খাতা চুরি রহস্য

খাতা চুরি রহস্য

এক

সন্ধ্যা নেমেছে। গরম কাল।

দক্ষিণ কলকাতায় যতীন দাস রোডে একটা ছোট বাড়ির দোতলায় পুলকের ড্রইং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিল পুলক আর জয়। পুলকের বয়স তিরিশ পেরিয়েছে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। দীর্ঘকার বলিষ্ঠ গড়ন। ধারালো মুখ। জয়ের বয়স হবে পঁচিশ-ছাব্বিশ। লম্বায় সে পুলকের কাছাকাছি তবে কিঞ্চিৎ রোগাটে। ফর্সা রং। হাসি হাসি সুশ্রী মুখ।

মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। তবে সেদিন বিকেলে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার গরমটা একটু কম। পুলকের পুরনো কাজের লোক হরিহর একটা ট্রে এনে রাখল সামনের টেবিলে। ট্রেতে দু’কাপ ধূমায়িত চা এবং প্লেটে অনেকগুলো সদ্য ভাজা বড় বড় বেগুনি।

#ফাসক্লাস।, জয় একটা গরম বেগুনি তুলে কামড় দিয়ে বলল, “কী করে বুঝলে হরিদাস, চায়ের সঙ্গে এখন ঠিক এই জিনিসটাই যে চাইছিল হন?”

হরিহর একগাল হেসে বলল, “তা অনেকদিন দেখছি তো, ইচ্ছেটা বুঝি।”

বেগুনি শেষ। কাপের চা-ও শেষ হয়ে এসেছে। গল্প করতে করতে জয় বলল, #পুলকদা , চলো না ক’দিন বেড়িয়ে আসি কোথাও? অনেক দিন বাইরে যাইনি। রাজগির যাবে?,

‘তা মন্দ নয়,’ পুলক রাজি, ‘আজ নয়, কালকে প্রোগ্রাম ঠিক করা যাবে।’

জয় লক্ষ করছিল যে পুলক মাঝে মাঝেই দেওয়াল ঘড়িটার দিকে নজর করছে। ও কোথাও বেরুবে নাকি? না কাউকে আশা করছে?

সাতটা বাজার কয়েক মিনিট আগে নিচে কলিং বেলটা বাজল। হরিহর সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। ফিরে এল হাতে একখানা ভিজিটিং কার্ড নিয়ে। বলল, ‘এক ভদ্রলোক বলছেন অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে।’ কার্ডটায় চোখ বুলিয়ে চেয়ারে আধশোয়া পুলক সোজা হয়ে বসে হরিহরকে বলল, ‘হুঁ, ভদ্রলোককে নিয়ে এসো এখানে।’

ও তাহলে এর অপেক্ষ’ই করছিল পুলকদা। ভাবে জয়। টেবিলে রাখা কার্ডখানায় সে চোখ বোলায় কৌতূহলে। নামটা ইংরেজিতে ছাপানো—মার্কো ডা গশ্! ঠিকানাটা ভবানীপুরের। এ আবার কোন্ জাতের লোক?

মার্কো ডা গশ্ ঘরে ঢুকলেন। লোকটি মাঝারি লম্বা। গাঁট্টাগোঁট্টা। মাথায় ধবধবে ঘন সাদা চুল। গোঁফ দাড়ি কামানো মুখ। রং তামাটে। পরনে দামি ট্রাউজার্স ও শার্ট। পায়ে দামি জুতো। লোকটিকে দেখতে মোটামুটি সুশ্রী। চেহারায় বেশ একটা ভদ্র ছাপ। তবে গম্ভীর বদন, যেন একটু বিষণ্ণ। কপালে ভাঁজ। চিন্তিত ভাব। বয়স মনে হল পঞ্চাশের ওপরে। ধীর পায়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে তিনি থমকে দাঁড়িয়ে পুলক আর জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ইতস্তুত করতে লাগলেন।

পুলক ডাকল ইংরেজিতে, #আসুন মিস্টার গশ্। বসুন। আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।,

মিস্টার গশ্ একটা চেয়ারে বসেন শ্রান্ত ভাবে। তারপর পুলককে জিজ্ঞেস করলেন পরিষ্কার বাংলায়, ‘আপনি কি পুলক রায়? অনুসন্ধানী মানে প্রাইভেট ডিটেকটিভ?’

এবার পুলক বাংলাতেই জবাব দেয় মৃদু হেসে, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। নিচে দরজার পাশে নেম প্লেটটা পড়েছেন বুঝি? দেখুন ডিটেকটিভ বা গোয়েন্দা বলাটা আমার পছন্দ নয়। নিজেকে আমি বলি অনুসন্ধানী। অবশ্য বলতে পারেন কাজটা একই। হ্যাঁ বলুন, আপনার প্রবলেম টা কী? ক্লান্ত শরীরেও যখন এসেছেন, দরকারটা নিশ্চয় খুব জরুরি।’

বেশ অবাক হয়ে মিস্টার গশ্ বললেন, “আমার শরীর যে—ভালো নয় বুঝলেন কী করে?’

‘বুঝেচি।’ পুলক ঠোঁটে একটু হাসি টেনে মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দেয় শুধু। ফের বলে— ‘হুঁ বলুন’—

মিস্টার গশ্ জয়ের দিকে চেয়ে কিঞ্চিৎ দোনামনা করতে থাকেন কথা বলতে। পুলক বোঝে সমস্যাটা। স্মিত হেসে বলে,’ ‘পরিচয় করিয়ে দিই। ওর নাম জয় দত্ত। ইতিহাসের রিসার্চ স্কলার। কিন্তু গোয়েন্দাগিরিতে বেজায় শখ। আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট বলতে পারেন। ওর সামনে যে কোনো গোপন কথা নিঃসংকোচে বলুন।’

মিস্টার গশ্ জয়ের দিকে চেয়ে একবার মাথা ঝাঁকালেন। তারপর পুলককে বললেন, ‘হ্যাঁ একটা প্রবলেমে পড়েছি। খুব সিরিয়াস প্রবলেম। আমাদের হোটেলে একজন যান মাঝে মাঝে। মিস্টার ভার্মা, বিজনেসম্যান। তিনি একদিন আপনার কথা বলেছিলেন। খুব প্রশংসা করেছিলেন। ওর কী একটা কেস নাকি আপনি সলভ্ করে দিয়েছেন।’

পুলক ঘাড় নেড়ে বলল, ‘হুঁ বুঝেচি। তা আপনার কেসটা কী?”

মিস্টার গশ্ মাথার চুলে আঙুল চালাতে চালাতে কপালে আরও কয়েকটি রেখা ফেলে ধীরস্বরে বললেন, ‘দেখুন আমার একটা খাতা হারিয়েছে। আসলে চুরি গিয়েছে। ওই খাতাটা উদ্ধার করতে চাই।”

‘কীসের খাতা?’ প্রশ্ন করে পুলক

‘রান্নার খাতা।”

‘অ্যা রান্নার খাতা চুরি!’ রীতিমতো অবাক হয়ে বলে পুলক।

‘হ্যাঁ, তাতে শ’খানেক রান্নার প্রসেস লেখা আছে। আমার নিজের হাতে লেখা। হলুদ রঙের শক্ত মলাটের বেশ মোটা খাতা। ছাত্রর যেমন একসারসাইজ বুক ব্যবহার করে ক্লাসে নোট লিখত সেই রকম। আমার কাছে খাতাটা খুবই মূল্যবান। কারণ ওর আর কপি নেই আমার কাছে। ও খাতার মূল্য যে কতখানি তা যে কেউ বুঝবে না। বুঝবে, যারা আমার মতো রান্নার লাইনে তাদের কাছে ওই খাতার মূল্য একটা দামি হীরে-পান্নার চেয়ে কম নয়।’

‘এক মিনিট।’ পুলক আগন্তুকের কথায় বাধা দেয়। তারপর বলে— ‘আপনি তো চমৎকার বাংলা বলেন। বাংলা দেশে অনেকদিন আছেন বুঝি?’

মার্কো ডা গশ্ একটুক্ষণ হাঁ হয়ে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘ভালো বাংলা বলব না কেন? খাঁটি বাঙালির ছেলে।’

পুলক অবাক হয়ে বলল, ‘বাঙালির ছেলে! আপনার নামটা দেখে কিন্তু মনে হয়েছিল। আপনি গোয়ানিজ। পর্তুগিজ ঘেঁষা নাম। অবশ্য হাবেভাবে ঠিক মিলছিল না।’

হো হো করে হেসে ওঠেন গশ্ সাহেব। অতঃপর হাসি থামিয়ে বললেন, ‘সরি। এই ভুলটা মশাই অনেকেই করে। ওই ভিজিটিং কার্ডে যা ছাপা আছে ওটা আমার প্রফেশনাল নাম। কাজের সুবিধের জন্যে নিয়েছি। আমার আসল নাম মশাই কর্মদাস ঘোষ। আমার ঠাকুমার দেওয়া নাম। দেশ এই পশ্চিমবঙ্গে হুগলি জেলায়। ওই নামটাই বদলে করে নিয়েছি মার্কো-বা-গশ্। হ্যাঁ ঠিক করেছেন, গোয়ানিজ টাইপই বটে।’

এবার হাসির পালা পুলক এবং জয়ের। পুলক জিজ্ঞেস করে, “নাম বদলাবার কারণ?’ মিস্টার গশ্ স্মিত মুখে বললেন, ‘কারণ আমার প্রফেশনে গোরানিজ কুকদের ভারি কদর। তবে ইচ্ছে করলে আমি পাক্কা গোয়ানিজ সাজতে পারি। আমার চেহারায় নাকি ওদের সঙ্গে মিল আছে। প্রায় পনেরো বছর গোয়ায় ছিলাম, ও দেশের ভাষা এবং ধরনধারণ তখনই রপ্ত করে নিয়েছি। তবে শুধু গোয়ানিজ নর, আমি আরও কয়েকটা ভাষা মোটামুটি বলতে পারি, কিছুটা পড়তেও পারি – ইংরেজি-হিন্দি-উর্দু-মিরাঠি ওড়িয়া। এছাড়া কিছুটা ফ্রেঞ্চ ইতালিয়ান আর আরবিও জানি।’

‘বাঃ!’ তারিফ করে পুলক।

‘পেটের দায়ে শিখেছি মশাই’, বলেন কর্মদাস ঘোষ ওরফে মার্কো-ডা-গশ্, ‘ভারতে নানা জায়গায় ঘুরেছি হোটেলে চাকরি নিয়ে। নানা জাতের লোকের সঙ্গে মিশেছি। ফ্রান্স ইতালি আরবদেশেও গিয়েছি—থেকেছি কয়েক বছর।’

‘আপনাকে তাহালে কী নামে ডাকব?’ জয় রহস্য করে জানতে চায়।

উত্তর হয়, ‘মার্কো গশ্ বা কর্মদাস ঘোষ, যা খুশি। আমি যে সমাজে সাধারণত মিশি সেখানে মার্কো বা গশ নামেই আমি পরিচিত। তবে দোহাই বাইরের লোকের সামনে আমায় কর্মদাস নামে ডাকবেন না। ওটা এক্কেবারে আমার ঘরোয়া নাম। শুধু নিকট আত্মীয়রাই আমার ওই নামে চেনে। বাইরের লোক আমার ও নামটা জানেও না।’

‘যদি মার্কোবাবু কিংবা গশ্মশাই বলি?’ জয় মক্তা করে।

‘না না বিচ্ছিরি শোনাবে’, আপত্তি করেন মার্কো ডা গশ্, ‘শুধু মার্কো বা গশ্ বলেই ডাকবেন।’

‘আপনার প্রফেশন কি কুকিং?” জিজ্ঞেস করে পুলক।

‘ইয়া’, সায় দেন মার্কো, “আমি একজন রাঁধুনি। মানে কুক। রান্নাই আমার পেশা এবং নেশা। সামান্য ছোট্ট হোটেলে কাজ শুরু করেছিলাম। আপাতত আমি একটা থ্রি-স্টার হোটেলের শেফ অর্থাৎ হেড-কুক। হোটেলে হোটেলে রান্নার চাকরির সুবাদেই আমার নানা দেশে ভ্রমণ। বিদেশেও গিয়েছি ওখানে ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁয় চাকরি নিয়ে।’

হোটেলের হেড-কুক। পুলকদের মুখে ফুটে ওঠা বিচিত্র ভাব বহুদর্শী কর্মদাস ঘোষের চোখ এড়ায় না। তাই বুঝি তিনি একটু হেসে বললেন, ‘রাঁধুনিগিরি করি বটে, তবে পড়াশোনাটা যে একদম করিনি তা নয়। গ্রাজুয়েশনটা করেছি। তবে ছোট থেকেই আমার রান্নার খুব শখ। কোনো নতুন রান্না বা খাবার খেতে ভালো লাগলেই তা শিখে ফেলতাম। নতুন রান্না আর নতুন খাবার তৈরির চেষ্টাও করতাম। আমার এক কাকা ছিলেন খাদ্যরসিক এবং রন্ধনরসিক। তিনি আমার অ্যাডভাইস দেন–কেন মিছিমিছি অফিসে কলম পিষে জীবনটা নষ্ট করবি? তোর হাতে আসল ন্যাক সেই লাইনে যা। উন্নতি করবি। কাজ করে আনন্দও পাবি। রান্নাও তো একটা আর্ট রে। বড়ো বড়ো হোটেলের ভালো ভালো কুকদের কত মাইনে জানিস? অনেক চাকুরে অফিসারদের চেয়ে বেশি। তেমনি তাদের ডিমান্ড। দেশে বড়ো বড়ো হোটেল লজের সংখ্যা কত ভেবে দেখ। কোনো দিন তোর চাকরির অভাব হবে না। তবে লাইনটা বাছলে একেবারে প্রফেশনাল ভাবে ভালো মতো শিখে এগোতে হবে। তবেই উন্নতি। পরে বুঝেছিলাম, কাকার উপদেশগুলো কত্ত কাজের। রান্না নিয়ে শখও মিটেছ, রোজগারও কম করিনি। আমার মতো অর্ডিনারি গ্রাজুয়েট, যার খুঁটির জোর নেই, অফিসের চাকরি করে এত রোজগার কখনওই করতে পারতাম না।

কাকার পরামর্শেই গ্রাজুয়েশনের পর রান্নার কোর্সে ভর্তি হয়ে অনেক দেশি-বিদেশি রান্না শিখলাম। বাবা মা একটু গাঁইগুই করেছিলেন প্রথমে। ছেলের এ কী উদ্ভট শখ! কিন্তু আমার জেদ দেখে শেষটায় আর বাধা দেননি। কাকাও তাঁদের বুঝিয়েছিলেন।’

‘রান্নার কোর্স করে বুঝি হোটেলে চাকরি নিলেন?’ প্রশ্ন করে জয়। গতানুগতিকতার বাইরে এই বিচিত্র স্বভাবের মানুষটির প্রতি তখন তার খুবই কৌতূহল জেগেছে।

‘হ্যাঁ। ইন্ডিয়া বিরাট দেশ। কত রকম লোক এখানে। কতরকম তাদের জিভের স্বাদ আর খাদ্যবস্তু। সে সব রান্না যতটা পারি শিখব এই আশায় নানা প্রভিন্সে ঘুরেছি হোটেল কুকের চাকরি নিয়ে। ওই সব রকমারি রান্না নিয়ে নিজের খেয়াল খুশি মতো এক্সপেরিমেন্টও চালিয়েছি, কিছুটা স্বাদ বদলাতে, নতুনত্ব আনতে। যেখানেই গেছি সেখানকার হোটেল, রেস্তোরাঁ, প্রাইভেট বাড়ি, যেখানেই নতুন ধরনের পছন্দসই খাবারের সন্ধান পেয়েছি তা শিখে নেওয়ার চেষ্টা করেছি: ইন্ডিয়ার বাইরে বিদেশেও গিয়েছি প্রানত এই উদ্দেশ্যে। অবশ্য বিদেশে গেলে মোটা মাইনে জুটেছে উপরি লাভ হিসেবে।’

‘আপনার খাতা হারানোর ব্যাপারটা কী?’ পুলক মৃদু স্বরে প্রশ্ন করতেই যেন চটক ভাঙে মিস্টার গশের। রন্ধন বিদ্যেটা যে উনি মনেপ্রাণে ভালোবাসেন তাতে সন্দেহ নেই। কারণ ওই কথা বলতে গিয়ে দেখা করার আসল উদ্দেশ্যটাই যেন হারিয়ে গিয়েছিল তাঁর মন থেকে। এবার একটুক্ষণ চুপ করে থেকে ভেবে নিয়ে ফের বলতে শুরু করেন—

‘দেখুন আগেই বলেছি, ওই হারানো খাতাটায় লেখা আছে বহু রান্নার রেসিপি ও প্রসেস। ওগুলো সাধারণ মামুলি খাবার নয়। সব স্পেশাল ডিশ। ইন্ডিয়ার নানা প্রদেশের রান্না। কত জায়গা থেকে যে জোগাড় করেছি। কেবল ভারত থেকে নয়, বিদেশে জোগাড় করা খাবারের রান্নাও আছে। যেমনটি পেয়েছি শুধু তেমনটি লেখা নয়। ওইসব খাবারগুলোর রান্না নিয়ে নিজে নিজে অনেক এক্সপেরিমেন্ট করেছি। খাবারগুলোর টেস্টও খানিক বদলেছি। যাতে এক দেশের খাবার অন্য দেশের লোকেরও খেতে ভালো লাগে। মানে অনেক রান্নায় চেঞ্জ করেছি। বলতে পারেন ইমপ্রুভ করেছি। আমার বহু বছরের কালেকশন, এক্সপেরিমেন্ট আর রিসার্চের রেজাল্ট ডিটেলসে লেখা আছে ওই খাতায়। এখন আমার বয়স ফিফটি ফোর। বাইশ-চব্বিশ বছর বয়স থেকে এটা আমার হবি। দুঃখের বিষয় ওই খাতার লেখাগুলোর কোনো কপি নেই আমার কাছে। কোনো রান্না কমপ্লিট হয়েছে মনে হলে তার রেসিপি আর গোটা প্রসেস এই খাতায় গুছিয়ে লিখে রেখে তার রাফ নোটগুলো ফেলে দিয়েছি। তাই ওই খাতাটা যাওয়া মানে আমার বহু বছরের সাধনা নষ্ট হওয়া। এখন চেষ্টা করলেও এই খাতার বেশির ভাগ রান্নার খুঁটিনাটি আর মনে করতে পারব না। এ যে আমার কত বড় লস!’

বাঃ লোকটি গুণী বটে। ভাবে জয়। কার মধ্যে যে কী গুণ লুকিয়ে থাকে? ঠিকঠাক উৎসাহ আর সুযোগ পেলে তার বিকাশ ঘটে। মহাভারতের ভীমও তো পড়েছি রন্ধনবিদ্যায় এক মস্ত গুণী ছিলেন। সে আপশোস ভরে জিজ্ঞেস করে মার্কোকে, ‘ইস মনে করতে পারবেন না? আচ্ছা, ওই খাতায় লেখা রান্নাগুলো আপনি করতেন না কখনও?’

‘করতাম,’ জবাব দেন মার্কো, ‘হোটেলে আমায় স্পেশাল মেনু রাঁধার দায়িত্ব দেওয়া হলে ওই খাতা থেকে বেছে নিয়ে দু একটা আইটেম করতাম। তবে সে তো কালে ভদ্রে। সাধারণত কয়েকটা চলতি খাবারেই অর্ডার হত বেশির ভাগ সময়। খাতার অন্তত অর্ধেক রান্না ফাইনালি খাতায় টুকে ফেলার পর আর দ্বিতীয়বার রেঁধে লোককে খাওয়ানোর চান্স পাইনি। সেগুলোর ডিটেলস তো কোনোমতেই আর মনে করতে পারব না।’

মার্কো বিষণ্নভাবে বললেন, ‘জানেন ইচ্ছে ছিল যে আর কয়েক বছর বাদে চাকরি থেকে রিটায়ার করে একটা রান্নার বই লিখব। তাতে ওই খাতার রান্নাগুলো থাকবে স্পেশালি। এক নামকরা পাবলিশার্স আমায় অফার দিয়ে রেখেছে বইটার জন্য। বইয়ের কাজে হাত দিলেই রয়াল্টির মোটা টাকা অ্যাডভান্স দেবে তাও বলেছে। সব ভেস্তে গেল।’

কথাগুলো শেষ করে মার্কো অবসন্নভাবে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন। পুলক বলল, “আপনাকে বেশ ক্লান্ত লাগছে।’

মার্কো বলল, ‘হ্যাঁ সত্যি আমি টায়ার্ড। সবে জ্বর থেকে উঠেছি। তবু আজ ছুটে এসেছি। নইলে হয়তো দেরি হয়ে যাবে।’

পুলক বলল, ‘তাহলে একটু রেস্ট নিয়ে নিন। চা-টা খাবেন কিছু?’

‘খাব। এই সময় আমি একবার চা খাই। আর শুধু দুটো বিস্কুট দিতে পারেন।’ মার্কোর চোখ বুজে যায়। চেরারে হেলান দিয়ে তিনি ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলেন।

হরিহর চা বিস্কুট নিয়ে আসে। ধীরে ধীরে চায়ে চুমুক দিলেন মার্কো। বিস্কুট দুটো খেলেন। তাঁর ক্লান্ত ভাবটা একটু কাটে।

দুই

মার্কোকে কিঞ্চিং তাজা দেখে পুলক জিজ্ঞেস করে, ‘সেই খাতাটা হারাল মানে চুরি গেল কী ভাবে?’

মার্কো জবাব দিলেন, ‘খাতাটা চুরি হয়েছে কয়েক দিন আগে আমার জ্বরের সময়। পাঁচ দিন আগে আমার হোটেলে নিয়ে যাই খাতাটা–’

‘কোন হোটেলে?’ জানতে চায় পুলক।

“কুতুব হোটেল। যেখানে আমি চাকরি করি এখন। ধর্মতলায়।’

‘বুঝেছি,’ ঘাড় নাড়ে পুলক, ‘তারপর?’

‘খাতাটা দেখে একটা স্পেশাল ডিশ বানাই। সেদিন বিকেল থেকেই শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছিল। অনেক রাতে যখন বাড়ি ফিরি গায়ে তখন বেশ জ্বর। মাথার খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। হাত ব্যাগ থেকে কিছু টুকিটাকি জিনিস বের করে শোবার ঘরে টেবিলের ওপর রাখি। তার মধ্যে পার্স আর খাতাখানাও ছিল। তারপর কোনোরকমে জামা কাপড় পাল্টে একটা মাথাধরার ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়ি বিছানায়। এমনকী ঘরের দরজার ছিটকিনি লাগাতেও ভুলে যাই। ঘুম মোটে হয় না। ছটফট করেই রাতটা কাটে। সকালে আমার সার্ভেন্ট ভরত যখন ডাকে আমায় তখন আমার গায়ে হাই টেমপেরেচার। আচ্ছন্ন ভাব। ভরত ভয় পেয়ে আমার ক’জন রিলেটিভকে খবর দেয়। আমার হোটেলেও টেলিফোন করে জানায়।’ ‘বাড়িতে আপনি একা থাকেন?’ প্রশ্ন করে পুলক। ‘হ্যাঁ, আপাতত একাই। আর ওই ভরত থাকে। আমার স্ত্রী মারা গিয়েছে বছর তিনেক হল। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে বছর পাঁচেক আগে। ওরা থাকে সিঙ্গাপুরে। বছরে দু-তিনবার আসে আমায় দেখতে। বাড়িটা আমার নিজের। বছর দশেক আগে কিনেছিলাম। আমি কলকাতায় এসেছি বছর দুই। বহুকাল বাইরে বাইরে কাটিয়ে মনে হল যে শেষ বয়সটা দেশে কাটাই, আত্মীয়দের কাছাকাছি। তাই কুতুবে কম মাইনের চাকরি নিয়ে চলে এলাম।

আমার দুই ভাগনে থাকত আমার বাড়িতে। বড়টি বছর দেড়েক হল চাকরিতে ট্রান্সফার হওয়ার ফ্যামিলি নিয়ে চলে গিয়েছে দিল্লি। আর ছোট তারককে আমি বাড়ি থেকে সরিয়েছি বাধ্য হয়ে মাস ছয়েক আগে।’

‘কেন?’ পুলক জানতে চায়।

‘ওর স্বভাবের জন্যে। বেশি রাত করে বাড়ি ফিরত প্রায়ই। ওর কাছে আজেবাজে টাইপের লোক আসত। হুল্লোড় করে তাস খেলত। আমার অসুবিধা হচ্ছিল। কয়েকবার ওয়ার্নিং দিয়েছি ঠিকভাবে চলতে, শোনেনি। তাই ওকে চলে যেতে বলেছিলাম। ওই পাড়াতেই একটা ঘর ভাড়া করে থাকে তারক। এখনও বিয়েটিয়ে করেনি। তবে আমার কাছে আসে মাঝে মাঝে। টাকাপয়সার টান তো লেগেই আছে। ধার চায় হরদম। উড়নচণ্ডী নেচার। ধার দিই, মাঝেসাঝে। শোধ অবশ্য করে না। সে আশাও করি না।’

‘কী কাজ করে আপনার ভাগনে তারক?’ জিজ্ঞেস করে পুলক।

‘বিজনেস করে। তবে কেবলই ব্যবসা পাল্টায়। কিছুই ওর দাঁড়ায় না। ফাঁকিবাজি করে কি আর ব্যবসা হয়?’

‘তারপর, জ্বরের সময় কী হল?’ আগের প্রসঙ্গের খেই ধরিয়ে দেয় পুলক।

‘হ্যাঁ দুটো দিন জ্বরের ঘোরে আর মাথা তুলতে পারিনি। ইতিমধ্যে অনেকে আমায় দেখতে আসে। ডাক্তারও আসে। ওষুধ পড়ে। তৃতীয় দিন জ্বর ছাড়ে। কিছু খেতেও পারি। ফোর্থ ডে-তে বিছানায় বসে লক্ষ করি যে টেবিলে রান্নার খাতাটা নেই। বাকি সব জিনিস রয়েছে। অবশ্য পার্সটায় কিছু টাকা ছিল। পরে খুলে দেখেছি টাকাও নেই; তো টাকা গিয়েছে যাক। কিন্তু রান্নার খাতাটা নেই দেখে কী বলব ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়লাম। খুঁজলাম, কিন্তু ঘরে কোথাও পেলাম না। ওই টেবিলেই রেখেছিলাম স্পষ্ট মনে আছে। ভরতকে জিজ্ঞেস করলাম। সে কোনো হদিশ দিতে পারল না। কী সর্বনাশ হয়েছে বুঝতে পেরে আর একদিন মাত্র রেস্ট নিয়ে দুর্বল শরীরেই চলে এসেছি আপনার কাছে।’ মার্কো অসহায়ভাবে পুলকের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

‘মানিব্যাগে কত টাকা ছিল?’ প্রশ্ন করে পুলক।

‘বেশি নয়, গোটা পঞ্চাশ।’

‘ভরত বিশ্বাসী?’

‘হ্যাঁ খুবই বিশ্বাসী। আমার কাছে আছে প্রায় দশ বছর। ওর কাছে ঢের বেশি টাকা জমা রাখি সংসার খরচ হিসাবে। পরে হিসাব দেয় খরচের। টাকা সরাচ্ছে কখনও সন্দেহ হয়নি। আমার বাড়ির বাজার হাট কেনাকাটি, বিল মেটানো, ভরতই প্রায় সব করে ওই জমা রাখা টাকা থেকে।’

‘রান্নার খাতাটা বাড়িতে রাখেন কোথায়?’ পুলক জানতে চায়।

‘আমার শোবার ঘরে টেবিলের ড্রয়ারে।’

‘ড্রয়ারে চাবি দেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘হোটেলে নিয়ে যান খাতাটা?’

‘যাই কদাচিৎ। সাধারণত আমি ওই খাতা থেকে কোনো আইটেম বানালে, কাগজে আলাদা করে রান্নাটা টুকে নিয়ে যাই। খাতাটা নিই না। তবে কখনও-সখনও তাড়াহুড়োর রান্না টুকতে সময় না পেলে খাতাটা নিয়ে গিয়েছি হোটেলে। খাতা দেখে রান্নার কাজ হয়ে গেলেই খাতাটা রেখে দিই হোটেলে আমার প্রাইভেট রুমে ড্রয়ারে চাবি দিয়ে! অনেক বছর আগে খাতাটা একবার চুরি করেছিল আমার এক কলিগ। তবে চট করে টের পেয়ে যাই। তারপর ওর ঘর সার্চ করে খাতা উদ্ধার করি। তখন থেকে সাবধান হয়ে গিয়েছি। একটু বাঁকা হেসে মার্কো বললেন— ‘অবশ্য খাতাটা চুরি করে কেউ লাভ করতে পারবে না, যদি না তার কোড ল্যাংগুয়েজ অর্থাৎ লেখার সাংকেতিক অর্থ উদ্ধার করতে পারে।’

‘মানে?’ দারুণ অবাক হয়ে বলে পুলক। আর জয়ও চমকে ওঠে শুনে।

রহস্যময় ভঙ্গিতে মার্কো জানালেন, ‘খাতাটা আমি নিজে হাতে লিখেছি ইংরেজিতে। তিন রকম রঙের কালিতে লেখা আছে রান্নাগুলো। লাল, কালো আর নীল। হয়তো কোনো আইটেম লেখা হয়েছে খানিকটা নীল আর খানিকটা লাল কালিতে। ফাউন্টেন পেনে বা ডট পেনে। আবার কখনও নীল লাল কালো তিন রঙেই লেখা আছে কোনো আইটেমের কিছু কিছু অংশ। ওই লেখার রঙেই লুকিয়ে আছে কোড মানে সংকেত।’

‘কী রকম?’ প্রচণ্ড কৌতূহলে প্রশ্ন করে জয়।

মার্কো বলতে থাকেন, ‘খাতায় নানা দেশের ফুড আইটেমগুলোর রান্নার ডিটেলস-এর বেশি অংশই লেখা আছে নীল কালিতে। নীল কালিতে লেখার মধ্যে কোনো গোপন ব্যাপার বা কোড নেই। যে ভাবে রাঁধতে হবে ঠিক তাই আছে লেখায়। কিন্তু অল্প কিছু কিছু অংশ লেখা হয়েছে লাল বা কালো কালিতে। ওই লাল বা কালো কালির ব্যবহারেই লুকিয়ে আছে কোড মানে গোপন সংকেত। সাধারণত রান্নার রেসিপি অর্থাৎ তেল ঘি নুন মশলার মাপগুলো লেখা হয়েছে লাল বা কালো কালিতে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে যে রেসিপিগুলো যাতে ভালোভাবে নজরে পড়ে তাই অন্য রঙের কালি ব্যবহার করা হয়েছে। আসলে কিন্তু তা নয়। লাল কালির লেখা বোঝাচ্ছে একটা কোডকে। আর কালো কালির লেখা বোঝাচ্ছে আর এক রকম সাংকেতিক মাপকে।

খাতায় কী কোড ব্যবহার করেছি তা আপনাদের বলব না খুলে। তবে একটা উদাহরণ দিলে ধরতে পারবেন ব্যাপারটা। এই ধরুন লাল কালিতে লেখা কোনো মাপ মানে হয়তো আসলে ওই মাপের অর্ধেক। যদি লাল কালিতে লেখা থাকে কোনো রান্নায় লাগবে এক কেজি সরষের তেল; তাহলে সেই রান্নায় আসলে দিতে হবে পাঁচশো গ্রাম সরষের তেল। আর কালো কালিতে লেখা মানে হয়তো বোঝাচ্ছে লেখা মাপের চার ভাগের তিন ভাগ। অর্থাৎ কালোতে এক কেজি তেল লাগবে লেখা থাকলে ধরতে হবে আসলে রান্নায় দিতে হবে সাড়ে সাতশো গ্রাম তেল।

কোন কালির বেলায় কী গোপন কোড বা মাপ সেটা জানি শুধু আমি নিজে। আর কেউ জানে না। আবার কিছু কিছু রান্নার দরকারি জিনিস লেখা আছে ক্যাপিটাল লেটর্সে। মানে বড় হাতের, অক্ষরে। তারমধ্যেও লুকিয়ে আছে গোপন সংকেত। যার অর্থ জানি শুধু আমি।

ওই খাতার বেশির ভাগ স্পেশাল আইটেম করার সময় রেসিপি মানে মশলাপাতিগুলো আমি নিজের হাতে মেশাতাম রান্নায়। খেয়াল রাখতা যাতে অন্য কেউ ধরতে না পারে। কাজেই খাতাটা হাতে পেলেই কেউ যে চট করে তাই থেকে রান্নাগুলোর খুঁটিনাটি জেনে ওই খাবার বানিয়ে ফেলবে সে ভয় নেই।

‘বাঃ বুদ্ধিটা তো দারুণ করেছেন।’ জয় মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করে।

কিন্তু কিন্তু ভাবে বলেন, ‘বুদ্ধিটা ঠিক আমার নয়, রবার্টের।

‘কে রবার্ট?’ প্রশ্ন করে পুলক।

‘রবার্ট ডি সুজা। গোয়ানিজ। আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড। গোয়ায় শুর মস্ত অ্যাগ্রিকালচারাল ফার্ম আছে। নানা ফলের বাগান। অবস্থা খুব ভালো। ধনী বলা যায়। ওর সঙ্গে গোয়াতেই আলাপ। ফুল ফল গাছপালা ছাড়াও ওর আর একটা প্রচণ্ড শখ – রান্না। ওর কিচেনে আমরা দু’জন কত যে রান্নার এক্সপেরিমেন্ট করেছি। দেশি বিদেশি কত চালু রান্নার হেরফের ঘটিয়ে খাবারগুলোকে নতুন স্বাদ দিয়েছি। ওঃ সে সময়গুলো আমাদের কী আনন্দে যে কাটত।’

‘রবার্ট এই কোড ল্যাঙ্গুয়েজের বুদ্ধিটা দিলেন কেন?’ পুলক মার্কের স্মৃতি রোমন্থনের উচ্ছ্বাসে বাধা দেয়।

মার্কো একটু থমকে গিয়ে বললেন, ‘আগেই বলেছি, এই খাতাটা একবার চুরি হয়েছিল। তখন আমি গোয়ায় একটা মাঝারি হোটেলে কাজ করি। হেড-কুকের প্রধান অ্যাসিস্ট্যান্ট। ওই রান্নার খাতাটায় তখন সবে লিখতে শুরু করেছি। জমানো টুকরো টুকরো নোটস থেকে খাতাটায় ফেরার করে টুকছি। হেডকুক গঞ্জালেস আমায় খুব ভালোবাসত। মাঝে মাঝে আমায় স্বাধীনভাবে দু-একটা স্পেশাল ডিশ করতেও দিত। আমি খাতাটা হোটেলে নিয়ে গিয়ে দেখে দেখে রান্না করতাম।

ওই হোটেলে আর একজন ছোকরা কুক ছিল— দেশাই। সে লক্ষ করেছিল ব্যাপারটা। একদিন সে হোটেলে আমার টেবিলের ওপরে রাখা খাতাটা স্রেফ না বলে নিয়ে মানে বলা উচিত চুরি করে নিজের ঘরে নিয়ে যায় পড়তে। ওই হোটেলের গায়েই একটা ঘরে থাকত দেশাই। ভাগ্যিস আমি সঙ্গে সঙ্গে টের পাই-খাতা মিসিং। একটু আগে দেশাইকে দেখেছি আমার টেবিলের কাছে। তাই সঙ্গে সঙ্গে ওর ঘরে গিয়ে ওকে হাতেনাতে ধরি খাতাটা সমেত। রবার্ট ব্যাপারটা জানতে পেরে এই কোড ল্যাঙ্গুয়েজের বুদ্ধিটা দেয়। কিছু কিছু অংশ কোডে লিখতে। যাতে খাতাটা চুরি হলেও চোর রান্নাগুলো চুরি করতে না পারে। আর সাবধানে রাখতে খাতাটা। কারণ হোটেলে কুক মহলে আমার এই রান্নার খাতার খ্যাতি ঠিকই ছড়াবে।’

মার্কো কেটু অপ্রতিভভাবে বললেন, ‘রবার্টের পরামর্শেই আমি একটা অন্য প্রফেশনাল নাম নিই। রবার্টই ঠিক করে দেয় নামটা—মার্কো-ডা-গশ্। আমার অরিজিনাল ফ্যামিলি নামের আদলে। সত্যি এতে কাজ হয়েছে। বেশির ভাগ লোকই আমায় গোয়ানিজ ভাবে। আর হোটেল ব্যবসায় গোয়ানিজ কুকের খুব ডিমান্ড। নাম পাল্টানোর পরেই আমি টপাটপ বেশি মাইনের কাজ পাই বড় বড় হোটেলে। খানিকটা এই নামের জোরেই। কারণ গোরানিজ কুক থাকলে হোটেলের প্রেস্টিজ বাড়ে।’

অনেকক্ষণ একটানা কথা বলে মার্কো ফের হাঁপিয়ে পড়েন। চেয়ারে পিঠ এলিয়ে চুপ করে দম নেন।

পুলক খানিক অপেক্ষা করে বলে, ‘দেখুন মিস্টার গশ্, আপনার ওই খাতা যে কেউ নেবে না। আপনার লাইনেরই কেউ খাতাটা চুরি করেছে। এখন বলুন, আপনার ওই রান্নার খাতার পরিচয় কলকাতায় আপনার লাইনের কে কে জানে?

মার্কো একটু চিন্তা করে বললেন, ‘অস্তুত দু’জনের কথা আমি জানি। কুতুব হোটেলে আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট রতনলাল মহাপাত্র আর ক্যালকাটা হোটেলের চিফ কুক হরিরাম শর্মা। এ দু’জন অবশ্যই জানে আমার খাতার কথা।’

কী করে জানল? আপনি নিজে বলেছেন তাদের?’ ‘না, তবে এখন গোয়া-দিল্লি-হায়দরাবাদের অনেক হোটেল স্টাফই জানে আমার এই খাতার কথা। হয়তো তাদের থেকে ওদের কানে এসেছে।’

‘ওরা বে জানে তার প্রমাণ কিছু পেয়েছেন?’

‘পেয়েছি। একদিন হোটেলে বসে আলগা পাতায় একটা রান্না টুকছিলাম ওই খাতা থেকে! রতনলাল হুট্ করে আমার রুমে ঢুকে কাছে এসে বলল—এই বুঝি আপনার সেই বিখ্যাত রান্নার খাতা? ভুরু কুঁচকে তাকাতে ও সরে পড়ে।’

‘রতনলালের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?’

‘বাইরে ভালোই। তবে কুত্তুবের চিহ্ন কুকের পোস্টটাও পাবে আশা করেছিল। আমায় বাইরে থেকে এনে বসিয়েছে। তাই আমার ওপর চাপা রাগ থাকতে পারে। ‘আর হরিরামের সঙ্গে?

হরিরামের সঙ্গে আমার অনেক দিনের চেনা। তবে লোকটা হিংসুটে স্বভাবের বলে ওকে এড়িয়ে চলি। হরিরান আমার বাসায় কয়েকবার গিয়েছে। ও নাকি গোপনে আমার কাজের লোক ভরতকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল, আমার যে একখানা মোটা হলুদ মলাটের খাতা আছে সেটা আমি রাখি কোথায়? ড্রয়ারে চাবি দিয়ে রাখি কি? ক্যালকাটা হোটেল আশায় অফার দিয়ে রেখেছে ওদের হোটেলে শেফ্ হিসাবে জয়েন করার জন্য। মনে হয় হরিরাম ভাই আমার ওপর প্রসন্ন নয়। তবে ক্যালকাটা হোটেলে জয়েন করার ইচ্ছে আমার নেই। কুতুবে আমি বেশ আছি। কুতুবের ম্যানেজার বিক্রম সিং আমায় খুব পেয়ার করে।’

‘আপনার জ্বরের সময় রতনলাল, হরিরাম দু’জনেই কি এসেছিল আপনাকে দেখতে?’ ‘হ্যাঁ দু’জনেই এসেছিল। ভরত বলেছে।’

মার্কো আকুল কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘যেই চুরি করুন খাতাটা পেয়ে তার লাভ হবে না, যতক্ষণ না সে কোডগুলোর রহস্য আবিষ্কার করতে পারে। কিন্তু চুরি ধরা পড়ার ভয়ে বা রাগের মাথায় যদি সে খাতাখানা ডেসট্রর করে ফেলে। আমার এত বছরের পরিশ্রম সাধনা জলে যাবে। খাতাটা অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে দিন প্লিজ।’

পুলক আশ্বাসের সুরে বলে, ‘অত হতাশ হবেন না। যে চুরি করেছে সে খাতাটার মূল্য বোঝে। নেহাত বেকায়দায় না পড়লে সেটা নষ্ট করবে না। খাতা চুরি আপনি যে টের পেয়েছেন সেটা আপনি বাইরে একদম প্রকাশ করবেন না। বরং নিশ্চিত ভাব দেখাবেন যেন খাতাটা ড্রয়ারেই আছে। আচ্ছা আপনার আত্মীয় কেউ জানে এই খাতাখানার পরিচয়?’

‘না। মুখ ফুটে বলিনি কাউকে। তবে দুই ভাগনে আন্দাজ করতে পারে ওটায় রান্না লেখা আছে। আমায় নিশ্চয় দেখেছে ওটা পড়তে। ওটার লিখতে।

‘হুম্।’ পুলক চিন্তিত ভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, ‘আপনি এখানে এসেছেন কীসে? মার্কো বললেন, ট্যাক্সিতে। আমার নিজের গাড়ি আছে। কিন্তু এখন গাড়িটা খারাপ, তাই ট্যাক্সিতে এসেছি।’

পুলক বলল, “ঠিক আছে হরিকে বলছি একটা ট্যাক্সি ডেকে দিতে। বাড়িতেই থাকবেন। দরকার মতো ফোন করব বা আমি নিজে যাব আপনার কাছে। মন শক্ত রাখুন।’ মার্কো বিদায় নিলেন।

তিন

মার্কো-ডা-গশের আগমনের পরদিন। পুলক সক্কালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফিরল ঘণ্টা দুই বাদে। বাড়ি এসে দেখে যে জয় তার ড্রইং রুমে তরিবত করে চা এবং পাঁপড় ভাজা সাঁটাচ্ছে হরিহরের বদান্যতায়।

‘কি, মার্কোর কেস নিয়ে ঘোরাঘুরি করছ বুঝি?’ প্রশ্ন করে জয়।

‘হুঁ। হরিহর চা’, হাঁক দিয়ে পুলক চেয়ারে বলে বলে, ‘একটু বাদেই মার্কোর কাছে যেতে হবে, যাবে নাকি সঙ্গে?’

‘জরুর।’ জয় রাজি। সে মিচকে হেসে বলে, ‘পুলকদা তোমার এই কেসটা কিন্তু তেমন প্রেস্টিজের নয়। সামান্য হলুদ মলাটের রান্নার খাতা, চপ কাটলেট স্যুপ বানাবার ফর্মুলা —নাঃ পাঁচজনকে বলার মতো নয়।’

পুলক গম্ভীর ভাবে বলে, ‘কেসটা অত হেলাফেলা করো না হে। দেখো জয়, বা চুরি হয়েছে তার বাজার দাম কত তাই নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না। যাই চুরি হোক না কেন, চোরকে ধরা বা জিনিসটা উদ্ধার করা কতটা শক্ত কাজ সেটাই আমার কাছে বিচার্য। সেটাই আমার চ্যালেঞ্জ। সেই অনুসন্ধানেই আমার আনন্দ। একখান অতি সাধারণ দেখতে খাতাকে যে কোনো জায়গয় বইখাতার মধ্যে লুকিয়ে রাখা যায়। আবার চট করে পুড়িয়ে ছিঁড়ে নষ্ট করে ফেলা যায়। কাজেই ওই খাতা উদ্ধার মোটেই সহজ কর্ম নয়। ধরা পড়ার ভয় হলেই চোর কিন্তু খাতাটা নষ্ট করে চুরির প্রমাণ লোপ করে দেবে। তাই খুব সাবধানে এগুতে হবে। চোর যেন টের না পায় তাকে সন্দেহ করা হচ্ছে। বুঝেচ রিস্কটা?’

‘তা বটে।’ জয় সায় দেয়।

চা শেষ করে দু’জনে বেরিয়ে পড়ে। পৌঁছয় মার্কোর বাড়িতে ভবানীপুরে। ছোট দোতলা বাড়ি। নিচের তলায় একটা পান সিগারেটের দোকান।

কলিং-বেল টিপতে ভরত দরজা খোলে। গশ্ সাহেব তখন বিছানায় শুয়ে। খবর পাঠানো হয়—উনি যেন নিচে না নামেন, পুলকরাই ওপরে যাচ্ছে।

কর্মদাস ঘোষ ওরফে মার্কো-ডা-গশকে রীতিমতো ক্লান্ত বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। শারীরিক ক্লান্তির চেয়ে মানসিকভাবেই যেন তিনি বেশি বিপর্যস্ত। বালিশে ঠেস দিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বিষণ্ণ হেসে তিনি পুলকদের অভ্যর্থনা জানালেন।

‘আপনার সঙ্গে আপনাদের হোটেল ম্যানেজার মিস্টার সিং-এর সম্পর্ক কেমন?’ কাজের কথায় আসে পুলক।

সোজাসুক্তি মার্কো জবাব দেন, ‘আমাদের রিলেশন খুব ভালো। বন্ধু বলতে পারেন। সিংজি নিজেই আমায় অফার দিয়ে কানপুর থেকে এখানে আনিয়েছেন।’

‘ঊনি আপনার রান্নার খাতা সম্পর্কে কিছু জানেন?’

‘মনে হয় না।’

‘অসুখের সময় উনি আপনাকে দেখতে এসেছিলেন এখানে?’

‘হ্যাঁ। একবার এসেছিলেন। তবে ফোনে প্রতিদিনই খোঁজ নেন।’

‘বেশ ওর সঙ্গে প্রাইভেটলি দেখা করতে চাই ইনভেস্টিগেশনের স্বার্থে। কুতুব হোটেলের আর কেউ যেন না তা টের পায়। আপনি মিস্টার সিংকে ফোন করে আমার পরিচয় জানিয়ে আমার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করে দিন। ফোনে খাতাটার কথা বলার দরকার নেই। শুধু বলবেন, আপনার একটা দামি জিনিস হারিয়েছে, আর আমায় সেটা উদ্ধারের ভার দিয়েছেন। সাক্ষাতে সব খুলে বলা যাবে।’

মার্কো বলল, ‘সিংজির সঙ্গে গোপনে দেখা করতে আমার বাড়িই বেস্ট প্লেন। আমি সিংজিকে এখুনি ফোন করছি।’ মার্কো বিছানর পাশে রাখা টেলিফোনের রিসিভার তুলে বিক্রম সিং-এর সঙ্গে কথা শুরু করলেন।

কথার শেষে মার্কো জানালেন, সিংজি আজ রাত আটটায় আমার বাড়িতে আসবেন বলেছেন। আধ ঘণ্টার বেশি থাকতে পারবেন না। হোটেলের দায়িত্ব আছে তো।’

‘বেশ, আমি আটটার আগেই চলে আসব এখানে।’ পুলক জানিয়ে দেয়। তারপর বলে, ‘আচ্ছা ক্যালকাটা হোটেলের মালিক বা ম্যানেজারের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?’

মার্কো বললেন, ‘ওদের কারও সঙ্গেই তেমন ঘনিষ্ঠতা নেই। হোটেলের চাকরিতে আছি বলেই যেটুকু পরিচয়। স্রেফ প্রফেশনাল সম্পর্ক। তবে ক্যালকাটা হোটেলের ম্যানেজার মিস্টার ব্যানার্জি আমার রান্নার ফ্যান। তাই হোটেলে চিফ-কুকের অফারটা দিয়ে রেখেছেন।’

পুলক বলল, ‘ব্যস, আর এখন কথা নয়। রাতে যখন আসব বাকি কিছু কথা হবে। আপনি এখন রেস্ট নিন।’

সে রাতে মার্কোর বাড়িতে পুলক একাই গিয়েছিল। মার্কো ও বিক্রম সিং-এর সঙ্গে পুলকের কী কথা হয় জয় জানে না। পুলক নিজে থেকে জয়কে সঙ্গে যেতে বলেনি তাই জয়ও তার সঙ্গ ধরার ইচ্ছে প্রকাশ করেনি।

পরদিন ভোরে পুলক জয়কে টেলিফোনে ডাকল। পুলক কয়েকটা জায়গায় যাবে, জয় সঙ্গে থাকলে ভালো হয়। ওই মার্কোর কেসটার ব্যাপারে। জয় তো উন্মুখ হয়েই ছিল। সে তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে যায়।

কথামতো সকাল দশটায় পুলকের বাড়ি এসে জয় দেখে যে ওর বাড়ির সামনে পুলকের ছোটকাকার মারুতি ভ্যানখানা দাঁড়িয়ে আছে, ড্রাইভার সমেত।

পুলকের কাকার গাড়িতেই বেরুল দু’জনে। পুলক পরনে বেশ দামি শার্ট ও ট্রাউজার্স চড়িয়েছে। মুচকি হেসে বলল একবার, ‘বুঝলি, বড় হোটেলে অর্ডার দিতে গেলে ভালো ড্রেস আর গাড়ি ছাড়া ঠিক মানায় না!’

পুলকাদের গাড়ি থামল চৌরঙ্গি এলাকায় ক্যালকাটা হোটেলের সামনে। রিসেপশনে ম্যানেজারের খোঁজ করতে মিস্টার ব্যানার্জি হাজির হলেন। ব্যানার্জি সাহেব রাশভারী মানুষ। শার্ট-প্যান্ট-টাই পরা। ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করলেন পুলকাদের, ‘কী দরকারে?’ পুলক বলল, ‘আমাদের বাড়িতে একটা ছোট পার্টি হবে। এখান থেকে দুটো মোগলাই ডিশ নিতে চাই। শুনেছি, আপনাদের হোটেলের নাম আছে মোগলাই খানায়।’

‘কী কী খাবার?’ জানতে চান ম্যানেজার।

‘লখনউ মাটন বিরিয়ানি আর বোগদাদি শাহি কাবাব।’

ব্যানার্জি বললেন, ‘বিরিয়ানিটা হবে কিন্তু বোগদাদি কাবার আমরা করি না।’

‘আপনাদের চিফ-কুককে ডেকে জিজ্ঞেস করুন না যদি তিনি জানেন? ওল্ড দিল্লিতে এক হোটেলে খেয়েছিলাম ওই কাবাব। দারুণ খেতে।’

‘অলরাইট ডাকছি। ওরে হরিরামজিকে ডাক তো’—

ক্যালকাটা হোটেলের শেফ হরিরাম শর্মা এলেন। বেঁটে মোটা লালচে চেহারা। মাংসল মুখখানা যেন রাগী রাগী।

হরিরাম অর্ডারটা শুনে একটু ভুরু কুঁচকে জানালেন, ‘বোগদাদি শাহি কাবাব হবে না। ও আমি জানি না। হুঁ, নাম শুনেছি বটে।’

‘একেবারে পারবেন না? যদি কারও থেকে জেনে নিয়ে বানিয়ে দেন? ঠিক দিল্লির হোটেলটার মতো স্বাদ না হলেও কাছাকাছি হলেও চলবে।’

‘নেহি সাব। ও কাবাব হোবে না।’ হরিরাম সাফ নাকচ করে দেয়।

‘আচ্ছা ওই কাবাব কলকাতায় কেউ করে?’ পুলক জানতে চায়।

‘নেহি মালুম।’ হরিরাম ঘাড় নাড়ে।

পুলক ব্যানার্জিকে বলল, ‘সরি মিস্টার ম্যানেজার, তাহলে এখন আপনাদের অর্ডার দিচ্ছি না। দেখি খুঁজে ওই কাবাব কেউ বানাতে পারে কিনা? দুটো ডিশ এক জায়গা থেকে পেলে আমার সুবিধে হয়। যদি বিরিয়ানিটা এখান থেকে নিই, পরে জানাব। থ্যাংকিউ।’

পথে গাড়িতে জয় আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেসকরে পুলককে, ‘কী ব্যাপার, পার্টি কীসের?’

‘মানে পুতুল এত ভালো ভাবে বি.এ. পাশ করল। ওকে খাওয়াব বলেছিলাম। সেটা পাওনা আছে।’

‘তোমার ভাগনি পুতুল?’

‘হ্যাঁ। তোমার আর রূপারও নেমন্তন্ন থাকবে।’

‘তা ওই বোগদাদি কাবাবটা কেন? পাওয়া যাচ্ছে না যখন, অন্য কিছু অর্ডার দিতে পারতে।’

‘নাহে। ওই বোগদাদি কাবাব আমি খাওয়াবই।’

জয় এবার পুলকের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হেনে বলে, ‘বুঝেচি, ওই কাবাবে কোনো রহস্য আছে। একটু খোলসা করো দেখি?’

পুলক কিন্তু খোলসা করে না। শুধু মুচকি হেসে বলে, ‘আছে, আছে পরে জানতে পারবে। চলো এবার কুতুবে ঢোকা যাক।’

গাড়ি তখন কুতুব হোটেলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

পুলক জয় ভিতরে ঢুকে হোটেলের ম্যানেজারে খোঁজ করল।

কুতুবের ম্যানেজার বিক্রম সিং মধ্যবয়সি দীর্ঘকায় সুপুরুষ প্রসন্নবদন পাঞ্জাবি পুরুষ। পুলকরা শাঁসালো খদ্দের ভেবেই যেন তিনি দুজনকে সাদরে বসালেন অফিস ঘরের এক কোনায় কথাবার্তা বলতে। কিন্তু পুলকের সঙ্গে যে গত রাতেই তাঁর আলাপ পরিচয় হয়েছে ঘুণাক্ষরেও তেমন কোনো ইঙ্গিত দিলেন না। পুলকও তা প্রকাশ করল না। বিক্রম সিং কথা বলছিলেন ভাঙা ভাঙা বাংলায় ও ইংরেজিতে।

পুলক ক্যালকাটা হোটেলে যেমন বলেছিল তেমনি এখানেও লখনউ মাটন বিরিয়ানি আর বোগদাদি শাহি কাবাবের অর্ডার দিতে চাইল নিজের বাড়িতে একটা ঘরোয়া পার্টি উপলক্ষে।

সিংজি একটু ভেবে বললেন, ‘আমি ঠিক বলতে পারছি না ডিশ দুটো করা যাবে কিনা?’ পুলক বলল,‘আপনাদের চিফ-কুক মার্কো গশ্ কিন্তু আমায় একবার বলেছিলেন, অর্ডার দিলে এই ডিশ দুটো বানিয়ে দিতে পারেন। আমি খোঁজ নিতে এসেছিলাম।’

‘কদ্দিন আগে?’

‘এই মাসখানেক আগে।’

বিক্রম সিং বললেন, ‘মার্কো যখন বলেছিল করা যাবে তখন নিশ্চয় করা যেত। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে মার্কো অসুস্থ, ছুটিতে আছে।’

পুলক বলল, ‘আর কোনো কুক নেই যিনি ডিশ দুটো তৈরি করতে জানেন?’ সিংজি বললেন, ‘দেখি রতনলালকে ডাকি। মার্কোর সিনিয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট।’

রতনলাল এল। রোগা ছোটখাটো চেহারা। মাঝ বয়সি। ভাঙাচোরা মুখখানায় কেমন বিরক্তি ভাব।

রতনলাল অর্ডারটা শুনে বলল, ‘বিরিয়ানিটা পারব। তবে বোগদাদি কাবাবের গ্যারান্টি চট করে দিতে পারছি না। অনেক দিন আগে শিখেছিলাম খাবারটা। নোট করে রেখেছিলাম। যদি নোটগুলো খুঁজে পাই মোটামুটি বানিয়ে দেব। বিকেলে আসুন একবার, ফাইনাল জানাব।’

‘ঠিক আছে, তাই আসব’, পুলক উঠতে উঠতে বলে, ‘আসলে যার পাশ করা উপলক্ষে পার্টি তাকে ওই কাবাবটা খাওয়াব বলে আশা দিয়েছি। এখানে না পেলে অন্য জায়গায় খুঁজতে হবে।’

খদ্দের হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় বুঝি বিক্রম সিং পুলকের সামনেই রতনলাল কে উৎসাহ দিলেন, ‘রতন ট্রাই ইওর বেস্ট। তোমার ওপর আমার কনফিডেন্স আছে।’ ফিরে যেতে যেতে জয় বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আচ্ছা রহস্যময় কাবাব বটে! ওর জন্যে এত ঘোরাঘুরি?’

পুলক মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, ‘হুঁ বাবা, ওই কাবাব না চাখলে রহস্যটা ঠিক ধরতে পারবে না।’

বিকেলে কুতুব হোটেল থেকে ঘুরে এসে পুলক জয়কে খুশি হয়ে জানাল যে রতনলাল আশা দিয়েছে যে ওই বোগদাদি কাবাব বানিয়ে দেবে।

একদিন বাদেই পুতুলের পাশ করার সেলিব্রেশন হল পুলকের বাড়িতে। সন্ধ্যায় পুতুল, পুতুলের ছোট ভাই বাচ্চু আর পুতুলের বন্ধু অর্চনা এল। আর এল জয় এবং তার বোন রূপা।

অনেক গাল-গল্প, গান, হই-চই-এর পর রাতে খাবার পালা। কুতুবের দুই স্পেশাল আইটেম ছাড়াও হরিহর বাড়িতে বানিয়েছে—ফিশ ফ্রাই আর চাটনি। দোকান থেকে এসেছে আইসক্রিম!

খাবার টেবিলে সবাই বার পর একটা ঢাকা দেওয়া চিনেমাটির পাত্র খুলতেই বিরিয়ানির এমন সুগন্ধ ছড়াল যে সবার জিভে জল এসে গেল, পেটে খিদে চনমন করে উঠল।

তার একটা পাত্রের ঢাকনি খুলতে, তাতে উঁকি দিয়ে জয় বলল, ‘এটায় কি বোগদাদি কাবাব নাকি?’

পুলক মাথা নেড়ে বলল, নাঃ কুতুবের বোগদাদি নয়, এটা আমিনিয়া রেস্টুরেন্ট থেকে আনা অন্য রকম কাবাব। কুতুবেরটা যাচ্ছেতাই বানিয়েছে রতনলাল। ওটা মুখে দেওয়া যায় না। কাল মশলার গড়গড়ে। ও পয়সা আমার জলে গেল। ম্যানেজারকে আমি কমপ্লেন করেছি। ম্যানেজার লজ্জিত হয়েছেন। কাবাবের দাম কিছু কম নেবেন বলেছেন। আর রতনলালকে ধমকবেন। কেন সে ভালো মতো না জেনে বানাতে গেল। তবে বিরিয়ানিটা ফার্স্টক্লাস বানিয়েছে। বোগদাদি কাবাব নেই তোমাদের বরাতে কী আর করা?’

যাহোক বোগদাদি স্পেশালের অভাবে নেমত্তন্নে কিছু মাত্র খামতি হয়নি। পরম তৃপ্তিতে পেট পুরে খেল সবাই।

চার

পুলক যেদিন নেমত্তন্ন খাওয়াল পুতুলের পাশ করা উপলক্ষে তার পরদিন সকাল দশটা নাগাদ মার্কো হাজির হলেন কুতুব হোটেলে। নিজের গাড়িতে নয় ট্যাক্সিতে। খুব আস্তে আস্তে পা ফেলে হোটেলে ঢুকলেন। বোঝা যায় তখনও তিনি খুবই দুর্বল।

মার্কোকে দেখেই ছুটে এল ম্যানেজার বিক্রম সিং।

মার্কো বললেন, ‘একটা জিনিস বোধহয় ফেলে গেছি। যেদিন জ্বর হয় সেই রাতে। সেটা খুঁজতে এসেছি।’

‘কী জিনিস?’

‘তেমন কিছু দামি জিনিস নয়। একটা নোট বই। খাতা। কোথায় যে রেখেছি ঠিক মনে করতে পারছি না। দেখি আমার রুমে!’

হোটেলের তিনতলায় একটা ছোট ঘরে বিশ্রাম নিতেন মার্কো। দরকারে রাতেও থেকে যেতেন ওই ঘরে। মার্কো সেই ঘরে গিয়ে খুঁজলেন টেবিলের ওপরে, টেবিলের ড্রয়ারেনোট বইটা পেলেন না। হোটেল স্টাফদের যাকে সামনে পেলেন তাকেই জিজ্ঞেস করলেন- ‘একটা হলুদ রঙের মলাটের বাঁধানো পাতা দেখেছ কি? কিচেনে বা আমার রুমে হয়তো ফেলে গিয়েছি।’

কেউ খাতাটার হদিশ দিতে পারল না।

রতনলালও মার্কোর সঙ্গে খানিক খুঁজল খাতাটা। জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনার সেই রান্নার খাতাটা বুঝি? কোথায় ফেললেন?’

মার্কো চিন্তিত ভাবে বলেন, ‘সেটাই ঠিক মনে করতে পারছি না। সেদিন শরীরটা এত খারাপ লাগছিল যে কোনো হুঁশই ছিল না। এখানে ফেললাম? না নিউ মার্কেটের দোকানে? বাড়ি যাওয়ার পথে নিউ মার্কেটে একটা দোকানে ঢুকেছিলাম কফি কিনতে। দেখি সেখানে। আমার নিজের গাড়ি খারাপ থাকায় সেদিন ট্যাক্সিতে এসেছিলাম। ট্যাক্সিতেই ফিরি। ট্যাক্সিতেই খাতাটা রয়ে গেলে অবশ্য আর আশা নেই। ট্যাক্সিতে বসে একবার কফির প্যাকেট আর খাতাটা বের করেছিলাম একটা বিল খু‍ঁজতে। বাড়িতেও পাচ্ছি না। যাকগে আমার খাটুনি বাড়ল।

‘খাটুনি বাড়ল কেন?’

‘অরিজিনাল খাতা থেকে আবার টুকতে হবে তাই।’

‘আপনার হারানো খাতাটায় তো অনেক ভালো ভালো রান্না লেখা ছিল? অনেক স্পেশাল ডিশ।’

‘তা ছিল।’ একটু রহস্যময় হেসে বলেন মার্কো, ‘তবে ও খাতা আর কারও হাতে পড়লে তার কোনো লাভ হবে না।”

‘কেন?’

‘কারণ ওই খাতার রান্নাগুলোর রেসিপি আর মাপগুলো সাংকেতিক কায়দায় লেখা আছে। সেই সাংকেতিক ভাষা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। সুতরাং ওই খাতার লেখা ফলো করে কেউ রান্না করতে চেষ্টা করলে উল্টো পাল্টা স্বাদ হবে খাবারের। অবশ্য খুব মেহনত করলে কোড ল্যাঙ্গুয়েজটা ধরা যায়। তবে তা লাল কালিতে লিখেছি। ওই লাল কালির লেখায় লুকিয়ে আছে কোড।’

রতনলাল চমৎকৃত হয়ে বলে, ‘বাঃ আচ্ছা বুদ্ধি করেছেন, বটে। তা কোড ল্যাঙ্গুয়েজে রেসিপিগুলো লিখলেন কেন? খাতা চুরির ভয়ে?’

‘ঠিক ধরেচ,’ সায় দেন মার্কো, ‘গোয়ায় থাকতে খাতাখানা একবার চুরি হয়েছিল। আমার হোটেলের এক ছোকরা বাবুর্চি খাতাটা চুরি করে। আমার রান্নাগুলো মেরে দেওয়ার তালে ছিল। চট করে টের পেয়ে ওর ঘর থেকে উদ্ধার করি খাতাটা। তারপরেই বুদ্ধিটা আসে। মাঝে মাঝে কোড ল্যাঙ্গুয়েজে রেসিপি লেখা। আমার অনেক কষ্টে জোগাড় করা সব রান্না, অন্যে বাটপারি করে তা জেনে ফেলবে। এটা অসহ্য। তখন থেকে দুটো খাতা তৈরি করেছি। একটায় লেখা আছে রান্নাগুলো ঠিকঠাক সোজা ভাষায়। অন্যটায় সংকেতে। রেসিপিগুলো কোড ল্যাঙ্গুয়েজে। আসল খাতাটা রাখি আমার ঘরে স্টিল আলমারির লকারে। আর নকল খাতাটা মানে কোডে লেখা খাতাটা থাকে টেবিলে। ওটা হোটেলেও আনি দেখেচ তো, ওই থেকে কোনো স্পেশাল রান্নার সময়। তাই আবার একটা নকল খাতা তৈরি করতে হবে আর কী। ওই হলুদ মলাটের খাতাটার মতো। আসল খাতাটা নিয়ে ঘোরাঘুরি রিস্কি। কোথাও হারিয়ে ফেলি বা চুরি হয়ে যায় যদি? থাকগে ওই হলুদ মলাটের খাতাটা নজরে পড়লে দিও আমায়।

না, তাই ‘আপনার এই কোডে লেখা নকল খাতাটার রহস্য বোধহয় আর কেউ জানে না?’ জিজ্ঞেস করে রতনলাল।

মার্কো জবাব দেন, ‘বাইরের লোক কেউ জানে না। তবে ঘরের লোক মানে আমার ভাগনে দু’জন জানে। ওদের সামনে একদিন বলেছিলাম কোডে রেসিপি লেখা খাতাটার কথা।

মার্কো ম্যানেজারের থেকে আরও কয়েকদিন ছুটি বাড়িয়ে নিয়ে চলে গেলেন। সেদিনই মার্কোর ঘরে ঢুকেই পুলক জয়কে রাত ন’টা নাগাদ ফোন করে ডেকে পাঠাল। জয় তার বাড়ি আসতেই বলল, ‘চল মার্কোর কাছে ঘুরে আসি। জরুরি দরকার।’ পুলকের মোটরসাইকেল চেপে রওনা দেয় দু’জন।

পুলক জিজ্ঞেস করল, ‘তারককে কেমন দেখলেন?’

মার্কো বলল, ‘খুব সিরিয়াস ইনজুরি নয়, তবে কয়েক দিন হাসপাতালে থাকতে হবে। মাথায় চারটে স্টিচ দিয়েছে। রড-টড দিয়ে মেরেছিল। আর নাক ভেঙে গিয়েছে ঘুসিতে।’

‘কে মেরেছে স্বীকার করেছে?’

‘পুলিশের কাছে করেনি। বলেছে, গিরিশ পার্কের ধার দিয়ে যাচ্ছিল। দুটো লোক ছিনতাই করবে বলে ধরেছিল ওকে। ও বাধা দিতে মেরেছে। শ’পাঁচেক টাকা ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়েছে। আমি ওর বেড়ের পাশে বসে আস্তে করে যেই বলেছি, জানি কে মেরেছে, রতনলালের লোক। অমনি তারকের মুখ একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। যেন ভীষণ ভয় পেয়ে বড় বড় চোখ করে আমার দিকে একটুক্ষণ তাকিয়েই চোখ বুজে ফেলল। আপনার অনুমানই ঠিক। ওকে রতনলালের লোকই ঠেঙিয়েছে।’

‘কী ব্যাপার? কেন মেরেছে তারককে? খুলে বল কেসটা। নইলে ছাড়ছি না।’ জয় রেগে বলে ওঠে।

‘আরে বলতামই তোমায়,’ পুলক জয়কে ঠান্ডা করে ‘আজ নয় তো কাল। অনুমানগুলো ঠিকঠাক লাগছে কিনা দেখে নেওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম।’

‘বেশ শুনি এবার।’ জয়ের তর সইছে না।

পুলক বলল, ‘আজ সন্ধেবেলা রতনলালের দু’জন ভাড়াটে গুন্ডা তারককে আচ্ছা ঠেঙিয়েছে। তারক আপাতত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বেডে শুয়ে আছে ব্যান্ডেজ জড়িয়ে।

‘কেন মেরেছে?’

‘খুব সম্ভব জেনেশুনে কোডে লেখা, কাজে লাগবে না, এমন একটা রান্নার খাতা রতনলালকে সাপ্লাই করে মোটা টাকা নেওয়ার অপরাধে।’

‘কোডে লেখা, মানে মার্কোর হারানো খাতা?’

‘হ্যাঁ তাই।”

‘ওটা তারক চুরি করে রতনলালকে দিয়েছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘প্রমাণ কী পেয়েছ?’

‘প্রমাণ বোগদাদি শাহি কাবাব।’ ও দিল্লির হোটেলে খাওয়া তোমার সেই ফেভারিট কাবাব? যেটা বানাতে গিয়ে রতনলাল গুবলেট করেছিল?’

পুলক হেসে বলল, ‘নাঃ ওটা আমি দিল্লির হোটেলে খাইনি। সত্যি বলতে কি কস্মিন কালেও খাইনি ও কাবাব। ওই কাঞ্চন মিস্টার গশের হারানো খাতার একটা স্পেশাল আইটেম। এই টোপ দিয়েই আমি বুঝলাম যে খাতাটা কার কাছে আছে।

‘কী রকম?’ ভয় একটু আঁচ করে ব্যাপারটা, তবু বিশদে জানতে চায়।

গুলক বলল, ‘প্ল্যানটা মিস্টার গশের সঙ্গে পরামর্শ করেই করি। খাতাটা যে চুরি করেছে সে নিশ্চয় খাতাটা পড়বে। বোগদাদি শাহি কাবাবের নামটাও তার নজর এড়াবে না! খাতায় নাকি প্রথম দিকেই আছে রান্নাটা। ও খাতা যার হেফাজতে, বোগদানি কাবাব ‘অর্ডার দিলে ক্রেডিট দেখাতে সে টা বানাবার চেষ্টা করতে পারে খাতা দেখে দেখে।’

‘তুমি তো সঙ্গে ছিলে জয়। ক্যালকাটা হোটেলের হেডকুক হরিরামের হাবভাব দেখে তো মনে হল যে বোগদাদি কাবাবের সে নামই শেখেনি। বানাতেও জানে না। সুতরাং বুঝলাম, মিস্টার গশের খাতা ওর কাছে নেই। তখন গেলাম কুতুবে। আমাদের দ্বিতীয় সাসপেক্ট রতনলালের কাছে।’

‘হুঁ বুঝছি।’ মাথা নাড়ে জয়।

‘কুতুবের ম্যানেজার সিং জানতেন আমি আসব। আমি মিস্টার গশ্ আর সিংজি মিলে প্লানটা ছকেই রেখেছিলাম। দারুণ অভিনয় করলেন বটে সিংজি। রতনলাল ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি ফাঁদ। ফলে রাজি হয়ে গেল কাবাবটা বানাতে এবং ফাঁসল। সেই কাবাব হাতে পেয়েই ছুটেছিলাম মিস্টার গশের কাছে। গশসাহেব, কারাবের স্বাদটা কী রকম হয়েছিল?’ ‘জঘন্য।’ মুখ বিকৃত করেন গশ্, ‘রতন একটা ইডিয়ট। রেঁধে কি নিজে টেস্ট করেনি? আশ্চর্য! তাহলেই বোঝা উচিত ছিল যে খাবারটা যা তা হয়েছে। এই গুণ নিয়ে উনি আবার শেফ হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। একে কুক্ থেকে বেয়ারা করে দেওয়া উচিত।’

‘আচ্ছা আপনি তারককে সন্দেহ করলেন কীভাবে?’ কৌতূহলী মার্কো জানতে চান।

পুলক জবাব দেয়, ‘কারণ ভরতের কাছে খোঁজ করে জেনেছিলাম যে রতনলাল দু’বার আপনাকে দেখতে আসে। কিন্তু সেই দু’বারই ভরত আপনার ঘরে ছিল। খাতাখানা টেবিলে থাকলেও ভরতের চোখ ফাঁকি দিয়ে সেটা সরানো খুব রিস্কি ব্যাপার। তখনই হঠাৎ মনে হল, খাতাটা আর কাউকে দিয়ে চুরি করায়নি তো রতন? কাকে দিয়ে। প্রথমেই সন্দেহ পড়ল তারকের ওপর। ওকে টাকা দিয়ে হাত করা অতি সহজ। তাছাড়া জ্বরের সময় আপনার মানিব্যাগ থেকে টাকা চুরি গিয়েছে জেনেও তারকের ওপরই সান্দেহ হয়। তাই অনুমানটা সত্যি কিনা বুঝতে আপনাকে দিয়ে নাটক করলাম মিস্টার গশ্। যেন খাতাটা খুঁজতে হাজির হলেন কুতুবে। কৌশলে রতনলালকে জানিয়ে এলেন খাতার রান্নাগুলোর রেসিপি যে কোডে লেখা তা জানত অপনার ভাগনে তারক। মিস্টার গশ, খবরটা শুনে রতনলালের মুখের ভাব কেমন হয়েছিল।

গশ্ বললেন, ‘আমি আড় চোখে লক্ষ করেছি। শুনেই রতনলালের মুখ কেমন কঠিন হরে গেল। আর সে রাতেই মার খেল তারক।’

‘রতনের পাঠানো গুণ্ডা তারককে ঠেঙিয়েছে জানলে কী করে?’ প্রশ্ন করে জয়।

পুলক জানাল, ‘কারণ আমার লোকেরা গত কয়েকদিন ধরে সমানে নজর রাখছে রতনলাল আর তারককে। দুজনের সমস্ত গতিবিধি আমার রিপোর্ট দিচ্ছে। ওরাই আমায় খবর দেয়।

আজ বিকেলে রতনলাল রাস্তায় বেরোয়। ওর বাড়ির কাছে পার্কে দুটো গণ্ডাদর্শন লোকের সঙ্গে কী সব কথা বলে। তারপর হেঁটে চলে যায়। তাদের মধ্যে একটা লোক মোটর সাইকেল চেপে বেরিয়ে যায়। অন্যজন পার্কেই ঘাপটি মেরে বসে থাকে। এই অবধি দেখে আমার স্পাই রতনের পিছু নেয়।

ওদিকে তারককে যে নজর রাখছিল সে রিপোর্ট করে, মোটর সাইকেলে আসা একটা অচেনা লোকের পেছনে চেপে তারক বেরিয়ে যায় এই রাত আটটা নাগাদ। মোটর সাইকেলে যে এসেছিল তার বর্ণনার সঙ্গে হবহু মিলে যায় পার্কের মোটর সাইক্লিস্টের বর্ণনা। রতনলাল যাদের সঙ্গে কথা বলেছে তাদেরই একজন। বোঝা যাচ্ছে, মোটর সাইকেলে চড়িয়ে পার্কে এনে লোক দুটো উত্তম-মধ্যম দেয় তারকাকে।

‘মানে ভুল খাতা দেওয়ার শাস্তি?’ জয় মুচকি হেসে বলে।

‘আন্দাজ করছি তাই। রতনলালের নির্দেশে। পরে জানা যাবে সব।’

মার্কো ভীষণ রেগে গরগর করে উঠলেন, ‘শয়তান তারককে আমি আর কখনও আমার বাড়িতে ঢুকতে দেব না। একটা পয়সাও আর সাহায্য করব না। অকৃতজ্ঞ স্কাউনডুল।’

পুলক বলল, ‘অসৎ সঙ্গ আর বদ নেশা, দুটোই মানুষের সর্বনাশ করে। নিজেকে না বদলাতে পারলে তারকের ভাগ্যে অনেক দুঃখ আছে আরও। যাকগে, তারকের যা হয় হবে, আপাতত রান্নার খাতাটা অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা দরকার।’

মার্কো চিন্তিত ভাবে বললেন, ‘হ্যাঁ তাই। রতনলাল ঘাবড়ে গিয়ে খাতাটা নষ্ট না করে ফেলে। হয়তো বুঝেচে, আমরা ষড়যন্ত্রটা আঁচ করেচি।’

‘সেইজন্যই তো পাঠালাম আপনাকে। খাতার রেসিপিগুলো যে কোড ল্যাঙ্গুয়েজে লেখা সে খবরটা ওকে শুনিয়ে দিতে।’

‘সেকি কোডে লেখা জানিয়ে দিয়েছ? কী কাণ্ড?’ আঁতকে ওঠে জয়।

‘আরে বুদ্ধ, কোডটা তো জানানো হয়নি। লেখাটা কোডে এটুকু শুধু বলা হয়েছে।’ আশ্বস্ত করে পুলক।

‘কেন?’ জয় দিশা পায় না।

‘কারণ তাহলে রতনলাল কোড উদ্ধারের চেষ্টা করবে। ফলে ক’দিন সময় হয়তো পাব হাতে। গতকালই আমার ইনফর্মার খবর দিয়েছে, রতনলাল খাতাটা জেরক্স করিয়ে ফেলেছে। এই ভয়ই করছিলাম। জেরক্স করিয়ে রেখে খাতাটাও না নষ্ট করে ফেলে প্রমাণ লোপের জন্যে। আমার লোক অনেক খুঁজে খুঁজে সন্ধান পেয়েছে কোথায় ও জেরক্স করিয়েছে। নিজের পাড়া থেকে অনেক দূরে একটা দোকানে।’

‘অ্যা জেরক্স করে ফেলেছে? মাই গড।’ মার্কো আতঙ্কিত।

‘হুঁ।’ জানাল পুলক, ‘জানি না ইতিমধ্যে খাতাটা নষ্ট করে ফেলেছে কিনা! মিস্টার গশ্ আপনি তো ওকে বলেছেন লাল কালিতে লেখা মাপগুলোর সাংকেতিক অর্থ আছে। জেরক্স কপিতে লাল নীল কালির তফাত ধরা পড়ে না। যদি খাতাটা এখনও থাকে, সংকেত উদ্ধার না করা অবধি রতনলাল সেটা নষ্ট করবে বলে মনে হয় না। তবু যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। প্ল্যান করে ফেলা যাক। কালই অ্যাকশনে নামব।’ তিনজনে গুজগুজ করল আধঘণ্টা মতো। তারপর পুলক ও জয় বিদায় নিল।

পাঁচ

সকাল আটটা নাগাদ। পুলক ও জয় হাজির হল কুতুব হোটেলে। তার। ম্যানেজারের খোঁজ করতে বিক্রম সিং এসে সাদরে অভ্যর্থনা করলেন তাদের, ‘আসুন স্যার। হ্যাঁ, সেদিনের কাবাবের দাম কিছুটা লেস করে দেব বলেছিলাম, সে টাকাটা নিয়ে যান। বিরিয়ানিটা তো ভালো লেগেছে?’

‘বিরিয়ানি ফাসক্লাস হয়েছিল।’ প্রশংসা করে পুলক।

‘আসুন আমার চেম্বারে, এক কাপ কফি খেয়ে খান।’ সিংজি আহ্বান জানান।

‘আবার কফি কেন?’ পুলক ইতস্তুত করে।

‘কেন খুব তাড়া? না হোয় গরিবের সাথ কুহু আড্ডা দিয়ে গেলেন কফি খেতে খেতে।’ বোঝা গেল যে বিক্রম সিং অতি দক্ষ ম্যানেজার। খদ্দেরকে ভবিষ্যতের জন্য তুষ্ট রাখতে ওস্তাদ।

কফি পান করতে করতে বিক্রম সিং তাঁর দেশ হরিয়ানার গল্প শুরু করলেন। চমৎকার রসিয়ে কথা বলেন মানুষটি।

মিনিট পনেরো বাদে হঠাৎ সিংজির কামরায় গটগটিয়ে ঢুকলেন মার্কো-ডা-গশ্। ‘হ্যাল্লো মার্কো:’ লাকিয়ে ওঠেন বিক্রম সিং, ‘বাঃ ফিট্‌ হয়ে গেছ?’

‘হুঁ। দু-এক দিনের মধ্যেই জয়েন করব। আচ্ছা রতনলাল এসেছে?

‘এসেছে।’

‘ওর সঙ্গে প্রাইভেটলি একটু কথা বলতে চাই।’

মার্কো আর সিংজির চোখে চোখে কী এক ইশারা খেলে যায়। বিক্রম সিং বললেন, ‘তো ইখানেই বাত চিত করতে পার। আমি রিসেপশন কাউন্টারে যাচ্ছি। পাঠিয়ে দিচ্ছি রতনলালকে।’

সিংজি উঠে পড়ে। পুলক আর জয়ও উঠে পড়ে। পুলক কিন্তু ঘর থেকে বেরিয়ে বেশি দূর যায় না। কয়েক পা গিয়ে থেমে দেওয়ালে টাঙানো একটা নোটিশ দেখতে থাকে এক মনে। জয়ও নোটিশটা পড়ার ভান করে। তাদের পাশ দিয়ে চলে যায় রতনলাল, ঢুকে যায় সিংজির কামরায়। পুলক ও জয় নিঃশব্দে গিয়ে দরজার কাছে আড়ালে দাঁড়িয়ে কান পাতে।

রতনলাল উৎফুল্ল ভঙ্গিতে মার্কোকে বলল, ‘বাঃ মিস্টার গশ্, আপনি সুস্থ হয়ে গিয়েছেন দেখছি। ডেকেছেন আমায়?’

দু’জনে মুখোমুখি চেয়ারে বসে টেবিলের দু পাশে। মার্কোর গম্ভীর ভাব দেখে রতনলাল নার্ভাস হয়ে ইতিউতি চায়। মার্কো কয়েক পলক স্থির দৃষ্টিতে রতনলালের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘রতন আমার খাতাখানা যে ফেরত দিতে হবে!’

‘কী খাতা?’ চমকে ওঠে রতনলাল।

‘বোকা সেজো না। কী খাতা তুমি ভালো ভাবেই জানো। আমার চুরি যাওয়া রান্নার খাতা। বাঁধানো। হলুদ মলাটের।’

‘সে খাতার আমি কি জানি? আপনি তো বললেন সেটা কোথায় হারিয়েছে, মনে করতে পারছেন না।’

‘সরি হারায়নি। আমার ঘর থেকে চুরি হয়েছে আমার অসুখের সময় এবং সেটি তোমার কাছে আছে।’ ঠাণ্ডা দৃঢ় গলায় জানালেন মার্কো।

‘কী আমায় চোর বলছেন? আমি কিন্তু ম্যানেজারকে কমপ্লেন করব।’ উত্তেজিত কণ্ঠে বলতে বলতে রতনলাল চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে দরজার দিকে ঘুরে দেখে যে দরজ আটকে দাঁড়িয়ে রয়েছে পুলক, আর তার পেছনে জয়।

‘আপনারা?’  ভুরু কুঁচকে দেখতে দেখতে রতনলাল হলে, ‘ও আপনারা সেই কাবাব আর বিরিয়ানি অর্ডার দিয়েছিলেন। এখানে কী করেছেন?’

পুলক এক পা ঘরে ঢুকে দরজা আগলে রেখেই বলল—‘আমি অনুসন্ধানী পুলক রায়। বলতে পারেন একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। মিস্টার গশ্ আমাকে অ্যাপয়েন্ট করেছেন এঁর হারানো রান্নার খাতাটা উদ্ধার করে দিতে। এই আমার কার্ড।’ পুলক নিজের নাম ঠিকানা ছাপা কার্ড এগিয়ে ধরে।

কেমন যেন হকচকিয়ে গিয়ে রতনলাল পুলকের কার্ডটা নিয়ে একবার চোখ বোলায়। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে কয়েকবার তারপরেই নিজেকে সামলে নিয়ে ব্যঙ্গের সুরে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে, ‘তা মিস্টার ডিটেকটিভ খাতাটার হদিশ পেয়েছেন?’

পুলক বলল, ‘নাঃ হাতে পাইনি এখনও, তবে জানতে পেরেছি কোথায় আছে।’

‘কোথায়?’

‘এই যে মিস্টার গশ্ যা বললেন, আপনার হেফাজতে।’

‘দেখুন মশাই টিকটিকিই হোন আর গিরগিটিই হোন, প্রমাণ ছাড়া কাউকে চোর বললে কিন্তু তার বিরুদ্ধে কেস করা যায়। সেটা জানেন কি? পথ ছাড়ুন। যত পাগলের প্রলাপ।’ রতনলাল গরগর করে রাগে।

‘সরি। পথ ছাড়ব না,’ পুলক দৃঢ়কণ্ঠে জানায়, ‘হ্যাঁ প্রমাণ আছে বলেই অভিযোগ করছি।’

‘কী প্রমাণ?’ চেঁচিয়ে ওঠে রতনলাল। তার হাবভাব তখন ফাঁদে পড়া হিংস্র জন্তুর মতো। পারলে পুলকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে জোর করে বেরিয়ে যায়। কিন্তু পুলক যথেষ্ট লম্বা ও শক্তিশালী। সেই তুলনায় রতনলাল নেহাতই ছোটখাটো দুর্বল। এর ওপর পুলকের সঙ্গে রয়েছে জয়। তাই নিজেকে কোনো মতে সামলে নেয় রতনলাল।

‘এক নম্বর প্রমাণ,’ বলতে বলতে পুলক তার শার্টের বুক পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে এবং কাগজটা খোলে। ফুলস্কেপ সাদা কাগজের একটা পাতা, তাতে কালো কালি দিয়ে হাতে লেখা ছোট ছোট অক্ষরে। লেখা কাগজটা রতনলালের নাগালের বাইরে ভুলে দেখিয়ে পুলক নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, ‘চিনতে পারেন, কী এটা?’

কাগজটা দেখেই রতনলালের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তবু যেন জোর করে বলে ওঠে, ‘কী এটা? জানি না।’

‘জানেন। জানেন বইকি। নিজের হাতের লেখা চিনতে পারছেন না? এটা বোগদাদি শাহি কাবাব বানানোর প্রণালী লেখা। মিস্টার গশের খাতা থেকে নিজের হাতে টুকে এনেছিলেন। যেটা দেখে রান্না করে আমার অর্ডার সাপ্লাই করেছেন।’ পুলক বেশ রসিয়ে বলে।

‘কী যা তা বকছেন?’ খেঁকিয়ে ওঠে রতনলাল।

‘কী বকছি তা আপনি ভালোই জানেন। শুনেছি রান্নার পর অনেক খুঁজেছিলেন লেখাটা। দুঃখের বিষয় পাননি। হয়তো ভেবেছিলেন, বাজে কাগজ ভেবে কেউ ফেলে দিয়েছে। কিন্তু ওটি যে এমন মারাত্মক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে তা কল্পনাও করেননি। তাই না?’

রতনলাল কোনো জবাব না দিয়ে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে চোয়ে থাকে।

পুলক আবার বলে, ‘লেখাটা পাবেন কী করে? ওটা যে চুরি হয়েছিল। মার্কোর খাতা চুরির মতোই; আর চুরিটা করে আমার এজেন্ট ঝন্টু।’

“ঝন্টু!” নিচু গলায় চাপা রাগে উচ্চারণ করে রতনলাল।

“আজ্ঞে হ্যাঁ’, পুলক মাথা হেলায়, ‘কুতুবে সদ্য অ্যাপয়েন্টেড রান্নার জোগানদার।’

‘দু নম্বর প্রমাণ’ পুলক ঘোষণা করে, ‘মিস্টার গশ মানে মার্কোর খাতার লেখা আপনি জেরক্স করিয়েছেন যেখান থেকে সেই জেরক্স সেন্টারের মালিকের সাক্ষ্য। আপনার চেহারা, খাতাখানার চেহারা এবং খাতার বিষয়বস্তু ওই ভেরন্স সেন্টারের মালিক কাসেম আলির স্পষ্ট মনে আছে। এমনকী ক’ পৃষ্ঠা জেরক্স করিয়েছেন দু দফায় তাও ভোলেননি আলি সাহেব। সব জানিয়েছেন।’

‘যত্তসব বানালো গল্পো।’ রতনলাল নস্যাৎ করে দেয় অভিযোগ।

‘তিন নম্বর প্রমাণ আরও মারাত্মক।’ পুলক বিন্দুমাত্র না দমে বলে চলে, ‘তারক স্বীকার করেছে যে আপনার জন্যেই সে খাতা চুরি করেছিল। আর আপনার লোকই তাকে মেরেছে।’

‘অ্যা তারক!’ থমথমে হয়ে যায় রতনলালের মুখ। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘কে তারক? আমি চিনি না কাউকে ওই নামে। অমায় যেতে দিন। পথ ছাড়ুন।’

‘সরি। মার্কোর খাতা অক্ষত দেহে ফেরত না পাওয়া অবধি আপনাকে এখানে অপেক্ষা করতে হবে।’

‘আমায় জোর করে আটকাচ্ছেন? আমি পুলিশে কমপ্লেন করব।’ গজগজ করে ওঠে রতনলাল—‘মিস্টার গশ্ আপনার ডিটেকটিভকে সরান, নইলে বিপদে পড়বেন।’

মার্কো নির্বিকার ভাবে বসে থাকেন। পুলক রতনলালের হুঁশিয়ারিতে কোনো পাত্তা না দিয়ে আবার বলে, ‘চট করে একটা চিঠি লিখে দিন আপনার স্ত্রীকে। পত্রবাহকের হাতে মার্কোর খাতাটা দিয়ে দিতে লিখুন। এখান থেকে কোন করে স্ত্রীকে বলে দিন চিঠি নিয়ে লোক যাচ্ছে। ঝন্টুই যাবে আপনার চিঠি নিয়ে। খাতা এখানে পৌঁছলে তবে আপনার মুক্তি।’

‘আমাকে যেতে দিন। আমি ম্যানেজারের কাছে কমপ্লেন করব।’ গর্জে ওঠে রতনলাল।

পুলক সবিনয়ে নিবেদন করল, ‘কোনো লাভ নেই মশাই। ম্যানেজার সিংজি সবই জানেন। তাঁর মদত না থাকলে কি আর তাঁর হোটেলে আপনাকে আটকাতে পারি?’

‘আমি এক্ষুনি পুলিশে কমপ্লেন করব। ষড়যন্ত্র করে আমার হোটেলে আটকে রাখার জনে। ছেড়ে দিন আমায়।’ রতনলালের তেজ কমার লক্ষণ নেই।

‘তা করতে পারেন বইকি,’ পুলক ব্যঙ্গের সুরে বলে, তবে ফর ইওর ইনফরমেশন, পুলিশে কমপ্লেন আনরা আগেই করে রেখেছি। আপনার বিরুদ্ধে মার্কোর খাতা চুরির কারণে। প্রমাণ-টমান সমেত। আপনার বাড়ি থেকে খাতাটা উদ্ধারের জন্য সার্চ ওয়ারেন্টও রেডি করে রেখেছে পুলিশ। আমরা সিগনাল দিলেই সার্চ হবে।’

রতনলাল তীব্র দৃষ্টিতে তাকায় পুলক আর মার্কোর দিকে।

‘কি বিশ্বাস হচ্ছে না?’ পুলকের কণ্ঠে বিদ্রুপ; ‘অলরাইট্। আপনার বাড়ির এলাকার আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার ও.সি.কে কোন করছি। তার সঙ্গে কথা বলে সত্যি মিথ্যা যাচাই করে নিন।’

পুলক সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোনে থানার সঙ্গে যোগাযোগ করল—‘কে সরকার? আমি পুলক। তুমি ভাই রতনলালবাবুকে মার্কো-ডা-গশের চুরি যাওয়া রান্নার খাতাটার ব্যাপারে একটু সমঝিয়ে দাও। আমার কথায় তো উনি পাত্তাই দিচ্ছেন না।’… পুলক রিসিভারটা রতনপালের হাতে দিতে দিতে বলে, ‘এক সময় পুলিশে চাকরি করেছি তো, তাই অনেক পুলিশ অফিসারের সঙ্গে আমার দোস্তি আছে।’

আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার দারোগা রতনলালকে কী বললেন ফোনে ঠিক বোঝা গেল না, কিন্তু দেখা গেল যে শুনতে শুনতে রতনলাল একেবারে চুপসে গেল। কাঁপা হাতে সে রিসিভার নামিয়ে রাখে।

খানিকক্ষণ মাথা নামিয়ে চুপচাপ থেকে রতনলাল ধীরে ধীরে বলল, ‘আমার স্ত্রী জানে না খাতাটা কোথায় আছে।’

পুলক বলল, ‘তাহলে চিঠিতে ডিরেকশন দিয়ে দিন, খুঁজে দেবেন।’

রতনলাল অনুনয়ের সুরে বলে, ‘আমায় ঝন্টুর সঙ্গে যেতে দিন বাড়িতে। সঙ্গে সঙ্গে খাতা দিয়ে দেব ওর হাতে! নইলে আমার স্ত্রী খুঁজে পাবে না। গাদা বই-খাতার পিছনে ওটা লুকনো আছে আলমারিতে।’

‘যাক বাবা খাতাটা নষ্ট করেনি।’ পুলকের কানের কাছে ফিসফিস করে জয়।

পুলক মাথা ঝাঁকিয়ে খুশিটা জানান দেয়, তারপর রতনলালকে বলে, ‘সরি, আপনাকে কোনো মতেই এখন খাতার কাছে যেতে দেওয়া যাবে না। কারণ সামান্য সুযোগ পেলেই হয়তো আপনি খাতাটা নষ্ট করে ফেলবেন প্রমাণ লোপ করতে।’ তারপরেই পুলক কড়া সুরে ধমকায়, ‘দেখুন প্রচুর বাজে সময় খরচ করেছেন। আর পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি। চিঠি না লিখলে বাধ্য হব পুলিশকে সার্চ করার অনুরোধ করতে। তবে ভালোয় ভালোয় খাতা পেয়ে গেলে মিস্টার গশের ইচ্ছে নয় আপনার বিরুদ্ধে পুলিশ কেস করতে। কী চান চটপট ঠিক করুন।’

এবার হাল ছেড়ে দেয়। বলে ওঠে, ‘দিন কাগজ কলম।’

রতনলাল মিনিট পনেরো বাদে রতনলালের চিঠি নিয়ে হুস করে মোটর বাইকে চেপে বেরিয়ে যায় ঝন্টু। পুলক ফের প্রশ্ন করে রতনলালকে, ‘তারককে মার খাওয়ালেন কেন? ভুল দেওয়ার অপরাধে?’

খাতা ‘হ্যাঁ তাই।’ ফুঁসে ওঠে রতনলাল, ‘সাংকেতিক ভাষায় লেখা হাজার টাকা নগদ আগাম নিয়ে ওই বোগাস খাতাটা গছালো। আডভান্সের টাকাটা ফেরত চেয়েছিলাম বলে আবার গরম দেখায়। আবার চুক্তির বাকি টাকাটা ডিমান্ড করে। ওর এত বড় সাহস! ওকে যে খতম করে দিইনি ওর বাপের ভাগ্যি। জোচ্চোর কাঁহাকা।’

অগ্নিশর্মা রতনলালের পিছনে মার্কোর ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফোটে। আর রতনলালের মুখোমুখি পুলক ও জয় অস্বাভাবিক গাম্ভীর্য অবলম্বনে কোনো মতে হাসি চাপে।

আধঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসে ঝন্টু। বাঁধানো হলুদ মলাটের মোটা একখানা খাতা সে তুলে দেয় পুলকের হাতে। সঙ্গে সঙ্গে তার বোকা বোকা মুখের একখানা হাসি উপহার দেয় রতনলালকে। প্রতিদানে রতনলাল তাকে বিষাক্ত দৃষ্টি হানে।

পুলক মার্কোকে খাতাটা দিয়ে বলল, ‘দেখুন ঠিক খাতা তো?’

মার্কো পরম যত্নে খাতাটার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে মাথা নেড়ে জানায়— ‘হ্যাঁ।’

‘কি লস্ট কুকিং বুক মিলা?’ দরজার কাছে শোনা গেল বিক্রম সিং-এর গলা। তিনি ঘরে ঢোকেন।

রতলাল কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার দিকে একবার আড় চোখে দেখে নিয়ে সিংজি বললেন, ‘মার্কো তুমি কি রতনের এগেনস্টে পুলিশ কেস করবে?’

‘না।’ জবাব দেয় মার্কো, ‘তাহলে ওর কেরিয়ার একদম বরবাদ হয়ে যাবে। খাতা না দিলে অবশ্য তাই করতাম।’

‘আমি কিন্তু এই বেইমানকে আর হোটেলে রাখতে পারব না। সিংজি কঠোর স্বরে জানালেন— ‘রতন তোমায় এক হপ্তা টাইম দিচ্ছি। অন্য কোথাও নোকরি খুঁজে নাও। ফিউচারে সমঝে চললে এই খাতা চুরির কথা কাউকে বলব না। এটা গ্যারান্টি দিচ্ছি।’ রতনলাল মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

সেদিন সন্ধ্যায়। মার্কো-ডা-গশ্ অর্থাৎ কর্মদাস ঘোষ মশায়ের ঘরে জমায়েত হয়েছে পুলক আর জয়। রান্নার খাতা চুরির কেসটা নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। তারই ফাঁকে হঠাৎ মার্কো একটা ব্যাঙ্ক চেক ড্রয়ার থেকে বের করে পুলকের হাতে দিয়ে সংকোচে জানালেন— ‘আমার যে উপকার করলেন তার জন্য এই সামান্য ঋণশোধ।’

জয় আড় নয়নে দেখল চেকটা। টাকার অঙ্কটা রীতিমতো মোটা। সে ছদ্ম অভিমান ভরে বলে ওঠে,  ‘ব্যস, টাকায় ফিজ দিলেই সব ঋণ শোধ হয়ে গেল বুঝি?’ মার্কো থতমত খেয়ে বললেন, ‘সরি। আর কিছু যদি? বলুন প্লিজ।’

জয় মিচকে হেসে বলল, ‘সেই বিখ্যাত বোগদাদি কাবাবটার স্বাদ কিন্তু আজও পাইনি।’ হো হো করে হেসে মার্কো বললেন, ‘অফকোর্স পাবেন বইকি। নিশ্চয়ই খাওয়াব। এ তো আমার পরম সৌভাগ্য। কবে খাবেন? কতজন খাবেন? নেমন্তন্ন করে রাখছি। হুকুম করুন স্যার। আমি রেডি।’

1 Comment

রহস্য সমগ্র, অজেয় রায় এর বই টি প্লিজ দেবেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *