পূর্বখণ্ড— সংলিপ্ত
মধ্যখণ্ড- সংশপ্তক
উত্তরখণ্ড- সংখ্যাপন

গণপতির কথা

গণপতির কথা

১।

“বদলে দিয়েছে। শয়তানটা হাতকড়া বদলে দিয়েছে।” মনে মনে গাল পাড়ল গণপতি। “আর কিচ্ছু করার নেই। সব খেলা শেষ। দর্শকদের থেকে একটু সময় চেয়ে স্টেজের পিছনে চলে যাব? সেখানে হয়তো কিছু ব্যবস্থা হতে পারে। নাকি চুপটি করে বসে থাকব? একসময় অধৈর্য হয়ে দর্শকরা নিজেরাই চলে যাবে।”

যে তার হাতে হাতকড়া পরিয়েছিল, তার ধৈর্যের অভাব নেই। শান্ত হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে সে অপেক্ষা করছে, গণপতি কী করে তা দেখার জন্য। গণপতি হাতে ঝাঁকি দিল। অনেক সময় এভাবে কাজ হয়। প্রতিটা ঝাঁকিতে হাতকড়ার ভিতরের লোহার কাঁটা গেঁথে যেতে লাগল তার চামড়ায়। আর তীব্র ব্যথায় প্রায় কঁকিয়ে উঠতে লাগল গণপতি।

দর্শকদের অত ধৈর্য নেই। এবার পিছন থেকে কে যেন সিটি দিয়ে উঠল। “কি হে জাদুকর, চাবিওয়ালা ডাকব নাকি?” আওয়াজ দিল এক ফচকে ছোকরা। এতক্ষণ যারা নিশ্বাস বন্ধ করে গণপতির জাদু দেখে প্রায় অবশ হয়ে গেছিল, তারাও একে অপরকে ঠেলা মেরে হাসাহাসি করছে। আজ প্রথমবার হয়তো জাদুকর গণপতির পতন দেখবে কলকাতার লোকজন, তাও হিন্দু মেলার মঞ্চে। গণপতির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠল।

.

১৮৬৭ সালে চৈত্র মাসে চড়কের দিন নবগোপাল মিত্র মশাই কলকাতায় এক নতুন ধরনের মেলা শুরু করলেন। সঙ্গী ছিলেন রাজনারায়ণ বসু আর ঠাকুরবাড়ির দ্বিজু ঠাকুর। বাংলাদেশে জাতীয় ভাবের উত্থান ঘটাতে শুরু করা এই মেলার নাম দেওয়া হয় “হিন্দুমেলা”। একেবারে অন্যরকম এই মেলায় গান, বক্তৃতা, প্রদর্শনী, কী না হত? হত কুস্তি প্রদর্শন, এমনকি সার্কাস-ও। স্বয়ং নবগোপালবাবু কতগুলি মড়াখেকো ঘোড়া নিয়ে নানা কসরত দেখাতেন। সেই হল বাঙালির প্রথম সার্কাস। ইদানীং অবশ্য ঠাকুরবাড়ির ছোটো ছেলে রবি ঠাকুর নিজে দায়িত্ব নেওয়ায় আগের নেহাত কেঠো আয়োজন থেকে মেলায় অনেক বেশি মানুষ আসেন। সময়টাও একটু পিছিয়ে আষাঢ়-শ্রাবণে করা গেছে। দেশি দেশলাই, গামছা, ভেজিটেবল মোমবাতি, পুতুল, চরকায় কাটা কাপড় ছাড়াও বাড়ির মেয়ে বউরা অনেকেই খাবারের দোকান দিয়ে বসেন। আর সেই খাবারের লোভে রাজ্যের লোক জমা হয়।

তবে গত কয়েক বছর মেলায় সবচেয়ে বেশি ভিড় টানছে একটাই তাঁবু। সে তাঁবুর উপরে একটা ধুতিপরা হাসিমুখের লোকের বিরাট বড়ো ছবি। সে রুমাল নেড়ে বলছে, “বহুৎ আচ্ছা। দিল খোস হো গয়া”। তাঁবুর চারিদিকে রঙিন কাচের স্লাইড। তাতে লেখা-

কুণ্ডলীনে শোভে চারু চাঁচর চিকুর
সুবসনে ‘দেলখোস’ বাসে ভরপুর
তাম্বুলেতে ‘তাম্বুলীন’ সুধাগন্ধ মুখে
প্রিয়জনে পরিতোষ করে লয়ে সুখে।

এই বছর নতুন এক বিজ্ঞাপনী কৌশল নিয়েছে এইচ বোসের কৃষ্ণলীন স্টল। যারাই তাদের তাঁবুতে যাচ্ছে, সবাইকে বিনে পয়সায় এক গেলাস করে তাদের নতুন আবিষ্কার ‘মিল্ক অফ রোজ’ খাওয়ানো হচ্ছে। ভালো লাগলে পরের প্রতি গেলাস এক আনা। হেমেন বোস নিজে প্রতিদিন মেলায় যেতে না পারলেও বিক্রির খবর নেন। এবার বিক্রি লক্ষণীয়ভাবে কম। দোকানে ভিড় হচ্ছে বটে, কিন্তু তা বিনে পয়সায় মিল্ক অফ রোজ খাওয়ার জন্য। কেউই আর এক আনা দিয়ে পরের গেলাস খেতে চাইছে না। এমনটা তো হবার নয়। জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়ে দোকানের কর্মচারী অদ্ভুত এক কথা জানালে। তাঁদের তাঁবুর ঠিক উলটো দিকে নাকি এক ম্যাজিশিয়ান তাঁবু ফেলেছে। এই বছরই প্রথম। সবাই সেখানেই ভিড় করছে। হেমেন বোস ব্যবসায়ী মানুষ। তিনি ব্যাপারটা সরেজমিনে দেখতে নিজেই মেলায় উপস্থিত হলেন। সঙ্গে তাঁর ফটোগ্রাফার বন্ধু উপেন্দ্রকিশোর। ইনি লেখালেখিও কিছু করেন বটে, কিন্তু তাঁর আসল আগ্রহ ছবি তোলায়। তাই তিনিও এসেছেন হিন্দু মেলার ছবি তুলতে। মেলায় ঢুকে

হেমেন বোস দেখলেন খবর একেবারে সঠিক। তাঁর তাঁবুর ঠিক উলটো দিকেই লাল হলুদ পতাকা টাঙানো বিরাট এক তাঁবু পড়েছে। বাইরে লেখা-

অদ্ভুত ইন্দ্রজাল
জাদুকর গণপতির ভোজরাজা ও ভানুমতীর খেলা

ভালো সময়েই পৌঁছেছেন তাঁরা। একটু বাদেই জাদু প্রদর্শনী শুরু হবে। একটা দশ-বারো বছরের বাচ্চা ছেলে তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে চেল্লাচ্ছে-

“অদ্যই শেষ রজনী! অদ্যই শেষ রজনী! অদ্য সত্যই শেষ রজনী। লোমহর্ষণ কাণ্ড। নিদারুণ ব্যাপার। ভৌতিক বাক্সের খেলা, বন্ধনমুক্তির খেলা। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাদুকর গণপতির খেলা দেখুন। দেখে মুগ্ধ হউন। টিকিট মাত্র এক আনা”

মিল্ক অফ রোজ না বিক্রি হবার কারণ এইবারে বুঝতে পারলেন এইচ বোস। এক আনা দিয়ে যদি এতরকমের তামাশা দেখা যায়, তবে সেই টাকা খেয়ে নষ্ট করে কোন পাগলে! তবে এই গণপতির নাম তিনি আগে শোনেননি। বেশ আগ্রহী হয়ে নিজেও এক আনা দিয়ে একটা টিকিট কাটলেন। তাঁর বন্ধু অবশ্য ম্যাজিকে খুব বেশি আগ্রহী নন। তিনি বাইরে ক্যামেরা কাঁধে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।

ভিতরে ঢুকে এইচ বোস বেশ অবাক হয়ে গেলেন। তাঁবুর আকার খুব ছোটো নয়, কিন্তু তাও কানায়কানায় ভরা। দর্শকদের অনেকেই আগেও এসেছে জাদু দেখতে, আবার আজও যে এসেছে, তা তাদের কথাতেই বোঝা গেল। মঞ্চ বলতে কাঠের চৌকি দিয়ে সামান্য উঁচু করা। ভিতরে হ্যাজাকের আলোতে ঝলমল করছে। খানিক বাদে বাইরের সেই সহকারী তাঁবুর সামনের পর্দা আটকে দিলে। বাজনদাররা সবাই মিলে জোরে জোরে খোল, করতাল, ভেঁপু বাজাতে লাগল। এইবার খেলা শুরু হবে।

সেসব থামতেও জাদুকরকে দেখা গেল না। মঞ্চ শূন্য। শোনা যাচ্ছে হারমোনিয়াম বাজিয়ে মধুর কন্ঠের গান, “মন যারে ভালোবাসে কেন তারে নাহি পায়/ যার তরে নয়নঝরে, সে তো ফিরে নাহি চায়।” শেষ হতেই প্রবল হাততালির মধ্যে মঞ্চে জাদুকর এলেন। তাঁর হাতে ধরা বিরাট এক ঘড়ি। সে ঘড়িতে কাঁটা-ফাঁটা কিচ্ছু নেই। শুধু সংখ্যা আর সংখ্যার নাম লেখা।

“আমি যখন হিমালয়ে আমার গুরুর কাছে জাদুবিদ্যে শিখেছিলাম, তখন ফিরে আসার সময় তিনি খুশি হয়ে আমায় এই ঘড়িটা দিয়েছিলেন। আমি বললাম, ‘বাবা, এই ঘড়িতে সময় দেখব কী করে?’ বাবা বললেন, ‘বেটা, এ হল জাদুঘড়ি। এতে কাঁটা লাগে না। সময় এখন তোর হাতের মুঠোয়। তুই যা বলবি, ঘড়িতে সেই সময়ই দেখাবে।— আমি দর্শকদের বলছি, যদি কেউ একটু মঞ্চে উঠে আসেন…’

বেশ আগ্রহী হয়ে হেমেন বোস নিজেই উঠে এলেন মঞ্চে। দেখাই যাক না, এ কেমন জাদুকর! বোসের হাতে একটা কালো রুমাল দিয়ে গণপতি বললে, “আপনি যতটা সম্ভব জোরে আমার চোখ বেঁধে দিন। যেন একবিন্দু আলো আমার চোখে প্রবেশ করতে না পারে।”

হেমেন বোস তাই করলেন। এবার গণপতি ঘড়ি আর দর্শকদের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “আমার পক্ষে কি এখন ঘড়ি দেখা সম্ভব?”

দর্শকদের একাংশ বেশ জোরেই বলে উঠল, “না।” হেমেন বোস নিজেও বুঝলেন দেখা সম্ভব নয়। তিনিও মাথা নাড়লেন।

“এইবারমশাই, এখন থেকে আপনার হাতই আমার ঘড়ির কাঁটা। আপনার হাত চলবে আমার বশে। আপনি ডায়ালের একেবারে মাথায় বারোতে হাত রেখে যে-কোনো সংখ্যার কথা ভাবুন। যে-কোনো। যে সংখ্যাটা আপনার ভালো লাগে।”

হেমেন বোস বারোতে আঙুল রাখলেন। মনে ভাবলেন ছয়।

“এবার সেই সংখ্যাটার বানান করুন। মনে মনে। আর প্রতিবার ঘড়ির ডায়াল বরাবর নতুন সংখ্যায় হাত রাখুন। গোনা শেষ হলেই থেমে যাবেন।”

.

S-I-X, বারোর পর থেকে শুরু করে হেমেন বোসের আঙুল ডায়ালের তিন নম্বরে থামল।

“এবার নতুন সংখ্যাটার বানান করে আবার একবার আঙুল চালান।”

T-H-R-E-E, হাত এবার আটের ঘরে।

“ব্যস! এবার বলুন তো, আপনি মনে মনে যে সংখ্যা প্রথমে ধরেছিলেন, বা দ্বিতীয়তে, এদের একটাও আমার জানার কথা কি?”

হেমেন বোস মৃদুকণ্ঠে কিছু বলার আগেই দর্শকদের থেকে সজোরে “না-আ-আ” ভেসে এল।

“এইবার শেষবার আপনাকে আর-একটু কষ্ট করতে হবে। শেষ যে সংখ্যাটায় হাত দিলেন সেটাও শুনে ফেলুন।”

E-I-G-H-T, গুনে নতুন সংখ্যায় হাত দেবার আগেই গণপতি চিৎকার করে বলে উঠল, “হিমালয়ের বাবা বলেছিলেন, সময় আমার বশে থাকবে। এই দেখুন। সময় আমার বশে রয়েছে। এই মুহূর্তে এই ভদ্রলোক ‘এক’টায় আঙুল দিয়ে আছেন। ঠিক কি না?”

গোটা তাঁবু করতালিতে ফেটে পড়ল। হেমেন বোস-ও মুগ্ধ হলেন। কিন্তু তখনও তাঁর অনেক কিছু দেখা বাকি ছিল।

গণপতি প্রথমে তাসের কিছু খেলা দেখালে। তার নির্দেশে দর্শকদের বলা তাস বান্ডিল থেকে লাফিয়ে উঠে শূন্যে তিরতির করে ভাসতে লাগল। তারপর সরু ছুঁচ আর সুতো নিয়ে গণপতি পা দিয়ে শুধু ছুঁচে সুতোই পরাল না, সেই ছুঁচ দিয়ে রীতিমতো ছেঁড়া জামা সেলাই করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল। এরপর তো আরও এক কাঠি। একমুঠো ভর্তি ছুঁচ নিয়ে গণপতি গপাৎ করে গিলে নিল। দর্শকদের অনেকেই হায়হায় করে উঠতেই গণপতি তাদের হাত তুলে অভয় দিল। সেখানেই শেষ না। সুতোর বান্ডিল থেকে কিছুটা লাল সুতো ছিঁড়ে সেটাও গিলে ফেলল। বেশ খানিক মুখ বিকৃত করে চিবিয়ে হাঁ করেই মুখ থেকে সে যখন সুতোয় গাঁথা ছুঁচের মালা বার করছে, এইচ বোস-ও মনে মনে মেনে নিলেন এমন জাদুকরের কাছে তাঁর মিল্ক অফ রোজ নেহাত পানসে।

ভূতের বাক্সের খেলায় গণপতিকে একটা বাক্সে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। শুধু তার মাথা আর হাত দুখানা বাইরে। সেই দুই হাত ধরে আছে তার দুই সহকারী। বাক্সের বাইরে কাগজে মোড়া স্লেট ঝুলছে। প্রথমেই গণপতি আর তার সঙ্গীরা বিদেহী আত্মাকে আহ্বান করল। আবার দুই দর্শককে মঞ্চে ডাকা হল। হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল দুটি বই। বলা হল যে-কোনো দুটি পাতা খুলে দুটি শব্দ পড়ে মনে রাখতে। তাঁরা তাই করলেন। এবার দুইজনের হাতে কাগজে মোড়া স্লেট দুটো ধরানো হল। বলতে বলা হল, বইয়ের পৃষ্ঠা আর শব্দ। বলার পরে স্লেটের ঢাকা খুলে দেখা গেল আত্মা এসে আগেই সেটা একেবারে সঠিকভাবে লিখে দিয়ে গেছে।

শেষ খেলা। আসল খেলা। বন্ধন মুক্তির খেলা। এই খেলার আগে প্রতিবার গণপতির বুক টিপটিপ করে অদ্ভুত এক আনন্দে। প্রথম অংশে গণপতিকে দড়িদড়া দিয়ে বেঁধে বাক্সে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। সে মুহূর্তে বন্ধন খুলে বেরিয়ে আসে। এই খেলা তার কাছে জলভাত। তার চেনা। কিন্তু তারপরেই সে যেটা করে সেটা হল সরাসরি চ্যালেঞ্জ। দর্শকদের মধ্যে কারও কাছে কোনও হাতকড়া থাকলে সে এসে গণপতিকে সেই কড়া দিয়ে বাঁধতে পারে। গণপতি মুক্ত হয়ে দেখাবে। বেশিরভাগ দর্শক এটার জন্যেই অপেক্ষা করে। অনেক সময় কেউ চ্যালেঞ্জ নিতে চায় না। কিন্তু দর্শকদের মধ্যে পুলিশের কেউ থাকলে খেলা জমে ভালো। প্রত্যেক পুলিশের ধারণা তার হাতকড়া সবচেয়ে সেরা। দুনিয়ার কেউই তা থেকে মুক্ত হতে পারবে না। আর প্রতিবার গণপতি তাদের ভুল প্রমাণ করে। চেনা খেলা বারবার দেখানোর চেয়ে এই খেলা দেখানোতে ঢের বেশি মজা। আজকেও সব খেলা শেষে সে দর্শকদের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল। তবে জানত আজ কিছু হবে না। সে আগেই দেখে নিয়েছে লাল পাগড়ি কেউ নেই এদের মধ্যে।

কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে দর্শকদের ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা হাত উঠল। গণপতি তাকে মঞ্চে ডাকতে গিয়ে আরও অবাক হয়ে দেখল এ কোনও দেশি মানুষ নয়, পাকা সাহেব। তার সাধ্যমতো ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে সাহেবকে ডেকে নিল সে। দরকারের কিছু বেশিবারই “ওয়েলকাম ওয়েলকাম” বলল। এবার আসল কাজ। সাহেব তাঁর পকেট থেকে যে হাতকড়াটা বার করলেন সেটা তার অতি চেনা স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন। মনে মনে হাসল গণপতি। এইখানে তারিণী থাকলে ভালো হত। কতকাল আগে এই হ্যান্ডকাফ নিয়েই তো ছোটুলাল ঘাটে প্রায় ডুবে মরতে বসেছিল তারা। এই হাতকড়া পরীক্ষা করার কিছু নেই। হাতে না নিয়েই সাহেবকে হাতকড়া পরিয়ে দিতে বলল গণপতি।

“ক্লিক” শব্দ করে তালা হাতে আটকে যেতেই ডান কবজিতে আলতো মোচড় দিল সে। স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসনের তুক এটাই। পাশে একটা স্ক্রু থাকে। এই মোচড়ে সেটা ঢিলে হয়ে যায়। বাকিটা জলভাত। আজকে মোচড় দেবার পর হাতকড়া আরও এঁটে বসতেই চমকে গেল গণপতি। আর তখনই চরম আতঙ্কের সঙ্গে সে খেয়াল করল এটা কোনও সাধারণ হাতকড়া না। বিশেষভাবে বানানো। স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসনের স্ক্রু-টাকে খুলে সেই জায়গায় লোহা দিয়ে ঝালাই করে দেওয়া হয়েছে। ফলে এক বিন্দু সরানোর উপায় নেই। খেলা দেখানোর আগে একটু সতর্ক হলেই এমনটা হত না। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। গণপতির হাত বেয়ে দরদর করে রক্ত পড়ছে। কিন্তু দর্শকদের সেদিকে লক্ষ নেই। তারা নানারকম টিপ্পনী কাটতে ব্যস্ত। অনেকে তো আবার পয়সাও ফেরত চাইছে। এমন অপমানিত আগে কোনও দিন হয়নি গণপতি। এবার হাতকড়ার কাঁটা মাংস ভেদ করে সোজা হাড়ে বিঁধছে। আজকের মতো হাত খুলতে পারলেও এই হাতে জীবনে আর কোনও দিন জাদু দেখাতে পারবে না গণপতি। চিরকালের মতো তার হাত দুটো অকেজো হয়ে যাবে।

এরই ফাঁকে অন্য এক চিন্তা খেয়ে ফেলছিল তাকে। কে এই সাহেব? আচমকা যেন মাটি খুঁড়ে উদয় হয়ে গণপতিকে সবার সামনে উলঙ্গ করে দিতে বদ্ধপরিকর। এ কী চায়? যেন তার মনের কথা বুঝেই সাহেব ফিসফিসিয়ে কাটা কাটা ইংরাজিতে তাকে বললেন, “মুক্তি চাই?”

গণপতি কথা বলার মতো অবস্থায় ছিল না। শুধু ধীরে ধীরে মাথা উপরে নিচে নাড়াল।

“তাহলে আমার কথা শুনতে হবে। রাজি?”

গণপতি সাহেবের উদ্দেশ্য কিছুই বুঝতে পারছিল না। কিন্তু এখন সে সময় নেই। সেসব পরে বোঝা যাবে। প্রায় কিছু না ভেবেই আবার উপরে নিচে মাথা নাড়াল সে। সাহেব যেন পালকের মতো হালকা একটা হাত বুলিয়ে দিলেন হাতকড়ায় আর খট শব্দ করে দুটো কড়াই খুলে গেল। দর্শকরা ফেটে পড়ল জয়ধ্বনিতে। গণপতির হাত দিয়েঝরে পড়া রক্ত লেগে আছে গোটা হাতকড়া জুড়ে। সেটাই কুড়িয়ে নিয়ে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে সাহেব আর কোনও কথা না বলে নেমে গেলেন। যাবার আগে শুধু বলে গেলেন, “তোমায় আমি খুঁজে নেব।”

এত কিছুর মধ্যে সাহেবের একটা জিনিসই চোখে পড়েছিল গণপতির। সাহেবের অদ্ভুত ভাবলেশহীন চোখ। চোখের একটা মণি নীল, আর অন্যটা ধূসর।

.

২।

গণপতি ছুটছিল। তীব্র বৃষ্টির ফলা তার শরীরকে বিধে ফেলছে ক্রমাগত। তার এই মরিয়া দৌড়ের সামনে কিছু নেই, কোনও উদ্দেশ্য নেই, কোনও চাওয়া পাওয়া নেই। তবু সে ছুটে চলছে। হাঁচড়েপাঁচড়ে। সে জানে না সে ছোটা বন্ধ করলে কী হবে? ছুটেই বা যাচ্ছে কোথায়? তবু এক অশনির অমোঘ টানে তার এই ছুটে চলা। সামনেই এক রুম বাঁশের সেতু। এই সেতুতে চেপে ইস্কুলে যেত একেবারে ছোটোবেলায়। সেতুর অন্যদিকে প্যাদনা দাঁড়িয়ে হাসছে। কোন এক অলীক মন্ত্রে প্যাদনা আবার সেই বছর দশেকে ফিরে গেছে। খালি গা, কোমরে ঢোলা ইজের। প্যাদনা সুর করে গান গাইছে, “ও ললিতে, চাঁপাকলিতে একটা কথা শুন সে/রাধার ঘরে চোর ঢুকেছে চূড়া বাঁধা এক মিনসে।” গণপতি সেই সেতু দিয়ে ওপারে পৌঁছাতেই দেখল প্যাদনা আর নেই। সে এক অন্ধকার গুহার ঠিক মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে। অনেক দূরে এক বিন্দুর মতো একটু আলো দেখা যাচ্ছে। গণপতি ছোটার বেগ কমাল না। সেই অন্ধকার গুহাতেও চোখ সয়ে গেছে অনেকটাই। গণপতি দেখতে পেল টকটকে লাল শালু পরনে, হাতে একটা ত্রিশূল নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছেন পিণ্ডারী বাবা… “বেটা তাকত হ্যায়? হিম্মত হ্যায়?” না, সে ভুল দেখেছে, লাল শালু না, লাল রক্ত পিণ্ডারী বাবার বুকের তলা থেকে ভেসে যাচ্ছে রক্তে, পাঁজর থেকে নিচ অবধি দেহটা দুফালা, বেরিয়ে আছে অস্ত্র। তবু বাবা হা হা করে হাসছেন। গণপতি ছোটা থামাল না। সেই অবস্থাতেই কানের কাছে কে যেন ফিসফিস করে বলে, “হাজতে যাবি, না আমাদের কথা শুনবি?” গণপতি সভয়ে দ্যাখে সামনের দাঁত উঁচু ছেলেটার হাতের একটা আঙুল নেই। সেই হাতেই সে বাড়িয়ে ধরেছে অদ্ভুত এক বাক্স। গণপতি জানে এই বাক্সে ভূত আছে। গণপতি হাত বাড়িয়ে বাক্স নিতে যায়। আর তখনই খেয়াল করে তার হাতে হাতকড়া বাঁধা। স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন, যার একদিক ঝালাই করে আটকে দেওয়া হয়েছে। গণপতি বুঝতে পারে না সে কী করবে? মাথার ভিতর অজস্র কথামালা জাল বুনে চলে। গোটা গুহা ভরে যায় মহিলা কন্ঠের এক হাসিতে। এ হাসি গণপতির খুব চেনা। সোনাগাজির লক্ষ্মীমতি হাসছে। মরে গিয়েও হাসছে। আর একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে সেই অদ্ভুত সুন্দর মেয়েটা। লখন যাকে নিজের দিদি বলে ডাকে। মায়াবী চোখে গণপতির দিকে তাকিয়ে আছে সে। গণপতি তার দিকে এগিয়ে যেতেই দেখল সে ভুল দেখেছে। এ অন্য মানুষ। এ নারী না। পুরুষ। শৈল। শৈলচরণ সান্যাল। শৈলর হাতে একটা পাতলা ছাপা রঙিন কাগজ। গণপতি হাতকড়ায় বাঁধা হাত বাড়িয়ে সে কাগজ নিতে যেতেই শৈল ছুট লাগাল। ধাওয়া করল গণপতি। গুহার ছাদ ভেঙে যাচ্ছে। আর সেখান থেকে খুব ধীরে নিচে এসে পড়ছে একটা মৃতদেহ। হ্যালিডের মৃতদেহ। শৈলর সেদিকে নজর নেই। সে দৌড়াচ্ছে। দৌড়াতে দৌড়াতে দুজন চলে এল গুহার একেবারে শেষে। এখানে অপার্থিব এক নীল আলোয় ভরে আছে চারদিক। শৈল দৌড় থামাল না। সামনেই অতলস্পর্শী এক খান। শৈল গিয়ে সোজা লাফ দিল সেই খাদে। গণপতিকে সে ডাকল “আয়আয়” বলে। গণপতি দ্বিধা করে। বুঝতে পারে না তার লাফানো উচিত কি না। ততক্ষণে খাদের ধারে ওরা সবাই এসে গেছে। প্রিয়নাথ দারোগা, সাইগারসন সাহেব, বড়লাট, এমনকি হীরালাল-ও। কেউ কিন্তু বলছে না। সবাই অপেক্ষা করছে গণপতির মহাপতনের। ভিড়ের মধ্যে থেকেই এগিয়ে এলেন এক সাহেব। সেই সাহেব, যার এক চোখ নীল, আর অন্য চোখ ধূসর। গণপতিকে কিছু বুঝতে না দিয়েই সাহেব হালকা হাতে মারলেন এক ঠেলা। গণপতি দেখল কোন আজব মস্তবলে সে আবার চলে এসেছে ছোটুলাল দুর্গাপ্রসাদ ঘাটে। ডুবে যাচ্ছে। জল বেড়ে উঠছে গলা, কান, মাথা… আর ঠিক সেই সময়ই একটা হাত এগিয়ে এসে তার চুলের মুঠি ধরল দৃঢ়ভাবে…

ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসল গণপতি। সারা গা ঘামে ভিজে যাচ্ছে। যেন সদ্য স্নান সেরে এসেছে। ধীরে ধীরে তাঁবুর পর্দা সরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। গোটা মেলা যেন শ্মশানভূমি। একটা মানুষও জেগে নেই। দুই-একটা কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক। তাদেরই একজন গণপতিকে দেখতে পেয়ে লেজ নাড়তে নাড়তে এগিয়ে এল। শেষ রাত। পূর্ণিমার চাঁদ প্রায় ঢলঢল। এখনই সময়। আর বেশি দেরি করলে অবস্থা হাতের বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে। পরনের ধুতিটায় মালকোঁচা মেরে, একটা ফতুয়া চাপিয়ে সেই রাতেই গণপতি ক্লাইভ স্ট্রিটের দিকে পা বাড়াল।

.

লক্ষ্মীমতি মারা যাবার পরে বেশ কিছুদিন তার ঘর ফাঁকা ছিল। যতই হোক, অপঘাত মৃত্যু। বেশ্যাদের মধ্যে আর কিছুর ভয় থাক না থাক, ভূতের ভয় প্রবল। কিন্তু এতদিন পরেও যখন কোনও উপদ্রব হয়নি, তখন সবাই ধরে নিল লক্ষ্মীমতি এই ঘরের মায়া কাটিয়ে অন্যলোকে জমিয়ে বসেছে। এখন তার ঘরের দখল নিয়েছে জুঁই নামের অল্পবয়সি এক বেশ্যা। গায়ের রং কালো হলেও মুখশ্রী সুন্দর, আর খদ্দেরকে বশ করার ছলাকলা এর মধ্যেই ভালো আয়ত্ত করেছে। এক সাহেব ইদানীং তাঁর বাঁধা বাবু। প্রায় প্রতিদিন একটু রাতে সাহেব এসে হাজির হন। এ সাহেব অন্যদের মতো না। দেখলেই কেমন যেন ভয়ভয় করে। বিশেষ করে চোখের দিকে তাকালে। সাহেবকে খুশি করতে অনেকসময় তার নিজের ঘরেই আরও দুই-চারটি মেয়েকে বসাতে হয় জুঁইয়ের। একা জুঁইতে সাহেবের সুখ হয় না। ইদানীং সাহেবের নতুন শখ হয়েছে। সোনাগাজির অলিতে গলিতে বেশ্যাদের ছোটো ছোটো ছেলেরা ঘুরে বেড়ায়। এরা সবচেয়ে হতভাগা। মায়ের এদের থেকে কোনও আশা নেই। বড়ো হয়ে হয় দালাল হবে, নয়তো গুণ্ডা বদমাশ। এই সাহেব আসার পরে এদের ভাগ্য কিছুটা খুলেছে। সাহেবের আদেশে জুঁই এদের মধ্যেই দেখতে শুনতে ভালো এমন সাত-আট বছরের দুই- একটা ছেলেকে ধরে নিয়ে আসে। প্রচুর টাকা বকশিশ দিয়ে বলা হয় কাউকে কিছু না বলতে। সাহেব এদের নিয়েই ফূর্তি করেন। জুঁই দরজার কাছে পাহারা দেয়। এদের মায়েরা খেয়াল রাখে না ঠিক, কিন্তু যদি জানে, জুঁই তাদের ছেলেদের দিয়ে এইসব কাজ করাচ্ছে, তবে অনর্থ হবে। এখন প্রায় শেষরাত। এখনও সাহেব বিছানায় ল্যাংটা হয়ে শুয়ে আছেন। দুটো বাচ্চা ছেলে ক্লান্ত হয়ে পাশেই ঘুমিয়ে পড়েছে। জুঁই মুখ ফিরিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল।

মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা তারিণীর। সেই যবে হাসপাতাল থেকে বাড়ি এসেছে, রাত গভীর হলেই ব্যথা বাড়ে। প্রথমে মাথার ঠিক মাঝখানে চিড়িক করে একটা ঝিলিক দিলেই তারিণীর ঘুম ভেঙে যায়। তারপর ধীরে ধীরে সেই ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে গোটা মাথাজুড়ে। আর শুয়ে থাকা যায় না। তারিণী পাগলের মতো ঘরে পায়চারি আরম্ভ করে। মাথা টিপে ধরে বসে থাকে। মাঝে মাঝে অন্য কথা ভেবে ব্যথাকে ভুলে থাকতে চায়। আজই যেমন। রাত প্রায় শেষ হয়ে গেলেও সে জেগে আছে। টেবিলের কেরোসিন ল্যাম্পের মাথায় কালি জমে প্রায় নিভুনিভু। একমনে তারিণী ডায়রি লিখে চলেছে। এসব করলে বরং মনটা অন্যদিকে যায়। শৈলর লেখা সেই ভয়ংকর নাটকে যদি বিন্দুমাত্র সত্যিও থেকে থাকে, তবে ইংরেজ রাজত্বে এত বড়ো দুঃসময় আগে আর আসেনি। ম্যাসনিক ব্রাদাররা পরিষ্কার দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছেন। এক দল রানির পক্ষে, অন্য দল রানিকে সরিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। আর সেই সরানো একেবারেই গণতান্ত্রিক উপায়ে হবে বলে মনে হয় না। তবে উপায় কী? আর রানি চলে গেলে নতুন রাজা কে হবেন? বেশ কয়েকবার পড়ে শৈলর সেই নাটক তারিণীর মুখস্থ হয়ে গেছে। মাথার দুদিকের রগ চেপে সে আবার লাইনগুলো মনে করার চেষ্টা করল। বিজ্ঞাপন… প্রথম অক্ষ…. দ্বিতীয় অক্ষ… আর তার শেষে…। গোটা ষড়যন্ত্র এতক্ষণে তারিণীর সামনে ধীরে ধীরে একটা রূপ নিতে শুরু করেছে। এ যদি সত্যি হয়, তবে তা ঠেকানোর সাধ্যি তার মতো ছাপোষা মানুষের নেই। ‘ভারতভিক্ষা’ ছবির প্রতিটা সংকেত এবার তার কাছে পরিষ্কার। মাথার তীব্র যন্ত্রণা ভুলে ভূতগ্রস্তেরমতো তারিণী ডায়রিতে সবকিছু লিখে যেতে লাগল।

.

আপিসে ছুটি মঞ্জুর হয়েছে। প্রিয়নাথ দেশের বাড়ি যেতে পারেন। কিন্তু এই প্রথমবার প্রিয়নাথের বাড়ি যেতে ইচ্ছেই করছে না। এমন ভয়ানক এক বিপদ গিলোটিনের মতো গলার কাছে ঝুলে রয়েছে, এই অবস্থায় বাড়ি গেলেও শাস্তি পাবেন না তিনি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে এইসবই সাতপাঁচ ভাবছিলেন। গোটা কেসটা যেভবে শুরু হয়েছিল, এখন সবকিছু ঘুরে গিয়ে একেবারেই অন্য রূপ নিচ্ছে। ব্রাদারহুড, জাবুলন, মহারানি, ষড়যন্ত্র- এত কিছু এই এক জীবনে তাঁকে দেখে যেতে হবে বলে ভাবেননি প্রিয়নাথ। সাইগারসন সাহেব যা ইঙ্গিত দিলেন, তাতে খুব তাড়াতাড়ি এরা কিছু একটা করবে। কী করবে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা যদি তাঁর থাকত! আর এই ভূত ব্যাপারটাই বা কী? হাতে শৈলচরণের নাটকটা নিয়ে উলটেপালটে দেখছিলেন। হঠাৎ একেবারে পঞ্চম অঙ্কের শেষের দিকে চোখ পড়ল তাঁর। তোয়াজি হিলি ভূত, সেনাপতি, কতা শুনবে না, সেনাপতির বিলাপ…. গোটা ব্যাপারটাই কেমন চেনাচেনা লাগছে। আর যদি তাই হয়, তবে এতদিন যেসব সমস্যা নিয়ে মাথার চুল ছিঁড়ছে গোটা পুলিশ ডিপার্টমেন্ট, সেটা আসল সমস্যাই না। সমস্যার পূর্বাভাস মাত্র। ভয়ানক একটা বড় আসে কাল যে করেই হোক তারিণী আর সাইগারসনের সঙ্গে দেখা করে তাঁর এই ধারণার কথা বলতে হবে। আজ রাতে আর ঘুম হবে না। পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে ঘরে ভেসে যাচ্ছে, তবু টেবিলের আলোটা উসকে দিলেন প্রিয়নাথ। টেবিলে সদ্যপ্রকাশিত এক গোয়েন্দার আত্মজীবনী। আসল লেখকের নাম নেই। নামটা দেখেই আগ্রহী হয়ে বইটা কিনেছিলেন তিনি। ঘুমই যখন আসবে না, পরে দেখ যাক কী লিখেছে তাঁর সিরিজের সমনামী এই “বাঁকাউল্লার দপ্তর” -এ।

গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের কোনও ঘরে কোনও আলো জ্বলছে না। সবাই যেন রাত্রির সুষুপ্তির ঘোরে ক্লান্তির আলোয়ান মুড়ে অচৈতন্য। শুধু দোতলার এক ঘরে একটা লোক জেগে আছে। তাঁর টেবিলে গ্যাসোজিনের পাত্র, তাঁর ঘর খন তামাকের ধোঁয়ায় আচ্ছা, চক্ষু দুটি মুখে তিনি দুই পা টান করে ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে ভেবে চলেছেন। যে দায়িত্ব নিয়ে দ্বিতীয়বার ইংরেজ রাজত্বের এই দ্বিতীয় লন্ডনে পা রেখেছেন তিনি, জানেন না, সেই কাজে সফলকাম হবেন কি না। আজ, একাকী, এই ভিনদেশে এই হোটেলের ঘরে বসে প্রথমবার তাঁর মনে হল এককালের গৃহসখা সেই ডাক্তারের কথা, লন্ডনের লাইসেনিয়াম থিয়েটারের কথা, চোরা গলিখুঁজিতে ঘুরে বেড়ানো উইগিল আর তার দলবলের কথা। যে দায়িত্ব পালনে তিনি এই দেশে এসেছেন তার শেষ কোনও রোমান্টিক গল্পের মতো সুখদায়ক হবে না তিনি জানেন। তিনি জানেন এই পথের শেষে রয়েছে এক রক্তঢালা করুণ পরিসমাপ্তি। যে পক্ষের জয়ই আসুক না কেন, তা আসবে প্রাণের বিনিময়ে। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া তাঁর আর কোনও উপায় নেই। শুধু যে কাজের জন্য পাঠানো হয়েছে, সেই কাজটুকু ঠিকভাবে করে সঙ্গে সঙ্গে দেশে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু যারা পড়ে থাকবে? কী হবে তাদের? কী হবে তারিণী, গণপতি কিংবা প্রিয়নাথের? যদি বেঁচেও থাকে, এদের জীবন আর আগের মতো থাকবে না। একমাত্র তিনিই জানেন এই অপরাধের পিছনে যে দীর্ঘ ছায়া আছে, সেই ছায়া ঠিক কতটা দীর্ঘ। তাঁকে আন্দাজ করা যায়, কিন্তু স্পর্শ করা যায় না। শৈল স্পর্শ করতে চেয়েছিল হয়তো। আর তাই তাকে চিরশান্তির দেশে চলে যেতে হল। তবে একটা বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। তাঁদের কার্যকলাপে এদের টনক নড়েছে। সব সম্ভাবনা থেকে অসম্ভবকে বাদ দিলে যা পড়ে থাকে সেটাই সত্য। তিনি জানেন সত্য কী। কিন্তু যতক্ষণ না চাকা ঘুরতে শুরু করছে, তাঁর কিচ্ছু করার নেই। আলগোছে হাতের পাশে রাখা স্টাডিভারিয়াস বেহালাটা হাতে তুলে নিলেন সাইগারসন। আর একটু বাদেই ভোর হবে। চাঁদের আলো ক্রমে আবছা হয়ে আসছে। আর সেইদিকেই তাকিয়ে বেহালার ছড়ে মেন্ডেলসনের LeIder De One Worter, শব্দহীন গানের মূর্ছনা তুললেন সাহেব। দুইজন সুরে মাতাল রাস্তা দিয়ে গলা জড়াজড়ি করে হেঁটে যাচ্ছিল। তারাও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আলো জ্বলা সেই জানলার দিকে।

গ্রেট ইস্টার্নের জানলা দিয়ে ভেসে আসা সেই সুরে পঙ্কিল কলকাতা যেন একলহমায় লন্ডন হয়ে গেল।

.

৩।

মাঝরাত পেরিয়ে গণপতি যখন নিমতলা শ্মশানে ঢুকল, তার গা থেকে ভকভক করে বাংলা মদের গন্ধ বেরুচ্ছে। এই একটি অভ্যেস কিছুতেই ত্যাগ করতে পারেনি সে। ভেবেছে ছেড়ে দেবে, তারপরেই কিছু না কিছু একটা ঘটে যায়। মদ আর ছাড়া হয় না। খালাসিটোলার ঝাঁপ বন্ধ হতে তবেই সে পদব্ৰজে এসেছে এখানে। অন্য কোনওভাবে না। তেমনটাই তারিণীর নির্দেশ ছিল। সেদিন ভোররাতে তারিণীর কাছে গিয়ে সব খুলে বলেছিল গণপতি। কিন্তু লুকায়নি। শুনে তারিণী ভয়ানক গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, “এই ব্যাপার আর তোমার-আমার মধ্যে নেই। দারোগাবাবু আর সাহেবকেও জানাতে হবে। তোমার কথা যদি সত্যি হয়, হাতে মাত্র সাতদিন আছে।”

তারিণীই বলেছিল, এই মুহূর্তে চারজনের একসঙ্গে দেখা করা বিপজ্জনক কার পিছনে কে বা কারা ফেউ হিসেবে লেগেছে বলা মুশকিল। তারিণীর অফিস ওরা চেনে। না হলে তারিণীর মাথায় বাড়ি মেরে শৈলর নাটক নিয়ে পালাতে পারত না। প্রিয়নাথ দারোগা বা সাইগারসন সাহেবের হোটেলে একসঙ্গে গেলে একই ব্যাপার। যে কিচ্ছু জানে না, তারও সন্দেহ হবে। শেষে অনেক ভেবে এই নিমতলা শ্মশানে, মধ্যরাতে তাদের অধিবেশনের ব্যবস্থা করেছে তারিণী। তাও সবাই একসঙ্গে আসবে না। এক এক করে। আলাদা আলাদা জায়গা থেকে। এসে বসে থাকবে নিজেদের মতো। এ কিছু আশ্চর্য নয়। নিমতলার শ্মশানে গেলে দেখা যায়, চারিদিকে মৃত্যুর দৃশ্য আর শোকের ভিতরে দিব্য এক নিশ্চিস্ত আড্ডা জমে আছে। আড্ডাটা দিনের চেয়ে রাত্রেই বেশি জমে ওঠে। বড়োগির্জার ঘড়িতে মাঝরাতের ঘন্টা বাজবার পরেই চারমাথা এক হবে। এইসবই তারিণী যোগাযোগ করে ব্যবস্থা করেছে।

গণপতির একটু দেরি হয়ে গেছে। শ্মশানে ঢুকেই সে দেখতে পেল চারদিকে দাউদাউ চিতা জ্বলছে। পুত্রহারা মা, স্বামীহারা স্ত্রী আর বাপ-মা-হারা সন্তান অশ্রান্ত স্বরে কেঁদে কেঁদে আকাশ ফাটিয়ে দিচ্ছে। কাঙাল ও ধনী, মনিব ও চাকর, পণ্ডিত ও মূর্খ, শিশু ও বুড়োর শব এখানে-ওখানে ছড়িয়ে পড়ে আছে। পুরুত মন্ত্র পড়ছে, বালবিধবা উন্মাদিনীর মতো স্বামীর মুখে আগুন জ্বেলে দিচ্ছে, কেউ চিতায় শান্তিজল ঢালছে, সদ্য-পিতৃহীন পুত্র অশ্রুভেজা চোখে, গঙ্গাপুত্রদের সঙ্গে তাদের প্রাপ্য নিয়ে দু-চার পয়সার জন্য দর কষাকষি করছে, শ্মশানেশ্বরের মন্দিরে স্তব আরাধনার ধ্বনি উঠছে, স্থানে স্থানে এক-এক দল লোক বসে মদ আর গাঁজা খাচ্ছে, উচ্চস্বরে গল্প-হাসি-মশকরা নিয়ে মত্ত হয়ে রয়েছে, এক প্রান্তে এক সন্ন্যাসী আস্তানা গেড়ে বসেছে সামনে একদল ভক্ত জোড়হাতে বসে সমস্ত বিচারবুদ্ধি হারিয়ে তার ধাপ্পাবাজি শুনছে আর একদিকে এক পাহারাওয়ালা নাচারের মতো বসে ঢুলছে আর পানওয়ালির টিপ পরা হাসি-হাসি মুখের কথা ভাবছে। গঙ্গার সামনে একদল ফকড় ছোকরা নানানরকম ইয়ার্কি মারছে, কেউ বা ঘাটের ওপরে বসে চক্ষু মুদে ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়েছে। কেউ বা মোটা গলায় চেঁচিয়ে গান ধরেছে। এদের মাঝেই এক কোণে চেনা তিনজনকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল গণপতি। একটু দূরেই চিতা জ্বলছে। তার আগুনে তিনজনকেই কেমন অদ্ভুত লাল বর্ণের দেখাচ্ছে। ওরা খুব মৃদুস্বরে কী যেন বলছিল। গণপতিকে দেখে তারিণী একটু হেসেই বলল, “যাক ভাই, তুমি এলে অবশেষে। দেরি দেখে ভাবছিলেম বোধহয় আজ আর আসতে পারলে না।” গণপতি স্পষ্ট দেখলে তার গায়ের বাংলা মদের গন্ধে দারোগাবাবুর নাক কুঁচকে গেল। সামান্য জড়ানো গলায় গণপতি উত্তর দিলে, “এসব নিয়ে ভাববেন না দারোগাবাবু। এই কারণসুধা মা কালীর পেসাদ। এই পেসাদে আমার নেশা হয় না। বরং বুদ্ধি টনটন করে”, বলেই আচমকা দারোগাবাবুর কানের কাছে হাত দিয়ে একটা আট আনার কয়েন বার করে নিয়ে এল গণপতি।

“এসব ছেলেমানুষি এখন রাখো”, ধমকে উঠল তারিণী, “শিয়রে শমন, আর তুমি…..”

গণপতি লজ্জিত হল। মদের নেশায় সে একটু বেশিই প্রগলভ হয়ে উঠেছিল।

কথাবার্তা মূলত ইংরাজিতেই হল। গণপতি যেখানে বুঝতে পারছিল না, তারিণী বাংলায় তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল। গোটা আলোচনার মুখ্য বক্তা ছিল তারিণীই।

“শৈল মারা যাবার পর আমি অনেক ভেবেছি। কেন এমন আচমকা তাকে চলে যেতে হল। শৈল ব্রাদারহুডে আমার পরে এসেছিল, কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি ব্রাদারহুডের একেবারে ঘনিষ্ঠ মহলে সে ঠাঁই পায়। অবশ্যই নিজ গুণে। আমি যদি খুব ভুল না করি, তবে ব্রাদারহুডের গোপনতম আর-এক শাখা জাবুলনদের সঙ্গেও তার সম্পর্ক ছিল। ন্যাশনালে তাকে যে চারজন ধর্ষণ করেছিল প্রত্যেকে অপঘাতে মারা যায়। ব্রাদারহুড নিজে এই ধরনের কাজ করে না, জাবুলন করে। আর সেখান থেকেই সমস্যার শুরু। শৈলর প্রতিশোধ নেওয়া শেষ হয়, কিন্তু জাবুলন শৈলকে রেহাই দেয় না। খুব সম্ভব এই ঋণ চোকাতেই শৈল সবার আড়ালে জাবুলনদের হয়ে কাজ করছিল। তবে আমি তাকে যতটা চিনি, অন্যের অধীনে কাজ করার লোক সে নয়। একসময় পর তার শিল্পীমন স্বাধীনতা খুঁজতে চাইবেই। আর যে-কোনো সংগঠন চায় প্রশ্নহীন সমর্পণ। আমি প্রায় নিশ্চিত ছিলাম, শৈলকে জাবুলন হত্যা করেছে। শৈলর লেখা সেই নাটক পড়ে আমি আরও নিশ্চিত হই। কিন্তু এরা কারা কিংবা ঠিক কী করতে চায়, কীভাবে করতে চায় আর কেন করতে চায়, সে বিষয়ে অনেক ভেবেছি, কোনও দিক খুঁজে পাইনি। পেতামও না, যদি না সেদিন ভোররাতে গণপতি এসে আমায় সব খুলে বলত।

“কী বলেছিল গণপতি?” প্রিয়নাথ কৌতূহলী হলেন।

“সেটা গণপতি নিজের মুখেই বলুক।”

একটু ইতস্তত করে গণপতি বললে, “আমি বাংলায় বলছি। তারিণী… সাহেবকে ইংরিজিতে বুঝিয়ে দিয়ো।” প্রথমেই সে হিন্দুমেলায় শেষ দিনের হাতকড়ার অভিজ্ঞতা বললে। এটাও বললে যে সেই সাহেব বলে গেছিলেন উনি নিজেই গণপতিকে খুঁজে নেবেন।

“তারপর খুঁজে নিয়েছিলেন?”

“সেটাই বলছি। সেদিন সবে ম্যাজিকের খেলা শেষ হয়েছে। শেষ দিন। তাই দলের সবাইকে ছুটি দিয়েছি। তারা এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি একা একখানি কেলনারের হুইস্কির বোতল আর বাদামভাজা নিয়ে বসে ভাবছি এমন কেন হল। ঠিক এই সময় সেই সাহেব আমার তাঁবুতে ঢুকলেন। তাঁর চেহারার মধ্যেই এমন একটা ব্যাপার আছে যে দেখলেই বুকের রক্ত শুকিয়ে আসে। সাহেব প্রথমেই জামার হাতা গুটিয়ে আমায় হাতের উল্কি দেখিয়ে বললেন তিনিও ব্রাদারহুডের সদস্য। তবে এখানের না। লন্ডনের। এখানের ব্রাদারহুড নিজেদের মতো কাজ করছে। কাউকে মানছে না। তাই লন্ডনের লজ থেকে তাঁকে এখানে পাঠানো হয়েছে এসব দেখভাল করতে। আমি বললাম, তা বেশ তো, করুন। তখন উনি আসল কথা বললেন। আমাদের ব্রাদারহুডের এক সদস্য আছে, ল্যানসন, অ্যাংলো। কিন্তু নিজের নাম বলে লখন। ওর বোনের এক অবৈধ মেয়ে সন্তান আছে। এই সাহেবের সেই মেয়ের খোঁজ চাই। যে-কোনো মূল্যে। আমি বললাম, আমি কোনও দিন সেই মেয়েকে দেখিনি। সাহেব বলল, বাচ্চা মেয়ে। বছর দশেক বয়স। নীল চোখ। মেমসাহেবের মতো দেখতে। আমি দেখেছি কি না। বললাম, দেখিনি। সাহেব বিশ্বাস করল না। শেষে বলল, তোমার বন্ধু শৈল দেখেছে, আর তুমি দেখোনি! আমি ওসব জানতে চাই না, তুমি সেই মেয়ের খোঁজ এনে দাও, নইলে….” এইটুকু বলে গণপতি একটু চুপ করল।

সাইগারসন সোজা গণপতির দিকে তাকিয়ে। তাঁর কানে নিজের মতো করে তর্জমা করে দিচ্ছে তারিণী। প্রিয়নাথ আবার প্রশ্ন করলেন, “নইলে কী হবে?”

গণপতির গলা তখন কাঁপছে, বলল, নইলে আমার অবস্থা শৈলর মতো হবে। আমি বললাম, আমি মরতে ভয় পাই না। তখন সাহেব যা বলল, তাতে আমি ভয় না পেয়ে পারলাম না”, গণপতি চুপ। প্রিয়নাথ আবার কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, তারিণী ইশারায় তাঁকে চুপ করতে বলল।

খানিক সামলে গণপতি আবার যখন শুরু করল, তার দু-চোখে জল, “আমাদের গ্রামে একটা মেয়ে ছিল। সত্যভামা। ছোটো থেকে তাকে চিনতাম। বামুনের মেয়ে। আমায় দাদা দাদা বলে ডাকত। আমি বাড়ি ছেড়ে বেরোনোর পর অনেকদিন তার কোনও খবর নেই। কিছুদিন আগে দেখলাম রাস্তায় নেমে এসেছে। বালবিধবা। এক নাগর জুটিয়েছিল। সেই নাগর তাকে ভোগ করে। কলকাতায় এসে সোনাগাজিতে বেচে দিয়েছে। ওর যে মাসি, সে ওকে দিনরাত খাটায়, মারে। ওই পাড়ায় আমার কিছু চেনাশোনা আছে। লক্ষ্মীমতি নামের এক বেশ্যা মরার পর সেই বাড়ি খালি পড়েছিল। আমিই ওকে ওই বাড়িতে বসিয়ে স্বাধীন ব্যবসা করতে বলি। মেয়েটা বড্ড ভালো। এখন নাম নিয়েছে জুঁই। সোনাগাজির পুঁটি গত বছর বুকের ব্যামোতে ম’ল। তার অপোগণ্ড মেয়েটাকে ও-ই মানুষ করে। সাহেব কীভাবে যেন জুঁইয়ের খোঁজ পেয়েছে। বলল, আমি মরতে ভয় না পেলেও ওরা পায়। আর আমি কথা না শুনলে ওদের এমনভাবে মারবে, যে, আমি ভাবব এর থেকে আমি মরে গেলে ভালো হত”, শেষটায় গণপতির গলা কান্নায় ধরে আসে।

বড্ড হতাশ লাগে প্রিয়নাথের। সব জেনেও তাঁর হাত পা বাঁধা। ওই পাড়া নিয়ে ইংরেজ পুলিশ বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন। প্রায়ই এমন খুন জখম ঘটে। রুটিন তদন্ত হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পিছনে কোনও বড়োমানুষের হাত থাকে। ব্যস! সব শেষ। ত্রৈলোক্য রাঁড়কে ধরা গেছিল, তার একমাত্র কারণ, সে নিজেও বেশ্যা ছিল।

“ভূতের বাক্স এখন কোথায়?” সাইগারসন সরাসরি গণপতিকে প্ৰশ্ন করেন।

“আমার কাছে ছিল। আমি খুলে দেখেছি। তাতে চার বোতলে চারটে আরক আছে। আর এক বোতলে ভরা সাদা সাদাবড়ি। প্রতিটায় লেবেল লাগানো।”

“কী লেবেল?”

“আরকে চারটে অক্ষর। B, H, U আর T। বড়িটাতে অবশ্য কোনও অক্ষর নেই। ছবি। একটা মড়ার খুলি আর হাড়ের তলায় আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা, হেল ফায়ার। নরকের আগুন। বাইবেলে পাপীদের জন্য চরমতম অভিশাপ। আমি অবশ্যি বাংলায় নাম দিয়েছি অগ্নিনিরয়।”

“ওটা তোমার কাছে কেন?”

“জানি না। লখন আমাকে বলেছে এটা সাবধানে রাখতে। প্রাণের চেয়েও বেশি দামি। ওর উপরে নাকি অনেকের নজর। এটা বেশ কয়েকবার চুরির চেষ্টাও হয়েছে। আমি ভবঘুরে মানুষ, তাই নিজের দখলে রাখিনি। তারিণী লুকিয়ে রেখেছে।”

“কোথায়?” উত্তর তারিণীই দিল, “আমার আপিসে। ডিরেক্টরের কাছে। যেখানে সেই তৈমুরের কাব্যগাথা আছে।”

সাইগারসন বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করলেন, “স্ট্রেঞ্জ! তোমায় এ জিনিস একেবারে দিয়ে দিল!”

“একেবারে দেয়নি। বলেছে এক বছরের জন্য রাখতে। এক বছর পরে ও নিজেই চেয়ে নেবে।”

“কেন, এক বছর পরে কী?” প্রিয়নাথ জানতে চাইলেন।

উত্তর দিলেন সাইগারসন, “রানির সিংহাসনে বসার ডায়মন্ড জুবিলি। গোল্ডেন জুবিলিতে রানি এ দেশে আসেননি। ক্ষমতা নেবার পর একদিনও না। এই নিয়ে খোদ ইংল্যান্ডেই কথা উঠছে। সামনের বছর ২০ জুন রানির এ দেশে আসার কথা।”

“আর ৩রা জুলাই ম্যাসনিক হলের অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন তিনি। প্রথমে ডিনার, তারপর অনুষ্ঠান।”

এবার সাইগারসনের চমকে যাবার পালা, “তুমি এ কথা জানলে কেমন করে?”

“লাটভবনে লখনের নিয়মিত যাতায়াত। ওখানে ওর লোক আছে। সব খবর থাকে ওর কাছে। এই বছর ভাই ৩রা জুলাই আমাকে ম্যাজিক দেখাতে হবে। যে সে ম্যাজিক না। ভূত নামানোর ম্যাজিক। সত্যিকারের ভূত। এবার ভালো হলে সামনের বার এটাই আবার দেখাব। রানির সামনে।”

“সত্যিকারের ভূত? সেটা কীভাবে সম্ভব?”

গণপতি বুঝিয়ে দিতেই উত্তেজনায় হাতে হাত ঘষতে লাগলেন সাহেব।

“বেশ। এবার তোমাদের যা বলব ঠিক তাই করবে। একটুও ভুলচুক হলে মহা বিপদ। এতে সাপ মরবে, লাঠিও ভাঙবে না।” বলে সাইগারসন একে একে বলে যেতে লাগলেন আগামী সাত দিন, কে, কবে, ঠিক কী করবে। বারবার করে বললেন। সব চলবে একেবারে ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে।

“এবার আমার একটাই প্রশ্ন সাইগারসন সাহেবকে”, সাইগারসন থামতে না থামতে তারিণী বলে উঠল, “এক বেশ্যার মেয়ের জন্য এই সাহেবের এত চিন্তা কীসের? কেন তাকে খুঁজতে গিয়ে শৈলকে প্রাণ দিতে হল? কেন আপনি আচমকা লন্ডন থেকে আবার এই দেশে এলেন? ধাঁধার এই অংশটা না মিললে বাকিটা কিছুতেই মেলানো যাচ্ছে না।”

“প্রথম যেদিন আমি তোমাদের চুঁচুড়ায় ডেকেছিলাম, সেদিন অনেকটা বলেছি। পুরোটা বলিনি। বলেছিলাম আমি এসেছি এখানকার জাবুলনদের কার্যকলাপ দেখার জন্য। এ কথা সত্য, যেটা বলিনি, সেটা হল হিলি দ্বিতীয়বার এই দেশে এক সম্পদ পালিয়ে আসার সময় সেই ভূতের বাক্সর সঙ্গে আরও মহামূল্যবান এ দেশে নিয়ে চলে আসে। আমি এসেছিলাম দ্বিতীয়টার সন্ধানে।

“সেটা কী?” প্রিয়নাথের উত্তেজনা বাঁধ মানে না।

“কী না, কে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী। অ্যালিস।”

তিনজনেই এত অবাক হয়ে যায় যে কারও মুখে কথা জোগায় না।

.

“আমাদের রানি ভিক্টোরিয়া মহানুভব, কিন্তু সময়ে সময়ে নিষ্ঠুর। নিজের ইচ্ছের বাইরে যে-কোনো কিছু হলেই কড়া হাতে তাকে দমন করতে দুবার ভাবেন না তিনি। সেই দমনপন্থা যতই কঠিন হোক না কেন। আর সেইজন্যেই তাঁর বিরোধীরা বেছে নিয়েছে কলকাতাকে। দ্বিতীয় লন্ডন। যেখানে রানির শাসন খাতায় কলমে চললেও আসলে চলে বড়োলাটের কথা। বড়োলাট পক্ষে থাকলে অনেক কাজ রানি জানতেও পারেন না। শুধু জানতে পারে আমাদের গুপ্তচর বিভাগ। প্রথমবার আমি এসেছিলাম হিলি আর সেই ভূতের খোঁজে। আর এইবার অ্যালিসের জন্য।”

“অ্যালিস কে?” তারিণী শুধায়।

“রানির নাতি, প্রিন্স এডি বড়ো অদ্ভুত ছেলে। ছোটো থেকেই। তাঁর আচরণে তাঁর বাবা প্রিন্স এডওয়ার্ড থেকে ঠাকুমা ভিক্টোরিয়া, সবাই বিরক্ত। তিনি নিজের মর্জির মালিক। সমাজের নিচুতলার মানুষরা তাঁর বন্ধু। এদেরই একজন চিত্রকর ওয়াল্টার সিকার্ট। ১৮৮৪ সালের গ্রীষ্মে এই সিকার্ট এডির সঙ্গে তাঁর মডেল অ্যানি এলিজাবেথ ক্রুকের পরিচয় করান। মেয়েটি এমনিতে খারাপ না, কিন্তু বস্তিবাসী এবং অশিক্ষিত। পরিচয় প্রেমে গড়ায়। সিকার্ট বাদে এই প্রেমের কথা কেউ জানত না। অ্যানিকেও শুরুতে এডির পরিচয় জানানো হয়নি। মুশকিল হল, সিকার্টকেও না জানিয়ে এক বছরের মাথায় তাঁরা গোপনে বিয়ে করেন। এবং বিয়ের ফল হিসেবে তাঁদের এক মেয়ে জন্মায়। সমস্যার শুরু তখনই। খবর রানির কাছে পৌঁছে যায়, তিনি কিছুতেই নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে এই মেয়েকে মেনে নেবেন না। এই মেয়ের খোঁজ চলে। অ্যানিকে পাগল সাজিয়ে বেডলামে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তবু আসল লোক, মানে অ্যালিসের খোঁজ পাওয়া যায় না।

অ্যানি জানত এমন বিপদ আসবে। তাই নিজের একেবারে কাছের পাঁচ বন্ধুকে অ্যালিসের খবর জানিয়ে যায়। সে খবরও রানির কাছে পৌঁছায়। তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক উইলিয়াম গলের নেতৃত্বে হোয়াইট চ্যাপেলের এই পাঁচ মহিলাকেই অত্যাচার করে খুন করা হয়। কিন্তু দেখুন বন্ধুত্বের কত বড়ো শক্তি, শত অত্যাচারেও এরা মুখ খোলেনি। রানি জানতেন এই অপরাধ চাপা থাকবে না। ফলে এক কাল্পনিক চরিত্রের সৃষ্টি করা হল। নাম দেওয়া হল “জ্যাক দ্য রিপার’। এই মহিলাদের কেউ দেহোপজীবিনী ছিলেন না। তাঁদের চরিত্রস্খলন করা হল। অ্যালিস তখনও অধরা।

“তবে আপনি কীভাবে অ্যালিসের খোঁজ পেলেন?”

“সম্পূর্ণ কাকতালীয়ভাবে। ব্রিটিশ গুপ্তচর বিভাগ রানির আদেশে চলে না। তাদের কাছে খবর ছিল, বেডলামে গোপনে কিছু কাজকর্ম চলছে। সেখান থেকেই আমরা এলি হেনকি জুনিয়ার আর রিচার্ড হ্যালিডের সন্ধান পাই। এরা ব্রিটিশ ম্যাসনিক লজের সদস্য এবং রানির সমর্থক। রানির প্রজাদের বশে রাখার জন্য নানারকম কাজকর্ম করত এরা। কিন্তু যতদূর জানি, রানির পরিষ্কার নির্দেশ ছিল, খবর বাইরে বেরোলে রানি নিজে এই সংযোগ অস্বীকার করবেন। গোটা ব্যবস্থাটা দেখাশোনা করতেন ডাক্তার গল। সেই ল্যাবরেটরিতেই কাজ করত এই হিলি। কিন্তু হিলি একেবারে বস্তি থেকে উঠে আসা, এবং এর সঙ্গে অ্যানি আর তার বান্ধবীদের যোগাযোগ ছিল। হিলিকে প্রথম থেকেই আমরা নজরে রেখেছিলাম। হিলি দ্বিতীয়বার এ দেশে পালিয়ে আসার সময় অ্যালিসকে গোপনে ভাগিয়ে আনে। আমরা যেহেতু হিলিকেই অনুসরণ করছিলাম, তাই রানির আগে আমাদের কাছে খবর আসে।”

“কিন্তু আপনারা রানিকেজানাননি?”

“না। আমার দাদা মাইক্রফটের কড়া নির্দেশ ছিল। ওয়েট অ্যান ওয়াচ। কারণ রানি যা করেন সবকিছুই যে সঠিক, তা তো নয়। হিলিকে গুম করে গুপ্তচর বিভাগ অন্য লোককে আদালতে হাজির করে, যাতে রানির লোক তার নাগাল না পায়। এদিকে ব্রাদারহুডে রানির পক্ষের লোকেরাও চুপ করে বসে নেই। তারাও অ্যালিসের খোঁজে এই দেশে একজনকে পাঠিয়েছে। এই লোকের আসল নাম কী, কেউ জানে না। কেউ বলে ম্যানুয়েল ডিব্যাসি, আবার কেউ বলে হিউড রাডি। এই লোকের উদ্দেশ্য ভালো নয়। তাই আবার আমাকে এই দেশে আসতে হয়। যদি অ্যালিস সত্যিই রানির উত্তরাধিকারী হয়, তবে তাকে বাঁচানো আমাদের কর্তব্য।”

“সাহেব, একটা কথা বলি?” তারিণী মৃদুস্বরে বলল। “আপনি আগে যা বলেছিলেন, আর আজ যা বলছেন, সব শুনে কেমন যেন বোকা বোকা লাগছে। আপনি কি মহারানির পক্ষে না বিপক্ষে?”

“আমি ইংল্যান্ডের পক্ষে”, হেসে বললেন সাইগারসন।

.

৪।

২৭ জুন, ১৮৯৬, শনিবার

তারিণীর আপিসে বসে রীতিমতো কাঁপছিল গণপতি। এমন বিপদে সে আগে কোনও দিন পড়েনি।

“আমার তো জলে কুমির ডাঙায় বাঘ দশা হে। সেই মেয়ে, যাকে কোনও দিন চোখেই দেখিনি, তাকে না চিনিয়ে দিলে সাহেব আমার সব্বনাশ করবেন, আবার দেখাতে গেলে, আর লখন টের পেলে কী হবে বুঝতে পারছ?”

“এত ভেবো না”, তারিণী তাকে ভরসা দেয়। “সাইগারসন সাহেব যা বললেন, তা নেহাত মন্দ বলেননি। সেইমতো চললে উনি বলেছেন কিছু হলে দায়িত্ব। আর চেনার কথা বলছ, এই দ্যাকো”, বলে একটা ছাপা কাগজ বার করে আনে তারিণী। “যদি খুব ভুল না হয়, তবে সেই মেয়ে কতকটা এই বাচ্চাটার মতো দেখতে। আর সেদিন সাহেব মেমসাহেবের বাচ্চারা অনেকে থাকবে। তাদের দলে এই মেয়ে মিশে থাকতে পারে। তুমি একটু খেয়াল রাখবে লখন কোনও বিশেষ বাচ্চার দিকে নজর রাখছে কি না।”

“ছবির একজন তো রানিমা, পাশে এই বুড়িটা কে?”

“সেসব তোমায় পরে বোঝানো যাবে। এ ছবি এখন তোমার কাছেই রাখো। তবে খবরদার! কারও হাতে না পড়ে। আর এই মেয়েকে কীভাবে চেনাবে তা নিয়ে কিছু ভাবলে?”

“বোধহয় ভেবেছি। কিন্তু তুমি বাইরে তাকিয়ে দেখেছ?”

“অনেক আগেই। রাস্তার উলটো দিকে দাঁড়িয়ে লোক দুটোর খবরের কাগজ পড়া আর শেষ হচ্ছে না। নজর রাখছে। ভালো, ভালো। এবার ওদেরকেই কাজে লাগাতে হবে।”

“কেমন করে?”

“বলছি শোনো….”

.

২৮ জুন, ১৮৯৬, রবিবার

ম্যাসনিক লজে আজ অনুষ্ঠানের আগের শেষ রবিবার। প্রায় সবাই এসেছে। লজের গ্র্যান্ডমাস্টার সকালের মাসের প্রার্থনার পরে সবাইকে নিজের নিজের কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। এক কোণে বসে গণপতি লখনকে খুঁজছিল। প্রথমে দেখতে পায়নি। তারপর পেল। সভার একেবারে পিছনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। একা। ভিড় ঠেলে লখনের পাশে দাঁড়িয়ে সোজা গ্র্যান্ডমাস্টারের দিকে তাকিয়ে লখনকে বলল, “সামনে বিপদ। সাবধান।” লখন চমকে দেখল গণপতি একমনে মাস্টারের কথা শুনছে। ঠোঁট নড়ছে না। ভেন্ট্রিলোকুইজম। লখন এটা জানে। সেও একইভাবে উত্তর দিল, “কী হয়েছে

গণপতি ঠিক সেটাই বলল, যেটা সেদিন রাতে সাইগারসন তাকে বলতে বলেছিল। একটা শব্দ বেশি না, একটা শব্দ কম না।

কাজ হল। লখনের ঠোঁটের কোণে মৃদু একটা হাসি ফুটে উঠল।

“তবে তাই হোক। সাহেব আসবে, কিন্তু ফিরবে না।”

“খুন!”

“এত সোজা না ব্যাপারটা”, লখনের চোখ সামনের দিকে, ঠোঁট চেপে বন্ধ। গ্র্যান্ডমাস্টারের কী একটা কথায় সবাই হাততালি দিতে সেও তালি দিয়ে উঠল।

“এই সাহেব লজের সদস্য। তাও লন্ডনের। শুধু সন্দেহের বশে একে কিছু করলে এখানের লজও আমায় ছেড়ে কথা বলবে না। তাই আগেভাগে কিছু করা যাবে না। সাহেবকে দিয়ে প্রথম আঘাত হানাতে হবে। আমরা তারপর আত্মরক্ষা করব। আমার শুধু একটা জিনিস লাগবে”, বলে গণপতির দিকে তাকিয়ে গণপতির হাতে কাপড়ে প্যাঁচানো কাঠের বাক্সটা দেখে একটা অবাক হাসি ফুটে উঠল লখনের মুখে।

গ্র্যান্ডমাস্টার তাঁর বক্তৃতা শেষ করার আগেই সবার অজান্তে ‘অগ্নিনিরয়’ আবার ফিরে গেল লখনের কাছে।

.

২৯ জুন, ১৮৯৬, সোমবার

মেডিক্যাল কলেজের সামনে অ্যাম্বুলেন্সটা থামতেই চারজন সাদা পোশাক পরা কর্মী এসে ভিতর থেকে এক সাহেবকে টেনে বার করল। গতকাল রাত থেকে সাহেবের পেটে অসহ্য যন্ত্রণা আর ভেদবমি। যন্ত্রণায় পেট চেপে ধরে দেহ কুঁকড়ে যাচ্ছে, মুখের একদিক বেঁকে লাল ঝরছে, গোটা দেহ সদ্য কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করছে। ছটফটানির চোটে সাহেবকে আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। কোনওক্রমে দোতলায় এক কেবিনে সাহেবকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হল। সাহেব চিকিৎসক ডাক্তার টেলর রোগীকে দেখেই ভয় পেয়ে গেলেন। রোগীর চোখ কোটরাগত, ঠোঁটের দুই কোণে কালচে ফেনা জমে গেছে, চোখ ঘোলাটে, বিকারের চোটে হাতের রোগা রোগা আঙুলগুলো থরথর করে কাঁপছে। থেকে থেকে গলা দিয়ে কোঁ কোঁ আওয়াজের কাতরানি ঠিকরে আসছে। ডাক্তার একটু এগিয়ে যেতেই রোগী চিলচিৎকার করে উঠল। ডাক্তার টেলর রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলেন।

“বেরিয়ে যাও। বেরিয়ে যাও, বেজন্মার বাচ্চারা। আমাকে খুন করার জন্য এখানে নিয়ে এসেছ?”

ডাক্তার বুঝলেন এ রোগীর মাথা কাজ করছে না। তবুও তিনি বললেন, “আপনি ভুল বুঝছেন, আসলে…”

“দূরে থাকো। আমার থেকে যতটা পারো দূরে থাকো। তোমার এই নোংরা হাত আমার গায়ে লাগাবে না বলছি। জানো আমি কে? তুমি সেদিনের জুনিয়ার ডাক্তার, আমায় দেখতে এসেছ কোন সাহসে? মেডিক্যাল সায়েন্সের তুমি কী জানো?”

ডাক্তার টেলর এবার বেশ অপমানিত বোধ করলেন। তাও মাথা ঠান্ডা রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কি তবে এখানে চিকিৎসা করাবেন না?”

“করাব না বলেছি?” আবার কাতরে উঠে বললেন সাহেব। “তবে তোমার কাছে না। তোমাদের ওই ইন্ডিয়ান ডাক্তার গোপাল দত্তকে ডাকো। এই প্রাচ্যদেশের রোগ সম্পর্কে তুমি কী জানো হে?”

“কিন্তু উনি তো অনেক সিনিয়ার…”

“তবে ঠিক আছে হে ছোকরা। তুমি আমার হাত জানো না। আমায় একটু ধাতস্থ হতে দাও। তোমার মেডিক্যাল লাইসেন্স যাতে চিরকালের মতো বাজেয়াপ্ত হয় সে ব্যবস্থা করছি।”

কেনেথ টেলর একেবারেই সদ্য যুবক। এবার সে ভয় পেল। কিন্তু ডাক্তার দত্ত কি আসবেন এই সামান্য কাজে? উনি তো রোগী দেখা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। বেশিরভাগসময়ই গবেষণা করেন।

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে গোপাল দত্তকে এসে সবটা জানাল টেলর। ইদানীং খুব বেশি রোগী দেখেন না ঠিকই, কিন্তু এই ঘটনা শুনে আগ্রহী হয়ে নিজেই কেবিনের দিকে গেলেন। কেবিনের বাইরে থেকেই কাতরানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঢুকে দেখলেন দুজন কেবিনবয় কী করবে বুঝতে না পেরে স্তম্ভিতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। রোগী খাটে বালিশে মুখ গুঁজে গোঙাচ্ছে। গোপালচন্দ্র ঘরে ঢোকা মাত্র রোগী চিৎকার করে বলল, “ডাক্তার, ডাক্তার, প্লিজ আপনি সবাইকে ঘর থেকে চলে যেতে বলুন। শুধু আপনি থাকুন। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”

গোপাল ইশারায় দুজনকে বাইরে যেতে বললেন। তারা বাইরে গিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিতেই রোগী তড়াক করে বিছানায় উঠে বসল। সারা দেহে রোগের কোনও চিহ্ন নেই। রোগীকে দেখে চমকে উঠলেন গোপাল দত্ত। “আপনি? কিন্তু এভাবে?”

“পিছনে লোক লেগেছে। তাই এ ছাড়া উপায় ছিল না। সামনে ঘোর বিপদ।”

“কী হয়েছে?”

“সব বলব। কিন্তু আগে আপনাকে কয়েকটা কথা বলতে হবে। বহু মানুষের প্রাণের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে এতে।”

“বলুন।”

পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে দেশলাই দিয়ে ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে প্রশ্ন করলেন সাহেব, “মাঝে বেশ কিছুদিন আপনি প্রেসিডেন্সি জেনারেল হাসপাতালে ক্যানিংহ্যাম ল্যাবরেটরিতে কাজ করেছিলেন। সত্যি করে বলুন দেখি, আপনাকে ঠিক কী করতে হয়েছিল?”

গোপালচন্দ্র এতটাই অবাক হয়ে গেলেন যে, হাসপাতালের কেবিনে সিগারেট ধরানো উচিত না, সেটাও সাইগারসনকে বলতে তাঁর মনে ছিল না।

.

৩০ জুন, ১৮৯৬, মঙ্গলবার

বর্ষাকাল। কিন্তু এই বৎসর বৃষ্টি বিশেষ হইতেছে না। এইরকম চলিলে আগামী বৎসর খরা অনিবার্য। অন্যদিকে শুনিতেছি বোম্বাই প্রদেশে প্লেগের উপদ্রব বাড়িতেছে। মহারাণীর ডায়মন্ড জুবিলীর পূর্বে এই সমস্ত লক্ষণ বিশেষ শুভ নয়। পত্রিকায় এই জুবিলী লইয়া ব্যঙ্গ করিয়া লিখিয়াছে, “মহারাণীর জুবিলী উৎসব ভারতীয় জনগণের প্রদেয় খাজনায় বিলাস ব্যতীত আর কিছু নহে। উহাদের নিকট জুবিলী হইলেও আপামর ভারতবাসীর নিকট এই অনুষ্ঠান জুজুবিলির ন্যায় প্রতিভাত হইতেছে। আমরা সকলে সেই জুজুর ভয়ে ভীত হইয়া আছি।” কিন্তু কাল রাত হইতে বৃষ্টি নামিয়াছে। অরুণদেব আপন কিরণজাল বিকীর্ণ না করিতে পারিয়া নিতান্ত বিষন্ন হইয়া রহিয়াছেন। পন্যদেব টিপি টিপি বৃষ্টির সহিত উপস্থিত হইয়া রহিয়া রহিয়া মহা গর্জন করিতেছেন। সেই ভীষণ গর্জনে আজ লালবাজারে মনুষ্য আনাগোনা নিতান্ত কম। দেখিলাম এই সুযোগ। ধীরে ধীরে সিঁড়ি অতিক্রম করিয়া টমসন সাহেবের কামরার সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। এক অদ্ভুত ত্রাসে আমার বুক কাঁপিতেছে। আদালী জানাইল কামরায় সাহেব ব্যতীত কেহ নাই। কামরায় প্রবেশের অনুমতি মিলিল। সাহেব একলা বসিয়া ধূম্রপান করিতে করিতে একখানি ফাইল উলটাইতেছিলেন। মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। মাথা না উঠাইয়াই আমায় বলিলেন, “বল কেন আসিয়াছ?”

“সাহেব, আমাকে কিছুদিন পূর্বে যে দায়িত্ব দিয়াছিলেন তাহা সম্পন্ন করিয়াছি। চটকলে সেই শ্রমিকের মামলার সমাধান হইয়াছে।”

সাহেব ফাইল হইতে মুখ তুলিয়া বিস্মিত দৃষ্টিতে আমার পানে চাহিলেন।

“বল কী! আসন গ্রহণ কর। আমি সম্পূর্ণটা শুনিতে ইচ্ছুক।”

আমি আসন গ্রহণ করিয়া ধীরে ধীরে সাইগারসন সাহেব যেমন শিখাইয়াছিলেন, তেমনটাই বলিলাম।

.

১ জুলাই, ১৮৯৬, বুধবার

সোনাগাজিতে জুঁইয়ের ঘরে ঢোকার আগেই ঘরের ভিতর গণপতি সেই সাহেবকে দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে যেতে চাইছিল। পারল না। আচমকা যমদূতের মতো দুটো মুশকো জোয়ান এসে গণপতিকে প্রায় চ্যাংদোলা করে ঘরে ঢোকাল। জুঁই খাটের এককোণে বসে থরথর করে কাঁপছে। গণপতিকে এই অবস্থায় দেখবে, সে কোনও দিন ভাবেনি। বাধা দিতে গিয়ে গণপতির ধুতি বিস্রস্ত। ফতুয়ার একদিক ছিঁড়ে গেছে। যণ্ডা দুইজন গণপতিকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিলে। তখনও গণপতি কাঁপছে।

“কী ব্যাপার? জুঁইকে সাবধান করতে এসেছিলে?”

গণপতি কোনও উত্তর দিল না।

“আর আমি যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম, সেটার কী হবে?”

মাটির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে গণপতি বলল, “আমি রাজি।”

“কবে?”

“পরশু। অনুষ্ঠানের দিন।”

“কীভাবে?”

গণপত্তি বলে চলল। সাইগারসন সেদিন বারবার বলে দিয়েছেন। এই জায়গায় কোনওরকম ভুলচুক হওয়া যাবে না। একটা শব্দ বাড়তি বলা যাবে না। প্রায় তোতাপাখির মতো শেখানো বুলি আউড়ে গেল গণপতি।

“ঠিক আছে। এবার তুমি যাও”, বলতে সে বেরোতে যাচ্ছে, এমন সময় “জুই আছিস নাকি?” বলে ঘরে ঢুকতে গিয়েই থেমে গেল একটা মেয়ে। পরমা সুন্দরী। গণপতি একে দেখেছে। সেই মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের ঘরে, লখনের সঙ্গে। ঘরে লোকজন দেখে “আমি পরে আসছি” বলে চলে গেল মেয়েটা। গণপতি দেখল সাহেব তাকে ছেড়ে ঠায় মেয়েটার দিকে দেখছেন। মেয়েটার চলে যাওয়া দেখছেন।

.

সেইদিন মাঝরাতে ম্যাসনিক লজে প্রায় কুড়ি ফুট চওড়া, দশ ফুট উঁচু একটা কাচ নামানো হল। প্রায় জনা দশেক লোক লাগল সেটাকে হলে ঢোকাতে।

হীরালাল তার কোডাকের মুভি ক্যামেরাটা খুলে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখল। মাঝে আর একটা দিন। তারপর এটা কাজে লাগবে। গণপতি বলেছে।

.

২ জুলাই, ১৮৯৬, বৃহস্পতিবার

সেম্বাদ ভাস্কর

মোকাম কলিকাতায় এই বৎসর মহাধুমধামের সহিত সকল গীর্জায় যীশু ভক্তি উৎসব পালিত হইবেক। প্রধান ধর্মাধ্যক্ষ শ্ৰীযুত লার্ড বিশপ ও অন্যান্য পাদরি সাহেবেরা একত্র হইয়া গত বৎসর এই সিদ্ধান্ত লইয়া এক প্রস্তর তাহাতে পিত্তলের পত্র তাহাতে সন তারিখ সুড়কী দ্বারা গ্রথিত করিয়াছেন। পাঠকদের জানাই এই দিবস ভারতীয় ক্রিস্তানগণের নিকট এক অতি পবিত্র ক্ষণ। তাঁহাদের অন্যতম অবতার প্রেরিত থোমা, যিনি দিদিমুস নামেও পরিচিত, ছিলেন নূতন নিয়ম অনুযায়ী যীশুর একজন প্রেরিত। থোমাকে সাধারণভাবে অভিশঙ্কী থোমা হিসেবে অভিহিত করা হয় কেননা তিনি যীশুর পুনরুত্থান সম্বন্ধে সন্দেহ পোষা করিয়াছিলেন; পরবর্তীতে যীশুর ক্রুশারোপণজনিত জখম দেখিয়া তিনি আমার প্রভু ও আমার ঈশ্বর কহিয়া তাঁহার বিশ্বাসের স্বীকারোক্তি জানান। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ক্রিস্টধর্ম প্রচারে রোমান সাম্রাজ্যের বাহিরে আসিয়া এই ধর্ম প্রচারে আগ্রহী হন। ৫২ খৃস্টাব্দে তিনি কেরল প্রদেশে আগমন করেন এবং বিশ বৎসর ধর্মপ্রচারের পর অধুনা মাদ্রাজের নিকটবর্তী মাইলাপুর নামক স্থানে তাঁহাকে হত্যা করা হয়। তাঁহার হত্যার দিন স্মরণ করিতেই ভারতীয় ক্রিস্টানরা এই দিবস পালন করিয়া থাকেন। পূর্বে কলিকাতায় এই উৎসব বড় সামান্য উৎযাপিত হইত। ইদানীং শ্রীযুত লার্ড বিশপ সাহেব এবং কলিকাতার ফ্রিম্যাসনরা একত্রে এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এই প্রসঙ্গে জানাই, আগামীকল্য প্রভাতফেরী, উপাসনা ইত্যাদি সমাপ্ত হইলে কলিকাতার ফ্রিম্যাসন হলে এক মহতী অনুষ্ঠানে গীত বাদ্য সহ জাদুবিদ্যা প্রদর্শিত হইবে। আগামী বৎসরের জুজুবিলির ভালই তৈয়ারি চলিতেছে একরকম বলা চলে।

.

৫।

৩ জুলাই, ১৮১৬, শুক্রবার

আজ সকাল থেকেই কলকাতার গ্র্যান্ড ম্যাসনিক লজে সাজ সাজ রব। গোটা হল সাজানো হয়েছে সাদা আর নীল ফুল দিয়ে। ফরগেট-মি-নট ফুল হল ম্যাসনদের প্রতীকী ফুল। সেই ফুলের গুচ্ছে গোটা হল যেন আলো হয়ে আছে। সকালে সূর্যের আলো ফুটতে না ফুটতে ম্যাসন হল থেকে বিরাট শোভাযাত্রা বার হল সেন্ট জন’স চার্চের উদ্দেশে। সঙ্গে তাঁদের আর্টিলারি ব্যান্ড, ম্যাসনিক চিহ্নখচিত লম্বা লম্বা পতাকা, ব্যানার আর ম্যাসনিক টাই পরে ব্রাদাররা প্রায় সবাই সেই শোভাযাত্রায় অংশ নিলেন। সবার সামনে গ্র্যান্ডমাস্টার হ্যালিফ্যাক্স নিজে। তাঁর হাতে ম্যাসনিক রুলার আর কম্পাস। শোভাযাত্রা গির্জায় পৌঁছাতেই লর্ড বিশপ নিজে গ্রান্ডমাস্টারকে অভিবাদন জানিয়ে ভিতরে নিয়ে এলেন। তারপর একত্রে মাস অনুষ্ঠিত হল। লর্ড বিশপ তাঁর ধর্মানুশাসনে জানালেন, “আগে চার্চ ও ব্রাদারহুডের আদর্শের বিরোধ ছিল। কিন্তু ইদানীং তা মিটেছে। এভাবেই চার্চ এবং ব্রাদারহুড একত্রে মিলেমিশে এই দেশের সাধারণ জনগণের উন্নতিসাধনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। চার্চ চায় আরও বেশি মানুষ প্রভু যীশুর করুণাছায়াতলে আশ্রয় পাক, আর তাই শুধু চার্চ না, ব্রাদারহুডেরও বর্ধিত দায়িত্ব এই ধর্মাচরণে চার্চকে সাহায্য করা।” উত্তরে গ্র্যান্ডমাস্টার হ্যালিফ্যাক্স বললেন, শুরু থেকেই তাঁরা চার্চের পক্ষে, চার্চের সঙ্গে কাজ করছেন। কিন্তু যেহেতু তাঁরা ধর্মীয় সংগঠন না, তাই সরাসরি কোনও ব্রাদারকে ধর্ম পরিবর্তনের কথা ব্রাদারহুড বলতে পারে না। তবে আলোচনার শেষে তিনি এও জানালেন, তাঁর বয়েস হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি দেশে ফিরে যাচ্ছেন। নতুন গ্র্যান্ডমাস্টার হবেন দলের অপেক্ষাকৃত তরুণ সদস্য ডাক্তার জোসেফ গ্রান্ট। সামনের বছর রানি এই দেশে আসবেন জুবিলি উপলক্ষ্যে। সেই মহতী অনুষ্ঠান পরিচালনায় যে তরুণ পরিচালকের প্রয়োজন, একমাত্র ডাক্তার গ্রান্টই পারবেন সেই দায়িত্ব নিতে।

এই ঘোষণায় মৃদু গুঞ্জন শুরু হল দর্শকদের মধ্যে। হ্যালিফ্যাক্স দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, এমন খবর কারও কাছে ছিল না। মৃদুভাষী, সদাহাস্যময় এই মানুষটি অনেকের প্রিয়পাত্র ছিলেন। সবাই ভেবেছিল, আগের গ্র্যান্ডমাস্টারদের মতো ইনিও এই দেশেই থেকে যাবেন চিরকালের মতো। ডাক্তার গ্রান্ট নবীন, চটপটে, অভিজাত পরিবারের সন্তান। এককালে লন্ডন লজের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। শোনা যায় রাজপরিবারের সঙ্গে তাঁর নাকি বিশেষ যোগাযোগ আছে। সেটা ঠিক কীরকম তা অবশ্য কেউ জানে না। গ্রান্ট নিজেও খোলসা করে বলেন। না। পাঁচ বছর হল এ দেশে এসেছেন গ্রান্ট, কিন্তু ব্রাদারহুডের সবাই তাঁকে পছন্দ করে। প্রতিটি ব্রাদারের নাম জানেন, তাদের পারিবারিক সমস্যায় সবার আগে পাশে দাঁড়ান, তাই গ্রান্টের নির্বাচনে অগুলি হল না কেউ। সবাই “আমেন, আমেন” বলে লজের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাল। গোটা দল দ্বিপ্রহরের কিছু আগে লজে ফিরে এল। আজ লজে ভোজের ব্যবস্থা আছে। লখন সকালে শোভাযাত্রায় যায়নি। লজের কাজকর্মের দেখাশোনার ভার তার উপরে। আজকের বিরাট ভোজসভায় খাবারের মধ্যে প্রধান জিনিস ‘বোরস্ হেড’ বা শুয়োরের মাথা। রোজমেরি, তেজপাতা, আপেল আর অন্যান্য নানা উপকরণ দিয়ে সাজিয়েগুছিয়ে টেবিলে পরিবেশন করা। নানারকম খাদ্য, পানীয় ধরে ধরে রাখা একদিকে। আছে টার্কি, ডাক রোস্ট, গ্রাম, পুডিং, যত রাজ্যের জিনিস দিয়ে তৈরি বিরাট বড়ো পাই, ট্যাকারিন, খেজুর, বাদাম, কিশমিশ, চকোলেট, আরও কত কী!!

ভোজ শেষ হতেই কেউ কেউ লজের রেস্টরুমে চলে গেলেন একটু জিরিয়ে নিতে, আর যাঁদের কাছেই বাড়ি তাঁরা সেই পথে পা বাড়ালেন। সন্ধেবেলা গান, জাদু ইত্যাদি হবে। আগেভাগে এসে আসন দখল না করলে ভালো জায়গা পাওয়া যাবে না। ম্যাসনিক হলটা খুব বেশি বড়ো না। ফলে লোকের ভিড় বাড়লে বসার সমস্যা হতেই পারে।

.

ভোজ শেষ হতে না হতে লখনের ডাক পড়ল। লজের এক ঘরে মাস্টার ম্যাসন এসে অপেক্ষা করছেন। তাঁর আসল পরিচয় লখন বাদে খুব কম ব্রাদারই জানেন। ঘরে ঢুকতে মাস্টার ম্যাসন প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন আজকের ব্যবস্থা কেমন চলছে। লখন পুঙ্খানুপুঙ্খ জানাল তাঁকে। দেখে মনে হল তিনি খুশি হয়েছেন।

“এবারের অনুষ্ঠান সেমিফাইনাল। ঠিকভাবে করতে হবে। যাতে আসল দিনে ভুলচুক না হয়।”

“হবে না মাস্টার।”

“হলের গ্র্যান্ডমাস্টার বদলে যাবেন কাল থেকে। খবর পেয়েছ?”

“হ্যাঁ, মাস্টার।”

“তাতে অবশ্য তোমার বিশেষ কিছু আসে যাবে না। তুমি এখন যেমন কাজ করছ, সেভাবেই করে যাবে।”

“হ্যাঁ মাস্টার।”

“আর সেই জাদুকর? সে কেমন কাজ করছে?”

“তার উপরে আমার ভরসা আছে মাস্টার।”

“ঠিক আছে, যাও।” বলার পরেও লখন যখন নড়ল না, মাস্টার ম্যাসন একটু বিরক্ত হলেন যেন।

“কিছু বলবে? যা বলার তাড়াতাড়ি বলো। আমাকে অন্য কাজে যেতে হবে।”

“একটা সমস্যা হয়েছে মাস্টার”, বলে লখন গণপতির থেকে যা যা শুনেছিল সব খুলে বলল। মাস্টার ম্যাসনের মুখে একটা কালো ছায়া পড়ল যেন।

“তোমাকে ধাওয়া করে এসেছে কেন?”

“জানি না। খুব সম্ভব শৈলকে এই লোকই মেরেছে। শৈল হয়তো মারা যাবারআগে আমার নাম বলেছে।”

“এই যে গণপতির কথা বলছ, এ বিশ্বাসযোগ্য?”

“আগেই বললাম মাস্টার। আমি ওকে চিনি। ও মিথ্যে বলবে না।”

“তুমি কী ভেবেছ এই নিয়ে?” লখন নিজের পরিকল্পনা খুলে বলল। মাস্টার শুনছিলেন আর মাথা নাড়ছিলেন, “না, না… এ তো নিজেকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া। তোমার কিছু হলে মহা মুশকিল। আমাদের সব পরিকল্পনা আবার অন্যরকম ভাবে ভাবতে হবে।”

“অতর্কিত আক্রমণ হলে বিপদের সম্ভাবনা থাকত মাস্টার, কিন্তু আমি যখন নিশ্চিত আক্রমণ আসবেই, আমিও তৈরি থাকব। আত্মরক্ষার উপায় আমার জানা আছে।”

“আসলে আমি আজকের অনুষ্ঠানে কোনও ঝামেলা চাইছিলাম না।”

“কিন্তু মাস্টার, এই লোক প্রেতের মতো। একে এমনিতে ধরা প্রায় অসম্ভব। কখন কোথায় থাকে, কেউ জানে না। অতি কষ্টে ফাঁদ পেতে একে ধরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আপনি অমত করবেন না।”

“ঠিক আছে। যা ভালো বোঝো করো। কিন্তু আমার নাম যেন কোনওভাবে কোথাও না উঠে আসে। যদি আসে….”

“আমাকে তার প্রতিফল ভোগ করতে হবে। জানি মাস্টার।”

“তুমি যাও এখন।”

লখন মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল।

.

দুইদিন ধরে প্রাণান্ত পরিশ্রমের পরে কাচটা গণপতির ঠিক মনমতো লাগানো গেছে। একটা অস্থায়ী মঞ্চ বানাতে হয়েছে। চড়া বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করতে হয়েছে। সব মাপে মাপে। একটুও এদিক ওদিক হলে গোটা ম্যাজিক মাঠে মারা যাবে। এত কঠিন, এত গুটিল জানু আজ অবধি মঞ্চে দেখায়নি গণপতি। তাই বারবার নিশ্চিত হয়ে নিচ্ছিল। বেলা গড়িয়ে গেছে। সকাল থেকে পেটে দানাপানি পড়েনি। বুকের ভিতরে টিপ টিপ আওয়াজ যেন বাইরে থেকেই শোনা যাচ্ছে। প্রতিটা শো-এর শেষে কী হবে সেটা গণপতি ঠিক করে। আজকের কার্টেন কল গণপতির হাতে নেই। কারও হাতে নেই। আজকের কার্টেন কল নির্ধারণ করবেন একমাত্র মহাকাল।

.

সন্ধ্যা আটটা থেকে অনুষ্ঠান শুরু। শুরুতে গান, তারপর কিছু বক্তব্যের পরেই আসল আকর্ষণ। গণপতির জাদু। মুখে মুখে রটে গেছে গণপতি নাকি আজকে মঞ্চে সত্যিকারের ভূত নামাবে। সে ভূত দেখা যাবে, হেঁটে চলে বেড়াবে। এমন আজব খবর আগে কেউ শোনেনি। তাই অনেকেই আজ উপস্থিত হচ্ছে। প্রিয়নাথ চলে এসেছেন অনেক আগেই। পরনে অবশ্য পুলিশি উর্দি নেই। সাইগারসন মানা করেছিলেন। এসেই দেখতে পেলেন হলের এক কোণে সাইগারসন চুপটি করে বসে আছেন। যেমনটা কথা ছিল। প্রিয়নাথ হলের মাঝামাঝি এক জায়গায় আসন দখল করে বসলেন। গোটা হল আলোতে আলোতে ভরা। স্থায়ীমঞ্চতে কীসব কারুকার্য করে অনেকটা উঠিয়ে কাঠের একটা অস্থায়ী মঞ্চ বানানো হয়েছে। নিশ্চিতভাবে ম্যাজিক দেখানোর জন্য। গোটা অনুষ্ঠানের ছবি তোলার জন্য হলের প্রবেশদ্বারের পাশেই বিরাট বেঢপ একটা ক্যামেরা নিয়ে, মাথায় কালো চাদর ঢাকা দিয়ে হীরালাল কী যেন করছে। সব একেবারে হিসেবমতো হচ্ছে, শুধু কোথাও তারিণীর দেখা নেই। প্রিয়নাথের মন এক অজানা আশঙ্কায় দুলে উঠল।

.

হাতে একটা লোহাবাঁধানো বেতের লাঠি দোলাতে দোলাতে ম্যাসনিক হলের দিকে হেঁটে আসছিলেন বেঁটেখাটো এক সাহেব। মাথায় টপ হ্যাট। সেন্ট আন্ড্রুজ চার্চ পেরিয়ে লালবাজারের আগে অবধি বেশ কয়েকটা অন্ধকার গলি। শুধু মোড়ের মাথায় এক-একটা করে বাতিস্তম্ভ I সন্ধের পর বেশ কিছু দেহোপজীবিনীরা এসে এখানে দাঁড়ায়। আপিসফেরতা বাবুরা, বিশেষ করে শুক্র- শনিবার দেশের বাড়ি ফেরার আগে একটু ফূর্তি করে যান। এদের কোনও বসার জায়গা নেই। দরদাম ঠিক হয়ে গেলে অন্ধকার গলির এক কোণে খদ্দেরকে টেনে নিয়ে সেখানেই যা হবার হয়। তাই এদের দর কম। আবার কম সময়ে দেহের জ্বালাও মেটে। পুলিশ সব জানে। হপ্তা নেয় বলে কিছু বলে না।

সাহেব এদের দিকে তাকাতে তাকাতেই যাচ্ছিলেন। সবই মামুলি। লালবাজার পার হবার ঠিক আগে মেয়েটাকে চোখে পড়ল সাহেবের। লাল চুল, গোলাপি চামড়া। দেখলে প্রথমে সাহেবের মেয়ে মনে হয়। কিন্তু মুখের যে লালিত্য, তা একমাত্র ভারতীয়দের মধ্যেই সম্ভব। হাফব্লাড। একেই না দুদিন আগে জুঁইয়ের ঘরের সামনে দেখেছিলেন সাহেব! না ঢুকে চলে গেল। তারপর সাহেব অনেক জায়গায় খুঁজেছেন একে। পাননি। জুঁই কিছু বলতে পারেনি। সেও নাকি অনেকদিন পরে ওকে দেখেছিল। আজ সেই মেয়ে ল্যাম্পপোস্টের তলায় দাঁড়িয়ে। এ যে মেঘ না চাইতেই জল! সাহেব ট্যাঁকঘড়ি বের করে দেখলেন, এখনও আধঘণ্টা সময় আছে। দ্রুত পায়ে তিনি মেয়েটার কাছে গেলেন। পাঁচ টাকায় রফা হল। এইসব মেয়েদের তুলনায় পাঁচ টাকা একটু বেশিই। তবু এই মেয়ের জন্য এটুকু খরচ করাই যায়। মেয়েটা তাঁকে টেনে নিয়ে গেল রাস্তার এক কোণের অন্ধকারে। সেখানে খড়, চাদর পেতে একটা অস্থায়ী বিছানার ব্যবস্থা হয়েছে। সাহেবের তর সইছিল না। হামলে পড়লেন মেয়েটার উপরে। কোনওমতে ওকে মাটিকে ফেলে তিনি পাগলের মতো তার টুকটুকে লাল ঠোঁটে মুখ ডুবিয়ে দিলেন।

.

শুরুতেই যখন ম্যাসনিক সংগীত “হেইল ইটারনাল” শুরু হল, গণপতি উইংসের একদিক থেকে উঁকি মেরে দেখল অনেকেই উপস্থিত। সাইগারসন আর প্রিয়নাথ দুই জায়গায় বসে আছেন, একদিকে ক্যামেরা নিয়ে হীরালাল দাঁড়িয়ে, লখন এদিক ওদিক তদ্বির করছে। কিন্তু সেই সাহেবের দেখা নেই। তাহলে এত আয়োজন, সব কি বৃথা যাবে? একগাদা বাচ্চাদের নিয়ে একজন ব্রাদার এলেন। গণপতি দেখল অবিকল সেই ছবির শিশুটির মতো এক মেয়ে। আলাদা করে চিনিয়ে দিতে হয় না। একেবারে সামনের সারিতে বসিয়ে দেওয়া হল তাদের। লখন মাঝে মাঝেই কাজের ফাঁকে গণপতির দিকে তাকাচ্ছে। সাহেব এলেই লখনকে ইশারা করতে হবে। গণপতির নজর দরজার দিকে। অনুষ্ঠান শুরু হবে। হবে, এই সময় প্রায় হস্তদন্ত হয়ে সাহেব হলে ঢুকলেন। হাতে একটা বেতের ছড়ি। লখনও সাহেবকে দেখেছিল। গণপতির দিকে তাকাতেই সেও মাথা নাড়ল। ঠিক এখানেই লখন এমন একটা কাজ করল যা গণপতির হিসেবের বাইরে। সোজা সাহেবের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। সাহেবের মুখ ভাবলেশহীন। লখন কী যেন বলল সাহেবকে। সাহেব মাথা নাড়লেন। গণপতি বুঝল লখন নিজের পরিচয় দিচ্ছে- এটা বাড়াবাড়ি রকম দুঃসাহস। লখন যদি টের পায় গণপতি মিছে কথা বলেছে, তাকে খুঁজতে না, সাহেব এসেছেন যাতে গণপাত অ্যালিসকে দোখয়ে দেয় সেজন্য, তবে সে তো বেইমানির সামিল! সাহেব লখনের সঙ্গে করমর্দন করলেন। লখন সাহেবকে পথ দেখিয়ে একটা আসনে বসিয়ে দিল। এসব কী হচ্ছে? এসব হবার তো কথা ছিল না!

.

অনুষ্ঠানের শুরুর প্রথম দশ মিনিট গেল গান আর বক্তৃতায়। বিদায়ী গ্রান্ডমাস্টার হ্যালিফ্যাক্স সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে আশা করলেন সামনের বছর মহারানির উপস্থিতিতে আরও জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান হবে। নতুন গ্র্যান্ডমাস্টার সেই দায়িত্ব নেবেন। লখন নিজে একটা চেয়ারে বসে সব শুনছিল। সবকিছু একেবারে হিসেবমতো চলছে। সাহেব ঢোকা মাত্র সে নিজের পরিচয় দিয়ে দিয়েছে, যাতে কোনও ভুল না হয়। সাহেব যাকে খুঁজতে এসেছেন, সে-ই নিজে এসে ধরা দিচ্ছে— সাহেব হয়তো অবাক হবেন, তবে খুশিও হবেন নিশ্চয়ই। গণপতিকে আর চিনিয়ে দিতে হবে না কষ্ট করে। গণপতির যা করার সে করেছে। বাকিটা লখন সামলে নেবে। ফতুয়ার পকেটে রিভলভারটা হালকা হাতে একবার অনুভব করে নিল লখন। এদিকে মঞ্চে গণপতি এসে গেছে। প্রথমেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান, তারপর তাসের যেসব ম্যাজিক সে দেখায় তা দ্রুত দেখিয়ে সরাসরি চলে এল আসল কথায়।

“আজ এই মঞ্চে আমি প্রথমবার এমন কাজ করতে চলেছি, যা ভূভারতে কেউ করেনি। এর আগে আমি আপনাদের ভূতের গলার আওয়াজ শুনিয়েছি। ভূতের কার্যকলাপ দেখিয়েছি ভৌতিক বাক্সে। দেখিয়েছি ভূতের বাক্সে হাত পা বাঁধা অবস্থায় থেকেও কীভাবে আত্মাদের আহ্বান করে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজানো যায়। কিন্তু অনেকেই মনে করেছেন ওসব জালিয়াতি। ম্যাজিশিয়ানের কায়দা। তাই এই প্রথমবার, এই ম্যাসন হলের মঞ্চে আমি এক সত্যিকারের ব্রাদারের আত্মাকে আহ্বান করব। ব্রাদার ডেভিড শৈলচরণ সান্যালকে আপনাদের অনেকেই চিনতেন। এই লজের একনিষ্ঠ কর্মী ছিল সে। দুঃখের বিষয়, কিছুদিন আগে নৃশংসভাবে তাকে হত্যা করা হয়। আরও দুঃখের বিষয়, আজ অবধি সেই খুনের কোনও কিনারা হয়নি। ব্রাদার শৈলর আত্মা কাল রাতে এসে আমায় বলেছিল আজ সেই খুনি এই অনুষ্ঠানে আসবে। ব্রাদার শৈল নিজে তাকে চিনিয়ে দেবে।”

গোটা হল জুড়ে গুনগুন এতটাই বাড়ল যে গ্র্যান্ডমাস্টার নিজে দাঁড়িয়ে সবাইকে চুপ করতে অনুরোধ করলেন। লখন বেশ অবাক। এমন তো কথা ছিল না! শৈলচরণ!! এও সম্ভব!

.

দ্রিম দ্রিম আওয়াজে খুব ধীরে একটা ডাক বাজতে থাকল। হলের আলো প্রায় নিভু নিভু। গণপতি বিচিত্র ভাষার এক মন্ত্রে শৈলকে ডাকছে। সে ভাষা চেনা কোনও ভাষা না। যেন কোনও আদিম মন্ত্রে জেগে উঠবে রসাতলের প্রেতাত্মারা। হলের দর্শকদের মধ্যে হঠাৎ একটা চাপা শ্বাস টানার শব্দ হল। লখন দেখতে পেল মঞ্চে গণপতির ঠিক পাশেই একটা উজ্জ্বল আলো আলেয়ার মতো কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতে আলো বেড়ে উঠছে আর ধীরে ধীরে তা এক মানুষের চেহারা ধারণ করছে। এ কোনও মরমানুষের চেহারা না। প্রায় স্বচ্ছ, যেন সদ্য নরক থেকে উঠে এসেছে। খানিক পরে আর কারও চিনতে বাকি রইল না। ধুতি আর ফতুয়া পরা, লম্বা চুল, রোগা, খাটো দেহের এই মানুষটা বেঁচে থাকতে ম্যাসন হলের প্রায় সবাই একে দেখেছে। শৈলর ভূত এবার মঞ্চের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত হেঁটে যেতে লাগল। ঠিক হাঁটা না, যেন ভেসে বেড়াচ্ছে। যাদের মনে তখনও সন্দেহ ছিল, এই হাঁটা দেখে তাও রইল না। শৈলরহাঁটায় এক নারীসুলভ কোমলতা ছিল। মৃত্যুর পরেও সে তা ছাড়তে পারেনি। শৈলর মুখ চোখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এ যে শৈলই, তাতে কারও বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। স্বয়ং গ্র্যান্ডমাস্টার হ্যালিফ্যাক্স হাতে ক্রুশ ধরে চোখ বন্ধ করে “Our Father, who art In heaven. Hallowed be thy name; thy kIngdom come; thy wIll be done on earth as It Is In heaven” বলতে লাগলেন বিড়বিড় করে। শুধু লখন ভুরু কুঁচকে রইল। এ তো পিপার’স গোস্ট! জাদুকরদের কঠিনতম ইলিউশান। কিন্তু শৈলকে এনে ঠিক কী করতে চাইছে গণপতি?

.

গণপতি এবার শৈলচরণের ভূতের দিকে ফিরল। কাটা কাটা গলায় বলল, “ব্রাদার শৈল, আমি জানি তোমার সঙ্গে যা হয়েছে তার কোনও মাফ নেই। আমি এটাও জানি, খুনি আজও এই সমাজে বিনা বাধায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। গতকাল তুমি বলেছিলে, সে আজ এখানে আসবে। সে কি এসেছে?”

লখন দেখল সেই সাহেব এবার যেন একটু উশখুশ করে উঠলেন। দুই- একবার ঘাম মুছলেন কপালের। হাতের তেলোর।

মঞ্চে শৈলর ভূত উপরে নিচে মাথা নাড়ল। অর্থাৎ এসেছে।

দর্শকদের মধ্যে আবার গুনগুন শুরু হল।

“তুমি কি তাকে দেখাতে পারবে?”

আবার উপরে নিচে মাথা নাড়ল শৈলর ভূত।

“তবে দেখাও।”

শৈলর ভূত খুব ধীরে ধীরে আঙুল তুলে দেখাবার আগেই অনেকগুলো ঘটনা একসঙ্গে ঘটে গেল। সেই সাহেব আচমকা উঠে দাঁড়ালেন নিজেই। মুখে অদ্ভুত এক হাসি। হাসি বাড়তে লাগল। হাসতে হাসতেই তিনি পকেট থেকে একটা মার্ক-৩ রিভলবার বার করে সোজা গুলি ছুড়লেন শৈলর ভূতকে লক্ষ্য করে। ভূতের গা ভেদ করে গুলি চলে গেল। শুধু প্রচণ্ড কান ফাটানো কাচ ভাঙার আওয়াজ এল মঞ্চ থেকে। লখন জানে সাহেব এরপরে তাকেই নিশানা করবে। তাকে খুঁজতেই তো সাহেবের আজ এখানে আসা। গণপতি বলেছে লখনকে। পকেটের পিস্তলটা নিয়ে উঠে দাঁড়াতে যাবে, এমন সময় দুই দিক থেকে দুই বজ্রমুষ্টি তার দুই হাত চেপে ধরল। পিছন থেকে ঘাড়ে ঠেকল ঠান্ডা ধাতব নল।

“পুলিশ। একদম চুপ করে বসে থাকো।”

হলের পিছন দিক থেকে তিন-চারজন ব্রাদার সাহেবকে নিরস্ত্র করতে ছুটে এল। এসব গণ্ডগোল দেখে মাস্টার ম্যাসন উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। লখন দেখল সাহেব তার দিকে না, বন্দুক তাগ করেছেন সোজা মাস্টার ম্যাসনের দিকে। ভয়ে লখনের চোখ বড়োবড়ো হয়ে গেল। মাস্টার ম্যাসনের পরিচয় সাহেব পেল কী করে? তবে কি শৈল… মরার আগে মাস্টার ম্যাসনের পরিচয়… একবারও এটা ভেবে দেখেনি লখন। কেন ভাবেনি?

কিছু বোঝার আগেই পরপর তিনটে গুলি মাস্টার ম্যাসনের বুক, মাথা আর গালা বিধে দিল। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন মাস্টার ম্যাসন কিংবা গোপন গ্র্যান্ডমাস্টার ডাক্তার জোসেফ গ্রান্ট। আর মাত্র চব্বিশ ঘন্টা পরেই যাঁর লক্ষের গ্র্যান্ডমাস্টার হবার কথা।

আরও একটা গুলির আওয়াজ। এবার আর সাহেব না। নিজের পুলিশি রিভলবার থেকে অভ্রান্ত টিপে এক গুলিতে সাহেবের মাথার খুলি উড়িয়ে দিয়েছেন। প্রিয়নাথ দারোগা। তাঁর চাকরিকালে এই প্রথম এনকাউন্টার।

গোটা হলে শিশুদের চিৎকার, হুড়োহুড়ি আর বারুদের ধোঁয়ার গন্ধে অবিচলিত একজনই শুধু কোনওমতে সেই ভিড়ের মধ্যে হ্যালিফ্যাক্সের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “গ্র্যান্ডমাস্টার, আমার নাম শার্লক হোমস I আপনাকে আমার অনেক কিছু বলার আছে, একটু সময় হবে?”

.

৬।

“অর্ধসত্য মিথ্যার চেয়ে ভয়ানক। আর এই গোটা কেসে বারবার সেটাই হয়েছে। কেউ কাউকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারেনি। প্রত্যেকে নিজেদের মতো ষড়যন্ত্র করেছে আর অন্যদের অর্ধসত্য বলেছে। ফলে কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যে, আলাদা করা কঠিন হয়ে গেছে। আমি নিজেও সত্য গোপন করেছি”, যিনি বলছিলেন, তাঁর নাম এতকাল সবাই সাইগারসন মোহেলস বলে জানত। আজ জানল তাঁর আসল নাম শার্লক হোমস।

“এই ছদ্মনাম আর বয়ে বেড়ানোর মানে হয় না। যে কাজে এই নাম নিয়েছিলাম, সে প্রয়োজন মিটেছে। আর হয়তো কোনও দিন এই দেশে আমাকে আসতে হবে না। তবে হ্যাঁ, এ দেশে এসে এমন কিছু মানুষের সঙ্গে আলাপ হল, যাদের আমি চিরটাকাল মনে রেখে দেব।” আলোচনা হচ্ছিল ক্লাইভ স্ট্রিটে তারিণীর আপিসে বসে। যিশু ভক্তি দিবসের সেই দুঃস্বপ্নের সন্ধ্যার এক সপ্তাহ অতিক্রান্ত। হোমস সাহেব আগামী কাল আটলান্টা জাহাজে চেপে লন্ডন রওনা হবেন। যাবার আগে সবাইকে একসঙ্গে ডেকেছেন। তারিণী ছাড়াও, গণপতি, প্রিয়নাথ আর হীরালাল-ও উপস্থিত।

“এখন আমি যা যা বলব, তা সরকারিভাবে বলার এক্তিয়ার আমার নেই। তবু বলি। আমাদের মহারানির বিরুদ্ধে আমাদের দেশেই নানা জায়গায় চাপা বিদ্রোহ শুরু হয়েছে। কেউ তাঁকে মহামারি রানি বলে, কেউ বা ব্রিটিশ ডাইনি। এই মুহূর্তে যুদ্ধবিগ্রহ সব মিলিয়ে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক অবস্থা বিশেষ ভালো না। প্রধানমন্ত্রী রানির কথায় ওঠেন বসেন। না চাইলেও বাধ্য হন। এদিকে রানি প্রায় শুরু থেকেই ম্যাসনিক হলকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করছেন। যেহেতু ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স তাঁর তাঁবেদার নয়, তাই তিনি ম্যাসনদের এক অংশকে ব্যক্তিগত ইন্টেলিজেন্স টিম হিসেবে ব্যবহার করে চলেছেন ক্রমাগত। এরা রানির জন্য যে-কোনো কিছু করতে দুবার ভাবে না। এখন সমস্যা হল রাজপরিবারেই রানির বিরোধী তৈরি হয়েছে। স্বয়ং রাজকুমার এডির বিবাহ রানি মেনে নেননি, তাঁর স্ত্রীকে পাগলা গারদে পুরে দেওয়া হয়। তাঁর মেয়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। যারা সেই মেয়ের সন্ধান জানত তাদের রানির ডানহাত ডাক্তার গল একে একে খুন করে। এই এক সমস্যা। পাশাপাশি ডাক্তার এলি হেনকি এমন এক আরক তৈরি করলেন, যা হাতে এলে যে-কোনো শত্রুকে বশে আনা যাবে। ম্যাসনদের মধ্যে দুইভাগ হয়ে যায় এই আরকের দখল নিয়ে। এক দল রানির পক্ষে, অন্য দল বিপক্ষে। এই লড়াইতে কী হত জানি না। মাঝখান থেকে সব হিসেব গুলিয়ে দিল একেবারে ছাপোষা এক কর্মচারী। হিলি। সে এমন দুটো জিনিস সঙ্গে নিয়ে ভারতে চলে এল যে, ইংল্যান্ডের সংঘ সব ছেড়ে আগে সেই দুই অমূল্য সম্পদ উদ্ধারে নামল। তাও একত্রে না। নিজেদের মতো করে। ফলে যা হয়। দুই দলের এই যুদ্ধে বহু সৈনিক প্রাণ দিল। হ্যালিডে, কার্টার, শৈল থেকে সেদিনের ম্যানুয়েল ডিব্যাসি। আসল মাথাদের টিকিটিও ছোঁয়ার সাধ্য কারও নেই।”

“সেদিন যা যা হল, আপনি কি তা আন্দাজ করেছিলেন?” প্রিয়নাথ জিজ্ঞাসা করলেন।

“কিছুটা অনুমান করেছিলাম। আন্দাজ না। আন্দাজ খুব বাজে স্বভাব। এতে ভুল হয় বেশি। এটুকু বুঝেছিলাম শৈল মরার আগে গোপনতম কিছু বলে গেছে, নইলে ওকে ওভাবে মরতে হত না। বুঝেছিলাম লখন কোনওভাবে ম্যানুয়েলকে ‘হেল ফায়ার’ খাওয়াবে, যাতে প্রথম আক্রমণ ও-ই করে। কিন্তু কীভাবে সেটা বুঝিনি।”

“কীভাবে?”

“এখানে অদ্ভুত চালাকি করেছিল লখন। আমি ভুলেই গেছিলাম গোটা খেলায় ওর এক পার্টনার-ইন-ক্রাইম আছে। ওর দিদি মারিয়ানা। ম্যানুয়েলের মহিলাদের প্রতি দুর্বলতা ছিল। ইচ্ছে করেই একদিন মারিয়ানা জুঁইয়ের বাসায় গিয়ে সাহেবকে মুখ দেখিয়ে আসে। জানত সাহেব তাকে একবার দেখলে ভুলবে না। সেদিন অনুষ্ঠান শুরুর আগে সে লালবাজারের পাশে ম্যানুয়েলকে টেনে নিয়ে গেছিল আমোঘ কামের টানে। আর সেখানেই….”

“কিন্তু সাহেবের শরীরে হেল ফায়ার প্রবেশ করাল কী উপায়ে?”

“মারিয়ানার ঠোঁটের চারদিকে গুঁড়ো করে হেল ফায়ার মাখানো ছিল। সে নিজে থুতুটাও গেলেনি। ম্যানুয়েল তাকে চুম্বন করা মাত্র তার ঠোঁট থেকে হেল ফায়ার সরাসরি সাহেবের দেহে ঢুকে যায়।”

“কিন্তু সাহেব আচমকা গ্রান্টকে মারলেন কেন?” তারিণী শুধাল।

“এটাও লখন স্বীকার করেছে। গ্রান্ট ছিলেন জাবুলনদের প্রধান। গোপন গ্র্যান্ডমাস্টার। যাকে ওরা মাস্টার ম্যাসন নামে ডাকত। খুব সম্ভব শৈল মরার আগে গ্রান্টের নাম বলে গেছিল। তা না হলে এই পরিচয় কারও জানার কথা না।”

“কিন্তু আইন তো লখনকে কিছু করতে পারবে না।”

“জানি। তাই অন্য উপায় নিতে হয়েছে। আর এইজন্যেই গণপতিকে দিয়ে হীরালালকে ডাকা। হীরালালের ক্যামেরায় সেদিনের সবকিছুর ছবি তোলা আছে। এমনকি শুরুতে লখন যে উপরচালাকি করে ম্যানুয়েলকে বসার জায়গা দেখিয়েছিল সেটাও। এই ভুল লখন করবে আমি ভাবিনি। যাই হোক, আমি লখনকে বলেছি, ও যদি কিছুমাত্র বাড়াবাড়ি করে তবে লজের গ্র্যান্ডমাস্টারের কাছে সেই ছবি চলে যাবে। লজ এখন হন্যে হয়ে খুঁজছে, কে ডিব্যাসিকে সেদিন আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। ছবি দেখলে যে কেউ ভাববে লখনই এই কাজ করেছে। তখন ও কিংবা ওর পরিবার কাউকেই ব্রাদারহুড শান্তিতে থাকতে দেবে না। তবে আশার কথা একটাই, আপাতত জাবুলনদের প্রকোপ এই দেশে কিছু হলেও কমবে। হ্যালিফ্যাক্সের আর এযাত্রা দেশে ফেরা হবে না। গ্র্যান্ডমাস্টার তিনিই থাকছেন। তিনি এসবের কিছুই জানতেন না। তাঁকে অন্ধকারে রেখেই …”

“লখনের তবে কী হবে?” গণপতির প্রশ্ন।

“ওর কোনও পরিচয়পত্র নেই। ইংরেজ শাসনে ওকে আর রাখা যাবে না। নতুন জায়গায়, নতুন পরিচয়ে সারাজীবন কাটাতে হবে ওকে।”

“কোন পরিচয়?”

“ম্যানুয়েল ডিব্যাসির দুটো পরিচয়পত্র ছিল। একটা ডিব্যাসি নামে, ফরাসি নাগরিক। অন্যটা হিউড র‍্যাডির নামে, ইংরেজ। প্রথম পরিচয়টা লখনকে দিয়ে ওকে চিরকালের জন্য চন্দননগরে ফরাসি শাসনে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”

“আর মারিয়ানা? অ্যালিস?” জিজ্ঞাসা করল তারিণী। এবার প্রিয়নাথ উত্তর দিলেন, “সেটা আমরাও সঠিক জানি না। টমসন সাহেব এই ব্যাপারটা একেবারে গোপন রেখেছেন। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে। তবে এটা কথা দিয়েছেন ওরা যেখানেই থাক, ভালো থাকবে। সুরক্ষিত থাকবে। প্রয়োজনে অ্যালিসের পরিচয় প্রকাশ করা হবে। নচেৎ নয়। আর হ্যাঁ, খুব সম্ভব এ দেশে সামনের বছর জুবিলি হচ্ছে না। রানির নিরাপত্তাভঙ্গ হতে পারে।”

“ওদের প্ল্যানটা ঠিক কী ছিল? জানা গেছে?”

“তা সঠিক বলা মুশকিল। লখন নিজেও সবটা জানে না। তবে যা মনে হয়, আগামী বছর যিশু ভক্তি দিবসে ম্যাসন হলে খাওয়াদাওয়ার পর ম্যাজিক শো ছিল। সেখানেই রানির দেহরক্ষী বা অমন কারও খাবারে হেল ফায়ার মিশিয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। পরে হয়তো প্রচার করত ভূতের আক্রমণে রানি মারা গেছেন। এই সবই আমার অনুমান। তবে পুরো ক্ষমতা দখল করার জন্যেই গ্রান্ট ক্ষমতা লাগিয়ে গ্র্যান্ডমাস্টার হতে চেয়েছিল, এটা স্পষ্ট।” বললেন হোমস। খানিক সবাই চুপ। প্রথম কথা বললেন প্রিয়নাথই।

“তারিণীকে শৈল সাজিয়ে মঞ্চে আনার বুদ্ধিটা কার? গণপতির?”

“না, আমার”, বলল তারিণী। “শৈলর ওভাবে মারা যাওয়াটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি। আমি ছাপোষা মানুষ। ক্ষমতা খুবই কম। কিন্তু বন্ধুর খুনিকে হাতের সামনে পেয়ে ছেড়ে দেব? আপনিই বলুন? গণপতি প্রথমে রাজি হয়নি। আমি বললাম ওই ছায়া ছায়া আকারে কেউ পষ্ট বুঝতে পারবে না। আমি শৈলর চলাফেরা অবিকল নকল করতে পারি। আমার মধ্যে দিয়ে হলেও, শৈল তো একদিনের জন্যেও বেঁচে উঠেছিল”, তারিণীর চোখ জলে ভরে আসে।

“তাহলে গণপতি, তুমি এখন কী করবে?”

“আর জাদু দেখাব না। জাদুর শখ আমার গেছে। পুঁটির মেয়েকে নাকি প্রফেসর প্রিয়নাথ বোস তাঁর বেঙ্গল সার্কাসে নিতে চান। আমিও সেই সার্কাসে যোগ দেব ভাবছি। এই পাপের শহরে আর মন টিকছে না।”

“সার্কাসে ম্যাজিক দেখাবে?”

“না। আমি অল্পবিস্তর ছবিও আঁকতে পারি। ওদের ওখানে জীবজন্তু আঁকার লোক খুঁজছে। দেখি একবার বলে। যদি আমায় নেন।”

হোমসকে গোটাটাই তর্জমা করে বলে দিলেন প্রিয়নাথ।

“বেশ। এবার কয়েকটা জরুরি কথা। যে কদিন বেঁচে আছ, ভুলবে না। তারিণী, তোমায় আগের বার একটা বই দিয়েছিলাম মনে পড়ে? একটু নিয়ে এসো দেখি। সঙ্গে গণপতির দেওয়া ভূতের বাক্সটাও।”

ডিরেক্টর খুলে দুটোই নিয়ে এল তারিণী।

“এবার দ্যাখো। হ্যালিডে নিজেই জানত না কী মহাসম্পদ আছে তার কাছে। টেমারলেনের মলাটের এই তলাটা ভালো করে খেয়াল করো। কী দেখছ?”

সবকটা মাথা এক হয়ে দেখতে থাকে। তারিণাই উত্তর দেয়, “আজ্ঞে হিজিবিজি কিছু লেখা।”

“হিজিবিজি না। কেমিষ্ট্রির ফর্মুলা। একদিন বেখেয়ালে বইয়ের এই অংশে পাইপের হলকা লেগে লেখা ফুটে উঠেছিল। তখনই বুঝেছিলাম। এলি হেনকি নিজে ভূত বানাতে ভুলে গেছেন, কিন্তু তার আগে অদৃশ্য কালিতে এখানে লিখে গেছিলেন। আমি চাইলে গোটাটাই উদ্ধার করতে পারতাম। করিনি। লেট দ্য জায়ান্ট স্লিপ। তোমরাও একে জাগিয়ো না। আর এখানেই আমার ভয়। এই বাক্স আর এই ফর্মুলা একসঙ্গে থাকলে, আর কোনও দুষ্টু লোকের হাতে পড়লে মহা বিপদ। তাই দুটো দুই জায়গায় থাক। তোমার কাছে বইটা আর হেল ফায়ার সহ বাক্সটা বাবু প্রিয়নাথের কাছে”, বলে কাপড়েমোড়া কাঠের বাক্সটা প্রিয়নাথের হাতে দিয়ে বললেন, “লখনের কাছেই ছিল। আমি চাইতেই দিয়ে দিল। এখন আপনার কাছে থাক। আপনার কাছে ধড়, আর মুণ্ডু তারিণীর কাছে।

“কিন্তু এ জিনিস তো নষ্ট করে ফেললেই হয়!”

“বিজ্ঞানের এত বড়ো আবিষ্কার নষ্ট করে ফেলবেন?” প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন হোমস। “কে জানে আজ থেকে একশো বছর পরে মানুষ এর কোনও কল্যাণময় দিক আবিষ্কার করবে কি না।

তারিণী তার কাছে এই কেসের যাবতীয় যা কিছু ছিল প্রিয়নাথকে দিয়ে দিল। এমনকি এই কেসের যতটুকু বিবরণ তার ডায়রিতে লেখা ছিল, সেটাও ছিঁড়ে দিয়ে দিল প্রিয়নাথকে। এই অভিশপ্ত কেসের সঙ্গে সে আর কোনও যোগ রাখতে চায় না।

.

সবাই চলে গেছে। ঘরে বসে একা তারিণী। সে শুধু একটা জিনিস নিজের কাছে রেখে দেওয়ার আবদার করেছে। সবাই মেনেও নিয়েছে। শৈলচরণের ম্যাগনাম ওপাস “বিষম ভূত ও পুষ্পসুন্দরীর পালা”, বাকি কপিগুলো সেই রাতে কে নিল, কেন নিল, উত্তর হয়তো জানা যাবে না কোনও দিন। তারিণী শৈলর লেখা পাতলা বইটাতে হাত বোলায়, হাত বোলায়। এই তো প্রথম পাতায় তার আর শৈলর নাম একসঙ্গে আছে। দুজনে একসঙ্গে এভাবেই থেকে যাবে চিরকাল।

কী মনে হওয়ায় তারিণী টেমারলেনের বইটা হাতে তুলে নেয়। মলাটটা রেখে ভিতরের বইটা খুলে বার করে নিয়ে আসে। তারপর সেই জায়গায় শৈলর লেখা রেখে দেয়। সাহেব বলেছিল এই বই নাকি পৃথিবীর অন্যতম দামি বই। কিন্তু তারিণীর কাছে শৈলর লেখার চেয়ে দামি কিছু নেই। মোটা সুতো দিয়ে বইটা মলাটের সঙ্গে সেলাই করে, বইকে লাল শালুতে মুড়ে দড়ি বেঁধে ডিরেক্টরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল তারিণীচরণ। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল ভিতরের অন্ধকারের দিকে। তারপর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডিরেক্টরের ডালা বন্ধ করে দিল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *