পূর্বখণ্ড- সংশয়
মধ্যখণ্ড— সংযোগ
উত্তরখণ্ড— সংকাশ

গণপতির কথা

গণপতির কথা

১।

গণপতির খুব ভয় করছে। জীবনে প্রথমবার। শিরশিরে একটা অনুভূতি মেরুদণ্ড বেয়ে চারিয়ে যাচ্ছে সারা দেহে। অবশ করে দিচ্ছে গণপতির সমগ্র চৈতন্যকে। যে ডাকের ভয় সে এতদিন সকাল সন্ধে করছিল, অবশেষে সেই ডাক এসেছে। সে জানে এই ডাকে সাড়া দিতেই হবে। ভাবত বছর চারেক আগে যা ঘটেছে তার সবই এক ভয়ানক দুঃস্বপ্ন। কিন্তু অন্ধকার অমানিশার মতো, ভয়াবহ প্রেতের মতো নির্দিষ্ট সময়ের অন্তরে আবার তা ফিরে এসেছে। ঠিক চল্লিশ মাস পরে। যেমনটা কথা ছিল। তার হাতে ধরে থাকা পাতলা রঙিন কাগজে যা লেখা আছে সে জিনিসের মর্ম উদ্ধার করা সাধারণের কর্ম না। সে জিনিস সাধারণের জন্যও না। কিন্তু গণপতি জানে রমণপাষ্টির যে খেলা চল্লিশ মাস আগে শুরু হয়েছিল, এখন তা একেবারে শেষ চরণে এসে গেছে নিশ্চয়ই। নইলে এই ডাক আসত না। তার আর কিচ্ছু করার নেই। যে মিথ্যাকে এতকাল মনের গহনে চাপা দিয়ে রেখে ভেবেছিল চিরতরে শেষ করে দিতে পেরেছে, তা যেন কোন অদ্ভুত জাদুবলে আবার জ্যান্ত হয়ে উঠেছে। পিন্ডারী বাবার সহকারী সেই অদ্ভুতদর্শন ছেলেটার মতো বড়লাটের মৃত ভাই আবার কবর থেকে জেগে উঠেছে। যাকে প্রথমবার সে দেখেছিল ছোট্ট প্রায়ান্ধকার এক ঘরে, মোমবাতির আবছা আলোতে। আর শেষবার নিজের হাতে তার ছিন্নভিন্ন দেহ শুইয়ে দিয়েছিল চিনাপট্টিতে এক অন্ধকার ল্যাম্পপোস্টের তলায়….

লালমোহন মল্লিকের বাড়ির বাইরে এক ঘরে গণপতির থাকার ব্যবস্থা করেছেন তাঁরা। এই পাঁচদিন সেখানে থেকেই জাদু দেখানোর কথা। ছোট্ট ঘরখানি। একখানি খাটিয়া আর আলনা ছাড়া আর বিশেষ আসবাব নেই। সেই খাটিয়ার ওপরেই একদিকে কাত করে রাখা ডোয়ার্কিনের বেলো হারমোনিয়াম। মন ভালো থাকলে গণপতি হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান ধরে। বেশিরভাগ গানই মজার গান। তবে সবসময় গায় না। ইদানীং হাইকোর্টের উকিল চন্দ্রমোহন সেনের বড়ো ছেলে হীরালালের সঙ্গে গণপতির ভাব হয়েছে। সে এলেই আবদার করে গান শোনানোর। বয়সে ছোটো হীরালালের বায়না ফেলতে পারে না গণপতি। হীরালালের সবচেয়ে প্রিয় দেশলাইয়ের গান। কয়েক বছর হল বিদেশ থেকে এ জিনিস আমদানি হয়ে নেটিভদের মন জয় করেছে। দরাজ গলায় গণপতি গায়—

নমামি গন্ধকগন্ধ মুণ্ডটি গোলালো,
সৰ্ব্বজাতি প্রিয়দেব গৃহ করো আলো।
নিদ্রিতের গুপ্তচর পাচিকার প্রাণ,
লম্বাদাড়ি কাবুলির শিরে যার স্থান।

শুধু হীরালাল কেন, গণপতির গান শুনতে ভিড় জমায় চাকর সহিসরাও। গানের মাঝে মাঝে মজার মজার গল্প বলে গণপতি। কিছু তার নিজের চোখে দেখা। কিছু লোকমুখে শোনা। কিন্তু গল্প বলার ভঙ্গিটি বড্ড মধুর। সে আসর জমিয়ে বসলে কারও সাধ্য নেই সেখান থেকে ওঠে। গান করতে করতে একটা মজার ম্যাজিক দেখায় গণপতি। সবাই দ্যাখে তার মুখ বন্ধ কিন্তু গান চলছে আগের মতোই। সবার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায়। আওয়াজ আসছে কোথা থেকে? জিজ্ঞেস করলে গণপতি উত্তর দেয় না। রহস্য করে হাসে। তার লক্ষ্মীট্যারা চোখে অদ্ভুত এক কৌতুক তিরতির করে কাঁপে। ঠোঁট না নেড়ে কথা বলার এই কৌশল তাকে শিখিয়েছিলেন বৈদ্যনাথধামের পিন্ডারী বাবা। সেও এক অদ্ভুত কাহিনি।

বাড়ি থেকে পালিয়েছিল গণপতি তখন সে ফোর্থ ক্লাসের ছাত্র। স্কুলফেরতা বাড়ি আসার পথে দ্যাখে পথের ধারে একজায়গায় বেজায় ভিড়। লাল চেলি পরা জটাধারী এক সাধু রাস্তার ধারে কাপড় পেতে নানা অদ্ভুত জিনিস দেখাচ্ছেন। ছোটো থেকেই লেখাপড়ার চাইতে এসবে গণপতির আগ্রহ বেশি। সেও জুটে গেল দঙ্গলে।

সাধুর সঙ্গে অল্পবয়সি, বছর ষোলো-সতেরোর এক ছেলে। কুচকুচে কালো গায়ের রং। সামনের দাঁতদুটো একটু উঁচু। সাধু হিন্দিতে কথা বলছে, সেও উত্তর দিচ্ছে হিন্দিতে।

—বেটা তাকত হ্যায়?

—হ্যায়।

—হ্যায় হিম্মত হ্যায়?

—হ্যায়।

—খেল কো জানতে হো?

—হ্যাঁ।

—তব দিখাও খেল।

বলেই বাবা পাশে খুঁড়ে রাখা এক গর্তে ছেলেটাকে পুঁতে, মাটি চাপা দিয়ে, পা দিয়ে বেশ চেপেচুপে শক্ত করে তার উপরে কিছু তুলসীর বীজ ছড়িয়ে দিয়ে মন্ত্র পড়ে জানালেন এবার এক ঘণ্টার মধ্যে এখান থেকে গাছ গজাবে। তারপর চলল আরও সব আজব কিসিমের জাদু। মরা মাছকে জ্যান্ত করা, মুখ থেকে বিদ্যুতের মতো আলো বার করা, হাতের উপরে জ্বলন্ত অঙ্গার রেখে হোম করা, জলের মধ্যে আগুন জ্বালানো। অবশেষে সাধু জানালেন এবার তিনি তাঁর ওই সঙ্গী ছেলেটাকে ডাকবেন। ছেলেটার আত্মা কবরের মধ্যে থেকে জবাব দেবে। সন্ধ্যা হয় হয়। আত্মার নাম শুনে সবাই আরও একটু ঘন হয়ে দাঁড়াল। সাধুবাবা সকলকে বললেন, “আপনারা কেউ বাত করবেন না।” তারপর তিনি খুব জোরে লখনকে ডাকলেন, “আরে এ লাখান”।

যেন অনেক দূর থেকে আওয়াজ এল, “বোলিয়ে জি পিন্ডারী বাবা”।

সবাই অবাক হয়ে দেখল বাবাজি হাসি হাসি মুখে বসে আছেন। উত্তর আসছে যেন আকাশ থেকে। খানিক কথাবার্তা চলার পর বাবাজি আর-এক কীর্তি করলেন। একটা লম্বা তলোয়ার নিয়ে সোজা মুখের ভিতর ঢুকিয়ে দিলেন। তলোয়ার বাঁটসুদ্ধ ধীরে ধীরে ঢুকে গেল পেটের ভিতরে। সেই শূন্য তলোয়ার থেকে ভূতের আওয়াজ বলে উঠল, “আপলোগ সামনে যা কর ইস তলোয়ার কো আহসাস কিজিয়ে।” কেউ যায় না। সবাই ভয়ে সিঁটিয়ে আছে। সাধুও করে ঊর্ধ্বপানে চেয়ে বসে আছেন। দেহ স্থির। নিশ্চল। যেন পাথরের মুর্তি। পেটের কাছে তলোয়ারের ডগাটা বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট। কিন্তু সেটা হাতে ধরার সাহস কারও নেই। গণপতির কী যেন হয়ে গেল। গুটিগুটি পায়ে পেটের কাছে উঁচিয়ে থাকা তলোয়ার স্পর্শ করতেই পিন্ডারী বাবা চিৎকার করে বলে উঠলেন, “সাব্বাস বেটা।” সবার সঙ্গে গণপতিও অবাক হয়ে দেখল কী অদ্ভুত এক জাদুমন্ত্রবলে গোটা তলোয়ারটা বাইরে বেরিয়ে বাবার হাতে চলে এসেছে এক মুহূর্তে। তিনি গণপতির দিকে চেয়ে হাসছেন। সবাই বিস্ময়ে তালি দিতেও ভুলে গেছে। অবাক হবার তখনও কিছু বাকি। সাধু দেখালেন পাশের মাটিতে এর মধ্যেই গজিয়ে গেছে প্রচুর সবুজ তুলসীচারা। হাওয়ায় লকলক করছে। বাবা এক-একটি করে চারা সবার হাতে তুলে দিলেন। তবে বিনে পয়সায় না। পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। এই দান নাকি ঠাকুরের ভোগে লাগবে। দেখতে দেখতে চারা শেষ। সবাই চারাগুলো মাথায় ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই ছেলেটার কী হল? যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে মাটি খুঁড়ে ছেলেটাকে বার করে আনলেন পিন্ডারী বাবা। সেও নির্বিকার মুখে সব সরঞ্জান গুটিয়ে সবার কাছে হাত পাততে লাগল। কেউ পয়সা দিল। কেউ দিল না। এর আগেও অনেক বাবাজি আর মাদারির খেলা দেখেছে গণপতি। কিন্তু এমনটা এই প্রথম। সে অপেক্ষা করতে লাগল কখন ভিড় হালকা হয়। হতেই সোজা বাবাজির পা জড়িয়ে ধরল। সে বাবাজির চেলা হতে চায়। সেও হবে আর বাবাজিও করবেন না। বললেন, “তু বড়া ঘর কা লেড়কা আছিস বেটা। এ খেল বহুত মুশকিল কা খেল আছে। ইন্দরজি নে ইস জাল কো বানায়া থা ফির ইস খেল কো দিখাতে থে রাজা ভোজ অউর রানি ভানুমতী। তেরা কেয়া মঝাল হ্যায় জো তু দো দিন মে ইসকো শিখ যায়েগা? ঘর যা। ইস কে লিয়ে সবকিছু ছোড়না পড়তা হ্যায়। তুঝসে না হো পায়েগা বেটা……”

জেদ চেপে গেছিল গণপতির মনে। এক সপ্তাহের মধ্যেই বাড়ি ছাড়ল সে। সঙ্গে বন্ধু মণীন্দ্রনাথ লাহা। গণপতি তাকে ডাকে প্যাদনা বলে। পিন্ডারী বাবা আর তাঁর সঙ্গী সেই ছোকরা সেদিনের পর যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন। অনেক খুঁজেও গণপতি তাঁদের সন্ধান পেল না। শেষে কিছু মাদারির সঙ্গী হয়ে কয়েকরকম খেলা রপ্ত করল দুজনে। নেহাত মামুলি খেলা। পেট চলে না তাতে। প্যাদনা হাল ছেড়ে দিল। ঠিক করল জাদুকর যখন হওয়া হল না, সাধুই হয়ে যাবে। কিন্তু বাড়ি ফিরবে না। প্রথমেই গেল তারাপীঠ। সেখানে সাধক বামাখ্যাপা তাকে প্রায় দূর দূর করেই তাড়িয়ে দিলেন। স্রোতে কুটোর মতো ভাসতে ভাসতে গণপতি পৌঁছাল বৈদ্যনাথধাম, আর সেখানেই একদিন এমন একটা ঘটনা ঘটল যাতে তার ভাগ্য বদলে গেল চিরকালের মতো।

গঙ্গার ঘাটে বসে জাদু দেখাচ্ছিল একদিন। এভাবেই পেট চালাতে হয় এখন। আপাত সহজ জাদু, কিন্তু যারা দ্যাখে চমকে যায়। পিন্ডারী বাবাও দেখিয়েছিলেন। মুখ থেকে আগুনের হলকা বার করা। এই তামাসা দেখাবার আগে মুখে কিছুটা আকরকোরা বচ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চিবাতে হয়। সেই চিবানো রস মুখের সব জায়গায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মাখিয়ে নিলে আগুনে মুখের কোনও ক্ষতি হয় না। মাদারি এমনটাই শিখিয়েছিল। সেদিন জাদু শুরু করতেই আচমকা পেটের ডানদিকে একটা ব্যথা শুরু হল। প্রথমে গা করেনি গণপতি। ধীরে ধীরে ব্যথা বাড়তে লাগল। যেন গরম লোহার একটা শিক কেউ ঢুকিয়ে দিয়েছে পেটে। ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে। মুখে আগুনজ্বলা নারকেলের লুটি ঢোকাতেই গণপতি টের পেল ভয়ানক কোনও ভুল হয়েছে। আগুনের তাপে জ্বলে যাচ্ছে মুখ। আগুনের শিখার বদলে গলগল করে একগাদা বমি করে ফেলল গণপতি। চারিদিকে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেরা সরে গেল ঘেন্নায়। গণপতির মনে হল সে এবার মারা যাবে। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার ঠিক আগে কেউ তাকে ধরে নিল। বড্ড চেনা একটা মুখ। কুচকুচে কালো চেহারা। সামনের দাঁতদুটো উঁচুমতন। গণপতির মনে হল স্বয়ং দেবদূত এসেছে তাকে বাঁচাতে। কোনও দিন ভাবতেও পারেনি এই মুখ একদিন চরম অভিশাপের মতো তাকে তাড়া করে বেড়াবে ক্রমাগত। এখন গণপতি তার নাম জানে।

লখন।

২।

টানা চারদিন জ্বরে ছটফট করেছিল গণপতি। মুখ পুড়ে খাক। কিচ্ছু খেতে পারছে না। পিন্ডারী বাবা পরম যত্নে কপূরের সঙ্গে নানা জড়িবুটি মিশিয়ে গণপতির মুখে প্রলেপ লাগিয়ে দিতেন। দিনে তিনবার করে খাইয়ে দিতেন গলা সুজি। ঠিক হতে প্রায় দিন দশেক লাগল। বাবা সরাসরি গণপতিকে প্রশ্ন করলেন, সে কেন তাঁর পিছু নিয়েছে? সত্যি কথাই বলল গণপতি। সে জাদুকর হতে চায়। শিষ্য হতে চায় পিন্ডারী বাবার। কিন্তু পিন্ডারী বাবা শিষ্য নেন না। যদি কিছু শেখার হয়, গণপতিকে বাবার সঙ্গে সঙ্গে থেকেই শিখতে হবে। কিন্তু লখন? লখনের কথা উঠলেই বাবা কথা ঘুরিয়ে নেন। একদিন শুধু ভুলে বলে ফেলেছেন, “ও কোই নর নেহি হ্যায় বেটা। ও পাক্কা যমরাজ আছে। উসকে সাথ তেরা কেয়া?” অনেক প্রশ্ন করেও এর বেশি কিছু জানতে পারেনি গণপতি। বাবা মুখে কুলুপ এঁটেছেন। লখনের হাবভাবও খানিক অদ্ভুত। সেও বাবার শিষ্য, কিন্তু বাবার আজ্ঞাবহ না। সে নিজের ইচ্ছেমতো চলে। মাঝে মাঝে কোথায় চলে যায় কে জানে? তিন-চার দিন ফেরে না। বাবাকে জিজ্ঞেস করলেও বাবা উত্তর দেন না। লখনকে আজ অবধি একটা কথা বলতে শোনেনি গণপতি। যে কেউ ভাববে ও বুঝি বোবা।

ঘুম থেকে কাকভোরে উঠে গণপতিকে বাবার জন্য স্নানের জল নিয়ে আসতে হয়। সেই জল গরম করতে হয় কাঠকুটো জ্বেলে। তারা তখন নেমে এসেছে হরিদ্বারে। হর-কি-পৌরি ঘাটের ব্রহ্মকুণ্ডের পাশেই এক মন্দিরের ধারে তাদের আস্তানা। বাবার বয়স হয়েছে। সরাসরি গঙ্গায় নামেন না। স্নান সেরে কিছু ফলাহার করতে না করতে ঘাটে লোকজন জনতে শুরু করে। গণপতিরাও নিজেদের কাজে লেগে যায়। লোকে বলে সমুদ্রমন্থনের সময় গরুড় যখন অমৃতভাণ্ড নিয়ে যাচ্ছিল তারই এক ফোঁটা এই ঘাটে চুঁইয়ে পড়ে। এই ঘাট তাই বড়ো পবিত্র। আর এখানে আসা মানুষরাও আসেন সবকিছু বিশ্বাস করতে, মেনে নিতে। বাবা সেই সুযোগই নেন। ঘাটের পাশেই ত্রিশূল পুঁতে উচ্চস্বরে মন্ত্র পড়তে থাকেন। ভিড় জমে যায় তাঁর চারপাশে। তখন শুরু হয় আসল খেলা।

দর্শকদের চোখের সামনে পাত্রের গঙ্গার জল রং বদলায়, কাঠের গোলা বাবাজির কথামতো গড়িয়ে গড়িয়ে এদিক ওদিক যায়, লম্বা সাদা পালক বাক্সের মধ্যে ঢুকেই হয়ে যায় ছটফটে একটা গোলা পায়রা। দর্শকদের অবাক ভাব মিটতে না মিটতে গণপতি বাবার সামনে এনে দেয় জ্বলন্ত কাঠকয়লা একটা লোহার কড়াই। সবার সামনে, যেন সুমিষ্ট কোনও ফল, এইভাবে বাবাজি একের পর এক সেই কয়লা খেয়ে চলেন। দুই হাতের করতলে তুলে নেন জ্বলন্ত দুই আংরা। তারপর হা হা করে হাসতে হাসতে সেগুলো নিয়েই জাগলিং দেখিয়ে চলেন, যেন নির্দোষ দুখানি আপেল।

গণপতি এই খেলার কায়দা শিখে নিয়েছে। ঘাটের পশ্চিম পাড়ে এক আঠালো গাছ আছে। এমন গাছ আগে কোনও দিন দেখেনি সে। এখানকার লোকেরা সে গাছের কাছে ঘেঁষে না। বাবার কাছে শুনেছে এই গাছের নাম ইস্টোরাক্স। রাতের বেলা চুপিচুপি তাকে এই গাছের আঠা নিয়ে আসতে হয়। খেলা দেখানোর আগে বাবা তাঁর জিভে আর মুখের দুইপাশে ভালোভাবে এই আঠা মাখিয়ে নেন। হাতের তালুতে মাখেন ঘৃতকুমারীর ডাঁটা আর ওল পেষাই করে। পেষাই অবশ্য গণপতিকেই করে দিতে হয়। বাবা খেলা দেখানোর জন্য কোনও টাকা নেন না। তাঁর আসল আয় ওষুধে। বিভিন্ন পেটের রোগের ওষুধ, বাতের তেল, সান্ডার তেল আর সবচেয়ে বেশি যার বিক্রি সেই শিলাজিৎ। সব পুরুষই মনে মনে জোয়ান হতে চায়। বাবা বলে চলেন, “আপলোগ ইতনে মেহনত করকে পয়সা কামাতে হো পর আপনে জওয়ানি কে উপর আপনে কভি ধ্যান দিয়া? কভি সোচা আপকি বিবি আপসে খুশ হ্যায় কে নেহি? না-খুশ বিবি মতলব পরায়া মর্দ। মেরি বাত মানো, ইয়ে লে যাও হিমালয় কা আসলি শিলাজিৎ। ইয়ে দুধ মে মিলা কর পিলো ফির অ্যায়সা খেল খেলো কে বিবি ভি পুছেগি, “ওয় মেরি জান, তুমনে আজ কেয়া খায়া?” সবাই হেসে ওঠে। কেউ শিলাজিৎ কিনতে এগোয় না। বড়োজোর দাঁত ব্যথা বা কান কটকটের ওষুধ বিক্রি হয় কিছু কিছু। বেলা বাড়ে। ভিড় হালকা হয়ে যেতে থাকে। এবারেই যেন শূন্য ফুঁড়ে উদয় হয় কিছু মানুষ। রোগা ক্ষয়াটে চেহারা থেকে তেল ঘি খাওয়া মাড়োয়ারি। বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে। জেনে নেয় নিয়মকানুন। চোরের মতো হাত পেতে পাতায় মোড়া শিলাজিৎ নিয়েই গেঁজেতে ঢুকিয়ে ফ্যালে। আর ফেলেই প্রায় দৌড়ে পালায়। কুলকাঠের ছাই আর গাবের আঠা দিয়ে তৈরি এই শিলাজিৎ কাজ না করলেও লজ্জায় কেউ অভিযোগ জানাতে আসবে না। যতক্ষণ বাবা তাঁর খেলা দেখান, প্রায় অদৃশ্যের মতো ভিড়ে মিশে থাকে লখন বাবার জাদুতে যখন সবাই আচ্ছন্ন, সবার অলক্ষে চলে তার হাতসাফাইয়ের কাজ। কারও গলার হার, গেজের টাকা, আঙুলের আংটি। কাছেই শেঠ বনওয়ারি দাসের গদি। তিনি প্রায় সিকিভাগ দামে এই চোরাই মাল কিনে নেন।

লখনকে নিয়ে একটা অস্বস্তি রয়ে গেছে গণপতির মধ্যে। ও কথা বলে কম। ছায়ার মতো এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মাঝে মনে হয় বাবাও যেন ওকে একটু সমঝে চলেন। লখন সব জাদু জানে। কিন্তু দেখায় না। জাদু দেখানো যেন ওর উদ্দেশ্য না। সবসময় অন্য কিছু ভাবছে। গণপতি আসার পরে বাবার চ্যালার কাজ পাকাপাকি গণপতিই করত।

একদিন রাতে বাবা গণপতিকে বন্ধনের জাদু শেখাচ্ছিলেন। হাতে হ্যান্ডকাফ আর দড়ি বেঁধে হাতের মোচড়ে কীভাবে মুক্ত হতে হবে। গণপতির সামান্য ভুলে হাতে হ্যান্ডকাফ প্ৰায় কেটে বসে গেছিল। বাবাজি যতই চেষ্টা করেন খোলার ততই লোহার হ্যান্ডকাফ আরও এঁটে বসে। বাবাজি প্রথমে গা করেননি। বলছিলেন “কোশিশ কর বেটা”, আর মৃদু মৃদু হাসছিলেন। শেষে গণপতি ব্যথায় প্রায় চিৎকার করে কেঁদে উঠল। তখন বাবাজি হাত লাগালেন কিন্তু ততক্ষণে লোহার আংটা হাতে চেপে বসে গেছে। নড়াতে গেলেই হাত ভেঙে যাবে। চাবি দিয়েও খোলা যাচ্ছে না। বাবাজি বললেন, একটাই উপায় আছে। গণপতিকে হাত সামনে টানটান করে হামাগুড়ি দেবার মতো বসতে হবে। গণপতি বসার চেষ্টা করার আগেই আচমকা কোথা থেকে উদয় হল লখন। তার হাত ধরে সামান্য মোচড়ে এমন করে হাতটা হাতকড়া থেকে বার করে দিল যেন অভিজ্ঞ শাঁখারি বাড়ির বউদের হাত থেকে চুড়ি খুলে নিচ্ছে। সেদিন পিন্ডারী বাবার মুখের সেই অবাক চাউনি ভুলতে পারেনি গণপতি।

সেদিন গভীর রাতে কালঘুমে ধরেছিল গণপতিকে। কিছুতেই চোখ মেলতে পারছিল না। ঘুমের মধ্যে শুধু টের পাচ্ছিল বহু মানুষের কথাবার্তা। নড়াচড়া। তার অঙ্গ অসাড়। কানের কাছে ভোঁ ভোঁ করছে। খুব আবছা লখনের গলা শুনতে পাচ্ছিল সে। একদল লোকের সঙ্গে লখন কথা বলছে। বাকিদের মুখে কথা নেই। তারা যেন চুপ করে শুনে যাচ্ছে লখনের কথা। মাঝে মাঝে লখনের গলা চড়ছে। আবার খাদে নেমে যাচ্ছে। গভীর কোনও শলাপরামর্শ চলছে সবাই মিলে। বাবাজি কোথায়? তিনিও কি ঘুমে কাতর? লখন কী বলছে গণপতি তা বুঝতে পারছে না। তবে এটুকু পরিষ্কার, লখন চোস্ত ইংরাজিতে কথা বলছে। এমন ইংরাজি খাঁটি সাহেব ছাড়া কারও মুখে শোনেনি গণপতি। তার চোখ ঘুমে ঢলে এল। তারপর আর কিছু মনে নেই…….

জ্ঞান ফিরল ঠান্ডা জলের স্পর্শে। গঙ্গার ঠান্ডা জল বারবার এসে তার পা ধুইয়ে দিয়ে যাচ্ছে। মাথা ব্যথায় ফেটে পড়ছে। একটু সাড় পেতেই বুঝল কেউ তাকে ঘাটের ধারে ফেলে রেখে গেছে। এখন ভোররাত। পুব আকাশ ফরসা হব হব করছে। আর একটু পরেই একে একে পুণ্যার্থীরা ভিড় জমাবে ঘাটে। অতিকষ্টে হাতে ভর দিয়ে উঠে বসল গণপতি। দুই হাতে বিষ ব্যথা। উঠে বসতেই পায়ে শক্ত মতো কী যেন ঠেকল। আর-একটা পা। ডান পা। লোমশ। এই পা সে চেনে। প্রতি রাতে এই পা ঘণ্টাখানেক টিপে দিলে তার ঘুমের অনুমতি মিলত। কিন্তু এখন এই পা বেয়ে চ্যাটচ্যাটে তরল গড়িয়ে পড়ছে। রক্ত। আকাশে ধীরে ধীরে আলো ফুটছে। পিন্ডারী বাবা ঘাটে চিৎপাত হয়ে শুয়ে। চোখদুটো খোলা। আকাশের দিকে তাকানো। বুকের পাঁজর থেকে নিচ অবধি সরাসরি দেহটা দুফালা করে দিয়েছে কেউ বা কারা। নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে হর-কি-পৌরির ঘাটে। বাবার পাশেই রাখা সেই তলোয়ারটা, যেটা খেলাচ্ছলে প্রায়ই পেটে ঢুকিয়ে দেন তিনি। এবার সেটা তাঁকে করেছে। তড়াক করে উঠে দাঁড়াল গণপতি। তার খালি গায়ে, পরনের খাটো ধুতিতে রক্তমাখা। দুই হাতে রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধেছে। ভোর হয়ে গেছে। এবারে সবাই এসে তাকে এভাবে দেখতে পাবে। এখন উপায়?

“হাজতে যাবি, না আমাদের কথা শুনবি?” পরিষ্কার বাংলায় প্রশ্ন এল ঘাটের একধার থেকে। ঘাটের পাশের মন্দিরের দেওয়ালের আড়াল থেকে অশরীরীর মতো বেরিয়ে এল লখন। তার সঙ্গে দুই ছোকরা সাহেব, যাদের গণপতি আগে কোনও দিন দেখেনি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *