খুদা-ঈ-খিদমতগার
”কমিউনিজম কেন ফেইল করল বল তো? সোবিয়েত ইউনিয়নটা গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে গেল কেন?”
অপু মাথা নাড়ল। জানে না।
”বিকজ ইট ডিড নট হ্যাভ আ প্রপার মার্কেটিং সিস্টেম। আরে বাবা একটা জিনিস তুমি বাজারে ছাড়বে, তার প্রপার মার্কেটিং চাই তো! কমিউনিজমের একটা ঠিকমতো U.S.P—ই ঠিক করতে পারল না সোবিয়েত ইউনিয়ন। ওয়ার্লড মার্কেট ধরতে হলে একটা ইউনিক সেলিং পয়েণ্ট দেখাতে হবে তো? একটা U.S.P? যে কোনও একটা কনসেপ্ট বাজারে সেল করতে হলে মার্কেটিং ম্যানেজমেন্টটা এফিশিয়েন্ট হওয়া দরকার। অমনি অমনি শুধু বিপ্লব বাধিয়েই ওসব কম্মো হয় না। বুঝলি? পৃথিবীটা খুব কঠিন ঠাঁই। এবরিওয়ান নিডস আ গুড মার্কেটিং ম্যানেজার। কমিউনিজম ডিড নট হ্যাভ ওয়ান।”
অপুটা হাঁ করে তাকিয়ে আছে শ্যামলদার মুখের দিকে।
এমন আশ্চর্য সব কথা বলে শ্যামলদা। আর কথাগুলো যখন বলে, তখন ওর সমস্ত চেহারাটা যেন বদলে যায়। এমনিতেই সুন্দর। আরও সুন্দর দেখায় ওকে তখন, চোখমুখ থেকে একটা জ্যোতি ঠিকরে বেরোয়। লম্বা বাদামি চুল টেনে পিছনে একটা ঝুঁটি বাঁধা রবার ব্যান্ড দিয়ে। হাল্কা দাড়ি গোঁফে যিশু যিশু ভাব। জিনসের ওপরে রঙিন কুর্তা চড়িয়ে চকচকে একটা বেগুনিরঙের সাইকেলে চড়ে আসে—অপু মুগ্ধ হয়ে যায়। দীপু বলছিল—”শ্যামলদা ওয়াল স্ট্রিটে দালালি করে কেমন করে রে? ওইরকম লম্বা চুল দাড়ি গোঁফ নিয়ে? শুনেছি ওয়াল স্ট্রিট খুব কনজারভেটিভ জায়গা, বিজনেস স্যুট পরে টিপটপ হয়ে থাকতে হয়, জুতোয় পালিশ, চুলে তেল, হাতে দামি ব্রিফকেস—শ্যামলদা তো একদম সেরকম না? কবি—কবি, প্রফেসর—প্রফেসর দেখতে।” অপুর মনে ধরল কথাটা। জিজ্ঞেস করতে হবে শ্যামলদাকে। সত্যিই তো শ্যামলদা আমেরিকা থেকে এসে অবধি পাড়াটায় নতুন প্রাণ এসেছে। সারাক্ষণ হইহই। গলা খুলে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে গাইতে গলি দিয়ে যায়। সকলকে ডেকে কথা বলে। অপু দীপুরা শ্যামলদাকে দেখেছে খুব ছোটবেলাতে। দিদিদের হিরো ছিল শ্যামলদা। দিদি তো এখন শ্বশুরবাড়িতে। শ্যামলদা খোঁজ নিয়েছিল।
”রুপুর কী খবর? কাজকর্ম কিছু করে, না রান্নাবান্না বাচ্চাবাচ্চা নিয়েই কাটিয়ে দিচ্ছে?”
দিদি কলেজে পড়ায় শুনে খুশি হয়েছিল। শ্যামলদার নিজের কলেজের পড়াশুনো শেষ হয়নি। সে নিয়ে তার কোনও দুঃখ আছে বলে মনে হয় না। যা অসীম পড়াশুনো শ্যামলদার! চিরদিনের বইপাগলা ছেলে।
”ওয়াল স্ট্রিট তো খুব ফর্ম্যাল জায়গা বলে শুনেছি, তোমার লম্বা চুল নিয়ে অসুবিধে হয় না শ্যামলদা?”
”কথাটা খুব ভুল বলিসনি, আগে ওইরকমই ছিল। এখনও আছে। কনজারভেটিভ জায়গা তো বটেই। এখনও স্যুট পরে অফিসে বসতে হয়। কিন্তু লম্বা চুল এখন চালু হয়ে গেছে, এলোমেলো না হলেই হল। বড় বড় বিজনেসম্যানদের ছবি দেখিস না? দাড়িগোঁফ লম্বা চুল এখন ফ্যাশন। ভার্জিন এয়ারলাইনসের কর্তা ব্র্যানসেনের ছবি দেখিসনি কাগজে? আমেরিকা বদলাচ্ছে। ইয়ং এক্সিকিউটিভরাও তো অনেকেই এরকম ঝুঁটি বাঁধে। আর শেয়ার মার্কেটে এখন অনেক অ্যাকাডেমিকসও আসছে, অ্যান্ড ইউ নো, হাউ দে ড্রেস!”
”শেয়ার মার্কেটে তুমি গেলে কেমন করে শ্যামলদা?”
”খেলাধুলোয়। খেলাধুলোয়। কাজ করতাম একটা গারমেন্টস ফ্যাক্টরিতে, ডেলি ওয়েজের কুলি। ফ্যাক্টরির বন্ধুদের সঙ্গে খেলায় খেলায় অঙ্ক কষে শেয়ারের হালচাল বলে দিতাম। সেই ছেলেগুলো এমনই জিততে লাগল শেয়ার মার্কেটে, যে বস—এর কানে আমার সুনাম পৌঁছে গেল। বস—এর যাতায়াত ছিল শেয়ার মার্কেটে। হতে হতে একদিন দেখলাম ওয়াল স্ট্রিটে আমারও একটা অফিস হয়ে গেছে। একেবারে র্যাগস—টু—রিচেস স্টোরি।”
শ্যামলদা কখনও ওয়াল স্ট্রিটের দালাল হয়ে যাবে এটা বাড়ির কেউ ভাবতে পারেনি। বইমুখো খ্যাপাটে গানপাগল ছেলেটা যে হঠাৎ বিপ্লবী হয়ে যাবে, সশস্ত্র রাজনীতি করে জেলে যাবে, তাতে বাড়ির লোক তত অবাক হয়নি। অবাক হল যখন শুনল প্রেসিডেন্সি জেল ভেঙে যে বারোটা ছেলে পালিয়েছে তাদের মধ্যে শ্যামলদাও ছিল। পালাল এবং ধরাও পড়ল না কোনদিন। বাড়ির লোকে ধরে নিয়েছিল গুমখুন হয়ে গিয়েছে। মাসিমা শয্যা নিয়েছিলেন, মেশোমশাইয়ের একটা স্ট্রোক হয়ে গেল। শোভনদা রাজনীতি করত না। সে আই আই টিতে মন দিয়ে পড়াশুনো করত। শোভনদা দারুণ রেজাল্ট করে অভাবনীয় চাকরি জোগাড় করে ফেলল। কিন্তু হিরো হয়ে রইল উধাও হয়ে যাওয়া শ্যামলদাই। চার বছর বাদে নিউইয়র্ক থেকে চিঠি এল।
”মাগো, ভাল আছি, ভাবনা কোরো না, দেশের অবস্থা আর—একটু ভাল হলেই ফিরব।”
জেল ভেঙে পালানো দুর্দান্ত বিপ্লবী শ্যামলদা আমাদের কল্পনার হিরো হয়ে উঠেছিল, আমেরিকা অভিবাসী শ্যামলদা হচ্ছেন বাস্তবের হিরো। কিন্তু শ্যামলদা ফেরেনি। চিঠি লিখত। টাকা পাঠাত। শ্যামলদার টাকাতে একতলা ভাঙাচোরা বাড়িটা আস্তে আস্তে তেতলা হল। ক্রমশ মাসিমা মেসোমশাই বুড়ো হয়ে গেছেন, শোভনদা আরও ভাল কাজ করছে, বিয়ে করেছে, টুকুবৌদি ইস্কুলে পড়ায়, শ্বশুরশাশুড়ির যত্ন করে, দুটো বাচ্চাকে মানুষ করে।
এত বছর বাদে হঠাৎ পাড়াসুদ্ধ চমকে দিয়ে শ্যামলার পুনরাবির্ভাব কোনও খবর না দিয়ে—মেসোমশাইয়ের আশি বছরের জন্মদিনটি মনে করে জ্যেষ্ঠপুত্র এসে উপস্থিত। রোগা কিন্তু সুপুরুষ শ্যামলদাকে যেন শোভনদার চেয়েও ছোট দেখাচ্ছে, হাঁটাচলা, নড়াচড়া, হাবভাব। এমনকী চেহারাও অনেকটা আগের মতনই রয়ে গেছে। রোগা পাতলা, ছটফটে, অন্যমনস্ক, স্বপ্নচারী শ্যামলদা।
মাসিমার মুখে পরিতৃপ্তি, আর শান্তি যেন চাঁদের আলোর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। হাতে মুখে খরচও করছে শ্যামলদা। আপন—পর ভেদ নেই। পাড়াপড়শির জন্যেও তার ওয়ালেটে প্রচুর মমতা উপচে পড়ছে। মেসোমশাইয়ের মনে কিন্তু সুখ নেই। হায়ার সেকেন্ডারিতে ফার্স্ট হওয়া ছেলে গ্রাজুয়েশন পর্যন্ত করল না, এ দুঃখু তাঁর যাবার নয়। শোভনদা যে এত ভাল রেজাল্ট করে এমন দারুণ চাকরি করছে, তাতেও তাঁর হতাশা ঘোচেনি। কিন্তু শ্যামলদার বর্তমান কেরিয়ার মেসোমশাইকে মর্মাহত করেছে। যে—ছেলের অঙ্কে মাথা ছিল দৈবশক্তির মতন, যার দ্বিতীয় আইনস্টাইন হবার কথা, সে কিনা হয়েছে নিউইয়র্কের শেয়ারবাজারের দালাল! মেসোমশাইয়ের মুখে হাসি নেই।
শোভনদা বোঝায়, ”শেয়ার মার্কেটের দালালি” বলতে তোমরা যেটা বুঝতে, ‘ফিনান্সিয়াল অ্যানালিস্ট”রা কিন্তু তা নয়। এটা অনেক বেশি সায়েন্টিফিক কাজ বাবা, খুব ডিগনিফায়েড প্রফেশন, এখন—প্রচুর রোজগার এতে”—মেসোমশাই চুপ করে থাকেন।
শ্যামলদাকে দেখেশুনে ”শেয়ার মার্কেটের দালাল” মনে করা শক্ত। ব্লু জিনস, কারুকাজ করা পাঞ্জাবি, পিছনে ঝুঁটি, কচিবেলার রবিঠাকুরের মতন গোঁফদাড়ি, আর স্বপ্ন স্বপ্ন চোখ করে ঘুরে বেড়ায়, গা থেকে দামি সুগন্ধ বেরোয়, পেটমোটা ওয়ালেট থেকে যখন তখন পাড়াসুদ্ধ সকলের জন্যে কোকাকোলা, চা, চিকলেট, সিগারেট, চলে আসে। বিশেষত অপুর জন্যে। অপু শ্যামলদার সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে পড়েছে। যেটুকু সময় কলেজে না গেলেই নয়, সেটুকু বাদে। দীপু একদিন ”রামভক্ত হনুমান” বলে খ্যাপাতে গিয়ে বিনুনিতে হ্যাঁচকা টান খেয়ে চুপ করে গেছে।
শ্যামলদার প্রতি অপুর ভক্তি খুব সিরিয়াস ব্যাপার। যে—লোকটা হায়ার সেকেন্ডারিতে ফার্স্ট হয়েও লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে জেলে যেতে পারে, জেল ভেঙে শূন্যহাতে পালাতে পারে এক্কেবারে সাতসাগরের ওপারে আমেরিকায় এবং ফিনান্সিয়াল অ্যানালিস্ট হয়ে নিউইয়র্কে বাড়ি গাড়ি করতে পারে—যার প্রত্যেকটা রবীন্দ্রসঙ্গীত মুখস্থ, এবং সেই সঙ্গে বিটলদের গান, সাইমন গারফুংকেলের গানও, যে এমন আশ্চর্য সব ভাবনা ভাবতে পারে এবং বুঝিয়ে বলতে পারে, তাকে ভক্তি না করলে কাকে করবে অপু?
”কমিউনিজম ফেইল করবার আর একটা কারণ, সেকেন্ড পয়েন্টটা কি বলত অপু?”
”কী কারণ? তুমিই বলো।”
”এই জায়গাটাতে স্ট্যালিনের সঙ্গে গাঁধীজির কোনও তফাত নেই। কী? পারবি বলতে?”
”দরিদ্রনারায়ণ?”
”দূর দূর! স্ট্যালিনের আবার ‘নারায়ণ’ কী? আবার ভাব। কোনখানে মিল দুজনের?” অপু মাথা নাড়ে। অপু জানে না কোনখানে মিল স্টালিনের সঙ্গে গাঁধীর।
”তবে শোন। সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বুঝতে পারলি তো? দু’জনেরই উদ্দেশ্য ছিল সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করবার। নতুন সমাজব্যবস্থার প্রবর্তনের পরিকল্পনা এবং প্রযুক্তি। স্ট্যালিন করছিলেন স্ট্যালিনের স্টাইলে, গাঁধী করছিলেন গাঁধী স্টাইলে। কিন্তু কাজটা একই, সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। পরিকল্পনা দুটো আলাদা। প্রযুক্তিও আলাদা। দুজনেই নতুন পরিকাঠামো গড়তে চেয়েছিলেন। বুঝলি তো, তাকেই বলে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং।”
অপু মুগ্ধ।
শ্যামলদা মিটিমিটি হাসতে হাসতে বলে—”জগতের গ্রেটেস্ট সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারের নাম কী? বল? বলতে পারবি তুই। জানিস নামটা। তোর চেনা লোক।” কোকে চুমুক দিয়ে সিগারেটে টান মেরে, ভুরু কুঁচকে, চুলে হাত বুলিয়ে, শেষে বোকা হেসে অপু বলল—”মাও সে তুং?”
”হল না, হল না!” শ্যামলদা মাথা নাড়ে।
”রং অ্যানসার। ইতিহাসে মাও আর ক’দিন। ওর ওই লালবই এবার সাদাবই হল বলে। ওদেরও তো কোনও মার্কেটিং ম্যানেজমেন্ট বলে পদার্থ ছিল না। প্লেটো, মার্ক্স, কাগজকলমে চেষ্টা করেছিল। হিটলার হাতেকলমে। কোনও না কোনও উপায়ে ইতিহাসে দেখবি মানুষ কিন্তু চিরটা কালই সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রচেষ্টা করে আসছে। ভুল পথে, ঠিক পথে, ভালোয় মন্দয়। অতি বিচিত্র মানুষের ইম্যাজিনেশন। কিন্তু সাকসেসফুল হয়েছে কেবল একজন তার কথাই বলছি। সে আমাদেরই স্বদেশবাসী—রামমোহন তাকে একটু হটাতে চেষ্টা করেছিলেন, বিদ্যাসাগর আর—একটু। কেউই ঠিক পেরে ওঠেননি। ড্যাংডেঙিয়ে রাজত্ব করে চলেছে সে এখনও। এবার বল? কে? আরে আমরা সকলে তো তারই ইঞ্জিনিয়ার্ড সোশ্যাল স্ট্রাকচারের মধ্যে আজও বসবাস করছি! এখনও ধরতে পারলি না? মনু রে, মনু! একমেবাদ্বিতীয়ম মনু!”
”তুমি, তুমি মনুকে শ্রদ্ধা করো!” হঠাৎ অপুর গলা চিরে আর্তনাদ বেরুল।
”শ্রদ্ধা—অশ্রদ্ধার কথা হচ্ছে না। প্র্যাকটিসের কথা, এফেকটিভনেসের কথা হচ্ছে। টিঁকে তো আছে! একমেবাদ্বিতীয়ম। ওর মতোই অ্যাগ্রেসিভ একটা অলটারনেটিভ যদ্দিন না কেউ দিচ্ছে, তদ্দিন ওরই রাজত্ব চলবে। মনু অবশ্য জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও বিশ্বাস করত। ওইসব জাতিভেদ বর্ণভেদ ওই কারণেই। এসব ব্যবস্থা গুড না ব্যাড, পরের কথা। দি গ্রেটেস্ট সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ার অফ দি ওয়ার্লড, তাতে তো সংশয় নেই!”
দীপু শুনে শিউরে উঠল—”এ কথা শুনলে ভাজপা তো হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে বিলি করবে রে। শিগগির বারণ কর তোর শ্যামলদাকে পাবলিককে এসব কথা বলতে। ওর তো কোনওই প্র্যাকটিক্যাল সেন্স নেই দেখছি। রাজনীতি ফাজনীতি করত কেমন করে?”
—”নেইই তো প্র্যাকটিক্যাল সেন্স”—অপু বলল মাথা ঝাঁকিয়ে। ”থাকবার দরকারই বা কী? হি ইজ আ ড্রিমার। স্বপ্ন নিয়েই আছে—আর দেখছিসই তো কেমন সন্ন্যাসীর মতন স্বভাব। প্র্যাকটিক্যাল হলে কি হরিকে নতুন রিকশা কিনে দিত? না কৌশল্যার মেয়ের বিয়ের জন্যে পাঁচ হাজার টাকা দিত? না বটতলার নাপিত মনসুরের ছেলের টিউমার অপারেশনের পুরো খরচটা দিয়ে দিত?” শ্যামলদা এই পৃথিবীর মানুষ না রে দীপু—এই পৃথিবীতে ওর মতো কাউকে আমি দেখিনি।
দীপু মুখ বেঁকিয়ে বলল—”আমিও না!”
”অপু। দেবতারা সর্বশক্তিমান, তবু তারা মহাকাব্যের হিরো হয় না কেন বলতে পারিস? কেননা তাদের মৃত্যু নেই। মৃত্যুর মূল্যেই মানুষ হিরো হয়। জীবনের কাছে দাম পায়। বুঝলি? যে মরে না, মরবে না, তার তো শোক যন্ত্রণা বিরহ বেদনা কিছুই নেই। সে ইন্টারেস্টিং পার্সনালিটি হবে কেন? ঋষিরা কেন যে অমরত্বের বর চাইত, তপস্যা করে অমর হতে চাইত, আমি বুঝতে পারি না। মৃত্যুই মানুষকে মহত্ত্ব দেয়। অমরত্ব জীবনকে বড় খেলো করে দেয়। তাই না? চিরজীবী হওয়াটা কোনও কাজের নয়!” অপু শ্যামলদার কথাগুলো রাত্তিরে শুয়ে শুয়ে ভাবে। কি অদ্ভুত ভাবনাগুলো শ্যামলদার।
”আমি অমরত্ব চাই না, আমি জীবন চাই, বাঁচতে চাই। আমি কী চাই জানিস অপু? যতদিন তার আয়ু আছে প্রতিটি মানুষ স্বাস্থ্যে, আনন্দে, কর্মে পরিপূর্ণ হয়ে বাঁচুক। ঈশ্বরের তাই ইচ্ছে। আমি তো ঈশ্বরের বাহন মাত্র। খোদা—ঈ—খিদমতগার। আমি খোদার খিদমত খাটি। আমার নিজের কোনও ইচ্ছে নেই।” শ্যামলদার সব কথা অপু ঠিক বুঝতে পারে না তবু শুনতে ভাল লাগে।
”অপু আমি হাজারিবাগে পঞ্চাশ একর জমি কিনেছি। কমলই সব বন্দোবস্ত করে দিচ্ছে। আশ্রম করব। ছোট ছোট থ্যাচড কটেজ। কুটির আর কী, বারান্দা, কিচেনেট, টয়লেট। যে কেউ চাইবে ওখানে গিয়ে থাকতে পারবে আপটু তিন মাস। ধ্যানকেন্দ্র, মেডিটেশনের সেন্টার। ফ্রি। তুইও যেতে পারিস। কিন্তু বউবাচ্চা নিয়ে সপরিবারে হল্লা করতে যেতে পারবে না কেউ। এটা আশ্রম। সাধনার স্থান। হলিডে রিসর্ট নয়। সংসারী মানুষের যখন দুদণ্ড সংসার থেকে ছুটি নিতে ইচ্ছে করবে, ঈশ্বরের কথা ভাবতে ইচ্ছে করবে—সে তখন ওই আশ্রমে চলে আসবে। ধ্যান করবে। নির্জনে বিজনে অরণ্যে নদীকুলে নিজের সাহচর্যে একা কিছুটা সময় কাটাতে পারবে। নিজের সঙ্গে নিজের আত্মিক সংযোগ পুনঃস্থাপন করবে। সুন্দর এই পৃথিবীর সঙ্গে নিজের সম্পর্ক পুনরাবিষ্কার করবে। টু গেট ইন টাচ উইথ ইওর সেলফ অ্যান্ড উইথ দ্য ওয়ার্লড আগেইন। আমি আর নিউইয়র্কে ফিরব না ভাবছি। আমার আর টাকার দরকার নেই। আমি এবার হাজারিবাগে গিয়ে ওদের সঙ্গে মাদল বাজাব, বাঁশি বাজাব। বনেই বাস করব। বানপ্রস্থ নেব ঠিক করেছি।”
কেন শ্যামলদা? তুমি বনে বাস করবে কোন দুঃখে? তোমার তো স্ত্রীপুত্র রয়েছে, ঘরসংসার সবই রয়েছে।”
”দুঃখেই কি লোকে বনে যায়? সুখেও তো যায়। আমি মনের সুখে বনে যাব। মানুষের ‘ঘর’ এক জিনিস, আর ‘সংসার’ আর একটা। নিউইয়র্কে আমার ‘ঘর’ আছে যেমন এই এখানেও। এ—’ঘরে’ থাকব। ‘ও—ঘর’ স্ত্রীপুত্র। কিন্তু সংসারটা আরও বড়। তার ভেতরে অনেক মানুষ। অনেক প্রাণী। তাদের প্রবল স্থানাভাব। তাদের আশ্রয় চাই। আমার আশ্রমে তারা সবাই গিয়ে থাকবে। তাদের সকলকে আমি রাখব। তোকেও রাখব।
”প্ল্যান তো এইটে। কিন্তু করতে দিলে তো। যারা বাধা দেবার তারা ঠিকই বিঘ্ন ঘটাবে। তারা ঠিকই নজর রেখেছে। আমি খুদা—ঈ—খিদমতগার। ওরা যে যাই বলুক যে যতই বাধা দিক, আমি ওদের বাধা মানব না। আমি যে খোদার খিদমত খাটি, সেটা ওদের মনে নেই।”
অপু দ্যাখে শ্যামলদার চোখ চকচক করছে।
—”ওরা কারা? কারা? শ্যামলদা।”
—”ওরা? ওরা হচ্ছে ডবলু ডবলু আই বি, ওদের নেট ওয়ার্ক প্রচণ্ড। সি বি আই, এফ বি আই, কে জি বি, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড, সব্বাই আছে ওদের মধ্যে। ওরা হল মাদার বডি। বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতেছ কেমনে দিই ফাঁকি? যাতেই পৃথিবীর উপকার হয়, তাকেই ওরা ক্রাইম বলে। আমার পিছনে কি আজ লেগেছে? নাঃ, এবার ইউ এন হিউম্যান কমিশনকে ইনফর্ম না করলেই নয়—এবার অবস্থা বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।”
অপু অবাক চোখে চেয়ে চেয়ে শোনে। শ্যামলদার সব কথা অপু সব সময়ে ঠিকমতন বুঝে উঠতে পারে না। এরপরেই শ্যামলদা অন্যরকম চোখে তাকাল, অন্যরকম গলায় বলল—
”জানিস অপু, ঘুম ভেঙে আমি রোজ কী করি? রোজ মনে করি আঃ। আরও একটি সূর্যোদয় আহা, আরও একটা দিন। মনে করি কত ভাল ভাগ্য আমার, এত সুন্দর পৃথিবীতে আরও এক দিন রয়েছি! ইউ মাস্ট কাউন্ট ইয়োর ব্লেসিংস, অপু। নেভার টেক লাইফ পর গ্রান্টেড!”
এমন তো হতেই পারে এক দিন সকালবেলা আর ঘুম ভাঙল না। নিদ্রা তো এক রকমের সাময়িক মৃত্যুই। জীবন যদি মায়াই হয় তবে—আমাদের ঠিক ঠিক বিশ্বাসের সুতোটা ধরে রাখতে হবে, যাতে এই বিপুল ল্যাবিরিনথে হারিয়ে না যাই। মৃত্যু সীমাহীন। শূন্যতার একটা বিষম ভীতি আছে—সীমাহীনতার প্রতি ভয় আছে আমাদের, তাই মৃত্যুকে ভয় করি। জীবনই নিরাপদ, জীবনে পূর্ণতা। কেননা জীবন সীমিত।” শ্যামলদা বলে,—”রবীন্দ্রনাথের কথা ভাববি। প্রতিদিন সকালে উঠে উনি জীবনকে সেলিব্রেট করতেন। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত, সব সময়ে। এভরি ডে। এভরি আওয়ার অফ দ্য ডে। এভরি মোমেন্ট। আমিও করি। রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে আই সেলিব্রেট লাইফ। বিকজ আই অ্যাম অ্যালাইভ। বিকজ দ্য ওয়ার্লড ইজ স্টিল হিয়ার। মা যেটা করেন ঠাকুরঘরে গিয়ে ফুলচন্দন দিয়ে। সেই একই ব্যাপার। এক কাজ, সেলিব্রেটিং লাইফ।
”ভক্তিতে আর যুক্তিতে কতটুকু তফাত? এই যুক্তি ব্যাপারটা নিজে কতদূর যুক্তিযুক্ত? আমি প্রায়ই ভাবি। হাউ র্যাশনাল ইজ র্যাশনালিটি?
আফটার অল মৃত্যুই বেঁচে থাকার শেষ যুক্তি। একমাত্র যুক্তি। তাই উপনিষদ বলে আনন্দেই জীবের জন্ম, জীবের প্রাণধারণ, এবং জীবের বিনাশ। বেঁচে যে আছি, এটাই মহা আনন্দের কারণ। অন্য কোনও কারণের প্রয়োজন নেই। সুফী কবিদের কিছু পড়েছিস? মিস্টিক সেইন্টরা এসব তত্ত্ব বুঝতেন। পড়েছিস?” অপু পড়েনি।
”কী। বইটই কিছু পড়িস তোরা আজকাল?”
”পড়ি তো। এই তো এই বইটা কাল শেষ করেছি।” ব্যাগ থেকে অপু বইটা বের করে ফ্যালে। মারিও ভার্গাস লেসার—এর ”আন্ট জুলিয়া অ্যান্ড দি স্ক্রিপট রাইটার।” উল্টেপাল্টে দেখে শ্যামলদা বলল ”তোর পড়া হয়ে গেছে?”
”হ্যাঁ অভীককে ফেরত দিতে যাচ্ছি।”
”আজকের দিনটা আমাকে ধার দিবি?”
অপু তো সানন্দে রাজী। তার কাছে বই ধার নিচ্ছে শ্যামলদা!
”অপু, র্যাশনালিটিটাকেই শেষ কথা জেনে আমরা ভীষণ ভুল করে ফেলেছি। সায়েন্সের ছাত্রদের ওটাই প্রথম ফলস স্টেপ। তোরাও এই একই ফাঁদে পা দিবি—ইকনমিকস পড়ছিস তো? ভয়ংকর সত্য দর্শন ঘটবে একদিন।”
”তার মানে।”
”মানে এক দিন জানতে পারবি র্যাশনালিটির দৌড় কতদূর। এক দিন দেখবি সব দেওয়ালগুলো ভেঙে পড়ছে, ঘুম ভেঙে চোখ মেলে দেখবি খাঁ খাঁ ফাঁকা মাঠের মধ্যে তুই একা দাঁড়িয়ে আছিস তোর পাশে কেউ নেই।—মা নেই বাবা নেই ভাই নেই বোন নেই বন্ধু নেই প্রেমিকা নেই—”
”শ্যামলদা!”
”স্ত্রী নেই, সন্তান নেই, দেখবি তোর মাথার ওপরে ছাদ নেই ভীষণ উঁচু আকাশ—চারিপাশে দেয়াল নেই, শনশন করে ঝোড়ো বাতাস বসছে, এই হচ্ছে তোর র্যাশনালিটির আসল চেহারা। সকলের জীবনেই এমন মুহূর্ত একদিন না একদিন আসে। আসতে বাধ্য। তখন কী করবি?”
”শ্যামলদা তুমি এসব কথা ভেবো না তো।”
”ভাববো না কি রে। এই কথাই তো ভাবব। সকলেরই শান্ত মাথায় ভাবা উচিত হাউ র্যাশনাল ইজ র্যাশনালিটি? ইট ইজ ইমপর্ট্যান্ট ফর আওয়ার সারভাইভ্যাল।”
”তুমি তাহলে এসব ভাবনাগুলো লেখ না কেন? যদি জরুরি ভাবনা হয় তবে তো লিখে ফেলা উচিত।”
”উচিত তো। কিন্তু কেউ ছাপাবে না। ওরা আটকে দেবে। তোকে একটা কথা বলছি শোন, তোরা তো ইকনমিক্সে ম্যাক্রো—মাইক্রো করিস। মনুষ্যসমজেরও মাইক্রো—ম্যাক্রো আছে। একটা মাইক্রো সোসাইটি রয়েছে তাতে যত সেনসিটিভ সোলগুলো বিলং করে—যাদের চিত্তে গভীরতা আছে, অন্তরে স্পর্শকাতরতা আছে, ভাবনায় সূক্ষ্মতা আছে, যারা অন্যের কথা ভাবে। এদের মধ্যে অন্তরের কথার আদান—প্রদান হয়, ইনার থটস, ফিলিংস সব কিছুর প্রপার কমিউনিকেশন হয় এদের নিজেদের মধ্যে। সেই ডেলিকেট, ক্ষুদ্র মাইক্রো সমাজে হিংসা নেই, ঘৃণা নেই, শ্রদ্ধা আছে, প্রেম আছে। মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানো আছে, হাতে হাত ধরা আছে। একটা ইনার মিউজিক বাজতে থাকে তাদের মধ্যে, তাল কাটে না—সুন্দর হয়ে বিকশিত হতে থাকে সব কিছু—তারা ডেলিকেট, কোমলপ্রাণ। দে বিলীভ ইন হিউম্যানিটি। কিন্তু বাইরের ম্যাক্রো সমাজটা আছে না! যারা স্থূল, হিংস্র, ভায়োলেন্ট, ক্রুড, হার্টলেস, সোললেশ, ভীষণ নৃশংস। তাদের চেষ্টা কেবল এই মাইক্রো সমাজটাকে গিলে খাবার, তার তাল কেটে দেবার, যাতে তাদের স্পেশিওটেম্পোরাল সূক্ষ্ম ব্যালান্সটা ভেঙে চুরে যায়, তাতে ওদের ইনার মিউজিকটা স্তব্ধ হয়ে যায়। কেউ যাতে কারও পাশে দাঁড়াতে না পারে, সব যোগসূত্র যাতে ছিন্ন হয়ে যায়—ওই প্রচণ্ড প্রতাপশালী হিংস্র হিংসুক ম্যানলেস—মুনলেস—উওম্যানলেস ম্যাক্রো ওয়ার্লড চায় আমরা পথভ্রষ্ট হয়ে ওদের বেঁধে দেওয়া হিংসা আর লোভের উন্মাদ ইগোফিউডাল অরবিটে ওদেরই মতন চির একাকী হয়ে চির—দুঃখী হয়ে চিরকাল ঘুরে ঘুরে মরি। ওরা জানে আমরা আনন্দের খোঁজ পেয়েছি। ওরা পায়নি, তাই ওরা আমাদের কাছ থেকে আনন্দ কেড়ে নিতে চায়। ওরা তাই তো চতুর্দিকে স্পাই লাগিয়ে রেখেছে—হঠাৎ গলা নামিয়ে শ্যামলদা ফিসফিস করেন, ”দেয়ার আইজ আর এভরিহোয়্যার। অ্যান্ড দোজ আর কিলার আইজ।”
অপুর কেমন গা শিরশির করতে থাকে। ভাল করে শ্যামলদার দিকে তাকায় স্বপ্নে ভেসে থাকা চোখগুলো এখন কেমন কুঁচকে আছে।
”এসব কথা তুমি লেখ না কেন শ্যামলদা?”
”বললাম তো কেউ ছাপবে না। আমি খোদার খিদমত খাটছি, আমি তো ছাপতেই চাইব। কিন্তু চাদ্দিকে যে চারশো চোখ! লিখতে কি আমাকে দেবে কেউ। এই ধর, না হাজারিবাগের আশ্রমটা। যেদিন থেকে ঠিক করলুম জমিটা কিনব, সেই দিন থেকেই পিছনে লেগে গেছে স্পাই। কমলকে যে চিঠিটা লিখলাম, সেটা ডাকঘর থেকেই চুরি করে নিল, যাতে আশ্রমটা বানাতে না পারি। যাতে নিরাশ্রয় মানুষগুলোর আশ্রয় না জোটে।” শ্যামলদা ফিসফিস করে বলতে লাগল—”যেদিন থেকে আমি লিখতে শুরু করব সেদিন থেকেই ওদেরও অপারেশন আরম্ভ হয়ে যাবে। একটার পর একটা বাধা সৃষ্টি করবে ওরা—হাতের কাজের কাগজটা কেউ উড়িয়ে নেবে—কলমের কালিটা কেউ শুকিয়ে দেবে—টেবিলে বসতে যাচ্ছি, টেবিলের ওপরে কেউ একগাদা খাবার—দাবার রেখে যাবে—এই ধর তোর কাছে আসব বলে বেরুচ্ছি—কেউ এসে বেল বাজাবে। যদি তা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত লেখাটা হয়ে যায়, এডিটরের কাছে মেসেজ পৌঁছে যাবে আমি এরকম একটা লেখা লিখছি। ব্যস আগে থেকেই এডিটর ‘না’ করে দেবে। আমার লেখা ছাপতে দেবে না ওরা।” শ্যামলদার চোখের ওপর চুল এসে পড়েছে—চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। শ্যামলদার দাড়ি, গোঁফগুলো ছাঁটা হয়নি অনেকদিন।
দীপু শুনে বলল, ”খুব খারাপ লক্ষণ। এটা শুনে ভাল লাগছে না রে দাদা। একেই বোধ হয় বলে প্যারানইয়া।”
অপু বলল ”তোমার মাথা।” বলল বটে, কিন্তু মনে মনে উদ্বিগ্ন হল। সত্যি শ্যামলদার কথাবার্তা ইদানীং কেমন যেন অন্যরকম শোনাচ্ছে। কেবলই বলছে ইউনাইটেড নেশন্সে হিউম্যান রাইটস কমিশনের কাছে চিঠি লিখবে।
‘আল্ট জুলিয়া’ বইটা পড়ে ফেরত দিয়েছে বটে, কিন্তু—দীপুকে বলেই ফেলল কথাটা—”শ্যামলদা একটা নভেল লিখছে। মহা মুশকিলের ব্যাপার হয়েছে।”
”নভেল লেখা তো ভাল কথা। মুশকিলের আবার কী হয়েছে?”
”লিখছে, কিন্তু পড়ছে না তো।”
”মানে।”
”মানে শ্যামলদা ওই বইটার চরিত্র, ওই স্ক্রিপ্ট রাইটার হয়ে গেছে। যে শুধুই লেখে। পড়ে না কিছু। শ্যামলদা এমনকি নিজের লেখাটাও পড়ছে না।”
”কী হয়েছে তাতে?”
”ভীষণ কেলেংকারি কাণ্ড হচ্ছে তো, উপন্যাসে যা তা ঘটছে। যে ছিল খলনায়িকা সে হঠাৎ বাচ্চা মেয়ে হয়ে যাচ্ছে, মরা লোক বেঁচে উঠছে, হিরোইনের নামেই চার—পাঁচটা বিভিন্ন ক্যারেক্টার চলে আসছে—হিরো নিজেই হিরোর বাবা হয়ে যাচ্ছে”
দীপু খিলখিলিয়ে হেসে ফ্যালে!
”চুপ কর দাদা, বাজে বকিস না—”
”বাজে নয়, সত্যি এইরকমই তো হচ্ছে, কিছুই মনে থাকছে না শ্যামলদার।”
—”তুই কেমন করে জানলি? তোকে দেখিয়েছে?”
”মুখে মুখে বলে তো গল্পটা। অনবরত পালটে পালটে যাচ্ছে—”
”তুই খাতাটা চেয়ে নিয়ে সব ঠিকঠাক করে দে না দাদা।” দীপু মায়ামায়া চোখে তাকায় দাদার দিকে।
”ইচ্ছে করেই সব নাকি পালটে পালটে ফেলেছে, যাতে স্পাইরা ধরতে না পারে। বলছে, বাড়ির সামনে সব সময়ে অচেনা লোকেরা ঘোরাফেরা করছে, ওকে লিখতে দেবে না বলে। তারা সেধে সেধে ওঁকে জিজ্ঞেস করে, ”কী শ্যামলদা কেমন আছেন—” আসল উদ্দেশ্য ওর পরে নজরদারি।”
দীপু বলল—এসব ভাল কথা নয়। লক্ষ করেছিস, শ্যামলদার চেহারাটা একটু বদলে গেছে ইদানীং? পান খাচ্ছিল, ঠোঁট থেকে চিবুক বেয়ে পানের রস গড়াচ্ছে দেখলাম। কোনও খেয়াল নেই। টিকি বাঁধা আছে তো বাঁধাই আছে, কদ্দিন চুলে চিরুনি পড়ে না—উস্কোখুস্কো।”
”জানি।” অপু বলল, ”স্ট্র্যাপ ছেঁড়া চটি। সত্যি আজকাল একদম নিজের যত্ন নিচ্ছে না শ্যামলদা।”
”কবে ফিরবে নিউ ইয়র্কে? কী সুন্দর এল, এখানে এসে কেমন যেন আলুথালু হয়ে যাচ্ছে।”
সত্যি শ্যামলদার চেহারায়, হাবভাবে নিউ ইয়র্কে ফেরবার কোনও তাড়া নেই। কাঁধের ঝোলা ব্যাগে একগাদা বই নিয়ে ঘোরে। হঠাৎ এক একটা বের করবে, —”এ বইটা পড়েছিস অপু? দারুণ! পড়ে দ্যাখ।” বলে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের একটা কঠিন টেক্সটবই পড়তে দেবে, তাতে দাঁত ফোটানোর শক্তি নেই অপুর।
রোববার সকালে নিধুর চায়ের দোকানে অপুকে শ্যামলদা যেসব কথা বলল, অপু বাড়ি ফিরে এসেই দীপুকে সব না জানিয়ে পারল না।
”বাড়িতে আর টেকা যাচ্ছে না অপু। শোভনের সঙ্গে চোখাচোখি হলেই সে হঠাৎ সাইকেলটা টেনে নিয়ে টিংটিং করে গলিতে বেরিয়ে যায়। শোভনের বউ টেবিলে ভাতের থালা নামিয়ে রেখেই রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে ঠুং ঠাং খুন্তি নাড়াতে থাকে। বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই বাবা নাকে চশমা এঁটে খবরের কাগজ পড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মার কাছে গেলে পর্যন্ত মা চোখ বুজে জপ করতে শুরু করে দেয়। আমার বাড়িসুদ্ধ প্রত্যেকটা লোক এখন ওদের দলে যোগ দিয়েছে।”
পাড়া প্রতিবেশীরা তো আগেই দিয়েছিল। ওদের সকলের একটাই সম্মিলিত উদ্দেশ্য। ওরা চায় শ্যামলদাকে দেশ থেকে উৎখাত করতে। ওকে নিউ ইয়র্কে ফেরত পাঠাতে।
”কেননা ওরা জানে আমি খতমের রাজনীতি মানতে পারিনি। ওই ‘পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কাটো’ আর ‘কুপিয়ে মারো’ আমার সহ্য হয়নি। আমার জন্যে ওরা তাই বোমা বানাচ্ছে। আমাকে মারবে বলেই পোখরানে বম্ব ব্লাস্ট—আমার আকাশ—বাতাস বিষিয়ে দেবার জন্যে, আমার মাটি শুকিয়ে দেবার জন্যে এদের এই অ্যাটম বোমা।” হঠাৎ গলা খুলে গেয়ে উঠল শ্যামলদা—”আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্বভরা প্রাণ/তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান/বিস্ময়ে তাই জাগে জাগে আমার প্রাণ”—বিশ্বাস কর অপু এই বিপুল সৌরজগতের পেছনে এই গ্রহনক্ষত্রের পেছনে একটা কসমিক প্ল্যান আছে—সেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পরিকল্পনার মধ্যে কিন্তু খতমের নীতি নেই। শুধুই সৃজনের! সৃষ্টি, পুনঃসৃষ্টি, পৌনঃপুনিক সৃষ্টি—এই হলো ব্রহ্মাণ্ডের কল্পনা। আর আমি ওই ব্রহ্মাণ্ডের অধিবাসী। আমি যে তাদেরও আমার ব্রহ্মাণ্ডে টেনে নিচ্ছি, ওরা তাই আমাকে উৎখাত করতে চায়। ওরা তাড়াতে চায় আমাকে। তুই বরং তাড়াতাড়ি ইউ এন—এর হিউম্যান রাইটস কমিশনে একটা চিঠি লিখে দে অপু। আই নিড দেয়ার প্রোটেকশন।”
”পোখরানের বোমা, শ্যামলদা বলল তোকে, শ্যামলদাকে মারবার জন্য? য্যাঃ।” দীপু বিশ্বাস করল না।
”তুমি ভুল বুঝেছ।”
”তাইই তো বলছে শ্যামলদা, বলছে ওটা ওকেই শেষ করবার অস্ত্র, যেহেতু ও প্রাণবাদী যেহেতু ও যুদ্ধবিরোধী, হত্যাবিরোধী।”
”চিরদিনই যেসব মানুষ পৃথিবীকে উদ্ভিদকে, প্রাণীদের ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে চেয়েছে, ম্যাক্রো সমাজ তাদের পিষে মেরেছে। অপু, বোমা ম্যাক্রো সমাজের ভাষা। এই ভাষা আমরা বুঝব না। মাইক্রো সমাজের ভাষা, সবই মননের আর হৃদয়ের। তার শক্তি চিন্তায় আর প্রেমে। ম্যাক্রো সমাজের ভাষা পেশির। ওদের শক্তি সংখ্যার আর ধনের। সেই যখন অন্তরের ছন্দ দিয়ে, নিসর্গের মন্ত্র দিয়ে মানুষকে পবিত্র করতে চেয়েছে ম্যাক্রো সমাজের প্রবল চাপ তার ওপরে এসে পড়েছে—তোর কি মনে নেই অপু ট্রটস্কির কথা? কেন খুন করা হল ওকে? ও তো কাউকে মারছিল না, ও তো কেবল লিখত। শুধু ট্রটস্কিই পারত সোবিয়েত রাশিয়ার অধঃপতন রুখতে। ট্রটস্কি পারত কমিউনিজমের জন্য একটা ঠিকঠাক USP তৈরি করে দিতে। স্ট্যালিনের বদলে যদি ট্রটস্কি যেত মস্কোতে আজ জগতের দরিদ্র মানুষের মুক্তি ঘটে যেত। ট্রটস্কি যে আসলে ছিল মরমিয়াবাদী। ও ছিল ভক্তপুরুষ, গোপনে সুফী কাল্টের লোক ছিল ও। মৃত্যু আর প্রেম দুটোকে এক করে দেখেছিল। যেমন দেখেছিল চে গুয়েভারা। ওরা সন্তপুরুষ শান্তির দূত, মুক্তির দূত। হাতে বন্দুক ছিল? তা থাকুক ভক্তের হাতে যখন বন্দুক থাকে, সেই বন্দুক কারওকে মারে না। তবু হাতে থাকাই হয় তো দরকার। সেই যে রামকৃষ্ণদেব সাপকে বলেছিলেন, ‘তোকে কামড়াতে বারণ করেছি। ফোঁস করতে তো মানা করিনি।’ বন্দুক হচ্ছে ফোঁস। গুলি হল ছোবল। অপু তুই বড্ড ভালমানুষ, তুইও একটা বন্দুক রাখবি হাতে, নইলে লোকে পিষে ফেলতে আসবে।
”আমার ভয় নেই, আমি তো খোদার খিদমত খাটছি। তবু, ওরা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলছে, অপু, তুই দেরি করিস না আর, উঠে হিউমার রাইটস কমিশনের চিঠিটা লিখে ফ্যাল ভাই। বাংলায় লিখলেই হবে—ওখানে পৃথিবীর সব ভাষা পড়বার লোক আছে। চিঠিটা লিখে ফ্যাক্স করে দে, ওরা যেন আমাকে গার্ড করতে লোকজন পাঠায় আর উকিল ঠিক করে। আমি নজরবন্দি হয়ে রয়েছি। স্পাইরা ঘিরে ফেলেছে আমাকে—স্থূলতা আর হীনতা দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে—তা বলে আমি হার মানিনি। তুই লিখে দে, আই অ্যাম ফাইটিং। আমি চারদিকের এই দৈন্য, এই শ্রীহীনতা এই আবর্জনা, কখনও বরদাস্ত করব না। কিছুতেই এতে অভ্যস্ত হয়ে যাব না, আমি কিছুতেই মেনে নেব না যে এটাই স্বাভাবিক, এত ঔদাসীন্য স্বাভাবিক, এই হিংস্রতা স্বাভাবিক। স্থূলতার গোদা প্রলেপ আমার সর্বাঙ্গে মাখিয়ে দিয়েও ওদের স্যাটিসফ্যাকশন হয়নি, ওরা এখন আমার বুদ্ধি লোপ করে দিতে চায়। মনের ভেতরটাকে থোঁতা—ভোঁতা করে দিতে খ্যাঁদা—বোঁচা করে দিতে চায়। তুই জেনে রাখ অপু, বোমা বানাতে আমি দেব না। এটা একটা পার্সোনাল অ্যাসাল্ট। বোমা ফাটাচ্ছে কেননা ওটাই আলটিমেট। বোমা যদি সহ্য করতে পারি—তবে রাস্তাভরা আবর্জনা, মাছিবসা—মিষ্টি, ওষুধে ভেজাল, ল্যাংটা শিশু—সবই সয়ে যাবে ভেবেছে! ভেবেছে আমি ভয় পেয়ে যাব? নেভার!”
”চলো তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি শ্যামলদা, মাসিমা মেসোমশাই অপেক্ষা করছেন, দেড়টা বেজে গেছে।”
আলুথালু চুল ঝাঁকিয়ে শ্যামলদা হঠাৎ চটে উঠল—দু’হাতের বুড়ো আঙুল নাড়াতে নাড়াতে স্বভাব—বিরুদ্ধ ভঙ্গিতে ভেংচি কেটে বলল—”অপেক্ষা করছেন, না ছাই। ওঁরা ডিফেন্স মিনিস্ট্রির সঙ্গে শলাপরামর্শ করছেন যাতে বাড়িটা বেচে দিতে পারেন, ওখানে তো নিউক্লিয়ার রিসার্চ ল্যাব হচ্ছে শুনিসনি তুই?”
চোখ কুঁচকে মুখ গম্ভীর করে শ্যামলদা বলল—”কেউ থাকে না, বুঝলি অপু, খুদা—ই—খিদমতগারদের পৃথিবীতে কেউ থাকে না। না বাবা, না মা, আই অ্যাম অল আলোন অন দিস প্ল্যানেট।
”সেই জন্যেই তো তোকে বলছি হিউম্যান রাইটস কমিশনে ফ্যাক্সটা পাঠিয়ে দিতে। যত দেরি করছিস তত বেশি বেড়ে যাচ্ছে আমার ভালনারেবিলিটি।”
শুনে রাত্রিবেলায় দীপু বলল, ”দাদা, ব্যাপার খুবই সঙ্গীন—তুই কালকেই যা, শোভনদা অফিস থেকে ফিরলে সব বলে আয়। আমার একদম ভাল লাগছে না।”
পরদিন সন্ধ্যাবেলাতে অপু গিয়ে দ্যাখে মাসিমা কান্নাকাটি করে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছেন। মেসোমশাই পাথর। টুকুবউদি ওঁদের কাছে চুপ করে বসে রয়েছে। বাচ্চা দুটোকে দেখা গেল না। বাড়িটা থমথম করছে।
”শোভনদা আছে?”
”শ্যামলদাকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছে।”
”কী হয়েছে?”
”শোভন এলেই শুনো।”
রাত্রে শোভনদা ফিরল। একেবারে ক্লান্ত বিধ্বস্ত। শ্যামলদা একটা বিশাল ছোরা হাতে পাড়াতে ঘোরাঘুরি করছিল। মিনিবাসেও উঠেছিল। সৌভাগ্যবশত কন্ডাক্টর আমাদেরই পাড়ার ছেলে স্বপন থাকায়, ভুলিয়ে ভালিয়ে নামিয়ে দিয়েছে, বাড়িতে খবরও পাঠিয়েছে। এরপর শ্যামলদা ছোরা হাতে নিধুর দোকানে গিয়ে চার কাপ চা চারটে অমলেট অর্ডার দিয়েছে। ছোরা হাতেই সিগারেট দেশলাই কিনে এনেছে। এ পাড়ায় ছুরিছোরা হাতে মানুষ ঘোরাফেরা করে না, তাই পাড়ার ছেলেরা জিজ্ঞেস করছে—
”শ্যামলদা, হাতে ছোরা কেন?”
”একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।”
”তা ছোরা নিয়ে কেন?”
”পুরনো হিসেব।”
আমেরিকা ফেরত বড়লোক ছোকরার আর ‘পুরনো হিসেব’ কী? কত বছরের পুরনো হিসেব সেটা? পাড়ার ছেলেরা ছুটে গেছে শোভনদার কাছে। খবর পেয়ে শোভনদাও দৌড়ে এসেছে নিধুর দোকানে।
শ্যামলদা একাই একটা টেবিলে বসে আছে। পরনে কোরা ধুতি। নোংরা গরদের পাঞ্জাবি। খালি পায়ে জুতো নেই। চিরুনি না পড়া চুলে একটা শুকনো হলুদ পাতা আটকে আছে। দাড়ি গোঁফ ঝাঁকড়া। টেবিলের ওপর উন্মুক্ত ছোরা, শ্যামলদা চা খাচ্ছে। টেবিলে সারি সারি কাপ। আধ কাপ খেয়েই আর এক কাপ চাইছে। চারটে প্লেটে ছেঁড়া ছেঁড়া চারটে ওমলেট। কোনওটাই খায়নি। চারদিকে সিগারেটের স্তূপ। সবই আধখানা খাওয়া। হাতে একটা বিস্কুটের প্যাকেট। তা থেকে নিধুর দোকানের রোগা রোঁয়া—ওঠা বাদামি কুকুরটাকে যত্ন করে একটার পর একটা বিস্কুট খাওয়াচ্ছে। আরও একটা বিস্কুটের প্যাকেট রয়েছে টেবিলে। দূরে দূরে অন্যান্য টেবিলের খদ্দেররা উৎসুক নয়নে দুরুদুরু বুকে শ্যামলদার কাণ্ডকারখানা দেখছে।
শোভনদা আকুল হয়ে শ্যামলদার পাশে বসে পড়ল।
”কী হলো, দাদা? ছোরাটা কার?”
”তাতে তোর কী?”
”কোথা থেকে পেলি?”
”ও তুমিও তাহলে দলে আছ। শুরু হয়ে গেছে আমাকে আটকান? শেষকালে পাড়ার লোকদের আমার পেছনে লাগিয়ে দিলি। তোর লজ্জা করল না।”
”লোক আমি লাগাব কেন, ওরাই তো গিয়ে আমাকে ডেকে আনল।”
”ডেকে আনল। না তুইই ওদের অ্যাপয়েন্ট করেছিস আমার গতিবিধির ওপর নজর রাখতে? আমিও ইউনাইটেড নেশনসে হিউম্যান রাইটস কমিশনে খবর পাঠিয়ে দিয়েছি ভেবো না আমি তোমাদের ছেড়ে দেব।”
”এ তুই কি বলছিস দাদা?”
”ঠিকই বলছি। তোরা আমাকে বাড়ি ছাড়া দেশছাড়া করতে চাস, আমাকে নিউ ইয়র্কের হাসপাতালটাতে ফেরত পাঠাতে চাস, আমাকে না তাড়ালে বাড়িটা অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনকে বিক্রি করতে পারছিস না, নিউক্লিয়ার রিসার্চ ল্যাবরেটরি বসাতে পারছিস না, বোমা তৈরির বন্দোবস্ত এগোতে পারছিস না। আমি কি জানি না ভেবেছিস।”
”দাদা, এসব তোমাকে কে বলেছে? সব ভুল বলেছে। একদম ভুল।”
”পঁয়ত্রিশ লক্ষ অলরেডি নিয়ে নিয়েছিস। আরও পঁচিশ দেবে আমি চলে গেলে। আমি যাব না। আই অ্যাস নট বাজিং ফ্রম হিয়ার।” এসব সত্ত্বেও দাদাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে কথা কইতে কইতে বাড়িতে এনে ফেলেছিল শোভনদা। পৌঁছেই ধুন্দুমার কাণ্ড। ভাঙচুর, চেঁচামেচি।
”অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের সঙ্গে ষড় করে তোরা আমাকে তাড়িয়ে দিতে চাস, বিকজ আই নো ইওর সিক্রেটস তোদের গোপন কথা সব আমি জেনে ফেলেছি—ইউ আর এগেইনস্ট অল লাইফ অফ আর্থ—ইউ আর অ্যান্টি—লাইফ, ইয়েস অন্য অন্য গ্রহকে প্রাণশূন্য করেছ, জলশূন্য করেছ, বায়ুহীন করেছ। তাতে তোদের শখ মেটেনি, তোরা এবার এই গ্রহটাকে খেতে এসেছিস—বোমা মেরে মেরে জলহীন বায়ুহীন করে দিচ্ছিস—আমি তা করতে দেব না—আই অ্যাম গোইং টু ফাইট টু দি এন্ড। আমি খুদা—ই—খিদমতগার, হিউম্যান রাইটস কমিশনে চিঠি—” শ্যামলদাকে জবরদস্তি ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মানসিক হাসপাতাল থেকে নার্স—ডাক্তার আনিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে।
তারপর নিউ ইয়র্কে খবর গেছে, শ্যামলদার মার্কিনী স্ত্রী বেটসি বউদি এসেছেন। তার কাছে শুনলাম শ্যামলদা ডিপসোমেনিয়ার চিকিৎসার জন্যে ওখানে হাসপাতালে ছিল। অনেক কড়া কড়া ওষুধ খেতে হয়, হয়তো সেইজন্যেই এই নার্ভাস ব্রেকডাউন—আগেও এমন হয়েছিল একবার। মাস দেড়েক বাদে শ্যামলদা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরল। অপু ছুটল খবর পেয়েই। দীপু টিপ্পনী কাটল, ”দেখিস দাদা, একটু রয়েসয়ে—হোঁচট খাস না আবার।”
গিয়েই মনটা আলো আলো হয়ে গেল অপুর। মাসিমা মেসোমশাই খাটের ওপরে বসে আছেন, টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে মা বাবাকে কাপে চা ঢেলে দিচ্ছে শ্যামলদা। টুকু বউদি স্কুলে, শোভনদা অফিসে। অপু ঢুকতেই মহা খুশি শ্যামলদা—”বেটসি। আরেকটা কাপ দাও অপুর জন্যে।”
—”কী খবর বস? লংটাইম, নো সি মাসী? এতদিন কোথায় ছিলেন? পরীক্ষা ওভার?”
ঠিক আগের মতন।
ফেডেড ব্লু জিনস, গাঢ় সবুজ খাদির কুর্তা থেকে সুগন্ধ আসছে। একটু তফাত, পরিষ্কার করে দাড়ি কামানো, চকচকে করে আঁচড়ানো চুলে সেই ঝুঁটিটা আর নেই। আগের চেয়েও সুন্দর দেখাচ্ছে। সুন্দর আর স্মার্ট। স্মার্ট আর কনফিডেন্ট। তরতাজা আর ঝকঝকে।
মাসিমা মেসোমশাইকেও খুশি খুশি লাগছে। চা খেতে খেতে গল্প। বেটসি বউদিও এসে যোগ দিয়েছে—ফলে আড্ডার মাধ্যম হয়ে গেছে ইংরাজি।
”অপু তুই অরুন্ধতী রায় পড়লি? আমিও পড়লাম। তবে বেটসির যত আহামরি লেগেছে, আমার তা লাগেনি। শ্যাডোলাইনস অনেক অনেক ভাল—অমিতাভ ঘোষের একটা আলাদা অন্তর্জগৎ আছে, যেটা অরুন্ধতীতে মিসিং— অরুন্ধতীর অনেক গিমিক রয়েছে যা অমিতাভর নেই, শ্যাডোলাইনসের মতন বাঙালি উপন্যাস বাংলাতেও বেশি নেই—”
”বিক্রম চন্দ্র, না বিক্রম শেঠ? শোভা দে কি লেখক? ইংরেজিতে ভারতীয় সাহিত্য কি ভারতীয়? বুকার প্রাইজ যারাই পায় তারাই কি শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক? শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কেমন করে মাপব?
নিউ ইয়র্কের অনেক গল্প সুনীলের গল্প। সুনীল এখন একা রয়েছে। বেটসি বউদিকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। সুনীল ওদের ছেলে। মাসিমা মেসোমশাই এখনোও এই প্রথম নাতিটির মুখ দেখেননি। এ বছরে হাই স্কুল শেষ করেছে সুনীল। ও কলেজে চলে গেলে, শ্যামলদারা দুজনে কলকাতাতে ফিরবে। আমেরিকাতে শ্যামলদার আর ভাল লাগছে না। বেটসি বউদির ইন্ডিয়াতে এই প্রথম। উনিশ বছর বিয়ে হয়েছে যদিও। এবার এসে খুব আপসোস হচ্ছে, আহা এত দিন কেন আসিনি। এত উষ্ণতা এত স্নেহ মমতা এই কলকাতায়! বেটসি বউদি নিউ ইয়র্কে একটা লইয়ারের ফার্মে কাজ করে। তার মা—বাবা থাকে ফ্লোরিডায়। বুড়ো হলে না, ফ্লোরিডা খুব ভাল—না ঠাণ্ডা না গরম। শ্যামলদা বলল—”যদি না কুমিরে খেয়ে ফ্যালে।”
তার মানে ফ্লোরিডাতে বেটসি বউদির বাপের বাড়ির বাগানের নর্দমাতে একটা কুমির ভেসে এসেছিল। এমন নাকি আকছার হচ্ছে ফ্লোরিডায়। নালা—নর্দমাতে শহরের মধ্যে কুমির পাওয়া যায়। মাছ—খেকো কুমিরই তারা প্রধানত, কিন্তু মানুষ পেলে ছাড়ে না।
”ও বাবা! আমেরিকা এমন?”
”এ আবার কেমন ধারা আমেরিকা?”
”আমাদের বরিশালেও তো এমন কথা শুনিনি। বাড়ির নর্দমাতে কুমির?” মাসিমা মেসোমশাই আর অপু একসঙ্গে অবাক।
”এবার যদি কমোডের মধ্যে কুমিরছানা ঢুকে আসে?”
”আসতেই পারে!”
”তা—র—প—র?”
সবাই মিলে হেসে উঠল।
আসবার আগে টাকা জমাতে হবে কিছু। সুনীলের ইউনিভার্সিটিতে পড়ার খরচপাতি অনেক, ওদেশে কলেজের মাইনে আমাদের মতন না। ঠিকমতন ইনভেস্ট করতে পারলে অসুবিধে হয় না, শ্যামলদা সে সব ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু আরেকটু হিসেব করা দরকার। কেননা এ দেশে থাকতে হলে ওখানে এমনভাবে ইনভেস্ট করে আসতে হবে যাতে সুদের টাকাতেই রাজার হালে থাকা যায়। এজন্যে আপাতত ফিরে গিয়েও শ্যামলদা ফের ওয়াল স্ট্রিটের অফিসে বসবে। মুম্বইয়ের শেয়ার মার্কেট নিয়েও কথা বলল শ্যামলদা। বোমার দাপটে মুম্বইয়ের যে কাহিল অবস্থাটা হয়েছিল, এখন তার থেকে সামলে গেছে অনেকটা। শ্যামলদা খোঁজ খবর রাখছে। আঁক কষছে।
এখানে এসেও তুমি ফিনানসিয়াল অ্যানালিসিস করবে, শ্যামলদা?”
”করতেও পারি। দেখি, সুযোগসুবিধে অনুযায়ী। বেটসি এখানে কাজকর্ম করবে না—বাগান করবে। বলে দিয়েছে।”
হাসিতে গল্পে সুন্দর কাটছিল সময়টা। পুরনো কথা শ্যামলদার কিছুই মনে নেই। কোনও প্রসঙ্গ উঠল না। অসুখের সময়টা ওর চৈতন্যে, স্মৃতিতে কোনও ছাপই রাখেনি। পূর্বকালের গন্ধ লেগে নেই কোনওখানে। অপুর বুক থেকে একটা বোঝা নেমে গেল। খোদা তাহলে তার খিদমতগারকে দয়া করেছেন।
এতক্ষণ ধরে ইংরিজি বলতে বলতে, অপু যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল শ্যামলদা যখন বলল—”চল অপু, নিধুর দোকানে যাই—বাড়িতে চা খেয়ে ঠিক জুত হয় না।”
আগের মতন নিধুর দোকানে গিয়ে বসল অপু আর শ্যামলদা। সেই দুটো অমলেট, দু’কাপ চা। পানের দোকান থেকে দু’প্যাকেট ক্লাসিক। শ্যামলদার উপহার। নিধুর দোকানে তো উৎসব পড়ে গেল।
”এই যে শ্যামলদা। ওয়েলকাম ব্যাক।”
”দারুণ দেখাচ্ছে কিন্তু।”
”কবে আমেরিকা যাচ্ছেন? আপনাদের নাকি সময় হয়ে এল। তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন কিন্তু।”
”শ্যামলদা, বউদিকে একদিন নিয়ে আসুন!”
হাজারটা কথা। ভালোবাসার কথা।
শ্যামলদা সকলের কথার উত্তর দিচ্ছে হাসিঠাট্টা করে। রোঁয়া ওঠা বাদামি কুকুরটা গা—ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়ে পত পত করে খুব লেজ নাড়ছে। শ্যামলদা নিজের অমলেট পুরোটাই ওকে দিয়ে দিল।
”শ্যামলদা, একখানা গান হয়ে যাক।”
”হ্যাঁ হ্যাঁ একখানা গান।” ছেলেদের হাঁক উঠল। বিনা ভনিতায় শ্যামলদা খোলা গলায় গান ধরল—’কেন যে মন ভোলে, আমার মন জানে না। তারে মানা করে কে আমার মন মানে না—’ এমনি একটার পর আর একটা। একসময়ে থেমে শ্যামলদা বলল ”বেটসি কেন নিধুর দোকানে চা খায় না জানিস অপু? শোভনটা ওকে বুঝিয়েছে এখানে নেড়ি কুকুরের দুধে চা হয়। খেলেই জলাতঙ্ক।”
—”য্যাঃ। বউদি ওসব বিশ্বাস করেছে নাকি?”
”করতেই পারে। কিছুই তো জানত না এ দেশের কথা।”
”তুমি বলতে না?”
কথা ঘুরিয়ে শ্যামলদা বলে, ”অপু তুই মহাভারত পড়েছিস?”
”হ্যাঁ—কেন”?
”শেষ দিকটা মনে আছে? ওই যে যেখানে ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী, কুন্তী, দ্রৌপদী সকলেই তাদের মৃত পুত্রদের মুখ দেখতে চাইছে?”
”মনে আছে।”
”যখন ব্যাসদেব তাদের পুত্রমুখ দর্শন করালেন, মৃত পুত্রেরা সকলেই ভাগীরথীর জল থেকে উঠে এলেন যুদ্ধের বেশে সেজে, যেন চকচকে নতুন টাকার মতন, শরীরে কোনও ক্ষত নেই, কোনও রক্ত নেই যন্ত্রণার লক্ষণ নেই। অস্ত্রের চিহ্ন পর্যন্ত নেই—সকলেই সুখী, সুন্দর সম্পূর্ণ, যুদ্ধ শুরু হবার আগে যে যেমন ছিল। মনে পড়ছে সেখানটা?” অপু ঘাড় নাড়ে। মনে পড়ছে।
”ধৃতরাষ্ট্র অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। দুর্যোধনের ঊরু ভগ্ন নয়, দুঃশাসনের বক্ষ অবিদীর্ণ, কারণটা কী জানতে চাইলে ব্যাসদেব কী কারণ বলেছিলেন তোর মনে আছে?” অপু একটু ভেবে নিতে চেষ্টা করল।
”একটু একটু মনে আছে বোধহয়।”
”কী মনে আছে, বল শুনি?”
”বোধহয় বলেছিল সবই মায়া। যুদ্ধ তো মোটে হয়ইনি। কেউ কারুর ঊরু ভাঙেনি, কেউ কারুর বুক চেরেনি, নশ্বর জীবনের সব কিছু অভিজ্ঞতাই মায়া, কোনওটাই সত্য নয়।—এরকমই কিছু বলেছিল মনে হয়।”
”ওই ব্যাখ্যাটা তোর বিশ্বাস হয়? আমার তো হয় না। আমার মনে ওর অন্য ব্যাখ্যা আছে। ধৃতরাষ্ট্রেরা যাদের দেখেছিলেন তারাই মায়ামূর্তি, তারা পিতামাতার স্নেহে গড়া, আকাঙ্ক্ষায় গড়া সন্তানের রূপ, তাতে কোনও খুঁত থাকতে পারে না। ওটাই আসলে মায়া ছিল। কেননা ওটা মৃত্যু—উত্তীর্ণ রূপ।”
আগের শ্যামলদা। চিরদিনের শ্যামলদা। অপুর দু চোখে মুগ্ধতা। অন্য টেবিল থেকে আবার রিকোয়েস্ট আসে— ”শ্যামলদা, শ্যামলদা এবার একটা ইংরেজি গান হোক—”
শ্যামলদা হেসে অপুর দিকে তাকায়।
অপু বলে—”বিটলস গাও।”
—”হি ওয়াজ জাস্ট অফ নো হোয়্যার ম্যান, সিটিং অন হিজ নো হোয়্যার ল্যান্ড মেকিং অল হিজ নো হোয়্যার প্ল্যান্স—ফর নোবডি… ডাজ নট হ্যাভ আ পয়েন্ট অফ ভিউ নোজ নট হোয়াট হিজ গোইং টু ডু। ইজ নট হি আ বিট লাইক ইউ—অ্যান্ড মি…”
নিধুর দোকান যেন ম্যাজিক স্তব্ধ।
অপু হঠাৎ দেখল দীপু এসে দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। গান শুনছে।
”দাদা বাড়ি চল ছোটকাকু এসেছে।”
”আরে আরে দীপু মেমসাব যে। কেমন আছ? শ্যামলদাকে যে দেখতেই পাচ্ছ না।— ইয়ং লেডি হয়ে গেছ কিনা।”
দীপু লজ্জা লজ্জা খুশি মুখে হাসে শুধু। অপু উঠে দাঁড়ায়।— ”চলি শ্যামলদা। কালকে আবার দেখা হবে। এক্ষুনি তো চলে যাচ্ছ না নিউ ইয়র্ক?”
—”নো, নেক্সট উইক। ঠিক হ্যায়, ফির মিলেঙ্গে—সি ইউ টুমরো—চা—ও।” দু’জনেই হাত নাড়ল। ওরা বেরিয়ে যাচ্ছে, শ্যামলদা পিছু ডাকল।
”অপু, একটা জরুরি কথা ছিল। বলতে ভুলে গেলাম।” শ্যামলদা উঠে দাঁড়িয়েছে। অপু ফিরে এল।
শ্যামলদার ভুরু কুঁচকে গিয়েছে। অপুর পিঠে হাত রেখে কানের কাছে মুখ নামিয়ে নিয়ে শ্যামলদা ফিসফিসে গলায় বলল—”সেই হিউম্যান রাইটস কমিশনকে চিঠিটা ফ্যাক্স করে দিয়েছিলি তো? উই মাস্ট বি রেডি—দে আর ওয়েটিং ফর মি।”
অপু দেখল শ্যামলদার চোখের মধ্যে অন্য একটা চোখ, পরিষ্কার কামানো গালে ঝাঁকড়া দাড়ি, চকচকে আঁচড়ানো চুলে একটা হেমন্তের হলুদ পাতা আটকে আছে।
শারদীয় দেশ ১৯৯৮