৫
”প্রথম দিন। দুজনেই টায়ার্ড থাকব বলে কাছাকাছি তিনটে স্পট আজ কভার করব। চাপোরা ফোর্ট, বাগা আর ক্যালেন্ডুলা বিচ।” প্রিয়ম একঝলক ডায়েরিতে চোখ বুলিয়ে নিল, ”খারাপ হবে?”
”একেবারেই না। চাপোরা ফোর্ট কোনটা বলো তো, যেখানে ‘দিল চাহতা হ্যায়’-এর শুটিং হয়েছিল। খুব ভালো লাগবে। তবে বাগা আর ক্যালেন্ডুলা বড্ড ভিড় হয়।” শংকর অর্ধেক চিকেন সসেজ মুখে পুরে বলল, ”চলো, আগে তো বেরোই!”
শংকরের বাবুর্চির নাম আফজল, সে এই সাতসকালেই এলাহি প্রাতরাশের আয়োজন করে ফেলেছে। সসেজ, হ্যাম, টোস্ট থেকে শুরু করে ইডলি, ধোসা, পুরি, ফল সবকিছু থরে থরে সাজানো রয়েছে টেবিলে। রুদ্র, প্রিয়ম, শংকর আর মার্তণ্ড দ্রুত ব্রেকফাস্ট করছিল।
”এটা কী?” রুদ্র একটা ফলে কামড় বসাল। ফলটা টমেটোর মতো দেখতে, গাঢ় লাল রঙের। টক-মিষ্টি খেতে। এমন ফল ও কোনোদিনও খায়নি।
”কোকাম ফল। মহারাষ্ট্র, গোয়াতে এই গাছ প্রচুর হয়। আমি তো আসা ইস্তক দিনে তিন-চারটে করে কোকাম খাই। জুসও বিক্রি হয়। খুব উপকারী। হজমশক্তি বাড়ায়। যাওয়ার সময় কয়েকটা ক্যান দিয়ে দেব তোকে।” শংকর হাসল।
”বাহ থ্যাঙ্ক ইউ। আচ্ছা, ফাদার জেমসন মার্ডারের কোনো কিনারা হল?”
”ও, কাগজে পড়েছিস!” শংকরের মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে গেল, ”মার্ডার কি না সেটাই তো বুঝতে পারছি না। রাঁধুনি অবশ্য বলেছে, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ফাদার হুমকি চিঠি পাচ্ছিলেন। এখন সেটা ফেকও হতে পারে।”
”একজন ফাদার ফেক হুমকিই বা পাবেন কেন?”
”সেটাই খটকা। পাপের শাস্তি পাওয়ার জন্য প্রস্তুত হও, সময় নেই, এইসব।”
”পোস্টমর্টেম কী বলছে?”
”কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। ফাদার জেমসন ডায়াবিটিক পেশেন্ট ছিলেন, নিয়মিত ইনসুলিন নিতেন। এ ছাড়া তো আর কিছু…!”
”মোটিভ কী? একজন ফাদারকে খুন করে কার কী লাভ?”
”সব হোমেই তো ফান্ড থাকে। সেন্ট সেবাস্টিয়ান হোমেও ছিল। সেই ফান্ডের অ্যাকাউন্টসে অনেক অসংগতি।”
”মানে? ডাকাতি?”
”ঠিক তা নয়। গত কয়েক মাস ধরে অনেক ক্যাশ টাকা খেপে খেপে ফান্ড থেকে বেরিয়েছে, যেগুলোর কোনো হিসেব নেই। হোমটার মালিক ছিলেন ফাদার জেমসনই। তিনি কী উদ্দেশে কাকে অত টাকা দিয়েছেন, কোনো উল্লেখ নেই।”
”হুমকি চিঠি আর খেপে খেপে পেমেন্ট?” রুদ্র খেতে খেতে বলল, ”ফাদার কি কোনোরকম ব্ল্যাকমেলের শিকার হচ্ছিলেন?”
”সেটাই আমার সন্দেহ ছিল। কিন্তু রিপোর্টে তো খুনের কোনো হিন্টই নেই। ওদিকে রাঁধুনি ছাড়া হোমের বাকি কর্মচারীদের স্ট্রং অ্যালিবাই আছে, সেদিন সবাই বাড়ি গিয়েছিল। আবাসিক বাচ্চারাও ছিল না। রাঁধুনিকে জেরা করা হচ্ছে।”
রুদ্র দ্বিতীয় কোকামটার দিকে হাত বাড়াল, ”তা এরকম একখানা মার্ডার কেসে তোকে ইনভলভ করেছে কেন? লোকাল থানার আই.সি. কী করছে?”
”আর বলিস না।” শংকরের গলা থেকে বিরক্তি ঝরে পড়ল, ”ছোটো রাজ্য হলে যা হয়। ক্রাইম ব্রাঞ্চের এস. পি. তো, গোটা নর্থ গোয়া আমাকেই সুপারভাইজ করতে হয়। আর ফাদার জেমসনের ভালো চেনাপরিচিতিও ছিল ওপরমহলে।”
”বুঝলাম।” রুদ্র হাই তুলল, ”তুই তো কাল সারাদিন ডিউটিতে ছিলি। রাতেও ঘুম হয়নি। এখন বেরোতে পারবি? তার চেয়ে আজকের দিনটা না হয় বাগানে বসেই…!”
”না না, ওসব কোনো ফ্যাক্টর নয়। বাড়ি বসে কী করব? চল ঘুরেই আসি…!”
শংকর কথা শেষ করতে পারল না, তার আগেই প্রিয়ম বলে উঠল, ”গোয়ার পুলিশরা তোমাদের মতো অত অলস নয়, রুদ্র, তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো। অলরেডি ঘড়িতে সাড়ে দশটা!”
”করছি করছি।” রুদ্র বেজার মুখে টোস্টে মাখন লাগাতে লাগল, ”আচ্ছা ওই দুয়ার্তে বলে ভদ্রলোকের কী হয়েছে রে?”
শংকর প্রিয়মের কথায় হাসছিল, এবার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল, ”ওটা আরেক ঝামেলা। সুইডেন থেকে একটা মেয়ে এসেছিল দুয়ার্তের আশ্রমে। দিনকয়েক আগে থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
”সেকী! দুয়ার্তে বলছিলেন, মেয়েটা কী একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করছিল?”
শংকর বিরক্ত মুখে বলল, ”প্রতিবাদ বলতে, মেয়েটা গোয়ার আদি বাসিন্দাদের ওপরপোর্তুগিজদের অত্যাচার এবং আরও নানারকম বৈষম্য নিয়ে বেশ কিছু আর্টিকল লিখেছে। দুয়ার্তে যা-ই বলুন, ওরকম প্রতিবাদ অনেকেই করে!”
”মানে গোয়া ইনকুইজিশন?” প্রিয়ম জিজ্ঞেস করল।
”হ্যাঁ, ইনকুইজিশন থেকে এখনকার সময়, সব মিলিয়ে মিশিয়ে। এখনও এখানকার কোঙ্কাণি, মারাঠিরা মনে করে, তারা পোর্তুগিজদের তুলনায় নানারকম সুযোগসুবিধা কম পায়, বৈষম্য হয় তাদের প্রতি। এইসব আর কী!”
”হুম, অনেক বিদেশি এসব নিয়ে কাজ করে।” রুদ্র জিজ্ঞেস করল, ”মেয়েটা কবে নিখোঁজ হয়েছে?”
”শেষ দেখা গিয়েছিল ১ ডিসেম্বর রাতে ডিনারের সময়। খেয়েদেয়ে মেয়েটা নিজের ঘরে চলে যায়। সকাল থেকে আর কেউ দেখতে পায়নি। অথচ আশ্রমের ঘরে তার ব্যাগ থেকে শুরু করে পার্স সবকিছু যেমন, ঠিক তেমনই রয়েছে। এমনকী মোবাইল আর জুতোও। শুধু মেয়েটাই যেন হাওয়ায় উবে গিয়েছে।”
”পাসপোর্ট?”
”ঘরেই রয়েছে।”
”ফুটেজ পাওয়া গেছে কিছু?”
শংকর ছুরি দিয়ে একটা আপেল কাটছিল, ”মুশকিলটা হল, দুয়ার্তের আশ্রমে কোনো ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা নেই। সবচেয়ে কাছাকাছি যে সিসিটিভি’টা রয়েছে, সেটা একটা রেস্টুরেন্টের। এখানে দুপুর তিনটে বাজলেই সব খাবারে দোকান বন্ধ হয়ে যায়। লোকজন সারা দুপুর-বিকেল বাড়িতে বিশ্রাম করে। রেস্তরাঁগুলো আবার খোলে সন্ধে ছ-টা নাগাদ, চলে একেবারে মাঝরাত অবধি। সকালেও ঝাঁপ খোলে দেরিতে। মাঝরাত অবধি ওই ফুটেজে কিচ্ছু নেই। তারপর রেস্তরাঁ বন্ধ, তাদের সিসিটিভি-ও বন্ধ।”
”গোয়াতে বিদেশিদের ওপর হামলার খবর মাঝেমধ্যেই পড়ি কাগজে। তবে, সেগুলো প্রায় সবই ছিনতাই-রাহাজানি। মেয়েটার কাছে কি কোনো কস্টলি জুয়েলারি ছিল?” রুদ্র জিজ্ঞেস করল।
”নাহ! তেমন কিছু তো আশ্রমের কেউ নোটিশ করেনি। আর ব্যাগও তো ইনট্যাক্ট রয়েছে।”
”নিজে কোথাও গেলে খালি পায়ে যাবে যেন? আর পাসপোর্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টই বা রেখে যাবে কেন? ঘরে কোনো ধস্তাধস্তির চিহ্ন ছিল?”
”না। গোয়া একেবারে ছোটো রাজ্য, আমরা বাস ডিপো, রেল স্টেশনগুলোয় ছবি পাঠিয়ে অ্যালার্ট করে রেখেছি। লোকাল যে ক্যাবগুলো চলে, তাদেরকেও জানানো আছে। কিন্তু ট্রেসই করতে পারছি না। কোনো অ্যাক্সিডেন্টও হয়নি বা বডি পাওয়া যায়নি। তার ওপর মেয়েটা বিদেশি নাগরিক। সুইডিশ এমব্যাসি থেকে চাপ আসছে। ডি. জি. স্যার বললেন, তোমারই তো এরিয়া, ও.সি.-কে সুপারভাইজ করো।” শংকর কাঁধ ঝাঁকাল, ”সেই চেষ্টাই করছি। আমার আন্ডারে তিনজন আই.সি. আছে। প্রতিটা বাস স্ট্যান্ড থেকে স্টেশন, হোটেল, বারের ফুটেজ ধরে ধরে চেক করা হয়েছে। কিন্তু কোনো ক্লু-ই পাচ্ছি না। এদিকে ফাদার দুয়ার্তে এই চত্বরের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। আমার প্রতিবেশীও। তিনিও ওপরমহলে তদবির করছেন। আমার কাছেও ক্রমাগত আসছেন।”
”ফাদার দুয়ার্তেও কি এখানকার কোনো চার্চের পাদ্রী?”
”না। উনি একটা অরফ্যানেজ চালান। আরও বিভিন্ন চ্যারিটেবল কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন। ভাগাতোরে সবাই ওঁকে খুব সম্মান করে। সেই সম্মান থেকেই ‘ফাদার’ বলে ডাকে। তবে কী জানিস, নিখোঁজ হওয়া মেয়েটা সুইডিশ হলেও আদতে ভারতীয়।”
”তা-ই নাকি?”
”হ্যাঁ। অনেক লম্বা গল্প।” শংকর ন্যাপকিনে মুখ মুছে উঠে দাঁড়াল, ”মার্তণ্ড, আবেলের খাওয়া হয়ে গেছে? গাড়ি বের করতে বলো।”
আবেল শংকরের গাড়িচালক। মার্তণ্ড দ্রুত উঠে খোঁজ নিতে চলে গেল বাইরে।
”মেয়েটা অনাথ, এখানকার একটা অনাথ আশ্রমে মানুষ। নাম রূপা। বাবা-মা একটা বস্তিতে থাকত, মারা যাওয়ার পর চার বছর বয়সে অরফ্যানেজে জায়গা হয়। ওর একটা ভাইও ছিল। রকি। বছরকয়েক পরে গোয়ায় এসে রূপাকে দত্তক নেয় এক নিঃসন্তান সুইডিশ দম্পতি। তারপর ও তাদের সঙ্গে সুইডেন চলে যায়। এতদিন পর নিজের দেশে এসেছিল।”
শংকর জিভ দিয়ে অপশোসের শব্দ করল, ”বেচারা! এসেই অদৃশ্য।”
রুদ্র বেসিনে গিয়ে হাত ধুচ্ছিল, ”রূপাকে কি দুয়ার্তের আশ্রম থেকে দত্তক নেওয়া হয়েছিল?”
”না। রূপা থাকত মারগাঁওয়ের একটা আশ্রমে।”
”আর ওর ভাই রকি?”
”তাকে কেউ দত্তক নেয়নি। সে এখন ওই অরফ্যানেজেই কাজকর্ম দেখাশুনো করে। মানে ম্যানেজার গোছের।”
”তবে রূপা মি. দুয়ার্তের ওখানে উঠেছিল কেন?”
প্রিয়ম এবার ক্লান্তস্বরে বলল, ”এই তোমরা কি যাবে? যদি না যাবে, তবে বলে দাও। দেখো, আমি কর্পোরেটে কাজ করি। অনেক কষ্টে তিনজন জুনিয়রকে প্রজেক্টের কাজ ডেলিগেট করে এসেছি। এসেছি গোয়াটা ঘুরে দেখব বলে। থানাপুলিশের কথাই যদি শুনব, সে তো কলকাতায় বসেই শুনতে পারতাম!”
৬
চাপোরা ফোর্টটা চাপোরা নদীর গায়েই, গোয়ার বরদেজ অঞ্চলে। সমতল থেকে প্রায় দেড়শো সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয় সেই দুর্গে। ইতিমধ্যে সূর্য মাথার ওপর চলে এসেছে, রোদের প্রচণ্ড তেজে চোখ-মুখ যেন ঝলসে যাচ্ছে। শংকরের ইঙ্গিতে মার্তণ্ড দৌড়ে গিয়ে প্রথমেই সবার জন্য একটা করে টুপি কিনে আনল।
ওরা সবাই মিলে টুকটাক কথা বলতে বলতে সিঁড়িতে উঠছিল। শংকর বলল, ”আমাদের ভাগাতোর বিচ থেকে স্পষ্ট দেখা যায় এই ফোর্টটা। আগে নাকি অত ট্যুরিস্ট আসত না। ওই ‘দিল চাহতা হ্যায়’-এর পরই পপুলার হয়েছে জানিস তো!”
”অথচ কত পুরোনো এর ইতিহাস।” রুদ্র বেশ কয়েকটা সিঁড়ি একটানা পেরিয়ে উঠছিল, ”সুলতান আদিল শাহ বানিয়েছিলেন শাহুরা, পোর্তুগিজদের হাতে তা হয়ে গেল চাপোরা। পরে মোঘলরা পোর্তুগিজদের আক্রমণ করতে আবার এখানেই নিজেদের সেনাদলের বেস ক্যাম্প করেছিল। মাঝখানে পারনেমের হিন্দু রাজাও এই দুর্গ নিজের দখলে রেখেছিলেন বছর দুয়েক। আচ্ছা, এর মধ্যে আগে একখানা চার্চ ছিল না?”
”তা তো জানি না!” শংকর ঠোঁট ওলটালেও মার্তণ্ড মাথা নাড়ল, ”ম্যাডাম ঠিকই বলেছেন। দেড়-দু-শো বছর আগে ভেতরে একটা ছোটো চ্যাপেল ছিল। সেন্ট অ্যান্থনির নামে।”
প্রিয়ম জিজ্ঞেস করল, ”আচ্ছা, ওল্ড গোয়ায় রয়েছে সে’ ক্যাথিড্রাল আর ব্যাসিলিকা অফ বম জেসাস। এ ছাড়া আমাদের ওখানকার প্রত্যেক তেমাথা মোড়ের শিব মন্দিরের মতো এখানে প্রতি আশি বা একশো মিটার অন্তর রয়েছে হয় চ্যাপেল নয় চার্চ। এই চ্যাপেল, চার্চ, ব্যাসিলিকা, ক্যাথিড্রাল এগুলোর মধ্যে পার্থক্য কী? সব ক’টাই তো গির্জা!”
”এটা কিন্তু বেশ ইন্টারেস্টিং প্রশ্ন। আমি এতদিন রয়েছি, একবারও তো ভাবিনি!” শংকর মাথা চুলকোল।
”সে কীরে! তুই তো ক্রিশ্চান। তুই জানিস না?”
”আরে ক্রিশ্চান তো নামেই। ওই ক্রিসমাসে, গুড ফ্রাইডেতে, ইস্টারে চার্চে যাই। আবার অষ্টমীতে অঞ্জলিও দিই। ছোটো থেকে বড়ো হয়েছি দুর্গাপুজোয় ঠাকুর দেখে আর কালীপুজোয় বাজি ফাটিয়ে। এত ডিটেইল জানব কী করে?” শংকর কাঁচুমাচু মুখে বলল।
”ছি ছি। তুই হলি পোর্তুগিজদের কলঙ্ক। পোর্তুগিজরা কত ধার্মিক হয়, জানিস?” রুদ্র হাসল।
”আমার চেয়েও ধার্মিক এখানে আরেকজন আছে। এই মার্তণ্ড, বলে দাও তো! কী হিন্দু, কী মুসলিম, কী ক্রিশ্চান, কী ইহুদি, মার্তণ্ড সব ধর্ম গুলে খেয়েছে।”
”তা-ই নাকি?”
”হ্যাঁ। সারা পৃথিবীর সব রিলিজিয়ন নিয়ে পড়াশুনো করা ওর নেশা। শুধু আপশোস একটাই, আমাদের ইউ. পি. এস. সি.-তে রিলিজিয়ন বলে কোনো অপশনাল পেপার নেওয়ার সুযোগ নেই। থাকলে মার্তণ্ডর টপ করা কেউ আটকাতে পারত না!” শংকর হা হা করে হাসল।
কথায় কথায় ওরা ফোর্টের ওপরে উঠে এসেছে। চাপোরা ফোর্টের ডিজাইনটা একটু অদ্ভুত। চারপাশেই খাড়া সিঁড়ি, দুর্গের একেবারে ওপরটা এবড়োখেবড়ো পাঁচিল দিয়ে আবৃত। অনুমান করতে কষ্ট হয় না, এই এবড়োখেবড়ো দেওয়াল শত্রুকে বিপদে ফেলার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে বানানো। সিঁড়ি দিয়ে উঠে প্রবেশপথটাও বেশ সংকীর্ণ, যাতে শত্রু এই অবধি পৌঁছোলেও একসঙ্গে ভেতরে ঢুকতে না পারে।
পাঁচিলের মাঝে অনেকটা উন্মুক্ত সমতলভূমি। সেখানে ইতস্তত ছাগল চরে বেড়াচ্ছে। এদিকে-ওদিকে কাজুবাদামের ঝোপ।
পাশেই বয়ে চলেছে চাপোরা নদী। সেই নদী আরও পশ্চিমে গিয়ে মিশেছে আরব সাগরের সঙ্গে। সব মিলিয়ে চাঁদিফাটা রোদ হলেও নয়নাভিরাম দৃশ্য। পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে সেখানকার ছবি তোলার জন্য ট্যুরিস্টদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে।
”টুপিটা কিনে খুব উপকার করেছিস রে! না হলে এখানে দাঁড়ানো যেত না।” রুদ্র প্রিয়মের দিকে তাকাল, ”এমনি বেশ হাওয়া দিচ্ছে, বলো! কিন্তু রোদ খুব চড়া।”
”হুম।” প্রিয়ম সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে মার্তণ্ডর দিকে এগিয়ে গেল। ছেলেটা একটু ভাবুক প্রকৃতির। গোয়ার ছেলে, নিশ্চয়ই বহুবার এসেছে এই দুর্গে, কিন্তু এমন তন্ময় হয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে রয়েছে যেন প্রথমবার দেখছে।
”ও ভাই মার্তণ্ড, বললে না? চ্যাপেল চার্চ ক্যাথিড্রাল আর ব্যাসিলিকার মধ্যে পার্থক্য কী?”
মার্তণ্ড বলল, ”চার্চ তো জানেনই স্যার, যেকোনো গির্জা, পাদ্রী থাকেন। চ্যাপেল হল ছোটো চার্চ টাইপের। মানে কোনো বিল্ডিং-এর সঙ্গে যুক্ত থাকা ছোটো উপাসনাগৃহ। দেখবেন অনেক মিশনারি স্কুলে বা হোমে থাকে। আবার অনেক বিখ্যাত জায়গাতেও থাকে। যেমন আমেরিকার লাস ভেগাস। সেখানে ছোটো ছোটো ম্যারেজ চ্যাপেল রয়েছে যেখানে বিয়ে দেওয়া হয়।”
প্রিয়ম সোৎসাহে ঘাড় নাড়ল, ”রাইট! দেখেছিলাম। আর বাকি দুটো?”
”চার্চের হেড যদি কোনো বিশপ হয়, তবে সেই চার্চ ক্যাথিড্রালে আপগ্রেড হয়ে যাবে। ‘ক্যাথিড্রা’ শব্দের মানেই হল বিশপের চেয়ার। যেমন আমাদের সে’ ক্যাথিড্রাল, কলকাতার সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রাল।”
”ওই বিড়লা প্ল্যানেটারিয়ামের পাশে যেটা?”
”হ্যাঁ স্যার। আমি কলকাতায় থাকার সময় গেছিলাম। আর ব্যাসিলিকা হল আরেক ধাপ ওপরে।”
”মানে চার্চের ঠাকুরদা!”
”ঠিক বলেছেন। ব্যাসিলিকা মানে রয়্যাল হাউস। এই ব্যাসিলিকা আবার দু-ধরনের। মাইনর আর মেজর। মাইনর ব্যাসিলিকা সারা পৃথিবীতে দু-হাজারের কাছাকাছি রয়েছে। আমাদের গোয়ার ব্যাসিলিকা অফ বম জেসাস তার মধ্যে একটা। আর মেজর ব্যাসিলিকা আছে মাত্র চারখানা। চারটেই ইটালির রোমে। সেন্ট পিটার, সেন্ট মেরি মেজর, সেন্ট পল’স আর সেন্ট জন ল্যাটেরান।” মার্তণ্ড একটানা বলে শেষ করল।
”বাপরে!” রুদ্র বিস্মিত হয়ে বলল, ”তুমি তো দেখছি ক্রিশ্চান ধর্মের অনেক কিছু জানো!”
”এই একই রকমভাবে ও বেদ-উপনিষদ, কোরান, হাদিসও জানে। দিনরাত এইসবে এত সময় নষ্ট করে করে ওর ইউ. পি. এস. সি.-র প্রিপারেশনের ক্ষতি করছে। একেই পুলিশের চাকরি করে পড়া, তার মধ্যে এত সময় নষ্ট করলে হয় নাকি? আগের বার দুটো পেপারে ঝুলিয়ে এসেছে।” শংকর পাঁচিলে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে নদীর হাওয়া খাচ্ছিল, একটা ফোন আসতে বাঁদিকে সরে গেল।
রুদ্র বলল, ”তা হলেও প্রশংসনীয়। এখনকার ক-টা লোক আসল বিষয়গুলো জানতে চায়? সবাই ধর্ম নিয়ে অন্ধ মাতামাতি, ওসকানি, রাজনীতিতেই ব্যস্ত। তোমার এদিকে হঠাৎ আগ্রহ জন্মাল কেন, মার্তণ্ড?”
মার্তণ্ড এত প্রশংসায় বেশ লজ্জা পাচ্ছিল। লাজুক মুখে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই শংকর ফোন রেখে দ্রুত এগিয়ে এল, ”আমাদের এখুনি ফিরতে হবে। রুদ্র, তোরা না হয় থাক। আমি ফিরে গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। এখান থেকে আনজুনা বিচ চলে যাবি। লাঞ্চটা থালাসা বলে একটা গ্রিক রেস্তরাঁ আছে, সেখানে করিস। খুব ভালো খাবার। আমার ড্রাইভার আবেলই নিয়ে যাবে।”
”কী হয়েছে?” রুদ্র মাঝপথে বাধা দিল।
”খুব চাপ হয়ে গেল।” শংকর উদবিগ্ন মুখে তাকাল, ”রূপা বলে মেয়েটার বডি পাওয়া গেছে ভাগাতোর বিচের একটা ফাঁকা জায়গায়, ঝোপের মধ্যে। ডাক্তার দেখে বলেছে, গত চোদ্দো থেকে আঠেরো ঘণ্টার মধ্যে খুন হয়েছে।”
”সেকী স্যার!” মার্তণ্ড হকচকিয়ে গেল, ”খুন?”
”হ্যাঁ। গোটা বডিতে কোনো ইনজুরি নেই, শুধু গলার নলিটা নিপুণভাবে কাটা। ব্লেড জাতীয় কিছু ওয়েপন ইউজ করা হয়েছে। ফরেনসিক টিম রওনা দিয়েছে। দেখি গিয়ে কী অবস্থা। মিডিয়াগুলো এবার ঝাঁপিয়ে পড়বে। এমব্যাসি থেকেও চাপ আসবে।” শংকরকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল, ”মার্তণ্ড, কাম কুইক!”
”দাঁড়া!” রুদ্র প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে খুব মিহি সুরে বলল, ”তোমার আজকের আইটিনেরারিতে আর কি কিছু আছে?”
প্রিয়ম নিরুত্তাপ গলায় বলল, ”নাহ। আর কিচ্ছু নেই। চলো, ডেডবডিটা দেখে আসা যাক! ওটাই দেখার আছে।”
”বাহ!” রুদ্রর মুখ ঝলমল করে উঠল, ”শংকর! আমরাও তোর সঙ্গে যাব!”
”এ কী!” শংকর দ্বিধাগ্রস্ত, ”তোদের তো প্যাকড আপ প্ল্যান, আজকের দিনটা নষ্ট করলে কিন্তু নর্থ গোয়া আর ঘোরা হবে না। আঞ্জুনা বিচ, ওজরান বিচ…!”
”আরে বিচ তো কম বেশি সব জায়গাতেই এক। কালকের প্ল্যানে বাকি বিচগুলো দেখে নেব না হয়!” রুদ্র ততক্ষণে দুর্গের সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করেছে, ”আচ্ছা, চোদ্দো থেকে আঠেরো ঘণ্টা মানে কাল রাতের দিকে মার্ডারটা হয়েছে। এত পরে বডি পাওয়া গেল কেন?”
শংকর বলল, ”সন্ধের পর এসব বিচ খুব ফাঁকা হয়ে যায়। তখন মাতালদের দৌরাত্ম্য চলে। আর ভাগাতোর এমনিতেই ছোট্ট বিচ, বাগা বা আঞ্জুনার মতো অত ভিড়ভাট্টা হয় না।”
”তবুও… রূপা এক সপ্তাহ আগে থেকে নিরুদ্দেশ, কোথাও চলে যাওয়ার এভিডেন্স নেই। তাহলে কাল খুন হল কেন? এই সাত দিন কোথায় ছিল? আচ্ছা, ডেডবডির পায়ে জুতো আছে?”
”হ্যাঁ। ওটা প্রথমেই জিজ্ঞেস করেছি। স্যান্ডাল আছে।” শংকর দ্রুত নেমে গেল।
সিঁড়ি দিয়ে ওরা তিনজন দ্রুত নামছিল। নামতে নামতে মার্তণ্ড সরে এল রুদ্রর কাছে। অস্ফুটে বলল, ”ম্যাডাম, আপনি গোয়া ইনকুইজিশন নিয়ে এত কিছু জানলেন কী করে! কাল রাতে শুনছিলাম।”
”এমনিই। জাস্ট কৌতূহল বলতে পারো! অনেক বিদেশি আর্টিকলে নামটার উল্লেখ পেয়েছি, এখানে আসার আগে মনে হল, ভালো করে জানি।”
”গোয়া ইনকুইজিশন সম্পর্কে আপনি বই থেকে যা জানতে পারবেন, তা আসল ঘটনার দশ ভাগের এক ভাগ, ম্যাডাম। গোয়ার রাজধানী পানাজি বলুন বা ভাস্কো, মারগাঁও কিংবা পন্ডা, টাউনে আপনি কিছুই দেখতে পাবেন না। ইনকুইজিশনের ভয়াল রূপ দেখতে গেলে আপনাকে যেতে হবে গ্রামে।”
”গ্রামে?”
”হ্যাঁ। এদিককার গ্রামে গ্রামে দেখবেন ইনকুইজিশনের কিছু চিহ্ন এখনও আছে।”
”কীরকম?”
মার্তণ্ড একটু থমকে বলল, ”আমার আদি বাড়ি নাগোয়া গ্রামে। নাগোয়া হল সলসেটের একটা গ্রাম। সলসেট আর বরদেজ, এই দুটো দ্বীপ পোর্তুগিজরা সবচেয়ে আগে দখল করেছিল।”
”জানি।”
”বরদেজের আগের নাম ছিল বারো দেশ, মানে বারোটা অঞ্চলের সমষ্টি। আর সলসেট ছিল সতষষ্টি, ছেষট্টিটা গ্রাম। পোর্তুগিজরা নাম পালটে দিল। তো, আমার বাড়ি যে নাগোয়া গ্রামে, তার পাশেই ছিল বার্না গ্রাম। বার্না গ্রামের নাম শুনেছেন ম্যাডাম?”
রুদ্র মাথা নাড়ল, ”না তো!”
মার্তণ্ড হাসল, ”বার্না গ্রামের আগের নাম ছিল বরুণপুরী। গোয়ার এইসব ছোটো ছোটো গ্রামের একটা করে গ্রামদেবতা থাকত। তো বার্না গ্রামের গ্রামদেবতা ছিলেন দেবী মহালসা।”
”দেবী মহালসা?”
”হ্যাঁ। সমুদ্রমন্থনের সময় যে অমৃত উঠে এসেছিল, ভগবান বিষ্ণু মোহিনী রূপ ধারণ করে সেই অমৃত অসুরদের থেকে রক্ষা করে দেবতাদের দিয়েছিলেন। বিষ্ণুর সেই মোহিনী রূপই এই পশ্চিম আর দক্ষিণ ভারতের কিছু রাজ্যে দেবী মহালসা নামে পূজিত হন। গোয়াতে তো বটেই, কর্ণাটক, কেরালা, গুজরাতেও মহালসাদেবীর মন্দির পাবেন। তো, বার্না গ্রামের একেবারে মাঝখানে ছিল সেই মহালসা মন্দির। ইনকুইজিশন বলবৎ হওয়ার পর ১৫৬৬ সাল নাগাদ পোর্তুগালের রাজার থেকে অর্ডার আসে যে, ওই দ্বীপের সব মন্দির ধ্বংস করতে হবে। এক বছরে দুশো আশিটা মন্দির ধ্বংস করা হয়। বার্না গ্রামের প্রধান পুরোহিত তখন মন্দির ধ্বংস করার আগের রাতে দেবী মহালসার বিগ্রহটা নিয়ে নদীর ওপারে পালান।”
”ওপারে কেন?”
”তখনও অবধি যে শুধু নদীর এপারটাই পোর্তুগিজরা দখল করতে পেরেছে। ওপারে আদিল শাহের রাজত্ব চলছে। সেটা নিরাপদ। বার্না গ্রামের ওই পুরোহিত তখন ওখানে গিয়ে নতুন করে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই জায়গার নাম পোন্ডা মাল।” মার্তণ্ড একনিশ্বাসে বলে যাচ্ছিল, ”এরকম বহু গ্রাম থেকে পুরোহিতরা বিগ্রহ নিয়ে চলে গেছিলেন ওপারে। সেইজন্য লক্ষ করে দেখবেন, গোয়ার অধিকাংশ বড়ো হিন্দু মন্দির রয়েছে পোন্ডা মালে এবং সেগুলো খুব কাছাকাছি দূরত্বে অবস্থিত। কারণ সেগুলোকে অন্য গ্রাম থেকে তুলে এনে পরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। খেয়াল করবেন, বেশির ভাগ মন্দিরের আর্কিটেকচারে রয়েছে পোর্তুগিজ স্টাইল। মাথায় গির্জার মতো ডোম, ভেতরে চার্চের মতো বড়ো বড়ো হলঘর। মন্দিরের গর্ভগৃহও অনেক উন্মুক্ত জায়গায়, ট্র্যাডিশনাল হিন্দু মন্দিরের গর্ভগৃহ এত খোলামেলা হয় না।”
”যেমন?”
”যেমন মঙ্গেশী মন্দির, কাভালে মন্দির, মারদোল মন্দির।” মার্তণ্ড জোরে নিশ্বাস নিল, ”তবে হ্যাঁ। গোটা গোয়ায় একটাই মন্দির আছে, যেটা পোর্তুগিজ জমানার আগে থেকে একই জায়গায় অবিকৃতভাবে রয়েছে। পশ্চিমঘাট পর্বতের এত ঘন জঙ্গলের মধ্যে সেই পাথরের মন্দির লুকোনো ছিল, যে পোর্তুগিজরা টের পায়নি!”
”কী নাম সেই মন্দিরের?” রুদ্র জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, কিন্তু থেমে গেল।
ফোর্টের সিঁড়ির একেবারে নীচের ধাপে একটা অল্পবয়সি ছেলে দাঁড়িয়ে সব ট্যুরিস্টকে একটা করে লিফলেট দিচ্ছে। আবার টাকাও নিচ্ছে।
প্রথমে মনে হয়েছিল, লিফলেট। কিন্তু না। রুদ্র ভালো করে দেখল। একটা চার পৃষ্ঠার খবরের কাগজ। ওই কোনো ছোটো অঞ্চলের সংবাদপত্র যেমন হয়, তেমন। ইংরেজিতে। নামটা বেশ দীর্ঘ এবং অদ্ভুত।
The Dark White.
দাম মাত্র দু-টাকা। রুদ্র দোনোমনা করে কিনেই ফেলল। সস্তা ফিনফিনে চারটে পাতা। ওপরে লেখা The most infamous weekly of Goa.
গোয়ার সবচেয়ে কুখ্যাত সাপ্তাহিক? এ কেমন ট্যাগলাইন?
”এটা কী কাগজ মার্তণ্ড?”
”এমনি লোকাল পেপার। মানে, গোয়ার নয়। কয়েকজন মিলে যেমন বের করে মনে হয়! সব ট্যুরিস্ট স্পটে দেখি বিক্রি করে আজকাল।” মার্তণ্ড গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল, ”আসুন ম্যাডাম। অনেক গল্প হল। ওদিকে আবার দেরি হয়ে যাচ্ছে। রূপাকে কে খুন করল?”
৭
আয়ার্ল্যান্ডের সুপ্রাচীন ট্রিনিটি কলেজ। হস্টেলের ভেতর থেকে বোঝা যাচ্ছিল না কত জোরে বৃষ্টি পড়ছে। মনে হচ্ছিল, থেমেই গেছে প্রায়। গেট খুলে বাইরে আসামাত্র জলধারার তীব্রতা টের পাওয়া গেল। উত্তেজনার বশে আনন্দিনী ছাতা ছাড়াই বেরিয়ে পড়েছিল। রাস্তায় এসে বুঝতে পারল, ও ভিজে যাচ্ছে। হু হু করে ভিজছে। ভিজছে ওর সাধের থিসিসটাও।
তবু ও ফিরে গেল না। থিসিসের ফাইলটাকে ওড়নার আড়ালে চাপা দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব ছুটতে লাগল প্রফেসরস ক্লাবের দিকে। ঘড়িতে বিকেল সাড়ে চারটে। সোনালি রোদ এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে গোটা ক্যাম্পাসকে। এদিকে সমান্তরালে বৃষ্টিও পড়ছে। আজব শহর এই ডাবলিন। কখন রোদ ওঠে, কখন বৃষ্টি নামে, কোনো ঠিকঠিকানা নেই।
উলটোদিক থেকে কেউ একজন জোরে ছুটে আসছিল। কাছাকাছি আসামাত্র আনন্দিনী চিনতে পারল। ইরফান। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি ডিপার্টমেন্ট। ঢাকা থেকে পড়তে এসেছে। ওকে দেখে বাংলাদেশি টানে চেঁচিয়ে উঠল, ”তোমার ছাতা কোথায়?”
”রুমে। আই অ্যাম লেট, ইরফান! সি ইউ লেটার।” আনন্দিনী ছোটা থামাল না। আর মাত্র আধ ঘণ্টা। আরেকটু দেরি হলেই পটেল স্যার বেরিয়ে যাবেন। তখন সামনের অনেকগুলো দিন মাটি হবে। নিজের বাড়ি থেকে এত হাজার মাইল দূরে পড়তে এসেছে ও, একটা মিনিটও ও নষ্ট করে এখানে বেশি থাকতে চায় না।
সত্যিই, আজও ভাবলে মনে হয় কালকের কথা, ছুটতে ছুটতে ভাবছিল আনন্দিনী। সেই কবে ইয়োরোপের এই আয়ার্ল্যান্ড দেশটায় একা একা পড়তে এসেছিল, তাও পাঁচ বছর হয়ে গেল। দিল্লির এক নামজাদা কলেজ থেকে সোশিয়োলজি নিয়ে মাস্টার্স করে স্কলারশিপ নিয়ে উচ্চশিক্ষায় ডাবলিনে আসা। ইয়োরোপের অন্যতম প্রাচীন এই ট্রিনিটি কলেজে ভরতি হওয়া। তারপর সময় তরতরিয়ে বয়ে যাওয়া। অঙ্কের ছাত্র পঙ্কজের সঙ্গে আলাপ, লিভ ইন, বছর তিনেকের স্বপ্নের মতো জীবন কাটানো। তারপর পঙ্কজের নতুন চাকরি নিয়ে নিউ ইয়র্ক চলে যাওয়া, বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো একদিন ব্রেক আপের প্রস্তাব পাওয়া।
না, বিনা মেঘে বজ্রপাত বলা যায় না একেবারেই, বৃষ্টির ছাট সামলাতে সামলাতে হাসি পেল আনন্দিনীর। শেষ কয়েক মাস যখন পঙ্কজ ওর নতুন সহকর্মিণীর সঙ্গে লিভ ইন করছে, তখন ওকে রীতিমতো উপেক্ষাই করত। আড়ালে-ইঙ্গিতে বোঝাতে চেষ্টা করত, সময় এসেছে এই সম্পর্কটার ডেথ সার্টিফিকেট লেখার।
আনন্দিনী অন্ধ, সব বুঝেও চুপ করে ছিল। অগত্যা পঙ্কজকে মুখ ফুটে বলতেই হল একদিন। প্রথমে ভালোভাবে, তারপর কড়া সুরে। কিন্তু অপ্রত্যাশিত সেই আঘাতে আনন্দিনী একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। চূড়ান্ত হতাশা, অবুঝপনা, কান্নাকাটি তীব্র অবসাদের কয়েকটা মাস! ভাবলেও দম বন্ধ হয়ে আসে ওর, যেন মনে হয় গভীর কোনো কুয়োয় তলিয়ে যাচ্ছে। রিসার্চের কাজকর্ম সব বন্ধ, দিনের পর দিন ঘরের মধ্যে বন্দি হয়ে জানলা দিয়ে উদাস চোখে চেয়ে থাকা।
সবকিছুরই শেষ আছে। অবসাদেরও। তারপর ধীরে ধীরে বন্ধুদের সাহচর্যে মূলস্রোতে ফিরে আসা। রিসার্চ স্কলার হিসেবে গবেষণায় আরও জোরজার মুখ ডুবিয়ে দেওয়া। হস্টেলে নিজের ঘরে পড়াশুনোয় ডুবে থাকা। সেই সময় ওর গাইড ড. পটেলও অনেক মনোবল জুগিয়েছেন।
প্রফেসরস’ ক্লাব ট্রিনিটি কলেজ ক্যাম্পাসের অনেকগুলো ক্লাবের মধ্যে একটা। সারাদিনের ক্লাসের পরে এখানে অধ্যাপকরা এসে নিজেদের মতো করে গল্পগুজব করেন। আবার আড্ডার ছলে অনেক রিসার্চের বিষয়েও আলোচনা হয়। আনন্দিনীর মতো রিসার্চ স্কলাররাও এসে জোটে প্রায়ই।
সোশ্যাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. জয়েশ পটেল প্রফেসরস ক্লাবের প্রকাণ্ড কাফেটেরিয়ার এককোণে কাচের দেওয়াল জোড়া জানলার পাশে বসে অলস চোখে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন। জানলার বাইরে ছোট্ট জলাশয়। সেখানে হাঁস চরছে। বৃষ্টির ফোঁটা জলের মধ্যে পড়ছে টুপটাপ। চারপাশে সবুজ ভেলভেটের মতো উজ্জ্বল ঘাস। কিছু হাঁস প্যাঁক প্যাঁক করতে করতে উঠে যাচ্ছে ডাঙাতে, ঘাসের ওপর পা ফেলে হাঁটছে। বৃষ্টির জলে তাদের পালকগুলো কেমন চুপসে গিয়েছে। সব মিলিয়ে নয়নাভিরাম দৃশ্য।
ড. জয়েশ পটেলের নিজের ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। তাঁর ইচ্ছা হল, বাইরে বেরিয়ে গিয়ে ওই হাঁসগুলোর পাশে উবু হয়ে বসতে। ওদের ঘাড়ের কাছটা আদর করে দিতে। এখানে এসব অদ্ভুত কাজ করলে কেউ কিছু বলার নেই। অন্যের ক্ষতি না করে যে যা খুশি করতে পারে, কেউ কারোর ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে না।
কিন্তু ড. পটেলের এখন সেই সময় নেই। সাড়ে আটটায় ফ্লাইট, আগামী দু-দিন ধরে প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা কনফারেন্স আছে। ছোটো একখানা ব্যাগ গুছিয়ে রেখে এসেছেন, কোয়ার্টারে গিয়ে কাঁধে নিয়েই বেরিয়ে পড়বেন।
ড. পটেল শেষ চুমুক দিয়ে উঠতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে এসে উপস্থিত হল আনন্দিনী। ঘরে পরার সালোয়ার-কামিজ ভিজে চুপচুপে, মাথা থেকে টপটপ করে জল ঝরছে।
ড. প্যটেল কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, ”কী ব্যাপার, আনন্দিনী!”
আনন্দিনী ওড়নার ভেতর থেকে ফাইলটা বের করে আনল, ”স্যার! আপনি বেরিয়ে যাবেন, তাই দৌড়োতে দৌড়োতে এলাম। আমাকে একবার ইন্ডিয়া যেতে হবে, স্যার!”
”বাড়ির সবাই সুস্থ আছেন তো?”
”না না! আমার দিল্লির বাড়িতে কিছু হয়নি।” আনন্দিনী ছটফটিয়ে উঠল, ”আমাকে একবার গোয়া যেতে হবে।”
”গোয়া!” ড. পটেল থমকে গেলেন, ”কেন?”
”কেন নয়, স্যার?” আনন্দিনী এবার ড. পটেলের নির্লিপ্তিতে একটু ক্ষুণ্ণই হল, ”সাউথ এশিয়ার দেশগুলোয় অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন নিয়ে আমি গত পাঁচ বছর ধরে এখানে পিএইচ. ডি. করছি। ব্যাংকক-পাট্টায়া থেকে মালদ্বীপ, রাজস্থান থেকে কেরালা, জনপ্রিয় সব ট্যুরিস্ট স্পট আমি এই কয়েক বছরে গিয়েছি, স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলেছি, নানারকম ডেটা সংগ্রহ করেছি। কিন্তু ভারতে ট্যুরিজমের সবচেয়ে যেটা জনপ্রিয় স্থান, সেই গোয়াতেই যাওয়া হয়নি কখনো। যাওয়ার কথা বললেই আপনি বারণ করেছেন।”
”আহা বারণ করতে যাব কেন! আমি বারণ করার কে? আমি তোমার রিসার্চ গাইড, বয়ফ্রেন্ড নই।” ড. পটেল বিব্রত মুখে তাকালেন, ”তোমার যখন না গিয়ে হয়ে যাচ্ছে, সবরকম ডেটা পেয়ে যাচ্ছ তোমার স্ট্যাটিস্টিক্যাল মডেলের জন্য, যাওয়ার তো বাধ্যবাধকতা নেই কোনো!”
”বাধ্যবাধকতা আছে, স্যার!” আনন্দিনী না বলে পারল না, ”ফোনে ইমেলে সব কাজ হয় না। আর যেটুকু হয়, তাতে তৃপ্তি হয় না। পিএইচ. ডি. পেতে গেলে ভালো জার্নালে তিনটে পেপার পাবলিকেশন লাগে, আমার দুটো হয়েছে। শেষ পেপারটার সাবজেক্টটা এমন, আমাকে নিজে যেতে হবেই, স্যার।”
”কেন, তোমার বোটানিস্ট বন্ধু তো গিয়েছে গোয়ায়। ওর থাকার ব্যবস্থাও করে দিয়েছি। তুমি যেভাবে বলো, ও তো বরাবর সেভাবেই তোমায় হেল্প করে।”
”হেল্প করে অবশ্যই, কিন্তু নিজে না গিয়ে একজনের ওপর কি ডিপেন্ড করে পিএইচ. ডি. পাওয়া যায়, বলুন? একটা খুঁতখুঁতানি রয়ে যায়। তা ছাড়া ওর নিজের কাজও রয়েছে।”
ড. পটেল কফিতে চুমুক দিলেন, ”ধৃতরাষ্ট্র গোটা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ সঞ্জয়ের মুখে শুনেছিলেন, কোনো ঘটনাই তাঁর অজানা থাকেনি।”
”আমার যে সেরকম কোনো সঞ্জয় নেই।” আনন্দিনী ম্লান হাসল, ”আমার বন্ধু শেষ ইমেল করেছিল সেন্ট ইনেজ ক্রিশ্চিয়ান কবরখানার ছবি তুলে। তাও প্রায় সাত দিন হল। আমার আরও অনেক কিছু এভিডেন্স চাই। এবং তাড়াতাড়ি চাই।”
”সেন্ট ইনেজ কবরখানায় কী আছে?” ড. পটেল জানতে চাইলেন।
”সেখানেই তো ফ্রেডির কবর সমাধি রয়েছে, স্যার!” জ্বলজ্বলে মুখে বলল আনন্দিনী।
”কার?”
”ফ্রেডি পিট। গোয়া শহরে নয়ের দশকের সেই কুখ্যাত পিডোফিল, যে প্রায় ত্রিশ বছর ধরে শয়ে শয়ে শিশুকে সেক্সুয়ালি মলেস্ট করেছিল।” আনন্দিনী ড. পটেলের অজ্ঞতায় মনে মনে অবাক হল।
অবশ্য ফ্রেডি পিটের নাম না জানা ড. জয়েশ পটেলের পক্ষে অস্বাভাবিক কিছু নয়। উনি নিজে সোশিয়োলজির নামী অধ্যাপক হলেও শিশুদের ওপর যৌননির্যাতন নিয়ে ওঁর তেমন কোনো কাজ নেই। ওঁর অধীনে বাকি যারা রিসার্চ করছে, তাদেরও গবেষণার বিষয়বস্তু একেবার আলাদা। ড. পটেলের দক্ষতা মূলত আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের নিয়ে কাজ করার ওপর। গোটা বিশ্বে এই বিষয়ে প্রায় সমস্ত কনফারেন্সে ওঁর ডাক পড়ে।
ও বলে যেতে লাগল, ”আমার শেষ পেপারটা তো তৃতীয় বিশ্বের অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের রমরমা কীভাবে শিশুদের ওপর যৌনহেনস্থা বাড়াচ্ছে, কীভাবে পিডোফিলদের বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে, আইনের কঠোরতাই বা সেই বিকৃতকামদের কতটা দমন করতে পারছে, সেই নিয়ে। আর সেই প্রসঙ্গে ফ্রেডি পিট তো একটা ফেনোমেনাল কেস, স্যার! ইন ফ্যাক্ট, তার আগে অবধি ভারতবর্ষে চাইল্ড সেক্স র্যাকেটের তেমন কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়াই যায়নি।”
”কীরকম?”
”শুনবেন স্যার? শুনলে গায়ে কাঁটা দেবে।” সোৎসাহে ফাইল খুলল আনন্দিনী, ”ফ্রেডি পিট সাতের দশকে গোয়ার মারগাঁওয়ে একটা অনাথ আশ্রম খুলেছিল। গুরুকুল অরফ্যামিলি। সেখানে ছয় থেকে ষোলো-সতেরো বছরের অনাথ ছেলেরা থাকত। জনদরদি স্বভাবের জন্য ফ্রেডি পিটের খুব সুনাম ছিল। ইংল্যান্ড, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, আরও নানা দেশ থেকে বিদেশিরা সেই আশ্রমে আসত, আবাসিক ছেলেদের জন্য সেই এন. জি. ও.-তে ডোনেশন দিত। এলাকার অনেক ছেলেও ফ্রেডির আশ্রমে ঘুরতে বা খেলতে যেত। এরকমই একজন বাচ্চা ছেলে ছিল সুবোধ। এগারো বছর বয়স। তার দেশ-বিদেশের স্ট্যাম্প আর কারেন্সি জমানোর নেশা ছিল। ফ্রেডি পিটের আশ্রমে যেহেতু দেশ-বিদেশের বন্ধুরা আসত, তার কাছে নানা ধরনের স্ট্যাম্প আর কয়েন পাওয়া যেত। সেই লোভে মাঝে মাঝেই সুবোধ গুরুকুল অরফ্যামিলি আশ্রমে যেত। সেটা নব্বই-একানব্বই সাল। ফ্রেডি পিটের বয়স তখন ছিয়াত্তর। ১৯৯১ সালের মার্চ মাসে একদিন সুবোধ স্কুল ফেরত অনেক দেরি করে বাড়ি ফেরে। ফিরে তার মা-কে বলে, তার পুরুষাঙ্গে খুব ব্যথা হচ্ছে।
”সুবোধের মা কিশোর ছেলেকে মলম লাগাতে বলেন, তারপর স্বামী ফিরলে ঘটনাটা জানান। সুবোধের বাবা ভার্গরাজ ছিলেন মাইন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি সুবোধের পুরুষাঙ্গ পরীক্ষা করে বেশ কিছু আঁচড়ের দাগ দেখতে পান। কিন্তু তিনি বার বার জিজ্ঞেস করলেও সুবোধ কিছু বলে না। পরের দিন ভার্গরাজ চলে যান ফ্রেডি পিটের আশ্রমে। একটা আবাসনের গোটা অ্যাপার্টমেন্ট জুড়ে ফ্রেডি পিটের গুরুকুল অরফ্যামিলি। কিন্তু ফ্রেডি তখন সেখানে ছিল না। আশ্রমের অনাথ ছেলেরা খেলছিল, তারা জানাল, ফ্ল্যাটে কেউ নেই।
”ভার্গরাজ ফিরে এলেন। কিন্তু হাল ছাড়লেন না। সেদিন সন্ধ্যায় ছেলেকে নিয়ে আবার বসলেন। প্রশ্নের পর প্রশ্নে অবশেষে সুবোধ ভেঙে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে জানাল, ফ্রেডি আঙ্কল তার পুরুষাঙ্গ নিয়ে খেলা করেন, আরও অনেক কিছু অসভ্যতা করেন। এমনকী তার শরীরে ইঞ্জেকশনও দেওয়া হয়। অনেকদিন ধরেই। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে গিয়ে ভার্গরাজ বললেন, এতদিন সুবোধ কিছু জানায়নি কেন?
”কী করব? ফ্রেডি আঙ্কল আমার জামা-প্যান্ট খুলিয়ে ছবি তুলে রেখেছে। কাউকে বলে দিলেই বলেছে, ওগুলো স্কুলে পাঠিয়ে দেবে! অনেক ছবি।” ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে সুবোধ, ‘ফ্রেডি আঙ্কল বলেছে, আমাকে বড়ো হলে বিদেশে পড়তে পাঠাবে। আমাকে আঙ্কল অনেক বাইরের স্ট্য্যাম্পও দিয়েছে। ফ্রেডি আঙ্কল খুব ভালো, বাবা!’
”ভার্গরাজ সেদিন সারারাত ঘুমোতে পারলেন না। ভোরে উঠে বিনিদ্র চোখে প্রাতর্ভ্রমণে বেরোলেন। হাঁটছেন বটে, কিন্তু তাঁর মাথা কাজ করছে না। কী করবেন তিনি! বিহ্বল লাগছে নিজেকে। ফ্রেডি পিট এই অঞ্চলের রীতিমতো প্রভাবশালী ব্যক্তি। কে বিশ্বাস করবে ভার্গরাজের কথা?
”ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তাঁর দেখা হয়ে যায় বন্ধু সান্তোবা দেশাইয়ের সঙ্গে। সান্তোবা দেশাই গোয়া পুলিশের এক উচ্চপদস্থ অফিসার। ভার্গরাজ আর পারলেন না, বন্ধুকে পুরো ঘটনাটা খুলে বললেন। সান্তোবা দ্রুত ভার্গরাজকে নিয়ে গিয়ে থানায় অভিযোগ দায়ের করলেন। আর তারপরই সামনে এল ফ্রেডি পিটের সেই ভয়ংকর চাইল্ড সেক্স র্যাকেট। যৌন আনন্দ পেতে বাচ্চা ছেলেদের ইঞ্জেকশন দিয়ে পুরুষাঙ্গ, অণ্ডকোষ বড়ো করা হত। বাইরে থেকে প্রচুর বিদেশি পর্যটক নিয়মিত আসত, তারা ফ্রেডি পিটের আশ্রম থেকে পছন্দমতো অনাথ ছেলেকে মোটা টাকার বিনিময়ে নিয়ে হোটেলে চলে যেত। উদ্ধার হল বাচ্চাদের তিন হাজারেরও বেশি ন্যুড ছবি, আরও নানারকম বিকৃতি, সেসব শুনলে…!”
”থামো থামো!” ড. পটেল হঠাৎ বলে উঠলেন।
”কী হল, স্যার?” বাধা পেয়ে আনন্দিনী অবাক। ড. পটেলকে সে মিষ্টবাক বলেই চেনে। বয়স আন্দাজ চল্লিশ, একটু কাজপাগল। বিয়ে-থা-ও করেননি। উনি এমন উত্তেজিত তো খুব একটা হন না।
”আসলে তোমার থিসিসের সাবজেক্টটাই এত ডার্ক!” ড. পটেল ঢকঢক করে জল খেলেন, ”কত হ্যাপেনিং টপিক ছিল। এত বড়ো একটা অতিমারি গেল, সারা পৃথিবী টলে গেল, সমাজের ওপর তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে রিসার্চ করলে কত প্রাসঙ্গিক হত বলো তো!”
”আপনি কী বলছেন স্যার, কিছু বুঝতে পারছি না।” আনন্দিনী বলল, ”আমার পিএইচ. ডি. শুরু হয়েছে পাঁচ বছর আগে। তখন এই অতিমারি আসবে, তা কে জানত?”
”আহা অতিমারি না-ই বা থাকুক।” মুহূর্তের মধ্যে নিজের ভুল শুধরে নিলেন ড. পটেল, ”মধ্যপ্রাচ্যের নানারকম ক্রাইসিস, আফ্রিকার উপজাতিদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারতা, ইয়োরোপ-আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর হওয়া বৈষম্য, শরণার্থী সমস্যা, সোশিয়োলজিতে কি টপিকের অভাব? যা কিছু আমাদের সমাজের ওপর প্রভাব ফেলে, সেই সবকিছুই গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে। এই তো নিকোটা কেমন সাইবেরিয়ার এস্কিমোদের জলের সমস্যা নিয়ে কাজ করছে। ভালো গ্রান্টও পাচ্ছে।”
আনন্দিনী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। নিকোটা জাপানের মেয়ে, ড. পটেলের অধীনে সে-ও গবেষণা করছে। ও বলল, ”ভালো গ্রান্টের লোভে তো রিসার্চ করতে আসিনি, স্যার।”
”তবে?” কৌতূহলী হয়ে তাকালেন ড. পটেল।
”আমার রিসার্চ পেপার পড়ে যদি রাষ্ট্রসংঘ বা অন্যান্য বড়ো চাইল্ড ওয়েলফেয়ার সংস্থাগুলো স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে আসে, সমস্যা দূর করার দিকে দেশের সরকার উদ্যোগী হয়, সেটাই লক্ষ্য।”
”গুড।” ড. পটেল এবার হাসলেন, ”আমি এতক্ষণ মজা করছিলাম। তোমার এই থিসিস দেখবে আলোড়ন তুলবে। তবে একটা পেপারের জন্য গোয়া ছোটাটা মনে হয় না খুব দরকার ছিল।”
”দরকার আছে, স্যার! ওটা একটা ল্যান্ডমার্ক কেস। গোয়ায় যত বিদেশি পর্যটক বাড়ছে, তত বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে এই চাইল্ড প্রস্টিটিউশনের। বাড়ছে নানাভাবে শিশুপাচার, নারীপাচার। এগুলো জনসমক্ষে আনা উচিত।”
ড. পটেল উঠে দাঁড়ালেন, ”কবে যাচ্ছ তাহলে?”
”আগামীকাল বিকেলে, স্যার। রিটার্ন টিকিট কেটে রেখেছি সাত দিন বাদে।”
”বেশ। আমি অ্যাপ্রূভ করে দিচ্ছি। আর আমি বেরিয়ে যাচ্ছি, ফিরব দু-দিন পর। ইউনিভার্সিটির তরফে আরও কিছু অ্যাপ্রূভাল লাগলে ইমেল কোরো।”
”থ্যাঙ্কস আ লট, স্যার!”
ড. পটেল মৃদু মাথা নেড়ে কাফেটেরিয়া ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ কী মনে পড়তে পিছু ফিরলেন, ”ভালো কথা। গোয়ায় গিয়ে তোমার সেই বন্ধুর সঙ্গেই থাকবে তো?”
”না স্যার। হোটেলেই উঠব।” আনন্দিনী কাঁধ ঝাঁকাল, ”রূপাকে দু-দিন ধরে ফোনে পাচ্ছি না। ইমেলেরও উত্তর নেই কোনো।”
”সেকী?”
”হ্যাঁ স্যার। ওর তো নিজেরও কাজ থাকে ওখানে, নানারকম হার্বস কালেক্ট করে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে। তখন নেটওয়ার্ক থাকে না আসি স্যার। হ্যাপি জার্নি।”
আনন্দিনী হাত নেড়ে কাফেটেরিয়ার বাইরে বেরিয়ে এল।
ওর মনটা খুশি-খুশি লাগছে। নিজে গিয়ে না দেখলে হয় নাকি?
ও জানতে পারল না, পেছনে হাঁটতে-থাকা ড. পটেল ততক্ষণে কাউকে ফোন করছেন, ”আমার রিসার্চ ফেলো গোয়া যাচ্ছে। বারণ করলাম, কিন্তু শুনল না…। হ্যাঁ, ফ্রেডি পিটের ব্যাপারেই!”
৮
আনুমানিক ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দ
শিরা ক্লান্ত পায়ে চড়াই ভাঙছিল। তার জামাটা ঘামে ভিজে এমনভাবে গায়ের সঙ্গে এঁটে গিয়েছে যে, এই ভ্যাপসা গরমেও কেমন শীত-শীত করছে। চোলিটা নেতিয়ে পড়ে আছে গলায়।
নিম্নাঙ্গের অবস্থা আরও শোচনীয়। ঘাগরাটা পা দুটোকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে ধরেছে, শিরা হাঁটতে গেলেই হোঁচট খাচ্ছে।
পাশে দ্রুতগতিতে হাঁটছিল গোকুল। তার অবস্থাও একই রকম। কপালের লাল তিলক গলে নাক দিয়ে গড়াচ্ছে, ধুতিটা আটকাচ্ছে চলার পদে পদে। অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গে পইতেটা লেপটে রয়েছে।
শিরার নাকানিচোবানি অবস্থা দেখে গোকুল হেসে ফেলল, ”ওইজন্য বলেছিলাম, আরেকটা ঘাগরা চোলি নিয়ে চলো। শুনলে না!”
শিরা উত্তর দিল না। অনেক দেরি হয়ে গেছে। পাহাড়ি জঙ্গল, ঝুপ করে সন্ধে নেমে যাবে।
পাহাড়ের পায়ের কাছে এবড়োখেবড়ো পায়ে-চলা পথ। সেখান দিয়ে চলতে চলতে শিরা জঙ্গলের দিকে তাকাল। সবুজ ঘন গাছপালার ফাঁক দিয়ে পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবছে। গাঢ় কমলা রং ছেয়ে গিয়েছে গোটা আকাশে। সেই রঙের গলিঘুঁজিতে আরও কত রকমের রং।
ওর জোশুয়াকাকার বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল।
”আমাদের চোখ কত রকমের রং দেখতে পায় জানিস?”
”কত?” শিরা মন দিয়ে ছবি আঁকতে আঁকতে কৌতূহলী চোখে তাকিয়েছিল।
”উমমম দশ লক্ষ।”
”যাহ, বাজে কথা বলো খালি।”
”মূর্খের মতো হাসিস না।” জোশুয়াকাকা চটে উঠেছিল, ”শুধু সূর্যের ছবি আঁকলে হবে? এবার থেকে মন দিয়ে সূর্যের উদয় আর অস্ত দেখবি। ভালো করে লক্ষ করবি, দেখবি কত রং এসে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। চোখের পলক ফেলার আগে দুটো রং মিশে গিয়ে জন্ম দিচ্ছে নতুন রঙের। তবে তো আঁকার চোখ তৈরি হবে!”
”বাহ, আঁকার হাত চাই না বুঝি?”
”চাই। কিন্তু তার আগেও চাই চোখ। ঘর থেকে বেরো, বাইরে তাকা। সমুদ্র, আকাশ, নদী চুপচাপ দেখে যা। কত রকমের পাখি, পোকা, ফুল। ঘরের কোণে ঢুকে বসে থাকলে চোখ তৈরি হবে?”
শিরা ভাবতে ভাবতে আবার ভালো করে তাকাল অস্তমান সূর্যের দিকে। সত্যিই সেখানে অত রং আছে? কে জানে, হতেও পারে। জোশুয়াকাকা একটু খ্যাপাটে গোছের, তা সন্দেহ নেই। তবে ওষুধপত্র থেকে দেশ-বিদেশের নানা কথা, গুপ্তবিদ্যা, কাকার জ্ঞান যে প্রচুর, তা এলাকার সবাই একবাক্যে স্বীকার করে। কাকা প্রতিসপ্তাহে গোয়ায় যায়, আর মশলাপাতি থেকে শুরু করে আয়না, বই, শুকনো ফল সব কিনে নিয়ে এসে গ্রামে বিক্রি করে। নাম-না-জানা পাখির পালক থেকে ভাঙা জাহাজ থেকে পাওয়া প্রসাধনী বাক্স, কাকার কাছে অনেক অদ্ভুত সব জিনিস পাওয়া যায়।
শিরার নাকটা সুড়সুড় করছিল, ও ভেজা জামার খুঁট দিয়ে নাকটা ঘষল।
অলস পায়ে ও এগোচ্ছিল বাড়ির দিকে। আজ ওরা যেখানে গিয়েছিল, আঁকার চোখ তৈরি করার অনেক সরঞ্জাম পেয়েছে। জোশুয়াকাকা শুনলে বেশ খুশি হবে।
ওদের গ্রামের নাম মোলে। ভারতবর্ষের পশ্চিম উপকূলের সহ্যাদ্রি পর্বতমালার একেবারে পায়ের কাছে এই গ্রাম। আগে এখানে খুব কম মানুষজন থাকত, কিন্তু গত পঞ্চাশ বছরে এদিকে জনবসতি একটু একটু করে বেড়েছে।
গ্রাম পেরিয়েই যে জঙ্গল শুরু হয়ে যাচ্ছে, তাতে যে শিরা কখনো আসেনি তা নয়, বেশ কয়েকবার এসেছে। কিন্তু তার এত ভেতরে কখনো যায়নি। তাই কয়েকদিন ধরেই গোকুল যখন বলছিল, একটু দোনামনায় ছিল ও। পিসি জানতে পারলে খুব বকুনি খাবে।
তার ওপর গোকুল মুখে কিছুই বলছিল না। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দুজনে হেঁটেই চলেছিল। এদিকের জঙ্গলে কি হিংস্র পশু রয়েছে? কে জানে! হঠাৎ হঠাৎ বনবিড়াল লাফিয়ে গেলে চমকে উঠছিল ও, ফিসফিস করে বলছিল, ”আমরা কোথায় যাচ্ছি, গোকুল? আ-আমার কিন্তু খুব ভয় করছে!”
পনেরো পেরিয়ে ষোলোয় পড়েছে শিরা, এই বয়সে মেয়েদের ঠিক-ভুলের ষষ্ঠেন্দ্রিয় তৈরি হয়ে যায়। গোকুল ওর চেয়ে তিন-চার বছরের বড়ো হলেও ছোটোবেলার বন্ধু। কিন্তু বয়ঃসন্ধিতে কি সবকিছু প্রত্যাশামাফিক চলে? নাহ, ঝোঁকের বশে চলে এসে শিরা ভুলই করেছে, এমনটাই ভাবছিল। ভয়, আশঙ্কা, দুশ্চিন্তা ক্রমশ জেঁকে ধরছিল ওকে। মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছিল ও, গোকুল যেন ওকে এমন কোনো আঘাত না করে, যে ক্ষতের দাগ শিরা সারাজীবনেও মুছতে পারবে না!
গোকুল বোধহয় অনুমান করছিল কিছু, ঈষৎ অবাক চোখে ও তাকিয়েছিল শিরার দিকে। কিছুটা আহতস্বরে বলেছিল, ”তুমি আমায় বিশ্বাস করো না?”
বিশ্বাস! এই শব্দের ওজন এতটাই ভারী যে শিরা কোনো উত্তর দিতে পারেনি। বিশ্বাস শব্দের দায় কার? বিশ্বাস যে করে, না বিশ্বাসের মর্যাদা যে রাখে?
নিজের মনে আকাশ-পাতাল ভাবছিল শিরা। হাঁটতে হাঁটতে ওর পায়ে যখন রীতিমতো টান ধরছে, তখনই গাছপালার ফাঁক দিয়ে দেখা দিয়েছিল এক আশ্চর্য মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।
চারপাশে বুনো পাহাড়, এত ঘন জঙ্গল যে, সূর্যের আলো অনেকটাই মিয়োনো। চোখের সামনে অপূর্ব সব গাছপালা, সবুজ ঘাস, নাম-না-জানা রঙিন ফুল ফুটে আছে, আর সেই ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াচ্ছে প্রজাপতি। আহ, কী সুন্দর দৃশ্য!
শিরা আনন্দে চোখ বুজে ফেলেছিল।
গোকুল হাসছিল, ”ভয় কেটেছে? এবার সামনে চলো।”
অদ্ভুত ব্যাপার, চারপাশে সূর্যের আলো ম্লান হলেও একটা বিশেষ জায়গার ওপরে কোনো গাছগাছালির আস্তরণ নেই, ফলে সেখান দিয়ে উজ্জ্বল সূর্যরশ্মি লম্বভাবে পড়ে উজ্জ্বল করে তুলছে যে স্থানটা, সেটা একটা পাথরের ইমারত। আয়তনে যে খুব বৃহদাকার তা নয়, কিন্তু লতায় ঢাকা পাথুরে গা দেখলেই অনুমান করা যায় প্রাগৈতিহাসিক এই দেবালয় অতি প্রাচীন।
নিবিড় অরণ্য, কোনো শব্দ নেই, প্রাণের যেন কোনো অস্তিত্ব নেই, সময়ের প্রবেশ যেন এখানে নিষিদ্ধ। শিরা মুগ্ধ চোখে দেখছিল। হিন্দুদের মন্দির ওর ভালোই লাগে, ভেতরে মানুষের মতো দেখতে সব হিন্দু ঠাকুর থাকে, আর অনেকে ঢাকঢোল, খোল-করতাল বাজায়। গান হয়।
কিন্তু এত নিস্তব্ধ মন্দিরে ও কখনো আসেনি।
ও বলেছিল, ”জঙ্গলের এত ভেতরে মন্দির? জানতামই না!”
”ভয়ে সারাক্ষণ সিঁটিয়ে থাকলে এমন অনেক কিছুই অজানা থাকবে।” গোকুল বলেছিল, ”বহু পুরোনো শিব মন্দির এটা। কদম্ব রাজাদের নাম শুনেছ?”
”না।” দু-দিকে মাথা নেড়েছিল শিরা।
”তা শুনবে কী করে! তোমার পূর্বপুরুষরা তো তখন অন্য দেশে।” গোকুল হাত নেড়েছিল, ”কদম্ব রাজারা বানিয়েছিলেন এই মন্দির। ভীষণ জাগ্রত।”
”পুজো হয় না? কোনো শব্দ পাচ্ছি না কেন?”
”নিয়মিত পুজো কে করবে? জঙ্গলের এত ভেতরে ভয়ে কেউ আসে না। আর রাস্তাও খুব গোলমেলে। আমি আগে একদিন বিনায়কদাদার সঙ্গে এসেছিলাম, মনে রেখে দিয়েছি তাই। ভেতরে চলো।”
শিরা সন্তর্পণে গোকুলের পিছু পিছু মন্দিরের প্রবেশপথে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। শিরা ইহুদি, কিন্তু জ্ঞান হওয়া ইস্তক হিন্দুপ্রধান মোলে গ্রামে বড়ো হয়েছে, হিন্দু বাড়িতে হাঁটু মুড়ে বসে গোরুর দুধ, গাছের ফল খেয়েছে, অজস্র মন্দিরে গেছে।
কিন্তু এই মন্দিরটা বেশ অন্যরকম।
মন্দিরের প্রবেশদ্বার পূর্বদিকে, এমনভাবে তা বানানো, যাতে প্রভাতের প্রথম সূর্যরশ্মি বিগ্রহের মুখে পড়ে। গর্ভগৃহের একেবারে মাঝে অধিষ্ঠিত রয়েছে শিবলিঙ্গ। সামনে বৃহদাকার একটি বৃষমূর্তি। শিরার মনে পড়ল, শিব ঠাকুরের বাহন হল ষাঁড়।
গোকুল নিচুস্বরে দেখিয়েছিল, ”গর্ভগৃহটা কেমন নিঝুম দেখো। ভেতরে নাকি একটা ভয়ানক বিষধর সাপ থাকে।”
”সাপ!” ফ্যাকাশে গলায় বলেছিল শিরা।
”বাহ, শিব মন্দিরে সাপ থাকবে না? নাগদেবই তো পাহারা দেন বিগ্রহকে।”
”ওরে বাবা!”
একটু আগের রোমহর্ষক সেই অভিযানের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে ওরা, শিরা খেয়ালই করেনি।
গোকুলের বাড়ি আর-একটু দূরে, হিন্দু পাড়ায়। যাওয়ার আগে ও হাত নাড়ল, ”চলি। আবার একদিন যাব, কেমন?”
”হ্যাঁ।” সোৎসাহে বলল শিরা, ”জঙ্গলের ভেতরে যে অত সুন্দর সুন্দর গাছ রয়েছে, কেউ জানেই না!”
”কেউ জানে না কী বলছ! তোমার বাবা এসে আগে সপ্তাহে কতবার ওই জঙ্গলে যেতেন, জানো?”
”বাবা?” শিরা বিস্মিত। ওর বাবা গার্সিয়া দে ওরতা গোয়ার বিখ্যাত ব্যক্তি। শুধু যে কিংবদন্তি চিকিৎসক তা-ই নয়, উদ্ভিদ গবেষকও বটে। জলে-জঙ্গলে অবহেলায় জন্মানো গাছ, সেই গাছের পাতা, শিকড়বাকড় থেকে বাবা অনেক রোগের ওষুধ আবিষ্কার করেছেন। বাবা আসলে ছিলেন স্পেনের মানুষ। সেই সময় স্প্যানিশ ইহুদিদের জোর করে তাড়িয়ে দেওয়া হলে বাবা চলে যান পোর্তুগালে। সেখানে আরও লক্ষ লক্ষ মানুষের সঙ্গে বাবাকেও সপরিবারে জোর করে ক্রিশ্চান করে দেওয়া হয়। তাঁদের বলা হতে থাকে ‘নিউ ক্রিশ্চান’।
শিরার বাবা ডাক্তারি পাশ করে পোর্তুগালের রাজধানী লিসবন শহরে অল্পদিনেই বিশাল পসার জমিয়েছিলেন। পোর্তুগালের রাজাকেও চিকিৎসা করেছিলেন। কিন্তু তারপর পোর্তুগালে ইনকুইজিশন আইন বলবৎ হল। ‘নিউ ক্রিশ্চান’রা নাকি মোটেই খ্রিস্টধর্ম পালন করছে না, লুকিয়েচুরিয়ে তারা তাদের পুরোনো ইহুদি ধর্মের উপাসনাই করছে ঘরের মধ্যে। তাদের কড়া শাস্তি দেওয়া হতে লাগল ইনকুইজিশন কোর্টে। যখন-তখন যেকোনো ইহুদিকে ধরে নিয়ে গিয়ে কোনো বিচার ছাড়াই মেরে ফেলা হতে লাগল। ভয়ে তখন বাবা তাঁর পরিবার-পরিজন নিয়ে চলে এলেন ভারতবর্ষ নামের এই দেশের গোয়াতে। এখানেও পোর্তুগিজ শাসন, তবে ইনকুইজিশনের ভয় নেই। বাবা গোয়ার গভর্নরের প্রধান চিকিৎসক হিসেবে কাজে যোগ দিলেন। গোয়াতেও তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগল না। গার্সিয়া দে ওরতাকে সবাই চেনে।
এইসব কথাই শিরা শুনেছে জোশুয়াকাকার কাছে। বাবা গোয়া শহরে থাকলেও ওদের বাকি পরিবার থাকে কিছু দূরের এই মোলে গ্রামে। শিরার মা মারা গিয়েছেন কয়েক বছর আগে। তারপর থেকে বাবা একটু একা থাকতেই পছন্দ করেন। সমুদ্রের পাশে বাবার ছোট্ট বাড়ি, সেখানে বাবা সারাদিন বই পড়েন, লেখেনও। এখানে শিরা আর ওর এগারো বছরের বোন আহিরা থাকে ওদের পিসির সঙ্গে। ক্যাথারিনপিসি নিজে বিয়ে করেননি, ওদের দুই বোনকে নিজের মেয়ের মতো আগলে রাখেন। ওদের এই মোলে গ্রামে বেশ কয়েক ঘর ইহুদি পরিবার থাকে। জোশুয়াকাকা তেমনই এক প্রতিবেশী।
শিরা আর আহিরা মাঝে মাঝে পিসির সঙ্গে নৌকো করে যায় গোয়ায়, বাবার কাছে থেকে আসে। বাবা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত স্বল্পবাক হয়ে পড়েছেন, দু-একটা কথা বলেন, তারপরই ডুব দেন নিজের লেখার জগতে। বাবা যে এককালে এই জঙ্গলে নিয়মিত ঘুরে বেড়োয়েছেন, ও জানতই না!
”তুমি কী করে জানলে, আমার বাবা ওই জঙ্গলে যেতেন?” শিরা জিজ্ঞেস করল।
গোকুল ঠোঁট ওলটাল, ”কে না জানে! ওই জঙ্গলের কত গাছপালা, পাতা থেকে তোমার বাবা ওষুধ বানিয়েছেন। আগের মাসে আমার জ্বর হল, তখন বাবা বলছিল।”
শিরা চুপ করে রইল। গোকুলের পরিবার গৌড় সারস্বত ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ভুক্ত। ওদের বাড়ির সবাইই খুব সজ্জন, মিষ্টভাষী এবং শিক্ষিত। আর গোকুলের বাবা সহদেব দেশপান্ডে হলেন এই মোলে গ্রামের গাঁওকর। প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। গোটা গ্রামের ভালোমন্দ তাঁর কাঁধে, তবু এত ব্যস্ততাতেও তিনি ছেলে-মেয়েদের সময় দিতে ভোলেন না। কত গল্প শোনান, দেশ-বিদেশের কথা, ইতিহাসের কথা।
শিরা একটা চাপা নিশ্বাস ফেলল। আর ওর বাবা এত বিখ্যাত মানুষ, অথচ ও আর ওর বোন সেভাবে কোনোদিনও বাবাকে চিনলই না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ও বলল, ”পরের দিন আমি অনেক ফুল তুলে আনব। সেদিন আমায় একটা প্রজাপতি ধরে দেবে?”
”দেব।” গোকুল হাসল।
”আচ্ছা!” চলে যেতে গিয়েই পিছু ফিরল শিরা, ”ওই মন্দিরটার নাম তো বললে না আমায়!”
গোকুল আবার হাসল। আঠারো-উনিশ বছরের তরুণ হলেও ওর হাসি যেন আটকে রয়েছে অনাবিল কৈশোরেই।
”তাম্বরি সুরলা শিব মন্দির। চলি।”
শিরা যখন বাড়িতে ঢুকল, আকাশ ম্লান হয়ে এসেছে। এখানে অনেক রাত অবধি দিনের আলো থাকে, এই যা বাঁচোয়া। না হলে পিসি শুধু মুখঝামটা দিয়ে ক্ষান্ত হত না, গুমগুম করে পিঠে দু-ঘা বসিয়ে দিত।
আহিরা কোথায়? ওহ, পাশের বাড়ি থেকে বোনের খিলখিল করে হাসির শব্দ কানে ভেসে আসছে। পাশের বাড়ির রেবেকা ওর গলায় গলায় বন্ধু, দুজনে খুব গল্প হচ্ছে।
ওকে ঢুকতে দেখে উলটোদিকের বাড়ি থেকে আইজ্যাককাকা চেঁচিয়ে উঠল, ”কী রে, এতক্ষণ কোথায় ছিলি? তোর পিসি তো চেলাকাঠ নিয়ে বসে আছে।”
শিরা উত্তর দিল না। যে যা-ই করুক, যেখানেই যাক, আইজ্যাককাকার শ্যেনদৃষ্টি এড়াতে পারবে না। আইজ্যাককাকার মতো দুর্মুখ মানুষ ওদের এই ইহুদি পাড়া কেন, গোটা মোলে গ্রামে আর একজনও নেই। গোয়াতেও কি আছে? কে জানে! কেউ ভালো থাকলে আইজ্যাককাকা ভেতরে ভেতরে জ্বলতে থাকে, কারো আনন্দের খবরেও চিমটি-কাটা কথা বলে অদ্ভুত আনন্দ পায়। আশ্চর্য মানসিকতা। শিরাকে ছোটোবেলায় ওর বাবা-মা নিয়ে কত বাজে কথা বলত, শিরার বাবা নাকি গোয়ায় আরেকটা বিয়ে করেছেন, তাই এখানে আসেন না, এইসব মিথ্যা কথা। ও কষ্ট পেত। বড়ো হতে হতে এখন আর শিরা কষ্ট পায় না। ও বুঝে গেছে, এই ধরনের মানুষগুলোর নিজের কষ্ট সবচেয়ে বেশি। এখন ও আইজ্যাককাকাকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলে। যদিও সবাই এড়িয়ে চলে না, এই সেদিনই রেবেকার বাবার সঙ্গে আইজ্যাককাকার একচোট ঝগড়া হয়ে গেছে। সোফিয়ামাসি, জোশুয়াকাকা, আরও অনেকের সঙ্গেই আইজ্যাককাকার প্রায়ই ঠোকাঠুকি লাগে।
আইজ্যাককাকার কথা শুনতে না-পাওয়ার ভান করে ও এগিয়ে গেল। পা টিপে টিপে ভেতরের ঘরের দিকে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ একটা আলোচনায় থমকে গেল। উঁকি মেরে দেখল, পিসি বসে আছে মাটিতে, একটা নারকেল ছাড়াচ্ছে। এক হাত দিয়ে টেনে ধরছে খোসাগুলো, অন্য হাতে ধীরে ধীরে বের করে আনছে ভেতরের গোল নারকেলটা। কাজ করতে করতে বলছে, ”দিন দিন পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে, জোশুয়া! গোয়া থেকে আমার বন্ধু ইসাবেল চিঠি লিখেছে। ওর পাশের বাড়ির সবাইকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছে। আমাদের ওপর ওদের এত রাগ কীসের?”
জোশুয়াকাকা বসে আছে জানলার পাশে। অন্যমনস্কভাবে বলছে, ”শুধু আমাদের ওপর কে বলল তোমায়? যারা ক্রিশ্চান নয়, তাদের সরকারি সব চাকরি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, হিন্দু কারিগররা চার্চের উপাসনার কাজে লাগে, এমন কোনো কিছু তৈরি করতে পারবে না। পিতল, মাটি বা পাথরের ক্রুশ বানিয়ে যে হিন্দু বা মুসলিমরা বিক্রি করত, তাদের বন্দি করা হচ্ছে। কাজি, মৌলবিদের তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমরাই যে শুধু অত্যাচারিত হচ্ছি, তা ভুল।”
”হুম জানি।” পিসি নিচু গলায় বলল, ”হিন্দু পাড়ার বিমলা বলছিল। ওর বোন পাঁচ বছরের ছেলে কোলে বিধবা হয়েছে। বাচ্চাটাকে জোর করে চার্চের লোকেরা নিয়ে গিয়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেছে। ওর বোনকেও বলেছে, যদি ক্রিশ্চান হয়, তবেই সব সম্পত্তি পাবে, না হলে কিচ্ছু পাবে না। হ্যাঁ রে, আমরা তো এতদূরের গ্রামে থাকি। এদিকে এসব শুরু হবে না তো?”
”তুমি কোন জগতে থাকো দিদি? সারাদিন ঘরের কাজ নিয়ে থাকলে হবে? চোখ-কানও খোলা রাখতে হবে।” জোশুয়াকাকা হাত নাড়ল, ”শুধু আমাদের গ্রাম কেন, ছোটোবড়ো সব গ্রামেই আস্তে আস্তে গ্রামসভার হিন্দু সদস্যদের হটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো গ্রামের প্রধান পদে এখনও কিছু হিন্দু গাঁওকর রয়েছে বটে, কিন্তু তাঁদের হাত থেকে সব ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, বদলে বসানো হচ্ছে ক্রিশ্চান গাঁওকরদের। নতুন আইন অনুযায়ী, হিন্দুরা আর কোনো নতুন মন্দির বানাতেও পারবে না, আর পুরোনো মন্দির সংস্কারও করতে পারবে না। মুসলিমদের মসজিদের ওপর মোটা কর বসানো হয়েছে। চারশোর কাছাকাছি মন্দির ভেঙে ফেলা হয়েছে।”
”কী বলছিস!” পিসি হাতের কাজ থামিয়ে চমকে তাকায়, ”কারা করছে এসব?”
”ইনকুইজিশন কোর্ট, আবার কারা!”
”এই কোর্ট কোথায় রে, গোয়াতেই?”
”হ্যাঁ, সুলতান আদিল শাহের যে রাজপ্রাসাদ পোর্তুগিজরা দখল করেছিল, সেই প্রাসাদই এখন ইনকুইজিশন কোর্ট। প্রধান ইনকুইজিটরের নাম আলেক্সো ডায়াজ ফালকাও। খোদ পোর্তুগালের রাজা তাঁকে পাঠিয়েছেন। ফালকাওয়ের অধীনে আরও কয়েকজন রয়েছে।”
”এদের কাজটা কী! এইসব আইন বানানো?”
”শুধু আইন বানানো নয়। যারা এইসব আইন মানছে না, তাদের শাস্তি দেওয়া। ওই কোর্টের ঘরগুলোয় বন্দি করে রাখা। তারপরও ক্রিশ্চান না হলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া।” জোশুয়াকাকা একটা নিশ্বাস ফেলল।
পিসি কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল। তারপর বলল, ”আমাদের তো কোনো চিন্তা নেই, বল! আমরা তো এখন আর ইহুদি নই, ক্রিশ্চান!”
”মুখে বললেও মনে মনে কি আমরা কেউ তা মানি, দিদি? তোমার বিছানার ওপর যে বই দুটো রাখা রয়েছে, সে দুটো হল হিব্রু বাইবেল আর তোরাহ। দিনে কতবার ওই বই দুটো থেকে প্রার্থনা করো, তা তোমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। আমাদের পূর্বপুরুষরা যে কেউ স্বেচ্ছায় ক্রিশ্চান হয়নি, প্রাণের দায়ে হয়েছে, আর এই বিদেশ-বিভুঁইতে এসে আমরা সবাই যে চোরাগোপ্তা মোজেসেরই উপাসনা করি, তা তারা ভালো করেই জানে, দিদি!” জোশুয়াকাকা ম্লান হাসল, ”তবে হ্যাঁ। তোমরা হলে গিয়ে গার্সিয়া দে ওরতার পরিবার। তোমার দাদার একটা চিঠিতে গভর্নর ছুটে আসবেন। তাই মনে হয় না, ওরা তোমাদের ঘাঁটাবে। আমাদের মতো এলেবেলেরাই শেষ হব, আর কী!”
”এভাবে বলছিস কেন!” পিসির গলাটা কেমন ভাঙা শোনাল।
”ঠিকই বলছি। ইনকুইজিশন কোর্ট সব গ্রামে ওদের চর ছড়িয়ে দিচ্ছে। সেই চরেরা গোয়ায় খবর পাঠাচ্ছে। অমনি কোর্টের সৈন্যরা এসে তাদের মারতে মারতে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এভাবে কত গ্রাম জ্বলে ছারখার হচ্ছে। আমাদের মধ্যেও যে কোনো চর লুকিয়ে নেই, তা কে বলতে পারে?”
প্রদীপের আলোয় ভিজে জামায় কাঁপতে কাঁপতে শিরা স্পষ্ট দেখল, জোশুয়াকাকার কথা শুনতে শুনতে ওর রাগী পিসিও কেমন যেন কেঁপে উঠল।
৯
শংকর ভুল কিছু বলেনি। ভাগাতোর সত্যিই খুব ছোটো সমুদ্রসৈকত। আশপাশে গুটিকয়েক রেস্তরাঁ দেখে বোঝা যায়, এখানে পর্যটকদের ভিড় একেবারেই হয় না। কিন্তু আজ বিচের একেবারে ডানদিকে বেশ জটলা। পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে ঘিরে রেখেছে। বাইরে থেকে কৌতূহলী জনতা উঁকিঝুঁকি মারছে।
ওদের গাড়িটা বালির মধ্যে দিয়ে গিয়ে সোজা ব্যারিকেডের সামনে থামল। বডিটা বেঁকেচুরে পড়ে রয়েছে বালি আর ঝোপের মধ্যে। ঊর্ধ্বাঙ্গটা এমনভাবে রাখা, যাতে চট করে দূর থেকে বোঝা যায় না যে এখানে একটা আস্ত লাশ পড়ে আছে। একজন কনস্টেবল ঝুঁকে পড়ে খুব সতর্কভাবে বডির আউটলাইন বরাবর লাল দাগ টানছে। জায়গাটায় ঘোরাঘুরি করছে প্রায় চোদ্দো-পনেরোজন পুলিশ।
শংকরকে দেখামাত্র একজন তরুণ পুলিশ অফিসার এগিয়ে এসে স্যালুট ঠুকলেন, ”স্যার! আমি আপনার জন্য ওয়েট করছিলাম। ড. সাওন্থ এইমাত্র চলে গেলেন। এদিকে আসুন।”
”পরাগ কামাত। নর্থ গোয়া ক্রাইম ব্রাঞ্চের ও.সি.। কাজের ছেলে।” শংকর মৃদুস্বরে বলে এগিয়ে গেল।
রুদ্র শংকর আর মার্তণ্ডের পিছু নিল। যে মেয়েটার মৃতদেহ ঝোপের মধ্যে পড়ে রয়েছে, তার বয়স চব্বিশ-পঁচিশ। গায়ের রং বেশ চাপা, মোটাসোটা গড়ন। পরনে সুতির ট্রাউজার আর শার্ট। চুলগুলো খুব কালো আর কোঁকড়া, অনেকটা আফ্রিকানদের মতো। চাউমিনের মতো সেগুলো ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে। চোখে কালো ফ্রেমের গোল চশমা। শংকর ঠিকই বলেছিল। গোটা শরীরে কোথাও ধস্তাধস্তি আর আঘাতের চিহ্ন নেই। কেবলমাত্র গলার নলির কাছে প্রায় তিন ইঞ্চি গভীর ক্ষত। সেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে চলে গেছে কানের পাশ বেয়ে। ভিজিয়ে দিচ্ছে চুলের কিছুটা। সেই রক্ততে বালি ভিজে উঠেছে। চোখ দুটো বোজা।
রুদ্র পায়ের দিকে তাকাল। একজোড়া স্যান্ডাল, ঘরে পরার চটি যেমন হয়। মেয়েটার পাশে কোনো ব্যাগ পড়ে নেই। ওর মনে অনেকগুলো প্রশ্ন এসে ভিড় করছিল। কিন্তু এখানে জিজ্ঞেস করাটা অনুচিত বুঝে চুপ করে রইল।
শংকর পরাগের দিকে তাকাল, ”প্রথম কারা নোটিশ করল?”
”স্যার, সকাল সাড়ে আটটায় আঞ্জুনা থানায় একটা ফোন আসে। এখানকার দুটো ছেলে এদিকে বিচ ভলিবল খেলতে এসে দেখতে পেয়েছে। আঞ্জুনা থানার আই.সি. বিজয় গোমস তখন আমায় জানায়। আমি ড. সাওন্থকে নিয়ে চলে আসি। বিজয়ও এখানে আছে, স্যার।”
”ছেলে দুটো কোথায়?”
”এই তো স্যার, এখানেই।” পরাগ ব্যারিকেডের ওদিকে দাঁড়িয়ে-থাকা উৎসুক জনতার দিকে আঙুল তুলল।
”নিয়ে এসো।”
কনস্টেবল গিয়ে ডাকতে দুটো আঠেরো-উনিশ বছরের ছেলে ব্যারিকেডের নীচ দিয়ে গলে এগিয়ে এল। দুজনেরই ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, পরনে একটা করে রংচঙে হাফপ্যান্ট। চোখে রঙিন রোদচশমা। বাঁ হাতে ঘড়ি। পায়ে স্যান্ডাল।
শংকর পুলিশি ভঙ্গিতে জেরা শুরু করল, ”কী নাম তোমাদের?”
”ভিকি মিশ্র। রিকি মিশ্র।”
”দুজনে ভাই নাকি?”
”হ্যাঁ স্যার।”
”বাড়ি কোথায়?”
”কাছেই। সেন্ট অ্যান্থনি স্কুলের পাশে।”
”কী করা হয়?”
”স্যার, সাইকেল স্কুটি বাইক ভাড়া দিই। বাবার বিজনেস। আর আঞ্জুনা ক্লাবের হয়ে বিচ ভলিবল টিমে খেলি। এই বছর ক্যালাঙ্গুটে বিচ ফেডারেশন কাপেও খেলেছি স্যার। থার্ড পজিশন পেয়েছি।”
”হুম। সকাল থেকে কী হয়েছে, সব ডিটেইলে বলো।”
ভিকি বলে ছেলেটা ম্লান মুখে বলতে লাগল, ”সকালবেলা ন-টায় গ্যারাজ খুলি। তার আগে ঘণ্টাখানেক বিচে এসে ভলিবল খেলি। আজকেও এসেছিলাম।”
”এদিকে তো বালির চেয়ে ঝোপ বেশি। এদিকে খেলতে এসেছিলে কেন?”
”না স্যার।” রিকি সমুদ্রের দিকে আঙুল তুলল, ”আমরা ওইদিকে খেলছিলাম। আমাদের আরও দু-তিনজন বন্ধুরও আসার কথা ছিল। তখনও কেউ আসেনি বলে আমরা দু-ভাই প্র্যাকটিস করছিলাম। রাস্তার কাছাকাছি লোকের ভিড় থাকে বলে আমরা এদিকটাতেই খেলি।”
”তারপর?”
”রিকি জোরে একটা আন্ডারহ্যান্ড সার্ভ করে, বলটা এদিকে এসে পড়ে। আমি আনতে এসে বডিটা দেখতে পাই।”
”তারপর?”
রিকি শুকনো ঠোঁটটায় একবার জিভ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ”আমরা খুব ভয় পেয়ে যাই। তখনও দূরের দোকানগুলো খোলেনি। ইন্টারনেট থেকে নম্বর খুঁজে আঞ্জুনা থানায় ফোন করি।”
”বিচ ভলিবল তো চারজন খেলে। তোমাদের বাকি দুজন পার্টনার এখনও এসে পৌঁছোয়নি?” রুদ্র এতক্ষণ পর মুখ খুলল।
ভিকি বলল, ”হ্যাঁ এসেছিল। ততক্ষণে পুলিশ এসে গেছে। ওরা ভয়ে ফিরে গেছে।”
শংকর কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর সরে এসে পরাগকে নির্দেশ দিল, ”ছেলে দুটোর বাড়ি আর বাকি ডিটেইল খোঁজ নাও। বাকি যে বন্ধুদের কথা বলছে, ভেরিফাই করো। আর বডি ফরেনসিকে পাঠিয়ে দাও। ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ডি. এন. এ. প্রোফাইলিং, পোস্টমর্টেম। আন্ডারস্ট্যান্ড?”
”ইয়েস স্যার!”
”বিজয়কে এগুলো বুঝিয়ে দাও। আর ফাদার জেমসনের কেসটার আপডেট কী?”
পরাগ বলল, ”স্যার, সেন্ট সেবাস্টিয়ান হোমের চারজন কর্মী। তিনজন সত্যিই বাড়ি গিয়েছিল, ভেরিফাই করেছি। একজন বলছে, মুম্বই গিয়েছিল কাজ খুঁজতে। তারটা যাচাই করা হচ্ছে। আর গিট্টু বলে রাঁধুনিটা পুলিশ কাস্টডিতেই আছে, ইন্টারোগেশন চলছে। গিট্টু বলেছে, কয়েক মাস ধরে ফাদার জেমসন নাকি চিন্তিত ছিলেন কোনো ব্যাপারে, ওই হুমকির নোটগুলো পাচ্ছিলেন। আপনাকে কালকের মধ্যে রিপোর্ট দিচ্ছি।”
”আরে শুধু রিপোর্ট দিলেই তো হল না, আমার খুনিকে চাই।” শংকর প্রিয়মের দিকে অপরাধী মুখে তাকাল, ”কী ঝামেলায় পড়লাম বলো তো! ভাবলাম কোথায় কদিন নির্ঝঞ্ঝাট ছুটি কাটাব, তা না। দু-দুটো মার্ডার। আমার তো ছুটির বারোটা বাজলই, তোমাদেরও একটা ঝামেলায় টেনে আনলাম।”
রুদ্র চারপাশে চোখ বুলোচ্ছিল, ”এখানে ফাদার দুয়ার্তেকে দেখছি না। উনি কি এখনও খবরটা পাননি?”
”পাননি সেটা ইমপসিবল।” শংকর তর্জনী তুলল, ”ওই যে দূরে কাফেটা দেখছিস, ওর পাশেই তো ওঁর অরফ্যানেজ। এত কাছে থেকে খবর পাননি হয় নাকি? এখন ওখানে একবার যেতে হবে। তোরা কি কোথাও ঘুরবি? না আবেল তোদের বাংলোয় পৌঁছে দিয়ে আসবে?”
রুদ্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য প্রিয়মের দিকে আড়চোখে তাকাল। প্রিয়ম যে মারাত্মক রকম রেগে রয়েছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এমনিতে প্রিয়ম হাসিখুশি, চট করে রাগে না। অল্প রাগলে তার বহিঃপ্রকাশও হয় না। কিন্তু একবার ভালোমতো রেগে গেলে তাকে সহজ করা খুব মুশকিল।
রুদ্র চিন্তায় নিজের অজান্তেই কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছল। তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, ”আজ তো বেশ বেলা হয়ে গেছে। সারারাত প্রায় জাগা। টায়ার্ডও আছি। আর কোথাও বেরোব না। চল, তোর সঙ্গে ফাদার দুয়ার্তের আশ্রম দেখে আসি। কাল সক্কাল সক্কাল উঠে আমরা ওল্ড গোয়া ঘুরতে যাব, ওই ব্যাসিলিকা, ক্যাথিড্রাল…! তা-ই তো প্রিয়ম?”
প্রিয়ম বরফের মতো ঠান্ডা গলায় জবাব দিল, ”কাল কোথায় যাব, সেটা কাল সকালে উঠে আমি একাই ঠিক করে নেব। আপাতত আমি আনজুনা বিচ যাচ্ছি। তুমি আশ্রম, ডেডবডি, মর্গ যা খুশি দেখে বেড়াও। এমনিতেই অনেক কষ্টে ছুটি পেয়েছি, এইসব করে সেটা নষ্ট করতে পারব না।”
শংকর মাথা নাড়ল, ”ঠিকই তো। প্রিয়ম, আমি এখুনি গাড়ির ব্যবস্থা…!”
”লাগবে না। আমি একটা স্কুটি ভাড়া করে নেব। আমার আসাটাই ভুল হয়েছে। ভেবেছিলাম দুজনে স্কুটি করে…!” প্রিয়ম বাক্য শেষ করল না, পেছন ফিরে হনহন করে হাঁটা লাগাল।
”কী রে তুই?” শংকর চাপাস্বরে ভর্ৎসনা করল রুদ্রকে, ”দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আরে কলকাতাতেও তো দিনরাত এইসব নোংরাই ঘাঁটিস। শুধু শুধু ছেলেটাকে রাগাচ্ছিস! ছুটিটাও নষ্ট করছিস। যা শিগগির!”
কড়া রোদের মধ্য দিয়ে প্রিয়ম হেঁটে যাচ্ছিল। ওর পায়ের জুতো কিছুটা করে ডুবে যাচ্ছিল বালির মধ্যে, পরমুহূর্তেই পা-টা টেনে তুলে ও সামনে এগিয়ে দিচ্ছিল।
রুদ্র সেদিকে দেখতে দেখতে অন্যমনস্কভাবে বলল, ”শংকর, ডেডবডির আশপাশে পড়ে-থাকা রক্ত এতই কম, মনে হচ্ছে না যে এখানে এসে খুন করা হয়েছে। অন্য কোথাও মার্ডার করে এখানে এসে ফেলে দিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সেক্ষেত্রে গাড়ি করে আনতে হবে। বালির ওপর গাড়ির চাকার দাগ থাকবে। এখনও অবধি পুলিশের যে ক-টা গাড়ি এসেছে, সেগুলোর চাকা ছাড়া অন্য কোনো গাড়ির চাকার ছাপ রয়েছে কি না সেটা মনিটর করতে বল তোর টিমকে।”
”সে না হয় বলছি। এটা আমার মাথাতেও এসেছিল।” শংকর বলল, ”কিন্তু তুই তো প্রিয়মের সঙ্গে যেতে পারতিস!”
”আমার এখন বিচ দেখতে ইচ্ছে করছে না, শংকর। এই মার্ডার মিস্ট্রিটা বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে। ও একাই ঘুরে আসুক। মাথাটা ঠান্ডা হবে। কাল একসঙ্গে ওল্ড গোয়া যাব। রূপার গলার কাছটা লক্ষ করেছিস? ক্ষতস্থানের চারপাশে একটা সরু সাদা দাগ। কোনো সরু চেইন অনেকদিন ধরে গলায় পরে থাকলে ওরকম দাগ হয়ে যায়। কিন্তু রূপার গলায় কোনো চেইন নেই। তাহলে চেইনটা কোথায় গেল?”
শংকর হাতছানি দিয়ে বিজয় গোমসকে ডাকল, ”তোমার কাছে ফাদার দুয়ার্তে রূপার যে ফোটোগ্রাফ দিয়েছিলেন, তাতে গলায় কোনো চেইন আছে?”
”হ্যাঁ স্যার। রূপার গলায় রুপোর চেইন ছিল।” কথাটা বলেই বিজয় চমকে তাকাল অদূরে পড়ে-থাকা ডেডবডির দিকে, ”চেইনটা তো নেই!”
রুদ্র বলল, ”শংকর, রূপা নেইলসন কোথায় কী লিখেছে, কাদের নিয়ে লিখেছে সেগুলো কি তোর কাছে আছে? ও কি কোনো টিমের সঙ্গে কাজ করত?”
”না। নিজের একটা ওয়েবসাইট ছিল, সেখানে ব্লগ লিখত। তিন-চার বছর ধরেই লিখছে। ওর বক্তব্য, গোয়ার নিম্নবর্ণের মানুষদের কৌশলে পাদ্রীরা নিজেদের ধর্মে কনভার্ট করিয়েছে। নানা অন্যায়-অত্যাচার করেছে। এখনও করছে। এই নিয়ে ও এখানকার কিছু লোকের ইন্টারভিউও নিয়েছে। আমি কাল রাতেই পড়ছিলাম।”
রুদ্র অবাক হল। কাকতালীয়ভাবে আজ সকালেই ওরা ইনকুইজিশন নিয়ে আলোচনা করছিল।