদের ভয় লাগবে, জানো!”
”কেন?”
”ইয়াব্বড়ো চেহারা।” সেবাস্টিয়ান মুখ-হাত ফুলিয়ে পেশি দেখাল, ”বড়ো বড়ো মাসল। বিশাল লম্বা।”
গেস্ট রুমের ভেতরটা একেবারে সাদামাটা একটা দু-কামরার অ্যাপার্টমেন্ট। একটা ঘরে খাট আর ওয়ার্ডরোব। অন্য ঘরে স্টাডি টেবিল আর বইয়ের র্যাক। বাইরের ডাইনিং-এর সঙ্গে লাগোয়া ছোট্ট রান্নাঘর। সেখানে টুকিটাকি বাসনপত্র। শংকরের নির্দেশে মার্তণ্ড বিভিন্ন অ্যাঙ্গল থেকে প্রতিটি ঘরের ছবি তুলছিল। সেবাস্টিয়ান ছেলেটা চঞ্চল হলেও বেশি ঘোরাঘুরি করছিল না। দরজায় দাঁড়িয়ে চুপচাপ দেখছিল।
শংকর বলল, ”রূপোর চেইনটা পাও কি না দ্যাখো তো মার্তণ্ড। হতে পারে, খুলে রেখে গিয়েছিল।”
রুদ্র এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে পায়চারি করছিল। ওয়ার্ডরোবে রয়েছে রূপার ট্রলি। সেখানে হালকা সুতির কিছু জামাকাপড়। বাথরুমে ফেসওয়াশ, সাবান, শ্যাম্পু। ড্রেসিং টেবিলের ওপর একটা চিরুনি আর নাইটক্রিম। একটা ডায়েরি। রুদ্র ডায়েরিটা হাত বাড়িয়ে তুলে নিল।
গত বছরের ডায়েরি। প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা ‘‘Our journey is just beginning.’’
শংকরও এগিয়ে এসে ডায়েরিটা উলটেপালটে দেখল, ”বাকি পুরো ডায়েরিটাই ফাঁকা কেন? একটা আঁচড়ও কাটা নেই।”
”হুম। তা-ই দেখছি।” রুদ্রও কিছু বুঝতে পারল না। কীসের জার্নি বলা হয়েছে? কীসেরই বা শুরু? বাকি ডায়েরিতে কিছুই লেখা নেই কেন?
রুদ্র রান্নাঘরের এদিকে এগিয়ে গেল। ছোটো ছোটো কাগজের ঠোঙায় রাখা রয়েছে নুন, চিনি, কিছু মশলাপাতি। একপাশে পাঁউরুটির একটা প্যাকেট, তাতে রয়েছে তিনটে পাঁউরুটি। পচে গেছে। আরেক পাশে থরে থরে সাজানো কফির বয়াম। নানা কোম্পানির, নানা ফ্লেভারের।
”রূপা কি খুব কফি খেতেন?” রুদ্র ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল।
মাইকেল কিছু বলার আগেই দরজার চৌকাঠ থেকে সেবাস্টিয়ান সোৎসাহে বলে উঠল, ”হ্যাঁ। রূপাদিদি সারাদিন ধরে পঞ্চাশ-ষাট কাপ কফি খেত। খেয়েই যেত, খেয়েই যেত। আমাদেরও দিত। সে কতরকম কফি! নিয়েও আসত, এখান থেকেও কিনত।”
রুদ্র লক্ষ করল, মাইকেল একবার সেবাস্টিয়ানের দিকে তাকাতেই ছেলেটা চুপ করে গেল।
ডাইনিং টেবিলের লাগোয়া রেফ্রিজারেটর, সেটার ভেতর রয়েছে দুটো ডিম। ফ্রিজটা খুলে রুদ্র ঝুঁকে একটা কাচের বাটি বের করল। ফুলকপি-আলুর তরকারি। আধখাওয়া। পচা গন্ধ ছাড়ছে।
রুদ্র ফ্রিজ, রান্নাঘরের ক্যাবিনেট, গ্যাস বার্নারের চারপাশ খুঁটিয়ে দেখছিল।
”রূপা নেইলসন কি নিজে রান্না করে খেতেন?”
এবার মাইকেল দ্রুত উত্তর দিল, ”ইয়েস ম্যাডাম।”
রুদ্র শংকরের দিকে দ্বিধাগ্রস্তভাবে তাকাল, ”তুই বলেছিলি না, রূপা নেইলসনকে শেষবার দেখা গিয়েছিল এক তারিখ রাতের ডিনারে?”
শংকর কিছু বলার আগে মাইকেল মুখ খুলল, ”হ্যাঁ। সেদিন রাতে উনি আমাদের সবার সঙ্গে হলে খেয়েছিলেন। না হলে উনি যখনই আসতেন, নিজেই নিজের খাবার করে নিতেন। ইন্ডিয়ান ফুড উনি খুব পছন্দ করতেন।”
”যখনই আসতেন মানে? উনি আগেও এসেছেন?” শংকর ভ্রূ কুঁচকোল।
”হ্যাঁ, রূপাদিদি তো গত মার্চেও এসেছিল!” মাইকেল কিছু বলার আগেই সেবাস্টিয়ান বলে উঠল, ”এক সপ্তাহ ছিল। খুব মজা হয়েছিল। তার আগের বছরও এসেছিল দুবার। আমাদের ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিল পানাজিতে।”
”আহ!” মাইকেল এবার জোরে ধমক দিল সেবাস্টিয়ানকে, ”তোকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে কে বলেছে? ফাদার জানতে পারলে কী করবেন খেয়াল আছে? পড়াশুনো নেই? শিগগির গিয়ে পড়তে বোস! আমি তো যা বলার বলছি।”
ধমক খেয়ে সেবাস্টিয়ান বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
শংকরের চোখের ইশারায় মার্তণ্ড ফাইল খুলল। রূপা নেইলসনের পাসপোর্টসহ সব নথির জেরক্স রয়েছে সেখানে। পাতা ওলটাতে ওলটাতে ও নিচুস্বরে বলল, ”এই পাসপোর্টটা ইস্যু হয়েছে মে মাসে। পুরোনো পাসপোর্টের কপি তো ফাইলে নেই। দেখছি স্যার এখুনি।”
রুদ্র বলল, ”এটা বয়েজ হোম। রূপাকে অ্যাডপ্ট করা হয়েছিল মারগাঁওয়ের একটা হোম থেকে। ফাদার দুয়ার্তের সঙ্গে রূপার কীসের সূত্রে পরিচয় ছিল, তুমি কি বলতে পারবে মাইকেল? দুয়ার্তে কি আগে মারগাঁওয়ের ওই হোমের সঙ্গে ছিলেন?”
”কী ব্যাপার, শংকর? তোমরা গেস্ট রুম দেখতে এসে যে মাইকেলকে আরেক রাউন্ড ইন্টারোগেশন শুরু করবে, সেটা তো বলোনি?”
সবাই চমকে উঠল। ফাদার দুয়ার্তে কখন যেন ঢুকে এসেছেন। তাঁর মুখে রাগ দপদপ করছে, নাক ঈষৎ লাল।
”বলাবলির কী আছে, ফাদার?” মার্তণ্ড দুম করে বলে উঠল, ”গঞ্জালভেজ স্যারের জুরিসডিকশনে একটা মার্ডার হয়েছে। ভিকটিমকে জীবিত অবস্থায় শেষ দেখা গিয়েছে আপনার আশ্রমে। ইনভেস্টিগেশনের স্বার্থে এই হোমের সবাইকে স্যার জেরা করতেই পারেন! হ্যাঁ, আপনি চুপ করে আছেন। থাকতে পারেন। আমরা আপনাকে বাধ্য করতে পারি না মুখ খোলার জন্য। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমাদের কাজে আপনি বাধা দেবেন।”
দুয়ার্তে এইরকম কড়া প্রত্যুত্তরের প্রত্যাশা সম্ভবত করেননি। তিনি তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে রইলেন মার্তণ্ডর দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ”গোয়া পুলিশ অকর্মণ্য বলে কি এখন বেঙ্গল পুলিশকে তোমাদের টিমে ডেপুটেশনে আনা হয়েছে?”
”ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করুন ফাদার!” শংকর নরম গলায় বোঝানোর চেষ্টা করল, ”সুইডিশ এমব্যাসিতে খবর গিয়েছে। ডি.জি. নিজেও উদবিগ্ন। অনেকদিন পর গোয়ায় বিদেশি নাগরিক খুন হল। আপনি একটু কোঅপারেট করুন প্লিজ! আমার এই বন্ধু গোয়ায় ঘুরতে এসেছে। খুব কমপিটেন্ট অফিসার। অনেক অ্যাচিভমেন্ট রয়েছে ওর। আমি এই কেসটা দেখছি বলে ও সাহায্য…!”
দুয়ার্তে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর সামনের চেয়ারটা টেনে বসলেন, ”রূপা নেইলসন সুইডিশ নাগরিক হলেও ওর জন্ম গোয়ায়। এখানকার জল, হাওয়া, মাটির সঙ্গে ও ভীষণভাবে নিজেকে কানেক্ট করতে পারত। এখানকার বেশ কিছু ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে অনেকরকম অভিযোগ রয়েছে, ও সেসব নিয়েই নিজের মতো করে লিখছিল। এতে ওর অনেক শত্রু তৈরি হয়েছিল। আমি এর বেশি কিছু জানি না। বাকি কাজ তোমাদের।”
১১
”দিদি! অ্যাই দিদি! কী রে? কখন থেকে ডাকছি!”
এক ঝটকায় চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল শিরার। ওর হাতে ফুলের সাজি। তাতে নানা রঙের তাজা ফুল। বিভোর হয়ে কত কী ভাবছিল ও, সংবিৎ ফিরে পেয়ে দ্রুতহাতে ধরে-থাকা কাগজটা লুকিয়ে ফেলল নিজের চোলির আড়ালে।
উজ্জ্বল মুখে ও বোনের দিকে তাকাল, ”কী সুন্দর ফুলগুলো, দেখ!”
ফুল কম বেশি সবাই ভালোবাসে। কিন্তু আহিরা হল ফুল পাগল। ওর প্রতিটি দিনের শুরু থেকে শেষ অবধি ফুল জড়িয়ে থাকে। পিসি বাড়ির পেছনে যে বাগান করেছে, সেই ফুল দিয়ে কখনো ও মালা গাঁথে, কখনো খোঁপায় গাঁথে। কখনো ঘর সাজায়। শিরা ভাবল, এই অচেনা ফুলগুলো দেখলে আহিরা নিশ্চয়ই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবে।
কিন্তু আহিরা যেন দেখেও দেখল না। কালো মুখে বলল, ”একটু আগে রেবেকার মা ফিরে এসেছে!”
”সে কী!” উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল শিরা, ”ফিরে এসেছে? আর ওর বাবা?”
গত কয়েকদিন ধরে ওদের এই ছোটো ইহুদিপাড়ায় আলোড়ন পড়ে গিয়েছে। এগারো বছরের রেবেকা আর তার বাবা-মা-কে মাঝরাতে ওদের মারতে মারতে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। হাতে পায়ে দড়ি বেঁধে এখান থেকে পাঁচ মাইল দূরের মাণ্ডবী নদীর তীর অবধি নিয়ে গিয়ে নৌকোয় ওঠানো হচ্ছিল ওদের। ইহুদি পাড়ার সবাই তো বটেই, গোটা মোলে গ্রামের সবাই ভয়ে, আতঙ্কে পিছু নিয়েছিল।
এমন ঘটনা এতদিন কানাঘুষোয় শুনতে পেলেও ওদের চোখের সামনে কখনো ঘটেনি। শিরা আর আহিরা বাড়িতে ঘুমোচ্ছিল, কিন্তু ক্যাথারিনপিসি গিয়েছিল জোশুয়াকাকার সঙ্গে।
পিসির মুখে শিরা শুনেছে, রেবেকা আর রেবেকার মা ঝরঝর করে কাঁদছিল, দড়ি-বাঁধা হাত দুটো জোর করে ছেড়ে দিতে বলছিল, কিন্তু গোয়া থেকে আসা ইনকুইজিশন কোর্টের সৈন্যরা যেন অন্ধ, ভ্রূক্ষেপহীনভাবে তারা টেনেহিঁচড়ে নৌকোয় তুলছিল ওদের।
খবর পেয়ে ওই মধ্যরাতেই হন্তদন্ত হয়ে নদীর ঘাটে এসে পৌঁছেছিলেন গাঁওকর সহদেব দেশপান্ডে। ব্যস্তসমস্ত হয়ে তিনি কথা বলতে গেছিলেন সৈন্যদলটার সঙ্গে। মাঝরাতে গ্রাম থেকে এসে একটা গোটা পরিবারকে এভাবে তুলে নিয়ে যাবে, আর গ্রামপ্রধানকে জানানো হবে না কেন?
প্রথমে সৈন্যরা কোনো কর্ণপাতই করছিল না। সহদেব গাঁওকরের সহকারী ভূদেব বার বার জিজ্ঞেস করায় ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়েছিল তারা। তারপর একটা কাগজ ছুড়ে দিয়েছিল।
নদীর চড়ায় দমকা হাওয়া, বার বার নিভে-যাওয়া আবছা আলোর মধ্যেই সহদেব গাঁওকর পড়েছিলেন কাগজটা। রেবেকার বাবা-মা আর রেবেকা নিউ ক্রিশ্চান। পঞ্চাশ বছর আগে পোর্তুগালে থাকার সময় রেবেকার দাদু ইহুদি থেকে ক্রিশ্চান হয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও নাকি এই ‘নিউ ক্রিশ্চান’ পরিবার লুকিয়েচুরিয়ে নিজেদের পুরোনো ধর্মাচরণ চালিয়ে যাচ্ছে। ঘরের মধ্যে তারা ইহুদি দেবতারই আরাধনা করে, যিশুখ্রিস্টের নয়। ইনকুইজিশন আইন অনুযায়ী এই অপরাধ ভয়ংকর।
সহদেব গাঁওকর অভিযোগপত্রের তর্জমা করে শোনানোমাত্র কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে-থাকা গোটা গ্রামের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। কী হিন্দু, কী ইহুদি, প্রত্যেকের মুখে পড়েছিল ভয়ের কালো ছায়া। রেবেকাদের আর্তনাদের মধ্যেই সামনে দাঁড়িয়ে-থাকা গ্রামের কয়েকজন মানুষ অনুচ্চস্বরে গ্রামপ্রধানকে অনুরোধ করেছিল।
”গাঁওকরজি! আপনি কিছু করুন। আপনি বললে ওরা ঠিক শুনবে। এভাবে একজনকে আজ নিয়ে গেলে কাল আরও পাঁচটা পরিবারকে তুলে নিয়ে যাবে। আমরা সবাই শেষ হয়ে যাব গাঁওকরজি! আপনি কিছু একটা করুন।”
সহদেব গাঁওকর করেছিলেন। সৈন্যদের চরম উদ্ধত দৃষ্টিতেও না দমে কথা বলতে গিয়েছিলেন ওদের সঙ্গে।
”আমি বলছি, ওরা আইন অমান্য করেনি। তোমাদের কাছে ভুল খবর দিয়েছে কেউ! ওদের ছেড়ে দাও।” সহদেব গাঁওকর বার বার বলছিলেন।
সৈন্যরা উত্তর তো দূর, দৃকপাতও করছিল না। রেবেকার বাবা-মা-কে তুলে নৌকোর ছইতে হাত-পা মুড়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, একজন তরতরিয়ে নেমে নিতে এসেছিল রেবেকাকে। এগারো বছরের রেবেকাকে কর্কশভাবে টানার সময় সৈন্যটা মুচড়ে দিয়েছিল কিশোরীর সদ্যপ্রস্ফুটিত স্তন। লজ্জায়, অপমানে, আতঙ্কে চিৎকার করে উঠেছিল রেবেকা।
সহদেব গাঁওকরের মাথায় হঠাৎ রক্ত উঠে গিয়েছিল, তিনি দ্রুত এগিয়ে গিয়ে কেউ কিছু বোঝার আগেই রেবেকাকে নিজের কাছে টেনে তাকে আড়াল করেছিলেন।
চেঁচিয়ে বলেছিলেন, ”আমার গ্রামের মেয়েদের একটা সম্মান আছে। আমাদের মেয়েকে এভাবে তোমরা নিয়ে যেতে পারো না। আমি এই গ্রামের গাঁওকর, আমি কথা দিচ্ছি, ওরা আর এমন করবে না। ওদের ছেড়ে দাও তোমরা!”
সৈন্যটা কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর সোজা এসে একটা ঘুসি মেরেছিল সহদেব গাঁওকরের মুখে।
মুহূর্তে একটা অবিশ্বাস মাখা অস্ফুট আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়েছিল ভিড়ের মধ্যে। সহদেব গাঁওকর নিজেও কথা বলতে পারেননি। তিনি মোলে গ্রামের বংশানুক্রমিক প্রধান, আশপাশের সব গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো আর সমৃদ্ধ এই মোলে গ্রামের প্রধান হিসেবে তাঁর সম্মান অনেক। তাঁর মুখে যে ভীষণ জোরে লেগেছিল তা নয়, কিন্তু গোটা গ্রামের সামনে এমন অকল্পনীয় অপমান তিনি বোধহয় কোনোদিনও দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি।
সৈন্যটা ঘুসি মেরেই থেমে থাকেনি। গ্রামবাসীদের সামনে হিন্দু গাঁওকরদের কীভাবে মারধর, অপমান করে সম্মান হ্রাস করতে হবে, সেই কৌশল সব সৈন্যকেই ভালোভাবে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে ইনকুইজিশন আদালতে।
সৈন্যটা অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে করতে সহদেব গাঁওকরের তলপেট লক্ষ করে একটা লাথি চালিয়েছিল। সঙ্গে ছুড়ে দিয়েছিল একদলা থুতু। আঘাতের তীব্রতায় সহদেব পড়ে গিয়েছিলেন মাটিতে।
যতক্ষণে তাঁকে সবাই ধরে ধরে তুলেছিল, ততক্ষণে রেবেকাদের নিয়ে নৌকো চলে গিয়েছিল বেশ কিছু দূর। পিসি সেদিন গোটা ঘটনাটা বর্ণনা করতে করতে কেঁদে ফেলেছিল। শুনতে শুনতে জল এসে গিয়েছিল শিরার চোখেও। বলেছিল, ”রেবেকারা কি আর ফিরে আসবে না, পিসি?”
”জানি না!” পিসি জোরে জোরে মাথা নেড়েছিল, ”আমার খুব ভয় করছে। খুব ভয় করছে রে!”
সেদিনের কথা ভাবতে ভাবতে শিরা উঠে দাঁড়াল, ”কী রে? কিছু বলছিস না কেন? রেবেকা আর রেবেকার বাবা এসেছে?”
আহিরা ছলছলে চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরল দিদিকে, ”ওরা রেবেকার গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল।”
”কী!”
”হ্যাঁ।” আহিরা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ”রেবেকার বাবা-মা-কে ওরা বার বার কনফেস করতে বলছিল।”
”কনফেস! কী অপরাধের স্বীকারোক্তি করবে ওরা?”
”নিউ ক্রিশ্চান হয়েও লুকিয়ে ইহুদি ঈশ্বর মোজেসের উপাসনা করেছে, সেই পাপের কনফেশন।” আহিরা বলল, ”রেবেকার বাবা-মা-র হাত-পা বেঁধে ওদের চোখের সামনে রেবেকার গায়ে আগুন লাগিয়েছিল ওরা। রেবেকার বাবা-মা যতক্ষণে কনফেস করেছে, ততক্ষণে রেবেকা এমনভাবেই পুড়ে গিয়েছিল, যে ও আর বাঁচেনি।”
শিরা শক্ত করে আহিরাকে চেপে ধরল, ”কী!”
”রেবেকার বাবার পা দুটো কেটে দিয়েছিল। তারপর জোর করে চেপে ধরে এত জল খাইয়েছে, যে জল খেতে খেতে…!” আহিরা থরথর করে কাঁপছিল, ”রেবেকার মা-কে নদীর পাড়ে নামিয়ে দিয়ে গেছে। জানিস দিদি, ওর মায়ের মাথায় কোনো চুল নেই। কেটে দিয়েছে ওরা। গায়েও কোনো জামা নেই। বুকে-পেটে চাবুকের দাগ। ওর মা খালি হাসছে। পাগলের মতো হাসছে!”
শুনতে শুনতে শিরাও কখন যেন কাঁপতে শুরু করেছে। ঠিক এই সময় ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকল পিসি। চোখ-মুখ উদ্ভ্রান্ত। ওদের দু-বোনের দিকে একঝলক তাকিয়ে বলল, ”দা-দাদা চিঠি লিখেছে। তোরা তোদের সব ঘাগরা-চোলি একটা পুঁটলিতে বেঁধে আমায় দে। তাড়াতাড়ি!”
শিরা আর আহিরা কিছুই বুঝতে পারে না। হিন্দু গ্রামে থাকতে থাকতে ওরাও হিন্দুদের মতো পোশাক পরে, খাওয়াদাওয়া করে। ঘাগরা-চোলি দিয়ে দিলে ওরা পরবে কী?
পিসি বোধহয় ওদের মনের কথা বুঝতে পারে, ”তোরা আজ থেকে গাউন পরবি। প্রতি রবিবার চার্চে যাবি। এই নে! এটা পরে নে।”
পিসির হাতে দুটো ছোটো লকেট। শিরা চিনতে পারে। ক্রুশিফিক্স। গোয়ার ক্রিশ্চানদের পরতে দেখেছে।
”এটা সবসময় গলায় পরে থাকবি।”
”কিন্তু পিসি…!”
”জানি। মোজেসের থেকে বড়ো কেউ নেই। কিন্তু আমার কাছে তার চেয়েও বড়ো হল তোদের দুজনের জীবন!” পিসির চোখে জল টলটল করছিল, ”আমার মা, দুই বোন বহু বছর লিসবনের ইনকুইজিশন কোর্টে বন্দি, তাদের কোনো খোঁজ নেই। এখানে আমি তোদের মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে আছি। আমি তোদেরও হারাতে পারব না।”
পিসির সঙ্গে সঙ্গে শিরাও কাঁদছিল, ”কিন্তু পিসি, বাবা তো আছে! তুমি যে বলতে, বাবা থাকতে আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না।”
শিরা আহিরার বাবা গার্সিয়া দে ওরতা গোয়ায় এসেছিলেন গভর্নর মার্টিম আফোনসো ডি সসার চিকিৎসক হয়ে। চিকিৎসার সূত্রে দুজনের মধ্যে গড়ে উঠেছিল গভীর বন্ধুত্ব। একে বিখ্যাত চিকিৎসক, তায় গভর্নর মার্টিমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ইহুদি হলেও শিরা আহিরার বাবা তাই গোয়ার স্বনামধন্য মানুষ।
”এতদিন তা-ই ভাবতাম। কিন্তু মার্টিম আফোনসো এখন আর গভর্নর নেই। নতুন গভর্নর আসার পর দাদার বাড়ির দিকেও ওরা কড়া নজর রাখছে! কে বন্ধু, কে শত্রু কিছুই বুঝতে পারছি না, শিরা। না হলে রেবেকার বাবা-মা-র বিরুদ্ধে নালিশ কে করল? আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। খুব সতর্ক থাকতে হবে।” পিসি এগিয়ে এসে আহিরাকে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরল, ”ভয় পাস না। তোদের কিচ্ছু হতে দেব না আমি।”
সেদিন রাতে কিছুটা সিল্কের গাউন পরে শোয়ার অনভ্যাসে, কিছুটা অস্থিরতায় শিরার আর ঘুম এল না। জানলার পাশেই ওর বিছানা। পাশে বোন আহিরা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। শিরা এপাশ-ওপাশ করছিল।
ওর মনের মধ্যে বিচিত্র অনুভূতি ঢেউ তুলছিল। একদিকে ভয়, অন্যদিকে উত্তেজনা।
গোকুল আজ দুপুরে সবার আড়ালে এসে ফুলের সাজি দিয়ে গেছে। সেই সাজিতে তাম্বুরি সুরলা শিব মন্দিরের নানা রংবাহারি ফুল ছাড়াও ছিল একটা চিঠি। সেই চিঠির কথা মনে পড়তেই ষোড়শী শিরার মুখে একরাশ রক্ত এসে জমা হল।
বালিশের নীচ থেকে ও চিঠিটা বের করে আনল। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে। চাঁদের নরম আলো এসে পড়েছে বিছানায়। সেই আবছা আলোয় ও লেখাটা আরো একবার পড়ার চেষ্টা করছিল।
ওর এই ষোলো বছরের জীবনে কেউ যে ওকে ভালোবাসার প্রস্তাব দেয়নি তা নয়, আইজ্যাককাকার ছেলে জোসেফ তো প্রায়ই ঠারেঠোরে জানাত তার ভালোলাগার কথা। এখন জোসেফ গোয়ায় চলে গেছে, মাঝেমধ্যে গ্রামে এলে তার চোখে সেই একই রকম কামনা দেখতে পায় শিরা।
কিন্তু গোকুলের মতো বন্ধু শিরার আর কেউ নেই। গ্রামপ্রধানের ছেলে হয়েও গোকুলের মধ্যে কোনো অহংকার নেই। শিরার সবচেয়ে ভালো লাগে গোকুলের মায়ায় ভরা মনটা। গ্রামের কেউ কোনো বিপদে পড়লে সবার আগে সে ছুটে যায়। শুধু তা-ই নয়, কত কুকুর, ছাগলকে প্রতিদিন খেতে দেয় গোকুল, তাদের গায়ে-পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়।
সেই গোকুল আজ ওকে লিখেছে, ”ভালোবাসা মানে কি একসঙ্গে ভালো থাকতে চাওয়া? তা-ই যদি হয়, তবে আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি, শিরা। তুমি আমার সঙ্গে গোটা জীবনটা হাঁটবে?”
শিরার মুখে আবারও একটা স্বর্গীয় ভালোলাগা এসে জমা হল। একঝলক তার মনে হল, গোকুল হিন্দু ব্রাহ্মণ, আর সে ইহুদি। তো কী? দুজনেই তো মানুষ, দুজনেরই রক্ত লাল। দুজনে ছোটো থেকে এই মোলে গ্রামে প্রায় একই সঙ্গে বড়ো হয়ে উঠেছে, খেলেছে, কত স্মৃতি!
শিরার সাধ্য নেই গোকুলের আহ্বান, গোকুলের ভালোবাসা অগ্রাহ্য করার।
আনমনে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ জানলায় চোখ পড়ে শিরার।
কেউ কি ঝপ করে সরে গেল বাড়ির পেছন থেকে? নাকি পুরোটাই চোখের ভুল!
অনেক চেষ্টা করেও আর কাউকে দেখতে পায় না শিরা। উঠে গিয়ে ঢকঢক করে অনেকটা জল খায়।
আহিরা অসাড়ে ঘুমোচ্ছে। ঘুমোলে ওকে একটা নিষ্পাপ শিশুর মতো দেখতে লাগে। চাদরটা আলতো করে বোনের গায়ে টেনে দেয় শিরা।
গোকুলের বাবা সহদেব গাঁওকর সেদিনের পর থেকে আর বাড়ি থেকে বেরোননি। হিন্দু পাড়ারও সবাই খুব ভয়ে আছে। গোকুল যখন ফুলের সাজি নিয়ে এসেছিল, চোখের মলিন ভাবটা শিরার চোখ এড়ায়নি।
জানলা দিয়ে দূর আকাশের নক্ষত্র দেখতে দেখতে ওর মনে হল, গোকুলের কোনো বিপদ হবে না তো?
১২
প্রিয়ম যখন স্কুটি নিয়ে ভাগাতোরে ঢুকল, তখন সব রাস্তায় আলো জ্বলে উঠেছে। রেস্তরাঁগুলো মৃদু পাশ্চাত্য মিউজিক আর আলোর রোশনাইয়ে তৈরি হচ্ছে সান্ধ্য পার্টির জন্য। সমুদ্রের নোনা বাতাসে সবার মেজাজ প্রসন্ন।
প্রিয়ম মৃদুমন্দ গতিতে স্কুটি চালাচ্ছিল। একেবারে চার দিনের জন্য ও স্কুটি ভাড়া নিয়ে নিয়েছে। সি লিঙ্ক রোডে প্রেমিক-প্রেমিকারা হাতে হাত জড়িয়ে হাঁটছে। কয়েকটি স্বল্পবসনা যুবতী বালির মধ্যে গোল হয়ে বসে গান করছে। তাদের কারো হাতে উকুলেলে, কারো হাতে গিটার, কারো হাতে রঙিন পানীয়।
পথচারীদের সেসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। ঘনিষ্ঠভাবে বসে-থাকা যুগলদের দিকে তারা দৃকপাতও করছে না। এখানে স্থলপুলিশ আছে। জলপুলিশ আছে। নীতিপুলিশ নেই।
গোয়া আনন্দের রাজ্য। কে বলবে সকালে কয়েকশো মিটার দূরেই একটা লাশ পাওয়া গেছে? প্রিয়ম দ্রুত হাঁটছিল। সকালে খুব ঝোঁকের মাথায় বেরিয়ে পড়েছিল। রুদ্রর বন্ধু শংকরও স্বামী-স্ত্রী-র মনোমালিন্যের মাঝে পড়ে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল।
এখন সে কথা ভেবে নিজেরই কেমন লজ্জা লাগছে।
কিন্তু ওই অবস্থায় পড়লে কার রাগ উঠবে না? প্রিয়ম নিজেই নিজের সালিশি করল। রুদ্র পুলিশে জয়েন করার পর থেকে আগের মতো হুটহাট ঘুরতে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। প্রিয়মেরও আন্ডারে একটা বড়ো প্রোজেক্ট, আর রুদ্র তো ছুটি পায়ই না। পেলেও সেগুলো বলা নেই কওয়া নেই, দুমদাম ক্যানসেল হয়ে যায়। আগে এমন হয়েছে বারকয়েক। এবারেও প্লেনে ওঠার আগে অবধি ও শঙ্কায় ছিল, আদৌ ঘোরাটা হবে তো?
সেখানে সৌভাগ্যক্রমে এবার যখন পাঁচ দিনের ছুটিটায় দুজন আসতে পেরেছে, তখন একটা লোকাল পুলিশ কেস নিয়ে রুদ্র যদি মাতামাতি শুরু করে, কার রাগ হবে না? আরে ভাই, ঢেঁকিকে স্বর্গে গেলেও ধান ভানতে হয় শুনেছি, কিন্তু এ যে দেখছি, ঢেঁকি আগ বাড়িয়ে যেচে পড়ে ধান ভানতে চলে যাচ্ছে!
রুদ্রর সকালের কাণ্ডকীর্তিগুলো মনে হওয়ামাত্র প্রিয়মের আবার রাগ চড়তে লাগল। এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন, সারা দুনিয়ার সব ক্রাইম সলভ করার দায়িত্ব ওর ওপর।
এস. পি. বাংলোর রক্ষী প্রিয়মকে দেখে চিনতে পেরে গেট খুলে দিল। বাংলোর ক্যাম্পাসে স্কুটিটা পার্ক করে প্রিয়ম দ্রুত ঘরের দিকে হাঁটছিল। সারাদিন রুদ্র একটাও ফোন করেনি। প্রিয়ম কোথায় ঘুরছে, যে জায়গাগুলো দুজনে মিলে যাওয়ার কথা ছিল, সেগুলো একা দেখে ফেলছে কি না, লাঞ্চ করেছে কি না, সেসব জানারও কোনো তাগিদ অনুভব করেনি। প্রিয়ম অনেক কাঠ-কাঠ উত্তর সাজিয়ে রেখেছিল মনের মধ্যে, সেগুলো সব মাঠে মারা গেছে।
প্রিয়ম ভেবে রেখেছিল, ফিরে কোনো কথা বলবে না। রুদ্রর কাছে যখন এই ঘুরতে আসার কোনো গুরুত্ব নেই, ওর কাছেই বা থাকবে কেন?
কিন্তু ঘরে এসে প্রিয়ম সেই প্রতিজ্ঞাটুকু রাখতে পারল না।
ঘড়িতে সন্ধে ছ-টা। বাইরে অন্ধকার। শনিবারের সন্ধেবেলা গোয়ার ক্যাসিনোগুলোয় যেখানে সবে ভিড় জমে উঠছে, সেখানে রুদ্র বিছানায় অঘোরে ঘুমোচ্ছে। লেপ-কম্বল লন্ডভন্ড, তারই মধ্যে পড়ে আছে তিন-চারটে মোটা মোটা ফাইল। জানলা খোলা। বাইরের বাগান থেকে মশা ঢুকছে পিলপিল করে। রুদ্রর গালে, কপালে দুটো মশা আরামে বসে তাদের ডিনার সারছে। রক্ত খেয়ে খেয়ে তারা এত ফুলে গেছে যে প্রিয়ম দুবার ফুঁ দিতেও তারা উড়তে পারল না। গ্যাঁট হয়ে বসে রইল।
প্রিয়ম আর নির্বিকার থাকতে পারল না। বাধ্য হয়ে রুদ্রর মুখটা ধরে ঝাঁকুনি দিল।
মশা দুটো খুব অনিচ্ছার সঙ্গে উড়ে যাওয়ামাত্র রুদ্র ধড়মড় করে উঠে বসল। ওর চোখ-মুখ ফুলে গেছে। গত রাতে ফ্লাইটের অপর্যাপ্ত ঘুম কড়ায়-গন্ডায় পুষিয়ে নিয়েছে, মনে মনে ভাবল প্রিয়ম।
যেন রুদ্রকে দেখতেই পায়নি, এমন একটা ভাব করে প্রিয়ম বাথরুমে চলে যাচ্ছিল। ভাবল, রুদ্র নিশ্চয়ই ওকে দেখে বলবে, কোথায় ছিলে এতক্ষণ! কী কী ঘুরলে? ফোন করোনি কেন?
সেগুড়ে বালি। রুদ্র একটা প্রকাণ্ড হাই তুলল। তারপর জড়ানো গলায় বলল, ”শংকর কোথায় গো! ফিরেছে?”
অদ্ভুত তো! প্রিয়ম অতিকষ্টে নিজেকে সংবরণ করল, ”তোমার বন্ধু কোথায়, তা আমি কী করে জানব?”
”হুম। বেচারা দিনরাত এক করে খাটছে। মাথার ওপর এত বড়ো বিপদ।”
প্রিয়মের এই এক দোষ। যত রাগই হোক, নিজের কর্তব্য বা স্বাভাবিক উদবেগ প্রকাশ থেকে ও বিচ্যুত হতে পারে না। পেছন ফিরে বলল, ”কীসের বিপদ?”
”একেই তো ফাদার জেমসনের খুনটার কোনো কিনারা হয়নি, তার ওপর এই রূপা খুন।” রুদ্র খাটে পড়ে থাকা ফাইলগুলো তুলে নিল, ”রূপা নেইলসন। বয়স চব্বিশ। ছোটোবেলাতেই বাবা-মা মারা গিয়েছিল। রূপা আর ওর ভাই রকি বড়ো হচ্ছিল মারগাঁওয়ের সেন্ট মারিয়া অরফ্যানেজে। ২০০২ সালে রূপাকে এসে দত্তক নেন সুইডিশ দম্পতি মি. জোনাথন নেইলসন আর মিসেস ইভা নেইলসন। রূপার নতুন নাম হয় রূপা নেইলসন। বলো তো, Our journey is just beginning কার বাণী?”
”জানি না!” প্রিয়ম কাঁধ ঝাঁকাল, ”আবদুল কালাম?”
”সবেতেই কি শুধু কালামের নামই মনে আসে?” রুদ্র ভ্রূ কুঁচকোল, ”জানি না বললেই হয়। আমিও তো জানতাম না। ইন্টারনেটে খুঁজে দেখলাম। মোজেসের বাণী ওটা।”
”মোজেস? মানে ইহুদিদের মোজেস?”
”ইয়েস। রূপার সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলেও দেখলাম রোম শহরে মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর সেই বিখ্যাত মোজেসের মূর্তির অনেক ছবি। রূপাকে একটা ইহুদি পরিবারে দত্তক নেওয়া হয়েছিল। নতুন বাবা-মা-র সঙ্গে সে চলে গিয়েছিল সুইডেনের স্টকহোমে। সেখানে স্কুল, স্কুল শেষ করে বোটানি নিয়ে পড়াশুনো প্যারিসের এক কলেজে। পড়া শেষ করে মেডিসিনাল প্ল্যান্ট নিয়ে রিসার্চ। রূপা নেইলসনের পুরোনো পাসপোর্ট বলছে, গত দু-বছরে রূপা ইন্ডিয়ায় এসেছে মোট তিনবার। আঞ্জুনা থানার তরফে রূপা নিরুদ্দেশের পর সুইডেনে তাঁর বাবা-মা-র সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। টেলিফোনিক রেকর্ডের বয়ান অনুযায়ী, রূপার সুইডিশ বাবা মি. জোনাথন নেইলসন জানাচ্ছেন, দেশের নিয়ম অনুযায়ী আঠেরো বছর বয়সে রূপাকে আসল সত্যিটা তাঁরা জানিয়েছিলেন। এমনিতেও রূপা কৃষ্ণাঙ্গী, দক্ষিণ ভারতীয়দের মতো চেহারা, নিজের আট-নয় বছর বয়সেই সে বুঝেছিল শ্বেতাঙ্গ বাবা-মায়ের সঙ্গে তার পার্থক্য। স্কুলেও তাকে এ নিয়ে বুলিড হতে হয়। বড়ো হয়ে রূপা যখন সবকিছু জানতে পারে, সে ঠিক করে, ইন্ডিয়ায় আসবে।”
”কী করবে এসে?”
রুদ্র কাঁধ ঝাঁকাল, ”জানি না। সম্ভবত ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। নেইলসন দম্পতি একটি বিদেশি কোম্পানি মারফত এখান থেকে রূপাকে দত্তক নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা সব কাগজপত্র রূপার হাতে তুলে দেন। রূপা এখানে এসে মারগাঁওয়ের অরফ্যানেজে যায়। এবারে সে ইন্ডিয়া এসেছিল ২৪ নভেম্বর। ২৫ নভেম্বর সে গিয়েছিল ওই অরফ্যানেজে। নিখোঁজ হয়েছে ১ ডিসেম্বর। আর খুন হয়েছে ৮ ডিসেম্বর রাতে।”
”বুঝলাম। তা একটা মার্ডার কেস যেমন হয়, এটাও তেমনই। এতে সমস্যাটা কোথায় আর তোমার বন্ধুরই বা বিপদ দেখলে কোথায়! এগুলো প্রোফেশনের পার্ট।” প্রিয়ম উষ্মাভরা গলায় বলল, ”সকালে সবার সামনে ওইরকম দুর্ব্যবহার করলে। তারপর থেকে কোনো ফোনও করোনি। এখন নিজের দোষ ঢাকতে ভুলভাল বলে বিষয়টা লঘু কোরো না প্লিজ।”
”আমি কিছু লঘু করছি না। আমি টায়ার্ড ছিলাম। তুমি আজকের দিনটা নিজের মতো ঘুরেছ, ভালো করেছ। কাল থেকে একসঙ্গে ঘুরব। মিটে গেল।” রুদ্র ফাইলের কাগজগুলো ওলটাতে ওলটাতে বলল।
”আমি তোমার সঙ্গে আর বেরোব না।” প্রিয়ম গম্ভীর মুখে বাথরুমে ঢুকে গেল। নিজের রাগ দেখানোটাও কখনো কখনো প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই মেয়েটা সেই কলেজ লাইফ থেকে একরকম। নিজে ভুল করবে, কিন্তু স্বীকার করবে না। এমন ভাব দেখাবে, যেন কিছুই হয়নি।
বাথরুম থেকে বেরোনোমাত্র প্রিয়ম ভাবল, রুদ্র বুঝি বলবে, ”কেন বেরোবে না? আচ্ছা, স্যরি, আমার ভুল হয়েছে!” এই জাতীয় কিছু।
কিন্তু রুদ্রর সে সব খেয়াল নেই। সে একটা ফাইল ভালো করে দেখছে, ”পুলিশ রূপার ভাই রকিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল নিরুদ্দেশ হওয়ার পরের দিন। রকি জানিয়েছে, রূপা গেছে, কথা বলেছে, চলে এসেছে। রূপা যখন সুইডেন চলে যায়, তখন রকির বয়স মাত্র দেড় বছর। তার কিছু মনেও নেই। তবু সে দিদি যখনই এসেছে, স্বাভাবিক কথাবার্তা বলেছে। এইবার এই রূপা নেইলসনের সঙ্গে ফাদার দুয়ার্তের যোগাযোগ নিয়ে কিন্তু কিচ্ছু লেখা নেই রিপোর্টে। শুধু লেখা আছে, দুয়ার্তে রূপাকে স্নেহ করতেন। কিন্তু কেন করতেন? কীভাবে আলাপ হল দুজনের?”
”কীভাবে?”
”সেটাই তো বের করার চেষ্টা করছিলাম। আরেকটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, দুয়ার্তের আশ্রমে রূপাকে শেষ দেখা গেলেও গোটা ফাইলে দুয়ার্তের কোনো বয়ান নেই। বোঝাই যাচ্ছে, এখানকার পুলিশ ওঁকে সমঝে চলে। সকালেও তড়পাচ্ছিলেন। তবে কিছু কথা বলেছেন। ওঁর সন্দেহ এখানকার কিছু গোঁড়া ফাউন্ডেশনের দিকে।” রুদ্র জল খেতে খেতে বলল, ”এইসব খটকার জন্যই আমি মি. নেইলসনকে আজ দুপুরে ফোন করেছিলাম।”
”মানে রূপার বাবাকে? সুইডেনে? ফোন নম্বর পেলে কোথায়?”
”এই ফাইলেই আছে।”
”কিন্তু তুমি কী পরিচয়ে ফোন করলে? মানে তোমার তো কোনো রাইট নেই এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করার। আমি বুঝতে পারছি না, তুমি ঘুরতে এসে আগ বাড়িয়ে এই কেসটার মধ্যে কেন ঢুকছ!” প্রিয়মের বিরক্তি ক্রমশই বাড়ছিল।
”আমি বলেছি, ইন্ডিয়ার পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে ফোন করছি। উনি আর কিছু সন্দেহ করেননি। ওই অশ্বত্থামা হত ইতি গজ টাইপের। আর পুলিশ হলে কী হবে, শংকর একটু সরল প্রকৃতির। অবসরে কবিতা লেখে। গান গায়। ওকে একটু হেল্প করতে চেষ্টা করছি। ও কেন যেচে গোয়ায় পোস্টিং নিয়েছে জানো?”
”কী করে জানব? তুমি তো ওকেই জিজ্ঞেস করতে বলেছিলে। সেই সুযোগ এখনও পাইনি।”
”ওর বাবা পোর্তুগিজ, মা হিন্দু। বাবা-মায়ের ছোটোবেলায় ডিভোর্স হয়ে যায়। বাবা তখন চলে আসেন গোয়ায়। আবার বিয়ে করেন, ছেলে-মেয়ে হয়। এখন একটা বিচের পাশে রেস্তরাঁ চালান। শংকরের মা কলকাতাতেই আছেন, আগে স্কুলে পড়াতেন। এখন খুব অসুস্থ, ক্যান্সার। মায়ের কাছেই শংকর মানুষ। এতদিন বাবা ছেলের কোনো যোগাযোগ ছিল না। এখন শংকর চেষ্টা করছে বাবার সঙ্গে সম্পর্কটা ঠিক করতে। ওর বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী মারা গিয়েছেন। শেষ বয়সে যদি আবার বাবা-মা-র মিল হয়, ক্ষতি কী!” রুদ্র একটা লম্বা নিশ্বাস নিল, ”ওর কাজে কোনো গাফিলতি হলে দুম করে সাউথ গোয়ায় ট্রান্সফার হয়ে যেতে পারে, সেন্ট্রালেও টেনে নিতে পারে। তাই আমি চাইছিলাম, যদি ওকে বন্ধু হিসেবে কোনো সাহায্য করা যায়।”
প্রিয়ম টেবিলে রাখা ইলেকট্রিক কেটলিতে কফি বানাচ্ছিল। একটা কাপে কফি ঢেলে রুদ্রর দিকে এগিয়ে দিল, ”তা রূপার বাবা কী বললেন?”
”শুনলে অবাক হয়ে যাবে।” রুদ্র সোৎসাহে কাপে চুমুক দিল, ”রূপা নাকি অনাথ ছিল না!”
”মানে?”
”রূপাকে যখন সুইডেন নিয়ে যাওয়া হয়, তখন ওর বয়স চার। ওই বয়সের আবছা স্মৃতি অনেকেরই থাকে। রূপারও আছে। রূপার বাবা ছিল না, কিন্তু মা ছিল। মা কোনো এক বারে সাফাইয়ের কাজ করত। মা, ভাই আর রূপা একটা বস্তিতে থাকত, এটুকুই ওর আবছা মনে আছে।”
”তারপর?”
”রূপা আর ওর ভাইকে ওদের মা রোজ কাজে যাওয়ার আগে একটা পার্কে খেলতে বসিয়ে যেত। ওরা সেখানে খেলত।”
”মানে সেই পার্ক থেকে কেউ ওদের চুরি করেছিল?”
”হতে পারে। রূপা আর কিছু মনে করতে পারেনি। ওর মায়ের সেই স্মৃতি ওকে তাড়া করে বেড়াত। তাই বড়ো হয়ে সম্ভবত নিজের শিকড় খুঁজতে এখানে আসত রূপা। ওর সুইডিশ বাবা-মা-ও ওকে উৎসাহ জোগাতেন। এখানকার অনেক হোম এরকমভাবে বাচ্চা পাচারে যুক্ত। এদের বলে Manufactured Orphan।”
”তৈরি করা অনাথ! এতে লাভটা কী?”
”সেটাই ইন্টারনেটে পড়ছিলাম। তুমি জানলে অবাক হয়ে যাবে, প্রিয়ম! ছয়-সাতের দশকে বিদেশি দম্পতিরা ভারত থেকে মুড়িমুড়কির মতো বাচ্চা দত্তক নিয়ে গিয়েছেন। তাঁরা হয়তো জানেন যে তাঁরা অনাথ শিশুকেই নিয়েছেন, কিন্তু আসলে সেই শিশু অনাথ নয়। লতা ডিক্সট্রা বলে এক ভদ্রমহিলার কথা শোনো। দিল্লির এক অনাথ আশ্রম থেকে তাঁকে দত্তক নিয়ে যান নেদারল্যান্ডসের এক দম্পতি। পরে বড়ো হয়ে লতা দিল্লি এসে জানতে পারে, সে অনাথ তো নয়ই, তাঁর বাবা-মা জীবিত, দুই মেয়ের পর আরও একটা মেয়ে হয়েছে বলে ওর বাবাই ওকে একটা অরফ্যানেজে দিয়ে এসেছিল। সেই অরফ্যানেজও জাল কাজকর্ম করে, লতার বাবাকে টাকাপয়সা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে লতাকে অরফ্যান হিসেবে নিয়ে নেয়। তারপর তার নাম পাঠিয়ে দেয় বিদেশের এক এন. জি. ও.-র কাছে। নেদারল্যান্ডসের সেই দম্পতি এসবের কিছুই জানতেন না, তাঁরা জাল নথিপত্রে সইসাবুদ করে মোটা অঙ্কের ডলার দিয়ে লতাকে নিয়ে যান। এটাকে বলে Inter Country Adoption।”
”কীরকম?”
”ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে-ওঠা এইসব adoption agency গরিব বাবা-মা, কিংবা কোনো কুমারী মা-কে ভুলভাল বুঝিয়ে বাচ্চা নিয়ে নিত। অনেক সময় ছোটোখাটো নার্সিং হোমের সঙ্গেও টাই আপ করা থাকত, সুস্থ বাচ্চা হলেও বলা হত, বাচ্চা মারা গেছে। এদিকে সেই বাচ্চা পাচার হয়ে যেত অ্যাডপশন এজেন্সির কাছে। ২০১১-তে CBI পুনের কয়েকটা নামকরা অনাথ আশ্রমের বিরুদ্ধেও এই একই চার্জশিট দায়ের করেছিল। ২০০২ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে তারা নাকি বাচ্চা কিডন্যাপ করে মোটা টাকায় বেচে দিত বিদেশি এজেন্সিতে।”
”বলো কী!”
”আরও আছে। ২০০৫ সালে চেন্নাইতে মালয়েশিয়া সোশ্যাল সার্ভিস সেন্টার বলে একটা সংস্থা ধরা পড়ে। তারা রাস্তা, পার্ক, ফুটপাত, যেখান থেকে পারত বাচ্চা কিডন্যাপ করে নিয়ে যেত। তারপর সেই বাচ্চাদের অনাথ বলে মোটা টাকায় বিক্রি করে দিত বিদেশি দম্পতিদের। এর মধ্যে কিছু বাচ্চাকে আবার সেক্স র্যাকেটেও জড়িয়ে দেওয়া হত। ২০১৮ সালে রাঁচিতে মিশনারিজ অফ ডিভিনিটির বিরুদ্ধেও তিনটে বাচ্চাকে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল।”
”মিশনারিজ অফ ডিভিনিটি?” প্রিয়ম বিস্মিত, ”মানে মাদার সিসিলিয়ার সংস্থা?”
”হ্যাঁ। সেখানকার একজন সিস্টার নিজে পুলিশের কাছে স্বীকারও করেছিলেন। আরও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় অনাথ আশ্রমগুলোর বিরুদ্ধে এই কমপ্লেইন আছে।”
”ভারতবর্ষ বলেই এগুলো সম্ভব। দেশের ভবিষ্যৎদের নিয়ে এত হেলাফেলা কোনো উন্নত দেশ করবে না।” প্রিয়ম বলল, ”কিন্তু একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পারছি না। রূপা খুন হয়েছে ২০২২ সালে। গোয়ায়। সেই খুনের তদন্তে হেল্প করতে গিয়ে তুমি কুড়ি-বাইশ বছর আগে কী হয়েছে, সেখানে ফিরে যাচ্ছ কেন? এতে তো আরও গুলিয়ে যাবে।”
”আমি নিজেও জানি না। ফাদার দুয়ার্তের কথা অনুযায়ী, রূপাকে খুন হতে হয়েছে কোনো উগ্র মৌলবাদীদের হাতে, যারা ওর লেখা পছন্দ করছিল না। সেটা শংকর ইনভেস্টিগেট করছে। অথচ রূপার বাবা মি. নেইলসন বলছেন, ওঁর মেয়ে আসত নিজের শিকড় খুঁজতে। আমার কীরকম যেন একটা মনে হচ্ছে! গোয়া ইনকুইজিশনে হিন্দু-মুসলিমদের সঙ্গে অত্যাচারিত হয়েছিল অনেক ইহুদিও। রূপা কি সেইজন্যই…?” রুদ্র কপালের দু-পাশের রগ দুটো টিপে ধরল।
”জোনাথন নেইলসন সুইডেন থেকে গোয়ায় এসে দত্তক নিয়েছিলেন কেন? মানে ভারতের তো আরও অনেক শহর আছে!”
”সেটাও জিজ্ঞেস করেছিলাম। জোনাথন নেইলসন আগে কয়েকবার নাকি গোয়ায় এসেছিলেন ঘুরতে। সেই সূত্রেই মারগাঁওয়ের ওই অরফ্যানেজের খোঁজ পান। মারগাঁওয়ে যেতে হবে। কথা বলতে হবে রূপার ভাই রকির সঙ্গেও।” রুদ্র উঠে দাঁড়াল, ”শংকর কি ফিরেছে? ফোন করি একবার!”
.
”ম্যাডাম, আসব?” দরজায় টোকা শুনে ওরা দুজনেই মুখ ফিরিয়ে তাকাল।
মার্তণ্ড।
”ম্যাডাম, স্যার ফিরেছেন। ফরেনসিকের রিপোর্ট এসেছে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট আর পোস্টমর্টেম। ডি. এন. এ. প্রোফাইলিং আসতে দু-দিন সময় লাগবে। আপনারা চাইলে স্যারের ঘরে আসতে পারেন।”
”হ্যাঁ চলো। আর এই ফাইলগুলো নাও। আমার দেখা হয়ে গেছে।”
মার্তণ্ড ফাইলগুলো নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, রুদ্র পিছু ডাকল।
”মার্তণ্ড।”
”ইয়েস ম্যাডাম?”
”ফাদার দুয়ার্তের সঙ্গে তোমার কতদিনের পরিচয়?”
মার্তণ্ড একটু থমকে গেল, ”পরিচয় বলতে তো কিছু, নেই ম্যাডাম!”
”মিথ্যে কথা বোলো না মার্তণ্ড। ইউ. পি. এস. সি. অ্যাসপিরেন্টের মুখে মিথ্যে শুনতে একদম ভালো লাগে না।” রুদ্র শান্ত গলায় বলল, ”আজ সকালে যখন ফাদার দুয়ার্তে এই বাংলোয় এসেছিলেন, বেরোনোর আগে আমাদের সবার চোখ এড়িয়ে তোমার দিকে ফোন করার ইঙ্গিত করেছিলেন। কেউ না দেখলেও আমি খেয়াল করেছি। তা ছাড়াও, দুয়ার্তের আশ্রমে গেস্ট হাউসে ঢোকার সেই বাঁকে যে জলের পাম্প রয়েছে, তুমি নিজে বাঁক পেরোনোর আগেই চেঁচিয়ে বলে আমাদের সাবধান করেছিলে। আগে ওখানে না গেলে তোমার পক্ষে সেটা বলা সম্ভব নয়। তুমি যতই আমাদের সামনে দুয়ার্তেকে মেজাজ দেখাও, তুমি ওঁকে আগে থেকে চেনো। সে চিনতেই পারো। তাতে অসুবিধার তো কিছু নেই। দুয়ার্তে এখানকার একজন রেসপেক্টেড মানুষ। কোনো ক্রিমিনাল নন। কিন্তু লুকোনোর কী আছে?”
মার্তণ্ড চুপ করে রইল।
রুদ্র বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা কাগজ তুলে নিল, ”সকালে চাপোরা ফোর্টের নীচে দ্য ডার্ক হোয়াইট নামের এই কাগজটা তোমার সামনেই আমায় দিয়ে গেল। কাগজটা আমি দুপুরে পড়ছিলাম। মূলত যুগ যুগ ধরে চলে আসা পাদ্রীদের ভণ্ডামি আর অত্যাচার নিয়ে লেখা। এডিটরের জায়গায় শুধু একটা সবুজ পাতা। বেশ ইন্টারেস্টিং কিন্তু! তা-ই না মার্তণ্ড?”
মার্তণ্ড এবার অসহায় চোখে তাকাল, ”বিশ্বাস করুন ম্যাডাম। আমি সত্যিই কিছু জানি না। ছোটো থেকেই আমার সব ধর্মের প্রতি আগ্রহ, সেই ইন্টারেস্ট থেকেই এই কাগজটা আমি পড়ি। একবার একটা জায়গায় ফাদার দুয়ার্তের সঙ্গে এই নিয়েই আলাপ হয়েছিল। উনিও এই কাগজের নিয়মিত পাঠক।”
রুদ্র ভাবলেশহীন মুখে টেবিলের একপাশে রাখা টি-মেকারটায় জল ঢালতে লাগল, ”আগামীকাল সকালে আমরা ওল্ড গোয়া ঘুরতে যাব। ব্যাসিলিকা অফ বম জেসাস, সে’ ক্যাথিড্রাল, মিউজিয়াম…! ফিরে বিকেলবেলা আমি শংকরের সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলব। তার আগে অবধি তোমায় সময় দেওয়া রইল।”
মার্তণ্ড এবার ছটফটিয়ে উঠল, ”আপনি স্যারকে এসব কিছু বলবেন না ম্যাডাম! স্যার আমাকে ভীষণ স্নেহ করেন, ভাইয়ের মতো দেখেন, অনেক হেল্প করেন। এতে ওঁর বিশ্বাস টলে যাবে।”
”শংকর তোমায় ভাইয়ের চোখে দেখে বলে তুমি সেই বিশ্বাসের সুযোগ নেবে, অপব্যবহার করবে, সেটা তো হতে পারে না।”
”আমি… আমি কী করেছি?” মার্তণ্ড আহত চোখে তাকাল।
”বলছি।” রুদ্র জল গরম করল। তারপর তিনটে কাপে গরম জল ঢালল। কাপগুলোয় একটা করে শুগার কিউব ফেলে দিয়ে টি-ব্যাগ ভিজিয়ে দিয়ে প্রিয়ম আর মার্তণ্ডর দিকে এগিয়ে দিল, ”আগে চা খাও।”
মার্তণ্ড দোনামনা করে চায়ের কাপ হাতে নিল। ওর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কপালে ঘাম জমছে বিন্দু বিন্দু।
বাইরে থেকে একটা ইংরেজি গান ভেসে আসছে। সম্ভবত এস.পি. বাংলোর সবচেয়ে কাছের কাফেটেরিয়া থেকে। সঙ্গে আসছে অনেক হাততালির শব্দ। গোয়ার নিশিযাপন শুরু হয়ে গেছে।
প্রিয়ম চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ”যাক! কাল তাহলে ওল্ড গোয়াটা ঘোরা হয়ে যাবে। দুপুরে লাঞ্চ করব পানাজির একটা পোর্তুগিজ রেস্তরাঁয়। আগে থেকে সব খোঁজ নিয়ে রেখেছি। বুঝলে?”
”একদম।” রুদ্র মাথা দোলাল, ”তার আগে এই খবরের কাগজটা দেখো। চারটে মোটে পাতা। ছোটোখাটো খবর বাদ দিলে দুটো বড়ো ধারাবাহিক লেখা রয়েছে। এক, গোয়ার পর্যটন ব্যাবসার আড়ালে নানারকম কালো দিক। সেক্স র্যাকেট, শিশুপাচার। দুই, গোয়া ইনকুইজিশন: ফিরে দেখা। লেখক, সূর্য।”
”তো?” প্রিয়ম জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।
”সূর্যর লেখা কলামটা পড়লে বোঝা যায়, ইনকুইজিশনের চিহ্ন খুঁজতে লেখক গোয়ার প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন। একেকটা গ্রাম ধরে ধরে দেখিয়েছেন পোর্তুগিজদের অত্যাচার। এবারের কিস্তিতে মূলত রয়েছে গোটা গোয়ার একমাত্র মন্দিরের কথা, যা ইনকুইজিশনের সময়েও ছিল অবিকৃত, যার অস্তিত্ব পোর্তুগিজরা কোনোদিন টের পায়নি।” রুদ্র তীক্ষ্ন চোখে মার্তণ্ডর দিকে তাকাল, ”গভীর জঙ্গলের মধ্যে থাকা প্রায় হাজার বছরের পুরোনো সেই পাথরের মন্দিরের কথা আমি আজ সকালেই শুনেছি। মন্দিরটার নাম তাম্বুরি সুরলা শিব মন্দির।”
রুদ্র প্রায় ফ্যাকাশে হয়ে-যাওয়া মার্তণ্ডর মুখের দিকে তাকিয়ে একটা বড়ো নিঃশ্বাস ছাড়ল, ”সূর্যের ম দিয়ে কোনো প্রতিশব্দ মনে পড়ছে, প্রিয়ম?”
”হ্যাঁ।” প্রিয়ম অস্ফুটে বলল, ”মার্তণ্ড।”
১৩
সুরলা নদীর তীরে প্রচুর পাথর। যেকোনো পাহাড়ি নদীর মতো সুরলা নদীর জলও কাচের মতো ঝকঝকে। নদীর দু-পাশ দিয়ে উঠে গিয়েছে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার পাহাড়। ঘন সবুজ অরণ্য।
একটু আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে। বৃষ্টি-ভেজা সবুজের মধ্যে যেন মনে হচ্ছে, এটা কোনো আদিম পৃথিবীর নদী।
তাম্বুরি সুরলা শিব মন্দিরের পেছনদিকের সুঁড়িপথ দিয়ে হেঁটে এসে সুরলা নদীর তীরে চুপ করে বসে ছিল শিরা আর গোকুল। আজকাল ওরা প্রায়ই আসে এখানে। শিরা অন্যমনস্ক চোখে ছোটো ছোটো পাথর তুলে ছুঁড়ছিল নদীতে, সেগুলো মৃদু ঢেউ তুলেই মিলিয়ে যাচ্ছিল। অদূরে পাখি ডাকছে।
ও চোখ বুজে বৃষ্টিস্নাত বনের গন্ধ নিচ্ছিল। গাউনটা উঁচু করে তুলে ধরে একবার করে গিয়ে পা ভেজাচ্ছিল নদীতে। পরক্ষণেই এসে বসে পড়ছিল।
গোকুলের হাতে অনেকগুলো লাল ফল। এগুলো কোকাম্বি, এই অঞ্চলে এই লাল ফলের গাছ অসংখ্য। গোকুল একেকটা ফল ছুরি দিয়ে কাটছিল, ভেতরের টক-মিষ্টি লালচে শাঁসটা এগিয়ে দিচ্ছিল শিরার দিকে।
”রেবেকার মা এখন কেমন আছে?” গোকুল জিজ্ঞেস করল। কত সময় শিরার বাড়িতে গিয়ে ও দেখেছে, আহিরা আর রেবেকা খেলছে। সেই ফুলের মতো ফুটফুটে মেয়েটাকে আগুনে ঝলসে দেওয়া হয়েছে, এই কথাটা ও যতবার ভাবছে, ততবারই যেন সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠছে। দুঃখে, অবিশ্বাসে, আতঙ্কে।
”কেমন আর থাকবে!” শিরার গলা ধরে এল, ”একটা মানুষ চোখের সামনে তিলে তিলে নিজের স্বামী, মেয়েকে মরে যেতে দেখার পর কেমন থাকতে পারে, ভেবে দেখো। নিজের ওপর হওয়া অত্যাচারের কথা তো ছেড়েই দিলাম। রেবেকা’র মা সারাদিন থম মেরে বসে থাকছে জানলার পাশে। আমার পিসি, পাশের বাড়ির সোফিয়ামাসি বার বার গিয়ে মুখে কিছু দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু রেবেকার মা কিছু খায়ই না। পাথরের মতো তাকিয়ে থাকে দূরে। মাঝেমধ্যে হাসে। প্রকাণ্ড জোরে হা হা করে অট্টহাসি। সেই হাসি শুনলে তোমার রক্ত জল হয়ে যাবে। হাসতে হাসতে আবার কাঁদে, ছুটে বেরিয়ে যেতে চায়। বলে, নদীতে ঝাঁপ দেবে। তখন তাকে ধরে রাখা দায় হয়।”
গোকুল চুপ করে রইল, কী বলবে ভেবে পেল না। ওদের এই মোলে গ্রামে প্রায় একশো পরিবার থাকে। তাদের মধ্যে ইহুদি পরিবার রয়েছে কুড়ি ঘর। তারা নামেই ইহুদি, গোকুলদের মতোই ঝরঝর করে কোঙ্কণি ভাষায় কথা বলে, গণেশপুজোর ‘চবথ’-এ বা দীপাবলিতে ওরা গোকুলদের সঙ্গেই উৎসবে-পার্বণে মেতে ওঠে, আবার ওদের ‘সুক্কোত’ কিংবা ‘শব্বত’-এ হিন্দুরাও একইভাবে হইহই করে। ইহুদি উৎসবগুলোয় শিরার পিসি ক্যাথারিন ‘বুরেকা’ নামের সেই মিষ্টিটা বানায়, কী ভালো লাগে খেতে।
শিরা কিছুটা শাঁস মুখে পুরে অন্যমনস্কভাবে বলল, ”আমাদের অনেকেই হয়তো চলে যাবে এখান থেকে।”
”চলে যাবে! কোথায়?”
”সেটা এখনও ঠিক হয়নি। কেউ বলছে, উত্তর ভারতের দিকে যাবে। কেউ বলছে, নিজের দেশে ফিরে যাবে। পোর্তুগাল বা স্পেনে।”
”সেখানেও তো একই জিনিষ চলছে!”
”হুম। তবু মরতে হলে নিজের দেশেই মরবে, এই আর কী!” শিরা একটা লম্বা শ্বাস ফেলল, ”বাবা এসেছিলেন দু-দিন আগে। রেবেকার মা-কে দেখতে। তখন গোটা পাড়া এসে ভিড় করেছিল। সবারই মনে ভয় ঢুকে গেছে। গোয়ায় ইহুদিদের ওপর অত্যাচার শুরু হয়েছে, কিন্তু আশপাশের গ্রামে এখনও তো ওরা সেভাবে আসতে শুরু করেনি। হঠাৎ আমাদের গ্রামে এল কেন? কেউ কি এখান থেকে কথা পাচার করছে? আসলে এমন হচ্ছে, কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সবার মনেই সন্দেহ বাসা বাঁধছে।”
”এখানকার যদি কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করে, আজ হোক, কাল হোক, আগুন তো তার ঘরেও লাগবে!”
”সেটা হয়তো সে উপলব্ধি করতে পারছে না!” কাঁধ ঝাঁকাল শিরা, ”অথবা এমনও হতে পারে, সে আগে থেকেই ওদের সঙ্গে সমঝোতা করে রেখেছে। কিছুই জানি না কী হচ্ছে।”
গোকুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ”তোমার বাবা কী চাইছেন?”
”বাবা এখনই চাইছেন না, যে সবাই এখান থেকে চলে যাক। রেবেকাদের ব্যাপারটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হতে পারে। গোটা গোয়া জানে, মোলে গ্রাম হল গার্সিয়া দে ওরতার দেশের বাড়ি। আর একান্তই তেমন পরিস্থিতি এলে…” শিরা তাকাল, ”বাবা বলেছেন, আমাদের নিয়ে পূর্ব ভারতের বাংলায় চলে যাবেন।”
”বাংলা!”
”হ্যাঁ। বাবা তো আহমদনগরের নিজামেরও চিকিৎসা করেছেন, বাংলায় গিয়ে ওখানকার নবাবের চিকিৎসা করতে পারবেন। তা ছাড়া সেখানে জমি খুব উর্বর, নদীনালা অঢেল, চাষবাসের কোনো সমস্যাই নাকি হবে না। শান্তিও আছে।”
গোকুল কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, ”আর আমি? আমি কী করব?”
গোকুলের কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল, শিরা কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না।
সত্যিই তো, গোকুলকে ছাড়া ও নিজেও কি জীবন কল্পনা করতে পারে? দ্রুত সামলে নিয়ে ও মুখে হাসি ফোটাল, ”তুমি… তুমি কোলেম গ্রামের জামাই হবে। বউকে কোলে নিয়ে দুধসাগরে স্নান করবে, আবার কী!”
গোকুলের বাদামি মুখ নিমেষে লাল হয়ে উঠল।
এদিককার সব গ্রামের মধ্যেই চল রয়েছে এক গ্রামের গাঁওকরের সঙ্গে অন্য গ্রামের গাঁওকরের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা। এতে দুই গ্রামের মধ্যে যোগাযোগও মজবুত হয়, ব্যাবসাবাণিজ্যও করা যায়। বিয়ের পর এখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের আরেকটা প্রথা হল, দুধসাগর জলপ্রপাতে গিয়ে স্বামী স্ত্রী’কে কোলে নিয়ে একসঙ্গে স্নান করবে। বিয়ের পরের সেই প্রথম স্নান নাকি খুব পবিত্র।
কোলেম ওদের প্রতিবেশী গ্রাম। সেই গ্রামের প্রধান উদ্ধব শিরোদকর যে তাঁর কন্যা পার্বতীর সঙ্গে গোকুলের বিয়ে দিতে খুবই আগ্রহী, তা শিরা তার গ্রামের সঙ্গিনীদের কাছে অনেকবার শুনেছে। ও ঢোঁক গিলে বলল, ”তোমায় এই কথাটা কিছুদিন ধরেই বলব ভাবছিলাম। যে সম্পর্কের কোনো পরিণতি নেই, তা আর এগিয়ে লাভ আছে? দুজনেই কষ্ট পাব।”
”আমি কিছু বুঝতে পারছি না, তুমি কী বলতে চাইছ!” গোকুলের চোখ টকটকে লাল হয়ে গেছে। প্রচণ্ড উত্তেজনায় ও শিরার হাত চেপে ধরল, ”আমি তোমায় ছাড়া আমার জীবন ভাবতে পারি না, শিরা!”
শিরার চোখ জলে ভরে গেল। কিছুটা শাঁস মুখে পুরে দ্রুত প্রসঙ্গ ঘোরাতে চাইল ও, ”ওসব কথা থাক। নম্রতাদিদির বিয়েতে যাবে বলেছিলে, কী হল?”
নম্রতা গোকুলের কাকার মেয়ে। গোকুলের কাকা থাকেন গোয়া শহরে, সেখানে তাঁর একটা বিদ্যালয় রয়েছে। নম্রতাদিদি মাঝে মাঝেই মোলে গ্রামে আসে। তখন শিরা, আহিরা আর নম্রতা অনেক গল্পগুজব করে।
”যাব না।” জোরে মাথা ঝাঁকাল গোকুল, ”তুমি আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।”
”যাবে না?” শিরা প্রাণপণে গোকুলকে স্বাভাবিক করতে চাইছিল, ”কবে থেকে প্রস্তুতি চলছে, নতুন জামাকাপড় তৈরি করালে, আর যাবে না কেন?”
”বিয়ে হচ্ছে না তাই।” অনিচ্ছায় উত্তর দিল গোকুল।
শিরা বিস্মিত হল। নম্রতাদিদির বিয়ে ঠিক হয়েছে স্বজাতির মধ্যেই, ওর হবু স্বামী জাতে শিরোদকর, গোয়ায় পারিবারিক আসবাবপত্রের ব্যাবসা। ভালো অবস্থা। নম্রতাদিদিকে যে ওদের খুব পছন্দ হয়েছে, তা গোকুল নিজেই শিরাকে বলেছিল। হঠাৎ কী এমন হল?
”দুই বাড়ির মধ্যে কোনো সমস্যা হয়নি।” গলাখাঁকারি দিল গোকুল, ”গোয়ায় নতুন নিয়ম হয়েছে, কোনো হিন্দু পণ্ডিত হিন্দু মতে বিয়ে দিতে পারবেন না।”
”আজব কথা বলো। হিন্দু পণ্ডিত হিন্দু মতে বিয়ে দেবে না তো কি ইহুদি মতে দেবে?”
গোকুল বুঝল, শিরা কিছুতেই এখন অন্য প্রসঙ্গে কথা বলবে না। বাধ্য হয়ে ও বলল, ”এইসব কাণ্ডই তো আজকাল গোয়ায় ঘটছে শুনছি, শিরা। যখন-তখন যাকে-তাকে দিনের আলোয় তুলে নিয়ে গিয়ে আটক করছে ইনকুইজিশন আদালতে। সেখানকার খুপরিগুলোয় নাকি একখানা জানলাও নেই। দিনে কোনোমতে একবেলা খেতে দেওয়া হচ্ছে। আমার এক বন্ধু ইন্দ্র, তার কাকার সঙ্গে কী হয়েছে জানো?”
”কী?”
”ইন্দ্রর কাকার গোয়ার এক জমজমাট বাজারে ঠাকুরের মূর্তির দোকান। খুব পসার সেই দোকানের, অনেক দূরদূরান্ত থেকে সেখানে লোকে মূর্তি কিনতে আসে। আমাদের বাড়ির ঠাকুরগুলোও সেখান থেকেই আনা। ওর কাকা বয়স্ক শান্তশিষ্ট ভদ্রলোক, একদিন সবে দোকান খুলেছেন, কর্মচারীরা খদ্দেরদের মূর্তি দেখাচ্ছে, হঠাৎ কয়েকটা লোক এসে সবার সামনে ওর কাকাকে মারতে মারতে নিয়ে গিয়ে বন্দি করেছে ইনকুইজিশন আদালতে।”
”ওঁর অপরাধ কী?”
”বাজারে হিন্দু দেব দেবীর মূর্তি বিক্রি করা সেদিনই নিষিদ্ধ করা হয়েছে, ইন্দ্রর কাকা খবরটা পাননি। উনি বন্দি রয়েছেন এক মাস হয়ে গেল, এখনও বিচারের জন্য আদালতে তোলা হচ্ছে না। একবেলা খেতে দেওয়া হচ্ছে, উনি নিরামিষভোজী জেনেও ইচ্ছা করে খাবারে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে মাছ বা মাংস।”
”এরা এত নিষ্ঠুর কেন!” শিরার মুখে বেদনার ছাপ ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল, ”রেবেকার মা-কেও জোর করে শুয়োরের মাংস খাইয়েছে। এরা কি বোঝে না, যে কোনো ধর্মের প্রথম শর্ত হল অন্য ধর্মকে সম্মান করা? কী অদ্ভুত!”
”গত পাঁচ প্রজন্ম ধরে আমাদের পূর্বপুরুষ মোলে গ্রামের গাঁওকর হয়ে আসছে। সেখানে হঠাৎ যে আমার বাবাকে সরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে, সেটাও কি অদ্ভুত নয়?” গোকুল একটা নিশ্বাস ফেলল, ”ধর্ম কী আজও বুঝলাম না শিরা। তবে আমার বাবা বলেন, মহাভারতে লেখা আছে, যে আচরণ তুমি অন্যের থেকে পেতে চাও না, সেই আচরণ অন্যের প্রতি না-করাই হল ধর্ম। ধর্ম মানে মানুষকে ভালোবাসা। আর সেই ভালোবাসা কখনো অন্যায় নয়।”
গোকুলের শেষ বাক্যে এমন কিছু ছিল, শিরা কেমন যেন কেঁপে উঠল। বিহ্বলতা কাটিয়ে চকিতে উঠে দাঁড়িয়ে ও বলল, ”আমি যাই। দেরি হয়ে যাচ্ছে। পিসি বকবে!”
গোকুল আড়ষ্টতা সরিয়ে উঠে শিরাকে জড়িয়ে ধরল, ”ভয় পেয়ো না শিরা!”
শিরা কাঁপছিল। ওর সদ্যতরুণী শরীরটা নিজের অজান্তেই জেগে উঠছিল। ভয়ে না আনন্দে ও জানে না, তবে এটুকু বুঝতে পারছিল, গোকুলের স্পর্শ, গোকুলের গায়ের পুরুষালি ঘ্রাণ, গোকুলের ভালোবাসা ওকে যেন কয়েক মুহূর্তে অনেক বড়ো করে দিচ্ছে। এক অদ্ভুত ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়ছিল মনে।
গোকুল ফিসফিস করল, ”কোনো ধর্মই ঘৃণার কথা বলে না, বলে মানুষরা।”
”কিন্তু আমরা তো মানুষদের মধ্যেই থাকি। রেবেকারাও থাকত। দেখছ তো কী হচ্ছে! চেনা মানুষগুলোও অচেনা হয়ে যাচ্ছে।” শিরা অস্থির গলায় বলল।
গোকুলের চোখ ছলছল করছিল, ”ওদিকে তাকাও।”
শিরা কাঁপতে কাঁপতে তাকাল। জঙ্গলের গাছপালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে তাম্বুরি সুরলা শিব মন্দিরের চূড়া। কী শান্ত-স্নিগ্ধ চারপাশ। পাখি উড়ছে। আকাশে ঝকঝক করছে মেঘ।
নির্মল প্রকৃতির মতো মানুষ শান্ত নয় কেন?
”চলো, আমরা আজ নির্জন তাম্বুরি সুরলা মন্দিরে দাঁড়িয়ে শপথ করি। আমরা কখনো আলাদা হব না, শিরা! প্রয়োজনে আমরা এই পোর্তুগিজ রাজ্য থেকে অনেক দূরে চলে যাব। প্রয়োজনে আমরা না হয় বাংলায় চলে যাব, দুজনে মিলে সেখানে নতুন সংসার পাতব! কেমন?”
শিরা উত্তর দিল না।
কিছুটা অস্থির হয়ে গোকুল ডাকল, ”শিরা!”
সংকোচ ছুড়ে ফেলে শিরা এবার মাথা রাখল গোকুলের বুকে। ওর বুকের ভেতরটা কাঁপছে, আনন্দে।
ঘণ্টা দুয়েক পর ওরা দুজন যখন আপন খেয়ালে হেঁটে আসছিল মোলে গ্রামের দিকে, তখন নির্জন নদীর পাড়ে তিরতির করে একটা নৌকো ভিড়ছিল। ঘাটে শব্দ হচ্ছিল ছপছপ।
নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল গোকুল আর শিরা কেউই খেয়াল করল না, সেই নৌকো থেকে কেউ একজন তাদের তীক্ষ্ন চোখে দেখছে।
১৪
আয়ার্ল্যান্ডের ডাবলিন থেকে গোয়া আসার কোনো সরাসরি উড়ান নেই। ডাবলিন থেকে ফ্র্যাংকফুর্ট। ফ্র্যাংকফুর্ট থেকে ম্যাসকট। সেখান থেকে গোয়া। গোটা প্লেন জার্নিতে সময় লাগল কুড়ি ঘণ্টারও বেশি।
তাতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। এখন আন্তর্জাতিক সব উড়ানেই ওয়াই ফাই পাওয়া যায়। প্রথম ফ্লাইটে ভালো করে ঘুমিয়ে নিয়ে পরের ফ্লাইট দুটোয় আনন্দিনী নিজের কাজ অনেকটা এগিয়ে নিয়েছে।
ফ্রেডি পিটের অপরাধ সামনে আসার পরও প্রথমে কেসটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। ফাদার ফ্রেডি পিট তখন গোয়ার এক সম্মানীয় ব্যক্তি। তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ নিয়ে বেশি দূর এগোতে চায়নি পুলিশ। তারপর শীলা বারসে নামে মুম্বইয়ের একজন শিশু অধিকারকর্মী এই নিয়ে আন্দোলন শুরু করলে তখন ধরপাকড় শুরু হয়। আনন্দিনী শীলা বারসের ফোন নম্বর জোগাড় করেছে। পৌঁছে কথা বলবে, তেমন হলে মুম্বইয়ে গিয়ে দেখাও করে আসতে পারে।
ফ্রেডি পিট গুরুকুল অরফ্যামিলি নামের ওই অনাথ আশ্রম খুলেছিল সাতের দশকে, তখন সেটা ছিল গোয়ার কোলভা অঞ্চলে। কিছু বছর পর মারগাঁওয়ের ওই ফ্ল্যাটে আশ্রমটাকে শিফট করা হয়। ভার্গরাজের অভিযোগের পর পুলিশ সেই ফ্ল্যাটে রেইড করে। খোঁজ মেলে প্রায় কুড়ি বছর ধরে চলা হাড়-হিম-করা এক আন্তর্জাতিক সেক্স র্যাকেটের খবর। উদ্ধার হয় আশ্রমের বাচ্চা ছেলেদের সঙ্গে বয়স্ক শ্বেতাঙ্গদের যৌনতার তেইশশোরও বেশি পর্ন ছবি, প্রায় দেড়শো ফিলমের নেগেটিভ, প্রচুর ইঞ্জেকশন ও ড্রাগ।
আনন্দিনী এর মধ্যেই সেই মামলার অনেক সাক্ষীর বয়ান জোগাড় করেছে। সেগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা রয়েছে তার ফাইলে। ম্যাসকট থেকে গোয়া আসার মধ্যরাতের উড়ানে সবাই যখন নিদ্রায় আচ্ছন্ন, হালকা আলো জ্বালিয়ে ও তখন নিজের ল্যাপটপে সবকিছু নোট করছিল।
ফ্রেডি পিট মামলায় সাক্ষী দিয়েছিল অনেকে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য গুরুকুল অরফ্যামিলির অনাথ আবাসিকরা। গত পনেরো দিন ধরে ইন্টারনেট ঘেঁটে গোয়া আদালতের ওয়েবসাইট থেকে মামলার সব নথি জোগাড় করেছে আনন্দিনী। ভবিষ্যতের স্বার্থে প্রত্যেকের নাম অবশ্য সেখানে গোপন রাখা হয়েছে।
পনেরো বছরের প্রথম আবাসিক ‘ক’ জানাচ্ছে, ১৯৯১ সালে গুরুকুল অরফ্যামিলিতে মোটামুটি পঁচিশটা ছেলে ছিল, যাদের বেশির ভাগেরই বয়স বারো বছরের নীচে। ‘ক’-এর বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায়, মা একা খেটে পেরে উঠছিল না। তাই ‘ক’ এবং তার ভাইদের ফ্রেডি পিটের আশ্রমে দিয়ে আসে। তখন ‘ক’-এর বয়স দশ বছর। হোমে এসে থেকেই সে দেখেছে, প্রতিরাতেই ফ্রেডি পিট সম্পূর্ণ উলঙ্গ থাকেন, এবং কোনো না কোনো কিশোরকে নিজের ঘরে ডেকে নেন। বাচ্চা ছেলেদের দিয়ে ফ্রেডি পিট হস্তমৈথুন থেকে মুখমৈথুন, সবরকম কাজই করাতেন। অনাথ বাচ্চাগুলো বাধ্য হয়ে সেসব করত। প্রচুর বিদেশি আসত ফ্রেডি পিটের ফ্ল্যাটে। তারা একেকটা বাচ্চাকে নিয়ে চলে যেত হোটেলে। কয়েকদিন থেকে আবার ফিরিয়ে দিয়ে যেত। এইজন্য ফ্রেডি পিটের মিলত মোটা টাকা।
‘ক’ নিজে গত কয়েক বছর ধরে নীল অস্কার জনসন নামে এক সুইডিশ সাহেবের সঙ্গে হোটেলে যায়। জনসন সাহেব প্রতিবছর গোয়ায় আসে, এসে তিন-চার মাস করে থাকে। ‘ক’-কে নিয়ে যায় কোলভা বিচের সুখসাগর হোটেলে। ‘ক’-কে নতুন জামাকাপড়ও দিয়েছে সেই সাহেব। আরেকজন সাহেব আছে, তার নাম ম্যাকব্রাইড। নিউজিল্যান্ড থেকে আসে। তার সঙ্গে ‘ক’-কে যেতে হত বেনাউলিম বিচের এক গেস্ট হাউসে। সেই গেস্ট হাউসের মালকিন নিজেও সাক্ষ্য দিয়েছে, ম্যাকব্রাইড নামের সেই সাহেব বছরে দু-তিনবার কোনো না কোনো কিশোরকে সঙ্গে করে এসে তার গেস্ট হাউসে উঠেছে। পায়ুসংগম, যৌন অত্যাচার থেকে এমন কিছু বিকৃতি ছিল না, যা অনাথ ছেলেগুলোকে দিয়ে করানো হত না।
ল্যাপটপে টাইপ করতে করতে কখন যেন একানব্বইয়ের সেই গোয়ায় চলে গিয়েছিল আনন্দিনী। নিজেকে যেন সেই গুরুকুল অরফ্যামিলির একজন করে ফেলেছিল ও। তীব্র কষ্টে, রাগে ওর ঠোঁটদুটো কাঁপছিল।
বাচ্চাগুলোর কারো বাবা-মা ছিল না, কারো থাকলেও খাওয়ানোর সামর্থ্য ছিল না বলে ওই হোমে থাকত। নিতান্ত দায়ে পড়ে সহ্য করতে হত ফ্রেডি পিট আর ওর বন্ধুদের বিকৃতি। দশ কিংবা বারো বছর বয়সেই পৃথিবীর যে নোংরা দিকটা তাদের দেখতে হয়েছে, সহ্য করতে হয়েছে, সারাজীবনেও কি ওরা সেই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারবে? কাটিয়ে উঠতে পেরেছে এতদিনে?
উফ! মানুষ মানুষই পারে এত নিষ্ঠুর হতে, এত নির্মম হতে। মানুষই পারে নিজের লালসার জন্য নিষ্পাপ শিশুদের ব্যবহার করতে। মানুষই পারে এতটা অমানুষ হতে।
”ম্যাম! ডু ইউ নিড আ টিস্যু?”
বিমানসেবিকার ডাকে সংবিৎ ফিরে পায় ও, ওর দু-চোখ দিয়ে বেয়ে-আসা জলের ধারা এই কম আলোতেও সহৃদয় এয়ারহোস্টেসের চোখ এড়ায়নি। আনন্দিনীর দিকে সে টিস্যু এগিয়ে দিচ্ছে।
”থ্যাঙ্কস!” আনন্দিনী চোখের জল মুছে স্বাভাবিক হয়।
ল্যাপটপের স্ক্রিনে একটা মেসেজ ঢোকে। প্রফেসর জয়েশ পটেল।
”তুমি কি পৌঁছে গেছ? রূপার সঙ্গে কথা হয়েছে? আমাকে জানাবে। উইশ ইউ অল দ্য বেস্ট!”
আনন্দিনীর মনের গুমোট ভাবটা একটু কাটে। ওদের ডিপার্টমেন্টের মেয়েমহলে ড. জয়েশ পটেল বেশ জনপ্রিয়। সুদর্শন সুদেহী ড. পটেল বাচালও নন, আবার গম্ভীরও নন। সুন্দর ছবি আঁকেন। ট্রিনিটি কলেজে আছেন প্রায় সাত-আট বছর হল। অবিবাহিত এই অধ্যাপককে কখনো কারো সঙ্গে লিভ ইন করতে দেখা যায়নি। ইয়োরোপিয়ান কালচার, সেখানে সবকিছুতেই রাখঢাক কম। ড. পটেল সমকামী নন। তবে এখনও একা কেন?
আনন্দিনীর হঠাৎ মনে পড়ে যায় নিকোটার বলা কথাটা। আর মনে পড়ামাত্র ওর গাল দুটো আরও লালচে হয়ে ওঠে।
মেয়েটা খুব ঠোঁটকাটা। বলছিল, ড. পটেলের যে আনন্দিনীর ওপর বিশেষ আগ্রহ রয়েছে, সেটা ডিপার্টমেন্টের সবাই খেয়াল করেছে। ও না এলেই ড. পটেল নানারকম খোঁজখবর নেন ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ আনন্দিনী নিজে যেচে একবার ডেটে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। এখানে অনেকেই দেয়। কিন্তু ড. পটেল কী একটা অজুহাত দিয়ে কাটিয়ে দিয়েছিলেন।
ড. পটেলের আন্ডারে আরও চারজন রিসার্চ করছে। তারা নিজেদের গবেষণার জন্য সারা দুনিয়া ঘোরে।
সবাইকেই কি উনি এভাবেই মেসেজ করে খোঁজ নেন?
ভাবতে ভাবতে ও আবার নিজের কাজে মনোযোগ দেয়। এত ঘণ্টার জার্নিতে ও কমপক্ষে পঞ্চাশবার রূপাকে ফোন করেছে। কোনো পাত্তা নেই। মেয়েটার হলটা কী?
রূপার সঙ্গে ওর আলাপ প্যারিসের একটা কনফারেন্সে পেপার প্রেজেন্ট করতে গিয়ে। বছর তিনেক আগে। ও সোশিয়োলজি, রূপা বোটানি। কিন্তু কিছু কিছু মানুষের সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি বন্ধুত্ব হয়ে যায়। রূপার সঙ্গেও আনন্দিনীর তেমনটাই হয়েছে।
রূপা ওর জীবনের সব দুঃখ আনন্দিনীকে বলেছে। ওর ইহুদি বাবা-মা, তাঁদের স্নেহ, নানারকম টানাপোড়েন—সব জানে আনন্দিনী। রূপা যখন ঠিক করেছিল, ও ভারতবর্ষের পশ্চিমঘাট অরণ্যের গাছগাছালি নিয়ে রিসার্চ করতে যাবে, আনন্দিনী প্রথমে বেশ বিস্মিত হয়েছিল। হঠাৎ সুইডেন ছেড়ে ভারতে কেন?
রূপা বলেছিল, ”তিনটে কারণ আছে, আনন্দিনী! এক, পশ্চিমঘাট অরণ্য এত ঘন, সেখানকার অনেক গাছই এখনও এক্সপ্লোর করা হয়নি, সেটা আমার অ্যাকাডেমিক কেরিয়ারে কাজে লাগবে। দুই, কাজের ফাঁকে ফাঁকে চেষ্টা করব, যদি আমার আসল বাবা-মা-কে খুঁজে বের করতে পারি।”
”ওহ তা-ই তো! তোর বাড়ি তো গোয়াতেই ছিল। আর তিন নম্বর কারণ?”
রূপা সামান্য চুপ করে থেকে বলেছিল, ”বাবা চান, আমি গোয়ার ইতিহাস নিয়ে লিখি।”
”তোর বাবা তো সুইডিশ, উনি গোয়ার ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী হলেন কেন?”
”বাবা তো ইহুদি, বাবার পূর্বপুরুষ আগে গোয়াতেই থাকতেন। সেখানে অনেক কালো স্মৃতি রয়েছে পরিবারের।” রূপা নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরেছিল, ”আমি গিয়ে হোটেলে থাকতেই পারি। কিন্তু কোনো পরিচিত লোকের সাহায্য পেলে আমার এই তিনটে কাজই করতে সুবিধা হবে। তুই কি কাউকে চিনিস?”
দু-বছর আগের কথা ভাবতে ভাবতে আনন্দিনী একটা লম্বা শ্বাস নিল। ও নিজে সুখী পরিবারের মেয়ে, ওর বাবা দিল্লির বিত্তশালী ব্যবসায়ী। তিন প্রজন্মের প্রবাসী বাঙালি। কিন্তু এত বৈভবে মানুষ হয়েও ওর মধ্যে একটা সহমর্মী মন আছে। সেই মনটাই হয়তো এভাবে অন্যের দুঃখে কষ্ট পায়। ছোটো থেকে পাড়ার কুকুর-বিড়াল হোক বা রাস্তার কোনো ভিখিরি, আনন্দিনী নিজের টিফিন বা হাতখরচ দিয়ে দিত অবলীলায়।
বাবা-মা না থাকার দুঃখ একরকম। আর পৃথিবীর কোনো এক কোণায় বাবা বা মা জীবিত আছে জেনেও তাদের না চেনার, তাদের সঙ্গে পরিচয় না থাকার দুঃখ আরেকরকম। রূপার সুইডিশ বাবা-মা ওকে যথেষ্ট ভালোবাসেন। তবু রাতের পর রাত ফোনের ইথার তরঙ্গ বয়ে রূপার কান্না-ভেজা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে আনন্দিনীর কাছে। যৌবনের সব আনন্দ হাতের কাছে মজুত থাকা সত্ত্বেও নিজেকে ছিন্নমূল এক বৃক্ষ মনে হয় রূপার। সুইডিশ উচ্চারণে সে ধরা গলায় বলে, ”আমাকে আমার মা-কে খুঁজে বের করতেই হবে রে!”
”তাহলে সেটাই ভালো করে কর। তোর থাকতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?”
‘না না! তোর প্রফেসর ভালোই ব্যবস্থা করেছেন। মি. দুয়ার্তে বেশ ভালো মানুষ। অনেক জানাশোনাও আছে ওঁর। আমাকে মারগাঁওয়ের ওই সেন্ট মারিয়া অরফ্যানেজে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।”
”আচ্ছা, তোর ভাই তো আছে ওই হোমে? সে কী বলল দিদিকে দেখে?” প্রথমবার রূপা গোয়া থেকে ফিরে এলে তাকে জিজ্ঞেস করেছিল কৌতূহলী আনন্দিনী।
”ধুর! তার স্মৃতিতেই আমি নেই।”
প্লেনের মধ্যে হঠাৎ খুব জোরে ঝাঁকুনি হতে থাকে। এয়ার পকেটে পড়েছে নির্ঘাত। অতীত থেকে ফিরে এসে নিজের সিটবেল্ট বাঁধে আনন্দিনী। আবার ফিরে আসে নিজের লেখার জগতে।
‘খ’ নামক কিশোর সাক্ষীটির বাবা মারা গিয়েছিল ছয় বছর বয়সে। চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে যুঝতে না পেরে ওর জায়গা হয় ফ্রেডি পিটের গুরুকুল অরফ্যামিলিতে। তারপর সেই একই অভিজ্ঞতা। দিনের পর দিন অপরিণত বয়সে বিকৃত যৌন অভিজ্ঞতা। পুলিশের জেরায় ‘খ’ বেমালুম বলছে, তার এমন কিছু খারাপ লাগত না। খেতে পেত। পরতে পেত। সাহেবরা বিদেশি জামাও দিত অনেক সময়। তার বদলে যেগুলো করতে হত, সেগুলো যে আদৌ অন্যায়, সেটাই কেউ শেখায়নি তাকে। ভালোমন্দ, ন্যায়-অন্যায়বোধই তৈরি হয়নি তার। ‘খ’-র সাক্ষ্যদানে উঠে এসেছে আরও কিছু বিদেশির নাম, যারা প্রতিবছর আসত গোয়ায়, ফ্রেডি পিটের কাছে।
‘গ’ নামক ছেলেটি দশ বছর বয়স থেকেই ইঞ্জেকশনের যন্ত্রণা সহ্য করত। ডমিনিক ও রেমন্ড নামের আরও দুজন শ্বেতাঙ্গের কথা সে বলেছে, যারা ছিল গুরুকুলের নিত্য অতিথি। গোটা কেস হিস্ট্রিতে রয়েছে আরও অনেক নাবালক সাক্ষীর গা শিউরে ওঠা জবানবন্দি। রয়েছে প্রায় ষাট-সত্তরজন লোকের কথা, যারা নিয়মিত অথবা কখনো কখনো যেত ফ্রেডি পিটের ওই অনাথ আশ্রমে। নিজেদের বিকৃত কাম চরিতার্থ করত অসহায় অনাথ ছেলেগুলোকে দিয়ে।
হঠাৎ ককপিট থেকে ঘোষণা শুরু হওয়ায় আনন্দিনী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ল্যাপটপ বন্ধ করে। রূপা এখনও অফলাইন। মেয়েটার কি ফোন খোয়া গেল নাকি?
প্লেন নামতে শুরু করেছে, আর কিছুক্ষণের মধ্যে গোয়া বিমানবন্দরে ল্যান্ড করবে। আনন্দিনী ড. পটেলকে ছোট্ট উত্তর পাঠায়, ”রিচিং গোয়া সুন!”
ওর চোখ কেমন জ্বালা করতে থাকে। হঠাৎ মনে হয়, ওর পিএইচ. ডি.-র শেষ রিসার্চ পেপারটার বিষয়টা একটু বদলালে কেমন হয়? এই ষাট-সত্তরজন দু-পেয়েকে পশু বলা মানে পশুদের অপমান করা। এদের কী শাস্তি দিয়েছে ভারত সরকার?
পরক্ষণে ও আবার মাথা নাড়ে। ফ্রেডি পিট বা তার মতো বিকৃত পিডোফিলদের চরম শাস্তি তো প্রয়োজন, কিন্তু যে নিষ্পাপ প্রাণগুলো শৈশব বা কৈশোরেই দুমড়ে-মুচড়ে গেল, তারা বড়ো হয়ে কোনোদিনও ভালোবাসার মর্ম বুঝতে পারবে?
শারীরিক সম্পর্কের যে পাশবিক কদর্য রূপ তাদের সামনে অসময়ে উন্মোচিত হয়ে গেছে, এরপর কি তারা আর কাউকে ভালোবাসতে পারবে? সুস্থ মানুষ হতে পারবে?
*
শংকর নিজের ঘরে বসে ডায়েরিতে লাল কালিতে কিছু একটা লিখছিল। সামনে ল্যাপটপ খোলা। এদিক-ওদিক কয়েকটা মোটা ফাইল ছড়ানো। মুখে-চোখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। রুদ্র আর প্রিয়মকে ঢুকতে দেখে মুখ তুলল, ”আয়।”
”কী লিখছিস? কবিতা বুঝি?”
শংকর অপ্রস্তুত হল, ”না না!”
রুদ্র হাসল, ”ট্রেনিং-এর সময় মনে আছে, কী বলেছিলি? তুই কবিতা-গান সবকিছু লিখিস লাল কালিতে। কী লিখলি শোনা। অবশ্য যদি তোর আপত্তি না থাকে।”
”নাহ, আপত্তির আর কী! এত ঝামেলার মধ্যে মনটাকে একটু হালকা করছিলাম!” শংকর ডায়েরিটা এগিয়ে দিল।
ডায়েরির পাতায় লাল কালিতে একটাই লাইন লেখা।
গন্তব্য এখনও এক সভ্যতা দেরি।
”বাহ!” প্রিয়ম বলল, ”লাইনটা তো বেশ। সত্যিই আমরা নিজেদের যত সভ্য বলে দাবি করি না কেন, সত্যিকারের সভ্য হওয়ার গন্তব্যে পৌঁছোতে গেলে আমাদের বহু দূর হাঁটতে হবে। হয়তো সব শেষ হয়ে যাবে। নতুন এক সভ্যতা গড়ে উঠবে। তখন আমরা সভ্য হব।”
”হয়তো! সেই নতুন পৃথিবীতে বিকৃতি থাকবে না, অপরাধ থাকবে না, শোষণ থাকবে না।” শংকর একটা নিশ্বাস ফেলল, ”রুদ্র, দুপুরে কি তুই ঘুমোচ্ছিলি?”
”ওই একটু। কাকিমাকে ফোন করলি?”
”হ্যাঁ। এবারের কেমোতে খুব কষ্ট পেয়েছে। মা-কে যে দিদি দেখাশোনা করে, বলছিল, মায়ের কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অনেকক্ষণের জন্য।” শংকর ম্লান মুখে বলল, ”এত কষ্ট পাচ্ছে যে আর দেখা যাচ্ছে না! তবু তার মধ্যেও আকারে-ইঙ্গিতে বাবাকে দেখতে চাওয়ার কথা!”
রুদ্র কিছু বলতে পারল না। কিছু কিছু সময় কোনো কথা বলা যায় না।
”যাক গে!” শংকর দ্রুত প্রসঙ্গ পালটাল, স্বাভাবিক হয়ে বলল, ”বোস, একটু কফি বানাই। প্রিয়ম, তুমি আজ কোথায় কোথায় গেলে?”
”আগুয়ারা ফোর্ট ঘুরে এলাম।” প্রিয়ম সোফায় বসল, ”তোমাদের ওই চাপোরা ফোর্টের থেকে ঢের ভালো। অনেক বড়ো এলাকা, লাইট হাউস আছে, জেল আছে। পাশেই মাণ্ডবী নদী। সেই ১৬১২ সালের পোর্তুগিজ দুর্গ। দারুণ লাগল। না গেলে খুব মিস করতাম।”
কথাটা বলে প্রিয়ম আড়চোখে রুদ্রর দিকে তাকাল। কিন্তু রুদ্রর কোনো হেলদোল নেই। নির্বিকার মুখে সোফায় বসে সে সামনে রাখা ম্যাগাজিন ওলটাচ্ছে।
শংকর বলল, ”হ্যাঁ, আগুয়ারা ফোর্ট আমিও গেছি। ক্যালাংগুট বিচ থেকে আরেকটু যেতে হয়। সিংকেরিম বিচের ওপর।”
”হ্যাঁ, আগুয়ারা মানে পোর্তুগিজ ভাষায় নাকি জল। আচ্ছা, তোমায় জিজ্ঞেস করা হয়নি। তুমি পোর্তুগিজ ভাষা জানো?”
”ধুস!” শংকর হেসে ফেলল, ”বাংলা হিন্দি ইংরেজি ছাড়া আমি কিচ্ছু জানি না। এখন কোঙ্কণি শুনলে একটু-আধটু বুঝতে শিখেছি।”
”সেকী!” প্রিয়ম অবাক হয়ে গেল, ”পোর্তুগিজ জানো না কেন?”
”রুদ্র তোমায় বলেনি?”
”না।” রুদ্র এবার হাসল, ”তুই নিজের মুখেই বল। প্রিয়ম শুনে অবাক হয়ে যাবে।”
শংকর বলল, ”মেদিনীপুরের মহিষাদলের কাছে একটা গ্রাম আছে। পোর্তুগিজ গ্রাম। প্রায় পাঁচশো বছর আগে মহিষাদলের রাজা ছিলেন আনন্দলাল উপাধ্যায়। সেই সময় একদিকে মারাঠা দস্যু বর্গিদের হামলা, অন্যদিকে জলপথে হার্মাদদের আক্রমণ নিয়ে তিনি খুব চিন্তায় ছিলেন। তাঁর স্ত্রী রানি জানকীর পরামর্শে তিনি তখন এই গোয়া থেকে বেশ কয়েকজন পোর্তুগিজ যোদ্ধাকে নিজের রাজ্যে নিয়ে যান। জমি দান করেন, বাঙালি মেয়েদের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তাদের থিতু করেন। যাতে হঠাৎ করে আক্রমণ হলে তারা প্রতিহত করতে পারে। তো, সেই পোর্তুগিজদের বংশধররা এখনও সেই গ্রামে রয়ে গেছে। তারা অবশ্য নামেইপোর্তুগিজ, খালি সারনেমগুলোই আছে। বেশির ভাগেরই সব একেবারে বাঙালিদের মতো। তবে আমার বাবা নিজের গরজে পোর্তুগিজ শিখেছিলেন। চাকরিসূত্রে পরে কলকাতায় চলে যান। তারপর আসেন গোয়ায়। তাঁর মধ্যে একটা ইয়োরোপীয় ঠাটবাট আছে। আমার নেই।”
রুদ্র ভেবেছিল, পশ্চিমবঙ্গের বুকে এইরকম এক টুকরো পোর্তুগাল আছে, সেখানে এখনও পোর্তুগিজরা থাকে শুনে প্রিয়ম হাঁ হয়ে যাবে।
কিন্তু প্রিয়ম খুব একটা অবাক হল না। মৃদু ঘাড় নেড়ে বলল, ”হুম জানি। গ্রামটার নাম মিরপুর।”
”আরে তুমি জানো?” শংকর বিস্মিত, ”কী করে জানলে? তোমার কি ওদিকে কোনো আত্মীয়স্বজন আছেন?”
”কেউ নেই। বছরখানেক আগে একটা পত্রিকায় ‘নীল শিকড়’ বলে উপন্যাস পড়েছিলাম। কোনো এক নতুন লেখিকার লেখা। ওই পোর্তুগিজ গ্রামের প্রেক্ষাপটে। তখনই জেনেছিলাম।”
”বাবা! এর ওপর একটা আস্ত উপন্যাস আছে?” রুদ্র অবাক মুখে তাকাল, ”জানতাম না তো! পড়তে হবে।”
”মিরপুর গ্রামে পেরেইরা, লোবো, ডি সিলভা এইসব পদবির লোকজন আছে।” প্রিয়ম বলল, ”চার্চ আছে, ক্রিশ্চানদের সব উৎসবও হয়। আবার ফুটবলে পোর্তুগাল জিতলে ওরা বিশাল মিছিল বের করে।”
”রাইট!” শংকর হাসল, ”তবে আমি কোনোদিনও যাইনি। বাবা যোগাযোগ রাখতেন না মিরপুরে, কেন জানি না। আমি বড়ো হয়েছি কলকাতাতেই। স্বপ্ন দেখা থেকে গালাগাল দেওয়া, সব বাংলাতে।”
রুদ্র একটু ইতস্তত করে বলল, ”তোর বাবার রেস্টুরেন্টটা আগুয়ারা ফোর্টের কাছে, না? বলেছিলি একবার!”
”হ্যাঁ।” শংকর প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল, ”ফাইলগুলো দেখলি?”

”হুম। অনেক কিছু বলার আছে।” রুদ্র বলল, ”তার আগে বল, পোস্টমর্টেম আর ফিঙ্গারপ্রিন্ট কী বলছে?”
”তুই ঠিকই আন্দাজ করেছিলি। অন্য কোথাও খুন করে বিচে নিয়ে আসা হয়েছিল। বিচে গাড়ির চাকার দাগ পাওয়া গেছে। পোস্টমর্টেম বলছে, খুব শার্প কোনো ওয়েপন, ধারালো ছুরিজাতীয় কিছু দিয়ে গলাটা কাটা হয়েছে। ওয়েপনটা খোঁজা হচ্ছে। সমুদ্রে ফেলে দিতে পারে। আর পেটে অ্যালকোহল মিলেছে।” শংকর বলল, ”সেটা বড়ো কথা নয়। গোয়ায় অ্যালকোহল না-খাওয়া লোকের সংখ্যাই বরং কম। কিন্তু কথা হচ্ছে, রূপা নেইলসন নিখোঁজ হয়েছে ডিসেম্বরের এক তারিখ, খুন হল আট তারিখ মাঝরাতে। তাহলে মাঝের এই সাতটা দিন সে ছিল কোথায়?”
”এই খটকাটাই তো ক্রমাগত ভাবাচ্ছে! ওর অরফ্যানেজে থাকা সেই ভাই? সে কী বলছে?”
শংকর ল্যাপটপটা এগিয়ে দিল, ”দুপুরে মার্তণ্ডকে নিয়ে মারগাঁওয়ের ওই অরফ্যানেজে গিয়েছিলাম। ওর ভাই রকি ওখানকার ম্যানেজার। ভিডিয়োটা দেখ। পুরোটা স্পাইক্যামে রেকর্ড করেছে আমার স্টাফ। আমরা এখানে এভাবে কাজ করি। এতে পরে চার্জশিট ফাইলে খুব সুবিধা হয়।”
”বাহ, এটা ভালো আইডিয়া!” রুদ্র ভিডিয়োটা খুলল।
শংকর, মার্তণ্ড ও আরও দুজন পুলিশ একটা বাড়িতে ঢুকছে। ফাদার দুয়ার্তের অনাথ আশ্রমের মতো খোলামেলা নয়, একটা একটেরে দোতলা বাড়ি। বেশ পুরোনো। কিছু কিছু জায়গায় ইট বেরিয়ে পড়েছে। বাড়ির সামনে লেখা ‘সেন্ট মারিয়া অরফ্যানেজ’।
দরজা দিয়ে ঢুকে অপরিচ্ছন্ন বারান্দা। সেই বারান্দা পেরিয়ে শংকররা ঢুকছে ভেতরে।
রোদ না-আসা অপরিচ্ছন্ন একটা অফিসঘর। এদিক-ওদিক বস্তাবন্দি জিনিসপত্র। একজন মাঝবয়সি লোক জাবদা খাতায় কী লিখতে লিখতে মুখ তুলে তাকাচ্ছেন। সিভিল ড্রেসের শংকরকে দেখে বাজখাঁই গলায় হিন্দিতে বলছেন, ”কী চাই?”
”এটা গোয়ায়!” রুদ্র অবাক হয়ে দেখছিল।
”গোয়া মানেই সবকিছু একেবারে ফ্রান্সের সমুদ্রসৈকতের মতো, তোকে কে বলল?” শংকর ভ্রূ কুঁচকোল, ”এখানে কত ঘিঞ্জি জায়গা আছে জানিস? ক্রাইমের আড়ত একেকটা এলাকা।”
ভিডিয়োতে শংকর বলছে, ”গোয়া পুলিশ থেকে আসছি। রকি কোথায়?”
লোকটা এবার সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে, বলছে, ”বসুন স্যার!”
রুদ্র দেখতে দেখতে বলল, ”তুই আগে কখনো ওখানে যাসনি, না?”
”না। মার্তণ্ডও যায়নি। রূপা নেইলসন নিখোঁজ হওয়ার পর লোকাল পুলিশ গিয়ে একটা রুটিন এনকোয়্যারি করেছিল।” শংকর ফাইল ঘেঁটে একটা কাগজ বাড়িয়ে দিল, ”এই দেখ, এটা ওদের রেজিস্টারের ফোটোকপি। রূপা আর রকির এনরোলমেন্টের পেজ। সেই ২০০২ সালের।”
একটা হাতে লেখা রুল বুক। তাতে পরপর কিছু নাম ও তথ্য। একেবারে বাঁ পাশে প্রত্যেকের ছবি। রঙিন পাসপোর্ট সাইজ ফোটোগ্রাফ। বিবর্ণ।
”এই পৃষ্ঠায় চারটে রেকর্ড রয়েছে। রকি মহাবংশী ছাড়া সবাইকে দত্তক নেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকেরই এজেন্সি হিসেবে নাম লেখা রয়েছে ব্রাইট ফিউচার ইন্টারন্যাশনাল। এই এজেন্সির মাধ্যমেই কি ওদের অ্যাডপ্ট করা হয়েছিল?”
”হ্যাঁ। গোয়ায় যেহেতু প্রতিবছর প্রচুর বিদেশি ট্যুরিস্ট আসে, এখানে এই কালচারটা রয়েছে। তুই কি জানিস, ইয়োরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার অনেক নিঃসন্তান দম্পতি দত্তক নেন ভারতে এসে?”
”জানি। কিন্তু তারা নিজেদের কমিউনিটির বাচ্চাকে দত্তক না নিয়ে এভাবে ভারত থেকে নেয় কেন, সেটা বুঝতে পারি না।”
শংকর ব্যাখ্যা করল, ”এর অনেকগুলো কারণ আছে। প্রথমত, প্রথম বিশ্বের দেশগুলোয় জনসংখ্যা কম, আমাদের দেশের মতো চাইলেই বাচ্চা পাওয়া যায় না। আর অ্যাডপশন অনেক ঝক্কির, নিয়মকানুনও খুব কড়া। অ্যাডপ্ট করার পরেও প্রতিনিয়ত সরকারের কাছে রিপোর্ট দিতে হয়, সরকারও মনিটর করে। দ্বিতীয়ত, ভারতের মতো গরিব দেশ থেকে বাচ্চা লিগ্যালি অ্যাডপ্ট করে নিজেদের উন্নত পরিবেশে তাকে মানুষ করব, এটা ভাবার মধ্যে হয়তো একটা তৃপ্তি কাজ করে। এখানকার সব অনাথ আশ্রম থেকেই এভাবে বাচ্চা অ্যাডপ্টেড হয়। বিদেশি দম্পতিরা প্রথমে ওই ব্রাইট ফিউচারের মতো কোনো আন্তর্জাতিক এজেন্সিতে যোগাযোগ করেন। এজেন্সির সঙ্গে আবার এই সেন্ট মারিয়া অরফ্যানেজের মতো অনাথ আশ্রমগুলোর টাই আপ থাকে, তারা অরফ্যানদের ডেটাবেস ফেলে দেয় নিঃসন্তান দম্পতিদের কাছে। তখন তাঁরা নিজেদের পছন্দমতো কাউকে বেছে নেন। ফাইনালি সব ফর্ম্যালিটিজ করতে আর বাচ্চাকে নিয়ে যেতে তাঁরা আসেন এখানে।”
”এ তো সেই দু-শো বছর আগের দাস কেনা-বেচার মতো!” প্রিয়ম মন্তব্য করল।
”শুনতে খারাপ লাগলেও খানিকটা তা-ই।”
”আর এসবের ফাঁক দিয়ে যারা অনাথ নয়, তারাও পাচার হয়ে গিয়েছে বছরের পর বছর ধরে।” রুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
”ঠিকই বলেছিস। তবে এখন আইন অনেক কড়া হয়েছে। তবুও ফাঁক তো থাকবেই। তবে গোয়ার এজেন্সিগুলো মোটামুটি নিয়ম মেনে কাজ করে। অন্তত গত দশ বছরে কোনো খারাপ রিপোর্ট তো নেই। আমি অরফ্যানেজটার গোটা রেজিস্টারটা দেখেছি, ওই ব্রাইট ফিউচার ইন্টারন্যাশনাল মারফত আরও অনেক দম্পতি বাচ্চা অ্যাডপ্ট করেছে এই কুড়ি বছরে।”
রুদ্র চোখ বুলোচ্ছিল কাগজটায়, ”এই ডাবল অরফ্যান, মেটারনাল অরফ্যান ব্যাপারটা কী?”
”ডাবল অরফ্যান মানে, যার বাবা-মা দুজনেই মারা গেছে। আর মেটারনাল মানে যার মা মারা গেছে, বাবা জীবিত। পেটারনাল মানে উলটোটা।”
”আমি জানতাম, অরফ্যান তাদেরই বলে, যাদের বাবা-মা দুজনেই মৃত।” প্রিয়ম কাঁধ ঝাঁকাল।
”আমিও সেটাই জানতাম।” রুদ্র ভিডিয়োটা আবার চালাল।
রকি মহাবংশী এসেছে। লম্বা-চওড়া পেটাই চেহারা। গায়ের রং বেশ চাপা। কোঁকড়ানো চুল। শংকর ওকে নানারকম প্রশ্ন করছে।
”তুমি রূপা নেইলসনের ভাই?”
”হ্যাঁ, স্যার।”
”এখানে কী করো?”
”বারো ক্লাস অবধি পড়ার পর এখানে সব সামলাই।”
”এই অরফ্যানেজের মালিক কে?”
”মালকিন। মিসেস মার্থা অ্যান্ড্রুজ। উনি থাকেন বিচের কাছে। আমি ম্যানেজার, এ ছাড়া পাঁচজন অফিস স্টাফ আছে। বাচ্চাদের দেখাশোনা করার জন্য রয়েছে ছজন।”
”এখানে কবে থেকে আছ?”
”২০০০ সাল থেকে। তখন আমার দু-বছর বয়স।”
”তোমার বাবা-মা?”
”দুজনেই মারা গেছে তার আগে। বাবা অটো চালাত, অ্যাক্সিডেন্ট হয়। তারপর মা দু-দিনের জ্বরে মারা যায়।”
”মান্ডু মহাবংশী কে?”
”আমার এক কাকা। এখানে কাকাই আমাদের দিয়ে যায়।”
”তোমার দিদি রূপার সঙ্গে তোমার যোগাযোগ ছিল?”
”দিদি চলে যাওয়ার পর ছিল না, কিন্তু তিন বছর আগে দিদি এখানে আসে। তখন থেকে যোগাযোগ শুরু হয়।”
”এর আগে কবে এখানে রূপা নেইলসন এসেছিলেন?”
”আগের বছর।”
”ভাগাতোরের গুড রিটার্ন দুয়ার্তে হোমে তুমি কখনো গেছ?”
”না।”
”রূপা নেইলসন গোয়াতে এলে ওখানে ওঠেন কেন?”
”স্যার, তা তো জানি না। তবে দিদি বলেছিল, আমার খোঁজ যখন প্রথম পাচ্ছিল না, তখন ওই হোমের ফাদার হেল্প করেছিলেন।”
আরও কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদের পর শংকর মিসেস মার্থা অ্যান্ড্রুজের ঠিকানা, ফোন নম্বর নিয়ে বেরিয়ে এল।
রুদ্র ভিডিয়োটা বার বার চালিয়ে দেখছিল। কোনো কোনো দৃশ্য পজ করে জুম করছিল, কোনোটায় আবার স্পিড বাড়াচ্ছিল। প্রায় মিনিট কুড়ি পর ও ভিডিয়োটা বন্ধ করল, ”তুই কীভাবে এগোচ্ছিস শংকর?”
”আমাদের সামনে এখন দুটো কাজ। এক, নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে এই এক সপ্তাহ রূপা নেইলসন কোথায় ছিল? মোবাইলটাও দুয়ার্তের আশ্রমে ফেলে যাওয়ায় তার লোকেশন ট্র্যাক করা যায়নি। নর্থ গোয়ার সব হোটেল, রিসর্ট, হলিডে হোমে খবর নেওয়া হয়েছে, রূপার ছবি কেউ চিনতে পারেনি। রূপা যদি কারো বাড়িতে উঠে থাকে, সে কে? এখানে এসে দুয়ার্তের আশ্রম আর মারগাঁওয়ের ওই অরফ্যানেজ ছাড়া কার সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল? এটা খুঁজে বের করা। আমার টিম রূপার লাগেজ সিজ করেছে, সেখান থেকে কোনো টিকিট বা কিছু পাওয়া যায় কি না সবকিছু খতিয়ে দেখছে। দুই, রূপার মার্ডারের পেছনে মোটিভ কী? একজন সুইডিশ নাগরিক এসে মার্ডার হল, কাগজগুলোয় ঝড় উঠে যাচ্ছে।” শংকরের কপালে ঘাম জমছিল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ”আমাকে এখন আবার যেতে হবে ডি.জি.-র কাছে। আবার একপ্রস্থ ঝাড় খাব। তোরা রেস্ট নে। যদি ডিনারের সময় ফিরতে পারি, দেখা হবে। কাল ওল্ড গোয়ায় ঘুরতে যাস যেন!”
”তোদের অ্যাজেন্ডার মধ্যে আরও দুটো পয়েন্ট যোগ কর।” রুদ্র বলল, ”তিন, রূপার কাকা হিসেবে যাকে দাবি করা হচ্ছে, সেই মান্ডু মহাবংশীকে জেরা করা। রূপা কিন্তু ডাবল অরফ্যান ছিল না। ওকে যখন অরফ্যানেজে দিয়ে যাওয়া হয়, ওর মা বেঁচে ছিল।”
”এটা আবার কোথা থেকে জানলি!”
”আমি নিজে ওর বাবার সঙ্গে আজ দুপুরে কথা বলেছি। আশা করি, এই নাক গলানোটায় তোর আপত্তি নেই। রূপার স্মৃতিতে ওর মা ছিল। সেই কারণেই ও বার বার গোয়ায় আসত। খুঁড়ে বের করতে চাইত নিজের শিকড়কে।”
”কিন্তু দুয়ার্তে বললেন, রূপা পোর্তুগিজদের অত্যাচার নিয়ে লিখত!”
”সে লিখতেই পারে। কিন্তু ওর বার বার আসার একটা কারণ নিজের পরিবারকে খোঁজাও।”
”তাহলে রকি আর রূপা কি একসঙ্গে মা-কে খুঁজত?”
”সেটা আমার মনে হয় না।” রুদ্র সোফায় হেলান দিল, ”কারণ, রকি বলে রূপার একজন ভাই থাকতেই পারে, কিন্তু সেই ভাই সম্ভবত ইনি নন।”
”মানে!” শংকর বিমূঢ়।
”তুই বোধহয় খেয়াল করিসনি।” রুদ্র রেজিস্টারের ফোটোকপিটা এগিয়ে দিল, ”রকি মহাবংশীর যে ছোটোবেলার ছবিটা আছে, তার সঙ্গে রূপা নেইলসনের ছোটোবেলার ছবির হুবহু মিল। দুজনেরই গোল মুখ, দুজনেরই একেবারে আফ্রিকানদের মতো কোঁকড়ানো চুল, দুজনেরই চিবুকের কাছটা একটু চাপা। আমি সকালেই রূপার ডেডবডি দেখেছি। তার এখনকার মুখের সঙ্গেও ছোটোবেলার ছবি মেলানো যায়। কিন্তু ছোটোবেলার মুখের সঙ্গে এখনকার রকির কোনো মিল নেই। চুল সোজা করতে পারে, কিন্তু গোল মুখ কী করে লম্বাটে হয়? চাপা চিবুক কী করে ছড়ানো হয়?” রুদ্র বলল, ”তুই ইমিডিয়েটলি এই-রকি মহাবংশীর ডি. এন. এ. স্যাম্পলিং করিয়ে রূপা নেইলসনের সঙ্গে ম্যাচ করানোর ব্যবস্থা কর। মান্ডু মহাবংশীকে খুঁজে বের করে তার সঙ্গেও ম্যাচ করাতে হবে। আমার মন বলছে, রূপার আসল ভাই রকি এ নয়। তাহলে এ কে? আসল রকিই বা কোথায়? তাকে কি পাচার করে দেওয়া হয়েছিল? ওই অরফ্যানেজের মালকিন মার্থা অ্যান্ড্রুজের কী বক্তব্য? আর এই ব্রাইট ফিউচার ইন্টারন্যাশনাল নামক এজেন্সিটাও অনেক কিছু জানে। ওদের চেপে ধর।”
”ফরেন এজেন্সি। মিনিস্ট্রি অফ ফরেন অ্যাফেয়ারস-এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। আরেকটা কথা, ২০০২ সালে রূপাকে দত্তক নেওয়ার সময় অরফ্যানেজটার মালিক ছিল মার্থা অ্যান্ড্রুজের স্বামী পিটার অ্যান্ড্রুজ।”
”সে কোথায়?”
”গত বছর কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মারা গেছে। আমি এখুনি ডি.জি. স্যারকে সব জানাচ্ছি।” শংকর উদ্ভ্রান্ত মুখে বলল, ”কিন্তু, আমরা মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে যাচ্ছি না তো?”
”সেটার উত্তর দেবে সময়।” রুদ্র আবার মাথায় হাত দিল, ”আরও অনেকরকম ধোঁয়াশা রয়েছে। কিন্তু সেগুলো কী, সেটাই ধরতে পারছি না।”