খেলাঘর
এক
নির্মাল্য বসু নিজে একজন নামজাদা ইন্টিরিয়র—ডেকরেটর। কাজেই তিনি যখন নিজের জন্যে বাড়ি বানালেন, তখন সেই বাড়িকে যে তিনি নিজের হাতে সাজাবেন, সেটাই স্বাভাবিক।
মনের মতন করে বাড়িটাকে সাজানোর ব্যাপারে কোথাও কোনো কার্পণ্য করেননি নির্মাল্যবাবু। না পয়সার, না পরিশ্রমের। যেখানে যে জিনিসটা মানাবে বলে মনে হয়েছে, সেই জিনিসটাকেই যে কোনো মূল্যে জোগাড় করে এনেছেন তিনি।
তবে শুধু পয়সা বা পরিশ্রম দিয়েই তো আর সৌন্দর্য রচনা করা যায় না। তার জন্যে আরও কয়েকটা জিনিস লাগে—যেমন রুচি, কল্পনা, জ্ঞান। বাড়ির ভেতরে ঢুকতে হবে না; নির্মাল্যবাবুর বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়ালেই যে কেউ বুঝতে পারবে, এই বাড়ির মালিকের মধ্যে ওই তিনটি জিনিসই বিস্তর পরিমাণে রয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক বাড়ির উত্তরদিকের গ্রানাইট পাথরের দেয়ালটার কথা। প্রথম যখন তৈরি হল তখন নির্মাল্যবাবুর বন্ধুস্বজনরা অনেকেই বলেছিলেন, এটা কী করলে নির্মাল্য? বিবর্ণ, এবড়ো খেবড়ো, এরকম দেয়াল ভালো লাগে না কি?
আজ যখন সেই রুক্ষ গ্রানাইটের ওপর একটা আইভিলতার ঝাড় লতিয়ে উঠেছে, আর পাথরের গা বেয়ে ঝর ঝর করে ঝরে পড়ছে জলের ধারা, তখন তারাই আর সেদিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছেন না।
বাড়ির ভেতরে বাইরে এরকম বহু উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে। তবে সব কিছুর মধ্যে একটা যোগসূত্র রয়েছে— সেটা হল একটা প্রাচীনতার ছাপ, ইংরিজিতে যাকে বলে ‘অ্যান্টিক—লুক’। ইচ্ছে করেই নিজের নতুন বাড়িতে এই প্রাচীনতার ছাপটা নিয়ে এসেছেন নির্মাল্যবাবু। সেইজন্যেই তাঁর বাড়ির সদর দরজায় রাজস্থানি পেতলের সূক্ষ্ম কারুকাজ। আলোর আধুনিক শেডের বদলে ব্রিটিশ আমলের গ্যাস ল্যাম্পের ঢাকনা। সিঁড়ির চাতালে গ্র্যান্ডফাদার ক্লক। এমনকি ড্রইং—রুমের ফার্নিচারগুলোও সাহেবি আমলের।
সব মিলিয়ে ব্যাপারটা যা দাঁড়াল, তাতে নির্মাল্যবাবু, তার স্ত্রী মৌটুসি আর তাদের ছোট্ট মেয়ে রুম্পা— তিনজনেই তাদের নতুন বাড়ি নিয়ে খুব খুশি। শুধু বহুদিনের পুরনো কাজের লোক বিজনবিহারী, যাকে নির্মাল্যবাবু আর তার স্ত্রী বিজুদা বলে ডাকে, তার খুব একটা ভালো লাগল না। সে খালি বলে, এই বাড়িটা কীরকম যেন অন্ধকার—অন্ধকার, জঙ্গল—জঙ্গল। বাড়ির ভেতরে কি কেউ এত গাছপালা লাগায় দাদাবাবু?
গাছ জিনিসটা নির্মাল্যবাবু আর তাঁর স্ত্রী মৌটুসি, দুজনেরই খুব প্রিয়। তাই তারা ও ব্যাপারে বিজুদার আপত্তিতে পাত্তা না দিয়ে আরও নতুন নতুন গাছ আমদানি করতে লাগল। তাদের পুরনো বাড়িতে মালি ছিল। নতুন পাড়ায় এসে সেই পুরনো মালিকে আর পাওয়া গেল না। তার বদলে কমল নামে এক চটপটে ছোকরা কাজে লাগল। সে প্রতি শনিবার বিকেলে সোনারপুর থেকে সাইকেল চালিয়ে আসে। থলি থেকে চটপট খুরপি, পোকামারা ওষুধের স্প্রে, গাছ ছাঁটা কাঁচি ইত্যাদি বার করে বাগানের আর ঘরের সমস্ত লতাপাতা পরিচ্ছন্ন করে কেটেকুটে দিয়ে চলে যায়।
গাছপালা যেখানে যা লাগানো হয়েছিল সবই নির্মাল্যবাবুর নিজের প্ল্যান অনুযায়ী। শুধু একটা ব্যাপারেই তাঁর প্ল্যানটা তিনি খাটাতে পারছিলেন না। নির্মাল্যবাবুর অনেকদিনের ইচ্ছে, বাড়ির ছাদের ঠিক মাঝখানে একটা চামেলি লতার কুঞ্জ বানাবেন। সেই কুঞ্জে গ্রীষ্মে আর বর্ষায় থোকায় থোকায় ফুল ফুটবে, চামেলি ফুলের মিষ্টি গন্ধ হাওয়ায় ভেসে বেড়াবে। জ্যোৎস্না রাতে তিনি ওই কুঞ্জের নীচে একটা ইজি—চেয়ারে বসে চামেলির ঝিরঝিরে পাতার ফাঁক দিয়ে দেখবেন মেঘেদের দৌড়। কিন্তু এই লতাকুঞ্জ বানানোর কাজটাই আর হয়ে উঠছিল না।
কারণটা খুব সামান্য। তিনি একটা মনের মতন মাচা পাচ্ছিলেন না।
হ্যাঁ, ছাদের মাঝখানে লতাকুঞ্জ বানাতে গেলে একটা শক্তপোক্ত কাঠামো না হলে চলে না, যেটাকে চলতি ভাষায় মাচা বলে। ওই কাঠামোর খুঁটি বেয়েই লতাগাছ ওপরে উঠবে, তারপর কাঠামোর ছাদে সেই লতা ছড়িয়ে পড়বে। তবেই না তৈরি হবে চামেলির কুঞ্জ। কিন্তু এমন সুন্দর বাড়ির ছাদে কি বাঁশ কিংবা লোহার চালু মাচা ব্যবহার করা যায়? দেখতে অত্যন্ত বেমানান লাগবে না?
নির্মাল্যবাবু ভেবেই পাচ্ছিলেন না, তাঁর বাড়ির ওই ‘অ্যান্টিক—লুক’—এর সঙ্গে মানানসই করে কীভাবে একটা কাঠামো বানানো যায়। এ ব্যাপারে তিনি বেশ কিছুটা পড়াশোনাও করে ফেললেন। পড়েটড়ে আর পুরনো বইয়ের ছবি দেখে তিনি বুঝলেন, প্রাচীন কালের সাহেবি বাংলো আর জমিদারদের বাগানবাড়িতে অমন লতাকুঞ্জ হামেশাই থাকত। সেগুলো ছিল অনেকটা চারিদিক খোলা মন্দিরের মতন। কোনো দেয়াল থাকত না, শুধু কয়েকটা থামের ওপর চুড়োটা থাকত। সেই চুড়োর ওপরেই ছড়িয়ে পড়ত মাধবী, চামেলি, আইভি কিংবা আঙুরের মতন নানান বাহারি লতা।
নির্মাল্যবাবু স্বপ্নেও কখনো ভাবেননি যে, অমন একটি রেডিমেড কাঠামো তিনি পেয়ে যাবেন। নতুন নয়, পুরনো। সত্যিকারের অ্যান্টিক।
স্বপ্নের জিনিসটা তিনি পেলেন গিরিপানির রাজবাড়িতে।
দুই
গিরিপানি জায়গাটা ওড়িশার কটক থেকে মাত্র চল্লিশ কিলোমিটার দূরে। পাহাড়ি এলাকা, জঙ্গলে ঢাকা। বেড়াবার পক্ষে আদর্শ।
নির্মাল্য বসু কিন্তু ওখানে বেড়াতে যাননি, কাজেই গিয়েছিলেন। ওখানকার রাজপরিবারের এখনকার বংশধর রাজা সুপ্তিনাথ মহাপাত্র সাহেবি কেতার মানুষ। রাজত্ব নেই তো কী হয়েছে? তাঁর দুটো জাহাজ, একটা কাগজের কারখানা আর তিনটে বড় হোটেল রয়েছে। সোজা বাংলায় রাজ্য না থাকলেও রাজা সুপ্তিনাথ ভয়ঙ্কর পয়সাওলা লোক।
তো, এই রাজামশাই পূর্বপুরুষদের সাতমহলা বাড়ি ছেড়ে ওইখানেই নতুন করে বানানো একটা আধুনিক প্যালেসে উঠে যাচ্ছেন। আর সেই প্যালেসের ইন্টিরিয়র ডেকরেশনের ভার দিয়েছেন নির্মাল্য বসুকে।
গিরিপানিতে গিয়ে নির্মাল্য বসু পুরো দুদিন ধরে নতুন বাড়িটা দেখলেন— যে বাড়িটা তাঁকে সাজাতে হবে। বাড়ির সমস্ত জায়গার ছবি তুললেন, মাপজোখ নিলেন, নোট—টোট লিখলেন। তৃতীয়দিন সন্ধেয় তাঁর ফেরার ট্রেন ছিল। কাজেই সেদিন দুপুরে তিনি রাজবাড়ির এক পরিচালককে সঙ্গী করে পুরনো রাজবাড়িটা দেখতে বেরোলেন।
সেই রাজবাড়িতে অবশ্য দেখার মতন বিশেষ কিছুই ছিল না। বাড়িটা বড় হলেও মোটেও সুন্দর নয়। তার ওপর কালের প্রহারে জীর্ণ। রাজকীয় আসবাব কিংবা ছবিটবি যা ছিল, সবই রাজা সুপ্তিনাথ হয় বিক্রি করে দিয়েছেন, নাহলে নতুন বাড়িতে তুলে এনেছেন। বেজার মুখে নির্মাল্যবাবু রাজবাড়ির পেছনের বাগানটার দিকে হাঁটা লাগালেন এবং সেখানে পৌঁছেই তাঁর মুখটা হাঁ হয়ে গেল। তিনি দেখতে পেলেন পেছনের বাগানে এক কোনায়, অবিকল তিনি যেমনটা চেয়েছিলেন, তেমনি এক কাঠামো দাঁড়িয়ে রয়েছে।
‘দাঁড়িয়ে রয়েছে’ মানে কোনো রকমে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার ছটা কাঠের থামের মধ্যে তিনটেই ভেঙে পড়েছে। তাই চুড়োটাও একদিকে হেলে পড়েছে। পুরো কাঠামোটার কোথাও একফোঁটা সবুজের চিহ্ন নেই। তবে এককালে নিশ্চয় ওটাকে ঘিরে কোনো বাহারি লতা ফুল ফোটাত।
নির্মাল্যবাবু তাঁর সমঝদারের নজরে দেখে নিলেন— পুরো মন্ডপটার গায়ে অসামান্য কাঠ খোদাইয়ের আলপনা। তেমনি সুন্দর মন্ডপটার গড়ন। ওড়িশার মন্দিরের চুড়োগুলো যেমন অনেকগুলো স্তর সাজিয়ে তৈরি হয় ঠিক সেইরকম এর চুড়োর গঠনশৈলী। এখন জীর্ণদশায় পড়ে আছে বলে বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু একটু সারিয়ে সুরিয়ে নিলেই এর আসল সৌন্দর্য আবার বেরিয়ে আসবে।
নির্মাল্যবাবু তাড়াতাড়ি নতুন প্যালেসে ফিরে রাজা সুপ্তিদেবকে তাঁর ইচ্ছের কথা জানালেন। বললেন, তিনি ওই কাঠের মঞ্চটা কিনতে চান। মহারাজ শুনে তো ভারি অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, ওই মাধবী কুঞ্জটা তো ভেঙে চুরে গেছে। পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। ওটার জন্যে দাম আর কী নেব? আপনি এমনিই নিয়ে যান। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
তারপর তিনি ম্যানেজারকে ডেকে হুকুম দিলেন, বোসসাহেব যে কাঠের মঞ্চটার কথা বলছেন, সেটা যেন এক্ষুনি কলকাতায় পাঠাবার ব্যবস্থা করা হয়। খরচপত্র সব সুপ্তিদেবের।
পরেরদিন নির্মাল্যবাবু কলকাতায় নিজের বাড়িতে ফিরে এলেন, আর তারও ঠিক দুদিন বাদে ট্রাকে চেপে সেই কাঠের মঞ্চ কলকাতায় চলে এল। সেটাকে সারাতে আরও পনেরোদিন লাগল। তরপর নির্মাল্যবাবুর ছাদের মাঝখানে তাঁর অনেকদিনের শখ মিটিয়ে চামেলির মঞ্চ বসে গেল। এখন শুধু কমলকে বলে একটা ভালো জাতের চামেলির চারা এনে ওটার গায়ে তুলে দেওয়ার অপেক্ষা।
সমস্যা হল নির্মাল্যবাবুদের কাজের লোক বিজুদাকে নিয়ে। সে তো এই নতুনবাড়িতে আসার পর থেকে এমনিতেই কেমন যেন ভয়ে ভয়ে থাকত। এই মঞ্চটা ছাদের মাঝখানে যেদিন খাড়া হল, তার কদিন পরেই সে একেবারে ফ্যাকাসে মুখে মৌটুসির সামনে মেঝের ওপর ধপ করে বসে পড়ল। বলল, দিদিমণি, ওই মাচাটাকে বিদায় কর। ওটা ভূতুড়ে।
মৌটুসি তো শুনে হেসেই বাঁচে না। বলে, ভূতুড়ে কেন গো বিজুদা? কী হয়েছে?
বিজনবিহারী বলল, আমি তো রাতে ওই ছাদের লাগোয়া চিলেঘরেই শুই। বুড়ো হয়েছি বলে ভালো ঘুম হয় না। রাতের বেলা মাঝেই মাঝেই ঘুম ভেঙে যায়। তা, কদিন ধরে ঘুম ভাঙলেই জানলা দিয়ে দেখছি, ওই কাঠের ছাউনিটার নীচে কে যেন বসে আছে। যতবারই কে? কে? বলে আওয়াজ দিয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া।
মৌটুসি চিন্তিত মুখে বলল, চোর টোর নয় তো বিজুদা?
তোমারও যেমন কথা দিদিমণি। দোতলার ছাদে চোর উঠবে কোথা দিয়ে? কেনই বা উঠবে? ছাদ থেকে নীচে নামার দরজা তো তোমরা ভোর হওয়ার আগে খোলো না। কাজেই চোর যদি ছাদে ওঠে, তাকে সারা রাত ছাদেই বসে থাকতে হবে। না, দিদিমণি, এ চোর নয়, ভূত।
মৌটুসি বলল, কেমন দেখতে তোমার ভূতকে?
অত্যন্ত গম্ভীরমুখে বিজনবিহারী উত্তর দিল, খালি গা, ফরসা ধবধবে গায়ের রং। সুন্দর করে ধুতি পরা, আর গলায় একটা চাদর জড়ানো। উদাস মুখে সে ওই মন্দিরের মেঝেতে গালে হাত দিয়ে বসে থাকে।
মৌটুসি হেসে বলল, এবার বুঝেছি। সাদা ধুতি, সাদা চাদর, ফরসা গায়ের রঙ। তোমার ভূতের সবটাই আসলে চাঁদের আলো দিয়ে বানানো। ওই মঞ্চের ফাঁক ফোকর দিয়ে জ্যোৎস্না এসে যখন নীচে পড়ে, তখন আলোছায়ার কারিকুরিতে মনে হয় একটা মানুষ বসে আছে। তুমি ও নিয়ে ভেবো না বিজুদা। ভয় করলে বরং আজ থেকে একতলার বৈঠকখানায় শুয়ো।
বিজনবিহারী স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, বাঁচালে দিদিমণি। তুমি যাই বলো, আমি নিজের চোখে যা দেখেছি তা অবিশ্বাস করি কেমন করে? আজ থেকে আমি নীচেই শোব।
তিন
রুম্পা, মানে চার বছরের কমলিনী বসু কিন্তু বিজুদার মতন অত ভয়টয় পায়নি। সে ক্রিসমাসের ছুটিতে ছাদের মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে পুতুল খেলছিল। খেলতে খেলতেই সে আড় চোখে দেখেছিল সেই লোকটাকে। বাবা গাছঘর বানাবে বলে যে কাঠের মন্দিরের মতন জিনিসটা নিয়ে এসে ছাদের মধ্যিখানে রেখেছে, সেই ঘরটার নীচেই লোকটা গালে হাত দিয়ে বসেছিল।
পুতুল খেলতে খেলতেই রুম্পা জিজ্ঞেস করেছিল, তোমার বুঝি মন খারাপ?
লোকটা জবাব দেয়নি।
রুম্পা বলেছিল, তুমি আমার সঙ্গে পুতুল খেলবে?
এবারেও কোনো জবাব না পেয়ে রুম্পা ভেবেছিল হাত ধরে ওকে টেনে আনবে। কিন্তু পুতুল রেখে যখন সে উঠে দাঁড়াল, তখন আর লোকটাকে দেখতে পেল না। কিন্তু আরও অবাক কাণ্ড, একটু বাদে সে দেখল তার মেয়ে পুতুলটার কপালে কে যেন সুন্দর করে চন্দনের আলপনা দিয়েছে।
আরও দু’চারবার এরকম ঘটনা ঘটার পর রুম্পা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, খেলবার ইচ্ছেই যদি আছে, তাহলে সামনে এসে খেল না কেন?
কিন্তু লোকটা এবারেও কোনো জবাব দিল না।
এই ঘটনাটার কথা যখন রুম্পা তার মাকে বলল, তখন মৌটুসি বলল, তুই নিশ্চয় বিজুদার হাবিজাবি গল্পগুলো শুনেছিস। আর এখন নিজে ওইরকম গল্প বানাচ্ছিস।
রুম্পা বলল, মোটেই আমি বানিয়ে বলছি না। তুমি নিজে গিয়ে দ্যাখো।
হ্যাঁ, দেখতে গিয়েছিল মৌটুসি। তবে তখনই নয়। দুপুরবেলায় রুম্পাকে ঘুম পাড়িয়ে সে চুপিচুপি ছাদে উঠে গিয়েছিল, কিন্তু গাছঘরের নীচে কাউকে বসে থাকতে দ্যাখেনি। দেখতে যে পাবে না সে ব্যাপারে মৌটুসি নিশ্চিত ছিল। তবে ওখানে দাঁড়িয়েই মৌটুসি একটা গন্ধ পেয়েছিল। চাঁপাফুলের গন্ধ। তাদের বাড়িতে চাঁপাফুলের গাছ নেই। তাছাড়া শীতকালে চাঁপাফুল ফোটেও না। মৌটুসি প্রথমে একটু অবাক হলেও, পরে ভেবেছিল, উত্তুরে হাওয়ায় অনেক দূর থেকে কোনো ধূপের গন্ধ ভেসে আসছে নিশ্চয়। যাই হোক, ব্যাপারটা নিয়ে সে আর বেশি ভাবেনি। আবার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসেছিল।
সেদিনই সন্ধেবেলায় রুম্পাকে বাড়িতে রেখে নির্মাল্যবাবু আর মৌটুসিকে একটু বেরোতে হল। কিছু কেনাকাটার ছিল। দিনটা ছিল শনিবার। শনিবার যেহেতু নির্মাল্যবাবুর কাজ কম থাকে তাই সেই দিনটায় ওরা প্রায়ই এখানে ওখানে ঘুরে আসে। কোনো দোকান টোকানে গেলে রুম্পা ভীষণ বায়না করে। তাই সেরকম কোথাও গেলে ওরা রুম্পাকে বিজুদার কাছে রেখে দিয়েই বেরোয়। ফেরবার সময় রুম্পার জন্যে ছোটখাটো কিছু কিনে আনতে হয় ঠিকই, তবু এই ব্যবস্থাতে ঝামেলা কম।
সেদিনও বেরোবার আগে ওরা দেখে গেল, কমল ছাদের বাগানে কাজ করছে, রুম্পা কমলের পায়ে পায়ে ঘুরছে আর যথারীতি আপনমনে বক বক করছে। বিজুদা নিচেই ছিল। রান্নাঘরে কাজ করছিল। সে নির্মাল্যবাবুরা বেরিয়ে যাওয়ার পরে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল।
তাই একটু পরে মোবাইলে বিজুদার কথাগুলো ওদের এত অবিশ্বাস্য লেগেছিল। বাড়ি থেকে বেরোনোর পরে বোধহয় আধঘণ্টাও কাটেনি, বিজুদা বাড়ির ল্যান্ডলাইন থেকে ফোন করে বলেছিল, দাদাবাবু, শিগ্গির আপনারা চলে আসুন। বড় বিপদ হয়ে গেছে।
যত জোরে পারে গাড়ি ড্রাইভ করে নির্মাল্যবাবু আর মৌটুসি বাড়ি ফিরলেন। বিজুদা দরজা খুলতেই রুম্পা ছুটে এসে মা—কে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। রুম্পা তো ঠিকই আছে। তাহলে কার বিপদ হল? নির্মাল্যবাবু কিছু বুঝতে পারছিলেন না। তিনি বিজুদাকে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বার বার সেই কথাটাই জিজ্ঞেস করছিলেন।—বিজুদা, বিজুদা। কী হয়েছে? কার বিপদের কথা বলছিলে? কী হয়েছে? কথা বলছো না কেন? ও বিজুদা…
বিজনবিহারীর অবস্থাটা তখন ঠিক সম্মোহিত কোনো মানুষের মতন। তার চোখে যেন দৃষ্টি নেই। মুখে কথা নেই। শুধু কোনোরকমে ইশারায় ছাদের দিকে আঙুলটা তুলে দেখালো। মৌটুসি আর নির্মাল্যবাবু পড়িমরি করে দৌড়ে ছাদে উঠে এসে যা দেখলেন, তাতে ওদেরও বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল।
সেই কাঠের মঞ্চের নীচের কমলের নিষ্প্রাণ দেহটা পড়ে আছে। কমলের শরীরে কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই, কোনো রক্ত নেই। শুধু মৃত্যুর পরেও তার চোখদুটো যেন ভয়ে বিস্ফারিত হয়ে রয়েছে। যে কেউ দেখলেই বুঝতে পারবে, প্রচণ্ড এক আতঙ্কেই কমলের শরীর থেকে প্রাণটা বেরিয়ে গেছে।
অনেকক্ষণ ধরে বিজুদা আর রুম্পার মুখে ভাঙা ভাঙা বিবরণ শুনে নির্মাল্যবাবু আর মৌটুসি যা উদ্ধার করতে পারল তা হল এই :
ওঁরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই কমল রুম্পাকে চেপে ধরে ওর হাত মুখ বেঁধে ফেলে। তারপর ওকে নিয়ে যখন ছাদ থেকে নামতে যাবে…
রুম্পার ভাষায়, ঠিক তখনই সেই লোকটা, সেই ফরসা মতন, খালি গায়ে লোকটা দুদিকে দুহাত ছড়িয়ে কমলের সামনে এসে দাঁড়াল। লোকটার মুখের দিকে তাকিয়েই কমলের হাত আলগা হয়ে যায়। রুম্পা তার কাঁধ থেকে ছাদে পড়ে যায়। আর কমল তখনও একদৃষ্টিতে সেই লোকটার মুখের দিকে তাকিয়েছিল।
রুম্পার কথা যদি বিশ্বাস করতে হয়, তাহলে লোকটার মুখ বলে কিছু ছিল না। মাথার ওপর দিয়ে জড়ানো চাদরের নিচে শুধু এক অন্ধকার শূন্যতাই জমে ছিল।
চার
এর পর যা যা হয় সবই হয়েছিল। পুলিশ এসেছিল নির্মাল্যবাবুর বাড়িতে। তারা কমলকে দেখেই চিনতে পারে। এর আগেও একটা কিডন্যাপিং—এর কেসে কমলকে তারা সন্দেহ করেছিল। তবে প্রমাণের অভাবে সেবার কমলকে আটকাতে পারেনি।
বোঝাই যাচ্ছে এবারেও কমল রুম্পাকে কিডন্যাপ করতেই চেয়েছিল। বিজনবিহারীর মতন এক বৃদ্ধকে মেরে অজ্ঞান করে ফেলতে তো ওর বেশি সময় লাগত না। বাইরে রাস্তায় নিশ্চয় তার সঙ্গীরাও গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। শুধু সেই অশরীরীর আবির্ভাব আর তাকে দেখে কমলের হঠাৎ মৃত্যুই তাদের সাজানো পরিকল্পনা বানচাল করে দিল।
পুলিশ কমলের মৃত্যুটাকে আকস্মিক হার্ট অ্যাটাক বলেই মনে করেছে। পোস্ট—মর্টেম রিপোর্টও সেরকমই বলছে। কাজেই পুলিশের কাছেও কেস বাতিল হয়ে গেল।
বাতিল হল না শুধু নির্মাল্যবাবুর কাছে। বাড়ির পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হওয়ার পরেই তিনি ফিরে গিয়েছিলেন গিরিপানির রাজবাড়িতে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ওই ছাউনিটার পেছনে এমন কোনো ইতিহাস আছে যার জন্যেই ওই বিষণ্ণ অশরীরী বার বার ওটার নিচে ফিরে আসে।
সে কে?
সেই উত্তরটা জানবার জন্যেই নির্মাল্য বসু আবার ফিরে গেলেন গিরিপানিতে। রাজা সুপ্তিদেব সব শুনে মোটেই হেসে উঠলেন না, বরং গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, মিস্টার বোস, আমি ছোটবেলা থেকেই ওই ছাউনিটার সঙ্গে জড়িত একটা কাহিনির কথা শুনছি। কিন্তু বিশ্বাস করিনি। ভেবেছি গ্রাম্য মানুষজনের কল্পনা। তাই সেদিন আপনাকে সে কথা বলিওনি। কিন্তু আজ আপনি যা বলছেন, তার সঙ্গে সেই কাহিনি বেশ মিলে যায়।
একটু ভেবে নিয়ে সুপ্তিদেব মহাপাত্র বলতে শুরু করলেন :—
আমার দাদুর বাবা তখন গিরিপানির রাজা। তখন রাজারা ছিলেন সত্যিকারেই রাজা। আমার মতন নাম কে ওয়াস্তে রাজা নন। ওই পুরনো রাজবাড়ি তখন লোক লস্করে গম গম করত। সৈন্য ছিল, সামন্ত ছিল, হাতি ঘোড়া সবই ছিল। আর সেই রাজার ছিল একটি ছোট্ট মেয়ে। রাজকুমারী সুহাসিনী। রানিমা আর রাজামশাই তাকে আদর করে হাসি বলে ডাকতেন।
এই হাসিকেই একদিন রাজবাড়ির বাগান থেকে কেউ চুরি করে নিয়ে যায়। কাজটা সহজ ছিল না। কারণ, বুঝতেই পারছেন, একজন রাজকুমারী তো আর বিনা পাহারায় যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায় না। হাসির সঙ্গেও পাহারাদার ছিল। উনিশ কুড়ি বছরের সেই ছেলেটার নাম ছিল বলরাম। সে ছিল হাসির সব থেকে বড় বন্ধু। সে ঘোড়া হত, হাসি তার পিঠে চাপত। গাছের সবচেয়ে উঁচু ডাল থেকে সে হাসির জন্যে চাঁপা ফুল পেড়ে আনত। হাসির পুতুলের জন্যে সে কাঠকুটো দিয়ে চমৎকার পুতুলের ঘর বানিয়ে দিত।
বলরাম আর হাসির প্রিয় খেলার জায়গা ছিল বাগানের এক কোনায় নিরিবিলি দাঁড়িয়ে থাকা ওই লতা কুঞ্জ। তখন ওই কুঞ্জ ঘিরে মাধবীলতার বন ছিল। ওখানেই চারবছরের হাসি তার বলরামদাদার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেলা করে কাটিয়ে দিত। যেদিন সুহাসিনী হারিয়ে যায়, সেদিনও সে বলরামের সঙ্গে ওই মাধবীকুঞ্জেই খেলা করছিল।
তবু সুহাসিনী কীভাবে হারিয়ে গেল?
স্বাভাবিকভাবেই অনেকে সন্দেহ করেছিল, বলরাম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। প্রতিবেশী কোনো রাজার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে সে নিজেই সুহাসিনীকে তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। তা ছাড়া আর কীভাবে রাজকুমারীর হারিয়ে যাওয়া সম্ভব?
বলরামের শাস্তি সঙ্গে সঙ্গেই হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। হয়নি যে তার বড় কারণ, রানিমা, মানে হাসির মা। তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করলেন না যে বলরাম হাসির কোনো ক্ষতি করতে পারে। বরং তিনি বলরামের কথাই বিশ্বাস করলেন:— সে না কি হাসির বায়নায় বাগানের পদ্মদিঘি থেকে পদ্মফুল তুলে আনতে গিয়েছিল। ফিরে এসে আর হাসিকে দেখতে পায়নি।
হাসি হারিয়ে যাওয়ার পর ঠিক এক সপ্তাহ বলরাম বেঁচেছিল। ওই এক সপ্তাহ সে পাগলের মতন রাজবাড়ির আশেপাশে ঘুরে বেড়াত। ওই কদিন তাকে কেউ খেতে দ্যাখেনি, ঘুমোতে দ্যাখেনি। সারাক্ষণ সে সম্ভব অসম্ভব সমস্ত জায়গায় হাসিকে খুঁজে বেড়াত। এক সপ্তাহ বাদে হাসি আর বলরামের প্রিয় খেলার জায়গা ওই মাধবীকুঞ্জের নীচ থেকে বন্দুকের আওয়াজে সবাই চমকে ওঠে। সবাই দৌড়ে গিয়ে দ্যাখে বলরাম ওই কাঠের ঘরের মেঝেয় চিৎ হয়ে পড়ে আছে। তার হাতে ধরা বন্দুক থেকে তখনও ধোঁয়া বেরোচ্ছে।
বলরাম কি আত্মহত্যা করেছিল? না কি বন্দুক পরিষ্কার করতে গিয়ে আচমকাই তার হাত থেকে গুলি ছুটে গিয়েছিল? সে কথা কেউ স্থির করে কোনোদিনই বলতে পারেনি।
তবে আজ আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে বলরাম বেঁচে থাকতে যে ভুল করেছিল, মৃত্যুর পর সেই ভুল আর দ্বিতীয়বার করেনি। একবার সে হাসিকে হারিয়েছিল। অন্যমনস্কতার সুযোগে রুম্পাকে আর হারাতে দেয়নি।
.
গিরিপানি থেকে ফিরে আসার পর নির্মাল্যবাবু সেই কাঠের মঞ্চটাকে আবার যথাস্থানে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন। কারণ তাঁর এবং মৌটুসির বিশ্বাস— আজও গিরিপানির ওই প্রাচীন প্রাসাদের পরিত্যক্ত বাগানে, ওই ভাঙা মাধবীকুঞ্জের নিচে শুধু বলরাম নয়, হাসিও ফিরে আসে। ওখানেই তারা আজও খেলাঘর সাজায়।
জেনেশুনে কি কেউ কোনো শিশুর খেলাঘর নষ্ট করে?