খেলাঘর

খেলাঘর

একটা বেলুন পাওয়া গেছে। তুয়া সেটা নিয়ে গাড়িতে উঠেছে।

অভিষেক সেটা দেখে ভ্রু কুচকাল কিছু বলল না।

ঊর্মি বিরক্ত গলায় বলল “বেলুন নিয়ে গাড়িতে উঠলি কেন আবার?”

তুয়া উত্তর দিল না। এ প্রশ্নের উত্তর হয় না।

ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিল।

ঊর্মি মনে মনে বলল “দুর্গা দুর্গা”।

গাড়ির পিছনের সিটে তুয়া আর ঊর্মি বসেছে।

ঊর্মি বলল “মেয়েটাকে ফোন করেছো?”

অভিষেক বলল “হ্যাঁ। এয়ারপোর্টে পৌঁছে যাবে”।

ঊর্মি বলল “ওকে”।

তুয়া বেলুনটা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। মার কথাটা তার কানে গেছে। সে বলল “কোন মেয়ে মা?”

ঊর্মি বলল “তোমার এক পিসি”।

প্লেন বাগডোগরায় নেমেছে। গাড়ি জোগাড় হয়ে গেছে।

জানা গেছে মেয়েটার নাম বিথী। তুয়া বিথীকে বিভিন্ন প্রশ্ন করছে। বিথী উত্তর দিয়ে যাচ্ছে।

গাড়ি পাহাড়ের রাস্তা ধরল দুপুর এগারোটায়।

সাড়ে তিনটে নাগাদ তারা কালিম্পং পৌঁছল।

দুটো ঘর নেওয়া হয়েছে। একটা ঘরের থেকে আরেকটা একটু দূরে।

ঘরে ঢুকে তুয়া প্রথম প্রশ্ন করল, “মা, বাবা বিথী পিসির সঙ্গে কেন থাকবে?”

অভিষেক জানলার ধারে একটা চেয়ার নিয়ে বসে আছে। দূরে পাহাড় দেখা যাচ্ছে।

বিথী ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বলল “এখন কোন প্ল্যান আছে?”

অভিষেক বিথীর দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে বলল “তোমার আসল নাম কী?”

বিথী চমকাল না। খাটের ওপর বসে স্বাভাবিক গলায় বলল “সেটা বলা যাবে না”।

 অভিষেক হাসল “ঠিক আছে। বোল না। বি আনড্রেসড”।

বিথী উঠে দাঁড়িয়ে পরনের সব পোশাক খুলে ফেলল। অভিষেক বিথীর দিকে তাকিয়ে বলল “দাঁড়িয়ে থাক”।

বিথী নড়ল না। দাঁড়িয়ে রইল।

অভিষেক উঠে দাঁড়িয়ে বিথীর গালে চুমু খেল। শরীর স্পর্শ করে বলল “তুমি অভিজ্ঞ। আমাকে জাগাও তো দেখি”।

বিথী অভ্যস্ত ভঙ্গিতে অভিষেকের ঠোঁটে আঙুল রাখল। অভিষেক বিথীর ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে যাচ্ছিল এমন সময় তার কটেজের কলিং বেল বেজে উঠল। বাইরে থেকে তুয়ার গলার স্বর ভেসে এল “বাবা, তাড়াতাড়ি এসো। আমরা হাঁটতে বেরব”।

বিথী ঘরে থেকে গেল। তুয়া, অভিষেক আর ঊর্মি হাঁটতে বেরিয়েছে।

তুয়া অভিষেককে বলল “বাবা, ওই আন্টি আর তুমি একসাথে থাকছ কেন?”

অভিষেক ঊর্মির দিকে তাকাল। ঊর্মি অভিষেকের দিকে থমথমে মুখে তাকিয়ে বলল “এর উত্তরটা তুমিই দাও”।

অভিষেক তুয়াকে কোলে তুলে বলল, ” মা, আন্টির সাথে আমার অফিসের কাজ আছে”!

পরক্ষণেই কথা ঘোরাল, “চল, আমরা খেলনা কিনি তোমার জন্য”।

তুয়া ভুলল না, বলল “তুমি রাতেও কাজ করবে”?

অভিষেক বলল “হ্যাঁ, অনেক কাজ আছে”।

ঊর্মি বলল ” মেয়েকেও সত্যিটাই বলে দাও। লুকনোর তো কিছু নেই।”

অভিষেক উত্তর না দিয়ে হাঁটতে থাকল।

বাজারে এল তারা কিছুক্ষণ পরে। ঊর্মি বলল “তুমি প্রোটেকশন ইউজ করছ?”

অভিষেক বলল “আমি এখনও কিছু করি নি”।

ঊর্মি বলল ” বিশ্বাস করি না”!

অভিষেক বলল “কোর না, কেউ মাথার দিব্যি দেয় নি”।

ঊর্মি আর কিছু বলল না।

বেল বাজালে বিথী দরজা খুলল। ঊর্মি আর তুয়াকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে এসেছে অভিষেক।

বিথী একটা শর্টস পরে আছে। অত্যন্ত আকর্ষণীয় চেহারা।

অভিষেক ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বলল ” ঘুমোলে?”

বিথী মাথা নাড়ল। বলল “আপনি কিছু করবেন?”

অভিষেক বিরক্ত হয়ে বলল “করা ছাড়া আর কিছু ভাবো না?”

বিথী যন্ত্রের মত বলল “সেটাই তো আমার কাজ। ভাবার সময় নেই”।

অভিষেক এগিয়ে গিয়ে বিথীকে চুমু খেল। সেকেন্ড তিনেক পরে তেতো গলায় বলল “মুখে পেঁয়াজের গন্ধ আসছে”।

বিথী বলল ” ব্রাশ করেছিলাম। গন্ধটা যায় নি। চুমুটা এখন বাদ দিন”।

অভিষেক বলল “ঠোঁট না ছুঁলে প্রেম হয় না’, আমার এই কবিতাটা পড়েছ?”

বিথী বলল “আপনি কবি?”

অভিষেক দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

হোম স্টের ডাইনিং রুম। ঊর্মি, অভিষেক একসঙ্গে বসেছিল। তুয়া বিথী তাদের উল্টোদিকে।

তুয়া বিথীকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে যাচ্ছে। “আন্টি তুমি কোথায় থাকো”,

“আন্টি তোমার বাড়িতে কে কে আছে?”

ঊর্মি তীক্ষ্ণ চোখে বিথীর দিকে তাকিয়ে রইল।

খাওয়া হয়ে গেলে তুয়া আর বিথী হাঁটতে বেরোল।

ঊর্মি হোমস্টের বাইরের বসার জায়গায় বসে অভিষেককে বলল “তারপর? কিছু লিখতে পারছ?”

অভিষেক সিগারেট ধরিয়ে অন্যমনস্ক গলায় বলল “নাহ”!

ঊর্মি বলল “তাহলে লাভ কী হল?”

অভিষেক বলল “প্ল্যানটা তোমার। তুমিই বুঝবে”।

ঊর্মি বলল ” শরীর সাড়া দেয় না তোমার আমার সঙ্গে থাকলে। এছাড়া আর কী প্ল্যান দেব তোমায়?”

অভিষেক বলল “কবিতা শরীরে সাড়া দেয় না। ভালবাসায় সাড়া দেয়”।

ঊর্মি অভিষেকের দিকে তাকিয়ে বলল “কেমন ভালবাসা চাও তুমি?”

অভিষেক কথা না বলে স্মোক করতে লাগল।

ঠান্ডা পড়ছিল।

বীথিকে তুয়াকে নিয়ে ফিরে এল।

ঊর্মি বীথিকে বলল “তোমার ঠান্ডা লাগছে না?”

বীথি উত্তর না দিয়ে অভিষেকের দিকে তাকিয়ে বলল “আমি ঘরে গেলাম”।

তুয়া বলল “আমিও আন্টির সাথে যাব”।

ঊর্মি তুয়াকে চড় মারল।তুয়া কাঁদতে শুরু করল।

অভিষেক তুয়াকে কোলে নিয়ে ঊর্মিকে বলল “মারছ কেন?”

ঊর্মি বলল “অত দরদ দেখাতে হবে না পরের মেয়েকে। দাও আমার কোলে দাও”।

তুয়া অভিষেককে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল।

অভিষেক বলল ” থাক। আমি ওকে ঘুম পাড়িয়ে তারপর যাব”।

ঊর্মি নিজেদের কটেজের দিকে রওনা দিল।

তুয়া ঘুমিয়েছে। ঊর্মি বলল “যাও, তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে”।

অভিষেক বলল “যাব। তোমার ভয় লাগবে না তো?”

ঊর্মি বলল “কেন, ভয় লাগলে তুমি থাকবে বুঝি?”

অভিষেক বলল “তুমি চাইলে থাকব”।

ঊর্মি বলল ” নাহ। যাও। মেয়েটা একা আছে”।

অভিষেক বলল “তোমার কি কিছুই হয় না? অ্যাটলিস্ট আমাদের কল্পনা করেও?”

ঊর্মি বলল “হয় না। আমার কিচ্ছু হয় না। আমার তোমাকে দেখে কিছু জাগে না। দেখো এই অনিচ্ছা দেখে তোমার কোন লাইন মাথায় আসে নাকি”।

অভিষেক বলল ” জাগা শুনলে আমার হাগা ছাড়া আর কোন লাইন মাথায় আসছে না আপাতত”!

ঊর্মি হেসে বলল “দেখো, বীথিতে ঘুরে টয়লেট হিউমার থেকে উত্তরণ করতে পারো নাকি”।

অভিষেক বলল ” দেখি”।

#

বীথি দরজা খুললে অভিষেক বীথির ঠোঁটে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বীথি বাঁধা দিল না। অভিষেক সন্তর্পণে দরজা বন্ধ করে বীথিকে খাটে শোয়াল। নগ্ন করল। গোটা শরীরে চুমু খেতে লাগল।

বীথি শীৎকার করে অভিষেকের চুল আঁকড়ে ধরল। অভিষেক হঠাৎ সব কিছু থামিয়ে বলল “তুমি অভিনয় করছ, তাই না? ফেক অরগাজম?”

রাত তিনটে। বীথি তার পাশে ঘুমিয়ে আছে।

অভিষেকের ঘুম আসছিল না। সে আলো জ্বালল। বীথি কম্বল জড়িয়ে শুয়ে আছে। অভিষেক কম্বল সরালো। সম্পূর্ণ নগ্ন মেয়েটা শুয়ে আছে।

কবিরা সোনাগাছি যায় তো। এক কবি লিখেছিলেন সোনাগাছিতে গিয়ে কোন নগ্ন বারবনিতার কোলে মাথা রেখে শুয়ে তাকে মা ডেকেছিলেন।

অভিষেকের হাসি পেল এত রাতেও।

কবি মানেই কি ন্যাকা হতে হবে?

অমিতের ঘুম পাচ্ছে। খিদেও পাচ্ছে।

আগে খাবে না ঘুমিয়ে নেবে বুঝতে পারছে না।

টিভিটা অকারণে চলছে। বন্ধ করতে ইচ্ছা করছে কিন্তু পারছে না।

অমিত কবিতা লিখতে বসেছিল। “দ্রোহপত্র” লিটল ম্যাগের জন্য।

সম্পাদক বলেছেন নরম কবিতা দিতে।

 অমিত লিখেছিল

“স্তনের মত ছড়িয়ে পড়ুক তোমার পরিচয়,

বাসলে ভাল সবাই কেন মায়ের মত হয়”?

সম্পাদক স্তন বাদ দিতে বলেছেন কবিতা থেকে। স্তনে অনেকের অনুভূতিতে লাগে। স্তন, নাভি এগুলো নাকি পর্ণোগ্রাফি হয়ে যাচ্ছে। আজকাল কবিতা লিখতে হলে অনেক কিছু বাদ দিয়ে লিখতে হয়। মানুষের অনুভূতি আর স্তনবৃন্ত এক হয়ে গেছে। নাড়া দিলেই জেগে ওঠে।

ফোন বাজছে। অমিত ঘড়ি দেখল। অবাক হল। প্রায় ভোর রাত হতে চলেছে। কে ফোন করবে?

সে ফোন দেখে হাই তুলল। অভিষেক। নির্ঘাত লিখতে পারছে না।

অমিত ফোন কেটে দিল। অভিষেক মেসেজ করেছে “মেয়েটা ল্যাংটো হয়ে ঘুমাচ্ছে। এখন তোলা ঠিক হবে?”

অমিত উত্তর দিল না। অভিষেকের মধ্যে আবার পাগলামি ফিরে আসছে। সে আর এই পাগলামির প্রশ্রয় দিতে চায় না।

এর আগে ঊর্মিকে নিয়ে পালাবার সময়েও সে সাহায্য করেছিল।

ঊর্মির বর নীলাদ্রি নিরীহ লোক। তার কাছে কেঁদে ফেলেছিল।

অমিত অভিষেকের থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করে।

অভিষেক দেয় না।

তাকে জড়াবেই। এবারেও কালিম্পং নিয়ে যেত তাকে। শেষ মুহূর্তে পালিয়েছে।

অমিত ফোন অফ করে দিল।

অভিষেককে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না।

কিছুতেই না।

১০

সকাল ন’টা।

চারজন ডাইনিং রুমে এসেছে। ভোর রাতের দিকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে কালিম্পঙে। তার সঙ্গে হাওয়া। ঠান্ডায় কাঁপছে তুয়া। অভিষেক তুয়াকে কোলে নিয়ে বসেছে।

ঊর্মি বীথীকে জিজ্ঞেস করল “ঘুম হয়েছে?”

বীথী মাথা নাড়ল।

ঊর্মি অভিষেকের দিকে তাকাল “তোমার কবিতা বেরোল?”

অভিষেক ঊর্মির কথার উত্তর না দিয়ে তুয়াকে বলল “আজ তো পাহাড় দেখা যাবে না বাবু। কী হবে আজকে?”

তুয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বলল “পচা জায়গা। আমি বাড়ি যাব”।

অভিষেক তুয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল “যাবে তো বাবু। বাড়ি গেলেই তো ছুটি খতম। যত বেশি দিন থাকা যায়, তত ভাল, তাই না? তোমার আবার আন্টি পড়াতে চলে আসবেন, সেটা ভাল হবে?”

তুয়া মুখ গোমড়া করল।

ব্রেড, বাটার, অমলেট, স্যুপ, দুধ, কর্ণফ্লেক্স, জ্যুস।

তুয়াকে পাশের সিটে বসাল অভিষেক।

ঊর্মি বীথীকে বলল “তোমার ঠান্ডা লাগে না? এই ঠান্ডাতেও ক্লিভেজ বের করে আছো?”

বীথী অভিষেকের দিকে তাকাল। অভিষেক হাসল “সবাই তো তোমার মত ঠান্ডা মেরে যায় না ঊর্মি”।

ঊর্মি বলল “এখন নিশ্চয়ই আবার ঘরে ঢুকে যাওয়ার প্ল্যান করছ?”

অভিষেক বলল “হ্যাঁ। এছাড়া আর কী করব? এই ওয়েদারে তো কোথায় যাওয়া যাবে না”।

তুয়া বলল ‘আমরা খেলব না বাবা?”

অভিষেক বলল “তোমায় মা এখন পড়াতে বসাবে। একটু পড়ে নাও। তারপর খেলি। কেমন?”

ঊর্মি বলল “আমি পড়াব?”

অভিষেক বলল “হ্যাঁ। এনগেজ রাখতে হবে তো”।

ঊর্মি গম্ভীর মুখে খেতে লাগল।

১১

বৃষ্টি পড়ছে খুব জোরে।

বীথী জানলার কাছে শাল জড়িয়ে বসে আছে।

অভিষেক খাটে নোটবুক আর পেন নিয়ে বসে আঁকিবুঁকি কাটছে।

বীথী বলল “আপনি কোন কোন কাগজে লিখেছেন?”

অভিষেক বলল “বেশ কয়েকটা। আজকাল বেরোচ্ছে না লেখা। সম্পাদকরা বলছে আমার লেখা মনোটোনাস হয়ে যাচ্ছে। ছন্দ ব্যাকডেটেড”।

বীথী বলল ” এই বৃষ্টিতে কিচ্ছু মাথায় আসছে না?”

অভিষেক বলল “না। ঘুরে ফিরে ছন্দে চলে যাচ্ছি”।

বীথী বলল ” কী রকম শুনি?”

অভিষেক মাথা নাড়ল “ধুস। কিছু হয় নি। তুমি এদিকে এসো”।

বীথী উঠে অভিষেকের সামনে এসে বসল। অভিষেক বীথীর চুলে হাত দিয়ে বলল ” স্পা কর?”

বীথী বলল “হ্যাঁ”।

অভিষেক বলল ” আমিও করি। আমার চুল কেমন লাগে তোমার। হাত বুলিয়ে দাও তো”।

বীথী কোন প্রশ্ন না করে অভিষেকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। অভিষেক বলল “আমার ঘামের গন্ধ ভাল লাগে। এখানে ঘাম হচ্ছে না”।

বীথী হাসল।

অভিষেক বলল ” একটু বরফ আনাই? নিপলে ঘষব”।

বীথী বলল “আনান”।

অভিষেক বলল ” তোমার ঠান্ডা লাগবে না?”

বীথী বলল “আপনার নিপলে ঘষবেন তো? আমার কথা বললেন নাকি?”

অভিষেক হেসে ফেলে বলল “তুমি রসিক। ইউ ডু হ্যাভ সেন্স অফ হিউমার। অনেকের থাকে না।”

বীথী বলল “অনেকের টাকা থাকে, আমার থাকে না”।

অভিষেক বলল ” কেন? অনেক টাকা পাবে তো এই ট্যুরটায়?”

বীথী বলল “এজেন্সিই হাফ খেয়ে নেবে”।

অভিষেক বলল ” শিট। আচ্ছা আমি তোমায় আলাদা করে দেব আরো।”

বীথী বলল “দেবেন। ভালই হয়।”

অভিষেক বলল “তোমার হিস্ট্রি কী? বাড়িতে কে অসুস্থ?”

বীথী বলল “কেউ না। জাস্ট গরীব। এবং বাজে পরিবার। একদিন এইডসে মরে যাব। এর বেশি কী হবে?”

অভিষেক বীথীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল “সবাই মরে যাব। কেউ এইডসে, কেউ একাকীত্বে”।

বীথী বলল ” আপনি একা?”

অভিষেক বলল “আমি একজনের বউ বাচ্চা ভাগিয়েছি। তার সেক্সুয়াল ফ্রিজিডনেস আছে জেনেও তাকে আমি ভালবেসেছি। তার মেয়ে আমাকেই বাবা হিসেবে জানে। তবু আমি একা। কেন একা?”

বীথী বলল “আপনি সেক্সুয়ালি ফ্রাস্ট্রেটেড”।

অভিষেক বলল ” কেন? আমার কি লিঙ্গ ছোট? ঠিকই আছে না?”

বীথী হেসে বলল “না না। সেসব না।”

অভিষেক বলল “এসো চুমু খাই। জিভে জিভ মিশুক। রেকর্ড করি চল দীর্ঘতম চুমু খাওয়ার”।

১২

জাহ্নবী লিখেছে “প্রেম পাচ্ছে। করবে?”

অমিত মেসেজটা দেখে লিখেছে “কবি মাত্রেই বদ। বদ লোকের সঙ্গে প্রেম করবে?”

জাহ্নবী লিখল “আমিও তো বদ। ভাল কোথায় বললাম”?

অমিত- “বদ সবাই হতে পারে না। তুমি তো আরও পারবে না। তুমি ভালবেসে ফেলো। আর তুমি আমার কী দেখে ভালবাসলে? পাগলামি দেখে? আসলে আমি কিন্তু খুব বোরিং একজন লোক”।

জাহ্নবী-“আমিও। লেটস মেক লাইফ মোর বোরিং”।

অমিত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ফেসবুক আসার পর এসব বেড়েছে। এত প্রেম পায় কোথায় এরা? পায়খানা পরিষ্কার হয় এদের? তার তো হয় না। ডাক্তার বলেছে ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম হয়েছে।

সে নাম দিয়েছে ইরিটেবল বাওয়াল সিন্ড্রোম। সকালে যখন কমোডে বসবে তখন মনে হয় পেছনে কেউ সিমেন্ট দিয়ে রেখে দিয়েছে। ঘর থেকে বেরনোর পরে বেজায়গায় বজ্র বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টির মত পেট ডেকে ওঠে। শহরের বিভিন্ন সুলভ শৌচাগার, শপিং মলের বাথরুমে অমিতের অবাধ যাতায়াত। টালিগঞ্জের সুলভের দারোয়ানটা তাকে চিনেও গেছে। মাঝে মাঝে টাকা নেয় না। ডেইলি প্যাসেঞ্জার ডিসকাউন্ট দেয় আর কী।

জাহ্নবী পিং করছে। অমিত লিখল “ভালবাসব না তোমার চোখ দুটো দেখে/না হয় বাসব না তোমার ঠোঁটের আদরে/ কোনদিন ভাসিও সমুদ্র প্লাবনে/ থেকো সাথে ভিজে গায়ে ওমের চাদরে”।

জাহ্নবী কবিতায় লাভ রিয়্যাকশান দিয়ে লিখল “আই লাভ ইট। ইউ আর এ ম্যাজিসিয়ান”।

অমিত- “বাজার হয় নি এখনও। কী খাব বল তো?”

– (হাসি ইমোজি দিয়ে) আমায় খেয়ে যাও।

– তুমি আগের দিন অভিষেকের কবিতাতেও দেখলাম ভাল ভাল কমেন্ট করেছ। সবার কবিতাই তোমাকে ভালোবাসায়?

– (রাগ) তোমারটা সব চেয়ে বেশি।

– দু লাইনে কবিতা হয় না। তোমরা আসলে প্রেমে পড়ার বাহানা খোঁজো জাহ্নবী।

– খুঁজি। তুমি জানো না তুমি কীভাবে আমাকে ছোঁও।

– আচ্ছা, একগাদা গদগদ কমেন্টের ভিড়ে তোমারও গদগদ কমেন্ট দিতে, লাভ ইউ লিখতে একবারও গা ঘিন ঘিন করে না তোমাদের?

– তুমি হিংসুটে।

– তা ঠিক। কিন্তু বল না, গা ঘিন ঘিন করে না। এত আদরবাসা টাইপ করতে? কী পাও?

জাহ্নবী রিপ্লাই দেওয়া বন্ধ করে দিল।

অমিত বুঝল রেগে গেছে। সে স্ট্যাটাস দিল

“শরীর বলতে শরীর বুঝো,

খামোখা ভালোবাসার নামে

নিমকি ছেনালি করতে এসো না”।

মিনিট পাঁচেকে লাইক একশো, শেয়ার চল্লিশ।

অমিত মনে মনে বলল “মাদারচোদ ফেসবুক শালা”।

১৩

“আমি বহুগামী।

বহুগামিতা রোগ নয়।

অপরাধ বলে সবাই,

ধর্মাবতার…”

এই অবধি লিখে থেমে গেল অভিষেক। কী বিচ্ছিরি পরিস্থিতি! এটা কিসসু হচ্ছে না।

বীথীর নগ্ন পিঠের ওপর নোটবুক রেখে লিখছে সে।

বীথী খোলাচুলে শুয়ে আছে।

কোমর অবধি চুল বীথীর।

অভিষেক বীথীর পিঠে হাত বুলিয়ে বলল “তোমার সম্পর্কে কিছু বল শুনি”।

বীথী বলল “কিছু বলার নেই”।

অভিষেক বলল “সংসার করার ইচ্ছে হয় না?”

বীথী হেসে বলল “তারপর আমার লোকটা আরেকটা বীথীর সাথে শুয়ে বেড়াবে?”

অভিষেক বলল “পয়েন্ট টু বি নোটেড। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের এক নারীতে হয় না। আমি তাদের দলে পড়ি”।

বীথী বলল ” আপনিও তবে একদিন এইডসে মারা যাবেন”।

অভিষেক বলল “হয়ত৷ কী আর হবে? পাপ কমবে একটা৷ মেয়েটার জন্য কষ্ট পাব। বড় মায়াবী মেয়েটা”।

বীথী বলল ” হ্যাঁ। কী করছে এই বৃষ্টিতে?”

অভিষেক বলল “মার খাচ্ছে হয়ত। মেয়েটা বড় মার খায়।”

বীথী বলল “এইটুকু বাচ্চা?”

অভিষেক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল “মায়ের ফ্রাস্ট্রেশন, মেয়ের ওপর পড়ে। কিছুক্ষণ পর মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবে। আবার মারবে। আবার কাঁদবে। সংসার ভীষণ নিষ্ঠুর। আমার ঊর্মিকে নিয়ে পালানোটা ঠিক হয় নি”।

বীথী বলল “খুব ভালবাসেন?”.

অভিষেক হাসল। বীথীর পিঠে মুখ রেখে এগিয়ে গিয়ে ঘাড়ে চুমু খেল৷ বীথী বলল ” আপনার সাথে শোয়ার একটাই ভাল দিক। আপনি লাভ মেকিং জানেন”।

অভিষেক বীথীর চুলে মুখ ডুবিয়ে বলল “কবিরা প্রেম করতে জানে তো”।

বাইরে বাজ পড়ল একটা খুব জোরে।

আর্তনাদ ভেসে এল।

অভিষেক ধড়মড় করে উঠে জামা পরতে পরতে বলল ” মেয়েটা ভয় পায় খুব। তুমি থাকো, আমি দেখে আসি।”

১৪

সকাল সাড়ে দশটা। অমিত শুয়ে শুয়ে ফ্যানের গায়ে লেগে থাকা নোংরা দেখছিল।

ফ্যানে নোংরা জমছে। ভাল ব্যাপার না। তার উচিত পরিষ্কার করা, কিন্তু পোষাচ্ছে না। অনেক পরিশ্রম। সব থেকে বড় ব্যাপার তার ডাস্ট অ্যালার্জি আছি। পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখা গেল নাকে ধুলো ঢুকে হাঁচি শুরু হল। একের পর এক হাঁচি হতে থাকে তার।

কলিং বেল বেজে উঠল। অমিত বিরক্ত হল।

এখন আবার কে এল? খাট থেকে উঠতে হবে।

সে উঠল না। কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে দেখল আবার বাজছে।

বিরক্ত মুখে দরজা খুলে অবাক হয়ে দেখল নীলাদ্রি দাঁড়িয়ে আছে।

সে বলল “তুমি? এখন?”

নীলাদ্রি বলল “শুনলাম অভিষেক ওদের নিয়ে বেড়াতে গেছে। তুমি জানো?”

অমিত সতর্ক হল। ঊর্মি চলে যাওয়ার পর থেকে নীলাদ্রি সামান্য সাইকোটাইপ হয়ে গেছে। বলল “না তো। আমি জানি না কিছু। কে বলল তোমায়?”

নীলাদ্রি তার তোয়াক্কা না করে ঘরের ভিতর ঢুকে একটা চেয়ার টেনে বসে বলল “সব জানি। খবর এসে গেছে”।

অমিত বলল “তুমি এখন অফিস যাও না?”

নীলাদ্রি বলল “কার জন্য রোজগার করব? বউ আর মেয়েই তো নেই। পরিবারই নেই। কার জন্য রোজগার করব বল? চাকরি করেই বা কী হবে?”

অমিত কী বলবে বুঝতে পারবে না। তার সামনে একটা পুরোপুরি হেরে যাওয়া মানুষ বসে আছে যার বউ পালিয়েছে অন্য পুরুষের সঙ্গে।

নীলাদ্রি একটা জংলা জামা পরে আছে। জামার একটা বোতাম নেই আবার। এই ছেলেটাকে দেখে কে বলবে আগে একে দেখে চেনাই যেত না। ব্যস্ত কর্পোরেট। বউ, ছোট মেয়েকে সময় দিতে পারত না। কখন যেন অভিষেক বন্ধু হয়ে গেল ঊর্মির। এত জটিল সম্পর্ক অমিত বুঝেও বুঝতে চায় না।

নীলাদ্রিকে বলল “কিছু খাবে?”

নীলাদ্রি বলল “উত্তরবঙ্গ যাব ভাবছি। অনেকদিন ওদের দেখি না”।

অমিত চমকে উঠল।

১৫

ঊর্মিদের কটেজে আসতে আসতে অভিষেক ভিজে গেল।

দরজা নক করতে ঊর্মি দরজা খুলল। অভিষেক বলল “চ্যাচাল কে?”

ঊর্মি তেতো গলায় বলল “তুয়া। ভয় পেয়েছে আর কী”।

তুয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। অভিষেক তুয়াকে কোলে নিতে গেল।

ঊর্মি বলল “চেঞ্জ করে হাত ধুয়ে নাও আগে। কী না কী ধরেছো”।

অভিষেক থমকে গেল। বাথরুমে গিয়ে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে টি শার্ট চেঞ্জ করে তুয়াকে কোলে নিল। তুয়া বলল “মা মারছে”।

ঊর্মি তুয়ার দিকে আগুনে চোখে তাকাল।

অভিষেক তুয়াকে কোলে নিয়ে পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে বলল “আচ্ছা বাবু। কাঁদে না। আমরা মজন্তালি সরকারের গল্প শুনি এবার? কেমন? নাকি লালকমল নীলকমলের গল্প শুনবে?”

ঊর্মি গজগজ করে বলল “তুমি ও ঘরে যাও, আমি আমার মেয়েকে সামলাতে পারি”।

অভিষেক বলল “কেমন সামলাচ্ছো তা তো দেখতেই পারছি। এটুকু একটা বাচ্চাকে মারতে হচ্ছে”।

ঊর্মি বলল “বেশ করব। আমার মেয়ে, আমি যা ইচ্ছা করব”।

অভিষেক খাটে বসে বলল “তা করবে কিন্তু যে রাগে তুমি ওকে মারছ, সেটা তো তুমি বলেছিলে বলেই আমি করেছি”।

ঊর্মি বলল “তুমি যেন চাও নি। প্রতি রাতে বারবার বলেছ এভাবে হয় না। লিখতে পারছ না, ইন্সপিরেশন পাচ্ছো না। আমি কী করব? তুমি না চাইলে তুমি মেয়েটাকে আনতে?”

অভিষেক তুয়ার দিকে তাকিয়ে গলা তুলে বলল “ঘরে কে জাগে?”

তুয়া হাসিমুখে চোখ বড় বড় করে বলল “লালকমলের আগে নীলকমল জাগে, আর জাগে খোলা তলোয়ার”।

ঊর্মি ক্লান্ত মুখে কাঁচের জানলার বাইরে বৃষ্টি দেখতে লাগল।

১৬

নীলাদ্রি অস্থির মুখে এয়ারপোর্টে বসে আছে।

অমিত বলল “তোমার মুভ অন করা উচিত ছিল নীলাদ্রি”।

নীলাদ্রি বিভ্রান্ত মুখে অমিতের দিকে তাকিয়ে বলল “আমি মুভ অন করে গেছি। মেয়েটার কথা মনে পড়ে। নিজের রক্ত তো”।

অমিত বলল “বেশ তো। ব্যাপারটা জটিল করার তো কোন দরকার ছিল না। অভিষেকের সঙ্গে কথা বললেও ও মেনে নেবে। খামোখা সেবার গুন্ডা পাঠাতে গেলে কেন?”

নীলাদ্রি মাথায় হাত দিয়ে বলল “ভুল হয়ে গেছে। আমার আসলে মাথা কাজ করে না। নিজেকে কেমন হেরে যাওয়া মানুষ মনে হয়। মনে হয় রাস্তায় সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বউ পালানো মানুষ মানেই তো হাসি ঠাট্টার জিনিস, তাই না?”

অমিত বলল “কিছুই তাই না। তুমিও একটা ভাল দেখে মেয়ে দেখে জমিয়ে প্রেম করতে। জ্বলে যেত ঊর্মি”।

নীলাদ্রি বলল “চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু অপরাধী মনে হয় নিজেকে মেয়ের মুখটা মনে পড়লে”।

অমিত বলল “রাবিশ, চল বিয়ার খাই”।

নীলাদ্রি উঠল। দুজনে বিয়ার পাবে গিয়ে বসল। এক সুন্দরী বেশ আগ্রহী মুখে অমিতের দিকে তাকিয়ে আছে। অমিতের চেনা চেনা লাগছিল। এগিয়ে গিয়ে বলল “আমি কি আপনাকে কোথাও দেখেছি?”

মেয়েটি বলল “আমি অভিনয় করি। আপনার গল্প নিয়ে রিসেন্ট যে সিনেমাটা ফ্লপ করল, আমি তার হিরোইন ছিলাম”।

অমিত মুখ কুঁচকে বলল “ঈশ, আপনার কেরিয়রটা ফুটুর ডুম করে দিলাম বলুন”।

মেয়েটি বলল “নাহ। থ্যাঙ্কস টু ইওর সাহসী দৃশ্য। লোকজন আমাকে ভালই কাস্ট করছে এখন”।

অমিত দেখল নীলাদ্রি মাথা নিচু করে বসে আছে। সে বলল “আপনার নাম কী যেন?”

মেয়েটি বলল “তারা। তারা মালহোত্রা”।

অমিত বলল “অবাঙালি? কথা শুনে তো বাঙালিই লাগছে”।

তারা বলল “তিন পুরুষ শিলিগুড়ি। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”

অমিত বলল “নর্থ বেঙ্গল। আপনি?”

তারা বলল “আমিও। বাড়ি যাব”।

অমিত বলল “বেশ। আচ্ছা আমি যাই, ও একা বসে আছে”।

তারা হেসে বলল “ওকে ডাকতে পারেন এখানে। প্রবলেম নেই। একা একা বসে আছি”।

অমিত নীলাদ্রিকে ডাকল।

নীলাদ্রি এসে আগ্রহী মুখে তারাকে দেখল।

অমিত পরিচয় করিয়ে দিল।

নীলাদ্রি হাত জোর করল।

তারা বলল “আপনিও লেখেন?”

নীলাদ্রি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল “না না, আমি লিখি টিখি না। আমি একজন ব্যর্থ মানুষ। হেরে যাওয়া মানুষ”।

তারা অবাক হয়ে অমিতের দিকে তাকাল।

অমিত হাসি হাসি মুখে তারার দিকে তাকিয়ে রইল।

১৭

লাঞ্চ দিয়েছে। তুয়া ঘুমিয়ে পড়েছিল। অভিষেক কোলে করে ডাইনিং রুমে নিয়ে এসেছে।

ঊর্মি আর বীথী বসেছে। অভিষেক তুয়াকে খাইয়ে দিচ্ছে৷ তুয়া খেতে চাইছে না, অভিষেক গল্প শোনাতে শোনাতে খাওয়াচ্ছে।

দুজন ছেলে এসেছে ডাইনিং রুমে। পরস্পরকে চুমু খাচ্ছে। খুনসুটি করছে।

গে কাপল।

ঊর্মি কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলল “যত উলটো পালটা যায়গায় এলাম”!

অভিষেক বলল ” কেন? উলটো পাল্টার কিছু নেই তো। আদর করবে এতে উল্টো পাল্টার কী আছে?”

ঊর্মি বলল “সেই তো। আমি যা বলব তার উল্টোটা তো তোমাকে বলতেই হবে”।

অভিষেক উত্তর দিল না। অনেকটা মাংস দিয়েছে। বীথী কম মাংস নিয়েছিল। ঊর্মি বেশ কয়েক পিস বীথীর প্লেটে দিয়ে বাঁকা গলায় বলল ” খাও খাও। অনেক পরিশ্রম হচ্ছে তোমার।”

বীথী কিচ্ছু বলল না। যেমন খাচ্ছিল তেমন খেয়ে যেতে লাগল।

মেঘের ফাঁক দিয়ে হালকা রোদ উঁকি মারছে। অভিষেক বলল “তুয়াকে নিয়ে বেরোব। ওকে একটু পাহাড় দেখিয়ে আনি। তোমরা কেউ যাবে?”

ঊর্মি বলল “তোমরা যাও। আমি যাব না”!

অভিষেক বলল ” ঠিক আছে। বীথী যাবে?”

বীথী মাথা নাড়ল।

ঊর্মি বীথীর দিকে একবার স্থির চোখে তাকিয়ে খাওয়া শুরু করল আবার।

১৮

প্লেনে অমিত তারার পাশে ম্যানেজ করে বসল। সারা রাস্তা দুজনে কথা বলল।

নীলাদ্রি হতাশ চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে ছিল।

বাগডোগরায় পৌঁছে অমিত নীলাদ্রিকে বলল “তারা আমাদের সঙ্গেই যাবে”।

নীলাদ্রি শ্বাস ছেড়ে বলল “তুমি শিল্পী লোক। তোমার মত হতে পারলে ভাল হত”।

অমিত বলল “তা বটে। চল। তোমার বউ খোঁজা অভিযানে বেরনো যাক”।

নীলাদ্রি বলল “ওদের খবর দিয়েছ?”

অমিত হাসল “না না। অভিষেককে মাঝে মাঝে শক ট্রিটমেন্ট দেওয়া উচিত। যেমন তোমাকে ওরা দিয়েছে, তোমার ট্রিটমেন্টটাও শকিং হওয়া উচিত তাই না?”

নীলাদ্রির চোখ জ্বলে উঠল “ঠিক ঠিক”।

লাগেজ বেল্ট থেকে ব্যাগ নিয়ে অমিত নীলাদ্রিকে দেখিয়ে তারাকে বলল “আমরা এই হেরে যাওয়া মানুষের জন্য যাচ্ছি, বুঝতে পারছ তো তারা?”

তারা হাসল “রাইট”।

অমিত বলল “অবশ্য হেরে যাওয়া মানুষের দিকে কতটা দেখব সেটা নিয়ে ডাউট আছে। তুমি এত সুন্দরী, আমি তো অন্য দিকে তাকাতেই পারছি না”।

তারা বলল “থাক। আর ফ্লার্ট করতে হবে না। পাহাড় যেতে ইচ্ছে করছে মানে এই নয় সারারাস্তা ফ্লার্ট করে যাবেন। আপনি বরং কয়েকটা কবিতা শোনাতে পারেন”।

অমিত জিভ কাটল “আমার কবিতা তো আমার নিজেরই মুখস্ত থাকে না। আচ্ছা, চেষ্টা করব, পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে তোমাকে ইমপ্রেস করার। একজন কোট আনকোট সাহসী অভিনেত্রীকে ইমপ্রেস করা কি মুখের কথা তারা?”

তারা হেসে ফেলল। নীলাদ্রি গাড়ি জোগাড় করে ফেলেছিল। তারার দুটো লাগেজ ছিল। বাকি দুজনের হ্যান্ড ব্যাগ ছাড়া কিছু নেই। ইনোভা জোগাড় করা গেছে। নীলাদ্রি সামনে বসল।

গাড়ি চলতে শুরু করল।

অমিত তারার বাঁ হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলল “তোমার হাতটা খুব নরম। যেন রূপসী বাংলা। অবশ্য জীবনানন্দ তোমাকে নিয়ে কবিতার বইই লিখে গেছেন”।

তারা অবাক হয়ে বলল “অ্যা? কী বই?”

অমিত ভরাট গলায় আবৃত্তি করল

“ আমার এ-জীবনের ভোরবেলা থেকে—

সে সব ভূখণ্ড ছিলো চিরদিন কন্ঠস্থ আমার ;

একদিন অবশেষে টের পাওয়া গেল

আমাদের দু–জনার মতো দাঁড়াবার

তিল ধারণের স্থান তাহাদের বুকে

আমাদের পরিচিত পৃথিবীতে নেই ;

একদিন দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের সাথে পথ ধ’রে

ফিরে এসে বাংলার পথে দাঁড়াতেই

দেখা গেল পথে আছে,— ভোরবেলা ছড়ায়ে রয়েছে—

দক্ষিণ, পশ্চিম, পূর্ব, উত্তরের দিক

একটি কৃষাণ এসে বার–বার আমাকে চেনায় ;

আমার হৃদয় তবু অস্বাভাবিক।

পরিচয় নেই তার,— পরিচিত হয় না কখনো ;

রবিফসলের দেশে রৌদ্রের ভিতরে

মনে হয় সুচেতনা, তোমারে হৃদয়ে

ভুল এসে সত্যকে অনুভব করে।

সময়ের নিরুৎসুক জিনিসের মতো—

আমার নিকট থেকে আজো বিংশ শতাব্দীতে তোমাকে ছাড়ায়ে

ডান পথ খুলে দিলো ব’লে মনে হ’ল,

যখন প্রচুরভাবে চ’লে গেছি বাঁয়ে।“

তারা মুগ্ধ গলায় বলল “অসাধারণ। আপনার লেখা?”

অমিত বলল “সাতটি তারার তিমির থেকে। কবিতার নাম ভাষিত। তোমার নাম অবশ্য লাবণ্য হলে ভাল হত। আমি অমিত তুমি লাবণ্য”।

তারা বলল “এই নামটা আমি শুনেছি। টেগোর, রাইট?”

অমিত হাসল।

১৯

বৃষ্টি ধরে এসেছে তবে রাস্তায় স্যাঁতস্যাঁতে ভাবটা আছে।

ঊর্মি হোটেলে থেকে গেছে।

অভিষেক তুয়াকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কোলে নিচ্ছে। রাস্তার ধারে ধারে ছোট ছোট পাহাড়ি ফুল ফুটে আছে। সেগুলো দেখে তুয়া বায়না করছে নেওয়ার জন্য। বীথী এনে দিচ্ছে।

অভিষেক বলল “তুমি বাচ্চাদের পছন্দ কর?”

বীথী বলল “হু, করি। কে করে না?”

অভিষেক বলল “তা ঠিক। বেশিরভাগ মানুষই বাচ্চা পছন্দ করে”।

তুয়া গম্ভীর গলায় বলল “আমি বাচ্চা পছন্দ করি না”।

বীথী শব্দ করে হেসে উঠল।

অভিষেক তুয়াকে বলল “তাহলে তুমি বুড়ো পছন্দ কর মা?”

তুয়া মাথা নেড়ে বলল “আমি কাউকে পছন্দ করি না”।

অভিষেক তুয়াকে কোলে নিল। বীথী বলল “এই প্রথম এরকম হল। কোন অ্যাসাইনমেন্টে কারো ফ্যামিলির সঙ্গে এলাম। ইউনিক এক্সপেরিয়েন্স”।

অভিষেক বলল “তা বটে। আগেকারদিনে রাজারাজরারা করত। বেড়াতে যেত, সঙ্গে পত্নী, উপপত্নী, রাড়, সব জুটিয়ে নিয়ে যেত”।

বীথী বলল “এস টি ডির জন্য প্রি কশান নিতেন না ওরা। যার ফলে তখনকার দিনে সব থেকে ভুগতেও হত বেশি”।

অভিষেক অবাক গলায় বলল “তুমি বেশ অ্যাওয়ার তো এই ব্যাপারে”।

বীথী হাসল “একটা এন জি ও আমাদের নিয়ে ক্লাস করায় মাঝে মাঝে”।

তুয়া বলল “এস টি ডি কী বাবা?”

অভিষেক জিভ কাটল। বলল “কিছু না মা। বড়দের ব্যাপার। তুমি চকলেট খাবে?”

তুয়া ঘাড় নাড়ল।

পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে অনেকটা চলে এসেছিল তারা।

একটা গাড়ি তাদের পেরিয়ে খানিকটা গিয়ে দাঁড়াল।

অভিষেক থমকাল।

দেখল গাড়ি থেকে নীলাদ্রি আর অমিত নামছে।

তুয়া অভিষেকের কাঁধ খামচে ধরে বলল “ওই বাজে লোকটা আবার এসেছে বাবা। মারো ওকে, মারো”।

২০

অভিষেক নীলাদ্রির দিকে তাকাতে পারে না। তার লজ্জা হয়। এককালে বন্ধুই তো ছিল।

পরিস্থিতিটা তার কাছে অস্বস্তিকর। তুয়া তাকে শক্ত করে ধরে আছে। অমিতের পেছন পেছন তারা নামল গাড়ি থেকে। অভিষেকের অমিতের ওপর রাগ হচ্ছিল। একবার তাকে ফোন করে এলে কী হচ্ছিল?

নীলাদ্রি বিহ্বল গলায় তাকে বলল “ঊর্মি কোথায়?”

অভিষেক বলল “হোম স্টেতে আছে। তুই কি ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিস?”

নীলাদ্রি বলল “তুয়ার কথা মনে পড়ছিল আর কী”।

অভিষেক তুয়াকে বলল “যাও, ওর কাছে যাও”।

তুয়া জোরে জোরে মাথা নাড়ল।

অমিত বলল “এখানে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় না?”

অভিষেক তারার দিকে তাকাল। মুখটা চেনা। সিনেমা করে মেয়েটা। তারা বলল “না, এখান থেকে দেখতে পাবে না। ভিউটা উল্টোদিকে”।

অমিত বলল “আমি আর তারা তাহলে এগোই। তোরা কথা বল?”

অভিষেক বলল “একদম না। তুই এখানে থাক। নীলাদ্রিকে এখানে নিয়ে এলি কেন? মজা দেখার জন্য?”

অমিত তারার দিকে তাকিয়ে বলল “এই যে দ্য ফেমাস পোয়েট অভিষেক। চেনো তো?”

তারা মাথা নাড়ল। অভিষেক বলল “তুই ঠিক কী চাইছিস বলবি?”

অমিত বলল “নীলাদ্রি বলল এখানে আসবে। আমিও চলে এলাম। তোর এক্সপেরিমেন্ট উইথ লাইফটা দেখার আগ্রহটাও ছিল আর কী। তোমার নাম কী?”

অমিত বীথীর দিকে তাকিয়ে গলা তুলল।

বীথী নাম বলল। নীলাদ্রি তৃষ্ণার্তের মত মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।

অভিষেকের নীলাদ্রির জন্য খারাপ লাগল হঠাৎ করে।

মেঘলা পাহাড় বলেই হয়ত।

অমিতকে বলল “তোরা বীথীকে নিয়ে হোমস্টেতে যা। আমি নীলাদ্রির সঙ্গে যাচ্ছি”।

অমিত বলল “মারপিট করবি নাকি? ডুয়েল লড়া হবে? তাহলে আমিও থেকে যাব”।

অভিষেক রাগী চোখে অমিতের দিকে তাকাল। অমিত হাত তুলল “ওকে ওকে, বীথী, চল আমাদের সঙ্গে। একটা রুম চাই। আমার আর তারার জন্য। পাব তো রে?”

অভিষেক বলল “জানি না”।

অমিত কাঁধ ঝাঁকাল। “ঠিক আছে। আমরা এগোই। বীথী এসো”।

বীথী বলল “আপনারা যান। আমার হাঁটতে ভাল লাগছে”।

অভিষেক বীথীর দিকে তাকিয়ে বলল “তুমি থাকবে?”

বীথী মাথা নাড়ল।

অমিত তারাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

অভিষেক নীলাদ্রিকে বলল “তুই খেয়েছিস কিছু?”

নীলাদ্রি মুগ্ধ চোখে তুয়াকে দেখছিল। শুনতে পেল না প্রথমটা। অভিষেক আবার বলল।

নীলাদ্রি বলল “না। লাঞ্চই হয় নি এখনও”।

অভিষেক বলল “ঠিক আছে। চল। হাঁটি”।

তুয়া অভিষেকের ঘাড়ে মুখ গুঁজে আছে। অভিষেক নীলাদ্রিকে বলল “ও বীথী। আমাদের সঙ্গে এসেছে”।

নীলাদ্রি বিহ্বল গলায় বলল “ওহ, তাহলে কি আর ঊর্মিকে তোর আর দরকার নেই? ফেরত নিয়ে যাব?”

অভিষেক নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল “তুয়া তোর কাছে থাকতে চাইবে না”।

নীলাদ্রির মুখটা নিমেষে ছাই হয়ে গেল। তুয়াকে বলল “তোর বাবা কিন্তু আমি জানিস তো মা?”

তুয়া বলল “তুমি পচা। বাজে লোক”।

নীলাদ্রি দাঁড়িয়ে পড়ল রাস্তার ওপরে। অভিষেক তুয়াকে বলল “একটু যাও মা, আমি আবার কোলে নেব তোমায়”।

তুয়া জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল “না। যাব না”।

নীলাদ্রি বলল “থাক, থাক। ছেড়ে দে”।

বীথী একটা কথাও না বলে চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছিল।

অভিষেক বলল “তুই এখানে না এলেই পারতিস। অমিতের উচিত ছিল তোকে আমাদের হদিস না দেওয়া। কলকাতায় দেখা করে নিতিস ওদের সঙ্গে। তোকে তো আমি কখনও বারণ করি নি”।

নীলাদ্রি বলল “ঊর্মি ভাল আছে অভিষেক”?

অভিষেক চুপ করে গেল। এ কথার কী উত্তর দেবে বুঝতে পারল না।

২১

“পাহাড় তোমায় কতটা টানে তারা?”

অমিত আনমনে প্রশ্নটা করল।

তারা বলল “সারাক্ষণ। কলকাতায় এসে বিজি হবার কিছুদিন আগেও তো বন্ধুরা মিলে বাসে উঠে চলে আসতাম। কোনদিন দার্জিলিং, কোনদিন কালিম্পং। গ্যাংটকও যেতাম”।

অমিত বলল “উইথ বয়ফ্রেন্ড বুঝি?”

তারা তার মুক্তোর মত দাঁত বের করে হেসে বলল “ছিল একজন। তার বাইকে করে অনেকটা চলে আসতাম। একবার বাড়িতে জানতে পেরে খুব বকাঝকা করল। কী মনে হল, ছেলেটা ব্রেক আপ করে দিল”।

গাড়ি কালিম্পং ছাড়িয়ে এগোচ্ছে। গাড়িতে উঠেই অমিত সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখন অভিষেকদের ব্যাপারে থাকবে না। ওখানে থাকা মানেই ওদের টানাপোড়েনের মাঝে নিজেকে জড়িয়ে নেওয়া। কোথায় যাবে এখনও ঠিক হয় নি তবে ড্রাইভার বলেছে সন্ধ্যের আগে লাভা পৌঁছে যাবে।

অমিত বলল “বয়ফ্রেন্ডরা অভিমানী হলে তো বড় বিপদ। বয়ফ্রেন্ড হবে হিম্মতওয়ালার জিতেন্দ্রর মত। সিংঘমের অজয় দেবগণের মত, শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদের বুম্বাদার মত…”

তারা হেসে গড়িয়ে পড়তে পড়তে বলল “এর মধ্যে বুম্বাদাকে ঢুকিয়ে দিলে?”

অমিত হাত নেড়ে বলল “না না, তুমি বুঝছ না, আমি কাউকে ঢোকাচ্ছি না। বলছি মিনমিনে বয়ফ্রেন্ড জিনিসটা আমার পোষায় না। অবশ্য আমি স্ট্রেট। সেক্ষেত্রে মিনমিনে গার্লফ্রেন্ড পোষায় না বলতে পারো”।

তারা বলল “আচ্ছা। তুমি কি কোনভাবে আমার বয়ফ্রেন্ড হবার জন্য আমাকে ইম্প্রেস করার চেষ্টা করছ?”

অমিত জিভ কেটে বলল “একেবারেই না”।

তারা বলল “একেবারেই না? ওহ, বাড়ি বুঝি খুব কনজারভেটিভ? ছেলে ইন্ডাস্ট্রির কোন মেয়ের সঙ্গে প্রেম করলে হই চই লেগে যাবে?”

অমিত বলল “ধুত্তোর বাড়ি। বাড়ির চিন্তা কে করে? আমি নিজের চিন্তা করি। তোমাকে গার্লফ্রেন্ড করার বিপদ অনেক। এক তুমি সুন্দরী। আর আমি এক ব্যর্থ কবি। এক লাইন লিখে দশ লাইন কাটি। অন্যধারার বাংলা সিনেমা করে ব্যাপক ঝাড় খেয়েছি। এদিকে তুমি কেরিয়রের টপে আছো। আমাদের হবে না ওসব। একদিন ওসব হয়ও না”।

তারা চোখ বড় করল “তাই বুঝি? একজন কবি বুঝি এত হিসেব মেনে চলে? এত প্র্যাক্টিকাল হয়?”

অমিত বিড় বিড় করে বলল “ভালোবাসা বাঁধা পড়ে থাকে আত্মসমর্পণকারী সৈনিকের সঙ্গে…”

তারা বলল “মানে?”

অমিত বলল “মানে কিছু না। আমরা কি একটা ঘরেই থাকব?”

তারা গলায় কৌতুক এনে বলল “কেন? সমস্যা কোথায়? একটা অবলা নারীকে ফুসলিয়ে নিয়ে এসে এখন একা রাখার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বুঝি?”

অমিত তারার দিকে তাকিয়ে বলল “ এই আকাশ ঘেরা রাস্তায় তুমি নিমীলিত চোখে, বসে থাকো একা কোন গহীন সঘনে, ভালবাসা নতজানু…” থেমে গিয়ে হতাশ গলায় অমিত বলল “ধুস। আমার লেখা শেষ হয়ে আসছে”।

তারা বলল “লেখার ক্ষমতা রিস্টোর কিভাবে হবে?”

অমিত হেসে বলল “ত দিয়ে শুরু এমন কোন শিলিগুড়িনিবাসী মেয়ের সঙ্গে দীর্ঘ একটি চুমু খেতে হবে”।

২২

ঊর্মি ব্যাগ গোছাচ্ছিল। যখন কোন কাজ না থাকে তখন ব্যাগটাই গোছায় সে বসে বসে। পরিপাটি রাখা জামা কাপড় আরও একবার গুছিয়ে ব্যাগে রাখে। কাজ না থাকলে কাজ তৈরী করে নেওয়া।

হোম স্টের মালিকের একটা বিরাট কুকুর আছে। সেটা ঘরের সামনে ঘুরে গেছে একবার। ঊর্মি কুকুর ভয় পায়। দরজা বন্ধ করে রেখেছিল তার কটেজের।

বেল বাজল। ঊর্মি দরজা খুলে স্থির হয়ে গেল। নীলাদ্রি দাঁড়িয়ে আছে। পিছনে অভিষেক আর বীথী।

ঊর্মি কয়েক সেকেন্ড নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল “ভেতরে এসো”।

নীলাদ্রি কোন কথা না বলে কটেজের মধ্যে এসে বসল। অন্যমনস্ক গলায় বলল “শহরটা অসহ্য হয়ে উঠছে আমার কাছে”।

অভিষেক তুয়াকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকল।

বীথী তাদের কটেজে চলে গেছে।

নীলাদ্রি বলল “ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আমি এখানে এলাম বলে। কিন্তু কিছু করার ছিল না আমার। আমি বোধ হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি ঊর্মি”।

ঊর্মি শান্ত গলায় বলল “আমরা সবাই কিছু না কিছু শতাংশ পাগল। তুমি তো বরাবারই পাগল”।

অভিষেক বলল “তুয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি বরং ওই রুমে…”

ঊর্মি অভিষেকের দিকে সরাসরি তাড়িয়ে বলল “তোমাকে তো কাপুরুষ বলে জানিনি কোন দিন”।

অভিষেক থমকে গেল। বলল “আমার মনে হয় নীলাদ্রি তোমার সঙ্গে কোন একটা বোঝাপড়া করতে এসেছে। এখানে আমার না থাকলেও হয় বোধ হয়”।

ঊর্মি বলল “একবস্ত্রে যেদিন ওকে ছেড়ে তোমার সঙ্গে বেরিয়েছিলাম তখন জিজ্ঞেস করতে পারতে। এখন কি এতটাই বোঝা হয়ে গেছি আমি?”

অভিষেক নীলাদ্রির দিকে তাকাল। নীলাদ্রি হঠাৎ বলল “আমায় একটা শাল দিতে পারবে ঊর্মি? ঠান্ডার কথাটা ভুলে গেছিলাম। খুব ঠান্ডা লাগছে যে”!

২৩

নীলাদ্রি বসে আছে শাল জড়িয়ে। তুয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।

ঘুমের মধ্যেই তুয়া সে হাত সরিয়ে দিল।

নীলাদ্রি বলল “মেয়েটা আমাকে একদম সহ্য করতে পারে না”।

ঊর্মি বলল “তুমি এখানে এসে ঠিক কী করতে চাইছ নীলাদ্রি?”

নীলাদ্রি একবার অভিষেক, আরেকবার ঊর্মির দিকে তাকিয়ে বলল “আমি আর কী করতে পারি বল। আমি তো একজন হেরে যাওয়া মানুষ”।

অভিষেক কী বলবে বুঝল না। নীলাদ্রির নুইয়ে পড়া প্রতিবার তাকে ধাক্কা দেয়। মারপিট করতে পারে, অজস্র গালাগাল দিতে পারে, কিচ্ছু করবে না। শুধু মাথা নিচু করে বসে থাকবে। তার অফিসে এসেও মাঝে মাঝে এরকম করে বসে থাকে।

ঊর্মি ব্যাগের চেন আটকে খাটে চুপ করে বসে বলল “হেরে যাওয়া জিতে যাওয়া এভাবে হয় না। তুমি আবার নতুন করে শুরু কর”।

নীলাদ্রি মাথা নাড়ল, “ধুস, আমি রিজেক্টেড মাল। বউ মরে গেলে বাজারে ভাল দাম পাওয়া যায়, কিন্তু বউ পালালে…”

ঊর্মি বলল “তুমি কি আমার মৃত্যু কামনা কর?”

নীলাদ্রি শিউরে উঠল “একদম না। তোমার কিছু হলে তুয়াকে কে দেখবে?”

ঊর্মি অভিষেকের দিকে তাকিয়ে তেতো গলায় বলল “সে দেখার অনেক লোক আছে”।

নীলাদ্রি অভিষেককে বলল “কেন? এরকম কেন? তোদের ভালবাসারও কি এক্সপায়ারি ডেট পেরিয়েছে?”

অভিষেক বলল “ঊর্মি সেক্সুয়ালি ফ্রিজিড হয়ে গেছে নীলাদ্রি। ওকে এখন আর কোন কিছু জাগায় না”।

নীলাদ্রি ঊর্মির দিকে কয়েক সেকেন্ড হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে বলল “তাতে? তাতে কী হয়? শরীরটাই সব?”

অভিষেক বলল “না, তা নয়। কিন্তু কিছুটা তো বটেই। তুই এখন ঊর্মিকে ফিরিয়ে নিয়ে বিনা যৌনতায় বাকি জীবনটা কাটাতে পারবি তো?”

নীলাদ্রি বিস্ফারিত চোখে অভিষেকের দিকে তাকিয়ে বলল “আমি তো ঊর্মিকে ভালোবাসি কি না জানিনা, কিন্তু যেদিন টেবিলের ওপর চিঠিটা দেখলাম, তারপর থেকে আমি মরে গেছি অভিষেক। সেক্সের কথা তো ভাবি নি কোন দিন!”

ঊর্মি বলল “ভাবো ভাবো। আমি তোমার থেকে দূরে চলে গেছিলাম বলে তুমি আমাকে ভালোবাসোনি। তুমি ভালবেসেছিলে নিজের ইগোকে। এখনও তাই বাসো। দিনের পর দিন অফিসের মিটিঙে ব্যস্ত থেকে, সংসার পরিবারকে দূরে রেখে তুমি কোন দিন আমার কথা ভাবো নি নীলাদ্রি। তুমি তখনও নিজের কথা ভেবেছিলে। এখনও নিজের কথাই ভেবে এসেছো। সবাই হাসবে তোমার বউ পালিয়েছে বলে, সেই ইগো থেকে এসেছো। রাতে ঘরে ফিরে এসে আমার ঘুমিয়ে থাকা শরীরটায় দিনের পর দিন ধর্ষণ করেছো। আমি না চাইতেও করেছো। তখন তুমি একবারও আমার কথা ভাবো নি। যোনি ছাড়া মেয়েদের তোমরা কোনদিন কোন কিছু ভাবতে পারো নি। আমিই বোকা ছিলাম, সে সময় অভিষেকের সঙ্গে চলে গেলাম। ভালবাসা পাওয়া অত সহজ না, তখন বুঝিনি। এখনও বুঝিনি হয়ত”।

নীলাদ্রি মাথা নিচু করে বসে রইল।

কলিং বেল বাজল।

অভিষেক দরজা খুলে দেখল অমিত তারাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

অমিত বলল “ধ্বস নেমে গেছে। গাড়ি কোন দিকেই যাচ্ছে না। আর তো ঘরও নেই এখানে রাতের মত। এই দুটো ঘরে সবাই মিলে থেকে যাই আজ রাতটা? কী বলিস?”

২৪

ঊর্মি থমথমে চোখে অভিষেকের দিকে তাকাল।

অভিষেক ইতস্তত করে বলল “রুম নেই বলল?”

অমিত বলল “হ্যাঁ। বলল খুব বেশি হলে এক্সট্রা বেড দিতে পারি। কাল দুপুরের আগে রোড ক্লিয়ার হবার চান্স কম। যে লেভেলে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এই তারা, ভেতরে এসে বস”।

তারা খানিকটা সংকুচিত হয়ে রুমের ভিতরে এল। অমিত অবশ্য স্বাভাবিক। তারাকে খাটে বসতে বলল। নীলাদ্রিকে দেখে বলল “কী বস? তোমার সব মিটল?”

নীলাদ্রি বিহ্বলভাবে অমিতের দিকে তাকিয়ে বলল “ওই আর কী”।

অমিত অভ্যস্ত হাতে সিগারেট বের করতে যাচ্ছিল, ঊর্মি কড়া গলায় বলল “এখানে স্মোক করবে না, তুয়া আছে”।

অমিত জিভ কাটল, “ঠিক ঠিক। এক্কেবারে সরি”।

ঊর্মি বলল “তা নীলাদ্রিকে এখানে তুমি কেন নিয়ে এলে? প্রতিবারের মত এবারেও মজা দেখার জন্য?”

অমিত বলল “তুমি সব সময় এত সিরিয়াস কেন ঊর্মি? এত সুন্দর একটা ওয়েদার, পাহাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে, কোথায় চিকেন, হুইস্কি নিয়ে বসে জমিয়ে পার্টি হবে, তা না। কেমন একটা মুড অফ করে বসে আছো। তুমি তো এরকম ছিলে না! দিনে দিনে এরকম খেকুরে হয়ে যাচ্ছো কেন?”

ঊর্মি কঠিন গলায় বলল “তুমি কী আশা কর তবে? আমার এক্স হাজব্যান্ডের সামনে এখানে মুজরো করব বুঝি?”

নীলাদ্রি খুক খুক করে কেশে বলল “অভিষেক, আরেকটা রুম আছে না? আমি বরং ওখানে যাই”।

অমিত জোরে হেসে উঠে বলল “হ্যাঁ, তাই যাও বরং। এসকর্ট আছে ও ঘরে, তুমি ওখানে গিয়ে লাইফটা রিস্টার্ট কর”।

অভিষেক তারার দিকে তাকাল। তারা কোন দিকে না তাকিয়ে মন দিয়ে মোবাইল ঘেঁটে যাচ্ছে।

সে বিরক্ত মুখে নীলাদ্রিকে বলল “নীলাদ্রি তুই ওই ঘরেই যা। বীথী বরং এখানে আসুক। মেয়েরা এই রুমে ঘুমোক”।

ঊর্মি বলল “আমি একটা বেশ্যার সঙ্গে এক ঘরে আমার মেয়েকে নিয়ে থাকতে পারলাম না, সরি”।

তারা ঊর্মির দিকে তাকিয়ে বলল “বেশ্যা একটা ফালতু টার্ম। সবাই বেশ্যা। আপনার ইচ্ছা না থাকলেও আপনি বরের সঙ্গে যেদিন জোর করে শুয়েছেন সেদিন আপনিও বেশ্যা হয়েছেন। আমি কাজের জন্য যখন প্রোডিউসারের সঙ্গে শুয়েছি, সেদিন আমিও বেশ্যা হয়েছি। এভাবে বেশ্যার ক্লাসিফিকেশন করা যায় নাকি?”

ঊর্মি হাতের ব্যাগটা মেঝেতে টান মেরে ফেলে দিয়ে চেয়ারের ওপর বসে পড়ে বলল “যা পারো কর। আমি আর কিছু জানি না”।

নীলাদ্রি ঊর্মির দিকে তাকিয়ে বলল “আমি বোধহয় তোমাকে খুব সমস্যায় ফেলে দিলাম তাই না”?

২৫

ডিনার টেবিলে সবাই এসেছে। রুমের সমস্যা থাকলেও খাবারের ব্যবস্থা হোম স্টে থেকে করা হয়েছে। ঊর্মি রুমে থেকে গেছে তুয়া ঘুম থেকে ওঠে নি বলে। ঠিক হয়েছে অভিষেক ঊর্মির খাবার নিয়ে যাবে।

অভিষেক বীথীকে নিয়ে বসেছে। তাদের সামনে অমিত আর তারা।

নীলাদ্রি চুপ করে বসে রয়েছে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে।

অমিত নীলাদ্রিকে বলল “কী বস? ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি?”

নীলাদ্রি বলল “কবি? আমি কবিতা লিখতে পারি না যে”।

অমিত বলল “কবিতা কি লিখলেই কবি হয় নাকি কেউ? কেউ কেউ সারাজীবন লিখেও কবি হতে পারে না। আমাকেই দেখো না”।

নীলাদ্রি বলল “কী যে বল,এসব কথা বললে কেউ শুনবে?”

একটু দূরের টেবিলে একজন মহিলা এসে তারার সঙ্গে সেলফি নিয়ে গেল। অমিত বলল “এই দেখো। এখানে তোমার কথা মত দুজন কবি বসে আছে কিন্তু সেলিব্রিটি কিন্তু সেই তারাই হল। এর মানে কী?”

তারা বলল “লেগ পুল কোর না আর। তোমাদের সবাই চেনে”।

খাবার দিল। বীথী চুপ করে খেতে শুরু করল।

অভিষেক বলল “কত প্ল্যান করে এসেছিলাম। কিছুই লেখা হল না। আর বোধ হয় কোন দিন লিখতে পারব না”।

অমিত বলল “লিখতে না পারলে ভাল তো। আমি একাই থাকব, সূর্য হয়ে জ্বলব। অবশ্য আর সূর্য হব কী, আমার নিজেরই তো লেখা বেরোয় না আজকাল। তারাকে দেখে কিছু বেরোতে পারে। দেখা যাক। আচ্ছা, তারাকে দেখেই কি লেখা হয়েছিল আকাশ ভরা সূর্য তারা? তাহলে আকাশ আর সূর্য কোথায়? তারা, তোমার কোন ভাই আছে এই দুজনের নামে?”

তারা বলল “তুমি এত টকেটিভ জানতাম না তো”।

অভিষেক বলল “অমিত যখন অপরাধবোধে ভোগে তখন ভাট বকতে শুরু করে। ও এখন তীব্র অপরাধবোধে ভুগছে নীলাদ্রিকে এখানে নিয়ে এসে”।

তারা অমিতের দিকে তাকাল “রিয়েলি?”

অমিত মাথা নাড়ল, “আমি শিওর নই। হতে পারে। ইনফ্যাক্ট মজা দেখতে এসেছিলাম অস্বীকার করতে পারি না, কিন্তু আমার ঊর্মির কথা ভাবা উচিত ছিল”।

অভিষেক বলল “ভাবিস নি যখন, তখন এখন আর ভাবতে হবে না”।

নীলাদ্রি বলল “আমারও দোষ আছে, না এলেই ভাল হত”।

অমিত বলল “হ্যাঁ, আমরা সবাই দোষী আমাদের এই দোষীর রাজত্বে”।

বিকট শব্দে বাজ পড়ল একটা।

বীথী ভয় পেয়ে এঁটো হাতেই অভিষেকের ডান হাত শক্ত করে ধরল।

২৬

বৃষ্টির মধ্যেই খাবার নিয়ে এল অভিষেক।

ভিজে গেছিল ঊর্মি বললো “বৃষ্টি থামলে আসতে পারতে”!

অভিষেক বলল “কখন থামবে তার কোন ঠিক আছে?”

ঊর্মি কিছু বলল না। অভিষেক টাওয়েল নিয়ে মাথা মুছে বলল “তুমি তুয়াকে নিয়ে এখানেই থাকো। বাকিরা ওই কটেজে থাকবে। সব এখানে থাকলে তুয়ার ঘুম হবে না”!

ঊর্মি টেবিলে খাবার রেখে বলল ” তুয়াকে ডেকে দাও৷ খাক কিছু”।

অভিষেক তুয়াকে ডাকতে গেল। তুয়া ঘ্যান ঘ্যান করতে লাগল। অভিষেক বলল “ছেড়ে দাও। ও ঘুমাক। তুমি সকালে উঠে খাইও। সন্ধ্যেয় চাউ খেয়েছে তো”!

ঊর্মি বলল ” তুমি অমিতকে কিছু বলছ না কেন? ওকে নিয়ে চলে এল?”

অভিষেক বলল “কী বলব? ওকে বলে কোন লাভ হয় কোনদিন?”

ঊর্মি বলল “জঘন্য সিচুয়েশন তৈরী হল একটা”!

অভিষেক চুপ করে রইল।

২৭

রাত দশটা।

মেঝেতে বিছানা করা হয়েছে। খাটে বীথী আর তারা শোবে। নিচে অভিষেক, নীলাদ্রি আর অমিত।

হোম স্টের এক ছেলেকে ধরে হুইস্কি আনিয়েছে অমিত।

বীথী, তারা, অমিত গ্লাসে মদ নিয়ে খেতে শুরু করেছে।

নীলাদ্রি অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে। অভিষেক বারান্দায় চেয়ারে বসে সিগারেট খেতে খেতে বৃষ্টি দেখছে।

বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ নেই। শীত আছে। অমিত ডাকল “কী রে, আয়”।

অভিষেক বলল ” তোরা খা”।

অমিত বলল “বৃষ্টি দেখে কি কবিতার ইন্সপিরেশন নিচ্ছিস? আমার তো গান আসছে। তাও রগরগে। টিপটিপ বরসা পানি। উফ, রবিনা!”

অভিষেক উত্তর দিল না।

নীলাদ্রি বীথীর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলল “আপনি নাচ জানেন?”

বীথী বলল “মুজরো? না স্ট্রিপটিজ?”

নীলাদ্রি ভয় পেয়ে বলল “না না সেসব না। ভারত নাট্যম”।

বীথী বলল ” স্ট্রিপটিজ জানি। দেখবেন?”

নীলাদ্রি সভয়ে দুদিকে মাথা নাড়ল।

অমিত বলল ” তুমি তো পারভার্ট আছো মাইরি। টিপ টিপ বরষার সাথে তোমার ভারতনাট্যম দেখতে ইচ্ছা করছে?”

নীলাদ্রি বলল “না আসলে আমি টিপ টিপ বরষা শুনিনি। ওনাকে এমনিই বললাম। ওনার ফিগারটা সুন্দর। ডান্সারের মত। ঊর্মির ফিগারও এরকম ছিল”!

অমিত খুক খুক করে কাশতে শুরু করল।

অভিষেক ঘরে এসে বসে বলল ” বৃষ্টি হচ্ছে কোথায় বৃষ্টির গান হবে, তা না, মাথায় শুধু আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে বাজছে। মাথাটা গেছে আমার”।

অমিত বলল “পরের মেয়ের বেবিসেটিং করলে এই হয়।”

অভিষেক রেগে গেল “তুই কি চাস আমি রেগে গিয়ে তোকে মারধোর করি? অনেকক্ষণ ধরে দেখছি পিঞ্চ করে যাচ্ছিস”।

অমিতের এক পেগ শেষ হয়ে গেছিল। দ্বিতীয় পেগ বানাতে বানাতে বলল “সোশ্যাল এক্সপেরিমেন্ট করছি। আমি দেখতে চাইছি কোন থ্রেশোল্ড পয়েন্টে গিয়ে তুই আমার ওপর হাত তুলিস”।

নীলাদ্রি বলল “আমার কন্যা রাশি। নরম মানুষ। নইলে আমারই বোধহয় অভিষেককে পেটানোর দরকার ছিল।”

অমিত হো হো করে হেসে উঠল।

পরক্ষণেই তারার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে বলল “হোয়াট আ নাইট। আজ রাতে কেউ আর ঘুমাব না”!

২৮

রাত দেড়টা। বৃষ্টি থেমেছে।

“রাত জাগব”, “রাত জাগব” বলে সব থেকে বেশি লাফালাফি করেছিল অমিত। সবার আগে সেই ঘুমিয়ে পড়েছে। নীলাদ্রি তিন পেগে আউট হয়ে বাথরুমের দরজার কাছে ঘুমিয়েছে। বীথী আর তারা খাটে শুয়েছে। অভিষেকের বসে থাকা অবস্থাতেই ঘুমাচ্ছিল।

তার ঘুম ভাঙল হঠাৎ করে।

মাথা ঝিম ঝিম করছে হুইস্কির প্রভাবে। বেশ কয়েক মিনিট চুপ করে বসে থেকে অভিষেক উঠে নীলাদ্রির গায়ে একটা কম্বল জড়িয়ে ব্যালকনিতে চেয়ারে বসে সিগারেট ধরাল।

পাইন বনের মধ্যে কটেজগুলো। বৃষ্টির ফলে চতুর্দিক ভেজা। দূরে কোথাও কুকুর ডাকার শব্দ ভেসে আসছে।

অভিষেক মনে মনে লিখতে চেষ্টা করল

“এখানে রাত হঠাৎ চলে আসে,

ভালোবাসাগুলো যেভাবে চলে যায়…”

ভালোবাসা চলে যায়? অভিষেক ভাবতে চেষ্টা করল স্বরলিপির কথা। প্রথম কষ্ট। বিচ্ছেদ এত যন্ত্রণাদায়ক কেন? এই জেনারেশনের বিচ্ছেদে কষ্ট হয়? নাকি সবটাই সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে আজকাল কম হচ্ছে?

ঊর্মিদের কটেজের আলো জ্বলে উঠল।

অভিষেক অবাক হল। দেখল ঊর্মি তাদের কটেজের দিকেই আসছে।

সে চেয়ার থেকে উঠে এগিয়ে গেল। বলল “কী হল?”

ঊর্মি বলল “ঘুম আসছে না। জানলা দিয়ে তোমাকে দেখলাম”।

অভিষেক বলল “তবু। তুয়া একা আছে তো”।

ঊর্মি বলল “তুমি আমাদের ওখানে চল। এখানে এত জনের সঙ্গে ঘুমাতে কষ্ট হবে”।

অভিষেক ঊর্মির দিকে তাকাল। কোন কোন দিন আসে যেদিন, অনেক চেনা মানুষকেও ভীষণ অচেনা লাগে।

#

হুইস্কির ঘোর ছিল।

অচেনা ঊর্মির মাঝরাতে প্রবল ভালোবাসা ছিল।

অভিষেকের যখন ঘুম ভাঙল তখন সকাল ন’টা। জানলা দিয়ে রোদ এসে পড়ছে।

আকাশ একেবারে পরিষ্কার। একটুও মেঘ নেই।

চোখ খুলতেই তুয়া বলল “গুডমর্নিং বাবা”।

অভিষেক বলল “গুড মর্নিং”।

ঊর্মি পাশে ঘুমাচ্ছে তাকে জড়িয়ে ধরে।

অভিষেক উঠে বসল। তুয়াকে ব্রাশ করাল। নিজে ব্রাশ করল।

তুয়াকে কোলে নিয়ে অমিতদের কটেজের দিকে রওনা দিল।

কটেজ ফাঁকা।

দরজা খুলে অভিষেক দেখল কেউ নেই। বিছানা পরিষ্কার করে রাখা।

অবাক হল অভিষেক। কী করবে বুঝতে পারল না।

তুয়া বলল “বাবা,আন্টি কোথায়?”

অভিষেক বলল “জানি না মা। বুঝতে পারছি না”।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরোতে যাচ্ছিল দেখল খাটের পাশে টেবিলে অ্যাস্ট্রে চাপা দেওয়া একটা কাগজ।

অভিষেক এগিয়ে গিয়ে কাগজটা নিল।

 “ভাই অভিষেক,

আমি একজন হেরে যাওয়া মানুষ, যে নিজের বউকে কোনদিন সময় দিতে পারি নি। দিনের পর দিন বাড়ি ফিরে ঊর্মির সঙ্গে অশান্তি করেছি। তুই যেদিন ঊর্মি আর তুয়াকে নিয়ে চলে গেলি আমার খুব রাগ হয়েছিল। কিন্তু আমি তো রাগ দেখাতে পারি না। কারো সঙ্গে ঝামেলাও করতে পারি না। কেঁদেছিলাম। পাগলের মত হয়ে গেছিলাম।

চাকরি ছেড়ে দিলাম। সারাদিন বাড়িতে বসে থাকতাম। আর প্রতি মুহূর্তে বুঝতে পারতাম একা একা থাকলে কেমন লাগে। ঊর্মির কেমন লাগত।

এখানে এলাম বলেই তো বুঝলাম ভাই, ঊর্মি আর আমার কোন দিন হতে পারবে না। কিছু বলে নি। তুইও বলিস নি। তবু বোঝা যায়। কোন পরিবারকে বাইরে থেকে দেখলে যেমন বোঝা যায়, সে পরিবারটা আমার না, অন্য কারো। তারা সুখে আছে, আমাকে দেখলে তারা ভালভাবে নিচ্ছে না। আমি সেখানে অবাঞ্চিত।

তুই যখন কাল আমার গায়ে কম্বলটা দিলি তখনই আমার ঘুম ভেঙে গেছিল। চুপ করে শুয়ে ছিলাম। আমি নিঃশব্দে দেখলাম ঊর্মি কেমন যত্ন করে তোকে নিয়ে গেল। এই মেয়েটা আমার বউ ছিল, এ জন্মে না বোধ হয়। আগের কোন জন্মে। আমি দেখলাম তোদের। এবার আর কাঁদলাম না।

বরং খুশি হলাম। এবার আমি নিশ্চিত হলাম, ঊর্মি যা করেছিল। ঠিক করেছিল।

আমি বীথীকে নিয়ে চললাম রে। দেখি আরও কোন দুর্গম জায়গায় যেতে পারি নাকি।

লাইফটা রিস্টার্ট করা দরকার।

তোর আশা করি বীথীকে এখন আর লাগবে না।

অমিত জানিয়ে দিল ওও পালাল। তোরা ভাল থাকিস।

তুয়ার বাবা তুইই। আমি না। বায়োলজিকাল বাপ হলেই বাপ হওয়া যায় না।

কবিতা লিখিস, আর যাই করিস।

ঊর্মিকে ভাল রাখিস। মেয়েটার তুই ছাড়া আর কেউ নেই।

নীলাদ্রি।

পুনশ্চ- আমার বউ নিয়ে পালিয়েছিলিস। তাই শাস্তিস্বরূপ বীথীর এজেন্সীতে যদি এক্সট্রা কোন টাকা লাগে দিয়ে দিস।

1 Comment

Kinda boring story. Nakamu type. Every thing is over and unnecessary.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *